ইসলাম ও আদর্শবাদিতা
[আদর্শবাদ (Idealism) শব্দটি প্রাচ্রের লোকেরা ভালো অর্থে ব্যবহার করে থাকে। কোন ব্যবস্থাপনার সমগ্র গুণাবলীকে বুঝানোর জন্যেই এ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু আলোচ্য অধ্যায়ে শব্বটিকে এ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। কেননা অত্র পুস্তকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারিত অপবাদ নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। এখানে এই শব্দটিকে প্রতীচ্যে (অর্থাৎ ইউরোপ-আমেরিকায়) যে অর্থে ব্যবহার করা হয় সেই অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতীচ্যৈর লোকদের মতে ‘আদর্শবাদ’ চিন্তা ও কল্পনার রাজ্যে মগ্ন থাকা এবং জীবনের বাস্তব সমস্যা যেমন দারিদ্র, ক্ষুধা, দুঃখ, যন্ত্রণা, জুলুম ও নির্যাতন মুখ-চোখ বুজে সহ্য করার নামান্তর। -যখন দরিদ্র জনসাধারণকে জিজ্ঞেস করা কেউ থাকেজ না, বিপদ-আপদ ও দুঃখ-নির্যাতনের প্রতিকার করার কোন পন্থা থাকে না, তখন তারা অত্যাচারের স্টীমররোলারের নিচে পিষ্ট হতে থাকে এবং পরিস্থিতির অনুকম্পার উপরই আত্মসমর্পণ করে প্রহর গুণতে থাকে। এ জন্যে সংগ কারণেই ইউরোপের লেঅকেরা এই শব্দটিকে বড় ঘৃণার চোখে দেখে। কেননা এটা একদিকে মানুষকে সামন্তবাদী জুলুম ও অবমাননার শিকার হতে বাধ্য করে এবং অন্যদিকে তাদেরকে দার্শনিক কুহেলিকার আবর্তে নিক্ষেপ করে বিভ্রান্ত করে ফেলে। অথচ বাস্তব জীবন ও উহার বিভিন্ন সমস্যার সাথে এই ধরনের দর্শনের কোন সম্পর্কই নেই। বস্তুত এই ধরনের দার্শনিক তত্ত্বের জবাব মানুষ উহার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করেই দিতে পারে। আর এ কারণেই ইউরোপের লোকেরা আদর্শবাদের সকল দিক ও বিভাগ নিয়েই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকে। এই পরিস্থিতি দেকে সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা ইসলামকেও এই শ্রেণীর একটি নিষ্ফল আদর্শবাদ ও অন্তসারশূন্য মতাদর্শ বলে সাব্যস্ত করছে। কিন্তু এতে করে যে তাদের মূর্খতা ও মানসিক পীড়া ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পায় না তা তারা বুঝতেই পারে না।]
সমাজতন্ত্রীদের প্রোপাগাণ্ডা
প্রায়ই আমাদের নিকট প্রশ্ন করা হয়: তোমরা মুসলমানরা যে ইসরামের কথা আলোচনা করছ তা কোথায়? উহার সত্যিকার রূপ তোমাদের কর্মজীবনে কোনদিন দেখা গেছে কি? তোমরা দাবী করছ যে, এটা একটি আদর্শ জীবনব্যবস্থা; কিন্তু বাস্তব জীবনে উহা কোন সময় অস্তিত্ব লাভ করছে কি? এর উত্তরে তোমরা রাসূলে আকরাম (স) ও খোলাফায়ে রাশেদীন –বরং তাদের প্রথম দু’জনের শাসনকালের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বলো। কেননা তোমরা ইতিহাসে আর কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাও না। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-কে তোমরা আদর্শ শাসক বলে গণ্য করো এবং তাকেই তোমরা মূর্তিমান ইসলামী ভাবধারা বলে মনে করো। কিন্তু তার শাসনামলেও সামন্তবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অসাম্য, জুলুম, স্বৈরাচার, মূর্খতা ও মূঢ়তা ছাড়া অন্য কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। তোমরা বলছ যে, ইসলাম মুসলমানদের এই অধিকার দিয়েছে যে, যদি তাদের শাসকরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের নিকট কৈফিয়ত তলব করতে পারে। কিন্তু এটাতো অনেক দূরের কথা, খেলফাতে রাশেদার পরবর্তী সময়ে এই বেচারাদেরকে তাদের শাসকরা কখনো তাদের রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসক নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছে কি?
তোমরা এও দাবী করে থাক যে, ইসলাম এমন একটি ন্যায়ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা উপহার দেয় যা সম্পদের সুষম বন্টনের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু খেলাফাতে রাশেদার আদর্শ যুগেও অর্থনৈতিক বৈষম্য কখনো বিদূরিত হয়েছে কি? তোমরা আরো বল যে, জনসাধারণের রোজগারের ব্যবস্থা করা ইসলামী রাষ্ট্রের একটি মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু সেই সকল লাখো-কোটি বেকার লোকদের সম্বন্ধে তোমরা কি বলতে চাও যারা দারিদ্র ও অনাহারের আবর্ত থেকে বের হওয়ার জন্যে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিতে বাধ্য হয়েছে কিংবা সারা জীবন ধরে বঞ্চনা ও দারিদ্রের শিকার হয়ে ধুকে ধুকে মরছে? তোমরা গর্ব করে বল যে, ইসলাম নারীদেরকে সর্বপ্রকার অধিকারই প্রদান করেছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে নারীরা সে অধিকার কোনদিন ভোগ করতে পেরেছে কি? এটা কি সত্য নয় যে, প্রতিকূল অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ তাদেরকে সে অধিকার ভোগ করার কোন সুযোগই দেয়নি? তোমরা মানুষের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সম্পর্কে বড় বড় বুলি আওড়াও এবং উহাকে আল্লাহভীতির সুফল বলে প্রচার করো। তোমাদের ধারণায় এই আল্লাহভীতির কারণেই শাসক ও শাসিত এবং জাতির বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সুবিচার ও নেকীর উপর ভিত্তি করে যাবতীয় সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে একটি সংক্ষিপ্ত সময় বাদ দিলে এই আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ ও উন্নতির ঝলকানি কোথাও দেখা যায় কি? এই আধ্যাত্মিক উন্নতি শাসকগোষ্ঠীকে অসহায় নাগরিকদের অধিকার কেড়ে নেয়া থেকে বিরত রাখতে পেরেছে কি? এই শাসক মণ্ডলী তাদের আযাদীকে কেমন করে ছিনিয়ে নিয়েছিল? তাই তোমরা যে দুনিয়ার কথাবার্তা বলছো তা এক খেয়ালী বা স্বপ্নের দুনিয়া ছাড়া অন্য কিছুই নয়। খেলাফঅতে রাশেদার যে স্বল্পকালীণ শাসন নিয়ে তোমরা খুব গর্ভবোধ করছ তা থেকে শুধু এতটা প্রমাণিত হয় যে, তখন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন কিচু সংখ্যক এমন ব্যক্তিত্ব বর্তমান ছিলেন যারা ইতিহাসের বিস্ময়কর কাজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এই সকল লোকও তাদের কীর্তিকলাপ ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপার। এবং ব্যতিক্রমধর্মী ছিলেন বলেই তাদের তিরোধানের পর এমন ব্যক্তির আর আবির্ভাব হয়নি এবং তাদের কীর্তিকালাপও আর কখনো দেখা যায়নি। এবং ভবিষ্যতেও আর কোন দিন দেখা যাবে না।”
এই সকল প্রশ্নই সমাজতন্ত্রী ও তাদের সমর্থকরা ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপন করে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলমানদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক এরূপ বিভ্রান্তিকর প্রোপাগাণ্ডার শিকার হয়ে বসে। এর কারণ হলো, ইসলামী ইতিহাস সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ এবং সামান্য যা কিছু জানে তা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের শেখানো বুলি মাত্র।
আদর্শবাদের দু’টি বিভাগ
মূল আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে আদর্শবাদের দু’টি মল বিভাগের পার্থক্য সম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন। আদর্শবাদ বা আদর্শ ব্যবস্থার একটি বিভাগ তো হলো এই যে, উহা কেবল খেয়ালী দুনিয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তব জীবনে উহার কোন চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। আর ইতিহাসেও এমন কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, উহা দ্বারা বাস্তব সমস্যার কোন সমাধান হয়েছে কিংবা উহা অনুসরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। এ ছাড়া আদর্শবাদের অন্য যে বিভাগটি রয়েছে তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা শুধু খেয়ালী দুনিয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটা যে সম্পূর্ণরূপেই বাস্তব এবং অনুসরণযোগ্য তার অকাট্য সাক্ষ্য মানবেতিহাসে বর্তমান এবং মানুষের বাস্তব জীবনেই উহার গভীর ছাপ বিদ্যমান।
মৌলিক প্রশ্ন
আদর্শবাদের এই বিভাগ দু’টিকে সামনে রেখে বিষয়টি সম্পর্কে চিন্তা করলে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আলোচ্য বিষয়ের মূল প্রশ্ন হলো: নিজস্ব প্রকৃতির দিক থেকে ইসলাম কি নিছক একটি অন্তসারশূন্য আদর্শ যার কোন অস্তিত্ব বাস্তব দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায় না? –উহা কি এজন্যে অনুসরণযোগ্য নয় যে, উহার ভেতর-বাইর সবটুকু আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র? কিংবা বিষয়টি এরূপ যে, ইসলাম তো অবশ্যই একটি অনুসরণযোগ্য ব্যবস্থা, কিন্তু প্রতি যুগেই যে এটা ফলপ্রসু হবে এমন দাবী করার যৌক্তিকতা আছে কি?
আদর্শবাদের এই বিভাগ দু’টির মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বর্তমান বা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসলাম যদি একটি নিছক আদর্শ বা কল্পনা হয়ে থাকে তাহলে তো এটা কখনো সম্ভবপর নয় যে, কেউ উহার বাস্তব অনুসরণ করবে –চাই বাহ্যিকভাবে সমাজের বিভিন্ন পরিবেশে ভবিষ্যতে উহাতে যতই পরিবর্তন আসুক। কিন্তু যদি এটা একটি অনুসরণযোগ্য জীবনব্যবস্থাই হয়ে থাকে এবং নিছক কয়েকটি বাহ্যিক কারণ উহার প্রবর্তনের পথে বাধার সৃষ্টি করে তাহলে বিষয়টির প্রকৃতি সম্পূর্ণরূপেই পাল্টে যায়। এমতাবস্থায় প্রতিকূল অবস্থা যদি পরিবর্তিত হয়ে যায়, কিংবা ইসলামের অনুকূলে এসে যায় তাহলে বাস্তব ক্ষেত্রেই উহা অনুসরণ করার আশা করা যায়।
ইসলাম একটি বাস্তব জীবনব্যবস্থা
ইসলাম ‘আদর্শবাদের’ কোন বিভাগের অন্তর্ভূক্ত? এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। কেননা এটা এতদূর স্পষ্ট যে, এ সম্পর্কে দ্বিমতের কোন অবকাশই নেই। ইতিহাসে ইসলাম তার নিজস্ব মহিমায় বাস্তবভাবেই একান্ত ভাস্মর। এতে করে অকাট্যরূপেই প্রমাণিত হয় যে, এটা একটি বাস্তব ও অনুসরণযোগ্য জীবনপদ্ধতি। মানুষ আজও এটা অনুসরণ করে চলতে পারে। এটা কোন অবাস্তব খেয়াল বা কল্পনা নয়। অন্যদিকে মানুষ আজও সেই মানুষ যারা অতীতে ছিল। তাদের প্রকৃতিও তা-ই এবং তাতে কোন পরিবর্তন আসেনি। সুতরাং যে মানুষ একবার প্রথমে ইসলামকে সাফল্যের সাথে অনুসরণকরেছে, এমন কারণ নেই যে, তারা আজ তাকে তাদের বাস্তব জীবনে স্থান দিতে পারবে না এবং উহার অনুসরণ করে সফলকাম হতে পারবে না।
দ্বীনের পুনর্জাগরণের আন্দোলন
আধুনিক যুগের কিছু সংখ্যক উন্নতিকামীর মতে বর্তমান যুগে ইসলামের পুনর্জাগরণ কখনো সম্ভবপর নয়। তাদের ধারণায় দ্বীনের পুনর্জাগরণ প্রচেষ্টা একেবারেই বেকার। কেননা উহার সাফল্যের কোন আশাই নেই। কিন্তু আমরা উন্নতিকামী বন্ধুদের নিকট জিজ্ঞেস করতে চাই, তাদের কথার অর্থ কি এই যে, ইসলামের কারণে প্রথম যুগে মুসলমানগণ নৈতিকতার যে শীর্ষ শিখরে আরোহণ করেছিল এবং সে পর্য়ন্ত উন্নীত হওয়া আধুনিক যুগের মুসলমানদের পক্ষে কি অসম্ভব? যদি এটাই ঠিক হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে: তাদের সেই ক্রমোন্নতির শ্লোগানসমূহ কোথায়? আর তাদের সেই দাবীই বা কোথায়? তাদের তো দাবী ছিল, মানুষ অব্যাহত ধারায় উন্নতি করছে এবং ণৈতিক ও মানসিক অবস্থার দিক থেকে মানুষ এখন বহুগুণ উচ্চ মর্যাদার অধিকারী।
খেলাফাতে রাশেদার স্বল্প স্থায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন
বলা হয় যে, খেলাফাতে রাশেদার আদর্শ যুগ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এরপর মুসলমানদের ইতিহাসে উহার নমুনা একান্তই বিরল। (যেমন হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীযের যুগ) এতে করে কি প্রমাণিত হয় না যে, জীবন পদ্ধতি হিসেবে ইসলাম সত্যিই অনুসরণযোগ্য নয়? এই প্রশ্নের উত্তর অবগত হওয়ার জন্যে বিষয়টি সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। কেননা উহার উত্তর ইতিহাসের পাতায় কোথাও রয়েছে মুসলিম দুনিয়ার নিজস্ব ইতিবৃত্তে আবার কোথাও রয়েছে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও সার্বজনীন সত্যের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে।
স্মরণীয় দু’টি কথা –প্রথম কথা
বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বৈ আমাদের দু’টি কথা স্মরণ রাখা একান্ত প্রয়োজন। প্রথম কথা হলো: খেলাফতে রাশেদার সময়ে ইসলামের প্রভাবে মানুষ যে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে এবং ইসলাম যেভাবে মানুষকে অতীতের সকল গ্লানি ও অধপতন থেকে উদ্ধার কর সভ্যতা ও নৈতিকতার শীর্ষে উপনীত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে তা এমন একটি অভূতপূর্ব ঘটনা যে, তাকে জীবজগতের সাধারণ নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা আদৌ সম্ভব নয়। ইসলাম এই দুনিয়ার বুকে যে সকল অলৌকিক পরিবর্তন আনয়ন করেছে এটাও তার একটা। কিন্তু এই অলৌকিক ঘটনা হঠাৎ করে হয়নি। বরং এর পেছনে ছিল মুসলমানদের নৈতিক বিপ্লব ও পুনর্গঠনের দীর্ঘ ইতিবৃত্ত। এর ফলেই এমন এমনে লোক মুসলমানদের মধ্যে আবির্ভূত হয়েছেন যারা ছিলেন এই অলৌকিক ঘটনার বাস্তব উদাহরণ এবং যারেদ জীবনধারা ছিল এর বাস্তব বিশ্লেষণ –ইসলাম যে তড়িৎ গতিতে সারা বিশ্বেছড়িয়ে পড়েছ মানবেতিহাসে তার কোন নযীর খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের বস্তুগত কিংবা অর্থনৈতিক ভাষায় ইসলামের এই বিস্ময়কর উন্নতির কোন বিশ্লেষণ করা একেবারেই অসম্ভব। যাই হোক, ইসলামের এই অভাবনীয় ব্যাপক বিস্তৃতির একটি ফল হয়েছে যে, এই দ্রুতগতিতে এমন এমন জাতিও ইসলাম গ্রহণ করেছে যারা এখনও পর্যন্ত ইসলামের সঠিক মর্ম ও মূল ভাবধারার সাথে পরিচিত হতে পারেনি এবং ইসলামের সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঠিক গুরুত্ব ও মূল্যও অনুধাবন করতে সমর্থ হয়নি। অন্য কথায় এই নবাগতদের ইসলাম সংক্রান্ত জ্ঞান এত অল্প ছিল যে প্রকৃতপক্ষে উহা না জানারই সামিল ছিল। আর মরার উপর খাড়ার ঘা ছিলযে, ইসলামের প্রথম যুগে নওমুসলিমদের তালিমের জন্যে সরকারের পক্ষে থেকে যেরূপ ব্যবস্থা করা হতো সেইরূপ কোন কার্যকরী ব্যবস্থা এই সকল নবাগতদের জন্যে করা হতো না।
দেখতে দেখতে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে। গণনার দিক থেকে মুসলমানদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু নওমুসলিমদের অধিকাংশই ইসলামের নিয়ম-নীতি ও তালিম থেকে বঞ্চিতই রয়ে যেতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে এক সময়ে মুসলমান শাসকগণ ইসলামের হুকুম-আহকামের বিরোধিতা করতে সাহসীয় হয়ে উঠে। কেননা ঐ সময়ে ইসলামী সমাজে কোন সতর্ক ও প্রশিক্ষিত জনমত ইসলামের স্বপক্ষে একটি প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে তাদের ভুল পদক্ষেপ প্রতিহত করার কোন আন্দোলন বা সংগ্রামও সূচিত হওয়ার অবকাশ হয়নি। এই পরিবেশে শাসকরা তাদের অধিকার হরণ করে নেয় এবং তাদের উপর নানাবিধ অত্যাচার ও অবিচার নির্দ্বিধায় চালাতে থাকে। বনু উমাইয়া, বনু আব্বাস, তুর্কী ও মামলূক রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস এরুপ জুলুম ও নির্যাতনের কলংকে কলঙ্কিত। ইতিহাসের এই সুদীর্ঘ অধ্যায়েই মুসলমান শাসকরা ইসলামকে তাদের সস্তা খেলনায় পরিণত করেছিল এবং মুসলমান জনসাধারণের যাবতীয অধিকার নৃশংসভাবে পদদলিত করেছিল।
দ্বিতীয় কথা
দ্বিতীয় স্মরণীয় কথাটি হলো: ইসলামের কারণে মানবতার যে অভাবনীয উন্নতি সাধিত হয়েছিল তা কোন জড়বাদী বা নিছক কুদরতী অবস্থার অনিবার্য ফল ছিল না। ইসলাম যেরূপে গোটা মানবতাকে একটি মাত্র প্রজন্মের মধ্যেই দাসপ্রথা ও সামন্তবাদী ব্যবস্থার লাঞ্ছনা ও অবমাননার তলদেশ থেকে উদ্ধার করে সামাজিক সুবিচারের সমুন্নত শীর্ষ দেশে পৌঁছিয়ে দিয়েছে তার কোন তুলনা মানবেতিহাসে মিলে না। মানবতাকে অন্ধ ভোগ-বিলাস ও যৌন ব্যভিচার ও প্রবৃত্তির লালসার দাসত্বের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং নৈতিক উন্নতি ও সচ্চরিত্রের শীর্ষ শিখরে আরোহণ করার সৌভাগ্য দান করা হয়েছে।
প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের এই বিস্ময়কর নৈতিক উন্নতি ইসলামেরই একটি অলৌকিক কীর্তি। কেননা হযরত বিশ্বনবী (স) এবং তাঁর সম্মানীয় সহচরবৃন্দ সর্বোচ্চ নৈতিক শক্তির প্রতিনিধি ছিলেন। এই আধ্যাত্মিক শক্তির কারণেই তারা এমন কাজ করতে সমর্থ হয়েছেন যাকে আজ অলৌকিক ব্যাপার বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু যখন তাদের শক্তির এই উৎস শুষ্ক হতে শুরুকরে তখনই তারা অবনতির শিকার হতে শুরু কর। তবুও তাদের অন্তকরণ ইলহামী হেদায়েতের এই নূরের কিছু না কিছু পরিমাণ প্রতি যুগেই বর্তমান থাকে। বর্তমান আলোচ্য বিষয়ে আমাদের ইসলামী ইতিাহসের এই ভাস্মর অধ্যায়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আমরা আকর্ষণ করতে চাই।
আধুনিক যুগে ইসলামের প্রতিষ্ঠা অধিকতর সহজ
বর্তমান যুগে ইলামী জীবন পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা অধিকতর সহজ। কিন্তু একথার অর্থ এই নয় যে, এ যুগে আমাদের বাস্তব জীবনে ইসলামরে প্রাথমিক যুগের ন্যায় কোন আধ্যাত্মিক বিপ্লব সংঘটিত করাই সম্ভবপর নয়; কেননা এখন হযরত বিশ্বনবী (স)-ও আমাদের মধ্যে বর্তমান নেই এবং তাঁর সম্মানীয় সাহাবায়ে কেরামও বেঁচে নেই। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। কেননা বিগত তের শত বছরে মুসলিম উম্মত এবং সমগ্র মানবতা যে ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও উন্নতি হাসিল করেছে সে কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের জগতে যে সকল বিষয়কে এক সময়ে অলৌকিক বলে মনে করা হতো সেগুলো আর অলৌকিক থাকেনি এবং সেগুলো হাসিল করাও আর অসম্ভব হয়ে যায়নি। ঐগলো করার জন্যে যে সকল গুণ ও উপযুক্ততার প্রয়োজন ছিল, আজকের লোকেরা সেদিক থেকে পুরোপুরি যোগ্রতা সম্পন্ন। এ কারণে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের ভাস্বর উদাহরণকে সামনে রেখে বর্তমান যুগে ইসলামী ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা কোন কঠিন কাজ নয়। কেননা আজকের দুনিয়া প্রথম যুগের তুলনায় ইসলামের অধিকতর নিকটবর্তী হয়ে এসেছে। এ কারণে তুলনামূলকভাবে কিছুটা চেষ্টা করলেন আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে পারি।
রাস্ট্র পরিচালকের গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও ইসলাম
দৃষ্টান্ত স্বরূপ আধুনিক যুগে বেশীর ভাগ দেশেই রাষ্ট্র পরিচালকগণকে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়। এবং জনগণের এরূপ অধিকার থাকে যে, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের নির্ধারিত ও অর্পিত দায়িত্ব পালনে যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তাদেরকে বরখাস্ত কিংবা দায়িত্বমুক্ত করতে পারবে। কিন্তু মূলত এই নির্বাচন ইসলামেরই একটি বৈশিষ্ট্যের আধুনিক প্রয়োগ। এই বৈশিষ্ট্য ইসলাম বিশ্ববাসীর নিকট উপস্থাপিত করেছিল আজ থেকে তেরশ’ বছর পূর্বে। নিসন্দেহে হযরত আবুবকর (রা) এবং হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর যুগে এই মূলনীতির বাস্তবায়নে ছিল একটি অলৌকিক ব্যাপার। কিন্তু আজ আর এটা কোন অলৌকিক ব্যাপার নয়। বরং একটি স্বাভাবিক ঘটনা মাত্র। এবং আজ এটা আমরা অতি সহজেই লাভ করতে পারি –কেবল এই শর্তে যে, পূর্ণ এখলাস- আন্তরিকতা ও সততা এবং পূর্ণাংগ দ্বীনদারীর সাথে আমরা যদি আমাদের জীবন গড়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারি। এই মূলনীতিকে যদি আমরা ইংল্যাণ্ড বা আমেরিকা থেকে আমদানী করতে পারি তাহলে ইসলাম নামে উহাকে গ্রহণ করতে পারবো না কেন? –বিশেষ করে যখন এটা কোন নতুন জিনিস নয়, বরং ইসলামে এটা প্রথম থেকেই বিদ্যমান?
মৌলিক প্রয়োজনের সমস্যা
অনুরূপ আরেকটি সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্রীয কর্মচারীদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর সমস্যা। এ সম্পর্কে হযরত বিশ্বনবী (স)-এর যে সুস্পষ্ট বিধান বর্তমান তাতে দেখা যায়, কর্মচারীদের যাবতীয় মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের উপর অর্পিত।
ইসলাম এই মূলনীতিটিকে বাস্তবায়িত করার জন্যে বর্তমান বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের প্রলেটারী একনায়কতন্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়েছে। অথচ ইসলাম শত সহস্র বছর পূর্বেই একনায়কতন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই পরিপূর্ণ সাফল্যেল সাথেই একে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছে। সুতরাং যদি আজ আমরা রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে চাই তাহলে সমাজতন্ত্রের প্রতি তাকাবার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। -ইসলামের দিক নির্দেশনা ও উজ্জল দৃষ্টান্তই এ জন্যে যথেষ্ট।
আলোচনার মূল বিন্দু
আমাদের আলোচনার মূল বিন্দু ছিল, বিশেষ করে কেবল সামাজিক অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণযোগ্য হতে পারে কি? এই মাপকাঠি দ্বারা যাচাই করেই কোন ব্যবস্থা অনুসরণযোগ্য কিনা তা সুষ্ঠুভাবে নির্ণয় করা হয। একমাত্র ইসলামই এই মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম। কেননা প্রকৃতপক্ষে এটাই একটি বাস্তবভিত্তিক কার্যকরী জীবন বিধান। বিশ্বের বুকে একমাত্র এটাই হয়েছিল এমন একটি জীবন বিধান পরিপূর্ণ সাফল্যেল সাথে কার্যকরী হয়েছিল এবং কোটি কোটি মানুষ একে আপন করে নিয়েছিল।
ইসলাম কি নিছক আবেদ ও আকাংখার ফসল?
সমাজতন্ত্রী লেখক গোষ্ঠি ও তাদের সহযোগীরা দাবী করে যে, আধুনিক সভ্যতার প্রাসাদ কেবল বৈজ্ঞানিক সত্যের উপরই গড়ে উঠেছে-অথচ ইসলাম শুধু আবেগ ও আকাংখার আশ্রয়ে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাদরে এই দাবীর পেছনে সত্যতার লেশমাত্রও নেই। ইসলামী আইনের প্রতি একবার দৃষ্টি দেয়াই সমাজতন্ত্রীদের এই দাবীর অসারতা হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে যথেষ্ট। ইসলাম যে আইন ব্যবস্থা দিয়েছে উহা নিছক আবেগ বা আকাংখার ভিত্তিতে গড়ে উঠেনি, বরং নির্ভেজাল সাক্ষ্য ও ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। অনুরূপভাবে খুলাফায়ে রাশেদীনের দৃষ্টান্তও আমাদের সামনে বর্তমান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তারা পরামর্শ পরিষদের সাথে পরামর্শ করার সময়ে কিংবা ইসলামী আইনের কোন ধারা-উপধারার বিশ্লেষণ অথবা উহার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের সময়ে নিছক আবেদ, আকাংখা, রুচি বা সুধারণার উপর ভিত্তি করে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি।
কিন্তু বাস্ত ঘটনা এই যে, জীবনের জন্যে একটি আইন ব্যবস্থা দেয়া সত্ত্বেও ইসলাম কেবল আইনের উপরই ভরসা করেনি। বরং উহা সর্বপ্রথম মানুষের আভ্যন্তরীণ সভ্যতার প্রতি লক্ষ্য দেয় এবং তাদের মধ্যে নৈতিক চেতনাকে এতদূর জাগ্রত করে দেয় যে, তারা নিজেরাই স্বতস্ফূর্তভাবে আইনের আনুগত্য করতে শুরু করে। আর এ জন্যে তাদেরকে ভয় বা লালসা দেয়ার কোন প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা হলো মানুষের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ইসলামী সমাজে আইন ঠিক তখনই প্রয়োগ করা হয় যখন সমাজের সামষ্টিক কল্যাণ ও এর প্রয়োজনীয়তাবোধ করবে এবং চরিত্র সংশোধনের যাবতীয় মাধ্যমেই বেকার বলে পরিগণিত হবে। ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান গনী (রা)-এর বহুল প্রচারিত বাণী:
(আরবী**********)
“আল্লাহ সেই সকল কাজ শক্তি দ্বারা বন্ধ করে দেন যা কুরআন দ্বারা বন্ধ করা যায় না।”
ইসলামী আইনের এই বৈশিষ্ট্যকেই পরিস্ফূট করে তোলে।
ইসলামের পুনর্জাগরণ এখনো সম্ভব–কয়েকটি দৃষ্টান্ত
যারা ইসলামের পুনর্জাগরণের অসম্ভব বলে মনে কাতের তাদেরকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়: হযরত উমর (রা)-এর ন্যায় মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ইতিহাসে রোজ রোজ ঘটে না। কিন্তু এ ধরনের উক্তি দ্বারা প্রকৃতপক্ষে তাদের মানসিক দৈন্যই প্রকাশিত হয়। কেননা ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামী আইনের বাস্তব প্রবর্তনের জন্যে আজ আমাদের হযরত উমর (রা)-এর ন্যায় আদর্শ লোকদের নয়। বরং তাদের ছেড়ে যাওয়া আইন ও উহার বিভিন্ন নযীরের একান্ত প্রয়োজন। কোন কারণ নেই যে, আমরা যদি মুখলিস ও সত্যনিষ্ঠ হই তাহলে তাদের অনুসরণ করতে পারব না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে: হযরত উমর (রা) তার খেলাফতে যুগে এরূপ ফরমান জারী করে দিলেন যে, যদি কেউ অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে চুরি করে বসে তাহলে তার হাত কাটার শাস্তি দেয়া যাবে না। এই আইন সংক্রান্ত নযীরের প্রয়োগের জন্যে ব্যক্তিগতভাবেই হযরত উমরের বর্তমান থাকার বাস্তব প্রয়োজনীয়তা আছে কি? কিছুতেই নেই। কেননা তাঁর এই আদেশ প্রকৃতপক্ষে তাঁর ইজতিহাদ ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। আর ইসলামী আইনের এই মৌলনীতির উৎস ছিল: (আরবী**********)
“সন্দেহ হলে হদ প্রবর্তন করা না।”
হযরত উমর (রা) তাঁর শাসনামলে এই আইনও প্রবর্তন করেছিলেন যে, মুসলমান শাসকরা ধনীদের অতিরিক্ত সম্পদ তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করে দরিদ্র লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিতে পারবে। আধুনিক ইংল্যাণ্ডে আজ ঠিক আইনই অনুসৃত হচ্ছে। কিন্তু অনস্বীকার্য যে, ইংল্যাণ্ডকে এই আইন রচনা করতে কিংবাউহার প্রবর্তনের জন্যে কোন উমরের প্রয়োজন হয়নি। বস্তুত এটা প্রকৃতপক্ষে বর্তমান যুগে ইসলামী আইন অনুসরণযোগ্য হওয়ার বড় একটি অকাট্য প্রমাণ। কেননা এই আইনও হযরত উমর (রা)-এর নিজের রচিত ছিল না; বরং পবিত্র কুরআনের যে আইনের উপর ভিত্তি করে এটা রচিত হয়েছিল সেটি ছিল:
(আরবী***********)
“যাতে করে তোমাদের সম্পদ কেবল ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে।” –(সূরা আল হাশর: ৭)
হযরত উমর (রা) খলীফা হিসেবে এই মতও প্রকাশ করেছেন যে, হুকুমাতের সকল কর্মচারী ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পদ এবং আয়ের উৎসগুলোর ব্যাপক অনুসন্ধান চালানোও হুকুমাতের এখতিয়ার ভুক্ত ব্যাপার। যাতে করে এটা জানা যায় যে, তারা কি এই সম্পদ বৈধ পন্থায় অর্জন করেছে, না অবৈধ পন্থায় আয় করেছে। বর্তমান বিশ্বে সকল রাষ্ট্রেই এই আইন সমর্থন করছে এবং এ আইন অনুযায়ী আমলও করা হচ্ছে। অথচ এখন আমাদের মধ্যে কোন উমর বর্তমান নেই।
হযরত উমর (রা) এই আইনও প্রণয়ন করেছিলেন যে, অবৈধ শিশুদের (যাদের পিতা-মাতার কোন সন্ধান পাওয়া যাবে না) লালন-পালন ও রাক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের যাবতীয় খরচও সসরকারই বহন করবে। যাতে করে পিতা-মাতার পাপের মাশুল নিষ্পাপ সন্তানকে দিতে না হয় সে জন্যেই এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। বিশ শতকের ইউরোপ-আমেরিকাও এরূপ আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছে। এতে করে আরেকবার এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলামী আইন-কানুন প্রবর্তনের জন্যে হযরত উমরের ন্যায় মহান ব্যক্তিদের বর্তমান থাকার কোন আবশ্যকতা নেই। বস্তুত হযরত উমর (রা)-এর এই সীমাহীন গুরুত্বের মূলে যে কারণটি বর্তমান আমরা তারই মুখাপেক্ষী। ব্যক্তি উমরের মুখাপেক্ষী নই। সে কারণটি হলো: হযরত উমর (রা) প্রাথমিক যুগের শ্রেষ্ঠ আইনবিদ বা ফকীহ ছিলেন, ছিলেন ইসলামের প্রকৃত রূহের সাথে পরিচিত। তার ইসলামের আইন ও মূলনীতিরও ছিল গভীর জ্ঞান। তার ব্যক্তিগত জীবনের আদর্শের আলোকে আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর ও সুখময় করে তুলতে পারি। তার ব্যক্তিত্ব সকল স্থান ও কালের সকল মুসলমানের জন্যে একটি পবিত্র ও উন্নতমানের আদর্শ। কিন্তু ধরুন, আমরা যদি তার ব্যক্তি জীবনের গুণাবলী নিজেদের জীবনের বাস্তবায়িত করতে না পারি তাহলেও আমাদের সামষ্টিক ও বাস্তব জীবনের সামগ্রিক কল্যাণের জন্যে তার পরিত্যক্ত ইসলামী আইনের তথা ফিকহার অনুসরণ আমাদের জন্যে যথেষ্ট হতে পারে। কেননা এরূপে আমরা কমপক্ষে অন্যদের দ্বারস্থ হয়ে তাদের আইন ও শাসনতন্ত্র ভিক্ষা করার অপমান থেকে তো বাঁচতে পারি।
ইসলাম খেলাফাতে রাশেদার সাথে নিঃশেষ হয়ে যায়নি
ইসলামী জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে আরো একটি ভুল ধারণা দেখা যায়। বলা হয়: খেলাফাতে রাশেদা এবং হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা)-এর সংক্ষিপ্ত সময় বাদ দিলে ইসলামী জীবনব্যবস্থা কখনো পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু যারা একথা বলে তারা একথা বেমালুম ভুলে যায় যে, খেলাফাতে রাশেদা অথবা হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের পরে ইসলাম একটি ধর্ম এবং জীবন পদ্ধতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য কোন সময়েই হারায়নি; বরং পূর্বে যেমন ছিল তখনও তেমনি ছিল। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, খেলাফাতে রাশেদার পরে সরকারী ব্যবস্থাপনায় পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে এক প্রকার দুর্বলতার পরিবর্তন সূচিত হয়। নতুবা রূহ বা মূল ভাবধারার কিদ থেকে সমাজব্যবস্থা যেমনটি ছিল তেমনটিই ছিল। তখনও সেই সমাজব্যবস্থা ‘বিত্তশালী’ ও ‘গরীব’ কিংবা ‘প্রবু ও গোলাম’-এর ন্যায় কোন শ্রেণী প্রথাকে বরদাশত করেনি। কেননা সেই ইসলামী সমাজব্যবস্থায় সমস্ত নাগরিকই ভ্রাতৃত্বের একই সূত্রে গ্রথিত ছিল; মেহনত ও শ্রমের এবং সুফল ও বরকতের সবাই ছিল সমান অংশীদার।
ইসলামের নিয়ন্ত্রণ পরবর্তী যুগে
এভাবে ইসলামী দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় একমাত্র ইসলামের আইনই দেশের নিয়ন্ত্রণী শক্তি হিসেবে কার্যকরী ছিল। সেই শক্তিই ইউরোপের ন্যায় সাধারণ মানুষকে সামন্তবাদীদের দয়া ও অনুকম্পার উপর ছেড়ে দেয়নি। ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিক দ্বারা মুসলমানদের ইতিহাসের প্রতিটি যুগই উজ্জল হয়ে উঠেছে এবং মুসলমানরা যে বিভিন্ন সময়ে তাদের দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে তার অনেক স্থানেই ইসলামী ঐতিহ্যের এই ঝলকানি আমরা দেখতে পাই। এই প্রসংগে গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ক্রসেডের (Crusade) যুদ্ধে সমগ্র খৃস্টান রাজা-বাদশাহদের পরাজিত করার কাহিনী মানবেতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ব্যাপার। অনুরূপভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চুক্তি পালনের ব্যাপারে মুসলমানদের ইতিহাস এক গৌরবময় অধ্যায়। অতপর জ্ঞানের অন্বেষণ ও অনুশীলন এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তারা এতদূর অগ্রসর ছিলেন যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প কলায় তারাই ছিলেন বিশ্বের পথিকৃৎ। ইসলামের এই প্রজ্জলিত মশালের আলোকেই অবশেষে গোটা ইইরোপ একদিন আলোকিত হয়ে উঠে এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও উৎকর্ষের পথে তারা দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে।
মোটকথা পাশ্চাত্যের লোকেরা বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন যে আকাশ কুসুম কল্পনা সর্বস্ব আদর্শবাদকে ঘৃণার চোখে দেখে সেইরূপ আদর্শবাদের সাথে ইসলামের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। বরং এটা একটি পূর্ণাংগ ও অনুসরণযোগ্য বাস্তব জীবনব্যবস্থা। একবার পরিপূর্ণ সাফল্যের সাথে এই ব্যবস্থা অনুসৃত হয়েছে এবং আজও উহাকে অপেক্ষাকৃত সহজভাবে অনুসরণ করা যেতে পারে। কেননা তেরশ’ বছরের মধ্যে মানুষ যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তা তাদেরকে ইসলামের কাছাকাছি এনে দিয়েছে। এ যুগে যদি সত্যিকারভাবে কোন জীবনব্যবস্থাকে অন্তসারশূন্য অবাস্তব ও অকার্যকর আদর্শবাদিতা বলে গণ্য করা যায় তাহলে সেটি হবে সমাজতন্ত্র। কেননা উহাকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও সাফল্যের সাথে অনুসরণ করা হয়নি। স্বয়ং সমাজতন্ত্রীরাই স্বীকার করে যে, আসল সমাজতন্ত্রের মঞ্চিল এখনো অনেক দূরে। বিশ্ব ধীরে ধীরে উহার দিকে অগ্রসর হচ্ছে মাত্র। যখন সমস্ত বিশ্ব একটি মাত্র বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে এবং দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ সকল মানুষের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করে দেয়া হবে ঠিক তখনই সত্যিকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন ‘গরীব’ ও ‘ধনী’র শ্রেণী সংগ্রামও চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, কেননা শ্রেণী সংগ্রামের মূর কারণ-অর্থনৈতিক বৈষম্যের কোন নাম-নিশানাও দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সমাজতন্ত্রের কাল্পনিক স্বর্গ
সমাজতন্ত্রের উপরোক্ত কাল্পনিক স্বর্গরাজ্যের সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্কই নেই। এটা ‘আত্মপ্রবঞ্চনা’ এবং দুনিয়াকে ধোঁকা দেয়া ছাড়া অন্য কিছুই নয়। সে সকল অলীক কল্পনার উপর উহার সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে উহার সবটুকুই বাতিল এবং ভিত্তিহীন। কেননা না মানুষের মধ্যে কৃত্রিম উপায়-উপাদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্য স্থাপন করা যেতে পারে। না নিছক সম্পাদের সমবন্টনের মাধ্যমে মানুষ সকল সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আর না একথা সত্য যে, মানুষের উন্নতির রহস্য কেবল শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যেই নিহিত। সমাজতন্ত্র এমন একটি আদর্শবাদিতার ধ্বজাধারী যার পেছনে কেবল সেই সকল লোকই ছুটতে পারে যারা বিচার-বিবেচনার সকল যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলেছে! ধূর্তামি আর কাকে বলে যে, এত সত্ত্বেও দাবী করা হচ্ছে যে, এটাই চূড়ান্ত পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক এবং বাস্তব জীবনের সকল প্রকার ঘটনার সাথে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।