নতুন বিশ্ব- ব্যবস্থার বিকল্প
মানব জীবন আজ বিশ্ব ইতিহাসের পালাবদল চিহ্নিত এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে । মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পতনের পর ইউরোপের শিল্প বিপ্লব এবং রেনেসাঁ যে মতবাদগুলোর জন্ম দিয়েছিলো এবং ধর্মের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সৃষ্টি করেছিলো, তাঁর আজ বিদায় ঘটছে । মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বিলোপ, দূর পাল্লার কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র হ্রাস চুক্তি স্বাক্ষর, সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ব্লক এবং কমিউনিজমের পতন, ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান এবং সোভিয়েত মার্কিন সহযোগিতার নতুন যাত্রা সংঘাত বিমুক্ত এবং শান্তিপূর্ণ এক বিশ্বের অবয়ব আমাদের সামনে তুলে ধরছে । কিন্তু তাঁর পাশেই আমরা আবার পালাবদলের ওপরে নতুন সংঘাতের বীজ উপ্ত হয়ে উঠতে দেখছি । প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসের অধীনে এমন একটা শান্তি এবং সহযোগিতার বিশ্ব আমরা দেখেছিলাম । কিন্তু তিরিশের মন্দা সবই উলট পালট করে দিয়েছিলো । বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারন যতটা না রাজনৈতিক, তাঁর চেয়ে বেশি ছিল অর্থনৈতিক । কথাটা মিথ্যা নয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা ছিল আজকের শিল্পোন্নত দেশগুলোর সমৃদ্ধির বুনিয়াদ । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনমূলক মার্শাল পরিকল্পনা ছিল পশ্চিমী পূঁজির জন্য এক সঞ্জীবনী শক্তি । আমি মনে করাই ঠাণ্ডা যুদ্ধোত্তর আজকের আপাত শান্তির বিশ্বটা ধীরে ধীরে এক অর্থনৈতিক যুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে । তিরিশের মন্দা আর কেউ চায় না । চায়না বলেই বাঁচার চেষ্টা, পূঁজির রক্ষার চেষ্টা এক অর্থনৈতিক যুদ্ধ অপরিহার্য করে তুলবে । আর এ অর্থনৈতিক যুদ্ধ সংগঠিত হবে রাজনৈতিক সংঘাতের মোড়কে । এ রাজনৈতিক সংঘাত হবে ঠাণ্ডা যুদ্ধের চেয়েও বিস্তৃত ও জতিলতর এবং দীর্ঘতর । ঠাণ্ডা যুদ্ধের বিপরীত পক্ষে ছিল কমিউনিজমের আদর্শ । আর ভাবী সংঘাতের এক পক্ষে থাকবে ইসলামের আদর্শবাদ যা পতনের শেষ তল থেকে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর মতো মুজাদ্দিদদের চেষ্টায় আজ শুধু পুনরুজ্জীবিত নয়, ভাবী আদর্শিক লড়াইয়ের যেকোনো মোকাবেলায় সে সমর্থ হয়ে উঠছে । বিশ্ব- রাজনৈতিক অঙ্গনের এ মতবাদিক লড়াইয়ের বিপরীত পক্ষে থাকবে কে ? অনেকেই আসতে পারে । তবে মুখ্য পক্ষ হিসেবে আসছে পুঁজিবাদের চৌকিদার তথাকথিত ‘লিবারেল ডেমক্রাসি’ নামক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা যার নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা একটি সংযুক্ত পশ্চিম ।
আমার এই মেরুকরনের মধ্যে আঁতকে উঠার মতো কিছুই নেই । পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে ইসলামের দাবী পুরনে অক্ষম মুসলমানদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক পতনের পর রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী শোষণ-নীপিড়নমুখী খৃষ্ট ধর্মকে সরিয়েই আজকের উদার নৈতিকতাবাদের পোশাক পরা ধর্মহীন এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র- তত্ত্বের উত্থান, যার গোঁড়ায় রয়েছে নিরেট বস্তুবাদ । নতুন বিশ্ব পরিস্থিতির গতি প্রকৃতি নিয়ে আমাদের আলোচনা আমরা আধুনিক ইতিহাসের এ আদি পর্ব থেকেই শুরু করতে পারি ।
আধুনিক যুগের যাত্রা লগ্ন অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থায় গির্জার অধীনে স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা জটিল এবং অসহনীয় আর্থ- সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে । চতুর্দশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শুধুমাত্র বিজ্ঞান এবং স্বাধীন জ্ঞান চর্চার অপরাধে যাজকযন্ত্র ৩৫ হাজার লোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে । জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের স্বর্ণশিখরে আরোহণকারী মুসলিম সভ্যতার বিকাশ তখন নির্বাপিত প্রায় । উল্লেখ্য, ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জ্ঞান- বিজ্ঞান এবং সভ্যতার সকল শাখায় মুসলমানদের অবাধ বিচরন ছিল । ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে জ্ঞান- বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব মুসলমান এবং ইউরোপের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে । ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের পর মুসলমানরা হারিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যায় মুসলিম বিশ্ব । এ কারনেই খৃষ্টান চার্চের অধীনে রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাতন্ত্রের মাধ্যমে যে অসহনীয় আর্থ সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়, তার সমাধানে ইসলাম কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি । কিন্তু সমাধান তো অবশ্যই একটা চাই । মানুষের জাগরিত চেতনা এর গতিশীল কর্মস্পৃহা সমস্যা বুকে আঁকড়ে বসে থাকতে পারেনা । তাই হয়েছে । যাজকতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে উদার নৈতিকতাবাদ । ওরা এসে যুক্তি এবং বস্তুর বাইরের সব কিছুকে অস্বীকার করলো । ধর্মকে আবদ্ধ করলো চার দেয়ালের মধ্যে । উদার নৈতিকতাবাদ থেকে জন্ম নিলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ । ইউরোপের উদার নৈতিকতাবাদের সয়লাব গোটা পৃথিবীতেই বইলো । তবে এ প্রভাব আফ্রিকা এবং এশিয়ার ইউরোপীয় কলোনিগুলোতে সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হল তারা স্বাধীন হবার পর । বিপুল সংখ্যক মানুষ উদার নৈতিকতাবাদের ভালো দিকের, যেমন গণতন্ত্রের চেয়ে ধর্মহীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বস্তুবাদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদিই গ্রহন করলো বেশি ।
উদার নৈতিকতাবাদের নীতি- নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন বস্তুবাদী সমাজচিন্তা এবং পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার একটা পরিবর্তন আনল বটে, কিন্তু মানুষের আর্থ- সামাজিক সমস্যার জতিলতা দূর করতে পারলো না । বরং স্বাধীনতার নামে সেচ্ছাচারীতা এবং স্বাধীন পুঁজি গঠনের নামে পুঁজিবাদী শোষণকে উৎকট করে তুললো । এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে এলো সমাজবাদ এবং কমিউনিজম । পূঁজির স্বাধীনতা শুধু হরন নয়, সবার হাত শুন্য করে সব পুঁজি নিয়ে গিয়ে জমা করা হল রাষ্ট্রের হাতে । পূঁজির স্বাধীনতা হরণের সাথে সাথে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি সকল স্বাধীনতা হরণ করা হলো । পেট ভরানোর নামে মানুষের গলায় পরানো হলো সার্বিক পরাধীনতার শৃঙ্খল । কিন্তু পেট ভরলো না মানুষের বরং রেশন দোকানে লাইন দেয়ার মতো অব্যাহত নানা দুর্ভোগে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো । সব মিলিয়ে সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট দেশগুলোতে ঘটলো প্রচণ্ড গনবিস্ফোরন । তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়লো কমিউনিস্ট সাম্রাজ্য ।
পুঁজিবাদী শোষণ- নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হয়েছিলো সমাজবাদ এবং কমিউনিজম । সমাজবাদ এবং কমিউনিজমের শোচনীয় ব্যর্থতার পর আবার সকলে পুঁজিবাদেই প্রত্যাবর্তন করছে । অবশ্য আদম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডোর আমলের সেই অন্ধ এবং শোষণধর্মী পুঁজিবাদ এখন আর নেই । শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশ এবং গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্মেষের ফলে পুঁজিবাদ অনেক কল্যাণধর্মী হয়ে উঠেছে । তবু পুঁজিবাদী শোষণ- বঞ্চনার তুলনায় এ কল্যাণ অনেক নগণ্য । উন্নয়ন ও সম্পদের স্বর্গভূমি বলে কথিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যায় এবং অশুভ প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়ে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির অভিশাপ মাথায় নিয়ে প্রতি বছর শত শত কৃষি ফার্ম এবং ডজন ডজন ব্যাংক দেউলিয়া হচ্ছে । পুঁজিবাদী দেশগুলোতে সম্পদের জৌলুস ও উন্মাদনার আড়ালে ক্ষুধার্তের কান্না নিদারুনভাবে চাপা পড়ছে । ইসলাম ছাড়া এদের এই কান্না মুছাবার আর কেউ নেই দুনিয়ায় । তবে পুঁজিবাদ আজ শুধু এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই নয়, পুঁজিবাদ আজ এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সামরিক শক্তির মালিক । মুক্ত অর্থনীতির নামে, বাজার অর্থনীতির নামে, গণতন্ত্রের নামে, মানবতার নামে পশ্চিমী রাষ্ট্র শক্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তির সুবিধা নিয়ে এ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চাপিয়ে দেবার জন্য আজ ছুটে আসছে । এ সাম্রাজ্যবাদের নাম দিয়েছে তারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা ।
এ নতুন বিশ্বব্যবস্থাকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের র্যান্ড কর্পোরেশনের সাবেক গবেষক এবং মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের অন্যতম পলিসি প্লানিং স্টাফ ঐতিহাসিক ফ্রান্সিস ফকুয়ামা তার বিশ্বজোড়া বহুল আলোচিত প্রবন্ধ “The End of History” তে ‘লিবারেল ডেমক্রাসি’ বলে অভিহিত করেছেন । পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত ‘লিবারেল ডেমক্রাসির’ পথকে কুসুমাস্তীর্ণ মনে করেননা, কিন্তু তারা একে আজকের পৃথিবীর আদর্শ জীবন ব্যবস্থাই মনে করেন । ফ্রান্সিস ফকুয়ামার মতে, কমিউনিজমের পতনের সাথে সাথে ‘লিবারেল ডেমক্রাসির প্রতিদ্বন্দ্বী সব ব্যবস্থা পদ্ধতিই শেষ হয়ে গেছে । তিনি বলেন, “পাশ্চাত্য এবং পাশ্চাত্য চিন্তাধারার বিজয় প্রমান করছে যে, পশ্চিমা উদার নৈতিকতাবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ব্যবস্থাই আজ খতম হয়ে গেছে ।” শুধু তাই নয়, তিনি বলছেন, “What we may be witnessing is not just the end of the cold war, or the passing of the particular period of post war history, but the end of the history as such, that is, the end points of Mankinds ideological evolution and the universalization of western liberal democracy.” অর্থাৎ “আমরা যে সময়টা দেখছি তা শুধু ঠাণ্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি কিংবা যুদ্ধোত্তর ইতিহাসের অপস্মৃতিই নয়, আমরা দেখছি ইতিহাসের সমাপ্তি । অন্য কথায় আমরা দেখছি মানব জাতির আদর্শিক বিবর্তনের শেষ প্রান্তসীমা এবং দেখছি পশ্চিমী লিবারেল ডেমক্রাসির বিশ্বজনীনতা ।” ফ্রান্সিস ফকুয়ামা এখানে মানুষের সকল আদর্শিক চাহিদার পরিসমাপ্তি টেনে সব ধর্মের বিকল্প হিসাবে ‘লিবারেল ডেমক্রাসিকে পেশ করেছেন । তিনি বলতে চেয়েছেন, ধর্মের ব্যর্থতার পটভূমিতেই যেহেতু উদার নৈতিকতাবাদের জন্ম এবং সেহেতু ধর্মকে পরাজিত করেই উদার নৈতিকতাবাদের উত্থান, তাই ধর্ম কোনভাবেই উদার নৈতিকতাবাদের বিকল্প হতে পারেনা । অবশ্য ফ্রান্সিস ফকুয়ামা ইসলামকে গননার মধ্যে এনেছেন, কিন্তু তার মতে ‘লিবারেল ডেমক্রাসির বিকল্প হবার মতো বিশ্বজনীনতা ইসলামের নেই । তিনি বলেছেন, “In the contemporary world only Islam has offered a theocratic state as a political alternative to both liberalism and communism. But the doctrine has little appeal for non Muslims and it is hard to believe that the movement will take any universal significance.” অর্থাৎ “আজকের সমসাময়িক বিশ্বে একমাত্র ইসলামই কমিউনিজম এবং উদার নৈতিকতাবাদের রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে ধর্ম রাষ্ট্রের রূপরেখা পেশ করেছে । কিন্তু অমুসলিমদের কাছে এ আদর্শের খুব কম মূল্যই রয়েছে এবং এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন যে, এ আন্দোলনটির কোন বিশ্বজনীন তাৎপর্য আছে ।” এ উক্তি শুধু ফকুয়ামার নয়, পশ্চিমের পণ্ডিতরা সাধারনভাবে আজ এটাই মনে করছেন । এভাবে তারা এ উপসংহারে পৌছেছেন যে, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে ‘লিবারেল ডেমক্রাসি এবং এর অঙ্গ হিসাবে মুক্ত অর্থনীতির নামে পুঁজিবাদ বিশ্ব জয় করতে যাচ্ছে এবং ধর্মসহ অন্য সব ব্যবস্থার ইতি ঘটছে ।
‘লিবারেল ডেমক্রাসির এ পাশ্চাত্য দেশীয় পণ্ডিতরা আমার মতে এখনো অষ্টাদশ শতকে দাড়িয়েই বিশ্বটাকে অবলকোন করছেন । সেসময় উদার নৈতিকতাবাদকে তারা যে দৃষ্টিতে দেখেছেন, ধর্মকে যেভাবে অবলোকন করেছেন এবং সমাজের যেরূপ তখন তাঁদের সামনে ছিল, এখনো তারা এ সবকিছুকে সেই দৃষ্টিতেই দেখছেন । এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বের কাছে বিশেষ করে পাশ্চাত্যের জনগনের কাছে কথিত ঐ উদার নৈতিকতাবাদ এবং ধর্ম কি সেই আগের অবস্থায় এখনো আছে ? এর সহজ উত্তর, না সে অবস্থায় নেই । আসলে পাশ্চাত্যের ফকুয়ামা টাইপ পণ্ডিতরা তাঁদের সমাজের দিকে মোটেও তাকান না । তাকালেও দেখেন আকাশস্পর্শী প্রাসাদ, তার ভেতরের মানুষ কেমন তা দেখেন না । তারা দেখেন পোশাকের চাকচিক্য, ফ্যামিলি বাজেট, বাজার দর কিন্তু মানুষের হৃদয়ে তারা উঁকি দেননা । উঁকি দিলে তারা দেখতেন, অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত গির্জা যে নির্যাতন করেছে তার সীমা ছিল মানুষের দেহ পর্যন্ত, কিন্তু তথাকথিত উদার নৈতিকতাবাদের নির্যাতন মানুষের হৃদয় মনকেই নিঃশেষ করে দিয়েছে । উদার নৈতিকতাবাদ সৃষ্ট এক একটি মানুষ আজ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত, শেকড়হীন জড় পদার্থ যেন তারা । তাঁদের বর্তমানটা হতাশায় ভরা, তাঁদের ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই নেই । সব হারিয়ে তারা এখন অতীতমুখী । বাস্তববাদী উদার নৈতিকতার ছোবলে নিমজ্জিত থেকে অতীতের স্মৃতি চারনের মধ্যে আজ তারা শান্তি খুঁজছে । ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স মনিটরে—‘One Man search for values’ শীর্ষক প্রবন্ধে জেন ফিলিপ লিখছেন, “You hear a lot of talk about American values these days. A lot of reference to the ‘good old days’ when you could trust people, to that by gone era when you could rely on the quality of American products, look to the media for enriching entertainment, have friends over for a game of charads and lively conversation. ‘People just don’t care anymore’ is as common as apple pie. ‘People never think about anyone but themselves’ or ‘people don’t even go out anymore they are all home, glued to the tube’ are observations frequently heard in casual conversation.” মিঃ কেন ফিলিপ আমেরিকানদের মানস- সন্ধানে আমেরিকার পথে- প্রান্তরে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন । প্রশ্ন করেছেন মানুষকে জীবন, জগত ও সমাজ সম্পর্কে । উত্তর যা পেয়েছেন তা এইঃ “I don’t know answer to that, no one’s ever asked me before, how would I know ?” আমেরিকান জীবন সম্পর্কে জেন ফিলিপের উপসংহারঃ “Americans are living in a society. Where people have stopped asking each other question that matter. Where days, and weeks can pass and even family member’s don’t know what is other is thinking or feeling. Where conversations about their beliefs, their dreams and their fears are preempted by a superficial pop culture . How do they form their conscience on social issues without mingling their thoughts with others, listening from distinctions, streching their opinion ? how do they sustain their relationships when they bring o little of themselves to the table ? ”
আমেরিকান এ জীবন চিত্র গোটা পশ্চিমের । বস্তুবাদী উদারনৈতিকতা মানুষের বহিরাংগ পালিশ করে ভেতরের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে । অর্থ- পরিচয়হীন জীবনের ভারে তারা আজ কুজ । তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশ যেমন ঋণের ভার বাড়িয়ে ঋণ পরিষদের চেষ্টা করছে, তেমনি পাশ্চাত্য মানুষ আজ তাঁদের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সমস্যার পাকে তলিয়ে যাচ্ছে । কুমারী মাতার উদ্বেগজনক হার কমাতে গিয়ে তারা স্কুলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ উপকরনের দোকান খুলছে । হতাশা ও বিচ্ছিন্নতার মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা ড্রাগসেবী হয়ে নিজেদের ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে । এভাবে বস্তুবাদী উদারনৈতিকতা যখন পাশ্চাত্য মানবতাকে ধ্বংস করছে, যখন পাশ্চাত্যের মানুষ সিন্দাবাদের এ ভূতকে ঘাড় থেকে নামানোর তালাশ করছে, তখন ফ্রান্সিস ফকুয়ামার মতো পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা বস্তুবাদী উদারনৈতিকতা তথা ‘লিবারেল ডেমোক্রেসিকে দুনিয়ার জন্য সর্বরোগ হারা মহৌষধ সাজাচ্ছেন । এই জন্যই বলছিলাম এরা অষ্টাদশ শতকে দাড়িয়েই আজও সবকিছু অবলোকন করেছেন ।
তারা যাই বলুন আসলেই বস্তুবাদী উদার নৈতিকতার দিন শেষ হয়ে গেছে ঠিক কমিউনিজমের মতই । জাপানের কিয়োটস্থ ‘ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর জাপানিজ স্টাডিজ’—এর ডাইরেক্টর জেনারেল এবং আজকের জাপানের সবচেয়ে সম্মানিত দার্শনিক তাকেশি উমেহারা পশ্চিমী উদার নৈতিকতাবাদের মৃত্যু পথ যাত্রার খবর দিয়ে বলছেন, “Modernism has already played itself out in principle. Accordingly, societies that have been built on modernism are destined to collapse. Indeed the total failure of Marxism warped side current of modernist society was only the precursor to the collapse of western liberalism, the main current of the modernity. Far from being the alternative to failed Marxism and the reigning ideology at the end of history, liberalism will be next domino to fall. Modernism as world view is exhausted and now even constitutes a danger to mankind.”
অর্থাৎ, “আধুনিকতা নীতিগতভাবে ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে । ফলশ্রুতি হিসেবে আধুনিকতার উপরে ভিত্তি করে যে সমাজ বিনির্মিত হয়েছে তারও ধ্বংসের আয়োজন সম্পূর্ণ । আধুনিক সমাজেরই একটা অংশ মার্কসবাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা পশ্চিমী উদার নৈতিকতাবাদেরও মৃত্যু ঘন্টা ধ্বনিত করেছে । কথিত ‘ইতিহাসের সমাপ্তি পর্বে’ ব্যর্থ মার্কসবাদ ও অন্যান্য বহমান আদর্শের বিকল্প হওয়ার অনুপযুক্ত উদারনৈতিকতাবাদের পতন পরবর্তী ইস্যু হিসেবে সামনে আসছে । বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে আধুনিকতাবাদ ফুরিয়ে গেছে এবং এমনকি এখন তা আজ মানবতার জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে দাড়িয়েছে ।”
কমিউনিজমের সাথে সাথে বস্তুবাদী উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার এই ব্যর্থতা, পাশ্চাত্য সমাজের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি এবং সেই সাথে সাধারনভাবে ধর্মীয় আদর্শবাদের উত্থান প্রমান করছে বিশ্ব ব্যবস্থা এক বড় রকমের পালাবদলের মুখোমুখি । তথাকথিত উদার নৈতিকতাবাদ, অন্যকথায় ধর্মহীন ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী গণতন্ত্র সমাজ চিন্তার অক্টোপাস থেকে মুক্তি লাভের জন্য মানবতা আজ আর্তনাদ করছে । এখন প্রশ্ন হলো, বিপজ্জনক এ মুতবাদের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য কে এগিয়ে আসবে ? কোন মতবাদ নেতৃত্ব দেবে সামনের পৃথিবীকে ? এক কথায় এর উত্তরঃ পৃথিবীর সর্বশেষ খোদায়ী জীবন বিধান এবং আজকের পৃথিবীতে অক্ষতভাবে অবশিষ্ট একমাত্র ধর্ম ইসলামই যোগ্যতা রাখে এ সংকট থেকে মানবতাকে মুক্ত করার ।
জাপানী দার্শনিক তাকেশী উমেহারাও বলেছেন, “প্রাচ্য দেশীয় কোন জীবন ব্যবস্থাই পারে বিশ্ব- মানবতাকে রক্ষা করতে । তবে তার মরে সে জীবন বিধানটি হলো কনফুসীয় ও বৌদ্ধ মতবাদপুষ্ট বিশেষ ধরনের সমন্বয়বাদী এক জাপানী ধারনা ।’’ তিনি বলছেন, “The new principles of the coming post modern era will need to be drawn primarily from the experience of non-western cultures, especially ancient Japanese civilization.”
কিন্তু দার্শনিক তাকেশী উমেহারা বস্তুবাদী উদার নৈতিকতাবাদ শোষিত আজকের মানবতার সমস্যাকে যতটা সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, ততটা সীমিত নয় । উদার নৈতিকতাবাদের বিকল্প হিসেবে মানবতার মুক্তির জন্য দরকার একটা পূর্ণাঙ্গ মতবাদের যা মানুষকে দেবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ আত্ম- পরিচয় সংকটের মতো মৌলিক সমস্যার সমাধান । বৌদ্ধ ও কনফুসীয় ধর্মপুষ্ট কিছু সামাজিক বিধি পূর্ণাঙ্গ মতবাদের এ দাবী পূরণ করতে পারেনা, পারে একমাত্র ইসলাম । এ সত্যের স্বীকৃতি এমনকি উদার নৈতিকতাবাদীরাও অনেকে দিচ্ছেন । Godfrey Hansen তার Muslims and the Modern world প্রবন্ধে লিখছেন, “Today Islam and the modern western world confront and challenge each other, no other majore religion posses such challenge to the west. Not Christianity, which is a part of the world and which has been eaten up from within by the acids of the modernity. not hinduism and buddhism, because their rediation to the west has been and is on high etherial plan. and not Judaism, which is to small and tribal a faith. Not guru, no swami, no lama, no Rabbi has had any impact on the west comparable to that exerted by the caliph, the mahdi, and ayatullah or by the that streotype hauniting the western imazination.”
অর্থাৎ “ইসলাম ও আধুনিক পশ্চিমী দুনিয়া আজ পরস্পর মুখোমুখি এবং একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করছে । আর কোন ধর্মই পশ্চিমের প্রতি এমন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় নি । খৃষ্টধর্ম কোন চ্যালেঞ্জ হয়নি, কারন খ্রিস্টধর্ম নিজেই পশ্চিমী দুনিয়ার অংশ এবং আধুনিকতার গ্রাস তাকে ভেতর থেকেই শেষ করে ফেলেছে । হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মও চ্যালেঞ্জেই আসেনা, কারন তা এক ক্ষুদ্র গোত্রীয় ধর্ম । ‘খলিফা’, ‘মাহদি’, ‘আয়াতুল্লাহ’ প্রভৃতি শব্দ পশ্চিমী চিন্তাধারাকে যেভাবে আলোড়িত করেছে সে তুলনায় ‘গুরু’, ‘স্বামী’, ‘লামা’, ‘রাব্বি’ কোন গুরুত্বই বহন করে না ।”
আজকের বিশ্বের উদার নৈতিকতাবাদী শোষণের একমাত্র বিকল্প যে ইসলাম, তার কারন উদার নৈতিকতাবাদ তার ধর্মহীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বংসকারী জীবানু দিয়ে মানুষের দেহে যে ব্যাধির সৃষ্টি করেছে, তাকে শুধু ইসলামই সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারে । আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে আজকের ইসলামী জাগরনের আন্দোলনের দিকনির্দেশক সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী লিখেছিলেন,
“Contemporary civilization takes democracy to mean sovereignty of the people, that is the collective will of the people in their own area is absolute and independent. This will is not, in the final analysis, subservient to the law, but the law is subject to its desire. And the only duty of the government is that its administration should be utilized to be fulfilled the collective desires of the people. Now consider : first, secularism freed people from the fear of god and the grip of eternal principles and turned them into uncontrolled worshippers of self. Then nationalism stupified them with the intoxicant of national selfishness, blind prejudice and national pride. And now this democracy gives total authority of law making to the desires of the unrestrained, intoxicated worshippers of the self and declares the achievement of the objectives desired by these people as a whole to be the only purpose of the government. The question is in what way will the condition of the independent sovereign nation be different from that of a hoodlum would be do on a small scale if he were independent and strong, would be done on a much larger scale by a nation of this type. Then if the world contains not merely one such nation but all the advanced nations have organized themselves on the lines of the secularism, nationalism and democracy, is it surprising that the world resembles a wilderness in which wolves howl, hunt and kill ? ( Islami neizam aur maghribi la dini jamhurat, page 19,20 )
মাওলানা মওদুদী এখানে গণতন্ত্রের নামে মানুষের হাতে সার্বভৌমত্ত ক্ষমতা তুলে দেয়ার তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, আজকের সভ্যতার ধর্মনিরপেক্ষবাদ ও জাতীয়তাবাদ মানুষকে স্বার্থপর এবং স্বেচ্ছাচারী এক অনিয়ন্ত্রিত শক্তিতে পরিনত করেছে, যার হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা যাওয়ার অর্থ উশৃঙ্গখল এক বন্য সমাজের পত্তন হওয়া । আজ বিশ্ব সমাজের যে চিত্র আমরা দেখছি তা মাওলানার একথার নিখুঁত প্রতিফলন । ধর্মহীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতায় দীক্ষিত এবং স্বার্থবাদী জাতীয়তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য চিন্তায় উজ্জীবিত আধুনিক মানুষ প্রকৃত অর্থে পশুতে পরিনত হয়েছে । মানুষ তার পরিচয় ভুলে গেছে । মানুষের এ পরিচয় সংকটই আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা, এতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যাধি । ইসলামের এই নিরাময় ব্যবস্থা আর কিছুই নয়, ‘মানুষকে তা’ মানুষকে জানিয়ে দেয়া এবং মানুষ হিসেবে তার যে লক্ষ্য, সে লক্ষ্যে তাকে উজ্জীবিত করা । মানুষের এ পরিচয় এবং তার এ লক্ষই তার জীবন দর্শন তথা সমস্ত কর্মকাণ্ডের ভিত্তি । মাওলানা মওদুদী লিখছেন, “এ দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা কি ? দুনিয়া বস্তুটা কি ? এই দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক কি ? মানুষ এ দুনিয়াকে ভোগ ব্যবহার কোড়বে কীভাবে ? জীবন দর্শন সম্পর্কিত এ প্রশ্নগুলো এমনি গুরুত্বপূর্ণ যে মানব জীবনের তামাম ক্রিয়াকাণ্ডের ওপরেই এগুলো গভীরভাবে প্রভাবশীল । দুনিয়ায় মানব জীবনের উদ্দেশ্য কি ? মানুষের এতো ব্যস্ততা, এতো প্রয়াস প্রচেষ্টা, এতো শ্রম মেহনত, এতো দ্বন্দ্ব সংগ্রাম কিসের জন্য ? কোন অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে মানুষের ছুটে চলা উচিৎ ? কোন লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাবার জন্য আদম সমাজের চেষ্টা সাধনা করা উচিৎ ? কোন পরিনতির কথা মানুষের প্রতিটি কাজে, প্রতিটি প্রয়াস- প্রচেষ্টায় স্মরন রাখা উচিৎ ? এই লক্ষ্য এবং আকাংখাগত প্রশ্নই মানুষের বাস্তব জীবন ধারাকে নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত করে থাকে আর তার অনুরূপ কর্মপদ্ধতি ও কামিয়াবির পন্থা জীবনে অবলম্বিত হয়ে থাকে ।”
সুতরাং মানুষের পরিচয় এবং জীবনের লক্ষ্যত সংকট দূর হলেই বস্তুবাদী উদার নৈতিকতাবাদ মানবতার দেহে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার নিরাময় হয়ে যাবে । ব্যাধিমুক্ত মানুষ তখন অবহিত হবে এই দুনিয়াটা আল্লাহর সাম্রাজ্য এবং তাঁরই কুদরত ও শক্তিমত্তার প্রকাশ । এখানে মানব জাতি আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত । এখানে মানুষের যা আছে, তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে অর্পিত আমানত । এ আমানতের জন্য একদিন মানুষকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে । অতএব মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কৃতিত্বের অধীনে তার শেষ রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে প্রেরিত আল কুরআনের আদেশ নিষেধ মোতাবেক মানুষকে অবশ্যই জীবন পরিচালনা করতে হবে । এ মৌল শিক্ষা প্রশিক্ষণই মানুষকে মানুষে পরিনত করবে এবং তাকে বর্তমান সভ্যতা সংকট থেকে মুক্ত করে তার ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করবে । আজকের বিশ্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো পেটের সমস্যা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজিত বৈষম্য ও বঞ্চনার সমস্যা । কেউ থাকছে সাত তলায়, কেউ খাদ্য অপচয় করছে কারিকারি, কেউ থাকছে অভুক্ত – এই সমস্যা দুনিয়ায় আজ প্রকট । এই সমস্যা পুঁজিবাদের সৃষ্ট, কিন্তু সমাজবাদ এবং কমিউনিজমেও এই সমস্যার কোন সমাধান নেই, তথাকথিত ‘লিবারেল ডেমোক্রাসীর’ কাছে তো নেইই । এ ক্ষেত্রেও দুনিয়ার মানুষের কাছে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে ইসলাম ।
এই বিকল্প নিয়ে কয়েকটি কথা বলে আমি আমার আলোচনা শেষ করতে চাই । অত্যন্ত স্বাভাবিক পথে ইসলাম আজকের মানব সমাজে বিরাজিত অর্থনৈতিক বৈষম্য- বঞ্চনা যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে । হালাল হারামের বিধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবৈধ পুঁজি এবং সম্পদের উৎস বন্ধ করে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কমপক্ষে ৪০ ভাগ দূর করা যেতে পারে । কেউ একে আকাশচারী চিন্তা বলতে পারেন, কিন্তু বাস্তবেই এটা সম্ভব । এরপর অপরিহার্য যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে বৈষম্যের আরো ২০ ভাগ দূর করা যেতে পারে । ধনীদের খরচের উপরে ইসলাম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে । ইসলামী বিধান অনুসারে সম্পদ কেউ অব্যবহৃত কিংবা আংশিক ব্যবহৃত রাখতে পারবে না । অব্যবহৃত কিংবা আংশিক ব্যবহারের কারনে হযরত উমর ( রাঃ ), হযরত বিলাল ( রাঃ ) এর বাগান বাজেয়াপ্ত করেছিলেন । সম্পদ থাকলেই কেউ এর অপচয় করবে বা বিলাসিতায় ব্যয় করবে এ অধিকারও ইসলাম কাউকে দেয়নি । এ ধরনের কাজ যারা করে তাঁদেরকে শয়তানের ভাই বলে অভিহিত করা হয়েছে । নিশ্চয়ই কোন মুমিনই শয়তানের ভাই হতে চাইবে না । খরচের উপরে এইসব নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় স্বাভাবিকভাবেই বিত্তশালীদের হাতে সম্পদের অধিকতর সঞ্চয় ঘটবে । বিধান অনুসারে এই সম্পদ বিত্তশালীরা ফেলে রাখতে পারবে না, বিনিয়োগ করতেই হবে । সম্পদের এই ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে আয় বণ্টনের পরিধি বাড়বে । তাছাড়া শুধু বিনিয়োগ নয়, জমে উঠা সম্পদের একটা অংশ বিত্তশালীদের ফি সাবিলিল্লাহ—খাতেও ব্যয় করতে হবে । প্রতিবেশিকে অভুক্ত রেখে কোন মুসলমান পেট পুরে খেতে পারেনা এই নীতি অনুসারে এবং ‘কর্জে হাসানা অনুসারে বিত্তশালীদের হাত থেকে আরও একটা সম্পদের বড় অংশ বিত্তহীনদের হাতে চলে যাবে । এইভাবে খরচের উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, ফি সাবিলিল্লাহ খাতের খরচ ও কর্জে হাসানার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বড় একটা অংশ, ধরা যাক সেটা দশ ভাগ, কমানো যেতে পারে । প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি, বিধানগত উপায় এসব দায়িত্বানুভুতির দিকগুলো কাজে লাগিয়ে এইভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য আমরা ৩০ ভাগে নামিয়ে আনতে পারি । ইসলামী সমাজে এই বৈষম্যটুকুও শেষে থাকবেনা । হযরত উসমান ( রাঃ ) এর মতো জাহেলী যুগের অনেক ধনী ব্যক্তি ইসলামী সমাজে অবশেষে ধনী থাকতে পারেননি । আবার ইসলামী সমাজে গরীব থাকাও কঠিন । এইভাবেই ইসলাম অত্যন্ত স্বাভাবিক উপায়েই অর্থনৈতিক বঞ্চনামুক্ত এক সুন্দর ও শান্তিময় সমাজের জন্ম দেয় ।
উপসংহারে বলতে চাই, মানব জীবন বিশ্ব ইতিহাসের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে । তথাকথিত ইউরোপীয় রেনেসাঁ ধর্মের বিকল্প হিসেবে যে মতবাদগুলোর জন্ম দিয়েছিলো তার আজ অবসান ঘটছে । ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপে যে কমিউনিস্ট বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিলো, যা গোটা দুনিয়াকেই একসময় গ্রাস করবে বলে মনে হয়েছিলো, সেই কমিউনিজম আজ তার স্বভূমিতেই বিধ্বস্ত । কমিউনিজমের জমজ ভাই পুঁজিবাদ অব্যাহত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েও নিজেকে আজ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ প্রমান করেছে । অন্যদিকে মুসলমানদের পতনের পর উপনিবেশবাদের যে কালো ছায়া গোটা দুনিয়াকে গ্রাস করেছিলো তার রাজনৈতিক রাহুগ্রাস থেকে পৃথিবী আজ মুক্ত । উপনিবেশবাদের দুই প্রতিভূ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন দুই জোটের ভাগ করে খাওয়ার ঠাণ্ডা যুদ্ধ পৃথিবীকে যন্ত্রনা দিয়ে এসেছে চারদশক ধরে । কিন্তু কমিউনিস্ট পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এই ঠাণ্ডা যুদ্ধেরও আজ অবসান ঘটিয়েছে । মস্কোষসহ পশ্চিমী শক্তিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একক ভাবে ছরি ঘুরাচ্ছে দুনিয়ায় । তাঁদের লাঠি ধরা হাতে শক্তি আছে বটে, কিন্তু মাথা তাঁদের শুন্য, হৃদয় তাঁদের দেউলিয়া । কোন আদর্শের যৌক্তিক কোন বুনিয়াদ তাঁদের জীবনে আজ নেই । তারা যে উদার নৈতিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত অর্থনীতির শ্লোগান দেয়, তাকে নিদেনপক্ষে সরকার ব্যবস্থা এবং অর্থ ব্যবস্থার কাঠামো বলা যেতে পারে, জীবন নিয়ন্ত্রণকারী সার্বিক কোন আদর্শ ব্যবস্থা তা অবশ্যই নয় ।
অতএব মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পতনের পর পশ্চিমা যে মতবাদগুলো ইসলামের স্থান দখল করতে চেয়েছিল, সেসব মতবাদ আজ ব্যর্থতা বরণ করে পেছনের দিকে হটে যাচ্ছে । আজ আদর্শের ময়দান প্রকৃত অর্থে শুন্য । মহানবী ( সাঃ ) এর আদর্শের বিশ্বব্যাপী উত্থান আজ কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র । ‘মৌলবাদ’, ‘মধ্যযুগীয়’ ইত্যাদি বলে এর দিক থেকে কেউ চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন, তাতে এই বাস্তবতার কোন ব্যত্যয় ঘটবে না । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের H. HADDAD এর মতো খৃষ্টান চিন্তাবিদ পর্যন্ত আজ স্বীকার করছেন, “Thus Islam is posited as the only viable vision of a better world order. This ( Islamic ) religious literature is modern in idiom as well as content, it takes the twentieth century seriously. Those who denigrate revivalist and relegate them to the dark ages, the middle ages or the seventh century, are at best completely missing the dynamics of the relevance of the religion for modern life., or at worst, purposefully ignore the new developments in the content and meaning of various Islamic doctrines.” ( Islamic awakening in Egypt, ASQ, Volume-9, Number -3,page- 255 )
অর্থাৎ, “এইভাবে ইসলাম উৎকৃষ্টতর একক এক বিশ্ব ব্যবস্থার আস্থাশীল রূপরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে । ইসলামী সাহিত্য ভাষা এবং বিষয় সবদিক থেকেই আধুনিক যা সাংঘাতিকভাবে বিশ শতকের । যারা ইসলামী পূর্ণজাগরন বাদীদের গাল দেয় এবং তাঁদেরকে অন্ধকার যুগ, মধ্য যুগ অথবা সপ্তদশকের মানুষ বলে অভিহিত করে, তারা আধুনিক জীবনে ধর্মের সাজুজ্জতা ধরতে সম্পূর্ণভাবেই ব্যর্থ হন অথবা ইসলামের বিভিন্ন মতবাদের অর্থ ও বিষয়ে যে উৎকর্ষতা এসেছে তা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই উপেক্ষা করেন ।”
ইসলামের সত্য এইভাবে সকলের কাছে সূর্যের মতো দেদীপ্যমান হয়ে উঠছে । ধীরে ধীরে উটপাখিদেরও চোখ খুলবে, কুম্ভকর্ণদেরও ঘুম ভাঙ্গবে । শুধু ইসলামী দুনিয়া নয়, বিশ্বের সব স্থানে সব প্রান্তেই ইসলাম জীবন রেনেসাঁর এক প্রচণ্ড গতির বিকাশমান শক্তি হিসেবে আসন গাড়ছে । Robin Wright তার ‘The Islamic Resurgence : A New Phase” শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, “Muslim activism in politics is only one aspect of what is a world wide phenomenon. But because of its inherent mixture of religion and politics, Islam could well become one of the world’s strongest ideological forces in the late twentieth century.”
মিঃ রবিন রাইট এখানে বিশ্বব্যাপী ইসলামের উত্থানকে আজকের স্বাভাবিক বিশ্ব প্রবনতার অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন । সেই সাথে স্বীকার করেছেন, ইসলামের এই উত্থান ঘটেছে তার ধর্ম রাজনীতির স্বাভাবিক ও অবিমিশ্র মতবাদিক শক্তির কারনেই । এই শক্তিই ইসলামের প্রান এবং এই ক্ষেত্রে ইসলামের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী দুনিয়াতে নেই । এ কথাও তাঁদেরই স্বীকৃতি থেকেই আসছে । ইসলামের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিই এখনি জগত জয় করবে, যাত্রা যার শুরু হয়েছে । বিশ্ব অপেক্ষা করছে সে, শুভ দিনের ।
( নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি একটি সেমিনারের জন্য প্রবন্ধটি লিখিত এবং গঠিত হয় )