ইসলাম ও সভ্যতা
ইসলাম বিরোধীদের প্রশ্ন
“তোমরা কি চাও যে, আমরা আজ তেকে হাজার হাজার বছরের পুরানো তাবুতে বসবাসকারী যাযাবরদের ন্যায় জীবনযাপন করি? মরুবাসী বর্বর বেদুঈনদের জন্যে ইসলাম ছিল সম্পূর্ণ উপযুক্ত; তাদের অভাব ও প্রয়োজনের তুলনায় উহাই ছিল যথেষ্ট। উহার সরলতায় তাদের জন্যে আকর্ষণও ছিল প্রচুর। কিন্তু আধুনিক যুগে যেখানে শব্দের চেয়েও অধিক দ্রুতগতিসম্পন্ন উড়োজাহাজ, মহা ধ্বংসাত্মক হাইড্রোজেন বোমা এবং চিত্তাকর্ষক চলচিত্রের জয় জয়কার চলসে সেখানে এমন কোন সভ্যতার কথা কল্পনা করা যায় কি যার ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর স্বীকৃতি এবং তার প্রতি ঈমান আনার উপর এবং এ যুগের সভ্যতার মাপকাঠিতে যা উত্তীর্ণ হতে সক্ষম নয়? কেননা সেটি হচ্ছে স্থবির, সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে একেবারেই অক্ষম। সুতরাং উহার বন্ধন থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এ যুগের উন্নত ও সুসভ্য জাতিগুলোর কাতারে আমরা দাঁড়াতে পারবো না।”
কিছুকাল পূর্বে একজন শিক্ষিত ইংরেজের সাথে আলোচনা কালে এই সকল প্রশ্নের সাথে আমি পরিচিত হই। এই ব্যক্তি ইউ. এন. ও. এর-একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে বিগত দু’ বছর ধরে মিসরে অবস্থান করছিলেন। [প্রকাশ থাকে যে, মূল আরবী পুস্তক ১৯৫৩ খৃস্টাব্দে মিসরে মুদ্রিত হয়।] এই প্রতিনিধি দলের উদ্দেশ্য ছিল মিসরীয় কিষাণদের জীবন-যাপনের মান উন্নত করার কাজে মিসর সরকারকে সাহায্য ও দিকনির্দেশনা প্রদান করা। কিন্তু এলাকার লোকদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও যেহেতু প্রতিনিধি দলে এমন কেউ ছিলেন না যিনি মিসরীয়দের ভাষা বুঝতে সক্ষম। এ কারণে মিসর সরকার স্থানীয় কিষাণদের এবং প্রতিনিধি দলের মধ্যে দোভাষীর কাজ সম্পাদন করার দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করেন। উপরোক্ত ইংরেজ ব্যক্তির সাথে আমার এই সূত্রেই পরিচয় ঘটে।
প্রথমবার সাক্ষাতের সময়েই আমি উক্ত ইংরেজকে বুঝিয়ে দিলাম: মিসরের লোকেরা ইংরেজদের ঘৃণা করে এবং ততদিনই ঘৃণা করতে থাকবে যতদিন তারা প্রাচ্যের একটি দেশেও তাদের অত্যাচার আক্রমণমূলক কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখবে। আমি তাকে একথাও জানিয়ে দিলাম যে, তাদের মিত্র দেশগুলো (যেমন আমেরিকা) সম্পর্কেও আমরা একই ধারণা পোষণ করি। কেননা তারা মিসর, ফিলিস্তিন ও অন্যান্য সমস্যার ক্ষেত্রে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আমার একথা শুনে সে হতবাক হয়ে গেল এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই আমাকে প্রশ্ন করলো: “তুমি কি একজন কমিউনিষ্ট?”
তার প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম: আমি কমিউনিস্ট নই, একজন মুসলমান। ইসলাম নামে আমার নিকট এমন একটি সংস্কৃতি ও জীবন পদ্ধতি বর্তমান যা সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ উভয়টির চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। কেননা জীবনের সকলদিক ও বিভাগের সমাধানই এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রত্যেকটি বিভাগই অন্য বিভাগের সাথে সামঞ্জস্যশীল।
দীর্গ ৩ ঘন্টা পর্যন্ত আলোচনার পর সে বলতে শুরু করলা: ইসলাম সম্পর্কে আপনি যা বললেন তা হয়ত সবই ঠিক। কিন্তু আমার সাথে যতটুকু সম্পর্ক বর্তমান তাতে একথা না বলে পারছি না যে, আধুনিক সভ্যতার সুফল থেকে আমি বঞ্চিত থাকতে পারি না। আমি উড়োজাহাজে ভ্রমণ করা বন্ধ করতে পারি না। রেডিওর মনমাতানো সংগীতকে বর্জন করতে পারি না এবং আরাম-আয়েশ ও বিলাস-ব্যসনের উপায়-উপাদানকেও ত্যাগ করতে পারি না।
তার উত্তর শুনে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। পর মুহূর্তেই আমি তাকে বললাম: “কেউ তো আপনাকে এগুলো বন্ধ করতে বলছে না।”
সে বলল: “তাহলে ইসলম গ্রহণ করার অর্থ কি যাযাবর ও বেদুইন জীবনে ফিরে যাওয়া নয়?”
ভিত্তিহীন প্রশ্নাবলী
ইসলামের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপনকারীরা সাধারণত উপরোক্ত রূপ প্রশ্নই করে থাকে। কিন্তু যারা বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের অধ্যয়ন করে থাকেন তারা অবশ্যই অবগত আছেন যে, এই সকল সংশয় ও প্রশ্নের আদৌ কোন ভিত্তি নেই। কেননা ইসলামে এমন একটি মুহূর্তও নেই যখন উহা মানুষের প্রগতি ও সভ্যতার পথে কোন বাধার সৃষ্টি করেছে।
ইসলাম প্রথম যাদের নিকট এসেছে তাদের বেশীর ভাগই ছিল বেদুইন। তারা সভ্যতা থেকে এতখানি দূরবর্তী ও পাষান হৃদয় ছিল যে, স্বয়ং আল্লাহ পাক তাদের সম্পর্কে এরশাদ করেন: (আরবী************)
“এই আরব বেদুইনরা আল্লাহদ্রোহিতা ও কপটতায় বড় কঠিন ছিল।” –(সূরা আত তাওবা: ৯৭)
ইসলামের মহা অলৌকিক শক্তি
ইসলামের একটি বড় অলৌকিক ব্যাপার (Miracle) হলো আরবের বর্বর ও কট্টর বেদুইনদেরকে একটি অখণ্ড জাতিতে পরিণত করে দিয়েছে। পশুত্বের স্তর থেকে মুক্ত করে তাদেরকে মানসিকতার মহান ও উন্নত মূল্যবোধের সাথে পরিচিত করে দিয়েছে শুধু তা-ই নয়, ইসলাম তাদেরকে অন্যদের পথপ্রদর্শক এবং আল্লাহর দ্বীনের আহ্বায়ক হওয়ার অনন্য গৌরবেও ভূষিত করেছে। ইসলাম মানুষকে যে সভ্য, সংস্কৃতিবান ও পবিত্র করে তুলতে সক্ষম তাহলো এরই সুস্পষ্ট উদাহরণ।
ইসলামী সভ্যতা এবং আধ্যাত্মিক ও বাস্তব জীবন
মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে তোলা নিসন্দেহে এক মহান লক্ষ্য। মানুষের যাবতীয় চেষ্টা ও সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্য এটাই। মানবীয় সভ্যতার প্রকৃত উদ্দেশ্যও এর চেয়ে ভিন্নতর কিছুই নয়। কিন্তু ইসলাম শুধু আত্মার সংশোধনকেই যথেষ্ট মনে করে না, বরং সাথে সাথে সভ্যতার সেই সকল আচার-অনুষ্ঠানকেও অব্যাহত রাখে যেগুলোকে বর্তমান যুগে জীবনের প্রকৃত আনন্দ বলে মনে করে। এ কারণেই ইসলাম বিজিত দেশসমূহের যে সকল আচার-অনুষ্ঠান তাওহীদ বা ইসলাম বিরোধী নয় সেগুলোকে শুধু চালু রাখার অনুমতিই দেয়নি, বরং যথারীতি উহার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
প্রাচীন গীস ও ইলা,
ইসলাম প্রাচীন গ্রীসের নিকট পাওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের শুধু সংরক্ষণই করেনি, উহার পৃষ্ঠপোষকতাও করছে। চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, অংকশাস্ত্র, পদর্থবিদ্যা, রসায়ন বিজ্ঞান এবং দর্শনশাস্ত্র এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসলাম এই জ্ঞানভাণ্ডারের শুধু হেফাজতই করেনি, বরং উহাকে আরো পরিবর্তিত করেছে। মুসলমানগণ এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণা কার্যে কতদূর উৎসাহী তা এর দ্বারাই প্রমাণিত হয়। বস্তুত ইউরোপের পুনর্জাগৃতি আন্দোলন (Renaissance) এবং বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক প্রগতির মূলভিত্তি হচ্ছে স্পেনীয় মুসলমানদরে বৈজ্ঞানিক অবদান। মোটকথা ইসলামী ইতিহাসের কোন যুগেই কেউ সভ্যতার পথে বাধার সৃষ্টি করেনি।
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্বন্ধে ইসলামের দৃষ্টিভংগি
পূর্ববর্তী সভ্যতা সম্পর্কে ইসলামের যে দৃষ্টিভংগি ছিল আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কেও ইসলাম সেই একই রূপ দৃষ্টিভংগি পোষণ করে। ইসলাম উহার কল্যাণকর দিকগুলোকে কখনো অস্বীকার করে না কিন্তু উহার ধ্বংসাত্মক ও মানবতাবিরোধী আচার-আচরণকে কখনো গ্রহণ করে না। ইসলাম উহার অনুসারীগণকে বৈজ্ঞানিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বল্গাহীনভাবে আজাদ করে দেয়ার পক্ষপাতী নয়। অন্যান্য সভ্যতার সাথে ইসলামী সভ্যতার দ্বন্দ্বের মাঝে ব্যক্তিগত বা গোত্রীয় পক্ষপাতিত্বের কোন স্থান নেই। গোত্র-বর্ণ, ভাষা-পেশা ও স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষকে একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করাই উহার কাম্য।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও ইসলাম
ইসলামী আন্দোলন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের বিরোধী নয় এবং মুসলমানরাও চায় না যে, বিভিন্ন হাতিয়ার ও অস্ত্র-শস্ত্রের উপর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখিত থাকতে হবে। এও তাদের ইচ্ছা নয় যে, তাদের আবাসগৃহে, খেত-খামারে বা কল-কারখানায় ওগুলেঅকে ব্যবহার করা করবে না। কেননা এগুলোতে নিষ্প্রাণ হাতিয়ার মাত্র; এগুলোর না আছে ধর্ম, না আছে দেশ। তবে এগুলোর ভুল বা নির্ভুল ব্যবহারের কারণে যে সারা বিশ্বের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বা উপকৃত হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ একটিতোপের কথাই ধরুন। উহার না আছে ধর্ম, না আছে বর্ণ, আর না আছে কোন দেশ। কিন্তু ইসলামের মতে, উহাকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার কর উহার সাহায্যে কারুর উপর জুলুম করা কোনক্রমেই বৈধ নয়; কোন মুসলমানেই এরূপ করার অধিকার বরং তার কাজ হলো এই যে, মানুষকে জালেমদের নির্যাতন থেকে বাঁচাবার জন্রে তোপ ব্যবহার করবে কিংবা আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে উহার সাহায্য গ্রহণ করবে।
অনুরূপভাবে ফিল্ম বা চলচিত্রও একটি আধুনিক আবিষ্কার। ইসলাম উহারও বিরোধী নয়। একজন মুসলমানের নিকট ইসলাম শুধু এতটুকুই দাবী করে যে, সে ফিল্মকে পবিত্র ধ্যান-ধারণা, সৎকর্ম এবং মানব স মাজের হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরার জন্যে ব্যবহার করুক। নির্লজ্জতা, নগ্নতা (Nudity) ও ঘৃণ্য চিন্তাধারার প্রকাশ ও প্রচারের মাধ্যম হিসেবে উহাকে গ্রহণ করার অধিকার কোন মুসলমানের নেই। নৈতিক, মানসিক অধপতনের ফলে সমাজে যে জঘন্য কার্যকলাপের সয়লাব চলছে তার প্রতিফলনকে ইসলম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। উহার মতে এই প্রকার ফিল্ম মানসতা বিধ্বংসী ও ন্যক্কারজনক। উহার মধ্যে মানবতার জন্যে কল্যাণকর কিছুই নেই। উহা মানুষের আদিম ও পাশবিক বৃত্তিগুলোকেই জাগ্রত করে দেয়। সুতরাং অনস্বীকার্য যে, এই শ্রেণীর ফিল্ম মানুষের আত্মিক ও মানসিক উন্নতির জন্যে কখনো সহায়ক হতে পারে না। বরং তার জন্যে চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক বলে প্রমাণিত হয়।
ইসলাম মানুষের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহের কখনো বিরোধিতা করে না। উহা মুসলমানদেরকে শিক্ষা দেয়, বিজ্ঞানের কল্যাণকর অবদানসমূহকে নিজেদের মহান লক্ষ্য হাসিলের জন্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। হযরত বিশ্বনবী (স) এরশাদ করেন:
“জ্ঞান আহরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে অবশ্য কর্তব্য।”
সম্ভবত এ ব্যাখ্যা এখানে নিষ্প্রয়েঅজন যে, জ্ঞান বলতে সর্ববিধ জ্ঞানকেই বুঝায। হযরত বিশ্বনবী (স) যেন বলতে চেয়েছেন যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত দিক ও বিভাগেই মুসলমানদের অগ্রসর হওয়া কর্তব্য।
মোটকথা যে সংস্কৃতি ও সভ্যতা সত্যিকার মানব সেবায় নিয়োজিত ইসলাম তার বিরোধিতা করে না। কিন্তু কোন সভ্যতা যদি মদ্যপান, জুয়া, বেশ্যাবৃত্তি, ব্যভিচার, নৈতিক বিপর্যয়, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, স্নায়ু যুদ্ধের অপকৌশল ও নানাবিধ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এক একটি জনগোষ্ঠীকে দাসত্বের নিগড়ে ধ্বংস করে দিতে তৎপর হয়, ইসলাম তাকে কোনক্রমেই সমর্থন করে না। বরং ইসলাম তাদের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে –যাতে করে বিশ্ববাসী তাদের যাবতীয় ব্যধি ও ধ্বংসলীলা থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়।