ইসলাম ও চিন্তার স্বাধীনতা
আলোচনার ফাঁকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো: “তুমি দেখছি ভীষণ সংকীর্ণমনা ও একজন মাছিমারা কেরানী!”
-কেন? –আমি প্রশ্ন করলাম।
-তুমি কি আল্লহর অস্তিত্বে বিশ্বাস কর?
-অবশ্যই।
-তার ইবাদাত কর এবং রোযা রাখ?
-নিশ্চয়ই।
-তাহলে তো আমার কথাই ঠিক যে, তুমি একজন সংকীর্ণমনা এবং একজন মাছিমারা কেরানী।”
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম: “তুমি কেমন করে আমাকে বলতে পারলে যে, আমি একজন সংকীর্ণমনা এবং মাছিমারা কেরানী?”
কেননা তুমি যে জিনিসগুলোকে বিশ্বাস কর উহা একেবারেই বাজে ও ভিত্তিহীন, উহার তাৎপর্য বা অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই। -সে স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিল।
“আর তুমি? তুমি কোন জিনিসকে বিশ্বাস কর? তুমি কি জান যে, সমগ্র বিশ্বচরাচর কে সৃষ্টি করেছে এবং কে আমাদের জীবনকে অস্তিত্ব দান করেছে?
-আমি প্রশ্ন করলাম।
-প্রকৃতি।
-কিন্তু প্রকৃতি কি?
-প্রকৃতি হলো এমন এক প্রচ্ছন্ন ও অসীম শক্তি যা আমরা পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বুঝতে পারি না।”
আমি তখন বললাম: “তুমি যা কিছু বললে তার দ্বারা আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, তুমি আমাকে এক অজ্ঞাত শক্তি (আল্লাহর) নির্দেশ মেনে চলার পরিবর্তে অন্য আর একটি একইরূপ অজ্ঞাত শক্তি (প্রকৃতির) অনুগত বানাতে চাও। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, নির্ভুল মাবুদকে বাদ দিয়ে যার নিকট আমি সকল প্রকার দৈহিক ও মানসিক শান্তি লাভ করি –তোমার সেই ছোট মাবুদ তথা প্রকৃতির আনুগত্য কেন করব –যে আমার ডাক শোনার ক্ষমতা রাখে না এবং আমার অভাব পূরণেরও কোন শক্তি রাখে না?”
চিন্তার স্বাধীনতার সর্বাধুনিক ধারণা
চিন্তার স্বাধীনতার উন্নতিকামীর কী ধরনের স্বাধীনতা চান আর একটি মোটামুটি ধারণা উপরোক্ত বক্তব্য থেকে আমরা লাভ করতে পারি। তাদের ধারণায়, চিন্তার স্বাধীনতার মানে হচ্ছে, প্রকৃত মাবুদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। কিন্তু এ হচ্ছে স্পষ্ট নাস্তিকতা। কস্মিনকালেও একে চিন্তার স্বাধীনতা বলা যায় না। এরা ইসলাম নিয়ে নিছক এ জন্যেই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে যে, উহা মানুষকে সেই চিন্তার স্বাধীনতা দেয় না যা তাকে আল্লাহদ্রোহিতা ও নাস্তিক্যবাদের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, আল্লাহদ্রোহিতা ও চিন্তার স্বাধীনতার অর্থ কি একই?
উন্নতিকামিদের প্রকৃত ভুল
উন্নতিকামিদের প্রকৃত ভুল হচ্ছে এই যে, তারা ইউরোপের চিন্তার স্বাধীনতা (Liberation) সম্পর্কে অধ্যয়নের সময়ে এই সত্যটি ভুলে যায় যে, যদি ইউরোপের কিছু নির্দিষ্ট অবস্থা ও ঘটনাবলীর কারণে সেখানে কুফর ও নাস্তিক্যবাদ ছড়িয়ে পড়ে তার দ্বারা এটা কখনো প্রমাণিত হয় না যে, দুনিয়ার অন্যান্য স্থলেও এই একই রূপ অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং একইরূপ নাস্তিক্যবাদ ছড়িয়ে পড়বে।
ইউরোপবাসীদের ধর্ম ত্যাগের কারণ
ইউরোপবাসীদের সামনে পোপ ও পাদ্রীরা খৃস্টান ধর্মের যে চিত্র তুলে ধরেছে, যেরূপ তারা অভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক সত্যকে মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করেছে। বিজ্ঞানীদের উপর অমানুষিক জুলুম ও নির্যাতন চালিয়েছে। মিথ্যা, অলীক কল্পনা ও পঁচা গল্পকে আল্লাহর ধর্ম নামে আখ্যায়িত করেছে তারই অনিবার্য ফল এই হয়েছে যে, মুক্ত চিন্তার অধিকারী ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা কুফল ও নাস্তিক্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কেননা তাদের সামনে যে দু’টি বিপরীতমুখী চিন্তাধারা বর্তমান ছিল তার মধ্যে যে কোন একটিকে গ্রহণ করা ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। এ কারণেই তারা আল্লাহর উপর স্বাভাবিক ঈমান আনার পথ পরিহার করে বিজ্ঞানও উহার প্রদত্ত দর্শনকেই সত্য বলা গ্রহণ করেছে। পাদ্রীরা গোটা ইউরোপকে যে আবর্তে নিক্ষেপ করেছিল তা থেকে আংশিক নাজাত লাভের জন্যেও তাদের ভিতরকাল জ্ঞানীদের বিবেচনায় কেবল এই একটি মাত্র পথই উন্মুক্ত ছিল। এক ক থায় বলা চলে যে, তারা প্রকাশ্যে ও খোলাখুলিভাবে চার্চের যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে ঘোষণা করতে বাধ্য হল, “আমা এমন খোদাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম যার নামে তোমরা আমাদেরকে গোলাম বানাতে চাও। আমাদের উপর আমাদের সাধ্যাতীত বোঝার পাহাড় চাপাও এবং জুলুম ও স্বৈরাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে চাও। তোমাদের খোদার উপর ঈমান রাখার অর্থ হলো আমরা সবাই বনবাসে যাই! এই জগত থেকে মুখ ফিরিয়ে বিজনা অরণ্যে হারিয়ে যাই। এমন খোদা এবং এমন আল্লাহর আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। এখন থেকে আমরা আমাদের এমন একজন নতুন খোদাকে স্থির করব যার মধ্যে তোমাদের খোদার গুণাবলী বর্তমান থাকবেই তদুপরি তার সামনে আমাদের গোলাম করে রাখার কোন পাদ্রী পুরোহিত বর্তমান থাকবে না এবং তারা আমাদের উপর তোমাদের খোদার ন্যায় নৈতিক আধ্যাত্মিক ও দৈহিক শর্তাদিও আরোপ করবে না।”
ইসলাম –একটি সরল ও সত্যিকার দ্বীন
সুতরাং ইহা সুস্পষ্ট যে, ইউরোপে ধর্মের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা ছিল সেখানকার চার্চ ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কুকীর্তির স্বাভাবিক প্রতিফল। কিন্তু ইসলাম এ ধরনের কোন ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই এবং উহাতে খৃস্টান ধর্মের ন্যায় এমন কোন অলীক কাহিনীও খুঁজে পাওয়া যায় না যাতে করে মানুষ ধর্ম থেকে দূরে সরে যায় এবং ধর্মদ্রোহিতা ও নাস্তিক্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইসলামে কোন চার্চ নেই। আছেন শুধু এক লা-শরীক আল্লাহ যিনি বিশ্বজাহানের একমাত্র স্রষ্টা, মৃত্যুর পর সকল মানুষকে একমাত্র তার দরবারেই উপস্থিত করা হবে। এটা এমন একটি পরিষ্কার বিশ্বাস যে, কোন প্রকৃতি পূজারী কিংবা নাস্তিকও যদি একে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চায় তবুও সহজভাবে একে উড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে না।
ধর্মীয় ইজারাদারির পরিসমাপ্তি
ইসলামে পোপ-পাদ্রীদের ন্যায় কোন শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই। কোন বিশেষ শ্রেণী বা ব্যক্তির দ্বীন নিয়ে কোন ইজারাদারী বা এজেন্সীগিরিরও কোন অবকাশ নেই। বরং এর সবকিছুই মানুষের যৌথ উত্তরাধিকার। প্রতিটি ব্যক্তিই নিজের স্বাভাবিক, আধ্যাত্মিক ও মেধাগত যোগ্যতা অনুযায়ী এর মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার সমান হকদার। ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষই পরস্পর সমান। তাদের মধ্যে পার্থক্য করার যে দিকটি রয়েছে তাহচ্ছে তাদের চরিত্র ও আমল। ইজ্জত ও মর্যাদার প্রকৃত হকদার কেবল তারাই যারা আল্লাহভীরু ও মুত্তাকী –চাই পেশার দিক থেকে তারা প্রকৌশলী হোক, শিক্ষক হোক, সাধারণ শ্রমিক হোক বা করিগর। কিন্তু ধর্ম এরূপ বিভিন্ন পেশার মধ্যে কোন একটি পেশাও নয়। এবং পেশাদার ধর্মীয় লোকদের কোন শ্রেণীও ইসলামে নেই। এ কারণেই ইসলামে ইবাদাত করার জন্যে কোন পাদ্রীর প্রয়েঅজন হয় না। অবশ্য ইসলামী সমাজে সামাজিক আইন-কানুন ও নিয়মনীতির বিশেষজ্ঞ-পণ্ডিতদের প্রয়োজন অপরিহার্য। কিন্তু ইসলামী ফিক্হা আইন বিশেষজ্ঞদের জন্যে ইসলামী সমাজে ততদূর মর্যাদাই প্রদান করা হয় যতদূর মর্যাদা অন্যান্য আইন বিশেষজ্ঞরা তাদের দেশে লাভ করে থাকে। অণ্যান্যদের বিপক্ষে তারা কোন বিশেষ মর্যাদা লাভ করে না। এবং কোন বিশেষ ধরনের সুবিধা সুযোগও ভোগ করে না। আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তারা শুধু প্রয়োজনের মুহূর্তে আইনের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে থাকে। এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো মিসরের ‘জামেয়ায়ে আজহার’ নামক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইউরোপীয় চার্চের ন্যায় ইহা কখনো এই অধিকার ভোগ করে না যে, বিরুদ্ধবাদীদেরকে জ্যান্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারবে কিংবা অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়ে তাদেরকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। উহার দায়িত্ব শুধু এতটুকু যে, মানুষের দ্বীন সংক্রান্ত জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণার সঠিক বিশ্লেষণ করবে এবং তাদের মধ্যে যে দুর্বলতা দেখা যাবে তা দলীল সহকারে পরিস্ফুট করে তুলবে। কিন্তু অন্যদিকে জনসাধারণেরও এই অধিকার আছে যে, তারা জামেয়ায়ে আজহারের ধর্মীয় ভূমিকা ও চিন্তা-ভাবনার সমীক্ষা করে যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে উহার ত্রুটি-বিচ্যূতির প্রতি অংগুলি নির্দেশ করবে। কেননা ইসলাম নিয়ে কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীর কোনরূপ ইজারাদারির অধিকার নেই। বরং দ্বীনী বিষয়ে কেবল সেই সকল ব্যক্তিদেরই কিছু বলার অথরিটি রয়েছে যারা দ্বীন সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের অধিকারী এবং সাথে সাথে এই দিক থেকেও উপযুক্ত যে, ব্যক্তিগত ভালো-মন্দের প্রতি না তাকিয়ে জীবনের বাস্তব সমস্যার সমাধানে দ্বীনী হুকুম-আহকামের সুষ্ঠু প্রয়াগ করতে সক্ষম।
ইসলামী জীবনব্যব্থার সঠিক ধারণা
ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, উলামায়ে কেরাম অর্থাৎ ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হবেন এবং তারাই উহার বড় বড় পদে বহাল হবেন। ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হবে তাহলো এই যে, সরকারী ব্যবস্থাপনার মূলভিত্তি থাকবে শরীয়াত তথা আল্লাহর আইন-কানুন। এছাড়া অন্য কোথাও কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয় না। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার পূর্বের মতই তাদের দায়িত্ব পালন করতে থাকে; অর্থনীতি বিশারদরাও তাদের কর্মসূচী অনুযায়ী নিজস্ব পরিমণ্ডলে কর্মরত থাকে। হ্যাঁ, এতটুকু পার্থক্য তো অবশ্যই হয় যে, তাদের কর্মকাণ্ডের মূল রূপরেখা ইসলামী অর্থনীতির আলোকে নির্ধারিত হবে এবং উহারই সাহায্যে ইসলামী অর্থনীতির সামগ্রিক কাঠামো রচনা করা হবে।
ইসলামী বিশ্বাস ও বিজ্ঞান
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়: ইসলামী বিশ্বাস ও ইসলামী সরকার এবং বিজ্ঞান ও উহার আবিষ্কৃত সত্যের মধ্য সমন্বয় বিধানে আজ পর্যন্ত কোন বাধার সৃষ্টি হয়নি। ইসলামী ইতিহাসে কখনো কোন বিজ্ঞানীকে তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা কোন তথ্য উদঘাটনের অপরাধে জীবিত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হয়নি। এ কারণেই ইসলাম মানুষকে আসমান-জমিনের অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ করার জন্যে বারবার আহবান জানায়, যাতে করে তারা নিজেদের এবং সমস্ত বিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্ক গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে নিজ প্রভু আল্লাহকে পেতে পারে। বস্তুত এরূপ চিন্তা-ভাবনার ফলেই পাশ্চাত্যের বহু বৈজ্ঞানিক এখন আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করা শুরু করেছে। যারা প্রথম দিকে আল্লাহর অস্তিত্ববে আদৌ স্বীকার করেনি।
নাস্তিক্যবাদের অন্ধ প্রচারক
পূর্বেই বলা হয়েছে: ইসলামে ইউরোপীয় চার্চের মত এমন কোন ব্যবস্থাপনা নেই যা তার অনুসারীদেরকে আল্লাহদ্রোহী বা নাস্তিক হতে বাধ্য করে। কিন্তু এ সত্ত্বেও যখন মুসলিম দেশগুলোতে আমরা কিছু লোককে আল্লাহদ্রোহিতা বা নাস্তিক্যবাদের প্রতি আহ্বান জানাতে দেখি তখন আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এরা আসলে কী চায়? বাস্তব ঘটনা এই যে, এরা তাদরে সাবেক সাম্রাজ্যবাদী বা উপনিবেশবাদী প্রভুদের অন্ধ অনুসারী এবং প্রভুদেরকে খুশী করার জন্যেই এরা চায়, দ্বীন ও দ্বীনী ইবাদাত ও হুকুম-আহকামের উল্টা-পাল্টা সমালোচনাকরে মুসলমানদেরকে “মুরদাত (তথা ধর্মত্যাগী)” বানাবার জন্যে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হোক। আর এই ধ্বংসাত্মক কাজটির তারা একটি সুন্দর নাম দিয়েছে “চিন্তার স্বাধীনতা।” ইউরোপবাসীরা এ জন্যে তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে –যাতে করে তারা চার্চের ধর্মীয শোষণ, অলীক কাহিনী ও উদ্ভট গল্পের হাত থেকে নিষ্কৃতিলাভ করে সত্যিকার অর্থেই চিন্তার স্বাধীনতা পেতে পারে। এভাবে একদিকে তো তারা সত্যের প্রতি অগ্রসর হয়েছে এবং বাধ্য হয়েই তারা অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু ইসলামে তো চার্চের মত কোন শোষক প্রতিষ্ঠান নেই এবং অলীক কাহিনী বা উদ্ভট কিচ্ছারও কোন অবকাশ নেই। ইসলাম তো নিজে অগ্রসর হয়েই সকল প্রকার স্বাধীনতা প্রদান করে –যা নিয়ে প্রখ্যাত ও আলোকপাপ্ত নেতারা হৈচৈ করে আকাশ-বাতাস মুখরিত কর তুলছে। কিন্তু এই হৈচৈ করার মূল রহস্য কোথায়? এবং ইসলামের উপর তারা এত রুষ্টই বা কেন?
চিন্তার স্বাধীনতার শ্লোগান কেন?
মূল বিষয় হলো এই যে, চিন্তার স্বাধীনতার এই ধ্বজাধারীরা প্রকৃত চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে আদৌ ভাবেন না। তাদের আসল মতলব হচ্ছে এই শ্লোগানের আড়ালে গোটা সমাজকে নৈতিক উচ্ছৃংখলতা ও যৌন ব্যভিচারের গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত করা; তাদের কুৎসিত উদ্দেশ্যকে ঢেকে রাখার জন্যেই তারা এই পর্দাটি ব্যবহার করছে। ধর্ম ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে তারা যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে তাতে চিন্তার স্বাধীনতার এই শ্লোগানটির লক্ষ্য মানুষকে ধোঁকা দেয়া ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তাদের ইসলাম বিরোধিতার কারণ এই যে, ইসলাম মানুষের চিন্তাকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমিত করে দেয়, বরং তাদের এই ধর্মদ্রোহিতার মূল কারণ হচ্ছে এই য, একমাত্র ইসলামই গোটা মানবজাতিকে মানবেতর চিন্তা-ভাবনা ও নিকৃষ্টতম ধ্যান-ধারণার গোলামী থেকে মুক্তি দেয়; অথচ ব্যভিচার বিলাসী উচ্ছৃংখল ধাপ্পাবাজদের নিকট এটা আদৌ পসন্দনীয় নয়।
ইসলামের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারের অভিযোগ
চিন্তার স্বাধীনতার এই প্রবক্ততরা এই অভিযোগও উত্থাপন করে যে, ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষেখ একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র হচ্ছে প্রভূত ক্ষমতার মালিক এবং একমাত্র ধর্মের নাম দিয়ে সরকার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। আর মানুষ ধর্মীয় পাগলামীতে মত্ত হয়ে কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই উহার জোরজবরদস্তিমূলক আইন-কানুনের হাতে নিজেদেরকে সোপর্দ করে দেয়। ইসলামী রাষ্ট্রের হাতে এই পুঞ্জিভূত ক্ষমতা থেকেই স্বৈরাচারের জন্ম হয় এবং এমন একটি মজবুত ব্যবস্থা গড়ে উঠে যেখানে জনসাধারণের অবস্থা গোলামের চেয়ে অধিক কিছুই নয় –যেখান এই জনসাধারণ তাদের ভালেঅ-মন্দ বোঝায় এবং তদনুযায়ী কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন অধিকারই লাভ করতে পারে না। অন্য কথায় তাদের স্বাধীনতাকে চিরদিনের জন্যেই ছিনিয়ে নেয়া হয়। এরপর শাসকদের অত্যাচার-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে কিছু বলার কোন সাহসই তারা পায় না। আর যদি কোন দুর্ভাগা তেমন কিছু বলার হিম্মত করেই বসে, তাহলেক তাকে ধর্মের এবং আল্লাহর বিদ্রোহী বলে সাব্যস্ত করে স্তব্ধ করে দেয়া হয়।
অভিযোগের স্বরূপ
এই অমূলক ও মাথা মুণ্ডহীন অভিযোগের সর্বোত্তম জবাব হচ্ছে পবিত্র কুরআন। এক স্থঅনে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী*********)
“তাদের প্রত্যেকটি কাজ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত করা হয়।” –(সূরা আশ শুরা: ৩৮)
তিনি অন্যত্র বলেন:
(আরবী*********)
“আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে ফায়সালা করবে তখন ন্যায় পরায়ণতার সাথে ফায়সালা করবে।” –(সূরা আন নিসা: ৫৮)
ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন:
(আরবী*********)
“আর যদি আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেল বিরুদ্ধাচরণ করি তাহলে তোমরা আমার আনুগত্য করবে না।”
ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা) যখন বলেছিলেন: “যদি তোমরা আমার মধ্যে কোন ত্রুটি দেখতে পাও তাহলে আমাকে সংশোধন করবে।” তখন এক ব্যক্তি বলল:
(আরবী*********)
“আল্লাহর কসম! যদি আমরা তোমার মধ্যে কোন ত্রুটি পেতাম তাহলে আমাদরে তলোয়অর দিয়েই তার সংশোধন করে দিতাম।”
ইসলামের এই মহান শিক্ষা এবং উহার অনুসারীদের এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগের কোন জবাব নেই কি?
ধর্ম ও স্বৈরাচার
অনস্বীকার্য যে, ইতিহাসে ধর্মের নামে বহুবার মানুষ অত্যাচার ও স্বৈরাচারের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছ। এবং আজও বহু দেশে ধর্মের নামে এসব তাণ্ডবলীলা চলছে। কিন্তু উৎপীড়ন ও স্বৈরাচার কি শুধু ধর্মের নামেই চলেছে? হিটলারের স্বৈরাচারী শাসন কি কেবল ধর্মর ভিত্তিতেই চালু ছিল? আজ রাশিয়ায় তো প্রকাশ্যভাবেই স্বীকার করা হচ্ছে যে, স্টালিন একজন জালেম ও নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসক ছিল, তার রাষ্ট্র ছিল একটি পুলিশী রাষ্ট্র (Ploice State)। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, স্ট্যালিনের সরকার কি ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল? সকল স্বৈরাচারী শাসক –মাও সেতুং হোক কিংবা ফ্রাংকো, দক্ষিণ আপ্রিকার ম্যালন হোক অথবা জাতীয়তাবাদী চিয়াং কাই হোক –কি ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করেছিল? প্রকৃত ঘটনা এই যে, বিশ শতকের লোকেরা তথাকথিত ধর্মেরযাঁতাকলে স্বৈরাচার ও ডিক্টেটরশীপের কুৎসিত ও ভয়ংকর রূপ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেনি। এক সময়ে ধর্মের ভয়ানক চেহারাকে ঢেকে রাখার জন্যে যেমন পবিত্রতার পোশাক পরিয়ে দেয়া হতো। আজকাল ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের ন্যাক্কারজনক চিত্রকে আড়াল করার জন্যে বিভিন্ন নামের আকর্ষনীয় লেবেল এঁটে দেয়া হচ্ছে।
অপরাধ কার?
কোন বুদ্ধিমান বা হুঁশিয়ার ব্যক্তিকেই স্বৈরাচারকে সমর্থন করতে পারে না এবং উহাকে সংগত বলেও রায় দিতে পারে না। কিন্তু একথা ঠিক যে, অধিক হতে অধিকতর সুন্দর নীতিকেও নিষ্ক্রিয় করে উহাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে দেখা যায়: অপরাধ কোন নীতির নয়, বরং এ অপরাধ সেই স্বার্থপর লাকদের যারা তাদের হীন-স্বার্থকে আড়াল করার জন্যে উক্ত নীতির নাম ব্যবহর করছে। ফরাসী বিপ্লবের সময়ে স্বাধীনতার নামে যে সর্বাধিক জঘন্য ও পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার কোন তুলনা নেই। কিন্তু এটা কখনো সম্ভবপর নয় যে, উক্ত নির্যাতনের দোহাই দিয়ে আমরা সর্বপ্রকার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা শুরু করবো। অনুরূপভাবে ইতিহাসে বহুবার আইন ও নীতির নামে শত সহস্র নিষ্প্রাণ ও নিরপরাধ মানুষকে জেল দেয়া হয়েছে। নানারূপ নির্যাতন করা হয়েছে এবং দুনিয়ার বুক থেকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরেও কি বলা যায় যে, আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতিকে বেকার ও নিষ্প্রয়োজনীয় সাব্যস্ত করে উহাকে খতম করে দেয়াই সমীচীন? ঠিক এমনি করে কিছু সংখ্যক দেশে যদি ধর্মের নামে অমানবিক নির্যাতন ও স্বৈরাচারী শাসন চালানো হয় তাহলে কি নিছক এ কারণেই ধর্মকে আমাদের জীবন থেকে বাদ দিতে হবে? তবে হ্যাঁ, কোন ধর্মই যদি অত্যাচার-উৎপীড়ন ও বে-ইনসাফীর ভিত্তিতে গড়ে উঠে তাহলে সে ধর্মকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে। কিন্তু ইসলামের ন্যায় যে ধর্ম ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম, যাবতীয জুলুম ও অত্যাচার নির্মল কররতে বদ্ধপরিকর, তার বিরোধিতগা করার কি কারণ থাকতে পারে? ইসলাম শুধু মুসলমানদের মধ্যেই ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। বরং মুসলমান এবং তাদের নিকৃষ্টতম দুশমনদের মধ্যেও সুবিচারের এমন আদর্শ স্থাপন করেছে যার নযীর বিশ্ব ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
জুলম ও স্বৈরাচারের প্রতিকার
জুলুম ও স্বৈরাচার বন্ধ করার সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হলো: মানুষের অন্তরে আল্লাহর বিশ্বাসকে বদ্ধমূল করেদেয়া এবং অন্যের সেই অধিকারের প্রতি মানুষকে শ্রদ্ধাশলী করে তোলা যার হেফাযতের দায়িত্ব ধর্মই তাদেরকে অর্পণ করেছে। এরূপ আল্লাহভীরু সমাজের সদস্যরা তাদের শাসকরা কখনো এমন সুযোগ দিতে পারে না যে, তারা আইনের সীমালংঘন করে অন্যের উপর জুলুম করতে সক্ষম হবে। ইসলাম যেরূপ সুবিচার ভিত্তিক জীবনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং জুলুম স্বৈরাচার নির্মূল করার প্রতি জোর দেয় তার কোন নযীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসলামের বিধান অনুযায়ী জনসাধারণের অবশ্য কর্তব্য হলো: যদি তাদের শাসকরা জুলুম ও উৎপীড়ন করতে শুরু করে তাহলে তাদের সংশোধনের জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। এই প্রসংগে হযরত বিশ্বনবী (স) বলেন:
(আরবী**********)
“তোমাদের কেউ যদি অন্যায় কাজ দেখে তাহলে তার সংশোধন করে দেবে।” –(বুখারী ও মুসলিম)
তিনি আরেক স্থানে বলেন: (আরবী**********)
“আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় জিহাদ হচ্ছে জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা।” –[আবু দাউদ ও তিরমিযী]
ইসলামী জীবনব্যবস্থার এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই লোকেরা যখন বুঝতে পারে যে, ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান গনী (রা) ইসলামের সরল পথ থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছেন তখন তারা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলেন –যদিও তা বিপ্লবের রূপ নিয়ে পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে নিয়ে যায়।
উন্নতিকামীদের সমীপে
পরিশেষে আমরা “উন্নতিকামী” ভাইদের নিকট বলতে চাই: প্রকৃত চিন্তার স্বাধীনতা দ্বীন বর্জন করার মধ্যে নিহিত নয়। বরং জনসাধারণের মনে এমন এক বৈপ্লবিক প্রেরণা সৃষ্টির মধ্যে সমাহিত যা কোন বে-ইনসাফী ও জুলুম বরদাশত করে না। যদি কোন অনিষ্ট তাদের দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে তারা তার সংশোধনের জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এই বৈপ্লবিক প্রেরণাই হবে ইসলামের ভাস্কর বৈশিষ্ট্য।