ঊনবিংশ শতকের অনন্য জাতীয় উত্থান
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ ভারতে বিস্ময়কর এক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। বাংলাদেশের টেকনাফ হতে ভারতের পশ্চিম সীমান্তের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল পর্য্ন্ত লক্ষ লক্ষ মুসলমানের চেতনাকে উজ্জ্বল করে তুলল এই আন্দোলন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ঘরবাড়ি ছাড়া, হিজরতের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, শাহাদাতের অভিলাষে সদা উন্মুখ লাখো যুবক বৃদ্ধের চোখে চেহারায় ইসলামের সোনালী যুগ যেন আর একবার ঝিলিক দিয়ে উঠল। এই আন্দোলনের কদর্য করার জন্য ইংরেজরা এর নাম দিল ওহাবী আন্দোলন। কেউ একে বলল সংস্কার আন্দোলন, কেউ একে নাম দিল জেহাদী আন্দোলন, কারও চোখে এটাই ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের প্রথম আযাদী আন্দোলন। আসলে এটা ছিল ভারতে প্রথম সুসংবদ্ধ ইসলামী আন্দোলন। ব্রিটিশ এবং আন্দোলনের আরও যারা বিরোধী তারা একথাটি সত্যিই বুঝেছিল, কিন্তু এদিক হতে সকলের দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখার জন্যই এর একটি ভয়ংকর রূপ ব্রিটিশ এবং হিন্দু বুদ্ধিজীবিরা সবার সামনে তুলে ধরল। তবু তাদের গালাগালি ও কুৎসা রটনার ফাঁক গলিয়ে সত্য তার আসল রূপ নিয়ে বেরিয়ে এল বারবার। ১৮৭০ সালের ২ আগস্ট “হিন্দু প্যাট্রিয়ট” পত্রিকা লিখলঃ
“ওহাবীরা তো ছড়িয়ে আছে সারা ভারতময়, আমাদের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে ও হায়দরাবাদের মতো শক্তিশালী ও সদা উত্তপ্ত মুসলমান রাজ্যেও তাদের সংখ্যা খুবই বেশি।………..ওহাবীরা খুব বিপজ্জনক সম্প্রদায় এবং সারা ইসলামিস্তানে (ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে) বিস্তৃত। ……..ওহাবী আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল ইসলামের মূল উৎস আরব দেশে এবং বর্তমানে সমগ্র মুসলিম জগতে ছড়িয়ে পড়েছে। ওহাবী প্রচারকরা খ্রিস্টান মিশনারীর মতোই অসংখ্য এবং তেমনই স্বধর্মনিষ্ঠ। বিরুদ্ধবাদী হলেও ওহাবীরা গোঁড়া মতবাদীদের চোখে কঠোর সংযমশীলতার জন্যে শ্রদ্ধার পাত্র। ………….
জেসুস্টদের মতোই ওহাবীদের নিজস্ব সংগঠন আছে, তাদের প্রচারকদিগকেও রীতিমতো টাকা পয়সা দেয়া হয় এবং এসব টাকা পয়সা আসে সংসারী লোকদের নিকট হতে আদায়কৃত তহবিল হতে। ওহাবী সম্প্রদায়ের লোকরাও একটি সুনির্দিষ্ট পথ ঠিক করে নিয়ে সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে নীরবে কাজ করে যায়, কেউ দৈনন্দিন বেচাকেনার কাজ করে, কেউ বা কখন কাফেরদের আদালতে কেরানীগিরির কাজও করে। কিন্তু কখনও তারা নিজেদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য কিংবা রাজনৈতিক লক্ষ্য ভুলে না। তারা অলক্ষ্যে আরও সুচারুভাবে এসব উদ্দেশ্যে কাজ করে যায়, টাকা পয়সা সাহায্য দিয়ে নতুন মতাবলম্বী সংগ্রহ করে এবং দূরের ও নিকটের সহকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রেখে ভারতে কিংবা আরবেই হোক জেহাদ পরিচালনা করে। এই আন্দোলনটা নিঃসন্দেহে সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ তার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীতে ইসলামের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করা, আর এ উদ্দেশ্যে ইসলামের অনুসারীদের সত্যিকারভাবে ইসলামে ফিরিয়ে এনে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন ঘটানো।”
উইলিয়াম হান্টার তাঁর ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে ওহাবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন উক্তি করেন। ওহাবীদের সমালোচনার ফাঁকে ফাঁকে অনেক সত্য বের হয়ে এসেছে তাঁর কলম থেকে। তিনি লিখেনঃ
“তারা (ওহাবীরা) ইসলামের একেশ্বরবাদী, একনিষ্ঠ ও বাস্তবনৈতিকতাই হচ্ছে তাদের শক্তির প্রধান উৎস। তারা প্রাণপণে চেষ্টা করে আদিম ইসলামের অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে, রীতিনীতিতে সেই সহজ সরলতা, জীবনধারায় সেই রকম পবিত্রতা এবং ইসলাম প্রচারে সেই রকম দৃঢ়তা অবলম্বন করতে। তাদের মুলমন্ত্র হচ্ছে দুটি-আল্লাহর একত্ব ও আত্মোৎসর্গ। ………….আল্লাহর ইচ্ছার ওপর যে অকুন্ঠ নির্ভরতা হযরত মুহম্মদের (স) সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল, সেটাই তারা প্রত্যেক মুসলমানের কাছে দাবি করতো।……………..ওহাবীরা কোনো একটি অর্থবান এবং শক্তিশালী শ্রেণী বিশেষের দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। আমি আগেই বলছি এবং এখনো আনন্দের সঙ্গে বলছি যে, তাদের মধ্যে এমন হাজার হাজার খাঁটি ধার্মিক ব্যক্তি আছে্ন, যারা আত্মনিগ্রহকে জীবনের প্রথম কর্তব্য হিসেবে জ্ঞান করেন। এই দিকটাই তাদের সমগ্র সংগঠনের ওপর কল্যাণ করেছে এবং বিষয় বাসনাদগ্ধ সরকারি লোকদের চোখে সম্ভ্রম, এমন কি ধর্মীয় পবিত্রতা এনে দিয়েছে। ওহাবীদের মনে নিজের জন্য ভয় নেই, অন্যের জন্য দুঃখ নেই। তারা জীবনের পথ ঋজু ও পরিষ্কার এবং কোন সাবধান বাণী বা শাসন বাণী তাকে ডাইনে বা বাঁয়ে নোয়াতে পারে না।”
ওহাবী আন্দোলন তথা ইসলামী আন্দোলন এর চরম বিদ্বেষী ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ এবং এ আন্দোলনের কঠোর সমালোচক ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতিনিধি উইলিয়াম হান্টার সাহেবের উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোতে ঐ আন্দোলন ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের যে চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করলাম তার মধ্য দিয়েই ইসলামী আন্দোলনের চরিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বস্তুত প্রকৃতই এটা ছিল এক নির্ভেজাল আদর্শবাদী এক গণ আন্দোলন। এ আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী। ১৮৩১ সালের ৬ মে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বালাকোট উপত্যকায় এক ভয়ংকর অসম যুদ্ধে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন।
বালাকোটে শহীদানের লাশের মিছিলে ওহাবী আন্দোলন তথা ইসলামী আন্দোলন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল এটাই ইতিহাসের স্বাক্ষ্য। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন এর মহান নেতা সৈয়দ আহমদ শহীদ ভারতে ইসলামী আন্দোলন এর যেমন প্রথম নেতা নন, শেষও নন। ভারতে এ ইসলামী আন্দোলন গড়ে ওঠার ইতিহাস যেমন দীর্ঘ তেমনি এর শেষ হওয়ার ইতিহাসেরও আজ শেষ হয় নি। সেই ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। ভারতের ঊনবিংশ শতকের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে মনোযোগ দেবার আগে আঠার শতকের আরব ভূমিতে একবার ফিরে যাওয়া দরকার। আগেই বলেছি ভারতের এই ইসলামী আন্দোলনকে ‘ওহাবী আন্দোলন’ বলে আখ্যায়িত করেছিল বৃটিশরা এব উপরে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার উদ্ধৃতিতে দেখেছি, ওহাবী আন্দোলন ইসলামের মূল উৎস আরব ভূমিতে জন্ম নিয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে আরবে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল, যে আন্দোলন ঊনবিংশ শতকে ভারতীয় ইসলামী আন্দোলনকে প্রেরণা দিয়েছিল, সে আন্দোলনের নায়ক ছিলেন মুহম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী, তাঁর আন্দোলন ছিল ইসলামী আন্দোলন। বৃটিশরা মুহম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীর আন্দোলনকে স্বতন্ত্র এক মাযহাব হিসেবে চিহ্নিত করতেও অপপ্রয়াস চালিয়েছিলেন। কিন্তু আবদুল ওহাব কোন মাযহাব সৃষ্টি করেন নি। বিশ্বনবী ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে ইসলামের যে রূপ ছিল সে নিষ্কলুষ ও নির্ভেজাল ইসলামের প্রত্যাবর্তনই ছিল তার লক্ষ্য। তিনি বলতেন, “ধর্ম কোন শ্রেণীবিশেষের একাধিকার নয়। কুরআন হাদীসের ব্যাখ্যা দেয়াও কোন ব্যক্তি বিশেষ বা শ্রেণীবিশেষ এর একাধিকার নয়। কোন যুগ বিশেষের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যেক ‘আলিম’ বা শিক্ষিত ব্যক্তির অধিকার আছে কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা দেয়ার।” যে সব জিনিস বিদআত, শিরক ও কুফরের প্রশ্রয় দেয় এবং ‘ইলহাদ’ বা ধর্মবিরুদ্ধ, সে সবের উৎখাত করতে তিনি বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। আল্লাহর তাওহীদ জ্ঞানে এতোটুকু অন্য ভাব অনুভূতির প্রশ্রয় দেয়া তার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। তার মৌল শিক্ষাই ছিল লা শরীক আল্লাহর একান্ত ও অকুন্ঠ নির্ভরতা এবং স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে যাবতীয় মধ্যস্থতার অস্তিত্ব বা চিন্তার বিলোপ সাধন, ওলি ও পীরদের প্রতি মুসলমানদের পূজা, এমন কি হযরত মুহাম্মদেরও আধা ঐশ্বরিক রূপ কল্পনার বিলোপ সাধন। কবরে সৌধ নির্মাণ তাঁর মতে পৌত্তলিকতারই শেষ চিহ্ন মাত্র। কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা বা নির্দেশের প্রত্যক্ষ বিপরীত হলে যুগ ও পরিবেশের কারণোদ্ভূত সমস্যার সমাধান ইজতিহাদের মাধ্যমে হওয়া উচিত, এ প্রত্যয়ে তিনি দৃঢ় ছিলেন। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী এভাবে তৌহিদের শিক্ষারই পুনরুজ্জীবন দান করেছিলেন। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদ ও ইসলামী পুনরুজ্জীবন আতঙ্কে ভীত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ একেই অভিহিত করেছিলেন ওহাবী আন্দোলন বলে।
মুসলিম জাতীয় জীবনের এক ঘোর দুর্দিনে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব আরবে এ ইসলামী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। স্যার উইলিয়াম হান্টার তাঁর ‘দ্যা ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে এই চিত্রটা এঁকেছেন এইভাবে। ১৮১৭ সালে তিনি লিখেছেনঃ
“প্রায় দেড়শো বছর আগে এক তরুণ আরবে হজ্জ করতে এসেছিলেন। তাঁর নাম আবদুল ওহাব। তিনি ছিলেন নজদের এক ক্ষুদ্র সরদারের পুত্র। সহযাত্রী হজ্বযাত্রীদের লাম্পট্য ও ভাঁড়ামি শহরটিকে কলুষিত করে ফেলেছে দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। তিনি দামিশকবাসী মুসলমানদের দুঃশ্চরিত্র ও দুর্নীতি সম্পর্কে গভীর চিন্তা করেন এবং শেষে প্রকাশ্যে এসবের নিন্দা করতে আরম্ভ করেন। তিনি প্রকাশ্যে তুর্কি আলেমদের এভাবে নিন্দে করতে থাকেন যে, তাঁরা নিজেদের আচার অনুষ্ঠানের দ্বারা আল্লাহর লিখিত বাণীকে অকেজো করে ফেলেছেন এবং অবর্ণনীয় পাপাচারের ফলেই তুর্কী জাতটা আজ কাফেরদের চেয়েও ঘৃণ্য হয়ে উঠেছে।”
বস্তুত অন্যায়, অবিচার ও সত্য বিকৃতির বিরুদ্ধে আপসহীন বিদ্রোহ এবং ইসলামকে তার স্বরূপ প্রতিষ্ঠার আকুল আকাঙ্খা নিয়ে কর্মজীবনে যাত্রা শুরু করেছিলেন মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার আন্দোলনকে যদি আধুনিক ইসলামী আন্দোলনের প্রথম অধ্যায় ধরা যায়, তাহলে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীর আন্দোলন ছিল ইসলামী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। বস্তুত আরব ভূমির নজদ প্রদেশের উমাইনা অঞ্চলে তামিম গোত্রের বনু সিনাম বংশে ১৭০৩ সালে জন্ম গ্রহণ করা শিশু মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব অষ্টাদশ শতকের চতূর্থ দশকে ৪শ বছর আগে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ফেলে যাওয়া ইসলামি আন্দোলনের পতাকা আবার সমুন্নত করে তুলে ধরেছিলেন। জেলে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীর জীবনও সুখের ছিল না। মুজাহিদের বিপ্লবী কন্ঠকে কেউ বরদাশত করতে চায় নি। শহর হতে শহরে বিতাড়িত হয়ে ফিরেছেন তিনি। অবশেষে তিনি আশ্রয় পেলেন মরহুম শাহ ফয়সালের পূর্ব পুরুষ আমির মুহাম্মদ ইবনে সউদের দরবারে। মুহাম্মদ ইবনে সউদ তখন মরুপল্লী দরিয়ার আমির। আমির সউদ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীকে শুধু সাদরেই গ্রহণ করলেন না, তার আন্দোলনেও শরীক হলেন। এইভাবে আবদুল ওহাব নজদীর যাযাবর আন্দোলন আরব ভূমিতে শেকড় গড়ে বসার সুযোগ পেল। তারপর ছড়িয়ে পড়েতে থাকল চারিদিকে। এরই সমান্তরালে দিল্লীর শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী, তার ছেলে শাহ আবদুল আজীজ এবং আমীর সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ইসলামি আন্দোলনের অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করেন ভারতে। আশ্চর্যের বিষয় ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ইসলামি আন্দোলনের পুরোধা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী এবং মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীর জন্মকাল একই বছর। উভয়ের জন্ম ১৭০৩ সালে (মতান্তরে আবদুল ওহাব নজদী এক বছরের ছোট)। আর উভয়ের কাজ ও আন্দোলনের পটভূমি ছিল একই রকমের। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী যখন তার আন্দোলনের বুনিয়াদ গড়েছিলেন, ভারত উপমহাদেশে মুসলিম জাতীয় জীবনে তখন ঘনায়মান এক দুর্যোগ। দরবেশ সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী জন্মগ্রহণ করেন। সুতরাং বড় হয়ে যখন তিনি জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করলেন, দিল্লীর সিংহাসন তখনও টিকে ছিল, নামমাত্র একটা শাসনও ছিল, কিন্তু মোগল রাজদন্ডের শক্তি ও শৌর্য তখন অস্তমিত। টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে মোগল সাম্রাজ্য। মুসলিম রাজশক্তির এই দুর্বলতার সুযোগেই উদীয়মান হিন্দু রাজশক্তি মারাঠা ও রাজপুতরা ঐক্যবদ্ধভাবে তিন দিক হতে ঘিরে ফেলেছে তখন দিল্লীকে। শুধু দিল্লী দখল নয়, ৮শ বছরের মুসলিম শাসনের সকল চিহ্ন মুছে ফেলতে তারা বদ্ধপরিকর। অন্তর্বিরোধে জর্জরিত ও গৃহবিবাধে উত্তর ভারতের মুসলিম শাসকরা এ ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে উদাসীন। মারাঠা, জাঠ ও রাজপুতদের সম্মিলিত বিশাল শক্তিকে মোকাবিলা করার শক্তি যেমন তাদের নেই, তেমনি মোকাবিলা করার কোন উদ্যোগও কোথাও ছিল না। দিল্লীর রহিমিয়া মাদ্রাসায় বসে নীরব দৃষ্টিতে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী। তিনি দেখতে পেলেন, দিল্লীর দ্বারপ্রান্তে আছড়ে পড়া মারাঠা জাঠ রাজপুতদের উত্তপ্ত তরঙ্গের অগ্রগতি যদি রোধ করা না যায়, তাহলে ভারতের ইতিহাস পাল্টে যাবে। ভারতব্যাপী আবার নেমে আসবে দাহিরী শাসন-নিশ্চিহ্ন হবে মুসলমানরা। প্রাণ কেঁদে উঠলো শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর। হাতে সময় নেই, সিন্ধিয়া, হোলকার ও বিশ্বাস রাওয়ের নেতৃত্বে তিন লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী ছুটে আসছে দিল্লীর দিকে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী জরুরী সাহায্যের আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখলেন কাবুলে আফগানরাজ আহম্মদ শাহ আবদালীর কাছে। লিখলেন তিনি, ‘কোন রাজন্যের সাহায্য নয়, ভারতে মুসলমানদেরকে ভাবী ধ্বংসের হাত হতে রক্ষার ঈমানী তাকিদেই তার এগিয়ে আসা প্রয়োজন।’ এই একই আবেদন জানালেন তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং রহিলাখন্ডের তরুণ নায়ক নজীবুদ্দৌলার কাছে। আর কিছু নয়, ভারতের মুসলমানদের রক্ষার জন্য সব ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অনুরোধ জানালেন তিনি। উদ্যোগ বৃথা গেল না। ১২ হাজার ঘোড়সওয়ার নিয়ে পথে কোন প্রকার কালক্ষেপণ না করে ঝড়ের বেগে কাবুল হতে ছুটে এলেন আহমদ শাহ আবদালী। সুজাউদ্দৌলাহ, নজীবুদ্দৌলাহ এবং দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমও তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। যুদ্ধ হল পানিপথে। এই ঐতিহাসিক তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিন্দু ক্ষাত্রশক্তির আকাশস্পর্শী অহঙ্কার আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্ত্বাধীন অতি ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর হাতে পানিপথের মাটিতে মাটি হয়ে গেল। আসন্ন ধ্বংসের প্রলংকারী সয়লাব হতে রক্ষা পেল ভারতের মুসলমানরা। যুদ্ধ শেষে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী ফিরে এলেন তার মাদরাসায়। তিনি বুঝলেন, মুসলমানরা আপাতত রক্ষা পেল। কিন্তু এটা তাদের শেষ রক্ষা নয়। ভারতে বিধ্বস্ত মুসলিম রাজশক্তির পটভূমিকে সামনে রেখে মুসলমানদের জন্য ভবিষ্যতে বহু বিপদের ঘনঘটা তিনি দেখতে পেলেন। পলাশীতে সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর শক্তিশালী এক বিপদ সামনে এগিয়ে আসছে তাও তিনি বুঝলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এসব বিপদ হতে মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে হলে তাদেরকে সকল প্রকার অধঃপতন ও পথভ্রষ্টতা হতে মুক্ত করে ইসলামের অজেয় শক্তিকে সঞ্জীবিত করে তুলতে হবে। একমাত্র ইসলামের শক্তিই মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে ও বিজয়ী রাখতে পারে। পবিত্র হেরেম শরীফে শুয়ে যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সে কথাও মনে পড়ল তার। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিধর্মীরা মুসলিম ভারতের নগরসমূহ দখল করে তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে। আজমীরের মত শহরেও ইসলামী বিধান জারি থাকতে পারে নি, বিধর্মী নিয়ম কানুন সেখানে জারি হয়ে গেছে। মুসলমানরা তার নিকট জমায়েত হয়ে উপদেশ ও কর্মপন্থা প্রার্থনা করছে। তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করছে, কি করে তারা আল্লাহর বেহেশতে যেতে পারে। তিনি তার উত্তরে বলছেন, ক্ষয়িষ্ঞু, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করতে হবে। লোকেরা তার হুকুম মেনে তার অনুসরণ করতে লাগল।’
এই স্বপ্নের নির্দেশ শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর কাছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল। তিনি বুঝলেন, অধঃপতিত মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার ছাড়া তাদের মধ্যে ইসলামের অজেয় শক্তি সঞ্চার করা যাবে না। অতঃপর এ লক্ষ্যেই কাজ শুরু করলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী। একদিকে সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে শক্তিশালী লেখনী ধারণ করলেন, অন্যদিকে শিক্ষকের আসন হতে বিপ্লবী কর্মীবাহিনী গড়ার কাজে মনোযোগ দিলেন। ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে পরিকল্পনার ছক আঁকলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী। দুর্দিন যদি সত্যিই মুসলমানদের জীবনে আসে, তাহলে দুই উপায়ে তারা অসহ্য পীড়ন হতে রক্ষা পেতে পারেঃ (১) বিদ্রোহ করা, (২) পশুর মত ইতর জীবন যাপন করা। পশুর মত ইতর জীবন যাপন করে কোন মুসলমানই আর মুসলমান থাকতে পারে না। তাই বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা ও নীতি নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই মুসলমানদের ঈমানের দাবি। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী তাঁর ছাত্রদের ইসলামের এ বিপ্লবী শিক্ষাতেই গড়ে তুলতে লাগলেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর এ বিপ্লবী শিক্ষারই ফসল তাঁর মাদ্রাসার ছাত্র ঊনবিংশশতকের ইসলামী আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বালাকোটের শহীদ সৈয়দ আহম্মদ ব্রেলভী এবং শাহ ইসমাঈল শহীদ। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর এ মাদ্রাসা থেকেই ব্রিটিশ ভারতকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা করা হয়েছিল। শাহ ওয়ালীউল্লাহর ছাত্র ও পুত্র শাহ আবদুল আজীজের কন্ঠেই এই বিপ্লবের বাণী ও বিদ্রোহের ঘোষণা সর্বপ্রথম ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। পরে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভীর পৌত্র ও শাহ আবদুল আজীজের ভাইপো শাহ আবদুল হাই রহিমিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকের আসন থেকে এই বিপ্লবের বাণী ভারতীয় মুসলমানদের সামনে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন। তিনি আরও সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেনঃ “কলকাতা হতে দিল্লী পর্যন্ত খ্রিষ্টানদের সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের অতি পাশাপাশি অবস্থিত দেশগুলো (অর্থাৎ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশগুলো) সবই শত্রুর দেশ বা ‘দারুল হরব’। কারণ সর্বত্রই পৌত্তলিকতা (কুফর ও শিরক) বলবৎ হয়ে গেছে এবং আমাদের শরীয়ত আইন আর প্রতিপালিত হয় না।”
পূর্বেই বলা হয়েছে, শত্রু অধিষ্ঠিত মসুলিম দেশ বা ‘দারুল হরবে’ বসবাসকারী মুসলমানদের সামনে দুটি পথ অবশিষ্ট থাকেঃ এক বিদ্রোহ করা এবং ইসলামের রাজনৈতিক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, দুই বিধর্মীর শাসন মেনে নিয়ে পশুর মত ইতর জীবনযাপনে রাজি হওয়া। দ্বিতীয় পথটি মুসলমানদের জন্য নয়। কারণ ইসলামের বিপরীত বা বৈরী শাসন সানন্দে ও বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া এবং মুসলমান থাকা-এ দুটি কাজ একসঙ্গে কিছুতেই চলেনা। তাই সেই সময় সেদিনের ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের স্বাধীনতা তথা ইসলামের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আল্লাহর অনুগত সব বান্দাহ তথা সচেতন মুসলমানদের জন্য মুসলিম জনতার ওপর নিপীড়নকারী সকল শক্তি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা জিহাদের ঝান্ডা উত্তোলন করা অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছিল। এই জিহাদের ঝান্ডাই হাতে তুলে নিয়েছিলেন সৈয়দ আহমদ শাহ ব্রেলভী এবং শাহ ওয়ালীউল্লাহর কর্মসূচীর তৈরি শাহ ইসমাঈল শহীদের মত শাহ আত্মীয়স্বজন এবং অগণিত ছাত্রবৃন্দ।
১৭৮৬ সাল। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী রায় বেরলীর এক সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। লোকসেবা, সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ ও খেলাধূলায় মশগুল হয়ে থাকা ছিল বালক সৈয়দ আহমদ এর প্রিয় হবি। এভাবেই কেটে গেল তার জীবনের সতেরটি বছর। এক সংবেদনশীল ও ব্যক্তিত্বশালী তরুণ হিসাবে গড়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু কেতাবী শিক্ষালাভ তাঁর কিছুই হলো না। তার বড় ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক দিল্লীর রহিমিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। বড় ভাই এর পথ ধরে ১৮০৪ সালের এক শুভ দিনে সৈয়দ আহমদ শাহ দিল্লীর রহিমিয়া মাদ্রাসায় এসে হাজির হলেন। প্রথম দিনের প্রথম সম্ভাষণেই শায়খুল হিন্দ শাহ আবদুল আজীজ তরুণ সৈয়দ আহমদকে দেখে মুগ্ধ হলেন এবং সহজেই উপলব্ধি করলেন যে, তাঁর নতুন শিষ্য পলিশহীন হিরার টুকরো।
দিল্লীর রহিমিয়া মাদ্রাসায় মাত্র দু’বছরের শিক্ষা সাধনার পর সৈয়দ আহমদ সত্যিই এক হিরের টুকরা হয়ে বেরিয়ে এলেন। শাহ আবদুল হক দেহলভী প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন, “সৈয়দ আহমদ এর কেতাবী শিক্ষার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তাঁকে এতখানি পরম জ্ঞান দান করেছেন যে, কেতাবী শিক্ষা তাঁর কাছে তুচ্ছ ব্যাপার”। আর স্বয়ং শায়খুল হিন্দ শাহ আবদুল আজিজ মত প্রকাশ করলেন, “আল্লাহ সৈয়দ আহমদকে ‘বিলায়েত ই আম্বিয়ার’ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।”
এবার সৈয়দ আহমদ শহীদ কর্মজীবনে প্রবেশ করলেন। যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার জন্য তিনি ৫ বছর পর দিল্লী হতে চলে গেলেন টংকে। টংকের নওয়াব আমির মুহাম্মদ খানের সৈন্যদলে ছয় বছর কৃতিত্বের সাথে কাজ করেন। অতঃপর তিনি আবার ফিলে এলেন দিল্লীতে। ফিরে আসার পর এবার শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী ও শাহ আবদুল আজীজের শিক্ষা ও স্বপ্নকে কার্যে পরিণত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গেল। দিল্লীতে মোগল রাজশক্তির কাঠামো তখনো টিকে ছিল। কিন্তু তাতে কোন প্রাণরস ছিল না। পাঞ্জাব হতে পশ্চিমে সমগ্র পশ্চিম ভারতে তখন নিষ্ঠুর শিখ রাজত্ব চলছে। চারদিকে হতাশা এসে গ্রাস করে মুসলমানদেরকে। পশ্চিম ভারতে মুসলমানদের ওপর শিখ নির্যাতনের অসংখ্য মর্মন্তুদ কাহিনী ছুটে আসতে লাগলো দিল্লীতে। হত্যা লুন্ঠনে ভরে গেল সে দেশ। মসজিদগুলোতে তখন তালা পড়েছে। গরু জবাই বন্ধ হয়ে গেছে। একদিন এক জলাশয়ের পাশ দিয়ে পথ চলার সময় শাহ ইসমাইল শহীদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়া এক মুসলিম মহিলার স্বগত কন্ঠের এই আর্ত ফরিয়াদ শুনলেন, ‘কোথাও কি আল্লাহর এমন বান্দা একজনও নেই যে আমাকে শিখের ঘর হতে উদ্ধার করতে পারবে?’
স্বগত কন্ঠের ফরিয়াদ শুনে শাহ ইসমাঈল শহীদও তাঁর চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। তাঁর মনে হল, ঐ আর্তনাদ যেন ঐ মহিলার নয়, গোটা দেশেরই যেন এক মৌন আর্তনাদ এটা। দিল্লীতে তখন সকলেই এটা অনুভব করেছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জিহাদ ঘোষণা বা মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আর কোন পথই থাকলো না। অতএব, জেহাদের সেনাদল সংগঠনের কাজ শুরু হয়ে গেল। দিল্লীর মাওলানা ইউসুফ, মাওলানা আবদুল হাই, শাহ ইসমাইল শহীদ, শাহ মুহাম্মদ ইসহাক, শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব প্রমুখ দেশবরেণ্য আলেম সৈয়দ আহমদ শহীদের হাতে বায়আত হলেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর পরিবারের লোকেরা নেতা হিসেবে সৈয়দ আহমদ শহীদের হাতে বায়আত হয়েছেন শুনে দেশের চারিদিকে সৈয়দ আহমদ শহীদের দাওয়াত আসতে লাগলো। শাহ আবদুল আজিজের নির্দেশে সৈয়দ আহমদ শহীদ ভারত ভ্রমণে বের হলেন।
ভারত ভ্রমণ তাঁর জেহাদী সেনাদল সংগঠনের ভ্রমণ ছিল। ১৮১৮ হতে ১৮২৬ সাল এই ৮ বছর তিনি গোটা ভারতময় ঘুরে বেড়ালেন। মানুষের প্রাণে তিনি আবেগের জোয়ার আনলেন। যেখানেই তিনি গেলেন, জনতার ঢল নামল সেখানে। মুসলিম জনতার তিনি যেন মুকুটহীন সম্রাট। তিনি যখন কোলকাতায় এলেন, কলকাতার মুসলমানদের অধিকাংশই তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করলেন। বাংলাদেশের ২৪ পরগণা থেকে শুরু করে সমগ্র উত্তরবংগ, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলা হতে অসংখ্য লোক কলকাতা গিয়ে সৈয়দ আহমদের কাছে বায়াত হলেন। সারা বাংলাদেশে হতে তিনি দাওয়াত পেলেন, কিন্তু এমন ব্যাপক সফরের সময় তাঁর ছিল না।
বস্তুত এইভাবে গোটা ভারতব্যাপী মাকড়সার জালের মত জেহাদী সংগঠন ছড়িয়ে পড়ল। স্যার উইলিয়াম হান্টারের মতে সারা ভারত ব্যাপী ওহাবী বিপ্লবের এই শাখা প্রশাখার বিস্তৃত বিবরণ দান করতে গেলে একখানা বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করতে হবে। আর তাঁর ভাষায়, “সারা ভারতটা সৈয়দ আহমদের খলিফাদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায় এবং ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থের প্রতিকুলে একটা সরকারও বাস্তবভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। প্রচ্ছন্ন ও পাল্টা এই সরকারের খবর ৪০ বছর ধরে ব্রিটিশ সরকার জানতেই পারে নি।”
দেশব্যাপী জেহাদী সংগঠন গড়ে তোলার পর জেহাদ পরিচালনার ক্ষেত্র হিসেবে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চলকে বেছে নিলেন সৈয়দ আহমদ। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হতে মুজাহিদরা ঐ পার্বত্য ভূমিতে জমায়েত হতে থাকবে এবং ঐখান হতেই শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করা হবে।
অবশেষে ১৮২৬ সালে সৈয়দ আহমদ শহীদ প্রায় দু’হাজার মুজাহিদের একটি দল নিয়ে উত্তর পশ্চিম সীমান্তের দিকে যাত্রা করলেন। শাহ ইসমাইল শহীদ, মাওলানা আবদুল হাই প্রমুখ বিপুল সংখ্যক আলেম তাঁর সাথী হলেন। এই বাহিনী রায়বেরেলি হতে বের হয়ে টংক, আজমীর, হায়দরাবাদ, পেশোয়ার, কোয়েটা প্রভৃতি স্থান ঘুরে সীমান্তের পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করল।
সৈয়দ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী সীমান্ত প্রদেশের দিকে যাত্রার পরেই সুবে বাংলা তথা বাংলা ও বিহার অঞ্চলের খলিফারা অর্থ ও মুজাহিদ প্রেরণের জন্য অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেন। পাটনায় মাওলানা বেলায়েত আলী, মাওলানা এনায়েত আলী, মাওলানা আহমদুল্লা প্রমুখ ব্যক্তিগণের নিয়ন্ত্রণাধীনে আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হল। মাওলানা এনায়েত আলী ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী মালদহ ও বগুড়া অঞ্চল বার বার সফর করলেন। মাওলানা বেলায়েত আলী কিছুদিন বাংলাদেশ সফর করার পর হায়দরাবাদ ও বোম্বাই অঞ্চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
বাংলা হতে ঠিক এ সময়েই ৮ হাজার মুজাহিদ জিহাদে যোগদান করতে যায়। এঁরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পদব্রজে কয়েক হাজার মাইলের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সীমান্তে পৌছে। মালদহ, পাবনা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, যশোর, চব্বিশ পরগণা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে কেন্দ্র ছিল। এ সব কেন্দ্র থেকে অর্থ ও মুজাহিদ সংগ্রহ করে পাটনায় প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের পর সীমান্তে পাঠানো হতো। ভারত বিশেষ করে বাংলা ও বিহার হতে প্রায় ১২ হাজার মুজাহিদ উত্তর পশ্চিম সীমান্তে পৌছার পর সৈয়দ আহমদ শহীদ শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার আগে সৈয়দ আহমদকে স্থানীয় কিছু গোত্র সরদারের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলো। সীমান্তের পাঠান জনসাধারণ সৈয়দ আহমদকে অত্যন্ত উৎসাহ আবেশ ও আনন্দের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করে। সৈয়দ আহমদ ছিলেন তাদের কাছে সৈয়দ বাদশা। তাঁর আদেশ নিষেধের অন্যথা তাদের কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। প্রভাবশারী ফবিলা সরদার সৈয়দ আহমদের আনুগত্যে গর্ববোধ করতেন। এ অবস্থায় বিশাল সীমান্ত এলাকা নিয়ে সৈয়দ আহমদ একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করলেন। তিনি গ্রহণ করলেন আমিরুল মুমিনীন উপাধি। সর্বত্র শরীয়তের বিধান চালু করলেন, কিন্তু এ শান্তির পরিবেশ বেশিদিন চলতে পারলো না। পেশোয়ারের সুলতান ইয়ার মুহাম্মদ খান এবং শিখদের কুটনীতি, কিছু কিছু গোত্রপ্রধানের অস্থিরতা ও অনিয়মতান্ত্রিকতার ফলে অভ্যন্তরীণভাবেই অনেক প্রতিকুল অবস্থার মোকাবিলা করতে হলো সৈয়দ আহমদকে। দু’বার তাঁকে মূল ঘাটি পরিবর্তন করতে হলো। একবার হুন্দ থেকে পঞ্জতরে দ্বিতীয়বার তাকে সরতে হলো পঞ্জতর থেকে।
১৮২৮ সাল হতে ১৮৩১ সালের মধ্যে শিখদের সাথে ছোটবড় অনেকগুলো সংঘর্ষ ও যুদ্ধ সংঘটিত হলো। অধিকাংশ যুদ্ধেই শিখরা মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত হয়। কিন্তু পেশোয়ারের সুলতান ইয়ার মুহাম্মদ খান ও হুন্দের খাদি খানের বিশ্বাসঘাতকতা ও উপজাতি সৈনিকদের অস্থিরতা বেশ কিছু বিজয়কে পরাজয়ে পরিণত করে। সৈয়দ আহমদ খান হুন্দের খাদি খান এবং পেশোয়ারের ইয়ার মুহাম্মদ খান উভয়কেই শায়েস্তা করেছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের পথ তিনি রোধ করতে পারেন নি। ১৮৩০ সালে পরাজিত যে মুহাম্মদ খানকে তিনি দয়া করে পেশোয়ারের শাসন ভার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মুহাম্মদ খানই পরে পেশোয়ারে বেশ কিছু বিশিষ্ট নেতাসহ বিপুল সংখ্যক মুজাহিদকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৮৩১ সালের শুরুর দিকে কাগান ও কাশ্মীরের কয়েকজন সর্দারের কাছ হতে ডাক আসে শিখদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে তাদের সহায়তা করার জন্য। কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ যাবার সোজা পথ ছিল আম্বের মধ্য দিয়ে। কিন্তু শিখ ও ইংরেজদের কুটনীতিতে আম্বের সরদার পায়েন্দা খান তখন বিক্রি হয়ে গেছেন। তাই সৈয়দ আহমদ আম্বের মধ্য দিয়ে যাবার অনুমতি পেলেন না, ফলে এক দুর্গম পথ ধরে তাকে যাত্রা করতে হলো কাশ্মীরের দিকে।
সে সময়টা ছিল ১৮৩১ সালের ফেব্রুয়ারী। কঠোর শীতের মধ্য দিয়ে বহু হিমবাহ অতিক্রম করে আঁকাবাঁকা বন্ধুর গিরিপথ ধরে সাচ্চুন হয়ে কাগান উপত্যকার প্রবেশপথ বালাকোটে গিয়ে হাজির হলেন। বহু ভারবাহী পশু পথে মারা পড়লো, বহু আসবাবপত্র পথে নষ্ট হল। শ্রান্ত ক্লান্ত মুজাহিদরা এপ্রিল মাসের শেষদিকে বালাকোটে এসে পৌছলেন। সুন্দর কাগান উপত্যকার প্রবেশ মুখ পর্বত ঘেরা ঊষর বালাকোটেই শিবির গাড়লেন সৈয়দ আহমদ শহীদ। তাদের গন্তব্য স্থান ছিল কিন্তু মুজাফফরাবাদ।
সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। অন্যভাবে বিভোর তিনি। তাঁর নিয়তিই ছিল যেন বালাকোটের ময়দানে শহীদি সম্মান লাভ। এ সময় জেনারেল শের সিংহ বিরাট এক শিখ বাহিনী নিয়ে খোরীর সরদার নজফ খানের প্রদর্শিত গুপ্ত পথে বালাকোটে এসে উপস্থিত হলেন ও মুজাহিদ বাহিনীকে ঘেরাও করে ফেললেন। নজফ খান অবশ্য প্রতিদ্বন্ধী সরদারেরই বিনাশ করতে চেয়েছিলেন। সৈয়দ আহমদের মৃত্যু চান নি কিংবা তাঁর বাহিনীকেও ফাঁদে ফেলতে চান নি। অবস্থা সঙ্গীন দেখে তিনি সৈয়দ আহমদকে বাঁচাতে চাইলেন এবং অবস্থার গুরুত্ব মুজাহিদদের বুঝিয়ে দিয়ে একটি গুপ্ত পথেরও সন্ধান দিলেন মুজাহিদদের সরিয়ে নেবার। শেষ পর্যন্ত কাগান উপত্যকার দিকে পালিয়ে যাওয়ার একটি নিরাপদ পথও খোলা ছিল। মুজাহিদদেরই তখন এ মনোবৃত্তি জাগে নি। তাঁরা সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য, ধর্মের জন্য হাজার হাজার মাইল দূর থেকে এসেছেন প্রয়োজনে হলে জান কুরবানী দিতে। আর বালাকোটের শহীদি দরগাহে যখন সে সুযোগ উপস্থিত হয়েছে, তখন কোন মুজাহিদ সে সুযোগ অবহেলা করতে পারেন?
১৮৩১ সাল, ৬ মে। শহিদী রক্তস্নাত ইতিহাসের এক অমর দিন। হিমেল হাওয়া প্লাবিত বালাকোটের ঊষর প্রান্তর। একদিকে দাঁড়ানো জেনারেল শের সিং এর ২০ হাজার সুসজ্জিত সৈন্য। আর অন্য পক্ষে পথশ্রমে ক্লান্ত ও ক্ষুৎপিপাসায় কাতর প্রায় নয়শ’ মুজাহিদ। শুরু হল যুদ্ধ। সেতো যুদ্ধ নয় যেন মৃত্যু অভিসারীদের বহ্নিবন্যায় মুক্তিস্নান। রক্তস্রোতে স্নান করে অমর শয্যায় শায়িত হলেন সঙ্গীসহ সৈয়দ আহমদ শহীদ এবং শাহ ইসমাইল।
ভারত উপমহাদেশের আজাদী সংগ্রামের এক মহান সৈনিক মাওলানা মুহাম্মদ আলী একদা বলেছিলেন, মুসলমানদের জীবন কাহিনীর বিস্তৃতি মাত্র তিনটি অধ্যায়েঃ (১) হিজরত (২) জেহাদ ও (৩) শাহাদাত। সৈয়দ আহমদ শাহ ও শাহ ইসমাইল শহীদের জীবন এই তিনটি অধ্যায়েই ছিল মূর্ত প্রতীক।
বালাকোটের কাহিনীর শেষ ১৮৩১ সালের ৬ মে তারিখেই। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস শেষ হয় নি, উইলিয়াম হান্টার একথা স্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সবই তো শেষ হলো, কিন্তু আমাদের হিন্দুস্তানী ধর্মান্ধদের বিতাড়িত করতে পারলাম না। কিংবা তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে হিন্দুস্থানে স্বগৃহে ফেরত পাঠাতেও সফল হলুম না।” এই সফল না হওয়ার কারণও হান্টার সাহেব উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমরা একদিকে সীমান্তের বিদ্রোহী বসতিকে ক্ষাত্র শক্তির দ্বারা পেষণে নিশ্চিহ্ন করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু অন্যদিকে আমাদেরই ধর্মান্ধ প্রজারা অফুরন্তভাবে মানুষ ও টাকা পয়সা জোগান দিয়ে সেটাকে লালন করেছে। আমরা পোড়া ছাইকে একদম মৃত ভেবে ফেলে এসেছি। আর তারা নতুন করে তৈল দান করে করে পুনরায় সেটাকে প্রজ্জ্বলিত করে তুলেছে।” হান্টার সাহেব অতি দুঃখের সাথে এ কথাগুলি লিখেছেন ১৮৭১ সালে। অর্থাৎ ১৮৩১ সালে বালাকোট বিপর্যয়ের পর ১৮৭১ সালে এসেও সৈয়দ আহমদ শহীদের ইসলামি আন্দোলন বিভিন্নভাবে সক্রিয় ছিল।
১৮৩১ সালের পর এবং ১৮৬৮ সালের মধ্যে ইংরেজ ও শিখদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদদের শুধু বিরাট আকারের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছে তিনটি। আর ছোট খাট সংঘর্ষ যে কত সংঘটিত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ১৮৬০ সালের পরে ওহাবী ট্রায়ালগুলো এবং আন্দামানে নির্বাসিত মুজাহিদদের নথিপত্রগুলো যদি ঘেটে দেখা হয় তাহলে এর কিঞ্চিৎ নজির মিলবে।
বস্তুত ইসলামী আন্দোলন এর অনির্বাণ শিখা নিভে যাবার নয়। এটা হয়ত পথ বদলায়, কর্মসূচী পরিবর্তন করে, স্থানান্তরিতও হয়তো হয়। কিন্তু লক্ষ্যপথের দুর্বার যাত্রা তার থেমে যায় না। ফিরাউনের জাহিলিয়াত নাশ করার জন্য মুসার আগমন দিনরাত্রির আবর্তনের মতই অবধারিত।