ইসলাম ও নারী
প্রাচ্য জগতে আজ নারীর অধিকার ও পুরুষদের সাথে সাদের সমতার দাবী নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা চলছে। নারীর অধিকার সম্পর্কে তাদের সমর্থকদের মধ্যে যে সকল পুরুষ ও মহিলা অত্যধিক সোচ্চার তারা ইসলাম সম্বন্ধে যে নির্বুদ্ধিতামূলক উক্তি করছে তার কোন তুলনা নেই। তাদের কেউ কেউ তো দূরভিসন্ধিমূলকভাবে বলছে: ইসলাম তো সকল দিক থেকেই নারী ও পুরুষের মধ্যে সাম্যের ব্যবস্থা করেছে। আবার কেউ কেউ নিছক মুর্খের মতই দাবী করছে: ইসলাম হচ্ছে নারীদের শত্রু। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে নারী হচ্ছে অবজ্ঞার পাত্র; মানসিকতার দিক থেকে তারা নিকৃষ্ট; সমাজে তাদের অবস্থান এতদূর নিম্নে যে, তাদের এবং অন্যান্য জানোয়অরের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই। তারা শুধু পুরুষদের যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করার মাধ্যমে এবং সন্তান উৎপাদনের অদ্বিতীয় মেশিন। এতে করে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর সামাজিক মর্যাদা পুরুষের তুলনায় অনেক নিম্নে; -এক কথায় পুরুষ হলো নারীর একচ্ছত্র শাসক, জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নারীর উপর চলে পুরুষের অবাধ রাজত্ব।
মোটকথা উপরোক্ত উভয় দলই ইসলাম সম্পর্কে একই রূপ মূর্খতার শিকার। দ্বিতীয়ত, এরা জেনে শুনেই মানুষকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করে দেয় –যাতে করে গোটা সমাজে অনাচার ও অশান্তি বিরাজ করে এবং তারই আড়ালে তারা নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
ইউরোপে নারী স্বাধীনতা আন্দোলন
ইসলামে নারীর মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে ইউরোপের নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের (Emancipation Movement) ইতিহাসের প্রতি একবার মোটামুটি দৃষ্টি দেয়া যাক। কেননা আধুনিক প্রাচ্যে যে চিন্তাধারার বিকৃতি লক্ষ্য করা যায়, এই আন্দোলনই হচ্ছে তার প্রধান উৎস।
প্রাচীন যুগের নারীদের অবস্থা
প্রাচীন ইউরোপ তথা গোটা দুনিয়ায় নারীদের কোন মান বা মর্যাদা বলতে কিছুই ছিল না। প্রাচীন “পণ্ডিত” ও “দার্শনিকরা” সুদীর্ঘকাল ধরে এ বিষয়ে গবেষণা চালাতে থাকে যে, নারীর মধ্যে প্রাণ বলতে কিছু আছে কি? –যদি থাকে তাহলে সেটা কি মানুষের, না অন্য কোন প্রাণীর? যদি মানুষের প্রাণই হয়ে থাকে তাহলে পুরুষদের বিপক্ষে তাদের সঠিক সামাজিক মর্যাদা কি? তারা কি জন্মগতভাবেই পুরুষদের গোলাম না গোলামের চেয়ে কিছুটা উন্নত মর্যাদার অধিকারী?
গ্রীস ও রোম
গ্রীস ও রোমকদের ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত সময়ে বাহ্যত নারীদের যখন কেন্দ্রীয় মর্যাদা দান করা হয়েছিল তখনও তাদের অবস্থা পূর্বর মত শোচনীয় পর্যায়ে ছিল। কেননা নারীদের তখন মর্যাদা দেয়া হয়েছিল তা নারী হিসেবে দেয়া হয়নি। গোটা নারী জাতির প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তা করা হয়নি। কেননা ঐ নামকাওয়াস্তে মর্যাদাটুকু কেবল বড় বড় শহরে বসবাসকারিণী কিছুসংখ্যক বিশেষ মহিলা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল –যারা নিজেদের কিচু গুণপনার কারণে সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। তারা হয়েছিল বিভ্রান্ত ও ভোগ-বিলাসী পুরুষদের আমোদ-প্রমোদের প্রধান মাধ্যম। তাই এ পুরুষরা তাদের উৎসাহ বর্ধন করতো নানাভাবে। মোটকথা নারীদের প্রতি যে সদাচার দেখানো হতো তা নারী হিসেবে তো নয়ই, এমনকি মানুষ হিসেবেও নয় –বরং তাদেরকে পুরুষদের আনন্দ-স্ফূর্তি ও যথেচ্ছ ভোগ-বিলাসের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্যেই তাদের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন করা হতো।
সামন্তদের যুগে
ইউরোপে নারীদের এই অবস্থা কৃষি দাসত্ব (Serfdom) ও সামন্তদের যুগেও অব্যাহত ছিল। নারীরা তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টির কারণে জীবনের চোখ ঝলসানো বাহ্যিক রূপ সৌন্দর্য দ্বারা বারবার প্রতারিত হয়েছে। তারা মনে করেছে: বাস, এই হলো জীবন। খাওয়া, পান করা, সন্তান উৎপাদন করা এবং জন্তু-জানোয়ারের মত নিরলস …. করাই হলো তাদের জীবনের একমাত্র ব্রত।
ইউরোপে যে শিল্প বিপ্লব ঘটে উহা নারীদের জন্যে চরম অভিশাপ ও অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের পয়গাম বয়ে নিয়ে আসে। এখন থেকে তারা যে দুঃখ-দুর্দশার করুণ শিকার হতে থাকে তাদের পেচনের রোমাঞ্চকর ইতিহাসকেও ম্লান করে দেয়।
ইউরোপে এখন যে মানসিকতা বর্তমান তা বক্রতা ও নিষ্ঠুরতার এক বীভৎস মূর্তি ছাড়া অন্য কিছুই নয়; তাতে সৌহার্দ ও মায়া-মমতা বলতে কিছুই নেই। উহা মানুষকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুঃখ-দুর্দশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এর পরিবর্তে মুখ্য বা গৌণ কোন প্রকার কল্যাণই সাধন করতে পারছে না। তবে কৃষি-দাসত্ব ও সামন্তবাদের যুগে এবং প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার আওতায় নারীদের জীবন জীবিকার দায়িত্ব পুরুষরাই বহন করতো। বস্তুত তখনকার পরিবেশ ও মন-মানসিকতার দিক থেকে ইহা সম্পূর্ণরূপে উপযোগী ছিল। এই সময়েও নারীরা বিভিন্ন কুটির শিল্পে পুরুষের সহযোগিতা করতো। আর এতে করে পুরুষরা নারীদের যে জীবিকা ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব বহন করতো তার একটা বিনিময় হয়ে যেত।
শিল্প বিপ্লবের পর
কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর কি শহর কি মফস্বল সর্বত্রই এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল। পারিবারিক জীবন সম্পূর্ণরূপেই ধ্বংস হয়ে গেল। পরিবারের সদসদের পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতির সকল বন্ধনই ছিন্ন হয়ে গেল। কেননা শিল্প বিপ্লবের ফলে যে মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয় তার ফলে নারী এবং শিশুদেরকেও গৃহ ছেড়ে কলে-কারখানার পথ ধরতে হয় –যাতে করে একমাত্র মেহনত করেই দু’ মুঠো আহার যোগাঢ় করা যায়। এতে করে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে পল্লী এলাকা পরিত্যাগ করে শহরে আসতে শুরু করে। পল্লী জীবনে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, স্নেহ-মমতা, প্রেম-প্রীতি এবং যৌথভাবে কর্ম-সম্পাদনের স্পৃহা পাওয়া যেত; কিন্তু শহুরে জীবনে এগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেখানে কেউই কারুর সংবাদ রাখে না। অন্য লোক তো দূরের কথা, নিকটতম প্রতিবেশীর কথাও কখনো চিন্তা করে না। প্রতিটি ব্যক্তিই সেখানে আত্মকেন্দ্রিক, কেউই কারুর কথা ভাবতে রাজী নয়। কেউ কারুর দায়িত্ব বা বোঝা বহন করতে সম্মত নয়। এ কারণে শহরে নৈতিক শৃংখলা বলতে কিছুই থাকলো না এবং তার পরোয়াও করতো না। ফলে যৌন অরাজকতার সয়লাবে গোটা পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠে, যৌন ইচ্ছা চরিতার্থ করার সামান্য সুযোগ পেলেও এর সদ্ব্যবহার করা হতো। এমনি করে নৈতিকতার বন্ধন বলতে কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। ফলে বিয়ে করার এবং ঘর-সংসার করার প্রবণতা প্রায় শেষ হয়ে গেল। যার একান্তই ইচ্ছা জাগত সেও চাইতো যে, এ বিপদ (!) যত দেরীতে আসে ততই ভালো। [এই প্রকার ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করে জড়বাদী ও মার্কসবাদীরা দাবী করে যে, কেবল অর্থনৈতিক পরিবেশই সামাজিক পরিবেশকে সৃষ্টি করে এবং মানুষের সম্পর্ককে নির্ধারণ করে। মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপশ্যই স্বীকৃত। কিন্তু এরূপ ধারণা করা ভিত্তিহীন যে, কেবল অর্থনৈতিক কারণই মানুষের চিন্তাধারা ও কর্মতৎপরতাকে নিয়ন্ত্রিত করে। ইউরোপে অর্থনীতির যে গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয় তার মূল কারণ হলো এই যে, ইউরোপবাসীর নিকট কোন মহান জাতীয লক্ষ্য বর্তমানছিল না –যা ইসলামী দুনিয়ার ন্যায় ইউরোপকেও আধ্যাত্মিক মহিমার সাথে পরিচিত করাতে পারতো এবং অর্থনৈতিক বর্ধনকে মানবতার ভিত্তিতে সুবিন্যস্ত করতো সাহায্র করতে পারতো। এরূপ হলে শুধু ইউরোপের যাবতীয় সমস্যায়ই সমাধান হতো না, বরং বহিবিশ্বের লোকেরাও জুলুমবাজদের ভোগ-বিলাস ও অন্যায় শোষণের (Explitaiton) হাত থেকে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হতো।]
নারী নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার
ইউরোপের পূর্ণাংগ ইতিহাসের আমাদের প্রয়োজন নেই। বরং উক্ত ইতিহাসের যে অংশটুকু নারীদের ভাগ্য নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এখানে শুধু সেটুকুই আলোচনা করছি। পূর্বেই আমরা বলেছি যে, শিল্প বিপ্লবের ফলে শিশু ও নারীদের উপর যে অর্থনৈতিক দায়িত্ব চাপানো হয়েছে তার ফলে পারিবারিক সম্পর্ক শিথিল হয়ে গেছে এবং গোটা সংসার জীবনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনস্বীকার্য যে এই বিপ্লবের ফলে নারীরই হচ্ছে সর্বধিক মজলুম –অত্যাচার ও নিপীড়নের নিষ্ঠুরতম শিকার। এখন থেকে তাদের যে পরিশ্রম করতে হতো তার কোন তুলনা অতীত ইতিহাসে বর্তমান নেই। এখন হতেই তাদের সমস্ত ইজ্জত ও সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়। একদিকে তারা যেমন মানসিক শান্তি হারিয়ে ফেলে, অন্যদিকে তেমনি হাজার পরিশ্রম কওে তারা এতটুকু সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতে ব্যর্থ হয়ে যায়। পুরুষকরা এমন হৃদয়হীন ও নিষ্ঠুর মানসিকতার শিকার হয় যে, স্ত্রী হোক, কন্যা হোক, বোন হোক, মা হোক –কোন নারীকেই আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে এবং যার রুজি তাকে কামাই করে বেঁচে থাকার জন্যে বাধ্য করে। এর পরেও এই নারীরা হতো কল-কারখানার মালিকদের বে-ইনসাফী ও স্বেচ্ছাচারিতার করুণ শিকার। নারীদেরকেক অধিক কাজ করানোর জন্যে বাধ্য করা হতো। কিন্তু তাদের পারিশ্রমিক ছিল পুরুষের তুলনায় কম।
ইউরোপীয় নারীদের নির্যাতিত হওয়ার মূল কারণ
ইউরোপীয় সমাজের মূল ভাবধারা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কার্পণ্য, নিষ্ঠুরতা ও অকৃতজ্ঞতা। এই বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে, নারীদের প্রতি তারা যে ব্যবহার করছে তার মুল কারণঅনুধাবন করা মোটেই কঠিন নয়। তারা মানুষকে কখনো মানুষ হিসেবে সম্মান দেয় না। কারুর মাধ্যমে কারুর উপকার হোক এও তারা পসন্দ করে না। তাদের অতীত ইতিাহস সাক্ষ্য দেয় যে, নিজের ক্ষতির কোন আশংকা না থাকলে সুযোগ হওয়া মাত্রই তারা অন্যের ক্ষতি করবেই। ভবিষ্যতেও তাদের এই স্বাভাবের যে কোন পরিবর্তন ঘটবে তার কোন আলামত খুঁজে পাওয়া যায় না। একমাত্র আল্লাহ যদি তাদের প্রতি দয়া করন এবং মহৎ গুণাবলী ও আধ্যাত্মিক পরিবত্রতার আলোকে তাদের সঠিক পথে চলার তওফিক দান করেন তাহলেই তাদের স্বভাব পরিবর্তন হতে পারে। যাই হোক, আমরা যে যুগের কথা আলোচনা করছিলাম তখন দুর্বল শিশু ও নারীদের উপর কল-কারখানার জালেম মালিক গোষ্ঠী যে যথেচ্ছ ও অমানুষিক যুলূম করতো তার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না।
সমাজ সংস্কারক এবং নারী
সমাজের এই দুর্বল শ্রেণীর উপর অত্যাচার যখন চরমে উঠে তখন কিছু সংখ্যক হৃদয়বান ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। তারা কেবল শিশুদের (হ্যা, শুধু শিশুদের, নারীদের নয়) উপর যাতে করে অত্যাচার না হয় সে জন্যে আন্দোলন শুরু করে। ছোট শিশুদেরকে কারখানায় চাকুরী দেয়ার বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে উঠে। কেননা এতে করে শিশুদের সকুমার বৃত্তিগুলো নষ্ট হয়ে দৈহিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া তাদেরকে যে পারিশ্রমিক দেয়া হতো তাদের কঠিন ও অযৌক্তিক কাজের তুলনায় তা হতো একেবারে নগণ্য। সামাজিক অবিচারের বিপক্ষে এই আন্দোলন সাফল্যমণ্ডিত হয়। ফলে শিশুর ন্যূনতম বয়সের মাত্রা ও পারিশ্রমিক বাড়তে থাকে এবং দৈনিক কাজের সময়সীমা কমতে থাকে।
কিন্তু নারীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে কোন সমাজ সংস্কারকই এগিয়ে এলো না। তারা পূর্বর মতই মজলুম থেকে গেল। তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্যেও কেউ সক্রিয় হলো না। কেননা এতটুকু করার জন্যে যে মানসকিতা ও নৈতিক উৎকর্ষের প্রয়োজন সমগ্র ইউরোপের কোথাও ছিল না। কাজেই নারীদের দুঃখ-দুর্দশার কোন পরিসমাপ্তি হলো না। দিনরাত হাড়ভাংগা খাটুনি খেটেই কোন মতে তাদের জঠর জ্বালা নিবারণ করতে হতো। কেননা তাদেরকে যে যৎসামান্য মজুরী দেয়া হতো তা অতটুকু কাজ করে পুরুষরা যে মজুরী পেত তার তুলনা খুবই কম।
বিশ্বযুদ্ধের পর
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকার লক্ষ লক্ষ পুরুষ মার যায় এবং পেছনে রেখে যায় তাদের লক্ষ লক্ষ বিধবা স্ত্রী। এরা হলো সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার করুণ শিকার। হলো নিরাশ্রয় ও অসহায়; এমন কোন মহৎ ব্যক্তি পাওয়া গেল না যার তত্ত্বাবধানে তারা নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারে। যারা তাদের আশ্রয়দাতা ছিল তাদের কতক মারা গেল, কতক জীবনের তরে পংগু ও অক্ষম হয়ে গেল, কতক প্রচণ্ড ভীতি, প্যারালাইসিস বা বিষাক্ত গ্যাসের কারণে চিরতরে অকর্মন্য হয়ে গেল। আবার কতক জেল খাটার পর সমস্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে যেন অথর্ব প্রাণীতে পরিণত হলো। এ শ্রেণীর লোকেরা বিয়ে-শাদীর স্পৃহা হারিয়ে ফেলল। কেননা দাম্পত্য জীবনে জৈবিক, দৈহিক বা মানসিক ঝামেলা পোহাবার শক্তিই তাদের ছিল না।
নারীদের অসহায় অবস্থা
যুদ্ধের ফলে পুরুষদের সংখ্যা যতদূর হ্রাস পায় তা পূরণ করা জীবিত ব্যক্তিদের পক্ষে কখনো সম্ভবপর ছিল না। পুরুষ ও শ্রমিকদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে কারখানাগুলোর মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয় এবং এ কারণে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে নারীদেরকে বাধ্য হয়েই ঘর থেকে বের হতে হয় এবং বের হয়ে পুরুষদের স্থলে কাজ করতে হয়। নতুবা তাদের নিজেদেরকে এবং তাদের সংশ্লিষ্ট বৃদ্ধা ও শিশুদেরকেও ক্ষুধার জ্বালায় মৃত্যুর কোঠে ঢলে পড়তে হতো। কিন্তু কারখানায় গিয়ে কাজ করার ফলে নারীদেরকে নিজ নিজ চরিত্র এবং সতীত্ব উভয়কেই বিসর্জন দিতে হতো। কেননা এই দু’টিকে রক্ষা করতে হলে একদিকে তাদের ‘প্রগতি’র পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং অন্যদিকে স্বাধীনভাবে পয়সা রোজগার করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, কারখানা মালিকদের অবস্থা এই ছিল যে, শুধু কর্মচারীদের হাতই তাদের কাম্যছিল না। বরং যৌন পিপাসা চরিতার্থ করার অবাধ সুযোগও তারা তালাশ করতো। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক নারীদের সম্ভ্রম লুটে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ তারা লাভ করলো। ফলে নারীদেরকে দ্বিগুণ দায়িত্ব পালন করতে হলো। একদিকে কারখানায় দিনরাত পরিশ্রম করা এবং অন্যদিকে কারখানার কর্ম-কর্তাদের মনোরঞ্জন করা। এখন থেকে নারীদের শুধু জঠর জ্বালা নিবারণ করাই নয়, বরং পুরুষদের যৌন পিপাসা মিটানোও তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধে বহু পুরুষের মৃত্যু হওয়ায় প্রত্যেক নারীর পক্ষে বৈধ পন্থায় যৌন পিপাসা মিটাবার উদ্দেশ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপে প্রচলিত তৎকালীন ধর্ম অনুযায়ী ইসলামী আইন অনুসারে জরুরী পরিস্থিতে একাধিক বিবাহেরও কোন অবকাশ ছিল না। ফলে অসহায় নারীরা নিজেদের বল্গাহীন কামনা ও প্রবৃত্তির হাতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। একদিকে উপার্জনের চিন্তা ও যৌন স্পৃহা চরিতার্থ উদগ্র নেশা এবং অন্যদিকে মূল্যবান কাপড়-চোপড় ও মনভোলানো সাজ-সজ্জা (Makeup) করার দুর্বার আকাংখার নিকট পরাভূত হয়ে তারা এক নির্দিষ্ট পথ ধরে চলতে শুরু করে।
মোটকথা এখন থেকে ইউরোপীয় নারীদের একমাত্র কাজ হলো পুরুষদের মনোরঞ্জন করা, কারখানা বা দোকানের চাকুরী করা এবং বৈধ-অবৈধ যে কোন পন্থায় কামরিপু চরিতার্থ করা। তাদের নিকট বিলাসিতা ও সাজ-সজ্জার উপায়-উপাদান যতই বাড়তে থাকে ততই তাদের লোভ-লালসাও বাড়তে থাকে। আর চরিতার্থ করার একমাত্র পন্থা ছিল এই যে, মজুরী বৃদ্ধির জন্যে তারা অধিক হতে অধিকতর সময় ব্যয় করবে। বলা বাহুল্য নারীদের এই দুর্বলতার সুযোগে কারখানার মালিকরা তাদের অমানুষিক জুলুম করতে শুরু করে। মালিকরা একই কাজের বিনিময়ে পুরুষদের চেয়ে অনেক কম পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে থাকে এবং অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জন করতে থাকে।
এর অনিবার্য ফল এই যে, একান্ত স্বাভাবিকভাবেই এমন এক মহাবিপ্লব দেখা দিল যে, জুলুম ও বে-ইনসাফীর ভিত্তিতে গড়ে উঠা শত শত বছরের পুরানো ব্যবস্থা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল।
সামাজিক বিপ্লবের পরে
কিন্তু এই বিপ্লবে নারীরা পেল কি? শারীরিক দিক থেকে তারা হলো অধিকতর করুণ অবস্থার শিকার। যে সম্ভ্রম ও সতীত্ব তারা হারিয়ে ফেলেছিল তা আর ফিরে পাওয়া গেল না। স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিতে ভরা যে মধুর পারিবারিক জীবনে নারীরা যে ব্যক্তিত্ব, সম্মান ও পরিতৃপ্তি লাভ করতে পারতো তা তো আর পুনর্গঠিত হলো না। তবে এই বিপ্লবে নারীরা পুরুষের সমান পারিশ্রমিক লাভের অধিকার টুকু লাভ করে। আর ইউরোপ এই স্বাভাবিক অধিকারটুকু দিতে সম্মত হয়নি, বরং এক সুদীর্ঘ ও সুকঠিন দ্বন্দব ও টানা-হেঁচড়ার পরেই সমতাটুকু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এরূপ একটি সংগ্রামে স্বাভাবিকভাবে যে সকল হাতিয়ার ও উপায়-উপাদান ব্যবহার করা যেতে পারে তার সবটুকুই ব্যবহার করা হয়েছে।
অধিকার আদায়ের এই সংগ্রামে নারীদের হরতালের পর হরতাল করতে হয়েছে, জনসমর্থন লাভের জন্যে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ ও মিছিল করতে হয়েছে। জনসভা ও পথসভার অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। প্রেস ও সাংবাদিকদের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করতে হয়েছে। এতকিছু করার পরেই অনুভূত হয়েছেছ যে, এই বিরোধের অবসানের জন্যে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নারীদেরকেও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ করতে হবে। প্রথমে তাদের ভোটাধিকারের দাবী উত্থাপন করা হয়। এই দাবী জোরদার হতে হতে শেষ পর্যন্ত এই শ্লোগান তোলা হয় যে, নারীদেরকে পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার অধিকার দিতে হবে। যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অধনে এই সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠে তার মৌল জীবন দর্শনে যেহেতু নারী-পুরুষের পার্থক্য বলতে কিছুই নেই সেহেতু দেশ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই নারী-পুরুষের সমান হওয়ার দাবী অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
ইউরোপের নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এই হল তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এ হল একটি ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাস। এর সব অংশই একটি কঠিন সূত্রে আবদ্ধ। এই পরিস্থিতি পুরুষদের কাম্য ছিল কি ছিল না তা আমাদের লক্ষণীয় নয়। তবে নারীরা অবিলম্বেই বুঝতে সক্ষম হল যে, যে বিকৃত সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের পদ থেকে তারা পুরুষদের সরিয়ে দিয়েছে সেখানে তারা নিজেরাও পুরুষদের মতই নিরুপায় ও অসহায়। [এ ধরনের ঘটনাবলীর পটভূমিতে মার্কসবাদীরা দাবী করে যে, মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক কারণই একমাত্র কারণ। (Factor) ইহাই একমাত্র নিয়ামক। ইউরোপীয় নারবীদের স্বাধীনতা আন্দোলনই নাকি এর বড় প্রমাণ। আমরা পূর্বেই বলেছি যে, অর্থনৈতিক গুরুত্বকে আমরা অস্বীকার করি না, কিন্তু একথা নিশ্চিত সত্য যে, ইউরোপবাসীদের নিকট যদি ইসলামের ন্যায় কোন মহান লক্ষ্য ও জীবনব্যবস্থা থাকতো –যাতে সর্বাবস্থায় নারীদের জীবন-জীবিকা ও ইজ্জত-সম্ভ্রমের দায়িত্ব পুরুষদের গ্রহণ করতে হয়, নিরুপায় অবস্থায় কোন নারী রুজির জন্যে কোন কাজ করলে তাকে পুরুষের সমান পারিশ্রমিক দিতে হয় এবং জ রুরী পরিস্থিতিতে পুরুষদেরকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয় যাতে করে নারীরা একদিকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভ করতে পারে এবং অন্যদিকে যৌন অনাচার ও বিশৃংখলার হাত থেকেও বেঁচে থাকতে সক্ষম –তাহলে সেখানকার নারীদের এরূপ মর্মান্তিক অবস্থার শিকার হতে হতো না।]
কিন্তু পাঠকবৃন্দ একথা শুনে নিশ্চয়ই আশ্চার্যান্বিত হবেন যে, যে ইংল্যাণ্ড গণতান্ত্রের হোতা বলে বিশ্ববিখ্যাত সে দেশের সরকারের বিভিন্ন বিভাগে নারীদেরকে পুরুষদের চেয়ে কম বেতন-ভাতা দেয়া হয়; অথচ সেখানকার নারী প্রগতির অবস্থা এতদূর তুঙ্গে যে, বেশ কিছুসংখ্যক মহিলাই জাতীয় পার্লামেন্টর আসন অলংকৃত করছে।
এখন আসুন। ইসলাম নারীদেরকে কি মর্যাদা ও স্থান দিয়েছে তাও আমরা দেখি। ইসলামী সমাজব্যবস্থায় নারীদেরকে যে সম্মানজনক মর্যাদা দেয়া হয়েছে তা লাভ করার পর এমন কোন ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, তাত্ত্বিক অথবা আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকে কি যাতে করে স্বীয় অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে ইউরোপীয় বোনদের ন্যায় নিরুপায় হয়েই সংগ্রামের পর সংগ্রাম করে যেতে হবে? এরপরই আমরা জানতে পারবো যে, প্রাচ্যের নারী স্বাধীনতার ধ্বজাধারীরা যে হৈহুল্লোড় ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে বেড়াচ্ছেন তা কি সত্যিই অর্থবহ, না পাশ্চাত্যের পদলেহনের নির্লজ্জ অভিব্যক্তি মাত্র।
ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্য –সাম্য
ইসলামী সমাজব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, উহা পুরুষকে যেমন মানবীয মর্যাদা দান করে। নারীকেও ঠিক তেমনি মানবীয় মর্যাদা দান করে। পুরুষের মধ্যে যেমন রূহ আছে বলে স্বীকার করে। নারীর মধ্যেও ঠিক রূহ আছে বলে বিশ্বাস করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী************)
“হে লোক সকল! তোমাদের সেই প্রভু পরোয়ারদেগারকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে একটি জান থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং সেই দু’টি থেকে বহু পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।” –(সূরা আন নিসা: ১)
মোটকথা, পুরুষ ও নারী জন্মা, অবস্থান এবং শেষ পরিণতির দিক থেকে একজন আর একজনের সমকক্ষ, সমান এবং একইরূপ অধিকারের হকদার। ইসলাম নারীকে একইরূপ জান, ইজ্জত ও সম্পদের অধিকার দান করেছেন; তাদের ব্যক্তিত্বকে সম্মানীয় বলে ঘোষণা করেছে। ইসলাম কাউকেই এই অধিকার দেয় না যে, সে তাদের দোষ অন্বেষণ করবে কিংবা তাদের পশ্চাতে কোনরূপ নিন্দা করবে। কাউকে এই সুযোগও দেয় না যে, কেউ তার ওপর মোড়লি করবে কিংবা তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালনের জন্যে তাদেরকে তুচ্ছ জ্হান করবে। নারীদের এই অধিকারসমূহ পুরুষদের ন্যায় স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্রও পার্থক্য নেই। এতদসংক্রান্ত যাবতীয় আইন-কানুনই নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যেই সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
(আরবী************)
“হে ঈমানদারগণ! পরুষরা যেন পুরুষদেরকে উপহাস না করে; কেননা হতে পারে সে ব্যক্তি (যাকে উপহাস করা হল) তার চেয়ে (আল্লাহর দৃষ্টিতে) উত্তম। এবং নারীরাও যেন নারীদেরকে উপহাস না করে। কেননা হতে পারে সে তার চেয়ে ভালো। এবং একে অন্যকে বিদ্রূপ করো না। একে অন্যকে মন্দ খেতাব দিয়ে ডেকো না। …. একে অন্যের ছিদ্র অন্বেষণ করো না এবং একে অন্যের পশ্চাতে নিন্দা করো না। -(সূরা আল হুজরাত: ১১-১২)
(আরবী***********)
“হে ঈমানগণ! তোমরা নিজেদের গৃহব্যতিত অন্যদের গৃহে প্রবেশ কর না। -যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি লাভ করবে এবং উহার অধিবাসীদেরকে সালাম প্রদান করবে।” –(সূরা আন নূর: ২৭)
(আরবী***********)
“এক মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের রক্ত, সম্মান এবং সম্পদ হারাম।” –(বুখারী ও মুসলিম)
অনুরূপভাবে ইসলাম আজর বা ছওয়াবের ক্ষেত্রেও পুরুষ এবং নারীকে সমান হকদার বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী***********)
“অতপর ঈমানদারদের রব তাদের দোয়া কবুল করেছেন। নারী হোক পুরুষ হোক তিনি কারুর আমল বিনষ্ট করেন না। তোমরা পরস্পর একে অন্যর অবিচ্ছেদ্য অংশ।” –(সূরা আলে ইমরান: ১৯৫)
স্থাপর সম্পত্তিতে সমঅধিকার
স্থাপর ও অস্থাবর সম্পত্তিতেও ইসলাম পুরুষ ও নারীদের মধ্যে সমতার প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউই তার যে কোন ধরনের সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। বন্ধক রাখতে পারে। পাট্টা দিতে পারে। কাউকে উইল করতে পারে। অধিকতর জমিন বৃদ্ধির মাধ্যমে বানাতে পারে, নিজের যেকোন প্রয়োজন ব্যবহার করতে পারে। এ ধরনের সকল ব্যাপারেই ইসলাম নারী ও পুরুষকে একই রূপ সমান অধিকার প্রদান করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী***********)
“পিতামাতা ও ঘনিষ্ট আত্মীয়রা যা রেখে যায় তাতে পুরুষদের অংশ রয়েছে। এবং পিতামাতা ও ঘনিষ্ট আত্মীয়রা যা রেখে যায় তাতে নারীদেরও অংশ রয়েছে।” –(সূরা আন নিসা: ৭)
(আরবী***********)
“পুরুষদের জন্যে রয়েছে তাদের আমলের প্রতিদান এবং নারীদের জন্যে রয়েছে তাদের আমলের প্রতিদান।” –(সূরা আন নিসা: ৩২)
ইউরোপ ও স্থাপর সম্পত্তির অধিকার
সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার এবং উহা ব্যবহারের নিঃশর্ত অধিকার সম্পর্কে দু’টি কথা স্মরণ রাখা একান্ত প্রয়োজন। সভ্য (১) ইউরোপের আ্ইন-কানুনে বর্তমানকাল পর্যন্ত স্থাপর সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার বলতে কিছুই ছিল না। আইনগতভাবে সরাসরি উহা ব্যহবার করার কোন সুযোগও তাদের ছিল না। তারা কোন না কো পুরুষ –যথা স্বামী, পিতা কিংবা কোন অভিভাবকের মাধ্যমে উহা ব্যবহার করতে পারতো। অন্য কথায় বলা যায় যে, ইসলামের পক্ষ থেকে নারীদেরকে এসব অধিকার প্রদান করার এগার শত বছর পর পর্যন্তও ইউরোপের নারীরা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে এবং উহা লাভ করার জন্যে তাদেরকে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে; আর তখন লুণ্ঠিত হয়েছে তাদের নারীত্ব ও সতীত্ব, বিপন্ন হয়েছে তাদের ইজ্জত ও সম্ভ্রম। শুধু তাই নয়, সে জন্যে স্বীকার করতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, উৎসর্গ করতে হয়েছে অসংখ্য প্রাণ। কিন্তু এত করেও তারা লাভ করলো সামান্য কিছু অধিকার। অথচ ইসলাম বহু পূর্বেই নারীদেরকে দিয়েছে এর চেয়ে বহুগুণ এবং বহু কল্যাণকর মৌলিক অধিকার। কিন্তু ইসলাম এ অধিকার দিয়েছে একান্ত পশ্চাতে কার্যকরী ছিল না। বরং এর পেছনে ছিল ইসলামর এক মহান উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করা। আর তা ছিল: মানুষের জীবনে যেন দু’টি মৌলিক সত্য –সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার –মূর্তিমান ও উদ্ভাসিত হয়ে উঠে –শুধু কল্পনার জগতেই নয়, বাস্তবজগতেই যেন উহা ভাস্বর হয়ে উঠে।
দ্বিতীয়ত, আরো একটি কথা স্মরণ রাখা করত্ব্য যে, সাধারণভাবে পাশ্চাত্যের এবং বিশেষভাবে সমাজতন্ত্রীদের দৃষ্টিভংগি হলো : মানবীয় জীবন প্রকৃতপক্ষে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার নামান্তর। তাদের মতে, নারীদের যতদিন মালিকান স্বত্ব অর্জিত হয়নি এবং নিজেদের সম্পত্তি ও মালিকানা স্বত্বে স্বাধীন ইচ্ছাকে কার্যকরী করতে পারেনি ততদিন নিশ্চয়ই তারা পুরোপুরি মালিকানা লাভ করতে পারেনি; স্বাধীন মানবীয় মর্যাদা তারা তখনই লাভ করেছে যখন তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং এতদূর যোগ্যতা হাসিল করতে পেরেছে যে, নিজেদের মালিকানা স্বত্বে অন্য কোন পুরুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সরাসরি স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছা প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে এবং নিজ মর্জি অনুযায়ী ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছে।
নারীদের স্বাধীন মর্যাদা
মানুষের জীবন সম্পর্কে সমাজন্ত্র ও পুঁজিবাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগি আমরা সমর্থন করি না। উহার কারণে মানুষের জীবন পশুর ন্যায় নিকৃষ্টতম অর্থণৈতিক স্তরে নেমে যেতে বাধ্য হয়। তবে তাদের একটি ধারণার সাথে আমরা নীতিগতভাবে একমত যে, মানব সমাজে মানবীয় চিন্তাধারা ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের উপর একটি সুষ্ঠু অর্থব্যবস্থার প্রভাব বহুলাংশে পতিত হয়। ইসলাম এদিক থেকে এক বিশেষ গৌরবের অধিকারী যে, উহা নারীদেরকে স্বাধীন অর্থনৈতিক মর্যাদা প্রদান করেছে এবং তাদেরকে এই অধিকার দিয়েছে যে, কোন প্রকার মাধ্যম ব্যতিরেকেই তারা একেবারে সরাসরিই তাদের যাবতীয় সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এখানেই শেষ নয়। ইসলাম নারীদেরকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় –বিবাহের ব্যাপারেও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছা মাফিক কাজ করার অধিকার দান করেছে এবং এরূপ ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, তাদের ইচ্ছা ব্যতিরেকে তাদের বিবাহ দেয়া যেতে পারে না। বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্যে তাদের স্বাধীন সম্মতি একটি অলংঘনীয় শর্ত। হযরত বিশ্বনবী (স) বলেন:
“কোন বিধবা নারীর বিবাহ তার পরামর্শ ব্যতিরেকে হতে পারে না; এবং কোন কুমারী নারীর বিবাহ তার সম্মতি ছাড়া হতে পারে না। এবং একজন কুমারীর সম্মতি হলো তার চুপ থাকা।” –(বুখারী ও মুসলিম)
বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করর অধিকার
ইসলামের পূর্বে যদি কোন স্ত্রী বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইতো তাহলে তাকে সে অধিকার দেয়া হতো না। তখন তাকে বাধ্য হয়েই অবৈধ ও ভুল পন্থা অবলম্বন করতে হতো। তখন স্বামীই হতো স্ত্রীর সর্বময় ক্ষমতার মালিক। স্ত্রীকে তার মর্জির বাইরে কোন কিছু করার এখতিয়ার ছিল না। কেননা তখন কোন দেশেই আইনগতভাবে তালাকের কোন অবকাশ ছিল না এবং দেশের প্রচলিত নিয়মেও এমন কোন ব্যবস্থার কথা চিন্তাই করতে পারতো না। ইসলামই সর্বপ্রথম নারীদেরকেক এই অধিকার অত্যন্ত স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দিয়েছে যে, যে কোন নারীই যখন ইচ্ছা করবে তখনই সে অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। [পাশ্চাত্যে এখন যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ বর্তমান তার প্রতি তাকালে বাহ্যিকভাবে মনে হয় যে, নারীদের এই অধিকারটুকুর স্বরূপ দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের এই বর্তমান অবস্থা ইসলামের কারণে সৃষ্টি হয়নি; বরং এটা হলো ইসলাম থেকে সরে যাওয়ার অপরিহার্য পরিণতি। ইসলামর প্রথম যুগে নারীরা এই অধিকার প্রয়োগ করতো। আইন প্রণেতা হিসেবে স্বয়ং বিশ্বনবী (স) এবং তাঁর পরে তার খলীফাগণ নারীদের এই অধিকার পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছে। আজ আমাদের দাবী শুধু এতটুকুই যে, ঐ সকল ইসলামী আইন প্রবর্তন করা হোক এবং উহার পথের বাধাগুলো অপসারিত করা হোক –চাই উহা পাশ্চাত্যের বর্তমান সামাজিক বা অর্থনৈতিক ফসল হোক কিংবা অনৈসলামিক আচার-আচরণের অন্ধ অনুসরণের কুফল হোক।] এমনকি আরো এক কদম অগ্রসর হয়ে উহা নারীদেরকে এই ক্ষমতাও দান করেছে যে, তারা নিজেদের ইচ্ছামত যাকে ইচ্ছে তাকেই বিবাহ করতে পারবে; এমনকি নিজের পসন্দনীয় ব্যক্তিকে বিবাহ করার পয়গামও পাঠাতে পারবে। ইসলামের শত শত বছর পর বিগত আঠারো শতকে এসে ইউরোপের নারীরা এই ধরনর কিছু অধিকার হাসিল করেছে; অথচ একে প্রাচীন রীতির বিরুদ্ধে এক বিরাট বিজয় বলে আখ্যায়িত করছে।
বিদ্যা অর্জনের অধিকার
একমাত্র ইসলামই সর্বপ্রথম সমস্ত মানুষের জন্যে বিদ্যা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে, যখন মূর্খতা ও মূঢ়তার গাঢ় অন্ধকারে সমমর্ত জগত আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। ইসলাম কেবল শ্রেণী বিশেষকেই বিদ্যা অর্জনের অধিকার দেয়নি। বরং প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই ইহাকে অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করেছে। সমস্ত মুসলমানের জন্যেই উহাকে ঈমান ও ইসলামের অপরিহার্য শর্ত বলে গণ্য করেছে। ইসলাম এরূপ একটি একচ্ছত্র গৌরবেরও অধিকারী যে, উহা নারীদেরকে স্বাধীন অস্তিত্ব দান করে তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে যে, বিদ্যা শিক্ষা ব্যতিরেকে তাদের ব্যক্তিত্ব কখনো পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। বি দ্যা অর্জন করা পুরুষদের জন্যে যেমন ফলয নারীদের জন্যেও ঠিক তেমনিভাবে ফরয। কেনা ইসলাম চায় একটি আদর্শ ও উন্নতমানের জীবন-যাপনের জন্যে নারী জাতি শারীরিক যোগ্যতার সাথে সাথে জ্ঞান ও মানসিক দিক থেকেও উন্নতি লাভ করুক। পক্ষান্তরে ইউরোপ বর্তমানকালের পূর্ব পর্যন্ত নারীদেরকে এই ধরনের কোন অধিকার প্রদান করতে পারেনি। সেখানে এ অধিকার কেবল তখনই দেয়া হয়েছে যখন অর্থনৈতিক চাপের ফলে তাদের সামনে বিকল্প কোন পথ উন্মুক্ত ছিল না।
উপরোক্ত আলোচনায় একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলাম বিরোধী চক্র নারীদের ব্যাপারে ইসলামের বিরুদ্ধে যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তার মূলে আদৌ কোন ভিত্তি নেই। তার বলে: ইসলাম নারী জাতিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর জীব হিসেবে গণ্য করে, উহা তাদেরকে পরুষদের অধীন করে রাখতে চায়, উহার দৃষ্টিতে তাদের জীবনের আদৌ কোন মূল্য নেই। এই অভিযোগগুলোর বিন্দুমাত্র মূল্য থাকলেও ইসলাম নারী শিক্ষার প্রতি এতদূর গুরুত্ব কিছুতেই আরোপ করতো না। এরূপ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে একথা প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারী জাতি একদিকে আল্লাহর নিকট এবং অন্যদিকে ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থায় এক সুউচ্চ ও সম্মানীনর আসনের অধিকারী।
নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্যের মাপকাঠি
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এবং অধিকারের দিক থেকেও কোন তারতম্য নেই। কিন্তু কাজকর্মের প্রকৃতির দিক থেকে স্বাভাবিকভাবেই যে পার্থক্য তাদের মধ্যে বিরাজমান ইসলাম তাকে উপেক্ষা করতে পারে না। অসংখ্য মহিলা সংস্থাও তাদের সমর্থক কবি-সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক ও তরুণ সম্প্রদায় ইসলামের এই দৃষ্টিভংগির বিরুদ্ধে বেসামল হয়ে উঠেছে। এটা নাকি ইসলামের এক অমার্জনীয় অপরাধ।
পুরুষ ও স্ত্রী জাতির মধ্যে ইসলাম যে সকল ব্যাপারে পার্থক্য নির্দেশ করে তার প্রতি দৃকপাত করার পূর্বে আসুন, শারীরিক, জৈবিক ও মনস্তাত্বিক দিক থেকে উভয় শ্রেণীর মধ্যে কী পার্থক্য বিরাজমান তা একবার পর্যালোচনা করি। এরপর ইসলামী দৃষ্টিভংগি নিয়ে আলোচনা করবো।
মূল বিষয়
পুরুষ ও নারী কি একই জাতি? নাকি দু’টি পৃথক পৃথক জাতি? জীবনে উভয়ের কাজ কি একই? না নারী ও পুরুষ হওয়ার কারণে তাদের দায়-দয়িত্বের পরিমণ্ডল আলাদা আলাদা? এই প্রশ্নগুলো বড়ই জটিল। কিন্তু এগুলোর সমাধানের উপরই নারী-পুরুষের মূল সমস্যার সমাধান নির্ভরশীল। যে সকল নারী ও তাদের সমর্থক লেখক, সাহিত্যিক, সংস্কারক ও তরুণ এই মত পোষণ করে যে, পুরুষ ও নারীর শারীরিক ও মানসিক অবকাঠামোতে তফঅৎ বলতে কিছুই নেই এবং সে কারণে জীবনের যাবতীয় কাজ-কর্মও হবে হুবহু একই প্রকৃতির। তাদেরকে কিছু বলার কোন প্রশ্নই উঠে না। তবে যারা পুরুশ ও নারীদের দৈহিক গঠন প্রক্রিয়ায় এবং তাদের কাজ-কর্মে কোন পার্থক্য স্বীকার করে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু অর্থবহ আলোচনা হতে পারে।
উভয় শ্রেণীর সমতা সম্পর্কে কিছু অর্থবহ আলোচনা হতে পারে।
উভয় শ্রেণীর সমতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আমার লেখা ‘আল ইনসানু বাইনাল মাদ্দিয়াতে ওয়াল ইসলাম’ নামক পুস্তকে দেখা যেতে পারে। প্রয়োজন অনুসারে উহার কিছু কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরা যাক।
দায়িত্ব ও লক্ষ্যের পার্থক্য
উভয় শ্রেণীর কাজ-কর্ম ও লক্ষ্যের মধ্যেই এই বুনিয়াদী পার্থক্র পরিস্ফুট হয়ে উঠে যে, মন-মেজাজ ও দৈহিক গঠন প্রণালীর দিক থেকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে বাস্তবেই এমন তারতম্য দেখা যায় যে, তারা নিজ নিজ কর্ম পরিধির মধ্যেই সুন্দর ও সুশৃংখলভাবে কাজ করতে সক্ষম।
এ কারণেই এখনো আমি বুঝতে অক্ষম যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে পরিপূর্ণ সমতা বিধানের যে অন্তসারশূন্য বক্তৃতা করা হয় বাস্তব দুনিয়ায় উহাকে কার্যকরী করা কেমন করে সম্ভবপর? মানুষ হওয়ার দিক থেকে পুরুষ ও নারীর সমান হওয়া একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক সত্য। মানব সমাজের তারা একই রূপ সদস্য। একই পিতার সন্তান হিসেবেও তারা সমান। কিন্তু বাস্তব জীবনের দায়-দায়িত্বে ও যাবতীয় কর্মকাণ্ডে তারা কি সমান হতে পারে? পুরুষের স্থানে নারী এবং নারীর স্থানে পুরুষ কি একইভাবে একই কাজ করতে সক্ষম হতে পারে? এ ধরনের সমতা কি বাস্তবে সম্ভবপর? সারা বিশ্বের নারীও যদি সমস্বরে এরূপ সমতার দাবী জানায়, সভা-সমিতি ও জলসা-জুলূস করে তাদের পক্ষে প্রস্তাবাদি পাশ করে তবুও তাদের এই স্বপ্ন কখনো সফল হওয়ার নয়। সভা-সমিতির প্রস্তাবাদিও কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। তাদের উভয় শ্রেণীর কর্মকাণ্ডে এমন কিছুও ঘটাতে পারবে না যাতে করে নারীরা পুরুষদের কাজ করা শুরু করবে এবং পুরুষরা নারীদের স্থলে গর্ভধারণ, সন্তান উৎপাদন ও স্তন্য দানের দায়িত্ব পালন করতে থাকবে।
স্বভাবগত ও মনস্তাত্বিক পার্থক্য
নারী জাতিকে তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব –গর্ভধারণ ও স্তন্যদান –আঞ্জাম দেয়ার জন্যে যে ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও মনস্তাত্বিক যোগ্যতার একান্ত প্রয়েঅজন তা কেবল তাদেরকেই দান করা হয়েছে। এবং সে কারণেই তারা তাদের সুকঠিন দায়িত্বসমূহ পালন করতে সক্ষম হয়।
নারীদের মেজাজ ও প্রকৃতি
এ এক বাস্তব সত্য যে, যে বিশেষ মন-মেজাজ নারীদেরকে তাদের আসল দায়িত্ব পালন –গর্ভধারণ ও দুগ্ধদান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং যে কারণে তাদের মনস্তাত্বিক ও মানসিক ব্যবস্থার একটি বিশেষ পরিবেশ রচিত হয় তা বর্তমান না থাকলেমায়ের স্নেহ, আশা-আকাংখা, উন্নত কর্মতৎপরতা, কঠিন মসিবত ও দুঃখ-কষ্টের সময়ে ধৈর্য ও সহনশীলতা এবং সহানুভূতি ও সমবেদনার বহিঃপ্রকাশ কস্মিনকালেও সম্ভবপর হতো না। নারীদের এই মনস্তাত্বিক, মানসিক ও স্বাভাবিক বৈশিষ্টগুলো যে পাশাপাশিই বর্তমান তা-ই নয়, একটি আরেকটির সম্পূরকও বটে। দ্বিতীয়ত, এগুলোর মধ্যে পরিপূর্ণ সামস্যও বর্তমান্য। এ কারণে নেহাত কোন ব্যতিক্রম ছাড়া এগুলোর কোন একটির অবর্তমানে অন্যকোনটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
নারী চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নারীদের মন জ্ঞান দ্বারা নয় বরং বিশেষ ধরনের আবেগ প্রবণতা দিয়ে গঠিত। তহাদের এই আবেগ প্রবণতাই জীবন্ত স্নেহ-মমতার একমাত্র উৎস। কেননা সন্তান লালন-পালনের জন্যে যে যোগ্যতা ও গুণপণার প্রয়োজন তা শুধু জ্ঞঅন দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে না; বরং তার জন্যে প্রয়োজন প্রচণ্ড আবেগ ও সীমাহীন উদ্যম। এই প্রচণ্ড আবেগই তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় কোন কিছু করার বা না করার সুযোগও দেয় না, বরং সংগে সংগেই সন্তানের যে কোন প্রয়োজন মেটাবার জন্যে তাদেরকে উন্মাদ করে তোলে; বিন্দুমাত্র বিলম্ব বা অলসতা দেখাবার কোন চিন্তাই তারা করতে পারে না।
নারী জীবনের প্রকৃত ব্রত এটাই। নারীদের যাবতীয তৎপরতায় এই ব্রতই তাদেরকে শক্তি যোগায় এবং এটাই তাদের সৃষ্টি ধর্মী লক্ষ্য অর্জনের পথকে প্রশস্ত করে দেয়।
পুরুষের কাজ
পুরুষদের কাজের প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্য রূপ। এবং সেই কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত যোগ্যতাই –যা নারীদের যোগ্যতার চেয়ে ভিন্নতর –পুরুষদেরকে দান করা হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়াই তার প্রধান কাজ। তারা বন্য হিংস্র প্রাণীকে বশ মানায়, আসমন-জমিনের প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে, সরকার গঠন করে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদির আইনও রচনা করে। এই সকল জটিল সমস্যার সমাধানের পর জেদের উপার্জনের এবং স্ত্রী ও সন্ততিদের অন্যদের যুলুম ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হয়।
পুরুষদের মানসিকতা
বস্তুত পুরুষদের দায়িত্ব সম্পাদনের জন্যে মহিলাদের ন্যায় প্রচণ্ড আবেগ প্রবণ মানসিকতার কোন প্রয়োজন নেই। পুরুষদের যে ধর নের কাজ করতে হয়, তাতে আবেগ প্রবণতা কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। বয়ে আনে ক্ষতি ও অকল্যঅণ। কেননা তাদের সে আবেগের বিশ্রাম বা বিরতির স্থান নেই; প্রতি মুহূর্তেই ঘটে উত্থান-পতন এবং সৃষ্টি হতে থাকে পরস্পর বিরোধী অদ্ভূত মানসিকতর। আবেগের কারণে এমন কোন যোগ্যতারই সৃষ্টি হয় না যাতে করে কোন লোক ধরাবাধা নিয়মে দীর্ঘকাল কাজ করতে পারে। তাদের পসন্দ না পসন্দ হওয়র কাজটিও পরিবর্তিত হতে থাকে। এরূপ সদা পরিবর্তনশীল মন-মানসিকতা একজন মায়ের জন্যেই সামঞ্জস্যশীল; কিন্তু একজন পুরুষের জন্যে এটা আদৌ কল্যাণকর নয়। কেননা তাদের কাজের ধরনই হচ্ছে এই যে, তাদেরকে স্বাধীন ও সুদৃঢ় মনোভাব ও অদম্য সাহসিকতার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে এক একটি কাজ আঞ্জাম দিতে হয়। তাদের বাস্তব জীবনে যেখানে অসংখ্য বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয় সেখানে তাদের আবেগ নয- বরং একমাত্র জ্ঞানই তাদেরকে সাহায্য করতে পারে। ভবিষ্যতে কর্তব্য নির্ধারণ করার জন্যে হোক, বর্তমান পরিস্থিতির সমীক্ষার জন্যে হাক কিংবা কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ের পূর্বে প্রত্যাশিত ফলাফল সম্পর্কে পর্যালোচনার জন্যে হোক একমাত্র বুদ্ধি বা জ্ঞানই তাদেরকে সঠিক দিশা দিতে পারে। জ্ঞানের গতি ধীর। কিন্তু উহাতে স্থায়ীত্ব ও দৃঢ়তা বর্তমান। হঠাৎ করেই কিছু করা উহার নিকট প্রত্যাশিত নয়। কেননা এগুলো হচ্ছে আবেগ প্রবণতার বৈশিষ্ট্য। ইহা নারীদের নারীত্বকেই আরো শোভনীয় করে তোলে। জ্ঞানের নিকট শুধু ইহাই আশা করা যায় যে,কোন লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যুক্তিসম্মত পন্থায় কাজ করার জন্যে আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দিবে। -তাই আমরা কোন বন্য প্রাণী শিকার করতে অগ্রসর হই, কোন নতুন হাতিয়ার আবিস্কার করার জন্যে গভেণায় লিপ্ত হই, কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করি, কোন রাষ্ট্র বা সরকার গঠন করি। কোন বাইরের রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ বা সন্ধি স্থাপন করার ঘোষণা দেই। অনস্বীকার্য য, এই সকল ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন দায়িত্ব পালনের একমাত্র বুদ্ধিই আমাদের প্রধান অবলম্বন। এ সকল ক্ষেত্রে বুদ্ধির স্থলে আবেগ দ্বারা পরিচালিত হলে সাফল্যের আশা করা বাতুলতা মাত্র।
সফল পুরুষ ও নারী
একজন পুরুষকে তার জীবনে শুধু তখনই সফল পুরুষ বলে গণ্য করা যায় যখন সে তার আসল কাজ ও মূল কর্তব্যকে যথারীতি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। এতে করে পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক পার্থক্যের কারণ যমন উপলব্ধি করা যায় তেমনি করে ইহাও অবগত হওয়া যায় যে, পুরুষ সেই সকল কাজে কেন সুখ ও তৃপ্তি লঅভ করে যাতে তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি ব্যবহার করা হয় এবং কেনই বা সে আবেগের জগতে এসে নিজেকে শিশুর মত অসহায় ভাবতে শুরু করে। পক্ষান্তরে এই আবেগের রাজ্যে একজন নারী চরম আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে। কেনা এই হচ্ছে তার সেই কাঙ্খিত পরিমণ্ডল যেখানে অবস্থান কর সে স্বীয় কর্তব্য-কর্ম সুন্দরভাবে কার্যকরী করতে সক্ষম হয় –যেমন নার্সিং, শিক্ষকতা, ধাত্রীগিরি ইত্যাদি পেশায় তারা আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করে। অনুরূপভাবে দোকানে কাজ করেও তারা পরিতৃপ্ত পায়। কেননা দোকানের মাধ্যমে তারা পুরুষ সাধী খুঁজে নেয়ার অবকাশ পায়। কিন্তু সকল কাজই তার মূল কাজের অধীন। একজন স্বামী, ঘর-সংসার বা সন্তানরা তার নিকট স্বাভাবিকভঅবে যা দাবী করে এবং যে দাবী তার প্রকৃতিরও মূল দাবী তা ঐ সকল কাজ দ্বারা কখনো পূর্ণ হতে পারে না। কেননা এটা একান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার যে, যখনই সে তার মূলকাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ লাভ করে তখন চাকুরী বা অন্যান্য কাজ-কর্ম ছেড়ে দিয়ে কেবল গৃহকর্মেই মশগুল হয়ে পড়ে। এবং জরুরী পরিস্থিতি বা টাকা-পযসার নেহাত প্রয়োজন না হলে গৃহের বাইরে কিছুতেই আসতে চায় না।
আবার নারী ও পুরুষের মধ্যে এমন মৌলিক পার্থক্র অবশ্যই নেই যে, তারা পরস্পর কখনো এক হতে পারবে না। আর উহার অর্থ এ-ও নয় যে, নারী ও পুরষ –এই দু’টি শ্রেণীর কোন একটির মধ্যে এমন যোগ্যতা আদৌ থাকতে পারে না যা প্রকৃতির দিক থেকে বিপরীত শ্রেণীর মধ্যে বর্তমান।
পুরুষ ও নারীর সাধারণ কাজ
পুরুষ ও নারী উভয় শ্রেণীই যেন অন্ত্র বা নাড়ীভূঁড়ির মত অংগাংগিভাবে জড়িত। যদি দেখা যায় যে, এমন নারীও আছে যে রাজ্যে শাসনের উপযুক্ত গুণের অধিকারী। বিচারকের আসনে সমাসীন, ভারী বোঝা বহন করতে সক্ষম। এমনকি যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করতেও পারদর্শী… আর এও যদি দেখা যায় যে, এমন পুরুষও রয়েছে যে, রান্না-বান্না করতে উস্তাদ, গৃহের কাজ-কর্মে পটু, শিশুদের প্রতি মায়ের মতই স্নেহ-মমতা দেখাতে সক্ষম, নারীর মতই আবেগ প্রবণ ও সাজসজ্জায় আগ্রহী এবং এক এক সময়ে এক এক প্রকার মানসিকতা ও মেজাজের অধিকারী তাহলে একথা ভুলে গেলে চলবে না এর সবকিছুই স্বাভাবিক ও প্রকৃতির বিপরীত বলতে এতে কিছুই নেই। এ হচ্ছে এ কথারই যুক্তিসম্মত ফলাফল যে, নারী-পুরুষের প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে অতিরিক্তভাবে অন্য শ্রেণীর বীজানুও বর্তমান থাকে। কিন্তু এর সাহায্যে পথহারা পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ এবং তাদের প্রাচ্যের অনুসারীরা এটা কখনো প্রমাণ করতে পারে না যে, নরী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্র একই হওয়া উচিত। আর এই ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টান্ত দ্বারা যে প্রশ্নটি হতে পারে তাহলো এই যে, তাহলো একজন নারীর কার্যক্ষেত্র কি পরিবর্তিত হতে পারে? যদি পারে তাহলে পুরুষের কাজ আঞ্জাম দেয়ার পরে সেকি ঘর সংসার, সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের প্রয়োজন অনুভব করবে? তার মনের এই শূন্যতা পূরণ হবে কি? এবং এর পরে নিজের যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্যে কোন পুরুষ সাথীর সন্ধান থেকে বিরত থাকবে কি?
পুরষ ও নারীর পারস্পরিক পার্থক্য অনুধাবন করার পর এখন আসুন, সেই বিষয়ও পর্যালোচনা করে দেখি যার ভিত্তিতে ইসলাম পুরুষ ও নারীদের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা নির্ধারণ করে এবং উভয়ের জন্যে পৃথক পৃথক কর্মক্ষেত্রের বিধান দেয়।
স্বাভাবিক জীবন পদ্ধতি
ইসলামের একটি মহন বৈশিষ্ট্য এই যে, উহার জীবন পদ্ধতি পরিপূর্ণরূপেই বাস্তবধর্মী। প্রকতির বিরুদ্ধে উহার কোন ভূমিকা নেই। উহাতে সংশোধন বা রহিতকরণের যেমন কিছুই নেই। তেমনি উহার প্রতিটি পদক্ষেপেই মানুষের স্বভাব এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল। উহা মানুষকে আধ্যাত্মিক পরিবত্রতায় মহিমান্বিত করে তোলে। উহা মানুষকে এতদূর উন্নত করে তুলতে চায় যে, উহার ডাণ্ডাও যেন আদর্শিকতার (Idealism) সাথে মিলে যায়। কিন্তু উন্নত ও পবিত্রতা অর্জনের সমগ্র কর্মকাণ্ডে কোথাও উহা মানুষের প্রকৃতির সাথে গরমিল বা সংঘর্ষের সৃষ্টি করে না। কেননা উহা বিশ্বাস করে: মানুষের প্রকৃতিতে কোন পরিবর্তন কখনো সম্ভবপর নয় এবং এরূপ করা কোন দিক থেকে কল্যাণকরও হতে পারে না। উহা বিশ্বাস করে: মানবতার যথার্থ উন্নতি উহাই যা মানুষ নিজের প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নয়; বরং উহার দাবী পূর্ণ করে এবং উহাকে এমনভাবে পরিমার্জিত করে হাসিল করবে যাতে করে সে নেকী ও সদানুষ্ঠানের সর্বোচ্চ মঞ্জিলে পৌঁছতে সক্ষম হয়। -নেকাীই হয় যেন তার কাঙ্খিত সম্পদ, আর প্রবৃত্তির দাসত্ব যেন হয় বিষবৎ পরিত্যজ্য।
পার্থক্যের দু’টি ক্ষেত্র
নারী ও পুরুষদের ব্যাপারে ইসলাম যে দৃষ্টিভংগি পোষণ করে তা মানবীয় প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুকূল। অবশ্য যেখানে কোন প্রাকৃতিক ভিত্তি বর্তমান, ইসলাম সেখানে উভয়ের মধ্যে সমতার বিধান দেয়। আর প্রকৃতি যেখানে পার্থক্যের দাবী করে সেখানে উহা পার্থক্যকেই মেনে নেয়। ইসলাম যে সকল ক্ষেত্রে পার্থক্য করে তার মধ্যে দু’টি ক্ষেত্রই অধিকতর উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি হলো পরিত্যক্ত সম্পত্তির বন্টন এবং দ্বিতীয়টি হলো পরিবারের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন।
পরিত্যক্ত সম্পত্তির বন্টন
মৃত ব্যক্তির মীরাস বা পরিত্যক্ত সম্পত্তির বন্টনের ব্যাপারে ইসলামের আইন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
(আরবী********) “পুরুষের অংশ দুই নারীর সমান।”
নিসন্দেহে এই বন্টন সম্পূর্ণরূপ প্রাকৃতিক এবং ইনসাফ ভিত্তিক। কেননা অর্থনৈতিক সমস্ত ব্যয়ভার একা পুরুষকেই বহন করতে হয়। নারীকে শুধু নিজের বোঝা ছাড়া অন্য কারুর বোঝা বহন করতে হয় না। অবশ্য নারীকে যে ক্ষেত্রে পরিবারের অভিাবকত্ব গ্রহণ করতে হয় তখনকার সথা স্বতন্ত্র। তবে এমন ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ইসলামী সমাজে খুব কমই হয়ে থাকে। কেননা যত দূলবর্তীই হোক না কেন যতক্ষণ পর্যন্ত নারীর কোন ঘনিষ্ট পুরুষ বর্তমান থাকবে ততক্ষণ তাকে রুজি-রোজগারের জন্যে বাইরে যেতে হয় না। নারী স্বাধীনতার ধ্বজাধারীরা এই ব্যবস্থাপনাকে কি নারী নির্যাতন নামে অভিহিত করতে পারে? তাদের অন্তসারশূন্য শ্লোগান ও সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতি না তাকিয়ে যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, মূল অংকটি একেবারেই সহজ; আর তাহলো: পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ নারীকে কেবল তার নিজের জন্যেই দেয়া হয় –যখন অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ দেয়া হয় পুরুষকে শুধু তার একার জন্যে নয়। বরং তার সাথে সাথে তার স্ত্রী (অর্থাৎ নারীকে) তার সন্তানকে এবং পরিবারের অন্যান্য জরুরী কাজে খরচের জন্যে। এতে করে মিরাসের বেশীর ভাগ অংশ কাকে দেয়া হয়? নারীকে, না পুরুষকে? অবশ্য কোন কোন পুরুষ এমনও হতে পারে যে, নিজেরসমস্ত সম্পদ কেবল ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশের জন্যেই দু’হাতে লুটিয়ে দেবে এবং বিবাহ করে সংসার পাতাবার জন্যে মোটেই অগ্রসর হবে না। কিন্তু এমন ঘটনা একান্তই বিরল। সচরাচর যেটা হয়ে থাকে তাহলো এই যে, পুরুষই পরিবারের সমস্ত সদস্যদের (নিজের স্ত্রীসহ) যাবতীয় প্রয়োজন মেটায়। কিন্তু এ কাজ সম্পন্ন করে কারুর প্রতি সে অনুগ্রহ দেখায় না, বরং নিজের এক নৈতিক দায়িত্ব (Moral Obligation) পালন করে মাত্র। যদি কোন নারী সম্পত্তির অধিকারী হয়, তাহলে তার স্বামী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে উহা স্পর্শও করতে পারে না। এখানেই শেষ নয়, স্ত্রী সম্পদশালিনী হলেও তার যাবতীয় ব্যয়ভার স্বামীকেই বহন করতে হয়। স্বামী যদি স্ত্রীকে কম খরচ প্রদান করে তাহলে সে আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে খোরপোষ আদায় করে নিতে পারে কিংবা অন্য কারণে প্রয়োজনবোধে সম্পর্কও ছিন্ন করতে পারে। সুতরাং একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, ইসলাম নারীকে পুরুষের অনুপাতে নামমাত্র বা অপর্যাপ্ত সম্পদের অধিকার দেয় বলে যারা অভিযোগ কর তাদের সে অভিযোগ যে কতদূর ভিত্তিহীন তা বলাই বাহুল্য। কেননা ইসলাম পুরুষকে যে অর্থনৈতিক দায়িত্ব অর্পণ করেছে তাতে করে একজন নারীর অনুপাতে একজন পুরুষের দ্বিগুণ সম্পত্তি পাওয়াই যুক্তিসংগত।
ইসলামী দায়ভাগের মূল দৃষ্টিভংগি
পরিত্যক্ত যে কোন সম্পদ ও মাল-আসবাবের ক্ষেত্রে ইসলামের উপরোক্ত বন্টন ব্যবস্থা সমভাবে প্রযোজ্য। এই পর্যায়ে ইসলামের মূল দৃষ্টিভংগি এমন ন্যায়সংগত ও সুবিচারভিত্তিক যে বিশ্বের ইতিহাসে উহার নযীর কেউ স্থাপন কতে পারেনি। সে দৃষ্টিভংগি হলো: (আরবী*******) –‘প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী দেয়া হবে।”
মানুষের যে সামাজিক দায়িত্বসমূহ পালন করতে হয় তার প্রেক্ষিতেই এই প্রয়োজনের পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোন পার্থক্যের বিধান দেয় না। এবং পারিশ্রমিকের ব্যাপারেও কোন তারতম্য স্বীকার করে না। ব্যবসায়ের মুনাফা বন্টন হোক, জমি থেকে কোন আয়ের ব্যাপার হোক কাউকেকোথাও অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। কেননা এই সকল ব্যাপারে ইসলাম নারী ও পুরুষের মধ্যে পূর্ণাংগ সাম্যের নীতি অনুসরণ করে এবং তাদের পরিশ্রম অনুযায়ী সমান পারিশ্রমিক দেয়। কাউকে কম বা বেশী দেয়া আদৌ সমর্থন করে না। মুসলমানদের মধ্যে কোথাও কোথাও যে নারীকে কম পারিশ্রমিক দেয়ার ঘটনা লক্ষ্য করা তার পেছনে রয়েছে ইসলাম বিরোধী চক্রের ব্যাপক ষড়যন্ত্র; তারা বুঝতে চায়: ইসলামের দৃষ্টিতে নারী পুরুষের অর্ধেক বলে তারা অর্ধেক পারিশ্রমিকে হকদার। এই বৈষম্যের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।
সাক্ষ্যের আইন
ইসলামের বিধান হলো: দু’জন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সাক্ষ্যের সমান। এতে করে ইহা কখনো প্রমাণিত হয় না যে, একজন নারী একজন পুরুষের অর্ধেকের সমান। মূলত এটা হলো একটি বিজ্ঞজনোচিত পদক্ষেপ। এর লক্ষ্য হলো: সমস্ত সম্ভাব্য উপায়ে আইনগত সাক্ষ্যকে দোষমুক্ত করা। চাই সে সাক্ষ্য আসামীর পক্ষে হোক কিংবা ফরিয়াগীর পক্ষে হোক। স্বীয় প্রকৃতির দিক থেকে নারী আবেগপ্রবণ ও সদা প্রতিক্রিয়াশীল। এ কারণে মামলার ঘটনার উপস্থাপনায় তালগোল পাকিয়ে ফেলা তার পক্ষে মোটেই বিচিত্র নয়। তাই সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে আরো একজন নারীকেও তার সংগী করে দেয়া হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
“যতি দু’জন নারীর মধ্যে কোন একজন ভুলে যায় তাহলে দ্বিতীয়জন তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে।” –(সূরা আল বাকারা: ২৮২)
কেননা হতে পারে যে, আদালতে যে আসামীর পক্ষে বা বিপক্ষে সে সাক্ষ্য দিচ্ছে সে একজন সুন্দরী মহিলা। তাই জিদ বা জ্বালা-পোড়ার কারণে তার বিপক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে বসবে। অনুরূপভাবে এমনও হতে পারে যে, আসামী একজন সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান যুবক। তাই তার প্রতি দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে চেতনার সাথে বা অবচেতনভাবেতাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে গিয়ে এমন কিছু বলে বসবে যার পশ্চাতে কোন ভিত্তি নেই। কিন্তু যেখানে দু’জন নারী একই সময়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে থাকবে তখন তাদের উভয়েরই এরূপ ভুল পথে অগ্রসর হওয়া এবং ভুল সাক্ষ্য দেয়াকে স্বাভাবিক বলে গণ্য করা যায় না। এরূপ পরিস্থিতিতে পারিপার্শ্বিক কারণে এটাই স্বাভাবিক যে, তাদের একজন যদি সত্য ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ভুল করে বসে তাহলে দ্বিতীয়জন তার সংশোধন করে দিতে পারে। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, যদি কোন মহিলা সাক্ষী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আদালতে উপস্থিত হয় তাহলে অন্য আর একজন মহিলা না থাকলেও তার একার সাক্ষ্যই কার্যকরী বলে পরিগণিত হবে।
পরিবারের অভিভাবকত্ব
অভিভাবকত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এর প্রকৃতিই হচ্ছে এই যে, একমাত্র সেই ব্যক্তিই এই দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম যে পরিচালনা কাজে উপযুক্ত এবং পরিবারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে আঞ্জাম দিতে সমর্থ। আসলে পরিবার হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি এবং অন্যান্য নির্ভরশীল ব্যক্তিদের একটি ক্ষুদ্র মিলনস্থল। এদের সকলের গুরুভার বহন করাই হচ্ছে অভিভাবকের প্রধান দায়িত্ব। অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ন্যায় পরিবারের জন্যেও প্রয়োজন এক অভিভাবকের। এই অভিভাবক না থাকলে গোটা পরিবারে নেমে আসে দারুন বিশৃংখলা, সৃষ্টি হয় বিভিন্ন অনাচার, পরিশেষে আসে সর্বাত্মক বিপর্যয়। পরিবারের অভিভাবকত্বের সমস্যা সমাধানের জন্যে তিনটি পন্থার কথা বিবেচিত হতে পারে। প্রথম, পুরুষিই হবে পরিবারের শাসক, দ্বিতীয়ত, নারীই হবে উহার পরিচালক, তৃতীয়ত, পুরুষ ও নারী যৌথভাবে এই দায়িত্ব পালন করবে।
তৃতীয় পন্থঅটি তো একেবারে অযৌক্তিক। উহার আলোচনার কোন প্রশ্নই উঠে না। কেননা কে না জানে যে, দু’জন পরিচালক হলে সেখানে একেবারে কোন পরিচালক না থাকার চেয়েও অধিকতর নৈরাজ্য ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। আসমান-জমিনের দু’জন পরিচারক হলে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় তার প্রতি ইংগিত করে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আারবী*********)
“যদি আসমান ও জমিনে আল্লাহ ছাড়া অন্য মা’বুদ থাকতো তাহলে (আসমান-জমিন) ধ্বংস হয়ে যেত। -(সূরা আল আম্বিয়া: ২২)
(আারবী*********)
“তাহলে প্রত্যেক মা’বুদ নিজ নিজ মাখলুকাতকে পৃথক পৃথক করে ফেলত এবং একজন আর একজনকে আক্রমণ করতো।” –(সূরা আল মু’মিনুন: ৯১)
কাল্পনিক মা’বুদদের অবস্থা যদি এই হয় তাহলে চিন্তা করে দেখুন, সেই সকল লোকদের অবস্থা কিরূপ হতে পারে যারা বাস্তবেই এতদূর জালেম এবং অবিচারক বলে পরিগণিত হয়েছে? [মানবজাতির ইতিহাস একথা সাক্ষ্য দেয় যে, সকল বিভাবে, সকল পরিমণ্ডলে এবং সকল প্রতিষ্ঠানে পরিচালক থাকে মাত্র একজনই। কোন রাষ্ট্রে দু’জন প্রেসিডেন্ট বা দু’জন উজিরে আজমের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। একটি পরিবারের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রয়োজ্য। সর্বাবস্থায় এর অভিাভাবক হবে মাত্র একজজনই। -(অনুবাদক)]
একটি প্রশ্ন
অবশিষ্ট দু’টি পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে পাঠকদের কাছে আমাদের একটি প্রশ্ন এই যে, যোগ্যতার দিক থেকে পরিবারের পরিচালক হওয়ার জন্যে নারী ও পুরুষের মধ্যে কে অধিকতর উপযুক্ত? জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে অধিকতর অগ্রসর পুরুষ কি এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে সক্ষম, না আবেগ প্রবণতার সাক্ষাত প্রতিমূর্তি নারী এই কাজে অধিকতর পারদর্শ? যখনই আমরা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখবো যে, মেধাগত যোগ্যতা এবং মজবুত দৈহিক কাঠামোর কারণে পুরুষ কি পরিবারের প্রশাসক হবে, না যে নারী প্রকৃতির দিকক থেকে দারুণ আবেগপ্রবণ, আনুগত্যশীল এবংসুকঠিন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুরুষোচিত সাহস ও নির্ভীকতা থেকে একেবারেই বঞ্চিত সেই হবে পরিবরের কর্ণধার, তাহলে আপনা-আপনিই সমস্যাটির সমাধান হয়ে যায়। এমনকি কোন নারী নিজেও এমন পুরুষকে পসন্দ করে না যেতার চেয়ে দুর্বল এবং যাকে সে সহজেই কাবু করতে সক্ষম। এরূপ পুরুষকে স্বভাবতই সে ঘৃণার চোখে দেখে এবং সে কখনো তার উপর নির্ভরশীল হতে চায় না। বিগত কয়েক শ’ বছর ধরে যে মানসিকতা পালিত হয়ে মীরাস হিসেবে তার নিকট পৌঁছেছে এ হচ্ছে তারই একটি ফলশ্রুতি মাত্র। কিন্তু যাই হোক না কেন, এটা একেবারে বাস্তব যে, নারী এখনো সেই পুরুষের প্রতিই আকৃষ্ট হয় যে শারীরিক দিক থেকে স্বাস্থ্যবান, সবল এবং শক্তিশালী। এই সত্যটি আমেরিকার মহিলাদের মধ্যে খুবই সুস্পষ্ট। আমেরিকার একজন মহিলা যেমন পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করে, তেমনি সে স্বাধীন। কিন্তু তবুও সে ঐরূপ পুরুষের অধীনে থেকে বিজিত অবস্থায় থাকতে পসন্দ করে; তাকেও সে ভালোবাসে তৃপ্তি লাভ করে এবং তাকে খুশী করার জন্যে সর্ব অবস্থায় চেষ্টা করে। সে পুরুষের সুঠাম দেহ এবং প্রশস্ত সিনা দেখে মুগ্থ হয়। এবং যখন শারীরিক শক্তির দিক থেকে তার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী ও মজবুত দেহের পুরুষ পায় তখন তার নিজেকে সমর্পণ করে দেয়।
একজন মহিলার পক্ষে পরিবারের অভিভাবকত্ব করার আগ্রহ কেবল তখন পর্যন্তই থাকতে পারে যতক্ণ তার কোন সন্তান না হবে এবং তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দায়-দায়িত্ব তার উপর অর্পিত না হবে। সন্তান-সন্ততি বর্তমান থাকতে পরিবারের অভিভাবকত্বের বাড়তি দায়িত্ব পালন করার কোন সুযোগ তার থাকতে পারে না। কেননা মা হিসেবে তার উপর যে নানাবিধ দায়িত্ব অর্পিত ঞয় তা যেমন কোন দিক থেকেই হালকা নয় তেমনি তাতেও সময় ব্যয় হয় প্রচুর।
পারিবারিক জীবনের মুল প্রেরণা
উপরোক্ত আলোচনার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয় যে, পরিবারে নারী হয়ে থাকবে পুরুষের দাসী এবং পুরুষ হবে তার অত্যাচারী প্রভু। কেননা সংসারে নেতৃত্ব বলতে বহুবিধ দায়িত্ব ও কর্তব্যের সমষ্টিকে বুঝায। আর উহা কেবল তখনই সুষ্ঠুরূপে সম্পাদিতহ হতে পারে যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও সহযোগিতার পরিবেশ বর্তমান থঅকে। সংসার জীবনের সাফল্যের জন্যে পারস্পরিক ভাববিনিময়, সৌহার্দ, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি একান্ত অপরিহার্য়য। ইসলাম পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও প্রযোগিতার স্থলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রীতি, শলা-পরামর্শ ও সহমর্মিতাকে পারিবারিক জীবনের ভিত্তি হিসেবে দেখতে চায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন: (আারবী*********)
“এবং সেই নারীদের সাথে সুন্দরভাবে জীবনযাপন কর।” –(সূরা আন নিসা: ১৯)
এবং বিশ্বনবী (স) বলেন: (আারবী*********)
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে নিজ পরিবারের লোকজনদের নিকট সর্বোত্তম।” –(তিরমিযী)
এখঅনে বিশ্বনবী (স) স্ত্রীর সাথে সদ্ব্যবহার করাকে পুরুষের নৈতিক চরিত্রের মাপকাঠি বলে সাব্যস্ত করেছেন। বস্তুত এই মাপকাঠি একেবারেই নির্ভুল। কেননা কোন ব্যক্তিই তার স্ত্রীর সাথে অসদ্ব্যবহার করতে পারে না যতক্ষণ না সে আত্মিক দিক থেকে পীড়াগ্রস্ত হয় এবং নেকীর উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত হয় কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
যাই হোক পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে যে সকল ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে বর্তমান তার সঠিক মর্ম অনুধাবন করা একান্ত প্রয়োজন। বেশীর ভাগ ভুল ধারণা দেখা যায় স্বামীর পক্ষ থেকে আরোপিত স্ত্রীর দায়িত্ব, তালাক বা বিচ্ছেদ এবং স্ত্রীর সংখ্যা সম্পর্কে।
স্বামী–স্ত্রীল সম্পর্কের জটিলতা
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিবাহের মাধ্যমে যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয় উহা মূলত একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক। এবং উভয়ের মধ্যে অন্যান্য যে সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন তা এদের ব্যক্তিগত, মনস্তাত্বিক, আত্মিক এবং দৈহিক সামঞ্জস্যতা ও সমঝোতার উপর নির্ভরশীল। আইনের বলে এই সম্পর্ক বা সমঝোতা কোনক্রমেই স্থাপন করা যায় না। এ কারণে যদি কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আনন্দঘন পরিবেশ তথা হাসি-খুশী বর্তমান থাকে এবং তাদের জীবনে পুরোপুরি মিল-মহব্বত ও নিশ্চিন্ততা বিরাজিত থাকে তাহলে এর রহস্য যে দাম্পত্য জীবনের মূলনীতির মধ্যেই প্রচ্ছন্ন অবস্থায় আছে কিনা তা দেখার কোন প্রয়োজন থাকে না। কেননা অনেক সময় দেখা যায় যে, স্বামী-স্ত্রীর ভেতর কঠিন অন্তদ্বন্দ্ব তাদের পারস্পরিক গভীর ভালোবাসা ও সুসম্পর্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে যদি কোন দম্পত্তির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বা মতভেদ দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে এতে করে নিশ্চয়ই একথা প্রমাণিত হয় না যে, এর পশ্চাতে স্বামীর কোন ভুল বা স্ত্রীর কোন অবাধ্যতা অবশ্যই রয়েছে। হতে পারে, মানুষ হিসেবে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই একান্ত ভালো লোক এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের মন-মেজাজ ভিন্ন প্রকৃতির, আর সে কারণে উভয়ের মধ্যে কোন সমঝোতা বা সুসম্পর্ক স্থাপিত হতে পারছে না।
বিবাহ আইনের প্রয়োজনীয়তা
দাম্পত্য সম্পর্কের এই জটিলতার কারণে আইনের এমন কিছু অবকাশ থাকার দরকার যাতে করে দাম্পত্য জীবনের প্রয়োজনীয় আইন ও নিয়ম-কানুন সেখান থেকে বের করা যেতে পারে। কেননা মানব জীবনের এই স্পর্শকাতর সমস্যার সমাধানের চেষ্টা ছাড়া মানবীয জীবনব্যবস্থার পূর্ণাংগতার দাবী করা যেতে পারে না। সুতরাং এমন আইনের প্রয়োজন যা ন্যূনকল্পে এমন কিছু সীমারেখা নির্ধারণ করে দেবে যার ভেতরে অবস্থান করে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই তাদের বিস্তারিত কর্তব্যসমূহ স্থির করে নেবে।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি ভালোবাসা ও স্বস্থির পরিবেশ বর্তমান থাকে তাহলে অধিকার ও দায়িত্বের হেফাজাতের জন্যে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কোন প্রয়োজন থাকে না। আদালতে তারা কেবল তখনই যেতে পারে যখন তাদের মধ্যে বনিবনাও না হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং তারা নিজেরা নিজেদের কলহ মীমাংসা করতে অক্ষম হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, সেই আইনকে হতে হবে সুবিচারভিত্তিক। সেখানে অযথা পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থাকবে না বিন্দুমাত্রও। এবং সে আইন হবে এমন ব্যাপক ও সর্বাত্মক যে, অধিক হতে অধিক সংখ্যক সমস্যার সমাধান যেন তাতে পাওয়া যায় অনায়াসেই। এই প্রসংগে বলে রাখা ভালো যে, মানবীয় কোন আইন বা নিয়ম এমন হতে পারে না যার আওতায় মানবজীবনের সমস্ত ঘটনাই আসতে পারে এবং কোন আইনের নিরেট ও শাব্দিক প্রয়োগ দ্বারাও কোন সুবিচারের সুষ্ঠু নযীর স্থাপন করা যায় না।
ইসলামী বিবাহ আইন সম্পর্কে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন
এখন আসুন, স্ত্রীর দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে ইসলামের কি বিধান রয়েছে তাও আমরা আলোচনা করি। কেননা এ নিয়ে ইসলাম বিরোধীদের হৈচৈর অন্ত নেই। ইসলামী আইনে স্ত্রীর দায়িত্ব সম্পর্কে তিনটি কথা স্মরণীয়:
এক: স্ত্রীর উপর দায়িত্ব অর্পণ কি জুলুমের নামান্তর?
দুই: এই দায়িত্ব কি এক তরফা এবং এর মোকাবিলায় তাকে কি কোন অধিকার দেয়া হয়নি?
তিন: এই দায়িত্ব কি চিরন্তন যে তার হাত থেকে নারী কখনো নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে না?
স্ত্রীর দায়িত্ব
স্বামীর পক্ষ থেকে তিনটি বড় দায়িত্ব নিম্নরূপ আরোপ করা হয়েছে:
(১) স্বামী যৌন মিলনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে স্ত্রীকে সংগে সংগেই তার আনুগত্য করতে হবে।
(২) স্ত্রী স্বামী গৃহে এমন কোন লোককে আসা-যাওয়অর সুযোগ দেবে না যার আসা-যাওয়াকে স্বামী পসন্দ করে না।
(৩) স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীকে তার বিশ্বাসভাজন হতে হবে এবং তার কোন আমানত খেয়ানত করতে পারবে না।
প্রথম দায়িত্ব
স্ত্রীর প্রথম দায়িত্ব কোন ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এতে যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা একেবারেই স্পষ্ট। পুরুষের দৈহিক গঠন এমন এক প্রকৃতির যে তার যৌন আকাংখার পরিতৃপ্তি নারীল চেয়ে বহুগুণে অধিক প্রয়োজনীয়। সে অস্থিরতা থেকে যতই মুক্ত থাকবে ততই সে স্বীং কর্মক্ষেত্রের নিজ দায়িত্ব অধিক প্রস্তুতি ও উৎসাহের সাথে আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবে। পুরুষ বিশেষ করে যৌবনকালেই কামভাবে অধিকতর উন্মাত্ত হয়ে এঠ এবং তখন ইহা চরিতার্থ করার প্রয়োজনীয়তা নারীদের তুলনায় বহুগুণ অধিক হয়ে পড়ে। অথচ নারীর যৌনস্পৃহা পুরুষের তুলনায় অনেক গভীর এবং দৈহিক ও মনস্তাত্বিক দিক থেকে পুরুষের প্রতি তার আকর্ষণও অনেক বেশী। কিন্তু সে কারণে তার পক্ষে ইহা অপরিহার্য নয় যে, সে তার যৌন স্পৃহা যৌ ক্রিয়ার মাধ্যমেই ব্যক্ত করবে।
পুরুষের প্রধানত এই প্রকৃতির প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যেই বিবাহ বন্ধরে নাবদ্ধ হতে হয়। অবশ্য আধ্যাত্মিক, মনস্তাত্বিক, সামাজিক ও অর্থণৈতিক তাগিদও বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এখন প্রশ্ন এই যে, স্বামী যদি যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে স্ত্রীর নিকট গমন করে এবং স্ত্রী যদি তখন স্বামীর আনুগত্য না করে তাহলে স্বামীর কি করা করত্ব্য? সে কি তখন অন্য নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করবে? কোন সভ্য সমাজই এরূপ অবৈধ সম্পর্ককে বরদাশত করতে পারে না। আর কোন নারী নিজেও সহ্য করতে পারে না যে, তার স্বামী দৈহিক বা মানসিক দিক থেকে তার পরিবর্তে অন্য কোন নারীর সন্ধান করুক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যতই তিক্ত হোক না কেন কোন স্ত্রীই এরূপ কার্যক্রমকে বরদাশত করতে পারে না।
তিনটি কারণ
স্বামীর আকাংখা সত্বেও স্ত্রীর পক্ষ থেকে যৌন ক্রিয়ার অসম্মতি জানার কারণ হতে পারে তিনটি। সেগুলো হলো:
(১) স্ত্রী স্বামীকে ঘৃণা করে এবং এ কারণে তার সাথে মিলিত হওয়াকে পসন্দ করে না।
(২) স্বামীকে ভালোবাসে কিন্তু যৌন ক্রিয়াকে পসন্দ করে না। সুতরাং স্বামীর কথা সে অগ্রাহ্য করে। এই ব্যাপারটি অস্বাভাবিক। অথচ বাস্তব জীবনে ইহা ঢের পাওয়া যায়।
(৩) স্ত্রী স্বামীকে অবশ্যয় চায় এবং যৌন ক্রিয়াকেও অসন্দ করে না। কিন্তু বিশেষ সময়ে তার ইচ্ছা জাগ্রত হয় না।
প্রথম কারণটি অত্যন্ত আপত্তিজনক। এটা কোন বিশেষ কাজ বা মেয়াদ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে –এমন কথা জোর করে বলা যায় না। এতে করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারে না। এর সর্বোত্তম প্রতিকার হলো এই যে, স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পর পৃথক হয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। আর এ ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, পুরুষের চেয়ে নারীকেইড সুবিধা দেয়া হয়েছে অনেক বেশী।
দ্বিতীয় যে কারণটির কথা বলা হয়েছে তার জন্যে স্বামীর যৌন আকাংখাকে দায়ী করা যায় না। ওটা এক প্রকার ব্যধি। উহার সুচিকিৎসা হওয়া একান্ত প্রয়োজন –যাতে করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল-বুঝাবুঝির কোন অবকাশ না থাকে। বরং পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের মহব্বত ও ভালোবাসায় কোন ভাটা না পড়ে। স্ত্রীর ইচ্ছা না হলে, সম্ভবপর হলে স্মাবী তাকে অনেক সময় দিবে, তবে স্বামীর ইচ্ছা পূর্ণ করার সুযোগ দেয়াই হবে স্ত্রীর কর্তব্য। ভালোবাসার দাবী এটাই এবং তাকে তালাক থেকে বাঁচার পথও এটাই। স্বামী-স্ত্রী যদি এরূপ কোন সমঝোতায় পৌঁছতে না পারে, তাহলে ভদ্রতার সাথ পারস্পরিক সম্পর্ক ছেদ করাই উত্তম। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত তারা দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখবে ততদিন পর্যন্ত ইসলামী আইনের দাবীই হলো এই যে, স্ত্রী স্বামীর যৌনস্পৃহা অবশ্যই মেটাতে থাকবে। কেননা এটাই স্বাভাবিক। স্ত্রীর উপর জোরজবরদস্তি করার প্রশ্ন এখঅনে উত্থাপিত হতে পারে না। কেননা এখানে ইসলামী আইনের লক্ষ্যই হলো: স্বামী যেন চরিত্রহীনতার পথে না যায় এবং দ্বিতীয় বিবাহ থেকেও বিরত রাখা যায়। আর একজন নারীর জন্য অনিচ্ছাকৃত যৌন মিলনের চেয়ে স্বামীর এই পদস্খলন বা দ্বিতীয় বিবাহ যে অধিকতর কষ্টদায়ক তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এরূপ অনাকাংখিত টনা-হেচড়া সবসময়ের জন্যেই চলতে থাকুক –ইসলামী আইন কখনো এটা পসন্দ করে না। আর এতে করে পারিবারিক শান্তি কখনো স্থাপিত হতে পারে না। সুতরাং উভয়ের পৃথক হয়ে যাওয়াই উত্তম।
তৃতীয কারণ যা বলা হয়েছে তা একটি সাময়িক অবস্থা মাত্র। খুব সহজেই তার প্রতিকার হতে পারে। বিশেষ সময়ে স্ত্রীর এই অবস্থা তার দৈহিক অবসাদের কারণেও হতে পারে কিংবা অত্যধিক পরিশ্রমজনিত কোন মানসিক কারণেও হতে পারে। কিন্তু এই অবস্থা যে একেবারেই সাময়িক তাতে কোন সন্দেহ নেই। স্ত্রী তার দৈহিক ও মানসিক মেজাজের সাহায্যে এ অবস্থার নিরসন করতে পারে। আবার যৌন মিলনের পূর্বে বিশেষ শৃংগারের মাধ্যমেও এ কাজটি হতে পারে। শৃংগারের মাধ্যমে হলে তাদের মিলন পশুত্বের স্তর অতিক্রম করে এবং উন্নত মানসিক স্তরে উপনীত হতে পারে। এমনকি করে স্ত্রীর সাময়িক অনীহার মূল কারণটিকেও দূর করা যেতে পারে।
অন্যদিকে স্ত্রী যখন স্বামীর সাথে মিলিত হতে চায় তখন স্বামী যদি কোন অস্বাভাবিক কারণে তাতে সাড়া না দেয় (পুরুষদের মধ্যে যদিও এটা খুব কম দেখা যায়) তাহলে ইসলামী আইনে স্ত্রীকে কখনো অসহায় অবস্থায় শিকার হতে দেয় না। যে ইসলামী আইন স্বামীর যৌন নাকাংখা পূর্ণ করা স্ত্রীর জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য বলে ঘোষণা দেয় সেই আইনই এমন ব্যবস্থাও করে দেয় যাতে করে স্ত্রীর বৈধ আকাংখা পূরণ করার পথে কোন বাধার সৃষ্টি না হয়। ইসলামের স্পষ্ট বিধান হলো: স্বামীকে স্ত্রীর আকাংখা অবশ্যই পূর্ণ করতে হবে, যদি কোন স্বামী-স্ত্রীর যৌন আকাংখা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের বিবাহকে বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে। ইসলমী আইনে স্বামী-স্ত্রীর অধিকারকে যেমন হরণ করা হয়নি, তেমনি তাদের দায়-দায়িত্বকে শিথিলও করা হয়নি। এ আইনে এমন কোন কথাই নেই যাতে করে স্ত্রীর প্রতি সামান্যতম উপেক্ষা বা অবজ্ঞা প্রমাণিত হতে পারে এবং এমন কিছুও নেই যাতে করে তার প্রতি জবরদস্তি বা স্বৈরাচারী আচরণের কোন অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে।
দ্বিতীয় দায়িত্ব
স্বামীর পক্ষ থেকে আরোপিত স্ত্রীর দ্বিতীয় দায়িত্ব হ লো এই যে, সে যেন এমন কোন ব্যক্তিকে ঘরে প্রবেশ করতে না দেয় যার যাতায়াত তার স্বামী পসন্দ করে না। স্ত্রীর ব্যভিচাণিী হওয়ার আশাংকার সাথে এই হুকুমের কোন সম্পর্ক নেই। কেননা ব্যভিচারিণী হওয়াকে তো ইসলাম আদৌ বরদাস্ত করে না। কোন স্বামী ইহা পসন্দ করলেও স্ত্রী এমন জঘন্য কাজে কখনো লিপ্ত হতে পারে না। স্বামীর উক্ত হুকুমের মধ্যে যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা একেবারেই স্পষ্ট। কেননা স্বামী-স্ত্রীর বেশীরভাগ দ্বন্দ্ব-কলহের মূলে থাকে বাইরের লোকের হস্তক্ষেপ। বাইরের লোকেরা কূটনামি বা এখানের কথা সেখানে লাগিয়ে পারিবারিক কলহকে অধিকতর ঘোরালো ও জটিল করে তোলে। এমন অনাকাংক্ষিত ঘটনা থেকে বাঁচার জন্যে স্বামী যদি স্ত্রীকে এরূপ হুকুম দেয় যে, অমুক ব্যক্তিকে গৃহে প্রবশ করতে নিষেধ করে দেবে এবং স্ত্রী যদি এরূপ করতে অস্বীকার করে তাহলে অবশ্যই তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। ফলে তাদের গহ হবে একটি কোন্দলের আখড়া এবং তাদের পারস্পরিক সুধারণা ও সমঝোতার কোন পথই আর অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং পরিবার ও উহার সন্তান-সন্ততির কল্যাণের জন্যে এটাই করণীয় যে, স্ত্রী স্বামীর এই আদেশ পালন করতে যেন বিন্দুমাত্রও অলসতা না দেখায়। কেননা শিশু সন্তানদের সুষ্ঠূ লালন-পালন ভালোবাসা, সহানুভূতি ও হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশেই সম্ভবপর।
প্রসংগত, এরূপ প্রশ্ন হতে পারে যে, আইনের দিক থেকে স্ত্রীর জন্যে যদি এটা বাধ্যতামূলক হয় যে, স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে কাউকে ঘরে প্রবশ করতে দেবে না। তাহলে স্বামীল জন্যেও এটা বাধ্যতামূলক কেন হবে না যে, সে স্ত্রীর ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে কাউকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেবে না? বস্তুত স্বামী-স্ত্রী যদি ভদ্র হয় এবং হাসি খুশি ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে কালাতিপাত করতে থাকে তাহলে স্ত্রীর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন প্রশ্নই উত্থাপিত হয় না। আর যদি হয়ই, তাহলে স্বামী নিজেই তার সন্তোষজনক উত্তর দিতে সক্ষম হবে। কিন্তু যদি ধরে নেয়া হয় যে, তাতে কবরে তিক্ততা বেড়েই চলছে এবং একে প্রশমিত করার কোন সম্ভাবনাই না থাকে তাহলে তাদেরকে আদালতের আশ্রয় নিতে হবে। স্ত্রীর যদি এরূপ অধিকার থাকে যে, সে নিজেই কোন ব্যক্তিকে তার স্বামীর গৃহে প্রবেশ করতে না দেয় তাহলে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কেননা একথা ভুললে চলবে না যে, অধিকাংশ স্থলেই নারীদের মানসিক প্রতিক্রিয়া যুক্তি বা বুদ্ধির গণ্ডিকে অতিক্রম করে বসে এবং প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার স্থলে স্বকীয় আবেগ প্রবণতা বশীভূত হয়ে পড়ে। এছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে শশুরালয়ের নানাবিধ তিক্ততাও তাকে ভুল পথে পরিচালিত করে। এ কারণে স্ত্রীর মর্জি ব্যতিরেকে স্বামী কাউকে গৃহে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারবে না –এরূপ বিধি আরো করে স্বামসীকে স্ত্রীর অধন করে দেয়া কোন বিজ্ঞজনোচিত কাজ হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে এরূপ কোন বিধিকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত চালু রাখাও সম্ভবপর নয়।
অবশ্য একথাও ঠিক নয় যে, স্বামীর কখনো কোন ভুলই হতে পারে না। বরং এরূপ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, কোন কোন সময় সে শিশুর মতও কাজ করে বসতে পারে। অনুরূপভাবে একথাও নির্ভুল নয় যে, ভুল বলতে যা কিছু হয় তা শুধু স্ত্রীর পক্ষ থেকেই হয় এবং স্বামীর কোন ভুলই নেই। কেননা এমনও হতে পারে যে স্ত্রী একান্ত যুক্তিসংগত কারণেই স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রীর আদৌ কোন দোষ নেই। কিন্তু ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থার প্রেক্ষিতে কোন আইন রচিত হতে পারে না। বরং সাধারণ অবস্থা এবং সাধারণ মানুষের জন্যেই আইন প্রণীত হয়। যেহেতু পুরুষের প্রাধান্য অধিক বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু স্ত্রী যদি বুঝে যে, সে স্বামীর সাথে জীবনযাপন করতে পারছে না তাহলে তার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকার অবশ্য থাকবে।
তৃতীয় দায়িত্ব
স্ত্রীর তৃতীয় দায়িত্ব হলো স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সতীত্ব এবং স্বামীর যাবতীয় সম্পদের হেফাজাত করা। এটা তো বিবাহের একটি স্বাভাবিক দাবী এবং সর্বদিক থেকেই যুক্তিসম্মত। এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলাই বাহুল্য। তবে এ দায়িত্ব এক তরফা নয়, স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদেরকে একে অন্যেল বিশ্বাসভাজন ও কল্যাণকামী হতে হবে।
ব্যর্থ স্বামী–স্ত্রী
এখন আসুন এমন দম্পত্তি সম্পর্কও আলোচনা করি যারা একে অন্যের উপর জুলূম ও নির্যাতন করতে এতটুকুও পরাঙমুখ হয় না। যেহেতু স্বামীই হচ্ছে পরিবারের অভিভাবক এবং পরিবারের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাবার জন্যে দায়ী সে জন্যে পবিত্র কুরআনে বিধান অনুযায়ী অবাধ্য স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার তাকে প্রদান কর বলা হয়েছে:
(আারবী*********)
“আর যে সকল নারী এমন হবে যে, তোমরা তাদের অবাধ্যতার আশংকা করবে তাদেরকে তোমরা মুখে উপদেশ দাও। তাদের শয়ন-শয্যা পৃথক করে দাও এবং (শেষ পদক্ষেপ হিসেবে) তাদেরকে প্রহার কর। অতপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করতে শুরু করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে (জুলুম ও নির্যাতন করার জন্যে) কোন বাহানা অনুসন্ধান করো না।” –(সূরা আন নিসা: ৩৪)
স্ত্রীকে সংশোধন করার ধারাবাহিক পদ্ধতি
পবিত্র কুরআনে উপরোক্ত আয়াতে স্ত্রীর যে সংশোধন পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে তা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া মাত্র। দৈহিক শাস্তির কথা একেবারে সর্বশেষ পর্যায়ে বলা হয়েছে। দেখা যায় যে, কোন কোন পুরষ তার এ অধিকারের অপপ্রয়োগ করে এবং ধারাবাহিকতার প্রতি লক্ষ্য না করে অপরাধ একটু পেলেই স্ত্রীকে মারধার করতে শুরু করে। কিন্তু এটা কোন দিক থেকেই সংগত নয়। উক্ত অপপ্রয়োগের একমাত্র প্রতিকার হলো: মানুষের আত্মিক ও নৈতিক চরিত্রকে উন্নত করার প্রচেষ্টা করতে হবে। বস্তুত এর গুরুত্ব সম্বন্ধে ইসলাম এতটুকুও উদাসীন নয়। পবিত্র কুরআনের পূর্বোক্ত আয়াতে যে নিয়মের প্রতি আংগুল নির্দেশ করা হয়েছে তার একমাত্র লক্ষ্য হলো পারিবারিক জীবনের হেফাযত এবং উহাকে মজবুতভাবে সংগটিত করা। কেননা যে কোন আইন হোক, ্হা কেবল তখনই কল্যাণকর ও কার্যকরী বলে পরিগণিত হতে পারে যখন উহার পৃষ্ঠপোষকতার এমন কিছু শক্তিও বর্তমান থাকে যা উহার অমান্যকারীদেরকে যথাযথ শাস্তি দিতেও সক্ষম। যদি এরূপ কার্যকরীশক্তি বর্তমান না থাকে তাহলে আইন শুধু একটি অন্তসারশূন্য বুলিতেই রূপান্তরিত হয়। বাস্তব দুনিয়ায় উহার কোন অস্তিত্ব থাকে না।
এই হুকুমের কল্যাণকারিতা
বিবাহের লক্ষ্য হলো স্বামী-স্ত্রীর সর্বাত্মক উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধন করা। এ জন্যে সর্বপ্রথমেই প্রয়োজন পারিবারিক জীবনে ভালোবাসা ও প্রশান্তি স্থাপন করা। এতে করে আইনের সাহায্য ছাড়াই স্বামী-স্ত্রী উভয়ই অধিক হতে অধিকতর পরিমাণে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নতিলাভ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের মধ্যে কলহ ও মতানৈক্য হলে উহার মারাত্মক কুফল শুধু তাদের নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তাদের সন্তান-সন্ততি তথা তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকেও বিনষ্ট করে ফেলে।
আদালত ও গৃহ বিবাদ
গৃহ বিবাদের মূল কারণ যদি স্ত্রী হয় তাহলে প্রশ্ন এই যে, তার সংশোধনের দায়িত্ব কার? আদালত এ কাজ করতে পারে কি? বাস্তব ঘটনা এই যে, আদালত তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে সমস্যাটিকে নিসন্দেহে আরো মারাত্মক করে তুলতে পারে কিন্তু সমাধানের পথ প্রশস্ত করতে পারে না। হতে পারে, তাদের মতানৈক্যের বিষয়টি খুবই নগণ্য ও ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আদালতে গিয়ে বিষয়টি আরো জটিল এবং আশংকাজনক রূপ নিতে পারে। কেননা কোন ঘটনা একবার যখন আদালতে পৌঁছে যায় তখন উভয় পক্ষের অহংকার ও জিদ বিষয়টির সুরাহার পথ রুদ্ধ করে দেয়। আদালতে কেবল কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নেয়া উচিত এবং কেবল তখনই নেয়া উচিত যখন আদালতের বাইরে উহার নিষ্পত্তি করা সম্পূর্ণরূপেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই যে সকল ছোটখাট ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে সেগুলোকে নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে না। কেননা এমনকি হলে তো ঘরে ঘরেই আদালত স্থাপন করা দরকার এবং এই সকল আদালতকে কেবল পারিবারিক ঝগড়া-কলহ নিষ্পত্তির জন্যেই মশগুল থাকতে হবে।
পুরুষের কাজ
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, গৃহে এমন একটি চালিকা শক্তি অবশ্যই থাকতে হবে যে, উহা যেন পারিবারিক সমস্যা-গুলোর সমাধান এবং যে কোন দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যের সংশোধন করতে সক্ষম। বস্তুত পরিবারের প্রকৃত অভিভাবক হিসেবে একমাত্র স্বামীই গৃহের এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের আঞ্জাম দিতে পারে। পবিত্র কুরআনের পূর্বোক্ত আয়াতে স্বামীকে এরূপ আদেশ দেয়া হয়েছে যে, সর্বপ্রথম সে স্ত্রীর মনে কোনরূপ আঘাত না দিয়ে শুধু সদুপদেশের মাধ্যমে তার সংশোধনের চেষ্টা করবে।স্ত্রী যদি এতে করে সংশোধিত হয়ে যায় তা হলেতো বিষয়টি এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু যদি সে এতেও তার ভুল স্বীকার করে নিতে সম্মত না হয় তাহলে স্বামীর কর্তব্য হবে স্ত্রীর শয়নের একদম পৃথক করে দেবে। এই শাস্তি প্রথমোক্ত (উপদেশ প্রদানের) শাস্তির চেয়ে কতকটা কঠিন। এতে করে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ইসলাম নারীদের মনস্তাত্বিক বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য রাখে। এবং এটাও ইসলামের নিকট অবিদিত নয় যে, স্বীয় রূপ লাবণ্য ও আকর্ষণীয় ভাবভংগির কারণে অনেক সময়ে সে এতদূর অহংকারী হয়ে উঠে যে, স্বামীর বিরুদ্ধাচরণ করতে বিন্দুমাত্রও ইতস্তত করে না। এক দিকে বিবেচেনা করে তার শয়ন-শয্যাকে পৃথক করে দেয়ার অর্থ হবে এই যে, স্বামীকে সে তার সৌন্দর্য ও চিত্তাকর্ষক রূপ লাবণ্য দিয়ে বশ করে রাখার অহমিকায় মত্ত হওয়ার সুযোগ পাবেনা। এতে করে তার অহংকারে অবশ্য ভাটা পড়বে এবং স্বামীর আনুগত্যের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠবে। কিন্তু এরূপ শাস্তি প্রদানের পরেও যদি সে সংশোধিত না হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, সে এতদূর হঠকারী ও গর্বিত যে, দৈহিক শাস্তি প্রয়োগ ছাড়া তাকে আর সুপথে আনা যাবে না। অনাকাংখিত হলেও যদি অবস্থা এমন পর্যায়েই এসে যায় তাহলে সর্বশেষ পন্থা হিসেবে স্বামীকে এরূপ অনুমতি দেয়া হয়েছে যে, স্ত্রীকে সে এ অবস্থায় প্রয়োজানুযায়ী মারপিঠ করতে পারবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তাকে নিছক কষ্ট দেয়ার জন্যেই মারপিঠ করবে, করং মারপটের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে তাকে সংশোধন করা। বস্তুত এ জন্যেই বিধান দেয়া হয়েছে যে, এই প্রহার হতে হবে খুবই হালকা ধরনের; মারাত্মক ধরনের মারপিট করার কোন অধিকার স্বামীকে দেয়া হয়নি।
এ পন্থা শুধু সতর্কতামূলক
স্ত্রীর সাথে উপরোক্ত কঠোর ব্যবহার কি তাকে অপমানিত করার কিংবা তার আত্মসম্মানে আঘাতহানার সামিল? না, এরূপ হওয়ার কোন যুক্তিই নেই। কেননা এ সম্পর্কে কিছু বলার সময়ে আমাদের প্রথমেই স্মরণ রাখতে হবে যে, এই প্রহার হলো নিছক একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। আর এ পদক্ষেপ কেবল তখনই গ্রহণ করা হয় যখন সংশোধনের যাবতীয় পন্থাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
শাস্তি–একটি মনস্তাত্বিক প্রয়োজন
দ্বিতীয় কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, কিছু কিছু মানসিক পীড়া এমন রয়েছে যে, দৈহিক শাস্তি ব্যতিরেকে তার কোন চিকিৎসা হতে পারে না। মনস্তত্ব বিজ্ঞান আমাদেরকে একথাই বলে যে, স্বাভাবিক অবস্থায় উপরোক্বত পদক্ষেপসমূহ (মৌখিক উপদেশ, শয্যাকে পৃথক করে দেয়া ইত্যাদি) অবশ্যই কার্যকরী। কিন্তু এমন এমন মানসিক ব্যধিও রয়েছে –যেমন পীড়াদান প্রবণতা (Masochism) ইত্যাদি –যা কেবল শারীরিক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমেই নিরাময় হতে পারে। এ ধরনের ব্যধিতে পুরুষের চেয়ে নারীরাই অধিক আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই শ্রেণীর ব্যধিগ্রস্ত নারীরা অবজ্ঞা ও মারপিটেইা এক প্রকার আনন্দ লাভ করে থাকে। [অন্যদিকে পুরুষরা সচরাচর যে মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাকে বলা হয় দুঃখদান প্রবণতা (Sadism)। এ শ্রেণীর ব্যধিগ্রস্ত পুরুষরা নির্যাতনের প্রতি এক প্রকার ভালোবাসা অনুভব করে থাকে।]
একথা স্পষ্ট যে, স্ত্রী যদি উপরোক্ত রূপ ব্যধির শিকার হয়ে পড়ে তাহলে তার সংশোধন একমাত্র শারীরিক শাস্তির মাধ্যমেই সম্ভবপর। এতে করে একদিকে তার মনস্তাত্বিক প্রয়োজন পূর্ণ হবে এবং অন্যদিকে তার অন্যায় সম্পর্কেও সচেতন হয়ে উঠবেচ। বাহ্যিকভাবে বিষয়টি যতই বিস্ময়কর মনে হোক না কেন, এক বাস্তব সত্য যে, উপরোক্ত রূপ ব্যধিগ্রস্ত স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই একে অন্যের জন্যে উত্তম জীবনসংগী হতে পারে। অথচ তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে মোটেই উত্তম নয়। অনুরূপভাবে জ্বালাতনময়ী স্বামী এবং নির্যাতনকারী স্ত্রীর দৃষ্টান্তও সমাজে একেবারে বিরল নয়। এবং এ ধরনের স্বামীদের মন-মেজাজ ঐ ধরনের স্ত্রীরা উত্তমরূপে ঠাণ্ডা করে রাখতে সক্ষম। আর এরা একে অন্যের প্রতি খুশী থেকেই দিনাতিপাত করতে পারে।
মোটকথা মারপিটের প্রয়োজন কেবল তখন ই অনুভূত হয় যখন স্বামী বা স্ত্রী সত্যিকার অর্থেই মানসিকভাবে পীড়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার পূর্বে এর কোন প্রশ্নই উঠে না। যাই হোক ইসলামী আইন স্বামীকে যে শারীরিক শাস্তি প্রদানের অনুমতি দেয় তাকে কেবল একটি সতকর্তকামূলক পদক্ষেপ বলেই অভিহিত করা যায়। কোন স্বামীকেই এই অধিকার দেয়া হয়নি যে, ছোটখাট ভুলের জন্যেও স্ত্রীর সাথে যা-তা ব্যবহার করতে পারবে। পবিত্র কুরআনে সংশোধনী পদক্ষেপের যে ধারাবাহিকতা বর্ণনা করা হয়েছে তাতে এই সত্যটিই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। হযরত বিশ্বনবী (স) স্বামীকে এই অধিকার কেবল তখনই প্রয়োগ করার অনুমতি দিয়েছে যখন সংশোধনের যাবতীয মাধ্যমই ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি বলেন:
(আরবী**********)
“তোমাদের কেউ নিজ স্ত্রীকে দিবাভাগে যেমন এমনভাবে প্রহর না করে যেমনভাবে উটকে প্রহার করা হয় এবং পুনরায় রাতে তার সাথে মিলিত হবে।” [বুখারী]
স্বামীর দুর্ব্যবহারের প্রতিকার
যদি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি দুর্বব্যবহার করার আশংকা দেখা দেয় তাহলে ভিন্নরূপ আইনের আশ্রয় নিতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী**********)
“যদি কোন নারীর স্বামীর পক্ষ থেকে দুর্ব্যবহার বা বেপরোয়া আচরণের আশংকা দেখা দেয় তাহলে তাদের এ কাজের কোন অপরাধ নেই যে, উভয়ই পরস্পর সমঝোতা করে নিবে। আর এই সমঝোতাই সর্বোত্তম।” –(সূরা আন নিসা: ১২৮)
কিছু লোক এ ব্যাপারেও নারী ও পুরুষের মধ্যে পরিপূর্ণ সমতার দাবী করে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন শুধু কাল্পনিক সমতার নয়, বরং এমন বাস্তবভিত্তিক সমতার যা অনুসরণযোগ্য হওয়ার সাথে সাথে মানবীয প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল বলেও গণ্য হতে পারে। কোন নারীই –চই যে, ‘পশ্চাদমুখী’ প্রাচ্যের হোক কিংবা ‘সুসভ্য’ পাশ্চাত্যের হোক –কখনো এটা চায় না যে, স্বামীর প্রহারের বদলে সেও স্বামীকে প্রহার করুক। এমন স্বামীকে কোন নারী কখনো সম্মানের চোখে দেখতে পারে না যে, এতদূর দুর্বল যে, তার (স্ত্রীর) হাতে কেবল মারপিটই খেতে থাকে। এ কারণেই এ পর্যন্ত কোন নারী এরূপ দাবী উত্থাপন করে নিয়ে স্বামীর যেমন তাকে মারপিট করার অধিকার রয়েছে ঠিক তেমনি তাকেও এই অধিকার দিতে হবে যে, সেও স্বামীকে প্রহার করতে পারবে।
এই বিষয়ের একটি বিশেষ দিক হলো এই যে, ইসলামের দৃষ্টিতে এটা অপরিহার্য নয় যে, নারী কেবল নীরবে স্বামীর অত্যাচার উৎপীড় সহ্য করতে থাকবে এবং উহার বিরুদ্ধে ‘উহ’ শব্দটিও করবে না। বরং এই পরিস্থিতিতে ইসলাম তাকে এই অধিকার দিয়েছে যে, সে ইচ্ছা করলে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারবে।
আলোচনার সারমর্ম
উপরোক্ত আলোচনার মধ্যে নিম্নরূপ কথাগুলো বর্তমান।
১. স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর উপর আরোপিত দায়িত্বসমূহে জবরদস্তি বা শক্তি প্রদর্শনের কিছুই নেই। বরং উহার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের সমষ্টিগত কল্যাণ আর সে সমাজের একটি অংগ হচ্ছে নারী।
২. স্ত্রীর অধিকাংশ দায়িত্বের মোকাবিলায় স্বামীর উপরও অনুরূপ দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে। যে সকল মুষ্টিমেয় বিষয়ে পুরুষকে নারীর বিপক্ষে যে কিছু না কিছু শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে তাতে মূলত তাদের দৈহিক ও মানসিক গঠনের স্বাভাবিক তারতম্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এতে নারীর প্রতি অবমাননা বা তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের কোন প্রশ্নই উঠে না।
৩. নারীর উপর পুরুষের যে শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তার বিপক্ষে নারীকে এরূপ আইনগত অধিকার দেয়া হয়েছে যে, স্বামী যদি তার সাথে প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহার করতে থাকে তা হলে সে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারবে।
তালাকের তিনটি পদ্ধতি
স্বামী-স্ত্রী তালাক বা বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দাম্পত্য জীবনের যাবতীয় দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে। এরূপ নিষ্কৃতিলাভের পদ্ধতি তিনটি যথা:
(১) বিবাহের সময়েই স্ত্রী তার ভাবী স্বামীর নিকট থেকে তালাকের অধিকার অর্জন করে। ইসলামী আইনে স্বামী ইচ্ছা করল যে তালাকের অধিকার তার নিজের তা স্ত্রীকে অর্পণ করতে পারে। তবে বাস্তবে খুব কম সংখ্যক নারীই এই অধিকার প্রয়োগ করে থাকে। যাই হোক নারী ইচ্ছা করলে এই অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে।
(২) স্ত্রী আদালতে এ কারণে স্বামীর নিকট তালাকের দাবী করতে পারে যে, সে তাকে ঘৃণা করে এবং সে এরূপ স্বামীর সাথে জীবন কাটাতে অনিচ্ছুক। শোনা যায়, কোন কোন আদালতে নাকি এরূপ মোকাদ্দমায় স্ত্রীর পক্ষে রায় দিতে নারাজ। অথচ এ ব্যাপারে ইসলামী আইনে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। হযরত বিশ্বনবী (স)-এর আদর্শও এই আইনের সমর্থন দেয় এবং এ কারণে ইহা ইসলামী আইনের একটি বিশেষ ধারা বলে পরিগণিত। স্ত্রী নিজেই যখন তালাকের দাবী করে তখন ইসলামী আইনে শুধু এরূপ একটি শর্ত আরোপ কর যে, ঐ সময়ের পূর্ব পর্যন্ত স্ত্রী স্বামীর নিকট থেকে ‘জেহেয’ (বা যৌতুক) স্বরূপ যা কিছু পেয়ে থাকবে তা স্বামীকে ফেরত দিতে হবে। এটাই ইনসাফ। কেননা স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেয় তাহলে তালাক পর্যন্ত স্বামীর দেয়া সবকিছুই স্ত্রীকে দিয়ে দিতে হয়। মোটকথা, বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে স্বামী ও স্ত্রীকে একই প্রকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হবে।
(৩) স্ত্রীর সামনে তৃতীয় আরেকটি পথ উন্মুক্ত রয়েছে যে, আদালতের মাধ্যমে স্বামীর নিকট থেকে তালাক গ্রহণ করার সাথে সাথে জেহেযের মাল-জিনিস এবং খোরপোষও আদায় করতে পারবে। তবে এর জন্য শর্ত হলো এই যে, জরুরী প্রমাণাদির সাহায্যে আদালতকে নিশ্চিত হতে হবে যে, স্বামী তার সাথে দুর্ব্যবহার করছে এবং বিবাহের সময়ে সে স্ত্রীকে যে খোরপোষ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা সে পালন করেনি। আদালত এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলে তাদের বিবাহ বাতিল করার রায় দিতে পারবে।
ইসলাম নারীকে যে এরূপ অধিকার দিয়েছে তা সে প্রয়োজনবোধে কাজে লাগাতে পারে। নারীকে এই অধিকার দেয়ার পর নারী ও পুরুষের অধিকারে এক প্রকার ভারসাম্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরুষ যখন নারীর উপর কিছু শ্রেষ্ঠত্ব রাখে তখন উহার মোকাবিলায় নারীকেও কিছু অধিকতর অধিকার প্রদান করা হয়েছে।
পারিবারিক বিশৃংখলা
তালাক বা বিচ্ছেদের পর পারিবারিক জীবনে নেমে আসে নানাবিধ বিশৃংখলা। স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতিকে ভোগ করতে হয় দুঃসহ যন্ত্রণা ও বহুবিধ ঝঞ্ঝাট। আর এ কারণে আদালতে চলে মোকাদ্দমার পর মোকদ্দমা। অনেক সময়ে দেখা যায়, স্ত্রী তার সন্তান-সন্ততি বা দুগ্ঘপোষ্য শিশু নিয়ে আনন্দের সাথে দিন যাপন করছে। এমন সময়ে হঠাৎ করে কোন সংবাদ বাহক তার স্বামীর পক্ষ থেকে একখানি কাগজের টুকরা –তালাকনামা তার হাতে দিয়ে চলে গেল। এমনি করে তার একটি সোনার সংসার ভেংগেচুরে খান খান হয়ে গেল। অথচ হতে পারে, এর পেছনে রয়েছে স্বামীর কোন সাময়িক আবেগ বা আকস্মিক ঝোঁপ্রবণতা। অথবা এমন কোন মহিলা তার পেছনে লেগেছে যে তার স্ত্রীর চেয়ে অধিকতর রূপসী। কিংবা স্বামী স্ত্রীর প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এবং একঘেয়েমী দূল করার জন্যে নতুন কাউকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে। অনুরূপভাবে স্ত্রীর শৈথিল্য বা নিষ্ক্রিয়তাও এর কারণ হতে পারে। অথবা অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা হেতু স্বামী স্ত্রীর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি করার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেও স্বামী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারে।
এই ধরনের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে নারী স্বাধীনতার সমর্থকরা প্রশ্ন করে থাকে, তাহলে কি তালাকের এই মারাত্মক অস্ত্র –যা তুলে দেয়া হয়েছে পুরুষের হাতে এবং যা ক্ষণিকের আবেগে কিংবা অন্য কোন হীনস্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে কত ধৈর্যশীলা ও নিষ্পাপ মহিলার এবং তার মাসুম সন্তান-সন্তডতির ভবিষ্যত জীবন চিরতরে অন্ধকার হয়ে যায়- ছিনিয়ে নেয়া সমীচীন নয় যাতে করে উহার অপপ্রয়োগ করে কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে?
রোমান ক্যাথলিক দেশসমূহের দৃষ্টান্ত
অস্বীকার করা যায় না যে, স্ত্রী ও সন্তানদের উপর যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট নেমে আসে তার একমাত্র কারণ হলো তালাক। কিন্তু প্রশ্ন হলো: এর প্রতিকার কি? স্বামীর তালাকের অধিকার ছিনিয়ে নিলেই কি এর সমাধান হবে? যদি বলা হয় : হ্যা, তাহলে ভেবে দেখতে হবে, পুরুষের এই অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার পর যে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে –যার নযিীর আমরা দেখতে পাই সকল রোমান ক্যাথলিক দেশে যেখানে তালাক সম্পূর্ণরূপেই নিষিদ্ধ –তার কোন প্রতিকার হবে কি? বিবাহকে যদি একটি স্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক হিসেবে নির্ধারিত করা হয় তাহলে সেই সকল স্বামী-স্ত্রীর পরিণাম সম্পর্কে হিসেবে নির্ধারিত করা হয় তাহলে সেই সকল স্বামী-স্ত্রীর পরিণাম সম্পর্কে একবার চিন্তা করুন যারা একে অন্যকে অন্তর থেকেই ঘৃণা কর এবং প্রতিনিয়তই ঝগড়া-কলহে লিপ্ত থাকে। তাদের নৈতিক অপরাধ কি দিনের পর দিন বেড়ে যাবে না? স্বামী ও স্ত্রী তাদের যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্যে বাইরে যত্রযত্র সংগিনী বা সংগী খুঁজে বেড়াবে না? আর এরূপ জঘন্য ও কুৎসিত পরিবেশে সন্তান-সন্ততির চরিত্র গঠিত হতে পারে কি? সচ্চরিত্র ও উপযুক্ত সন্তানের জন্যে তো প্রয়োজন পিতা-মাতার স্নেহ ও মায়া-মমতার এক অনাবিল পরিবেশ। প্রয়োজন তাদের উন্নত ও সুশৃংখল পরিবেশ। এ জন্যেই দেখা যায়। যারা মানসিক অস্থিরতা ও দুরন্ত মনস্তাত্বিক ব্যধির শিকার তাদের অধিকাংশের মূলে থাকে পিতা-মাতার এরূপ নৈতিক অধপতন এবং উচ্ছৃংখল জীবন কিংবা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহের মারাত্মক অভিশাপ।
আদালাত ও পারিবারিক কলহ
কোন কোন মহল এরূপ প্রস্তাব তুলেছৈ যে, স্বামীর তালাকের অধিকারের উপর বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা উচিত, যাতে করে উহার প্রয়োগের অধিকার কেবল স্বামীকে প্রদান না করে আদালতকেও দেয়া যেতে পারে। আদালতের কর্তব্য হবে উভয় পক্ষের সালিশ উপস্থিত করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে ফেলবে আর নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে তালাকের ডিক্রি জারী করে দেবে। তবে তালাকের ফায়সালা করার পূর্বে সালিশদের কর্তব্য হবে বিষয়টির সর্বাত্মক পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই করবে এবং স্বামীর মত পরিবর্তন ও স্ত্রীর সমঝোতা মেনে নেয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করবে। এ ধররে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরই তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর সে তালাকের ঘোষণা স্বামী নয়, বরং স্বয়ং আদালতই প্রদান করবে।
আমাদের মতে, স্বামী-স্ত্রীর এই সমঝোতার জন্যে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় যার বিরুদ্ধে কেউ কোন প্রশ্নই উত্থাপন করতে পারে না। আমাদের ধারণায়, এরূপ পরিস্থিতিতে আদালতের হস্তক্ষেপ করার কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই। কেননা ইসলামী আইনশাস্ত্রে এরূপ সমস্যার যে সমাধান দেয়া হয়েছে তা আমাদের জন্যে অবশ্যই যথেষ্ট। উহা বর্তমান থাকতে অন্য কোন রূপ সমাধানের কোন প্রশ্ন উঠে না। অনস্বীকার্য যে, এর সমাধান বেশীর ভাগই নির্ভর করে স্বয়ং স্বামী-স্ত্রীর উপর । তারা আন্তরিকতার সাথেই যদি সমঝোতা করতে চায় তাহলে আদালতের ন্যায়ই তাদর আত্মীয়-স্বজনরা তাদের উপরকার করতে সক্ষম। আর তারা (স্বামী-স্ত্রী) যদি আন্তরিকতার সাথে নিষ্পত্তি না চায় তাহলে দুনিয়ার বড় বড় আদালতও তাদের ফায়সালা করতে পারবে না। এখনো দুনিয়ায় এমন এমন দেশ রয়েছে যেখানে নিজেদের যাবতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় তখন আদালতের পক্ষ থেকেই ডিক্রি জারী করে দেয়া হয। কিন্তু এ সত্ত্বেও সেই সকল দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার তালাক সংঘটিত হয়। কেবল এক আমেরিকাতেই বার্ষিক তালাকের হার হচ্ছে ৪০%। দুনিয়াতে এই হলো সর্বোচ্চ হার।
আদালতের হস্তক্ষেপের ক্ষতির দিক
আদালত যখন স্বামীর উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এ বিষয়ে সুনিশ্চিত হবে যে, সমস্ত অপরাধ একমাত্র স্ত্রীর এবং তার সাথে একত্রে বসবাস করা স্বামীর পক্ষে আর সম্ভবপর নয় তখনই কেবল তালাক দেয়া যেতে পারবে এবং এর সামান্যতম অন্যথা হলেও তালাক দেয়া যাবে না –তালাকের এই পন্থাকে সঠিক বলে মেনে নিলেও যে প্রশ্নটি থেকে যায় তাহলো: এতে করে স্ত্রীর কোন কল্যাণ হবে কি? তালাকের ভয় হয়ত থাকলো না। কিন্তু সেই সংসারে তার শান্তি হবে কি যেখানে দিনরাত ২৪ ঘন্টা সগড়া-ঝাটি লেগেই থাকবে –যেখানে দেখতে হবে স্বামীর অগ্নিমূর্তি। থাকতে হবে তার বোঝা হয়ে? এমন গৃহে থাকার জন্যে স্ত্রীকে বাধ্য করা সমীচীন হবে কি যেখানে সুযোগ পেলেই স্ত্রী তার স্বামীকে ধোঁকা দিতে সমর্থ হবে? নিশ্চয়ই কোন আইন এ ধরনের পরিস্থিতিকে সমর্থন করতে পারে না এবং এটাও বরদাশত করতে পারে না যে, ঘৃণা, অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের এমন এক সংসারে স্বামীর অত্যাচার অবিচার মুখ বুজে একজন স্ত্রী সহ্য করতে থাকুক। কেবল সন্তানদের তালিম ও লালন-পালনের জন্যে কোন স্ত্রী এমন এক জাহান্নামে আগুনে বসবাস করতে পারে কি? আর এমন জুলুম ও অমানুষিক নির্যাতনের ভেতরে সে তার সন্তানের শিক্ষা ও লালন-পালনের দায়িত্বিই বা কেমন করে আঞ্জাম দিতে পারে?
সমস্যার একমাত্র সমাধান
বস্তুত এই ধরনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান গোটা সমাজের নৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্বিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপর নির্ভরশীল। এ জন্যে মানসকি পরিচ্ছন্নতা বিধানর এক দীর্ঘ কর্মসূচীর প্রয়োজন। এরূপ কর্মসূচীকে সফল করতে পারলেই নেকী ও কল্যাণের পরিবেশ রচিত হতে পারে এবং সামাজিক জীবনের একটি সুষ্ঠু ভিতও গড়ে উঠতে পারে। এমন একটি সুন্দর ও পবিত্র সমাজেই স্বামীর অন্তরে এরূপ উপলব্ধির সৃষ্টি হতে পারে যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটি পবিত্র ও অনাবিল সম্পর্ক। এ সম্পর্ককে খনিকের আবেগ বা খেয়াল-খুশীর উপর কখনো ছেড়ে দেয়া যায় না।
জীবনের পুনর্গঠন
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের এই কাজটি যেমন দীর্ঘ তেমনি ধীর গতিসম্পন্ন। এর জন্য প্রয়োজন ইসলামী আইনের আলোকে জাতির সমাজ জীবনকে নতুন করে ঢেলে সাজানো। আর উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যে প্রয়োজন সমস্ত জাতীয প্রতিষ্ঠান যেমন পরিবার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফিল্ম, রেডিও, টেলিভিশন, প্রেস, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। এ কাজ বড় কঠিন এবং এতে সময়ও লাগে প্রচুর। কিন্তু স্থায়ীভাবে সামাজিক বিপ্লব সাধন করতে হলে এর কোন বিকল্পও নেই। স্থায়ী বিপ্লবের একমাত্র পথ এটাই।
আইনের মৌল লক্ষ্য
স্মরণীয় যে, পারিবারিক আইনের মৌল লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায় বিচারের এমন এক ব্যবস্থাপনা কায়েম করা যা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্রতিই ইনসাফ করবে এবং বে-ইনসাফীর হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করবে। তালাক এই সামাজিক ইনসাফের বড় একটি দাবীকে পূর্ণ করে দেয়। এটা স্বামী-স্ত্রীর জন্যে এমন একটি সুযোগ সৃষ্টি করে যে, তারা যদি তাদের পারিবারিক জীবন শান্তির সাথে বসবাস করতে ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে তাদের একজন যেন আরেকজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এই পর্যায়ে আমাদের ইসলামী আইন শাস্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানটিকেই স্মরণ রাখতে হবে যে, “আল্লাহর দৃষ্টিতে সকল বৈধ কাজের মধ্যে তালাক হচ্ছে সবচেয়ে অপসন্দনীয় জিনিস।”
একটি জরুরী আইন
একাধিক স্ত্রীকে বিবাহ করা সম্পর্কে আমাদেরকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, এ হলো নিছক একটি জরুরী আইন। এটা কোন মৌলিক আইন নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী**********)
“এতএব নরীদের ভেতর থেকে যাদেরকে তোমরা পসন্দ কর তাদেরকে বিবাহ কর; দু’ দু’জনকে, তিন তিনজনকে এবং চার চারজনকে। যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, তোমরা (তাদের মধ্যে ) সুবিচার করতে সক্ষম হবে না তাহলে মাত্র একজন নারীকেই বিবাহ কর।” –(সূরা আন নিসা: ৩)
উপরোক্ত আয়াতে পরিষ্কারভাবে ইংগিত করা হয়েছে যে, একাধিক বিবাহ করতে হলে স্বামীর জন্যে এরূপ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, সকল স্ত্রীদের সাথে একই রূপ সুবিচারপূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। এই আয়াতে আরো ইংগিত রয়েছে যে, স্বামীর এক বিবাহ করাই সমীচীন। সাধারণ অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসলাম একাধিক স্ত্রীর বিপক্ষে স্ত্রীর একজন হওয়াকেই অধিকতর পসন্দ করে। কিন্তু কোন কোন অবস্থায় একাধিক স্ত্রী গ্রহণেল অপরিহার্যতা সুবিচারের পরিবর্তে অবিচারের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। সেরূপ অস্বাভাবিক অবস্থার জন্যে ইসলাম একাধিক স্ত্রী গ্রহণেল পথকে উন্মুক্ত করে রেখেছে। কেননা যদিও এ অবস্থায় পূর্ণাংগ ইনসাফ পতিষ্ঠা করা সম্ভবপর নয় তবুও এরূপ জরুরী অবস্থায় যে সকল অনিষ্ট হতে পারে তা নিশ্চয়ই সেই সকল অনিষ্টের চেয়ে বহুগুণ কম যা একজন স্ত্রী হওয়ার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করে দেয়ার ক্ষেত্রে সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বর্তমান।
যুদ্ধের ফলে
উদাহরণ স্বরূফ যুদ্ধের কথাই ধরুন। যুদ্ধে সাধারণত বিরাট অংকের পুরুষ নিহত হয়। ফলে পুরুষ ও নারীদের সংখ্যার ভারসাম্য একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়। আর এ অবস্থায় একাধিক বিবাহ একটি অপরিহার্য সামাজিক প্রয়োজন হয়ে দেখা দেয। বস্তুত গোটা সমাজই তখন একাধিক বিবাহের মাধ্যমৈ যৌন নৈরাজ্য ও ব্যভিচার থেকে বেঁচে যায়। সাধারণত যুদ্ধের পরপরই এরূপ যৌন ব্যভিচার এক মহামারীর আকার ধারণ করে। কেননা পুরুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে অসংখ্য নারীর আশ্রয়স্থলও বলতে কিছু থাকে না। এরূপ মহিলাদের কোনভাবে রুজির ব্যবস্থাও হয়ে যেতে পারে; কিন্তু তাদের যৌন স্পৃহা মিটাবার কোন ব্যবস্থা থাকে না। এ পরিস্থিতিতে বেশীর ভাগ যেটা হয়ে থাকে তাহলো এই যে, তারা পুরুষের ঘৃণ্য ও কুৎসিত ব্যভিচারের শিকারে পরিণত হয়। তখন দাম্পত্য জীবনের সুখ শান্তির পথ যেমন রুদ্ধ হয়, তেমনি যে সন্তান-সন্ততির পরিমন্ডলে তাদের জীবনে বেহেশতী সুখ নেমে আসে আশার প্রদীপও চিরতরে নিভে যায়। আর এ পরিস্থিতিতে তাদের অবশিষ্ট জীবনের দুঃখের পশরা নিয়েই তাদের এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়।
ফ্রান্সের শিক্ষামূলক দৃষ্টান্ত
উপরোক্ত জরুরী পরিস্থিতিতে ঐ সকল ছিন্নমূল বিধবা নারীদের জন্যে কী করা উচিত? এদেরকে কি এমনভাবে ছেড়ে দেয়া সমীচীন যাতে করে তারা সামাজিক নীতি-নৈতিকতার কোন পরোয়া না করে বৈধ-অবৈধ যে কোন পন্থায় যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করে বেড়াবে? ফরাসীরা ঠিক এমনি এক সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। তখন সামাজিক নিয়ম-নীতি ধূলিসাৎ হয়ে গেল; ক্রমে ক্রমে তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ম্লান হয়ে গেল। বস্তুত এরূপ সামাজি অধপতনের আশংকা থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র পথই হলো এই যে, আইনে পুরষদের জন্যে পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এরূপ অনুমতি থাকতে হবে যে, পুরুষের জন্যে একাধিক বিবাহের ব্যবস্থা থাকবে। তবে তার জন্যে শর্ত থাকবে: স্ত্রীদের মধ্যে সমান ব্যবহার ও ন্যায়বিচার রক্ষা করে চলতে হবে। অবশ্য চরিত্র ও গুণপনার জন্যে কোন স্ত্রীর প্রতি অধিকতর আন্তরিক দুর্বলতা সৃষ্টি হলে সে কথা স্বতন্ত্র। এর উপর কোন শর্তই আরোপ করা যায় না। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে সাম্যের চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।
আরো কিছু জরুরী পরিস্থিতি
অনুরূপভাবে আরো কিছু জরুরী পরিস্থিতিতে পুরুষের জন্যে একাধিক বিবাহ করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়: কোন কোন পুরুষ অন্যান্য পুরুষদের চেয়ে অধিকতর দৈহিক শক্তির অধিকারী। এরূপ পুরুষদের জন্যে একজন স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা ইচ্ছা করেও সে তার জৈবিক শক্তিকে চেপে রাখতে পারে না। এমন পুরুষদের জন্যে আইনগতভাবেই দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি থাকা বাঞ্ছনীয়। নতুবা বিচিত্র নয় যে, এরা বাধ্য হয়েই ঘরের বাইরে গার্লফ্রেন্ডের নিকট গিয়ে যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করবে এবং সমাজকে এমন কিছু করাতে বাধ্য করবে যার অনুমতি কোন সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা কোনক্রমেই দিতে পারবে না।
স্ত্রীর সন্তান না হওয়া
এছাড়া আরো কিছু পরিস্থিতিতে রয়েছে যার সমাধান স্বামীর জন্যে একাধিক বিবাহ ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না –যেমন স্ত্রীর সন্তান না হওয়া অথবা এমন কোন স্থায়ী ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়া যে কারণে স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনের কোন পন্থই অবশিষ্ট থাকে না। স্ত্রীর সন্তানস না হওয়া এমন অপরাধ নয় যাতে করে তাকে তিরষ্কার করা যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, স্বামী এ কারণে সন্তান থেকে বঞ্চিত হবে কেন? সুতরাং এই সমস্যার যুক্তিসংগত সমাধান হলো দ্বিতীয় বিবাহ করা। এ ক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রী ইচ্ছা করলে স্বামী ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে পারে। নতুবা তালাক নিয়ে পৃথক হয়ে যেতে পারে। আর স্ত্রী স্থায়ীভাবে ব্যধিগ্রস্ত হলে তার সম্পর্কে একথা বলা সংগত হবে না যে, যেহেতু যৌন লালসা একটি নিকৃষ্ট ব্যাপার সেহেতু উহা চরিতার্থ করার সুযোগ না থাকলে একজন নিরপরাধ স্ত্রীর আশা-আকাংখা পদদলিত করে দ্বিতীয় বিবাহ করা কোন মতেই সমীচীন নয়। কেননা এখানে মূল বিবেচ্য বিষয় যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করা ভালো, না মন্দ তা নয়। বরং মানুষের বাস্তব প্রয়োজনই হচ্ছে মূল বিষয়। আর বাস্তব প্রয়োজনকে কখনো উপেক্ষা করা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে স্বামী যদি নিজ ইচ্ছায় স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখার উদ্দেশ্যে নিজেকে বঞ্চিত রাখতে প্রস্তুত হয় তাহলে সেটি হবে তার মহত্ব ও উদারতার পরিচায়ক। কিন্তু আল্লাহ কোন মানুষের উপর তার শক্তি ও সামর্থের বাইরে কোন বোঝা অর্পণ করেন না। কেননা সত্যের সম্মুখীন হওয়াই অধিকতর সত্য। এরূপ ভদ্রতার আড়ালে যে কত ধরনের পাপ চলতে থাকে তার সন্ধান পাওয়া যায় ঐ সকল জাতির জীবনে যারা একাধিক বিবাহকে অভদ্রজনোচিত কাজ বলে গর্ব করে বেড়ায়।
এই প্রসংগে সেই সকল পরিস্থিতিকেও স্মরণ রাখতে হবে যে, স্বামী এমনভাবে নিরুপায় হয়ে যায় যে, না সে স্ত্রীকে ভালোবাসতে পারে না, তাকে তালাক দিয়ে স্বাধীন করে দিতে পারে। এই প্রকার সকল পরিস্থিতিতে স্বামীর একাধিক বিবাহ হচ্ছে একমাত্র সমাধান।
সমস্যার বিভিন্ন দিক
স্ত্রীর বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কেও আলোচনা করা প্রয়োজন যাতে করে এ ব্যাপারে কারুর কোন সন্দেহের অবকাশ না থাকে।
চলাফেরার অধিকার
সর্বপ্রথম চাকুরী করার, শ্রমিক হওয়ার এবং চলাফেলার কথাই ধরা যাক। ইসলাম নারীরেকে মেহনত, শ্রম ও চলাফেরার পূর্ণ অধিকার দেয়। ইসলামের প্রথম যুগে যখনই কোন সত্যিকার প্রয়োজন হতো তখন মুসলমান নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করতো। এই রূপে ইসলাম নারীদেরকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে যেমন মহিলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নার্সিং এবং মহিলাদের চিকিৎসা কেন্দ্রে কাজ করতে কোন বাধা আরোপ করে না। বরং প্রয়োজন হলে জরুরী অবস্থায় রাষ্ট্র যেমন পুরুষদের নিকট থেকে নানারূপ সেবা গ্রহণ করে। তেমনি মহিলাদের নিকট থেকেও সেবা গ্রহণ করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে যদি কোন মহিলা একেবারেই আশ্রয়হীন হয় এবং তার সাহায্যের জন্যে কোন পুরুষ না থাকে তাহলে জীবিকা অর্জনের জন্যেও সে গৃহের বাইরে যেতে পারে। তবে একথা নিশ্চয়ই স্মরণ রাখতে হবে য, ইসলাম নারীকে নিজের গৃহ ছেড়ে বাইরে যাওয়ার অনুমতি কেবল তখনই দিতে পারে যখন বাস্তবিকিই কোন প্রয়েঅজন দেখা দেবে কিংবা এমন কোন বাধ্য-বাধকতা এসে উপস্থিত হবে যে, তাকে বাইরে না গিয়ে কোন উাপায়ই নেই।
সচরাচর যখন কোন বিশেষ বাধ্য-বাধকতা দেখা না দেবে তখন ইসলাম ইহা কিছুতেই পসন্দ করে না যে, পাশ্চাত্যের এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মত মহিলারা খামাখাই গৃহের বাইরে বিচরণ করে বেড়াবে। ইসলামের দৃষ্টিতে ইহা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কেননা সামাজিক কর্মতৎপরতায় শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে নারীরা যখন নিজেদের ঘর থেকে বিদায় নেবে তখন তাদের জীবনের মূল তৎপরতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে মূল ব্রত একমাত্র গৃহের অভ্যন্তরে থেকেই আঞ্জাম দেয়া সম্ভপর। এখানেই শেষ নয়, নারীরা যখন বিনা প্রয়োজনে গৃহ পরিত্যাগ কবে তখন সমাজে বহুবিধ মনস্তাত্বিক, সামাজিক এবং নৈতিক বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়বে। তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।
সর্বাত্মক ক্ষতি
নারী জাতি দৈহিক, মানসিক এবং আত্মিক দিক থেকে জীবরে মুল লক্ষ্য অর্থাৎ মা হওয়া সর্বাত্মক যোগ্যতা অর্জনে যে পরিপূর্ণরূপেই সফল তাতে কোন সন্দেহ নেই। নারী জাতির জন্যে ইহা এক চরম সত্য। এ সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং যা তাদের জন্যে জরুরী নয় তার প্রতি যদি তারা ঝুঁকে পড়ে সময় ব্যয় করতে শুরু করে এবং নিজেদের মূল বর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে তাহলে তার ক্ষতি কেবল পরিবার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং গোটা মানবতাই সে কারণে দারুণবাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে করে তারা মা হওয়ার পরিবর্তে পুরুষদের হাতের খেলনা, তাদের আনন্দ-স্ফূর্তির খোরাক এবং আমোদ-প্রমোদ ও ভ্রমণের সংগিতে পরিণত হতে বাধ্য হবে; তাদের ভোগ-বিলাস এবং কামান্ধতার ভেঁট হয়ে নিজেদের ইজ্জত ও সম্ভ্রম সবকিছু হারিয়ে ফেলবে। ইসলাম নারীত্বের এই অবমাননাকে বিন্দুমাত্রও বরদাশত করে না। কেননা উহার অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হলো এই যে, গোটা মানবতাকে এমন একটি সুসংবদ্ধ একক বলে বিশ্বাস করে যা কালজয়ী ও অক্ষয় –শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয়।
একটি ভিত্তিহীন চিন্তা
কেউ বলতে পারে যে, শিশুদেরকে আয়ার হাতে সোপর্দ করে কোন নারী যদি ঘরের বাইরে কোন চাকুরী করে তাহলে ক্ষতি কি? এতে করে একদিকে সে যেমন অর্থ উপার্জন করতে পারবে তেমনি অন্যদিকে মা হিসেবে তার মুল দায়িত্বও পালন করতে পারবে। কিন্তু এই ধারণাটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। কেননা একজন আয়অ –সে যতই ভালো হোক এবং শিশুদের দৈহিক, মানসিক ও মনস্তাত্বিক বিকাশ সাধনের জন্যে যতই চেষ্টা করুক না কেন, একটি ক্ষেত্রে সে পুরোপুরিই ব্যর্থ। সে ক্ষেত্রটি হলো: সে কখনো মা হতে পারে না এবং মায়ের স্থলাভিষিক্তও হতে পারে না। সে শিশুদেরকে কখনে মায়ের সেই অবারিত ও অফুরন্ত স্নেহ-মমতার পিযুষধারা দিতে পারে না, যার অভাবে জীবনের পষ্পোদ্যান যায় বিরাণ হয়ে –মানবীয় নৈতিকতার পথ যায় চিরতরে রুদ্ধ হয়ে।
কযারা পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুসারী কিংবা সমাজতন্ত্রের দিগভ্রান্ত ধ্বজাধারী তাদের অর্থহীন চিৎকারে মানবীয় প্রকৃতিতে কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না। এ বাস্তবকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম দু’ বছরে মায়ের সার্বক্ষণিক ও সর্বাত্মক স্নেহ-যত্ন এবং পরিপূর্ণ মনোনিবেশ ছাড়া কোন শিশুই সুষ্ঠুভাবে লালিত হতে পারে না। এই সময়ে মায়েল পরিবর্তে অন্য কেউই –চাই সে ভাই হোক, বোন হোক বা অন্য কোন আত্মীয় হোক –এমনকি আয়া বা নার্সও শিশুকে মায়েল স্নেহ-যত্ন দিয়ে এ কাজটি করতে সমর্থ হয় না। সাধারণত একজন আয়াকে একই সময়ে দশ দশ কিংবা বিশ বিশটি শিশুর দেখাশুনা করতে হয়। এরূপ ভাড়াটিয়া (বা রাখালিনী সদৃশ) মায়ের আওতায় শিশুরা সর্বদাই দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত থাকে।কখনো একটি শিশুর খেলনা আরেকটি শিশু জোর করে বা না বলে নিয়ে যায়। কখনো বা চিমটি দেয় ইত্যাদি সারাক্ষণই চলতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে এই ঝগড়া-বিবাদ তাদের দ্বিতীয় স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। এরপর তারা যতই বড় হতে থাকে ততই স্নেহ-মমতা প্রীতি-ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে অপরিচিত এবং যাবতীয় সুকুমার বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে মানুষ নামক এক জন্তুতে পরিণত হয়।
মুসলমান স্বামী, বাপ ও ভাইদের কিট একটি প্রশ্ন
যদি সত্যিকার কোন অপরিহার্য প্রয়েঅজন দেখা দেয় তাহলে এরূপ কোন আয়ার তত্ত্বাবধানে শিশুদেরকে রাখা যেতে পারে। কিন্তু এরূপ কোন প্রয়োজন দেখা না দিলে এটা করা কোন বিজ্ঞজনোচিত কাজ নয়। হতে পারে পাশ্চাত্য জগতের লোকেরা নিজেদের ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার দুর্বিপাকে নিজেদেরকে অনেকটা নিরুপায় বলে মনে করে। কিন্তু প্রাচ্যেল মুসলমানদের জন্যে নিজেদেরকে নিরুপায় মনে করার কোন বৈধ কারণ নেই। আমাদের পুরুষদের সংখ্যা কি সত্যিই এতদূর হ্রাস পেয়েছে যে, গৃহের বাইরে যাবতীয় কাজ-কর্ম চালাবার জন্যেও আমাদের নারীদের সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন? –না মুসলমান পুরুষ, স্বামী, বাপ, ভাই ও অন্যা্য পুরুষ আত্মীয়-স্বজনদের অন্তর থেকে সমস্ত সম্ভ্রমবোধ ও ‘গায়রাত’ ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে গেছে এবং নিজেদের স্ত্রী, কন্যা ও ভগ্নিরা তাদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে? আর এ কারণে এই নিরুপায় ও অসহায় নারীরা নিজেদের বোঝা নিজেরা বহন করার আশায় অফিস-আদালত, কল-কারখানা বা খেত-খামারে গিয়ে গিয়ে চাকুরী করতে বাধ্য হচ্ছে?
ইসলামী দুনিয়ার দারিদ্র
এ-ও বলা হয় যে, চাকুরীর মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনস করতে সক্ষম হয়। এবং এতে করে তার মূল্য ও সম্ভ্রম বেড়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, ইসলাম নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে কখনো অস্বীকার করেছে? বাস্তব ঘটনা হলো এই যে, ইসলামী দুনিয়ার এখন যে নানাবিধ সমস্যা বর্তমান তা আমাদের জীবনব্যবস্থার কোন ত্রুটির অপরিহার্য ফলশ্রুতি নয়; বরং এ হচ্ছে সেই ব্যাপক ও সর্বাত্মক দারিদ্রতার ফসল যার কারণে কি পুরুষ, কি নারী সবাইকেই নির্দোষ ও পবিত্র জীবনযাপনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এর একমাত্র সমাধান হিসেবে আমাদেরকে উৎপাদন বাড়াতে হবে –যাতে করে গোটা জাতিই সচ্ছল ও দারিদ্র মুক্ত হতে পারে। উৎপাদনের উপায়-উপাদানের মালিকানা নিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে বর্তমান যে প্রতিযোগিতা চলছে তা এই সমস্যার আদৌ কোন সমাধান নয়।
চাকুরীর আরেকটি ক্ষতি
নারীদের চাকুরীর পক্ষে আরো একটি দলিল এরূপ পেশ করা যায় যে, একজন নারী চাকুরী করে গোটা পরিবারের আয় বৃদ্ধি করতে পারে। কেননা একথা স্পষ্ট যে, দু’জনের উপার্জন একজনের উপার্জনের চেয়ে অবশ্যই বেশী। কোন কোন সংসারের জন্যে ইহা সঠিক হতে পারে। কিন্তু সমাজের সমস্ত মহিলাই যদি চাকুরী গ্রহণ করে তাহলে গোটা পরিবার ব্যবস্থাই যে ধ্বংসগ্রস্ত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা এতে করে স্বামী-স্ত্রী অধিক সময় ধরে একে অন্যের নিকট থেকে দূরে থাকার কারণে সমগ্র সমাজ জীবনেই নৈতিক অনাচার ছড়িয়ে পড়বে। অর্থনৈতিক, সামাজিক বা নৈতিক এমন কোন বাধ্যবাধকতা সত্যিই আছে কি যে কারণে একজন নারীর ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে নিজের সতীত্বের ন্যায় অমূল্য সম্পদকে বিকিয়ে দিবে?
এ–ই উচ্চ সম্মান
ইসলাম নারীর প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক দায়িত্ব হিসেবে পূর্ণ একাগ্রচিত্ততা ও নিশ্চিন্ততা সহকারে ভবিষ্যত প্রজন্মের বৃদ্ধি ও লালণ-পালনের নির্দেশ প্রদান করেছে। তার সামনে মানবীয় প্রকৃতি ও সমাজ উভয়ের চাহিদাই বর্তমান ছিল। এ কারণেই ইসলাম নারীর অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনের সমস্ত বোঝা পুরুষের উপর অর্পণ করেছে যাতে করে নারী সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু সাথে সাথেই উহা নারীর সামাজিক মর্যাদা এতদূর উন্নীত করে দেয়া হয়েছে যে, যখন একব্যক্তি বিশ্বনবী (স)-এর নিকট প্রশ্ন করলেন: “আমার নিকট সদ্ব্যবহার লাভের অধিকার সবচেয়ে কার বেশী? হযরত নবী (স) উত্তরে বললেন: তোমার মা। সে আবার প্রশ্ন করলো: তারপর কে? হযরত বললেন: তারপর তোমার মা। ঐ ব্যক্তি পুনরায় প্রশ্ন করলো: তারপর কোন্ ব্যক্তি? হযরত বললেন: তোমার পিতা।” –(বুখারী ও মুসলিম)
ইসলাম এবং আধুনিক নারী স্বাধীনতা আন্দোলন
ইসলাম নারী জাতিকে যে অধিকার ও মর্যাদা দান করেছে তা দেখে এটা বুঝাই মুস্কিল যে এর পরেও আধুনিক মুসলমান নারীদের অধিকার আদায়ের নামে এত হৈচৈ ও হুর-হাঙ্গামার উদ্দেশ্য কি? এমন কোন অধিকার অবশিষ্ট আছে কি যা ইসলাম নারীকে প্রদান করেনি যাার জন্যে তাদের আন্দোলন করতে হবে, -ভোটাধিকার আদায় এবং পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব লাভের ক্ষমতাও অর্জন করতে হবে? আসুন, তাদের দাবী সম্পর্কেও আলোচনা করা যাক।
মানবীয় সাম্য
আজকের মুসলমান নারীদের একটি দাবী হলো: তাদের একই রূপ সমান মানবীয় মর্যাদা প্রদান করতে হবে। কিন্তু হয়ত তারা জানেই না যে, ইসলাম তাদেরকে এই অধিকার বহুকাল পূর্বেই প্রদান করেছে। শুধু নীতিগতভাবেই নয়, -বাস্তব দিক থেকেও এবং আইনের দিক থেকেও।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবী
তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চায় এবং সমাজ জীবনে সরাসরি অংশগ্রহণের দাবীদার। অথচ ইসলামই হচ্ছে দুনিয়ার সর্বপ্রথম ধর্ম যা তাদেরকে এই অধিকার বহুকাল পূর্বেই প্রদান করেছে।
শিক্ষালাভের অধিকার
তারা শিক্ষালাভের অধিকার চায়। অথচ ইসলাম তাদেরকে শুধু শিক্ষা হাসিলের অধিকারই দেয়নি, বরং উহাকে তাদের জন্যে অবশ্য কর্তব্য –ফরয বলে গণ্য করেছে।
নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী বিবাহের অধিকার
তারা কি এরূপ অধিকার চায় যে, তাদের অনুমতি ও মর্জি ব্যতিরেকে তাদের বিবাহ হতে পারবে না? ইসলাম তাদেরকে এই অধিকার প্রদান করেই ক্ষ্যান্ত থাকেনি বরং এরূপ অধিকার প্রদান করছে যে, তাদের বিবাহের বিষয়টি নিজেরাই চূড়ান্ত করতে পারবে।
ইনসাফ, সম্প্রীতি ও আইনগত সংরক্ষণ
তারা কি চায় যে, গৃহে থেকে যখন তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে থাকবে তখন তাদের সাথে সদয় ও সুবিচারভিত্তিক সদ্ব্যবহার করতে হবে? স্বামীরা যখন তাদের সাথে দুর্ব্যবহার বা বে-ইনসাফী করবে তখন কি তারা বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার চায়? ইসলাম তাদেরকে এই অধিকারসমূহ পুরোপুরি প্রদান করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং পুরুষদের উপর তাদের এই অধিকারসমূহের সংরক্ষণের দায়িত্বও অর্পণ করেছে।
চাকুরীর অধিকার
এছাড়া তারা কি চায় যে, গৃহের বাইরে গিয়েও তারা কাজ কর্ম ও চাকুরী করবে? ইসলাম সত্যিকার প্রয়োজনে নারীদেরকে এই অধিকার সহস্রাধিক বছর পূর্বেই প্রদান করে রেখেছে।
একটি ব্যতিক্রম
কিন্তু তারা যদি এই অধিকার চায় যে, সকল নীতি-নৈতিকতাকে বৃদ্ধাংষ্ঠি দেখিয়ে যথেস্ছ চলাফেরা ও অবাধ বিচরণের সুযোগ দিতে হবে এবং তাদর মানবতা বিধ্বংসী কর্মতৎপরতাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না তাহলে ইসলম কখনো তাদেরকে এই স্বাধীনতা দান করতে পারে না। কেননা ইসলাম এই ধরনের কাজকে মানবীয় ইজ্জত ও সম্ভ্রমের ঘোর বিরোধী বলে গণ্য করে। উহা কখনো এটা বরদাশত করে না যে, কোন নারী অথবা পুরুষ এই ধরনের কাজে লিপ্ত হয়ে মানবতাকে বিপন্ন করে তুলুক। কিন্তু আজকালকার নারীরা যদি এই ধরনের কিছু চায় তাহলে তাদের পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের আশ্রয় নেয়ার কোন প্রয়েঅজন নেই; বরং তাদের জন্য সেইদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করাই উত্তম যেদিন যাবতীয় সামাজিক বন্ধন ও ঐতিহ্য একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। এরপর তাদের স্বপ্নসাধ এমনিই পূর্ণ হবে এবং কোন রূপ বাধা-বন্ধন ব্যতিরেকেই লীলা-কেলায় মগ্ন হতে পারবে।
কিছু সংখ্যক লোক এমন রয়েছে যারা একথা স্বীকার করে যে, প্রাচ্যের দেশগুলোর অবস্থা ও মূল্যবোধ এবং পাশ্চাত্যের অবস্থা ও মূল্যবোধের মধ্যে আসমান-জমিন ব্যবধান। তবুও তারা বলতে দ্বিধা করে না যে, প্রাচ্যের নারীদের সামাজিক মর্যাদা এতদূর নিম্নে যে, মানুষ তার বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়। অন্য দিকে পাশ্চাত্যের নারীরা একদিকে যেমন স্বাধীনতা লাভ করেছে, তেমনি অন্যদিকে যথাযোগ্য সামাজিক মর্যাদাও হাসিল করেছে। সুতরাং প্রাচ্যের নারীরা যদি পাশ্চাত্যের নারীদের অুসরণ করে তাদের কেড়ে নেয়া অধিকারসমূহ যদি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় তাহলে তাতে দোষের কি কারণ থাকতে পারে?
মুসলমান নারীদের বর্তমান অবস্থা
আমরা স্বীকার করি যে, বর্তমানে মুসলমান দেশগুলোতে নারীরা বহুবিধ থেকেই অনুন্নত। সামাজিক মর্যাদা বা সম্ভ্রম বলতে তাদের কিছুই নেই –তারা কেবল পশুর মতই দিন যাপন করছে। সব কথাই ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এই অবস্থার জন্যে দায়ী কে? কোন না কোন দিক থেকে ইসলাম বা ইসলামী শিক্ষাই কি এ জন্যে দায়ী?
প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এই যে, আজকাল প্রাচ্যেল নারীরা যে করুন অবস্থার শিকার তা হচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্বিক অবস্থার অনিবার্য ফলশ্রুতি। যদি সত্যিই আমরা সামাজিক জীবনের সুষ্ঠু সংশোধন কামনা করি তাহলে আমাদেরকে উপরোক্ত অবস্থাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে যাতে করে অধপতনের মুল উৎসও আমরা অবগত হতে পারি।
অধপতনের মূল
প্রাচ্যের নারীদের অধপতনের মূল কারণ হচ্ছে তাদের দারিদ্রতা। বিগত কয়েক পুরুষ থেকেই গোটা প্রাচ্যের জগত এই অভিশাপে জর্জরিত। এছাড়া সেই সামাজিক বে-ইনসাফীও এ জন্যে দায়ী যে কারণে সমাজের মুষ্টিমেয় লোক তো সীমাহীন আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে লিপ্ত এবং অবশিষ্ট লাখো-কোটি বনি আদম তথা সাধারণ মানুষ না সংগ্রহ করতে পারছে তাদের পরনের কাপড়, না জোটাতে পারছে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের জন্যে দু’ মুঠো অন্ন। এর মূলে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কুশাসনে এবং স্বৈরাচারী নির্যাতন। আর এ কারণেই মানুষকে শাসক ও শাসিত –এই দু’টি পৃথক শ্রেণীতে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে। শাসক শ্রেণরি লোকেরা যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিজেদের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিচ্ছে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা জনসাধারণেল উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অধিকারও পাওনা যেটুকু –তার সবটুকুই যেন তাদের; জনসাধারণকে কোন অধিকার দিতে নারাজ। বর্তমানে প্রাচ্যের সমাজ জীবনের ওপর স্বৈরাশাসনের যে কালো মেঘ ছায়া বিস্তার করেছে তা এই সামাজিক দূরবস্থারই অনিবার্য ফসল। এই সামাজিক অবস্থাই প্রাচ্যের নারীদের বর্তমান শোচনীয় অবস্থা ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মুল কারণ।
দারিদ্র ক্লিষ্ট পরিবেশ
আজকের নারীরা পুরুষদের সাথে পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। কিন্তু প্রাচ্যের বর্তমান চরম দারিদ্র ক্লিষ্ট পরিবেশে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব কি? কেননা এই পরিবেশ পরিস্থিতির নির্মম শিকার শুধু নারীরাই নয়, পুরুষরাও –এর নিষ্ঠুর কষাঘাতে সকলেই জর্জরিত।
সামাজিক নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া
পুরুষরা ঘরে নারীদের সাথে যে দুর্ব্যবহার করে –যে অকথ্য জুলূম ও নির্যাতন চালায় তার মূলে রয়েছে তাদের নিজেদের নির্যাতিত হওয়ার প্রতিক্রিয়া। যে পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে কাজ করে বা চলাফেরা করে সেখানকার সবাই তাদের উপর কমবেশী নির্যাতন চালায়। সমাজের সবখানেই তাদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হতে হয়, কখনো কখনো মোড়ল-মাতুব্বরদের হাতে তাদের অপমাণিত হতে হয়, কখনো পুলিশ বা কারখানার মালিকরা তাদের আত্মসম্মানে আঘাত দেয়, কখনো আবার রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের কোপানলে পড়ে তাদের ইজ্জত ও সম্ভ্রম হারাতে হয়। মোটকথা প্রতিটি স্থানে ও প্রতিটি মুহূর্তেই তাদের নানাবিধ অবমাননা ও তিরষ্কারে জর্জরিত হতে হয়; অথচ কারুর বিরুদ্ধে তার অভিযোগের বা প্রতিশোধ নেয়ার কোন ক্ষমতা নেই। তাই ঘরে এসেই তার সব রাগ ও আক্রোশ নিজের স্ত্রী, সন্তান বা অন্যান্য ঘনিষ্ঠজনদের উপর ঝড়তে শুরু করে।
দারিদ্রের এই অভিশপের ফলেই একজন পুরুষ এমন নির্জীব ও হৃদয়হীন হয়ে পড়ে যে, পরিবারের ঘনিষ্ঠ ও আপনজনদের সাথে স্নেহ-ভালোবাসা, সহমর্মিতা বা সহিষ্ণুতাপূর্ণ ব্যবহার করার উপযুক্ততাই হারিয়ে ফেলে। আর এ কারণেই একজন নারী তার স্বামীর পক্ষ থেকে সকল প্রকার জুলুম, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার মুখ বুজে বরদাশত করছে। কেননা সে জানে যে, স্বামী যদি তাকে ঘর থেকে বের করে দেয় তাহলে তাকে অনাহারেই মরতে হবে। এমনকি সে এই ভয়ে নিজের বৈধ অধিকা আদায়ের জন্যেও এতটুকু সাহস করে না। পরিশেষে স্বামী যখন তাকে তালাক দিয়ে দেয় তখন তার বোঝা বহন করতে পারে না। তার পিতা-মাতাও এতদূর দরিদ্র যে, তারা তার বোঝা বহন করতে পারে না। স্ত্রী যদি স্বামীগৃহ ত্যাগ করে পিতা-মাতার গৃহে গমন করে তাহলে তারাও তাকে এরূপ উপদেশ দেয় যে, তার স্বামীর ঘরে ফিরে যাক এবং যে কোনভাবেই হোক স্বামীর নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে চলতে থাকুক। মোটকথা গোটা প্রাচ্যেল নারীদের এই লাঞ্ছনা-অবমাননার মূলে রয়েছে তাদের অভাবনীয় দারিদ্র।
উদ্দেশৗ ও লক্ষ্যের অনুপস্থিতি
দারিদ্রের এই নির্মম কষাঘাতের ফলে গোটা প্রাচ্যের আজ জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বলতে যেমন কিচুই নেই, ঠিক তেমনি আত্মপরিচয় লাভের কোন নিদর্শনও খুঁজে পাওয়া যায় না। গোটা এলাকাই মূর্খতার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। সুউচ্চ মানবীয় মূল্যবোধের ধারণা থেকেও সবাই বঞ্চিত। তবে সব হারিয়েও তারা একটি মাত্র মূল্যবোধকে সমর্থন করে চলেছৈ যে, শক্তি ও উহার প্রদর্শনীয় পূজা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই; যারা দুর্বল তাদেরকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করাই হবে বুদ্ধিমত্তার কাজ। মোটকথা কারুর দুর্বল হওয়া তার দৃষ্টিতে তাকে হেয় ও অপমানিত করার জন্যে যথেষ্ট।
শক্তির পূজা
শক্তির এই পূজার কারণে পুরুষ একজন নারীকে অত্যন্ত তুচ্ছ করে। দৈহিক শক্তির দিক থেকে দুর্বল নারীকে সম্মান দেয়ার জন্যে যে নৈতিক উৎকর্ষতা ও মহত্বের প্রয়োজন পুরুষ তা থেকে সম্পূর্ণরূপেই বঞ্চিত। এ কারণেই আজকের পুরুষের অন্তরে নারীর মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বলতে কিছুই নেই। এবং নেই বলেই সে নারীকে সম্মান ও মূল্য দিতে পারছে না। অথচ মানুষকে স্বাভাবিক মর্যাদা দেয়াই হচ্ছে মানুষের কাজ। কিন্তু নারী যদি ধন-ঐশ্বর্যের মালিক হয় তাহলে প্রাচ্যের বর্তমান জড়বাদী পরিবেশে সে অতি সহজেই সম্মা ও পদমর্যাদা লাভ করতে সক্ষম।
অধপতিত সমাজ
এরূপ অধপতিত ও অনুন্নত সমাজে –যার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমাদের প্রাচ্যের সমাজ –মানুষ এতদূর নিম্নস্তরে নেমে যায় যে, পুরোপুরি পশুর স্তর কিংবা তার একেবারে নিকটবর্তী পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমন সমাজে মানবতার কোন রাজত্ব চলে না। রাজত্ব চলে কেবল যৌন স্পৃহার। জীবন সম্পর্কে তাদের যাবতীয় চিন্তা ও কর্মে এই যৌন ভাবধারারই প্রতিফলন ঘটে। এর রং ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বস্তুত এই ধরনের সমাজ ব্যবস্থায় নারী হয় শুধু পুরুষের ভোগের সামগ্রী, সে হয় তার কামরিপু চরিতার্থ করার একমাত্র হাতিয়ার। মানুষ হিসেবে সে কোন সম্মান বা মূল্য লাভ করতে পারে না। কেননা মনস্তাত্বিক, মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে তাদের পুরুষের চাইতে এতদূর নিম্নস্তরের মনে করা হয় যে, না তাকে কোন সম্মানের হকদার বলে গণ্য করা হয়। আর না সে জন্যে কান দাবী উত্থাপন করা যেতে পারে। এর অনিবার্য ফল হয় এই যে, নারী ও পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক নিছক পশুসুলভ সম্পর্কেই পরিণত হয়। আর এতে করে পুরুষের নিকট কেবল বস্তুগত লাভ কখনো প্রাধান্য লাভ করে না। সুতরাং স্বার্থসিদ্ধির পরে সে বস্তু নিয়ে আর মাথা ঘামায় না।
মূর্খতা ও ক্ষুধা
একটি অধপতিত সমাজে মূর্খতা ও ক্ষুধা সর্বদাই লেগে থাকে। সুতরাং তাদের কাছে না এত পরিমাণ সময় আছে, না এতদূর শক্তি আছে যে, তারা নৈতিকতা ও নিয়ম-শৃংখলার দিক থেকে উন্নতি লাভ করতে পারে। অথচ এই সকল গুণ ব্যতিরেকে কোন সমাজই উন্নতমানের সমাজ হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারে না এবং পশু স্তর থেকে উত্তীর্ণও হতে পারে না। সমাজে এই প্রকর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শৃংখলার অভাব কিংবা উহার কোন বিকৃত রূপের উপস্থিতির ফলে দেখা যায় যে, মানব জীবন নিছক অর্থনৈতিক জীবনে পরিত হয়। শক্তি ও ক্ষমতার পূজা একান্ত হয়ে উঠে এবং জীবনকে শুধু পাশবিক ও জৈবিক লালসা বা ভোগ স্পৃহা দিয়েই পরিমাপ করা হয়।
মায়ের ভুল পথ অবলম্বন
এরূপ অনুন্নত সমাজে মা হিসেবে নারীরা এক ভুল পথ অবলম্বন করে বসেও এবং নিজেদের অজ্ঞাতসারেই নারী জাতি সম্বন্ধে পুরুষদের দৃষ্টিতে যাবতীয় অনিষ্টের কারণ বলে পরগণিত হয়। তারা নিজেদের ছোট্ট একটি শিশুকেও এমন এক শাসনকর্তা বানিয়ে দেয় যে, সে তাদেরকে হুকুম করতে এবং আনুগত্য করাতে অভ্যস্ত হয়। তাদের স্নেহ ও বাৎসল্য এতদূর অন্ধ হয়ে উঠে যে, তারা তার অযথা দাবী ও অন্যায় আকাংখার বিরদ্ধেও কোন টু শব্দটি করতে অগ্রসর হয় না; বরং তার প্রতিটি বাজে ও অযৌক্তিক দাবী পূরণ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরূপ লাগামহীন স্নেহের অনিবার্য ফল হয় এই যে, এই শিশু যখন যুবক হয়ে যায় তখন সে প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে বসে এবং কামনা করে যে, অন্য লোকের মুখ বুজে তার প্রত্যেকটি হুকুমই তামিল করতে থাকবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে যখনই প্রতিবাদের সম্মুখীন হয় তখন সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং সমম্ত ক্ষিপ্ততার প্রতিশোধ সে তার ঘনিষ্ট লোকজন –পুরুষ, নারী ও শিশুদের তেকে নিতে বাধ্য হয়। গোটা মুসলিম জাহান আজ যে উদ্বেগ ও অস্থিরতার করুণ শিকার তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ সম্পর্কে এতক্ষণ আলোচনা করা গেল। প্রাচ্যের নারীদের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মূল কারণও এর মধ্যে নিহিত। কিন্তু একথা স্পষ্ট যে, এই কারণসমূহ ইসলাম কখনো সৃষ্টি করেনি এবং নির্ভুল ইসলামী ভাবধারার সাথে এর কোন সামঞ্জস্যও নেই।
ইসলাম এবং প্রাচ্যের বর্তমান দারিদ্রতা
গোটা প্রাচ্যে আজ যে নিঃস্বতা ও দারিদ্র বর্তমান উহার মূল কারণ কি ইসলাম? –নিশ্চয়ই নয়। কেননা ইসলম তো উহার আদর্শ যুগে –হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের যুগে –সামজ ও রাষ্ট্রকে এতদূর উন্নত করে তুলেছিল যে, ঘরে ঘরে গিয়ে অভাবী ও নিঃস্ব লোকের সন্ধান করা হতো কিন্তু দান বা অর্থ সাহায্য গ্রহণ করার মত কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। ইসলাম জীবনের একটি বাস্তব বা আমলী (Practical) জীবনব্যবস্থা। উহা বাস্তব জগতেই এরূপ শক্তিশালী অর্থব্যবস্থার অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। এই ইসলামকেই –এই জীবনব্যবস্থাকেই আমরা দুনিয়ায় পুনপ্রতিষ্ঠিত করতে চাই? একটি জীবনব্যবস্থা হিসেবেই ইসলামের কামনা হলো: জাতির সমস্ত ধন-দৌলত সকল নাগরিকদের মধ্যে ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে বন্টন করা হোক। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী*******)
“যাতে করে সম্পদ কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হতে থাকে।” (সূরা আল হাশর: ৭)
ইসলাম দরিদ্রতাকে উত্তম বলেও মনে করে না এবং পসন্দনীয় জিনিস বলেও গণ্যঙ করে না। ইসলাম চায়: দুনিয়ার বুক থেকে উহার অস্তিত্বই মুছে যাক। ইসলাম অনুরূপভাবে কাউকে আড়ম্বরতা, ভোগ-বিলাস বা মাতলামি করার অনুমতি দিতেও নারাজ। আধুনিক প্রাচ্যের নারীদের দুঃখ-দুর্দশার সবচেয় বড় কারণ হচ্ছে দরিদ্রতা। এর পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারলেই তাদের বেশীল ভাগ সমস্যার সমাধান আপনা আপনিই হয়ে যেতে পারে। সাথে তাদের হারানো সম্ভ্রম ও মর্যাদাও ফিরে আসবে। এবং এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে গৃহের বাইরে গিয়ে চাকুরী অনুসন্ধান করার কোন প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেবে না। (যদিও চাকুরীর অধিকার তাদের তখনও বহাল থাকবে।) কেননা এ অবস্থায় তারা জাতীয় সচ্ছলতা এবং সম্পদে উত্তরাধিকারের মাধ্যমে নিজেদের বৈধ অংশ লঅভ করতে সমর্থ হবে। তারা নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্যে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করতে পারবে। এরূপে নারীরা যখন বস্তুগত দিক থেকে সচ্ছল হয়ে উঠবে তখন পুরুষরাও তাদেরকে সম্মান দিতে শুরু করবে এবং তারা দরিদ্রতার ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণ সৎসাহসের সাথে নিজেদের যাবতীয় বৈধ অধিকার ভোগ করতে সক্ষম হবে।
রাজনৈতিক জুলুম ও ইসলাম
বলুন তো, আধুনিক প্রাচ্যে আজকাল যে রাজনৈতিক জুলুম দৃষ্টিগোচর হয় এবং যার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পুরুষ গৃহে এসে স্ত্রী ও সন্তানদের উপর রাগ ঝড়তে শুরু করে –এটা কি ইসলামের সৃষ্টি?
ইসলামকে এই রাজনৈতিক জুলুমের জন্যে বিন্দুমাত্রও দায়ী করা যায় না। কেননা উহা মানুষকে জুলুম ও বে-ইনসাফীর সামনে মাথা নত করতে শিক্ষা দেয না। বরং অবিচলভাবে উহার মোকাবিলা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে। উহা শাসক ও শাসিতের পারস্পরিক সম্পর্ককে এমন ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নির্ধারিত করে যে, একবার ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর(রা) লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: “শোন এবং আনুগত্য কর।” তখন সংগে সংগেই এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে উত্তর দিল: “আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার কথা শুনবো না এবঙ আনুগত্য করবো না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি এর কৈফিয়ত না দেবেন যে, আপনি যে চাদর পরিধান করেছেন তা আপনি কোথায় পেয়েছেন? এই জবাব শুনে হযরত উমর (রা) প্রথমেই রাগে লাল হননি; বরং তিনি লোকটির সৎসাহসের প্রশংসা করলেন এবং সকলের সামনে চাদরের ঘটনাটি খুলে বললেন। তখন ঐ ব্যক্তি পুনরায় দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো: এখন আপনি বলতে থাকুন, আমরা আপনার আনুগত্যের জন্যে হাজির আছি। আজ আমরা এরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠা করার জন্যে চেষ্টা করছি –যাতে করে কোন শাসক যেন জনগনকে তার স্বৈরাচারের লক্ষ্যে পরিণত করতে না পারে এবং জনগণের মধ্যে এমন সৎসাহস বর্তমান থাকে যে, সম্পূর্ণ নির্ভিকভাবেই তারা শাসকদের সামনেই ইচ্ছা অনুযায়ী কথা বলতে পারে এবং নিজ নিজ গৃহে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের সাথে স্নেহ-মমতা, প্রেম-প্রীতি এবং ভালোবাসা প্রদর্শন করে শান্তি ও সমৃদ্ধির সাথে জীবনযাপন করতে পারে।
উন্নত মানবীয় মূল্যবোধ ও ইনসাফ
উন্নত মানবীয় মূল্যবোধের অধপতনের জন্যেও কি ইসলাম দায়ী? কিছুতেই নয়। উন্নত মানবীয় মূল্যবোধের পতনের জন্যে ইসলামকে কিছুতেই দায়ী করা যায় না। কেননা উহা তো মানুষকে সুউচ্চ আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সাথে পরিচিত করিয়ে তাকে উত্তম মানুষ রূপে গড়ে তোলে। উহাইতো মানুষকে সর্বপ্রথম এই শিক্ষা দিয়েছে যে, সম্পদ বা শক্তি ইজ্জত বা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, বরং উহার আসল মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া এবং সৎকাজ। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী***********)
“নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে সম্মানীয় যে তোমাদের মধ্রে সর্বাধিক মুত্তাকী।” –(সূরা আল হুজুরাত: ১৩)
ইসলাম প্রদত্ত এই সুউচ্চ মূল্যবোধ একবার যখন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় তখন নারীকে আর এ জন্যে অবজ্ঞার পাত্রী বলে গণ্য করা হবে না যে, সে দৈহিক দিক থেকে অনেক দুর্বল। বরং ইসলামী সমাজে স্ত্রীর সাথে সদ্ব্যবহার করাকেই মানুষের আভিজাত্য ও মনুষ্যত্বের মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। যেমন হযরত বিশ্বনবী (স) এরশাদ করেন:
(আরবী***********)
“তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই সর্বোত্তম যার ব্যবহার হবে গৃহের লোকজনদের সাথে সবচেয়ে সুন্দর। এবং নিজ গৃহের লোকদের সাথে ব্যবহারের দিক থেকে আমিই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম।”
এই হাদীস দ্বারা শুধু মানুষের সেই গভীর চেতনা ও উপলব্ধির কথাই অবগত হওয়া যায় না, বরং এই সত্যও আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, কোন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে কেবল তখনই দুর্ব্যবহার করতে পারে যখনসেনিজে কোন মনস্তাত্বিক বা মানসিক পীড়ায় আক্রান্ত হবে কিংবা মানবতার স্তর থেকে নীচে নেমে যাবে।
মানুষের বর্তমান অধপতন এবং তাদের জীবনে যে পশুত্বের দাপট গোচরীভূত হয় তার জন্যেও কি ইসলাম দায়ী? –নিশ্চয়ই নয়। কেননা ইসলামতো এটা কখনো বরদাশত করে না যে, মানুষ এত নিম্নস্তরে গিয়ে পশুর মত জীবনযাপন করতে থাকবে। বরং ইসলাম মানুষকে আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে এতদূল উন্নত করে তুলতে চায় যে, সে যেন আর প্রবৃত্তির গোলাম হতে না পারে এবং পশুসুলভ দৃষ্টিভংগি থেকে সে যেন আত্মরক্ষা করে চলতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষ ও নারীর যৌন সম্পর্ক কোন পশুসুলভ সম্পর্ক নয়। বরং এটা তাদের স্বাভাবিক প্রয়োজনের অভিব্যক্তি মাত্র। এ কারণেই উহা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে বৈধতার সনদ প্রদান করে, যাতে করে তারা যৌন ব্যভিচার ও যথেচ্ছ লীলা-খেলায় মত্ত না হয়ে জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে তাদের গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে অগ্রসর হতে পারে। কেনা উহা ভালো রূপেই জানে যে, যৌন স্পৃহা চরিতারথ করার এই বৈধ দরজাও যদি বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে নারী-পুরুষ উভয়ের পদস্খলনই অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্যেই ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্ককে খারাপ মনে করে না, কিন্তু এত সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়িকেও পসন্দ করে না। কেননা উহা চায় যে, মানুষ তার সকল শক্তিসামর্থ জীবনের মহান উদ্দেশ্যসমূহ হাসিল করার জন্যেই ব্যয় করুক; পুরুষরা আল্লাহর পথে তার দ্বীন প্রতিষ্ঠান জন্যে সর্বদা জিহাদে [হক প্রতিষ্ঠার জন্যে বাতিলেল বিরুদ্ধে যে চূড়ান্ত পর্যায়ের সংগ্রাম করা হয় তাকেই বলা হয় জিহাদ। -(অনুবাদক)] ব্যস্ত থাকুক এবং নারীরা গৃহে থেকে সন্তানদের লালন-পালন এবং সাংসারিক কাজ-কর্মের তত্ত্বাবধান করুক। ইসলাম এরূপ পুরুষ এবং নারী উভয়কেই জীবনের সর্বোচ্চ ও পবিত্রতম লক্ষ্য নির্ধারিত করে দিয়েছে এবং তাদেরকে প্রকৃত মানবীয় মর্যাদা নিয়েই বাঁচতে শিখিয়েছে।
নৈতিক মূল্যবোধের বর্তমান বিপর্যয় ও নৈরাজ্যও ইসলাম সৃষ্টি করেছে? –কিছুতেই নয়। পবিত্র কুরআন এবং হযরত বিশ্বনবী (স)-এর সর্বোত্তম আদর্শ মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক পবিত্রতা আনয়ন করে এবং তাদেরকে অন্যদের সাথে যাবতীয় কাজ-কর্মে ঐরূপ আত্মসংযম, সুবিচার এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার শিক্ষা দেয় যেরূপ অন্যদের নিকট থেকে ঐগুলো পাওয়ার প্রত্যাশায় করে।
আমাদের সামাজিক ঐতিহ্য
তাহলে কি আমাদের সামাজিক ঐতিহ্য প্রাচ্যের নারীদের অধপতনের জন্যে দায়ী? অতীতের ঘটনাবলীই কি –যেমন কোন কোন লেখক বলেছে –তাদেরকে অপদার্থ, সংকীর্ণমনা ও মুর্খ বানিয়ে রেখেছে? –না, এমনটিও নয়। কেননা আমাদের ঐতিহ্য না কাউকে জ্ঞান অন্বেষণ করতে বাধা দেয়, না মেহনত করতে বা চাকুরী করতে নিষেধ করে। -না সামাজিক কার্যকলাপে অন্যদের সাথে সম্পর্ক ও সহযোগিতার পথে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তবে ইসলামের একমাত্র শর্ত হলো: সকল কর্মতৎপরতার লক্ষ্য হবে মানবতার কল্যাণ এবং সামাজিক অবক্ষয়ের কোন পথ যেন খুলে দেয়া না হয়।
আমাদের ঐতিহ্য [এখানে সত্যিকার ইসলামী ঐতিহ্যের কথা বলা হয়েছে। বিজাতীয় ঐতিহ্যকে বুঝানো হয়নি। এ দু’টিকে মিশ্রিত করে দেয়া আপত্তিজনক] যে জিনিস পসন্দ করে না তাহলে কতকগুলো ক্ষতিকর ও নির্বুদ্ধিতামূলক চাল-চলন; যেমন বিনা প্রয়োজনে নারীদের ঘর থেকে বের হওয়া, রাস্তায় রাস্তায় গাড়ী হাকানো কিংবা পার্কে পার্কে ঘুড়ে বেড়ানো। এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে, কোন লোকই একথা অস্বীকার করতে পারে না যে, কোন নারীই গৃহের বাইরের এই সকল কর্মকাণ্ডে সময় নষ্ট করে তার সত্যিকার নারীসুলভ যোগ্যতাকে কখনো কাজে লাগাতে পারে। এবং এতে করে সমাজে তার সম্মান ও মূল্যও কখনো বাড়ে না। নারীরা যদি এই পথে চলতে শুরু করে তাহলে –যেমন পাশ্চাত্যের সুসভ্য (!) এবং উন্নতমনা ‘সোসাইটি গার্লস’ –এর অভিজ্ঞতায় দেখা যায় –তারা খুব সহজেই পুরুষদের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হয়ে বসবে। বস্তুত যারা প্রাচীন ঐতিহ্যের বিরোধী তাদের বিরোধিতার মুল কারণ হলো এটাই যে, এতে করে তাদের সেই যৌন যথেচ্ছাচার, ভোগ-বিলাস ও মাতলামির পথ রুদ্ধ হয়ে যায় যাতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
অসংলগ্ন প্রলাপ
মিসরের একজন লেখক –যে ফাঁক পেলেই ইসলামের উপর আঘাত হানতে এক মুহূর্তেও দেরী করে না –তার একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকার মাধ্যমে মুসলমান মহিলাদেরকে বার বার উৎসাহ প্রদান করে বলতো: “পুরনো পঁচা ঐতিহ্যকে ভেংগে দাও, ঘর থেকে বাইরে আস, বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে পুরুষদের সাথে সাথে অফিস ও কারখানায় চাকুরী গ্রহণ করো। এগুলো তোমরা এ জন্যে করবে না যে, এগুলো করার সত্যিই কোন প্রয়োজন আছে। বরং মানব প্রজন্মের ‘মা’ হিসেবে তোমাদের উপর যে নানাবিধ দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে বেঁচে থাকার জন্যেই তোমরা এগুলো করবে। এ ব্যক্তি [এই লেখকের নাম সালামা মূসা। তার সমস্ত লেখা ইসলাম বিদ্বেষে ভরপুর। এ শ্রেণীর আরেকজন খৃস্টান লেখকের নাম জুরজী জায়দান। ইসলামের শত্রুদের মধ্যে এরা উভয়ই শীর্ষস্থানীয়।] নারীদেরকে এরূপ উপদেশও দেয় যে, রাস্তায় চলার সময়ে যে মহিলা নীচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে চলে সে প্রকৃতপক্ষে সাহস ও আত্মবিশ্বাস থেকে বঞ্চিত। এবং এতে করে এও প্রমাণিত হয় যে, সে পুরুষদের ভয়ে সর্বদাই ভীতু। কিন্তু ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে যখন সে উন্নতমনা হয়ে উঠবে তখন তার ভয় আপনা আপনি দুর হয়ে যাবে এবং সাহাসিকতার সাতে পুরুষদের মোকাবিলা করতে শুরু করবে।” কিন্তু একথা বলার সময়ে উক্ত লেখক সেই ইতিহাসের কথা একদম ভুলে গেছে যা অধ্যয়ন করলে সে জানতে পারতো যে, হযরত আয়েশা (রা) –যিনি তদানিস্তন যুগে রাজনীতিতে পুরোপুরিই অংশগ্রহণ করেছেন এবং যুদ্ধেও সৈন্যবাহিনী পরিচালন করেছেন তিনিও পুরুষদের থেকে পর্দা করেছেন। তার একথাও স্মরণ থাকেনি যে, দৃষ্টি অবনত করা শুধু নারীদেরই বৈশিষ্ট্য নয়। কেননা ইতিহাসে এ সাক্ষ্যও বর্তমান যে, হযরত বিশ্বনবী (স) কুমারীদের চেয়েও অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। এতে কি প্রমাণিত হয় যে, তিনি লজ্জাশীল ছিলেণ বলেই তার আত্মবিশ্বাস বলতে কিছু ছিল না? অথবা তাঁর এটা জানাই ছিল না যে, তিনি আল্লাহর রাসূল? না জানি ইসলামের শত্রুরা আরো কতকাল এরূপ অসংলগ্ন ও নির্বুদ্ধিতামূলক কথা বলতে থাকবে?
আজকাল নারীরা অধপতনের শেষ সীমায় পৌঁছে যেভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে তা এক বাস্তব সত্য। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু এর প্রতিকার তো সেটা হতে পারে না। যা প্রতীচ্যের নারীরা অবলম্বন করেছ। কেননা তাদেরকে যে পরিবেশ-পরিস্তিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে তার ধরন ছিল সম্পূর্ণরূপেই স্বতন্ত্র। এবং দুর্দশা দূর করার জন্যে যে পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা হয়েছে তাও সেই পরিস্থিতির স্বাভাবিক ফসল।
প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজন
নারীদের সমস্যা হোক কিংবা পুরুষদের, ইসলাম এবং একমাত্র ইসলামই সেই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। এ জন্যে আমাদের পুরুষ, নারী, বৃদ্ধ, নওজোয়অন সকলের অবশ্য কর্তব্য হলো একতাবদ্ধ হয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজ নিজ জীবনকে ইসলামী বিধান অনুযায়ী গড়ে তোলা। আমরা যখন এ কাজ সম্পন্ন করতে পারবো তখন এই বাস্তব দুনিয়ায় আমরা আমাদের আকীদা ও মতাদর্শকেও বিজয়ী করতে সক্ষম হবো। আমাদের সামগ্রিক জীবনে ভারসাম্য স্থাপন করার জন্যে এই হচ্ছে একমাত্র পথ। এই আদর্শই যাবতীয় বে-ইনসাফী, অত্যাচার-উৎপীড়ন, বলপ্রয়োগ ও স্বৈরাচারের অভিশাপ থেকে সম্পূর্ণরূপেই মুক্ত।