ইসলাম ও অমুসলিম সংখ্যালঘু
কতক লোকের মতে ইসলামী সরকার অমুসিলম সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে যে মূলনীতি অনুসরণ করে থাকে তা একটি বিশেষ স্পর্শকাতর বিষয়। সে সম্পর্কে আলেচনা করতে গেলেই নাকি জটিলতার আশংকা দেখা দেয়। কেননা তাতে করে মুসলমান এবং অমুসলমানদের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষেরসৃষ্টি হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। এ কারণে তারা এ সম্বন্ধে আলোচনা করতে অগ্রসর হয় না।
সংখ্যালঘুদের অমুলক ভীতি
আমরা প্রাচ্যের খৃস্টান পণ্ডিতদের সাথে এ সম্বন্ধে খোলাখুলি আলোচনা করতে চাই। তাদের নিকট আমাদের প্রশ্ন: ইসলামী সরকার সম্পর্কে তাদের এ ভীতির কারণ কি? –তারা কি ইসলামী আইন-কানুনকে ভয় করে, না বাস্তব জীবনে উহার প্রয়োগকে ভয়ের চোখে দেখে?
পবিত্র কুরআন ও সংখ্যালঘু
ঐ সকল ভীত ব্যক্তিগণকে আমরা পবিত্র কুরআনের নিম্ন আয়াতগুলো অনুধাবন করতে অনুরোধ করি:
(আরবী**********)
“আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে সেই সকল লোকদের প্রতি এহসান ও ইনসাফ করতে নিষেধ করেন না যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করেনি। আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন।” –(সূরা আল মুমতাহিনা: ৮)
(আরবী**********)
“আজ তোমাদের জন্যে পবিত্র জিনিসগুলোকে হালাল করে দেয়া হলো: আর কিতাবীদের জবাই করা জন্তু তোমাদের জন্যে হালাল এবং তোমাদের জবাইকৃত জন্তু তাদের জন্যে হালাল। এবং ঐ সকল সতী মহিলাও তোমাদের জন্যে হালাল যারা মুসলমান এবং ঐ সকল সতী মহিলাও যাদেরকে তোমাদের পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল।”
ইসলামী আইনশাস্ত্রের একটি নীতি
এই প্রসংগে ইসলামী আইন শাস্ত্রের এই নীতির প্রতি পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, অমুসলমানদের জন্য ঠিক তেমনি দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপ করা হয়েছে যেমনটি করা হয়েছে আমাদের মুসলমানদের জন্য।
পবিত্র কুরআন মুসলমানদের প্রতি এরূপ নির্দেশ দেয় যে, তারা অমুসলমানদের সাথে সৌহার্যমূলক ও সুবিচারভিত্তিক ব্যবহার করুক। ইবাদাতের ক্ষেত্রে তারা মুসলমানদের মতই স্বাধীন। শুধু তাই নয়, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সামাজিক অধিকার ও দায়িত্বের দিক থেকেও মুসলমানদের ন্যায় সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে। অধিকন্তু ইসলাম মুসলমান ও অমুসলিমানদের পারস্পরিক সম্পর্ককে সুন্দর ও শক্তিশালী করার জন্যেও সচেষ্ট। এ কারণে উহা মুসলমানদেরকে অমুসলমানদের বাড়িতে যাওয়ার এবং বন্ধুর ন্যায় পানাহারের অনুমতিও প্রদান করে। এমনকি উহা মুসলমানদের কিতাবী হলে অমুসলমানদের বিয়ে শাদীর অনুমতি দিতেও কুণ্ঠিত নয়।
আরনল্ডের সাক্ষ্য
উপরোক্ত নীতির বাস্তবায়নে নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু বলার পরিবর্তে ইউরোপের খৃস্টান লেখকদের বরাত দেয়াই সংগত বলে মনে হয়। কেননা এতে করে কারুর সন্দেহই থাকবে না যে, আমরা বোধ হয় খামাখাই ইসলামের পক্ষে কথা বলছিঃ। স্যার আরনল্ড তার বিখ্যাত গ্রন্থ (The Preaching of Islam) এ বলেন:
“তারা যে শক্তি প্রয়োগ বা জবরদস্তির ফলে ইসলাম গ্রহণ করেনি –একথা তাদের সেই সৌহার্দমূলক সম্পর্ক দ্বারাই প্রমাণিত হয় যা এখনকার যুগে খৃস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে বর্তমান ছিল। স্বয়ং মুহাম্মাদ (স) কতিপয় খৃস্টান গোত্রের সাথে এই মর্মে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন যে, তিনি তাদের হেফাজতের দায়িত্ব পালন করবেন এবং তারা তাদের ধর্ম-কর্ম সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সম্পাদন করবে। তাদের ধর্মীয় নেতাদের যাবতীয় অধিকার ও ক্ষমতা –যা ইসলামের পূর্ব থেকেই তাদের জন্যে নির্ধারিত ছিল-বহাল থাকবে।” [পৃষ্ঠা: ৪৮]
“হিজরী ১ম শতকের মুসলিম বিজেতারা আরবে জন্মগ্রহণকারী খৃস্টানদের সাথে যে সৌহার্দমূলক আচরণ করেছে এবং পরবর্তী নেতারা যা অব্যাহত রেখেছে তা দেখে প্রত্যয়ের সাথেই বলা যায়, যে সকল খৃস্টান ইসলাম গ্রহণ করছে তারা তা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই করেছে।” [পৃষ্ঠা: ৫১]
“যখন মুসলমান সৈন্যরা জর্দানে পৌঁছে এবং হযরত আবু উবাইদা (রা) ফাহেলা নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন তখন স্থানীয় খৃস্টান অধিবাসিরা তাকে লিখে জানাল: মুসলমান ভাইসব! আমরা তোমাদেরকে বাইজাইন্টাইনদের চেয়ে অধিক অগ্রাধিকার দিচ্ছি –যদিও তারা আমাদের একই ধর্মের অনুসারী। কেননা তোমরা আমাদের সাথে সুষ্ঠুভাবে চুক্তি পালন করেছ। তোমরা আমাদের প্রতি অধিকতর অনুগ্রহশীল। আমাদের উপর তোমাদের হুকুমাত তাদের হুকুমাতের চেয়ে উৎকৃষ্ট। কেননা তারা আমাদের অনেক ঘরবাড়ি ও সম্পদ সামগ্রী লুণ্ঠন করে নিয়েছে।” [পৃষ্ঠা: ৫৫]
স্যার আরনল্ড আরো বলেন:
“এটাই ছিল সিরিয়ার জনগণের মানসিক অবস্থা -৬৩৩ হতে ৬৩৯ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সমযে আরবরা যখন রোমকদরেকে ক্রম পর্যায়ে সিরিয়া থেকে বের করে দিয়েছিল। ৬৩৭ খৃস্টাব্দে দামেস্কের অধিবাসীরা আরবদের সাথে কিছু শর্ত সন্ধি স্থাপন করে এবং এর ফলে শুধু যে পরাজয় থেকে রক্ষা পেল তাই নয়, বরং কিছু সুযোগ-সুবিধাও তারা লাভ করলো। এরপর অনতিবিলম্বেই সিরিযার অন্যান্য বহু শহরই তাদের পথ অনুসরণ করে। হেমাস (Emessa), আর্থুজা (Arthusa), আরিথুসা (Arethusa), হিরোপালস (Hireopolis) এবং অন্যান্য শহর এক একটি করে আরবদের সাথে চুক্তিসম্পাদন করে তারে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। পরিশেষে জেরুজালেমের সম্মানীয় পাদরীও (Patrarch) একই প্রকার শর্তে শহরটিকে মুসলমানদের হাতে তুলে দেন। বেঈমান শাহনশাহর ধর্মীয় ধর্মীয় জুলুম ও নির্যাতনের কারণে তিনি রোম সাম্রাজ্য এবং তার খৃস্টান শাসনের বিপক্ষে মুসলমানদের ধর্মীয় সদাচরণ ও সৌহার্দমূলক ব্যবহারে অত্যধিক প্রীত হন। আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর প্রাথমিক ভয় অতিবাহিত হওয়ার পর সেখানকার অধিবাসীদের মনে আরব বিজেতাদের জন্য গভীর ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।” [পৃষ্ঠা: ৫৫]
ইসলামী হুকুমাত সম্পর্কে এই হলো একজন খৃস্টান পণ্ডিতের সাক্ষ্য। এরপর ইসলামী ব্যবস্থা সম্পর্কে খৃস্টানদের ভীত হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে কি? ধর্মীয় উন্মাত্ততার শিকার –মুসলমান, না অমুসলমান? হতে পারে খৃস্টানরা মুসলমানদের “ধর্মীয় উন্মাত্ততার” ভয়ে ভীত। এ কারণ যদি সত্যই হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, “ধর্মীয় উন্মাত্ততার” অর্থই তারা জানে না। এর অর্থ জানতে হলে তাদের নিম্ন ঘটনাবলীর প্রতি অবশ্যই তাকাতে হবে:
ধর্মীয় বিচারালয়
খৃস্টান ধর্ম যাজকরা যে ধর্মীয় বিচারালয় (Inquisition Courts) স্থাপন করে তার মূল লক্ষ্য ছিল স্পেনের মুসলমানদের চিরতনে নির্মূল করে দেয়। এই বিচারালয়সমূহে মুসলমানদেরকে ভয়ানক শাস্তি দেয়া হতো। তাদের উপর নির্যাতন চালাবার জন্যে এমন এমন লোমহর্ষক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল যার কোন নযীর ইতিপূর্বে বিশ্বের কোথাও ছিল না। তারা মুসলমানদের জীবন্ত অবস্থায় আগুনে ফেলে পুড়িয়ে ভষ্ম করে ফেলত, তাদের নখগুলোকে টেনে খুলে ফেলতো এবং গোশত থেকে পৃথক করে দিত। চোখগুলো উঠিয়ে ফেলতো এবং শরীর অংগ-প্রত্যংগগুলোকে গোশতের মত টুকরা টুকরা করে ফেলতো। আর এই সকল হিংস্র ও পাশবিক নির্যাতনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী দ্বীণকে বর্জন করিয়ে খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা।
প্রশ্ন এই যে, পাশ্চাতের কোন মুসলিম দেশে বসবাসকারী খৃস্টানরা মুসলমানদের নিকট তেকে এরূপ ব্যবহার পেয়েছে কি?
পাইকারীভাবে মুসলমানদের হত্যা
আজও উগ্র জাতীয়তাবাদের অন্ধ দাসানুদাস যুগোশ্লোভিয়া আল বেনিয়া, রাশিয়া এবং ইউরোপের শাসনাধীন উত্তর আফ্রিকা, সোমালিল্যাণ্ড, কেনিয়া ও জাঞ্জিবার এবং ভারত ও মালয়য়ে কোন সময়ে শান্তি ও নিরাপত্তার নামে আবার কখনো জাতীয় শুদ্ধির নামে পাইকারীভাবে মুসলমানদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।
ইথিওপিয়া –ধর্মীয উন্মাত্ততা ও গোড়ামির একটি দৃষ্টান্ত
ধর্মীয় উন্মাত্ততার আর একটি দৃষ্টান্ত হলো ইথিওপিয়া। -এই দেশটি প্রাচীনকাল থেকেই ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে মিসরের সাথে ঘনিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট। এখানে মুসলমান ও খৃস্টানরা প্রথম থেকে বসবাস করে আসছে। মুসলমান হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ৩৫% থেকে ৪০%। কিন্তু এ সত্ত্বেও এ দেশে এমন একটি বিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে ইসলামী শিক্ষা বা আরবী পড়বার সুযোগ বর্তমান। মুসলমানরা একান্ত নিজেদের চেষ্টায় যে দু’ একটা মাদ্রাসা স্থাপন করছে তার উপর যে ভারী ট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে এবং পদে পদে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে তাতে করে একদিকে মেযন এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তেমনি অন্যদিকে নতুন করে স্থাপনের উৎসাহও বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মোটকথা সরকারের পক্ষ থেকে এমন সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে যাতে করে ইসলামী শিক্ষা কোন মতেই প্রসারিত হতে না পারে এবং শিক্ষকরাও পুরানো শিক্ষাব্যবস্থার অক্টোপাস থেকে মুক্তি লাঠ করতে না পারে।
মুসলমানদের করুণ অবস্থা
ইটালীয় আক্রমণের পূর্বে ইথিওপিয়ার অবস্থা এরুপ ছিল যে, যদি কোন মুসলমান খৃস্টান ঋণদাতার নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতো এবং সময় মত পরিশোধ করতে ব্যর্থ হতো তাহলে সেই ঋণদাতা ঋণগ্রস্ত মুসলমানকে গোলাম বানিয়ে ফেলতো। আর খৃস্টানি সরকারের চোখের সামনেই এই গোলামের বেচা-কেনা চলতো এবং এই গোলামদের উপর আরো নানা প্রকার জুলুম-নির্যাতন চালানো হতো।
মুসলমানগণ ইথিওপিয়ার এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে না ক্যাবিনেটে তাদের কোন মন্ত্রী আছেন, না আছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে কোন অফিসার।
প্রশ্ন এই যে, কোন ইসলামী দেশে খৃস্টানদের সাথে এরূপ ব্যবহার করা হয়েছে কি? আজ তাদের স্বধর্মের লোকেরা মুসলমানদের সাথে যে ব্যবহার করছে তারা মুসলিম দেশে তাদের সাথে সেইরূপ ব্যবহার পসন্দ করে কি? –যাই হোক ধর্মীয উন্মাত্ততার এই হলো সঠিক পরিচয়।
সংখ্যালঘু এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
কমিউনিষ্ট বা সমাজতন্ত্রীদের মতে মানব জীবন অর্থনৈতিক স্বাধীনতারই নামান্তর। যদি কিছুক্ষণের জন্যে এই অলীক ধারণাকে সঠিক বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র বসবাসকারী খৃস্টানরা কি কখনো জীবনের এই যথার্থ মূল্য থেকে বঞ্চিত রয়েছে? ইসলামী হুকুমাত কি কখনো তাদেরকে সম্পত্তির মালিক হতে, সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করতে কিংবা সঞ্চয় করতে নিষেধ করেছে? কেবল বিধর্মী হওয়ার অজুহাতে তাদেরকে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং হুকুমাতের দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে কি কখনো বঞ্চিত করা হয়েছে?
ইংরেজদের চক্রান্ত
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এ এক বাস্তব সত্য যে, মুসলিম দেশসমূহে খৃস্টানরা কোনদিন জুলুম বা ধর্মীয নির্যাতনের শিকার হয়নি। আধুনিক যগে যে দু’ একটি ঘটনা ঘটনার কথা শোনা যায় উহার মূলে রয়েছে ইংরেজদের ষড়যন্ত্র। তারা জেনেশুনেই সুপরিকল্পিতভাবে খৃস্টানদেরকে উৎসাহ যুগিয়ে বিভেদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে চলেছে।
জিযিয়া ও উহার সঠিক মর্ম
ইসলাম বিরোধীরা জিযিয়ার প্রসংগ উত্থাপন কর এরূপ অভিযোগ করে থাকে যে, মুসলমান ধর্মীয় শত্রুতা সাধন করার জন্যেই অমুসলমানদের নিকট থেকে এই কর আদায় করে থাকে। এর সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ উত্তর দিয়েছেন স্যার আরনল্ড তার The Preaching of Islam নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে তিনি বলেন:
“পক্ষান্তরে মিসরের কৃষকেরদ মধ্যে যারা মুসলমান ছিল তাদের যখন সামরিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখা হতো তখন উহার বিনিময়ে তাদের উপর ঐরূপ করই আরোপ করা হতো যেরূপ আরেপ করা হতো খৃস্টানদের উপর।” [পৃষ্ঠা: ৬৩]
স্যার আরনল্ড আরো বলেন:
“পূর্বেই বলা হয়েছে যে, জিযিয়া কেবল স্বাস্থ্যবান পুরুষদের নিকট তেকে তাদের সামরিক দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে আদায় করা হতো –যা তাদেরকে মুসলমান হলে প্রদান করতে হতো। আর এটাও উল্লেখযোগ্য যে, যখন কোন খৃস্টান মুসলিম সেনাবাহিনীর অন্তর্বুক্ত হয়ে সামরিক দায়িত্ব পালন করতো তখন তাতে এই জিযিয়া কর দিতে হতো না। আন্তাকিয়ার (Antioch) নিকটবর্তী এলাকা আল জুরাইজিমার খৃস্টান গোত্র মুসলমানদরে সাথে এই মর্মে সন্ধি স্থাপন করে যে, তারা তাদের মিত্রগোত্র হিসেবে বসবাস করবে, যুদ্ধে তাদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবে এবং এর বিনিময়ে তাদেরকে কোন জিযিয়অ কর দিতে হবে না, বরং যুদ্ধলব্ধ (গনীমতের) মালেরও নির্ধারিত অংশ লাভ করবে।” [পৃষ্ঠা: ৬২]
এতে করে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, ধর্মীয় অসহনশীল জিযিয়অ করের মূল কারণ নয়। আসলে এটা ছিল এমন একটি কর যা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে ঐ সকল লোকের নিকট থেকে আদায় করা হতো যারা কোন সামরিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকতে চাইতো।
পবিত্র কুরআনে জিযিয়ার হুকুম
এই প্রসংগে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
(আরবী***********)
“কিতাবীদের সেই সকল লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যারা আল্লাহ এবং আখেরাত দিবসের উপর ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যাকে নিষিদ্ধ করেছে তাকে নিষিদ্ধ বলে গণ্য করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজেদের দ্বীন বলে গ্রহণ করে না যে না পর্যন্ত না তারা নিজ হাতে জিযিয়অ কর প্রদান করে এবং (তোমাদের নিকট) নতি স্বীকার করে।” –(সূরা আত তাওবা: ২৯)
এই আয়াতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় কেবল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মুসলিম শাসনাধীনে বসবাসকারী অমুসলমানদের সাথে এআয়াতের কোন সম্পর্ক নেই।
বিভেদের জন্যে দায়ী কে?
পরিশেষে আমরা বলতে চাই: উপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও কমিউনিজমের চরেরাই মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে থাকে।
কমিউনিষ্টদের ষড়যন্ত্র
কমিউনিষ্টদের ষড়যন্ত্রের মূল কথাই হলো ‘অবস্থা বুঝে কথা বলা।’ মজুর ও শ্রমিকদের কাছে তারা বলে: “তোমরা যদি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে শরীক হও তাহলে কল-কারখানা তোমাদেরকে দিয়ে দেয়া হবে।” কৃষকদের কাছে গিয়ে বলে: “তোমরাই হবে সমস্ত জমি-জমার মালিক।: বেকার গ্রাজুয়েট বা শিক্ষত লোকদের নিকট তারা বলে: “তোমরা যদি সমাজতনত্র গ্রহণ কর তাহলে তোমাদের সবাইকেই যোগ্যতা অনুসারে চাকুরী দেয়া হবে।” যৌন ব্যভিচার পরায়ণ যুব সমাজকে তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা যেমন খুশী ভোগ-বিলাসে মশগুল হতে পারবে; রাষ্ট্র, আইন বা প্রচলিত নীতিবোধ তাদের যৌন লালসা চরিতার্থ করার পথে কোন অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারবে না।
অন্যদিকে খৃস্টানদেরকে তারা বুঝায়। যদি তোমরা সমাজতন্ত্র গ্রহণ কর তাহলে আমরা ইসলামকে –অর্থাৎ সেই ধর্মকে যা মানুষের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্যের সৃষ্টি করে তাকে –চিরতরে ধ্বংস করে দেব। এ সকল প্রচারনার বিপক্ষে আমরা পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটিই যথেষ্ট বলে মনে করি:
(আরবী***********)
“তাদের মুখ থেকে যে কথা বেরিয়ে আসে তা কতই না নিকৃষ্ট। তারা শুধু মিথ্যা কথাই বলে।” –(সূরা আল কাহ্ফ: ৫)
ইসলামের প্রতি মিথ্যা আরোপ
মোটকথা এর চেয়ে জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না যে, উহা কেবল ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে। কেননা ইসলাম তো ধর্ম ও প্রত্যয় নির্বিশেষে সকল মানুষকেই মৌলিক মানবীয় অধিকারসমূহ দান করে; উহা মানুষকে নির্ভেজাল মানবতার ভিত্তিতেই ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। এবং স্ব স্ব পসন্দ অনুযায়ী যে কোন ধর্ম গ্রহণ করার এবং সে অনুযায়ী আমল করার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করে।
সুতরাং আমরা সহজেই আশা করতে পারি যে মুসলমানদের ন্যায় মুসলিম দেশের খৃস্টান অধিবাসীরা পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে এবং ইসলামের সাথে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের ভিত্তিতে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিযে যেতে পরাঙ্খমুখ হবে না। দ্বিতীয়ত, আমরা এ আশাও করতে পারি যে, তারা সাম্রাজ্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় কখনো কর্ণপাত করবেন না।