অপরাধ দমনের দর্শন
মানুষের উপায় উপকরণগত দিকের বিচারে এই গ্রহ জীবনের উন্নতি যথেষ্টই হয়েছে। কিন্তু উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্য যদি হয় মানুষের সুখী জীবন, তাহলে বলতে হবে উন্নতি সমৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। শান্তি ও স্বস্তির পরিবেশ আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী হতে ক্রমেই বিদায় নিচ্ছে। হত্যা, সংঘাত, সংঘর্ষ এবং অশান্তি অস্বস্তিতে ভরে উঠছে এই পৃথিবীটা। লক্ষণীয়, অনুন্নত দেশগুলোর চেয়ে উন্নত দেশগুলোতেই এই পাপ কর্মের পরিমাণ পরিধি বেশি। আরও লক্ষণীয়, যেসব দেশে কিছু পরিমাণেও ইসলামের আইন চালু আছে, সেসব দেশে অপরাধ সংগঠনের হার আশ্চর্যজনকভাবে কম। এর মধ্য দিয়ে অপরাধ দমনে ইসলামি আইনের কার্যকারিতা এবং পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী জীবন দর্শনের শূণ্য গর্ভতা প্রমাণিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে আজকের দুনিয়ায় কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক উন্নতি যতটা হয়েছে, মনের মানবিক বিকাশ ততটা হয়নি। হয়নি শুধু নয়, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের এক প্রকার মূর্খতা অনেক ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনকেও অস্বীকার করে বসেছে। সেকুলার ও নিরীশ্বরবাদী সমাজ চিন্তা এর দৃষ্টান্ত। এই অবৈজ্ঞানিক দর্শন ব্যক্তি চিন্তা এবং পরিবার ও সমাজ সম্পর্কের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে। এমন কি নীতিনিষ্ঠ ও মূল্যবোধ সমৃদ্ধ ধর্মীয় সমাজেও যখন কারিগরি জ্ঞানের আড়াল দিয়ে এই দর্শনের প্রবেশ ঘটেছে, তখন সেই সমাজ ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম নীতি ও মূল্যবোধের অধিকার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে নীতি ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে একটি শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শূণ্যতা বলতে কোন জিনিস সৃষ্টিতে নেই। নীতিবোধ যখন কোন জায়গা হতে বিদায় নেয় তখন সে জায়গাটা শূণ্য থাকে না। দুর্নীতি এসে তখন সেখানে আসন গেড়ে বসে। শৃঙ্খলা যখন কোথাও থাকে না, সেখানে তখন বিশৃঙ্খলা আসেই। এইভাবে পাপবোধ যখন মানুষের মন হতে লয় পেয়ে যায়, তখন অপরাধ সংঘটন আর তার কাছে অন্যায় মনে হয়না। পশ্চিমী সভ্যতা এবং পশ্চিমী সভ্যতা প্রভাবিত সমাজগুলোর এই অবস্থা এমন বীভৎস সমাজ দেহের জন্ম দিয়েছে যার তুলনা মাকাফ ফলের সাথেই চলে। ব্যভিচার অপরাধের প্রায় সামাজিকরণ হয়ে গেছে সেখানে। ধর্ষণ পাপের এমন সয়লাব সেখানে যার জন্য পুরুষদের ঘর হতে বের হবার বিরুদ্ধে কারফিউ জারির দাবি উঠে নারী সমাজের পক্ষ হতে। খুন, ডাকাতি, সন্ত্রাসী, রাহাজানি সেখানে মারাত্মক রকম বাড়ছে। সভ্যতার চাকচিক্যপূর্ণ উপরি কাঠামোর আড়ালে সেখানে কি ধরনের পশু মানসিকতার সৃষ্টি হয়ে আছে, তার একটা বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে গত কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক সিটিতে কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ঘটনায়। প্রাচ্যের দেশগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা, এমন কি রাতভর বিদ্যুৎ না থাকার ঘটনা অহরহই ঘটে থাকে, কিন্তু নিউইয়র্ক সিটিকে কয়েক মিনিট বিদ্যুৎ না থাকায় যা ঘটেছিল, তার এক আনাও অন্য কোথাও ঘটে না। বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগে সেদিন নিউইয়র্ক সিটিতে হাজার হাজার ডাকাতি ও দোকান লুটের ঘটনা ঘটে। রাস্তা-ঘাট ও বাড়িতে ধর্ষিতা হয় হাজার হাজার নারী। ধর্মবোধকে বাদ দিয়ে এবং প্রতিষ্ঠিত নীতি ও মূল্যবোধকে হত্যা করে সভ্যতাকে যেভাবে ভারসাম্যহীন করা হয়েছে তারই ফল এটা। ইসলামী নীতি ও মূল্যবোধ এমন সমাজ জীবনের জন্ম দেয় যেখানে অপরাধমূলক ঘটনার এই সয়লাব কল্পনাই করা যায় না। আর এই নীতি ও মূল্যবোধই পারে এই সয়লাব রোধ করে সমাজে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে। ইসলামি আইনের এই ভূমিকাই আজ আমাদের আলোচ্য বিষয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ কি এটা আমাদের প্রথমে জানা দরকার। ইসলামি আইনবেত্তাগণ বলেন, যা শাস্তিযোগ্য এমন কিছু কাজ করা অথবা যা করার নির্দেশ রয়েছে তা পরিত্যাগ করার নামই অপরাধ। এই সংজ্ঞা অনুসাররে অবাধ্যতা, পাপ এবং হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, কারো বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে ঘৃণা ছড়ানো ইত্যাদির মত অন্যায় কর্মকান্ড ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের জন্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে ‘সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান’ অর্থাৎ ‘তাজীর’ এর আওতায় পড়ে এমন সব কাজকেই আমরা অপরাধ বলব। ইসলামি শাস্তি আইনে ‘বিবেচনামূলক শাস্তি’ বা ‘তাজির’ এর ক্ষেত্র ব্যাপক। ইসলামি শরীয়ত বা ইসলামি জীবন বিধানের বাস্তবায়ন ও রক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখিত সব অপরাধই এর আওতায় পড়ে। ‘হুদুদ’ এর মত এক্ষেত্রে শাস্তির বিধানটা সুনির্দিষ্ট নয়। বিচারক তদন্তের মাধ্যমে সব কার্য-কারণ বিচার করে এক্ষেত্রে শাস্তির বিধান দিয়ে থাকেন। সমাজ জীবনের সুস্থতা বিধানের জন্য ‘তাজীর’, ‘হুদুদ’ এর মতই আজ সমাজ গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামের শাস্তি আইনের উদ্দেশ্য মানুষকে কষ্ট দেয়া নয়। বরং অপরাধী, অপরাধ প্রবণ ও অন্যান্যদের নিরুৎসাহিত এবং তাদের সামনে ভয়ের বড় বাধা সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য। এজন্যই ইসলাম প্রকাশ্য স্থানে এবং সকলের সামনে অপরাধীদের শাস্তি কার্য্কর করার বিধান দিয়েছে যাতে করে একজনের শাস্তি দেখে দশজন সংশোধন হতে পারে এবং সকলে অপরাধ হতে বেঁচে থাকার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। ইসলামের এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সুবিবেচনা প্রসূত এবং বৈজ্ঞানিক যা অপরাধ দমনে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে, এখনও রাখছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে।
অন্যদিকে ইসলামী শাস্তি আইনের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে অপরাধের নিরাময়ের ব্যবস্থা নিহিত রয়েছে। ইসলামি শাস্তি আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ এখানে নিম্নলিখিতভাবে তুলে ধরা হয়ঃ
(এক) ইসলামের আইন বিধান স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক প্রদত্ত। মানুষ এই বিধান মেনে নেয় পরকালীন জবাবদিহি ও শাস্তির ভয়ে, ইহজাগতিক কর্তৃপক্ষের ভয়ে শুধু নয়। এই বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে ইসলামি আইন জগতে অতুলনীয়।
(দুই) ইসলামের শাস্তি বিধান অপরাধের সাথে ভারসাম্যমূলক। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়তি জুলুম এখানে নেই।
(তিন) ইসলামি আইন সুনির্দিষ্টভাবে শুধু অপরাধীকেই শাস্তি দান করে, একের অপরাধে অন্যের শাস্তির বিধান এখানে নিষিদ্ধ।
(চার) ইসলামি আইনের সামনে সকলেই সমান। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধনী-নির্ধন, বড়-ছোট, শক্তিশালী-দুর্বল, রাজা-প্রজা ইত্যাদির মধ্যে কোন ভেদ ইসলাম করে না। একজন দরিদ্র নাগরিকের অভিযোগে একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে এই আইনের অধীনে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় এবং শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয়। এই বৈশিষ্ট্যও অতুলনীয়।
(পাঁচ) ইসলামি আইন নৈতিক মূল্যবোধকে সংরক্ষণ করে এবং সমাজকে ইসলামি শিক্ষা আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখে।
(ছয়) ইসলামি আইন বিধান যে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার নিশ্চয়তা বিধানও ইসলামি আইন করে থাকে।
ইসলামি আইন মানুষের মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক। এই অধিকারগুলো যেমন ধর্ম, জীবন, জ্ঞান, ছেলে-সন্তান এবং সম্পদ এর বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্য পরকালিন শাস্তির অতিরিক্ত ইহকালীন শাস্তির ব্যবস্থা করেছে ইসলাম। প্রতিটি মানুষের অপরিহার্য এই অধিকার সংরক্ষণের কাজ ইসলাম দুইভাবে করেছে। প্রথমতঃ এটা করেছে অন্তঃকরণে ধর্মীয় সচেতনা সৃষ্টি এবং নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে তার মধ্যে মানবিক সতর্কতার উত্থান ঘটানোর দ্বারা এবং দ্বিতীয়তঃ হুদুদ, কিসাস ও তা’জীর এর আওতায় শাস্তির বিধান দাঁড় করিয়ে।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ইসলামের কোন কোন শাস্তি আইন কারো কারো কাছে (যেমন পশ্চিমের তথাকথিত মানবতাবাদীরা) কঠোর মনে হতে পারে; কিন্তু এ আইন, এ বিধান সমাজের সার্বিক বালাই ও বৃহত্তর মঙ্গলের জন্যই প্রয়োজন। একজন অপরাধীর দিকে করুণার দৃষ্টি ফেলার সাথে সাথে যদি সমাজের অন্যান্য মানুষের মৌলিক অধিকারের মূল্য ও তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করা হয় তাহলে এটা বুঝা যাবে। পশ্চিমের অনেক দেশ শাস্তি আইনের ক্ষেত্রে অহেতুক উদার হতে গিয়ে দেশকে সীমাহীন অপরাধ সংঘটনের ভাগাড়ে পরিণত করেছে। ইতিহাস সাক্ষী, যে দেশে যে সমাজে ইসলামী আইন কার্যকরী হয়েছে, সেখানে অপরাধ কমে গেছে এবং যেখানেই যে কারণেই হোক অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধান হতে পিছু হটা হয়েছে, সেখানেই অপরাধ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারণেই আজ আধুনিক আইনতত্ত্ব ইসলামি বিধানের দাবি মেনে নিয়ে বলতে শুরু করেছে যে, অপরাধের শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা একান্তভাবেই সমাজ এবং সমাজ শৃঙ্খলার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই অপরিহার্য।
ইসলাম অপরাধীদের প্রতি যে দৃষ্টিভংগি পোষণ করে, সে দৃষ্টিভংগিও সমাজ থেকে অপরাধের মূলোচ্ছেদে সহায়তা করে থাকে। ইসলাম কাউকেই আরোগ্যের অযোগ্য বলে মনে করে না। তওবার মাধ্যমে সংশোধন হওয়ার পথ ইসলাম খোলা রেখেছে। জঘন্য অপরাধীও তওবার মাধ্যমে ভালো হয়ে যেতে পারে। অপরাধীদের এভাবে ভালো হওয়ার সুযোগ ইসলাম সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করে থাকে। নৈতিক মূল্যবোধ উজ্জীবনের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম তিনটি কাজের নির্দেশ দেয়। কাজগুলি নিম্নরূপঃ
(এক) সুসংস্কৃত জনমত গঠন। ইসলাম মানুষকে ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ হতে বিরত থাকতে বলে। সমাজের যারা ভালো ও চরিত্রবান, তাদেরকে ইসলাম দায়িত্ব দেয় মন্দ কাজ হতে অন্যদের ফিরিয়ে রাখতে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সংশোধনের এ দায়িত্ব সমাজে পালিত হলে সমাজ হতে অপরাধ নির্মুল করা সহজ হয়ে যায়।
(দুই) ভালোবাসা ও সহমর্মীতার অনুশীলন। ইসলাম প্রতিটি বিশ্বাসীকে সুকুমার এই হৃদয়বৃত্তিকে সজ্জিত হতে বলে এবং অপরাধকে ঘৃণা করে অপরাধীকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে অনুপ্রেরণা দেয়। সমাজের ভালো লোকদের এই সহমর্মীতা অপরাধীর মনে সৎবৃত্তির উত্থান ঘটায় এবং অপরাধ সংঘটনে তাকে নিরুৎসাহিত করে।
(তিন) অশ্লীল কথা ও কাজের প্রচার না করা। অশ্লীলতার প্রচার না করলে তা যেমন গুরুত্ব হারায়, তেমনি অন্যান্য মানুষের পক্ষে তা হতে বেঁচে থাকা সহজ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কোন কাজের প্রচার না করলে ক্ষতি শুধু অপরাধীরই হয়, কিন্তু তা প্রচার করলে আল্লাহর রোষকেই উদ্দীপ্ত করা হয়।
মানুষের সংশোধন ও সমাজে অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে ইসলামের নৈতিক কর্মসূচী অত্যন্ত সুফলদায়ক। ইমাম গাজ্জালী(রা) বলেছেন, সংশোধনের নৈতিক পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষকে সবপ্রকার পাপ পঙ্কিলতা হতে মুক্ত করা যায়।
মানুষের মধ্যে সৎবৃত্তি উজ্জীবনের নৈতিক কর্মসূচী ছাড়াও অপরাধ বিরোধী সামাজিক প্রতিরোধ কর্মসূচী ইসলাম দেয়। এই প্রতিরোধ কর্মসূচীকে আমরা নিম্নলিখিতভাবে উপস্থাপিত করতে পারি।
(এক) অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য ইসলাম ৫টি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেঃ
(ক) মানুষের মধ্যে ধর্মবোধ বৃদ্ধি এবং তাদেরকে পদস্খলন থেকে বাঁচানোর জন্য সহায়তার হাত প্রসারিত করা।
(খ) মানুষের মধ্যে ভালো কাজের জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করা।
(গ) ভাল কাজ করা এবং মন্দ কাজ হতে বিরত থাকার প্রবণতা সৃষ্টি করা।
(ঘ) মানুষকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক নির্দেশনা দান।
(ঙ) পারস্পরিক সহযোগিতা ও পরামর্শ বিনিময়ের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করা।
(দুই) অপরাধের প্রচার না করে বেড়ানো এবং অপরাধীদের অপরাধ করে চলতে না দেয়া।
(তিন) সন্দেহমুক্ত ‘হুদুদ’ এর আওতাধীন অপরাধের ক্ষেত্রগুলোতে যথাযথভাবে শাস্তি আইনের প্রয়োগ করা। অনুরূপভাবে ‘তাজীর’ এর ক্ষেত্রগুলোতে অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সমস্ত পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা।
(চার) অপরাধীদের জন্য তওবার অবাধ পরিবেশ উন্মুক্ত রাখা।
(পাঁচ) অপরাধীদের সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন না করা এবং অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধের জন্য শাস্তির বাইরে কোন নিন্দা না করা।
(ছয়) অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী হবার জন্য উৎসাহিত করা।
(সাত) সকলের সমৃদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তা বিধানকারী নৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সামাজিক যে দায়িত্ব ইসলামি জীবন বিধান নির্দিষ্ট করেছে, তার বাস্তবায়নের প্রতি যত্ন নেয়া।
উপরে অপরাধ দমন এবং সমাজকে অপরাধ মুক্ত করার ক্ষেত্রে ইসলামের যে নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত বিধান ও কর্মসূচীর সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরা হলো, তা শুধু আজকের বিশ্বে নয়, যে কোন সময়ে যে কোন যুগে অপরাধ দমন ও অপরাধের মূলোচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট। আজকের দুনিয়ায় ব্যাপক অপরাধ সংঘটন ও আইনভংগ করার মত প্রবণতার মধ্যে যে কারণগুলো নিহিত রয়েছে তা মোটামুটি নিম্নরূপঃ
(ক) আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকা।
(খ) উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা না থাকার কারণে শাস্তির ভয় কমে যাওয়া।
(গ) আইন ও শাস্তিকে পাশ কাটানোর সুযোগ থাকা।
(ঘ) শাস্তি পদ্ধতি অপরাধীকে সংশোধন না করে আরও বড় অপরাধীতে পরিণত করা।
(ঙ) সামাজিক ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক সংশোধনের ব্যবস্থা না থাকা।
(চ) ভাল হয়ে সমাজে মর্যাদার সাথে পুনর্বাসিত হবার সুযোগ অপরাধীর না পাওয়া।
(ছ) নৈতিক সংস্কারের কোন সুযোগ না থাকা।
(জ) ধর্মবোধ, পাপ-পূণ্যের ধারণা এবং কৃত কর্মের জন্য পরকালীন জওয়াবদিহী ও শাস্তির ভয় না থাকা।
বিশ্বের অপরাধ পীড়িত দেশের সমাজ ব্যবস্থাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাদের দুরবস্থার মূলে উপরের একাধিক অথবা সবগুলো কারণই সক্রিয় রয়েছে। আজ জগতে এই কারণগুলি দূর করার ক্ষমতা একমাত্র ইসলামি আইনই রাখে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ইসলামে অনেকটা সহজাত। ইসলামি বিধানাবলি যেহেতু আল্লাহর দেয়া সেহেতু এর প্রতি মানুষ বিশেষ ভয় ও শ্রদ্ধাবোধ পোষণ করে যা মানব রচিত আইনের ক্ষেত্রে কল্পনাই করা যায় না। ইসলাম নির্ধারিত শাস্তি আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রদর্শনের কোন অবকাশ নেই। সুতরাং ইসলামের শাস্তি বিধানকে অপরাধীরা ভয় করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে ইসলামি সমাজে ধনী, প্রতিপত্তিশালী, উজির-নাজীর কারো পক্ষেই শাস্তিকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফাকেও এখানে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। এই কারণে ইসলামি আইনের অধীনে সমাজের প্রতিপত্তিশালী, পরাক্রমশালীরাও ইসলামের শাস্তি আইনকে ভয় করে চলে। ইসলামি আইন একজন অপরাধীকে নামকা-ওয়াস্তে শাস্তি দিয়ে আরো অপরাধ সংঘটনের জন্য সমাজে ছেড়ে দেয় না। খুন, ব্যভিচার, চুরি-ডাকাতির এমন কঠোর শাস্তি ইসলাম দেয় যার ফলে অপরাধীরা এই অপরাধ পুনরাবৃত্তির আর কোন সুযোগ সাধারণতঃ পায় না। ‘তাজীর’ এর আওতাধীন অপরাধের ক্ষেত্রেও রয়েছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। এসব শাস্তির পাশাপাশি ইসলাম দিয়েছে সহযোগিতামূলক সংশোধন, অপরাধীদের মর্যাদাপূর্ণ পুনর্বাসন এবং নৈতিক সংস্কারের কর্মসূচী। সর্বোপরি ইসলামি সমাজে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা হয় ধর্মবোধ, পাপ-পূণ্যের ধারণা এবং কৃত কর্মের জন্য পরকালীন জবাবদিহি ও শাস্তির ভয়। ইসলামের এই ব্যবস্থা দুনিয়াতে অদ্বিতীয়। দুনিয়ার অনেক দেশেই আইন আছে, আইনের কড়াকড়িও আছে, কিন্তু ধর্মীয় এই ভিত্তি সেখানে অনুপস্থিত। যা এমনকি এককভাবেই মানুষের মন থেকে যাবতীয় অপরাধ প্রবণতার মূলোচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম। খোদায়ী আদেশ নিষেধ বিশ্ববাসীদের জন্য এমন একটা আইন যার বাস্তবায়নের জন্য কোন পুলিশের দরকার হয় না, কোন পাহারার দরকার পড়ে না। মদ খাওয়া বন্ধ করার ক্ষেত্রে আমেরিকান চেষ্টার ব্যর্থতা এবং মহানবীর চেষ্টার সাফল্যও আজকের দুনিয়াতেও মুসলিম দেশে মদ খাওয়া হারাম বা পাপের ব্যাপার। এমন খোদাভীরু লোকদের যে সমাজ সে সমাজই হয় সুখের, শান্তির ও প্রকৃত সমৃদ্ধির। আর এ ধরনের লোক তৈরিই ইসলামি আইন বিধানের মৌল প্রোগ্রাম। ইসলামের এ প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত হলে শুধু একটি সমাজে নয়, শুধু একটি দেশে নয়, গোটা বিশ্বে অপরাধ প্রদমিত হয়ে, অপরাধের মূলোচ্ছেদ ঘটে আসতে পারে অনাবিল এক শান্তি ও স্বস্তি যার জন্য; বিশ্বের মানুষ আজ হাহাকার করছে।
অনাবিল শান্তি ও স্বস্তির এই সমাজ আমরা দেখেছি ইসলামের স্বর্ণযুগে যখন ইসলামের আইন বিধান পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীকালে উমাইয়া, আব্বাসীয়, ওসমানীয় শাসনামলে যখনই কোন শাসক ইসলামি বিধানাবলির অনুকরণ ও প্রয়োগে জোর দিয়েছেন, তখনই অপরাধের উদ্যত মস্তককে আমরা প্রদমিত হতে দেখেছি, কায়েম হতে দেখেছি সমাজে শান্তি ও স্বস্তি। আজকের যুগেও এই দৃষ্টান্ত অনুপস্থিত নয়। সৌদি আরবের দৃষ্টান্ত আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘রিসার্চ সেন্টার ফর প্রিভেনশন অব ক্রাইম’-এর ডিরেক্টর জেনারেল ড. ফারুক আবদুর রহমান মুরাদ তার এক নিবন্ধে লিখেছেন-
“বিভেদ বিশৃঙ্খলার শিকার আরব উপদ্বীপকে সৌদি শাসন একক একটি রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে নিয়ে আসার পর পরই সেখানে জীবনের সকল স্তরে শরিয়াতী বিধানের বাস্তবায়ন শুরু হয়। অগ্রাধিকার দেওয়া হয় নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও ইসলামের সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের প্রতি। ফলে বিশৃঙ্খলার বদলে ঐক্য, সামাজিক অস্থিরতা ও গোত্র-দ্বন্ধের পরিবর্তে আসে স্থিতিশীলতা এবং জীবন, সম্মান ও সম্পদ নিয়ে দুশ্চিন্তার বদলে আসে নিরাপত্তার আরামদায়ক অনুভূতি। এর আগে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে সকল সুবিধা কুক্ষিগত ছিল এবং অন্য পনর আনা মানুষ ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যেত। এখন, আইনের চোখে সবাইকে সমান মর্যাদা হলো যার ফলে মানুষ শান্তি, সামাজিক সুবিচারের মুখ দেখল।”