ইসলাম ও সামন্তবাদ
অতি সম্প্রতি আমি শুনতে পেলাম, জনৈক ছাত্র এম. এ. ডিগ্রী নেয়ার জন্যে একখানি পুস্তিকা (Thesis) লিখে প্রমাণ করেছে যে, ইসলাম একটি সামন্তবাদী ব্যবস্থা। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, ছাত্রটিকে তো এই ভেবে ক্ষমা করা যায় যে, প্রকৃতপক্ষেই তার জ্ঞানের অভাব এবং এ কারণেই সে ভুল করে বসেছে। কিংবা তার উদ্দেশ্যই ছিল ইসলামকে কলংকিত করা এবং প্রকৃত অবস্থায় সম্যক জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করেই উহাকে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু যে সকল বিজ্ঞ শিক্ষক তাকে উক্ত পুস্তিকার ভিত্তিতে সনদ দিচ্ছেন তাদের দৃষ্টিভংগিকে কিভাবে বিশ্লেষণ করা যায়? ইসলামের সামাজিক ও অর্থনৈকি ব্যবস্থা এবং ইসলামের সামগ্রিক ইতিহাস সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাকে কি নামে আখ্যায়িত করা যায়?
কিন্তু পরবর্তী মুহূর্তেই আমার যখন স্মরণ হলো যে, এই শিক্ষকমণ্ডলী কারা এবং কেমন করে তাদের মন-মগজে অন্যদের মতাদর্শ ও চিন্তাধারা ছাড়া আর কিছু নেই। তারা ভিন্নদেশী এক্সপ্লয়েটেশান (Expliatation)-এর সার্থক ফসল। মিঃ ডানলপের (Dunlop) বিশেষ কর্মব্যস্ততার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শিক্ষকমণ্ডলীই। [মিঃ ডানলপ ছিল একজন ইংরেজ অফিসার। বৃটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষথেকে তাকে মিসরে শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও পরিচালনার জন্যে দায়িত্ব অপর্পণ করা হয়েছিল।] এদেরকে বাহ্যত আধুনিক জ্ঞান অর্জন করার জন্যে প্রেরণ রা হয়েছিল। কিন্তু মূলত এও ছিল তাদের চক্রান্তেরই একটি অংশ মাত্র। -উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক শিক্ষিতদেরকে তাদের নিজস্ব তাহজীব, তামাদ্দুন ও ঐতিহ্য থেকে উদাসীন করেতোলা –যাতে করে তারা নিজেদের ধর্ম, ইতিহাস, বিশ্বাস ও চিন্তাধারাকে ঘৃণা করতে শেখে এবং পাশ্চাত্যের প্রভুদের অন্ধ অনুসারী হওয়াকে গৌরবের কারণ বলে মনে করতে থাকে। এ কারণে এরা যদি ইতিহাস ও ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করার কাজে বরাবর লিপ্ত থাকে তাহলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে?
সামন্তবাদের বৈশিষ্ট্য
মূল বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে সামন্তবাদের মর্ম ও উহার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে আমরা ডক্টর রাশেদ আল বেরভী প্রণীত “আন নেযামুল এশতেরাকী” (সমাজতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থা) নামক পুস্তক থেকে নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি পেশ করছি। পুস্তকখানি অতিসম্প্রতি ইউরোপে প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞ লেখক সামন্তবাদের ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে আলোচনা প্রসংগে বলেন:
“সামন্তবাদী ব্যবস্থাপনা নিছক একটি উৎপাদনী ব্যবস্থাপনা, উহার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে এতে এক শ্রেণীর দাস থাকে। এই ব্যবস্থায় জমির মালিক বা তাদের কর্মকর্তারা উৎপন্ন ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ কিষাণদের কাছ থেকে আদায় করে এবং এই পর্যায়ে তারা কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ সুযোগ-সুবিধাও লাভ করে থাকে। জমিদাররা কিষাণদের নিকট থেকে তাদের খেয়ালখুশী অনুযায়ী যে কোন প্রকার সেবা গ্রহণের অধিকার লাভ করত। কিষাণদের নিকট থেকে নগদ বাবাকীতে জমির খাজনাও নিতে পারত। এর কারণ হলো: সামন্তবাদী ব্যবস্থা তার অধীনস্থ লোকদেরকে দু’টি উল্লেখযোগ্য শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন:
(১) জমিদার ও জায়গীরদার (বা সামন্ত) এবং
(২) কিষাণ ও মজদুর। এদের সামাজিক মর্যাদা এদের কাজ ও দায়িত্বের মানগত পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে যেত। কিষাণ, চাষী ও গোলাম এই সামাজিক মর্যাদা পরিবর্তনের বিভিন্ন নাম। এদের মধ্যে কয়েকটি শ্রেণীর এখন অস্তিত্ব নেই এবং অবশিষ্টগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।”
বিনা পয়সায় বাধ্যতামূলক শ্রম
“কিষাণরা জমিন তৈরী করে বীজ বুনায় এবং ফসল ফলায়। এ জন্যে তাদেরকে কিছু ফসল দেয়া হতো –যাতে করে তারা পরিবার-পরিজনদের কিছু অন্নের ব্যবস্থা করতে পারে। এরূপে ক্ষেত-খামারে তাদের ঝুপড়ি বানাবার জন্যেও কিছু জমিন দেয়া হতো। এই সুবিধাটুকুর বিনিময়ে তারা জমিদারদের ক্ষেতে চাষাবাদের হাতিয়ার ও প্রাণগুলোকে নিয়ে হাল চালাত। ফসল কাটার সময়ে তারা কোন পারিশ্রমিক না নিয়েই মালিকদের কাজ করে দিত। কোন কোন সময়ে তারা নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী হাদিয়া-তোহ্ফাও পেশ করত। অধিকন্তু বাধ্যতামূলকভাবে তাদের নিজ নিজ শস্য জমিদারদের কলে ভাংগাতে হতো এবং আংগুরের রস বের করতে হলেও তাদের মেশিনে গিয়ে বের করতে হতো।”
সামন্তদের বিচার ও পরিচালনার অধিকার
সামন্তবাদী ব্যবস্থায় জমিদাররাই তাদের এলাকায় বসবাসকারী কিষাণদের যাবতীয বিচার ও পরিচালনার সর্বাত্মক অধিকার লাভ করত। এই ব্যবস্থাপনায় ফসলের মূলে থাকত একমাত্র কিষাণরাই। কিন্তু আজকাল স্বাধীনতা বলতে আমরা যা বুঝি সে ধরনের স্বাধীনতা এই কিষাণরা কখনো ভোগ করত না। যে জমিমেন তারা কাজ করত তার মালিক হওয়ার অধিকারও তাদের ছিল না। এ জমিন না তারা বিক্রয় করতে পারত, না তাদের মৃত্যুর পর তাদের সন্তান-সন্ততিরা উহার অধিকারী হতো। না তারা উহা কাউকে দান করতে পারত। তাদের প্রবুরা (জমিদাররা) যখন ইচ্ছা তখনই তাদের বাধ্যতামূলক শ্রম আদায় করত কিংবা বিনা পয়সায় খাটিয়ে নিত। যতবড় ক্ষতিই হোক না কেন এর বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার অধিকারও কারুর ছিল না। এখানেই শেষ নয়; জমিদারদের প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ এই দরিদ্র কিষাণদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে বড় রকমের কর দিতে হতো। এই করের পরিমাণও নির্ধারণ করত এই জমিদাররা। যদি কোন জমিদার তার জমিন অন্য কোন জমিদারের নিকট বিক্রয় করে ফেলত তাহলে উক্ত জমিনের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট কিষাণরাও বিক্রি হয়ে যেত এবং নতুন জমিদারের মালিকানাধীন দাস বলে গণ্য হতো। নিজের জটর জ্বালা নিবারণের জন্যে অন্য কোথাও কাজ করার উপায় থাকত না এবং নিজ ইচ্ছায় নিজের জমিদারকে ছেড়ে অন্য কোন জমিদারের কাজ করার এখতিয়ার থাকত না। মোটকথা সামন্তবাদী যুগের এই কমিউন শ্রেণীকে প্রাচীন যুগের দাস এবং আধুনিক যুগের কৃষকদের মধ্যবর্তী অবস্থা বলা যেতে পারে।”
“কিষাণকে জমিন দেয়া বা না দেয়ার অধিকার ছিল জমিদারের। কোন কিষাণকে কী পরিমাণ দেয়া হবে তা ফায়সালা করার এখতিয়ার ছিল একমাত্র জমিদারের। কিষাণের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হবে তাও নির্ধারণ করত এই জমিদার। এরূপ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়েও জমিদার না কিষাণদের অভাব-অভিযোগ বা অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখত। না এতটুকু পরোয়া করত যে, তার এই সিদ্ধান্তের ফলে পার্শবর্তী সামন্তদের উপর কি প্রবাব পড়বে।”
কিষাণদের পলায়ন
বিজ্ঞ লেখক আরো বলেন: “এই সকল কারণে খৃস্টীয় তের শতকে সেই অবৈধ পলায়ন আন্দোলন শুরু হয় যার অনিবার্য ফল স্বরূপ পরিশেষে ‘কৃষি-কর্মী’র আবির্ভাব ঘটে। ইতিহাসে এই আন্দোলন ‘কিষাণ পলায়ন’ নামে খ্যাত। এর একটি ফল হলো এই যে, জমিদাররা এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছল যে, প্রত্যেক জমিদার তার পলাতক কিষাণকে ফিরে পাওয়ার দাবী করে ফিরিয়ে নিতে পারবে। এই সমঝোতা অনুযায়ী সামন্তরা এই অধিকারও পেল যে, ইচ্ছা করলে তারা জায়গীরে অনধিকার প্রবেশকারী সকল কৃষককে গ্রেফতার করতে পারবে। কিন্তু এতদূর কড়াকড়ি সত্ত্বেও ‘কিষাণ পলায়ন’ রোধ করা গেল না। বরং উল্টো এতখানি বেড়ে গেল যে, ‘পলায়ন’ এই যুগের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হলো। ফলে জমিদাররা নিরুপায় হয়ে নিজ নিজ জমিন চাষ করানোর জন্যে অধিক হতে অধিকতর ভাড়াটিয়া শ্রমিকদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হলো; জমিদারদের পারস্পরিক সমঝোতা বেকার হয়ে গেল। অন্য কথায় বলা যায়, এখন থেকে জমিদার ও কিষাণদের পারস্পরিক সহযোগিতা একটি পরিবেশ সূচিত হলো। বস্তুত এতে করে আরেকটি সুফল হলো এই যে, জমিদাররা এখন থেকে জোর করে বিনা পয়সায় খাটানোর পরিবর্তে শ্রমিকদেরকে নগদ পয়সা দিয়ে কাজ করাতে শুরু করল।”
“অতপর যতই দিন যেতে লাগল ততই কিষাণরা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠতে লাগল। অন্যদিকে পুরানো যুগের ধনিক শ্রেণী ও সামন্তরা তাদের প্রয়োজন এতদূর বৃদ্ধি করেছিল যে, (এই পরিবর্তিত অবস্থায়) তাদের যাবতীয উপায়-উপাদান একত্র করেও তারা সে প্রয়োজন মেটাতে পারল না। কিষাণরা তখন সামন্তদের এই দুরবস্থার সুযোগ গ্রহণ করল। তারা নগদ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করে করে নিজ নিজ প্রভুর নিকট থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে শুরু করল। খৃস্টীয় তের শতকে যখন ‘কৃষি কর্মীদের’ স্বাধীনতা সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে তখন পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। অতপর কাল-পরিক্রমায় যে পরিবর্তনগুলো ঘটে তার মধ্যে সবচে’ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, সামন্তবাদী কাঠামো ভেংগে পড়ার উপক্রম হলো এবং পরবর্তী কয়েক শতকের মধ্যেই তা চিরকালের জন্যে বিলুপ্ত হলো।” [আন নিযামুল এশতেরাকী: পৃষ্ঠা-২২-২৩।]
এই হলো সামন্তবাদী ব্যবস্থার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। উপরে আমরা যে উদ্ধৃতিসমুহ পেশ করেছি তার উদ্দেশ্য হলো: পাঠকবৃন্দ সামন্তবাদী ব্যবস্থা এবং উহার বৈশিষ্ট্যসমূহ পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হন এবং নিছক বাহ্যিক মিল দেখে উহাকে অন্য কোন ব্যবস্থার সাথে তালগোল পাকাবার হাত থেকে বেঁচে যেতে পারেন। প্রশ্ন হলে: এই বৈশিষ্ট্য ও কর্মতৎপরতাপূর্ণ সামন্তবাদী ব্যবস্থা ইসলামী ইতিহাসের কোন্ যুগে এবং কোথায় পাওয়া গেছে?
ভুল বোঝার কারণ
যে বাহ্যিক মিল থাকার কারণে অনেক লোক বিভ্রান্ত হয় এবং বুল করে ঐ সকল সুযোগ সন্ধানী লোকদের জন্যে ইসলামের বিপক্ষে জাজ্জ্বল্যমান মিথ্যা বলার জন্যে অজুহাত সৃষ্টি করে দেয় সেটি হলো এই যে, প্রাথমিক ইসলামী সমাজ দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল: (১) জমিদার ও (২) কিষাণ। কিষাণরা মজিদারদের জমিতে কাজ করত। কিন্তু ইহা নিছক একটি বাহ্যিক মিল মাত্র। শুধু এতটুকু মিল দেখে কোনক্রমেই ইসলামের কৃষি ব্যবস্থাকে সামন্তবাদী ব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করা যায় না।
সামন্তবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহের আলোকে সামন্তবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহকে সংক্ষেপে নিম্নরূপ বলা যায়:
(১) চিরস্থায়ী কৃষি গোলামী।
(২) চাষীদের উপর দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষমতাতিরিক্ত বোঝা অর্পণ। চাষীদের কর্তব্য ছিল:
ক. সপ্তাহে পুরো একটি দিন জমিদারদের ক্ষেত-খামারে বিনা পয়সায় কাজ করতে হবে।
খ. বীজ বপন ও ফসল কাটার সময়ে কোন রূপ বিনিময় ছাড়াই বাধ্যতামূলকভাবে জমিদারের কাজ করে দিতে হবে।
গ. ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান, তেহার-মেলা ও অন্যান্য আনন্দের দিনে নিজেদের হাজারো অভাব-অভিযোগ থাকলেও সবদিক থেকে সুখী ও ধনবান প্রভুদের (জমিদারদের) খেদমতে মূল্যবান উপঢৌকন পেশ করতে হবে।
ঘ. নিজেদের শস্য কেবলমাত্র নিজ নিজ জমিদারদের মেশিনে ভাংগাতে হবে।
(৩) জমিদারদের ক্ষমতা ও এখতিয়ার ছিল সুপ্রশস্ত ও অসীম, যেমন:
ক. নিজেদের খেয়ালখুশী অনুযায়ী যাকে যে পরিমাণ ইচ্ছা সেই পরিমাণ জমি দিত।
খ. কৃষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য তারা নিজেরাই ইচ্ছামত নির্ধারণ করত এবং তাদেরকে তা অবশ্যই পালন করতে হতো।
গ. তারা তাদের জন্যে যে কর নির্ধারণ করত তা তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবেই পরিশোধ করতে হতো।
(৪) জমিদারদের পরিচালনা ও বিচার ব্যবস্থার যে সীমাহীন অধিকার দেয়া হয়েছিল তা তারা কোন রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী নয়, বরং নিজ খেয়াল-খুশীমত প্রয়োগ করত এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্র কোন বাধার সৃষ্টি করতে আসত না।
(৫) সামন্তবাদী ব্যবস্থার পতনের যুগে কোন কৃষক আযাদী হাসিল করতে চাইলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে এক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমিদারদের প্রদান করতে হতো।
সামন্তবাদী ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে সামনে রেখে কে বলতে পারে যে, ইসলামের সাথে এগুলোর দূরতম সম্পর্কও বর্তমান? ইসলামী ইতিহাসের কোন যুগেই এর কোন অস্তিত্ব নেই।
ইসলাম ও কৃষি গোলামী
ইসলাম কৃষি গোলামী (Sorfdom)-কে বিন্দুমাত্রও বরদাশত করে না। উহা গোলামীর একটি মাত্র অস্থায়ী রূপ ছাড়া অন্য কোন রূপকে আদৌ সমর্থন করে না। সেই রূপটির যাবতীয কারণ ও পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্বন্ধে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। উহার আলোকে কোন চাষীকে এক টুকরো জমিনের সাথে আবদ্ধ করে রাখার দাসত্বকে কখনো বৈধ বলার অবকাশ নেই। ইসলামী ইতিহাসে মাত্র এক প্রকার গোলামীই বর্তমান। এরা বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দী হয়ে মুসলমানদের হস্তগত হতো। এতে করে দেখা যায় যে, প্রাথমিক ইসলামী সমাজে গোলামদের সংখ্যা স্বাধীন নাগরকদের চেয়ে খুবই নগণ্য ছিল। এরা মালিকদের ক্ষেতে কাজ করত। পরিশেসে হয় মালিক স্বেচ্ছায় তার গোলামকে আযাদ করে দিত। নতুবা গোলাম নিজে ‘মুকাতাবত’ চুক্তির অধীনে কিছু অর্থের বিনিময়ে আযাদ হয়ে যেত। পাশ্চাত্যের সামন্তবাদী ব্যবস্থায় গোলামদের স্বাধীনতা লাভের এইরূপ কোন সুযোগ বর্তমান নেই। কেননা সে ব্যবস্থায় কিষাণ, চাষী বা শ্রমিকদেরকে স্বাধীনতা দেয়ার আদৌ কোন ইচ্ছা ছিল না। বরং এর সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে এরূপ চেষ্টা করা হয়েছে যে, গোলামীকে স্থায়ী করে তোলা হোক- কিষাণ, চাষী বা শ্রমিকরা আযাদীর চেষ্টা করেও যেন আযাদ হতে না পারে তার জন্যে সকল প্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করা হোক। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে কৃষককে কৃষি-গোলাম মনে করা হতো। জমিনের সাথে সাথে এরূপ গোলামের বেচাকেনাও সম্পন্ন হতো। এ কারণে কোন জমিদার যখন কোন জমিন বেচে ফেলত তখন ঐ জমিনে যে কৃষকরা কাজ করত তারাও বিক্রি হয়ে যেত এবং নতুন মালিকের স্বত্ব বলে বিবেচিত হতো। এই কৃষি-গোলামরা যে জমিনে কাজ করত সে জমিন ত্যাগ করে অন্য কোথাও যেতে পারত না এবং জমিদাদেরর যাবতীয খেদমত ও চাকুরী থেকে অব্যাহতি লাভেরও কোন অধিকার পারে না। উহা জীবন-মরণের মালিক এক ও লা-শরীক আল্লাহর গোলামী ছাড়া অন্য কারুর গোলামী ও আনুগত্যকে কখনো স্বীকার করে না। উহার স্পষ্ট বক্তব্য: কোন মাখলূক বা সৃষ্টজীবের এমন কোন অধিকার নেই যে, তার ন্যায় অন্য কোন মাখলুককে তার গোলাম বানিয়ে রাখবে। কেননা এরূপ হওয়াটাই প্রকৃতি বিরোধী। এরূপ হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন না কোন অনৈসলামিক উপাদান সক্রিয় থাকবে। ইসলাম এ ধরনের গোলামীকে একটি অস্থায়ী রূপ বলে মনে করে। এবং একে কোন মতেই স্থায়ী করতে চায় না; চায় উহার যাবতীয উপায় ও অবলম্বনের সাহায্যে উহাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিতে। এ কারনেই উহা একদিকে গোলামদের মধ্যে স্বাধীনতা লাভের স্পৃহা জাগ্রত করে দেয় এবং অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী গোলামদের সর্ববিধ সহায়তা দান রাষ্ট্রীয কর্তব্য বলে বিধান দিয়েছে।
অর্থণৈতিক জীবনের গণ্ডিতেও ইসলাম এক মানুষের অধীনে আর একজন মানুষের দাসত্বকে কখনো সমর্থন করে না। উহা যুদ্ধবন্দীদেরকে গোলাম বানাবার অনুমতি সন্তুষ্টিচিত্তে দেয়নি, দিয়েছে একান্ত নিরুপায় হয়ে। কেননা তখনকার পরিবেশে এই সমস্যার অধিকতর উৎকৃষ্ট সমাধান অন্য কিছুই ছিল না। যখনই সে সমাধান পাওয়া গেল- গোলামদের মধ্যে মন-মানসিকতার দিক থেকে একটি স্বাধীন সমাজে স্বাধীন নাগরিকদের উপযুক্ততা সৃষ্টি হলো- তখনই ইসলাম তাদের জন্যে আযাদীর পথ উন্মুক্ত করে দিল।
ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি
ইসলামী অর্থনৈতিক কাঠামো কাজের স্বাধীনতা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং একে অন্যের সেবার প্রেরণার ভিত্তিতে রচনা করা হয়েছে। এ কারণেই ইসলামী সরকার উহার আওতাভুক্ত সকল অসহায় ও অক্ষম লোকদের অধিকার ও সুবিধাদির সংরক্ষণ করত; অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় যারা পেছনে পড়ে গিয়ে জীবনযাপনের ন্যূনতম সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতো সরকার তাদের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। ইসলামী সমাজে কেউ ভূস্বামীদের গোলাম হয়ে থাকতে বাধ্য হতো না। কেননা স্বয়ং সরকারই নানা উপায় ও পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের স্বাধীনতা লাভের সযোগ করে দিত। ন্তিু এর বিনিময়ে সরকার কখনো তাকে অবদস্থ করত না- তার স্বাধীনতা ও আত্ম-সম্মানবোধেও কোন আঘাত দিত না। আভ্যন্তরীণ মানসিকতা ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো উভয় দিক থেকেই ইসলম সামন্তবাদী ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। উহা এমন এক যুগে আবির্ভূত হয়ে গোটা মানবতাকে সামন্তবাদী লূঠপাট থেকে রক্ষা করেছিল যখন কেউই আর কৃষি গোলামীর (Serfdom) খপ্পরে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
ইসলামী যুগের কৃষক
সামন্তবাদী ব্যবস্থায় কৃষকদের উপর সীমাতিরিক্ত কর্তব্য ও দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু ইসলামী ইতিহাসে এরূপ কৃষকদের কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসলামী যুগে কোন কৃষক অপরাধী সাব্যস্ত হলে ইসলামের দৃষ্টিতে ভূস্বামীর এ অধিকার থাকত যে, সে ইচ্ছা করলে উক্ত জমি তাকে না দিয়ে অন্য কাউকে দিতে পারত। কিন্তু কোন কৃষকের উপর জুলুম বা দুর্ব্যবহার করার কোন অধিকার তার থাকত না। কেননা ইসলাম ভূস্বামী ও কৃষকের পারস্পরিক সম্পর্ককে প্রবু ও গোলামের ভিত্তিতে নয়, বরং স্বাধীনতা ও সাম্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ভূস্বামী কৃষকের পারস্পরিক সম্পর্কের রূপ
ইসলামের দৃষ্টিতে ভূস্বামী ও কৃষকদের পারস্পরিক আইনগত সম্পর্কের দু’টি রূপ হতে পারে:
(১) পারস্পরিক চুক্তি এবং (২) বর্গাভিত্তিক চাষ (মুজারা‘আত)। পারস্পরিক চুক্তির আওতায় কৃষক জমিনে উৎপন্ন সমস্ত ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ জমিদারকে জমির ভাড়া বাবদ প্রদান করত। অবশিষ্ট ফসলের মালিক হতো এই কৃষক। সে এর সাহায্যে তার নিজরে ও পরিবার-পরিজনদের প্রয়োজন মেটাতো। এমনি করে ইসলামী ব্যবস্থায় শুধু কৃষকদের স্বাধীনতাই সকল দিক থেকে নিরাপদ হতো না; বরং জমিন ও উহার চাষাবাদের যে পদ্ধতি সমীচীন মনে করা হতো তাও অবলম্বন করতে পারত।
মুজারা’আত বা বর্গাভিত্তিক চাষ
অনুরূপভাবে মুজারা’আতের আওতায় কৃষকরা জমিনের ফসলের জমিদারদের সাথে সমান অংশীদার হয়ে যেত। জমিনের চাষাবাদ ও অন্যান্য পর্যায়ে যে অর্থ ব্যয় হতো তা একা জমিদার বহন করত। কৃষক শুধু জমির চাষাবাদ ও দেখা শুনার কাজই করত; অন্য কোন দায়িত্ব তার থাকত না।
ইসলামী কৃষিনীতির বৈশিষ্ট্য
উপরোক্ত রূপ দু’টির কোনটিতেই জবরদস্তি বা বাধ্যতামূলকভাবে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করাবার কোন অবকাশ নেই। কোন জমিদারেরই কোন শ্রমিক বা কৃষককে বেগার খাটানোর কোন এখতিয়ার নেই। এমনকি কোন জমিদার যে শাহী ক্ষমতা বা সুবিধা-সুযোগের মালিক হয়ে কৃষকদেরকে সীমাতিরিক্ত ডিউটির যাঁতাকলে তাদের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নেবে এমন কোন সুযোগও বর্তমান নেই। কেননা ইসলাম জমিদার ও কৃষকদের সম্পর্কের ভিতকে একই রূপ আযাদী, একই রূপ কর্তব্য, একই সুবিধা এবং কিছু নেও কিছু দেও” (Give and Take)-এর সাম্যের উপর রচনা করেছে।
জমি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা
ইসলামী নীতির প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, কৃষকদের এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে যে, জমিনের যে কোন খণ্ডই সে স্বেচ্ছায় ভাড়ার চুক্তিতে বেছে নিতে পারে। অনুরূপভাবে যে কোন জমিদারের যে কোন জমি মুজারা’আতের জন্য নিতে পারে এবং যখন ইচ্ছে তখনই ছেড়ে দিতে পারে।
চুক্তিতে সমতার বিধান
এই ব্যবস্থাপনার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, জমি সংক্রান্ত চুক্তির সময়ে জমিদারের বিপক্ষে কৃষককেও সমান মর্যাদা দেয়া হয়। কোনরূপ চাপ বা ভয়-ভীতির কারণে সে চুক্তি করতে বাধ্য নয়। কেননা সেও ইসলামী সমাজের একজন স্বাধীন নাগরিক। সুতরাং এ ব্যাপারে তার পুরোপুরি অধিকার রয়েছে যে, সে যদি এই চুক্তিকে নিজের জন্যে কল্যাণকর বলে মনে না করে তাহলে সে উহা বাতিলও করতে পারে। জমিদার কোন চুক্তিকে তার উপর চাপিয়ে দেযার অধিকার রাখে না এবং চুক্তি করতে অস্বীকার করলে জমিদার কোন প্রতিশোধমূলক আচরণও করতে পারে না। মুজারা’আতের ক্ষেত্রেও কৃষকরা জমিদারদের বিপক্ষে আইনগতভাবেই সমান নিরাপত্তালাভের অধিকারী। তারা একে অন্যের সমান অংশীদার। জমির উৎপাদিত ফসল সমান দু’ভাগে ভাগ করে নেয়ার সে হকদার।
অবৈধ ফায়দা লোচার পরিবর্ত সাহায্য প্রদান
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পাশ্চাত্যের সামন্তবাদী ব্যবস্থায় ধর্মীয় ও অন্যান্য মেলা বা উৎসব অনুষ্ঠানে সুখী ও ধনী জমিদারদেরকে খুশী করার জন্যে দরিদ্র কৃষকরা বাধ্যতামূরকভাবে মূল্যবান উপহার পেশ করত। কিন্তু ইসলামীসমাজের চিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে দরিদ্র কৃষকরা ধনী জমিদারকে কখনো উপহার দেয়নি। বরং তাদের নিকট থেকে তারা হাদিয়া-তোহফা লাভ ক রত। ইসলামী যুগে সচ্ছল জমিদাররা ঈদ এবং অন্যান্য আনন্দোৎসবে- বিশেষ করে রমযান মুবারকে নিজেদের দরিদ্র কৃষক ভাইদের নিকট হাদিয়া-তোহফা পাঠিয়ে দিত, তাদেরকে দাওয়াত করত এবং সমাজের অন্যান্য অভাবী লোকজনদের সাহায্য করত। অন্য কথায় ইসলামী ব্যবস্থাপনায় সচ্ছল ও ধনী লোকেরা গরীব কৃষকদের নিকট থেকে সভ্য (!) ইউরোপের ন্যায় উপহারের নামে যথাসর্বস্ব কেড়ে নেয়ার পরিবর্তে তাদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্যে নিজেদের অর্থ-সম্পদ মুক্ত হস্তে ব্যয় করত। সুতরাং স্পষ্টতই দেখা যায়: ইসলামে পাশ্চাত্যের সামন্তবাদী ব্যবস্থার ন্যায় কৃষকদেরকে জবরদস্তি বেগার খাটানো এবং অনাবশ্যক সীমাহীন দায়িত্বের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত করার কোন অবকাশ নেই।
নির্যাতনের হাত থেকে কৃষকদের নিরাপত্তা প্রদান
ইউরোপীয় সামন্তবাদী ব্যবস্থায় কৃষকদের অবৈধভাবে গোলাম বানিয়ে রাখার, জবরদস্তি বেগার খাটাবার ও অন্যান্য নির্যাতনের বিনিময়ে জমিদাররা তাদেরকে অন্যের নির্যাতন ও জুলুম থেকে হেফাযত করার বিনিময়ে জমিদাররা তাদেরকে অন্যের নির্যাতন ও জুলুম থেকে হেফাযত করার দায়িত্ব গ্রহণ করত। অথচ বাস্তব ঘটনা এই যে, ইসলামী যুগে কৃষকদের এরূপ নিরাপ্তা প্রদানের কোন প্রশ্নই কোন সময়ে উঠেনি। কেননা মুসলমান ভূস্বামী ও অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা এ ধরনের দায়িত্ব স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবেই পালন করেছে এবং ইহার পরিবর্তে তারা কোনদিন বিনিময় দাবী করেনি। শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যেই তারা এ কাজের আঞ্জাম দিয়েছে। বস্তুত এই নিঃস্বার্থ প্রেরণাই অনাবিল বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত ইসলাম জীবনব্যবস্থাকে অন্যান্য জীবনব্যবস্থার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বলে প্রমাণ করেছে। এক প্রকার ব্যবস্থায় মানুষ অন্য মানুষের উপকার করাতে ইবাদাত বলে গণ্য করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্যে সচেষ্ট হয়। যখন আরেকটি ব্যবস্থায় নিজেদের ভাইদের উপকার করাও এক প্রকার ব্যবস্থা বলে পরিগণিত হয় এবং এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়: মুনাফার অধিক হতে অধকতর পরিমাণ সে নিজেই হস্তগত করবে এবং অন্যকে ন্যূন কল্পে যতটুকু না দিলে চলে না শুধু ততটুকুই দেবে। সুদের পেছনেও এই জড়বাদী হীন স্বার্থ বর্তমান। সুদের যে বেশী পাওনাদার সেই বাজিমাৎ করে এবং জীবনের সকল সুবিধাই সে যাতে কুক্ষগত করতে পারে তার জন্যে সচেষ্ট হয়ে উঠে।
জমি নেয়ার স্বাধীনতা
সামন্তবাদী ব্যবস্থার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল: জমিদারের এরূপ অধিকার ছিল যে, সে যাকে যতটুকু ইচ্ছা ততটুকু জমি চাষ করতে দিত এবং নিজের মর্জিমাফিক দায়িত্ব ও বেগার খাটাবার এক লম্বা-চওড়া ফিরিস্তি তৈরী করে কৃষকের ঘাড়ে বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দিত। এটা ছিল কৃষি গোলামীর এক জঘন্য ইউরোপীয় সংস্করণ। ইসলামের সাথে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। কেননা কৃষি গোলামী (Serfdom) ইহা আদৌ সমর্থন করে না। ইসলামে পাট্টার ভিত্তিতে জমি গ্রহণের ক্ষেত্রে কৃষকের হক ও এখতিয়ার তার ইচ্ছা কিংবা আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। কৃষকের বিপক্ষে জমিদারের কোন কথাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। তার অধিকার শুধু এতটুকুই যে, পাট্টা নেয়ার সময়ে কৃষ যে পরিমাণ অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে সেই পরিমাণ অর্থ যথারীতি দিয়ে যেতে হবে।
অনুরূপভাবে মুজারা’আতের সময়ে কোন্ কৃষক কতটুকু জমি পাওয়ার অধিকারী? ইসলামী ব্যবস্থা এটা নির্ধারণের অধিকারও জমিদারকে দেয়া হয়নি। বরং ইহা নির্ভর করতে কৃষকের মর্জির উপর। বংশের অন্য কোন ব্যক্তি বিশে করে তার পুত্রও যদি কৃষিকার্যে সহায়তা করার জন্যে উপস্থিত হয় এবং অধিক পরিমাণ জমি পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করত তাহলে কোন বাধার সৃষ্টি করা হতো না। মুজারা’আতের নীতি অনুযায়ী কৃষকের যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য কেবল নির্ধারিত জমি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকত। এবং ফসল না উঠা পর্যন্ত উক্ত জমিনের স্বত্ব যৌথভাবে জমিদার ও কৃষকের থাকত। জমিদারের অন্যান্য জমি ও জায়গীরের দায়িত্ব এই কৃষককে বহন করতে হতো না। এবং ইউরোপীয় চাষীদের ন্যায় অন্য জমিতে কাজ করতে বাধ্য থাকত না।
জমিদার খোদাদের পতন
ইসলাম ও সামন্তবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে এই যে, সামন্তবাদী ব্যবস্থায় জমিদাররা কৃষক-শ্রমিকদের পরিচালনা ও বিচারের ক্ষেত্রে যে বল্গাহীন ও যথেচ্ছ অধিকার লাভ করেছিল তার কোন নযীর কেউ কল্পনাই করতে পারে না। নিজ নিজ এলাকার আওতায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ব্যাপারেই তারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারত। তারাই ছিল সকলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু ইসলাম এসে সামন্তবাদী খোদার মূর্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। কেননা উহা অহেতুক সুবিধাবাদের ঘোর বিরোধী এবং উহার অপবিত্র স্পর্শ থেকে মানবজীবনকে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে চায়।
ইউরোপের আইনব্যবস্থা ও সামন্তবাদ
ইউরোপীয়দের নিকট এমন কোন আইন ব্যবস্থাও ছিল না যার আলোকে তারা জমিদার ও কৃষকদের পারস্পরিক সম্পর্কে সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম হতো। পরবর্তী সময়ে রোমের যে আইন পাশ্চাত্যের আইন রচনায় ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে তা সামন্তদেরকে এত সুপ্রশস্ত ও সীমাহীন এখতিয়ার দান করেছিল যে, পরিশেষে তারা নিজ নিজ জায়গীর ও এলাকায় নিরঙ্কুশ বাদশাহ হয়ে বসেছিল। এ বাদশাহরা প্রজাদেরকে শুধু আইনই দিত না, বরং যথেচ্ছভাবে উহার প্রয়োগও করত। এই সামন্তরা একই সময়ে আইনও রচনা করত এবং পরিচালনা ও বিচাকার্যও সম্পন্ন করত। এরূপ এক দিক থেকে তারা রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র কায়েম করে বসেছিল। রাষ্ট্রের চাহিদা মোতাবেক যতক্ষণ তারা ফৌজি ও আর্থিক সাহায্য অব্যাহত রাখতে সক্ষম হতো ততক্ষণ সরকার এই ক্ষুদে বাদশাহদের কোন কার্যেই কোন হস্তক্ষেপ করত না।
আইনের শাসন
ইসলাম এক রাষ্ট্রের মধ্যে আকের রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বিন্দুমাত্রও বরদাশত করত না। ইসলামী ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরাকর থাকে একমাত্র একটাই। এই সরকারই দেশের আইন অর্থাৎ ইসলামী শরীয়তকে সকল নাগরিকের জীবনে সামগ্রিকভাবে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। উহার দৃষ্টিতে সকল নাগরিক একই রূপ সম্মান ও ইজ্জতের অধিকারী। কোন নাগরিককে কেবল তখনই শাস্তি দেয়া যেতে পারে, যখন সত্যিই তার অপরাধ প্রমাণিত হয়। পরবর্তীকালে সরকার যখন ইসলামী নীতি থেকে বিচ্যূত হয়ে রাজতন্ত্রের ছাঁচে ঢালাই হয় তখনও তাতে ইসলামী সরকারের কিছু গুণ বর্তমান থাকে; যেমন, কেন্দ্রীয় সরকারই উহার আওতাধীন সকল নাগরিকের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাবার ব্যবস্থা করত এবং তাদের সকল প্রকার সুবিধা-সুযোগের প্রতি লক্ষ্য রাখত। ইসলামী সালতানাতের অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত কর্মতৎপরতার মাঝেও সর্বত্র একই আইন কার্যকরী ছিল। বস্তুত এই আইনের শাসনই কৃষকদেরকে জায়গীরদারদের জুলুম-নির্যাতন, লুট-পাট এবং যথেচ্ছ পাশবিক আচরণ ও খামখেয়ালীর হাত থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে। কেননা তাদের উপর জায়গীরদার বা জমিদারদের নয়, বরং একমাত্র আল্লহর আইনের শাসন কার্যকরী ছিল- যার দৃষ্টিতে স্বাধীন মানুষ হিসেবে শুধু জমিদার ও কৃষকাই সমান ছিল না, সকল মানুষ সমান এবং একই রূপ ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী ছিল। নিসন্দেহে মুসলমানদের ইতিহাসে দু’ একটি ঘটনা এরূপ পাওয়া যায় যে, কিছু মুসলমান বিচারক ন্যায্য ইনসাফের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ অবলম্বন করে জেনেশুনেই শাসক ও জায়গীরদারদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। কিন্তু প্রথম, ইসলামী ইতিহাসে এরূপ ঘটনার সংখ্যা খুবই নগণ্য। ইউরোপের ঐতিহাসিকরাও একে যৎসামান্য বলে উল্লেখ করেছে। সুতরাং একে ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য কিছুই বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, এই মুষ্টিমেয় দৃষ্টান্তের বিপক্ষে এত অসংখ্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বর্তমান যে, তাতে বিচারকগণ শুধু জমিদার, গভর্নর বা মন্ত্রিদের বিপক্ষে নয়, বরং স্বয়ং খলীফাদের বিরুদ্ধে এবং গরীব ও শমিকদের পক্ষে ফায়সালা দিয়েছেন। অথচ এ জন্যে কোন বিচারককে বরখাস্তও করা হয়নি। কিংবা তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি।
চলাফেরার পূর্ণ স্বাধীনতা
ইসলামী ইতিহাসে ইউরোপের “কিষাণ পলায়ন” –এর ন্যায় কোন আন্দোলনের অস্তিত্ব নেই। এর একমাত্র কারণ ছিল : ইসলামী ব্যবস্থায় কৃষকরা শুধু এক জায়গীর থেকে আরেক জায়গীর নয়। বরং ইসলামী রাষ্ট্রের বিশাল এলাকায় যেখানে খুশী সেখানে যাওয়অর পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করত। তারা ইচ্ছামত স্থান বদলাতে পারত। অবশ্য মিসরীয় কৃষকদের ন্যায় কেউ যদি বিশেষ স্থান ত্যাগ করতে না চাইত তাহলে সে কথা ছিল স্বতন্ত্র। মিসর ছাড়া ইসলামী দুনিয়ার সব এলাকার কৃষকরাই চলাফেরার এই স্বাধীনতার মাধ্যমে নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। কেননা তারা মিসরীয় কৃষকদের মত এক নির্দিষ্ট স্থানের মোহে আবদ্ধ হয়ে থাকেনি এবং ইউরোপেীয় কৃষদের মত নানাবিধ ও আইন ও সামাজিক নির্যাতনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিতও হয়নি।
স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার
ইউরোপীয় সামন্তবাদের ইতিহাসের শেষ যুগে কৃষকরা কেবল মূল্য দিয়েই তাদের স্বাধীনতা ক্রয় করতে পারত। কিন্তু মুসলমানদের ইতিহাসে এ ধরনের কোন নযীর নেই। এর পরিষ্কার কারণ হলো: ইসলামী ইতিহাসে কৃষকদেরকে কখনো কৃষি গোলাম বানানো হয়নি। তারা স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এবং স্বাধীনতার সকল অধিকারই তারা অর্জন করেছে। এ পর্যায়ে অন্যান্য কোন শ্রেণীর লোকদের সাথে কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং ইউরোপীয় কৃষকদের মত তাদের অর্থ দিয়ে স্বাধীনতা ক্রয়ের কোন প্রশ্নই উঠেনি।
মুসলমান জায়গীরদারদের জনহিতকর কাজ
এই প্রসংগে আমাদের আরো একটি বিষয় স্মরণীয়। সেটি হলে : ইতিহাসের প্রতিটি যুগে ইসলামী দুনিয়ায় ছোট-বড় জায়গীর দেখা যায়। এগুলোর আয় থেকে শুধু যে তারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতো তা-ই নয়, বরং স্থল ও নৌপথের বাণিজ্য পরিচালনা এবং শিল্প ও কারিগরীর পৃষ্ঠপোষকতাও করত। অন্য কথায় তাদের এই ভূমিকার ফলে সামাজিক ও জাতীয় কল্যাণের পথ সুপ্রশস্থ হতো। পক্ষান্তরে ইউরোপে যখন সামন্তবাদের অভ্যুদয় ঘটে তখন উহার প্রবল স্রোতে শিল্প ও ব্যবসায়ের যেটুকু যা পূর্বে ছিল তা খড়কুটার মত ভেসে গেল। এরপরে গোটা ইউরোপে মানসকি অবনতি এবং শিক্ষাগত স্থবিরতা যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকে। পরিশেষে ইসলাম এসে তাদেরকে মূঢ়তার অন্ধকার থেকে বের করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে সমুজ্জল করে তোলে। এর একটি সুযোগ হয়েছিল ক্রুসেডের সময়ে। তখনই সমগ্র সুযোগ হয়েছিল যখন স্পেন ভূখণ্ডে তারা মুসলমানদের সম্মুখীন হয়েছিল। ইউরোপ ও ইসলামের এই সম্পর্কের ফলে একদিন জ্ঞানের রাজ্যে রেনেসাঁ আন্দোলনের সৃষ্টি হয় এবং গোটা ইউরোপ ধীরে ধীরে বহু শতাব্দীর ধর্মীয় ও শিক্ষাগত স্থবিরতার হাত থেকে মুক্তিলাভ করে।
ইসলামী দেশসমূহে সামন্তবাদ
ইসলামী দুনিয়ায় ইসলাম যতদিন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় শক্তি হিসেবে কার্যকর ছিল ততদিন কোন ইসলামী দেশেই সামন্তবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। কেননা আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিকভাবে এবং মৌলিক বিশ্বাস ও বুনিয়াদী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ইসলাম ও সামন্তবাদ একটি আরেকটির সম্পূর্ণ বিপরীত। যে সকল কারণ ও পরিবেশের উপর ভিত্তি করে সামন্তবাদ গড়ে উঠে ইসলাম তার প্রত্যেকটিকে অংকুরে বিনষ্ট করে দেয়। মুসলিম ইতিহাসের উমাইয়া ও আব্বাসী যুগে যে জায়গীরদারী ব্যবস্থা দেখা যায় তার পরিসর ও প্রভাব একান্তই সীমিত। উহা কখনো এতদূর বিস্তার লাভ করেনি যাতে করে উহাকে মুসলমানদের সমাজ জীবনের কোন অপরিহার্য অংগ বলে সাব্যস্ত করা যেতে পারে।
ইসলামী দুনিয়ায় পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব
উসমানী শাসনের পতনের শেষ যুগে ইসলামী দুনিয়ায় সামন্তবাদের কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তখন ছিল এমন একটি যুগ যখন মুসলমানদের ঈমান ও আকীদা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নিয়ন্ত্রণ এমন লোকদের হাতে চলে গিয়েছিল যারা শুধু নামে মাত্রই মুসলমান ছিল। ঠিক এই যুগেই যখন পাশ্চাত্যের আল্লাহবিমুখ, জড়বাদী ও ধ্বংসাত্মক সভ্যতা বিজয়ীবেশে ইসলামী দুনিয়ায় প্রবেশ করে, তখন পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়ে উঠে। এই নতুন সভ্যতা মুসলিম দেশসমূহে ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র করে সামরিক অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে, তাদের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলে, পারস্পরিক সৌহার্দ ও সহযোগিতার প্রেরণাকে বিনষ্ট করে দেয় এবং উহার স্থলে পুঁজিবাদী লূঠপাট ও আত্মসাতের জঘন্য লীলা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। আর এর অনিবার্য ফল স্বরূপ গরীব শ্রেণীর লোকেরা এমন এক দুর্ভাগ্য ও প্রবঞ্চনার নির্মম শিকারে পরিণত হলো যে, উহার অক্টোপাস থেকে আজও তারা মুক্তিলাভ করতে পারেনি। ইউরোপ থেকে আমদানী করা সামন্তবাদ এখনও কিছু সংখ্যক মুসলিম দেশে উহার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে পুরোপুরি বর্তমান।
বর্তমান ইসলামী দুনিয়ায় যে সামন্তবাদ চলছে তার জন্যে ইসলাম বা ইসলামী সমাজব্যবস্থাকে বিন্দুমাত্রও দায়ী করা যায় না। কেননা ইসলাম একে সৃষ্টি করেছে, না এর স্থিতি ও বিস্তৃতির জন্যে কোন ভূমিকা রেখেছে। এ জন্যে ইসলামকে শুধু তখনই দায়ী করা যেত যখন মুসলিম দেশসমূহে বাস্তবেই ইসলামী সরকার কার্যকরী থাকত এবং একমাত্র ইসলামী আইন-কানুনই প্রচলিত থাকত। একন যে সকল “মুসলিম (!)” শাসক এই দেশসমূহে হর্তাকর্তা-বিধাতা তারা ইসলামী শাসনের কোন ধার ধারে না। বরং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ধার করা আইন অনুসারে দেশ পরিচালনা করছে।
আলোচনার কয়েকটি বিশেষ দিক
আলোচনা প্রসংগে এমন কিছু সত্য উদঘাটিত করা হয়েছে যাকে কেন্দ্র করে আধুনিক বিশ্বের বহু মতাদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো:
এক। সামন্তবাদের প্রতিষ্ঠায় কেবল ব্যক্তিগত মালিকানাই কার্যকরী নয় যে, উহার বিপক্ষে অন্য লোকদের চেষ্টার আদৌ কোন গুরুত্ব ছিল না। বরং সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় মালিকানা নীতি এবং জমিদার ও ভূমিহীনদের পারস্পরিক সম্পর্কের ফলেই উহা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। এ কারণেই ইসলামী যুগে ব্যক্তি মালিকানা প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও সামন্তবাদী ব্যবস্থার উল্লেখ ও বিস্তৃতি কোনদিনই সম্ভবপর হয়নি। ইসলাম নিছক একটি জীবনাদর্শনই নয়, বরং বাস্তব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সুষ্ঠু সামঞ্জস্য নিয়েই ইসলাম। বস্তুত উহা সমাজের সকল সদস্যের মধ্যে এমন এক অনাবিল ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রচনা করে দেয় যাতে করে কোন সামন্তবাদী ব্যবস্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই না পারে।
দুই। ইউরোপে যদি সামন্তবাদী ব্যবস্থার অভিশাপ অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে তার অর্থ এই নয় যে, এটা মানবীয় উন্নতির এমন এক মঞ্চিল যা অতিক্রম করা একন্তই অপরিহার্য। ইউরোপের এই অভিশাপে জর্জরিত হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল যেখানে কোন নিখুঁত প্রত্যয় ও আদর্শ জীবন পদ্ধতির অস্তিত্বই ছিল না- যাতে করে মানবীয় সম্পকর্সমূহ সমুন্নত ক রার কোন সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। একমাত্র ইসলামী দুনিয়ায় এই নেয়ামত বর্তমান ছিল এবং ছিল বলেই তারা উক্ত অভিশাপ থেকে বেঁচে গিয়েছে। ইউরোপে যদি এই নেয়ামত বর্তমান থাকত তাহলে সেখানে সামন্তবাদী ব্যবস্থা কোনদিন বিস্তারলাভ করতে পারত না।
তিন। অর্থনৈতিক প্রগতির বিভিন্ন স্তর তথা প্রাথমিক সমাজতন্ত্র, দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ এবং দ্বিতীয় সমাজন্ত্র- যা সমাজতন্ত্রীদের “দ্বন্দ্বগত জড়বাদ (Dialectical Materialism) নামক দর্শন হিসেবে মানবেতিহাসের এক অপরিহার্য অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে- একমাত্র ইউরোপীয় ইতিহাসের পাতায় বর্তমান; অন্য কোথাও এর অস্তিত্ব নেই। আর এগুলোর পশ্চাতে কোন শাশ্বত সত্যও নেই। ইউরোপের বাইরে দুনিয়ার কোন জাতিই উপরোক্ত স্তরগুলোর সম্মুখীন হয়নি। ইসলামী দুনিয়ার অবস্থাও অনুরূপ। তার ইতিহাসে সামন্তবাদের কোন অধ্যায় নেই, না সামন্তবাদের কোন স্তর বিরাজমান, আর না এরূপ কোন স্তর আসার সম্ভাবনা বর্তমান।