দিকে দিকে পুনঃজ্বলিয়া উঠিছে
তুরস্কের সুলতান দিগ্বিজয়ী সুলাইমানের মৃত্যু ( ১৫৫৬ খ্রিঃ ) এবং লোপাস্তোর নৌযুদ্ধে তুর্কি নৌবহরের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বে মুসলমানদের রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক তুর্কি খেলাফতের পতন পর্ব শুরু হয় । পূর্ব- দক্ষিন এশিয়ায় মুসলিম শাসন শক্তির প্রতীক ছিল মুঘোল সাম্রাজ্য । ১৭০৭ সালে সম্রাট আওরংগজেবের তিরোধানের মধ্য দিয়ে তারও পতন শুরু হয়ে যায় । ১৭৫৭ সালে হিমালয়ান উপমহাদেশে শুরু হয় ব্রিটিশ শাসন । উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম শাসনের শক্ত ঘাটি মিশর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে চলে যায় ১৮১২ সালে । তারও অনেক আগে ১৭৫০ সালের মধ্যেই মুসলিম দুনিয়ার পূর্ব প্রান্তের শক্ত দরওয়াজা ইন্দোনেশিয়া উপনিবেশিক শক্তির হাতে চলে যায় । এক কথা অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে উনিশ শতকের প্রারম্ভকালের মধ্যেই প্রায় গোটা ইসলামী দুনিয়া ভূখণ্ডিক এবং রাজনৈতিক পরাধীনতার গাড় তিমিরে ঢাকা পড়ে যায় । ভূখণ্ডিক এবং রাজনৈতিক পরাধীনতার অবশ্যম্ভবী ফল হিসেবে তাঁদের উপরে জেঁকে বসে সাংস্কৃতিক দাসত্বের কালো থাবা । একজন সমীক্ষকের ভাষায়, “The invaders took the task of ‘westernizing us. The pseudo Vlamas they planted in our religious centres, the agents they employed in the Universities, Government, Educational institutions and publishing houses and the missionaries and the orientalists who worked in the service of the imperialist forces, put their energies in order to distort the noble teachings of Islam.”
ইসলামের শিক্ষাকে বিকৃত করার তাঁদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি । আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভি তার ‘Islamic Awakening between extremism and Rejection’ গ্রন্থে লিখেছেন, “পূর্ণাঙ্গ, ভারসাম্যময় ও সুবিচার পূর্ণ বিধান হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম স্বদেশেই নির্বাসিত হয়েছে । সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্র পরিচালনা, মানুষ ও সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক তথা সর্বক্ষেত্রে ইসলাম অপসারিত । ইসলামকে শরিয়ত ছাড়া দ্বীন, রাষ্ট্র ছাড়া ধর্ম এবং কর্তৃত্ব ছাড়া আইনের কিতাবে পর্যবসিত করা হয়েছে ।”
ইসলামী দুনিয়ার এই অবস্থা সামনে রেখেই ‘The Return of Islam’ নিবন্ধে Barnard Lewis রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) এর ‘আল- লাত’ ও ‘আল- উজ্জার’ মতো মূর্তি উৎখাতের সংগ্রামের দিকে ইংগিত করে বিদ্রুপের সাথে লিখেছেন, “এখনো মুসলমানরা সংগ্রাম করছে, তবে সেটা ‘আল- লাত’, ‘আল- উজ্জার’ মতো মূর্তি বিদায়ের জন্য নয় বরং ‘রাষ্ট্র’, ‘জাতি’ ও ‘বর্ণ’ এর মতো নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ।” মুসলমানদের এই অবস্থা দেখে Barnard Lewis এর মতো অনেকেই বিদ্রূপের হাসি টেনে উপসংহার টেনেছেন , ইসলামের প্রত্যাবর্তন আর সম্ভব নয় । কিন্তু তাঁদের সকলের অনুমান, উপসংহার মিথ্যা প্রমান ইসলাম তার শক্তিমত্তা প্রমান করেছে । পতনের পঙ্ক থেকে মুসলমানদের উত্থানের শক্তি হিসেবে ইসলাম সূর্য শিখার মতো জেগে উঠেছে অন্ধকারের বুক চিরে । ইসলামের অপরাজেয় শক্তি – সঞ্জীবিত মুসলমানদের বেপরোয়া উত্থানের সূর্য শিখা শুধু ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া নয়, শুধু বাংলাদেশ- ভারত পাকিস্তান নয়, প্রজ্জলিত হয়েছে প্রতিটি মুসলিম দেশে- সারা বিশ্বে । শুধু উত্থান নয়, যে পশ্চিমী শক্তি মনে করেছিলো ইসলামকে তারা শেষ করে দিয়েছে সেই পশ্চিমের জন্যই ইসলাম আজ একক শক্তিশালী এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে । Godfreys Jansen তার ‘International Islam’ শীর্ষক আলোচনায় ‘Moslems and the Modern World’ নিবন্ধে স্বীকার করেছেন, “Today Islam and the modern western world confront and challenge each other. No other majore religion posses such a challenge to the west. Not Christianity, which is a part of the western world which has been eaten up from within by the acids of the modernity. Not Hinduism and Buddhism, because their radiation to the west has been and is on high ethereal plan. And not Judaism , which is too small and tribal a faith. Not guru, no swami, no lama, no rabbi has had any impact on the west comparable to that exerted by the chaliph, the mahdi and the ayatollah, or by the that stereotype haunting the western imagination, the mullah Leading the Jihad . ( The Economist, January 3, 1981 )
অর্থাৎ “ইসলাম ও আধুনিক পশ্চিমী দুনিয়া আজ পরস্পর মুখোমুখি এবং একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করছে । আর কোন ধর্মই পশ্চিমের প্রতি এমন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় নি । খৃষ্টধর্ম কোন চ্যালেঞ্জ হয়নি, কারন খ্রিস্টধর্ম নিজেই পশ্চিমী দুনিয়ার অংশ এবং আধুনিকতার গ্রাস তাকে ভেতর থেকেই শেষ করে ফেলেছে । হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মও চ্যালেঞ্জেই আসেনা, কারন তা এক ক্ষুদ্র গোত্রীয় ধর্ম । ‘খলিফা’, ‘মাহদি’, ‘আয়াতুল্লাহ’ প্রভৃতি শব্দ পশ্চিমী চিন্তাধারাকে যেভাবে আলোড়িত করেছে সে তুলনায় ‘গুরু’, ‘স্বামী’, ‘লামা’, ‘রাব্বি’ কোন গুরুত্বই বহন করে না ।”
মুসলিম দুনিয়ায় রাজনৈতিক পতনের সাথে সাথেই ইসলামের এই উত্থান শুরু হয় । আমাদের হিমালয়ান উপমহাদেশ যখন সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের গ্রাসে চলে যাচ্ছিলো, তখনই সাইয়েদ আহমেদ ব্রেলভীর জিহাদ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, তিতুমীরের এবং হাজী শরিয়তুল্লাহর মুক্তি আন্দোলন এই সময়েই শুরু হয় । ইসলামী দুনিয়ার রাজনৈতিক পতন ঘটেছিলো শাসক মহলের আদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক বিচ্যুতির কারনেই । পরাধীনতার অন্ধকার যখন নেমে এলো, তখন শাসক মহল নয়, ইসলামী জনতার চত্বর থেকেই এলো প্রতিরোধ । প্রতিটি মুসলিম দেশে সাইয়েদ আহমেদ ব্রেলভী, হাজী শরিয়তুল্লাহ এবং তিতুমীরের মতো ইসলামী জননেতাগণ উপনিবেশিক শক্তির প্রতিরোধে এগিয়ে এলেন । এই প্রতিরোধই উত্তরকালে পরিনত হলো জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে । গোটা ইসলামী দুনিয়ায় প্রতিটি মুসলিম দেশে ইসলাম এবং ইসলামী জননেতাগনই মানুষের মুক্তির চেতনাকে প্রজ্বলিত করেছে এবং এগিয়ে নিয়েছে মুক্তির সংগ্রামকে সাফল্যের সিংহদারে । ইন্দনেশিয়ায় মোহাম্মাদিয়া আন্দোলন, ভারতে মুজাহিদ আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এবং জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান, মুসলিম লীগের আন্দোলন, লিবিয়ার সেনুসী এবং অমর মুখতারের ( রঃ ) আন্দোলন, আরব উপদ্বীপে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব ( রঃ ) এর আন্দোলন, নাইজেরিয়ায় উসমান দাম ফোদিও ( রঃ ) এর আন্দোলন, আলজেরিয়ায় আব্দুল কাদিরের আন্দোলন, মরক্কোর আব্দুল করিম রিফের আন্দোলন এবং সোমালিল্যান্ডে মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহর আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে আদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক চেতনার উদ্ভব ঘটিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার দীপশিখা আবার প্রজ্বলিত করে । কিন্তু স্বাধীনতা যখন এলো, তখন উপনিবেশিকরা তা তুলে দিলো তাঁদের ভুক্তভোগী বা বেতনভোগী শিক্ষা-সংস্কৃতি গলাধঃকরনকারী অনুগামীদের হাতে । যারা মুখে ইসলামের শ্লোগান দিলেও উত্তরকালে হয়ে দাঁড়ালো ‘নব্য উপনিবেশিক’ । যাদের হাতে প্রতারিত হলো দেশ এবং দেশের জনতা । ইন্দনেশিয়ায় ডঃ সুকর্ণ, হিমালয়ান উপমহাদেশে পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ, মিসরে বাদশাহ ফারুক এবং নাসের, আলজেরিয়ায় বেন বিল্লাহ ও হুয়ারী বুমেদিন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মতো প্রতিটি নব্য স্বাধীন মুসলিম দেশের নব্য শাসকরা ইসলামের সাথে, মুসলমানদের সাথে এবং তাঁদের প্রতিশ্রুতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো । ফলে স্বাধীনতা এসেও তা ফলপ্রসূ হলো না । স্বাধীনতা তার জনগনকে নিজ মেরুদণ্ডের উপর দাড় করাতে পারলো না । স্বাধীন হয়েও জনগণকে শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তা আর আদর্শের ক্ষেত্রে পরাধীনতার শৃঙ্খল বয়েই চলতে হলো ।
এই পটভূমিতেই প্রতিটি মুসলিম দেশে ইসলামী জনতার কাতার থেকে জোরদার হয়ে মাথা তুলেছে ইসলামী আন্দোলন । ইন্দোনেশিয়ায় মোহাম্মাদিয়া আন্দোলন এবং মাসুমী পার্টি, মালয়েশিয়ায় পাস এবং আবিম, বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-কাস্মীর-শ্রীলংকায় জামায়াতে ইসলামী, আরব দেশগুলোতে ইখওয়ানুল মুসলিমিন, আলজেরিয়ায় ইসলামিক সালভেশন পার্টি, আফগানিস্তানের হেজবে ইসলামী এবং জমিয়তে ইসলামী, তিউনিসিয়ায় আল নাহাদা, তুরস্কের ট্রুথ পার্টি ইত্যাদি এই ইসলামী আন্দোলনের সুবিশাল কাফেলাড় কয়েকটি নাম । এই কাফেলা সংগ্রাম করছে দেশ এবং জনতার প্রকৃত মুক্তির জন্য । প্রথম স্বাধীনতা দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতা এনেছে, উপনিবেশিকদের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করেছে কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিরংকুশ- হয়নি, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা তো আসেইনি । ইসলামী আন্দোলন দ্বিতীয় মুক্তি, দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম করছে, সেই সংগ্রামের মাধ্যমেই আসবে উপনিবেশিকদের প্রভাবমুক্ত রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং আসবে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আজাদী । ইসলামী আন্দোলন মুসলিম দেশগুলোর এবং ইসলামী জনতার স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার আজ একমাত্র অবলম্বন ।
এই বাস্তবতা যেহেতু সবার কাছেই পরিস্কার সাবেক উপনিবেশিক প্রভুদের কাছে যারা এখনো শোষণ করছে মুসলিম দেশগুলোকে, পরিস্কার উপনিবেশিকদের ধ্বংসাবসেষ সেকুলার মুসলিম শাসকদের কাছে, যাদের তরফ থেকে ইসলামী আন্দোলন আজ প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে । ইন্দোনেশিয়ায় ‘মাসুমী আন্দোলন’ পঞ্চাশের দশকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, আজও তার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি । উপরন্তু বিভিন্ন বিধি- নিষেধ আরোপ করে ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক উত্থানকে বাধাপ্রাপ্ত করা হচ্ছে সেখানে । তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনকে কয়েকবার নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে এবং তার স্বাভাবিক চলার পথে বাঁধা সৃষ্টি করা হচ্ছে । তিউনিসিয়ায় ইসলামী আন্দোলন ‘মুভমেন্ট অব ইসলামিক টেন্ডেন্সী’ অব্যাহত জেল জুলুমের শিকার হয়ে আসছে । সম্প্রতি তাকে নাম পাল্টাতে বাধ্য করা হয়েছে। তিউনিসিয়ার ইসলামী আন্দোলন ‘মুভমেন্ট অব ইসলামিক টেন্ডেন্সী’ এখন আল নাহাদা নাম নিয়ে আন্দোলন করছে । আলজেরিয়ার ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা আজ সকলের সামনে । মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমুন – কে পঞ্চাশের দশকে বেআইনি করা হয়েছে । শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, জেল জুলুমের শিকার হয়েছে হাজার হাজার কর্মী- সমর্থক । সেখানে ইসলামী আন্দোলনের গতিরোধ করার জন্য এমন কোন কাজ নেই যা করা হয়নি । মিসরের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ইসলামী আন্দোলনের গতি রোধ করার জন্য কতদূর নেমেছিল তার একটা সুন্দর বিবরন দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যাসাসুসেটস’ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Yvonne Y. Haddod তার ‘Islamic Awakening in Egypt’ নিবন্ধে ১৯৮৫ সালের একটি চিত্র এইভাবে এঁকেছেন, “In July of 1985 President Mubarok ordered the removal of all religion proclamation from public places. Overnight they disappeared. The government press explained that it was becoming a provocation and thus might lead to sectarian division. Police at road blocks stopped cars and find drivers for even carrying a dangling picture of a slant, an amulet, or a chain of prayer beads around the rear view mirror or on the dash board. The penalty for such demonstration of religious affiliation was the suspension of the cars registration for a year.”
অর্থাৎ ১৯৮৫ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট হুসনী মুবারক সকল প্রকাশ্য স্থান থেকে ধর্মীয় বানী সমূহ অপসারণের নির্দেশ দিলেন । রাতারাতিই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হলো । সরকারী সংবাদ মাধ্যম এই পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলল, ঐ বানী সমুহ উস্কানিমূলক যা সাম্প্রদায়িক বিভক্তি ডেকে আনতে পারে । মোড়ে মোড়ে গাড়ি থামানো হতো এবং ড্রাইভারদেরকে এমনকি পীর- দরবেশ ধর্ম নেতাদের ছবি ঝুলিয়ে রাখা, কবজ রাখা, গাড়ির রিয়ার ভিউ আয়নায় তসবি ঝুলিয়ে রাখার জন্যও জরিমানা করা হতো । এই ধরনের ধর্মানুরুক্তি বা ধর্ম প্রীতি প্রদর্শনের শাস্তি স্বরূপ এক বছরের জন্য গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হতো ।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও মিসরে ইসলামী আন্দোলনের গতি রুদ্ধ হয়নি বরং মানুষের কাছে তার আবেদন আরও গভীরতর হয়েছে, তার প্রভাব আরও বিস্তৃতই হয়েছে ।
Carnegie Endowment for International Peace এর সিনিয়র এ্যাসোসিয়েটস Robin Wright তার ‘The Islamic Resurgence : A New Phase’ নিবন্ধে লিখেছেন, “Majore developments 1987 indicated that the Islamic resurgence has taken deep root in the middle east with unprecedented impact in modern times. Its current depth and breadth, particularly in states long known for their stability and moderation, also indicate that Islam is almost certain to be the single most energetic force in the region for the foreseeable future – In Egypts April election the Muslim brotherhood become the largest legal opposition force.”
অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের প্রধান ঘটনাবলী ইংগিত দিচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী জাগরণের শিকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত । মধ্যপ্রাচ্যের এমনকি স্থিতিশীল ও প্রগতিশীল দেশগুলোতেও ইসলামী আন্দোলনের গভীরতা ও বিস্তার এ কথারই প্রমান দিচ্ছে যে, আগামীতে এ অঞ্চলে ইসলাম নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত শক্তিমান একক এক শক্তিতে পরিনত হতে যাচ্ছে । মিসরে এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড সবচেয়ে বৃহৎ বৈধ বিরোধীদল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে । ”
উল্লেখ্য এই নির্বাচনে সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডকে সাধীনভাবে এবং স্বাভাবিক কাজকর্মও করতে দেয়নি । নির্বাচনের আগে তাঁদের প্রায় ৩ হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করে রাখা হয় এবং নির্বাচনের ফলাফলকে সরকার নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে । এরপরেও এই রেজাল্ট হয়েছে । শত বাঁধা সত্ত্বেও মিসরে যেমন ইসলামী আন্দোলনের বিস্তার ঘটছে, তেমন ঘটনা অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও আমরা দেখছি । আলজেরিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের গতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে বহুদিন থেকে । আলজেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্ত্রাস করতো বামপন্থীরা, সন্ত্রাসের শিকার হতো ইসলামপন্থী ছাত্ররা, আবার উল্টো জেল-জুলুমের শিকারও হতো এই মজলুমেরাই । ১৯৮৭ সালে ইসলামী আন্দোলনের ১৮৭ জন কর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় এবং শাস্তি দেয়া হয় । কিন্তু ইসলামী আন্দোলন তাতে আরও গতিমানই হয়েছে । ১৯৯১ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্ট শতকরা ৮০ ভাগ আসন লাভ করে । এই নির্বাচনে বিজয়ের পর ফ্রন্টের সকল শীর্ষ নেতাকে এবং হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয় । এবার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় । এই নির্যাতন এবং দমন নীতির পরেও এবং সকল শীর্ষ নেতা ও অসংখ্য কর্মী জেলে থাকা সত্ত্বেও গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্ট ২৩১ টি আসনের মধ্যে ১৮৮ টি আসন লাভ করে । দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৯ টি আসনে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল গত জানুয়ারী মাসে । নিশ্চিতভাবেও এ নির্বাচনেও ইসলামী সালভেশন ফ্রন্টই বিজয়ী হতো । এই অবস্থা আঁচ করে সমস্ত নির্বাচনই বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্টের উপর জুলুম- নির্যাতন শুরু হয়েছে । ফ্রন্টকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে । কিন্তু এইসব পদক্ষেপ দ্বারা আলজেরিয়ায় ইসলামী আন্দোলনকে আরও জনপ্রিয়, আরও শক্তিশালীই করা হচ্ছে । তুরস্কেও ইসলামী আন্দোলনকে দুর্বল করার এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ চালিয়ে যেতে না দেয়ার অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেখানকার সরকার । তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনকে কিছুদিন আগে তৃতীয় বারের মতো নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছে । তাঁদের নতুন নাম হয়েছে ‘ট্রুথ’ পার্টি । এ নাম নিয়ে নির্বাচনে নেমেও এ দলটি সাম্প্রতিক নির্বাচনে ১৬ ভাগ ভোট পেয়েছে, সরকার গঠনকারী দল পেয়েছে ৩০ ভাগের মত। সমীক্ষকদের ভাষায় ইসলামী আন্দোলন সেখানে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে । অন্যান্য মুসলিম দেশেও এই একই অবস্থা ।
আফগানিস্তানে ৯ বছরব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তারা সোভিয়েত পরাশক্তিকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে । পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ইসলামী আন্দোলন ক্রমবর্ধমান হারে তারুণ্যকে আকৃষ্ট করছে এবং যৌবন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠছে । বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামী হাজারো অপপ্রচার, বাঁধা- বিপত্তি সত্ত্বেও গত বছরের সাধারন নির্বাচনে ভোট প্রাপ্তির বিচারে তৃতীয় বৃহত্তম স্থানে উন্নীত হওয়া তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতেরই ইংগিতবহ । মালয়েশিয়ায় এইস সম্ভাবনা আরও উজ্জলতর । ইন্দোনেশিয়ার তরুণেরাও পিছিয়ে নেই । সরকারী দমন নীতির কারনে সেখানে একটা আপাত নিস্তরঙ্গতা দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ভেতরে ইসলামী জাগরণের বহ্নিশিখা সর্বব্যাপী এবং দীপ্ততরই হয়ে উঠছে ।
এক কথায় গোটা ইসলামী দুনিয়ায় ইসলামী আন্দোলন সকালের নতুন সূর্য শিখার মতো দীপ্ত । দিনের আবর্তনের মতো দিন যতই যাচ্ছে এই সূর্য শিখা ততই দীপ্ত হয়ে উঠছে এবং তার প্রভাবে অন্ধকার দূর হচ্ছে । বিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত ইসলামের ঘাড়ে চড়ে জাতীয়তাবাদ মুসলিম দেশগুলোকে মুক্ত করেছে, এনেছে ভৌগোলিক স্বাধীনতা । বাকী আছে উপনিবেশিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষাদর্শের কবল থেকে মুসলমানদের মুক্ত করা তাদেরকে প্রকৃত স্বাধীন করার কাজ । এ দায়িত্ব ইসলামের । মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামী আন্দোলন এ দায়িত্বই পালন করছে । এই আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়ার সাধ্য আজ কারো নেই ।
‘মৌলবাদ’, ‘মধ্যযুগীয়’ ইত্যাদি বলে উটপাখির মত কেউ এর দিক থেকে চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন তাতে এই বাস্তবতার কোন ব্যত্যয় ঘটবে না । এ অন্ধরা চোখ বন্ধ করে সত্যকেই অস্বীকার করতে চায় । Yvonne H. Haddod –এর মতো খৃষ্টান চিন্তাবিদ পর্যন্ত আজ স্বীকার করছেন, “Thus Islam is posited as the only viable vision of a better world order. This ( Islamic ) religious literature is modern in idiom as well as content, it takes the twentieth century seriously. Those who denigrate revivalist and relegate them to the dark ages, the middle ages or the seventh century, are at best completely missing the dynamics of the relevance of the religion for modern life., or at worst, purposefully ignore the new developments in the content and meaning of various Islamic doctrines.” ( Islamic awakening in Egypt, ASQ, Volume-9, Number -3,page- 255 )
অর্থাৎ, “এইভাবে ইসলাম উৎকৃষ্টতর একক এক বিশ্ব ব্যবস্থার আস্থাশীল রূপরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে । ইসলামী সাহিত্য ভাষা এবং বিষয় সবদিক থেকেই আধুনিক যা সাংঘাতিকভাবে বিশ শতকের । যারা ইসলামী পূর্ণজাগরন বাদীদের গাল দেয় এবং তাঁদেরকে অন্ধকার যুগ, মধ্য যুগ অথবা সপ্তদশকের মানুষ বলে অভিহিত করে, তারা আধুনিক জীবনে ধর্মের সাজুজ্জতা ধরতে সম্পূর্ণভাবেই ব্যর্থ হন অথবা ইসলামের বিভিন্ন মতবাদের অর্থ ও বিষয়ে যে উৎকর্ষতা এসেছে তা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই উপেক্ষা করেন ।”
সন্দেহ নেই ইসলামের সত্য এইভাবেই সূর্যের মতো সকলের কাছে দেদীপ্যমান হয়ে উঠবে । উটপাখিদেরও চোখ খুলবে, কুম্ভকর্ণদেরও ঘুম ভাঙ্গবে ।
শুধু ইসলামী দুনিয়া নয়, বিশ্বের সব স্থানে সব প্রান্তেই ইসলাম জীবন রেনেসাঁর, প্রচণ্ড গতির এক বিকাশমান শক্তি হিসেবে আসন গাড়ছে । Robin Wright তার ‘The Islamic resurgence : A New Phase’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, “Muslim activism in politics is only one aspect of what is a world wide phenomenon. But because of its inherent mixture of religion and politics, Islam could well become one of the worlds strongest ideological forces in the late twentieth century.”
মিঃ রবিন রাইট এখানে বিশ্বব্যাপী ইসলামের উত্থানকে আজকের স্বাভাবিক বিশ্ব প্রবনতার অংশ বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু সেই সাথে স্বীকার করছেন, ইসলামের এই উত্থান ঘটছে তার ধর্ম ও রাজনীতির স্বাভাবিক ও অবিমিশ্র মতবাদিক শক্তির কারনেই । এই শক্তিই ইসলামের প্রান এবং এই ক্ষেত্রেই ইসলামের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী দুনিয়াতে নেই । একথাও তারা স্বীকার করেন । তাঁদের একজন Godfrey Jansen কি বলেছেন, প্রবন্ধের শুরুতেই তা তুলে ধরেছি । ইসলামের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিই একদিন জগত জয় করবে, যার যাত্রা শুরু হয়েছে।