১৩
সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ ও বাঁচার উপায়
[প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম ১৯৩৫ সালের মার্চে তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। – সম্পাদক]
কুরআন মজীদে এই সত্যটি একটি সাধারন নীতি হিসেবে বিবৃত হয়েছে যে, কোনো জাতি সৎকর্মশীল হলে আল্লাহ তাআলা তাকে অযথা ধ্বংস করে দেবেন-তিনি এমন জালিম ননঃ
(আরবী)
অর্থঃ তোমাদের প্রভূ এমন নন যে, তিনি জনপদগুলোকে অন্যায়ভাবে ধ্বংস করে দেবেন- যদি তার বাসিন্দারা সৎকর্মশীল হয়।(সুরা হুদঃ১১৭)
ধ্বংস ও বিনাশ করার মানে কেবল জনপদগুলোকে বিপর্যস্ত করা এবং তার অধিবাসীকে মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করাই নয়; বরং তার একটি বিশিষ্ট পন্থা হলোঃ জাতিসমুহকে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন করে দেয়া,তাদের সামগ্রিক শক্তিকে চূর্ন করে ফেলা এবং তাদেরকে পরাভূত ও পদানত, লাঞ্চিত ও অপমানিত করা। তবে উল্লিখিত নীতির ভিত্তিতে কোনোরূপ ধ্বংস ও বিনাশ কোনো জাতির উপর ততোক্ষন পর্যন্ত আপতিত হতে পারেনা, যতক্ষন না সে কল্যান ও সংস্কারের পথ বর্জন করে অনিষ্ট, বিশৃংখলা, অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের পথে চলতে থাকে এবং এভাবে নিজেই নিজের জন্যে জুলুম ডেকে আনে। এই নীতিকে সামনে রেখে আল্লাহ তায়ালা যেখানেই কোনো জাতিকে আযাবে নিক্ষেপ করার কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে তাদের অপরাধের কথাও সঙ্গে সঙ্গে বিবৃত করেছেন- যাতে করে লোকেরা উত্তমরূপে জানতে পারে যে, তাদের আপন কর্মদোষেই আদের ইহকাল ও পরকাল বরবাদ হয়ে থাকেঃ
(আরবী)
অর্থঃ ‘প্রত্যেককেই আমরা তার অপরাধের জন্যে পাকড়াও করেছি। আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুমকারী ছিলেননা; বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিলো’। (সুরা আনকাবুতঃ৪০)
এই নীতি থেকে উদ্ভুত দ্বিতীয় বিষয়টি হলো এই যে, ধ্বংস ও বিনাশের কারণ ব্যক্তিগত পাপাচার নয়; বরং সামগ্রিক তথা জাতীয় ও জাতীয় পাপাচার। অর্থাৎ বিশ্বাস ও আচরণের বিকৃতি যদি লোকদের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে দেখা যায়, কিন্তু মোটামুটিভাবে লোকদের ধর্মীয় ও নৈতিক মান উন্নত হয় এবং তার প্রভাবেব্যক্তিগত অনাচার চাপা পড়ে থাকে, তাহলে পৃথক পৃথকভাবে ব্যক্তিরা যতোই খারাপ হোক না কেন, সামগ্রিকভাবে জাতি বেঁচে থাকেই। সে অবস্থায় এমন কোন ফিতনার সৃষ্টি হয়না, যা গোটা জাতির বিনাশের কারন হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস ও আচরণের বিকৃতি যখন ব্যক্তিকে অতিক্রম করে গোটা জাতির মাঝে ব্যাপ্তিলাভ করে এবং জাতির ধর্মবোধ ও নৈতিক চেতনা একেবারে বিগড়ে যায়, আর তাতে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণেরই বিকাশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন সে জাতির ওপর থেকে আল্লাহ তায়ালার কৃপা দৃষ্টি একেবারে উঠে যায়। অতঃপর সে সম্ভ্রমের উচ্ছাসন থেকে অপমানের নিম্নস্তরে নামতে থাকে। এমনকি এক সময় আল্লাহ তায়ালার কোপানল তার বিরদ্ধে প্রজ্বলিত হয়ে উঠে এবং তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস ও বরবাদ করে দেয়া হয়।
কোরআন হাকীমে এর বহুতরো দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
হজরত নূহের জাতির মধ্যে যখন বিশ্বাস ও আচরণের বিকৃতি শিকড় গেড়ে বসলো এবং চারিদিকে তা বিস্তৃতি লাভ করলো, এবং সেই সঙ্গে এই বিষবৃক্ষ থেকে মিষ্টি ফল লাভের আশাও একেবারে তিরোহিত হয়ে গেলো, তখনই তাকে ধ্বংস করে দেয়া হলো। শেষ পর্যন্ত হজরত নুহ (আঃ) বাধ্য হয়ে রব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করলেনঃ
(আরবী)
অর্থঃ আমার প্রভু! দুনিয়ার বুকে এই কাফিরদের মধ্য থেকে একজনকেও জীবিত রেখোনা। তুমি যদি এদেরকে বাঁচিয়ে রাখো তো তোমার বান্দাদের গুমরাহ করে ফেলবে এবং এদের বংশ থেকে শুধু কদাচারী ও নিরেট অবিশ্বাসীরাই জন্মলাভ করবে। (সুরা নুহঃ ২৬-২৭)
আদ সম্প্রদায়কে তখনি ধ্বংস করা হলো, যখন তার অন্তরে পাপাচার একেবারে শিকড় গেড়ে বসলো, জালিম, দুর্বৃত্ত ও বিপর্যয়কারী লোকেরা তাদের নেতা ও শাসকের মর্যাদা লাভ করলো এবং কল্যাণ ও মঙ্গলকামী লোকদের জন্যে সামাজিক-সামগ্রিক ব্যবস্থায় কোন স্থানই বাকী রইলোনাঃ
(আরবী)
অর্থঃ আ’দ সম্প্রদায় তাদের প্রভুর আদেশকে অগ্রাহ্য করলো এবং তার রাসুলদের অবাধ্যতা করলো আর প্রত্যেকে উদ্ধত সত্য দুশমনের আনুগত্য করলো। (সুরা হুদঃ ৫৯)
লুত সম্প্রদায়কে তখনি ধ্বংস করা হলো, যখন তাদের নৈতিক চেতনার চরম অবনতি ঘটলো এবং নির্লজ্জতা আতোখানি বৃদ্ধি পেলো যে, প্রকাশ্য মজলিস ও হাট বাজারে পর্যন্ত ব্যভিচার হতে লাগলো, এমনকি ব্যভিচারকে ব্যভিচার মনে করার মতো অনুভূতি লোকদের মধ্যে বাকি রইলোনাঃ
(আরবী)
অর্থঃ (লুত বললেন), তোমরা কেন মেয়েদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো এবং পথচারীদের উৎপাত করো আর (প্রকাশ্যে) মজলিসে বসে ব্যভিচার করো?
(সুরা আনকাবূতঃ ৯)
মাদায়েনবাসীদের ওপর থিক তখনি গযব নাযিল হলো, যখন গোটা জাতি বেঈমান, প্রবঞ্চক ও বিশ্বাসঘাতকে পরিনত হলো। ওজনে কম দেয়া ও বেশি নেয়া কোনো দূষণীয় কাজ রইলোনা। জাতির নৈতিক চেতনা এতোখানি বিলুপ্ত হলো যে, এহেন দূষণীয় কাজের জন্য তিরস্কার করা হলে তারা লজ্জায় মাথা নতো করার পরিবর্তে উল্টো তিরস্কারকারীকেই তিরস্কার করতো। এমনকি তাদের কোনো কাজ যে তিরস্কার যোগ্য হতে পারে, এ কথাটিই তাদের বোধগম্য হতোনা। তারা ব্যভিচার কে দূষণীয় মনে করতোনা, বরং এই কাজটিকে যে ব্যক্তি মন্দ বলতো, তাকেই ভ্রান্ত ও নিন্দার্হ বিবেচনা করতোঃ
(আরবী)
অর্থঃ (শুয়াইব বললেন), হে আমার জাতি! ইনসাফের সাথে মাপো এবং ওজন করো, তাদের জিনিসপত্র কম দিওনা এবং দুনিয়ায় ফাসাদ ছড়িয়োনা। তারা বললো, হে শুয়াইব! তুমি যা কিছু বলছো, তার অধিকাংশই আমাদের বোধগম্য হচ্ছেনা। আমরা তোমাকে খুবই দুর্বল দেখতে পাচ্ছি। যদি তোমার গোত্রটি না থাকত তো আমরা তোমায় ‘সঙ্গেসার’ করে দিতাম। (সুরা হুদঃ ৮৫-৯১)
বনী ইসরাইলকে অপমান, লাঞ্ছনা ও গযব-অভিশাপের মধ্যে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত তখনি কার্যকরী হলো, যখন তারা জুলুম, দুষ্কৃতি ও হারামখোরীর দিকে ছুটতে লাগলো। তাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে সুবিধাবাদের ব্যাধি সঙ্ক্রমিত হলো। সাধারন লোকদের মধ্যে পাপাচারের সঙ্গে সমঝোতার মনোভাব সৃষ্টি হলো এবং অন্যায়কে অন্যায় বলা এবং তার থেকে বিরত রাখার মতো কোনো মানবগোষ্ঠী বাকি রইলোনাঃ
(আরবী)
অর্থঃ তুমি তাদের অধিকাংশকেই দেখছো যে, পাপাচার ও খোদা নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন এবং হারামখোরীর দিকে ছুটে চলেছে। তারা কিরুপ নিকৃষ্ট কাজ করে যাচ্ছিলো! তাদের পীর ও আলেমরা কেন তাদেরকে মন্দ কথা বলতে এবং হারাম মাল খেতে বারন করলনা? তারা অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ করছিলো। (সুরা মায়েদাঃ ৬২-৬৩)
(আরবী)
অর্থঃ বনী ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফরী করলো, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা বিন মরিয়মের ভাষায় লানত করানো হলো, এই জন্যে যে, তারা বিদ্রোহ করেছিলো এবং সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিল। তারা অপরকে দুষ্কর্ম থেকেও বিরত রাখতোনা। (সুরা মায়েদাঃ ৭৮-৭৯)
এই সর্বশেষ আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নবী করীম (সাঃ) থেকে যে হাদিসগুলো বর্ণিত আছে, কোরআন কারীমের উদ্দেশ্যকে তা আরো সুস্পষ্ট করে তোলে। হাদিসগুলোর সার সংক্ষেপ হলো- নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ
বনী ইসরাইলের মধ্যে যখন পাপাচার বিস্তৃতি শুরু হলো, তখনকার অবস্থা ছিলো এই যে, এক ব্যক্তি তার ভাই, বন্ধু বা পড়শীকে দুষ্কর্ম করতে দেখলে বারণ করতো। তাকে বলতো, “ওহে! খোদাকে ভয় করে চলো”। কিন্তু তারপর সে (প্রথমোক্ত) লোকটি তারই সাথে মেলামেশা ও ওঠাবসা করতো। এমনকি ঐ পাপাচারী লোকটির দুষ্কৃতি প্রত্যক্ষ করেও তার সঙ্গে মেলামেশা ও পানাহারে অংশগ্রহণ করতে সে বিরত হতোনা। অবস্থা যখন এমনি দাঁড়ালো, তখন তাদের একের উপর অন্যে প্রভাব বিস্তার করলো। ফলত আল্লাহ সবাইকে এক রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দিলেন এবং তাদের নবী দাউদ ও ইসা বিন মরিয়মের ভাষায় তাদের ওপর অভিসম্পাৎ করলেন।
বর্ণনাকারী বলেন যে, বক্তৃতা প্রসঙ্গে নবী করীম (সাঃ) এই পর্যন্ত এসেই আবেগের আতিশয্যে বসে পড়েন এবং বলেনঃ
যে মহান সত্তার হাতে আমার জীবন, তার শপথ! লোকদেরকে সুকৃতির আদেশ দেয়া ও দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখা, কাউকে অসৎ কাজ করতে দেখলে বাধা দান করা ও তাকে সৎপথে চালিত করা এবং এ ব্যাপারে কিছুমাত্র উদারতা না দেখানো তোমাদের প্রতি অবশ্য কর্তব্য। নচেত আল্লাহ তোমাদের একের মনের উপর অন্যের প্রভাব বিস্তার করে দেবেন এবং বনী ইসরাইলের মতোই তোমাদের উপর অভিসম্পাৎ করবেন।
বস্তুত বিশ্বাস ও আচরণের বিকৃতি হচ্ছে মহামারীর অনুরুপ। যে কোনো মহামারী প্রথমত কতিপয় দুর্বল লোককে আক্রমণ করে। এমতাবস্তায় আবহাওয়া ভালো হলে, স্বাস্থ্যরক্ষা বিভাগের প্রচেষ্টা সঠিক হলে, ময়লা ও আবর্জনা সাফ করবার ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট হলে এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তির যথাসময়ে চিকিৎসা করা হলে ব্যাধি আর ব্যাপক মহামারীর রুপ ধারন করতে পারে না, বরং জনসাধারণ তার আক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকতে পারে। কিন্তু একই ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা যদি অলস ও দায়িত্বহীন হয়, স্বাস্থ্যরক্ষা বিভাগ উদাসীন হয়, পরিচ্ছতা বিধানকারীরা ময়লা ও আবর্জনা প্রশ্রয় দেয়, তবে রোগ জীবাণু ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়াতে থাকে এবং আবহাওয়ার সাথে মিশে পরিবেশ কে অত্যন্ত খারাপ করে তোলে। ফলে তা স্বাস্থ্যের পরিবর্তে রোগের পক্ষে অনুকূল হয়ে উঠে। অবশেষে সমাজের সাধারণ লোকেরা যখন হাওয়া, পানি খাদ্য, পোশাক, বাড়ি মোটকথা কোনো জিনিসকেই ময়লা ও দুর্গন্ধ মুক্ত পায়না, তখন তাদের জিবনীশক্তি দুর্বল হতে থাকে এবং গোটা সমাজই ব্যাপক মহামারীর কবলে নিক্ষিপ্ত হয়। এমতাবস্থায় বড় শক্তিমান ব্যক্তির পক্ষেও রোগের কবল থেকে আত্মরক্ষা করা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। এমনকি খোদ চিকিৎসক, পরিচ্ছন্নতা বিধানকারী ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের সংরক্ষকরা পর্যন্ত রোগের কবলে নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে যারা নিজেদের ব্যাপারে অন্তত স্বাস্থ্যরক্ষার উপায়গুলো অবলম্বন করে নিয়মিত ওষুধাদি সেবন করে, তারাও ধংসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পায়না। কারণ তাদের কাছে বাতাসের বিষাক্ততা, পানির নোংরামি, খাদ্যবস্তুর দূষণীয়তা ও মাটির কলুষতার কি প্রতিকার আছে?
এরই পরিপ্রেক্ষিতে নৈতিকতা ও আচরণের বিকৃতি এবং চিন্তা বিশ্বাসের ভ্রষ্টতাকে অনুমান করে নেয়া যেতে পারে। আলিমরা হচ্ছেন জাতির চিকিৎসক। শাসক ও বিত্তবানরা তার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে দায়িত্বশীল। জাতির ঈমানী সম্ভ্রম ও সমাজের নৈতিক চেতনা হচ্ছে জীবনীশক্তির তুল্য। সামাজিক পরিবেশ হচ্ছে হাওয়া, পানি, খাদ্য, পোশাক ও বাড়ীর অনুরুপ। আর জাতীয় জীবনে ধর্ম ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে সুকৃতির আদেশ ও দুষ্কৃতির প্রতিরোধ হচ্ছে দৈহিক সুস্থতার দৃষ্টিতে পরিচ্ছন্নতার ও স্বাস্থ্যরক্ষা সংক্রান্ত প্রচেষ্টার সমতুল্য। এমতাবস্থায় আলিম ও শাসক সম্প্রদায় যখন তাদের আসল দায়িত্ব – অর্থাৎ সুকৃতির প্রতিরোধ পরিহার করে দুষ্কৃতির ও বিকৃতির সঙ্গে আপোষরক্ষা করতে থাকে, তখন জাতির মধ্যে অনাচার, পাপাচার ও অনৈতিকতা বিস্তার লাভ করতে থাকে। ফলে জাতির ইমানী সম্ভ্রম ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। এমনকি পরিণামে গোটা সামাজিক পরিবেষই বিকৃতিদুষ্ট হয়ে যায়। জাতির জীবন পরিবেশ কল্যাণ ও সুকৃতির জন্যে প্রতিকূল এবং দুষ্কৃতি ও বিকৃতির জন্যে অনুকূল হয়ে উঠে। লোকেরা সুকৃতির দিক থেকে পালাতে থাকে এবং দুষ্কৃতিকে ঘৃণা করার পরিবর্তে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। লোকদের নৈতিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণ বদলে যায়। দোষ গুনের স্থান আর গুন দোষের স্থান দখল করে বসে। এমতাবস্থায় গোমরাহী, কদাচার ও অনৈতিকতা ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠে। কল্যাণ ও সুকৃতির কোনো বীজেরই প্রস্ফুটিত ও ডালপালায় পল্লবিত হবার সামর্থ্য থাকেনা। মাটি, হাওয়া, সবই তাকে প্রতিপালন করতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ তাদের সমগ্র শক্তিই বিষবৃক্ষের বিকাশ বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত হয়ে যায়। বস্তুত কোনো জাতির সামগ্রিক অবস্থা যখন এই পর্যায়ে এসে পৌছে, তখনি সে খোদায়ী আযাবের উপযোগী হয়ে উঠে। তার প্রতি এমন ধ্বংসলীলা অবতীর্ণ হতে থাকে যে, তার কবল থেকে কেউ নিষ্কৃতি পেতে পারেনা। এমনকি কেউ খানকার মধ্যে আত্মগোপন করে দিনরাত ইবাদত বান্দেগিতে মশগুল থাকলেও তার রেহাই নেই। এই অবস্থা সম্পর্কেই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী)
অর্থঃ সেই ফেতনাকে ভয় করো, যা শুধু তোমাদের মধ্যকার জালিম ও পাপাচারী লোকদেরকেই দুর্যোগের মধ্যে নিক্ষেপ করবেনা। (সুরা আনফালঃ ২৫)
এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ ‘এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় হচ্ছে এই যে, তোমরা দুষ্কৃতিকে নিজেদের সামনে দৃঢ়মূল হতে দিওনা, কারণ দুষ্কৃতির সঙ্গে তোমরা আপোষ রফা করলে এবং তাকে বিস্তার লাভের সুযোগ দিলে আল্লাহর তরফ থেকে ব্যাপক আযাব নাযিল হবে এবং ভাল-মন্দ নির্বিশেষে সবাই তার কবলে নিক্ষিপ্ত হবে।‘ একটি হাদিস থেকে জানা যায় খোদ নবী করীম (সাঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যা দান করে বলেনঃ
(আরবী)
অর্থঃ ‘আল্লাহ বিশিষ্ট লোকদের কাজের জন্যে সাধারণ লোকদের আযাব দেননা, কিন্তু তারা যখন নিজেদের সামনে দুষ্কৃতিকে দেখতে থাকে এবং প্রতিরোধ করার শক্তি থাকতেও তাকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে না আসে, তখন বিশিষ্ট ও সাধারণ সবাইকে আল্লাহ আযাবের কবলে নিক্ষেপ করেন।‘
জাতির নৈতিক ও ধর্মীয় স্বাস্থ্যকে অটুট রাখবার সবচাইতে বড় উপায় হলো এই যে, তার প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যেই ইমানী সম্ভ্রম ও নৈতিক চেতনা বর্তমান থাকতে হবে। নবী করীম (সাঃ) একে একটি ব্যাপক অর্থপূর্ণ শব্দ “হায়া” যা লজ্জাশীলতা দ্বারা আখ্যায়িত করেছেন। “হায়া” হচ্ছে আসলে ঈমানেরই একটি শাখা। তিনি বলেছেনঃ (আরবী)লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ। এমনকি একবার হজরতের কাছে নিবেদন করা হলো যে, “হায়া” হচ্ছে আসলে দীনের একটি অংশ। তিনি বললেনঃ (আরবী) – বরং তা সম্পূর্ণ দীন।
হাদিসে উল্লেখিত ‘হায়া’ শব্দের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, দুষ্কৃতি ও পাপাচার দেখামাত্রই লোকদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রতিরোধ স্পৃহা জেগে উঠবে এবং হৃদয় মন তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করবে। এই গুণটি যার মধ্যে বর্তমান থাকবে, সে কেবল অন্যায় থেকে বিরতই হবে না; বরং অন্যের মধ্যেও এর অস্তিত্ব বরদাশত করবে না। দুষ্কৃতির প্রতি সে উদারতা দেখাবে না। জুলুম ও পাপাচারের সঙ্গে আপোষ রফা করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তার সামনে কোন দুষ্কর্ম অনুষ্ঠিত হলে তার ঈমানী সম্ভ্রম অমনি উদ্দীপিত হয়ে উঠবে। সে তাকে হাত বা মুখ দিয়ে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করবে কিংবা অন্তত তাকে নিশ্চিহ্ন করার আকাঙ্ক্ষায় তার হৃদয় মন উদ্বেল হয়ে উঠবেঃ
(আরবী)
অর্থঃ “ তোমাদের মধ্যে কেউ কোন দুষ্কৃতি দেখতে পেলে তাকে নিজ হাতে নিশ্চিহ্ন করবে, এতে অক্ষম হলে মুখ দিয়ে (চেষ্টা করবে), আর এতেও অক্ষম হলে অন্তর দিয়ে (ঘৃণা) করবে; আর এ হচ্ছে দুর্বলতম ঈমানের লক্ষণ!(মুসনাদে আহমদ)
(আরবী)
যে জাতির মধ্যে এ গুণটি সাধারণভাবে বর্তমান থাকবে, তার দীন ও ধর্ম সুরক্ষিত থাকবে। তার নৈতিক মনের কদাচ অবনতি ঘটবে না। কারণ তার প্রতিটি ব্যক্তিই হবে অপরের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ও জিজ্ঞাসাকারী। তার মধ্যে প্রত্যয় ও আচরণের বিকৃতি নাক গলানোরই পথ খুঁজে পাবে না।
প্রকৃতপক্ষে কুরআন মজীদের লক্ষ্যই হচ্ছে এমনি একটি আদর্শ সমাজ গঠন করা, যে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিই আন্তরিক ঝোঁক-প্রবণতা ও স্বাভাবিক লজ্জা সম্ভ্রম এবং নিজস্ব বিবেকের তাড়নায় জিজ্ঞাসাবাদ তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব পালন করবে এবং কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই খোদায়ী ফৌজদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেঃ
(আরবী)
অর্থঃ “এভাবে আমরা তোমাদেরকে এক ন্যায়পরায়ণ ও মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি যাতে করে তোমরা লোকদের উপর তত্ত্বাবধানকারী হও আর রাসুল তোমাদের প্রতি তত্ত্বাবধানকারী হন।“ (সূরা বাকারাঃ ১৪৩)
এ জন্যই বারবার মুসলমানদের বলা হয়েছে, সুকৃতির আদেশ দান এবং দুষ্কৃতির প্রতিরোধকরণ হচ্ছে তোমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। এটি প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও নারীর মধ্যে পরিস্ফুট হওয়া উচিতঃ
(আরবী)
অর্থঃ তোমরাই উৎকৃষ্ট জাতি; তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে লোকদের (কল্যাণের) জন্য। তোমরা (লোকদের) সুকৃতির আদেশ দাও এবং দুষ্কৃতির প্রতিরোধ করো আর আল্লাহ্র প্রতি ঈমান পোষণ করো।‘ (সূরা আলে ইমরানঃ ১১০)
(আরবী)
অর্থঃ মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের মদদগার; তারা সুকৃতির আদেশ দেয় আর দুষ্কৃতির প্রতিরোধ করে।(সূরা তওবাঃ ৭১)
(আরবী)
অর্থঃ তারা সুকৃতির আদেশদাতা, দুষ্কৃতির প্রতিরোধকারী এবং আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমা সংরক্ষণকারী।(সূরা তওবাঃ ১১২)
(আরবী)
অর্থঃ এদেরকে আমরা দুনিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতা দান করলে এরা নামায প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত দান করবে, সুকৃতির আদেশ দিবে আর দুষ্কৃতির প্রতিরোধ করবে। (সূরা হজ্জঃ ৪১)
মুসলমানদের অবস্থা যদি এরুপ হয়, তাহলে তাদেরকে এমন একটি লোকালয়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যার প্রতিটি বাসিন্দার মধ্যেই পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষাবোধ বর্তমান রয়েছে। তারা শুধু নিজেদের দেহ এবং গৃহকেই পাক সাফ রাখেনা; বরং লোকালয়ের যেকোনো জায়গায় ময়লা ও আবর্জনা দেখলে তা দূর করে ফেলে। তারা কোথাও ময়লা, আবর্জনা ও দুর্গন্ধ থাকতে দেয়ার পক্ষপাতী নয়। স্পষ্টত এমনি লোকালয়ের আবহাওয়া পাক সাফ ও পরিচ্ছন্ন থাকতে বাধ্য। এখানে রোগ জীবাণু সৃষ্টি হওয়ার কোন সুযোগই পাবে না। যদি ঘটনাচক্রে কেউ দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়েও পড়ে; তবু যথাসময়ে তার চিকিৎসা হবে; কিংবা অন্তত তার রোগটা ব্যক্তিগত রোগ পর্যন্ত সীমিত থাকবে অন্য লোকদের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে ব্যাপক মহামারীর রুপ ধারণ করবে না।
কিন্তু মুসলিম জাতি যদি এই উন্নত নৈতিক মান বজায় রাখতে না পারে, তাহলে সমাজের দীনি ও নৈতিক স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখার জন্য অন্তত একটি দল তাদের মধ্যে অবশ্যই বর্তমান থাকা উচিত। এই দলতি সর্বদা এই খেদমত আঞ্জাম দেয়ার জন্য তৈরি থাকবে এবং লোকদের চিন্তা বিশ্বাসের ময়লা ও স্বভাব চরিত্রের অপবিত্রতা দূর করতে থাকবে।
(আরবী)
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকা উচিত, যারা (লোকদেরকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সুকৃতির আদেশ দিবে এবং দুষ্কৃতির প্রতিরোধ করবে। (সূরা আলে ইমরানঃ ১০৪)
এই দলতি হচ্ছে আলিম ও শাসকবর্গের সম্মিলিত দল। এর পক্ষে সুকৃতির আদেশ দান ও দুষ্কৃতির প্রতিরোধে ব্যাপৃত থাকা ততোটাই আবশ্যক, শহরের পরিচ্ছন্নতা বিধান ও স্বাস্থ্যরক্ষা সংক্রান্ত বিভাগের পক্ষে আপনার দায়িত্ব সম্পাদনে সচেতন থাকা যতটা প্রয়োজন। এই শ্রেণীর লোকেরা যদি আপন কর্তব্য পালনে গাফিল হয়ে যায় এবং জাতির মধ্যে সুকৃতির দিকে আহবান ও দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখার মত একটি দলও বর্তমান না থাকে, তাহলে ধর্ম ও নৈতিকতার দিক থেকে জাতির বিনাশ ঠিক তেমনি নিশ্চিত, যেমন দেহ ও প্রাণের দিক থেকে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থাহীন লোকালয়ের ধ্বংস সুনিশ্চিত। প্রাচীন জাতিগুলোর উপর যে ধ্বংসলীলা অবতীর্ণ হয়েছে, তার কারণ এই যে, তাদেরকে দুষ্কৃতিতে বাধা দান এবং সুকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত রাখার মত কোন দলেরই অস্তিত্ব তখন ছিল নাঃ
(আরবী)
অর্থঃ তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মধ্যে অন্তত এমন শিক্ষিত ও জ্ঞানবান লোকই বা থাকলো না কেন, যারা দুনিয়ায় ফ্যাসাদ সৃষ্টি থেকে (লোকদেরকে) বিরত রাখত – কেবল যে কয়টি লোককে আমরা তাদের মধ্য থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি, তাদের ছাড়া। (সূরা হুদঃ ১১৬)
(আরবী)
অর্থঃ তাদের আলিম ও পীরগণ কেন তাদেরকে কুকথা বলা ও হারামখোরী থেকে বিরত রাখলোনা? (সূরা মায়েদাঃ ৬৩)
কাজেই এর থেকে প্রমানিত হচ্ছে যে, জাতির আলিম, পীর ও শাসকদের দায়িত্বই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তারা শুধু আপন কৃতকর্মের জন্যেই দায়িত্বশীল নন; বরং গোটা জাতির কৃতকর্মের দায়িত্ব অনেকটা তাদের উপর ন্যস্ত। জালিম, নিপীড়ক ও বিলাসপ্রিয় শাসক এবং তাদের তোষামোদকারী আলিম ও পীরদের কথা আর কি বলা যায়! আল্লাহ্র কাছে তাদের যে পরিণতি হবে, তার উল্লেখ করাই নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু যে শাসক, আলিম ও পীর সম্প্রদায় আপন লোকালয়, গৃহকোণ ও খানকার মধ্যে বসে তাকওয়া, পরহেজগারী, ইবাদত ও দরবেশীপনার পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছেন তারাও আল্লাহ্র কাছেজিজ্ঞাসাবাদ থেকে রেহাই পাবে না। কারণ তাদের জাতির উপর চারিদিক থেকে যখন গুমরাহী ও অনৈতিকতার ঝড় ঝঞ্চা ধেয়ে আসছে, তখন গৃহকোণে শুধু মাথা নুইয়ে বসে থাকা তাদের কাজ নয়; বরং তাদের কাজ হচ্ছে বীরপুরুষের ন্যায় ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়া আল্লাহ তাদেরকে যা কিছু শক্তিসামর্থ্য ও প্রভাব প্রতিপত্তি দান করেছেন, তার সাহায্যে ঐ ঝড় ঝঞ্চার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ঝড় ঝঞ্চা কে দূরীভূত করার দায়িত্ব অবশ্য তাদের উপর ন্যাস্ত নয়, কিন্তু তার মোকাবেলায় তার নিজের তামাম সম্ভাব্য শক্তি নিয়োজিত করার দায়িত্ব অবশ্যই তাদের উপর আরোপিত। এ কাজে তারা কিছুমাত্র অবহেলা করলে তাদের ব্যাক্তিগত ইবাদত বন্দেগী ও তাকওয়া পরহেজগারী তাদের পরলৌকিক জবাবদিহি থেকে মোটেই নিষ্কৃতি দেবে না। কোন শহরে যদি মহামারী বিস্তার লাভ করে এবং তাতে হাযার হাযার মানুষ মৃত্যুবরণ করতে থাকে আর এমতাবস্তায় পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষা বিভাগের কোন কর্মচারী নিজের ঘরে বসে শুধু নিজের ও সন্তান সন্ততির জীবন রক্ষায় চেষ্টা করতে থাকে, তবে এমন কর্মচারীকে কেউ কখনো নিরাপরাধী দায়িত্বশীল বলবে না। কোন সাধারন নাগরিক এরুপ করলে ততোটা আপত্তিকর হয় না, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষা বিভাগের কোন অফিসার এরুপ করলে তার অপরাধী হওয়ার ব্যাপারে কোনই সন্দেহের অবকাশ থাকে না।