ইসলাম ও যৌন সমস্যা
পাক সংক্রান্ত চিরন্তন ধারণা
পাশ্চাত্যের মনস্তাত্বিক বিশেষজ্ঞরা ধর্মের বিরুদ্ধে একটি অপবাদ দিয়ে থাকে যে, উহা মানুষের জীবনীশক্তিকে নির্মূল করার শিক্ষা দেয় এবং পরিশেষে তাকে চিরন্তন পাপবোধের এমন গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত করে দেয় যে, যেখানে থেকে সে প্রতিটি কাজকেই পাপের কাজ বলে মনে করতে থাকে। আর তখন তার সামনে প্রায়শ্চিত্তের একটি মাত্র পথই খোলা থাকে –সে পথটি হলো জীবনের সকল আনন্দ ও খুশীকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা। তাদের এ দাবীর সমর্থনে তারা এ-ও বলে থাকে যে, ইউরোপ যতদিন ধর্মের অক্টোপাসে বন্দী হয়ে রয়েছে ততদিন মূঢ়তার গভীর অন্ধকার চতুর্দিক থেকেই তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছিল। কিন্তু যখন তারা ধর্মীয় স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্তিলাভ করে তখন তাদের আশা-আকাংখায় উন্নত চিন্তাধারার অবরুদ্ধ সয়লাব পুনপ্রবাহিত হতে শুরু করে এবং শুষ্কভূমিতে আবার বসন্তের আবির্ভাব ঘটে।
ধর্মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন
মনস্তাত্বিক পণ্ডিতরা বেশীর ভাগ সময়ে প্রশ্ন করে বসে: তোমরা কি আমাদেরকে ধর্মেরদিকে ফিরে যেতে বল? তোমরা কি আমাদের প্রগতির পথে পুনরায় ধর্মীয় বিশ্বাসের পাহাড় রচনা করতে চাও? তোমরা কি কামনা কর যে, আমাদের প্রতিশ্রুতিশীল প্রজন্মকে পদে পদে বাধা দিয়ে নির্জীব পাষাণ করে তুলবো? নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের লোকদের এই হলো মৌলিক প্রশ্ন। কিন্তু যেহেতু এখানে ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, বরং একমাত্র ইসলামই আমাদের আলোচ্য বিষয়। সেহেতু আমরা তাদের ধারণা সঠিক, না ভুল সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। বরং যৌন সমস্যা সম্প্ক ইসলামের দৃষ্টিভংগি কি সে সম্বন্ধে আলোচনা করার পূর্বে দেখব, যৌন স্পৃহার দমন (Sexual Repression) বলতেই বা কি বুঝায়? কেনা দেখা যায়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই এর ভুল অর্থ করে এবং বিভিন্ন অবস্থায় একে খাপ খাইয়ে নেয়ার ব্যাপারেও ভুল পথ অনুসরণ করে।
যৌন স্পৃহা দমনের সঠিক মর্ম
যৌন স্পৃহা দমন (Sexual Repression) যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকার নাম নয়। বরং যৌন ক্রিয়াকে জঘন্য ও চরম ঘৃণার্হ কাজ বলে মনে করাই হচ্ছে এর সঠিক অর্থ। -এতদূর জঘন্য ও ঘৃণার্হ বলে মনে করা যে, কোন সভ্য বা ভদ্র ব্যক্তিই এর কল্পনা করাকেও পাপ বলে বিশ্বাস করে। এই অর্থে যৌন স্পৃহা দমন মানুষের অজ্ঞাতসারে এক প্রকার উপলব্ধি হিসেবে বিরাজ করতে থাকে; যৌন ক্রিয়ার বারবার পুনরাবৃত্তিও উহাকে নির্মূল করতে পারে না। যে ব্যক্তি যৌন স্পৃহা দমনের শিকার হয় সে প্রকৃতির হাতে বন্দী হয়ে যৌন ক্রিয়ায় তো অবশ্যই লিপ্ত হয়। তবে উহাকে অপবিত্র ও লজ্জাকর মনে করেই লিপ্ত হয়। এমন ব্যক্তি যদি প্রতিদিন বিশ বারও এই ক্রিয়ায় লিপ্ত তবুও সে যৌন রোগী বলে সাব্যস্ত হবে। এবং যখনই সে এই ক্রিয়ায় লিপ্ত হবে তখন তার মনে এই দ্বন্দ্ব উপস্থিত হবে যে, তার করণীয় কি ছিল এবং সে কী করে ফেলেছে। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সংঘটিত এই মানসিক দ্বন্দ্বের ফলে বিভিন্ন মনস্তাত্বিক বিভ্রাট ও ব্যাধি সৃষ্টি হতে থাকে।
ফ্রয়েডের সাক্ষ্য
কেউ যেন এরূপ ধারণা না করে যে, যৌন স্পৃহা দমন কিংবা উহাকে বর্জন করার এই সংজ্ঞা গ্রন্থকার নিজেই মনগড়াভাবে উপস্তাপিত করেছেন।এরূপ ধারণা সঠিক নয়। কেননা যৌন স্পৃহা দমনের এই সংজ্ঞা ও অর্থ ফ্রযেডের নিকট থেকেই গ্রহণ করেছি –যে সারা জীবন ধর্মকে এই বলে বিদ্রূপ করেছে যে, উহা মানুষের কর্মশক্তিকে নির্মূল করে দেয় এবং যাবতীয় কাজ ও কর্ম-চাঞ্চল্য থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। সে তার Three contributions to sexual Theory’ নামক গ্রন্থের ৮২ পৃষ্ঠায় বলেছে: “যৌন স্পৃহা দমন ও যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকার মধ্যে –যাকে এ কাজের অস্থায়ী বিরতি বলা চলে –পার্থক্য করা প্রয়োজন।”
ইসলামের দৃষ্টিভংগি
যৌন স্পৃহার দমন যৌন ক্রিয়াকে অত্যন্ত ঘৃণার্হ মনে করার অনিবার্য ফল; এর সাথে যৌন ক্রিয়ার অস্থায়ী বিরতির কোন দূরতম সম্পর্কও বর্তমান নেই। -একথা শোনার পর এখন আসুন, এ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি কি তাও আমরা যাচাই করে দেখি।
ইসলাম মানুষের প্রকৃতিকে সমর্থন করে
একমাত্র ইসলাম ছাড়া দুনিয়ার এমন কোন ধর্মকেই যা মানুষের প্রাকৃতিক প্রেরণা ও সহজাত প্রবৃত্তিকে পবিত্র বলে সাব্যস্ত করে এবং উহার যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা করতে অগ্রসর হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:
(আরবী***********)
“মানুষের জন্যে চিত্তাকর্ষক নারী, সন্তান-সন্ততি, সোনা-রূপার স্তুপ, চিহ্নিত অশ্ব, চতুষ্পদ জন্তু এবং চাষযোগ্য ভূীমকে অত্যন্ত আনন্দদায়ক বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।” –(সূরা আলে ইমরান: ১৪)
আল্লাহর এই বাণী মানুষের মনের আনন্দদায়ক সবকিছুকে উল্লেখ করে উহার বাস্তবতাকে সম্পূর্ণরূপেই সমর্থন করছে। এই আয়অতে না উহার কোনটির বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা হয়েছে, না মানুষের প্রবৃত্তি ও প্রেরণাকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে।
প্রবৃত্তির দাসত্বের প্রতি ভর্ৎসনা
একথা ঠিক যে, ইসলাম প্রবৃত্তির দাসত্বকে কখনো পসন্দ করে না এবং মানুষ এ ব্যাপারে অত্যধিক ঝুঁকে পড়ুক –এটাও ইসলামেরকাম্য নয়। কেননা এরূপ হলে জীবনের সমস্ত নিয়ম-কানুনই ব্যর্থ হতে বাধ্য। মানুষের লক্ষ্য হলো সার্বক্ষণিক প্রগতি ও কল্যাণ। কিন্তু মানবতার উপর কুপ্রবৃত্তি ও জৈবিক লালসার শাসন যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন এই কল্যাণের আশা করা নিছক বাতুলতা মাত্র। কেননা এটা মানবীয় শক্তিসমূহের উৎসকেই ধ্বংস করে দেয় এবং মানুষকে পশুত্বের সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে দেয়।
প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ ও যৌন স্পৃহা দমনের মধ্যে পার্থক্য
ইসলাম কখনো চায় না যে, মানুষ অধপতনের শেষ সীমায় পৌঁছুক এবং পাশবিকতার শিকারে পরিণত হোক। কিন্তু এই মহান উদ্দেশ্য ও যৌন স্পৃহা দমন তথা জৈবিক প্রেরণাকে নির্মূল করার মধ্যে আসমান-জমিনের পার্থক্য বর্তমান। যৌন স্পৃহা দমনের নামে যৌন স্পৃহা এবং উহার সংশ্লিষ্ট প্রবৃত্তির লালসা ও জৈবিক প্রেরণাকে ঘৃণিত ও অপবিত্র মনে করে চিরপ্রচলিত পবিত্রতা ও আত্মিক উন্নতির মূলে যে কুঠারাঘাত করা হচ্ছে তা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না।
সামাজিক কল্যাণ ও প্রবৃত্তি
মানুষের আত্মিক পবিত্রতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইসলাম নীতিগতভাবেই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে সমর্থন করে। অজ্ঞাতসারে উহাকে নির্মূল করার শিক্ষা ইসলাম কখনো দেয় না বরং বাস্তব জীবনে উহার কার্যকারিতাকে পুরোপুরিই সমর্থন করে যাতে করে এক যুক্তিসম্মত গণ্ডির মধ্যে মানুষ আনন্দ ভোগ করতে পারে অথচ অন্য কোন ব্যক্তি বা সমাজ তার কারণে দুঃখত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বস্তুত এ সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, যে ব্যক্তি সদাসর্বদা কামরিপু চরিতার্থ করার পেছনে লেগে থাকে তার যাবতীয় দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতা অনেক আগেই নিশেষ হয়ে যায়। জৈবিক লালসার রঙীন বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে সে অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। প্রবৃত্তি লালসা ছাড়া অন্য কিছ সে চিন্তাই করতে পারে না।
যখন কোন সমাজের সকল মানুষের যোগ্যতা ও শক্তি-সামর্থ এই জৈবিক লালসা চরিতার্থ করার পেছনে ব্যয়িত হতে থাকে তখন সেই সমাজটিই ব্যধিগ্রস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। কেননা আল্লাহ প্রদত্ত আইন-কানুনের বিরোধিতা করে এই নির্বোধ ব্যক্তিরা নিজেদের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমস্ত বিভাগ গঠন করার পরিবর্তে কেবলমাত্র একটি তুচ্ছ বিভাগের জন্যেই উহাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে পারিবারিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং সমাজ জীবনে নেমে আসছে দারুণ অস্থিরতা ও বিপর্যয়। অতপর সমাজ জীবনের যে অবস্থা ঘটে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:
(আরবী**********)
“তুমি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ ধারণা করছো অথচ তাদের মন বিভিন্নমুখী।” –(সূরা আল হাশর: ১৪)
এই অবস্থা একটি জাতির ঠিক তখনই উপলব্ধি করা যায় যখন অন্য কোন জাতি তাদেরকে আক্রমণ করে জগতের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হয়। আধুনিক ফ্রান্সের ইতিহাস দ্বারা ইহা অকাট্যরূপে প্রমাণিত হয়।
ইসলাম মানুষকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে না
ইসলাম মানুষের জীবনে যে কিছু সংখ্যক শর্ত আরোপ করেছে তার উদ্দেশ্য হলো: ব্যক্তিগত স্বাধীনতা যেন অন্য কোন ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজের কোন প্রকার ক্ষতিসাধন না করেই জীবনের সকল প্রকার আনন্দ উপভোগ করতে পারে। শুধু এখানেই শেষ নয়, ইসলাম অত্যন্ত স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানুষকে আনন্দ লাভ করার জন্যে আহ্বান জানাতেও দ্বিধা করেনি। কিছু সংখ্যক আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করুন:
(আরবী*********)
“(হে মুহাম্মাদ!) তাদেরকে বলুন, আল্লাহর সেই সৌন্দর্যকে কে হারাম করে দিল যা তিনি তার বান্দাদের জন্যে বের করে দিয়েছেন এবং আল্লাহর দেয়া পবিত্র জিনিসগুলোকেই বা কে নিষিদ্ধ করেছিল?” –(সূরা আল আ’রাফ: ৩২)
(আরবী*********)
“এবং দুনিয়া থেকে তোমার নিজের অংশ ভুলে যেয়ো না।” –(সূরা আল কাসাস: ৭৭)
(আরবী********)
“আমি তোমাদেরকে যে পবিত্র বস্তু দিয়েছি তা আহার কর।” –(সূরা আল আ’রাফ: ১৬০)
(আরবী********)
“আহার কর, পান কর এবং সীমালংঘন করো না।” –(সূরা আল আ’রাফ: ৩১)
যৌন স্পৃহার গুরুত্ব
ইসলাম এতদূর স্পষ্ট ভাষায় যৌন সম্পর্কের গুরুত্বকে স্বীকার করে যে, বিশ্বনবী (স) এরশাদ করেন:
(আরবী********)
“তোমাদের দুনিয়ায় আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় হলো সুগন্ধি ও স্ত্রী জাতি, আর আমার চোখের জন্যে শীতলকারক হচ্ছে নামায।” [তাফসীরে ইবনে কাসীর]
এই হাদীসে স্ত্রী জাতিকে দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধির সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। অধিকন্তু যে নামায আল্লাহর নৈকট্যলাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম তার সাথে সাথেই এই স্ত্রী জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আরেকটি উপলক্ষে হযরত বিশ্বনবী (স) যখন বলেছিলেন: “স্ত্রীর সাথে মিলিত হলেও মানুষকে সওয়াব দেয়া হয়।” তখন মুসলমানগণ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন: “কামরিপু চরিতার্থ করলেও কি মানুষ সওয়াব পায়?” হযরব বিশ্বনবী (স) তখন উত্তরে বলেছিলেন: তোমরা কি এটা দেখ না যে, কেউ যদি অবৈধ পন্থায় এই কামরিপ চরিতার্থ করে তাহলে তার পাপ হয়, তাহইতো যখন সে বৈধ পন্থায় উহা চরিতার্থ করে তখন তার সওয়াব হয়।” [আল মুসলিম]
মোটকথা, ইসলামী বিধান অনুযায়ী ‘যৌন স্পৃহা দমন’ নামে কোন প্রকার দমনই থাকতে পারে না। তারণ্যের উচ্ছলতায় যখন যৌন স্পৃহা পুরোমাত্রায় জাগ্রত হয় তখন উহাকে নিকৃষ্ট বলার কোন কারণ থাকতে পারে না। আ এমন কোন প্রয়োজনও নেই যে, যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করাকে ঘৃণিত কাজ বলে মনে করবে এবং উহাকে দুর্বল বা নির্মূল করার জন্যে সচেষ্ট হবে।
তরুণদের নিকট ইসলামের দাবী
ইসলাম তরুণদের নিকট একটি মাত্র দাবী করে। আর সেটি হলা: নিজ নিজ যৌন স্পৃহাকে গলাটিপে মারার পরিবর্তে উহাকে লাগাম পরিয়ে দিতে হবে, নিজের ইচ্ছা ও মননশক্তির সাহায্যে উহাকে সুনিয়ন্ত্রিত করে কাজে লাগাতে হবে। অন্য কথায়, যেন স্পৃহাকে নির্মূল বা দমন করে রাখার পরিবর্ত উহাকে চরিতার্থ করার যথোপযুক্ত ও যুক্তিসম্মত সুযোগ না হওয়া পর্যন্ত উহাকে স্থগিত করে রাখতে হবে। এই প্রকার সাময়িক বিরতি ফ্রয়েডের মতেও ‘যৌন স্পৃহা দমনের’ সমার্থক নয়। এতে করে যৌন স্পৃহা দমনের ফলশ্রুতি স্বরূপ যে দৈহিক দিক হলো শিরা-উপশিরায় বিভিন্ন অসুবিধার সৃষ্টি হওয়া এবং মানসিক ক্ষতির দিক হলো নানা প্রকার মনস্তাত্বিক বিকার ও ব্যধির সূত্রপাত হওয়া।
প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার মূল লক্ষ্য
ইসলাম প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার যে দাবী করছে তা নিছক কোন প্রশাসনিক ফরমান নয়; বরং তার পেছনে রয়েছে গভীর প্রজ্ঞা ও প্রভূত কল্যাণ। উহার লক্ষ্য জীবনের আনন্দ ও স্ফূর্তি থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা নয়। বরং সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপনের জন্যে মানুষকে উপযুক্তরূপে গড়ে তোলা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, যে জনগোষ্ঠী কুপ্রবৃত্তি ও জৈবিক লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং প্রয়োজনের মুহূর্তেও আমোদ-প্রমোদ ও জৈবিক ভোগ-বিলাস বর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে যায় সে জনগোষ্ঠীর নিকট থেকে নেতৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়। অনুরূপভাবে বিশ্বের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সাফল্য ও নেতৃত্ব কেবল সেই জাতিই লাভ করে যারা যাবতীয় বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করার ক্ষমতা রাখে এবং দরকারবোধে আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দ-উল্লাসকে শুধু ঘন্টা বা দিন নয় বরং বছরের পর বছর ধরে বর্জন করে চলতে পারে। ইসলামে রোযার বিধান এ জন্যে করা হয়েছে।
বিভ্রান্তির শিকার ও ইসলাম
কিছু সংখ্যক “স্বাধীনচেতা” লেখক-লেখিকা রোযা সম্পর্কে এমন ভংগিতে কথা বলে যে, মনে হয় তারা গভীল কোন তত্ত্ব বা রহস্য আবিষ্কার করে ফেলেছে। এরা বলে: “রোযা-কি যে এক ধোঁকা। কিছু অর্থহীন হুকুমের অজুহাতে মানুষকে পানাহার থেকে বঞ্চিত রাকার অর্থ কি? বিশেষ করে যখন সে হুকুমের মধ্যে যুক্তির কোন বালাই নেই এবং উহার অনুসরণ কোন কল্যাণকর উদ্দেশ্যও সাধিত হওয়ার কোন পথ নেই।”
বিভ্রান্তির চরম প্রেমিক এই সকল ব্যক্তির নিকট আমাদের নিবেদন: তারাই বা কেমন লোক যারা কোন মহান উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যে মাত্র কয়েকটি ঘন্টার জন্যেও নিজেদের জৈবিক লালসার মুখে লাগাম পরাতে পারে না। প্রবৃত্তির এই সকল দাসানুদাস কস্মিনকালেও মানবতার কোন কল্যাণ করতে পারে না। যারা নিজেদের আনন্দ-স্ফূর্তিকে ক্ষণিকের জন্যে বর্জন করতে অপারগ তারা কখনো হকের সহযোগিতা ও বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যেও অদম্য সাহস, সহিষ্ণুতার প্রয়োজন তা দেখাতে পারে না। এবং পারে না বলেই ধ্বংস তাদের জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
সমাজতন্ত্রীদের তেলেসমাতি
রাশিয়ার সমাজতন্ত্রীরা যদি নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রাণান্তকর বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার উপযুক্ততা অরজন করতে না পারতো তাহলে স্টেলিন গ্রাডে কখনো একযোগে লড়া করতে সক্ষম হতো না। কিন্তু একথা জানা সত্ত্বেও ইসলামী দুনিয়ায় যে সকল সমাজতন্ত্রী অত্যধিক সোচ্চার তারা রোযা এবং অন্যান্য ইসলামী অনুষ্ঠান নিয়ে উপহাস করে থাকে। যার একমাত্র লক্ষ্য হলো প্রবৃত্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করা। এ কোন আজব কাণ্ড যে, সমাজতনেত্রর ধ্বজাধারীরা তাদের রাষ্ট্রের অর্থাৎ তাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শাসনক্ষমতার জন্যে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করার জন্যে সচেষ্ট; অথচ যখন রাষ্ট্র ও সমস্ত প্রাণীজগতের স্রষ্টা আল্লাহর নামে উক্ত প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করার দাবী করা হয় তখন তারা একেবারে অস্থির ও মতিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং বেশ হৈচৈ শুরু করে দেয়।
অনুগ্রহ ও ক্ষমার দ্বীন
একথাও বলা হয় যে, ধর্ম তার অনুসারীদের মনে চিরন্তন গোনাহগার হয়ে থাকার ধারণাকে বদ্ধমূল করত তাদের জীবনকে নিরানন্দ ও তিক্ততায় ভরে দেয়। আর এই গোনাহর ধারণা একটি শক্তিশালী ভূত হয়ে তাদের মন ও মস্তিষ্কের উপর সওয়ার হয়ে বসে। কোন কোন ধর্মের ক্ষেত্রে কথাটি সঠিকও হতে পারে; কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে কথাটি আদৌ প্রয়োজ্য নয়। কেননা ইসলাম এমন একটি দ্বীন যাতে শাস্তি ও জাহান্নামের চেয়ে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে অনেক বেশী।
পাপের সঠিক ধারণা
ইসলামের মতে পাপ এমন কোন ভূত নয় যা সর্বদা মানুষের স্কন্ধ সওয়ার হয়ে থাকবে। এবং এমন কোন চিরন্তন ছায়া বা অন্ধকারও নয় যার গণ্ডিতে মানুষ সারা জীবন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘুরতে থাকবে এবং বাইরে বেরুবার কোন পথই খুঁজে পাবে না। হযরত আদম (আ)-এর যে ত্রুটিটুকু হয়েছিল তা উন্মুক্ত তরবারির ন্যায় মানুষের মাথার উপর ঝুলন্ত অবস্থায় নেই এবং উহার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্যে আমাদের অতিরিক্ত কোন প্রায়শ্চিত্তেরও প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বলেন:
(আরবী********)
“তখন আদম তাঁর প্রভু পরোয়ারদেগারের নিকট থেকে কিছু কথা শিক্ষা করে তাওবা করে এবং তিনি উহা কবুল করেন।” –(সূরা আল বাকারা: ৩৭)
অর্থাৎ স্বীয় ত্রুটি মার্জনার জন্যে হযরত আদম (আ)-কে কঠিন রসম-রেওয়াজের কোন স্তর অতিক্রম করতে হয়নি; বরং এদিকে তিনি সর্বান্তকরণে তাওবা করলেন এবং ঐদিকে আল্লাহ তা মঞ্জুর করে নিলেন।
আল্লহর অনুগ্রহ ও বনি আদম
আদি পিতা হযরত আদম (আ)-এর ন্যায় তাঁর সন্তান-সন্ততিদের উপরও আল্লাহর অনুগ্রহ চিরন্তনভাবেই বর্তমান। হযরত আদম (আ) যেমন তার ত্রুটির পরেও আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হননি তেমনি তার সন্তান-সন্ততিরাও গোনাহ করে বসলে তাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় না। কেননা আল্লাহ পাক তাদের স্বাভাবিক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং এ কারণে তিনি তাদের উপর ততটুকু বোঝা অর্পণ করেন যতটুকু তারা সহজেই বহন করতে সক্ষম। আল্লাহ এরশাদ করেন:
(আরবী********)
“আল্লাহ কোন প্রাণীর উপর তার ক্ষমতার চেয়ে অধিক দায়িত্বভার অর্পণ করেন না।” –(সূরা আল বাকারা: ২৮৬)
হযরত বিশ্বনবী (স) বলেন: (আরবী********)
“সকল মানুষ (বনি আদম) ভুলকারী। এবং ভুলকারীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা (তাদের পাপের কারণে লজ্জিত হয়ে) তাঁর নিকট তাওবা করে।” –[তিরমিযী]
আল্লাহর অনুগ্রহের ব্যাপকতা
পবিত্র কুরআনে আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহ ও ক্ষমা সম্পর্কে অসংখ্র আয়াত বর্তমান। আমরা এখানে একটি মাত্র উদাহরণ পেশ করছি:
(আরবী********)
“আর তোমরা দৌড়ে চল সেই পথে যে পথ যাচ্ছে তোমাদের প্রভু পরোয়ারদেগারের ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে –যার প্রশস্ততা হচ্ছে জমিন এবং সমস্ত আসমানের ন্যায়; আর যা তৈরী করে রাখা হয়েছে সেই সকল মুত্তাকীদের জন্যে যারা তাদের সম্পদ ব্যয় করে সুখে-দুঃখে সর্ব অবস্থায়, যারা গোস্বা হজম করে এবং মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়। আল্লাহ এই সকল নেক লোকদেরকে ভালোবাসেন। আর যাদের অবস্থা এই যে, কেউ কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন গোনাহ করে নিজেদের উপর জুলূম করলে সঙগে সংগেই তাদের আল্লাহর কথা স্মরণ হয় এবং তাঁর কিনট তাদের অপরাধের জন্যে ক্ষমা চায়; কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে তাদের অপরাধ ক্ষমা করতে পারে এবং তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মকে অব্যাহত রাখে না। -এই সকল লোকের প্রতিদান তাদের রবের নিকট এই যে, তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন এবং এমন উদ্যানে তাদের প্রবেশ করাবেন যার নিম্নদেশ থেকে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে এবং সেখানে তারা অনন্তকাল বসবাস করবে। সৎলোকদের জন্যে কতই না সুন্দর এই পুরস্কার।” –(সূরা আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৬)
এই আয়াত দ্বারা পরিষ্কারভাবে অবগত হওয়া যায় যে, আল্লাহর অনুগ্রহ কত ব্যাপক, তার রহমত কত অপরিসীম। তিনি বান্দার শুধু তাওবাই কবুল করেন না, বরং তিনি গোনাহর সামান্যতম স্পর্শ থেকেও বান্দাকে পাক-পবিত্র করে একান্ত নিজ অনুগ্রহে মুত্তাকী ও নেক্কারদের মনোনীত দলের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
আল্লাহর অনুগ্রহের এক বিস্ময়কর দিক
প্রশ্ন এই য, এমন দয়ালু ও স্নেহশীল আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা সম্পর্কে কারুর অন্তরে বিন্দু-বিসর্গ পরিমাণ সন্দেহ থাকতে পারে কি? আল্লাহ এই সীমাহীন অনুগ্রহে যে বিশ্বাসী তার কোন মানসিক হতাশা বা নৈরাশ্য থাকতে পারে না। এই বিশ্বাসই তাকে বলে দেয়: সে কোন চিরন্তন গোনাহগার নয়। তার প্রভুর অনুগ্রহে যে কোন মুহূর্তেই সে গোনাহমুক্ত হয়ে পবিত্র হতে পারে। (দাগী আসামীর মত মোহরাঙ্কিত পাপী হয়ে তাকে থাকতে হয় না।) যখনই সে গোনাহর জন্যে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তখনই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তার অনুগ্রহের ছায়ায় স্থান দান করেন। এই ক্ষমা ও অনুগ্রহলাভের জন্যে প্রকৃত অনুতাপ ও লজ্জা ছাড়া অন্য কোন শর্ত নেই। এ কথাটি এতদূর স্পষ্ট যে, এর সমর্থনে কোন সাক্ষ্যের প্রয়োজন নেই; তবুও আমরা এই প্রসংগে বিশ্বনবী (স)-এর একটি মূল্যবান হাদীস এখানে উল্লেখ করছি:
(আরবী***********)
“যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি: তোমরা যদি গোনাহ না করতে তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেন এবং তোমাদের স্থলে এমন লোকদেরকে আনতেন যারা গোনাহ করার পর ক্ষমাপ্রার্থী হতো, আর তাদেরকে মা করে দিতেন।” –[মুসলিম]
মনে হয়, মানুষের গোনাহখাতা মাফ করাই যেন আল্লাহ পাকের একান্ত কাম্য। পবিত্র কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়অতও এই প্রসংগে প্রণিধানযোগ্য:
(আরবী**********)
“আল্লাহর এমন কি প্রয়োজন পড়েছে যে, তিনি তোমাদের শাস্তি দেবেন –যদি তোমরা কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে কালযাপন কর এবং ঈমান অনুসারে চল? আল্লাহ বড় মূল্যায়ণকারী এবং সকলের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।” –(সূরা আন নিসা: ১৪৭)
এটা নিশ্চিত যে, আল্লাহ মানুষকে কখনো দুঃখ-কষ্টে পতিত অবস্থায় দেখতে চান না;’ –চান মানুষকে তার সীমাহীন রহমত ও মাগফেরাতের পরশে সৌভাগ্যবান করে তুলতে।