১৪
ঈমান ও আনুগত্য
[প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। – সম্পাদক]
সামাজিক ব্যবস্থা যে ধরনের এবং যে উদ্দেশ্যের হোক না কেন, তার প্রতিষ্ঠা, সংস্হিতি ও সাফল্যের জন্যে দু’টি জিনিস হামেশাই প্রয়োজন। প্রথমত, যে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে কোন সমাজ গঠিত হবে, সে নীতি গোটা সমাজ ও তার প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে বদ্ধমূল হবে এবং তার প্রতি সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিরই সর্বাধিক অনুরুক্তি থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমাজে আনুগত্য ও আজ্ঞানুবর্তিতার ভাবধারা বর্তমান থাকতে হবে। অর্থাৎ সে যাকে নির্দেশদাতা বলে স্বীকার করবে, তার নির্দেশের পুরোপুরি আনুগত্য করতে হবে, তার নির্ধারিত বিধিব্যবস্থার কঠোরতার সঙ্গে অনুবর্তী হতে হবে এবং তার নির্দিষ্ট সীমারেখা কখনো লঙ্ঘন করতে পারবে না। যে কোন ব্যবস্থাপনার কামিয়াবীর জন্য এগুলো হচ্ছে অপরিহার্য শর্ত। ব্যবস্থাপনা সামরিক হোক কি রাজনৈতিক, সামাজিক হোক কি ধর্মনৈতিক, এ দুটি শর্ত ছাড়া তা না কায়েম হতে পারে, আর না তার লক্ষে উপনীত হতে সক্ষম।
দুনিয়ার গোটা ইতিহাস খুলে দেখুন। কাপুরুষ, মুনাফিক, অবাধ্য ও অননুগত লোকদের নিয়ে কোন আন্দোলন কামিয়াব হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তা চলমানও রয়েছে এমন একটি দৃষ্টান্ত কেউ খুঁজে পাবে না। এ ব্যাপারে কারো ইতিহাস ঘাঁটা ঘাঁটিরও প্রয়োজন নেই। একবার নিজের চারদিকেই চোখ বুলিয়ে দেখুন। যে সেনাবাহিনী তার আপন রাজ্য ও প্রধান সেনাধ্যক্ষের অনুগত ও আজ্ঞানুবর্তী নয়, যার সৈনিকরা সামরিক নিয়ম কানুনের অনুবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানায়, কুচকাওয়াজ এর জন্য বিউগল বাজলে কোন সৈনিকই নিজের জায়গা থেকে নড়তে প্রস্তুত নয়, কমান্ডার কোন নির্দেশ দিলে সৈনিকরা তা অগ্রাহ্য করে যায়, এমন বাহিনী সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করা চলে? সৈনিকদের এমন একটি সমাবেশকে কি কেউ ‘সেনাবাহিনী’ আখ্যা দিতে পারেন? এমন বিশৃঙ্খল একটা বাহিনী কি কোন যুদ্ধে জয়লাভ করবে বলে কেউ আশা পোষণ করেন? যে রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে আইনের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই, যার বিধিবিধান প্রকাশ্য ভাবে ভঙ্গ করা হয়, যার অফিসাদিতে কোনরূপ নিয়ম শৃঙ্খলার অস্তিত্ব নেই, যার কর্মচারীরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনে সম্মত নয়, তেমন রাষ্ট্র সম্পর্কে কি বলা যেতে পারে? এই ধরনের প্রজা আর এমনি শাসক নিয়ে কোন রাষ্ট্র কি দুনিয়ার বুকে বেশীদিন টিকে থাকতে পারে? আজকে দুনিয়ার চোখেরসামনেই জার্মানী ও ইটালির দৃষ্টান্ত[এটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বেকার কথা। – সম্পাদক] বর্তমান রয়েছে। হিটলার ও মুসোলিনী যে বিপুল শক্তি অর্জন করেছে গোটা দুনিয়া সে সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু তাদের এ সাফল্যের মূল কারণটা কি জানেন? সেই দুটি জিনিষ অর্থাৎ ঈমান ও আনুগত্য। নাজী ও ফ্যাসিস্ট পার্টিদ্বয় যদি নিজেদের নীতি ও আদর্শের প্রতি এতটা দৃঢ় প্রত্যয় না রাখত এবং এতখানি কঠোরভাবে আপন নেতৃবৃন্দের অনুগত না হতো, তাহলে তারা কখনোই অত শক্তিশালী ও সফলকাম হতে পারত না।
এই সাধারণ নিয়মের মধ্যে কোন ব্যতিক্রম নেই। ঈমান ও আনুগত্য হচ্ছে আসলে সংগঠনের প্রাণতুল্য। ঈমান যতটা দৃঢ় এবং আনুগত্য যতটা পূর্ণ হয় সংগঠন ততই বেশি সফলকাম হবে। পক্ষান্তরে তার ঈমানে যতটা দুর্বলতা এবং আনুগত্যের প্রতি সে যতখানি বিমুখ হবে সংগঠন ততখানিই দুর্বল হয়ে পড়বে এবং সেই অনুপাতে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতেও সে ব্যর্থকাম হবে। কোন সমাজ ও সংগঠনে কপটতা, অবিশ্বাস, চিন্তার অনৈক্য, বিদ্রোহ, অবাধ্যতা ও বিশৃঙ্খলার ব্যাধি বিস্তার লাভ করবে এবং তারপরও তাতে নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় থাকবে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকে উন্নতির পথে এগুতে দেখা যাবে – এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার। এ দু’টি অবস্থা সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী। যেদিন থেকে দুনিয়ায় মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে তখন থেকে আজ পর্যন্ত কখনো দু’য়ের সমন্বয় ঘটেনি। যদি প্রাকৃতিক আইন অপরিবর্তিত হয়, তাহলে আইনের এই ধারাটিও অপরিবর্তনীয় অর্থাৎ উক্ত অবস্থা দুটির মধ্যে কখনো সমন্বয় ঘটতে পারে না।
এবার যে কওমটি নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দিচ্ছে, তার দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। কপটতা ও অবিশ্বাসের এমন কোন ধরণটি মুসলমানদের মধ্যে বর্তমান নেই যা মানুষ কল্পনা করতে পারে? আজ ইসলামী সমাজব্যবস্থায় এমন লোকও শামিল রয়েছে, যারা ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা দীক্ষা পর্যন্ত অবহিত নয় এবং আজ পর্যন্ত জাহিলী আক্বীদা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছে। এখানে এমন লোকও রয়েছে, যারা ইসলামের মৌল নীতিগুলো সম্পর্কেও সন্দেহ পোষণ করে এবং এই সন্দেহের কথা প্রকাশ্যে প্রচারও করে বেড়ায়। এ সমাজে এমন লোকও রয়েছে, যারা ধর্ম ও ধার্মিকতার বিরুদ্ধে খোলাখুলি অসন্তোষ ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছে। এর ভেতর এমন লোকও রয়েছে, যারা আল্লাহ ও রসূলের প্রদত্ত শিক্ষার মোকাবিলায় কাফিরদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারাকে অগ্রাধিকার দান করেছে। এখানে এমন লোকও রয়েছে, যারা আল্লাহ ও রসূলের প্রদত্ত বিধানের উপর জাহিলী রসম রেওয়াজ ও ক্বুফরী আইনকানুনকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এ সমাজে এমন লোকও রয়েছে, যারা আল্লাহ ও রসূলের শত্রুদেরকে তুষ্ট করার জন্য ইসলামী রীতিনীতিকে অবমাননা করে চলেছে। এর এমন লোকও রয়েছে, যারা নিজেদের ক্ষুদ্রতম ও তুচ্ছতম স্বার্থের খাতিরে ইসলামী ইমারতের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করতেও প্রস্তুত – যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কুফরের সহায়তা করে চলছে, ইসলামের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাফিরদের সেবা করে যাচ্চে এবং নিজেদের আচরণ দ্বারা একথাই প্রমাণ করছে যে, ইসলাম তাদের কাছে এতটুকু প্রিয় বস্তুও নয়, এর জন্য তারা এক চুল পরিমাণ ক্ষতিও স্বীকার করতে পারেনা। ফলকথা, মজবুত ঈমান ও নির্ভুল প্রত্যয়সম্পন্ন মুসলমানদের একটি নগণ্য দল ছাড়া এই জাতির বিরাট অংশই এ ধরণের মুনাফিক ও ভ্রান্তবিশ্বাসী লোকদের দ্বারা পরিপূর্ণ।
এতো গেল ঈমানের কথা। এবার আনুগত্যের প্রতি দৃকপাত করা যাক। কোন পরিদর্শক মুসলমানদের কোন মহল্লায় গেলেই এার একটি অদ্ভুত চিত্র দেখতে পাবে। সেখানে আযান হচ্ছে; কিন্তু মুয়াযযিন কাকে ডাকছে, কিসের জন্য ডাকছে, বহু মুসলমানের মধ্যে এ অনুভূতিই নেই। নামাযের সময় আসে, আবার চলে যায়; কিন্তু একটি নগণ্য দল ছাড়া বাকি সব মুসলমান নিজের কাজ-কারবার ও খেলাধূলাকে আল্লাহ্র জন্য ত্যাগ করতে রাজি নয়। প্রতি বছর রমযান মাস আসে; কিন্তু এটা যে কী গুরুত্বপূর্ণ মাস, বহু মুসলমান পরিবারে এ চেতনাটা পর্যন্ত দেখা যায় না। এ সময় বহু মুসলমান প্রকাশ্যে পানাহার করে এবং এই রোযা না রাখার দরুণ তারা বিন্দু পরিমান লজ্জাও অনুভব করে না; বরং উল্টো রোযাদার লোকদেরকেই তারা শরমিন্দা করার চেষ্টা করে। পরন্তু যারা রোযা পালন করে তাদের মধ্যেও খুব কম লোকই পূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সহকারে তা পালন করে থাকে; বরং কেউ শুধু রসম হিসেবে পালন করে, কেউবা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী ভেবে পালন করে, আবার কেউ রোযা রেখে আল্লাহ্ ও রসূল কর্তৃক নিষিদ্ধ সবকিছুই করে যায়। যাকাত ও হজ্জ্বের অনুবর্তন এর চাইতেও নিম্নমানের। হালাল হারাম ও পাক নাপাকের পার্থক্যবোধ মুসলমানদের মধ্য থেকে প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। বস্তুত আল্লাহ্ ও রসূলের নিষিদ্ধ কোন জিনিষটি মুসলমানরা বৈধ করে নিচ্ছেনা? আল্লাহ্ ও রসূলের নির্ধারিত কোন সীমারেখাটি মুসলমানরা লঙ্ঘন করছে না? আল্লাহ্ ও রসূলের প্রতিষ্ঠিত কোন বিধিব্যবস্থাটি মুসলমানরা ভঙ্গ করছে না? আদমশুমারীর দিক থেকে দেখলে ত মুসলমানদের সংখ্যা কোটি কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই কোটি কোটি লোকের মধ্যে শতকরা বা হাজারকরাও নয়, লাখ প্রতি কতজন আল্লাহ্ ও রসূলের বিধানের প্রতি বিশ্বস্ত এবং যথার্থভাবে ইসলামী আইনব্যবস্থার অনুবর্তনকারী?
বস্তুত যে জাতির মধ্যে মুনাফিকী ও ঈমানী দৌর্বল্যের ব্যাধি বিস্তার লাভ করে, যার মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের কোন অস্তিত্ব থাকেনা, যার ভেতর থেকে আনুগত্য ও আইনানুবর্তিতা বিলুপ্ত হয়ে যায় তার যা পরিণতি হওয়া উচিৎ, মুসলমানদের ঠিক সেই পরিণতিই হচ্ছে। মুসলমানরা আজ সমগ্র দুনিয়ায় পরাধীন ও পরাভূত। যেখানে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে, সেথানেও তারা অপরের নৈতিক, মানসিক ও বৈষয়িক আধিপত্য থেকে মুক্ত নয়। তাদের অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, দারিদ্র্য ও দুরবস্থা হচ্ছে জনশ্রুতির মত। নৈতিক অবনতি তাদেরকে লাঞ্ছনার চরম সীমায় নিয়ে পৌঁছিয়েছে। আমানতদারী, বিশ্বাসপরায়ণতা, সত্যবাদিতা, প্রতিশ্রুতি পালন ইত্যাকার গুণরাজির দরুণ এককালে তারা সর্ব্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল – সেসব গুণ আজ তাদের থেকে অন্যদের মধ্যে স্থানান্তর হয়েছে এবং তার পরিবর্তে বিশ্বাস ভঙ্গ, মিথ্যাচার, প্রতারণা, ওয়াদা খেলাফ ও অসদাচরণ স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। তাকওয়া, পরহেযগারী ও নৈতিক পবিত্রতার দিক থেকে তারা প্রায় অন্তসারশূন্য হতে চলেছে। সামাজিক ও জাতিগত সম্ভ্রমবোধ দিনদিন তাদের মধ্য থেকে তিরোহিত হতে চলেছে। তাদের মধ্যে নিয়ম শৃঙ্খলার কোনরূপ লেশমাত্র নেই। পরস্পরের প্রতি বিতৃষ্ণা ও বীতশ্রদ্ধায় তাদের মন ভরে উঠেছে। কোন সাধারণ স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের জন্য মিলেমিশে কাজ করার মত যোগ্যতা তাদের বাকি নেই। অপরাপর জাতির চোখে তারা চরম লাঞ্ছিত ও অপমানিত। তাদের উপর থেকে অন্যান্য জাতির আস্থা চলে গিয়েছে এবং বাকিটুকুও চলে যাচ্ছে। তাদের জাতিগত, সামাজিক ও সামগ্রিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের জাতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিলীন হতে চলেছে। নিজেদের অধিকার সংরক্ষণ এবং জাতীয় মর্যাদার নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা অপারগ হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার লাভ করেছে, গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ও ইউরোপীয় শিক্ষপ্রাপ্তদের হারও বেড়ে চলেছে – তাদের মধ্যে আধুনিক কায়দার বাংলোতে বসবাসকারী, মোটর কারে আরোহনকারী, স্যুট কোট পরিধানকারী, বড় বড় উপাধিধারী এবং উচ্চ পদমর্যাদা লাভকারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বটে; কিন্তু যে সুউচ্চ নৈতিক গুণরাজিতে পূর্বে তারা বিভূষিত ছিল, তার থেকে আজ তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত। প্রতিবেশী জাতিগুলোরউপর তাদের যে প্রভাব প্রতিপত্তি বর্তমান ছিল, আজ আর তার নাম নিশানাও বাকি নেই। পূর্বে যে মানসম্ভ্রম ও শক্তি সামর্থ্যের তারা অধিকারী ছিল, আজ তার কিছুই বর্তমান নেই আর ভবিষ্যতে এর চাইতেও মারাত্মক লক্ষণ পরিলক্ষিত হবে।
যেকোন ধর্ম বা সভ্যতা অথবা কোন সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে দু’রকম কর্মনীতিই মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য গতে পারে। সে যদি তার অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে তার মূলনীতির প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস পোষণ করতে হবে। তার আইনকানুন ও বিধি ব্যবস্থার পুরোপুরি অনুবর্তন করতে হবে। সে যদি এরূপ করতে না পারে, তবে তার অন্তর্ভুক্তই গতে পারবেনা, কিংবা হলেও প্রকাশ্যভাবে তার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ দু’টির মধ্যে কোন তৃতীয় পন্থা যুক্তিযুক্ত হতে পারেনা। এক ব্যক্তি কোন রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তও হবে, তার একটি অংশ বলে স্বীকৃতও হবে, তার অনুগত হওয়ার দাবিও করবে, আবার তার মূলনীতিকে পুরোপুরি কি অংশত অমান্যও করবে, তার নির্ধারিত আইনকানুনের বিরুদ্ধাচরণও করবে, তার রীতিনীতি ও বিধি ব্যবস্থার অনুবর্তন থেকে নিজেকে মুক্তও করে নেবে – এটা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত কর্মনীতি হতে পারেনা। এরূপ কর্মনীতির অনিবার্য ফল হচ্ছে এই যে, লোকদের মধ্যে মুনাফিকী চরিত্রের সৃষ্টি হবে। তাদের মন থেকে আন্তরিকতা ও নিঃস্বার্থপরতা বিদায় নেবে। কোন মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য তাদের হৃদয়ে উদ্দীপনা ও দৃঢ় সংকল্পের সৃষ্টি হতে পারবেনা। দায়িত্ববোধ, কর্তব্যজ্ঞান, আইনানুগত্য, নিয়মানুবর্তিতা তাদের থেকে বিদায় গ্রহণ করবে। ফলে কোন সমাজব্যবস্থার পক্ষে কার্যপযোগী সভ্য হবার যোগ্যতাই তাদের মধ্যে থাকবেনা। এহেন দুর্বলতা, অক্ষমতা ও দোষত্রুটি নিয়ে তারা যে সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত হবে, তার পক্ষে একটা বিরাট অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। যে সভ্যতার দেহে প্রবেশ করবে, তার পক্ষে একেবারে কুষ্ঠরোগের জীবাণু বলে প্রমাণিত হবে। যে ধর্মের অনুবর্তী হবে, তাকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে ছাড়বে। এই সকল গুণাবলী নিয়ে মুসলমান হবার চাইতে বরং যে দলের নীতি ও আদর্শের প্রতি তাদের মন সায় দেয় এবং যার কর্মনীতি তারা অনুবর্তন করতে চায় তার মধ্যে শামিল হয়ে যাওয়া শতগুণে উত্তম। বস্তুত যে কাফির তার ধর্ম ও সভ্যতাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এবং তার রীতিনীতি ও বিধিব্যবস্থার অনুবর্তন করে, অন্তত মুনাফিক মুসলমানের চাইতে সে উত্তম।
যারা পাশ্চাত্য শিক্ষা, আধুনিক সভ্যতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অধিকার লাভকে মুসলমানদের জাতীয় ব্যাধির প্রতিকার বলে মনে করে, তারা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। আল্লাহ্র কসম! যদি প্রতিটি মুসলমান এমএ, পি.এইচ.ডি. কিংবা ব্যারিস্টারও হযে যায়, ধনসম্পদে সুসমৃদ্ধ হয়ে উঠে, পাশ্চাত্য সাজপোষাকে আপাদমস্তক সুসজ্জিতও হয় এবং রাষ্ট্র সরকারের তাবৎ পদমর্যাদা ও পরিষদগুলোর সমুদয় আসনও [মনে রাখা দরকার, এখানে বৃটিশ ভারতের সরকারি পদ ও পরিষদের আসনের কথা বলা হয়েছে। – সম্পাদক]
তারা দখল করে বসে – আর তাদের হৃদয়ে মুনাফিকীর ব্যাধি লুক্কায়িত থাকে, কর্তব্যকে তারা কর্তব্যই জ্ঞান না করে, অবাধ্যতা, বিদ্রোহ ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণে তারা অভ্যস্ত হয়, তাহলে আজকের মত অপমান, লাঞ্ছনা ও দুর্বলতার মধ্যেই তারা নিমজ্জিত থাকবে। বস্তুত নিজেদের স্বভাব চরিত্র ও নৈতিকতার কারণে যে গভীর খাদে [এখানে খাদ মানে – পরাধীনতা] তারা পতিত হয়েছে, তার শিক্ষাদীক্ষা, চালচলন, ধনসম্পদ, রাষ্ট্রক্ষমতা এর কোনটাই তাদেরকে উদ্ধার করতে পারবেনা। মুসলমানদের যদি উন্নতি ও প্রগতি লাভ করতে হয় এবং একটি শক্তিমান ও মর্যাদাবান জাতি হিসেবে দাঁড়াতে হয়, তাহলে সর্বপ্রথম তাদের ঈমান ও আইনানুবর্তিতার গুণরাজি সৃষ্টি করতে হবে। এতোদভিন্ন তাদের ব্যক্তিজীবনে যেমন শক্তি সঞ্চারিত হতে পারেনা, তেমনি জাতীয় জীবনেও নিয়মশৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারেনা। পরন্তু তাদের সামগ্রিক শক্তি এতখানি প্রচন্ডরূপ ধারণ করতে পারেনা, যাতেকরে দুনিয়ার জীবনে তারা সমুন্নত হতে পারে। কারণ একটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জাতি – যার জনসমষ্টির নৈতিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা যারপর নাই শোচনীয়, সে কখনো দুনিয়ার সুদৃঢ়, শক্তিশালী ও সুসংগঠিত জাতিগুলোর মোকাবিলায় শিরোন্নত করতে পারেনা। খড়কুটোর গাদা যত বড়ই হোক না কেন, তা কখনো দুর্গ বলে গণ্য হতে পারেনা।
যারা মুসলমানদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অবাধ্যতার প্রচার করছে, তারা ইসলাম ও মুসলমানদের নিকৃষ্টতম শত্রু। এর হচ্ছে সবচাইতে নিকৃষ্ট শ্রেণীর মুনাফিক – এদের অস্তিত্ব মুসলমানদের পক্ষে সশস্ত্র কাফিরদের চাইতেও বেশি মারাত্মক। কারণ এরা কখনো বাহির থেকে হামলা করেনা; বরং ঘরের মধ্যে বসে গোপনে গোপনে ডিনামাইট বিছাতে থাকে। এরা মুসলমানদেরকে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রেই অপদস্থ করতে চায়। এই শ্রেণীর লোক সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে যে, এরা নিজেরা যেমন কাফির হয়েছে, তোমাদেরকেও তেমনি কাফির বানাতে ইচ্ছুক : (আরবী) “এরা চায় তোমরাও যেন কুফরীতে নিমজ্জিত হও, যেমনি নিমজ্জিত হয়েছে তারা এবং এভাবেই যেন তোমরা তাদের বরাবর হও।” (সূরা আন নিসা : ৮৯) এদের দুষ্কৃতি থেকে বাঁচবার ন্যূনতম পথ হচ্ছে এই যে, যারা মনেপ্রাণে মুসলমান এবং মুসলমান থাকতেই ইচ্ছুক, এদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কচ্ছেদ করা উচিৎ – (আরবী) “তোমরা তাদের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক হিসেব গ্রহণ করোনা” নচেৎ কুরআন তাদের জন্য এই চরম শাস্তি ঘোষণা করেছে যে, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।”
(আরবী)
(তারা যদি একথা না মানে, তবে তাদের পাকড়াও করো এবং যেখানেই পাও নিধন করো।)