আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলন বলতে সাধারণভাবে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনকেই আমরা বুঝি। কিন্তু বায়ান্নর আন্দোলন ভাষা আন্দোলন এর পরিণতি পর্ব, এর শুরু কিন্তু আরো আগে। প্রকৃতপক্ষে দেশ বিভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির ধারণার মতই পুরানো রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটা। দেশ বিভাগকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান প্রস্তাবের আলোকে লিখিত মুজিবর রহমান খাঁর ‘পাকিস্তান’, হাবিবুল্লা বাহারের ‘পাকিস্তান’, তালেবুর রহমানের ‘পাকিস্তানের ক্রমবিকাশ’ প্রভৃতি গ্রন্থে পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার কথা আলোচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা ও কোলকাতার ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ এবং ‘পূ্র্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ দেশ বিভাগের অনেক আগে থেকেই তাদের সভা সমাবেশে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে আলোচনা করত।
কিন্তু রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি বাদানুবাদে রূপ নেয় তখন, যখন হিন্দু প্রভাবিত কংগ্রেস সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ‘হিন্দী’র কথা বলে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ‘হিন্দী’র কথা উঠার সাথে সাথে পাল্টা প্রস্তাব হিসেবে উর্দুর কথা উঠল। সেই সময় ১৯৩৭ সালের ২৩ এপ্রিল দৈনিক আজাদ রাষ্ট্রভাষার ওপর একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় লিখে। সম্পাদকীয়টিতে উর্দু হিন্দী ঝগড়ার প্রেক্ষিতে বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়, “সাহিত্যের দিক দিয়ে বাঙ্গালা ভারতের সমস্ত প্রাদেশিক সাহিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাঙ্গালা ভাষায় বিবিধ ভাব প্রকাশোপযোগী শব্দের সংখ্যাও বেশি। অতএব বাঙ্গালা সবদিক দিয়াই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করতে পারে।’
১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবের পর এবং দেশ বিভাগের আগে রাষ্ট্রভাষার বিতর্ক যখন আরো তীব্র হয়ে ওঠে তখন বাংলাদেশের কয়েকজন কবি সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোর দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে মাসিক মোহাম্মদীর কার্তিক সংখ্যায় “পূর্ব পাকিস্তানের জবান” শীর্ষক নিবন্ধে আবুল মনসুর আহমদ বলেন, “উর্দু নিয়ে এই ধ্বস্তধ্বস্তি না করে আমরা সোজাসুজি বাংলাকেই যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুসলিম বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পগত রূপায়ণে হাত দিতে পারব।” ১৯৪৪ সালে মাসিক সওগাতের আশ্বিন সংখ্যায় ‘পাকিস্তানঃ রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবি ফররুখ আহমদ লিখেন, “পাকিস্তানের অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে একথা সর্বাদিসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানেরই কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীন মত প্রকাশ করেছেন যা নিতান্তই লজ্জাজনক। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার রূপান্তরিত করলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হবে এই তাদের অভিমত। কি কুৎসিত পরাজয়ী মনোবৃত্তি এর পেছনে কাজ করছে এ কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছি।”
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার মাস তিনেক আগে হায়দরাবাদের উর্দু সম্মেলনে পাকিস্তানের একজন প্রথম সারির নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ঘোষণা করেন, “উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে।” এই বক্তব্য দেশের রাষ্ট্রভাষা বিতর্ককে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ও অন্যান্য কয়েকজন বুদ্ধিজীবি ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠিত হয়। সংস্থা হিসেবে এই তমদ্দুন মজলিসই পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বলতে গেলে একক ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থা ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। ভাষা আন্দোলনের এটাই প্রথম পুস্তিকা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করে এতে প্রবন্ধ লিখেন অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, ‘ইত্তেহাদ’ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম।
তমদ্দুন মজলিসের তৎপরতা এবং উপরোল্লিখিত পুস্তিকার ভূমিকা ছাত্র ও বুদ্ধিজীবি মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ সময় তমদ্দুন মজলিস তার দ্বিতীয় উদ্যোগ হিসেবে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, রাজনৈতিক নেতা ও খ্যাতনামা লোকদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি মেমোরেন্ডাম সরকারের কাছে পেশ করে এবং তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১২ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে একটি সাহিত্যসভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আলোচনা করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, কাজী মোতাহার হোসেন এবং কবি জসিম উদ্দীন, প্রমুখ। এই সাহিত্য সভার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নুরুল হক ভূঁইয়াকে আহবায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ তার কাজ শুরু করে। ঘটনা দ্রুত এগিয়ে চলে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ব্যাপক প্রচার কাজ শুরু হয়। এই সময় চকবাজার এলাকায় প্রচারকাজ চালাতে গিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম এবং অন্যান্যরা বিরোধী পক্ষের দ্বারা ঘেরাও হন। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বপ্রথম ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভিপি (মৌলভী) ফরিদ আহমদ, মুনির চৌধুরী, এ.কে.এম. আহসান, (বিচারপতি) আবদুর রহমান চৌধুরী, প্রমুখ। সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল করে সেক্রেটারিয়েটে যায়।
ভাষা আন্দোলন ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৭ মার্চ ঢাকায় এবং ১১ মার্চ গোটা দেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট আহবান করে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এই দিনই প্রথম সংঘটিত গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, ছাত্রদের পিকেটিং এবং পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ঢাকা শহর বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয়। সেক্রেটারিয়েট এলাকায় বিক্ষোভ করতে গিয়ে কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, অলি আহাদ, খালেক নেওয়াজ, বায়তুল্লাহ, প্রমুখ পুলিশের লাঠিচার্জের মুখে পড়েন এবং কাজী গোলাম মাহবুব ও শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। টিএন্ডটি এলাকায় পিকেটিং করতে গিয়ে সেসময়ের ডাকসু জিএস গোলাম আযম ও অন্যান্য ১২ জন ছাত্র গ্রেফতার হন। ছাত্র জনতার ওপর নির্যাতন চললেও সরকার আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করেন। পূর্ব পাকিস্তানের চীফ মিনিস্টার ছাত্রদের সাথে একটি চুক্তিতে আসেন। উল্লেখ্য ১৫ মার্চ ও ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যে ঐতিহাসিক ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী। ১৫ মার্চ সাক্ষরিত ৭ দফা চুক্তির প্রথম দফাতেই বলা হয়, পূর্ববঙ্গ পরিষদের চলতি অধিবেশনে বাংলাকে পূর্ব বঙ্গের সরকারি ভাষা এবং সর্বস্তরের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব পাশ করতে হবে। দ্বিতীয় দফায় বলা হয়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ সম্বলিত প্রাদেশিক পরিষদের গৃহীত একটি প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাতে হবে। এই চুক্তিতে সরকারের পক্ষে সাক্ষর করেন চীফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দীন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন কামরুদ্দীন আহমদ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই চুক্তি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ চুক্তিকে স্বাগত জানাতে গিয়ে ‘ইত্তেহাদ’ তার সম্পাদকীয়তে বলে ঃ “বিরাট শক্তি ও দুর্জয় বিরোধিতার মধ্যে সংগ্রাম করিয়া বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীগণ যে সাফল্য লাভ করিয়াছেন তাহা ইতিহাসে সোনার হরফে লিখিত থাকিবে।”
সত্যই তাই। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ভিত্তিই ছিল এই চুক্তি। সরকার কর্তৃক এই চুক্তি লংঘন করার প্রতিবাদেই ৫২ এর ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। চুক্তি হয়েছিল বলেই পরবর্তীকালে চুক্তি লংঘনের প্রশ্ন উঠেছিল এবং ভাষা আন্দোলন সামনে এগিয়ে চলার একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছিল।
১১ মার্চের পর আরও দুটো ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একটি কায়েদে আযমের ঢাকা রেসকোর্স ও কার্জন হলে ভাষণ। ২১ মার্চের রেসকোর্স এবং ২৪ মার্চের কার্জন হল ভাষণে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। দ্বিতীয়টি হল ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্তী লিয়াকত আলী খানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা। এই সমাবেশে ছাত্রদের পক্ষ হতে তাঁর কাছে একটি মেমোরেন্ডাম পেশ করা হয়। ইংরেজি ভাষার এ মেমোরেন্ডামটি তৈরি করেছিলেন ছাত্রনেতা (বিচারপতি) আবদুর রহমান চৌধুরী। আর সমাবেশে তা পাঠ করেছিলেন তদানীন্তন ডাকসু’র সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম।
উল্লেখ্য, এই মেমোরেন্ডামে শুধু ভাষার দাবিই ছিল না, এতে এ অঞ্চলের গরীব ও পশ্চাদপদ জনগণের বিভিন্নমুখী সমস্যাসহ তাদের প্রাণের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। মেমোরেন্ডামটি এ দেশের মানুষের স্বাধিকার সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক দলিল।
’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুরু হয় খাজা নাজিমুদ্দিনের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। তিনি ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’ একথা বলেন। তার এ ঘোষণা ছিল ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চের ‘রাষ্ট্রভাষা’ চুক্তির খেলাফ। এই চুক্তি খেলাফের প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এ তারিখেই ছাত্রনেতা আবদুল মতিনের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়ে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। আহবায়ক নির্বাচন করা হয় কাজী গোলাম মাহবুবকে। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষেদের উদ্যোগে ৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয় এবং বিকেলে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ জনসভায় ছাত্রনেতাদের সাথে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আবুল কাশেম এবং মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় চক্তিভঙ্গের জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়। এ সভা থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারী দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রস্তুতিমূলক কর্মতৎপরতা মধ্য দিয়ে অবশেষে আসে ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারী। ঢাকা শহরের সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারি হয়। সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে সামনে এগিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা না ভাঙ্গা ছাত্রদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। আসে ২১শে ফেব্রুয়ারী। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্রদের রাস্তায় বেরিয়ে আসার চেষ্টা আর পুলিশের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা এক জংগী পরিবেশের সৃষ্টি করে। ছাত্রদের ওপর নেমে আসে কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ, অবশেষে গুলি। গুলিবর্ষণে শহীদ হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং আরও অনেকে। সৃষ্টি হয় ভাষার জন্য জীবন দেয়ার নতুন্ এবং অনন্য এক ইতিহাস।
ভাষা আন্দোলনের এই ইতিহাস নিয়ে অনেক নষ্টাচার হয়েছে এবং হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনে যাদের টিকিও দেখা যায়নি, তারা আজ ভাষা আন্দোলনের জনক সেজে বসতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করছে না। ভাষা আন্দোলন ছিল স্বদেশ, স্বজাতি, স্বধর্মপ্রেমিক এবং রাজনৈকি উদ্দেশ্য বিমুক্ত ছাত্রদের একটি আন্তরিক আন্দোলন। বামপন্থী ও কম্যুনিস্টরা এবং বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী এই আন্দোলনকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে। কিন্তু সচেতন ছাত্ররা তা হতে দেয় নি। কিন্তু মতলবীরা তখন যা পারে নি, পরবর্তীকালে তারা আন্দোলনের ইতিহাসকে হাইজ্যাক করে, বিকৃত করে তাদের স্বার্থের কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছে। এর জন্য দায়ী যারা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন তারাও। এদের মধ্যে অধ্যক্ষ আবুল কাশেমের কিছু চেষ্টা ছাড়া আর কারও কাছ থেকে আমরা তেমন কিছু পাইনি যা থেকে আমরা ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারি। এমনকি ১৯৭৮ সালে ঢাকা ডাইজেস্ট সাক্ষাতকার গ্রহণের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের দিনের আলোতে না আনলে তাদের সবার নামও আমরা জানতে পারতাম না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সত্যিকার সৈনিকদের এই দুর্ভাগ্য দেখে ক্ষোভ হয়। কিন্তু সেই সাথে এই ভেবে তৃপ্তি পাওয়া যায় যে, তারা সত্যিকার অর্থেই মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, নাম কেনা বা অন্য কোন স্বার্থে নয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিয়েছে, স্বাধিকার চেতনা অবশেষে আমাদের দিয়েছে স্বাধীনতা। স্বাধীন হওয়ার পরও আজ স্বকীয়তা আমাদের আহত, বিকলাংগ। বিকলাংগ বিকৃত দশা রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রসঙ্গে এখানে কিছু বলব না। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে বাংলা ভাষার জন্য, সে বাংলা ভাষাও আজ আগ্রাসী সন্ত্রাসীর শিকার। রাষ্ট্রভাষা হলেও রাষ্ট্রভাষার স্থান সে পায় নি। অবশেষে জাতীয় সংসদে আইনের চাবুকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। আজ কোলকাতার ‘ভাষা সংস্কৃতি’ আমাদের স্বকীয়তা গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। তাদের শব্দ সংস্কৃতি এসে আমাদের শব্দ ও ভাষা সংস্কৃতিকে মুছে দিচ্ছে। তাদের সাহিত্য এসে আমাদের বিকাশমান সাহিত্যকে গলা টিপে ধরছে। দু’শ তেত্রিশজন বুদ্ধিজীবি বিবৃতি দিয়েছেন অনেক দেরীতে। সম্ভবত সেই বায়াত্তর সালে মরহুম কবি জসিমউদ্দীন কোলকাতার সাহিত্যের এক তরফা প্রবেশের সমালোচনা করে সম-বিনিময়ের কথা বলেছিলেন। সেকথা বলে তিনি সেদিন হয়েছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু সেদিনের ‘প্রগতিশীলরা’ আজ প্রতিক্রিয়াশীল সাজতে বাধ্য হচ্ছেন নিছক নিজেরা সাহিত্যের বাজারে টিকে থাকার জন্য। জাতির স্বার্থকে সেদিন তারা তোয়াক্কা করেন নি, কিন্তু আজ পেটের স্বার্থ তাদের বাধ্য করেছে জাতির কথা ভাবতে। এই ভাবনা আমাদের সকলের জন্য সার্বিক হোক এবং তা আমাদের স্বতন্ত্র স্বাধীন ভাষা সংস্কৃতিকে ষড়যন্ত্রের কবল হতে মুক্ত করুক এই কামনা করে আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করছি।