পশ্চিমের তথ্য –সাম্রাজ্য
‘গ্লোবাল ইনফরমেশন এন্ড ওয়ার্ল্ড কমিউনিকেশন’ বিষয়ক আলোচনায় একজন সমাজবিজ্ঞানী আজকের জটিল জীবন কাঠামোর একটা ছক এঁকেছেন । ছকের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন । তাঁর চারিদিকে রয়েছে সমাজ, রাজনীতি, শিল্প ও অর্থনীতি । আর এসব কিছুকে ঘিরে সাংস্কৃতিক প্রতিবেশের বৃত্ত । এর অর্থ আজকের আধুনিক জীবন কাঠামোর কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন । অন্য কথায় ইনফরমেশন কমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রণ করছে আজকের গোটা জীবন কাঠামোকে ।
ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে গত একযুগে এক আমূল পরিবর্তন এসেছে । এই পরিবর্তন শুধু আঙ্গিক এবং প্রকৃতির ক্ষেত্রে নয়, সংস্কৃতির বিস্তার ও বিন্যাসে এর ভূমিকা নতুন যুগের সূচনা করেছে । আজকের ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশনের মতো গণমাধ্যম নিছক মাধ্যমের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিবেশের সজ্ঞান এবং সক্রিয় অস্ত্রে পরিণত হয়েছে । রেডিও, ভিডিও, ক্যাসেট, টেলিভিশন প্রভৃতি আমাদের প্রতিদিনের জীবন থেকে বিরাট অংশ কেড়ে নিচ্ছে । যেমন আমাদের বাংলাদেশেই প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৪ ঘণ্টারও বেশি সময় নিয়ে যাচ্ছে টেলিভিশন । এর মধ্যে গড়ে দুই তৃতীয়াংশ সময় নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী টেলিভিশন প্রোগ্রাম । এই শেষোক্ত দিকটা খুবই উল্লেখযোগ্য । ইলেক্ট্রনিক্স এবং প্রিন্ট উভয় ক্ষেত্রেই পশ্চিমারা আজ গোটা দুনিয়ায় রাজত্ব করছে । শাসন, শোষণ এবং বাণিজ্য সবই তারা করছে । পশ্চিমা দেশগুলোর রেডিও এবং টেলিভিশন প্রচার মাধ্যম বিশ্বের মোট রেডিও ওয়েভ লেংথের ৯০ ভাগ এবং পশ্চিমা প্রধান নিউজ এজেন্সিগুলো প্রতিদিন মোট নিউজের শতকরা ৮০ ভাগের মালিক হয়ে দাঁড়িয়েছে । তাঁদের প্রচারিত এই নিউজের শতকরা সর্বোচ্চ ২৫ ভাগ উন্নয়নশীল দেশ সংক্রান্ত । এই হিসাব বিবিসি এবং সিএনএন টেলিভিশন বর্তমান পর্যায়ে আসার আগের । সুতরাং সিএনএন এবং বিবিসি টেলিভিশন বিশ্বজোড়া প্রচার শুরু করার পর অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে ।
পশ্চিমের ‘তথ্য’ এবং ‘সংবাদ’ আজ তাঁদের অতি লাভজনক পণ্যে পরিনত হয়েছে । দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এই পণ্য চড়া দামে কিনে থাকে । প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রে এই মূল্য আমরা দিচ্ছি । সিএনএন এবং বিবিসি’র স্টার টিভির মূল্য আমাদের কোন কোন দেশকে হয়তো এখন খুব উচ্চহারে দিতে হচ্ছে না, কিন্তু অভ্যাসটা গড়ে নেবার পর সে উচ্চমূল্য তারা হাঁকবে । তাছাড়া নগদ মূল্যের বাইরে সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনীতি- অর্থনীতি ক্ষেত্রে যে চড়া মূল্য আমরা দিচ্ছি তা আরও মারাত্মক ।
বস্তুত ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলো আজ পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলোর আগ্রাসনের শিকার । এ আগ্রাসনের রূপ সার্বিক । তাঁদের প্রচার মাধ্যমে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই এক ধ্বংসকারী হস্তক্ষেপে রত রয়েছে । উন্নয়নশীল দেশগুলোর জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রচার বা গনমাধ্যম গুলো পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের আগ্রাসনের মুখে ক্ষতিগ্রস্থ এবং সংকুচিত হচ্ছে । এমন একসময় আসছে যখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর শান্তি, শৃঙ্খলা, জনমত গঠন, শিক্ষা এবং উদ্বুদ্ধকরণ সবই গিয়া পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের হাতে বাঁধা পড়বে । তখন আমাদের ভালকে তারা মন্দ বলবে, আমাদের মন্দকে তারা ভালো দেখাবে । এইভাবে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ ষোল আনা আদায় করে নেবে আমাদের কাছ থেকে । কয়েকদিন আগে বিবিসি টেলিভিশন প্রোগ্রামে ভারতের মিজোরাম প্রদেশকে ‘খৃষ্টান স্টেট’ বলে উল্লেখ করা হলো । বলা হলো সেখানে শতকরা ১০০ ভাগই খৃষ্টান । সম্ভবত বাসিন্দাদের ১০০ ভাগ খৃষ্টান বলেই মিজরামকে ‘খৃষ্টান স্টেট’ বলা হয়েছে । অথচ মিজোরাম খৃষ্টান স্টেট নয় । এটা একধরনের উস্কানি । মিজোরামে খ্রিস্টান আগমনের একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে বিবিসি’র টিভি অনুষ্ঠান অনেকটা সময় ব্যয় করেছে যা বিবিসি বা সিএনএন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কোন ভালো দিক দেখানোর জন্য মোটেই করেনা । অবশ্য সময় দেয়, কিন্তু সেসময়টা দেয় আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র, সংঘাত, কুসংস্কার ইত্যাদি খারাপ জিনিস প্রকাশের জন্য ।
অবস্থা এমন হবে সেটা অনেক আগেই বোঝা গিয়েছিলো । এজন্যই এখন থেকে প্রায় দুই যুগ আগে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশনের অর্ডার’ এর দাবী উঠেছিলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষ থেকে । এ প্রেক্ষিতেই জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ম্যাকব্রাইড কমিশন গঠন করে । স্বাধীন এবং ভারসাম্যপূর্ণ সংবাদ প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও সমঝোতা জোরদার করার লক্ষ্যে নতুন, সুবিচারপূর্ণ ও অধিকতর কার্যকর ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশনের অর্ডার’ সুপারিশ করার জন্যে এ কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয় । কমিশনের বিবেচনার মধ্যে যে বিষয়গুলো ছিল তা হলো—
- (১) রেডিও ওয়েভ লেংথের বরাদ্দ পরীক্ষা করে দেখা এবং সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা ।
- (২) উপগ্রহের যুক্তিযুক্ত এবং ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করে একটা চুক্তি সম্পাদন করা ।
- (৩) পশ্চিমী নিউজ সরবরাহের মূল্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য হ্রাস করা ।
- (৪) পশ্চিমী দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে টেকনোলজি হস্তান্তর অবাধ করা ।
- (৫) সংবাদ বিনিময় ব্যবস্থায় অর্থ সাহায্যের জন্য একটা বিশেষ তহবিল গঠন করা যাতে করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও সময়ানুগ তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ সম্ভব হয় ।
- (৬) উন্নয়নশীল এবা তৃতীয় বিশ্বের একটি আধুনিক, শক্তিশালী এবং স্বাধীন নিউজ এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করা । যা নিয়ন্ত্রণ মুক্ত তথ্য সরবরাহের বিকাশ ঘটাবে, জাতীয় সংরক্ষণবাদিতার বদলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করবে, বড় বড় তথ্য মাধ্যমের একচ্ছত্র প্রভুত্বের জায়গায় ছোট মাধ্যমগুলোর প্রতিযোগিতা শক্তি বাড়িয়ে তাঁদের সামনে নিয়ে আসবে এবং তথ্য সরবরাহে সরকারী হস্তক্ষেপই একে বহুমুখী করে তুলবে ।
কিন্তু ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশনের অর্ডার’ গড়ে তোলার জন্য গঠিত ম্যাকব্রাইড কমিশন কাজ করতে পারেনি । তাঁকে কাজ করতে দেয়া হয়নি । শিল্পোন্নত পশ্চিমী দেশগুলো নতুন তথ্য ব্যবস্থার দাবীর মধ্যে তাঁদের তথ্য সাম্রাজ্যবাদের পতন দেখতে পেয়েছিল । তাই তারা এই বিশ্ব তথ্য ব্যবস্থায় এই নতুন ধারনাকে গাজখুরী ( Mere of Fiction) বলে অভিহিত করলো এবং ইউনেস্কোকে চাপ দিলো এই উদ্যোগ পরিত্যাগ করার জন্য । সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট ফাটল সৃষ্টি হলো পশ্চিমী দেশগুলোর সাথে ইউনেস্কোর । সেই সময় ইউনেস্কোর ডাইরেক্টর জেনারেল ছিলেন সচেতন এবং সাহসী একজন আফ্রিকান মুসলিম । তিনি পশ্চিমা দুনিয়ার দাবীর কাছে মাথা নত করেননি । এমনকি ব্রিটেন এবং আমেরিকা ইউনেস্কো পরিত্যাগের হুমকী দিলেও নয় । অবশেষে সত্যিই আমেরিকা এবং ব্রিটেন ইউনেস্কোকে চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দেয় এবং সদস্য পদ প্রত্যাহার করে নেয় । এসব ডামাডোলের মধ্যে ম্যাকব্রাইড কমিশন অচল হয়ে পড়ে । ইউনেস্কোর সেই ডাইরেক্টর জেনারেলও তাঁর পদ হারান । এইভাবে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশনের অর্ডার’ – এর অপমৃত্যু যেমন অপমৃত্যু ঘটেছিলো ঠিক সময়েই ‘নিউ ইন্টারন্যাশনাল ইকনোমিক অর্ডার’ – এর দাবীর ।
মযাকব্রাইড কমিশন ব্যর্থ হয়েছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের দাবী অনুযায়ী ‘নতুন বিশ্ব তথ্য ব্যবস্থা’ আর প্রতিষ্ঠিত হয়নি । তবে নতুন তথ্য ব্যবস্থা দুনিয়ায় এসেছে, তথ্য ব্যবস্থার উন্নয়নও হয়েছে আকাশস্পর্শী । কিন্তু নতুন তথ্য ব্যবস্থা এবং এর আকাশ স্পর্শ উন্নয়ন পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে উন্নয়নশীল দুনিয়ার প্রায় গোটা ‘টাইম এন্ড স্পেসকেই’ দখল করে নিয়েছে । নিউজ এজেন্সীর ক্ষেত্রেও ওদেরই আধিপত্য । প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রেও গোটা দুনিয়া ওদেরই বাজার । প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার তথ্য রাজ্যে সৃষ্টি হয়েছে আজ দুটি পক্ষঃ ‘Have and Have Not’- একপক্ষ সর্বস্বের অধিকারী, আরেক পক্ষ সর্বস্বহারা ।
আধুনিক জীবন কাঠামোতে ‘ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন’ যেখানে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়ের গতি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করছে, সেখানে এই ক্ষেত্রে পশ্চিমা দুনিয়ার হাতের পুতুল হওয়ার অর্থ পশ্চিমের সার্বিক উপনিবেশে পরিনত হওয়া । উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রকৃত অবস্থা গড়িয়ে গড়িয়ে এদিকেই যাচ্ছে । সেদিন আসছে, যেদিন আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি শুধু নয় এবং আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব শুধু নয়, আমাদের নিজ জনগনের চিন্তা- চেতনাকেও ওরা নিয়ন্ত্রণ করবে বিশ্বজোড়া এবং সার্বক্ষণিক ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়া সাম্রাজ্যের সীমাহীন শক্তির মাধ্যমে ।
এই উদ্বেগজনক দিক নিয়ে একসময় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন যথেষ্ট চিন্তা- ভাবনা করেছিলো, কিন্তু জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সেই আগের সুদিন নেই বলে তাঁর পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব বলে মনে হয় না । মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ইসলামী সম্মেলন সংস্থাও এ নিয়ে অনেক চিন্তা- ভাবনা করেছে এবং এখনো করছে । ১৯৮৮ সালে মুসলিম দেশগুলোর তথ্য মন্ত্রীগন জেদ্দায় মিলিত হয়ে সম্মিলিত তথ্য কৌশল ও সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করে । আলোচনা শেষে এই বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তা- ভাবনা ও সুপারিশ তৈরির জন্য একটি সাবকমিটি গঠন করা হয় । এই সাবকমিটি ১৯৮৯ সালের ২১শে অক্টোবর তাঁদের আলোচনা পর্যালোচনার পর যে সুপারিশমালা প্রকাশ করে তাঁর মধ্যে রয়েছেঃ
(১) ইসলামী তথ্য- কৌশল গ্রহন, ইসলামী তথ্য- পরিকল্পনা প্রনয়ন এবং এর সংস্কারের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে ।
(২) সাব- কমিটি কর্তৃক মুসলিম বিশ্বের তথ্য- মাধ্যমের সমন্বয় –সংযোগ, অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করার জন্য ওআইসি সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ করা হয়ঃ
- ( এক ) যোগাযোগ উন্নয়নমূলক প্রজেক্ট গ্রহন ।
- ( দুই ) ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও তথ্য বিনিময়ের খরচ হ্রাস করন ।
- ( তিন ) ওআইসি পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনের ১৫ তম বৈঠকে গৃহীত ‘ইসলামিক টেলিকমিউনিকেশন ফেডারেশন’ সম্পর্কে ‘এ্যাক্ট’- কে অনুমোদন দান ।
(৩) নিম্নলিখিত তথ্য বিষয়ক ইসলামী সংস্থাকে সহায়তা প্রদানঃ
- (এক) ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক নিউজ এজেন্সী ( IINA ) ।
- (দুই) ইসলামিক স্টেটস ব্রডকাস্টিং অর্গানাইজেশন ( ISBO ) ।
(৪) ‘ইসলামিক ইনফরমেশন চার্টার অব অনার’ প্রনয়ন করা ।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও তথ্য সংক্রান্ত আরো ৬টি সুপারিশ করা হয় ।
এই সুপারিশগুলো হয়তো আজকে যা প্রয়োজন, তাঁর সবগুলো পূরণ করেনা । তবু এ সুপারিশগুলো কার্যকর হলে বিশ্ব তথ্য জগতে একটি শক্তির উত্থান ঘটতে পারে । কিন্তু এই ব্যাপারে কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য একটু অগ্রগতি ছাড়া উল্লেখ করার মত কিছুই মুসলিম বিশ্ব করতে পারেনি । সবচেয়ে জরুরী বিষয় ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক নিউজ এজেন্সি’ এবং ‘ইসলামিক স্টেটস ব্রডকাস্টিং অর্গানাইজেশন’ সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী করা । কিন্তু এই ক্ষেত্রে যে লজ্জাজনক ব্যর্থতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা প্রকাশেরও অযোগ্য । ১৯৮৬ সালে জেদ্দাস্থ ইসলামিক নিউজ এজেন্সীতে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো । সেখানে কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম রয়টার, এফপি, এপিদের বিস্তার যখন ক্রমবর্ধমান, তখন IINA তাঁর কাজ গুটিয়ে ফেলেছে কেন ? উত্তরে জানলাম, একমাত্র সৌদি আরব ছাড়া ইসলামিক নিউজ এজেন্সীকে দেয় চাঁদা অন্য কোন মুসলিম রাষ্ট্র পরিশোধ করেনি । ফলে টাকার অভাবে বিশ্বব্যাপী যে নিউজ এজেন্সী তারা গড়ে তুলছিল তা তাঁদের গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে । যে চাঁদা তারা পাচ্ছে তাঁর ভিত্তিতে যতটুকু কাজ করা যায়, তা তারা করছে । ইসলামিক স্টেটস ব্রডকাস্টিং – এর ব্যাপারেও ঐ একই কথা প্রযোজ্য । মক্কা ভিত্তিক ‘ভয়েস অব ইসলাম’ নামে ব্রডকাস্টিং স্টেশন গঠিত হয়েছে কিন্তু তাঁর ভয়েস আমরা শুনতে পাইনা । অথচ এই ‘ভয়েস অব ইসলাম’ এবং ‘ইসলামিক নিউজ এজেন্সী’ আজ পশ্চিমী সিএনএন, বিবিসি, রয়টার, এপি এবং এএফপি- এর মতো বিশ্বে স্থান লাভ করা উচিৎ ছিল । কিন্তু তা হয় নি । হয় নি এই কারনে যে, মুসলিম দেশগুলো এই ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় নি । অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোর জাতীয়ভাবেও সাধ্য নেই যে, তারা সিএনএন, বিবিসি, এএফপি- এর মোকাবেলা করবে ।
সুতরাং সংগতভাবেই আজ আমরা পশ্চিমী তথ্য সাম্রাজ্যবাদের অসহায় শিকারে পরিনত হয়েছি । অসহায় বলছি এই কারনে যে, আমাদের আকাশকে যে সিএনএন এবং বিবিসি –এর জন্য খুলে দিয়েছি তা আমাদের অসহায় হওয়ার জন্যই । একদিকে তাঁদের প্রস্তাব আমাদের কাছে আদেশ যা অস্বীকার করার সাধ্য আমাদের নেই, অন্যদিকে আমাদের কাছে সিএনএন এবং বিবিসি- এর কোন বিকল্প নেই । অবশ্য আমাদের অসহায়ত্বকে ঢাকা দেবার জন্য আমাদের সরকারী কর্মকর্তারা বলছেন যে, তথ্যের অবাধ গতির প্রতি শ্রদ্ধাবশতই তারা এটা করেছেন । এটা যে দুর্বলের অসহায় আত্মতৃপ্তি তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ অন্তত আমার নেই ।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই আত্মতৃপ্তি ‘ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন’ এর মতো এমন একটি বিষয় নিয়ে যা আমাদের আধুনিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের গোটা জীবনকেই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করছে । সাবধান না হলে এই আত্মতৃপ্তি আমাদেরকে এক নয়া উপনিবেশবাদের অক্টোপাসে ঠেলে দিতে পারে । যে উপনিবেশবাদ আজ ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ এর মোহনীয় পোশাক পরে সামনে এগুচ্ছে যার বাম হাতে আছে ‘মুক্ত বা বাজার অর্থনীতি’ এবং ডান হাতে আছে ছক কাঁটা এক ‘গণতন্ত্র’ এবং মাথায় আছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত বিশাল ‘তথ্য শক্তির সাম্রাজ্য’ ।