সপ্তম অধ্যায়
ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিসমূহ
১. সার্বভৌমত্ব কার?
২. রাষ্ট্রের কর্মসীমা (অধিক্ষেত্র)
৩. রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের কর্মসীমা বা অধিক্ষেত্র এবং এগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক
৪. রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য
৫. সরকার কিভাবে গঠিত হবে?
৬. শাসকের গুণাবলী ও যোগ্যতা
৭. নাগরিকত্ব ও তার ভিত্তিসমূহ
৮. নাগরিকদের অধিকার
৯. নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের অধিকার
১৯৫২ সালে ২৪ নভেম্বর করাচী বার এসোসিয়েশনের সভাপতি মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র) কে ইসলামী সংবিধান বিষয়ে একটি আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের জন্য দা্ওয়াত দিয়েছিলেন। এই আলোচনা সভার উদ্দেশ্য ছিলো ইসলামী সংবিধান সম্পর্কে দেশের শিক্ষিত মহল, বিশেষত আইনজীবীদের মনে যে সংশয় ও জটিলতা রয়েছে তা দূর করার চেষ্টা করা। এই সময়টি দেশের ইতিহাসে বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এবং গোটা দেশে ইসলামী সংবিধান প্রণয়নের জোর দাবি চলছিলো। ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে নাজিমুদ্দীন রিপোর্ট প্রকাশ এক মাসের জন্য মুলতবি করা হয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতদের মনে অনেক প্রশ্ন উত্থিত হয়েছিলো যার মদুত্তর প্রদান প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলো। মাওলানা মওদুদী উক্ত আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করে কয়েক ঘন্টার আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে এই প্রয়োজন পূরণ করেন। মাওলানা মওদূদীর একটি ভাষণের সাধ্যমে আলোচনা বভার উদ্বোধন হয় এবং এই ভাষণে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো সুস্পষ্টভাবে তোলে ধরেন। বক্তৃতা শেষে কয়েক ঘন্টা ধরে প্রশ্নেত্তর চলতে থাকে। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে মাওলানার সেই ভাষণের বাংলা তরজমা পেশ করা হচ্ছে। -সংকলক
ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিসমূহ
আমি সর্ব প্রথম সংবিধান ও ইসলামী রাষ্ট্রের কয়েকটি বড় বড় ও মৌলিক বিষয়ের উল্লেখ করে সংক্ষেপে বলবো যে, সে সম্পর্কে ইসলামের আসল উৃৎসে কি মুলনীতিগত নির্দেশ পাওয়া যায়? ইসলাম সাংবিধানিক ব্যাপারে কোনো পথনির্দেশ দান করে কিনা, করলে তা নিছক সুপারিশের পর্যায়ভুক্ত নাকি মসিলমানদের পক্ষে অপরিহার্য ও অবশ্য পালনীয় পথ নির্দেশ, এই সবই আমার পরবর্তী আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে আমি বিস্তারিত আলোচনার দিকে না গিয়ে মোটামুটিভাবে সংবিধানের ৯টি মৌলিক ধারা সম্পর্কে আলোচনা করবো।
১.প্রথম প্রশ্ন হলো, সার্বভৌমত্ব কার? কোনো বাদশাহর? নাকি কোনো শ্নেণীর অথবা গোটা জাতির? নাকি আল্লাহ্ তায়ালার?
২. দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, রাষ্ট্রের কর্মসীমা [Jurisdiction] কি? রাষ্ট্র কতোদূর পর্যন্ত আনুগত্য পেতে পারে? এবং কোন্ সীমায় পৌঁছে তার আনুগত্য পাওয়ার অধিকার খতম হয়ে যায়?
৩. সংবিধান প্রসংগে তৃতীয় মৌলিক প্রশ্ন রাষ্ট্রর বিভিন্ন বিভাগের কর্মসীমা সম্পর্কে। অর্থাৎ শাসনবিভাগ [Executive] বিচার বিভাগ [Judiciart] এবং আইনপরিষদ [Legislature] প্রভৃতির আলাদা আলাদা কর্মসীমা [Jurisdiction] কি হবে? এদের প্রত্যেকটি বিভাগ কি কর্তব্য এবং কি দায়িত্ব পালন করবে? কোন্ সীমার মধ্যে অবস্থান করবে এবং তারপর এদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের ধরন কি হবে?
৪. চতুর্থ গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠিত উদ্দেশ্য কি? রাষ্ট্র কোন্ উদ্দেশ্যে কাজ করবে এবং এর শাসনপ্রণালীর মৌলিক নীতি কি হবে?
৫. পঞ্চম প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সরকার কিভাবে গঠন করা হবে?
৬. ষষ্ঠ প্রশ্ন হলো শাসকদের গুণাবলী ও যোগ্যতা [Qualifications] কি হবে? কোন্ ধরনের লোক প্রশাসন চালাবার যোগ্য বিবেচিত হবে?
৭. সপ্তম প্রশ্ন হলো, সংবিধানে নাগরিকত্বের ভিত্তি কি হবে? কিভাবে এক ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক পরিগণিত হবে এবং কিভাবে নয়?
৮. অষ্টম প্রশ্ন হলো, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার কি?
৯. নবম প্রশ্ন, নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের কি কি অধিকার আছে?
যে কোনো দেশের সংবিধানে এই প্রশ্নগুলো সম্পূর্ণরূপে মৌলিক। ইসলাম এই প্রশ্নগুলোর কি জবাব দেয় তাই আমরা লক্ষ্য করে দেখবো।
১. সার্বভৌমত্ব কার?
সর্বপ্রথম আমরা দেখবো ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান সার্বভৌমত্বের [Sovereignty] স্থান কাকে দান করে?
এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও অকাট্য জবাব কুরআন মজীদ থেকেই আমরা জানতে পারি। তাহলো, সার্বভৌমত্ব যে কোনো অর্থে একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার জন্যই সংরক্ষিত। কারণ বস্তুতপক্ষে তিনিই প্রকৃত শাসক। অত্এব এটা তাঁর অধিকার যে, কেবল তাঁকেই সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী স্বীকার করতে হবে। এই বিষয়টি কেউ আরো গভীর ও ব্যাপকভাবে হৃদয়ংগম করতে চাইলে আমি তাকে পরামর্শ দেবো, প্রথমে তিনি যেনো সার্বভৌমত্বের অর্থ এবং ধারণাকে খুব ভালো ও পরিষ্কারভাবে বুঝে নেন।
সার্বভৌমত্বের অর্থ
রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই শব্দটি উচ্চতর ক্ষমতা এবং নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোনো ব্যক্তির বা ব্যক্তিসমষ্টির কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌমত্বের অধিকারী হওয়ার অর্থ এই যে, তার নির্দেশই আইন। এই আইন রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপর জারি করার সর্বসয় কর্তৃত্ব তারই। নাগরিকরা তার শর্তহীন আনুগত্য করতে বাধ্য। তা ইচ্ছায় ওও সাগ্রহে হোক কিংবা বাধ্য হয়ে। তার নিজের ইচ্ছা ব্যতীত বাইরের কোনো শক্তি তার শাসন ক্ষমতাকে বিন্দুমাত্র সীমাবদ্ধ ও সংকুচিত করতে পারেনা। তার বিপরীতে নাগরিকদের কোনো অধিকার নেই। যার যা কিছু অধিকার আছে তা সবই একমাত্র তাঁরই দান। কাজেই যে অধিকার তিনি হরণ করবেন তা আপন আপনিই লুপ্ত হয়ে যায়। আইনদাতা [Low Giver] যখন কারো অধিকার স্বীকার করেন তখনি তা আইনহত অধিকার বলে স্বীকৃত হয়। কাজেই মতো কোনো অধিকার বাকী থাকবেনা। সার্বভৌমত্বের অধিকারীর ইচ্ছা্য়ই আইন অস্তিত্ব লাভ করে এবং তা নাগরিকদেরকে আনুগত্যের রজ্জুতে বেঁধে নেয়। কিন্তু স্বয়ং সার্বভৌমত্বের অধিকারীকে বাধ্য করার মতো কোনো আইন কোথাও নাই। সার্বভৌমত্বের অধীকারী তার নিজসত্তয় নিরংকুশ ও সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক। তার বিধান সম্পর্কে বালো বা মন্দ, বিশুদ্ধ বা ভ্রন্ত- এই ধরনের কোনো প্রশ্নই উত্থাপিত হতে পারেনা। তিনি যা কিছুই করবেন তাই ভালো ও কল্যাণকর। তার অধীন কোনো নেই। তিনি যা কিছু করবেন তাই সঠিক, তার অধীনস্থ কেই এটাকে ‘ভ্রন্ত’ আখ্যয়িত করতে পারেনা। সার্বভৌমত্বের অধিকারীকে “মহান পবিত্র, দোষত্রুটিমুক্ত এবং সকল প্রকার ভুলের ঊর্ধে” মেনে নিতে হবে, চাই তিনি এইসব গুণের অধিকারী হোন বা না হোন। এই হলো আইনগত সার্বভৌমত্বের [Legal sovereignty] ধারণা। যা একজন আইনবিদ [ফকীগ বা [Jurist] পেশ করেন এবং যার কম কোনো জিনিসের নাম “সার্বভৌমত্ব” নয়। কিন্তু এই সার্বভৌমত্ব একেবারে একটি কল্পিত বিষয় হিসেবে থেকে যায় যতক্ষণ না তার পশ্চাতে কোনো বাস্তব সার্বভৌমত্ব কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় “রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব” [Political sovereignty] বিদ্যামান থাকে। অর্থাৎ কার্যত সেই কর্তৃত্বের মালিক তিনি, যিনি এই আইনগত সার্বভৌমত্বকে প্রয়োগ করবেন।
প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্ব কার?
এখন প্রথমেই এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, উক্তরূপ কোনো সার্বভৌমত্ব বাস্তবিক পক্ষে মানবীয় পরিমন্ডলে বিদ্যামান আছে কি? যদি থেকে থাকে তবে তা কোথায়? এই সার্বভৌমত্বের মালিক কাকে বলা যেতে পারে?
কোনো রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাস্তবিকই কোনো বাদশাহ্ কি এরূপ সার্বভৌমত্বের মালিক হয়েছে বা কখনো পাওয়া গিয়েছে বা পাওয়া যেতে পারে? নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী যে কোনো বাদশাহ্র বা শাসন কর্তার কথাই চিন্তা করুন। তার ক্ষমতা ও এখতিয়ারের মূল্যায়ন করলে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন যে, কতো দিক দিয়েই না সে বাঁধাগ্রস্ত এবং কতোভাবেই না অসংখ্য বহিঃশক্তি তার ইচ্ছা ও মর্জির বিরুদ্ধে তাকে সীমাবদ্ধ করে রাখছে, তাকে অক্ষম করে দিচ্ছে।
তারপর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনোও স্থানে অংগুলি নির্দেশ করে তথায় “বাস্তব সার্বভৌমত্ব” আছে বলে দাবী করা যায় কি? যাকেই এই সার্বভৌমত্বের মালিক মনে করা হবে, পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, তার বাহ্যিক নিরংকুশ কর্তৃত্বের অন্তরালে প্রচ্ছন্নভাবে আরো কতকগুলো শক্তি বিদ্যমান আছে যাদের হাতে তার কর্তৃত্বের চাবিকাঠি নিহিত।
ঠিক এই কারণেই রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পন্ডিতগণ যখন সার্বভৌমত্বের সুম্পষ্ট ধারণা নিয়ে মানবসমাজে তার “ প্রকৃত ধারকের” সন্ধান করেন, তখন তারা চরমভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েন। সার্বভৌমত্বের যোগ্য কোনো ক্ষমতাধর সত্ত্বা খুঁজে পাওয়া যায়না। কারণ মানবতার পরিসীমায় বরং সত্য কথা এই যে, সমগ্র সৃষ্টি জগতের কোথাও সার্বভৌমত্বের প্রকৃত ধারক মোটেই বিদ্যমান নেই। তাই কুরআন মজীদ এই সত্যকে বার বার তুলে ধরেছে যে, বাস্তবিকপক্ষে সার্বভৌমত্বের একমাত্র মলিক আল্লাহ্ তিনি নিরংকুশ ক্ষমতার মালিক [*****] ১. {“যা কিছু করতে চান তা সম্পূর্ণরূপ করতে পারেন।” [সূরা হূদঃ ১০৭]} তিনি কারো নিকট দায়ী নন। কারো কম্মুখে তাকে জবাবদিহি করতে হয়না। [*****] ২. {“তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদকারী কেউ নেই। [ সূরা আম্বিয়াঃ ২৩]} তিনি সর্বময় ক্ষমতা, এখতিয়ার ও কর্তৃত্বের অধিপতি [****] ৩. {সমস্ত কিছুর কর্তৃত্ব তাঁর হাতে। [সূরা মুমিনুনঃ ৮৮]} তিনি এমন এক সত্ত্বা, যার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে সীমাবদ্ধ করতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই [*****] ৪. {“তিনি আশ্রয় দান করেন এবং তাঁর বিপরীতে কেউ আশ্রয় দিতে পারেনা।” [সূরা মুমিনুনঃ ৮৮]} তার সত্ত্বা সকল প্রকার দোষত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। [***********] ৫. {“তিনি আশ্রয় দান করেন এবং পবিত্র সত্ত্বা ও নিরাপত্তা বিধায়ক।” [সূরা হাশরঃ২৩]}
সার্বভৌমত্ব কার অধিকার?
দ্বিতীয় প্রশ্ন এই উত্থাপিত হয় যে, প্রকৃত ব্যাপার যাই হোক আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে যদি এই সার্বভৌমত্বের অধিকার প্রদান করাও হয় তবে বাস্তাবেও কি তার হুকুম ‘আইন’ বলে বিবেচিত হবে? তার উপর কারো কোনো অধিকার থাকবেনা? তার শর্তহীন আনুগত্য করতে হবে। এমনকি তার নির্দেশ সম্পর্কে ভালো মন্দ, ভুল ও নির্ভুল হওয়ার প্রশ্ন আদৌ উত্থাপন করা যাবেনা?
আল্লাহ্কে ছাড়া এই অধিকার চাই কোনো ব্যক্তিকে, কোনো প্রতিষ্ঠানকে, কিংবা দেশবাসীর সংখ্যাগুরু দলকেই দেয়া হোক, সেই সম্পর্কে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করা যাবে যে, শেষ পর্যন্ত কিসের ভিত্তিতে সে এই অধিকার লাভ করলো? কোন্ সনদের ভিত্তিতে সে জনগণের উপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব করার অধিকার লাভ করলো? এই প্রশ্নের উত্তরে খুব বেশী বললে শুধু এদোটকুই বলা যেতে পারে যে, জনগণের সমর্থনেই তার এই কর্তৃত্বের সনদ। কিন্তু আপনি কি একথা মেনে নিতে প্রস্তুত যে, কোনো ব্যাক্তি যদি নিজেকে স্বেচ্ছায় অন্য ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করে তবে বিক্রেতার উপর ক্রেতার সংগত মালিকানা অধিকার সত্যিই কি স্থাপিত হবে? এরূপ ইচ্ছাকৃত আত্মবিক্রয় যদি ক্রেতাকে সংগত মালিকানা না দেয়, তাহলে জনগণের নিছক ইচ্ছা ও সম্মতি প্রকাশ কারো সার্বভৌমত্ববে কিরূপে সংগত প্রমাণ করতে পারে? কুরআন মজীদ এই গ্রন্থির জট এভাবে খুলে দিয়েছে যে, আল্লাহ্র সৃষ্টির উপর কোনো সৃষ্টির প্রভুত্ব কায়েমে করার এবং হুকুম চালাবার কোনো অধিকার নেই। এই অধিকার একমাত্র আল্লাহ্র এবং তার এই অধিকারের ভিত্তি এই যে, তিনিই নিখিল সৃষ্টির স্রষ্টা। “সাবধান! সৃষ্টি তাঁরই, এর উপর প্রভুত্ব চালাবার, একে ‘শাসন’ করার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।” [সূরা আরাফঃ ৫৪] এটা এমন যুক্তিপূর্ণ কথা যাকে অন্তত জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধিসম্মত লোকেরা যারা আল্লাহ্কে সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করে, কিছুতেই প্রত্যাখ্যান করতে পারেনা।
সার্বভৌমত্ব কার হওয়া উচিত?
তৃতীয় প্রশ্ন এই যে, হক ও বাতিলের কথা না তূলেও সার্বভৌমত্বের এই অধিকার যদি কোনো মানবশক্তিকে দেয়া হয়, তাবে তাতে মানুষের কি প্রকৃত কল্যাণ হতে পারে? মানুষ- সে ব্যক্তি হোক, শ্রেণী হোক কিংবা কোনো জাতি বা সমষ্টিই হোক সার্বভৌমত্বের এতো বিরাট ক্ষমতা সামলানোই তার পক্ষে অসম্ভব। জনগণের উপর হুকুম চালাবার সীমাহীন অধিকার তার থাকবে, তাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অন্য কারো থাকবেনা এবং তার সকল সিদ্ধান্তই নির্ভুল মনে করে শিরধার্য করে নেয়া হবে, এরূপ অধিকার ও কর্তৃত্ব যদি কোনো মানবীয় শক্তি লাভ করতে পারে, তবে সেখানে যুলুম, নিপীড়ন ও নির্যাতন হওয়া একেবারে অনিবার্য ব্যাপার। তখন সমাজের মধ্যেও যুলুম হবে, ‘সমাজের বাইরে অন্যান্য পতিবেশী সমাজের উপরও যুলুম হবে। এরূপ ব্যবস্থার মূল প্রকৃতিতেই বিপর্যয়ের বীজ নিহিত রয়েছে। মানুষ যখনই জীবনের এই পথ অবলম্বন করেছে, তখনি ভাঙ্গন, বিপর্যয় ও অশান্তি সর্বগ্রাসী হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ যার বাস্তবিকপক্ষে সার্বভৌমত্ব নেই এবং যাকে সার্বভৌমত্বের অধিকারও প্রদান করা হয়নি, তাকেই যদি কৃত্রিমভাবে সারভৌমত্বের অধিকার ও কর্তৃত্ব দান করা হয়, তবে সে কিছুতেই এই পদের যাবতীয় ক্ষমতা এখতিয়ার সঠিক পন্থায় ব্যবহার করতে সক্ষম হবেনা। কুরআন মজীদ এই কথাই নিন্মোক্ত ভাষায় ঘোষণা করেছেঃ
“যারা আল্লাহ্র দেয়া বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করেনা, তারা যালিম।” [সূরা মায়েদাঃ ৪৫]
আল্লাহ্র আইনগত সার্বভৌমত্ব
এসব কারণে ইসলাম চূড়ান্তভাবে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে যে, আইনগত সার্বভৌমত্ব তাঁরই স্বীকার করতে হবে যার বাস্তব সার্বভৌমত্ব স্থাপিত হয়েছে নিখিল বিশ্বের উপর এবং গোটা মানবজাতির উপরও যার সার্বভৌমত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। একথাটি কুরআন মজীদে বার বার বলা হয়েছে এবং তা এতো বলিষ্ঠভাবে ব্যক্ত হয়েছে যে, কোনো কথা বলার জন্য তা অপেক্ষা জোরালো ভাষা আর হতে পারেনা। উদাহরণস্বরূপ দেখুন কুরআন একস্থানে বলেছেঃ
“হুকুম দিবার ও প্রভুত্ব ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার আল্লাহ্র ছাড়া আর কারো নেই। তিনি আদেশ করেছেন, একমাত্র তাঁরই দাসত্ব ও আনুগত্য করো, এটাই সঠিকপন্থা।” [সূরা ইউসুফঃ ৪০]
অনত্র বলেছেনঃ
একমাত্র সেই বিধানই অনুসরণ করো যা তোমাদের জন্য তোমাদের ‘প্রভুর’ নিকট থেকে নাযিল করা হয়েছে এবং তাকে ত্যাগ করে অন্য পৃষ্ঠপোষকদের অনুসরণ করোনা। সূরা আরাফঃ ৩]
তৃতীয় একস্থান আল্লাহ্র এই আইনগত সর্বভৌমত্ব অমান্য করাকে পরিষ্কার কুফরী বলে ঘোষণা করা হয়েছেঃ
“আল্লাহ্র নাযিলকৃত বিধান অনুসারে যারা ফায়সালা করেনা তারা কাফির।” [সূরা মায়েদাঃ ৪৪]
এই আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, আল্লাহ্ তায়ালার আইনগত সার্বভৌমত্ব স্বীকার করার নাম ঈমান ও ইসলাম এবং তা অস্বীকার কারার নামই নিরেট কুফর।
রসূল (স) এর পদমর্যাদা
দুনিয়াতে আল্লাহ্র এই আইনগত সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধি হচ্ছেন আল্লাহ্ প্রেরিত নবীগণ। অন্য কথায় আমাদের আইন রচয়িত ও সংবিধান দাতা [Low Giver] আমাদের জন্য কি আইন এবং কি নির্দেশ দিয়েছেন তা জানবার একমাত্র উপায় হচ্ছে আম্বিয়ায়ে কিরাম। এ কারণে ইসলামে আল্লাহ্র হুকুমের অধীন নির্দ্বিধায় তাদের অনুসরণ করার স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন শরীফে পরিষ্কার দেখতে পাবেন যে, আল্লাহ্র প্রেরিত নবীই উদাও কন্ঠে ঘোষণা করেছেনঃ
“আল্লাহ্কে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।” [সূরা শূয়ারাঃ ১০৮,১১০,১২৬,১৪৪,১৫০,১৬৩,১৭৯]
আর কুরআন মাজীদ একথা সুনির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত নীতি হিসেবে বর্ণনা করেছেঃ
“আমি যে রসূলই প্রেরণ করেছি আল্লাহ্র নির্দেশ মোতাবিক তাঁর অনুসরণ করার জন্যই তাকে পাঠিয়েছি।” [সূরা নিসাঃ ৬৪]
“যে ব্যক্তি রসূলের অনুসরণ করবে, সে মূলত আল্লাহ্রই অনুসরণ করলো।” [সূরা নিসাঃ ৮০]
এমনকি বিতর্কপূর্ণ ও মতবিরোধ সংকুল বিষয়ে রসূলকে যারা “সর্বশেষ মীমাংসাকারী” বলে মানতে অস্বীকার করে কুরআন মজীদ তদেরকে ‘মুসলামান’ গণ্য করতেই সুস্পষ্টরূপে অস্বীকার করেছেঃ
“অতএব না, তোমার রবের শপথ, তারা কখনো ঈমানদার হতে পারেনা, যতক্ষণ না তারা তাদের পারস্পরিক বিতর্ক ও বিরোধমূলক বিষয়সমূহে- হে নবী তোমাকেই সর্বশেষ বিচারক মানবে এবং তুমি যা মীমাংসা দিবে তা পরিপূর্ণরূপে মেনে নিবে এবং তা শিরধার্য করে নিতে হৃদয়ে দ্বিধা সংকোচ বোধ করবেনা।” [সূরা নিসাঃ ৬৫]
কুরআন আবার বলছেঃ
“আল্লাহ্র রসূল যখন কোনো ব্যাপারে কোনো ফয়সালা করেন, তাখন মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীর পক্ষে সেই সম্পর্কে নতুন করে ফয়সালা করার বিন্দুমাত্র এখতিয়ার নেই। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে, সে সুস্পষ্ট ভ্রন্তিতে নিমজ্জিত।” [সূরা আহ্যাবঃ ৬৩]
ইসলামে আইনগত সার্বভৌমত্ব একান্ত ও নিরংকুশভাবে একমাত্র আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের জন্য নির্দিষ্ট। অতপর এই সম্পর্কে সন্দেহ করার আর কোনো অবকাশ থাকেনা।
রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্র
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সাংবিধানিক ব্যাপারের ফায়সালা হয়ে যাওয়ার পর আর একটি প্রশ্ন বাকি থেকে যায় যে, অতপর রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব [Political sovereignty] কার? নিশ্চিতভাবে এর উত্তর এই এবং এই- ই হতে পারে যে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বও একমাত্র আল্লাহ্র। কারণ আল্লাহ্ তায়ালার আইনগত সার্বভৌমত্ব মানব সমাজে যে প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক শক্তিবলে কার্যকর [Force] করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হবে, আইন ও রাজনীতির পরিভাষায় তাকে কখনো সার্বভৌমত্বের মালিক বলা যায়না। যে শক্তির আইনগত সার্বভৌমত্ব নেই এবং যার ক্ষমতা ও একতিায়ার এক উচ্চতর আইন আগে থেকেই সীমিত ও অনুগত বানিয়ে দিয়েছে এবং যার পরিবর্তন কারার কোনো ক্ষমতা তার নেই, সে সার্বভৌমত্বের ধারক হতে পারেনা, এটা তো সুস্পষ্ট কথা্ একন এর প্রকৃত অবস্থা বা মর্যাদা কোন্ শব্দ দ্বারা ব্যাক্ত করা যেতে পারে? কুরআন মজীদই এই প্রশ্নর সমাধান দিয়েছে। কুরআন মজীদ এই প্রতিষ্ঠানকে ‘খিলাফত’ নামে ব্যক্ত করেছে। অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠান স্বয়ং “একচ্ছত্র শাসক” নয় বরং একচ্ছত্র শাসকের প্রতিনিধি মাত্র।
গণতান্ত্রিক খিলাফত
আল্লাহ্র প্রতিনিধি শব্দটি শোনার সংগে সংগে ‘জিল্লুল্লাহ্’ [আল্লাহ্র ছায়া]’ পোপবাদ এবং বাদশাহদের খোদায়ী অধিকার [Divine right of the kings] প্রভৃতির দিকে আপনাদের মন ও মানসিকতা যেনো বিচ্যুত না হয়। কুরআনের সিদ্ধান্ত এই যে, আল্লাহ্র এই প্রতিনিধিত্বের অধিাকার বিশেষ কোনো ব্যক্তি, পরিবার, বংশ কিংবা নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত নয়। বস্তুতপক্ষে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের সমর্থক এবং কোনো শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত নয়। বস্তুতপক্ষে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের মসর্থক এবং রসূলের মারফতে প্রাপ্ত আল্লাহ্র বিধানকে উচ্চতর ও চূড়ান্ত আইন হিসেবে মান্যকারী সকল মানুষই আল্লাহ্র দেয়া এই প্রতিনিদিত্বের অধিকারী।
“ আল্লাহ্ ওয়াদা করেছেন যে, তিনি পৃথিবীতে ঈমানদার ও সৎকার্মশীল লোকদেরকে তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত করবেন।” সূরা আননূরঃ৫৫]
এই জিনিসই ইসলামী খিলাফতকে রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, পোপবাদ এবং পাশ্চাত্য ধারণাভিত্তিক ধর্মরাষ্ট্র [Theocracy] প্রভৃতির বিপরীতে এক নিখঁত ও পূর্ণ গণতন্ত্রে পরিণত করে। কিন্তু তা পাশ্চাত্য গণতন্ত্র হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। পাশ্চত্য গণতন্ত্র যেখানে জনগণকেই সার্বভৌমত্বের ‘মালিক’ মনে করে, সেখানে ইসলাম ‘মুসলিম’ জনগণকে কেবল খিলাফতেরই অধিকারী বলে অভিহিত করে। রাষ্ট্রব্যবস্থা পবিচালনর জন্য পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে দেশবাসীর ভোট গ্রহণ করা গ্রহণ করা হয় এবং গণমতের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয় এবং পরিবর্তিত হয়; ইসলামী গণতন্ত্রও তাই দাবী করে। কিন্তু পার্থক্য এই যে, পাশ্চাত্য ধারণায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিরংকুশ ও সীমাহীন শক্তির মালিক। পক্ষান্তরে ইসলামের ধারণা অনুসারে গণতান্ত্রিক খিলাফত আল্লাহ্ তায়ালার আইনের অনুসরণ করতে বাধ্য।
২. রাষ্ট্রের কর্মসীমা
খিলাফতের উপরোক্ত ব্যাখ্যা এই বিষয়টির সরাসরি সমাধান হয়ে যায় যে, ইসলামী সংবিধানে রাষ্ট্রের কর্মসীমা কতোদূর পর্যন্ত বিস্তৃত? ইসলামী রাষ্ট্র যখন আল্লাহ্র খিলাফত, এখানে যখন একমাত্র আল্লাহ্র আইনগত সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত, তখন তার ক্ষমতা ও ইখ্তিয়ার অনিবার্যরূপেই আল্লাহ্ নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যেই গন্ডিবদ্ধ থাকতে বাধ্য। ইসলামী রাষ্ট্র তার কর্তব্য উক্ত সীমার মধ্যে অবস্থান করেই পালন করবে। সে সাংবিধানিক দিক থেকে এ সীমা লংঘন করতে পারেনা। আল্লাহ্র আইনগত সার্বভৌমত্বের নীতিমালা হতে এই কথা কেবল যুক্তি হিসেবেই যে পাওয়া যায় তা নয়, বরং কুরআন মজীদ স্বয়ং তা সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছে। কুরআনের স্থানে স্থানে বিধান প্রদান করে সতর্ক করে দেয়া হয়েছেঃ
“এটা আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমা, [তা লংঘন করা তো দূরের কথা] তার নিকটেও যেয়োনা।”
“এটা আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমা, তা লংঘন করোনা।”
“আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমা যারা লংঘন করে তারা যালিম।”
অতঃপর কুরআন একটি মূলনীতি হিসেবে এই হুকুম জারী করেছেঃ
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্র আনুগত্য করো, আল্লাহ্র রসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বসম্পন্ন তাদেরও। কোনো বিষয়ে যদি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মতাবিরোধ হয়, তাবে তা আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ এবং পরকালে বিশ্বসী হয়ে থাকো।” [সূরা নিসাঃ ৫৯]
এ আয়াত অনুসারে রাষ্ট্রের আনুগত্য অনিবার্যরূপে আল্লাহ্ ও রসূলের আনুগত্যের অধীন হবে, তা থেকে স্বাধীন হবেনা। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, আল্লাহ্ ও রসূলের বিধান অনুসরণের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের নিকট আনুগত্য দাবী করার কোনো অধিকারই রাষ্ট্রের নেই। একথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করবে, তার আনুগত্য কিছুতেই করা যাবেনা।”
“স্রষ্টার হুকুম অমান্য করে সৃষ্টির আনুগত্য কিছুতেই করা যাবেনা।”
এই নীতিটির সংগে উক্ত আয়াত আর একটি মূলনীতিও নির্ধারণ করে। তা এই যে, মুসলিম সমাজে যে কোনো প্রকার মতবিরোধই হোক, ব্যক্তিগণের পরস্পরের মধ্যে হোক, বিভিন্ন দলের মধ্যে হোক, কিংবা রাষ্ট্র ও প্রজা সাধারণের মধ্যে হোক, অথবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে হোক তার মীমাংসা কারার জন্য আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত চূড়ান্ত বিধানের দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এই নীতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে রাষ্ট্রের অবশ্যই একটি সংস্থা থাকবে যা মতদৈততামূলক বিষয় সমূহের চূড়ান্ত মীমাংসা আল্লাহ্র কিতাব ও রসূলের সুন্নহ্ মুতাবিক করবে।
৩. রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের কর্মসীমা ও পারস্পরিক সম্পর্কে
রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের [Organs of states] ক্ষমতা, অধিকার ও এখ্তিয়ারের সীমা ও উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিষ্কাররূপে জানা যায়।
আইন পরিষদের সীমা
আইন পরিষদ [Lagislature] কে আমাদের প্রাচীন পরিভাষায় বলা হয় “আহলুল-হাল্ল-ওয়াল-আকদ [আইন বিধিবদ্ধকারীগণ]। যে রাষ্ট্র আল্লাহ্ ও রসূলের আইনগত সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়ে গঠিত হয়েছে তার আইন পরিষদও যে কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতে রসূলের বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ মতৈক্যের বলেও কোনো আইন পাশ করার অধিকারী হতে পারেনা, তা একেবারে সুস্পষ্ট। একটু আগেই আমি আপনাদেরকে কুরআনের এই ফয়সালা শুনিয়েছি যে, “আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রসূল যে বিষয়ে চূড়ান্তবাবে মীমাংসা করে দিয়েছেন সেই সম্পর্কে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার কোনো ঈমানদার পুরুষ বা নারীর নেই” এবং “যারা আল্লাহ্র দেয়া বিধান অনুসারে ফায়সালা করেনা, তারাই কাফেল।” এসব সুস্পষ্ট নির্দেশের অনিবার্য দাবি হলো আল্লাহ্ এবং রসূলের বিধানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইন রচনা করা আইন পরিষদের অধিকারের সীমাবহির্ভূত এবং আইন পরিষদ এই ধরনের কোনো আইন পাশ করলেও তা অনিবার্যরূপে সংবিধানের লংঘন [Ultrovires of the constitution] বলে অভিহিত হবে।
প্রসংগত এই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, এমতাবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্রে আইন পরিষদকে নিন্মলিখিত অনেক কাজ করতে হবে।
১. যেসব ব্যাপারে আল্লাহ্ এবং রসূলের সুস্পষ্ট ও চুড়ান্ত বিধান মওজুদ রয়েছে, আইন পরিষদ যদিও তাতে কোনো রদবদল করতে পারবেনা, কিন্তু সেই বিধান ও নির্দশসমূহকে কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন ও পন্থা প্রণালী [Rules and Regulations] নির্ধারণ করা আইন পরিষদের কর্তাব্য।
২.যেসব ব্যাপারে কুরআন হাদীসের বিধানের একাধিক ব্যাখ্যার সম্ভাবনা রয়েছে তন্মধ্যে কোন্ ব্যাখ্যাটিকে আইন হিসেবে গ্রহণ করা হবে, তা নির্দষ্ট করা আইন পরিষদেরই কাজ। এজন্য আইন পরিষদে অনিবার্যরূপে এমন সব লোক থাকতে হবে যাদের আল্লাহ্র বিধানের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দক্ষতা ও যোগ্যতা আছে। অন্যথায় ঐসব বিধানের ভূল ব্যাখ্যা ইসলামী শরীয়াতকে বিকৃত ও পরিবর্তিত করে দিতে পারে।
মূলত, এই প্রশ্নটি ভোটদাতাদের নির্বাচনী দৃষ্টিভংগি ও যোগ্যতার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট। নীতিগত ভাবে এই কথা স্বীকার করতে হবে যে, আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে একটি গ্রহণ করা ও তাকে বিধিবদ্ধ করার অধিকার আইন পরিষদের। ফলে আইন পরিষদের গৃহীত ব্যাখ্যাই আইন হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু শর্ত এই যে, সে যেনো ব্যাখ্যার সীমা অতিক্রম করে বিকৃতির সীমা পর্যন্ত পৌঁছে না যায়।
৩. যেসব ব্যাপারে আল্লাহ্ এবং রসূলের কোনো নির্দেশ বা বিধান বিদ্যমান নেই, সেসব ব্যাপারে আসলামের সাধারণ নীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে নতুন আইন রচনা করা অথবা সেই সম্পর্কে ফিক্হের কিতাবসমূহে পূর্বে হতে প্রণীত কোনো আইন বর্তমান থাকলে তন্মধ্যে কোনো একটিকে গ্রহণ করা আইন পরিষদের কাজ।
৪. যেসব ব্যাপারে নীতিগত কোনো নির্দেশও পাওয়া যায়না, সে সম্পর্কে মনে করতে হবে যে, এই বিষয়ে আইন রচনার অধিকার আল্লা্হ্ তায়ালা আমাদেরকে দিয়েছেন। কাজেই এসব ব্যাপারে আইন পরিষদ যাথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করতে পারে। তবে শর্ত এই যে, সে আইন যেনো শরীয়তের কোনো হুকুম বা নীতির বিরোধী বা তার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। এ সম্পর্কে “যা নিষিদ্ধ নয় তা বৈধ” মূলনীতিটি গৃহীত হয়েছে।
এই চারটি নিয়ম রসূলের সুন্নহ, খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারা এবং মুজতাহিদদের অভিমত থেকে আমরা জানতে পারি। প্রয়োজনে এর প্রত্যেকটি নিয়মের উৎস কি তাও আমি বলে দিতে পারি। কিন্তু আমার মনে হয়, ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ কেউ ভালো করে হৃদয়ংগম করে নিলে তার সাধারণ জ্ঞান [Common Sense] তাকে বলে দিবে যে, এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইন পরিষদের কর্মসীমা অনুরূপই হওয়া উচিত।
শাসন বিভাগের কর্মসীমা
এখন শাসন বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করবো। একটি ইসলামী রাষ্ট্রে শাসন বিভগের [Executive] আসল কাজ হচ্ছে আল্লাহ্র বিধান জারী করা এবং তাকে কার্যকর করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা । এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যই তাকে একটি অমুসলিম রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করে। তা না হলে একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং একটি কাফির রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পার্থাক্য থাকেনা। ‘শাসন বিভাগ’ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ‘উলিল আমর’ এবং হাদীস শরীফ ‘উমারা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন ও হাদীস উভয়ই তাদের আদেশ শোনা এবং মানা’ [Obedience] সম্পর্কে জোর আদেশ দিয়েছে। কিন্তু সাথে সাথে তাতে এই শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, তাদেরকে আল্লাহ্ ও রসূলের বিধানের অনুগত থাকতে হবে। তারা তা লংঘন করে নাফরমানী ও বিদয়াতের পথে পা বাড়াবেনা। কুরআন মজীদ এ সম্পর্কে পরিষ্কার বলে দিচ্ছেঃ
“কখনো এমন কোনো ব্যক্তির আনুগত্য করোনা যার অন্তর আমার [আল্লাহ্র] স্মরণ থেকে গাফিল করে দিয়েছি, এবং যে নিজের নফসের লালসা বাসনা চরিতার্থ করার পথ অবলম্বন করেছে আর সীমা লংঘন করাই যার অভ্যাস।” [সূরা কাহাফঃ ২৮]
“যেসব সীমালংঘনকারী পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে, সংস্কারের কোনো কা্জই সীমালংঘনকারী পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে, সংস্কারের কোনো কাজই করেনা, তোমরা তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আনুগত্য করোনা।” [সূরা শুয়ারঃ ১৫১-১৫২]]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি এভাবে ব্যক্ত করেছেনঃ
“তোমাদের উপর যদি কোনো নাককাটা ক্রীতদাসকেও আমীর বা ‘রাষ্ট্র পরিচালক’ নিযুক্ত করা হয় এবং সে আল্লাহ্র বিধান অনুসারে তোমাদের নেতৃত্ব দান করে তোমরা তার কথা শোনো এবং আনুগত্য করো।” [মুসলিম]
“মুসলিম ব্যক্তিকে সবসময় আদেশ শ্রবণ ও অনুসরণ করে চলতে হবে, চাই সাগ্রহেই হোক, কিংবা বাধ্য হয়ে- যতক্ষণ না তাকে কোনো পাপ কাজের আদেশ করা হয়। কিন্তু কোনো পাপ কাজের হুকুম দেয়া হলে তা শোনা ও মানা যাবেনা।” [বুখারী, মুসলিম]
“যে ব্যক্তি আমাদের ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কোনো নতুন মতবাদের প্রচলন করবে যা তার সামগ্রিক প্রকৃতির সংগে খাপ খায়না, তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যাত।” [বুখারী, মুসলিম]
“কোনো বিদয়াতী [ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কোনো অনৈসলামিক রীতি পদ্ধতি উদ্ভাবনকারী] কে যে ব্যক্তি সম্মান প্রদর্শন করলো সে ইসলামকে মূলোৎপাটনে সাহায্য করলো।” [বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান]
এসব সুস্পষ্ট আলোচনার পর এই সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ বা অস্পষ্টতা অবশিষ্ট থাকতে পারেনা যে, নির্বাহী সরকার ও তার ব্যবস্থাপনার জন্য ইসলামে কি সীমা নির্ধারিত করা হয়েছে? কুরআন ও হাদীসের উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমীহ থেকে তা স্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায়।
বিচার বিভাগের কর্মসীমা বা অধিক্ষেত্র
এরপর বিচার বিভাগের [Judiciary] কথা। আমাদের প্রাচীন পরিভাষায় যা ‘কাদা’ [******] র সমার্থবোধক। বিচার বিভাগের অধিক্ষেত্র বা কর্মসীমা আল্লাহ্র আইনগত সার্বভৌমত্বের নীতিমালাই সরাসরি নির্দিষ্ট করে দেয়্। ইসলাম যখনই তার নীতিমালার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কায়েম করে, নবীগণই তা সর্বপ্রথম বিচারপতি হয়ে থাকেন এবং আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী জনগণের বিষয়সমূহের মীমাংসা করাই তাঁদের কাজ। নবীদের পরে যারা এই দায়িত্বে অভিষিক্ত হবেন, তারাও আবার নিজেদের বিচার কার্যর ভিত্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল থেকে প্রপ্ত আইনের উপর স্থাপন করতে বাধ্য। কুরআন মজীদের ‘সূরা মায়িদার’ দুই রুকুব্যাপী এই বিষয়েরই আলোচনা রয়েছে। তাতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, আমি তাওরত নাযিল করেছি; তাতে হিদায়াত ও উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা ছিলো এবং বণী ইসরাঈলের সকল নবীই এবং তাদের পরে সকল রব্বানী [আল্লাহ্ওয়ালা] ও পন্ডিতগণ তদনুসারে ইহুদীদের ব্যাপারসমূহের মীমাংসা করতেন। তাদের পরে আমি ঈসা ইবনে মারিয়ামকে প্রেরণ করেছি এবং তাকে হিদায়াত ও উজ্জ্বল আলোক বিশিষ্ট ইঞ্জীল কিতাব দিয়েছি। অতএব ইঞ্জীল কিতাবধারীদের কর্তব্য আল্লাহ্ প্রদত্ত ইঞ্জীলের হিদায়াত অনুসারে ফায়সালা করা। এই ঐতিহাসিক বিবরণ প্রদানের পর আল্লাহ্ তায়ালা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেছেন, আমি এই কিতাব [কুরআন মজীদ] ঠিক ঠিকভাবে পরম সত্যতা সহকারে তোমার প্রতি নাযিল করেছিঃ
“অতএব তুমি জনগণের মধ্যে আল্লাহ্র নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করো এবং তোমার নিকট আগত এই মহান সত্যকে উপেক্ষা করে মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ করোনা।” [সূরা মায়িদাঃ ৪৮]
সামনে অগ্রসর হয়ে আল্লাহ্ তায়ালা নিম্মলিখিত আয়াত দ্বারা এই আলোচনা সমাপ্ত করেনঃ
“অতএব মানুষ কি জাহিলী যুগের ফায়সালা চায়? অথচ আল্লাহ্র প্রতি যাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে, তাদের জন্য আল্লাহ্ ছাড়া উত্তম ফায়সালাকারী আর কে হতে পারে?” [সূরা মায়িদাঃ ৫০]
“এই দীর্ঘ আলোচনা চলাকালে আল্লাহ্ তায়ালা তিনবার বলেছেনঃ যারা আল্লাহ্র নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করেনা তারা কাফির…….. তারা যালিম…… তারা ফাসিক।” [সূরা মায়িদাঃ ৪৪-৪৯]
আল্লাহ্ তায়ালার এই কঠোর শাসন বাণীর পর একথা বলার হয়তো আর প্রয়োজন বাকী থাকেনা যে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের আদালত কেবল আল্লাহ্র আইন কার্যকর করার জন্য কায়েম হয়, তার বিপরীত ফায়সালা করার জন্য নয়।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের পারস্পরিক সম্পর্ক
এখন ইসলামী রাষ্ট্রের উল্লিখিত তিনটি বিভাগের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কি হবে এই প্রশ্নটির আলোচনা বাকী থাকলো। এ সম্পর্কে কুরআন হাদীসের সরাসরি নির্দেশ তো বিদ্যমান নেই, কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের কার্যক্রম ও ঐতিহ্য [Convention] থেকে আমরা পরিপূর্ণ পথনির্দেশ লাভ করতে পারি। এই উৎস থেকে আমরা এই তথ্য লাভ করতে পারি যে, রাষ্ট্র প্রধান শুধু রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বলেই রাষ্ট্রের এই তিন বিভাগের প্রধান। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মর্যাদা্য়ই অভিষিক্ত ছিলেন এবং খোলাফায়ে রাশেদীনও কখন এই মর্যাদায় সমাসীন ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র প্রধানের নীচের পার্যায়ে সেকালেও এই তিনটি বিভাগ পরস্পর থেকে পৃথক ছিলো। কখনকার যুগে “আহলুল হাল্লি-ওয়াল আকদ” সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো। খিলাফতে রাশেদার যুগে তাঁদের পরামর্শের আলোকে প্রশাসন পরিচালিত হতো এবং আইন সম্পর্কিত বিষয়ের ফায়সালাও তাদেরই পারমর্শক্রমে সম্পন্ন হতো। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ আলাদা ছিলেন। বিচার বিভাগের উপর তাদের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকরা ছিলোনা। কাজী [বিচারকগণ পৃথক ছিলেন, তাদের উপর শাসনকার্য পরিচালনার কোনো দায়িত্ব অর্পিত ছিলোনা।
রাষ্ট্রীয় বিষয়সমূহের সুষ্ঠু সমাধান করার যখনি প্রয়োজন দেখা দিতো, কখন খোলাফায়ে রাশেদীন “আহলুল হাল্লি-ওয়াল আকদ” এর সভা ডেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ চাইতেন। এবং পরামর্শভিত্তিকে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যেতো।
সরকারী প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ খলীফার অধীন ছিলেন। খলীফাই তাঁদের নিয়োগ দান করতেন এবং তাঁরই নির্দেশে তারা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
কাজী [বিচারক]দেরকেও যদিও খলীফাই নিযুক্ত করতেন; কিন্তু একবার কাজী নিযুক্ত হওয়ার পর তার বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার কোনো অধিকারই খলীফার ছিলোনা। বরং খলীফার ব্যক্তিগত ব্যাপারেই হোক কিংবা শাসন বিভাগের প্রধান হিসাবেই হোক, তার বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে তাঁকেও ‘কাজীর’ সন্মুখে জবাবদিহি করার জন্য ঠিক সাধারণ নাগরিকের মতোই উপস্থিত হতে হতো।
একই সময় কোনো ব্যক্তি কোনো এলাকায় শাসকও হয়েছেন এবং বিচারকও হয়েছেন পদস্থ কর্মকর্তা বা গভর্ণর, কিংবা স্বয়ং রাষ্ট্র প্রধান প্রমাণ পাওয়া যায়না। অনুরূপভাবে দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা মুকদ্দমায় জবাবদিহি করতে অথবা আদালতে হাজির হওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে কোনো ব্যক্তি বিশেষকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে বলেও কোনো উদাহরণ পাওয়া যায়নি।
বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত ব্যাপারে বৃহৎ পরিসরে বর্তমান কালের প্রয়োজন অনুসারে কিছুটা। রদবদল করা যেতে পারে, কিন্তু তার মূলনীতি যথাযথভাবে অপরিবর্তিত থাকবে। তাতে যে ধরনের খুঁটিনাটি রদবদল করা যেতে পারে, তা এভাবে যে, রাষ্ট্র প্রধানের শাসনতান্ত্রিক ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা ও এখ্তিয়ারকে খোলাফায়ে রাশেদীন যতোখানি বিশ্বাসযোগ্য ও আস্তাভাজন ছিলেন, অনুরীপ রাষ্ট্র প্রধান বর্তমান যুগে পাওয়া যাবেনা। তাই আমরা রাষ্ট্র প্রধানের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার উপরও বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারি, যাতে সে ডিক্টেটরে পরিণত হতে না পারে। মামলা মুকাদ্দমা ও শুনানির জন্য সরাসরি সংগত হতে পারে, যাতে সে কোনোরূপ অবিচার করার সুযোগে না পায়।
[মাওলানার বক্তৃতার এ পর্যায়ে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার এই মতের উৎস কি? তার উত্তরে মাওলানা মওদূদী বলেনঃ
আমার এই কথার দলীল এই যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ পৃথক ছিলো। আর রাষ্ট্র প্রধানের নিকট এই উভয় ক্ষেত্রের ক্ষমতা সে যুগে শরীয়তের কোনো বিধানের ভিত্তিতে একত্র করা হয়নি বরং এই ভরসায় একত্র করা হয়েছেল যে, তিনি বিচারক হিসেবে বিচারালয়ে আসীন হয়ে নিজের শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারসমূহকে কিছুমাত্র প্রভাবশালী হতে দিবেননা। বরং খোলাফায়ে রাশেদীদের প্রতি সেকালের জনগণের এতাদূর আস্থা ছিলো যে, তারা খলীফাকেই “সর্বশেষ মীমাংসাকারী” হিসেবে কামনা করতো, যাতে অন্য কোথাও বিচার না পাওয়া গেলেও তাঁর নিকট অবশ্যই সুবিচার পাওয়া যাবে। বর্তমান যুগে এ রকম আস্থাভাজন ব্যক্তি যদি আমরা লাভ করতে না পারি, তবুও রাষ্ট্র প্রধানকেই যুগপৎভবে প্রধান বিচারপতি ও শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসীন রাখতে হবে ইসলামী সংবিধানের কোনো ধারাই আমাদেরকে সেজন্য কিছুমাত্র বাধ্য করেনা।]
অনুরূপভাবে আমরা এই ব্যাপারে যেসব পরিবর্তন সাধন করতে পারি তা এই যে, আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের বা পার্লামেন্টের নির্বাচন পদ্ধতি এবং তাদের সংসদীয় নীতিমালা আমরা এ যুগের প্রয়োজন অনুসারে প্রণয়ন করতে পারি। এরূপে আরো অনেক ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করা যেতে পারে।
এখানে আরো দু’টি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে- যার জবাব দেয়াও প্রয়োজন। প্রথম এই যে, বিচার বিভাগ “আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের” গৃহীত কোনো আইনকে কুরআন ও সুন্নাতের খিলাফ হওয়ার কারণে বাতিল করতে পারে কি? এই সম্পর্কে শরীয়াতের কোনো নির্দেশ আছে বলে আমার জানা নেই। খিলাফতে রাশেদার কর্মপন্থা এই ছিলো যে, সে যুগে বিচার বিভাগের এরূপ কোনো অধিকার বা ক্ষমতা ছিলোনা। কিংবা কোনো কাজী এরূপ করেছে এমন কোনো নজীর পাওয়া যায়না। কিন্তু আমার মতে এর কারণ শুধু এই যে, সেকালের আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ [বা পরামর্শ সভা] এর লোকগণ কুরআন হাদীসে গভীর বুৎপত্তি রাখতেন। বর্বোপরি স্বয়ং খোলাফায়ে রাশেদীনের সম্পর্কে জনগণের এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে, তারা বিদ্ধমান থাকতে কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীত কোনো ফায়সালা হতে পারেনা। বর্তমান যুগেও আমরা যদি আমাদের সংবিধানের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারি যে, কোনো আইন পরিষদ কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীতে কোনো আইন পাশ করবেনা, তবে আজও বিচার বিভাগকে আইন পরিষদের ফায়সালা মানতে বাধ্য করা যায়। কিন্তু তদ্রূপ নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব না হলে নিরুপায় হয়েই বিচার বিভাগকে আইন পরিষদের গহীত কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীত আইনসমূহ বাতিল করার এখ্তিয়ার দিতেই হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, ইসলামে আইন পরিষদের [আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ] সঠিক মর্যাদা কি? তা কি রাষ্ট্র প্রধানের নিছক মন্ত্রণাসভা, যার পরামর্শ গ্রহণ কিংবা বর্জনের অধিকার তার রয়েছে? অথবা রাষ্ট্র প্রধান কি আইন পরিষদের সংখ্যাগুরুর কিংবা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ফায়সালাসমূহ গ্রহণ করতে অবশ্যই বাধ্য থাকবেন।
এই প্রসংগে কুরআন মজীদ যা কিছু বলেছে তা এই যে, মুসলমানদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়া বাঞ্চনীয় “তাদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়ে থাকে।” (সূরা শূরাঃ ৩৮)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাষ্ট্রধান হিসেবে সমম্বোধন করে আল্লাহ্ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেনঃ
“সামগ্রিক ব্যাপারসমূহে তাদের সাথে পরামর্শ করো। [পরামর্শের পর] যখন তুমি [কোনো কাজের] সংকল্প করবে তখন আল্লাহ্র উপর ভরসা করে কাজ করো।” [আলে ইমরানঃ ১৫৯]
এই দুইটি আয়াতই সামগ্রিক ব্যাপারসমূহে পরামর্শ করাকে অপরিহার্য করে দিয়েছে। এতে রাষ্ট্র প্রধানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পরামর্শের কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছলে পরে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে কাজ করে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু আমাদের মূল প্রশ্নের কোনো জবাব তা থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা। হাদীস থেকেও তার নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত কোনো জবাব পওয়া যায়না। অবশ্য খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারা ধেকে ইসলামী আইনজ্ঞাগণ সাধারণভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, রাষ্ট্র প্রধানই গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার জিম্মাদার এবং পরামর্শ সভার সাথে তিনি পরামর্শ করতে বাধ্য বটে, কিন্তু এর সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুর কিংবা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে রাষ্ট্র প্রধান [সবসময় বাধ্য নন। অন্য কথায়, রাষ্ট্র প্রধানকে ‘ভেটো’ প্রয়োগের অধিকার দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এই মতটির সংক্ষিপ্ততা ও অস্পষ্টতার জন্য ভুল বুঝাবুঝির কারণ হতে পারে। কেননা লোকেরা এই মত বর্তমান পরিবেশে বেখে হৃদয়ংগম করতে চেষ্টা করে এবং সেই পরিবেশ তাদের সামনে নেই যে পরিবেশ [খোলাফায়ে রাশদীনের যুগ] থেকে এই মত গ্রহণ করা হয়েছে। খিলাফতে রাশেদার যুগে যাদেরকে “ আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ” বা পরামর্শ সভার সদস্য নির্দিষ্ট করা হতো, তার ভিন্ন ভিন্ন দলের আকারে সংগঠিত ছিলোনা। কর্তমান যুগের আইন পরিষদসমূহ যেসব পার্লামেন্টারী নিয়ম কানুনে শক্ত করে বাঁধা হয়ে থাকে, সেকালের পরামর্শ সভা সেরূপ ছিলোনা। তারা প্রথমে আলাদা আলাদা ভাবে নীতি নির্ধারণ করে, কার্যসূচী নির্দিষ্ট করে এবং পার্টি মির্টিং- এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মজলিসে শূরা বা পার্লামেন্টে আসতোনা। পরামর্শের জন্য যখন তাদেরকে আহ্বান করা হতো তখন তারা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত মনে পরামর্শেস্থলে এসে বসতো। খলীফা স্বয়ং তাদের মজলিসে উপস্থিত থাকতেন। আলোচ্য বিষয় তথায় পেশ করা হতো, সপক্ষে এবং বিপক্ষে সকল দিক দিয়েই স্বাধীনভাবে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হতে পারতো। তারপর উভয় পক্ষের যুক্তি প্রমাণ তুলনা করে খলীফা নিজের প্রমাণসহ নিজ সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতেন। খলীফার এই মত সাধারণত এমন হতো যে, তা সমগ্র মজলিসই সমর্থন করতো। কোনো কোনো সময় কিছু সংখ্যক সমস্য খলীফার সাথে দ্বিমত পোষণ করতো কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভূল বা “সমর্থন অযোগ্য” মনে করতোনা, বরং তাকে অপেক্ষিকভাবে কম অগ্রাধিকারযোগ্য বলে মনে করতো এবং ফায়সালা হয়ে যাওয়ার পর অন্তত তা মেনে নিতো। পরামর্শ সভায় পরামর্শ দাতাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে এবং কখনও এমন মতবিরোধের সৃষ্টি হয়নি যে, কতোজন কোন্ মতের পক্ষে তা গণনা করে দেখার প্রয়োজন হতো। পক্ষান্তুরে খলীফা পরামর্শ সভার প্রায় সম্মিলিত ঐক্যমতের বিরুদ্ধে কাজ করা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, খিলাফতে রাশেদার ইতিহাসে তদ্রূপ ঘটনা মাত্র দুইবার ঘটেছিলো্ একবার উসামা বাহিনী প্রেরণের ব্যাপারে এবং দ্বিতীয়বার মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার ব্যাপারে। কিন্তু উভয় ঘটনায় সাহাবায়ে কিরাম খলীফার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন। তা এই কারণে নয় যে, ইসলামী সংবিধান খলীফাকে ‘ভেটো’ প্রয়োগ ক্ষমতা করার দিয়ে রেখেছিলো এবং সাংবিধানিকভাবে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তারা খলীফার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য ছিলেন। বরং তার প্রকৃত কারণ এই ছিলো যে, খলীফা হযরত আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর রাজনীতি জ্ঞান, দূরদর্শিতা ও অন্তদৃষ্টির প্রতি সাহাবায়ে কিরামের পূর্ণ আস্থা বিদ্যমান ছিলো। তারা যখন দেখলেন, হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নিজের মতের যথার্থতা সম্পর্কে এতোটা দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন এবং দীন ইসলামের কল্যাণ দৃষ্টিতেই এই মতের প্রতি তিনি এতো বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তখন তাঁরা উদার চিত্ত মতের সপক্ষে নিজেদের মত প্রত্যাহার করলেন। বরং পরে তাঁরা তাঁর মতের সত্যতা ও সুষ্ঠতার প্রকাশ্যভাবে প্রশংসা পর্যন্ত করেছিলেন এবং স্পষ্ট ভাষায় স্বীকারও করেছিলেন যে, এই সংকট মুহূর্তে হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যিনি হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মতের সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠভাবে বিরোধিতা করেছিলেন, উদত্ত কন্ঠে বলে বেড়াতেন, আল্লাহ্ তায়ালা আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হৃদয়কে এই কাজের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, হযতর আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ফায়সালাই ছিলো পথার্থ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনার অনুমান করতে পারেন যে, ইসলামে “ভেটো”র এই ধারণা মূলত কোন পরিবেশের নজির থেকে সৃষ্টি হয়েছে? শূরার কর্মনীতি ও তার অন্তর্নিহিত ভারধারা এবং শূরা সদস্যদের মনোবৃত্তি ও স্বভাব প্রকৃতি খিলাফতে রাশেদার অনুরূপ হলে উক্তরূপ কর্মনীতি অপিক্ষা উত্তম ও উন্নত কর্মপন্থা আর কিছুই হতে পারেনা। এই কর্মপন্থাকে যদি তার অনিবার্য পরিণতি ও শেষ মনযিল পর্যন্ত আমরা নিয়ে যেতে পারি, তবে খুব বেশী বললেও এতোটুকু বলা যায় যে, এই ধরনের মজলিসে শূরার রাষ্ট্র প্রধান ও পরিষদ সদস্যগণ যদি নিজ মত অন্যের সপক্ষে প্রত্যাহার করতে প্রস্তুত না হয় বরং নিজের উপর জিদ ধরে বসে, তবে তখন গণভোট [Referendum] গহণ করা যাবে। তারপর যার মতকে জনমত বাতিল করে দিবে তাকে ইস্তফা দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সেরূপ মনোবৃত্তি ও অভ্যন্তরীন ভাবধারা সৃষ্টি করতে এবং সে ধরনের মজলিসে শূরা গঠন করা যতোদিন না সম্ভব হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শাসন বিভাগেকে আইন পরিষদের সংখ্যাগুরুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
৪. রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য
এখন আমরা আলোচনা করে দেখবো যে, ইসলাম কোন্সব মৌলিক উদ্দেশ্য [Objective] পেশ করে, যার জন্য একটি ইসলামী রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে। কুরআন মজীদ ও সুন্নতে রসূলে এই উদ্দেশ্যসমূহের যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা এইঃ
কুরআন আমার রসুলদেরকে উজ্জ্বল দলীল প্রমাণ সহকারে পঠিয়িছি এবং তাদের সংগে কিতাব ও ‘মীযান’ নাযিল করেছি, যেনো মানুষ ইনসাফ ও সুবিচারের উপর কায়েম হতে পারে।” [সূরা হাদীদঃ ২৫]
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
“যেসব মুসলমানকে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনুমতি দেয়া হচ্ছে তাদেরকে যদি আমি পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব দান করি, তবে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে, সৎ কাজের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখবে।” [সূরা হজ্জঃ ৪১]
“আল্লাহ্ তায়ালা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাহায্যে এমন কাজের পথ রুদ্ধ করেন যা কুরআনের দ্বারা বন্ধ করেননা।” [তফসীরে ইবনে কাছীর]
অর্থাৎ যেসব অনাচার ও পাপাচার কেবল কুরআনে উপদেশ ও যুক্তির দ্বারা দুরীভূত হয়না, সেগুলো নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োজন।
এ থেকে জানা গেলো যে, মানবতার কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ইসলাম যেসব সংস্কারমূলক কর্মসূচী পেশ করেছে, রাষ্ট্রের সমগ্র উপায় উপকরণের সাহায্যে তা বাস্তবায়িত করাই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সীমান্ত রক্ষা এবং জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নত করাই রাষ্ট্রের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নয়। ইসলাম মানবতাকে যেসব কল্যাণকর ব্যবস্থয় সুসজ্জিত ও সমৃদ্ধ করে তুলেতে চায় সেগুলোর উন্নত আর যেসব পাপাচার থেকে পবিত্র করতে চায় সেগুলো নির্মূল, নিস্তেজ ও দূর্বল করতে সকল শক্তি নিয়োজিত করাই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই ইসলামী রাষ্ট্রকে অমুসলিম রাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্র ও পৃথক করে দেয়।
৫. সরকার কিভাবে গঠিত হবে
এই মৌলিক বিষয়গুলোর বিশ্লেষণের পর আমাদের সম্মুখে পঞ্চম প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়। সেটি হলো, উপরোল্লিকিত মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে তার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য সরকার কিভাবে সম্পন হবে? এ প্রসংগে রাষ্ট্র প্রধানের [Head of the State] ইসলামী পরিভাষায় যাকে ইমাম, আমীর বা খলীফা বলা হয় নিয়োগের ব্যাপারটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে ইসলামের নীতি হৃদয়ংগম করার জন্য ইসলামের প্রাথমিককালের ইতিহাস পর্যালোচনা করা আমাদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র প্রধানের নির্বচন
যেমন আপনার সকলেই জানেন, আমাদের বর্তমান ইসলামী সমাজের সূচনা মক্কার কুফরী পরিবেশে হয়েছিলো এবং এই প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে ইসলামী সমাজের সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠাকারী ছিলেন আমাদর নেতা ও পথপ্রদর্শক মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই ইসলামী সমাজ যখন তার সংগঠন ও রাজনৈতিক স্বাধীকারের দিক থেকে উন্নতি লাভ করে একটি রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করার মঞ্জিল পর্যন্ত পৌছে গেলো, তখন তার প্রথম ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই ছিলেন এবং তিনি কারো দ্বারা নির্বাচিত ছিলেননা বরং সরাসরি আল্লাহ্ তায়ালা কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথ রূপে পালন করার পর তার শ্রেষ্ঠতম বন্ধুর [আল্লাহ্] সাথে মিলিত হলেন। কিন্তু তাঁর স্থালভিষিক্ত নির্বাচন সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট, নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশ দিয়ে যাননি। তাঁর এই নীরবতা এবং কুরআন মজীদের বাণী “তাদের সামগ্রিক ব্যাপরসমূহে পারস্পরিক পরামর্শে সম্পন্ন” এর আলোকে সাহাবায়ে কিরাম বুঝতে পারলেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের দায়িত্ব মুসলমানদের নিজস্ব নির্বাচনের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবং এই নির্বাচন মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতেই সম্পন্ন হওয়া বাঞ্চনীয়। ১{সন্দেহ নাই যে, মুসলমানদের মধ্যে শীয় মতাবলস্বীগণ মনে করেন যে, নবীদের ন্যায় ইসলামী সমাজের নেতৃত্ব পদে নিযুক্তিও আল্লাহ্র তরফ থেকেই হয়ে থাকে। কিন্তু এই মতবিরোধ পর তার পুনরাবির্ভাব পর্যন্ত ইমামের পদ যেহেতু শূন্য রয়েছে, তাই বর্তমানে মুসলমানদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ একজন আল্লাহ্ কর্তৃক নিযুক্ত নয় এমন ব্যক্তির হাতেই ন্যস্ত হওয়া উচিত।}
জনসম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। অতপর তাঁর অস্তিম সময় যখন উপস্থিত হলো, তখন তাঁর দৃষ্টিতে খিলাফতের জন্য সর্বাপেক্ষা যোগ্যতম ব্যক্তি যদিও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন, কিন্তু তাঁর স্থালাভিষিক্তের নাম তিনি নিজে প্রস্তাব করলেননা, তিনি প্রবীণ ও বিশিষ্ট সাহাবাদের পৃথক প্রথকভাবে ডেকে প্রত্যেকের মত অবগত হলেন। তারপর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সপক্ষে তাঁর নিজের শেষ উপদেশ লেখালেন। অতপর রোগাক্রন্ত অবস্থায়ই তিনি তাঁর ঘরের দরজায় উপস্থিত সকল মুসলমানদের সম্মেলনকে সম্বোধন করে বললেনঃ
“জনমন্ডলি! আমি যাকে আমার স্থালাভিষিক্ত মনোনীত করবো তোমরা কি তাকে সমর্থন করবে? আল্লাহ্র শপথ! চিন্তা ও গবেষণা করে মত নির্ধারণে আমি বিন্দুমাত্র ত্রুটি করিনি। আমি আমার কোনা আত্মীয় ব্যক্তিকেও নিযুক্ত করছিনা। আমি ওমর ইবনুল খাত্তাবকেই স্থালাভিষিক্ত নিযুক্ত করছি। অতএব তোমরা তাঁর কথা শুনো ও মেনে চলো।”
বিরাট জনসম্মেলন থেকে আওয়াজ উঠলঃ
আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। [তাবারী, ২য় খন্ড, পৃঃ ৬১৮, মাতবায়াল ইসতিকামাহ, মিশর]
এভাবে মুসলমানদের দ্বিতীয় খলীফা নিয়োগ কার্যও মনোনয়নের দ্বারা সম্পন্ন হয়নি বরং তদানীন্তন খলীফা মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করে এক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করেন এবং সমবেত জনগণের সম্মুখে তা পেশ করে মঞ্জুর করিয়ে নেন।
অতপর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর অন্তিমকাল উপস্থিত হয়। তখন নবী করমী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্বাধিক বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সাহাবীগণের ছয়জন সাহাবী এমন ছিলেন, খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণের ব্যাপারে যাদের উপর মুসলমানদের প্রথম দৃষ্টি নিপতিত হতে পারে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এই ছয়জনের সমন্বয়ে একটি মজলিসে শূরা গঠন করেন এবং পারস্পরিক পরামর্শক্রমে একজনকে খলীফা নিযুক্ত করার দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করেন। সেই সংগে তিনি ঘোষণা করলেনঃ
“তোমাদের মধ্যে যে কেই মুসলমানেদের সাথে পরামর্শ না করেই জোরপূর্বক রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে বসবে, তোমরা তাকে হত্যা করো।” [মুহাম্মদ হুসায়ন হায়কালঃ আল-ফারুক ওমর, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩১৩]
এই মজলিস খলীফা নির্বাচনের কাজ শেষ পর্যন্ত হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর উপর অর্পন করেন। তিনি মদীনার অলিগলি ঘুরে জনগণের মতামত জেনেছেন, বাড়ী বাড়ী গিয়ে পুরাবাসিনীদের নিকট পর্যন্ত এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্রদের মতামতও জানতে চেষ্টা করেছেন। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হজ্জে আগত লোক-যারা মদীনা থেকে নিজ নিজ দেশে রওনা করছিলো তাদের মতও অবগত হন। এরূপ অবিশ্রান্ত অনুসন্ধানের পর তিনি নিঃসন্দেহে জানতে পারলেন যে, গোটা জাতির সর্বাধিক আস্থাভাজন ব্যক্তি বর্তমানে দুইজন। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং এদের মধ্যে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর দিকে আবার অধিক সংখ্যক লোকের ঝোঁক রয়েছে। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সপক্ষেই এই গণমতের ভিত্তিতে অবশেষে ফায়সালা হলো এবং প্রকাশ্য সম্মেলনে তার হাতে ‘বায়াত’ [আনুগত্যের শপথ] গ্রহণ করা হয়।
অতপর হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাহাদাতের হৃদয়বিধারক ঘটনা ঘটে। ফলে মিল্লাতে ইসলামিয়ার মধ্যে চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। এই সময় কয়েকজন সাহাবী হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ঘরে একত্রিত হন এবং তাঁকে বলেনঃ এই সংকট মুহূর্তে উম্মতের নেতৃত্বের যোগ্যতম ব্যক্তি আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। অতএব আপনি এই গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করুন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যদিও তা অস্বীকার করলেন গ্রহণ করতে, কিন্তু তাঁরা তাঁকে বাববার অনুরোধ করতে লাগলেন।
তখন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন- “আপনারা যদি বাস্তবিকই তা চান তবে মসজিদে চলুনঃ
“কারণ আমার আনুগত্যের শপথ [বায়াত] গোপনে অনুষ্ঠিত হতে পারেনা এবং মুসলিম জনসাধারণের সম্মতি ব্যতীত তা সম্পন্নও হতে পারেনা।” [তাবারী ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪৫০]
অতপর তারা মসজিদে নববীতে চলে গেলেন। আনসার ও মুহাজিরগণ তথায় সমবেত হলেন। আর সকলের না হলেও অন্তত অধিকাংশ লোকের সমর্থনে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খলীফা নির্বাচিত হন এবং তাঁর বায়াত’ গ্রহণ করা হয়।
অতপর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর উপর যখন ঘাতকের আক্রমণ হয় এবং তিনি মুমূর্ষ অবস্থায় উপনীত হন, তখন জনগণ তাঁর নিকট জিজ্ঞাসা করলো, আপনার পরে আমরা আপনার পুত্র হাসান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকেই কি খলীফা নিযুক্ত করবো এবং তাঁর হাতেই কি বায়াত’ করবো? উত্তরে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, শুধু এ টুকুই বলেছিলেনঃ
“আমি এজন্য তোমাদের কোনো হুকুম দিচ্ছিনা, কোনো কিছু করতে তোমাদেরকে নিষেধও করছিনা। তোমরা নিজেরা খুব ভালো করে বিবেচনা করে দেখতে পারো।” [তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১১২]
এই হচ্ছে রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচনের ব্যাপারে খিলাফতে রাশেদার কার্যক্রম এবং সাহাবায়ে কিরামের সর্বসম্মতিমূলক কর্মপন্থা। খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীরবতা এবং “তাদের সামগ্রিক ব্যাপারে তাদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমেই আঞ্জাম পেয়ে থাকে”- আল্লাহর এই বাণীর উপর তাদের কর্মনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। এই নির্ভরযোগ্য সাংবিদানিক ঐতিহ্য থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচন সাধারণ লোকদের সম্মতির উপর নির্ভারশীল। কোনো ব্যক্তিরই জোরপূর্বক রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই। [ কোনো কোনো লোকের মনে এই প্রশ্ন জাগে যে, ইসলামের প্রকৃত নিয়ম যদি তাই হবে, তাহলে রাজতন্ত্রের যুগে নাম করা আলেমগণ জোরপূর্বক রাজ তখত দখলকারী লোকদের খিলাফত ও নেতৃত্ব কিরূপে স্বীকার করে নিলেন? উত্তরে বলা যায় যে, মূলত, এখানে দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিষয়কে পরস্পর তালগোল পাকিয়ে ফেলার কারণে গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি হয়েছে। একটি বিষয় তো এই যে, ইসলামে খলীফা বা শাসনকর্তা নির্বাচনের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য পন্থা কি? আর একটি এই যে, কখনো ভ্রান্ত পন্থায় কোনো ব্যক্তি যদি খিলাফতের গদী দখল করে বসে তবে তখন কি করা উচিত? প্রথম বিষয়ে আলেমগণের সর্বসম্মত উত্তর এই যে, মুসলিম জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে নির্বাচনই হচ্ছে সঠিক কর্মনীতি।
দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, এরূপ পরিস্থিতিতে যেসব আলেম অধিকতর নরমপন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তারাও শুধু এতোটুকুই বলেছেন যে, শান্তি শৃংখলা এবং মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার খাতিরেই এরূপ খলীফাকে বরদাশত করে নিতে হবে। কিন্তু সতর্কতার সাথে রক্ষ্য রাখতে হবে যে, এরূপ জোরপূর্বক শাসন দখলকারী ব্যক্তি দীন ইসলামের মূলবিধান ও ভিত্তিকে যেনো বিগড়ে দিতে না পারে। এরূপ পরিস্থিতিতেও উক্ত শর্ত যদি বহাল পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করা তারা পছন্দ করেননা। কারণ তা করলে সমগ্র দেশে বিচ্ছিন্নতা, অশান্তি ও বিপর্যয় দেখা দিবে। এ কথার অর্থ কখনো এই নয় যে, যারা উপরোক্ত মত পোষণ করতেন তারাও জোরপূর্বক গদি দখল করাকে সুষ্ঠু ইসলামী পন্থা বলে মনে করতেন।] বিশেষ কোনো পরিবার কিংবা শ্রেণীরও এর উপর একচেটিয়া আধিপত্য নাই। [ এই প্রসংগেও কতিপয় লোক সংশয় সৃষ্টি করে যে, তাহলে যেসব হাদীসে কুরাইশদেরকে খিলাফতের অধিক হকদার বলা হয়েছে তার অর্থ কি? এর উত্তর আমরা রাসায়েল ও মাসায়েল গ্রন্থে পেশ করেছি।] উপরন্তু এই নির্বাচন হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, জবরদস্তিমুক্ত এবং মুসলমানদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যমে। কিন্তু মুসলমানদের স্বাধীন মনোভাব কিভাবে বা কি উপায়ে জানা যাবে? এই ব্যাপারে ইসলাম নির্দিষ্ট ও বাঁধাধরা কোনো পন্থা ঠিক করে দেয়নি। অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু বিশেষ শর্ত এই যে, যে পন্থাই গ্রহণ করা হোক- সমগ্র জাতির আস্থাভাজন ব্যক্তি কে? তা যেনো সেপন্থা দ্বারা সন্দেহাতীতরূপে জানতে পারা যায়।
মজলিসে শূরার গঠন
রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচনের পর মজলিসে শূরা বা পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচন আমাদের সম্মুখে অধিকতর জটিল বিষয়। এই মজলিস কিভাবে গঠিত হবে, এর সদস্য কিভাবে নির্ধারণ করা হবে এবং কারাইবা তাদেকরকে নির্বাচিত করবে?
যৎসামান্য অধ্যয়নের ভিত্তিতে লোকেরা এই মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়েছে যে, খিলাফতে রাশেদার যুগে যেহেতু সাধারণ নির্বাচনের [General Election] মাধ্যমে শূরা সদস্যগণ নির্বাচিত হতেননা, তাই ইসলামে জনমত জানবার জন্য মূলতই কোনো পন্থা বিদ্যামান নেই, বরং সমসাময়িক খলীফার বুদ্ধিবিবেচনার উপর বিষয়টি ছেড়ে দেয়া হয়েছে যে, সে নিজ ইচ্ছামতো যে কোনো লোকের সাথে পরামর্শ করতে পারে। মূলত সেকালের, বিষয়কে একালের পরিবেশে রেখে বুঝার চেষ্টার কারণে এই ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সেকালের প্রত্যেকটি কথাকে সেকালের পরিবেশে রেখে পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং তার বাস্তব খুঁটিনাটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই সেই নীতিসমূহ হৃদয়ংগম করার চেষ্টা করতে হবে।
ইসলাম মক্কা মুয়াজ্জামায় একটি আন্দোলন হিসেবেই উত্থিত হয়েছিলো। দুনিয়ার আন্দোলনসমূহের একটি প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, সর্বপ্রথম যারাই এই আন্দোলনে যোগদান করেন, আন্দোলনের অগ্রনায়কের তারাই হয় বন্ধু, সংগী, সহকারী, পরামর্শদাতা এবং সাহায্যকারী। তাই যারা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তারা অতি স্বাভাবিকভাবেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বন্ধু ও পরামর্শদাতা হয়েছিলেন। আল্লাহর নিকট হতে যেসব ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ নাযিল হতোনা, তিনি সেসব বিষয়ে তাঁদের সাথে পরামর্শ করতেন। উত্তরকালে এই আন্দোলনে যখন নতুন নতুন লোক যোগদান করতে লাগলো এবং বিরোধী শক্তিসমূহের সাথে তার দ্বন্দ্ব, সংঘাত ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠলো, তখন যেসব লোক নিজদের ঐকান্তিক নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমত, আত্মদান, অনাবিল জ্ঞানবুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির দিক দিয়ে গোটা জামায়াতের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিলেন তারা ভোটে নির্বাচিত হননি। বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা ও দুঃসহ অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমেই তারা নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথমত, যারা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সাবিকুনাল আউয়ালুন। দ্বিতীয়ত, পরবর্তীকালে যেসব পরীক্ষিত সাহাবী জামায়াতের মধ্যে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছেন এই উভয় শ্রেণীর সাহাবীগণের উপর ঠিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতোই সর্বসাধারণ মুসলমানের আস্থা ছিলো।
এরপর হিজরতের বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়। হিজরতের সূচনা এভাবে হয় যে, দেড়-দুই বছর পুর্বে মদীনার কয়েকজন প্রভাবশালী লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের প্রভাব ও প্রচেষ্টায় আওস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়ের ঘরে ঘরে ইসলামের বিপ্লবী বাণী পৌছে গিয়েছিলো। এদেরই আহ্বানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং অন্যান্য মুহাজির নিজ নিজ ঘরবাড়ী ত্যাগ করে মদীনায় চলে যান এবং সেখানে ইসলামের এই আন্দোলন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং একটি রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। যাদের প্রভাবে ও প্রচেষ্টায় ইতোপূর্বে মদীনায় ইসলাম প্রসারিত হয়েছিলো, এই নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অতি স্বাভাবিকভাবে তাঁরাই স্থানীয় নেতা হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তারাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে শূরায় সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবা এবং পরীক্ষিত মুহাজিরদের সংগে তৃতীয় দল হিসেবে শামিল হওয়ার অধিকারী হয়েছিলেন। বস্তুত পক্ষে তারাও অতি স্বাভাবিক নির্বাচন পদ্ধতিতেই নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে তাঁরা এতোদূর আস্থাভাজন ছিলেন যে, তখন আজকালকার আধুনিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এসব লোকই নির্বাচিত হতেন।
অতপর মদীনার সমাজে দুইশ্রেণীর লোক আত্মপ্রকাশ করতে লাগলো। প্রথমতঃ যারা দীর্ঘ আট দশ বছর কালের রাজনৈতিক সামরিক ও প্রচারগত কঠিন কার্যসমূহ আঞ্জাম দিয়েয়েন তাঁরা। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাদের প্রতিই লোকদের দৃষ্টি পতিত হতে লাগলো। দ্বিতীয়ঃ যারা কুরআন মজীদের জ্ঞান ও দীন ইসলামের সুক্ষ্ম জ্ঞানের দিক দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ফলে দীন ইসলামের তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞানের দিক দিয়ে জনগণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে তাদেরকেই অগ্রগণ্য ও নির্ভরযোগ্য মনে করতো। স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জীবদ্দশায় এসব সাহাবীর নিকট কুরআন শিখবার এবং বিশেষ বিশেষ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করার সাধারণ নির্দেশ দিয়ে তাদের যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততাকে অধিকতর বলিষ্ঠ করেছিলেন। এই দুই প্রকারের লোকও অতি স্বাভাবিক নির্বাচনের নিয়মে মজলিসে শূরায় স্থানে লাভ করেছিলেন। তাদের মধ্যে কাউকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ভোট গ্রহণের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। আর ভোট যদি বাস্তবিকই লওয়া হতো, ইসলামী সমাজের সমগ্র জনতার প্রথম দৃষ্টি যে তাদের উপরই পড়তো, তাতো কোনো সন্দেহ নেই।
এভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় যে মজলিসে শূরা গঠিত হয়েছিলো, উত্তরকালে তাই খোলাফায়ে রাশেদীনেরও মন্ত্রণা পরিষদ বলে বিবেচিত হলো। ফলে এই নিয়মটি একটি সাংবিধানিক ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং পরবর্তীকালে এমন সব লোক এই নিয়ম অনুসারে মজলিসে শূরায় প্রবেশ করতে থাকেন যারা নিজেদের অবদান এবং উচ্চতর নৈতিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার দ্বারা জনপ্রিয়তা লাভ করে এই মজলিসে নিজেদের স্থান করে নিয়েছিলেন। এই লোকদেরকেই আরবী পরিভাষায় “আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ” [বন্ধনকারী ও বন্ধন মুক্তকারী] বলা হতো। তাদের সাথে পরামর্শ না করে খোলাফায়ে রাশেদীন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেননা। তাদের প্রকৃত মর্যাদা একটি ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাহাদাতের ঘটনার পর কয়েকজন সাহাবী হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করলেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেনঃ
“এটা তোমাদের ফায়সালা করার বিষয় নয়, শূরার সদস্য এবং বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণের কাজ। বস্তুত শূরার সদস্য এবং বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ যাকে মনোনীত করবেন, তিনিই খলীফা হবেন। অতএব এখন আমরা সমবেত হবো এবং এই বিষয়ে বিবেচনা করবো।” [ইবনে কুতায়বা, আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, পৃঃ ৪১]
একথা পরিষ্কার জানা যায় যে, “মজলিসে শূরার সদস্য সে যুগে কিছু নির্দিষ্ট লোক ছিলেন, যারা পূর্ব থেকেই এই মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহের চূড়ান্ত মীমাংসা করার ভার তাঁদের উপরই ন্যস্ত ছিলো। কাজেই খলীফা পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য ছিলেননা- ইচ্ছা হলে কারো সাথে পরামর্শ করতেন নাহলে নাই করতেন, আর করলেও জাতির গুরুতর বিষয়সমূহের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকারী কারা ছিলো তা মোটেই জানা যেতোনা- একথা কিছুতেই বলা যায়না। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর উক্ত বাণী থেকেই এরূপ কথার ভিত্তিহীনতা প্রমাণিত হয়েছে। [এখানে আরো একটি প্রশ্ন জাগে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় কেবল মদীনার লোকগণই কেন শূরার সদস্য হতেন এবং অন্যান্য এলাকা হতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি আহবান করা হয়নি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর এই যে, তা না করার মূলে দুইটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত কারণ বিদ্যমান ছিলোঃ
প্রথম কারণ এই যে, আরব দেশের এই ইসলামী রাষ্ট্র কোন জাতীয় রাষ্ট্র ছিলোনা, তা সম্পূর্ণ আলাদা পন্থায় অস্তিত্ব লাভ করেছিলো। প্রথমে একটি মতাদর্শের ব্যাপক প্রচার লোকদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলো। এই বিপ্লবের অনিবার্য পরিণতিতে একটি আইননুগ সমাজ দানা বেঁধে উঠেছিলো, তারপর এই সমাজ একটি আইনানুগ রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। এই প্রকারের রাষ্ট্রে স্বভাবত কেন্দ্রীয় অস্থাভাজন ব্যক্তি তিনিই ছিলেন যিনি এই বিপ্লবের বীজ বপন করেছিলেন। তার পরে সেইসব লোকই এই বিপ্লবী সমাজের কেন্দ্রীয় আস্থাভাজন ব্যক্তি হয়েছিলেন, যারা এই বিপ্লব সৃষ্টিকারীর দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। তাদের নেতৃত্বে ছিলো একটি স্বাভাবিক এবং যুক্তিসংগত নেতৃত্ব এবং এই সমাজে তাদের ছাড়া অন্য কেউই জনগণের আস্থাভাজন হতে পারতোনা। ইসলামী সমাজে সমালোচনার অবাধ অধিকার ও পূর্ণ সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও কেবল এই কারণেই তাঁদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এবং “কেবল মদীনার লোকেরই কেন পরামর্শদানের অধিকার ভোগ করছে” বলে টু শব্দটিও সেকালের সারা আরব দেশের কোথাও ধ্বনিত হয়নি।
দ্বিতীয় কথা এইযে, সেকালের তামাদ্দুনিক অবস্থায় আফকানিস্তান থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট রাজ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া মোটেও সম্ভবপর ছিলোনা। এবং মজলিসে শূরার প্রত্যেক আঞ্চলিক সদস্যের পক্ষে সাধারণ এবং জরুরী অধিবেশসসমূহে এসে যোগদান করাও অসম্ভব ছিলো। ] খিলাফতে রাশেদার এই কার্যক্রম, বরং স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই জীবনাদর্শ থেকে যে মূলনীতি নির্গত হয় তা এই যে, রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে অবশ্যই পরামর্শ করবেন, কিন্তু সেই পরামর্শ যার তার কিংবা নিজের খেয়ালখুশি মতো মনোনীত লোকদের সাথে করবেন, যাদের স্বার্থহীনতা, নিষ্ঠাপূর্ণ কল্যাণ কামিতা এবং যোগ্যতা সম্পর্কে জনগণ নিশ্চিন্ত, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তসমূহে যাদের অংশ গ্রহণ এই বিষয়ের গ্যারান্টি যে, ঐ সিদ্ধন্তের পেছনে গোটা জাতির সমর্থন আছে বলে প্রমাণ করে। আর জনগণের আস্থাভাজন লোক কে কে, তা জানার যে উপায় ইসলামের প্রথম যুগে তখনকার বিশেষ পরিস্থিতিতে কার্যকরী ছিলো, আজ তা কোথাও পাওয়া যেতে পারেনা। আর সেকালের তামুদ্দুনিক অবস্থায় যেসব প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা ছিলো তাও আজ বর্তমান নেই। কাজেই বর্তমান যুগের অবস্থার দৃষ্টিতে ও আজকের প্রয়োজন মুতাবিক জাতির আস্থাভাজন ব্যক্তিদেরকে সঠিকভাবে নির্বাচিত করার জন্য আধুনিককালের উদ্ভাবিত সংগত ও নির্দোষ পন্থাসমূহও গ্রহণ করা যেতে পারে। বর্তমান যুগের নির্বাচন পদ্ধতিও এই সংগত পন্থাসমূহের অন্যতম। এই পন্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু যেসব দুর্নীতি ও অসদুপায় অবলম্বনের অবাধ সুযোগ গণতন্ত্রকে একটি বিদ্রূপে পরিণত করেছে, সেসব কলংকময় ও অবাঞ্ছিত পন্থা কিছুতেই বরদাশত করা যেতে পারেনা।
সরকারের কাঠামো ও তার ধরন
অতপর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে সরকারের কাঠামো ও ধরন কি রূপ? এই প্রসংগে খিলাফতে রাশেদার যুগের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করলে আমরা সুস্পষ্টরূপে জানতে পারি যে, ঐ যুগে আমীরুল মুমিনীন [ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি] ছিলেন সে মূল ব্যক্তি যার নিকট নির্দেশ শোনার ও আনুগত্য করার শপথ গ্রহণ করা হতো এবং যাকে আস্থাভাজন ব্যক্তি নে করে জনসাধারণ তাদের সামগ্রিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহ, অর্থাৎ সরকার পরিচালনার সর্বময় দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব তার উপর ন্যস্ত করতো। আমীরুল মুমিনীনের মর্যাদা ইংলন্ডের রাজা ও প্রধানমন্ত্রী, ফ্রান্স ও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি এবং রাশিয়ার ষ্ট্যালিন প্রমুখের মর্যাদা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিলো। তিনি নিছক রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেননা বরং মন্ত্রীপরিষদের প্রধানও তিনিই ছিলেন। তিনি সশরীরে মজলিসে শূরায়ও উপস্থিত হতেন এবং সভাপতিত্বও করতেন। প্রত্যেক আলোচনায়ও তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন, নিজ সরকারের সকল কাজের জবাবদিহি করতেন এবং নিজের দায়দায়িত্বের হিসেব নিজেই পেশ করতেন। তাঁর পার্লামেন্টে না ছিলো ‘সরকারী দল’ আর না ছিলো ‘বিরোধী দল’[। তিনি সত্যের অনুগামী হলে গোটা পার্লামেন্ট [শূরা] তার দল হিসেবেই কাজ করতো। আবার সমগ্র পার্লামেন্ট তার বিরোধী হয়ে যেতো, যদি তাকে ভুল বা বাতিল পথে অগ্রসর হতে দেখা যেতো। পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্যই ছিলো স্বাধীন, যে বিষয়ে তার মতৈক্য হতো তা প্রকাশ্যভাবে সমর্থন করতেন, আবার যে ব্যাপারে তার মতবিরোধ হতো প্রকাশ্যভাবে তার বিরোধীতা করতেন। খলীফার নিজের মন্ত্রীসভা পর্যন্ত পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে পারতেন। তারপরও ‘রাষ্ট্রপতিত্ব’ এবং মন্ত্রীত্বের মধ্যে পূর্ণ বিশ্বস্ততা ও সহযোগিতা বিদ্যমান থাকতো এবং কোনো পক্ষেরই ইস্তফা দেয়ার প্রশ্নই উঠতোনা। খলীফা কেবল পার্লামেন্টের নিকট দায়ী ছিলেননা, সমগ্র জাতির সামনেই তিনি প্রত্যেক কাজের, এমন কি নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কেও জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন। তিনি দিনরাত পাঁচটি সময় মসজিদে জনগণের সম্মুখীন হতেন, প্রত্যেক জুময়ার দিন তিনি জনগণের সম্মুখে বক্তৃতা দিতেন। জনসাধারণ তাদের শহরের অলি গলিতে প্রত্যেক দিন তাঁকে চলাফেরা করতো এবং দেখতো এবং যে কোনো ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করতে বা সমালোচনা করতে পারতো। প্রত্যেক নাগরিকিই যে কোনো সময় তার পরিধেয় টেনে ধরে নিজের প্রাপ্য দাবী করতে পারতো। তার নিকট কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হলে সেখানে বর্তমান কালের ধরাবান্ধা নিয়ম অনুযায়ী পার্লামেন্টারী প্রথায় করার প্রয়োজন হতোনা। তাঁর সাধারণ ঘোষণা ছিলো:
“আমি যদি সঠিক কাজ করি তবে তোমরা আমার সাহায্য করো। আর আমি যদি অসদাচরণ করি তবে তোমরা আমাকে “সোজা” করে দিবে। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের অনুসরণ করতে থাকবো, তোমরা ততক্ষণ আমার আনুগত্য করবে। আর আমি যদি আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের নাফরমানী করি, তবে আমার আনুগত্য করা তোমাদের মোটেই কর্তব্র হবেনা।” [মুহাম্মদ হুসাইন হায়কাল, আবুবকর আস-সিদ্দীক, পৃঃ ৬৭]
এরূপ সরকার প্রণালীর সাথে বর্তমান যুগের অসংখ্য রাজনৈতিক পরিভাষার মধ্যে একটি পরিভাষারও সামঞ্জস্য না হলেও এই ধরনের শাসন পদ্ধতির সাথে ইসলামের পূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে। অতএব এটাই আমাদের আদর্শ নমুনা। কিন্তু এ ব্যবস্থা ঠিক তখন খাপ খেতে পারে, যখন গোটা সমাজ ইসলামের বিপ্লবী দৃষ্টিভংগি অনুসারে পূর্ণরূপে প্রস্তুত হবে। তাই মুসলিম সমাজের যখনই পতন শুরু হয়েছে তখন এরূপ সরকার পদ্ধতির সাথে তাঁর সামঞ্জস্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে গেলো। এখনো আমরা যদি এই আদর্শ নমুনার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে চাই, তবে প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে তা থেকে চারটি মূলনীতি আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে এবং তা বাস্তবায়িত করতে চেষ্টানুবর্তী হতে হবে।
১. সরকারের প্রকৃত দায়িত্ব যার উপরইন ন্যস্ত করা হবে, তিনি কেবল গণপ্রতিনিধিদেরিই নয় বরং জনগণের সম্মুখীন হতেও বাধ্য থাকবেন এবং নিজের যাবতীয় কাজর্ম শুধু পরামর্শের ভিত্তিতেই চলবেনা বরং নিজের কর্মকর্তাদের জন্যও তাকে জবাবদিহি করতে হবে।
২. বর্তমানে প্রচলিত দলীয় পদ্ধতি থেকে মুক্ত হতে হবে। কারণ এটা গোটা সরকার ব্যবস্থাকেই গোঁড়ামি ও দলীয় কোন্দলে জর্জরিত করে। এই প্রথার সুযোগেই বর্তমান সময় যে কোনো ক্ষমতালিপ্সু ও সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি ক্ষমতা দখল করে জনসাধারণের অর্থে নিজের একটি মুসাহিব গোষ্ঠী তৈরি করে নিতে পারে। অতপর অজস্র মানুষের গগণবিদারী চিজৎকার উপেক্ষা করে সেই মুসাহিব গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতায় জেঁকে বসে থাকবে।
৩. সরকার ব্যবস্থাকে বর্তমানের ন্যায় অত্যন্ত জটিল ও পেঁচালো নীতিমালার জালে জড়ানো বন্ধ করতে হবে। কারণ তাকে কর্মচারীদের পক্ষেকাজ করা হিসেব গ্রহণকারীদের পক্ষে হিসেব গ্রহণ করা এবং বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
৪. সর্বশেষ, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি এই যে, রাষ্ট্রপ্রধান ও পার্লামেন্টের সদস্য পদে এমন সব লোককে নিযুক্ত করতে হবে, যাদের মধ্যে ইসলাম প্রদত্ত অপরিহার্য গুণাবলী সর্বাপেক্ষা বেশী বিদ্যমান পাওয়া যায়।
৬. রাষ্ট্রপ্রধানের অপরিহার্য গুণাবলী ও যোগ্যতা
রাষ্ট্র প্রধানের গুণাবলী ও যোগ্যতার [Qualification] প্রশ্ন ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমি এতোদূর বলতে পারি যে, ইসলামী সংবিধান কার্যকরী হওয়া বা না হওয়া সম্পূর্ণ এরই উপর নির্ভর করে।
রাষ্ট্র প্রধান এবং মজলিসে শূরার [পার্লামেন্ট] সদস্য পদের জন্য একপ্রকারের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা তো আইনগত প্রকৃতির, যার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন বা একজন বিচারক যাচাই করে কোনো ব্যক্তির যোগ্য [Eligigle] হওয়া বা না হওয়ার ফয়সালা করেন। আরও একপ্রকারের যোগ্যতা বিদ্যমান থাকা জরুরী যার দৃষ্টিতে নির্বাচকমণ্ডলী প্রার্থ বাছাই করার এবং মনোয়ন দান করার কাজ সম্পন্ত করে এবং ভোট দাতাগণ ভোট প্রার্থীদের ভোট দেয়। প্রথম প্রকারের যোগ্যতা একটি দেশের কোটি কোটি বাসিন্দার প্রত্যেকের মধ্যেই বিদ্যমান পাওয়া যায়। কিন্তু এই দ্বিতীয় প্রকারের যোগ্যতা দুর্লভ, কোটি কোটি বাসিন্দাদের মধ্য হতে মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যেই তা পাওয়া যায়। প্রথম প্রকারের যোগ্যতার মানদন্ড শুধু সংবিধানের কয়েকটি কার্যোপযোগী ধারায় অন্তর্ভুক্ত [Operative Clauses] করার জন্য নির্ধারিত হয়, কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের যোগ্যতার মানদন্ড সমগ্র সংবিধানের প্রাণসত্তায় বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন। একটি সংবিধানের সাফল্য জনগণের মনমানসিকতাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সঠিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করার উপর নির্ভরশীল। একমাত্র এরূপ নির্বাচন পন্থাই সংবিধানের প্রাণসত্তা অনুসারে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্বাচন করা সম্ভব।
কুরআন এবং হাদীস এই উভয প্রকার যোগ্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে আলোচনা করেছে। প্রথম প্রকারের যোগ্যতার জন্য তা চারটি মানদন্ড নির্ধারণ করেছে।
১. তাকে মুসলমান হতে হবে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে:
“হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহ্র, আনুগত্য করো তাঁর রসূলের এবং সে লোকদের যারা তোমাদের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালক।” [সূরা আননিসা: ৫৯]
২. তাকে পুরুষ হতে হবে। কুরআন মজীদ বলে:
“পুরুষ নারীদের উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন।” [সূরা আননিসা: ৩৪]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“যে জাতি নিজের কাজের কর্তৃত্ব নারীর উপর সোপর্দ করলো, সে জাতি কখনো সফলকাম হতে পারবেনা।” [বুখারী]
৩. তাকে সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন এবং বালেগ হতে হবে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে:
“তোমাদের ধন সম্পদ যাকে আল্লাহ্ তোমাদের অস্তিত্ব রক্ষার উপকরণ বানিয়েছেন তা নির্বোধ লোকদের হাতে সোপর্দ করোনা।” [সূরা আননিসা: ৫]
৪. তাকে দারুল ইসলামের বাসিন্দা হতে হবে। কুরআন মজীদ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে:
“যার ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করে [দারুল ইসলামে] আসেনি, তাদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব তোমাদের নয়, যতক্ষণ না তারা হিজরত করে।” [সূরা আনফাল: ৭২]
এই হচ্ছে সে চারটি আইনগত যোগ্যতা। এ যোগ্যতা যার মধ্যে বিদ্যমান পাওয়া যাবে আইনের দৃষ্টিতে সে রাষ্ট্রপ্রধান বা পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে। কিন্তু এই আইনগত যোগ্যতাসম্পন্ন অসংখ্য লোকের মধ্যে কোন্ লোকদের উপরোক্ত দায়িত্বপূর্ণ পদসমূহের জন্য আমরা নির্বাচিত করবো, আর কাদের নির্বাচিত করবোনা কুরআান ও হাদীসে আমরা এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব পেয়ে যাই:
“আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন যে, আমানতসমূহ [দায়িত্বপূর্ণ পদ] আমানতদার [বিশ্বাসযোগ্য] লোকদের উপর সোপর্দ করো।” [সূরা আননিসা: ৫৮]
“তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক সম্মানিত সে ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক মুত্তাকী-আল্লাহ ভীরু।” [সূরা হুজুরাত: ১৩]
“নবী বললেন, আল্লাহ্ তায়ালা শাসন কার্যের জন্য তোমাদের উপর তাকে [তালূতকে] অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং তাকে বিদ্যাবুদ্ধি ও দৈহিক শক্তিতে সমৃদ্ধি দান করেছেন।” [সূরা বাকারা: ২৪৭]
“এমন ব্যক্তির আনুগত্য স্বীকার করোনা, যার মন আল্লাহর স্মরণ শূন্য, যে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কাজকর্ম সীমা লংঘনকারী।” [সূরা কাহ্ফ”: ২৮]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“যে কেউ বিদয়াতপন্থী ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলো সে ইসলামকে ধ্বংস করার কাজে সাহায্য করলো।” [বায়হাকী]
“আল্লাহর শপথ! এমন ব্যক্তিকে আমরা কখনো কোনো রাষ্ট্রীয় পদে নিযুক্ত করবোনা, যে নিজে তা পেতে চায় কিংবা তার জন্য ললায়িত হয়।” [বুখারী, মুসলিম]
“আমাদের দৃষ্টিতে পদপ্রার্থীই তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় অবিশ্বস্ত।” [আবু দাউদ]
উল্লেীখত গুণাবলীর কতকগুলোকে আমরা অনায়াসেই আমাদের সংবিধানের ব্যবহারিক ধারা হিসেবে বিধিবদ্ধ করে নিতে পার। যথা: পদপ্রার্থীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। অন্যান্য যেসব গুণকে আইনের আওতার মধ্যে সুনির্ধারিতভাবে গণ্য করা যায়না সেগুলিকে আমাদের সংবিধানের নীতিনির্ধারক মূলনীতি হিসেবে গণ্য করা উচিৎ। এবং রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য ইসলামের দৃষ্টিাতে অপরিহার্য গুণাবলী সম্পর্কে প্রত্যেক নির্বাচনের সময় জনগণকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করা নির্বাচক মণ্ডলীর অন্যতম কর্তব্য হিসেবে ধার্য করে দিতে হবে।
৭. নাগরিকত্ব ও তার ভিত্তি
এখন নাগরিকত্বের বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। ইসলাম যেহেতু চিন্তা ও কর্মের একটি পূর্ণাংগ ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থার ভিত্তিতে সে একটি রাষ্ট্রও কায়েম করে। তাই ইসলাম তার রাষ্ট্রের নাগরিকত্বকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে। উপরন্তু সততা ও ন্যায় পরায়ণতা যেহেতু ইসলামের মূল প্রাণসত্তা, তাই কোনো প্রকার ধোঁকা বা প্রতারণা ব্যতিরেকেই সে নাগরিকত্বের এই দুই শ্রেণীকে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছে। মুখে মুখে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দানের কথা বলে এবং কার্যত তাদের মধ্যে কেবল পার্থক্য করেই নয় বরং তাদের বিরাট অংশকে মানবীয় অধিকার দিতেও কুণ্ঠিত হওয়ার মতো মারাত্মক প্রতারণা কিছুইতে ইসলাম করতে পারেনা। যেমন আমেরিকায় নিগ্রোদের, রাশিয়ায় অ-কমিউনিষ্টদের এবং দুনিয়ার সমস্ত ধর্মহীন গণতন্ত্রের [Secular Democracy] রাষ্ট্রে দেশের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার বর্জিত দুরাবস্থার কথা দুনিয়ার কার না জানা আছে?
ইসলাম নাগরিকদের নিম্নোক্ত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে:
১. মুসলিম।
২. জিম্মী [অমুসলিম]
১. মুসলিম নাগরিকদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে:
“যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং নিজেদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে; আর যারা তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের সাহায্য করেছে, তারা একে অপরের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক। পক্ষান্তরে যারা [শুধু] ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করে [দারুল ইসলামে] চলে আসেনি, তাদের বন্ধুতা ও পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব তোমাদের নয়- যতক্ষণ না তারা হিজরত করলো।” [সূরা আনফাল: ৭২]
এ আয়াতে নাগরিকত্বের দুইটি ভিত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ঈমান, দ্বিতীয় দারুল ইসলামে [ইসলামী রাষ্ট্রের] প্রজা [পূর্ব থেকেই কিংবা পরে] হওয়া। একজন মুসলমান তার ঈমান আছে; কিন্তু কাফেরী রাজ্যের আনুগত্য ত্যাগ করে হিজরত করে দারুল ইসলামে এসে যদি বসবাস করতে শুরু না করে, তবে সে দারুল ইসলামের নাগরিক বলে বিবেচিত হতে পারেনা। পক্ষান্তরে দারুল ইসলমের সকল ঈমানদার বাসিন্দাগণ দারুল ইসলামের নাগরিক, তাদের জন্ম দারুল ইসলামে হোক কিংবা দারুল কুফর থেকে হিজরত করেই আসুক এবং তারা পরস্পর পরস্পরের সাহায্যকারী ও সহযোগী। [হিজরত করে যারা আসে তাদের সম্পর্কে কুরআন একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের কথা বলেছে যে, এই ধরনের লোকদের পরীক্ষা [Examine] করে দেখা আবশ্যক [সূরা মুমতাহিনা, ১০ নং আয়াত দ্রঃ]। এই ব্যবস্থা যদিও মুহাজির স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু তা থেকে এই সাধারণ মূলনীতি জানা যায় যে, বহিরাগত ও হিজরতের দাবিদার ব্যক্তিকে দারুল ইসলামে গ্রহণ করার পূর্বে তার প্রকৃত মুসলমান ও মুহাজির হওয়া সম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করতে হবে। যাতে করে হিজরতের সুযোগে ভিন্ন উদ্দেশ্য সম্পন্ কোনো লোক দারুল ইসলামে প্রবেশ করতে না পারে। কোনো ব্যক্তির প্রকৃত ঈমানের অবস্থা আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ জানতে পারে না, কিন্তু বাহ্যিক উপায়ে যতদূর যাচাই করা সম্ভব তা করতে হবে।]
এই মুসিলম নাগরিকদের উপরই ইসলাম তার পরিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার দায়িত্বভার চাপিয়ে দিয়েছে। কারণ তারাই নীতিগতভাবে এই ব্যবস্থাকে সত্য বলে মানে। তাদের উপর ইসলাম তার পরিপূর্ণ আইন জারী করে, তাদেরকেই তার সমগ্র ধর্মীয়, নৈতিক, তামাদ্দুনিক এবং রাজণৈতিক বিধানের অনুসারী হতে বাধ্য করে। তার যাবতীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের ভারও সে তাদের উপরই অর্পণ করে। দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা জন্য সকল প্রকার কুরবানী সে কেবল তাদের নিকটই দাবী করে। অতঃপর সে এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা নির্বাচনের অধিকারও তাদেরই দান করে এবং তার পরিচালনার জন্য সংসদে অংশগ্রহণ এবং তার দায়িত্বপূর্ণ পদসমূহে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগও তারাই লাভ করে। যাতে এই আদর্শবাদী রাষ্ট্রের কর্মসূচী ঠিক তার মূলনীতিসমূহের সাথে সংগতি রেখে বাস্তবায়িত হতে পারে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনকাল এবং খিলাফতে রাশেদার স্বর্ণযুগ উল্লিখিত মূলনীতির সত্যতা ও যৌক্তিকতার দৃষ্টান্ত। যেমন এ সময় শূরার সদস্য হিসেবে কোনো প্রদেশের গভর্ণর হিসেবে কিংবা সরকারী কোনো বিভাগের মন্ত্রী, সেক্রেটারী, বিচারক বা সৈন্য বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে কোনো যিম্মীকে নিযুক্ত করা হয়নি। খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারেও তাদের অংশ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি। অথচ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেও ইসলামী রাষ্ট্রে তারা বর্তমান ছিলো। একথা আমাদের বুঝে আসেনা যে, এসব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের অংশ গ্রহণের যদি কোনো অধিকারই থাকতো, তবে আল্লাহর নবী তাদের সে অধিকার কিভাবে হরণ করতে পারেন এবং স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের নিকট সরাসরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকগণ ক্রমাগতভাবে ত্রিশ বছর পর্যন্ত কেমন করে তাদের অধিকার আদায় না করে থাকতে পারেন।
২. যিম্মী নাগরিক বলতে সেসব অমুসলিমকে বুঝায় যারা ইসলামী রাষ্ট্রের চতুর্সীমার মধ্যে বসবাস করে তার আনুগত্য ও আইন পালন করে চলার অংগীকার করবে, চাই তারা দারুল ইসলামে জন্ম গ্রহণ করে থাকুক কি বাইরের কোনো কাফের রাজ্যে [দারুল কুফর] থেকে এসে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা হওয়ার আবেদন করে থাকুক। এই দিক দিয়ে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়না। ইসলাম এই শ্রেণীর নাগরিকদের ধর্ম, সাংস্কৃতি, ব্যক্তি আইন [Personal Law] এবং জান মাল ও সম্মানের পূর্ণ নিরাপত্তা দান করে। তাদের উপর রাষ্ট্রের কেবল গণসাধারণ [Public Law] জারী করা হবে। এই গণআইনের দৃষ্টিতে তাদেরকেও মুসলমান নাগরিকদের সমান অধিকার ও মর্যাদা দেয়া হয়। দায়িত্বসম্পন্ন পদ [Key post] ব্যতীত সকল প্রকার চাকুরীতেও তাদের নিযুক্ত করা যাবে। নাগরিক স্বাধীনতাও তারা মুসলমানদের সমান ভোগ করবে, অর্থনৈতিক ব্যাপারেও তাদের সাথে মুসলমানদের অপেক্ষা কোনোরূপ স্বতন্ত্র আচরণ করা হয়না। রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে তা সম্পূর্ণরূপে মুসলমামনদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
এই দুই শ্রেণীর নাগরিকত্ব ও তার পৃথক পৃথক মর্যাদা সম্পর্কে কারো আপত্তি থাকলে সে যেনো পৃথিবীর অন্যান্য আদর্শবাদী রাষ্ট্র অথবা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র- তার মূলনীতিসমূহ মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী সংখ্যালঘু নাগরিকদের প্রতি যে আচরণ করে সে দিকে দৃষ্টিপাত করে। বাস্তবিকই একথাই চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায় যে, একটি রাষ্ট্রের মধ্যে তার মূলনীতির সম্পূর্ণ পৃথক মূলনীতিতে বিশ্বাসী, যা অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে, ইসলামের চেয়ে অধিক ইনসাফ, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও বদান্যতার সাথে অন্য কোনো ব্যবস্থা সে জটিলতার সমাধান করেনি। অন্যরা ও জটিলতার সমাধান প্রায়িই দুইটি পন্থায় করেছে; হয় তাকে [সংখ্যা লঘূকে] নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করেছে অথবা শূদ্র বা অস্পৃশ্য শ্রেণী বানিয়ে রেখেছে। ইসলাম উপরোক্ত পন্থার পরিবর্তে তার নীতিমালা মান্যকারী ও অমান্যকারীদের মধ্যে ন্যায়ানুগ একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়অর পন্থা গ্রহণ করেছে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে তার নীতিমালা পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে বাধ্য করে এবং উক্ত নীতিমালা অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বভার তাদের উপর অর্পণ করে। আর যারা নীতিমালার অনুসারী নয় তাদেরকে সে দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য অত্যাবশ্যক সীমা পর্যন্ত তার বিধান মানতে বাধ্য করে। ইসলাম তাদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়ার সাথে সাথে তাদের যাবতীয় সাংস্কৃতি ও মানবীয় অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে।
৮. নাগরিক অধিকার
এরপর আমাকে বলতে হবে যে, ইসলামে নাগরিকদের কি কি মৌলিক অধিকার [Fundamental Rights] স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
সর্ব প্রথম ইসলাম নাগরিকদের জান মাল ও ইজ্জত আব্রুর পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকার দান করেছে। আইন সংগত বৈধ কারণসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো কারণে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবেনা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম প্রচুর সংখ্যক হাদীসে এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। বিদায় হজ্জের প্রাক্কালে তিতিন তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ভাষণে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার নীতিমালা বর্ণনা করেছেন। সে ভাষণে তিনি বলেছেন:
“তোমাদের জান, তোমাদের মাল, তোমাদের মান সম্মান তদ্রূপ সম্মানার্হ [হারাম] যেমন আজকের এই হজ্জের দিনটি সম্মানার্হ।”
কেবল একটি অবস্থায় তা সম্মানার্হ [হারাম] থাকবেনা। তা তিনি অপর এক হাদীসে এভাবে বলেছেন:
“ইসলামী আইনের আওতায় কারো জান মাল অথবা ইজ্জত আব্রুর উপর কোনো হক [অধিকার] প্রমাণিত হলে আইন অনুমোদিত পন্থায় অবশ্যই তা আদায় করতে হবে।”
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে, যে কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সংরক্ষণ। দেশে প্রচলিত এবং সর্বজন স্বীকৃত আইন সংগত পন্থায় দোষ প্রমাণ না করে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে ইসলামে কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করা যায়না। সুনানে আবু দাউদ- এর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
একদা মদীনার কিছু সংখ্যক লোক কোনো সন্দেহের কারণে বন্দী হয়েছিলো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে ভাষণদানরত থাকা অবস্থায় একজন সাহাবী দন্ডায়মান হয়ে তাঁর নিকট আরজ করলেন, আমার প্রতিবেশীদেরকে কোন্ অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রশ্নের প্রথম ও দ্বিতীয বারে কোনো উত্তর না দিয়ে নীরব থাকলেন। শহরের পুলিশ প্রধানকে তাদের গ্রেপ্তারের সংগত কোনো কারণ থাকলে তা পেশ করার সুযোগ দেয়ার জন্য তিনি (স) নিরুত্তর থাকলেন। ঐ সাহাবী তৃতীয় বার তাঁর প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে এবং পুলিশ প্রধান নিরুত্তর থাকলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বললেন:
“তার প্রতিবেশীদের ছেড়ে দাও।” [আবু দাউদ, কিতাবুল কাদা]
উপরোক্ত ঘটনা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধে দোষী সাব্যস্ত না করা পর্যন্ত কোনো নাগরিককে গ্রেপ্তার করা যাবেনা। ইমাম খাত্তাবী [র] তাঁর “মায়ালিমুস সুনান” গ্রন্থে উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন: “ইসলামে শুধু দুই প্রকারে গ্রেপ্তারী বৈধ। [এক] শাস্তিস্বরূপ আটক করা অর্থাৎ আদালতের রায়ে কোনো নাগরিককে কয়েদীর শাস্তি প্রদান করা হলে তাকে আটক করা। নিঃসন্দেহে এই আটক সম্পূর্ণ সংগত। [দুই] তদন্তের জন্য আটক করা অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তি বাইরে থাকলে তদন্তকার্য ব্যাহত হতে পারে এরূপ আশংকা থাকলে তাকে কয়েদ করা যেতে পারে। এতদ্ব্যতীত অন্য প্রকারের আটক বৈধ নয়।” [মায়ালিমুস সুনান, কিতাবুল কাদা]
ইমাম আবু ইউসুফ [র] তাঁর “কিতাবুল খারাজ” গ্রন্থে এই একই কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, কোনো ব্যক্তিকে নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বন্দী করা যাবেনা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম কেবল দোষারোপের ভিত্তিতেই কাউকে বন্দী করতেননা। বাদী ও বিবাদী উভয়কে আদালতে হাযির হতে হবে। সেখানে বাদী দলীল প্রমাণসহ তার দাবী উত্থাপন করবে। সে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করতে ব্যর্থ হলে বিবাদীকে বেকসুর খালাস দিতে হবে। [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ১০৭]
হযরত উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও একটি মুকদ্দমার রায় দিতে গিয়ে ঘোষণা করেন:
“ইসলামে কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা যাবেনা।” [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, বাব শারতিশ শাহিদ]
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার হচ্ছে, মত প্রকাশের এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বিষয়টি সম্পর্কে ইসলামী আইনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। তাঁর খিলাফত আমলে খারিজী সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় হয়েছিলো। বর্তমানকালের নৈরাজ্যবাদী [Nihilist] দলসমূহের সাথে তাদের অনেকটা সামঞ্জস্য ছিলো। আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর খিলাফতকালে তারা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই অস্বীকার করতো এবং অস্ত্রবলে এর অস্তিত্ব বিলোপের জন্য বদ্ধপরিকর ছিলো। আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এই অবস্থায় তাদেরকে নিম্নোক্ত পয়গাম পাঠান:
“তোমরা যেখানে ইচ্ছা বসবাস করতে পারো। তোমাদের ও আমদের মধ্যে এই চুক্তি রইলো যে, তোমরা রক্তপাত করবেনা, ডাকাতকি করবেনা এবং কারও উপর যুলুম করবেনা।” [নায়লুল আওতার, ৭ম খন্ড, পৃঃ ১৩০]
অপর এক জায়গায় তিনি তাদের বলেন:
“তোমরা যতক্ষণ বিপর্যয় ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করবেনা, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তোমাদের উপর আক্রণ করবোনা।” [নায়লুল আওতার, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ১৩৩]
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোনো দলের মতবাদ যাই হোক না কেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মত যেভাবেই প্রকাশ করুক না কেন, ইসলামী রাষ্ট্র তাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেনা। কিন্তু তারা যদি নিজেদের মত শক্তিকে প্রয়োগে [By violent Means] বাস্তবায়িত করতে এবং রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা চূর্ণ বিচূর্ণ করার চেষ্টা করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরও একটি মৌলিক অধিকারের প্রতি ইসলাম যথেষ্ট জোর দিয়েছে। তাহলো ইসলামী রাষ্ট্র তার চতুঃসীমার মধ্যে বসবাসকারী কোনা নাগরিককে তার জীবন যাপনের মৌলিক প্রয়েঅজন থেকে বঞ্চিত রাখতে পারবেনা। ইসলাম এ উদ্দেশ্যে যাকাত প্রদান ফরয করেছে এবং এ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“তাদের ধনীদের নিকট থেকে তা আদায় করা হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্যে তা বন্টন করা হবে।” [বুখারী ও মুসলিম]
অপর এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম মূলনীতি হিসেবে ইরশাদ করেন:
“যার পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক নেই, তার পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার।”
অপর এক হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“মৃত ব্যক্তি যে বোঝা [ঋণ অথবা পরিবারের অসহায় সদস্য] রেখে গেলো তার দায়িত্ব আমাদের উপর।” [বুখারী ও মুসলিম]
এ ক্ষেত্রে ইসলাম মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে মোটেই পার্থক্য করেনি। কোনো নাগরিককেই অন্ন ব্ত্র ও আশ্রয়হীন অবস্থায় ত্যাগ করা যাবেনা। ইসলাম মুসলিম নাগরিকদের মতো তার অমুসিলম নাগরিকদের অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থানের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। হযরত উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু এক ইহুদী বৃদ্ধকে ভিক্ষা করতে দেখে তার উপর আরোপিত কর মওকুফ করেন এবং তার জন্য রাজকোষ থেকে ভাতা মঞ্জুর করে রাজকোষে কর্মকরতাকে লিখে পাঠান:
“আল্লাহর শপথ! এ লোকটির যৌবনকালে যদি তার দ্বারা কাজ করিয়ে থাকি এবং এখন তার এই বার্ধক্যে তাকে নিরূপায় অবস্থায় ত্যাগ করি তবে তার সাথে মোটেই সুবিচার করা হবেনা।” [ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৭২]
হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হীরা নামক এলাকার অমুসলিম নাগরিকদের জন্য যে চুক্তিপত্র লিখে দিয়েছিলেন তাতে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছিলো যে, যে ব্যক্তি বার্ধক্রে পৌঁছবে, অথবা যে ব্যক্তি আকস্মিক বিপদে পিতিত হবে, অথবা যে ব্যক্তি গরীব হয়ে যাবে তার নিকট থেকে কর আদায় করার পরিবর্তে রাজকোষ থেকে তার এবং তার পরিবার পরিজনের জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-৮৫]
৯. নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের অধিকার
নাগরিকদের প্রদত্ত এসব অধিকারের বিপরীতে তাদের উপর রাষ্ট্রেরও কতোগুলো অধিকার বর্তায়। এর মধ্যে সর্বপ্রথম অধিকার হচ্ছে, তাদের আনুগত্য লাভের অধিকার। ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয় “শ্রবণ করা ও মেনে চলা”। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন:
“শ্রবণ করা, অনুসরণ করা ও মেনে চলা অসময়ে ও সুসময়ে এবং আনন্দ ও নিরানন্দ সকল অবস্থায় অপরিহার্য।”
অর্থাৎ কোনো আইন নাগরিকদের পছন্দ হোক বা অপছন্দনীয় হোক, সহজসাধ্য হোক বা কষ্টসাধ্য হোক, তা মান্য করা এবং পালন করা সকলের জন্যই অপরিহার্য।
ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরকগণ হবে ইসলামী রাষ্ট্রের বন্ধু ও হিতাকাংখী। নাগরিকদরে উপর এটা ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কুরআন মজীদে ও সুন্নাতে রসূলে একথা প্রকাশের জন্য ‘নুসহ’ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এই শব্দটির ভাবার্থ [Loyalty] [রাজানুগত্য] ও [Allegiance] [রাজানুগত্য] শব্দদ্বয়ের তুলনায় অধিকতর ব্যাপক। এর দাবী এই যে, প্রত্যেক নাগরিক আন্তরিক ও নিষ্ঠা সহকারে রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনা করবে এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কাজ বরদাশত করবেনা, রাষ্ট্রের কল্যাণ ও মঙ্গলের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক রাখবে।
শুধু তাই নয়, ইসলামী রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের উপর এর চেয়েও কঠিন কর্তব্য চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ইসলামী সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা করা নাগরিকদের অপরিহার্য কর্তব্য। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান এবং তার উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনবোধে নিজেদের জান মাল উৎসর্গ করতে তারা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হলে কুরআন মজীদ তাকে “প্রকাশ্য মুনাফিক” বলে সাব্যস্ত করেছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে রাষ্ট্রের যে বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে সেই বৈশিষ্ট্যযুক্ত রাষ্ট্রকেই আমরা “ইসলামী রাষ্ট্র” হিসেবে আখ্যায়িত করি। এ পদ্ধতির রাষ্ট্রকে আধুনিকালের পরিভাষায় যে নামেই অভিহিত করা হোক, সেকুলার [ধর্মহীন], গণতান্ত্রিক বা ধর্মতান্ত্রিক ইত্যাদি যাই বলা হোক, তাতে কিচুমাত্র যায় আসেনা। কারণ পরিভাষা বা নাম নিয়ে আমাদের কোনো বিতর্ক নেই। আমাদের বক্তব্য এই যে, আমরা যে ইসলামকে মান্য করার দাবী করি, আমাদের জীবন ব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থা সে ইসলামের নির্ধারিত মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হোক।