ইসলাম কি জনসাধারণের আফিম?
“ধর্ম জনসাধারণের আফিম” –কার্লমার্কসের এ প্রসিদ্ধ উক্তিটি সমাজতন্ত্রের প্রাচারকরা সকল মুসলিম দেশে চোখ বুজে প্রচার চলেছে। এমনকি বর্তমানে ইসলামও এর আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
কার্লমার্কস এবং সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক যুগের নেতারা ইউরোপের যে পরিবেশে কাজ শুরু করে তাতে এমন কিছু কারণ ও অবস্থা বর্তমান ছিল যাতে করে তারা গীর্জা ও ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ঐ সময়ে ইউরোপে –বিশেষ করে রাশিয়ায় চরম পর্যায়ের পাশবিক ও দমনমূলক সামন্তবাদ চালু ছিল। তখন লক্ষ্য লক্ষ মানুষ অনাহারে ও ঠাণ্ডায় মারা যেত, অবশিষ্টদের অধিকাংশই গনোরিয়া, যক্ষ্মা এবং এ ধরনের মারাত্মক রোগের শিকার হতো। কিন্তু হায়! তাদের এই দুঃখের দিনে একটুখানি সমবেদনা জানাবারও কোন প্রাণী খুঁজে পাওয়া যেত না। সামন্তদের যে শ্রেণীটি অসহায় গরীবদের রক্ত চুষে চুষে নিজেদের আরাম-আয়েশ ও বিলাস-ব্যসনের ব্যবস্থা করতো তাদের অন্তরাত্মা এতটুকুও শিউরে উঠতো না।
ধার্মিকদের কীর্তি
এরপর “মরার উপর খাঁড়ার ঘা” হিসেবে নেমে আসতো ধর্ম নেতাদের অমানুষিক জুলুম। গরীব ও মেহনতী লোকেরা যদি কখনো সামাজিক বৈষম্য ও বে-ইনসাফীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতো তাহলে ধার্মিক গোষ্ঠী তথা পাদ্রীরা তাদেরকে ধরাশায়ী করে ফেলতো। মেহনতী ও মজলুম জনতাকে সাহায্য করার পরিবর্তে তারা তাদেরকে ধৈর্যধারণ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উপদেশ দিয়ে বলতো: “কেউ তোমাদের ডান গালে চড় মারলে তার দিকে বাম গালটি ফিরিয়ে দাও। আর কেউ যদি নালিশ করে তোমাদের জামা নিতে চায় তাহলে তোমাদের চোগাও তাকে নিতে দাও।” তারা আরো বলতো যে, যারা এই দুনিয়ায় জুলুম ও বে-ইনসাফীর শিকার হয় তাদেরকে এর প্রতিদানে পরলৌকিক জগতে জান্নাত এবং শান্তিপূর্ণ চিরস্থায়ী জীবন দান করা হবে। এ জন্যে তাদের ধৈর্যধারণ করা উচিত। এবং নিজেদের অধিকার ও দাবী-দাওয়া সম্পর্কে কোন আন্দোলন না করা সমীচীন। এমনি করে তারা মজলুম জনতাকে অবুঝ শিশুর মত প্রবোধ দিয়ে তাদের দাবী আদায়ের প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিত এবং কোন বিপ্লব বা আন্দোলনের পথকে রুদ্ধ করে দিত।
প্রবোধ ও ধমকীর পথ
পারলৌকিক শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি লাভের পরেও যখন ঐ উৎপীড়িত জনতা তাদের অধিকার আদায়ের জন্যে সচেষ্ট হতো তখন এই পাদ্রীরা নানারূপ ধমীক দিয়ে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করতো। তারা বলতো : যে ব্যক্তি তার সামন্ত প্রভুর আদেশ অমান্য করবে তারা হবে আল্লাহ, গীর্জা ও পাদরীদেরও মহাশত্রু এবং চরম বিদ্রোহী। স্মরণীয় যে, ঐ যুগে খোদ গীর্জাই ছিল বড় ধরনের সামন্ত। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছিল তাদের মজদুর। এ কারণে নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই যখন মেহনতী মানুষ ও সামন্তদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তখন এই পাদরীরা রাশিয়ার রাজপরিবার এবং তাদের সহযোগী সামন্তদের সাথ আঁতাত স্থাপন করে। কেননা মূলত তারা সবাই ছিল একই থলির বিভিন্ন খেলনার গুটি মাত্র। তারা একথাও ভালো করে জানতো যে, জনগণ যদি কোন সময় বিপ্লব সৃষ্টি করে তখন সামন্তরা যেমন বাঁচতে পারবে না তেমনি পাদরীরাও কোনরূপ নিষ্কৃতি পাবে না। এ কারণে পালৌকিক শান্তির প্রতিশ্রুতি ও ধমকী যেখানে ব্যর্থ হয় সেখানে ডাণ্ডা দিয়েই এই সকল আল্লাহদ্রোহী ও ধর্ম বিরোধীদেরকে ঠাণ্ডা করে দেয়া হতো। এ ব্যাপারে সামন্তরা পাদরীদের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করতো। পাদরীদের এহেন কার্যকলাপের ফলেই ইউরোপের লোকেরা ক্রমে ক্রমে বুঝতে শুরু করে যে, ধর্মই হলো মানুষের প্রকৃত দুশমন, “ধর্ম মানুষের আফিম” –কার্লমার্কসের এই বাণীর মধ্যে এই ঐতিহাসিক সত্যের ইংগিত বর্তমান।
শাসকদের সাথী
সমাজতন্ত্রীরা ধার্মিক শ্রেণী সম্পর্কে এও বলে থাকে যে, তারা শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বদা শাসকদের সহযোগিতা করে এবং জান্নাতের আশায় সকল প্রকার অবমাননা ও বে-ইনসাফীকে বরদাশত করার উপদেশ দেয় –যাতে করে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায় এবং অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী তাদের রক্ত অবাধে চোষণ করতে সক্ষম হয়।
জামেয়ায়ে আজহারের দৃষ্টান্ত
এই পর্যায়ে তারা জামেয়ায়ে আজহার (মিসরের আজহার বিশ্ববিদ্যালয়)-এর কিছু সংখ্যক পণ্ডিতের বরাত দিয়ে থাকে। এই পণ্ডিতেরা রাজা-বাদশাহদের হাত চুমা দিত এবং তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কুরআনের অপব্যাখ্যা করে ইসলামকে বিকৃত করতো। এর একমাত্র লক্ষ্য ছিল শাসকদের রাজত্বকে স্থায়ী করে তোলা এবং জনগণ যাতে করে শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে না উঠে সেজন্যে তাদেরকে নানাভাবে বিরত রাখা। তারা বলতো যদি তারা শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কিংবা তাদের কোন আদেশ অমান্য করে তাহলে তারা পাপী ও আল্লাহদ্রোহী বলে সাব্যস্ত হবে।
আসল প্রশ্ন
উপরোক্ত কথাগুলো আমূলক নাও হতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এই সকল পেশাদার ধর্মীয় নেতা যা কিছু করছে তা কি তারা ধর্মীয় বিধান অনুসারে করছে, না নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যে করছে?
স্বার্থান্বেসী আলেমদের দৃষ্টান্ত
অনস্বীকার্য যে, মুসলিম জাতির ইতিহাসে যে সকল স্বার্থান্বেসী আলেমদের উল্লেখ দেখা যায় তাদের কর্মতৎপরতা ছিল ইসলামের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তারা ছিল এ যুগের বিভ্রান্ত কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের মত –যারা ঘৃণ্য স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে বড় বড় অপরাধ করতেও এতটুকু কুণ্ঠিত হয় না। তবে এই ধর্ম নেতাদের অপরাধ যে ঐ সকল কবি-সাহিত্যিকদের মত –যারা ঘৃণ্য স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে বড় বড় অপরাধ করতেও এতটুকু কুণ্ঠিত হয় না। তবে এই ধর্ম নেতাদের অপরাধ যে ঐ সকল কবি-সাহিত্যিকদের চেয়ে সহস্রগুণ মারাত্মক ও সুদুরপ্রসারী তা না বললেই চলে। কেননা ধর্মের অনুসারী তথা ধারক ও বাহক রূপে তাদের নিকট এটাই প্রত্যাশা করা হয় যে, তারাই হবে ধর্মের সংরক্ষণকারী ও পৃষ্ঠপোষক। আল্লাহর ধর্মকে বিকৃত করে তারা যে ন্যক্কারজনক অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে তা তারা নিশ্চিতরূপেই অবগত ছিল।
পেশাদার ধার্মিক শ্রেণী ও ইসলাম
আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এ সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ও নিশ্চিত ধারণা থাকা উচিত যে, ইসলাম প্রথমত, পেশাদার ধার্মিক শ্রেণীর কোন অস্তিত্বিই নেই; দ্বিতীয়ত, ধর্মীয নেতারা যা কিছু বলবে তা-ই যে ইসলাম সংগত হবে তার কোন কারণ নেই্ বস্তুত মুসলমানদের এই দুর্ভাগ্যের একমাত্র কারণ হলো নিজেদের দ্বীন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব এবং উহাকে তোয়াক্কা না করার জঘন্য মানসিকতা।
ইসলাম একটি অপ্রতিরোধ্য স্বাধীনতা আন্দোলন
ইসলামের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগ উত্থাপন করা হয় যে, উহা মেহনতী জনতাকে জুলুম ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা আন্দোলন করার অধিকার দেয় না। এ অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এর সবচেয়ে বড় ও অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে মুসলমানদের ইতিহাস। যে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের মাধ্যমে মিসরের প্রাক্তন স্বৈরাচারী বাদশাহর হাত থেকে মিসরবাসীরা মুক্তি লাভ করে তার মূলে ছিল একটি ইসলামী আন্দোল। শুধু এখানেই শেষ নয়, মুসলিম দেশসমূহে যতগুলো স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে তার সবগুলোই ছিল ইসলাম প্রদত্ব স্বাধীনতা স্পৃহার অনিবার্য ফসল। ফরাসীদের বিরুদ্ধে মিসরীয়রা যখন সোচ্চার হয়ে উঠে তখন তার পুরোভাগে ছিলেন মুসলিম আলেম সম্প্রদায়। মুহাম্মদ আলীর বে-ইনসাফীর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদের ঝড় প্রবাহিত হয় তারও নেতৃত্বে ছিলেন আলেম সমাজ। সুদানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয় তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আল মাহদী নামক একজন প্রসিদ্ধ আলেম। এমনি করে লিবিয়ায় ইটালীয় এবং মরোক্ততে ফরাসীদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে জোর প্রচেষ্টা চালানো হয় তার মূলেও রয়েছে ইসলামপন্থীদের অবদান। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কাশানীর যে বৈপ্লবিক আন্দোলন শুরু হয় তার পশ্চাতেও সক্রিয় ছিল ইলাম। এই সকল আন্দোলন এ কথাই প্রমাণ করে যে, ইসলাম এমন একটি শক্তিধর স্বাধীনতা আন্দোলন যা সকল প্রকার সামাজিক বে-ইনসাফী, অজ্ঞতা ও বৈষম্য চিরতরে উৎখাৎ করার জন্যে পরিচালিত হয়।
কুরআন থেকে সমাজতন্ত্রীদের ভুল দলীল প্রদান
সমাজতন্ত্রের প্রচারকরা কুরআন পাকের দু’টি আয়াতের উদ্বৃতি দিয়ে প্রায়ই একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, ইসলাম মানুষকে সকল প্রকার বে-ইনসাফী ও অবমাননাকে সহনশীলতা ও কৃতজ্ঞতার সাথে বরদাশত করার শিক্ষা দেয়। আয়াত দু’টি হলো:
(আরবী**********)
“এবং তোমরা এমন কোন জিনিসের আকাংখা করো না যাতে আল্লাহ কারুর চেয়ে কাউকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।” –(সূরা আন নিসা: ৩২)
(আরবী**********)
“আর কখনো আপনি সেই সকল জিনিসের প্রতি তাকাবেন না যার মাধ্যমে আমি কাফেরদের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্যে প্রদান করেছি। ঐগুলো নিছক পার্থিক জীবনের সৌন্দর্য। এবং আপনার প্রতিপালকের দান (যা পরকালে পাওয়া যাবে।) বহুগুণে শ্রেষ্ঠ এবং চিরস্থায়ী।” –(সূরা আত ত্বা-হা: ১৩১)
কুরআনের নির্ভুল অর্থ
প্রথম আয়াত নাযিল হওয়ার পটভূমি সম্পর্কে তাফসীরবিদগণ বলেন: পুরুষদের জন্যে জিহাদ যখন অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয় তখন জনৈক স্ত্রীলোক হযরত বিশ্বনবী (স)-এর নিকট প্রশ্ন করলেন: আল্লাহর পথে জিহাদ করার সৌভাগ্য থেকে মহিলাদেরকে বঞ্চিত করা হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর উপরোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ করা হয়।
তাফসীরবিদগণ উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার আরো একটি পটভূমির কথা উল্লেখ করেছেন। সেটিই অধিকতর পরিচিত। সেটি হলো: মানুষকে নিছক আশা-আকাংখার কল্পনা জগতে বসবাস না করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এবং খেয়ালীপোলাও পাকাবার ব্যধি থেকে নিষ্কৃতিলাভের জন্যে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে। কেননা এতে করে মানুষের কর্মশক্তি অন্তরসারশূন্য হয়ে যায় এবং ঈর্ষা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতার ন্যায় ঘৃণিত ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে পার্থিব জীবনে তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য হয়। মোটকথা এই অকল্যাণকর দিক থেকে বাঁচার জন্যে এবং যে কাজে তার সুষ্ঠু যোগ্যতার কারণে সত্যিকার মর্যাদা ও সম্ভ্রম অর্জিত হয় সেই কাজে উৎসাহ দেয়ার জন্যে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় আয়াতে মানুষকে বস্তুগত স্বাভাবিক মান থেকে আধ্যাত্মিক জগতের উন্নত মানে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে আহ্বান জানানো হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে: দুনিয়ার মাল-আসবাব ও সাজ-সরঞ্জাম দ্বারা কারুর মহত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় না। এই প্রকার লোক –যাদের কাছে বস্তুগত স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া কোন সৎগুণই বর্তমান নেই –একদিকে যেমন ঈর্ষার কারণ নয়, তেমনি কারুর অনুসরণ যোগ্যও নয়। এই আয়াতে সর্বপ্রথম সম্বোধন করা হয়েছে স্বয়ং বিশ্বনবী (স)-কে। এখানে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নিকট ধনী ও সচ্ছল কাফেরদের কোন মূল্য নেই। কেননা তারা ঈমান রূপ মহান সম্পদ থেকে একেবারেই বঞ্চিত। বরং মূল্য যেটুকু আছে তা একমাত্র বিশ্বনবী (স)-এরই প্রাপ্য। হক ও সততার তিনি ছিলেন পরম ও পূর্ণাংগ আদর্শ। তাই সত্যিকার সম্ব্রম ও সম্মানের একমাত্র হকদার তিনিই।
ধৈর্য ও তুষ্টির পরিচয় ও স্থানত
প্রশ্নকারীদের কথিত মতে যদি ধরে নেয়া হয় যে, উপরোক্ত আয়াতে মানুষকে ধৈর্য ধারণের এবং অল্পে তুষ্ট থাকার উপদেশ দেয়া হয়েছে এবং যারা আল্লাহর নেয়ামতরাজির মধ্যে ডুবে আছে তাদের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাহলেও প্রশ্ন উঠে, এই বিধি-নিষেধের ক্ষেত্র কোথায়? কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে এ আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে?
চিত্রের দু’টি দিক
উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর জানার পূর্বে প্রথমেই আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ইসলাম একটি পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা। এবং উহার অনুসরণ ও অনুকরণের লক্ষ্য কেবল তখনই অর্জিত হতে পারে যখন সকল শাখা-প্রশাখা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ গোটা জীবনব্যবস্থাকেই অবশ্য পালনীয় সত্য হিসেবে গ্রহণ করবে। এবং তখনই উহার সত্যিকার রূহ উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, ব্যাপারটি শুধু এখানেই শেষ নয় যে, ইসলাম গরীব ও বঞ্চিত মানুষকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ধৈর্য অবলম্বনের উপদেশ দেয় এবং তাদের চেনা ধনী ব্যক্তিদের ধন-ঐশ্বর্যের জন্যে বিদ্বেষ পোষণকরতে নিষেধ করে বরং এই সংগে অন্যদিকে ধনী ও সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে এরূপ নির্দেশ দেয় যে, স্বার্থপরতা থেকে তাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে এবং আল্লাহর দেয়া ধন-ঐশ্বর্য তাঁর পথে অধিক হতে অধিক পরিমাণে ব্যয় করতে হবে –কেননা এই হচ্ছে তাদের নাজাতের পথ। নতুবা আখেরাতে তাদেরকে ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে হবে। চিত্রের এই দু’টি দিকে লক্ষ্য রাখলে একথা সহজেই অনুমান করা যাবে যে, ইসলাম যে পথ অবলম্বন করেছে। প্রকৃতপক্ষে তাই হচ্ছে সুবিচারভিত্তিক ভারসাম্যপূর্ণ একমাত্র পথ।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি
ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি হলো: উহা একদিকে মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা থেকে ঊর্ধে উঠে মানুষের কল্যাণে নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে এবং অন্যদিকে তাকে ঈর্ষা ও কুটিলতা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশদেয়। আর এর একমাত্র লক্ষ্য থাকে যেন সে নিজে অর্থের কাঙাল হিসেবে অপরের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয় না। ইসলাম এরূপ গোটা মানসিক শান্তি স্থাপন করতে সমর্থ হয়। বলা বাহুল্য, অর্থনৈতিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যবস্তুও এটাই। কেননা উহা সমস্ত সম্পদে সমাজের সকল ব্যক্তির মধ্যে এমনভাবে বন্টন করতে চায় যে, কেউ যেন অধিক সম্পদের মালিক হয়ে বিলাস-ব্যসন ও ভোগ-লালসার সাগরে ডুবে না যায়, আবার কেউ যেন দারিদ্র ও বঞ্চনার শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য না হয়।
ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য
যখন কোন সমাজকে ইসলামের বিধি-নির্দেশ অনুযায়ী ঢেলে সাজান হয় তখন বঞ্চনা এবং নির্যাতন-নিপীড়নের যাবতীয় পন্থাকেই নির্মূল করে দেয়া হয়। অথচ একটি অনৈসলামিক সমাজব্যবস্থায় ধনাঢ্য জালিম এবং বঞ্চিত মজলূমের সুখ-দুঃখ জীবনের অপরিহার্য অংগ বলে পরিগণিত হয়। শোষণ ও বন্ধনমুক্ত পরিবেশ কেবল সেই সমাজেই পাওয়া যেতে পারে যেখানে ধনী ও সচ্ছল ব্যক্তিরা নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং সে দায়িত্ব পালনে সদা তৎপর। কেননা ধনী ও সচ্ছল ব্যক্তিরা যদি করত্ব্য সচেতন না হয় এবং জনস্বার্থে আল্লাহর পথে নিজেদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় না করে তাহলে দরিদ্র ও মজরুম জনসাধারণকে বঞ্চনা ও নির্যাতনের মুখে ধৈর্য অবলম্বনের উপদেশ কেমন করে দেয়া যেতে পারে? এবং জুলুম ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হওয়ার জন্যেই বা কেমন করে বলা যেতে পারে? নিশ্চয়ই এটা কোন ইসলামী নীতি নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐ সমস্ত কাপুরুষ যারা বে-ইনসাফী ও জুলুমের বিরুদ্ধে অস্ত্র পরিত্যাগ করে এবং কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই কঠিন শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী**********)
-“যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছিল তাদের রূহগুলো যখন ফেরেশতারা কবজা করে তখন তারা তাদের প্রশ্ন করে: তোমরা কোন অবস্থায় ছিলে? উত্তরে তারা বলে: দুনিয়ার বুকে আমরা বড় দুর্বল ও নিরুপায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলে: আল্লাহর দুনিয়া কি এতদূর প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা হিজরত করতে পারতে? বস্তুত এই সমস্ত লোকের ঠিকানা হলো জাহান্নাম। আর সে ঠিকানা হলো বড়ই খারাপ। -হ্যাঁ, যে সকল নারী-পুরুষ ও শিশু সত্যই অসহায় এবং যাদের বের হওয়ার কোন পন্থা নেই, হয়ত আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও মার্জনাকারী।” –(সূরা আন নিসা: ৯৭-৯৯)
একটি অমার্জনীয় অপরাধ
পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে নিছক দুর্বলতার কারণে বে-ইনসাফী ও জুলুমকে বরদাশত করা একটি অমার্জনীয় অপরাধ। পবিত্র কুরআনে এদেরকে ‘জালেমী আনফুসিহিম’ অর্থাৎ ‘নিজেদের উপর জুলুমকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছে। কেননা এরা মানবীয় ইজ্জত ও সম্ভ্রমের সেই সুউচ্চ মঞ্জিল থেকে যে মঞ্জিলকে আল্লাহ পাক মানবতার জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছেন –নীচে নেমে এসে অধপতন নিয়েই তৃপ্তিলাভ করছে। মানুষের জন্যে অবশ্য কর্তব্য হলো উক্ত সুউচ্চ মঞ্জিলে আরোহণ করার জন্যে তারা চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালাবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে বে–ইনসাফী ও জুলুম
মুসলমানদেরকে যখন হিজরত করার নির্দেশ দেয়া হয় তখন তারা একদিকে ছিল কাফের দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং অন্যদিকে ছিল তাদের জুলুম ও নির্যাতনের নিষ্ঠুর শিকার। কাফেরদরে ধর্মীয় নেশাগ্রস্ততা ও চরম অসহযোগ তাদের জীবনযাপনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিল। এরূপ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় তাদেরকে হিজরত করার হুকুম দেয়া হলো। কিন্তু হিজরত ছিল জুলুম ও নির্যাতনের বিপক্ষে একটি মাত্র ব্যবস্থা বা মাধ্যম। এছাড়াও একাধিক পন্থায় এর মোকাবিলা করা যেত। সে যাই হোক এখানে পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আমরা এদিকে আকৃষ্ট করতে চাই যে, ইসলাম বে-ইনসাফী ও জুলুমকে চুপচাপ বরদাশত করাকে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ের মারাত্মক অপরাধ বলে গণ্য করে এবং বিষয়টির প্রতি এতদূর গুরুত্ব আরোপ করে যে, মুসলমানদের মধ্যে যারা সত্যসত্যই দুর্বল, অসহায় ও মজলুম ছিল এবং জুলুম ও জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোন শক্তিই যাদের ছিল না তাদের জন্যেও উপরোক্ত আয়াতে কেবল ক্ষমার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অবশ্যই যে ক্ষমা করা হবে তা বলা হয়নি। অথচ তাদের অক্ষমতা যুক্তিসম্মত এবং একান্তই বাস্তব, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং ঐ আয়াতে প্রকৃপক্ষে যে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তাহলো এই যে, বে-ইনসাফী ও জুলুমের মোকাবিলা করার বিন্দুমাত্রও শক্তি যদি বর্তমান থাকে তাহলে তাদের পক্ষে কস্মিনকালেও এটা বৈধ হবে না যে, উহাকে বরদাশত করবে এবং উহাকে খতম করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ না করবে।
আর দুর্বল, অসহায় ও মজলুম মুসলমানদের জন্যে স্পষ্ট বিধান হলো: ইসলাম তাদের ব্যাপারে এতটুকুও উদাসীন নয়; বরং তাদের হেফাজত ও সঠিক সহযোগিতার জন্যে গোটা মুসলিম উম্মতকেই সরাসরি নির্দেশ দেয় এবং এই উদ্দেশ্যে সমস্ত জালেমের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের আহ্বান জানায়:
(আরবী**********)
“আর কী কারন থাকতে পারে যে, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্যে যুদ্ধ করছো না, যাদেরকে দুর্বল পেয়ে দাবিয়ে রাখা হয়েছে এবং যারা এরূপ ফরিয়াদ করছে যে, প্রভু হে, তুমি আমাদেরকে এই বসতি থেকে উদ্ধার করো যার অধিবাসীরা জালেম এবং তুমি নিজ পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী বানাও।” –(সূরা আন নিসা: ৭৫)
এই আয়াতে একথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তা’আলা জুলুম ও বে-ইনসাফীর সামনে মাথা নতকারী লোকদেরকে বিন্দুমাত্রও পসন্দ করেন না; বরং যারাই আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলো: তারা হকপন্থী ও তাওহীদী জনতার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জুলুম ও বে-ইনসাফীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে যাতে করে মজলুম জনতা জালেম গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে।
একটি ভুল ধারণার অবসান
কারুর কারুর এরূপ ধারণা হতে পারে যে, উপরোক্ত আয়াত কেবল দ্বীন ও ঈমান সংক্রান্ত ব্যাপারেই প্রযোজ্য। ইসলামের দুশমনদের হাতে মুসলমানরা যখন নিগৃহীত হতে থাকে –তথা কাফেরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার কারণে স্বাধীনভাবে কোন দ্বীনী বা ধর্মীয় কাজ আঞ্জাম দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে কেবল তখনকার জন্যে উক্ত আয়াত নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা একেবারেই ভুল। কেননা একটি পূর্ণাংগ জীবন পদ্ধতি হিসেবে ইসলাম (নামায-রোযার ন্যায়) ধরমীয় অনুষ্ঠানাদি পালন এবং সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের যাবতীয় তৎপরতাকে একই রূপে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করে এবং ঐগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্রও পার্থক্য করে না। কেননা ঐগুলোর প্রত্যেকটির ভিত্তিই হচ্ছে ইসলামী আকীদা। উক্ত ভিত্তিমূল থেকেই সকল শাখা প্রশাখা উৎসারিত হয়। বাস্তব! ইসলামের দৃষ্টিতে ইসলামী ইবাদত অনুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি করা হোক। কিংবা ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে কোন অন্তরায় সৃষ্টি করা হোক –সবকিছুই একই পর্যায়ভুক্ত। এই বাধা দানকারীরা চাই কার্য়য ও নামে কাফের হোক কিংবা নামেও মুসলমান কিন্তু কাজের দিক থেকে আল্লাহদ্রোহী ও কাফের হোক তাকে কিছুই আসে যায় না। পবিত্র কুরআনের ফায়সালা ইহাই। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী**********)
“আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারা কাফের।” –(সূরা আল মায়েদা: ৪৪)
মোটকথা ইসলাম চায়! সম্পদ যেন কোন অবস্থাতেই মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং সমাজের সর্বত্রই যেন উহা আবর্তিত হতে থাকে। এবং সংগে সংগে ইসলামী রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব হল এটা যে, উহার আওতাধীন সকল নাগরিকের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। রুজী রোজগারের সম্ভাব্য সকল পন্থা উন্মুক্ত করে দিতে হবে। রাষ্ট্র যদি এই ব্যবস্থা অবলম্বন না করেকিংবা কোন নাগরিক যদি দৈহিক অক্ষমতা বা দুর্বলতার কারণে উপার্জন করতে সক্ষম না হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু বিশ্বনবী (স)-এর নির্দেশ [গ্রন্থকার যে হাদীসের প্রতি ইংগিত করেছেন তাহলো বিশ্বনবী (স) বলেন: “যে ব্যক্তি আমাদের (ইসলামী রাষ্ট্রের) কর্মকর্তা হিসেবে কোন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে তার স্ত্রী না থাকলে তাকে বিবাহ করাতে হবে, ঘর না থাকলে ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে। খাদেম না থাকলে খাদেমের ব্যবস্থা করতে হবে।”] অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের জন্যেও প্রাইভেট বা পাবলিক প্রতিষ্ঠানে যে সকল কর্মচারী বা কর্মকর্তা কাজ করে তাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতিও এরূপ লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব উহার কর্তপক্ষকে অবশ্যই পালন করতে হবে। কেননা জনজীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগই ইসলামী ব্যবস্থার শাখা-প্রশাখা ও অবিচ্ছেদ্য অংগ-প্রত্যংগ বলে পরিগণিত। যে ব্যক্তি জনগোষ্ঠী এর কোন এক দিক ও বিভাগের কোথাও আল্লাহর বিধানের প্রতি উদাসীনতা দেখাবে সে কখনো সত্যিকার মুসলমান হতে পারে না। ঈমানের দাবীতে সে কেবল তখনই সত্যনিষ্ঠ হতে পারেযখন সে আল্লাহর জমিনে একমাত্র আল্লাহর আইন জারী করার উদ্দেশ্যে প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাবে। এ কারণেই যারা ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থাকে বিজয়ী করার জন্যে কোনরূপ চেষ্টা চালায় না আল্লাহ তাদেরকে স্বেচ্ছায় বে-ইনসাফী, জুলূম ও স্বৈরাচারের সাথে আপোষ করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করে ‘জালেমী আনফুসাহুম’ (নিজেদের প্রতি জুলুমকারী) বলে আখ্যায়িত করেন।
‘কুরআন থেকে সমাজতন্ত্রীদের ভুল দলীলল প্রদান’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে উল্লিখিত আয়াত দ্বারা যারা এটা প্রমাণকরতে চেয়েছেন যে, ইসলাম মানুষকে জুলুম ও নির্যাতনকে মুখ বুজে বরদাশত করার শিক্ষা দেয়। তাদের এ ভুলধারণাকে ক্ষণিকের জন্যে নির্ভুল বলে ধরে নিলেও উহার পরিণাম দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় যে, তাদের ধারণা সম্পূর্ণরূপেই ভুল। কেননা উহার পরিণাম হলো ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। ঐ সকল প্রতিবাদী মনে করেছিল যে, প্রথম আয়াতের পরিণম হবে এই যে, সম্পদ শুদু মুষ্টিমেয় লোকের হাতেই সঞ্চিত হবে এবং অন্যান্য লোকেরা উহার সুফল ও কল্যঅণ থেকে বঞ্চিত হবে (যেমন হয়েছিল সামন্ত প্রথা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়)। কিন্তু এরূপ হওয়া ছিল আল্লাহর ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা কুরআন পাকের স্পষ্ট হুকুম হলো:
(আরবী**********)
“যাতে করে সম্পদ ধনীদের মধ্যে আবর্তিত হতে না থাকে।” –(সূরা আল হাশর: ৭)
দ্বিতীয় পরিণাম সম্পর্কে তারা বলেছিল: সম্পদশালীরা সাপ হয়ে তাদের সম্পদ পাহারা দিতে থাকবে- খরচ করলেও করবে তাদের ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের জন্যে। এরূপ লোকদের সম্বন্ধেই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
“সেই সকল লোককে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও যারা সোনা-রূপা জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে উহা ব্যয় কর না।” –(সূরা আত তাওবা: ৩৪)
এতে স্পষ্টরূপে প্রমানিত হয় যে, আল্লাহর নিকট এরূপ সঞ্চয় নেহাৎ ঘৃণিত ও অপসন্দনীয়। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
“আর আমরা কোন জনবসতিতে কোন ভীতি প্রদর্শনকারী (পয়গম্বর) প্রেরণ করিনি, যেখানকার সচ্ছল ব্যক্তিরা একথা বলেনি যে, তোমরা যে বিধি-নির্দেশ নিয়ে প্রেরিত হয়েছ আমরা তা স্বীকার করি না।” –(সূরা সাবা: ৩৪)
(আরবী**********)
“যখন আমরা জনবসতিকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন আমরা সেখানকার স্বচ্ছল লোকদের হুকুম করি। আর তারা তথায় নাফরমানি করতে শুরু করে; তখন উক্ত বসতির জন্যে আযাবের ফায়সালা হয়ে যায় এবং আমরা উহাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেই।” –(সূরা বনী ইসরাঈল: ১৬)
(আরবী**********)
“এবং বামপন্থী; বামপন্থীরা কতই নিকৃষ্ট। আগুনের মধ্যে থাকবে এবং উথলানো পানির মধ্যে এবং কালো ধোয়ার কুণ্ডুলীর মধ্যে –যা ঠাণ্ডাওও নয় এবং আনন্দদায়কও নয়। এই লোকেরা এর পূর্বে দুনিয়ায় বড় সচ্ছলতার মধ্যে দিনাতিপাত করতো।” –(সূরা আল ওয়াকিয়া: ৪১-৪৫)
মোটকথা লোকেরা যদি সামাজিক জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে তাহলে সর্বাত্মক ধ্বংস ছাড়া কোনই ফল হবে না। ইসলাম মানুষকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে সামাজিক জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হওয়ার উপদেশ দেয়- এই অভিযোগ যে কতবড় মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে সামাজিক অন্যায়কে চুপচাপ দেখতে থাকা এবং উহাকে বন্ধ করার জন্যে চেষ্টিত না হওয়া আল্লাহদ্রোহিতার স্পস্ট নিদর্শন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এতে করে আল্লহর গযব নেমে আসে এবং এমনি করেই একটি জাতি আল্লাহর অভিশাপ ও শাস্তির উপযুক্ত বলে গণ্য হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(আরবী**********)
“বনী ইসরাঈলদের মধ্যে যারা আল্লাহদ্রোহিতহার পথ অনুসরণ করে তাদের উপর দাউদ এবং ঈসা ইবনে মারইয়ামের ভাষায় অভিশাপ দেয়া হয়েছে। কেননা তারা নাফরমানী করেছিল এবং সীমালংঘন করে চলছিল। তারা একে অন্যকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা পরিত্যাগ করেছিল। তারা যা করছিল তা ছিল বড়ই নিকৃস্ট।” –(সূরা আল মায়েদা: ৭৮-৭৯)
হযরত বিশ্বনবী (স) বলেন: (আরবী**********)
“তোমাদের যে কেউ অন্যায় কাজ করতে দেখবে সে যেন তা নির্মূল করার প্রচেষ্টা চালায়।”
(আরবী**********)
“আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বোত্তম জেহাদ হলো জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা।”
পবিত্র কুরআনে আয়াতের সাথে হযরত বিশ্বনবী (স)-এর এই নির্দেশের মাধ্যমে এই সত্য পরিস্ফূট হয়ে উঠে যে, সামাজিক বে-ইনসাফী ও অন্যায়-অনাচার একটি সমাজে কেবল তখনই মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, যখন সেখানকার শাসকগোষ্ঠী ইনসাফ ও কল্যঅণের পথ বর্জন করে চলে। ইসলামের দৃষ্টিতে এমন শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই ফলয়। এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের পথ একমাত্র এটাই। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, ঐ সকল লোক কতবড় অপদার্থ যারা ইসলামকে এই বলে বিদ্রূপ করে যে, উহা মানুষকে চমর মিনতির সাথে যাবতীয বে-ইনসাফী ও জুলুম বরদাশত করার উপদেশ দেয়। বস্তুত এ ধরনের উক্তি কেবল তারাই করতে পারে যারা ধর্ম-বিরোধিতায় একেবারেই অন্ধ, অথবা কুপ্রবৃত্তির আবর্তে সম্পূর্ণরূপেই দিশেহারা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যার বেসাতি করতে সর্বদাই বদ্ধপরিকর।
কুরআনের আয়াতের একটি প্রণিধানযোগ্য দিক
পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়অতে মানুষকে যে আকাশ কুসুম রচনা করতে নিষেধ করা হয়েছে তহার সর্বাধিক কল্যাণকর দিক হচ্ছে এই যে, মানুষ এভাবে যতই খেয়ালী পোলাও পাকাতে থাকবে ততই তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকবে। কেননা তাতে সত্যিকার গঠনমূলক প্রচেষ্টা বলতে কিছুই নেই। এই আয়াতের আরো একটি দিক প্রণিধানযোগ্য; তাহলো: রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতির অস্তিত্ব একটি বাস্তব ও প্রাকৃতিক সত্য। মানুষ ইচ্ছা করলেই এগুলোকে খতম করতে পারে না। এ কারণে তার জন্যে সর্বোত্তম পন্থা হলো এই যে, এগুলোর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের কর্মপদ্ধতিকে নির্ধারিত করে নিবে।
আকাশ কুসুম কল্পনার ধ্বংসকারিতা
আকাশ কুসুম আশা-আকাংখার পেছনে যতই ঘুরে মারুক না কেন তাতে অকল্যঅণ ও অপকরিতা ছাড়া অন্য কিছুই অর্জিত হয় না। কেননা দুনিয়াতে কিছু লোক আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ যোগ্যতা নিয়েই আগমন করে যারা সে কারণে জগতে খ্যাতিমান পুরুষ হিসেবে পরিচিত হয় এবং সকল দিক থেকে মহাসম্মানের পাত্র হয়ে উঠে। আবার কিছু লোক এমনও জন্মগ্রহণ করে যাদের অন্তরে থাকে খ্যাতি ও প্রসিদ্ধিলাভের উৎকট কামনা। কিন্তু সে পর্যন্ত পৌঁছার জন্যে যে যোগ্যতা ও গুণপনার প্রয়োজন তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা ব্যর্থ হয় যেমন পদে পদে তেমনি উহার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না কস্মিনকালেও। এদের অলীক আশা-আকাংখা পূরণের ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। আর তাদের ঈর্ষা, পরশ্রীকারতরতা, ক্ষমতার মোহ, পরনিন্দা ইত্যাদি ব্যধিগুলোকেও কেউ রোধ করতে পারে না। কেননা যে গুণাবলী ও যোগ্যতা থেকে তারা বঞ্চিত তা কোন স্থান থেকে কেউ সংগ্রহ করে দিতে পারে না।
সুখ ও সৌন্দর্যের সমতা
দু’জন মহিলার কথা ধরুন, একজন হচ্ছে রূপ-সৌন্দর্যে অতুলনীয়, হুর-পরীকেও সে হার মানায়। আর একজন হচ্ছে কুশ্রী, কালো ও কুৎসিত। কিন্তু কুশ্রী হলেও সে চায়, মানুষ তাকে সুন্দরী বলুক, তার রূপ-সৌন্দর্য বর্ণনায় মানুষ পঞ্চমুখ থাকুক। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, রূপ-সৌন্দর্য ও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষেত্রে এই উভয় মহিলাকে সমান করা যায় কি? অনুরূপভাবে দু’টি দম্পতির কথা ধরুন। একটি দম্পতি পারস্পরিক ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি, আস্থা ও নির্ভরতার দিক থেকে বেশ সুখেই দিন যাপন করছে; সন্তান-সন্ততির কলকাকরীতেও তাদের সংসার যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু এরই পাশে আর একটি দম্পতি যাবতীয় আনন্দ ও সুখ থেকে বঞ্চিত। সকল প্রকার চিকিৎসা ও প্রতিকারের চেষ্টা সত্ত্বেও সন্তানলাভের সৌভাগ্য থেকে তারা বঞ্চিত। প্রশ্ন এই যে, দুনিয়ার সমস্ত শক্তি একত্র হয়েও কি এদের দাম্পত্য জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে?
একমাত্র পথ
মোটকথা মানব জীবনের এমন অসংখ্য বিষয় বর্তমান যার সমাধান যেমন অর্থনীতি দিতে পারে না, তেমনি কোন সমাজ বা রাষ্ট্রও দিতে পারে না। এই প্রকার যাবতীয় বিষয়ে মানুষের জন্যে যুক্তিসংগত পথ মাত্র একটিই বর্তমান। আর তাহলো এই যে, আল্লাহর ইচ্ছার উপরেই তাদের ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে; অল্পে তুষ্টিই তাদের একমাত্র নীতি; তারা বিশ্বাস করবে, দুনিয়ার মানুষ যা কিছু পায় তার সাথে তার দ্বীনী কাজের সামঞ্জস্যতা অপরিহার্য নয়। দুনিয়ার ব্যর্থতা ও প্রবঞ্চনাকে পারলৌকিক সুখ ও সমৃদ্ধি দিয়ে পুষিয়ে দেয়া হবে।
রাশিয়ার দাবীর অন্তরালে
নিরেট অর্থণৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিতে বিচার করে কে বলতে পারে যে, এই দুনিয়াতেই পূর্ণাংগ সাম্য সম্ভবপর? সমস্ত দুনিয়ার এমন একটি দেশের কথাও কল্পনা করা যায় না যেখানে লোকেরা পারিশ্রমিক ও পদের দিক থেকে একজন আর একজনের সমান। সোভিয়েট রাশিয়ার দাবী ছিল এই যে, সে দেশে পরিপূর্ণ সাম্য স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানকার সমাজে উঁচু-নীচু বলতে কি কিছুই নেই? ধরুন রাশিয়ার একজন কারিগর পদ ও বেতন উভয় ক্ষেত্রেই উন্নতি করার জন্যে বড়ই উদগ্রীব। একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য তার বড় আকাংখা। কিন্তু তার মেধা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়া সত্ত্বেও সে তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। কিন্তু বলূন তো, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার কোন সাহায্য করতে পারে কি? অনুরূপভাবে কোন শ্রমিক যদি শারীরিক দুর্বলতার কারণে নির্ধারিত সময়ের বাইরে অতিরিক্ত সময়ে (Over Time) কাজ করতে অক্ষম হয়। অথচ সে অতিরিক্ত সময়ে কাজ করার আশা করে –যা কেবল একজন সবল শ্রমিকের পক্ষেই সম্ভবপর-তাহলে রাষট্র তার এই আশা পূরণ করতে পারে কি? বলা বাহুল্য এই ধরনের ব্যাপারে রাষ্ট্র কিছুই করতে পারে না। সুতরাং এই ধর নের লোকেরা যদি আশায় বঞ্চিত হওয়ার পরেও আশা একদিন পূর্ণ হবে –এরূপ কল্পনা নিয়ে ঘুরতে থাকে এবং কার্যত কেবল বঞ্চিতই হতে থাকে তাহলে তার পরিণতি এচাড়া আর কি হতে পারে যে, তাদের সমগ্র জীবনই নিছক কল্পনা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকবে; নোংরা চিন্তা-চেতনা, ঈর্ষা-বিদ্বেষ ও পরিশ্রীকাতরতার অক্টোপাসে আবদ্ধ হয়ে থাকবে; এ থেকে মুক্তিলাভের কোন পথ তারা খুঁজে পাবে না। যারা এরূপ মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত –যারা এরূপ অলীক চিন্তায় অস্থির তারা নিজেদের কোন দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। কেননা ক্ষমতার লিপ্সায় এবং উঁচু স্কেল লাভের লোভ তাদেরকে সুস্থভাবে থাকতে দেয় না। লোভ-লালসার এই মারাত্মক ব্যধিকে শক্তি ও ভয়-ভীতির মাধ্যমে দূর করা ভালো, না তাদের মনোরাজ্রে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করে উহাকে স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করার অভ্যাস সৃষ্টি করার পদক্ষেপ নেয়া ভালো? বস্তুত এই শেষোক্ত পন্থার প্রতি ইংগিত করেই পূর্বোক্ত আয়াতে সবর ও কৃতজ্ঞতার পথ অবলম্বন করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
আলোচনার সারমর্ম
এই হলো ইসলামী দাওয়াতের সারমর্ম। ইসলাম মানুষের সকল প্রকার বৈধ আশা-আকাংখা ও প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখে এবং উহা পূর্ণ করার পথ রচনা করে দেয়। কিন্তু সাথে সাথে ঐ সকল সত্যকেও সমর্থন করে যার পরিবর্তন-পরিবর্ধন মানবীর শক্তির অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে যেখানে জুলুম ও বে-ইনসাফী দেখায যাবে সেখানে প্রতিকার করা সম্ভবপর হলে ঈমান এবং আল্লহর সন্তুষ্টি অর্জনের দাবী হবে এই যে, উক্ত বে-ইনসাফী ও জুলূম খতম করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। আল্লাহ বলেন:
(আরবী**********)
“অতপর যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে এবং নিহত হবে কিংবা জয়লাভ করবে তাকে অবশ্যই আমি মহাপুরষ্কার দান করবো।” –(সূরা আন নিসা: ৭৪)
যাইহোক, দুনিয়াতে যদি এমন কোন ধর্ম তাকে তাহলে নিশ্চয়ই তা ইসলাম ধর্ম নয়। কেননা উহা সর্বপ্রকার বে-ইনসাফী ও জুলূমের মারাত্মক বিরোধী। এমনকি উহার সাথে আপোষকারীদেরকেও উহা ভয়ানক শাস্তির উপযুক্ত বলে গণ্য করে।