মুসলিম সংহতি – আন্দোলন
মুসলিম জাতির পরিচয় সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি । আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম জাতিকে দুনিয়ার সব মানুষের জন্য তার নির্দেশিত এবং পছন্দনীয় জীবন যাপনের সাক্ষী হিসেবে এবং সর্বোত্তম জাতি হিসেবে দুনিয়ার নেতৃত্ব দানের জন্য পাঠিয়েছেন । এই ভাগ্যবান জাতিরই সংহতি আন্দোলন এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি সম্পর্কেই আমি বলছি । সংহতি আন্দোলনের প্রশ্ন কখন আসে ? সংহতি যখন থাকে না তখন । সংহতি যে আজকে নেই তা কাউকেই বলার অপেক্ষা রাখেনা । আজ শুধু সংহতি নেই নয়, প্রায় অর্ধশত খণ্ডে বিভক্ত মুসলিম বিশ্ব আজ নানা প্রকার দ্বন্দ্ব- সংঘর্ষে লিপ্ত । সংহতি আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বলার আগে আল্লাহ মনোনীত সর্বোত্তম এই জাতি কিভাবে এ অবস্থায় পৌঁছল সেই দীর্ঘ এবং বেদনাদায়ক ইতিহাসের দিকে কিঞ্চিত নজর দেয়া দরকার । খোলাফায়ে রাশেদিনের স্বর্ণ যুগ শেষ হয়ে যাবার পর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে খিলাফত ব্যবস্থার বদলে প্রকৃত অর্থে মুলুকিয়াত বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে । নামে কিন্তু তা খিলাফতই থাকলো । মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের চত্বর থেকে এটাই প্রথম বড় ধরনের পদস্খলন । আকিদা বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত এই পদস্খলন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার পথ খুলে দিলো । এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়তে থাকলো উপর থেকে নীচের দিকে । অধঃপতন হয়ে উঠতে লাগলো সর্বব্যাপী ।
মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের উপর এর এমন এক মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হলো যা পরিনামে ইসলামের বিশ্ব সয়লাবী অগ্রযাত্রাকেই স্তব্ধ করে দিলো। ইতিহাস সাক্ষী, বাগদাদের পতনের পর ইসলামের ভৌগোলিক বিস্তারও বন্ধ হয়ে যায়। ইতিহাসের আরো সাক্ষ্য ১২৫৮ সালে বাগদাদের যে পতন তা হালাকু খানের কাছে ঘটেনি, ঘটেছে নিজেদের অনৈক্য এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্রের কাছে । বাগদাদের পতন ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় ইসলামের অগ্রগতিই শুধু বন্ধ করে দিলো না, মুসলমানদের সৃষ্টিধর্মী প্রতিভাও কোথায় যেন হারিয়ে গেলো । গোটা বিশ্বে ইসলামকে ছড়িয়ে দেয়ার মতো জীবন্ত ও গতিশীল কোন আন্দোলনের ক্ষেত্রে গতিহীন কোন অবস্থা থাকতে পারে না । এ কারনে মুসলিম জাতীয় জীবন ও তার অগ্রগতি হারিয়ে স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না । সুতরাং যেদিন সে তার অগ্রগতি হারালো, সেদিন থেকেই তার পতন শুরু হলো । বাগদাদের পতনের পরপরই সিসিলিসহ ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য দ্বীপ থেকে মুসলমানদের বহিষ্কৃত হতে হলো । আর ১৪৯২ সালের মধ্যেই গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম সভ্যতার পাদপীঠ স্পেন থেকে মুসলমানরা উৎখাত হয়ে গেলো ।
১৫৬৮ সালে তুর্কি সুলতান সুলাইমানের মৃত্যু ঘটার পর ওসমানীয় খিলাফতের পতন ঘটতে থাকে এবং ১৯২৯ সালে কামাল আতাতুর্কের হাতে খিলাফতের উৎখাত ঘটার মাধ্যমে এই পতন প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে । মুসলিম বিশ্বের যে ক্ষীন কেন্দ্রটুকু এতোদিন টিকে ছিল তাও এইভাবে শেষ হয়ে গেলো এবং মুসলিম বিশ্বের অবস্থা এর পর সুতা ছেড়া মালার মতো হয়ে দাঁড়ালো । মুসলিম বিশ্ব খণ্ড- বিখন্ড ও দ্বন্দ্ব- সংঘাতে পূর্ণ হয়ে গেলো । এখানে উল্লেখ্য, উসমানীয় খিলাফতের যখন পতন ঘটেছিলো এবং উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব এশিয়ার মুসলিম রাজ্যগুলো দ্বন্দ্ব- সংঘাতে যখন দুর্বল হয়ে পড়ছিল, তখন ইউরোপে খৃষ্টান শক্তির জ্ঞান ও শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠেছিল । ১৯২১ সালে উসমানীয় খিলাফতের যখন পতন ঘটলো, তখন দেখা গেলো গুটি কয়েক ছাড়া স্বাধীন মুসলিম দেশ আর অবশিষ্ট নেই । অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর উপনিবেশিক শক্তিগুলোরও দিন ফুরালো । একে একে মুসলিম দেশগুলো স্বাধীন হয়ে গেলো । দেশ স্বাধীন হলো বটে, কিন্তু মুসলিম জাতীয় জীবন স্বাধীন হতে পারলো না । ভাষা অথবা আঞ্চলিক দিক থেকে জাতীয় রাষ্ট্রের তারা মালিক হলো, কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের যে বিকৃতির কারনে তাঁদের অধঃপতন, পরিশেষে পরাধীনতা এসেছিলো সে বিকৃতি অনেক ক্ষেত্রে আরো ঘনীভূত হল । নব্য স্বাধীন অধিকাংশ মুসলিম দেশে যারা ক্ষমতায় বসলো, তারা উপনিবেশিক শাসকদের ধ্যান ধারনারই সৃষ্টি । সুতরাং ক্ষমতার হাত বদল ছাড়া মৌলিক কোণ পরিবর্তন এলো না । যে বিভেদ বিদ্বেষ আগে ছিল, সেটাই আবার অন্য নামে অন্য রংয়ে আসন গেঁড়ে বসলো । মুসলিম বিশ্বের এই অধঃপতিত দশাই আমরা আজ অবলোকন করছি ।
এবার অধঃপতিত এই মুসলিম বিশ্বের সংহতির আন্দোলনের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক । আগেই বলেছি, খোলাফায়ে রাশেদীনের পর শাসক মহলে ক্রমবর্ধমান যে পদস্খলন সূচিত হয়, তাই উপর থেকে নীচের দিকে সংক্রমিত হয়ে অনৈক্য এবং বিভেদ- বিদ্বেষকে বল্গাহীন করে তোলে । এই অধঃপতনের যাত্রা যখন থেকে শুরু প্রায় তখন থেকেই সংহতি আন্দোলনেরও শুরু । এই সংহতি আন্দোলনকে দুটি ধারায় বিভক্ত করা যায় । তার একটি মুসলিম সমাজ এবং সরকারের সংস্কার আন্দোলন, অপরটি মুসলিম বিশ্বের আন্তঃরাষ্ট্রীয় ঐক্যের আন্দোলন । মুসলিম সমাজ এবং সরকারের সংস্কার আন্দোলনকে আবার দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় । তার একটি হল একক বা ব্যক্তি পর্যায় আর অন্যটি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় । মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের ঐক্যের প্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলন যেহেতু মুসলিম সমাজ এবং সরকারের সংস্কার আন্দোলনেরই একটি দল ও সেহেতু সংস্কার আন্দোলন মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের ঐক্য আন্দোলনের চেয়ে প্রায় বারশো বছরের বড়, তাই প্রথমে সংস্কার আন্দোলন থেকেই আমরা আলোচনা শুরু করছি ।
একক বা ব্যক্তি পর্যায়ের সংস্কার আন্দোলন
খোলাফায়ে রাশেদীনের পর উমাইয়া বংশের খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের সময় খিলাফত ব্যবস্থা একবার বিদ্যুৎ চমকের মতো সোনালী যুগের রূপ পরিগ্রহ করার পর আবার তা অন্ধকারে হারিয়ে গেলো । সেই অন্ধকারে আলোকবর্তিকার মতো কয়েকজন জগত বিখ্যাত মুসলিম সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটে । তাঁদের মধ্যে চার ইমাম হযরত ইমাম আবু হানিফা (রঃ), হযরত ইমাম মালিক (রঃ), হযরত ইমাম শাফেয়ী ( রঃ ) এবং হযরত ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল ( রঃ ) এর নাম সমধিক উল্লেখযোগ্য । তাঁদের সংস্কার আন্দোলনের সময়কাল ৮ম শতাব্দীর শুরু থেকে ৯ম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । কিন্তু তাঁদের আন্দোলনের শক্তিমত্তার পরবর্তী সাত- আট শতাব্দী পর্যন্ত মুজতাহিদ সৃষ্টি করতে থাকে । তারা মুসলিম সমাজের অধঃগতির পটভূমিতে দ্বীনের মুলনীতির ভিত্তিতে শরিয়তের কাঠামোকে পরিপূর্ণভাবে শাসককুল এবং মুসলিম সমাজের সামনে নিয়ে আসেন । পদস্খলিত ও আদর্শ বিচ্যুত তদানীন্তন খিলাফত ব্যবস্থার সাথে নিঃসম্পর্ক থেকে, শাসককুলের সবরকম অনুপ্রবেশ থেকে মুক্ত থেকে এবং তাঁদের মোকাবেলা করে তারা হক- কে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন । এই দুঃসাহসিক কাজে তারা অপরিসীম দুঃখ কষ্ট এবং নির্যাতন ভোগ করেন । ইমাম আবু হানিফা ( রঃ ) উমাইয়া এবং আব্বাসীয় উভয় খলিফাদের আমলেই বেত্রদণ্ড এবং কারাদণ্ড ভোগ করেন । এমনকি অবশেষ তাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হয় । ইমাম মালিক ( রঃ ) কে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের আমলে বেত্রদণ্ড দেয়া হয় এবং তাকে এমন ভীষণভাবে পিছমোড়া করে বাঁধা হয় যে, তার দুটি হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের উপর আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন, মোতাসিব এবং ওয়াসিক তিনজনের আমলেই অবিরাম নির্যাতন চালানো হয় । বলা হয়ে থাকে, তার উপরে এতো মারপিট হয় যে, হাতীও সে মার খাওয়ার পর জীবিত থাকতে পারতো না । চার ইমামের এই সংস্কার আন্দোলন তদানীন্তন শাসন ব্যবস্থাকে সংশোধন করতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু মুসলিম সমাজের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহান নেয়ামত হিসেবে তা কাজ করতে থাকে ।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মৃত্যুর দুশো বছর পর ১০৫৫ সালে ইমাম গাজ্জালীর জন্ম হয়। তিনিও ১১১১ সাল পর্যন্ত অবিরাম এবং বিরাট এক সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন । মুসলিম সমাজের অনৈক্যের উৎস জাহেলিয়াত কবলিত শাসক গোষ্ঠীর তিনি কঠোর সমালোচনা করেন । খলিফা নামীয় বাদশাহর মুখের ওপরে তিনি বলেন, “স্বর্ণ অলংকারের ভারে তোমার ঘোড়ার পিঠ ভাঙ্গেনি তো কি হয়েছে ? অনাহার- অর্ধাহারে মুসলমানদের পিঠতো ভেঙ্গেছে ।” তিনি ঘোষণা করেন, “আমাদের যমানার সুলতানদের সমস্ত বা অধিকাংশ সম্পদ হারাম । এই সুলতানদের নিজেদের চেহারা অন্যকে না দেখানো উচিৎ এবং অন্যদের চেহারা নে দেখা উচিৎ । এদের ( শাসকদের ) সাথে কোন সম্পর্ক না রাখা এবং এদের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের ভক্তদের দূরে অবস্থান করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য ।”
ইমাম গাজ্জলীর ব্যাকুল প্রত্যাশা ছিল পৃথিবীর যে কোন এলাকাতেই হোক না কেন নির্ভেজাল ইসলামী নীতি এবং আদর্শের ভিত্তিতে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক । ইমাম গাজ্জালীর মৃত্যুর ১৫১ বছর পর ১২৬২ সালে অকুতোভয় সংগ্রামী সংস্কারক ইমাম ইবনে তাইমিয়া জন্ম গ্রহন করেন । তিনি যখন জ্ঞান চক্ষু উন্মিলন করে মুসলিম সমাজের দিকে চাইলেন, তখন বাগদাদের পতন ঘটে গেছে । চরিত্রহীন মুসলিম শাসককুল তখন ভাসমান পানার মতো এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজ বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো অবশ অচেতন । মিসর ও সিরিয়ার মতো যে গুটি কয়েক দেশ তাতারিদের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে পেরেছিল, সেখানেও কোন ইসলাম ছিল না, ছিল চেংগেসী স্বেচ্ছাচারিতা । এই কালো অমানিশার মধ্যেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার ক্ষুরধার লেখনী, গভীর প্রজ্ঞা ও তেজস্বী বক্তব্যের মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন । সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কখনো কোন বৃহত্তর শক্তিকে তিনি ভয় করেননি । বহুবার তাকে কারারুদ্ধ হতে হয় এবং কারাগারেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । ইমাম ইবনে তাইমিয়া মুসলিম শাসককুলকে সংশোধন এবং ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি বটে, কিন্তু মুসলিম উম্মাহকে সামনে এগিয়ে চলার অত্যন্ত মজবুত পথ তিনি রচনা করে যান ।
ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি মোগল ভারতে আরেকজন মহান সংস্কারকের জন্ম হয় । তিনি শায়েখ আহমাদ সরহিন্দী । মুজাদ্দেদী আলফেসানী নামেই তিনি বেশি পরিচিত । রাষ্ট্রীয় সংশোধনের ক্ষেত্রে তিনি ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতই সংগ্রাম করেন । দশ বছর তাকে মোগল জেলে কাটাতে হয় । প্রকৃতপক্ষে তার সাহসী সংগ্রামই সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ভয়াবহ এক জাহেলিয়াতের কবল থেকে ভারতের মুসলমানদের রক্ষা করে এবং আলমগীর আওরঙ্গজেবের মতো একজন দরবেশ সম্রাটের জন্ম হয় । শায়খ আহমাদ সরহিন্দীর পর ভারতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম সংস্কার আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করে । মুসলিম সংস্কার আন্দোলনের এই প্রাতিষ্ঠানিক রুপের দিকেই এখন দৃষ্টিপাত করা যাক । তবে তার আগে বিশ্ব মুসলিম সংহতির আরেকজন সিংহপুরুষ জামালুদ্দিন আফগানী সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই । বিশ্ব মুসলিম সংহতি আন্দোলনের ক্ষেত্রে একজন মহান দিকপাল ছিলেন জামালুদ্দিন আফগানী । ইসলাম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান, মুসলিম উম্মাহর প্রতি তার অপরিসীম মমতা ৩১ বছর বয়সে তাকে দেশ ছাড়া করে । তিনি ছিলেন শক্তিশালী গ্রন্থকার, বিজ্ঞ শিক্ষক, অনলবর্ষী বক্তা এবং তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী । তিনি লিখেন, “একমাত্র ইসলামই মুসলিম সমাজের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও জাতীয় শক্তি নিশ্চিত করতে পারে এবং ধর্মহীনতা ও অবনতি এবং ধ্বংসের কারন ।” তিনি মুসলিম জাগরন এবং ঐক্যের মিশন নিয়ে তার গোটা জীবনটাই মুসলিম দেশসমূহে ঘুরে বেড়ান । তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারত, মিশর, তুরস্ক, আরব, ইরান, আফগানিস্তান সর্বত্র । তিনি ইউরোপ এবং রাশিয়াতেও গেছেন । সচেতন মুসলমানরা তার জন্য পাগল ছিল । কিন্তু আত্মচিন্তায় বিভোর মুসলিম এবং উপনিবেশিকেরা তার ইসলামী সংহতি চিন্তাকে বরদাশত করেননি । বিতাড়িত হয়েছেন তিনি এক দেশ থেকে অন্য দেশে । অবশেষে তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের ‘স্বর্ণ পিঞ্জরে’ নজরবন্দী থাকা অবস্থায়ই তিনি প্রানত্যাগ করেন । দৃশ্যত ব্যর্থতা নিয়েই তিনি ধরাধাম ত্যাগ করেছেন । কিন্তু মিশন তার ব্যর্থ হয়নি । তার বিশ্ব মুসলিম সংহতি চিন্তা পরবর্তীকালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করে এবং আজকের মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের ইসলামী ঐক্য তার স্বপ্নকেই সার্থক করেছে। উনিশ শতকের গোটা শেষার্ধটাই ছিল এই মহান সংস্কারকের কার্যকাল । ১৮৯৭ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন ।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার আন্দোলন
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মৃত্যুর ৩৭৬ বছর পর এবং শায়খ আহমাদ সরহীন্দ –এর মৃত্যুর ৭৯ বছর পর পবিত্র আরব ভূমি এবং ভারতে দুই মহান সংস্কারকের জন্ম হয় । ১৭০৩ সালে একই বছরে ভারতে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলোভী ( রঃ ) এবং আরবে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব ( রঃ ) জন্ম গ্রহন করেন । ইমাম ইবনে তাইমিয়ার অসমাপ্ত কাজকেই তারা পূর্ণতর করে তোলার চেষ্টা করেন । তাঁদের হাতে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন প্রথমবারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করে । শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলোবী মুসলিম সমাজের সার্বিক অধঃগতি রোধের উপায় হিসাবে ইসলামী খিলাফতের দৃষ্টান্ত অনুসরন করলে ভারতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে বিশাল ইসলামী বুনিয়াদ রচনা করে, অন্যদিকে দিল্লীর রাহিমিয়া মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করেন । সৈয়দ আহমাদ শহীদ এবং শাহ ইসমাইল শহীদ পরিচালিত মুজাহিদ আন্দোলন ভারতে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল । অপরদিকে আরবে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর আন্দোলন বিদআত ও জাহেলিয়াতের কবল থেকে নির্ভেজাল তৌহিদবাদের পুনরুত্থান ঘটায় । আমীর মুহাম্মাদ বিন সৌদ এবং তার উত্তরসূরি আব্দুল আজিজ ইবনে সৌদ এর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাবার কারনে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের আন্দোলন অন্তুত আরব উপদ্বীপে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে যায় । আজও এই আন্দোলন সেখানে ধিকি ধিকি জ্বলছে । অতীতের যেসকল ব্যক্তি কেন্দ্রীক ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের চেয়ে মুসলিম সমাজের রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ক্ষেত্রে এই দুই আন্দোলন অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে ।
শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের অহাবী আন্দোলন এবং শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবীর মুজাহিদ আন্দোলনের পটভূমিতে বর্তমান প্রথমার্ধে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আরো দুইটি আন্দোলন জন্ম লাভ করে । এ দুটি আন্দোলনের একটি ইমাম হাসানুল বান্না প্রতিষ্ঠিত ইখওয়ানুল মুসলিমুন এবং অন্যটি সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী । ইখওয়ানুল মুসলিমুন ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে মিশরে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভারতে ১৯৪১ সালে আগস্ট মাসে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয় । ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠাই আন্দোলন দুইটির লক্ষ্য । এ দুটি আন্দোলন মুসলিম দেশ সমূহ এবং গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বেসরকারী প্লাটফর্ম থেকে বিশ্বব্যাপী মুসলিম সংহতির বুনিয়াদ রচনা করছে । এই মহান লক্ষ্য অর্জনের সাথে মিল্লি সালামত পার্টি, আফগানিস্তানের হিজবে ইসলামী, তিউনিসিয়ার হারকাতুল ইত্তেহাদুল ইসলামী, সেনেগাল ও জাম্বিয়ার হিজবুল্লাহ পার্টিসহ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার ইসলামী আন্দোলন অমূল্য অবদান রাখছে । প্রকৃতপক্ষে এসব আন্দোলনের একটা ফল হিসেবেই মুসলিম বিশ্বভিত্তিক মুসলিম সংহতির প্রতিষ্ঠান রাবেতা আল আলম আল ইসলামী- এর জন্ম হয়েছে । অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স বা ওআইসি- এর জন্মও এই পটভূমিতেই হয়েছে । মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের ঐক্য সংগঠন হিসেবে ওআইসি- কে নিয়ে আমি পরে আলোচনা করবো । তার আগে বেসরকারী ক্ষেত্রে কর্মরত রাবেতার মতো বিশ্ব ভিত্তিক ইসলামী সংহতির আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করা যাক ।
বিশ্ব- ভিত্তিক মুসলিম সংহতির আন্দোলন হিসেবে রাবেতা আল আলম আল ইসলামী সম্পর্কে আলোচনার আগে এধরনের আরেকটি সংগন মোতামার আল আলম আল ইসলামী সম্পর্কে আলোচনা প্রয়োজন ফিলিস্তিনের গ্র্যান্ড মুফতী আমিন আল হুসাইনির নেতৃত্বে বাদশাহ আব্দুল আযীযের আহবানে মোতামারের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় মক্কায় ১৯২৬ সালে । বিশ্ব মুসলিম সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং তাকে শক্তিশালী করাই ছিল এ সম্মেলনের মূল সুর। মোতামারের পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালে জেরুজালেমে । দীর্ঘদিন পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর ১৯৪৯ সালে করাচী সম্মেলনের মাধ্যমে মোতামারকে পুনরুজ্জীবিত করা হয় । এ আন্দোলন তার সীমিত পরিষদ নিয়ে এখনো কাজ করে যাচ্ছে । কিন্তু মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালের মে মাসে পবিত্র মক্কা শরীফে রাবেতা আল আলম আল ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয় । মুসলিম বিশ্বের ৫৮ জন নেতৃস্থানীয় চিন্তানায়ককে নিয়ে প্রথম সাংগঠনিক পরিষদ গঠিত হয় । রাবেতা পাঁচটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ শুরু করে । এ পাঁচটি লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে ইসলামের বানী ও শিক্ষা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া, ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করা, মুসলিম সংখ্যালঘু এবং নির্যাতিত মুসলমানদের সাহায্য- সহযোগিতার জন্য কাজ করা, ইসলাম প্রচার ও ঐক্য সংহতি রক্ষায় মুসলিম সমাজকে সাহায্য করা প্রভৃতি । এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাবেতা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের অবস্থার উন্নতি এবং সমন্বয় ও সাহায্যকারী ইসলামীক প্রতিষ্ঠান গঠন ও সংহতকরনে সাহায্য করে আসছে । বলা যায়, রাবেতার উদ্যোগ ও সাহায্যের ফলেই আফ্রিকার মুসলমানদের জন্য আফ্রিকান ইসলামিক কো- অডিন্যাটিং কাউন্সিল এবং উত্তর আমেরিকা, দক্ষিন আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার জন্য প্রথক পৃথক ইসলামিক কো- অরডিন্যাটিং কাউন্সিল গঠিত হয়েছে । অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানদের জন্যও রাবেতাগুলোর প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই তার কিছুটা বুঝা যাবে । মুসলিম বিশ্বের আন্তঃরাষ্ট্র সংহতি বিধানের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতির পরিধি ধীরে ধীরে বাড়ছে । সামনের দিনগুলোতে ‘মুসলিম কমন মার্কেট’, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল জয়েন্ট ভেঞ্চার’, ‘ইউনিফর্মিটি এন্ড কো- অপারেশন ইন কাস্টমস এন্ড এ্যালাইড ম্যাটারস’, ‘গ্যাস পাওয়ার ব্যাংক’, ‘কারেন্সি ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন’ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ নেয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে । মুসলিম সংহতির ক্ষেত্রে ওআইসি- এর প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতিকে নিঃসন্দেহেই বিস্ময়কর ব্যাখ্যা দেয়া যায় ।
আকিদা এবং বিশ্বাসগত মৌল যে অধঃগতির কারনে মুসলমানদের সংহতি ও স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে, আনন্দের কথা সেই মৌল বিষয়ের দিকেও ওআইসি- এর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে । তৃতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত মক্কা ঘোষণা এবং চতুর্দশ ইসলামী পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনে গৃহীত ইসলামী মানবাধিকার সম্পর্কিত ঢাকা ঘোষণা খুবই উল্লেখযোগ্য । মক্কা ঘোষণায় ঐতিহাসিক দলিলে আমাদের রাষ্ট্র প্রধাঙ্গন তাঁদের বিশ্বাসের নবায়ন করেছেন । তাঁদের যার অতীত যেমনই হোক, তারা নতুন করে ঘোষণা করেছেনঃ
- ১। আল্লাহর কিতাব এবং নবীর সুন্নাত অর্থাৎ ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান ।
- ২। এ জীবন বিধানই মুসলিম জীবন ও মুসলিম জাতির জীবনের নিরাপত্তা, সংহতি এবং সমৃদ্ধির উৎস ।
- ৩। প্রতিটি মুসলমানকে তাঁদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ ও মূল্যবোধকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে ।
- ৪। ইসলামের সাথে যারাই বেইমানী করবে তারাই হবে দুষ্কৃতিকারী ।
উপরোক্ত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র প্রধানগন বিশ্বের ইসলামী আন্দোলন এবং ইসলামের পুনরজাগরন কারী মুসলিম জনগনের সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন । এর মাধ্যমে ইসলামের পুনরজাগরন কামীদের উপর এতদিন ধরে আরোপিত গোঁড়া, ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল হবার অভিযোগ তারা সরকারীভাবেই ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দিয়েছেন । রাষ্ট্র প্রধানগন ইসলামী আদর্শে Strict Adherence –এর কথাই বলেছেন, ইসলামী আন্দোলনকারীরাও এই Strict Adherence –এর কথাই বলেন । ইসলামের পুনরজাগরন কামী বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের সাথে আমাদের রাষ্ট্র প্রধানদের মতের এই সম্মেলনই তৃতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনের ঐতিহাসিক কীর্তি । এ মাসেই মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কায় চতুর্থ ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে । মুসলিম উম্মাহর প্রত্যাশা মক্কা ঘোষণাকে সামনে রেখে বিশ্ব মুসলিম সংহতির অগ্রযাত্রাকে সত্যিকার অর্থেই গতিদান করা হবে ।
আমি আগেই বলে এসেছি মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের সংহতি আন্দোলন ওআইসি মুসলিম জনগনের কাতার থেকে আসা ইসলামী সংস্কার আন্দোলনেরই একটা ফল । সুররাং আজকের ইসলামী আন্দোলনগুলোর ব্যাপকতা ও শক্তিমত্তার উপরই ওআইসি – এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে । অনাগত ভবিষ্যতটাকে আমি আঁকতে চাই এইভাবে, জনগনের ইসলামী আন্দোলন একদিকে অধিকতর শক্তিশালী ও ব্যাপকতর হতে থাকবে । অন্যদিকে এরই চাপে মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলন ওআইসি- ও ইসলামের নিকটতর হয়ে উঠবে । এইভাবে ভবিষ্যতের কোন এক শুভদিনে এক পয়েন্টে এসে ইসলামী আন্দোলন ও রাষ্ট্র ক্ষমতা এক হয়ে যাবে এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামী খিলাফতের বুনিয়াদ রচিত হবে । মুসলিম সংহতির আজকের প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি নিঃসন্দেহে এই চূড়ান্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অগ্রসর হয়ে চলছে । মুসলিম উম্মাহ আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই শুভদিনের । আমি আমার এই নিবন্ধ এই প্রার্থনা দিয়েই শেষ করছি মুসলিম উম্মাহ এবং ইসলামী আন্দোলনের এই সংহতি প্রচেষ্টাকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কবুল করুন ।