সিপাহী বিপ্লবোত্তর মুসলিম রাজনীতি
১৮৫৭ সাল ব্রিটিশ- ভারতীয় রাজনীতির একটা টার্নিং পয়েন্ট । এই বছর ভারত শাসনকারী ব্রিটিশ ইষ্ট- ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারতীয় সৈন্যের ব্যারাক সহ ভারতবর্ষের এক বিরাট অঞ্চল জুড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিপ্লব, অন্য কথায় প্রবল এক জন- অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় । এই জন-অভভুত্থানকে আমাদের অনেক ইতিহাসকার ‘প্রথম আযাদী আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন । আমাদের মতে ইতিহাসের সাথে এমন বে-ঐতিহাসিকের মতো কাণ্ড আর কিছুই হতে পারেনা । প্রকৃতপক্ষে পলাশী যুদ্ধের পরে আযাদী হারা মুসলমানরা যখনই তাঁদের পরাধীন অবস্থার কথা অনুভব করেন তখন থেকেই তাঁদের আযাদী আন্দোলনের শুরু । ১৭৬৪ সালে বক্সারের রণাঙ্গনে অংকুরেই নির্বাণ লাভ করে, তবু তাকে স্বাধীনতা প্রচেষ্টা না বললে ভুল হবে । তবে প্রতিরোধ এবং আযাদী আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠে মুসলিম জনগনের কাতার থেকেই । তদানীন্তন শিক্ষিত সমাজনেতা তথা আলেম সমাজই এ সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদান করেন । পলাশীর যুদ্ধের মাত্র ৬ বছর পরে ফকির আন্দোলনের নেতা ফকির মজনু শাহের বাহিনীর সাথে ইংরেজ বাহিনীর যুদ্ধ সংগঠিত হয় । নবাবের অনেক পলাতক সৈন্য এবং স্বাধীনতা পাগল মানুষ ফকির মজনু শাহের পতাকা তোলে সমবেত হয়েছিলো । প্রায় তিন দশক ধরে বাংলার এক বিরাট অঞ্চলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তারা সংগ্রাম পরিচালনা করেছে । এদের সংগ্রাম স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পরে পরেই আমরা হাজী শরিয়তুল্লাহ, তিতুমীর, সাইয়েদ আহমেদ ব্রেলভী প্রমুখ মুসলিম জননেতাকে ব্যাপক এবং প্রবল আযাদী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে দেখি । এদের সকলেরই সংগ্রাম সাধনার উৎস ছিলেন শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী এবং তার পুত্র শাহ আব্দুল আযীয দেহলভীর শিক্ষা এবং সংস্কার পরিকল্পনা । বস্তুত তিতুমীরের নারকেল বাড়িয়া এবং সাইয়েদ আহমেদ ব্রেলভীর বালাকটের মতো দেশের অসংখ্য স্থানে তারা উনিশ শতকের শুরু থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে রক্তলেখা ইতিহাসের শুরু করেন, তাঁরই একটা দৃশ্য ১৮৫৭ সালের সিপাহী আযাদী সংগ্রাম । তাই বলছিলাম, ১৮৫৭ সালের আযাদী সংগ্রাম প্রথম আযাদী সংগ্রাম নয়, সংগ্রামের অনেক দৃশ্যের মধ্যে এটা একটা অবিস্মরণীয় দৃশ্য মাত্র । বলেছি, এই দৃশ্য ১৮৫৭ সালের আযাদী সংগ্রামের এই ঘটনা, ব্রিটিশ ভারতীয় রাজনীতির একটা টার্নিং পয়েন্ট । ১৭৫৭ সালের পর থেকে চলে আসা রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস যেন একটা বড় মোড় পরিবর্তন করে এখানে এসে । সমাজের সম্মুখ সারিতে কিছু চরিত্র বদল হয়, কিছু রূপ পরিবর্তন ঘটে । ঐতিহ্যিক সংগ্রামী চেতনা এখানে এসে যেন মুখ থুবড়ে পড়ে । ১৮৫৭ সালের পর যে মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠে তা এইঃ
- (ক) ব্রিটিশ ভারতের শাসনভার কোম্পানীর হাত থেকে ব্রিটিশ সরকারের কাছে হস্তান্তর ।
- (খ) ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দু বাবু শ্রেনীর মাধ্যমে হিন্দু জাতীয় চেতনার উত্থান ।
- (গ) মুসলিম সংগ্রামী শক্তির ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে ইংরেজী শিক্ষিত মুসলিম আপোষকামী শক্তির উদ্ভব ।
এই রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলো সামনে রাখলেই ১৮৫৭ সালের পরবর্তী মুসলিম রাজনীতির চরিত্র আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে । প্রথমে ধরা যাক, ভারতের কর্তৃত্ব কোম্পানীর হাত থেকে ব্রিটিশ রাজের হাতে যাওয়ার বিষয়টা । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারতের দখল পর্ব সমাপ্ত করার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের এই অভিনয় সংগঠিত হয় ১৮৫৮ সালে । বাংলাদেশ পদানত করার সময় ক্লাইভ মহীশুর, হায়দ্রাবাদ, মারাঠা এবং দিল্লীকে বশে আনার সময় ওয়েলেসলী এবং কর্ণওয়ালিস এবং সিন্ধুসহ ভারত দখলে আনার জন্য ইংরেজ গভর্নর নেপিনার ষড়যন্ত্র ও পশুশক্তি বলে যে পাপের পাহাড় রচনা করেছিলেন যার বিরুদ্ধে সিপাহী জনতার একটা মরিয়া প্রতিক্রিয়া ছিল ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ, সে পাপকেই ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্বারা ব্রিটিশরাজ ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে চেয়েছিলেন । এই ক্ষমতা হস্তান্তরের মূলে আর যতো কারণই থাকুক, সব দোষ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘাড়ে চাপিয়ে ভারতীয়দের কাছে ব্রিটিশ সরকার ও জাতিকে নির্দোষ সাজানোর লক্ষই ছিল মুখ্য । এই অস্ত্র তাঁদের বৃথা যায়নি । অন্তুত স্তাবকরা নতুন ব্রিটিশ রাজের পক্ষে ওকালতি করার একটা বিরাট সুযোগ পেয়েছিল । আর ব্রিটিশ সরকারও নতুন করে যাত্রা শুরু করার যে সুযোগ থাকে তা পুরোপুরি নিয়েছিল । বলাবাহুল্য, এই কৌশল প্রতিক্রিয়াকে ভিন্নমুখী করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি মজবুত করার পক্ষেই সহায়ক হয়েছিলো । লক্ষণীয়, ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত প্রতিরোধের যে বহ্নিশিখা ইংরেজ শাসকদের নিরন্তন পুড়েছে, পরবর্তী ৯০ বছর তাকে আমরা অনুপস্থিত দেখি । ‘রাজানুগত প্রজাদের দাবী আদায়ের যন্ত্রনা তাকে ভোগ করতে হয়েছে বটে, কিন্তু নারকেল বাড়িয়া এবং বালাকোটের শহীদানদের মতো উন্নতশির স্বাধীনতা সংগ্রামীর জ্বালানো বহ্নিশিখায় জলতে হয়নি ব্রিটিশ রাজকে । ১৮৫৭ সালের পর উইলিয়াম হান্টারের পর্যালোচনা এবং লর্ড মেকলের পরিকল্পনা অনুসরন করে ব্রিটিশরাজ আপোষমূলক রাজনীতির যে বীজ বপন করেছিলেন, তাঁরই পুরস্কার ছিল এটা । উপনিবেশিক শক্তির হাতে এই আপসের রাজনীতির যারা উপকরন হয়েছিলেন তাঁদের ইতিহাসই পরবর্তীকালের রাজনীতি । আমরা এখন সেই রাজনীতির আলোচনায় আসছি ।
এ পর্যায়ে প্রথমে আসে ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দু বাবু শ্রেনীর কথা । কিন্তু এ সম্পর্কে বলার আগে পলাশী উত্তর হিন্দু রাজনীতি সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা প্রয়োজন । উল্লেখ্য, ভারতে ব্রিটিশ শাসন অধিকাংশ হিন্দু নেতাদের কাছে প্রভু পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই ছিলনা । মুসলিম শাসনে তারা আশাতিরিক্ত ভালো ব্যবহারই পেয়েছে – একথা গুণীজনদের মুখ থেকেই শুনুন । দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রাজা রামমোহন রায় বলেছেন, “মুসলিম শাসনে এদেশের হিন্দু অধিবাসীরা মুসলমানদের মতই সকল প্রকার রাজনৈতিক অধিকার, সুযোগ- সুবিধা ভোগ করতেন । রাষ্ট্রের উচ্চতম পদ, সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব, প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতা, সম্মানীত মন্ত্রীর আসন প্রভৃতির ক্ষেত্রে নিয়োগের ব্যাপারে ধর্ম বা জন্মস্থান কিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়াত না । হিন্দুরা ভূমি মজুরী লাভ করতো, খাজনা মওকুফ পেত এবগ্ন উচ্চ বেতন ছাড়াও অফিস সংলগ্ন ভূমি ব্যবহারের দেদার সুযোগ তাঁদের ছিল ।” ( Memorial to the supreme court of Calcutta, 1823 )
কিন্তু মুসলিম শাসকদের এই ভালো ব্যবহারের কোন প্রকার স্বীকৃতি পলাশী উত্তর হিন্দুদের ব্যবহারে মেলেনি । এই সময় তাঁদের রাজনীতির সারকথা ছিল, নতুন প্রভুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদেরকে দিয়ে এবং তাঁদের সাহায্য নিয়ে পুরাতন প্রভু মুসলমানদেরকে যতো পারা যায় নির্যাতন- নিষ্পেষণে নিষ্পিষ্ট করে ফেলা । হিন্দুরা ইংরেজ প্রেমে এতখানিই অন্ধ হয়ে পড়েছিলো যে, বালাকোট এবঞ নারকেলবাড়িয়ায় যখন ভারতের মুসলমানরা ইংরেজদের হাতে জীবন দিচ্ছে, তখন তারা বলছে, “আমাদের যদি বলা হয় তোমরা ব্রিটিশ শাসন চাও না কার শাসন চাও ? আমরা বলবো আমরা ব্রিটিশ শাসন চাই । এমনকি হিব্দু শাসনও নয় ।” ( Daily ‘Reference’ of the Hon’ble Prosonor kumar thakur, july, 1831 )
১৮৫৭ সালে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইংরেজদের কামানের গোলায় জীবন দিচ্ছিল, তখন হিন্দু পত্রিকা লিখেছে, “আমরা পরমেশ্বরের সমীপে সর্বদা প্রার্থনা করি, পুরুষানুক্রমে যেন ইংরেজাধীকারে থাকিতে পারি ; ভারত ভূমি কতো পুণ্য করিয়াছিলেন এই কারনে ইংরেজ স্বামী পাইয়াছেন, মৃত্যুকাল পর্যন্ত যেন ইংরেজ ভূপালদিগের মুখের পান হইয়া পরম সুখে কাল যাপন করেন ।” ( সংবাদ ভাস্কর, ২০ জুন ১৮৫৭ )
স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে হিন্দু পত্রিকাগুলো কি দৃষ্টিতে দেখেছে, বন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি কি নিষ্ঠুর মনোভাব পোষণ করেছে, তার অনেক দৃষ্টান্তের একটা এখানে তুলে ধরছি । ১৮৫৭ সালের ১৮ এবং ২০ জুন সংবাদ ভাস্কর লিখে, “আগ্রা, দিল্লী, কানপুর, অযোধ্যা, লাহোর প্রদেশীয় ভাস্কর পাঠক মহাশয়রা এই বিষয়ে মনোযোগ করিবেন এবং পাঠ করিয়া বিদ্রোহীদের আড্ডায় আড্ডায় ইহা প্রকাশ করিয়া দিবেন, সিপাহীরা জানুক ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সিপাহী ধরা আরম্ভ করিয়াছেন, আর বিদ্রোহী সিপাহী সকল শোন শোন, তোদের সর্বনাশ উপস্থিত হইলো, যদি কল্যাণ চাহিস তবে এখনো ব্রিটিশ পদানত হইয়া প্রার্থনা কর, — ক্ষমা করুন ।— গত বুধবার বেলা দুই প্রহর দুই ঘণ্টাকালে সৈন্য পরিপূর্ণ এক জাহাজ উত্তর দিকে থেকে আসিয়া কলিকাতা দুর্গের দক্ষিণাংশে লাগিল । সে সময় উক্ত জাহাজ অতি সুদৃশ্য দৃষ্টি হইল, গোরা সৈন্যরা পাঁচশো সিপাহীকে হাতে হাতকড়া পায়ে বেড়ী দিয়া লইয়া আসিয়াছে, গভর্নমেন্ট সিপাহীদিগের প্রতি যে প্রকার ক্রোধ করিয়া রহিয়াছেন, তাহাতে বলিদান দিবেন ইহাই জ্ঞানগ্রাহ্য হইতেছে । কালীঘাটে বহুকাল নরবলি হয় নাই । আমাদিগের রাজ্যেশ্বর যদি হিন্দু হইতেন এই সকল নরবলি দ্বারা জগদম্বার তৃপ্তি করিতেন ।” বস্তুত হিন্দুদের পলাশী উত্তর রাজনীতিই ছিল ইংরেজদের তোষণ এবং মুসলমানদের বিরোধিতা । ইংরেজদের নিকট তারা এর পুরস্কারও লাভ করে । পলাশী যুদ্ধের একশো বছরের মধ্যে সহায়- সম্পদে সমৃদ্ধ মুসলমানরা কাঠুরে এবং ভিস্তিওয়ালার জাতিতে পরিণত হয় । আর তাঁদের হস্তচ্যুত সম্পদের বৃহত্তর অংশই প্রতিবেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে গিয়ে জমা হয় । এই সম্পদ ভোগের চৌহদ্দিতেই হিন্দু বাবু শ্রেনীর জন্ম এবং তাঁদের জাতীয়তাবাদী উত্থানের মূলে আরেকটি উৎসর্গ কাজ করেছে ।
১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজ ভারতের শাসনভার হাতে নেয়ার পর ব্রিটিশ সরকার ভারত বাসীকে ভারত শাসনকার্যে সংশ্লিষ্ট করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন । শাসন কাজের বিভিন্ন পর্যায়ে ইংরেজী শিক্ষিত ভারতবাসীকে ধীরে ধীরে সুযোগ দেয়ার কাজও শুরু হয় । হিন্দুরা ইংরেজী শিক্ষা গ্রহন করেছিলো বলেই এই সুযোগ ষোল আনাই তাঁদের কপালে জুটে যায় । এভাবে ইরংরেজী শিক্ষিত এক হিন্দু বাবু শ্রেনীর উদ্ভব হয় । যাদের রাজভক্তি ছিল প্রশ্নাতীত । কিন্তু সেই সাথে তাঁদের মধ্যে জাতীয় অধিকারের চেতনারও বিকাশ ঘটতে থাকে । ১৮৫৭ সালের পূর্বে হিন্দুরা যেখানে ইংরেজদের স্তর এবং বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া স্বার্থ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল, সেখানে ১৮৫৭ সালের পূর্ব ইংরেজদের স্তর গাঁথা থাকলো কিন্তু আগের সেই বিচ্ছিন্ন স্বার্থ চিন্তাটা জাতীয় স্বার্থ চিন্তায় রূপ পরিগ্রহ করলো । ব্রিটিশ প্রশাসনে অংশ এবং মর্যাদা নিয়েই এই চিন্তার শুরু । ১৮৫৮ সালের রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় সরকারী চাকুরীতে ভারতীয়দেরকে যে সমান সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়, তা ১৮৬১ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস এ্যাক্ট- এ পরিনত হয় । কিন্তু ইংরেজরা এই এ্যাক্ট অনুযায়ী ভারতীয়দেরকে সুযোগ- সুবিধা দিত না । বিশেষ করে সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের নিয়োগ তারা এড়িয়ে চলতো । এই সময়ের একটা ঘটনা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আন্দোলনে রূপ নেয় । স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজী সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হন । কিন্তু তাকে তালিকা থেকে বাদ দেবার চেষ্টা করা হয় । পরে মহারানীর খাস বিচারালয়ের হস্তক্ষেপে তার চাকরি দেয়া হয় । কিন্তু স্যার সুরেন্দ্রনাথকে চাকুরী দিয়েও বরখাস্ত করা হয় । চাকরী বঞ্চিত স্যার সুরেন্দ্রনাথ ভারতীয়দের পক্ষে আন্দোলনে নামেন এবং ‘ইন্ডিয়া এ্যাসোসিয়েশন ক্যালকাটা” নামক প্রতিষ্ঠান গড়েন । উল্লেখ্য ব্রিটিশ ভারতে হিন্দুদের এটাই প্রথম প্রতিবাদমুলক একটি গনপ্রতিষ্ঠান । কিন্তু তারও জন্ম আবার অনুগত প্রজা হিসেবে চাকরির অধিকার আদায়ের জন্যই । উত্তরকালে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ‘আর্মস এ্যাক্ট’, ‘ভারনেকুলার প্রেস এ্যাক্ট’ প্রভৃতির মতো বিভিন্ন ধরনের শাসনতান্ত্রিক অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয় । এই আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে ১৮৮৫ সালে এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম নামে একজন প্রাক্তন ইংরেজ সিভিল সার্জেন্ট – এর উদ্যোগে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় । জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল, রাজানুগত ভারতবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করে বিক্ষোভ- বিশৃঙ্খলা দেশকে রক্ষা করা । পরে গভর্নর জেনারেল ডাফ্রিনের পরামর্শেই কংগ্রেস একটি রাজনৈতিক দলে পরিনত হয় । প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় কংগ্রেস মুখ্যত ব্রিটিশ আগ্রহেই দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে । কংগ্রেস মহলে ব্রিটিশ পদ, পদবি এবং খেতাবের ছড়াছড়ি হয়ে যায় । স্যার সুরেন্দ্রনাথ যাকে সিভিল সার্ভিস থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিলো তাকেও স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয় । ইতিহাস এ ব্যাপারে একমত যে, রাজানুগত ইংরেজী শিক্ষিত এই বাবু শ্রেনীই জনগনের উত্থান চেতনার বাগডোরা হাতে রেখে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নাম করে ভারতীয়দের অসন্তোষ উত্তেজনা দুই যুগেরও বেশি ঠেকিয়ে রাখে এবং এইভাবে এই সংস্থা, ঐতিহাসিকদের ভাষায়, “বিদেশি প্রভুদের স্বার্থে একটি ঘা- চোষক গদির” কাজ করে যায় । বিশ শতকের শুরুর দিকে কংগ্রেস গোপাল কৃষ্ণ গোখেলের নেতৃত্বে মধ্যপন্থী এবং বালগঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখের নেতৃত্বে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী – এই দুই উপধারায় বিভক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে । বলা যায়, এ পর্যায়ে এসেই বঙ্গ ভঙ্গকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস তথা হিন্দু রাজনীতি নতুন এক মোড় পরিবর্তন করে, যা ১৮৫৭ সাল উত্তর মুসলিম রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে ।
১৮৫৭ সাল উত্তর মুসলিম রাজনীতির যে শিরোনাম আমরা দিয়েছি তা হলো, মুসলিম সংগ্রামী শক্তির ধ্বংসস্তূপ থেকে ইংরেজী শিক্ষিত আপসকামী মুসলিম মুসলিম শক্তির উত্থান । পলাশী প্রান্তরে মুসলিম রাজশক্তির ভাগ্য বিপর্যয়ের পর মুসলিম সমাজনেতা তথা আলেম সমাজ স্বাধীনতা সংগ্রামের যে আপোষহীন পতাকা উত্তোলন করেন, ১৯৫৭ সালে ইংরেজরা তাকেই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়ার চেষ্টা করে । ১৮৭১ সালে ভারতীয় রাজনীতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে স্যার উইলিয়াম হান্টার লেখেন, “এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ভারত গভর্নমেন্ট যদি পূর্ব থেকেই ষড়যন্ত্র আইনের ৩নং ধারা অনুযায়ী ভারতের আলেমদের কঠোর হস্তে শাসন করতো তাহলে ভারত গভর্নমেন্টকে মুজাহিদ আলেমদের আক্রমনের ফলে এতো দুঃখ ভোগ করতে হতো না । কতিপয় আলেমকে গ্রেফতার করলে আম্বালা দুর্গে আমাদের এক হাজার সৈন্য হতাহত হতো না এবং লক্ষ লক্ষ পাউন্ড অর্থ বেচে যেতো । এমনকি উক্ত লড়াইয়ের পরও যদি কঠোর হস্তে আলেমদেরকে দমন করা হতো, তবে অন্তুত পক্ষে ১৮৬৮ সালে কালাপাহাড় অভিযান থেকে রক্ষা পাওয়ার আশা ছিল ।” উইলিয়াম হান্টার আলেমদের কঠোর হস্তে দমন না করায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন । কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, ইংরেজরা তাঁদের সাধ্য অনুসারে স্বাধীনতা কামীদের বিরুদ্ধে কোন কঠোরতাই বাদ রাখেনি । কাফির বিদ্রোহকে তারা কঠোর হাতেই দমন করেছে । তিতুমীর এবং হাজী শরীয়তুল্লাহর সংগ্রামকেও দমন করার জন্য হেন কাজ নেই যা তারা করেনি । সমগ্র ভারত বর্ষ বিস্তৃত সাইয়েদ আহমেদ ব্রেলভীর স্বাধীনতা সংগ্রামকেও শত রকম নির্যাতনের মাধ্যমে নাস্তানাবুদ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয় । কিন্তু এতো করেও আন্দোলনের গতি স্তব্ধ করা যায়নি ।
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ হবার পর যে হত্যালীলা শুরু হয় তারও নিষ্ঠুর শিকার হয় আলেম সমাজ । বিল্পব পরবর্তীকালে শত শত আলেম শাহাদাৎ বরন করেন । শুধু ফাঁসিতেই শাহাদাৎ বরন করেন প্রায় ৭০০ আলেম । মাওলানা ফযলে হক খয়রাবাদী, মাওলানা ইয়াহিয়া আলী, মাওলানা আবু জাফর থানেশ্বরী, মাওলানা মুফতী এনায়েত আলী প্রমুখ শত শত আলেমকে আন্দামানে নিরবাসন দেয়া হয় । এক কথায় মুসলিম সংগ্রামী শক্তিকে সেদিন সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা চলে । সেদিনের দিল্লীর বিবরন দিতে গিয়ে কবি লিখেছেন, “মুসলমানদের অবস্থা দেখে কাঁদবে, এমন একজন মুসলমানও দিলীতে অবশিষ্ট ছিলনা ।” আর মাওলানা ফযলে হক খয়রাবাদী তার আত্ম কথায় লেখেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করেছে প্রমান হলেই কোন হিন্দুকে ধরা হত কিন্তু পালাতে পারেনি এমন কোন মুসলমান সেদিন বাঁচেনি ।”
ভারতবর্ষ ব্যাপী এই গণহত্যা চালানোর পরও মুসলমানদের সংগ্রামী শক্তির অস্তিত্ব বেচে থাকে । সিপাহী বিপ্লবোত্তর রাজনীতিতে এদের ভূমিকা একেবারে গৌণ নয় । ১৮৫৭ সালের আযাদী সংগ্রামের সময় উত্তর- পশ্চিম সীমান্তের দুর্গম ইয়াগিস্তানে বালাকোটের ধ্বংসাবিশিষ্ট বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সংগ্রামের অগ্নী পুরুষ মাওলানা বেলায়েত আলীর ভাই মাওলানা এনায়েত আলী । আর ভারতের অভ্যন্তরে এ আন্দোলন সংগঠনের কঠিন দায়িত্ব পালন করছিলেন মাওলানা ইয়াহিয়া আলী, যিনি সিপাহী বিদ্রোহ সংগঠনের কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । বিপ্লব পরবর্তী কঠিন নির্মূল অভিযানের পরও সাইয়েদ আহমেদ ব্রেলভীর বিপ্লব আন্দোলনের কাজ মাওলানা আব্দুল্লাহ, মাওলানা আব্দুল করিম, মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ প্রমুখের মতো সংগ্রামী আলেমের নেতৃত্বে সামনে এগিয়ে চলে, যা ছিল মানুষের কাছে সংগ্রাম এবং প্রতিবাদী চিন্তার প্রতীক হিসেবে অনুপ্রেরনার উৎস । এরই পাশাপাশি ১৮৫৭ সালের সংগ্রামী আলেমদের আরেকটি দল দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা এবং দীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে মুসলমানদের অন্তরে বিপ্লবের স্ফুলিংগ অনির্বাণ রাখার কাজে ব্রতী হন । সিপাহী বিপ্লবের দিল্লী ফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক হাজী এবাদুল্লাহ গ্রেফতারের কঠিন পরওয়ানা এড়িয়ে মক্কায় হিজরত করেন এবং সেখান থেকেই তিনি আন্দোলনের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন । দিল্লী যুদ্ধে আহত মাওলানা কাশেম নানতুবীর মাথায়ও গ্রেফতারী পরওয়ানা ঝুলছিল । তিনিও বেরিয়ে এলেন দিল্লী থেকে । মাওলানা কাশেম নানতুবীই ১৮৬৬ সালে দিল্লীস্থ শাহ ওয়ালী উল্লাহর রাহিমিয়া মাদ্রাসার অনুকরনে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন । উল্লেখ্য মাওলানা কাশেম নানতুবীর নিকট মাওলানা মামলুকুল আলী ছিলেন বালাকোট পরবর্তী বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা শাহ ইসহাকের কেন্দ্রীয় বিপ্লবী পরিষদের সদস্য । আরো উল্লেখ্য, দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রথম প্রধান শিক্ষকের যিনি দায়িত্ব নেন তিনি এই মাওলানা মামলুকুল আলীর পুত্র মাওলানা ইয়াকুব । এভাবে দেওবন্দ মাদ্রাসা দিল্লীর রাহিমিয়া মাদ্রাসার মতই বিপ্লবী মুজাহিদ তৈরির আরেকটি কারখানায় পরিণত হয় । উত্তরকালে এই মাদ্রাসা থেকে যারা বেরিয়ে আসেন তারা মুসলমানদের আত্মরক্ষা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার সব রকমের তৎপরতা সহ দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ‘অসহযোগ আন্দোলন’, ‘খিলাফত আন্দোলন’ এবং ‘দেশ বিভাগের আন্দোলন’ –এ অমূল্য ভূমিকা পালন করেন ।
কিন্তু স্বীকার করতেই হবে সিপাহী বিপ্লবোত্তর মুসলিম রাজনীতিতে আপোষহীন মুজাহিদদের এই সংগ্রামী কাফেলা সামনের কাতার থেকে ধীরে ধীরে পেছনের কাতারে সরে যায় । সামনে এসে দাঁড়ায় মুসলিম রাজনীতির আপসকামী এক ধারা । এই আপসকামী ধারার অগ্রপথিক ছিলেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিষদের সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারপতি মাওলানা আব্দুল লতিফ । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাবেক মুন্সেফ স্যার খেতাবপ্রাপ্ত সাইয়েদ আহমদ খান এবং ব্রিটিশ বিচার বিভাগের কোলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলী । তারা মুসলিম সমাজের সমস্যাকে ভিন্ন এক দৃষ্টি ভঙ্গিতে অবলোকন করেন । তদানীন্তন পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা মনে করেন, সহযোগিতার মাধ্যমেই মুসলিম জাতিকে তাঁদের অধিকার আদায় করতে হবে । সহযোগিতার মাধ্যমেই ইংরেজী শিক্ষা- দীক্ষা লাভ করে জাতীয় স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে হিন্দুরা বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে, এটা লক্ষ্য করেই তারা জাতির জন্য এই চিন্তা করেন । নবাব আব্দুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমাদ খান এবং সৈয়দ আমীর আলী তিনজনই এব্যাপারে একমত ছিলেন যে, ভারতে আত্মমর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে হলে ইংরেজী শিক্ষার মাধ্যমে মুসলিম সমাজের আধুনিকীকরণ ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই । বস্তুত ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নবাব আব্দুল লতিফের “ক্যালকাটা মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি” যা পরে “আলীগড় সায়েন্টিফিক সোসাইটি” নাম পরিগ্রহ করে এবং ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সৈয়দ আমীর আলীর “সেন্ট্রাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন” মুসলিম সমাজে ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের একই লক্ষ্যে কাজ করেছে । স্যার সৈয়দ আহমাদ খানের “আলীগড় সায়েন্টিফিক সোসাইটি” ১৮৭৫ সালে “আলীগড় মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল” কলেজে রূপ লাভ করে । সৈয়দ আমীর আলীর চিন্তার সাথে স্যার সৈয়দ আহমাদ খান এবং নবাব আব্দুল লতিফের চিন্তার কিঞ্চিত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় । সৈয়দ আমীর আলীর চেষ্টা ছিল, নৈতিক পুনর্গঠন এবং অবিরাম রাজনৈতিক চেষ্টার মাধ্যমেই ভারতীয় মুসলমানদের যথার্থ এবং ন্যায়সংগত দাবী- দাওয়ার প্রতি সরকারের স্বীকৃতি আদায় করা । কিন্তু নবাব আব্দুল লতিফ এবং স্যার সৈয়দ আহমাদ খান চাইতেন, মুসলমানদের সংঘাতের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে শিক্ষা- দীক্ষায় উন্নত করে সামাজিকভাবে তাঁদেরকে যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠা করা । যাহোক, তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুসলমানদের বৈষয়িক উপকার অবশ্যই হল । ১৮৮৩ সালে নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আহমাদ খান এবং সৈয়দ আমীর আলী কোলকাতায় মিলিত হন এবং একই কর্মপন্থা অনুসরন করতে একমত হন । ১৮৮৫ সালে তাঁদের দাবী- দাওয়ার অধিকাংশই ব্রিটিশ সরকার মেনে নেয় । এর ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত এবং চাকুরী ক্ষেত্রে সুযোগ- সুবিধা প্রসারিত হয় । কিন্তু লক্ষণীয় যে, উপনিবেশিক শক্তির সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে অগ্রগতি অর্জনের ১৮৫৭ সাল উত্তর এই চিন্তা ১৮৫৭ সাল পূর্ব ১০০ বছরের মুসলিম রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত । তবু সময়ের প্রেক্ষাপটে এবং হিন্দুদের উন্নতি- উত্থানের পটভূমিতে এই চিন্তাই ক্রমশ প্রসার লাভ করতে থাকে । এর ফলে ইংরেজী শিক্ষিত রাজানুগত এক নতুন মুসলিম শ্রেনীর উদ্ভব ঘটে । একমাত্র জাতীয় চেতনার ক্ষেত্রে পার্থক্য ছাড়া নব উত্থিত হিন্দু শিক্ষিত শ্রেনীর সাথে এদের তেমন পার্থক্য ছিলনা । মূলত এদের হাতেই হিন্দুদের উগ্র জাতীয়তাবাদী বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সময়ের অপরিহার্য প্রয়োজনকে সামনে রেখে ১৯০৬ সালে মুসলমানদের জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয় । স্যার সুরেন্দ্রনাথের হিন্দু জাতীয় চেতনা যেমন ছিল, নবাব সলিমুল্লাহও তেননি জাতীয় চেতনা নিয়ে মুসলিম লীগের পত্তন করেন । এভাবে ১৮৫৭ সালের পর মুসলিম রাজনীতিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গুনগত পরিবর্তন ঘটে । ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত মুসলমানদের ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন । ইসলামী জিন্দেগীর পুনঃপ্রতিষ্ঠা সহ মুসলমানদের স্বাধীনতা অর্জন ছিল এর মূল কথা । কিন্তু ব্রিটিশের সাথে আপসকামীতার পথ ধরে পরে যে জাতীয় আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলো মুসলিম লীগের মাধ্যমে, তার মূল কথা ছিল জাতীয় স্বার্থের নিশ্চয়তা বিধান । ব্রিটিশ রাজের অনুগত প্রজা হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতির জন্য ন্যায্য অধিকার আদায়ই এর লক্ষ্য ছিল । অবশ্য এই একই লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুদের জাতীয় কংগ্রেস যেমন পরে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্লাটফর্মে পরিনত হয়, তেমনি মুসলিম লীগও ভারতীয় মুসলমানদের আযাদী সংগ্রামের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে ।
আমরা আগেই বলেছি, বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু এবং মুসলমানদের রাজনীতিতে একটা বড় ধরনের মোড় পরিবর্তন ঘটে, যেমনিভাবে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ উনিশ শতকের রাজনীতিতে একটা মাইলস্টোন প্রমানিত হয় । ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ব্রিটিশ সরকার তাঁদের শাসনকার্যের সুবিধার জন্যই ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বঙ্গ এবং আসামকে নিয়ে আলাদা প্রদেশ গঠন করে । এতে মুসলিম প্রধান পূর্ব বঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই লাভবান হয় । পূর্ববঙ্গীয় মুসলমানদের এই লাভ হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষী আগুনে ঘি ঢেলে দেয় । মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু রাজনীতি যেখানে মুসলমানদের এদেশে বাস করার অধিকারই স্বীকার করতে চায় না, সেখানে মুসলমানদের জন্য আলাদা এই লাভটা তারা বরদাশত করতে পারবে কেমন করে ? এখানে স্মর্তব্য, উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সংকীর্ণ পরিসরে হিন্দুদের পুনরুত্থান আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে । স্বামী দয়ানন্দের ‘আর্য সমাজ’ ছিল এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু । ‘ভারত শুধু ভারতীয়দের জন্য’- এটা ছিল তাঁদের প্রধান শ্লোগান । তারা ভারতীয় বলতে কেবল হিন্দুদেরকেই বুঝাতো । স্বামী দয়ানন্দ ভারতবর্ষের কোটি কোটি মুসলমানকে এদেশের সন্তান হিসেবে গণ্য করতেও অস্বীকার করেন । তার শুদ্ধি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের অহিন্দুদেরকে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করা । ১৮৮৩ সালে স্বামী দয়ানন্দ মারা যান । কিন্তু বালগঙ্গাধর তিলক, লালাহংশ রাজ, লালা লাজপত রায়, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রমুখ কংগ্রেস নেতারা দয়ানন্দের আন্দোলন আরো দক্ষতার সাথে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান । এরই পাশাপাশি স্বামী বিবেকানন্দও রামকৃষ্ণ মিশনকে এক চরমপন্থী হিন্দু সংস্কার সংস্থায় রুপান্তরিত করেন । এভাবে হিন্দু স্বার্থ কংগ্রেসেরও স্বার্থও হয়ে দাঁড়ায় । এমন একটা পরিবেশেই বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দেয়া হয় । কোলকাতাকে কেন্দ্র করে হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে । কংগ্রেস নেতা স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজী ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোভাগে । সকল হিন্দু নেতাই এর সাথে যোগ দিলেন । এমনকি উদারপন্থী গোপালচন্দ্র গোখেলও বাদ থাকলেন না । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের শুভেচ্ছাপুস্ট ‘অনুশীলন সমিতি’ বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ১৯০৬ সালের দিকে পুরোপুরি সন্ত্রাসী আন্দোলনে রূপ নেয় । কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ায় সমগ্র দেশের পরিস্থিতি মুসমানদের জন্য অগ্নীগর্ভ হয়ে দাঁড়ায় । সংখ্যাগরিষ্ঠের সার্বিক মারমুখো এই পরিস্থিতিতেই মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উপায় হিসেবে নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে আয়োজিত নবাব ভিখারুল মুলকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভারতীয় মুসলমানদের নেতৃবৃন্দের ঢাকা বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় । কিন্তু নবাব স্যার সলিমুল্লাহর চরম ব্যাকুলতা এবং মুসলিম লীগের চেষ্টা কোণই কাজে এলো না । ব্রিটিশ রাজ হিন্দুদের দাবীর কাছে নতী স্বীকার করলো এবং ১৯১১ সালের ১১ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ রাজ স্বয়ং দিল্লী এসে বঙ্গভঙ্গ রহিত করার ঘোষণা দিলেন । এই সালে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভগ্নহৃদয় নবাব সলিমুল্লাহকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করা হল । যাহোক এই ঘটনা হিন্দু মুসলিম দুই জাতিকে পরস্পর থেকে দূরে ঢেলে দেয় এবং কংগ্রেস সম্পর্কে কংগ্রেসপ্রেমিক মুসলমানদেরও মোহ ভংগ ঘটায় । এ সময় সৈয়দ আমীর আলীর আমন্ত্রনে কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন । একটা ক্ষেত্রে মুসলমানরা এ সময় একটা বিজয় লাভ করে । বঙ্গভঙ্গ বিরোধী হিন্দু আন্দোলন যখন আকাশ- বাতাস বিষিয়ে তুলছিল,সেই সময় বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের পক্ষ থেকে সৈয়দ আমীর আলীর নেতৃত্বে একটি ডেপুটেশনে ভারত- সচিব লর্ড মরলের সাথে দেখা করে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা আদায় করলেন । মুসলমানদের পৃথক জাতীয় প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি স্বরূপ পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে হিন্দু- মুসলিম রাজনীতির আধুনিক পর্বে এই যে দুই স্বতন্ত্র যাত্রা শুরু হল, তাই ১৯৪৭ সালে দুই জাতির জন্য দুইটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি সৃষ্টি করে । মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে ইংরেজী শিক্ষা সৃষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দ প্রধান ভূমিকায় থাকেন বটে, কিন্তু তারা যে শক্তি এবং ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে কাজ করেন, তার ষোল আনা নির্মাতাই ছিলেন ১৮৫৭ সালের পর রাজনীতির ক্ষেত্রে পেছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়ানো মুসলিম জননেতা আলেম সমাজ । এই উপমহাদেশে লক্ষ লক্ষ আলেম নিরবে যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, তা যদি সংগৃহীত হয় তাহলে জানা যাবে তাঁদের অবদান কতো বড়,কতো মহৎ । প্রকৃতপক্ষে তারাই মুসলিম সমাজকে এবং সেই সাথে আপসকামী মুসলিম রাজনৈতিক নেতাদেরকে হিন্দু ষড়যন্ত্রের গ্রাসে পরিণত হবার হাত থেকে রক্ষা করেছেন । তবে একথা ঠিক, সিপাহী বিপ্লবোত্তর রাজনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিন্দু জাতি সত্তার মারমুখো উত্থান । মুসলমানদের আপোষহীন সংগ্রামী শক্তির পেছনে চলে যাওয়া এবং নব উত্থিত মুসলিম আপসকামী শক্তির সহজাত দুর্বলতার অনুকূল ভুমিতেই এই হিন্দু পুনরুত্থান শক্তির চারা গাছ গজিয়েছিল । সে চারা গাছ আজ মহীরুহু । ১৮৫৭ সালের পর আমাদের আপসকামী সেই যে অনুগ্রহ ভিক্ষা শুরু হয়েছিলো, বলা যায়, তা আজ এক জাতীয় রূপ পেয়েছে । এতদসত্ত্বেও পরবর্তী ৯০ বছরের মুসলিম রাজনীতি একটা ফল দিয়েছে, কিন্তু তা স্মৃতিকে বেদনার্তই করে । ১৯০ বছরের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের চাওয়া আমাদের এই পাওয়ার মধ্যে মিলেনা । পুরো সেই পাওয়ার তৃপ্তি অতৃপ্তই রয়ে গেছে ।