আমেরিকাঃ নাইন ইলেভেন এর পর
মার্কিন যুক্তরাষ্ট সফরে আমরা যখন মিসিগানের ডেয়ারবোর্নে, ভয়েস অব আমেরিকা থেকে একটা টেলিফোন পেলাম। আমাদের সফর সম্পর্কে ওরা জানতে চায়। একটা প্রশ্ন এইরকম যে, এর আগেও আমি একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলাম। তা থেকে এ সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি কি না? খুবই ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন। আমার মনে হয়, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেও সফর করেছেন এবং এখন সফর করছেন, তাদের কাছে এই পরিবর্তনের ব্যাপারটাই প্রথম বিষয় হবে। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে উঠতে গিয়েই এই পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছিলাম। শুধু জুতা খুলতেই হলো না। বডি সার্চের জন্য বিশেষ স্থানে বিশেষ নিয়মে দাঁড়াতে হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটগুলোতে যেমন ওয়াশিংটন হতে মিশিগান এবং মিসিগান হতে নিউইয়র্ক যাওয়ার সময়েও এই ধরনের চেকিং এর মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিমান ও যাত্রীদের নিরাপত্তার প্রয়োজনেই এমন পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর। এই বিরক্তি এড়ানোর জন্যই নিউইয়র্ক হতে ওয়াশিংটন যাবার ইন্টারনাল ফ্লাইটের সুযোগ না নিয়ে আমি সড়কপথে ওয়াশিংটন গিয়েছি। আরেকটি বিষয়, এই চেকিং এর চাপটা নন আমেরিকান, নন ইউরোপিয়ানদের ওপরই বেশি। তবে সাধারণত সকলকেই চেকিং এর শিকার হতে হয়। ওয়াশিংটনে একটা লাঞ্চে একজন আমেরিকান কূটনীতিকের সাথে কথা হচ্ছিল আমাদের। তিনি জানালেন, তাঁকেও বারবার এ ধরনের চেকিং এর শিকার হতে হয়েছে শুধু নয়, জওয়াবদিহিও করতে হয়েছে কেন তিনি এত বেশি আরব দেশ সফর করছেন। এটা তাঁর কূটনৈতিক দায়িত্বের অংশ সেকথা বলার আগে তারা বুঝে নি। উল্লেখ্য, ঐ কূটনীতিকের মুখে মুসলমানদের মত দাড়ি রয়েছে।
নাইন ইলেভেন এর পরবর্তী সময়ে এই পরিবর্তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একমাত্র পরিবর্তন নয়। নাইন ইলেভেনে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা উপলক্ষ করে দুনিয়ায় নানামুখী পরিবর্তনের যে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সুতরাং সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে সেখানে-আইন ও সরকারী দৃষ্টিভঙ্গিতে। পরিবর্তন এসেছে সেখানে জনজীবনের নানাক্ষেত্রে। ইতিবাচক নেতিবাচক সবধরনেরই। কিন্তু এতকথা সেদিন ভয়েস অব আমেরিকাকে বলার সময় হয় নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার দেশ। সেখানে কোন কালাকানুন নেই। নাগরিক অধিকার সেখানে কোনভাবেই পদদলিত হয় না অনেক দেশের মত। এটা ছিল আমেরিকানদের গর্ব। কিন্তু নাইন ইলেভেনের পর এই গর্বে ধ্বংস নেমেছে। নাইন-ইলেভেনের পর ঐ বছরই ২৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট বুশ একটি আইন পাশ করেন। তার নাম USA Patriot Act. সে দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে আইনটি ‘eroded civil liberties’. এই আইনে প্রশাসন সন্দেহভাজনদের দীর্ঘসময় এমনকি অনির্দিষ্টকাল পর্য্ন্ত আটক রাখতে পারে। কোন অন্যায়ের সাথে জড়িত না হলেও শুধু সন্দেহ হলেই যে কোন নাগরিকের বাড়ি ঘর, ব্যবসায় বাণিজ্যের স্থান ও রেকর্ডপত্র সার্চ করতে পারা যায় এই আইনের অধীনে। তিনশ পৃষ্ঠার এই আইনে নাগরিক স্বাধীনতার অনেক কিছুই বাঁধা পড়েছে। কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সেলস শপ ১০ হাজার ডলার বা তার বেশি মূল্যের জিনিস কোন ব্যক্তির কাছে বিক্রয় করলে তার তথ্য সরকারকে জানাতে হবে।
নাগরিক অধিকার খর্বকারী এই প্যাট্রিয়ট এক্ট প্রবর্তন করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন জনগণের নিরাপত্তা বিধানের নামে। মার্কিন ‘বিল অব রাইটস’ এর পরিপন্থী এ্ই আইন পাস না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কি ক্ষতি হতো তা বলা মুশকিল, তবে এই আইন ক্ষতি করেছে মার্কিন মুসলমানদের ও অন্যান্য দেশের মুসলমানদের। নাইন ইলেভেনের পর বিপুল সংখ্যক মার্কিন মুসলিম নাগরিককে ডিটেনশনে রাখা হয়েছে এই আইনের অস্ত্র প্রয়োগ করে। বিনা অপরাধে বিনা বিচারে এই আটকে রাখাকে সংবিধানের ৬ষ্ঠ সংশোধনীর পরিপন্থী বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ষষ্ঠ সংশোধনীতে বলা হয়েছে,” …..The accused shall enjoy the right to speedy and public trial, by an impartial jury of the state and district wherein the crime shall have been committed, which district shall have been previously ascertained by law, and to be informed of the nature and cause of the accusation, to be confronted with the witnesses against him.” কিন্তু নাইন ইলেভেনের পর সংবিধানের এই নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে।
নাইন ইলেভেনের ঘটনার সাথে মুসলমানদের জড়িত করা হয়েছে। সংবিধানসম্মত নিরপেক্ষ কোন কোর্টে তা প্রমাণিত না হলেও মুসলমানরা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ বিদেশী মুসলিমরাও পাইকারীভাবে সন্দেহের তালিকায় পড়েছে। দু’হাজার এক সালের নভেম্বরে মার্কিন এটর্নি জেনারেলের আদেশ অনুসারে এই ধরনের পাঁচ হাজার মুসলমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার মধ্যে মাত্র বিশজনকে গ্রেফতার করা হয়, তাও সন্ত্রাসের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন অভিযোগে নয়। এরপরও আরও তিন হাজার মুসলিম ব্যক্তির জিজ্ঞাসাবাদের ঘোষণা এটর্নি জেনারেলের অফিস হতে দেয়া হয়।
মুসলিম ব্যক্তির মত মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ওপরও বৈষম্যমূলক আইনের ছোবলে গিয়ে পড়ে। দু’হাজার এক সালের ৪ ডিসেম্বর এক আদেশ বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘হোলি ল্যান্ড ফাউন্ডেশন ফর রিলিফ এন্ড ডেভলপমেন্ট’ (HLF) নামের মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। মার্কিন সরকার এই সংগঠনকে ফিলিস্তিনী ‘হামাস’ গ্রুপের সাহায্যকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে। HLF পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে, তারা কোনভাবেই কোনপ্রকার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত নয়। তারা রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে ফিলিস্তিনী ইয়াতিম, বিধবা ও দরিদ্রদের সাহায্য করে। এই মানবিক সাহা্য্যের বাইরে কোন দল বা পক্ষকে তারা কোন আর্থিক সাহায্য দেয় নি। মনে করা হয় ফিলিস্তিনী অধিকার দলনকারী ইহুদী লবি বহুদিন থেকে চেষ্টা করছিল এই ধরনের মুসলিম দাতব্য সংস্থার কন্ঠরোধ করার জন্য। নাইন ইলেভেনকে একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে মার্কিন প্রশাসনকে দিয়ে একইভাবে তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করল। HLF এর পর গ্লোবাল রিলিফ ফাউন্ডেশন (GRF) বেনেভলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (BIF) এর উপরও মার্কিন সরকার অবরোধ আরোপ করে। অথচ এই দাতব্য সংস্থার বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার সুনির্দিষ্ট কোন সন্দেহের কথা বলতে পারে নি। কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ এনে মামলাও দায়ের করতে পারে নি। এইদিক থেকে বলা যায়, একেবারে বিনা অপরাধেই তিনটি দাতব্য সংস্থাকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই তিনটি মুসলিম দাতব্য সংস্থারই রেকর্ড রয়েছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রিলিফ কার্য্ক্রম পরিচালনায়। তারা অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্পও পরিচালনা করতো। সংস্থাগুলো বন্ধ করে দেয়ায় পঞ্চাশ হাজার নিয়মিত দাতার দানের হাতকে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। সরকারি এই কার্য্যক্রম সমালোচিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিতর থেকেই। Bill of Rights এর পরিপন্থী বলে একে অভিযুক্ত করা হয়েছে। Bill of Rights (4th Amendment) এর বলেছে, “The right of the people to be secure in their persons, houses, papers and effects, against unreasonable searches and seizures, shall not be violated and no warrants shall issue, but upon probable cause”.
একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সামাজিক ও গবেষণার কাজেও হস্তক্ষেপ করা হয়েছে নাইন ইলেভেনের পর। দুই হাজার দুই সালের জানুয়ারীতে Operation Green Quest এর অংশ হিসেবে গোপন ও বেনামা প্রমাণের ভিত্তিতে ‘material support for foreign terrorist organization’ এর অভিযোগ তুলে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, (IIIT) গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ইসলামিক সোশাল সায়েন্সেস’ এর মত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হয়। এই ধরনের অভিযানকে মার্কিন সংবিধানের পরিপন্থী বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “……. The use of secret evidence is in violation of the Fitth Amendment, which states that no person shall be deprived of life, liberty, or property, without due process of Law.”
নাইন ইলেভেনের ঘটনার জন্য সর্বতোভাবে মুসলমানদের দায়ী করা এবং নিরাপত্তার জন্য শুধুমাত্র মুসলমানদের ক্ষতিকর মনে করার এই সরকারি প্রবণতা মার্কিন যুক্তরাষ্টে্র ভিতরের এক শ্রেণীর ব্যক্তি ও সংস্থার মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দেয়। ‘সাউদার্ন ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন’ দু’হাজার দুই সালের বার্ষিক সম্মেলনে জ্যাকস ভিল ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এর রেভারেন্ড জেরী ভাইনস মুসলমানদের প্রতি কুতসিত আক্রমণ করে বলেন, “Prophet Muhammad was a demon possessed pediphile.’ Allah is not Jehovah either. Jehovah’s not going to turn you into terrorists that will try to bomb people and take the lives of thousands and thousands people”. ‘ক্রিশ্চিয়ান ব্রডকাস্টিং নেটওয়ার্ক’ তার 700 Club প্রোগ্রামে বিষোদগার করে বলে যে, ‘ভয়ংকর ও ধ্বংসকামী মুসলমানদের দ্বারা আমেরিকা আক্রান্ত’। তিনি বলেন, “স্বয়ং কুরআন বলছে, যেখানেই কাফেরদের দেখ হত্যা কর।” মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় রক্ষণশীল ভাষ্যকার এ্যানি কোলটার মুসলমানদেরকে ‘Camel riding nomad’ বলে অভিহিত করেন। তিনি তার `online column’ এ লিখেন, “We should invade their (Muslims) countries, kill their leaders and convert them to Christiniaty.” ফ্রি কংগ্রেস ফাউন্ডেশন এর সভাপতি Paul Weyrich মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগকে উদ্দেশ্য করে লিখেন যে ডাক বিভাগের Eid Greeting সীলে ‘টুইন টাওয়ার’ এর অবয়ব উৎকীর্ণ থাকতে হবে। কারণ তাঁর মতে `American’s most notable experience with Islam was the attacks on 9-11.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইভানজেলিস্ট রেভারেন্ড বিলি গ্রাহামের ছেলে ইভানজেলিস্ট ফ্রাঙ্কলিন গ্রাহাম বারবার ইসলামকে `Wicked’, `violent’ হিসেবে অভিহিত করেন। টিভি চ্যানেল NBC এর এক প্রোগ্রামে তিনি বলেন, “ We are not attacking Islam, but Islam attacked us, The God of Islam is not the same God……It is a different God……I belive it is a very eivil and wicked religion”.
অবশ্য পরে বিলি গ্রাহাম বলেন, “It is not my calling to analyze Islam?” কিন্তু মুসলমানদের পক্ষ হতে তাঁর বিভ্রান্তি দূর করার জন্য আলোচনার আহবান জানালে তিনি আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেন। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচার এভাবেই চলতে থাকে। Idaho স্টেটের ‘ক্রসরোডস এ্যাসেম্বলি অব গড চার্চ’ এর একটি ডিসপ্লে সাইনবোর্ড এ লিখা হয় “The spirit of Islam is the spirit of Antichrist.’ লসএঞ্জেলসের ‘Simon Wiesenthal Centre Museum of Tolerance’ এর ডীন রাব্বি মারভিন হায়ার টিভি চ্যানেল CNN কে বলেন, “There are direct reference in the Quran to violence.” টুওয়ার্ড ট্রাডিশন” এর সভাপতি রাব্বি ড্যানিয়েল ল্যাপিম ঘোষণা করেন, “Conservative Christian are the natural allies of the Jewish community…….Today we are witnessing two distinct religious civilization in conflict: That of the Quran, allied with the believers in no God, violently challenging the civilization of the Bible, of Christiniaty and Judaism.”
এই ধরনের ইসলাম ও মুসলমানবিরোধী বিষোদগারের দৃষ্টান্ত অজস্র। নাইন ইলেভেনের পর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য সরকারিভাবে মুসলমানদের টার্গেট করার সাথে সাথেই স্রোতের মত এই বিষোদগার শুরু হয়। এই বিষোদগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক শ্রেণীর মানুষকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে প্ররোচিত করে। নানা স্থানে মুসলিম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়। Council on American Islamic Relation (CAIR) এর একটা রিপোর্ট বলেছে, “The 9-11 attacks were followed by a dramatic rise in anti-Muslim hate crimes. CAIR received 1717 reports of harassment, violence and other discriminatory acts in the first six months. Although violent attacks have dropped sharply, CAIR has logged more than 325 complains in the second six months period after the attacks –a 30 percent increase over the same period prior to 9-11.”
ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী ‘hate speech’ ও ‘hate crime’ এর মত নেতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি আরেকটা ইতিবাচক পরিবর্তন মার্কিন জনজীবন প্রত্যক্ষ করে। ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী হিংসাত্মক অপপ্রচারের প্রতিটির জবাব আমেরিকান মুসলমানরা দেবার চেষ্টা করেছে। তাদের পাশাপাশি আমেরিকান মুসলমানদের দুর্দিনে এগিয়ে এসেছে বিবেকসম্পন্ন অমুসলিম আমেরিকানরা। `Southern Baptist Convention’ এর মুসলিম ও ইসলাম বিরোধী জঘন্য অপপ্রচারের জবাবে এগিয়ে এসেছে `American Baptists’ নামের ভিন্ন একটি সংগঠন। দু’হাজার দুই সালের ১৪ জুন `American Baptists Churches’ এর সাধারণ সম্পাদক A.R. Medley বলেন, “…..I am deeply saddened by remarks made by some Baptists leaders and other Christans that have maligned the Islamic faith and religion…….” এর আগে দু’হাজার এক সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের General Board of American Baptist Churches এর পক্ষ হতে anti-Islam, anti-Muslim ও anti-Arab প্রচারণার তীব্র প্রতিবাদ করে এক ঘোষণা প্রচার করা হয়। সে ঘোষণায় আমেরিকানদের প্রতি আহবান জানানো হয়ঃ
- To persue a better understanding of Islam, Muslims and Arabs (including Arab Christians) by including in their churche’s educational programs a study of Islam, of muslim worlds and the Christian minorities within that world. The world and of the issues that have united and divided us by inviting Muslims and Arabs to be a part of the leadership and fellowship of such programme;
- To encourage local and regional economical and interfaith agencies to seek conversation and cooperation with Muslim religious organizations.
- To advocate and defend the civil rights of Arabs and Muslim living in the U.S. by such means as monitoring organization and agencies which exercise responsibility for the peace, welfare and security of the community;
- To reject the religious and political demagoguery and manipulation manifest in the reporting of events related to the middle east, to seek an understanding of the underlying causes of the event, and to condemn violence as a means of enforcing national will or achieving peace;
- To challenge and rebut statements made about Islam, Muslims and Arabs that embody religious stereotyping, prejudice and bigotry.”
“ন্যাশনাল ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন” নামের আরও একটি আমেরিকান সংস্থা ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী হিংসাত্মক প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তার জনগণের প্রতি আহবান জানায়, “To pray for calm and rational thought and behaviour, to pray that our passion do not goad us into cries for vengeance, to pray that the finest character of America will emerge from the chaos of this experience.” নর্থ আমেরিকান কংগ্রেস অন ল্যাটিন আমেরিকা’, ‘কংগ্রেসনাল ব্ল্যাক এসোসিয়েট’, ‘দি সিভিল লিবারাটিজ কোয়ালিশন’ প্রভৃতি সংস্থা মুসলিম বিরোধী প্রোপাগান্ডা ও কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করে। The Congressional Black Assoicate দু’হাজার এক সালে ১৬ নভেম্বর নতুন কালাকানুনের বিরোধিতা করে বলে, ……..Although profiling is now being directed primarily at Muslims ans people who look Middle Eastern, experience shows that it will also be used against other minorities.” দু’ হাজার এক সালের ডিসেম্বরে The American Civil Liberties Union (ACLU) এবং অন্য আরো ১৮ টি সংস্থা ফেডারেল কোর্টে গিয়ে বিস্তারিত তথ্য, যেমন তার কি অপরাধ, তারা কোথায় কতদিন ধরে আছে, তাদের উকিলদের নাম কি ইত্যাদি জানার চেষ্টা করে। তারা ‘গ্লোবাল রিলিফ ফাউন্ডেশন’ এর প্রতিষ্ঠাতা রাবিহ হাদ্দাদের আমেরিকা হতে বহিষ্কারাদের সংক্রান্ত মামলার প্রকাশ্য শুনানির দাবিতে দুটি মামলা দায়ের করে। দুই হাজার দুই সালের জানুয়ারী মাসে শিকাগোর আদালতে তারা আরো দুটি মামলা দায়ের করে।
এসব প্রতিবাদ ও আইনী লড়াই ইতিবাচক ফলও দান করে। দু’হাজার দু’সালের আগষ্টে একজন ফেডারেল বিচারক তার রায়ে বলেন যে, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট রাবিহ হাদ্দাদের মামলার শুনানি রুদ্ধদ্বার কক্ষে করে অসাংবিধানিক আচরণ করছে। কোর্ট জাস্টিস ডিপার্টমেন্টকে আটক ব্যক্তিদের নাম প্রকাশেরও নির্দেশ দেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনের অসাংবিধানিক উদ্যোগকে সিনেটও বানচাল করে দেয়। দু’হাজার এক সালের ৮ নভেম্বর সিনেটর রবার্ট সি স্মিথ ‘Intelligence Authorization Bill’ নামে একটি বিল পাস করানোর জন্য সিনেটে আনেন। এই আইনের লক্ষ্য হলো, অভিযুক্তকে শাস্তি দেয়া হলো কোন তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে, তা অভিযুক্তের কাছ হতে গোপন রাখা। সিনেটর প্যাট্রিক লেহী এবং সিনেট বব গ্রাহামের মত ডিমোক্রেট সিনেটরদের সোচ্চার কন্ঠে বাধা এই আইন প্রণয়নের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
কংগ্রেসের হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটি ও ব্লাক ককাসের সদস্য জন কনিয়াস জুনিয়র কালাকানুনের একজন তুখোড় সমালোচক। তিনি নানাভাবে মুসলিম আটকদের সহায়তা দান করেন। দু’হাজার দু সালের ২২ জানুয়ারী তিনি The Detroit News এ বলেন, “To be clear, I have firmly supported the need to bring terrorists to justice, while consistently protesting against government abuse of our constitution……I fear the justice department, in its zealousness to protect our freedoms by detaining Middle Easterner without disclosing evidence and holding secret hearings, is quickly whittling away the constitutional foundation that has made freedom a becon for the world.”
নাইন ইলেভেন এর পর ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মার্কিন মিডিয়া আগ্রাসন ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। সিয়ান হ্যানিটি, বিল ও রেলি, রীচ লোয়ারী, ড. লরা শ্লেসিংগার, রস লিমবার্গ, ক্যাল টমাস এবং এ্যালেন কিয়াসের মতো বিখ্যাত মার্কিন ভাষ্যকাররা তাদের মুখ হতে বিষ উদগার করেন। এরই পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমের কিছু কিছু উদ্যোগ ইসলাম ও সন্ত্রাসের মধ্যকার পার্থক্য প্রদর্শনে এগিয়ে আসে।` Orphan winfrey show’ নামের NBC টেলিভিশনের ১ ঘন্টার টেলিভিশন অনুষ্ঠান মুসলমানদের জীবন ও ইসলামি আদর্শ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে। অনুষ্ঠানটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স টেলিভিশন নেটওয়ার্ক’ এর ‘Seventh Heaven Show’ এবং ‘Noggin and Nickelodeon’ এর A walk in your shoes’ প্রোগ্রাম ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে ভুল ধারণা নিরসনে এগিয়ে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Washington Post সহ অনেক পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে মার্কিন প্রশাসনের বৈষম্যমূলক আইন ও আচরণের তীব্র সমালোচনা করে। দু’হাজার দুই সালের ৭ ফেব্রুয়ারী ওয়াশিংটন পোস্ট লিখে, “Ten days after the 9-11 attacks, the administration instructed its immigration judges to keep certain proceedings closed. Not only would hearing be conducted in secret with `no visitors, no family and no press’ present, but the `record of the proceeding (was) not to be released to anyone’ either including `confirming or deying whether such a case is on the docket or scheduled for a hearing’…….. Public access has been not existent anyway. Immigration cases carry enormous consequences for people’s freedom. The trials should, like criminal trials, be open for public scrutiny and criticism unless there is a compelling reason to the contrary. Holding trials in secret is a tactic unworthy of a great legal system.
উপরে যে আলোচনা হলো তা পুরোটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও এমন কথা বলার অনেক লোক আছে। বিশেষ করে নাইন ইলেভেনের পর আফগানিস্তান, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাপারে যে মার্কিন পলিসির প্রকাশ ঘটেছে, মার্কিন সংবিধানের নিরিখে সে সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যেতে পারে। কিন্তু আজ এ বিষয়টা আমার আলোচ্য নয়। তবে গুয়ানতানামো বন্দীখানার ব্যাপারটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের কোন ব্যাপার নয়। প্রায় সাতশ’র মতো লোককে সেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে। যারা মার্কিন কোর্ট ও মার্কিন আইনের আশ্রয় পাচ্ছে না। অথচ তারা মার্কিনীদের হাতেই বন্দী। মার্কিন সরকারের হাতে বন্দী থাকলেও মার্কিন আইন ও মার্কিন কোর্টের হাত তাদের পর্যন্ত পৌছতে পারছে না এবং তাদের ব্যাপারে পৃথিবীর সব আইন অক্ষম। মানবাধিকার লংঘনের এতোবড় ঘটনা সভ্য জগতের ইতিহাসে নেই। নাইন ইলেভেন পরবর্তী মার্কিন জীবনের এটাও একটা পরিবর্তন। গুয়ানতানামোকে বাদ দিয়ে মার্কিন ইতিহাস লেখা যাবে না।
নাইন ইলেভেন মার্কিন আইন ও মার্কিন আচরণের মতো মার্কিন মুসলমানদের জীবনেও পরিবর্তন এনেছে। হত্যা ধর্ষণ হতে শুরু করে সম্পত্তির ক্ষতি, নানাভাবে নির্যাতন ও লাঞ্চনা গঞ্জনার তারা শিকার হয়েছে। কিন্তু এই নেতিবাচক পরিবর্তন তাদের জীবনে আরেকটা ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। সেটা হলো আমেরিকানদের দৃষ্টি ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। বহুক্ষেত্রেই ইসলামকে বোঝার ও মুসলমানদেরকে জানার জন্য তারা এগিয়ে এসেছে। নাইন ইলেভেনের পরপরই মার্কিন প্রশাসনের একটি অংশ এবং একশ্রেণীর আমেরিকানদের মধ্যে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধীতা যেমন প্রকট হয়ে ওঠে, তেমনি এ সময়ই সাধারণ ও সচেতন মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে আগ্রহ দারুণভাবে বেড়ে যায়। এর একটা পরিমাপক হলো নাইন ইলেভেনের পর প্রথম এক কোয়ার্টারে ইসলাম গ্রহণের হার ছিল প্রতি মাসে চার হাজার হতে সাড়ে চার হাজার। নাইন ইলেভেন পূর্ব সময়ের চেয়ে এই হার প্রায় চার গুণ বেশি। পরে এই হার কমে এসেছে বটে, কিন্তু তবু বর্তমান হার নাইন ইলেভেন পূর্ব হারের চেয়ে অনেক বেশি। সাধারণ আমেরিকানরা খুঁজে খুঁজে ইসলামী বইপত্র ও পত্রপত্রিকা পড়ে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ মেটাচ্ছে। সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরে একদিন আমি নিউইয়র্ক মেসেজ পত্রিকার সম্পাদকের টেবিলে বসেছিলাম। এ সময় তার কাছে একটি টেলিফোন এলো আটলান্টা হতে। একজন অমুসলিম মেয়ে মেসেজ পত্রিকার গ্রাহক হওয়ার নিয়মাবলি জানার জন্য এই ফোন করেছিল। মেয়েটি কোথাও হতে এই পত্রিকার নাম পেয়েছিল। সম্পাদক সাহেব বললেন, এ ধরনের চিঠিপত্র, টেলিফোন, ইমেইল তারা অহরহই পাচ্ছেন। এই সফরে ওয়াশিংটন ডেট্রয়েড, নিউইয়র্ক যেখানেই ধর্মনেতা, আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের সাথে দেখা হয়েছে, তাঁরা বলেছেন যে, নাইন ইলেভেন এর পর রেডিও, টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা ও অনুষ্ঠানে তাদের ডাক বেড়ে গিয়েছে। স্থানীয়ভাবে মুসলমানরা স্থানীয় রাজনীতিক ও সমাজ নেতাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারা পরিবর্তনের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক। নাইন ইলেভেনের পর থেকে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দলের স্থানীয় নেতা এবং সিনেট ও কংগ্রেস সদস্যরা মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছেন। নাইন ইলেভেন পরবর্তী বিপর্য্যয়কর মুহুর্তে বহুক্ষেত্রেই তাদের সহযোগিতা স্বান্তনায় মুসলিম আমেরিকানরা নিরাপত্তা বোধ করেছে। মেরিল্যান্ড অথবা ভার্জিনায় একটা চমকপ্রদ গল্প শুনেছিলাম। সেখানকার গভর্নর অফিসে একজন মুসলিম আমেরিকান চাকরি করেন। নাইন ইলেভেন ঘটনার পরদিন তিনি ভয়ে অফিসে যাওয়া হতে বিরত থাকেন। গভর্নর এ বিষয়টি জানার সাথে সাথেই ছুটে যান কর্মচারীর বাড়িতে এবং তাকে অভয় দিয়ে নিয়ে আসেন।
নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকান মুসলমানদের জীবনের পরিবর্তনের আরেকটি বড় দিক হলো, তাদের দৃষ্টি এবার তাদের নিজেদের দিকে খুব ভালোভাবেই পড়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। তাদের শক্তি ও সম্ভাবনাকে যেন তারা নতুন করে আবিষ্কার করেছে। এবার মিসিগানের ডেট্রয়েট ডিয়ারবোর্নে থাকাকালে সেখানে আরব আমেরিকানদের তিন দিনব্যাপী বার্ষিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান দলের নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন। তিন দিনের এই কনভেনশনে ডেমোক্র্যাটিক দলের নমিনেশনকামী আটজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীই বক্তৃতা করেন। শুনেছি আরব আমেরিকান এই কনভেনশন মার্কিন রাজনীতিকদের কাছে এবার যে গুরুত্ব পেয়েছে, তার শতভাগের একভাগ গুরুত্বও অতীতে পায় নি। কনভেনশনের দ্বিতীয় দিনে বার্ষিক ডিনার অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এই ডিনার পার্টিতে দাওয়াত পেয়েছিলাম। ডিনার পার্টিতে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টির নেতৃবৃন্দসহ িএকজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বক্তৃতা করেন। তারা সবাই মুসলিম স্বার্থের পক্ষে কথা বলেন। আমেরিকান মুসলমানরা যে নির্যাতন নিপীড়ন এর শিকার হয়েছে তাও তারা স্বীকার করেন এবং এজন্য সরকারকে তারা অভিযুক্ত করেন। কিন্তু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আরব আমেরিকান নেতাদের বক্তৃতা। এই বক্তৃতায় তাদের আত্মসমালোচনা ও আত্ম সমীক্ষা ছিল। মুসলমানদের বিভিন্ন গ্রুপ নামে বিভক্তিজনিত অনৈক্যকে তারা আমেরিকান মুসলমানদের দুর্বলতা ও দুর্ভাগ্যের একটা কারণ বলে উল্লেখ করেন। এই দুর্বলতা না থাকলে তারা মার্কিন রাজনীতির মূল স্রোতধারায় তাদের শক্তিশালী অবস্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হতো। মুসলিম নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘ভোট আমাদের right এবং ব্যালট আমাদের might. এই অস্ত্র আমরা এতদিন ব্যবহার করি নি, এখন ব্যবহার করতে হবে এই অস্ত্র’। উক্তিটি আমি মনে করি সব আমেরিকান মুসলমানদেরই। মসজিদগুলোর সামনে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে মুসলমানদের ভোটার রেজিষ্ট্রেশনের হিড়িকের মধ্যে এই মনোভাবেরই সরব প্রকাশ দেখতে পেয়েছি। আত্মপরিচয়সহ নিজের প্রকাশ করার দৃঢ়তাও সৃষ্টি হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে নাইন ইলেভেনের পর। নিউইয়র্কে অথবা ওয়াশিংটনে একজন কলেজ শিক্ষকের কাছে গল্প শুনেছিলাম যে, নাইন ইলেভেনের পর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম মেয়েদের মধ্যে মাথায় রুমাল পড়ার অভ্যাস বেড়েছে। ভয়-সংকোচের বদলে তারা সাহসী হয়ে উঠেছে। একটা বিস্ময়কর ঘটনা হলো, ভার্জিনিয়ার স্টেটের সিনেটের জন্য সাঈদ আফিফা নামের একজন বোরখাধারী মহিলা ডেমোক্রেটিক পার্টির নমেনেশন পাওয়ার নির্বাচনী প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছে। এটা কোন মিরাকল নয়। মিথ্যার ওপর সত্যের জয় এভাবেই সূচিত হয়ে থাকে।
নাইন-ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘হোম এ্যাফেয়ার্স’ এ এত পরিবর্তন এলেও মার্কিন যুক্তরাষ্টের ‘ফরেন এ্যাফেয়ার্স’ এ কোন পরিবর্তন লক্ষ করি নি। সফরকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান পলিসি, ইরাক পলিসি, ফিলিস্তিন-ইসরাইল পলিসি ও ‘ওয়ার অন টেরর’ প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক মতবিনিময় হয়েছে আমাদের। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে কোন নতুন চিন্তার কোন ইঙ্গিত আমরা পাইনি। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার সাথে একজন আফগান জড়িত না থাকলেও লাদেন এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার প্রত্যক্ষ ও সন্দেহাতীত প্রমাণ না মিললেও হত্যা ধ্বংসের মাধ্যমে আফগানিস্তান দখল এবং ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের নাম নিশানা না পাওয়া গেলেও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইরাক কুক্ষিগত করাকে মার্কিন প্রশাসন এখনও সঠিক মনে করছে। এটা তাদের সিদ্ধান্তগত দৃঢ়তা, না ঘটনা পূর্ব কোন মাইন্ড সেট এর ফল, তা বলা মুশকিল। তবে সত্য এই যে সত্যের মুখোমুখি মার্কিন প্রশাসনকে একবার হতেই হবে। সিনেটর রবার্ট বায়ার্ডও একই কথা বলেছেন। দু’হাজার তিন সালের ২১ মে সিনেটের এই সাবেক মেজরিটি লিডার ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর বায়ার্ড সিনেটের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে এ কথাটিই বলেছিলেন এভাবে;
‘Truth has a way of ascerting itself despite all attempts to obscure it. Distortion only serves to derail it for a time. No matter to what lengths we humans may go to obfuscate facts or delude our fellows, truth has a way of squeezing out through the cracks, eventually…..the American people unfortunately are used to political shading, spin and the usual chicanery they hear from public officials. They patiently tolerate it up to a point. But there is a line. It may seem to be drawn in invisible ink for a time, but eventually it will appear in dark colors, tinged with anger. When it comes to shedding American blood-when it comes to wreaking havoc on civilians, on innocent men, women and children callous dissembling is not acceptable. Nothing worth that king of lie not oil, not revenge, not reflection, not somebody’s grant pipedream of a democracy domino theory. And mark my words, the calculated intimidation which we see so often of late by the powers that be will only keep the loyal opposition quiet for just so long. Because eventually, like it always does, the truth will emerge. And when it does, this house of cards, built with deceit, with fall.”
অনুরূপভাবে ফিলিস্তিন ইসরাইল ব্যাপারেও মার্কিন পলিসি এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বাপর সব ঘটনা এটাই প্রমাণ করেছে যে, মার্কিন প্রশাসন ফিলিস্তিনে অবশ্যই শান্তি চায়, কিন্তু সেই শান্তি ইসরাইলী অভিভাবকত্বে, ইরসাইলকে অদ্বিতীয় অবস্থায় রেখে। ব্যাপারটা ঠিক ভারতবর্ষে লর্ড ডালহৌসি কর্তৃক দেশীয় রাজ্যগুলো জন্য প্রণীত অধীনতামূলক মিত্রতার মতই। এ না হলে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানের জন্য ‘সেলফ রুল’ এবং আজকের ‘রোডম্যাপ’ কিছুরই প্রয়োজন ছিল না। পিএলও যখন ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিল , তখন স্রেফ রুলের ভাঁওতাবাজিতে না গিয়ে যদি তখনই ১৯৬৭ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চল ইসরাইল ফেরত দিত, তাহলে অশান্তির বড় কারণ দূর হয়ে যেত। হামাসেরও সৃষ্টি হতো না। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপন সহজ হয়ে যেত। কিন্তু ইসরাইল শান্তি চায় না, চায় আধিপত্য, যার সুন্দর নাম হলো ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ইসরাইলী এই নীতিকেই এনডোর্স করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথে এই মানসিকতাই সবচেয়ে বড় বাধা। আমি এবারের সফরকালে শান্তির জন্য ইসরাইল বিনাশর্তে ১৯৬৭ সালে অধিকৃত এলাকা ছাড়তে পারে কি না এই প্রশ্ন তুলেছিলাম। স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল এর দুজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি একই জবাব দিয়েছিলেনঃ সমস্যাটি এত সরল নয়, সমাধান এত সহজ নয়। ইহুদী একটি গ্রুপের সাথে আমাদের আলোচনা ছিল। সেখানেও এই প্রশ্ন আমি করেছিলাম। বিস্ময়করভাবে জবাব একই রকমের ছিল-সমস্যাটি এত সহজ নয়। তবে সেলফ রুল ফর্মুলাও সমস্যাকে সহজ করে নি। রোডম্যাপ সমস্যাটা সহজ করে দেয় কিনা তা দেখার বিষয়।
নাইন ইলেভেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় নীতিকেই প্রভাবিত করেছে। এই প্রভাব তার অভ্যন্তরীন নীতিতে যেমন কিছু নেতিবাচক প্রভাব এনেছে, তেমনি তার বৈদেশিক নীতির ইতিবাচক পরিবর্তনে বাধার সৃষ্টি করেছে। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনদিনই আর তেমন হবে না, যেমনটা ছিল নাইন ইলেভেনের পূর্বে।” এর সাথে আমি একমত নই। আমি সিনেটর বায়ার্ডের সাথে একমত যে, মার্কিন জনগণের দ্বারাই অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারিত হয়। তবে এর জন্য অপেক্ষাটা অনেক সময় কষ্টকর হয়ে ওঠে।
(২০০৩ সালের ১৩ অক্টোবর থেকে প্রায় ২৪ দিন ব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে। প্রবন্ধটি সেই সফরের একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা।)।