১৬
মুসলমানদের শক্তির আসল উৎস
[প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম ১৯৩৫ সালের জানুয়ারীতে তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। – সম্পাদক]
হিজরী দ্বিতীয় শতকের গোড়ার দিকের কথা। সাজস্থান ও দুরখজের
[বর্তমানে আফগানিস্তানের প্রাচীন নাম।]
তৎকালীন শাসক যার খান্দানী উপাধি ছিলো রুতবেল – বনী উমাইয়ার প্রতিনিধিকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এ জন্যে ক্রমাগত তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছিল। কিন্তু সে কিছুতেই বশ্যতা স্বীকার করলোনা। ইয়াজিদ বিন্ আব্দুল মালিক একবার তার কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্যে দূত প্রেরণ করেছিলো। তখন সে মুসলিম দূতকে জিঞ্জেস করলো ঃ ’আগে যেসব লোক খাজনা আদায় করতে আসতো, তারা কোথায় গেলো?তাদের পেট অভুক্ত লোকদের ন্যায় পিঠের সঙ্গে চিপটে থাকতো, কপালে কালো দাগ পড়ে থাকতো এবং তারা খেজুর পাতা পরিধান করতো।’
বলা হলো, তারা তো অতক্রিান্ত হয়ে গেছেন। রুতবেল বললোঃ ’ তোমাদের চহোরা সুরাত যদিও তাদের চাইতে শানদার; কিন্তু তাঁরা তোমাদের চাইতে বেশি প্রতিশ্রুতি পালনকারী এবং অধিকতর শক্তিশালী ছিলেন।
ঐতিহাসিকগণ বলেন, একথা বলেই রুতবেল রাজস্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দিলো এবং প্রায় অর্ধ শতক পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে স্বাধীন রইলো।
এ হচ্ছে এমন সময়ের কথা, যখন বিপুল সংখ্যক তাবেঈ ও তাবে তাবেঈ বর্তমান ছিলেন। সেটা ছিলো ইমাম মুজতাহিদগণের যুগ। তখন নবী করীম সাঃ -এর তিরোধানের পর মাত্র একটি শতক অতক্রিান্ত হয়েছিলো। মুসলমানরা একটি জীবন্ত ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে দুনিয়ার উপর বিরাজ করছিলো। তারা ইরান, ইরাক, রোম, মিসর, আফ্রিকা, স্পেন প্রভৃতি দেশের শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলো। সাজ সরঞ্জাম, জাঁক জমক ও ধন সম্পদের দিক থেকে দুনিয়ার কোনো জাতিই তখন তাদের সমকক্ষ ছিলনা। এসব কিছুই পুরোপুরি বর্তমান ছিল। তাদের হৃদয়ে ঈমানও সতেজ ছিল। ’শরয়ী ’ বিধি বিধানের অনুবর্তিতা আজকের চাইতে অনেক বেশি ছিল। নেতৃত্বের আদেশ ও তা পালন করার ব্যবস্থা ছিল। গোটা জাতির মধ্যে এক প্রচন্ড নিয়মানুবর্তিতা বর্তমান ছিল। কিন্তু তা সত্বেও যারা সাহাবাদের আমলের অভুক্ত, দরিদ্র ও মরুবাসীদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করেছিল, তারা এই সরঞ্জামে সুসজ্জিত এবং ঐ সাজ সরঞ্জামহীন লোকদের আসমান জমিনের পার্থক্য অনুভব করল। এটা কিসের পার্থক্য ছিল?ইতিহাসবেত্তাগণ হয়তো একে শুধু গ্রামীণ সভ্যতা ও প্রাচীণ সভ্যতার পার্থক্য বলে অভিহিত করতে চাইবেন। তারা বলবেন, প্রাচীন মরুবাসিগণ বেশি কষ্ট সহিঞ্চু ছিল আর পরবর্তী লোকেরা ধনদৌলত ও তামদ্দুনিক সমৃদ্ধির ফলে বিলাসপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আমি বলব ঃ আসলে এ পার্থক্য ছিল ঈমান, আন্তরিকতা, চরিত্রগুণ এবং আল্লাহ ও রসূলের প্রতি আনুগত্যের পার্থক্য। মুসলমানদের আসল শক্তি এই জিনিসগুলোর মধ্যেই নিহিত ছিল। সংখ্যার প্রাচুর্য, সাজ সরঞ্জামের বাহুল্য, ধনদৌলতের সমৃদ্ধি, ঞ্জান বিঞ্জান ও শিল্পকলার নৈপুণ্য, তমদ্দুন ও সভ্যতার উপকরণাদি এর কোনটাই তাদের শক্তির উৎস ছিলনা। তারা শুধু ঈমান ও সৎ কর্মের উপর নির্ভর করেই সম্মুখে অগ্রসর হয়েছিল। এই জিনিসটিই দুনিয়ায় তাদের সমুন্নত করেছিল। এটিই অন্যান্য জাতির হৃদয়ে তাদের খ্যাতির আসন প্রতিষ্টা করে দিয়েছিল। যখন শক্তি ও সম্ভ্রমের এই সম্পদ তাদের কাছে বর্তমান ছিল, তখন সংখ্যার অপ্রতুলতা এবং সাজ সরঞ্জামের অভাব সত্বেও তারা শক্তিমান ও সম্মানিত ছিল। আর যখন এই সম্পদ তাদের কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল, তখন সংখ্যার প্রাচুর্য এবং সাজ সরঞ্জামের বাহুল্য সত্বেও তারা দুর্বল ও সম্ভ্রমহীন হয়ে পড়তে লাগল।
রুতবেল একজন শত্রু হিসেবে যা বলেছে তা মিত্র ও সদুপদেষ্টাদের হাজারো ওয়াযের চাইেিতও বেশি শিক্ষাপ্রদ। সে প্রকৃতপক্ষে এই সত্যটিই তুলে ধরেছে যে, কোন জাতির প্রকৃত শক্তি তার সুসজ্জিত সেনাবাহিনী, তার সমরাস্ত্র, তার সুদক্ষ সৈন্য সামন্ত এবং বিপুল উপায় উপকরণের মধ্যে নিহিত নয়, বরং তা রয়েছে তার সৎ স্বভাব, দৃঢ় চরিত্র, নির্ভুল আচরণ ও উন্নত চিন্তাধারার মধ্যে। এ হচ্ছে এমন এক আধ্যাত্মিক শক্তি, যা বস্তুগত উপকরন ছাড়াই দুনিয়ায় নিজের কর্তৃত্ব চালিয়ে থাকে। এ জিনিস মাটিতে উপবেশনকারীদেরকে সিংহাসনোপবিষ্টদের ওপর জয়যুক্ত করে তোলে। এ শুধু ভূমিরই অধিকারী নয়, বরং লোকদের হৃদয়েরও মালিক বনিয়ে দেয়। এই শক্তির বলে খেজুরপাতা পরিধানকারী, শুষ্ক কঙ্কালসার, অনুজ্ঝল চেহারাবিশিষ্ট ন্যাকড়া জড়ানো তরবারীর ধারকগণ দুনিয়ায় এমন খ্যাতি প্রতিপত্তি, শৌর্য বীর্য, মান র্মযাদা ও শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্টা করতে পারে, যা শানদার পোশাক পরিধানকারী, বিপুল ও বলিষ্টদেহী, উজ্জ্বল চেহারাবিশিষ্ট, উচ্চ দরবারসম্পন্ন, বড় বড় কামানধারী ও প্রচন্ড পরাক্রমশালী লোকেরাও ঐ শক্তি ছাড়া প্রতিষ্টা করতে পারেনা। বস্তুত নৈতিক শক্তির প্রাচুর্য বস্তুগত উপকরণের অভাব পূর্ণ করে দিতে পারে, কিন্তু বস্তুগত উপকরণের প্রাচুর্য নৈতিক শক্তির অভাবকে কখনো পূর্ণ করতে পারে না। এই শক্তি ছাড়া শুধু বস্তুগত উপকরণের সঙ্গে প্রতিপত্তি লাভ করতে পারলেও তা হবে অপূর্ণ ও অস্থায়ী – তা কখনো পরিপূর্ণ ও সুদৃঢ় হবেনা, তাতে লোকদের হৃদয় কখনো অবনমিত হবেনা, শুধু মাথাটাই নত হবে মাত্র। তা -ও আবার প্রথম সুযোগেই বিদ্রোহ করার জন্যে তৈরি হয়ে থাকবে।
কোনো ইমারত তার বর্ণ বৈচিত্র্য, কারুকর্য, শোভা সৌন্দর্য, পুস্পময় আঙ্গিনা ও বাহ্যিক মরোহারিত্ব দ্বারা স্থিতি লাভ করেনা। বাসিন্দাদের আধিক্য, সাজ সরঞ্জামের বাহুল্য, উপায় উপাদানের প্রাচুর্য তাকে সুদৃঢ় করতে পারেনা। তার ভিত্তি যদি দুর্বল হয, প্রাচীরগুলো যদি ঠুনকো হয,খুঁটিগুলো ঘুণে ধরে ফেলে, তবে তা বাসিন্দাদের দ্বারা যতোই পূর্ণ হোক, তাতে যতো কৌটি টাকার মালমাত্তা ও আসবাবপত্র থাকুক, তার সাজসজ্জা লোকদের দৃষ্টিকে ঝলসিয়ে দিক এবং তাদের হৃদয়কে মুগ্ধ করুক এর কোনটাই তাকে ধ্বসে পড়া থেকে রক্ষা করতে পারেনা। লোকেরা শুধু বহিরাকৃতিকেই দেখে থাকে, তাদের দৃষ্টি লক্ষ্যস্থলেই আবদ্ধ হয়ে পরে। কিন্তু যুগের ঘটনাপ্রবাহ বাহ্যদৃশ্যর সঙ্গে নয়, অন্তর্নিহিত সত্যের সাথে মোকাবিলা করতে আসে। তা ইমারতের ভিত্তির সঙ্গে শক্তি পরিক্ষা করে। তার প্রাচীরের দৃঢ়তা ও পরিপক্ষতা যাচাই করে দেখে। খুঁটিগুলোর বিন্যাস ও সংস্থাপনকে পরখ করে দেখে। এই জিনিসগুলো যদি সঠিক, সুদৃঢ় ও স্থিতিশীল হয়, তবে যুগের ঘটানাপ্রবাহ এমনি ইমারতের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। সে ইমারতের কোন কারুকার্য বা সৌন্দর্য সুষমা না থাকলেও ঘটনা প্রবাহের ওপর সে নিশ্চিতরূপে জয়যুক্ত হবে। নতুবা ঘটনার সংঘাত শেষ পর্যন্ত তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলবে এবং নিজের সঙ্গে তাবৎ অধিবাসী এবং সৌন্দর্যোপকরণ নিয়েই বিধ্বস্ত হবে।
জাতীয় জীবনের অবস্থাও এমনি। কোনো জাতিকে তার গৃহ, পোশাক পরিচ্ছদ, সওয়ারী, বিলাসদ্রব্য, চারুকলা, কল কারখানা এবং স্কুল কলেজই জীবন্ত, শক্তিশালী ও সমূন্নত করে তোলেনা; বরং তাকে সমূন্নত ও শক্তিশালী করে তার সভ্যতার মূলগত আদর্শ, তার হৃদয়ে সে আদর্শের স্থিতিলাভ এবং তার আচরণে সে আদর্শের কর্তৃত্ব প্রতিষ্টা। এই তিনটি জনিসি অর্থাৎ আদর্শের বিশুদ্বতাতার প্রতি পোখতা ঈমান এবং বাস্তব জীবনে তার পূর্ণ কর্তৃত্ব জাতীয় জীবনে ঠিক তেমনি গুরুত্ব রাখে, একটি ইমারতের বেলায় তার সুদৃঢ় ভিত্তি, তার পরিপক্ক প্রাচীর এবং তার মজবুত খুঁটিগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনটি জিনিস যে জাতির মধ্যে পুরোমাত্রায় বর্তমান থাকবে, দুনিয়ায় সে জয়যুক্ত হবে। তার বাণীই সমূন্নত হবে। আল্লাহ্র দুনিয়ায় তারই কর্র্তৃত্ব চলবে। লোকদের হৃদয়ে তারই খ্যাতির আসন প্রতিষ্টিত হবে। তাদের মস্তক তারই নির্দেশের সামনে অবনত হবে। সে জীর্ণ কুটিরে বাস করুক, শতছিন্ন কাপড়ই পরিধান করুক, অনশনে তার পেটের চামড়া পিঠের সঙ্গে চিপটে থাকুক, তার দেশে একটি কলেজও না থাকুক, তার লোকালয়ে একটি কারখানাও পরিদৃষ্ট না হোক, বিঞ্জান ও শিল্পকলায় সে সম্পুর্ণ পশ্চাদপত হোক -দুনিয়ায় সে-ই সম্ভ্রমের অধিকারী হবে। লোকেরা যে জিনিসগুলোকে উন্নতির পাথেয় বলে মনে করে, তা শুধু ইমারতের কারুকার্য মাত্র, তার প্রাচীর বা স্তম্ভ নয়। অথচ ঠুনকো প্রাচীরের ওপর সোনার পাত বসিয়ে দিলেও তাকে ধ্বসে পড়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই কথাটাই কুরআন মজীদে বিবৃত করা হয়েছে বারবার।
কুরআন ইসলামের মূলনীতি সম্পর্কে বলেছে যে, আল্লাহ মানুষকে যে অটল ও অপরিবর্তনীয় প্রকৃতির (আরবী) ওপর সৃষ্টি করেছেন, ইসলামের নীতি হচ্ছে সেই প্রকৃতিসম্মত। কাজেই এ নীতির ওপর যে ’দীন’কে প্রতিষ্টিত করা হয়েছে তাই হচ্ছে ’সুপ্রতিষ্টিত দীন’ (আরবী) অর্থাৎ এ হচ্ছে এমন দীন যা ইহকাল ও পরকাল সংক্রান্ত তাবৎ বিষয়কেই সঠিক প্রক্রিয়ার ওপর প্রতিষ্টিত করে দেয়ঃ
(আরবী)
অর্থঃ তুমি একনিষ্টভাবে এই দীনমুখী হয়ে যাও। আল্লাহ যে প্রকৃতির ওপর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাতে কোনো পরিবর্তন হয়না। এটাই সঠিক দীন। তবে অধিকাংশ লোকই তা জানেনা।’ (সূরা রূমঃ ৩০)
অতপর সে বলেঃ এই সুপ্রতিষ্টিত দীনের ওপর দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকো, এর প্রতি ঈমান পোষণ করো এবং তদনুযায়ী কাজ করো। এর সুফল আপনা আপনিই প্রকাশ পাবে। দুনিয়ার তোমরাই সমূন্নত হবে। তোমাদেরকেই পৃথিবীর রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করা হবে। তোমরাই খিলাফতের মর্যদায় অভিষিক্ত হবে।
(আরবী)
পক্ষান্তরে যারা দৃশ্যত দীন ইসলামের চৌহদ্দীর মধ্যে প্রবেশ করেছে, কিন্তু তাদের হৃদয়ে না দীনের আসন প্রতিষ্টিত হয়েছে, না ইসলাম তাদের জীবন বিধানে পরিণত হয়েছে – তাদের বাহ্য চেহারা খুব জমকালো সন্দেহ নেই;
(আরবী)
তাদের কথাবার্তাও খুব মধুর; (আরবী)
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা হচ্ছে প্রাণহীন কাঠের পুত্তলী ” (আরবী)
তারা আল্লাহর চাইতে মানুষকে বেশি ভয় করে: ” (আরবী)
তাদের ক্রিয়াকান্ড মরীচিকার মতো; দেখতে তা পানির মতো মনে হলেও আসলে তা কিছুই নয়: ” (আরবী)
এমন লোকেরা কখনো সামগ্রিক শক্তি অর্জন করতে পারেনা। কারণ তাদের হৃদয় থাকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন। তারা নিষ্টা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কোনো কাজেই ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনা : ” (আরবী)
তারা কখনোই মুমিন ও সৎ লোকদের ন্যায় শক্তির অধিকারী হতে পারেনা: ” (আরবী) তারা কখনো দুনিয়ার নের্তৃত্বর আসন লাভ করতে পারেনা: ” (আরবী) তাদের জন্যে দুনিয়ায় যেমন অপমান ও লাঞ্ছনা, আখেরাতেও তেমনি কঠিন শাস্তি ছাড়া আর কিছুই নেই: ” (আরবী)
একথায় হয়তো অনেকে বিস্মিত হবে যে, কুরআন মুসলমানদের উন্নতি, তাদের শক্তি কর্তৃত্ব লাভ এবং অন্যান্য সকল জাতির ওপর বিজয়ী হবার জন্যে শুধু ঈমান ও সৎ কর্মকেই একমাত্র উপায় বলে ঘোষণা করেছে। তারা অবাক হবে যে, কোথাও মুসলমানদেরকে ইউনিভার্সিটি বানাবার, স্কুল কলেজ খুলবার, কল কারখানা প্রতিষ্টা করার, জাহাজ গড়বার, কোম্পানী কায়েম করার, ব্যাংক খুলাবার, বৈঞ্জানিক যন্ত্রপাতি আবিস্কার করার, কিংবা পোশাকাদি, সামাজিকতা ও চালচলনে উন্নত জাতিগুলোর অনুকরণ করাবার কথা বলা হয়নি। অন্যদিকে কুরআন মুনাফিকীকেই আধোগতি, অধপতন, দুনিয়া আখেরাতে লাঞ্ছনা ও অপমানের একমাত্র হেতু বলে অভিহিত করেছে -আজকের দুনিয়ায় যে জিনিসগুলোকে তরক্কীর হেতু বলে গণ্য করা হয় তার অভাবকে কোথাও পতনের হেতু বলে উল্লেখ করা হয়নি।
কিন্তু কুরআনের মূল ভাবধারাটি অনুধাবন করতে পারলে এ বিস্ময় স্বভাবতই দূর হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম অনুধাবণীয় বিষয় হলো এই যে, যে জিনিসটিকে ’মুসলমান’ বলে আখ্যা দেয়া হয় তার ভিত্তি একমাত্র ইসলাম ছাড়া আর কিছুই নয়। মুসলিম হিসেবে তার স্বরূপ একমাত্র ইসলামের দ্বারাই নির্ণীত হতে পারে। সে যদি মুহাম্মদ সাঃ কর্তৃক আনীত পয়গামের প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং তাঁরই মাধ্যমে অবতীর্ণ বিধি বিধানের আনুগত্য করে, তবে ইসলাম বহির্ভূত আর কোনো জিনিস তার কাছে না থাকলেও তার ইসলাম পূর্ণত্ব লাভ করব।ে পক্ষান্তরে সে যদি পার্থিব জীবনের তামাম সৌন্দর্যোপকরণে সুসজ্জিত হয, কিন্তু তার হৃদয়ে ঈমানের প্রভাব না থাকে এবং তার বাস্তব জীবনেও ইসলামী বিধি বিধানের আনুগত্য থেকে মুক্ত হয় তবে সে গ্রাজুয়েট, ডাক্তার, শিল্পপতি, ব্যাংকার, সেনাধ্যক্ষ ইত্যাদি সবকিছুই হতে পারে, কিন্তু মুসলমান হতে পারেনা। কাজেই কোনো ব্যাক্তি বা জাতির মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলামের মর্মবানী বদ্ধমূল না হলে তাদের কোনো উন্নতিই মুসলিম ব্যাক্তি বা জাতির উন্নতি আখ্যা পেতে পারেনা। এমতাবস্থায় যতো বড় উন্নতিই করা হোক না কেন, তা কিছুতেই মুসলমানের উন্নতি বলে গণ্য হবেনা। আর স্পষ্টত এমনি উন্নতি কখনো ইসলামের লক্ষ্য হতে পারেনা।
অবশ্য কোনো জাতি আদৌ মুসলমান না হলে এবং তার চিন্তাধারা, নৈতিক চরিত্র ও সমাজ বিধানের মূলভিত্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু হলে আলাদা কথা। নিঃসন্দেহে, এমনি জাতি ইসলাম থেকে ভিন্নতর নৈতিক, সামজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক নীতির উপর দাঁড়াতে পারে, এমনকি সে নিজেও ঈস্পিত তরক্কীর শেষ প্রান্ত অবধিও পৌঁছুতে পারে। কিন্তু অপর পক্ষে কোনো জাতির চিন্তাধারা, নৈতিক চরিত্র, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভিত্তি ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আর ইসলামের ব্যাপারেই তার প্রত্যয় ও আচরণ উভয় দিক থেকে দুর্বল হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্নকথা। এমনি জাতি বস্তুগত উন্নতির উপায় উপকরণ যতো বিপুল পরিমাণে সংগ্রহ করুক না কেন, একটি সুদৃঢ় ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে সমুত্থিত হওয়া এবং দুনিয়ার বুকে সমুন্নতি লাভ করা তার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার। কারণ তার জাতিয়তা, নৈতিক, চরিত্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল ভিত্তিই দুর্বল। তার ভিত্তিমূলেন দুর্বলতা এমনি মারাত্মক যে, নিছক বাহ্যিক সৌন্দার্যোপকরণ তা কখনো দূর করতে পারেনা।
একথার অর্থ্ এই নয় যে, জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্পকলা এবং বস্তুগত উন্নতির অন্যবিধ উপায় উপকরণের যথার্থ গুরুত্বকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে এই যে, মুসলিম জাতির পক্ষে এই জিনিসগুলোর গুরুত্ব হচ্ছে দ্বিতীয় পর্যায়ের। ভিত্তির দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতা হচ্ছে এই সবগুলোর ওপরই অগ্রগণ্য। ভিত্তি স্থিতিশীল হয়ে গেলে তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তামাম বস্তুগত উপকরণই অবলম্বন করা যেতে পারে এবং তা করাও উচিত। কিন্তু এটিই দুর্বল হয়ে পড়লে, হৃদয়ে তার শিকড় দৃঢ়মূল না হলে এবং বাস্তব জীবনে তার নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়লে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় দিক থেকেই জাতির নৈতিক চরিত্র স্বভাব প্রকৃতি ও কাজ কারবার বিকৃত, বিপর্যস্ত ও বিশৃংখল হয়ে যেতো, তার সমাজ পদ্ধতি শিথিল হয়ে পড়তো এবং তা শক্তি সামর্থ বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তার গুরুত্ব হ্রাস পেতো। এমনকি এর ফলে অন্যান্য জাতি তার ওপর প্রাধান্য পর্যন্ত বিস্তার করতে পারে। এমতাবস্থায় বস্তুগত উপকরণের প্রাচুর্য, ডিগ্রীধারী ও পন্ডিত ব্যক্তিদের বাহুল্য এবং বহ্যিক শোভা সৌন্দের্যর চাকচিক্য কোনোই কাজে আসতে পারেনা।
এর চাইতেও বড় আর একটি কথা রয়েছে। কুরআনে হাকীম অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছে যে, ‘তোমরা যদি মুমিন হ্ও তো তোমরাই সুমুন্নত হবে,’ ‘আল্লাহর দলই জয়যুক্ত হবে।’ এবং ‘যারা ঈমান ও সৎকর্মের দ্বরা ভূষিত হবে, তারা অবশ্যই দুনিয়ার খিলাফত লাভ করবে।’ এই দৃঢ়তার ভিত্তি কি? অন্যান্য জাতি যতোই বস্তুগত উপকরণের অধিকারী হোকনা কেন, মুসলমানরা শুধু ঈমান ও সৎকর্মের অস্ত্রবলেই তাদের ওপর জয়যুক্ত হবে এতো বড় দাবি কোন ভিত্তির ওপর করা হয়েছে?
কুরআনই এই জটিল প্রশ্নের মীমাংসা করে দিয়েছেঃ
(আরবী)
অর্থঃ হে মানবগণ! একটি উপমা বর্ণিত হচ্ছে, একে মনোযোগ দিয়ে শোনো। আল্লাহকে ত্যাগ করে তোমরা যে জিনিসগুলোকে ডাকো, তারা একটি মাছি পর্যন্ত সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেনা। যদি তারা সবাই মিলে এই কাজে শক্তি প্রয়োগ করে, তবুও নয়। তেমনিভা্বে একটা মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনো জিনিস ছিনিয়ে নেয় তো তার কাছ থেকে সে জিনিসটি ছাড়িয়ে আনবার ক্ষমতাও তাদের নেই। প্রার্থনাকারী যেমন দুর্বল, তেমনি প্রার্থিত বস্তুটিও দুর্বল। এই লোকের আল্লাহকে উপযুক্ত মর্যাদাই প্রদান করেনা। অথচ আল্লাহই হচ্ছেন প্রকৃত ক্ষমতা ও মর্যাদাবান।’ (সূরা হজ্জঃ ৭৩-৭৪)
(আরবী)
অর্থঃ যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য শক্তিকে পৃষ্ঠপোষক মনে করছে, তাদের উপমা হচ্ছে মাকড়সা; সে ঘর তৈরি করে বটে, কিন্তু সমস্ত ঘরের চাইতে মাকড়সার ঘরই হচ্ছে বেশি দুর্বল।’ (সূরা আনকাবুতঃ ৪১)
অর্থাৎ যারা শুধু বস্তুগত শক্তির উপর নির্ভর করে, তাদের নির্ভরের জিনিসগুলোই হচ্ছে এমন যে, তারা নিজেরাই কোনোরূপ শক্তির অধিকারী নয়। এমন শক্তিহীন বস্তুনিচয়ের ওপর নির্ভর করার স্বাভাবিক ফলে তারা নিজেরাও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মতে যে দুর্ভেদ্য কেল্লা নির্মাণ করে তা মাকড়সার জালের মতোই ঠুনকো। যারা প্রকৃত ক্ষমতাবান ও সম্ভ্রমশালী তারা আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে সমুত্থিত হয়, তাদের মোকাবিলা করার মতো শক্তি কখনোই এদের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারেনা:
(আরবী)
অর্থঃ যে ব্যক্তি তাগূত বা খোদাদ্রোহী শক্তিকে ছেড়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে, সে এমন দৃঢ় রজ্জু আঁকড়ে ধরেছে, যা কখনো ছিন্ন হবার নয়।’ (সূরা বাকারাঃ ২৫৬)
কুরআন দৃঢ়তার সঙ্গে এ-ও দাবি জানিয়েছে যে, যখনই ঈমানদার ও কাফিরদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, তখন ঈমানদার লোকেরাই বিজয়ের অধিকারী হবে।
(আরবী)
অর্থঃ কাফিররা যদি তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তো অবশ্যই তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে; অতপর তারা কোনো বন্ধু ও সাহয্যকারী পাবেনা। এটাই আল্লাহ তায়ালার নীতি, যা আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। আর তোমরা কখনো আল্লাহর নীতিতে ব্যতিক্রম দেখতে পাবেনা।’ (সূরা আল-ফাতাহ্ঃ ২২-২৩)
(আরবী)
অর্থঃ আমরা কাফিরদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করবো; কেননা তারা আল্লাহর সঙ্গে সেসব বিষয়কে শরীক করেছে, যেগুলোকে তিনি কোনো মর্যাদাই দান করেননি।’ (সূরা আল-ইমরানঃ ১৫১)
এর কারণ হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যে লড়াই করে, আল্লাহর শক্তি তার সহায়ক হয় আর আল্লাহ যাকে সহায়তা করেন, তার মোকাবিলায় কারো কোনো জোরাজুরিই চলতে পারেনাঃ
(আরবী)
অর্থঃ এর কারণ হলো, ঈমানদারদের সাহয্যকারী হচ্ছেন আল্লাহ আর কাফিরদের কোনো সাহায্যকারীই নেই।’ (সূরা মুহাম্মদঃ ১১)
(আরবী)
অর্থঃ তুমি যখন তীর ছুঁড়েছিলে, তখন তুমি ছুঁড়োনি; বরং তা ছুঁড়েছিলেন আল্লাহ।’ (সূরা আনফালঃ ১৭)
এই হচ্ছে মুমিন ও সৎ লোকদের শক্তিমত্তার কথা। অপরদিকে এটাও আল্লাহর চিরন্তর নিয়ম যে, যে ব্যক্তি ঈমানদার ও সচ্চরিত্রবান, যার আচরণ ও ক্রিয়াকান্ড স্বার্থপরতার কলুষতা থেকে মুক্ত, যে প্রবৃত্তির অভিরুচি ও জৈবিক বাসনার পরিবর্তে আল্লাহর নির্ধারিত বিধানের যথাযথ পায়রবী করে-তার জন্যে লোকদের মনে প্রীতির আসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। লোকদের মন স্বভাবতই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের সশ্রদ্ব দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ হয়। লেনদেন ও কাজ কারবারে নিশ্চিন্তে তার প্রতি নির্ভর করা যায়। শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সবাই তাকে সত্যবাদী বলে মনে করে এবং তার শালীনতা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার ওপর ভরসা করেঃ
(আরবী)
অর্থঃ যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে, আল্লাহ লোকদের অন্তরে তাদের প্রতি ভালোবাসার সঞ্চার করবেন।’ (সূরা মরিয়মঃ ৯৬)
(আরবী)
অর্থঃ আল্লাহ ঈমানদার লোকদেরকে একটি সুদৃঢ় বাণীর সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করে দেন- দুনিয়ার জীবনে এবং আখিরাতেও।’ (সূরা ইব্রাহীমঃ ২৭)
(আরবী)
অর্থঃ যে ব্যক্তি সৎ কাজ করবে, সে পুরুষ হোক আর নারী, মুমিন হলে অবশ্যই আমরা তাকে উত্তম জিন্দেগী প্রদান করবো এবং তার উত্তম কৃতকর্মের প্রতিফলন দান করবো।’ (সূরা নাহলঃ ৯৭)
কিন্তু এগুলো কিসের ফলাফল? কেবল মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করার, মুসলমানের নাম রাখার, কতিপয় নির্দিষ্ট সামাজিক রীতি গ্রহণ করার এবং কয়েকটি হিসাব করা রসম রেওয়াজ পালন করার ফল এগুলো নয়। এই ফলাফল প্রকাশের জন্যে কুরআনে হাকীম ঈমান ও নেক কাজের শর্ত আরোপ করেছে। তার লক্ষ্য হচ্ছে এই যে, তাদের চিন্তাধারা, ধ্যান ধারণা, নৈতিক চরিত্র, কাজ কারবার সর্বত্রই তার কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে। তাদের গোটা জীবনধারা এই পবিত্র কালেমার যথার্থ ছাঁচে গড়ে উঠবে, তাদের মন মগজে এই কালেমার বিপরীত কোনো কল্পনাই ঠাঁই পাবেনা এবং তার প্রতিকুল কোনো কজেও তারা লিপ্ত হবেনা। বস্তুত মুখে লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করার ফল এমনিভাবে প্রকাশ পেতে হবে যে, উচ্চরণের সঙ্গে সঙ্গেই লোকদের জীবনে এক প্রচন্ড বিপ্লব সৃষ্টি হবে, তাদের শিরা উপশিরায় তাকওয়ার ভাবধারা অনুপ্রবিষ্ট হবে। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শক্তির সামনে তাদের মস্তক নতো হবেনা। আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে তাদের হাত প্রসারিত হবেনা। তাদের হৃদয়ে আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় থাকবেনা। তাদের ভালবাসা ও শত্রুতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্যে হবেনা। আল্লাহর বিধান ছাড়া আর কারো বিধান তাদের জীবনে কার্যকর হবেনা। আপন প্রবৃত্তি ও তার যাবতীয় বাসনা এবং তার কাম্য ও মনোপুত বস্তুগুলোকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কুরবানী করতে তারা হামেশা প্রস্তুত থাকবে। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশের সামনে কেবল ‘শুনলাম ও মেনে নিলাম’-এটুকু বলা ছাড়া তাদের আর কোনোই কথা ও কাজ থাকবেনা। এমনি অবস্তা যখন সৃষ্টি হবে, তখন তাদের শক্তি কেবল নিজেদের প্রাণ ও দেহের শক্তিই হবেনা; বরং তা হবে সেই মহপরাক্রমশালীর শক্তি, যার সামনে আসমান ও জমিনের প্রতিটি জিনিসই অবনমিত হয়ে আছে। তারা সেই মহাজ্যোতির্ময়ের দীপ্তিতে দীপ্তিমান হবে, যিনি তামাম জাহানেরই প্রকৃত মাহবুব ও মাশুক।
নবী করীম সা. ও খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে এই বস্তুটিই ছিলো মুসলমানদের আয়ত্তাধীন। অতপর এর কী ফলাফল প্রকাশ পেয়েছিল ইতিহাসই তার সাক্ষী। সে যুগে যে ব্যক্তিই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কথাটি উচ্চারণ করেছে, তার গোটা আকৃতিই বদলে গিয়েছে। কাঁচা তামা থেকে সে হঠাৎ নিখাঁদ সোনায় পরিণত হয়েছে, তার ভেতরে এমনি আকর্ষণ শক্তির সৃষ্টি হয়েছে যে, লোকদের হৃদয় স্বভাবতই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তার প্রতি কারো দৃষ্টি পড়লেই সে অনুভব করেছে, যেনো তাকওয়া ও পরহেযগারীর জীবন্ত প্রতিমূর্তি সে প্রত্যক্ষ করছে। সে হয়তো অশিক্ষিত, দরিদ্র, উপবাসী, ছেড়া কাপড় পরিহিত এবং চাটাইয়ের ওপর উপবিষ্ট ছিলো, তবু লোকদের হৃদয় মনে তার ভীতি এমনি আসন জুড়ে বসতো, যা বড় বড় জমকালো শাসকদের ভাগ্যেও জুটতোনা। একজন মুসলমানের অস্তিত্ব ছিলো একটি দ্বীপের মতো; সে যেখানে থাকতো বা যেদিকেই যেতো, চারদিকে তার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়তো। সে দীপের সাহায্যে লক্ষ লক্ষ দীপ দীপ্তিমান হতো। পরন্তু সে দীপ্তিকে যে গ্রহণ না করতো, কিংবা তার সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধাতে চাইতো, তাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবার ক্ষমতাও রাখতো।
এমনি ঈমানী শক্তি ও চরিত্রের অধিকারী মুসলমানই তারা ছিলো যে, তাদের সংখ্যা যখন মাত্র সাড়ে তিন শো’র মতো ছিলো, তখন গোটা আরবকেই তারা প্রতিদ্বন্দিতার জন্যে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলো। আর যখন তাদের সংখ্যা কয়েক লক্ষে গিয়ে উন্নিত হলো, তখন গোটা দুনিয়াকেই তারা পদানত করবার দুর্বার সংকল্প নিয়ে এগিয়ে এলো এবং তখন তাদের মোকাবিলায় যে শক্তি এসে দাঁড়িয়েছে, চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
উপরে যেমন বলা হয়েছে, মুসলমানদের প্রকৃত শক্তি হচ্ছে এমনি ঈমান ও সচ্চরিত্রের শক্তি। এ শক্তি কেবল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কথাটির তাৎপর্য হৃদয় মনে বদ্ধমূল হবার ফলেই অর্জিত হতে পারে। কিন্তু এই তাৎপর্য যদি অন্তরে দৃঢ়মূল না হয়, কেবল মুখেই এই শব্দটি উচ্চারিত হতে থাকে এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মজীবনে কোনো বিপ্লবের সৃষ্টি না হয়- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলার পরও যদি মানুষের অবস্থা অবিকল পূর্বের মতোই থাকে এবং তার ও এই কালেমায় অবিশ্বাসীদের মতো গায়রুল্লাহকে ভয় করে তার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তার প্রেমে আসক্ত হয়, তাদেরই মতো ইচ্ছা প্রবৃত্তির গোলাম হয়, আল্লাহর বিধান ত্যাগ করে মানবীয় আইন কিংবা আপন প্রবৃত্তির আনুগত্য করে, তার চিন্তাধারা, ইচ্ছা বাসনা ও মনন শক্তিতে একজন অমুসলিমের চিন্তা বাসনা মননের ন্যায়ইকলুষতা থাকে, তার কথাবার্তা, কাজকর্ম ও আচার ব্যবহারও যদি একজন অমুসলিমের মতোই হয়, তাহলে মুসলমান কিসের ভিত্তিতে অমুসলমানের ওপর প্রতিপত্তি লাভ করবে?ঈমান ও তাকওয়ার শক্তি না থাকলে মুসলমান ঠিক অমুসলমানের মতোই একজন মানুষ বৈ তো কিছু নয়! অত:পর মুসলমান ও অমুসলমানের প্রতিযোগিতা কেবল দৈহিক শক্তি ও বস্তুগত উপকরণের ভিত্তিতেই হবে এবং এ প্রতিযোগিতায় যে শক্তিমান, সে-ই দুর্বলের ওপর বিজয়ী হবে।
এ দুটি অবস্থার পার্থক্য ইতিহাসের পাতায়ও এমনি সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে যে, এক নজরেই তা প্রত্যক্ষ করা চলে। কোথাও হয়ত দেখা যাবে যে, মুষ্টিমেয় মুসলমান বড় বড় রাষ্ট্রশক্তিকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে এবং আটকের[ পাঞ্জাব ও সীমান্তের মধ্যস্থলে অবস্থিত সিন্ধুর একটা উপনদী] দুই তীর থেকে আটলান্টিকের উপকূল পর্য্যন্ত ইসলামের কর্তৃত্বকে বিস্তৃত করে দিয়েছে। অপরদিকে আজকে যেমন দেখা যাচ্ছে, কোটি কোটি মুসলমান দুনিয়ায় বাস করছে, অথচ তারা অমুসলিম শক্তির পদানত হয়ে আছে। পরন্তু যে জনপদগুলোতে কোটি কোটি মুসলমান কয়েক শতক ধরে বসবাস করছে, সেখানেও আজ কুফর ও শিরকের প্রাবল্যই বর্তমান রয়েছে।