ইসলাম ও ব্যক্তি মালিকানা
ব্যক্তি মালিকানা কি মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি? কমিউনিস্টরা উত্তর দিয়ে থাকে যে, তা নয়। তারা দাবী করে যে, মানুষের প্রাথমিক যুগ ছিল সমাজতন্ত্রের যুগ সে যুগের মানবসমাজে ব্যক্তি মালিকানা বলতে কিছুই ছিল না। তখন সকল জিনিসেই ছিল সকলের যৌথ মালিকানা্ তাতে সবাই থাকতো সমান অংশীদার। তখন তাদের ভেতরে ছিল ভালোবাসা ও সহযোগিতা। ছিল ভাই ভাই হয়ে মিলে-মিশে থাকার পরিবেশ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ স্বর্ণ যুগ বেশী দিন স্থায়ী হলো না। কেননা কৃষিকাজ ও চাষাবাদ শুরু হওয়ার সাথে সাথে চাষের জমি ও উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে তাদের পারস্পরিক ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। এবং এই বিরোধই ক্রমে ক্রমে তাদের যুদ্ধ-বিগ্রহের পথ প্রশস্ত করে দিল। সমাজতন্ত্রীদের দৃষ্টিতে এর একমাত্র সমাধান হলো সেই আদি সমাজতন্ত্রের দিকে ফিরে যাওয়া-যাতে করে ব্যক্তি মালিকানা ও তার যাবতীয় দ্বন্দ্ব-কলহ চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং সবকিছুতেই সবার যৌথ মালিকানা স্থাপিত হবে। ফলে সবাই উপকৃত হওয়ার সুযোগ লাভ করবে। সমাজতন্ত্রীদের মতে কেবল এভাবেই সারা দুনিয়ায় শান্তি, সমৃদ্ধি, ভালোবাসা ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মনস্তত্ব ও ব্যক্তি মালিকানার প্রেরণা
আবেগ-অনুভূতি, ধ্যান-ধারণা ও আচার-আচরণের কোন্টি স্বভাবজাত এবং কোন্টি অর্জিত –এ ব্যাপারে কোন সীমারেখা আছে কি? মনস্তাত্বিক পণ্ডিতরা এর বিভিন্ন জবাব দিয়েছে। কেননা এ ব্যাপারে তাদের মতানৈক্য অত্যন্ত মারাত্মক। ব্যক্তি মালিকানার ব্যাপারেও তাদের এরূপ মতভেদ বর্তমান। বকতক মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীর মতে ব্যক্তি মালিকানা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি; এতে পরিবেশের কোন প্রভাব নেই। যেমন কোন শিশু তার খেলনাটি হাতছাড়া করতে চায় না। কারণ সে হয়ত ভাবছে, এতে করে তার খেলনার সংখ্যা কমে যাবে। কিংবা সে ভয় করছে যে, অন্য শিশুরা তার অবশিষ্ট খেলনাগুলোও নিয়ে যাবে। বস্তুত যেখানে শিশুর সংখ্যা দশ এবং খেলনা মাত্র একটি, সেখানে তাদের ঝগড়া হবেই। কিন্তু দশটি শিমুর জন্যে দশটি খেলনা থাকলে প্রত্যেক শিশুই একটি করে পাবে এবং তা নিয়ে খুশী থাকবে। ফলে তাদের মধ্যে ঝগড়ার লেশমাত্রও থাকবে না।
অপর্যাপ্ত প্রমাণ
সমাজন্ত্রী ও তাদের সমমনা মনোবিজ্ঞানী ও সমাজে বিজ্ঞানীদের যুক্তির জবাবে আমাদের বক্তব্য নিম্নরূপ:
এ পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানীই এই মর্মে কোন অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপিত করতে সক্ষম হয়নি যে, ব্যক্তি মালিকানার প্রবৃত্তি মানুষের কোন সহজাত প্রবৃত্তি নয়। ব্যক্তি মালিকানার বিরোধীরা বড়জোর এতটুকু বলতে পারে যে, ব্যক্তি মালিকানার মানুষের সহজাত স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হওয়ার অনুকূলে কোন চূড়ান্ত প্রমাণ তাদের কাছে নেই।
শিশু ও খেলনার দৃষ্টান্ত
শিশু ও খেলানার দৃষ্টান্ত দ্বারা সমাজতন্ত্রী পণ্ডিতরা যে দৃষ্টিভংগী বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে তার দ্বারা তাদের কল্পিত সিদ্ধান্ত কখনো উপনীত হওয়া যায় না। দশটি খেলনা থাকতে দশটি শিশুর পারস্পরিক ঝগড়া না হওয়া দ্বারা মানবীয় প্রকৃতিতে ব্যক্তি মালিকানার প্রবৃত্তির অনুপস্থিতি কখনো প্রমাণিত হয় না। বরং এর দ্বারা শুধু এতটুকু অবগত হওয়া যায় যে, সুষ্ঠু পরিবেশে ব্যক্তি মালিকানার স্পৃহা পূর্ণাংক সাম্য স্থাপিত হলেও পূর্ণ হয়ে যায়, দৃষ্টান্ত দ্বারা মানুষের উপরোক্ত প্রবৃত্তির না থাকা প্রমাণিত হয় না। বরং উক্ত প্রবৃত্তির পূর্ণ হওয়ার একটি পদ্ধতি পরিস্ফুট হয়। কেননা এ সত্যও কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, অনেক শিশু এমনও আছে যে, নিজেদের খেলনা থাকা সত্ত্বেও তারা সংগীতের খেলনাগুলো কেড়ে নেয় এবং তাদেরকে নিরুপায় করার পরিবেশ সৃষ্টি না করা পর্যন্ত তারা এ কাজ থেকে বিরত হয় না।
এ কোন্ স্বর্ণ যুগ!
সেই আদিকালের মানব সমাজকে সকল সমাজতন্ত্রীই স্বর্ণ যুগ বলে অভিহিত করে থাকে। অথচ তেমন কোন যুগের পক্ষে কোন অকাট্য প্রমাণ তারা উপস্থাপিত করতে পারেনি। যদি এর অস্তিত্ব ছিল বলে ধরেও নেয়া হয় তবুও আমাদের মেনে নিতে হবে যে, সেই স্বর্ণ যুগে ফসল উৎপাদনের কোন পন্থা-পদ্ধতির অস্তিত্ব ছিল না। এবং ছিল না বলে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহেরও কোন অবকাশ ছিল না। এ যুগে মানুষের আহার্য সংগ্রহের জন্যে কোন প্রকার বেগ পেতে হতো না। তারা যখন ইচ্ছা গাছের ফল ছিড়ে খেতে পারতো, ধারাল অস্ত্র নিয়ে বনে-জংগলে শিকার করে জটর জ্বালা নিবারণ করত। কিন্তু কোন ফল বা গোশত সঞ্চয় করে রাখার কোন প্রয়োজন হতো না। কেননাএকদিকে যেমন উহা নষ্ট হয়ে যেত, তেমনি অন্যদিকে দেরী করে খেলে উহার স্বাদও খারাপ হয়ে যেত। সুতরাং যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি উহা নিঃশেষ করে ফেলত। তাই এই যুগের জীবনযাপনের যখন কোন দ্বন্দ্ব-কলহের প্রশ্নই উঠে না তখন ব্যক্তি মালিকানার স্বাভাবিক অনুপস্থিতি কখনো প্রমাণিত হয় না। কেননা ঐ যুগে দ্বন্দ্ব না থাকার আসল কারণ ছিল এই যে, ঐ সময়ে এমন কোন জিনিসের অস্তিত্বই ছিল না যা মানুষের ঝগড়ার কারণ বলে গণ্য হতে পারে। বস্তুত এ কারণেই কৃষি ও চাষাবাদ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ঝগড়ার সূচনা হয়। কৃষি ও চাষাবাদ সমস্যাই মানুষের ভেতরকার দ্বন্দ্ব-কলহ প্রবণতাকে জাগ্রত করে দেয় এবং এখান থেকেই উহা সক্রিয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
সাধারণ স্ত্রীত্ব দ্বন্দ্ব না হওয়ার কোন প্রমাণ নয়
যদি সমাজন্ত্রীদের এই ধারণাকেও মেনে নেয়া হয় যে, প্রাথমিক যুগে নারী ছিল সকল পুরুষের সাধারণ স্ত্রী, তবুও চূড়ান্তরূপে এ দাবী প্রমানিত হয় না যে, ঐ যুগে নারীদের কারণে পুরুষদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব বা শক্তি পরীক্ষা বলতি কিছুই ছিল না। কেননা “সাধারণ স্ত্রীত্বের (Common Wifedom) নীতি” বহাল থাকলেও একজন নারী অন্যান্য নারীদের চেয়ে সুন্দরী হওয়অর কারণে দ্বন্দ্বের কারণ বলে পরিগণিত হতে পারে। এখানে আমাদের এ-ও দেখতে হবে যে, যদি একই রূপ সমান জিনিস নিয়ে কোন ব্যাপারে হতো তাহলে অবশ্যই কোন দ্বন্দ্ব হতো না। কিন্তু যেখানে জিনিসের মান ও মূল্য সমান নয় এবং মানুষের বিবেচনায় ভালো-মন্দের পার্থক্য বর্তমান সেখানে মতভেদ ও দ্বন্দ্ব অবশ্যই অপরিহার্য।–সমাজন্ত্রীদের স্বপ্ন “ফেরেশতাদের” আদর্শ সমাজও এই দ্বন্দ্বের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে না।
শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রেরণা
সেই প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষের মধ্যে সমপর্যায়ের লোকদের তুলনায় বিশেষ সম্মানের অধিকারী হওয়ার আকাংখা বর্তমান। এ কারণে বাহাদুরী, দৈহিক শক্তি কিংবা অন্য কোন দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার চেষ্টা অব্যাহত গতিতে চলছে। এখনো কিছু আদিম গোত্রের সন্ধান পাওয়া যায় –যাদের জীবনকে সমাজতন্ত্রীরা আদি সাম্যবাদী জীবনের (!) দৃষ্টান্ত বলে মনে করে –যারা কেবল সেই সকল যুবকদের কাছে মেয়েদেরকে বিয়ে দেয় যারা কোন দ্বিধা-সংকোচ না করে নিজেদের পিছে একশত কোড়া খেতে তৈরী হয়ে যায়। প্রশ্ন এই যে, কি কারণে এই যুবকেরা কোন ব্যথা বা যন্ত্রণার পরোয়া না করে দৈহিকভাবে এরূপ জখম হওয়ার জন্যে এগিয়ে আসে? এর পরিষ্কার জবাব হলো এই যে, নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ এবং অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রেরণাই হচ্চে এর একমাত্র কারণ। যদি এ ধারণা সত্য হয় যে, দুনিয়ার সকল জিনিসের মধ্যে পরিপূর্ণ সমতার নীতি বিরাজমান তাহলে কী কারণে একজন লোক অন্য একজন লোককে বলতে বাধ্য হয় “আমি তোমার মত নই। বরং তোমার চেয়ে ঢের ভালো।” মানবীয় প্রবৃত্তির এই দিকটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, যদি ধরে নেয়া হয় যে উপরোক্ত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রেরণার সাথে বর্তমান তা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। মানুষ যখন এই দুনিয়ায় পদার্পণ করেছে তখন থেকেই মানুষের মধ্যে এই প্রেরণা বর্তমান।
ব্যক্তি মালিকানা প্রসংগে
এখন দেখা যাক ইসলামে ব্যক্তি মালিকানার স্বরূপ কি? সমাজতন্ত্রীদের মতে ব্যক্তি মালিকানা ও বেইনসাফী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণে মানুষ জুলুম-নির্যাতন এবং অবিচার থেকে বাঁচতে চায় তাহলে তাদেরকে ব্যক্তি মালিকানা বন্ধ করে দিতে হবে।
দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সত্য
সমাজতন্ত্রীরা তাদের দাবীর সময়ে দু’টি সত্য একেবারেই ভুলে যায়। একটি হলো: মানুষের উন্নতি সকল প্রকার মানুষের সর্ববিধ প্রচেষ্টা ও সাধনার ফল। এবং দ্বিতীয়টি হলো: ‘আদি সাম্যবাদ’ নামক আদর্শ যুগে (!) মানুষের উন্নতি ছিল শূন্যের কোঠায়। অন্য কথায়, মানুষ কেবল তখনই উন্নতি করতে শুরু করে যখন ব্যীক্ত মালিকানার কারণে তাদের দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। সুতরাং এই প্রকার দ্বন্দ্ব মানুষের জন্যে কেবল অকল্যাণই নয়। বরং বৈধ গণ্ডি অতিক্রম না করলে এটাই যে মানুষের একটি মনস্তাত্বিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বে–ইনসাফীর প্রকৃত কারণ
ইসলাম একথা স্বীকার করে না যে, দুনিয়ায় অত্যাচার-উৎপীড়ন এবং জুলুম ও বে-ইনসাফীর মূল কারণ হলো ব্যক্তি মালিকানা। ইউরোপ ও অন্যান্য অমুসলিম দেশে বে-ইনসাফীর যে বিবরণ পাওয়া যায় তার মূল কারণ ছিল এই যে, যে সকল সরকার এবং আইন রচনার যাবতীয় ক্ষমতা সচ্ছল ও ধনী লোকেদের হাতে ন্যস্ত ছিল। ফলে তারা এমন আইনই রচনা করে যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল পুঁজিপতি ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা। তাতে অন্য কোন শ্রেণীর উপর অবিচার বা উৎপীড়ন হয় কিনা সে দিকে কারুর কোন লক্ষ্যই ছিল না।
ইসলামে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই
ইসলামে শাসক শ্রেণীর কোন অস্তিত্ব নেই। ইসলামী ব্যবস্থায় আইন রচনার দায়িত্ব কোন নির্দিষ্ট উঁচু শ্রেণীর হাতে ন্যস্ত নয়; বরং তার সার্বিক ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই নিবদ্ধ যিনি মানুষের সকল শ্রেণীর একমাত্র খালেক এবং সমস্ত মানুষই তার চোখে সমান। কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সমাজই এরূপ বিশেষ মান বা মর্যাদার অধিকারী নয় যে, সেই সুবাদে সে বা তারা অন্যদের উপর বে-ইনসাফী করার জন্যে অগ্রসর হবে। ইসলামী ব্যবস্থায় সমস্ত মুসলমান স্বাধীন ও নিরপেক্ষা নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের শাসক নির্বাচন করবে; কিন্তু কোন বিশেষ শ্রেণী বা দলকে নির্বাচন করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। নির্বাচন অন্তে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কোন মুসলিম শাসক নিজেদের রচিত কোন আইন প্রবর্তনের কোন অধিকার লাভ করে না। সে শুধু আল্লাহর আইনর আনুগত্য করতে থাকে এবং সেই আইনই প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়। আর যতক্ষণ সে আল্লাহর আইনের আনুগত্য করতে থাকে ততক্ষণ মুসলিম জনগণও তার আনুগত্য করতে থাকে। এ পর্যায়ে মুসলিম জাহানের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর বাণী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণেল সময়ে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে বলেছিলেন:
(আরবী**********)
“আমার আনুগত্য কর যতক্ষণ আমি তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর আনুগত্য করি। আর যদি আমি আল্লহর না-ফরমানি করি তাহলে তোমরা আমার আনুগত্য করবে না।”
ইসলাম কোন শাসককে আইন রচনার এরূপ অধিকার দেয় না যে, সে নিজেই আইন বিধিবদ্ধ করবে কিংবা অন্যকে আইন রচনার অধিকার অর্পণ করবে। আইনগত দিক থেকে কোন শাসকই একটি শ্রেণীকে অন্য আর একটি শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের উপর প্রাধান্য দিতে পারবে না; পুঁজিপতিদের প্রভাবে কোন শাসকের এ অধিকারও নেই যে, এমন কিছু আইন রচনা করবেক যাতে করে সচ্ছল শ্রেণীর লোকদের হাতে থাকবে সুবিধার পর সুবিধা, আর অন্যদের হতে থাকবে ক্ষতির পর ক্ষতি।
একথাও এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা যখন ইসলামী সরকারের কোন কথা বলি তখন আমাদের লক্ষ্যে থাকে ইসলামী ইতিহাসের সেই সোনালী যুগ যখন সত্যিকার অর্থেই ইসলামী আইন-কানুন ও শিক্ষা অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালিত হতো। খেলাফতের অবসানের সাথে সাথে যখন পতনের যুগ শুরু হয়- অন্য কথা রাজতন্ত্র শুরু হয় তখনকার কোন কথা আমরা চিন্তা করি না। ইসলাম ঐরূপ রাজতন্ত্রকে (যাকে শাসকরা খেলাফত নামেই চালিয়েছে) কখনো সমর্থন করে না এবং করে না বলেই রাজা-বাদশাদের ভুল ও অন্যায় কার্যকলাপের জন্যে ইসলামকে বিন্দুমাত্রও দায়ী করা যায় না। ইসলামী শাসনের আদর্শ যুগ ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কিন্তু তাই বলে এরূপ ভুল বোঝার কোন অবকাশ নেই যে, ইসলামী ব্যবস্থা একটি কল্পনার ফানুস মাত্র। বাস্তব জীবনে তাকে রূপায়িত করা যায় না। কেননা যে জীবন ব্যবস্থাকে একবার বাস্তব জীবনে সর্বাংগ সুন্দরভাবে সফল করে তোলা হয়েছে (এবং যা যুগের পর যুগ ধরে কল্যাণকর বলে উত্তীর্ণ হয়েছে) তাকে পুনর্বার রূপায়িত করার পথ কোন বাধাই থাকতে পারে না। এটাকে রূপায়িত করার জন্যে সকল মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো অবশ্য কর্তব্য। এটাও অনস্বীকার্য যে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়িত করার জন্যে আজ যে অনুকূল পরিবেশ বর্তমান তা অতীতে কখনো ছিল না।
আইনের সাম্য
ইসলামী জীবন পদ্ধতিতে সচ্ছল শ্রেণীর খুশী অনুযয়ী আইন রচনার কোন এখতিয়ার নেই। ইসলামের মতে অধিকারের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির আদৌ কোন অবকাশ নেই। বরং ইসলামী বিধি অনুযায়ী সকল মানুষের সাথে একই রূপ ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদি ইসলামী আইনের কোন ধারা বা উপধারার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়- যেমন দুনিয়ার সব আইনের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন তাহলে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের গৌরবময় কীর্তি হলো এই যে, তারা কোনদিন সচ্ছল লোকদের প্রতি তাকিয়ে ইসলামী আইনকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেননি যাতে করে তা তাদের স্বার্থসিদ্ধির এবং অন্যান্য শ্রেণীর উপর অত্যাচার-উৎপীড়নের হাতিয়ার বলে পরিগণিত হতে পারে। বরং এর বিপরীত অবস্থা এই দেখা গেছে যে, তারা প্রতনিয়তই লক্ষ্য রেখেছেন যাতে করে শ্রমিক ও মেহনতী শ্রেণীর মৌলিক প্রয়োজন মেটাবার পথে কোন অন্তরায় না থাকে; এমনকি কোন কোন আইন বিশেষজ্ঞতো মুনাফার ব্যাপারে কৃষক-শ্রমিকের অংশ মালিকের সমান বলে সাব্যস্ত করেছেন।
মানুষের প্রকৃতি হীন নয়
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের প্রকৃতি এতদূর হীন নয় যে, ব্যক্তি মালিকানার ফল অনিবার্যরূপেই জুলুম ও বে-ইনসাফীর রূপে প্রকাশিত হবে। মানুষের শিক্ষা ও সভ্যতার সম্পর্ক যতদূর বর্তমান তাতে দেখা যায় ইসলাম এই পর্যায়ে সে সাফল্য অর্জন করেছে তা অভূতপূর্ব ও তুলনাহীন। বস্তুত প্রভূত অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের অবস্থা ছিল:
(আরবী****************)
“তারা সেই লোকদেরকে ভালোবাসে যার হিজরত করে তাদের নিকট আসে এবং তাদেরকে যা কিছু দেয়া হয় তার কোন প্রয়োজনও তারা অন্তরে অনুভব করে না এবং নিজেদের চেয়ে তারা অন্যকে অগ্রগন্য করে –যদিও তারা অনাহারে থাকে।” –(সূরা আল হাশর : ৯)
তারা নিজেদের সম্পদ অন্যদেরকে শরীক করে নিতে আনন্দ লাভ করতো –অথচ এ ক্ষেত্রে দুনিয়ার কোন স্বার্থ লাভ করা তাদের উদ্দেশ্য থাকতো না। বরং এর বিনিময়ে তারা কামনা করতো আল্লাহর ক্ষমা এবং আখেরাতের পুরস্কার।
এই মহান ও পবিত্র আদর্শের কথা –আমারে স্মরণ রাখতে কর্তব্য। গোটা মানবজাতির ইতিহাসে এটা একান্তই বিরল। এর আলোকেই আমাদের ভবিষ্যত হতে পারে মহীয়ান ও সমুজ্জল। আর এ থেকেই আমরা সহজে অনুমান করতে পারি যে, মানবতার মর্যাদা কত সমুন্নত ও দেদীপ্যমান।
একটি শক্তিশালী সমাজ
প্রসংগত আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ইসলামের লক্ষ্য শুধু এতটুকুই নয় যে, মানুষ কেবল কল্পনার জগতেই ব্যস্ত থাকুক। ইসলাম মানুষের সর্বাত্মক কল্যাণ ও প্রগতিকে কেবল ‘সুধারণা ও সদিচ্ছা’র মেহেরবানীর উপরই ছেড়ে দেয় না। ণৈতিক ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি এতদূর গুরুত্বারোপ করা সত্ত্বেও ইসলাম মানবজীবনের বাস্তব সমস্যাগুলোকে কখনো ছোট করে দেখে না। ইসলাম আইনের সাহায্যে এই আদর্শ বাস্তবায়িত করতে চায় যে, গোটা সমাজে যাবতীয় অর্থ ও সম্পদের সুষম ও সুবিচারভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকুক। নৈতিক পবিত্রতায় সমুন্নত করার সাথে উহা ন্যায়ভিত্তিক আইন-কানুনও উপহার দেয় এবং এমনি করে একটি শক্তিমান ও সর্বাঙ্গীন সুন্দর মানবসমাজ গড়ে তোলে। সম্ভবত এই সত্যকে ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা) তার এই বক্তব্যে পরিস্ফূট করে তোলেন:
(আরবী*************)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তির সাহায্যে ঐ সকল জিনিস বন্ধ করে দেন, কুরআনের সাহায্যে যা বন্ধ করা হয় না।”
ইতিহাসের সাক্ষ্য
মোটকথা এরূপ দাবী করা আদৌ যুক্তিসংগত নয় যে, ব্যক্তি মালিকানা দ্বারা বে-ইনসাফী ছাড়া অন্য কিছুই সৃষ্টি হয় না। কেননা ইতিহাসে এমন বহু যুগ পাওয়া যায় যখন ব্যক্তি মালিকানা দ্বারা কোন বে-ইনসাফী সৃষ্টি হয়নি। ইসলাম জমির মালিক হওয়ার সুযোগ দিয়েছে; কিন্তু তা ইউরোপের সামন্তবাদের ন্যায় অভিশপ্ত রূপ গ্রহণ করেনি। ঐরূপ আশংকার পথ রুদ্ধ করার জন্যে ইসলাম এমন অর্থনৈতিক ও সামাজিক আইন রচনা করেছে যে, তার কারণে সামন্তবাদী ব্যবস্থা কখনো জন্মলাভ করতে পারেনি এবং ঐ সকল লোকও এক উন্নতমানের জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়েছে। যাদের মালিকানায় জমি বলতে কিছুই ছিল না। বস্তুত এরূপ নিরাপত্তামূল ব্যবস্থা থাকার কারণেই ইসলামী দুনিয়ার ধনী লোকদের পক্ষে দরিদ্র লোকদের উপর জুলুম করার সুযোগই কোনদিন আসেনি।
ব্যক্তি মালিকানার অধিকার অবাধ নয় –সীমিত
যদি একথা মেনও নেয়া হয় যে, ইসলাম পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের সম্ভাবনা অবশ্যই ছিল তাহলে সাথে সাথে এ সত্যকেও মেনে নিতে হয় যে, ইসলাম পুঁজিবাদের কেবল সেই অংশই চলতে পারতো যতটুকু জনসাধারণের কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হতো। ইসলাম একদিকে মানুষের স্বভাবকে পরিশুদ্ধ করে এবং অন্যদিকে এমন আইন-কানুন রচনা কর যাতে করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, অন্যায়, শোষণ এবং অত্যাচার-উৎপীড়নের কোন অবকাশই থাকে না। যদি ইসলামী ব্যবস্থা কার্যকরী হওয়ার কোন সুযোগ থাকতো তাহলে তার কর্মসূচী বাস্তবায়িত করে পাশ্চাত্য দুনিয়াকে বর্তমান শোচনীয় অবস্থা তেকে বহু পূর্বেই মুক্ত করা যেত। এছাড়া ইসলামকে ব্যক্তি মালিকানার যে অধিকার দেয়া হয়েছে তা একেবারে অবাধ ও নিরংকুশ নয়, বরং কতগুলো শর্তের অধীন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইসলামের বিধান হলো এই যে, জনহিতকর ও জনসেবায় নিয়োজিত সকল উপায়-উপাদানের মালিকানা থাকবে জনগণের। কোন কোন সময় ইসলাম ব্যক্তি মালিকানাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে; কিন্তু যখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটা অত্যাচার-উৎপীড়নের কারণ হবে না, কেবল তখনই তার অনুমতি প্রদান করে।
স্ক্যান্টিনেভিয়ার উদাহরণ
এ ব্যাপারে অধিক আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে অমুসলিম দেশসমূহের ভেতর থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উদাহরণ দেয়া গেল। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টেটটি নরওয়ে ও সুইডেন নামক দু’টি দেশ নিয়ে গঠিত। বহু গোত্র ও জাতীয় বৈষম্যের শক্তিশালী প্রবক্তা ইংরেজ, আমেরিকান ও ফরাসীরা একথা উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করে যে, সদাচার ও সভ্যতার মানদণ্ডে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের কোন তুলনা নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, এ হেন দেশেও ব্যক্তি মালিকানাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তারা শুধু সম্পদের ইনসাফ ভিত্তিক ও সুষম বন্টনের ব্যবস্থা করেছে। এই উদ্দেশ্যকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যে তারা যে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে তার লক্ষ্য হলো শ্রেণী বৈষম্যকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং কাজ ও পারিশ্রমিকের মধ্যে একটি সুষ্ঠু অনুপাত বজায় রাখা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এই বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ইসলামী আইনের কোন কোন দিকের বাস্তবায়নের ফলেই এই এলাকাটি অবশিষ্ট দুনিয়ার চেয়ে অধিক সাফল্যের অধিকারী।
আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহের মৌল ভিত্তি
যে সামাজিক মতাদর্শের উপর একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে তা থেকে এটাকে কখনো পৃথক করা যায় না। বর্তমান যুগের প্রচলিত তিনটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা –অর্থাৎ পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলাম –পর্যালোচনা করে আমরা এই সত্যের সন্ধান পাই যে, এই ব্যবস্থা ও মালিকানা সংক্রান্ত মতাদর্শের সাথে উহার নির্ধারিত সামাজিক পটভূমির এক গভীর সমর্পক বর্তমান।
পুঁজিবাদ
যে চিন্তাধারার উপর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত তাহলো এই যে, ব্যক্তি সত্ত্বা নির্দোষ ও পবিত্র; এই পবিত্রাকে কোন অবস্থাতেই ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। কোনরূপ সামাজিক শর্তও উহার বিরুদ্ধে আরোপ করা যাবে না। এক কথায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অবাধ ব্যক্তি মালিকানার পক্ষপাতী, উহার বিপক্ষে কোন প্রকার শর্তকেই উহা বরদাশত করে না।
সমাজতন্ত্র
এর সম্পূর্ণ বিপরীত সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদী দর্শন হলো এই যে, ‘সমাজ’ই হলো একমাত্র ভিত্তি যার বাইরে পৃথক বা স্বাধীন অবস্থায় কোন ব্যক্তির আদৌ কোন অস্তিত্ব নেই। সমাজতন্ত্র তাই এই সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে মালিকানার সমস্ত অধিকার রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করে এবং ব্যক্তি মালিকানার যাবতীয় অধিকার জনসাধরনের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়।
ইসলাম
এই পর্যায়ে ইসলামের সমাজ দর্শন সম্পূর্ণরূপেই ভিন্ন। আর এ কারণে উহার অর্থব্যবস্থার সাথে উপরোক্ত অর্থব্যবস্থা দু’টোরও কোন মিল নেই। ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্নে ইসলামের বক্তব্য স্পষ্ট। সিলামী বিধি অনুযায়ী একটি ব্যক্তিকে একই সময়ে দ্বিবিধ দায়িত্ব পালন করতে হয়। একটি হলো ব্যক্তিগত এবং অন্যটি হলো সামাজিক। সামাজিক দায়িত্বের দিক থেকে একজন ব্যক্তি সমাজের সদস্য বলে বিবেচিত হয়। ইসলাম চায়, একজন ব্যক্তি এই উভয় প্রকার দায়িত্বের মধ্যে সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধান করে কর্মতৎপর হোক।
ইসলামের বৈশিষ্ট্য
ইসলামের এই সমাজ দর্শন কোন ব্যক্তিকে তার সমাজ থেকে যেমন পৃথক করে দেয় না। তেমনি উহাকে এমন সুযোগও দেয় না যাতে করে ব্যক্তি ও সমাজ দু’টি বিপরীত শক্তি হিসেবে পরস্পর সংঘর্ষশীল হয়ে উঠতে পারে। একই সময়ে একজন ব্যক্তি একদিকে স্বাধীন এবং অন্য দিকে সমাজের আশা-আকাংখা এবং অপর দিকে ব্যক্তি ও সমাজভুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির একটি সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করতে চায়। কিন্তু এই সমন্বয়ের লক্ষ্যে উহা ব্যক্তি স্বার্থকে যেমন উপেক্ষা করে না। তেমনি সামাজিক কল্যাণকেও বিসর্জন দেয় না। উহার আইন সমাজের জন্যে যেমন ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দেয় না, তেমন এক বা একাধিক ব্যক্তির সুবিধার জন্যে গোটা সমাজে অনাচার ও অশান্তি সৃষ্টিরও অনুমতি দেয় না। উহা একদিকে ব্যক্তির হেফাযত করে এবং অন্যদিকে গোটা সমাজকে অশান্তি ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে।
একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভংগি
ইসলামী অর্থব্যবস্থা পারস্পরিক সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধানের এমন একটি ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের দু’টি চরম অবস্থাতর মাঝামাঝি একটি সর্বাঙ্গীন সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভংগি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এতে উভয় ব্যবস্থার কল্যাণকর দিকগুলো তো অবশ্যই বর্তমান কিন্তু উহাদের বিভ্রান্তি ও ক্ষতিকর দিক থেকে সম্পূর্ণরূপেই মুক্ত। ইহা নীতিগতভাবে ব্যক্তি মালিকানার অনুমতি দেয়। কিন্তু বিভিন্ন গণ্ডি দিয়ে উহাকে এমনভাবে সীমিত করে দেয় যে, উহা মানুষের কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছুই করতে পারে না। অন্য দিকে ইসলাম শাসক মণ্ডলী ও সমাজকে মানুষের সমষ্টিগত জীবনের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তি মালিকানার জন্যে আইন রচনার এবং সামাজিক প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তি মালিকানার জন্যে আইন রচনার এবং সামাজিক কল্যাণের প্রেক্ষিতে উহাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার অধিকার দিতেও কুণ্ঠবোধ করে না।
অন্যায় কাজের সংশোধন
ইসলাম ব্যক্তি মালিকানা সমর্থন করে; কেননা উহার মাধ্যমে যে অন্যায় কাজের সম্ভাবনা থাকে তার সংশোধনের যোগ্যতাও উহার আছে। এবং এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপায়-উপকরণৗ ইহা অবলম্বন করে থাকে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নীতিগতভাবে ব্যক্তি মালিকানাকে সমর্থন করার পর সমাজকে উহার সুষ্ঠূ প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয ক্ষমতা প্রদান উহাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করার চেয়ে সহস্র গুণ উত্তম। বিশেষ করে যখন এরূপ কল্পনার উপর ভিত্তি করে উক্ত মালিকানাকে অস্বীকার করা হয় যে, ব্যক্তি মালিকানার প্রেরণা মানবীয প্রকৃতির কোন অপরিহার্য অংগ নয় নবেং মানব জীবনে উহার কোন প্রয়োজনও নেই তখন উহার প্রয়োজনীয়তা কত অধিক তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। স্বয়ং রাশিয়ায় যে সরকার এই ব্যক্তি মালিকানাকে সীমিতভাবে সমর্থন করেছে তাতে করে সুস্পষ্টরূপে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মানবীয় প্রকৃতির দাবী সাথে সমন্বয় বিধান করা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্যেই কল্যাণকর।
তাই প্রশ্ন জাগে, তাহলে ব্যক্তি মালিকানাকে নিষিদ্ধ করা হবে কোন যুক্তিতে? এবং কেনই বা ইসলামের নিকট এরূপ বাদী করা হবে যে, ইসলাম উহাকে হারাম বলে গণ্য করা হোক?
সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার ব্যর্থতা
সমাজতান্ত্রের দাবী হলো: মানবসমাজে সাম্য স্থাপন করার লক্ষ্যে ব্যক্তি মালিকানাকে খতম করা অপরিহার্য। কেননা এরূপেই একজন মানুষকে অন্যান্য মানুষের দাসত্ব ও গোলামীর হাত থেকেমুক্তি দিতে সক্ষম। রাশিয়ায় উৎপাদনের উপায়-উপকরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানাকে খতম করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে সকল উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যে ইহা করা হয়েছিল তা কি অর্জিত হয়েছে? কিন্তু স্ট্যালিনের আমলে রাশিয়া সরকারকে অতিরিক্ত কাজ করানোর জন্যে শ্রমিকদেরকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক লোভ দেখাতে হয়েছিল। আর এরূপে তিনি শ্রমিকদেরকে সমান পারিশ্রমিক দেয়ার নীতিকে কার্যতই অস্বীকার করেছেন।
রাশিয়ায় আজ সকল কর্মচারীকে কি একই পরিমাণ পারিশ্রমিক দেয়া হয়? সেখানকার ডাক্তার ও নার্সদেরকে কি একই রূপ বেতন দেয়া হয়? স্বয়ং বিশিষ্ট সমাজতন্ত্রীরাই বলে থাকে যে, রাশিয়ায় প্রকৌশলী ও শিল্পীদের আয় সবচেয়ে বেশী। এতে করে অবচেতনভাবেই তারা স্বীকার করছে যে, রাশিয়ায় বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পারিশ্রমিকের পার্থক্য এখনো বহুল পরিমাণে বর্তমান। আর এ বৈষম্য কেবল বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং একই শ্রেণরি লোকদের মধ্যেও যথেষ্ট দেখা যায়।
এখনকার চিন্তা
ব্যক্তি মালিকানা নিষিদ্ধ করার পর রাশিয়ার লোকদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের স্পৃহায় কি ভাটা পড়েছে অন্যকে পেছনে ফেলে নিজে অগ্রসর হওয়ার এই বৈষম্য-চিন্তা কি নিঃশেষ হয়ে গেছে? যদি দিয়েই থাকে তাহলে সেখানকার ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নেতৃবৃন্দ, কারখানাগুলো পরিচালকমণ্ডলী, ঊর্ধতন ও বিভাগীয ব্যবস্থাপক গোষ্ঠীকে কীরূপে নির্বাচন করা হয়? এবং স্বয়ং কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় সদস্যদের মধ্যে পার্থক্যই বা কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
ব্যক্তি মালিকানা বৈধ- না অবৈধ এই প্রসংগ বাদ দিয়েও অবশ্যই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে, এটা কি সত্য নয় যে, অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য অর্জনের স্পৃহা মানবীয প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংগ? সমাজতন্ত্র ব্যক্তি মালিকানাকে খতম করেছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও উহা ব্যক্তি মালিকানার অনিবার্য ফসল-বৈশিষ্ট্য অর্জনের এই সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক অনিষ্ট থেকে মানব জাতিকে মুক্ত করতে পারেনি। সমাজতন্ত্রের এই ন্যাক্কার জনক ব্যর্থতার পর আমরা তাদের চলা পথে কোন ক্রমেই চলতে পারি না। তাদের সেই ভ্রান্ত ও পংকিল পথ আমরা অনুসরণ করতে পারি না। যা মানবীয় প্রকৃতির সম্পূর্ণরূপেই বিরোধী এবং যা এমন লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে যা অর্জন করা কস্মিনকালেও সম্ভপর হবে না।
অসার যুক্তি
রাশিয়ায় যে শ্রেণী বৈষম্য সে বর্তমান সে সম্পর্কে কোন কোন সমাজতন্ত্রীর বক্তব্য হলো, এ বৈষম্য পরিমাণে এত অল্প যে, উহার ফলে সচ্ছল শ্রেণীর লোকেরা যেমন আনন্দ-স্ফূর্তিতে মগ্ন হতে পারে না, তেমনি নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা কখনো বঞ্চনারও শিকার হয় না। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, ব্যক্তি মালিকানাকে পুরোপুরি নির্মূল করার পরেও যদি অবস্থা এরূপ থেকে যায় তাহলে উহার জন্যে এত কষ্ট স্বীকারের কি প্রয়োজন থাকতে পারে? আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর পূর্বে যখন দুনিয়ার কোথাও কমিউনিজমের অস্তিত্ব ছিল না তখন ইসলাম সমগ্র দুনিয়াবাসীর সামনে যে মৌল নীতি পেশ করেছে তার অন্যতম নীতি ছিল, সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক পার্থক্যকে ক্রমে ক্রমে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা যাতে করে কিছু লোক অন্যদেরকে বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আনন্দ ও স্ফূর্তির মধ্যে ডুবে থাকতে না পারে। কিন্তু এই উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে ইসলাম কেবল আইনের ডাণ্ডাই ব্যবহার করেনি; বরং মানুষের অন্তরে আল্লাহর নেকী এবং মানুষকে ভালোবাসার প্রেরণাকে এমনভাবে জাগ্রত করে দিয়েছে যে, এরপর আইনের আনুগত্যের জন্যে বাইরের কোন শক্তি প্রয়োগের আদৌ কোন প্রয়োজন হয়নি।