৪
মানবীয় আইন বনাম আল্লাহর আইন
১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার মদ্য নিবারক আইনটি যথারীতি বাতিল ঘোষণা করা হয়। ফলে সভ্য দুনিয়ার অধিবাসীরা প্রায় চৌদ্দ বছর পর আবার নিরসের সীমা পেরিয়ে রসের চৌহদ্দীতে পদার্পন করে। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মিঃ পুজভেল্টের অভিষিক্ত হওয়াটাই ছিলো নিরসের ওপর রসের বিজয় লাভের প্রাথমিক ঘোষণা। এপ্রিল (’৩৩) মাসে একটি আইনের সাহায্যে শতকরা ৩১.২ ভাগ এ্যালকোহলযুক্ত মদকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপর মাত্র কয়েক মাস অতিক্রান্ত না হতেই মার্কিন শাসনতন্ত্রের অষ্টাদশ সংশোধনীটি বাতিল করে দেয়া হলো। উক্ত সংশোধনী অনুযায়ি যুক্তরাষ্ট্রের চৌহদ্দীর মধ্যে মদের ক্রয়-বিক্রয়, আমদানী রফতানি ও চোলাই-প্রস্তুতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
বস্তুত আইনের সাহায্যে নৈতিকতা ও সামাজিক সংশোধনের এ ছিলো সবচাইতে বড় প্রচেষ্টা। দুনিয়ার ইতিহাসে এতো বড় প্রচেষ্টার আর কোনো দৃষ্টান্ত খঁজে পাওয়া যায়না। অষ্টাদশ সংশোধনীর আগে ‘এ্যন্টি সেলুন লীগ’ নামক সংস্থা কয়েক বছর ধরে পত্র-পত্রিকা, বক্তৃতা বিবৃতি প্রচারপত্র, নকশা-চিত্র, ম্যাজিক-লন্ঠন, ছায়াছবি এবং অন্যান্য বহুতরো উপায় আমেরিকানদের মন মগজে মদের অপকারিতাকে বদ্ধমূল করের দেবার চেষ্টা করছিল। এই বিরাট প্রচারকার্যে উক্ত সংস্থাটি পানির মতো অর্থের বন্যা ছুটিয়েছিল। অনুমান করা হয়েছে যে, আন্দোলনের সূচনা থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত শুধু প্রচারকার্যেই সাড়ে ছয়কোটটি ডলাল ব্যয়িত হয়েছে এবং মদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত বই-পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছে, তার মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিলো নয়শো কোটির মতো!
এতদভিন্ন মদ্য নিবারক আইনটি কার্যকর করণে চৌদ্দ বছরে মার্কিন জাতিকে যে বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছি, তার মোটামুটি পরিমান ৬৫ কোটি পাউন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ সম্প্রতি ১৯২০ সালের জানুয়ারী থেকে ১৯৩৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়কার যে সংখাতত্ত্ব প্রকাশ করেছে তা থেকে জানা যায়, উক্ত আইনটি কার্যকর করার ব্যাপারে মোট দু’শ ব্যক্তি নিহত হয়েছে, ৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ৩’শ ৩৫ জনকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে, এক কোটি ৬০ লক্ষ পাউন্ড জরিমানা ধার্য করা হয়েছে এবং ৪০ কোটি ৪০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
জান ও মালের এই ভয়াবহ ক্ষতি এজন্যই বরদাশত করা হযেছিল যে, বিশ শতকের যে ‘সুসভ্য’ জাতির জ্ঞানের সূর্য্য মধ্যাহ্ন গগন পর্যন্ত উপনীত হয়েছে, তাকে দুষ্কৃতির উৎস থেক উৎসারিত বেশুমার আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দৈহিক ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করা হবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পূর্বে ও পরে কয়েক বছরের ক্রমাগত প্রচেষ্টা –যাতে সরকারী শক্তিও অংশীদার ছিল- মার্কিন জাতির মদ্যপান সংক্রান্ত সংকল্পের সামনে ব্যর্থকাম হলো এবং শেষ পর্যন্ত ‘বিশ্ব-ইতিহাসের বৃহত্তম সংস্কার প্রচেষ্টা’ নিষ্ফল হলো্
মদ্য নিবাররন প্রচেষ্টার এই ব্যর্থতা এবং নিবারক আইনটির এই রদকরণের কারণ মোটেই এই নয় যে, মদের যেসব অপকারিতা দূর করার জন্য প্রচার প্রোপাগান্ডা ও আইনগত শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল, এক্ষণ সেগুলো উপকারী হয়ে দাড়িঁয়েছে অথবা কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়া পূর্ব ঘোষিত ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিচ্ছে; বরং পূর্বের চেয়েও ব্যাপক ও বিপুল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আজ এ সত্য স্বীকৃত হয়েছে যে, বেশ্যাবৃত্তি, ব্যভিচার, সমমৈথুন, চৌর্যবৃত্তি, জুয়াখেলা, হত্যাকান্ড এবং এমনিতরো অন্যান্য নৈতিক অপরাধ এই পাপ কেন্দ্রেরই ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়। আর পাশ্চাত্য জাতিগুলোর নৈতিকতা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সামাজিকতার ধ্বংস সাধনে এর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তবু মার্কিন সরকার এ করানে তার আইনটি প্রত্যাহার করে হারামকে হালাল করতে বাধ্য হয়েছে যে, মার্কিন জাতির বিপুল সংখ্যাধিক্য অংশ কোনো মতেই মদ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়নি। তাই চৌদ্দ বছর আগে যে মার্কিন জনমত মদকে হারাম করেছিল, আজ আবার তাকে হালাল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
আমাদের জানা মতে, আজ পর্যন্ত কোনো ঘোরতর সুরা সমর্থকও মদ্যপানের ক্ষতিকে অস্বীকার করতে পারেনি, অথবা নিবারক আইন বিরোধিগণ ‘মদের আশীর্বাদ’ সম্পর্কে এমন কোনো তালিকা পেশ করতে সক্ষম হয়নি, যা তার ক্ষতির তুলনায় কিছুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসে যখন জনমতের সমর্থনপুষ্ট অষ্টাদশ শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী উত্থাপিত হয়েছিল, তখনই ‘রসহীনতা’ ও ‘রস-সমুদ্রের’ সমস্ত দিকের চুলচেরা বিশ্লষণ করা হয়েছিল। আর সেসব ক্ষতি ও অনিষ্টকারিতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই কংগ্রেস উক্ত সংশোধনী বিলটি অনুমোদন করেছিল। ৪৬টি রাষ্ট্র উক্ত সংশোধনী সমর্থন করেছিল এবং প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদ উক্তি সংশোধনী অনুসারে নিবারক আইন পাশ করেছিল। এসব কিছুই মার্কিন জাতির ইচ্ছা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছিল এবং যতোদিন নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারটি কাগজ-পত্র ও লোকমুখে সীমিত ছিলো, গোটা জাতি সানন্দে তাকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু যখনই এই নিষেধাজ্ঞা বাস্ত ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলো, সমগ্র মার্কিন জাতির চেহারাই তখন বদলে গেল। পাপাচারের অবর্তমানে একটিমাত্র রাত অতিবাহিত করেই দুনিয়ার সবচাইতে সভ্য, জ্ঞানী, সচেতন সত্যপ্রিয় এবং উন্নতিশীল জাতি একেবারে উম্মাদ হয়ে গেলো এবং বিরহের আবেগে সে এম কান্ডকারখানা শুরু করে দিলো, যা দেখে সন্দেহ হতে লাগলো যে, এ জাতি বুঝি প্রাচ্যকাব্যের কাল্পনিক প্রেমিকদের মতো বাস্তবিকই নিজের মাথা ঠুকে গুঁড়িয়ে ফেলবে।
এর ফলে অনুমোদিত মদ্যালয়গুলো বন্ধ হবার সাথে সাথে দেশের সর্বত্র অসংখ্য গুপ্ত মদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো। এসব আড্ডায় আইনের চোখে ধুলো দিয়ে মদ্যপান এবং তার কেনাবেচা জন্য বিচিত্র ধরণের কৌশল অবলম্বন করা হয়। কোনো ব্যক্তি তার কোনো বন্ধু বা প্রিয়জনকে এসব গুপ্ত মদ্যালয় এবং নির্দিষ্ট সঙ্কেতগুলো জানিয়ে দিলে তা একটি বিশেষ অনুগ্রহ বলে বিবেচিত হতো। পূর্বে সরকার লাইসেন্সপ্রাপ্ত মদ্যালয়গুলোর সংখ্যা, সেগুলোতে ব্যবহৃত মদের ধরন এবং তাতে যাতয়তকারীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতে পারতো। কিন্তু পাপাচারের এই আড্ডাগুলো ছিলো সরকারের নিয়ন্ত্রন সীমার বাইরে। এদের সংখ্যা ছিলো নিষিদ্ধকরণের পূর্বেকার অনুমোদিত শুঁড়ীখানাগুলোর চাইতে কয়েকগুন বেশী। পরন্তু এসব আড্ডায় স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর, নিকৃষ্ট ধরনের শরাব বিক্রি হতে লাগলো। তাতে অল্প বয়স্ক বালক-বালিকদের যাতায়ত অনেক বেড়ে গেলো। এর ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাশীল মহলে ব্যাপক উদ্বেগের সঞ্চার হলো। মদের দাম পূর্বের চাইতে কয়েকগুন বেশী চড়ে গেলো। মদ্য বিক্রয় এক বিরাট লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হলো। ফলে লক্ষ লক্ষ লোক এই ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করলো। অন্যদিকে গোপন মদ্যালয় ছাড়াও অসংখ্য ভ্রাম্যমান মদ্য বিক্রেতার আবির্ভাব হলো। এসব চলমান মদ্যালয় স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হোটেল-রেঁস্তোরা, প্রমোদকেন্দ্র এমনকি লোকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে মদ্য বিক্রয় এবং নতুন নতুন খরিদ্দার সংগ্রহ করতে লাগলো। অনুমান করা হয়েছে যে, নিষিদ্ধকরণের পূর্বের চাইতে পরবর্তীকালে আমেররিকার শুঁড়ী-বিক্রেতার সংখ্যা অনুন্য দশগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। পরন্তু এই ব্যবসায় শহরের সীমা ডিঙ্গিয়ে গ্রামাঞ্চল অবধি বিস্তৃতি লাভ করেছে। ঘরে ঘরে শরাব তৈরির গোপন কারখানা প্রতিষ্টিত হয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষণার পূর্বে আমেরিকার মদ্য-চোলাইয়ের অনুমোদিত কারখানার সংখ্যা ছিলো মোট চারশ। নিষিদ্ধ ঘোষনার পর মাত্র ৭ বছরের মধ্যে ৭৯ হাজার ৪শত ৩৭ জন কারখানা মালিককে গ্রেফতার এবং ৯৩ হাজার ৮শত ৩১টি মদের দোকান বাজেয়াপ্ত করা হয়। এতদসত্ত্বেও মদের ব্যবসায় কিছুমাত্র হ্রাস পায়নি। বে-আইনি বিভাগের জনৈক সাবেক কমিশনার এক বিবৃতিতে বলেনঃ ‘আমরা সমগ্র কারখানা ও দোকানের মাত্র এ –দশমাংশ পাকড়াও করতে সমর্থ হয়েছি’।
এভাবে দেশে মদ্যপানের পরিমাণ অস্বাভিক রকম বেড়ে যায়। অনুমান করা হয় যে, নিষিদ্ধ আমলে মার্কিন জনসাধারণ প্রতি বছর ২০ কোটি গ্যালন মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই পরিমাণটা ছিলো নিষিদ্ধ ঘোষণার পূর্ববর্তী পরিমাণের চাইতে অনেক বেশী।
এতো বিপুল পরিমাণে যে মদ ব্যবহৃত হয়, গুণগতো দিক দিয়ে তা ছিলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর। এ সম্পর্কে চিকিৎসকদের অভিমত হচ্ছে এই; ‘এই বস্তুটিকে মদ বলার চাইতে বিষ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। কারণ এটি কন্ঠনালী দিয়ে নিম্নে অবতরণর সঙ্গে-সঙ্গেই কলিজা ও মস্তিষ্কে এর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। দু’দিন পর্যন্ত ঐ অঙ্গ দু’টি এর দ্বারা প্রভাবিত থাকে। এর নেশায় মানুষ কোনো সৎ চিন্তা ও সৎ কর্মের উপযোগী থাকেনা, বরং তার স্বভাব-প্রকৃতি গোলযোগ, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অপরাধ প্রবণতার দিকে ধাবিত হয়।
এ ধরণের মদের ব্যবহারাধিক্যের ফলে আমেরিকাবাসির দৈহিক স্বাস্থ্য একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিউইয়র্ক শহরের সংখ্যাতত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, ঘোষণার পূর্বে ১৯১৮ সালে এ্যালকোহলের প্রতিক্রিয়ায় রোগাক্রান্তদের সংখ্যা ৩৭৪১ এবং মৃত্যুবরণকারীদের সংখ্যা ছিলো ২৫২। আর ১৯২৬ সালে রোগাক্রান্তদের সংখ্যা ১১ হাজার এবং মৃত্যুবরণকারীদের সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজারের গিয়ে উপনীত হয়। এতদভিন্ন যারা সরাসরি মদের প্রতিক্রিয়ায় প্রভাবিত হয়ে মৃত্যুবরণ কিংবা জীবনমৃত হয়ে পড়ে, তাদের সংখ্যা অনুমান করাই সম্ভব নয়।
এমনিভাবে অপরাধ, বিশেষত কিশোর ও যুবকদের অপরাধ প্রবণতা অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পায়। মার্কিন বিচারকদের একটি বিবৃতিতে বলা হয়: ‘আমাদের ইতিহাসে আর কখনো নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এতো বিপুল সংখ্যক কিশোরকে গ্রেফতার করার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়না’। এভাবে কিশোর ও অল্পবয়স্কদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা মাত্রাতিরিক্ত রকমে বেড়ে যাবার পর যুবকদের সম্পর্কেও তদন্ত করা হয়। তার ফলে প্রমাণিত হয় যে, ১৯২০ সাল থেকে সমাজের মদ্যপান ও দুষ্কৃতিপরায়ণতা প্রতি বছর বিপুল হারে বেড়ে যাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো শহরে ৮ বছরের মধ্যে শতকরা দু’শ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৩৩ সালে আমেরিকার জাতীয় অপরাধ সংস্থার (National Crime Council) ডিরেক্টর কর্ণেল মোস (Col. Moss) এ তথ্য প্রকাশ করেন যে, ‘বর্তমানে আমেরিকার প্রতি তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন পেশাদার অপরাধী। পরন্তু আমাদের এখানে হত্যার অপরাধ শতকরা ৩’শ ভাগ বেড়ে গিয়েছে’।
মোটকথা, চৌদ্দ বছরে আমেরিকায় মদ্য নিরারনের যে ফলাফল প্রকাশ পায়, তার মোটামুটি বিবরণ হচ্ছে এইঃ
– লোকদের মন থেকে আইনের প্রতি মর্যাদাবোধ তিরোহিত হয় এবং সমাজের সর্বস্তরে আইন ভঙ্গ করার ব্যধি বিস্তার লাভ করে।
– মদ্যপান নিবারণের আসল লক্ষ্য অর্জিত হয়নি; বরং তার উল্টো নিষিদ্ধ ঘোষণার পর বস্তুটি পূর্বের চাইতেও বেশী পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
– নিবারক আইনটি কার্যকর করণে একদিকে সরকারের এবং অপরদিকে গোপনে মদ্য ক্রয়ের ফলে প্রজা সাধারণের অপরিমিত আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয় এবং এভাবে গোটা দেশের মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে্।
– রোগের প্রকোপ, স্বাস্থ্যহানি, মৃত্যুহার বৃদ্ধি, জনচরিত্রের বিপর্যয়, সামজের সকল স্তরে, বিশেষত নব্য বংশধরগণের মধ্যে দুষ্কৃতি ও পাপাচারের বিস্তৃতি এবং অপরাধমূলক কার্য অস্বাভাবিক রকমে বৃদ্ধি পায়।
এই ছিলো উক্ত আইনের নৈতিক ও তামাদ্দুনিক ফলাফল।
এই ফলাফল অর্জিত হয় এমন একটি দেশে, যাকে বিশ শতকের আলোকোজ্জ্বল যুগে সর্বাধিক সুসভ্য দেশ বলে গণ্য করা হয়। তার অধিবাসীরা উন্নতমানের শিক্ষা ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত। জ্ঞান বিজ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার আলোকে তাদের মনমগজ আলোকদীপ্ত। তারা নিজেদের ভাল মন্দ ও লাভ ক্ষতি অনুধাবন করতে পুরোপুরি সমর্থ।
এই পরিণামফল প্রকাশ পায় এমন অবস্থায়, যখন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এবং কয়েক’শ কোটি পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তক প্রকাশ করে গোটা জাতিকে মদের অপকারিতা সম্বন্ধে মতর্ক করে দেয়া হয়েছিল।
এই ফলাফল আত্বপ্রকাশ করে এমন পরিস্থিতিতে, যখন মার্কিন জাতির এক বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ নিষিদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভ করেছিলো এবং তাদের ইচ্ছানুসারেই নিবারক আইনটি পাশ হয়েছিলো।
সর্বোপরি এই পরিণামফলের অভিব্যক্তি ঘটে এমন অবস্থায়, যখন আমেরিকার মতো বিরাট রাষ্ট্র বিশ শতকের সর্বোত্তম শাসনযন্ত্রের সহায়তায় মদ্যপান ও মদবিক্রির মূলোচ্ছেদ করার জন্যে পূর্ণ চৌদ্দ বছর পর্যন্ত অবিচল ছিলো।
বস্তুত এই ফলাফল প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত সরকার ও জনসাধারণ উভয়েরই সংখ্যাগুরু অংশ মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারে একমত ছিলো এবং এ কারণেই তা নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু যখন জানা গেলো যে, দেশবাসী কোন মতেই মদ্যপান ত্যাগ করতে সম্মত নয় এবং জবরদস্তিতে মদ বর্জন করানোর ফলে পূর্বের চাইতেও অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তখন সেই সরকার ও সংখ্যাগুরু জনসাধারণই আবার মদকে বৈধ করার ব্যাপারে মতৈক্যে উপনীত হলো।
এবার এমন একটি দেশের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করুন, যা আজ থেকে সাড়ে ১৩শ’ বছর পূর্বেকার অন্ধকার যুগে – যা সবচাইতে অন্ধকার যুগ বলে বিবেচিত হতো সে দেশের অধিবাসীরা ছিলো অশিক্ষিত। তাদের মধ্যে জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলার কোন নাম নিশানা পর্যন্ত ছিলোনা। তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোন সন্ধান জানতো না। তাদের মধ্যে লেখাপড়া জানা লোক হয়তো বা দশ হাজারে একজন পাওয়া যেত এবং তারও মান এতো নিম্ন যে, আজকের সাধারণ লোকও তার চাইতে বেশি জ্ঞান রাখে। বর্তমান যুগের সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান ও উপায় উপকরণ তখন মোটেই ছিলোনা। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র ছিলো একেবারেই প্রাথমিক অবস্থায় এবং তা কায়েম হবার পর মাত্র কয়েক বছরের বেশি অতিক্রান্তও হয়নি। তখনকার জনসাধারণ ছিলো মদের ভক্ত প্রেমিক। তাদের ভাষায় মদের প্রায় আড়াইশ’র মতো নাম ছিলো। সম্ভবত দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এর এতো নামকরণ হয়নি। এটা ছিলো মদের প্রতি তাদের আসক্তির প্রমাণ। এর আরও একটি প্রমাণ হচ্ছে তাদের কাব্য সাহিত্য। তা থেকে জানা যায়, মদ্যপান ছিলো তাদের স্বভাবগত এবং তা বিবেচিত হতো তাদের জীবনধারণের পক্ষে একটি অপরিহার্য বস্তু হিসেবে।
এই পরিস্থিতিতে সেখানে মদ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলো। আল্লাহর রসূল স.-এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো, এ সম্পর্কে শরীয়তের বিধান কি? তিনি বললেন, আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে এইঃ
(আরবী)
অর্থঃ ‘তারা তোমার কাছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাওঃ এ দু’টিতে বড় বড় অপকার রয়েছে, অবশ্য লোকের জন্য কিছু উপকারিতাও আছে। কিন্তু এ দু’য়ের ক্ষতির পরিমাণ উপকারের চাইতে অনেক বেশি।’ (সূরা বাকারা: ২১৯)
এটা মদ সম্পর্কে কোন হুকুম ছিলোনা; বরং এতে মদের প্রকৃতি ও গুণাগুণ বিবৃত করে বলা হয়েছে যে, তাতে কল্যাণ ও অকল্যাণ উভয় জিনিসই বর্তমান রয়েছে। তবে অকল্যাণের দিকটিই বেশি শক্তিশালী। এই শিক্ষামূলক ঘোষণার ফলে জাতির একটি অংশ ততক্ষণাতই মদ্যপান ত্যাগ করল। এতদসত্ত্বেও মদ্যপায়ীরাই রইলো সংখ্যাগুরু।
এরপর আবার মদ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো। কারণ কোন কোন লোক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়তে গিয়ে ভুল করে ফেলত। এমতাবস্থায় রসূলে করীম স. আল্লাহর এই হুকুম শুনিয়ে দিলেনঃ
অর্থঃ ‘হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা নামাযের কাছেও যেয়োনা; (নামায তোমাদের এমন অবস্থায় পড়া উচিত, যখন)তোমরা জানতে পারো যে, তোমরা কি বলছ।’ (সূরা নিসা: ৪৩)
এই আদেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই লোকেরা মদ্যপান করার জন্যে সময় নির্দিষ্ট করে নিলো। এরপর থেকে তারা সাধারণভাবে ফজর ও যোহরের মাঝখানে কিংবা এশার পর মদ্যপান করতে লাগলো, যাতে করে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়তে না হয় কিংবা নেশার কারণে নামায ত্যাগ করার প্রশ্ন উঠতে না পারে।
কিন্তু মদের আসল ক্ষতিকর দিকটি তখনও অনুদ্ঘাটিত ছিলো। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় লোকেরা প্রায় সময়ই গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতো এবং তার পরিণতি খুনখারাবী পর্যন্ত পৌঁছতো। এ কারণে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ও চূড়ান্ত নির্দেশ জানিযে দেবার প্রয়োজন হয়ে পড়লো। অতপর এরশাদ হলোঃ
(আরবী)
অর্থঃ ‘হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি, পাশাখেলা ইত্যাদি হচ্ছে শয়তানের উদ্ভাবিত নোংরা কাজ; সুতরাং ওগুলো তোমরা বর্জন করো। আশা করা যায়, এই বর্জনের ফলে তোমরা কল্যাণ লাভে সমর্থ হবে। শয়তান তো মদ ও জুয়ার সাহায্যে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বৈরিতা জাগিয়ে তুলতে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখতে চায়। এটা জানার পরও কি তোমরা ওগুলো থেকে বিরত থাকবেনা? আল্লাহর আনুগত্য করো, রসূলের কথা শোনো এবং বিরত থাকো। কিন্তু তোমরা যদি অবাধ্যতা করো, তবে জেনে রেখো, আমার রসূলের কাজ হচ্ছে শুধু নির্দেশকে স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া।’ (সূরা মায়িদা: ৯০-৯১)
এই নির্দেশ আসার সঙ্গে সঙ্গেই সুরা-রসিক ও মদ্য প্রেমিকগণ যারা মদের নামে নিজেদের জীবন পর্যন্ত উত্সর্গ করতে প্রস্তুত ছিলো – এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লো। মদ্য নিবারণ সংক্রান্ত ঘোষণা শোনার সাথে সাথেই সুরা পাত্রগুলোকে ভেঙ্গে ফেলা হলো। মদীনার অলিগলিতে মদের বন্যা-প্রবাহ বয়ে গেলো। এক মজলিশে বসে দশ এগার জন সাহাবী সুরা পান করে নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন। এরই মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণাকারীর এই আওয়াজ কানে এলো যে, মদকে চিরদিনের জন্য হারাম করে দেওয়া হয়েছে। সেই নেশার ঘোরেই খোদায়ী হুকুমের প্রতি এমনি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হলো যে, সাহাবাগণ অনতিবিলম্বে সুরা পান বন্ধ করে দিলেন এবং সুরা পাত্রগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়া হলো। এক ব্যক্তি কোথাও বসে সুরাপান করছিলো। সে মুখে কেবল পেয়ালাটি তুলে ধরেছে, এমন সময় কেউ এসে মদ্য নিবারক আয়াতটি পড়ে শোনালো। অমনি তার মুখ থেকে পেয়ালাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। ফলে সে এক ফোঁটা মদও গলাধকরণ করতে পারলোনা।
এরপর যে ব্যক্তিই সুরা পান করেছে, তাকে জুতা, লাঠি, লাথি, ঘুসি ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দেয়া হয়েছে। পরে এর শাস্তিস্বরূপ ৪০টি করে বেত্রাঘাত দেয়া হতে লাগলো। শেষে ৮০টি বেত্রাঘাতের শাস্তি নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো। ফলে আরবদেশ থেকে মদ্যপানের নাম নিশানা পর্যন্ত মুছে গেলো। এরপর ইসলাম যেখানেই গিয়েছে, বিভিন্ন জাতিকে স্বাভাবিকভাবেই সে ‘নিরস’ পরহেযগার বানিয়ে দিয়েছে। এমনকি, আজও ইসলামের প্রভাব অত্যন্ত দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ কোনরূপ ‘নিবারক আইন’ বা দণ্ডবিধি ছাড়াই মদকে সম্পূর্ণ বর্জন করে চলছে। মুসলিম জাতির মধ্যে সুরাপায়ীদের সংখ্যা যদি গণনা করে দেখা হয়, তাহলে আজও হয়তো এ জাতিকে দুনিয়ার অন্যান্য জাতির চাইতে বেশি পরহেযগার দেখা যাবে। পরন্তু এ জাতির মধ্যে যারা সুরাপান করে, তারাও একে অত্যন্ত গুনাহ্র কাজ বলে মনে করে। তাদের হৃদয় এজন্যে অনুতপ্ত হয় এবং অনেক সময় নিজে নিজেই তওবা করে এ কুঅভ্যাস ছেড়ে দেয়।
বস্তুত ন্যায় নীতি ও বিচার বুদ্ধির জগতে চূড়ান্ত ফয়সালা নির্ভর করে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ওপর। এর সাক্ষ্যকে কখনো মিথ্যা বলে প্রমাণ করা যায়না।এখানে সবার সামনেদু’টি অভিজ্ঞতা রয়েছেঃ একটি আমেরিকার, দ্বিতীয়টি ইসলামের। উভয় অভিজ্ঞতার মধ্যকার পার্থক্য্ সুস্পষ্ট। এবার এ দু’টি অভিজ্ঞতার তুলনা করে এ থেকে শিক্ষালাভ করে এ থেকে শিক্ষালাভ করা প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিরই কর্তব্য।
আমেরিকায় বছরের পর বছর ধরে মদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হয়েছে। এর অপকারিতা বিবৃত ও বিজ্ঞপিত করার কাজে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। চিকিত্সা বিজ্ঞান, সংখ্যাতাত্বিক প্রমাণ এবং যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তার শারীরিক, নৈতিক ও আর্থিক অনিষ্টকারীতাকে এমনিভাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তা অস্বীকার করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। ছবির সাহায্যে মদের অপকারিতাকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করানো হয়েছে। জনসাধারণ যাতে নিজেরাই মদের অনিষ্টকারীতা বুঝতে পেরে তা বর্জন করতে প্রস্তুত হয়, সর্বোতভাবে তার চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া জাতির সবচাইতে বড় প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা Congress বিপুল ভোটাধিক্যে মদ্য নিবারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এর জন্যে প্রয়োজনীয় আইনও পাশ করে। সর্বোপরি তার কেনাবেচা. চোরাই-প্রস্তুতি ও আমদানি-রপ্তানিকে বন্ধ করার জন্যে সরকার (যে সরকার তত্কালীন দুনিয়ার বৃহত্তম শক্তিবর্গের অন্যতম) তার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করে। কিন্তু জাতি (যে জাতি তখনকার শিক্ষিত ও আলোকপ্রাপ্ত জাতিগুলোর অগ্রনায়ক ছিলো) তাকে বর্জন করতে সম্মত হয়নি। অবশেষে চৌদ্দ–পনের বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই তারা হারামকে আবার হালাল করতে বাধ্য হয়ে গেলো।
অপরদিকে ইসলামী রাষ্ট্রে মদের বিরুদ্ধে কোন প্রচারণা চালানো হয়নি। সেখানে প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা বাবদ একটি পয়সাও ব্যয়িত হয়নি। কোন ‘এ্যান্টি সেলুন লীগ’-ও গঠন করা হয়নি। সেখানে আল্লাহ্র রসূল কেবল এইটুকু বলে দিয়েছেন যে, ‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্য মদকে হারাম করে দিয়েছেন।’ তাঁর মুখ থেকে এই নির্দেশটি বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা জাতি (যে জাতি মদের প্রেমে আমেরিকার চাইতেও বেশি অগ্রবর্তী ছিলো এবং পারিভাষিক জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তায় কেউ তার সমকক্ষ ছিলোনা) সুরাপান থেকে বিরত হলো। তারা মদকে এমনিভাবে বর্জন করল যে, ইসলামের সীমার মধ্যে থেকে তাদের পক্ষে ‘রসহীনতা’ থেকে ‘রসসমুদ্রে’ প্রত্যাবর্তন করা অসম্ভব হয়ে গেলো। পরন্তু এই ‘রসহীনতা’র মধ্যে আবদ্ধ থাকার জন্যে তাদের কোন অনুশাসন, কোন জিজ্ঞাসাবাদ বা কোন দণ্ডবিধিরও প্রয়োজন রইলোনা। কারণ কোন জবরদস্তি শক্তি বর্তমান না থাকলেও তারা সুরাপান থেকে বিরত থাকবে। সর্বোপরি এমন কোনো হারামও নয় যে, একে কোন রকমে আবার হালাল করা যেতে পারে। যদি তামাম দুনিয়ার মুসলমানও মদের স্বপক্ষে সর্বসম্মতভাবে ভোট দেয়, তবুও এ হারাম কখনো হালাল হতে পারেনা।
এই বিরাট তারতম্যের কারণ অনুসন্ধান করলে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যাবে। সে বিষয়গুলো শুধু মদের ব্যাপারেই নয়; বরং আইন ও নীতি শাস্ত্রের সমস্ত প্রশ্নেই মূলনীতি হিসেবে প্রযোজ্য।
প্রথম কথা এই যে, মানবীয় বিষয়াদিস সংগঠন ও পরিচালনায় ইসলাম ও পার্থিব বিধি ব্যবস্থার মধ্যে একটি মৌল পার্থক্য আছে। আর পার্থিব বিধি ব্যবস্থা নির্ভর করে সম্পূর্ণ মানবীয় অভিমতের ওপর। এই কারণেই তা শুধু সামগ্রিক ও মৌলিক ব্যাপারেই নয়, বরং প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপারেই সাধারণ কিংবা বিশিষ্ট লোকদের অভিমতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য। আর মানবীয় অভিমতের (তা সাধারণ লোকদের হোক কি বিশিষ্ট লোকদের) অবস্থা হচ্ছে এই যে, প্রতিটি মূহুর্তে তা অভ্যন্তরীণ ঝোঁক প্রবণতা, বাহ্যিক কার্যকারণ এবং জ্ঞান বুদ্ধির পরিবর্তনশীল নির্দেশের দ্বারা (তা হামেশা নির্ভুল হবে এমন কোনো কথাও নেই) প্রভাবিত হতে থাকে। এই প্রভাবের ফলে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে হামেশা পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পরিবর্তনের অনিবার্য ফলেই ভাল-মন্দ, ভুল-নির্ভুল, বৈধ-অবৈধ এবং হারাম-হালালের মানদণ্ড পরিবর্তিত হতে থাকে। আর এই পরিবর্তনের ফলে আইনের পরিবর্তনও অনিবার্য হয়ে পড়ে। এভাবে সেখানে নৈতিকতা ও সভ্যতার কোনো স্থায়ী, সুদৃঢ় ও অপরিবর্তনীয় মানদণ্ড কায়েম হতে পারেনা। মানুষের মতো বৈচিত্র্য সেখানে আইনের ওপর কর্তৃত্ব করে, আর আইনের বৈচিত্র কর্তৃত্ব করে মানব জীবনের ওপর। এর দৃষ্টান্ত হলো, যেনো কোনো আনকোরা ড্রাইভার মোটর চালনা করছে। তার অপরিপক্ক হাতে অনিয়মিতভাবে গাড়ির স্টিয়ারিং এদিক সেদিক ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এই অনিয়মিত ঘুরানোর ফলে মোটরের গতিও অনিয়মিত ও অনিশ্চিত হবে। সে দৃঢ়তার সাথে কোনো নির্দিষ্ট পথে চলতে পারবেনা। আর গাড়ি যখন এলোমেলোভাবে চলতে থাকবে, তখন খোদ ড্রাইভারের ওপরই প্রভাব পড়বে। কখনো সে সোজা পথে চলতে থাকবে, আবার কখনো চলবে বাঁকা পথে। কখনো কোনো গর্তে গিয়ে পড়বে, আবার কখনো কোনো প্রাচীরের সাথে সংঘর্ষ বাঁধাবে। আবার কখনো তা উঁচুনিচু, বন্ধুর পখে চলতে গিয়ে হোঁচট খাবে।
পক্ষান্তরে ইসলামী আইন ও নীতিশাস্ত্রের গোটা মূলবস্তু এবং বেশির ভাগ খুঁটিনাটি বিষয়ই আল্লাহ এবং রসূল কর্তৃক নির্ধারিত। সেখানে মানবীয় অভিমতের বিন্দু পরিমাণও স্থান নেই। তবে জীবনের পরিবর্তনশীল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ মৌলিক বিধান ও খুঁটিনাটি দৃষ্টান্ত অনুসারে প্রয়োজনমতো ছোটখাট ব্যাপারে নয়া আইন রচনার অধিকার মানুষের রয়েছে। কিন্তু সে আইনও অনিবার্যভাবে শরয়ী মূলনীতির আলোকেই রচিত হতে হবে। বস্তুত এই খোদায়ী আইনের ফলেই আমাদের কাছে নৈতিকতা ও সভ্যতার একটি স্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল মানদণ্ড বর্তমান রয়েছে। আমাদের নৈতিক ও সামাজিক বিধি-ব্যবস্থায় বৈচিত্র ও বিভন্নমুখিতার কোনো নাম নিশানা পর্যন্ত নেই। আমাদের গতকালকার হারাম আজকে হালাল এবং আগামীকাল আবার হারাম হতে পারেনা। এখানে যা হারাম করা হয়েছে, তা চিরকালের জন্যেই হারাম আর যা হালাল করা হয়েছে, তা কিয়মত অবধি হালাল। আমরা আমাদের মোটরের স্টিয়ারিং এক সুনিপুণ ও সুদক্ষ ড্রাইভারের হাতে সঁপে দিয়েছি। তিনি আমাদের মোটরকে সোজা পথে চালিত করবেন, এব্যাপারে আমরা নিশ্চিন্ত :
يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ ۖ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ ۚ وَيَفْعَلُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ
অর্থঃ আল্লাহ্ ঈমানদার লোকদের একটি সুনিশ্চিত বাণীর সাহায্যে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে স্থিতি ও দৃঢ়তা দান করেন, আর যালিম ও অবাধ্য লোকদের তিনি পথভ্রষ্ট করে দেন, যাতে করে তারা কোথাও স্থিতি লাভ করতে না পারে।’ (সূরা ইব্রাহীম : ২৭)
এর ভেতরে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিহিত রয়েছে। তাহলো, বৈষয়িক রাষ্ট্রে মানব জীবনের জন্যে কোনো বিধি-ব্যবস্থা প্রণয়ন কিংবা নৈতিক চরিত্র, সমাজ ব্যবস্থা ও তামাদ্দুনিক কাঠামোর সংশোধনের নিমিত্ত কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হলে নেহায়েত খুঁটিনাটি ব্যাপারেও জনগণের সম্মতির অপেক্ষা করতে হয়। তার আইন কানুনের প্রত্যেকটি ধারা কার্যকরীকরণে জনমতের উপরে নির্ভরশীল হতে হয়। জনগণের মতের বিরুদ্ধে যে সংস্কার বা গঠনমূলক আইনই কার্যকরী করা হোক, শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করতেই হয়। এটা শুধু আমেরিকার অভিজ্ঞতাই নয়; বরং দুনিয়ার সমস্ত অভিজ্ঞতাই একথার সাক্ষ্য বহন করে। এ থেকে এ সত্যই প্রমাণিত হয় যে, মানব চরিত্র ও সমাজ ব্যবস্থার সংশোধনের বেলায় পার্থিব আইন সম্পূর্ণ অক্ষম ও অনুপযোগী। কারণ সে আইন বিকৃত জনসমষ্টির সংশোধন করার প্রয়াসী, তার মঞ্জুরী অমঞ্জুরী বা প্রত্যাবর্তন প্রত্যাহারের জন্যেও সেই জনমতের ওপরেই তাকে নির্ভর করতে হয়।
ইসলাম এই জটিলতার নিরসন করেছে অন্য একটি উপায়ে; আর একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, এ ছাড়া এই সমস্যার আর কোনো সমাধান নেই। তাহলো এই যে, নৈতিক চরিত্র, সমাজনীতি ও তামাদ্দুনিক প্রশ্নাবলী উত্থাপন এবং শরয়ী বিধানের প্রতি আনুগত্যের দাবি জানানোর পূর্বে সে গোটা মানব জাতিকে আল্লাহ্, তাঁর রসূল এবং তাঁর কিতাবের প্রতি ঈমান পোষণের আহ্বান জানায়। অবশ্য ঈমান আনা বা না আনা মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ঈমান আনবার পর তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার আর কোনো প্রশ্ন থাকেনা। অতপর আল্লাহ্র তরফ থেকে তাঁর রসূল যে নির্দেশই দান করেন এবং আল্লাহ্র কিতাব যে আইনই নির্দিষ্ট করে দেয়, তার আনুগত্য তার পক্ষে অপরিহার্য। এই মূলভিত্তি স্থাপনের পর ইসলামী শরীয়তের তামাম বিধিব্যবস্থা তার ওপর কার্যকরী হয়ে যাবে। এরপর আর কোনো খুঁটিনাটি বা মৌলিক প্রশ্নেই তার সদিচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনো স্থান থাকবেনা। এ কারণেই শত শত কোটি টাকার অপচয়, অতুলনীয় প্রচার প্রোপাগান্ডা এবং রাষ্ট্রশক্তির অপরিমেয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমেরিকায় যে কাজ সম্ভব হয়নি, তা ইসলামী রাষ্ট্রে আল্লাহ্র তরফ থেকে রসূলের একটিমাত্র ঘোষণায়ই হয়ে গিয়েছে।
তৃতীয় শিক্ষামূলক বিষয় এই যে, কোনো মানব সমাজ জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলার দীপ্তিতে যতোই প্রদীপ্ত হোক এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে যতো উন্নতির শিখরেই আরোহণ করুক না কেনো, সে খোদায়ী আইন কানুনের অনুগত ও আজ্ঞানুবর্তী না হলে এবং তার ভেতর ঈমানী শক্তি পয়দা না হলে নিজের বল্গাহীন প্রবৃত্তির কবল থেকে সে কখনো মুক্তিলাভ করতে পারেনা। তার ওপর প্রবৃত্তির দুর্বার আকাঙ্খা চেপে বসবে। ফলে তার প্রবৃত্তি যে বস্তুটির প্রতি আকৃষ্ট হবে, তার অপকারিতা সূর্যালোকের চাইতে উজ্জ্বল করে দেখালেও তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানকে (অর্থাৎ বুদ্ধি পূজারীদের উপাস্য) সাক্ষী হিসেবে এনে দাঁড় করালেও তার মোকাবেলায় সংখ্যাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পেশ করলেও (যা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে কখনো মিথ্যা হতে পারেনা) এবং তার অনিষ্টকারীতাকে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণলদ্ধ জ্ঞানের সাহায্যে প্রমাণ করে দিলেও সে কখনো অই প্রিয় বস্তুটি বর্জন করবেনা। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের ভেতর নৈতিক চেতনা সঞ্চয় করা, তার বিবেক বুদ্ধিকে পরিচালিত করা এবং তার মধ্যে আপন প্রবৃত্তিকে বশীভূত করার মতো শক্তির সৃষ্টি করা দর্শন, বিজ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তির কাজ নয়। এ কাজ ঈমান ছাড়া আর কোনো উপায়ে সম্পন্ন হতে পারেনা। (প্রথম প্রকাশঃ তরজমানুল কুরআন : জানুয়ারি ১৯৩৪ সাল)