১৭
ধর্ম বীর পুরুষের জন্যে, কাপুষের জন্যে নয়
[ প্রবন্ধটি সর্ব প্রথম ১৯৩৬ সালের মে মাসে তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।]
আমার ( সুদ ও আধুনিক ব্যংকিং ) গ্রন্থটি দেখে বারবার একটি মন্তব্য প্রকাশ করা হচ্ছে। তা হলো এই যে, বর্তমান যুগে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা রাজনৈতিক শক্তির পোষকতায় আমাদের চারিদিকের আর্থিক জগতের উপর কর্তৃত্বশীল হয়ে আছে। অর্থনীতির গোটা গাড়িই চালিত হচ্ছে পুঁজিবাদী নীতির নির্দেশিত পথে। শুধু পুঁজিবাদরা হচেছ এর পরিচালক আর এর সাহায্যে সেইসব জাতি প্রগতির পথে এগিয়ে চলছে, যাদের জন ধনোৎপাদন ও ধনব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো ধর্মৗয় বা নতৈকি বন্ধন নেই। অন্যদিকে আমাদের সামাজিক ও সামগ্রিক শক্তি আজ বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত। দুনিয়ার গোটা অর্থব্যবস্থা বদলে ফেলা তো দুরের কথা, নিজ জাতির মধ্যে ইসলামী অর্থব্যবস্থাকে পুরোপুরি কায়মে করতেও আমরা সামর্থ নই। এমতাবস্থায় আমাদের ধর্মীয় বন্ধন যদি আমাদের যুগের চলমান অর্থব্যবস্থায় পুরোপুরি অংশগ্রহণে বিরত রাখে, তাহলে আমাদের জাতির পক্ষে আর্থিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির উপায় উপকরণ থেকে উপকৃত হবার ব্যাপারে অন্যান্য জাতির চাইতে পেছনে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনোই ফলোদয় হবেনা। এর ফলে আমরা ক্রমাগত দরিদ্র হতে থাকবো, আর প্রতিবেশি জাতিগুলো ধনবান হতে থাকবে। পরন্তু এই আর্থিক দুর্বলতা নৈতিক রাজনৈতিক ও তামাদ্দুনিক দিক থেকেও আমাদের নিস্তেজ ও হীনবল করে ফেলবে। এ শুধু আন্দাজ অনুমানের কথা নয়;বরং বাস্তব দুনিয়ায়ও আমরা এই অবস্থাই দেখতে পাচ্ছি বছরের পর বছর ধরেই। আর ভবিষ্যতে আমাদের যে পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে, তার লক্ষণগুলোও এমনকিছু অস্পষ্ট ব্যাপার নয় যে, তা কারো চোখেই পড়বেনা। কাজেই শুধু শরিয়তের আইন রচনা করে আমাদের কী লাভ?ইসলামের আর্থিক নীতি বিবৃত করেই বা আমাদের কী ফায়দা?বরং এই পরিস্থিতিতে ইসলামের আইনের অনুসৃতির সাথে সাথে আমাদের আর্থিক দুরাবস্থারও প্রতিকার করা এবং উত্তোরোত্তর তরক্কির দিকে এগিয়ে চলার কোনো পথ আছে কিনা, আমরা তাই জানতে চাই। যদি তা না থাকে তো দুটি অবস্থার মধ্য থেকে একটির অবশ্যই মুখোমুখি হতে হবে – হয় মুসলমানরা সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে যাবে, নতুবা যেসব আইন কানুন যুগের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অক্ষম, অন্যান্য জাতির ন্যায় মুসলমানরাও সেগুলোর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হলো, এই প্রশ্নটি তো শুধু সুদ পর্যন্তই সীমিত নয় – এর পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও প্রশস্ত। যদি জীবনের তামাম দিক ও বিভাগের মধ্যে শুধু অর্থনৈতিক বিভাগেই একটি অনিসলামী ব্যবসা প্রতিষ্টিত থাকতো, তাহলে বিষয়টি হয়তো তুলানামূলক ভাবে হালকা হতো। কিন্তু বাস্তব অবস্থা অন্য রকম। নিজের চারিদিকের দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন – খোদ নিজের অবস্থাটা পর্যালোচনা করে দেখুন। অনিসলামী প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে জীবনের কোন্ দিকটি মুক্ত রয়েছে?ধর্মবিস্বাস, চিন্তধারা ও মতাদর্শের ওপর কি জড়বাদ ও নাস্তিকতা কিংবা অন্তত সন্দেহ ও সংশয়ের প্রাধান্য বিস্তৃত নয়?শিক্ষা ব্যাবস্থার ওপর কি খোদাবিমূখতা কর্তৃত্বশীল নয়?তাহযীব ও তমদ্দুনের ওপর কি ফিরিঙ্গীপনার প্রভুত্ব কায়েম নয়?পাশ্চাত্যপনা কি সমাজের গভীর তলদেশ অবধি দৃঢ়মূল নয়?তার প্রতপিত্তি থেকে নৈতিক চরিত্র কি নিরাপদ?লেনদেনের ব্যাপারে কি তার প্রাধান্য থেকে মুক্ত?আইন কানুন ও রাষ্ট্রনীতি, সরকারী পলিসি ও কর্মধারা, মতাদর্শ ও কর্মকান্ড এর কোনো একটিও কী তার প্রভাব থেকে মুক্ত?
পরিস্থিতি যখন এই, তখন আলোচ্য প্রশ্নটিকে এবং তারও একটি মাত্র দিকের মধ্যে কেন সীমিত রাখতে চান?একে আরো ব্যাপক ও প্রশস্ত করে তুলুন এবং সমগ্র জীবনের উপর ছড়িয়ে দিন। বরং বলুন যে, জীবননদী তার গতিপথ বদলে ফেলেছে। প্রথমে সে ইসলামের পথে প্রবহমান ছিলো, এখন সে অনিসলামী পথে প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা তার গতিপথ বদলাতে সক্ষম নই। এমনকি তার স্রোাতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটবার মতো শক্তি সামর্থও আমাদের নেই। অথচ আমাদের দাঁড়িয়ে থাকাতেও রয়েছে মৃত্যুর বিভিষিকা। এমতাবস্থায় আমরা মুসলমানও থাকতে পারি আর এই প্রবহমান নদীর স্্েরাতে নিজেদের তরীও ভাসিয়ে দিতে পারি – আমাদেরকে এমন কোনো পথ দেখানো হউক। অর্থাৎ আমরা কা’বার যাত্রিও থাকব আর তুর্কীস্থানগামী কাফেলার সঙ্গেও সম্পর্ক রাখবো। আমরা আমাদের ভাবধারা, মতাদর্শ, জীবনলক্ষ্য, জীবনাদর্শও কর্মপন্থায় অমুসলমানও হবো আবার মুসলমানও থাকব। যদি এই বৈপরীত্যগুলোকে কেউ একত্রিত করার কোনো পথনির্দেশ দান করতে না পারেন, তাহলে তার পরিণতিতে হয় আমরা এই নদীর তীরেই বসে থাকব, নতুবা আমাদের নৌকার ওপর আঁটা ইসলামের এই লেবেলটিকে একদিনে ছেঁড়ে ফেলব। অতপর অন্যান্য নৌকার সাথে আমাদের এই নৌকাটিও নদীর স্রোতে সমানে চলমান দেখা যাবে।
আমাদের আলোকপ্রাপ্ত ও ’প্রগতিবাদী’ রা যখন কোনো সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেন, তখন তারা সর্বশেষ যুক্তি হিসেবে – যা তাদের কাছে সবচাইতে শক্তিশালী যুক্তি বলে পরিগণিত – বলেন যে, এ হচ্ছে যুগের ধর্ম, এ দিকেই হাওয়ার গতি প্রবাহিত, দুনিয়ায় এরকমই হচ্ছে! সুতরাং আমরা কি করে এর বিরোধিতা করতে পারি?আর বিরোধিতা করেই বা কিভাবে বেঁচে থাকতে পারি! নৈতিকতার প্রশ্ন তোলা হলে এরা বলেন, দুনিয়ার নৈতিক মানদন্ড বদলে গিয়েছে। এর মানে হল মুসলমানরা সেই পুরনো নৈতিক মানকে কী করে আঁকড়ে থাকতে পারে?পর্দা সম্পর্কে এরা বলেন, দুনিয়া থেকে পর্দার চলন উঠে গিয়েছে। অর্থাৎ যে জিনিসটি দুনিয়া হতে উঠে গিয়েছে, মুসলমানরা তাকে কি না উঠিয়ে পারে?শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা হলে এর সর্বশেষ দলিল হিসেবে এরা বলেন, দুনিয়ায় ইসলামী শিক্ষার চাহিদা নেই। এর উদ্দেশ্য হলো, বাজারে যে বস্তুটির চাহিদা নেই, মুসলমান শিশু তেমনি বস্তু কি করে হতে পারে?আর যেরূপ পণ্যের চাহিদা আছে, তেমনি পণ্য সে হবেনা কেন?সুদ সম্পর্কে আপত্তি তোলা হলেই এরা বলেন, এখন সুদ ছাড়া দুনিয়ায় কাজ চলতে পারে না। আর দুনিয়ার কাজ সম্পাদনের জন্যে যে জিনিসটি নিতান্ত আবশ্যক, মুসলমান তা কি করে পরিহার করতে পারে?ফলকথা, শিক্ষা, নৈতিকতা, সমাজ, তমদ্দুন, অর্থনীতি, আইন কানুন, রাজনীতি এবং জীবনের অন্যান্য যে কোন বিভাগে তারা ইসলামী নীতি বর্জন করে ফিরিঙ্গীপনার অনুসরন করতে চায়, তার জন্যে যুগের ধর্ম, হাওয়ার গতি ও দুনিয়ার চলনই তাদের কাছে অকাট্য দলিল হয়ে দাঁড়ায়। আর এই দলিলটিকে পাশ্চাত্যনুসরণ তথা আংশিক ধর্মত্যাগের বৈধতার পক্ষে হাতিয়ার ভেবে পেশ করা হয় এবং ধারণা করা হয় যে, এই দলিলের দ্বারা ইসলামী ইমারতের যে অংশটির ওপরই হামলা করা সম্ভব, তাকে ধ্বসিয়ে দেয়াই কর্তব্য।
আমরা বলি, ভাঙ্গাচুরার এই প্রস্তাবগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে পেশ না করে সবগুলো মিলিয়ে একটি পুর্ণাঙ্গ প্রস্তাব কেন তৈরি করেননা?গৃহের এক একটি দেয়াল, এক একটি খুঁটি এবং এক একটি কামরাকে বিধ্বস্ত করার পৃথক পৃথক প্রস্তাব তৈরি করায় এবং প্রতিটি বিষয়ের উপর স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করায় তো অযথা সময়ের অপচয় হয়। তার চাইতে এটা কেন বলেন না, গোটা বাড়িটাই ধ্বসিয়ে দেয়া দরকার। কেননা এর রং যুগের রং থেকে ভিন্ন, এর গতি হাওয়ার গতির বিপরীত, এর গঠন প্রকৃতি দুনিয়ার প্রচলিত ইমারতগুলোর গঠন প্রকৃতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।
যারা প্রকৃতই এমনি চিন্তাধারা পোষণ করেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করা নিস্ফল। তাদের জন্যে তো সোজা ও সুস্পষ্ট জবাব হচ্ছে এই যে, এই বাড়িটা ধ্বসানো এবং এর জায়গায় অন্য বাড়ি তৈরি করার ঝুঁকি কেন আপনারা গ্রহন করেছেন?অন্য যেসব সুন্দর, সুদৃশ্য ও সুরম্য বাড়ি আপনাদের পছন্দ হয় সেখানেই গিয়ে উঠুন। যদি নদীর স্রোতে প্রবাহিত হবারই ইচ্ছা হয় তো এই নৌকার লেবেল ছেঁড়ার কষ্ট কেন স্বীকার করতে যাবেন?যেসব নৌকা আগে থেকেই প্রবাহিত হচ্ছে, তার কোনো একটিতেই জায়গা করে নিন। যারা আপন চিন্তাধারা, নৈতিকতা, সামাজিকতা, অর্থনীতি, শিক্ষাদীক্ষা তথা জীবনের কোনো একটি জিনিসেও মুসলমান নয় এবং মুসলমান থাকতে ইচ্ছুক নয়, তাদের নামমাত্র মুসলমান থাকায় ইসলামের আদৌ কোনো ফায়দা নেই; বরং ক্ষতিই সমধিক। তারা খোদা পূজারী নয়, হাওয়া পূজারী। দুনিয়ায় যদি মূর্তি পূজার প্রাবল্য দেখা দেয় তো এরা নিশ্চিতভাবে মূর্তি পূজা শুরু করে দেবে। দুনিয়ায় যদি নগ্নতার প্রচলন হয় তো এরা অবশ্যই পরিধেয় বস্ত্র খুলে ফেলবে। দুনিয়ায় যদি অপবিত্র বস্তু খাওয়ায় শুরু হয় তো এরা নিসন্দেহে অপবিত্রতাকে বলবে পবিত্রতা, আর পবিত্রতাকে অপবিত্রতা। এদের মন মগজ হচ্ছে গোলাম, তাই গোলামীর জন্যে এরা উন্মুখ হয়ে আছে। এদের জীবনে ফিরিঙ্গীপনার প্রাবল্য রয়েছে, এজন্যেই নিজেদের গোপন থেকে প্রকাশ্য পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরা ফিরিঙ্গী হতে ইচ্ছুক। আবার কাল যদি হাবশীদের প্রাধান্য দেখা দেয়, তাহলে অবশ্য এরা হাবশী হবার প্রয়াস পাবে নিজেদের মুখমন্ডলে কালি মেখে নেবে, ওষ্টাধর মোটা করবে, মাথার চুল হাবশীদের ন্যায় কুঞ্চিত করবে এবং হাবশীদের কাছ থেকে আগত প্রতিটি জিনিসেরই পূজা শুরু করে দেবে। ইসলামের পক্ষে এমন গোলামদের কোনোই প্রয়োজন নেই। যদি কোটি কোটি লোকের তালিকা থেকে এসব মুনাফিক ও গোলামি প্রবৃত্তির লোকের নাম বাদ দেয়া হয়:
(আরবী)
অর্থ: তারা আল্লাহকে ভালোবাসে, আল্লাহও তাদের ভালবাসেন। তারা মুমিনদের প্রতি ন¤্র, কাফিরদের প্রতি কঠোর। তারা আল্লাহর পথে লড়ে, চলে এবং একাজে কারো তিরস্কারের ভয় করেনা। ” (সূরা মায়েদা : ৫৪)
এমনি চরিত্রবিশিষ্ট মাত্র কয়েক হাজার মুসলমান থেকে যায়, তাহলে বর্তমান সময়ের চাইতে ইসলাম অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। ঐ কোটি কোটি লোকের নিস্ক্রমণ তার পক্ষে রোগীর দেহ থেকে দূষিত রক্ত নির্গত হবারই শামিল বলে গণ্য হবে।
(আরবী) আমাদের ভয় হচ্ছে যে, আমাদের ওপর কোনো বিপদ এসে পড়বে।’ – এটা কোন নতুন আওয়াজ নয়। এ আওয়াজটি বহু আগে থেকেই মুনাফিকদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়ে আসছে। এ আওয়াজই তো লোকদের অন্তরে প্রচ্ছন্ন কপটতার সন্ধান বলে দেয়। এই আওয়াজ উচ্চারণকারীরা হামেশাই ইসলাম বিরাধী শিবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ও বিধি নিষেধকে হামেশাই পায়ের বেড়ি এবং গলার ফাঁস মনে করে। আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য চিরকালই এদের কাছে অপ্রীতিকর। এরা চিরদিনই আল্লাহর আনুগত্যের ভেতর জান ও মালে ক্ষতি এবং তার নাফরমানীতেই ইহজীবনের তাবত সাফল্য দেখতে পেয়েছে। কাজেই এদের মুখ চেয়ে আল্লাহর বিধান কে আগে কখনো বদলানো হয়নি, এখনো বদলানো যেতে পারেনা আর ভবিষ্যতেও বদলানো হবেনা। আল্লাহর বিধান ভীরু কাপুরুষদের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। নফসের দাস ও দুনিয়ার গোলামদের জন্যে নাযিল হয়নি। বাতাসের বেগে উড়ে চলা খড় কুটো, পানির স্রোতে ভেসে চলা কীট পতঙ্গ এবং প্রতি রঙে রঙ্গীন হওয়া রংহীনদের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। এমন দুসাহসী নরশার্দুলদের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা বাতাসের গতি বদলে দেবার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে, যারা নদীর তরঙ্গের সাথে লড়তে এবং তার স্রোতধারা ঘুরিয়ে দেবার মতো সৎ সাহস রাখে। যারা আল্লাহর রংকে দুনিয়ার সকল রঙেরচাইতে বেশি ভালোবাসে এবং সে রঙেই যারা গোটা দুনিয়াকে রাঙিয়ে তুলবার আগ্রহ পোষণ করে। যে ব্যক্তি মুসলমান তাকে নদীর স্রোতের ভেসে যাওয়ার জন্য পয়দা করা হয়নি। তাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হল জীবন নদীকে তার ঈমান ও প্রত্যয় নির্দেশিত সোজা ও সরল পথে পরিচালিত করা। যদি সেই সোজা পথ থেকে নদী তার স্রোত ফিরিয়ে নেয় আর সেই পরিবর্তিত স্রোতধারায়ই ভেসে চলতে সম্মত হয়ে যায় তো এমন ব্যক্তির ইসলামের দাবী একেবারেই মিথ্যা। বস্তুত যে ব্যক্তি সাচ্চা মুসলমান, সে এই ভ্রান্তমুখী স্রোতের সাথে লড়াই করবে, তার গতি ঘুরিয়ে দেবার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করবে, সাফল্য ও ব্যর্থতার কোন পরোয়াই সে করবেনা। এই লড়াইয়ের যে কোন সম্ভাব্য ক্ষতিই সে বরণ করে নেবে। এমনকি নদীর স্রোতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তার বাহু যদি ভেঙ্গেও যায়, কিংবা তার শক্তিও যদি শিথিল হয়ে পড়ে এবং পানির তরঙ্গাঘাত তাকে আধমরা করে কোন তীরের দিকে ছুড়ে ফেলেও দেয়, তবুও তার আত্মা কখনো পরাজয় বরণ করবেনা। তার দিলে এই বাহ্যিক ব্যর্থতার জন্য এক মুহূর্তের তরেও কোন অনুতাপ জাগবেনা, কিংবা নদীর স্রোতে ভেসে চলা কাফির ও মুনাফিকদের সাফল্যের জন্য ঈর্ষার ভাবধারা ও প্রশ্রয় পাবেনা।
কুরআন মুসলমানদের সামনে রয়েছে। পয়গম্বরদের আদর্শ ও জীবন চরিত তাদের সামনে রয়েছে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ইসলামের অমর পতাকাবাহীদের জীবন ও ইতিবৃত্ত তাদের সামনে রয়েছে। ঐসব থেকে কি তারা এই শিক্ষাই পাচ্ছে যে হাওয়া যেদিকে যাবে, তারাও সেদিকেই উড়ে চলবে? পানি যেদিকে প্রবাহিত হবে, তারাও সেদিকে ভেসে চলবে? যমানা যে রং ধারণ করবে, তারাও সেই রঙে রঙিন হবে? এই যদি উদ্দেশ্য হত, তাহলে কোন কিতাবের অবতরণ এবং কোন নবী প্রেরণেরই বা কি প্রয়োজন ছিলো? তাদের হেদায়াতের জন্য বাতাসের জন্য ঢেউ, তাদের পথনির্দেশের জন্য দুনিয়ার জীবনপ্রবাহ এবং তাদেরকে টিকটিকির চরিত্র শেখানোর জন্য যমানার রঙহীনতাই তো যথেষ্ট ছিল। এই ধরণের নাপাক শিক্ষার জন্য আল্লাহ কোন কিতাব অবতরণ করেননি আর এ উদ্দেশ্যে কোন নবী প্রেরণ করেননি। মহান সত্তার কাছে যে পয়গাম এসেছে,তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে এই যে, দুনিয়া যে সব ভ্রান্ত পথে এগিয়ে চলছে, সেগুলোকে বর্জন করে একটি সোজা পথ নির্মাণ করতে হবে, তার বিপরীত পথগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে এবং দুনিয়াকে সেসব পথ থেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করতে হবে। ঈমানদার লোকদের একটি জামায়াত গঠন করতে হবে এবং সে জামায়াত শুধু নিজে সোজা পথে চলবেনা; বরং দুনিয়াকেও সেদিকে টেনে আনবার চেষ্টা করবে।
নবী রসূল এবং তাদের অনুবর্তীগণ হামেশা এই উদ্দেশ্যেই জিহাদ করেছেন। এ জিহাদে তারা শুধুমাত্র দুঃখ কষ্টই করেননি বরং সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন- এমনকি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন। তবু তাদের কেউ বিপদের ভয়ে কিংবা স্বার্থের প্রলোভনে যুগের গতিকে কখনো নিজের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেননি। এখন যদি কোন ব্যক্তি বা দল আসমানী হেদায়াতের নির্দেশিত পথে চলার ভেতর ক্ষতি,অসুবিধা বা বিপদ দেখতে পায় এবং ঐসবে ভীত হয়ে এমন কোনো পথে চলতে চায়, যে পথের পথিকদের স্বচ্ছল, কৃতকাম ও উন্নতিশীল বলে মনে হয়- তাহলে সে সানন্দেই নিজের পছন্দনীয় পথে যেতে পারে। কিন্তু সে নির্বোধ ও লোভাতুর মানুষ নিজেকে এবং গোটা দুনিয়াকে এ ধোকা দেবার কোন চেষ্টা করছে যে, আল্লাহর কিতাব এবং নবীর নির্দেশিত পন্থা বর্জন করেও সে তারই অনুবর্তী? অবাধ্যতা স্বতই এক বড় অপরাধ; তার সঙ্গে মিথ্যা, প্রতারণা ও কপটতা যুক্ত করে কোন্ ফায়দাটা অর্জন করা যাবে?
জীবন নদী একবার যেদিকে প্রবাহিত হয়, সেদিক থেকে আর তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া যায়না-এ ধারণাটি যুক্তির দিক দিয়ে যেমন ভ্রান্ত, তেমনি অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণও এর প্রতিকূল সাক্ষ্য দেয়। দুনিয়ায় একবার নয়, অসংখ্যবার বিপ্লব এসেছে এবং প্রত্যেক বিপ্লবই নদীর গতি বদলে দিয়েছে। এর সবচাইতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তো ইসলামের ইতিহাসেই বর্তমান আছে। হযরত মুহাম্মদ সা. যখন দুনিয়ায় আগমন করেন, তখন জীবনের এই নদী কোন্ দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল? তামাম দুনিয়ায় কি তখন কুফর ও শিরকের প্রাধান্য বর্তমান ছিলোনা? জালিম ও স্বৈরাচারী শাসনশক্তি কি তখন কায়েম ছিলোনা?শ্রেণী ভেদের জুলুমমূলক বৈষম্য কি মানবতাকে কালিমালিপ্ত করে রাখেনি? নৈতিকতায় অশ্লীলতা, সমাজ জীবনে আত্মপূজা, অর্থনীতিতে জুলুমমূলক সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ এবং আইন কানুনে কি অবিচারের প্রাবল্য বর্তমান ছিলোনা? কিন্তু একটিমাত্র লোক দাঁড়িয়েই গোটা দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন! তৎকালীন দুনিয়ার সমস্ত ভ্রান্ত চিন্তা, মতবাদ ও গলদ পন্থাকে তিনি রহিত করে দিলেন এবং সেগুলোর মোকাবিলায় একটি নিজস্ব মত প্রচার ও জিহাদের দ্বারা দুনিয়ার গতিকে তিনি ঘুরিয়ে দিলেন এবং এইভাবে যামানার রংও বদলে ফেললেন।
এর অধুনাতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে কম্যুনিষ্ট আন্দোলন। উনিশ শতকে পুজিবাদের আধিপত্য চরম প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছিলো। যে ব্যবস্থাটি এতোবড় ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির পোষকতায় দুনিয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে উৎখাত করাও করাও সম্ভবপর-কোনো নির্বোধ ও কাপুরুষ ব্যক্তি তখন একথা ধারণাও করতে পারতোনা। কিন্তু এমনি পরিস্থিতির মধ্যেই কাল মার্কস্ নামক এক ব্যক্তি কম্যুনিজমের প্রচার শুরু করলেন। বিভিন্ন দেশের সরকার তার বিরোধিতা করলো। আপন দেশ থেকে তিনি বিতাড়িত হলেন। দেশে দেশে তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন-অনটন ও দু:খ কষ্টের মুখোমুখি হলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে কম্যুনিষ্টদের একটি শক্তিশালী দল তিনি সৃষ্টি করে গেলেন। এই দলটি মাত্র চল্লিম বছরের মধ্যে শুধু রাশিয়ার সবচাইদে ভয়ঙ্কর শক্তিকেই উৎখাত করে ছাড়লনা; বরং তামাম দুনিয়ায়ই পুজিবাদের ভিত্তিমূলকে কাঁপিয়ে দিলো। সেই সঙ্গে সে এতো বড় শক্তিশালী এক অর্থনৈতিক ও তামান্দুনিক ব্যবস্থা পেশ করলো যে, আজ দুনিয়ায় তার অনুবর্তীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এমনকি যেসব দেশে পুজিবাদের কর্তৃত্ব গভীরভাবে বদ্ধমূল, সেসব দেশের আইন কানুনও আজ এর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। [উল্লেখ্য, এটা রাশিয়ায় কম্যুনিস্ট শাসনের জয়জয়কার যুগের কথা। প্রবন্ধটির রচনাকাল ১৯৩৬ সাল।]কিন্তু এই বিপ্লব শক্তির প্রভাবেই সংঘটিত হয়েছে আর শক্তি হচ্ছে ঢালাই করার নাম-ঢালাই হবার নয়। অন্যকথায় ঘুরিয়ে দেয়াকে বলা হয় শক্তি-ঘুরে যাওয়াকে নয়। দুনিয়ায় কখনো কাপুরুষ ও নির্বোধেরা কোনো বিপ্লব সৃষ্টি করেনি। যাদের কোন নিজস্ব নীতি বা কোন জীবন লক্ষ্য নেই, কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে কুরবানী দেবার মতো আগ্রহ যাদের নেই, দু:খ কষ্ট ও বিপদ আপদের মোকাবিলা করার সাহসিকতা যাদের নেই; বরং দুনিয়ায় শুধু আরাম আয়েশ ও সুযোগ সুবিধাই যাদের একান্ত কাম্য, যে কোনো ছাঁচে ঢালাই হওয়া এবং যে কোনো চাপে নতো হওয়াই যাদের স্বভাব-মানবেতিহাসে এমন লোকদের কোনো উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বই দেখা যায়না। কারণ ইতিহাস তো কেবল বীর পুরুষরাই সৃষ্টি করতে পারেন। তারাই অক্লান্ত সাধনা, কুরবানী ও জিহাদের দ্বারা জীবন নদীর গতি ঘুরিয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার ধ্যান ধারনা বদলে দিয়েছেন। আচরণ ও কর্মনীতিতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। পরন্তু যমানার রঙে রঙিন হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের রঙেই তাঁরা যমানাকে রাঙিয়ে দিয়েছেন।
সুতরাং দুনিয়া যে পথে এগিয়ে চলছে, সেপথ থেকে তাকে ফেরানো যেতে পারেনা, যুগের যা ধর্ম, তার অনুসরণ করা ভিন্ন উপায়ন্তর নেই’ – এসব কথা বলবার কোনোই অবকাশ নেই। অক্ষমতার মিথ্যা দাবি করার চাইতে নিজেদের দুর্বলতার সত্যতা স্বীকার করাই উচিত। আর যখন তার স্বীকৃতি দেয়া হবে,তখন এ-ও স্বীকার করতে হবে যে, দুর্বল লোকদের জন্যে দুনিয়ার না কোনো ধর্ম হতে পারে, আর না পারে কোনো নীতি বা বিধি বিধান। এমনি ব্যক্তিকে তো যে কোনো বলবানের সামনেই নতো হতে হবে। যে কোন শক্তিমানের ভয়েই স্তব্ধ হয়ে থাকতে হবে। সে কখনো কোনো নীতি বা বিধি বিধানের অনুগত হতে পারেনা। আর কোনো ধর্ম যদি তার জন্যে আপন নীতি পরিবর্তন করতে থাকে, তাহলে তা আদতে কোনো ধর্মই নয়।
‘ইসলামের বিধি-নিষেধ সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক’- এ-ও একটি ধোকা ছাড়া কিছু নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামের কোন্ বিধি নিষেধটি মুসলমানরা পালন করছে? কোন্ সীমাটি তারা লংঘন করেনি? যে জিনিসগুলো তাদের ধ্বংস করছে, ইসলাম তার কোনটির অনুমতি দিয়েছে? তারা ধ্বংস হচ্ছে অপব্যয় ও অপচয়ের ফলে। এরই কারণে বার্ষিক কোটি কোটি টাকা তাদের পকেট থেকে মহাজনের ভান্ডারে চলে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ইসলাম কি তাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছে? আপনবদ স্বভাবই তো তাদেরকে ধ্বংস করছে। এই চরম দারিদ্রের ভেতরও তাদের লোকদের দ্বারা সিনেমা ও খেল তামাশাগুলো পরিপূর্ণ থাকে। তাদের প্রতিটি ব্যক্তি বেশভূষা ও রূপচর্চার উপকরণে আপন সামর্থ্যের চাইতেও বেশি ব্যয় করে। অর্থহীন প্রথা, প্রদর্শনীমূলক ক্রিয়াকান্ড ও মূর্খতাব্যঞ্জক রং তামাশায় প্রতি মাসে তাদের পকেট থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়িত হয়। এর কোন কাজটি ইসলাম তাদের জন্য হালাল করেছে?তাদেরকে সবচাইতে বেশি ধ্বংস করছে যাকাত আদায়ে ঔদাসীন্য এবং পারস্পারিক সহযোগিতার প্রতি বেপরোয়া মনোভাব। ইসলাম কি এ জিনিসগুলোকে তাদের প্রতি ফরয করেনি? কাজেই প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, তাদের অর্থনৈতিক দুর্গতি ইসলামী বিধি নিষেধের অনুসৃতির ফল নয়; বরং এ হচ্ছে তা থেকে মুক্ত হবারই পরিণতি। বাকি থাকে শুধু সুধের প্রতি নিষেধাজ্ঞা; কিন্তু তা-ই বা কোথায় কায়েম রয়েছে? শতকরা অন্তত ৯৫ ভাগ মুসলমান কোনো যথার্থ অক্ষমতা ছাড়াই সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহন করে থাকে। একেই কি বলে ইসলামী আইনের বিধি-নিষেধ? বিত্তবান মুসলমানদের এক বিরাট অংশ কোনো না কোনো রূপে সুদ গ্রহন করছে। যথারীতি মহাজনী কারবার না করলেই বা কি আসে যায়! ব্যাংক, বীমা, সরকারী বন্ডস, প্রভিডেন্ড ফান্ডস ইত্যাদির সুদতো বেশিরভাগ বিত্তবান মুসলমানই খাচ্ছে! তাহলে যে সুদ সংক্রান্ত বিধি নিষেধকে তারা নিজেদের আর্থিক দুরবস্থার জন্যে দায়ী করে, তার অস্তিত্ব রইলো কোথায়?
অধিকতর বিস্ময় ও কৌতুকের ব্যাপার এই যে, মুসলমানদের সম্ভ্রম ও জাতীয় শক্তিকে ঐশ্বর্যের ওপর আর ঐশ্বর্যকে সুদের বৈধতার ওপর নির্ভরশীল বলে যুক্তি প্রদর্শন করা হচ্ছে! মনে হয় সম্ভ্রম ও শক্তি জিনিসটা আসলে কিসের ওপর নির্ভরশীল এ খবরটাই ঐ যুক্তিবাদীদের জানা নেই। বস্তুত নিছক ধনমাল কখনো কোনো জাতিকে সম্ভ্রান্ত ও শক্তিশালী বানাতে পারেনি। মুসলমানদের প্রতিটি ব্যক্তি যদি লাখপতি বা কোটিপতিও বনে যায়, আর তাদের মধ্যে চারিত্রিক শক্তি না থাকে, তাহলে বিশ্বাস করুন দুনিয়ার কেউ তাদের সম্ভ্রম করবেনা। পক্ষান্তরে তাদের ভেতর যদি প্রকৃত ইসলামী চরিত্র বর্তমান থাকে, তারা সত্যনিষ্ঠ ও বিশ্বাসপরায়ণ হয়, প্রলোভন ও ভয়ভীতি থেকে মুক্ত হয়, নীতির প্রশ্নে অটল এবং লেনদেন পরিচ্ছন্ন হয়, সত্যকে সত্য এবং কর্তব্যকে কর্তব্য জ্ঞান করে, হারাম ও হালালের পার্থক্যের প্রতি হামেশা লক্ষ্য রাখে আর তাদের অন্তর্নিহিত নৈতিক শক্তির কারণে কোনো ক্ষতির ভয় ও লাভের হাতছানি তাদেরকে ন্যায়নীতি থেকে বিচ্যুত করতে এবং কোনো মূল্যের বিনিময়েই তাদের ঈমানকে খরিদ করতে না পারে-তাহলে দুনিয়ায় তাদের সুনাম প্রতিষ্ঠিত হবে। লোকদের হৃদয়ে তাদের সম্ভ্রম আসন পেতে বসবে। তাদের কথা লাখপতির গোটা সম্পদের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। তারা পর্ণকূটিরে থেকে তালি দেয়া কাপড় পরিধাণ করলেও সম্পদের স্তুপের ওপর অবস্থানকারীদের চাইতে বেশি সম্ভ্রমের দৃষ্টিতেই তাদের দেখা হবে। তারা জাতি হিসেবে এতখানি শক্তি অর্জন করবে যে, তাকে কখনো পরাজিত করা যাবেনা। সাহাবা রা-দের আমলের মুসলমানরা কি রকম দারিদ্রক্লিষ্ট ছিলো! কম্বল, তাঁবু ও পর্ণকুটিরে তাঁরা বাস করতেন। নাগরিক সভ্যতার জাঁকজমকের সাথে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাঁদের বেশভূষা,খাদ্যবস্তু,অস্ত্রপাতি কোনটাই যথোপযোগী ছিলোনা- তাঁদের কাছে জমকালো ধরনের সওয়ারীও ছিলোনা। কিন্তু তাঁদের যে সুনাম ও সুখ্যাতি ছিলো, তা উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগের মুসলমানরা না অর্জন করতে পেরেছে, আর না পেরেছে পরবর্তী কোনো কালের মুসলমানরা। তাঁদের ধন দৌলত ছিলো না, কিন্তু চারিত্রিক শক্তি ছিলো- এই শক্তিই তাঁদের সম্ভ্রম ও শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি দৃঢ়মূল করে দিয়েছিল। পরবর্তীকালের লোকেরা ধন দৌলত সঞ্চয় করে এবং রাষ্ট্রশক্তি লাভ করে জমকালো শহর ও সভ্যতা গড়ে তোলে; কিন্তু এর কোনোটাই তাদের চারিত্রিক দুর্বলতার বিকল্প পেশ করতে পারেনি।
মুসলমানরা ইসলামী ইতিহাসের শিক্ষা তো বিস্মৃতই হয়েছে; কিন্তু দুনিয়ার যে কোনো জাতির ইতিহাসের প্রতি তারা তাকিয়ে দেখতে পারে। দুনিয়ার কোনো জাতি শুধু সুবিধাবাদ, আরামপ্রিয়তা ও স্বার্থ পূজার দ্বারা শক্তি ও সম্ভ্রম অর্জন করেছে- এমন একটি দৃষ্টান্তও তারা খুঁজে পাবেনা। কোনো নীতি ও নিয়মানুবর্তিতার অনুবর্তী নয়, কোনো বৃহৎ উদ্দেশ্যের জন্যে কষ্টক্লেশ, শ্রম, মেহনত ও কঠোরতার বরদাশত করতে সক্ষম নয়, নীতি ও লক্ষ্যের জন্যে প্রবৃত্তির দাবি এবং আপন সত্তাকে উৎসর্গ করে দেবার মতো প্রেরণা পোষণ করেনা- এমন কোনো সম্ভ্রান্ত ও সমুন্নত জাতির অস্তিত্ব তারা খুঁজে পাবেনা। এই শৃঙ্খলা, নীতিনিষ্ঠা এবং বৃহৎ লক্ষ্যের জন্যে আরাম আয়েশ ও স্বার্থ ত্যাগের কোনো না কোনো রূপ তারা সর্বত্রই দেখতে পাবে। ইসলামে এর রূপ এক ধরনের। এখান থেকে বেরিয়ে অন্য কোনো সমাজে অন্তরভূক্ত হলেও, ভিন্ন কোনো রূপে তাদের একটা না একটা বিধি বিধানের অনুবর্তী হতে হবেই। কোনো না কোনো নিয়মানুবর্তিতার বাঁধনকে স্বীকার করতে হবেই। কতিপয় নির্দিষ্ট নীতির শিকলে তারা অবশ্যই বাঁধা পড়বে এবং কোনো নীতি ও লক্ষ্যের খাতিরে তাদের কাছে কুরবানী দাবি করা হবেই। যদি তাদের মধ্যে এর আগ্রহ বর্তমান না থাকে, তারা শুধু কোমলতা ও মাধুর্যেরই পিয়াসী হয় এবং কোনো কঠোরতা ও তিক্ততা স্বীকার করার মত শক্তি তাদের মধ্যে না থাকে তাহলে ইসলামের বিধি বন্ধন থেকে বেরিয়ে তারা যেখানে খুশি গিয়ে দেখতে পারে- কোথাও তারা সম্ভ্রমের আসন পাবেনা। কোথাও থেকে তারা শক্তি অর্জন করতে পারবেনা। এই সাধারণ নিয়মটিকে ইসলাম মাত্র চারটি শব্দে বিবৃত করছে। আর পৃথিবীর গোটা ইতিহাসই এই শব্দ চারটির সত্যতার সাক্ষ্য বহন করেছেঃ (আরবী)(নিশ্চয়ই কঠোরতার সঙ্গে রয়েছে কোমলতা)। এই কোমলতা হামেশাই কঠোরতার সাথে সংশ্লিষ্ট। যার ভেতরে কঠোরতাকে সহ্য করার মতো শক্তি নেই, সে কখনো কোমলতার গুণে বিভূষিত হতে পারেনা।