একুশ শতকের এজেন্ডা
অস্তায়মান বিশ শতকের উপসংহার থেকেই গড়ে উঠবে একুশ শতকের যাত্রাপথ। তাই এই উপসংহারের স্বরূপ সন্ধান খুবই জরুরী। আমেরিকান এক লেখক তার এক শতাব্দী সিরিজ গ্রন্থে শতাব্দীর ‘Mega Trend’গুলোকে তার মত করে চিহ্নিত করেছেন। এই ‘Mega Trend’ গুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
(ক) বিশ্ব অর্থনীতি
(খ) বিশ্ব রাজনীতি
(গ) বিশ্ব সংস্কৃতি।
এই ‘Mega Trend’ গুলি বিশ শতাব্দীর অনন্য কারিগরি, বৈষয়িক ও বুদ্ধিভিত্তিক উন্নতি এবং এই উন্নয়নের স্রোতে বহমান জাতিসংঘের অনন্য ভূমিকার দ্বারা প্রতিপালিত ও পরিচালিত হয়ে আগামী শতাব্দীর সিংহদ্বারে এক বিশেষ রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই রূপের নির্ণয়ই একবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে দিতে পারে।
প্রথমে বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের গতি প্রকৃতির প্রশ্ন আসে। আশির দশকের শুরু পর্যন্ত বিশ্ব দুই অর্থনীতি পুঁজিবাদ ও কম্যিউনিজমের সংঘাতে সংক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু তারপর মুক্তবাজার অর্থনীতির অপ্রতিরুদ্ধ গ্রাসে সমাজবাদী অর্থনীতির পতন শুরু হলো। আশির দশকের সমাপ্তিতে এসে তা সমাপ্ত হয়ে গেল। আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির গ্রাসে গোটা পৃথিবী। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল কথা হলোঃ শক্তিমান অর্থনীতি বিজয় লাভ করবে, পরাজিত হবে দুর্বল অর্থনীতি। এই পরাজয়ের ভয় দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করে তুলবে এবং সেও উন্নীত হবে বিজয়ীর আসনে। তাই সবাইকেই মুক্তবাজার অর্থনীতির স্রোতে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই তত্ত্ব কথায় উল্লেখিত ‘আইডিয়াল সিচুয়েশন’ হয়তো কোনদিন আসবে কিংবা আসবেই না। তবে তার আগেই শক্তিমান অর্থনীতি করাল গ্রাসে আত্মরক্ষার অধিকারহীন দুর্বল অর্থনীতির পরাধীন হয়ে মরার মত বেঁচে থাকার পর্যায়ে চলে যাবে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতি গলাধঃকরণ করে ইতিমধ্যেই বিদেশী পণ্য বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় বাজার না পাবার আশংকায় বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আসবে না, বরং তা যাবে বাজার দখলকারী দেশের পুঁজিপতিদের কাছে। যাওয়া শুরু হয়েছে। যে বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তা গিয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। এর অন্যথা না ঘটলে অব্যাহত এই প্রবণতা বাংলাদেশকে শিল্পপণ্যের ক্রেতা এবং কৃষিপণ্যের বিক্রেতায় রূপান্তরিত করবে।
বলা হচ্ছে, এই বিনাশ হতে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (WTO). কিন্তু জাতিসংঘের মত এই সংস্থাও শক্তিমানদের দ্বারা পরিচালিত এবং শক্তিমান অর্থনীতিরই স্বার্থ পুরা করবে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থা মুক্তবাজার অর্থনীতির বিশ্বনিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ দুর্বল অর্থনীতির বেয়াড়াপনাকে শায়েস্তা করবার জন্য বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করতে পারবে হয়তো ‘মহান’ মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল্যবান স্বার্থেই।
মুক্তবাজার অর্থনীতির এই বিশ্বরূপ বিশ্বে একক এক অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্যেই। যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে আজকের শক্তিমান অর্থনীতিগুলোই আর শোষিত হবে অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির দেশসমূহ। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের এটাই প্রবণতা।
এই প্রবণতা তার লক্ষ্যে পৌছতে পারলে, একক এক বিশ্ব অর্থনীত গড়া এবং তাকে এককেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়াস সফল হলে বিশ্বের মানুষের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে তার অশুভ প্রভাব নেমে আসবে।
অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী মুসলিম অর্থনীতিগুলোর জন্য এটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চ্যালেঞ্জ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় ‘Mega Trend’ হিসেবে আসে বিশ্ব রাজনীতির কথা।
ইসলাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান একটা বিশ্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যার নেতৃ্ত্ব দেবে ইহুদীরা এবং যার রাজধানী হবে জেরুজালেম। তাঁর স্বপ্নের ভবিষ্যত আমি জানি না, তবে এক বিশ্ব অর্থনীতির মতই এক বিশ্ব রাষ্ট্র গড়ার ধীর ও ছদ্মবেশী প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসে ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতিসংঘ এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র জয় করেছে যেমন কম্যুনিস্ট সাম্রাজ্য, তেমনি জয় করবে গোটা বিশ্ব। বিশেষ সংজ্ঞায়িত এ গণতন্ত্রের আদর্শের কাছে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অধিকারকে বলি দিতে বলা হচ্ছে। বলি না দিলে শক্তি প্রয়োগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। ‘গণতন্ত্রের স্বার্থ’ রক্ষার জন্যই হাইতিতে আন্তর্জাতিক বাহিনী নামানো হয়েছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। এমন হাইতি ভবিষ্যতে আরো অনেক হতে পারে।
গণতন্ত্র কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে গণতন্ত্রের অর্থ ও অধিকারের সংজ্ঞা নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্টের মত মোড়ল গণতান্ত্রিক দেশগুলো যে রক্তস্রোতের ওপর তাদের বর্তমান রাষ্ট্রসংহতি গড়ে তুলেছে, সে রক্তস্রোত প্রবাহিত না হলে এবং সে সময় গণতন্ত্রের নীতি অনুসৃত হলে তাদের এই রাষ্ট্রসংহতি গড়ে উঠতো না। এমনকি রেড ইন্ডিয়ানদেরও একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো। এই ইতিহাস তারা ভুলে গেছে। যেমন আমাদের প্রতি তাদের এখন নসিহত, বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর গায়ে আমাদের হাত দেয়া যাবে না। তথাকথিত ‘আদিবাসি’ বলে তাদের মাটিতে আমাদের পা দেয়া যাবে না। দেশের ভিতরে কোন গ্রুপ বা ব্যক্তি যদি বিদেশী টাকার পুতুল সেজে জাতীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে গলা টিপে মারতে চায়, তাহলেও গণতন্ত্রের আদর্শের স্বার্থে তাদের জামাই আদর দিয়ে যেতে হবে।
গণতন্ত্রের দায়িত্বহীন এই আদর্শ অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী এবং সমস্যা পীড়িত দেশ ও জাতিকে দ্বন্ধ সংঘাতে ক্ষত বিক্ষত এমনকি খন্ড বিখন্ড করতে পারে। অন্তত আর কিছু না হোক বহু মত ও পথে বিভক্ত এবং দুর্বলতো করবেই। এ ধরনের দেশ ও জাতিকে তাদের স্বকীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে অনায়াসেই সরিয়ে আনা যায় এবং তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপর বিদেশী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে এনজিও প্রভাব। এরা নামে নন গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন হলেও এদের সরকারি ভূমিকা ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। এখনি এরা সরকারি বাজেটের একটা অংশ পাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এরা সরকারের গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টর পরিচালনার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে। তখন আইন শৃঙ্খলা ও দেশরক্ষা ছাড়া সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না। জাতিসংঘের অনুসৃত নীতি রাষ্ট্রসমূহের দেশ রক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত অথবা বিলোপ করে দিতে পারে। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষার কাজ অনেক আগেই শুরু করেছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজেও হাত দিয়েছে। অতএব জাতিসংঘ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রসমূহকে দেশ রক্ষা বাহিনী খাতে খরচ বন্ধ করতে বলতে পারে। সুতরাং সরকারের কাজ তখন হয়ে দাঁড়াবে শুধু শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সরকারের এই কাজও নিয়ন্ত্রিত হবে এনজিওদের দ্বারা। কারণ এনজিওরা গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টরের মালিক হওয়ার ফলে দেশের রাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। আর এনজিওরা, সবাই জানেন, আর্থিক ও আদর্শগত দিক থেকে মূলত জাতিসংঘ অথবা জাতিসংঘের পরিচালক শক্তিসমূহের আজ্ঞাবহ। এ অবস্থায় রাষ্ট্রসমূহ কার্যতই জাতিসংঘ নামের এককেন্দ্রিক এক শক্তির অধীনে চলে যাবে।
রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হলো জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধ বিলোপ অথবা দুর্বল করারও একটা প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী চলছে। জাতিসংঘ তার উন্নয়ন, সেবা ও শান্তি প্রতিষ্ঠামূলক এজেন্সিসমূহের মাধ্যমে একটা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ গড়ে তুলেছে এবং পারস্পরিক নির্ভরতার এক অপরিহার্য অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থা জাতীয় চিন্তাকে ধীরে ধীরে পিছনে ঠেলে দেবে এবং আন্তর্জাতিক বিবেচনাকে বড় করে তুলবে। জাতিসংঘের পেছনে ‘নাটের গুরু’ যারা, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই ‘শূণ্য জাতীয় বোধ’-অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
এভাবেই পৃথিবীর আজকের শক্তিমানরা জাতিসংঘের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জাতিসংঘকে এক নতুন বিশ্বরূপ দিতে চাচ্ছে। জাতিসংঘের জননন্দিত সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যামার শোল্ড বলেছিলেন, জাতিসংঘকে হতে হবে ‘বিশ্ব সংস্থা’, ‘বিশ্ব সরকার’ নয়। সে হবে উন্নয়ন ও শান্তির সহায়তাকারী, কোনক্রমেই জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোন সিস্টেমের ডিক্টেশনকারী নয়। কিন্তু জাতিসংঘকে আজ রাষ্ট্রসমূহকে দুর্বল ও নিরস্ত্রীত্ব করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বের দুর্বল জাতিসমূহের মত মুসলমানদেরকেও একবিংশ শতকের এই জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
বিশ্বে এক অর্থনীতি ও এক রাজনীতির মত গোটা বিশ্বকে এক সংস্কৃতির অধীনে আনারও দুর্দান্ত প্রয়াস চলছে। এই লক্ষ্যে দুনিয়ার মানুষের জন্য একক এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ কাজ করছে। তারা চাচ্ছে গোটা দুনিয়ার জন্য মূল্যবোধের একক একটি মানদন্ড নির্ধারণ করতে। এই মানদন্ডের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সেক্যুলার হিউম্যানিজম’। জাতিসংঘের এই সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে এই তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে যে, মানবাধিকার সকলের উর্ধ্বে। জাতীয় ধর্ম, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য, ইত্যাদি অধিকার সবই এর অধীন। এই অধিকারগুলো ততটুকুই ভোগ করা যাবে, যতটুকু মানবাধিকার অনুমোদন দেয়। জাতিসংঘের এক দলিলে এভাবে বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক জীবন ও পরিচয়ের বিকাশসহ সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির জন্যই স্বীকৃত। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অধিকারকে সীমাহীন করা যাবে না। যখনই তা মানুষের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে, তখনই সংস্কৃতির অধিকার অচল হয়ে পড়ে। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, সাংস্কৃতিক অধিকারকে মানুষের মৌল স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না(United Nation Background note-by Diana Ayten Shenker). এই দৃষ্টিভঙ্গিই জাতিসংঘের নাইরোবি সম্মেলন, কায়রোর জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন, কোপেনহেগেনের সামাজিক শীর্ষ সম্মেলন, বেইজিং এর বিশ্ব নারী সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আরো হবে। উদ্বেগের বিষয়, এসব সম্মেলনে সুকৌশলে প্রণীত ‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ’ (Secular Humanism)প্রতিষ্ঠার দলিলে অধিকাংশ মুসলিম দেশও দসখত করছে। অথচ জাতিসংঘ প্রচারিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ’ এর তত্ত্ব মেনে নিলে ইসলামকে কেটে ছোট বিকলাঙ্গ করে মসজিদে পুরে রাখতে হবে। তাদের বলা উচিত ছিল, ‘তথাকথিত সার্বজনীন মানবাধিকার আইন নিশ্চিতভাবেই মানবজীবন, তার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ঐতিহ্যিক সংরক্ষণকে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন করে তুলতে পারে। ইসলামের আদর্শ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে কার্যকরভাবে মানব মর্যাদার প্রতিষ্ঠা হয়, `সেটাই হয় সত্যিকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা।’ কিন্তু এ কথা কেউ আমরা বলি নি।
এভাবে অন্য কেউও বলছে না, অন্য জাতি, অন্য ধর্মও নয়। তার ফলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ’-বিশ্ব সংস্কৃতির একমাত্র মানদন্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্য কথায় এটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব সংস্কৃতি।
এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা আমাদের ধর্ম পালন করতে পারবো না। উত্তরাধিকার আইনকে বলা হবে মানবাধিকার বিরোধী, শাস্তি আইন অভিহিত হবে বর্বর বলে। পর্দাকে বলা হবে মানবাধিকারের খেলাফ, কুরবানীকে বলা হবে অপচয় ইত্যাদি। এমনকি ইসলামের দাওয়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে মানবাধিকার পরিপন্থী বলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোথায় জাতীয় আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হলে তাকে বলা হবে মানবাধিকার বিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে।
‘সেক্যুলার হিউম্যানিজম’ প্রকৃতপক্ষে একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য মানুষকে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে নেয়া। মানুষের ধর্ম না থাকলে তার জাতীয়তা ধ্বসে পড়বে। জাতীয়তা ধ্বসে পড়লে তার রাষ্ট্রও ধসে যাবে। এটাই চাচ্ছে আজকের ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্ব নিয়ন্ত্রকেরা।
বিশ্বে ধর্মসমূহকে বিশেষ করে ইসলামকে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিরোধী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে একবিংশ শতকে।
বিশেষ করে ইসলামকেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, অন্য ধর্মগুলির কোনটিই পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকরী নয়। সুতরাং তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে না, করতে চাইলেও তারা পারবে না। কিন্তু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। শুধু ইসলামই তাদের চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকতে পারে। ইসলামের শত্রুরাও এ কথা বলেছে। ‘The End History’ এর লেখক ফ্রান্সিস ফকুয়ামা কম্যুনিজমের ধ্বংস স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য চিন্তাধারার বিজয় প্রমাণ করেছে যে, পশ্চিমা উদারনৈতিক মতবাদের পরিদ্বন্ধী সব ব্যবস্থাই আজ খতম হয়ে গেছে।’ কিন্তু তিনিই আবার বলেছেন, ‘তবে প্রতিদ্বন্ধিতা একটা হবে ধর্মের সাথে আসছে একবিংশ শতাব্দীতে’ এবং তাঁর মতে সে ধর্ম ইসলাম।
সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে মানবতার সামনে, তার মোকাবিলা ইসলামকেই করতে হবে।
আর এ দায়িত্ব বিশ্বের মুসলমানদের। আনন্দের বিষয়, এ দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় জীবনে যে রেনেসাঁ প্রয়োজন, সে রেনেসাঁ আজ সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম বিশ্বে। রেনেসাঁর নিশান বরদার সংগঠনেরও সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম দেশে দেশে। ক্রমবর্ধমান হারে তরুণদের সম্পৃক্তিতে এ সংগঠনগুলো বিকশিত হয়ে উঠছে। ত্যাগ ও কুরবানীর ক্ষেত্রেও রেনেসাঁ-কাফেলার নিশান বরদাররা পিছিয়ে নেই। আজ গোটা দুনিয়ায় আদর্শের জন্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিচ্ছে একমাত্র মুসলমানরাই।
তবে প্রয়োজনের তুলনায় এবং চ্যালেঞ্জের মুখে এটুকুই যথেষ্ট নয়। এসব কাজকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মৌল কিছু বিষয়ে মুসলিম তরুণদের নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মৌল এই বিষয়কে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়ঃ
(ক) নিজেদের জীবন ব্যবস্থা ও তার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন। কুরআন, হাদীস এবং মহানবীর জীবন সম্পর্কে তো অবশ্যই, ইসলামের আইন ও ঐতিহ্য সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
(খ) ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রতিটি মুসলিম তরুণকে তার চারপাশে যা আছে, যা ঘটছে তার প্রতি তীক্ষ্ম নিরীক্ষণী দৃষ্টি রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক –সব বিষয়েই। এই নিরীক্ষণের ক্ষেত্রে তাদের মনে রাখতে হবে, দৃষ্টি মনোহারীতা নয় সত্যই আসল কথা। আজ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন প্রচারণার জোরে খুব সহজেই মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এ অবস্থায় গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিবোধ সামনে রেখে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
(গ) তীব্র সাংস্কৃতিক সংঘাতের এই যুগে মুসলিম তরুণদেরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক নীতিবোধ ও পরিচয়কে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। আর্ট, আরকিটেকচার হতে শুরু করে জীবনচর্চার সকল ক্ষেত্রে ইসলামের চিন্তা ও দর্শনকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে ইসলামের সাথে অন্য সংস্কৃতিগুলোর মৌল পার্থক্যসমূহ। এই পর্যালোচনার জ্ঞান তাদেরকে নিজেদের এবং অন্যদের অবস্থান বুঝতে সাহায্য করবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমর্থ করে তুলবে।
(ঘ) মুসলমানদের বিজ্ঞানের যে পতাকা ৯শ’ বছর আগে অবনমিত হয়েছিল এবং সাড়ে ৬শ বছর আগে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল, সেই পতাকার গর্বিত শির আবার উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য মুসলিম তরুণদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।
(ঙ) ইসলাম সকল যুগের সর্বাধুনিক মতবাদ। এই মতবাদকে যুগ-পূর্ব অচল ভাষা বা কৌশলে নয়, যুগশ্রেষ্ঠ ভাষায় যুগ-উত্তর লক্ষ্য সামনে রেখে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু তাহলেই এই আদর্শ যুগ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সকল মানুষের ঘরে গিয়ে পৌছতে পারবে।
এই করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে মুসলিম তরুণরা যে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে সজ্জিত হবে, তা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন।
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মূলতই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে অবশ্যই অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমরশক্তির মত দিকগুলো আছে। তবে এগুলোর অর্জন, অধিকার, ব্যবহার, কার্যকারিতা-সবকিছুই বুদ্ধির শক্তির ওপর নির্ভরশীল। কম্যুনিজম রক্ষার সব অস্ত্র, সব অর্থ সোভিয়েত ভান্ডারে থাকার পরেও বৈরী জ্ঞান ও সংষ্কৃতির সয়লাবে যেমন তা শেষ হয়ে গেছে, তেমনি ‘সেক্যুলার হিউম্যানিজম’ এবং আগ্রাসী পুঁজি ও আধিপত্য রক্ষার ‘গণতন্ত্র’ তার ভান্ডারে সব অস্ত্র, সব অর্থ রেখেই শেষ হয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন শুধু ইসলামের মহান মানবতাবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির আধুনিকতম মানের প্রচন্ড এক সয়লাব।