ইসলাম ও সমাজতন্ত্র
“মানব জীবনে যা কিছু সুন্দর ও মহৎ, যে মূল্যবোধ সুষ্ঠু ও কল্যাণকর তারই নাম ইসলাম। এটা এক শাশ্বত জীবন পদ্ধতি; সকল প্রজন্মের ও সকল সমাজের এক আদর্শ পথনির্দেশ। কিন্তু বিনগত চারশ’ বছর ধরে ইসলামী সমাজব্যবস্থা এক ধারাবাহিক অস্থিরতার শিকার হওয়ায় ইসলামের অর্থনৈতিক বিধানসমূহ কার্যত বেকার হয়ে পড়েছে এবং উহার ধারাবাহিক উন্নতির পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং আমরা যদি আধ্যাত্মিক ও মানসিক পবিত্রতার জন্যে ইসলামকে মৌলিক আকীদা হিসেবে গ্রহণ করি এবং অর্থনৈতিক সমস্রাদির সমাধান হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করি তাহলে তাতে দোষ কি? কেননা এতে করে আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান তো অবশ্যই হবে, অথচ আমাদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে ও কাজ-কর্মে কোন পরিবর্তন সূচিত হবে না। মোটকথা এভাবে আমরা একদিকে সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবো, তেমনি বর্তমান যুগের আধুনিকতম অর্থনৈতিক মতাদর্শের সংস্পর্শে এসে অধিকতর উপকৃত হতে সক্ষম হবে।”
এই বক্তব্য কোন ইসলামী চিন্তাবিদের নয়। ইসলামের চরম শত্রুদের বিভ্রান্তিকর এ এক অভিনব নমুনা।
সমাজতন্ত্রীদের কৌশল
উপরোক্ত যুক্তি সমাজতন্ত্রী পণ্ডিতদের এক অভিনব কৌশল। এই অদ্ভূত শয়তানী খেলা তারা দীর্ঘকাল ধরেই খেলে আসছে। প্রথম দিকেও তারা ইসলামের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবেই আক্রমণ চালাত এবং নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করে ইসলামকে হেয় ও নিষ্ক্রিয় বলে গণ্য করার চেষ্টা করতো। কিন্তু যখন তারা দেখল যে, এই বিরোধিতার কারণে মুসলমানদরে ইসলাম প্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন তারা নিজেদের কর্মসূচী পরিবর্তন করে ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করে। এ সময় তারা যে যুক্তির আশ্রয় নেয় তা ছিল “সমাজতন্ত্র কারুর ইসলঅকে হস্তক্ষেপ কর না; কেননা মৌলিকতার দিক থেকে সমাজতন্ত্র সামাজিক সুবিচারের নামান্তর।এবং রাষ্ট্র নাগরকদের যে মৌলিক প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করে সমাজতন্ত্র তো তারই সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। সুতরাং ইসলামকে সমাজতনেত্্রর বিরোধী বলে গণ্য করেতোমরা কি মুসলিম জাহানকে বুঝাতে চাও যে, ইসলাম সামাজিক সুবিচারের বিরোধী? নিশ্চয়ই ইসলাম সামাজিক সুবিচারের বিরোধী নয় এবং উহা এমন কোন মতবাদের বিরোধীতা করতে পারে না যা সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর।”
পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসরণ
সমাজতন্ত্রীদের এই শয়তানী যুক্তি পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের যুক্তি থেকে মোটেই ভিন্নতর নয়। সমাজতন্ত্রীদের ন্যায় সাম্রাজ্যবাদীরাও প্রথম দিকে খোলাখুলিভাবেই ইসলামের কঠোর সমালোচনা করতো। কিন্ত যখন তারা বুঝতে পারলো যে, এতে করে মুসলিমরা ইসলাম সম্পর্কে আরো সতর্ক হয়ে উঠে তখন তারা তাদের ‘টেকনিক’ পরিবরতন করে ফেলে এবং বলতে শুরু করে: পাশ্চাত্য জগত তো শুধু এতটুকুই চায় যে, প্রাচ্যের অধিবাসীরা তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে উঠুক। ইসলাম –যেহেতু সমন্ত সভ্যতার মূল উৎস সেহেতু উক্ত সভ্যতার বিরোধী হতে পারে না। তারা মুসলমানদেরকে আশ্বাস দিল যে, তারা নিজেদের নামায-রোযা এবং সুফীসুলভ আমল-অনুষ্ঠান বর্জন না করেই এই আধুনিক সভ্যতাকে গ্রহণ করতে পারে। অথচ তারা ভারো রূপেই জানত যে, একবার তাদের সভ্যতার শিকার হয়ে যাওয়অর পর মুসলমানদরে মধ্যে এই যোগ্যতাই আর অবশিষ্ট থাকবে না যে, তারা তাদের ইসলামী ভাবধারা ও আচার-অনুষ্ঠানকে জীবন্ত রাখতে সক্ষম হবে; বরং কয়েকটি প্রজন্মের পর পুরোপুরি এবং চিরকালের জন্যেই তাদের সভ্যতার দাসানুদাসে পরিণত হবে। বস্তুত তাদের এ ধারণা ছিল একেবারেই নির্ভুল। কেননা মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের এই আধুনিক সভ্যতা প্রবেশের ফলে এমন এমন ব্যক্তির সৃষ্টি হয়েছে –যারা হয়েছে ইসলাম সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এমনকি কোন যুক্তিসম্মত কারণ বা জ্ঞান ছাড়াই অনেকেই ছড়াচ্ছে ইসলামের প্রতি দারুণ বিদ্বেষ বা অপরিসীম ঘৃণা।
সমাজতন্ত্রীদের আসল লক্ষ্য
ঠিক এরূপ খেলাই সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা মুসরিম দেশগুলোতে অব্যাহত রেখেছে। তারা মুসলমানদের বলছে: “সমাজতন্ত্রকে একটি অর্থব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করার পরেও তোমরা মুসলমানই থাকবে; তোমাদের নামায, রোযা ও সুফীসূলভ আমল-আখলাকের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না। কেননা সমাজতন্ত্র তো নিছক একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এটা মানুষের ধর্মীয় ব্যাপারে কোনরূপ নাক গলায় না। সুতরাং মুসলমানদের পক্ষে সমাজতন্ত্র গ্রহণ না করার কোন কারণই থাকতে পারে না। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, মুসলমানরা একবার যদি সমাজতন্ত্রকে স্বাগত জানায় তাহলে তাদের পক্ষে মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকা কখনো আর সম্ভবপর হবে না; সমাজতন্ত্রীরা কিছুকালের মধ্যেই তাদের মস্তিষ্ক ধোলাই করে তাদের মতাদর্শের অনুসারী করে ফেলবে। ইসলামের সামান্য মাত্র নিদর্শনও তাদের এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের জীবনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেননা বর্তমান যুগ চরম দ্রুতগতির যুগ। এ যুগে বহু দূরপ্রসারী পরিবর্তনও অধিক হতে অধিকতর সংক্ষিপ্ত সময়ে খুব সহজেই আনয়ন করা যায়। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, পরিস্থিতি এরূপ হওয়া সত্ত্বেও অসংখ্য মুসলমান সমাজতন্ত্রীদের আপাত মধুর বাক্যে মুগ্ধ হয়ে তাদের শিকার হয়ে যাচ্ছে। কেননা এতে করে তারা নিরানন্দ ও শুষ্ক ইসলামী দায়িত্ব পালন থেকে বেঁচে যায় এবং পথ চলার জন্যে যে স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন তার হাত থেকেই নিষ্কৃতি পায়। এ ছাড়া গঠনমূলক কাজ-কর্মে যে সীমাহীন পরিম্রম করতে হয় তা তেকেও মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হয়। তারা তো মনে প্রাণে এটাই চায় যে, কোন কাজ-কর্মের ঝামেলা না থাকুক এবং নেমাগ্রস্তদের মত শুধু খাবের পর খাব দেখতে থাকুক; কোন সমস্যা নিয়েই যেন তাদের চিন্তা করতে না হয়; বরং অন্যেরা তাদের সমাধান বের করে দিক আর তারা আরমসে চোখ বুজে তাদের অনুসরণ করতে থাকুক।
ইসলাম সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত
স্বরণীয় যে, যে মতাদর্শ বা ব্যবস্থাপনা মৌল নীতির দিক থেকে ইসলামের সাথে সংঘর্ষশীল নয় ইসলাম তার বিরোধিতা করে না। কিন্তু সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মনে রাখতে হবে যে, উহা মূলনীতি ও উপাদানের দিক থেকে ইসলামের সম্পূর্ণ বিরোধী। এ কারণে বাহ্যিকভাবে কোথাও কোথাও মিল থাকলেও একটি আরেকটির চেয়ে ভিন্নতর এবং পৃথক। তাই মুসলমানগণ ইসলাম প্রদত্ত শ্রেষ্ঠতম জীবনব্যবস্থা বর্জন করে কমিউনিজম, পুঁজিবাদ কিংবা জড়বাদী সমাজতন্ত্রকে কোনক্রমেই গ্রহণ করতে পারে না। কেননা ইসলামের সাতে উহার কোনটিরই কোন সম্পর্ক নেই। বরং বাহ্যিকভাবে কোন কোন বিষয়ে সাদৃশ্য থাকলেও মৌলিকভাবে ইসলাম এবং উহার যে কোন একটির মধ্যে আসমান-জমিন ব্যবধান। আল্লাহ তা’আলা তার পবিত্র গ্রন্থে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন:
(আরবী***********)
“আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত কানুন অনুসারে হুকুম দেয় না তারা পুরোপুরিই কাফের।” –(সূরা আল মায়েদা: ৪৪)
সুতরাং সমাজতন্ত্র গ্রহণ করার পর আমরা মুসলমান থাকতে পারি কি? –কিছুতেই না। কেননা সমাজতন্ত্র শুধু অর্থনৈতিক সংস্কারের কোন কর্মসূচী নয়। যারা একটাকে এরূপ একটি কর্মসূচী হিসেবে উপস্থাপিত করে তারা হয় কোন প্রবঞ্চনার শিকার। নতুবা কোন অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে অন্যকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে সচেষ্ট। প্রকৃত ঘটনা এই যে, সমাজতন্ত্র স্বীয় প্রত্যয় ও আচরণ উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামের বিপরীত। সুতরাং এ দু’টোর তুলনা একেবারেই অপরিহার্য।
প্রত্যয় ও চিন্তাধারার পার্থক্য
প্রত্যয় ও চিন্তাধারার দিক থেকে ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে যে বহুবিধ পার্থক্য বর্তমান তার উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
জড়বাদী ধারণা
প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে, সমাজতন্ত্র একটি জড়বাদী ধারণা মাত্র। উহার দৃষ্টিতে একমাত্র সত্য তাই যা আমরা পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমৈ অবগত হতে পারি। যে সকল সত্য আমাদের ইন্দ্রিয় শক্তির আওতার বাইরে তার সবকিছুই হলো অলীক ও কল্পনা ও ভিত্তিহীন। এবং ভিত্তিহীন বলে সেগুলো সম্পর্কে মানুষের চিন্তা করার বা ইতস্তত করার কোন যুক্তিই নেই। এ পর্যায়ে এঞ্জেলস এর বক্তব্য হলো: “জড় বস্তুইহলো একমাত্র সত্য।” তার অনুসারী জড়বাদীদের মতে: “মানুষের মেধা হচ্ছে এক প্রকার জড় পদার্থের অভিব্যক্তি এবং বাহ্যিক পারিপার্শিকতারই প্রতিফলন মাত্র।” তাদের ধারণায় “মানুষের আত্মা (রূহ)-ও হচ্ছে বস্তুগত পরিবেশের একটি একটি ফসল।” অতএব দেখা যাচ্ছে যে, সমাজতন্ত্র নিছক একট জড়বাদী মতাদর্শ। এতে মানব জীবনের যাবতীয় আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডকে হাস্যকর মনে করা হয় এবং একে যাবতীয় অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সমষ্টি বলে আখ্যায়িত করা হয়।
মানবতার নিকৃষ্টতম চিন্তাধারা
মানবীয় জীবন ও চেষ্টা-সাধনার এই ধারণা অত্যন্ত নিম্ন ও নিকৃষ্টমানের, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ইসলাম এই ধারণার সাথে কখনো একমত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মর্যাদা অনেক বড়। যদিও দেহ তার জড়, চলতে হয় তাকে মাটির উপর। কিন্তু তার আত্মা ও চিন্তাশক্তির বিচরণস্থল অনন্ত অসীম। তার মৌলিক মানবীয় প্রয়োজনসমূহও কেবল অন্ন, বাসস্থান ও যৌন তৃপ্তি সাধন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়।
একটি ভুল ধারণা
কোন কোন পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন যে, আমরা যদি কেবল সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং আল্লাহ ও রাসূল সম্পর্কে আমদের মৌলিক বিশ্বাস ও চিন্তাধারা অব্যাহত রাখি এবং আধ্যত্মিক উন্নতি সাধনের অন্যান্য কাজ বজায় রাখি, তাহলে সমাজতন্ত্রের এই বড়বাদী চিন্তাধারা আমাদের জীবনে কোন প্রবাব বিস্তার করতে পারে কি? কেননা সমাজতন্ত্র তো নিছক একটি অর্থনৈতিক সংস্কারমূলক কর্মসূচী।এ কর্মসূচীর পক্ষে আমাদের জীবনের অন্যান্য দিকের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার কোন সাধ্য নেই। কিন্তু এরূপ ধারণা সম্পূর্ণরূপেই ভুল। এ বিষয়ে কারুর সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, সমাজতন্ত্রের নিজস্ব দৃষ্টিতেই কোন জাতির অর্থব্যবস্থা এবং তাদরে মৌল বিশ্বাস ও জীবনাদর্শ দু’টি পৃথক পৃথক জিনিসের নাম নয়; বরং তাদের উভয়ের মধ্যেই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান। একটিকে আরেকটি থেকে পৃথক করার কোন উপায় নেই। কেননা উভয়েল ভিত্তিই হচ্ছে একই অর্থব্যবস্থা। নির্ভেজাল জড়বাদী মতাদর্শ থেকেই উভয়ের জন্ম। সমাজতন্ত্রী লেখকরা এই সত্যটিকে নানাভাবে উপস্থাপিত করেছে। কার্লমার্সক এবং এঞ্জেলস এর পুস্তকেও এ সত্যটির প্রতি যথেষ্ট আলোকপাত করা হয়েছে।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ধারণা
সমাজতন্ত্রীরা দ্বান্দ্বিক বাস্তবাদ (Dialectucal Materialism)-কে চরম সত্য বলে বিশ্বাস করে। তাদের মতে দুই বিপরীত শক্তির দ্বন্দ্ব বিত্তবান পুঁজিপতি এবং বিত্তহীন শ্রমিকদের শ্রেণীগত দ্বন্দ্বই এমন একটি কারণ যা মানুসের সকল প্রকার অর্থনৈতিক ও বস্তুগত প্রগতির মূল। এ পর্যন্ত মানুষ যে উন্নতি করেছে তা এই শ্রেণীগত দ্বন্দ্বই এমন একটি কারণ যা মানুষের সকল প্রকারঅর্থনৈতিক ও বস্তুগত প্রগতির মূল। এ পর্যন্ত মানুষ যে উন্নতি করেছে তা এই শ্রেণী সংগ্রামের একমাত্র ফল। আজ পর্যন্ত এই উন্নতির সময়ে মানুষকে যে দাসপ্রথা, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে তাও এই দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি এবং এরই মাধ্যমে উহা নিজস্ব মঞ্জিলে অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সমাপ্তি পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হবে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের এই আলোকেই সমাজতন্ত্রীরা তাদের ভূমিকাকে নির্ভূল বলে প্রমাণ করতে চায়। আর এই মতাদর্শর বুনিয়াদের প্রেক্ষিতেই তারা একথা নিশ্চিত বলেধরে নেয় যে, বর্তমান মতাদর্শের সংগ্রামে পরিশেষে একমাত্র সমাজতন্ত্রই জয়লাভ করবে। তারা এও দাবী করে যে, সমাজতন্ত্র এবং এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের চিন্তাধারার মধ্যে এমন একটি (বৈজ্ঞানিক) সম্পর্ক বিরাজমান যাতে আল্লাহ, রাসুল কিংবা ধর্মের আদৌ কোন অবকাশ নেই। কেননা তাদের ধারণায় এই সকল জিনিস নিছক অর্থনৈতিক কারণের ফলশ্রুতি মাত্র। অর্থনৈতিক পটভূমি থেকে পৃথক করলে এগুলোর কোন অস্তিত্ব বা গুরুত্বই অবশিষ্ট তাকে না। এ কারণে মানব জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য নির্ধারণ কিংবা উহার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ তেকে বিচার করলেও দেখা যাবে যে, ঐগুলো একেবারেই বেকার। জীবনে যা সত্যিই মূল্যবান তাহলো অর্থণৈতিক উৎপাদনের উপায়-উপাদান। এগুলোর পরিবর্তনের সাথে সাথেই মানব জীবন প্রভাবিত হয় এবং বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্রের এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ যে কত অসার ও অন্তসারশূন্যতা প্রমাণ করার জন্য এই ইতিহাসই যথেষ্ট যে, আরব দেশে ইসলাম যে সর্বাত্মক, অভূতপূর্ব ও প্রচণ্ড বিপ্লব আয়ন করে তার পূর্বে সেখানে কোন অর্থনৈতিক বিপ্লবের সন্ধান পাওয়া যায় না এবং আরবদের অর্থনৈতিক উপায়-উপাদানেও কোন পরিবর্তন হয়েছিল বলে প্রমাণ করা যায় না। এমনটি হলে বলা যেত যে, তার ফলেই হযরত বিশ্বনবী (স)-এর বিপ্লব এবং ইসলামের সার্বিক সাফল্য সম্ভবপর হয়েছে।
আল্লাহহীন মতাদর্শ
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম ও সমাজতন্ত্র সম্পূর্ণরূপেই পরস্পর বিরোধী। ও দু’টোকে কখনো এক বলে স্বীকার করা যায় না। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লহর অপরিসীম দয়া ও স্নেহ বিশ্ব সৃষ্টির সবকিছুকেই ঘিরে আছে। আল্লাহই তার বান্দাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যে তার মনোনীত নবী-রাসূল প্রেরণ করেন যাতে করে তারা গোটা মানবজাতিকে ইসলামের সরল ও সঠিক পথে –যা অর্থনৈতিক অবস্থা ও পরিবেশের চেয়ে শত সহস্রগুণ উন্নত এক মহান সত্য পরিচালিত করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে মানুষের উন্নতির স্তরসমূহ পরস্পর বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের একমাত্র ফলশ্রুতি। এতে আল্লাহর ইচ্ছা কিংবা অন্য কোন চালিকা শক্তির আদৌ কোন স্থান নেই। স্থান আছে শুধু এমন এক মানবীয় প্রয়োজনের যার মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক জীবনের নানাবিধ সমস্যা। একজন মুসলমান মুসলমান থাকা অবস্থায় এবং একমাত্র ইসলামকেই সত্যিকার জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করার পর সমাজতন্ত্রীদের মতাদর্শকে কেমন করে মেনে নিতে পারে? কেমন করেই বা সে উহার একনিষ্ঠ সেবক হতে পারে?
সমাজতন্ত্রের মানুষ সংক্রান্ত চিন্তাধারা
ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে দ্বিতীয় পার্থক্য হলো এই যে, সমাজতন্ত্র মানুষসম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে মানুষ বস্তুগত ও অর্থনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সামনে একটি অসহায় খেলনা মাত্র। কার্লমার্কসের বক্তব্য হলো:
“মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিভিত্তিক জীবন তাদের অর্থনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষের বুদ্ধি-বিবেক সামাজিক পরিস্থিতি ও কর্মকাণ্ড রচনা করতে পারে না্; বরং সামাজিক কর্মকাণ্ডই মানুষের বুদ্ধি-বিবেককে সৃষ্টি করে।”
মানুষ সম্পর্কে ইসলামের চিন্তাধারা
ইসলামের মানুষ সংক্রান্ত চিন্তাধারা সম্পূর্ণরূপেই ইতিহাচক। এটা সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিপরীত। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ এক স্বাধীন চিন্তাধারা ও ক্ষমতার মালিক এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোন কিছুর সামনেই সে মাথা নত করে না। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
(আরবী***********)
“এবং সমস্ত আসমান ও জমিনে যত জিনিস রয়েছে তার সবই তিনি (আল্লাহ) নিজ পক্ষথেকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন।” –(সূরা আল জাসিয়া: ১৩)
ইসলাম মানুষের নিকট এই সত্যই তুলে ধরে যে, শক্তি ও ক্ষমতার দিক থেকে এই বিশ্ব সৃষ্টিতে মানুষের স্থানই সকলের উপরে এবং অন্যান্য সবকিছুই মানুষের সেবক মাত্র। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমরা মানুষকেই পেশ করতে পারি। মানুষের উন্নতি তথাকথিত ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের’ কোন নিয়ম-নীতিরই অধীনতা স্বীকার করেনি। প্রথম যুগের মুসলমানগণ কখনো এক মুহূর্তের জন্যেও একথা চিন্তা করেনি যে, মানুষের ভাগ্যলিপি বা ইতিহাস রচনায় অর্থনীতির অপরিহার্য গুরুত্ব বর্তমান। দ্বিতীয়ত, কোন অর্থনীতির সামনে তাদের মার্কসের কথিত মতে –অসহায়ের মত মাথাও নত করতে হয়নি। তারা নিজেদের ইচ্ছায় এবং সজ্ঞানেই তাদের অর্থব্যবস্থাকে আল্লাহর বিধান ও হযরত বিশ্বনবী (স)-এর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। সমাজের অন্যান্য দিক ও বিভাগের ক্ষেত্রেও তারা একই পথ অনুসরণ করেছেন। বস্তুত যখন তারা দাসদেরকে মুক্তি দিয়েছেন তখন কোন অর্থনৈতিক বা বস্তুগত মুনাফা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেনি। বরং সেটা ছিল ইসলামী শিক্ষার অনিবার্য সুফল। আর সে কারণেই ইসলামী দুনিয়ায় সামন্তবাদী ব্যবস্থা কখনো গজাতে পারেনি; অথচ সে ঘৃণ্য ব্যবস্থা শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে ইউরোপ এবং অন্যান্য ভূখণ্ডে প্রচলিত ছিল।
সমাজের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ
ইসলাম ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তৃতীয যে কথাটি স্মরণ রাখা প্রয়োজন তাহলো: কোন অর্থব্যবস্থাকেই উহার সামাজিক দর্শন ও চিন্তাধারা থেকে পৃথক পৃথক করা যায় না। এ কারণে সমাজতন্ত্রকে একটি অর্থব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করার পর আমরা সমাজতান্ত্রিক জীবন দর্শন থেকে যে জীবন দর্শন মানুষকে অর্থব্যবস্থার একটি অসহায় খেলনা বলে মনে করে এবং কেবল অর্থনৈতিক কারণই সমস্ত সমাজ বিপ্লবের একমাত্র কার্যকরী শক্তি হিসেবে মেনে নেয় –কোন ক্রমেই আত্মরক্ষা করতে পারি না। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার অনিবার্য ফলশ্রুতি হলো সমাজতান্ত্রিক জীবন দর্শন। এই জীবন দর্শনের দৃষ্টিতে মানুষের জীবনে সবচেয়ে অধিক ও সিদ্ধান্তমূলক গুরুত্ব হচ্ছে একমাত্র সমাজের: সমাজের মানুষ উহার অসহায় খাদেম মাত্র। অন্য কথা সমাজতন্ত্রে সমষ্টিই হচ্ছে সবকিছু, ব্যষ্টি বা শত সহস্র ব্যক্তি মানুষ উহার নিরুপায় সেবকের চেয়ে অধিক কিছু নয়।
ইসলামে ব্যক্তির গুরুত্ব
ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজতন্ত্রের এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে ইসলাম বিরোধী। ইসলামের দৃষ্টিতে আসল গুরুত্ব কেবল ব্যক্তি মানুষের। সমাজের সেই গুরুত্ব নেই এবং কখনো হতেও পারে না। (কেননা মানুষের জন্যেই সমাজ, সমাজের জন্যে মানুষ নয়।) এ কারণেই ইসলাম তার মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সমাজের বিপক্ষে ব্যক্তির উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। ইসলাম মানুষের অন্তরকে এমন সমুজ্জল ও পরিশীলিত করে তুলতে চায় যে, সে স্বেচ্ছায় যাবতীয় সামাজিক দায়িত্বই আঞ্জাম দিতে অগ্রসর হবে। -অন্য কথায় উহা ব্যক্তিকে সমাজের একটি সচেতন সদস্যের সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত দেখতে চায়- যাতে করেসে নিজের স্বাধীন মর্জি অনুযায়ী সামাজিক কর্তব্য পালন করতে এবং নিজের পেশাকে গ্রহণ করে নিতে সক্ষম হয়। কেননা একদিকে যেমন সে কোন নির্দিষ্ট পেশাকে গ্রহণ করতে বাধ্য নয়, তেমনি কোন পেশাকে বর্জন করার দায়িত্বও তার নেই। প্রশাসন যদি কোন সময় আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করে বসে তখন ইসলাম প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই অধিকার প্রদান করে যে, সে প্রশাসনের হুকুমকে অমান্য করতে পারবে। ইসলাম তো এমনিই তার আওতাধীন সকল ব্যক্তিকে সমাজের নৈতিক বিধানসমূহের পৃষ্ঠপোষক হওয়ার দায়িত্ব প্রদান করে এবং যে কোন সামাজিক দুর্নীতিকে বন্ধ করার জন্যে শক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য করে। ইসলামের এই মহগান লক্ষ্য এমন কোন সমাজে অর্জিত হতে পারে না যেখানে ব্যক্তিকে কোন মূল্য দেয়া হয় না এবং কোন স্বৈরাচারী ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারের সামনে যে সরকার যাবতীয় অর্থনৈতিক উপায় ও উৎপাদনকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত করে তাকে নিরুপয় করে রেখে দেয়া হয়।
সামাজিক সম্পর্কসমূহের সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি
এই শেষ কথাটিও আমাদের ভুলে যাওয়অ উচিত নয় যে, সমাজতান্ত্রিক দর্শনে সামাজিক সম্পর্কসমূহের পারস্পরিক বিন্যাস ও শৃংখলাবিধানের মধ্যে সবচেয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে অর্থনৈতিক কারণের উপর। মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ইসলাম উহাকে যেমন অস্বীকার করে না।তেমনি উহাকে হ্রাস করার কথাও বলে না। কোন জাতির জীবনে যে একটি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান থাকে ইসলাম তাকে উপেক্ষা করে না এবং নৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে উহার যে প্রভাব পতিত হয় তাকেও অস্বীকার করে না। কিন্তু উহা এরূপ কষ্ট কল্পনাকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না যে, আমাদের জীবন অর্থব্যবস্থা ছাড়া কিছুই নয়। এবং সমাজতন্ত্রের মত এরূপ বিশ্বাস করতেও সম্মত নয় যে, মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে গেলেই অবশিষ্ট সকল সমস্যারই আপনা আপনিই সমাধান হতে বাধ্য। নিম্ন দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে কোন সন্দেহ নেই।
অর্থণৈতিক সমস্যা মানুষের দুঃখ–কষ্টের কোন সমাধান নয়
একই রূপ অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পন্ন দু’জন যুবকের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হোক। তাদের মধ্যে একজন তো তার অন্ধ প্রবৃত্তির দাসানুদাসে এবং ভোগ-বিলাসের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আর দ্বিতীযজন ভোগ-বিলাসে নিমজ্জিত থাকার পরিবর্তে লেখা-পড়ার মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ এবং আত্মিক চেতনা বৃদ্ধির কাজে মশগুল থাকে। প্রশ্ন এই যে, এই যুবক দু’জন কি একই রূপ ব্যবহার পাওয়ার উপযোগী? উভয়ের অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই কি উভয়ের জীবনকে একই রূপ কল্যাণ, সততা ও সাফল্যের অধিকারী বলে গণ্য করা যাবে কি?
ঠিক এরূপে আরেক ব্যক্তির দৃষ্টান্ত নিন। এ ব্যক্তি বড় কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মানুষ তার কথা শোনে এবং তাকে খুব শ্রদ্ধা করে। এই ব্যক্তিকে কি এমন এক ব্যক্তির সমান বলে গণ্য করা যায় যে সকল দিক থেকেই অথর্ব, যার না আছে কোন ব্যক্তিত্ব, দনা আছে কোন সামাজিক মূল্য। বরং সে একজন উপহাসের পাত্র বলেই সর্বত্র বিবেচিত হয়। নিছক অর্থনৈতিক সমস্যাই কি এই অকেজো ব্যক্তির একমাত্র সমস্যা যে, এটির সমাধান হয়ে গেলেই তার অবশিষ্ট সমস্যাগুলোর আপনাআপনিই সমাধান হয়ে যাবে? এভাবেতার জীবনকি সেরূপ সুন্দর ও সুষ্ঠু হয়ে উঠতে পারবে, যেরূপ হতে পারে প্রথমোক্ত সম্মানীয় ব্যক্তির জীবন?
অনুরূপভাবে একজন রূপবতী ও সম্মানীয়া মহিলা কি একজন কুৎসিত সাধারণ শ্রেণীর মহিলার সমান হতে পারে? দ্বিতীয় মহিলার অর্থনৈতিক সমস্যাদি দূরীভূত হওয়ার পর তার অবশিষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান কি আপনা আপনিই হয়ে যাবে যাতে করে সে প্রথমোক্ত মহিলার সমকক্ষ হয়ে উঠবে?
নৈতিক মূল্যবোধই সর্বাধিক গুরুত্বের অধিকারী
মানুষের মধ্যে এরূপ নৈতিক পার্থক্যের প্রেক্ষিতেই ইসলাম মানুষের অর্থনৈতিক মূল্যবোধের স্থলে নৈতিক মূল্যবোধকেই সবচেয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। কেননা উহার দৃষ্টিতে মানবীয় জীবনের ভিত্তি অর্থনৈতিক মূল্যমানের উপর নয়, বরং অর্থনীতিরসাথে সম্পর্কহীন এমন কিছু মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত যা বাস্তবায়িত করার জন্যে ঠিক ততখানি সাধনা করতে হয় যতখানিকরতে হয় অর্থনৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে। এ জন্যেই ইসলাম আল্লাহ ও মানুষ –অর্থাৎ প্রভু ও গোলামের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কেননা আল্লাহ ও মানুষের এই আধ্যাত্মিক সম্পর্কই মানুষের বাস্তব জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। এটাই মানুষকে বস্তুগত জীবনের সর্বনিম্ন স্তর থেকে- যে স্তরে সে বস্তুগত জীবনের অধীন এবং ধ্বংসাত্মক টানা-হেচড়া, ঘৃণা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ ইত্যাদির নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হয়- তুলে নিয়ে মানবতার এমন এক সুউচ্চ ও মহিমান্বিত স্তরে পৌঁছিয়ে দেয় যেখানে সে শুধু প্রবৃত্তির লালসার হাত থেকে মুক্তিলাভ করতেই সক্ষম হয় না। বরং সে এমন এক জগতের অধিকারী হয়ে যায় যেখানে নেকী, কল্যাণ ও ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই বর্তমান থাকে না।
আধ্যত্মিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্বের একটি দিক
ইসলামী আদর্শে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আরো একটি দিক থেকে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের মৌলিক গুরুত্ব বর্তমান। ইহলোকে এই আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ মানবজাতির এক অমূল্য সম্পদ। মানব জীবনে এর প্রভাব যে কত গভীরে ও দূরপ্রসারী তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। এর প্রতি যথার্থ মনোযোগ দিয়ে উহার সুষ্ঠু বিন্যাস সাধন করা হলে মানব জীবনে উহা ততদূরই প্রবাব বিস্তার করতে সক্ষম যতদূর সক্ষম কোন অর্থনৈতিক কিংবা অন্যবিধ ব্যবস্থাপনা। বরং সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব অন্যান্য যে কোন ব্যবস্থার প্রভাব অপেক্ষা অত্যধিক প্রশস্ত ও কার্যকরী।
ইতিহাসের দর্পণ
মুসলমানদের নিজস্ব ইতিহাসই এ সত্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ধর্মত্যাগীদের প্রচণ্ড বিদ্রোহ যখন ইসলামী শক্তিকে গ্রাস করতে উদ্যত হয় তখন মুসলিম জাহানের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা) একাই একে কঠোর হাতে দমন করার জন্যে প্রস্তুত গ্রহণ করেন। অথচ হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীগণৗ এই যুদ্ধে খলীফার সাথে একমত হতে পারেননি। কিন্তু এ সত্ত্বেও হযরত আবু বকর (রা) অবিচল থেকে সুদৃঢ় প্রত্যয় ও অবাবনীয় বীরত্বের সাথে পরিস্তিতির মোকাবিলা করেছেন। প্রশ্ন জাগে, এই প্রত্যয় ও দৃঢ়তার মূলে কী ছল? সেটি কি কোন বস্তুগত লাভের চিন্তা? না কোন পার্থিব লোভ-লালসা? কোন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেল আশা? নিশ্চয়ই এই কঠিনতম মহাবিপদের সময়ে কোন বস্তুগত মুনাফঅ কিংবা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নেশা তাকে অনুপ্রাণিত করেনি। যদি তাই হতো, তাহলে তিনি এতবড় যুদ্ধে কিছুতেই জয়যুক্ত হতে পারতেন না এবং ইসলাম ইতিহাসের এই সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদসংকুল সংগ্রামে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে তার দায়িত্বও পালন করতে পারতেন না। তার এই অভাবনীয় দৃঢ়তা এবং যাবতীয় প্রতিকূল অবস্থার উপর সকল নিয়ন্ত্রণ তার আধ্যাত্মিক প্রেরণারই এক অলৌকিক ঘটনা (বা Miracle) মাত্র। এটা মানবেতিহাসেরও এক অবিস্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এতে করে প্রমাণিত হয় যে, আধ্যাত্মিক শক্তির মধ্যে এতবড় অর্থনৈতিক এবং বস্তুশক্তিও বর্তমান যার কোন নযীর খুঁজে পাওয়া যাবে না। (ইসলামের পঞ্চম খলীফা) হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা)-এর মধ্যেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত বর্তমান। তিনি তাঁর অভাবনীয় আধ্যাত্মিক শক্তির বলে পূর্ববর্তী উমাইয়া খলীফাদের যাবতীয় জুলুম ও নির্যাতনের মূলোৎপাটন করে নতুন করে সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করেন, অতীতের যাবতীয় অবিচার ও নির্য়াতনর ক্ষতিপূরণ দান করেন এবং ইসলামরে সামাজিক বিধি-নির্দশ ও নিয়ম-নীতিকে পুন প্রবর্তিত করেন। আর এর অনিবার্য ফল স্বরূপ এমন এক বিস্ময়কর ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক মু’জিযা সংঘটিত হলো যে, এরপর গোটা ইসলামী সমাজে দান বা যাকাতের অর্থ পেতে পারে এমন কোন দরিদ্র লোকের অস্তিত্বই থাকলো না।
আধ্যাত্মিক দিকের গুরুত্বের মুল কারণ
উপরোক্ত সর্বাত্মক কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য করেই ইসলাম এই আধ্যাত্মিক দিকের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কেননা উহা মানুষকে বিস্ময়কর ও সর্বাত্মক কল্যাণ থেকে কখনো বঞ্চিত করতে চায় না। আবার উহার আধ্যাত্মিক কল্যাণের নামে পার্থিব উন্নতির বস্তুগত উপায় অবলম্বন করার পথেও কোন বাধার সৃষ্টি করে না। ইসলাম মু’জিযাকে অস্বীকার করে না। কিন্তু উহার অপেক্ষাযহাত-পা বন্ধ করে বসে থাকার নির্দেশ দেয় না। বরং এর সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে উহার সর্বোচ্চ মূলনীতি হলো:
(আরবী***********)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তি প্রয়োগ করে সেই সকল জিনিস বন্ধ করে দেন যেগুলো কুরআন দ্বারা বন্ধ হয় না।” [-তৃতীয় খলীফঅ হযরত উসমান (রা)-এর উক্তি]
সমাজতন্ত্রের মানবিক দিক
সমাজতন্ত্রের নির্ধারিত পন্থায় যে ব্যক্তি নিজের বস্তুগত ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটাবার জন্যে চেষ্টা করতে থাকে তার জন্যে নিজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি মনোযোগী হওয়া কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়। কেননা সমাজতন্ত্রের সমস্ত গুরুত্বই জীবনের শুধু একটি বিভাগ মাত্র বিভাগ অর্থাৎ অর্থব্যবস্থার উপর আরোপ করা হয়। এটাকে মেনে নিলে মানব জীবনের অন্যান্য দিকের উন্নতির প্রতি লক্ষ্য দেয়ার কোন অবকাশই থাকে না! বাস্তবে কেবল ঐ একটি দিকের প্রতিই মনোযোগ দেয়া সম্ভবপর হয়। এর উদাহরণ স্বরূপ মানবদেহের একটি অংগ-হৃদপিন্ডের কাজ ধরা যেতে পারে। এই অংগটি যদি বেড়ে যায় তাহলে সে অবস্থাটি দেহের অন্যান্য অংগ-প্রত্যংগের উন্নতিকে অবশ্য অবশ্যই রুদ্ধ করে দিবে। এমতাবস্থায় সমাজতন্ত্রীদের জীবনে অর্থব্যবস্থার উপর উক্তরূপ অসাধারন গুরুত্ব জীবনের অবশিষ্ট দিক ও বিভাগের উন্নতিকে সার্বিকভাবেই ব্যহত করে দেয়।
কেউ কেউ হয়ত ইসলাম এবং সমাজতন্ত্রের এরূপ দার্শনিক তুলনাকে আদৌ পছন্দ করে না। কেননা তাদের দৃষ্টিতে এ ধরনের দার্শনিক আলোচনা কখনো গভীর হতে পারে না এবং এতে কোন উপকারও হয় না। তাদের মতে, জীবনের বাস্তব সমস্যাগুরৈাই একমাত্র গুরুত্বের অধিকারী। সুতরাং দার্শনিক আলোচনার চেয়ে এর গুরুত্বই অধিক। এ কারণে কোন ব্যবস্থাপনাকে গ্রহণ বা বর্জন করার সময়ে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় আলোচানায় বিভ্রান্ত হওয়ার কোন যুক্তিই থাকতে পারে না। বরং এর প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আলোচ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের বাস্তব জীবনে কতদূর কল্যাণকর হতে পারে। এ জন্যেই উপরোক্ত অনুসারীরা যখন দার্শনিক আলোচনার সম্মুখিন হতে বাধ্য হয় তখন তারা অস্থির ও দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে এবং তারা বুঝতেই পারে না যে, বাস্তব জীবনে শেষ পর্যন্ত ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সংঘর্ষ হয় কি কারণে। তাই তারা অন্ধের মত এ দু’টির সংঘর্ষকেই অস্বীকার করতে থাকে।
ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের পার্থক্যের বাস্তব দিক
সমাজতন্ত্রীদের উপরোক্ত চিন্তাধার মোটেই সঠিক নয়। কেননা কোন বিষয়ের বাস্তব ও দার্শনিক –এ দু’টি দিককে কখনো পৃথক করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ইসলামের মধ্যে যে পার্থক্য বর্তমান তা শুধু দর্শন বা চিন্তাধারা দিক থেকেই নয়। বরং বাস্তবেও বহু তারতম্য বিরাজমান। নিম্নে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা গেল:
পরিবারের ধ্বংস সাধন
ইসলামরে দৃষ্টিতে নারী জীবনের আসল কর্তব্য হচ্ছে মানবীয় প্রজন্মের বৃদ্ধি ও লালন-পালন। এ জন্যেই ইসলাম নারীর গৃহ ত্যাগ করাকে আদৌ পসন্দ করে না। এবং অসাধারণ ও জরুরী পরিস্থিতি ছাড়া অন্য কোন সময়েনারীকে এই অনুমতি দেয় না যে, কারখানা বা ক্ষেত-খামারে মজদুরী করে ফিরুক। হ্যাঁ, যদি এমন কোন পুরুষ অর্থাৎ তার স্বামী, পিতা, ভাই কিংবা অন্য কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিবারে না থাকে যে তার দায়িত্ব গ্রহণ রতে পারে তাহলে নিরুপায় হয়ে অবশ্যই সে মজদুরী করার জন্যে গৃহ ত্যাগ করতে পারে। অথচ এর সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে সমাজকে পুরুষদের ন্যায় নারীদেরকেও কল-কারখানা ও ক্ষেত-খামারে মজদুরী করাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। সমাজতন্ত্রের জীবন দর্শন নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন মৌলিক মনস্তাত্বিক পার্থক্রকে আদৌ স্বীকার করে না এবং করে না বলেই নারী-পুরুষের স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রেও কোনরূপ তারতম্য মেনে নিতে সম্মত নয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার স্বাভাবিক ভিত্তিই হলো উৎপাদনের সকল উপায়-উপাদানকে যথাসাধ্য বৃদ্ধি করা। অতএব একথা সুস্পষ্ট যে, এই লক্ষ্য কেবল তখনই অর্জিত হতে পারে যখন রাষ্ট্রের সকল নাগরীক –পুরুষ হোক বা নারী হোক –গৃহ ত্যাগ করে বাইরে আসবে এবং নিজেদের সকল যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাকে একই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে প্রয়োগ করতে সমর্থ হবে, আর সকল পরীক্ষাগার ও ক্ষেত-খামারকে নিজেদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহন করতে পারবে। এই সর্বাত্মক কাজে নারীদেরকেও সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান তালে একই প্রকার কাজ করে এগুতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীরা বিশেষ কোন সুবিধালাভের হকদার হতে পারবে না। এমনকি সন্তান প্রসবকালীন সময় ছাড়া কখনো তার কাজে অনুপস্থিত থাকতে পারবে না। এ পরিবেশের অনিবার্য ফল হবে এই যে, শিশুরা মায়ের স্নেহ-মমতা, আদর-যত্ন এবং লালণ-পালন থেকে বঞ্চিত হবে এবং সময়ান্তরে এই শিশুরাই [সন্তানদের প্রশিক্ষণ পর্যায়ে ‘ইসলাম ও নারী’ অধ্যায়ে বিস্তৃ রূপে আলোচনা করা হয়েছে।] ব্যবসায়ের পণ্যের মত কারখানার উপযোগী শ্রমিকে পরিণত হবে।
মোটকথা, সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা মেনে নিলে আমাদের নারীদেরকে গৃহের চার দেয়ালকে পরিত্যাগ করে অবশ্য অবশ্যই কারখানা বাক্ষেত-খামারে বাধ্যতামূলকভাবে মেহনত করতে হবে। আর এর ফলে পারিবারিক ব্যবস্থাপনা একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ পরিবারই হলো ইসলামের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একমাত্র ভিত্তি। [এতে করে পরিবারভুক্ত নারী ও পুরুষের পারস্পরিক অসহযোগিতা কখনো প্রমাণিত হয় না। সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন কাজ করলেও তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সুসম্পর্ক যেমন অব্যাহত থাকে ঠিক তেমনি পরিবারস্থ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও কোন ভাটা পড়ে না। তাদের কর্মক্ষত্র বিভিন্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও যৌথকর্মসূচীতে কোন অসুবিধার সৃষ্টি হয় না।] এবং ইসলামী জীবনব্যবস্থায় এটা এক মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর উত্তরে যদি কেউ বলে যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও কল-কারখানা ও ক্ষেত-খামারে কাজ করা নারীদের জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। তাহলে তার স্মরণ রাখা উচিত যে, এটা তার ঘরোয়অ বা মনগড়া দর্শন হতে পারে; সমাজতান্ত্রিক দর্শনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই এবং কোন সমাজতন্ত্রী এর সাথে সংশ্লিষ্টও হতে পারে না। এ ব্যাপারে কমিউনিস্টরা কখনো ধোঁকাবাজির আশ্রয় নেয় না। অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান বৃদ্ধি করাকে মানব জীবনের জন্যে অপরিহার্য বলে আমরাও স্বীকার করি। কিন্তু এ উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাকে মেনে নেয়ার কোন আবশ্যকতা আমরা স্বীকার করি না। কেননা স্বয়ং সমাজতান্ত্রীরা যে অর্থনৈতিক উন্নতি হাসিল করেছে তার কৃতিত্ব তাদের নিজেদের নয়। বরং ঐ সকল অর্থনৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যা তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ধার করে এনেছে। [সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করার প্রথম দিকে রাশিয়ার অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। অতপর সেখানে ইউরোপ থেকে ধার করা পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার সাহায্যে উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয় এবং উন্নত দেশ বলে পরিগণিত হয়।] প্রশ্ন এই যে, একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যদি অন্যান্য দেশের উন্নত শ্রেণীর উৎপাদন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে উন্নতি লাভ করতে পারে তাহলে তাকে উক্ত একই পথ অনুসরণ করে একটি ইসলামী রাষ্ট্র উন্নতি লাভ করতে পারে না কেন? বিশেষ করে ইসলামী রাষ্ট্র ইহলৌকিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে নীতিগতভাবেই যখন কৃষি ও কারিগরীর সর্বাধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধার সৃষ্টি না করে তখন উন্নতি লাভ না করার কোন কারণই থাকতে পারে না।
প্রলেটারী একনায়কতন্ত্র
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সৌধ প্রলেটারী শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের ভিত্তির উপরই গড়ে উঠে। অন্য কথায়, এই ব্যবস্থাপনায় কেবল সরকারই সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক। সরকারই সকল নাগরিকদের ব্যাপারে এরূপ সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী যে, তাদের মধ্যে কে কোন্ কাজ কি রূপে করবে? –চাই সে কাজের জন্যে তার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাক বা না থাক, তার দৈহিক ও মানসিক অবস্থার সাথে সে কাজের সংগতি থাকুক বা না থাকুক। আর গোটা রাষ্ট্রে এই পরিকল্পনা ও বাস্তব কাজের উপর সরকারের পক্ষ থেকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে না কেউ কিছু চিন্তা করতে পারে। না কেউ কিছু স্বাধীনভাবে বলতে বা লিখতে পারে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপ কাঠামোগুলোকেও সরকারই তৈরী করে এবং ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত করে। উহার লক্ষ্য ও কর্মসূচীও সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়। সমাজতন্ত্রীদের এই প্রলেটারী শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র একটি ব্যক্তির একনায়কতন্ত্রের চেয়ে সহস্রগুণ নিকৃষ্ট ও মারাত্মক। এ দু’টির পার্থক্যৗ পাঠকদের স্মরণ রাখা উচিত। একটি ব্যক্তির একনায়কতন্ত্র যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে সে ব্যক্তিটি যদি ভদ্র ও ভারসাম্যপূর্ণ মানসিকতার অধিকারী হয় এবং দেশ ও দশের কল্যাণ সাধনই যদি তার লক্ষ্য হয় তাহলে কোন সময়ে এরূপ আশা করা যায় যে, কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা আইন-কানুন রচনার ক্ষেত্রে জনগণের সঠিক বাভুল প্রতিনিধিদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে এবং তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে পারে। কিন্তু প্রলেটারী একনায়কতন্ত্রের নিকট এমন কিছুর আশা কা বাতুলতা মাত্র। কেননা তাদের সর্বপ্রথম ও একমাত্র লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক উন্নতি এবং এরূপ একনায়কতন্ত্র কেবল সেই সকল কাজেই উৎসাহ দেখাতে পারে যা এই লৌহ শৃংখলকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে পারে। প্রলেটারী একনায়কন্ত্রে’র পরিভাষাটিই এই সত্যের প্রতি অংগুলি নির্দেশ করছে।
সমাজতন্ত্রের দার্শনিক পরাজয়
সমাজতন্ত্রের যে ত্রুটিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে তাছাড়াও এর একটি বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। সেটি হলো: এর কোন নিখুঁত ও সুষ্ঠু দুর্শনিক ভিত্তি নেই। এ কারণেই সমাজতন্ত্র চিন্তাধারা ও বাস্তব কর্মতৎপরতায় অন্য কোন ব্যবস্থাপনার সাথে কোন সমঝোতায় উপনীত না হয়ে পারে না। দেখা যায়, প্রথম পর্যায়ে উহা ব্যক্তিগত মালিকানাকে পুরোপুরি খতম করার শ্লোগান তুলেছে এবং একে একে সমস্ত কর্মচারীদের পারিশ্রমিকের হার সমান করে দিয়েছে কিন্তু কিছুকাল যেতে না যেতেই এই উভয় ব্যাপারেই সমঝোতা করতে হয়েছে। কেননা পরবর্তী পর্যায়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাই একথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকলে আন্তরিকতাই একথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকলে আন্তরিকতার সাথে কাজ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় এবং মেহনতের ভিত্তিতে পারিশ্রমিকে বেশ কম করা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও কল্যাণকর। কেননা এতে করে কাজের সাথে শ্রমিকদের মনের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে উৎপাদনের পরিমাণও বেড়ে যায়। ব্যক্তি মালিকানা এবং পারিশ্রমিকের তারতম্য স্বীকার করে সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা কার্লমার্কসের দর্শনের দু’টি প্রধান স্তম্ভকে বর্জন করেছে এবং এমন এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে যা ইসলামী দৃষ্টিভংগির অনেকটা কাছাকাছি। প্রশ্ন এই যে, মানবতা যখন অন্যান্য মতাদর্শ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে এরূপে বারবার ইসলামের দিকে এগিয়ে আসছে তখন আমরা মুসলমানরা কেন আমাদের একমাত্র ও নির্ভুল জীবনব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করে সমাজতন্ত্রে ক্রোড়ে আশ্রয় নিচ্ছি?