৫
পাশ্চাত্য সভ্যতার আত্মহত্যা
রাষ্ট্রনীতি, ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্পকলা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য জাতিগুলোর বিস্ময়কর উন্নতি ও অগ্রগতি একশ্রেণীর লোকের মন মগজ অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মনে এই ধারণার সঞ্চার হয়েছে যে, ঐ জাতিগুলোর উন্নতি ও তরক্কী হয়তো বা অক্ষয়, অবিনশ্বর। দুনিয়ায় তাদের প্রভুত্ব ও আধিপত্য চিরতরে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। পৃথিবীর রাজত্ব ও উপায় উপকরণের কর্তৃত্বের ব্যাপারে একেবারে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ দেয়া হয়েছে। তাদের শক্তি ও ক্ষমতা এমনই মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যে, তা উৎখাত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
বস্তুত এটা কোনো নতুন ধারণা নয়; বরং প্রত্যেক যুগের প্রতাপশালী জাতিগুলো সম্পর্কেই এরূপ ধারণা পোষণ করা হয়েছে। মিসরের ফিরাউন বংশ, আরবের আদ ও সামূদ, ইরাকের কালদানি, ইরানের কিসরা, গ্রীসের দিগ্বিজয়ী বীর, রোমের বিশ্ববিশ্রুত সম্রাট, জগজ্জয়ী মুসলিম মুজাহিদ, তাতারীদের দুনিয়াখ্যাত সেনাবাহিনী প্রমুখ সবাই এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে একই রূপ প্রতাপ ও শক্তির তামাসা দেখিয়ে গেছেন। পালাক্রমে এরা প্রত্যেকেই আপন আপন ভোজবাজির নৈপুণ্য দেখিয়ে একইভাবে দুনিয়ার মানুষকে বিস্মিত করে দিয়েছেন। যখন যে জাতিই মাথা তুলেছে, এভাবেই সে দুনিয়ার ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। এমনি করেই সে বিশ্বময় নিজের খ্যাতি, যশ ও বীর্যবত্তার ডঙ্কা বাজিয়েছে আর এভাবেই দুনিয়ার মানুষ ধারণা করে নিয়েছে যে, তাদের শক্তি ও ক্ষমতা অক্ষয়, অবিনশ্বর। কিন্তু তাদের আয়ুষ্কাল যখন পূর্ণ হয়ে গিয়েছে এবং অক্ষয় ও অবিনশ্বর ক্ষমতার অধিকারী সম্রাট তাদের কর্তৃত্বের অবসান ঘোষণা করেছেন, তখন তাদের এমনি পতন ঘটেছে যে, অধিকাংশ জাতিই দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। কোনো কোনোটির নাম-নিশানা দুনিয়ায় থাকলেও তারা তাদের শাসিতের শাসনাধীন, গোলামদের গোলাম এবং পদানতদের পদানত হয়েই বেঁচে রয়েছে :
قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُمْ سُنَنٌ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ
অর্থঃ তোমাদের পূর্বে অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। পৃথিবীতে ঘুরে দেখো, যারা (আল্লাহ্র বিধান) অস্বীকার করেছে, তাদের পরিণাম কি হয়েছে!’ (সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত ১৩৭)
বস্তুত বিশ্বপ্রকৃতির গোটা ব্যবস্থাপনাই এমনি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে, এখানে কোনো স্থিতি ও বিরতির অবকাশ নেই। এখানে এক অবিশ্রান্ত গতি, পরিবর্তন ও আবর্তন বিদ্যমান। এটি কোনো জিনিসকেই এক অবস্থায় টিকে থাকতে দেয়না। এখানে সৃষ্টির সাথে লয়, ভাঙ্গার সাথে গড়া, উত্থানের সাথে পতন হাত ধরাধরি করে চলছে। এমনিভাবে এর বিপরিত নিয়মও চালু রয়েছে। আজ একটি মাষা পরিমাণ বীজ যেখানে বাতাসের বেগে উড়ে উড়ে বেড়ায় কাল তা-ই মাটিতে স্থিতি লাভ করে এক প্রকান্ড ডালপালাযুক্ত বৃক্ষে পরিণত হয়। আবার পরদিন তা-ই শুকিয়ে মাটিতে একাকার হয়ে যায়। অতপর প্রকৃতির সঞ্জিবনী শক্তিগুলো তাকে ত্যাগ করে অপর কোনো বীজের লালন পালনে নিয়োজিত হয়। এই হচ্ছে জীবনের ভাঙ্গা গড়া ও উত্থান পতনের নিয়ম। কিন্তু মানুষ এর কোনো একটি অবস্থাকে একটু বেশি দীর্ঘস্থায়ী হতে দেখলেই মনে করে যে, এ অবস্থা একেবারে চিরস্থায়ী। সে অবস্থাটি যদি নিম্নগামী হয় তবে মনে করে যে, চিরকাল এরূপ নিম্নগামীই থাকবে। আবার তা যদি উর্ধ্বগামী হয় তো ধারণা করা হয় যে, চিরদিন এমনি উর্ধ্বগামীই থাকবে। কিন্তু এখানে পার্থক্য যাকিছু তা বিলম্ব আর অবিলম্বের; আসলে কোনো অবস্থাই চিরস্থায়ী নয় :
إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ ۚ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَاءَ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
অর্থঃ কালের উত্থান পতন আমি মানুষের মধ্যে আবর্তন করে থাকি।’ (সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত ১৪০)
দুনিয়ার গোটা পরিবেশই আবর্তিত হচ্ছে এক ধরণের গতিক্রমের মধ্যে। জন্ম মৃত্যু, যৌবন বার্ধক্য, শক্তি দৌর্বল্য, শীত বসন্ত, শুষ্কতা সজীবতা সবকিছুই হচ্ছে এই আবর্তনের বিভিন্ন রূপমাত্র। এই আবর্তন ধারায় পালাক্রমে প্রত্যেক জিনিসেরই একবার সুদিন আসে। তখন শুরু হয় তার বিকাশ বৃদ্ধি, প্রকাশ পায় তার শৌর্যবীর্য, পরাকাষ্ঠা দেখায় সে আপন রূপ ও সৌন্দর্য। এমনকি একদিন সে উন্নতি ও প্রগতির চরম প্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়। এসময়ে সে ক্ষীণ, খর্বকায়, দুর্বল ও অক্ষম হয়ে পড়ে এবং যে শক্তিগুলো তার বিকাশ বুদ্ধির সূচনা করেছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই তাকে ধ্বংস করে দেয়।
গোটা সৃষ্টিজগতে এই হচ্ছে আল্লাহ্ তায়ালার বিধিবদ্ধ নিয়ম। দুনিয়ার অন্যসব জিনিসের মতো মানুষের ওপরও রয়েছে এ নিয়ম পুরোপুরি কার্যকর। তাকে ব্যক্তিগতভাবে বিচার করা হোক, কি জাতিগত দৃষ্টিতে মান-অপমান, সুখ-দুঃখ, উন্নতি-অবনতি এবং এমনিতরো অন্যান্য সমস্ত লক্ষণই ঐ গতিক্রমের সাথে বিভক্ত হতে থাকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও জাতির মধ্যে। এখানে এমন কেউ নেই, যাকে এই ভাগাভাগির বেলায় করা হয়েছে সম্পূর্ণ বঞ্চিত, কিংবা যার উপর কোনো অবস্থাকেই করা হয়েছে চিরস্থায়ী। সুদিন বা দুর্দিন কোনো অবস্থায়ই এর ব্যতিক্রম হয়না :
سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلُ ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا
অর্থঃ পূর্বে যারা অতীত হয়েছে তাদের ব্যাপারে এটাই ছিলো আল্লাহর রীতি। তুমি আল্লাহর রীতিতে কখনো কোনো পরিবর্তন পাবেনা। (সূরা আহযাব : আয়াত ৬২)
এই পৃথিবীর আনাচে-কানাচে আমরা অতীত জাতিগুলোর অনেক নিদর্শন দেখতে পাই। তারা তাদের কৃষ্টি সভ্যতা, শিল্পকর্ম ও কলাকুশলতার প্রচুর স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছে। সেসব স্মৃতিচিহ্ন দেখে মনে হয়, আজকের প্রগতিশীল ও প্রতাপশালী জাতিগুলোর চাইতে তারা কিছুমাত্র খাটো ছিলোনা; বরং সমকালীন জাতিগুলোর ওপর তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিলো এদের চাইতেও বেশি :
أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ كَانُوا أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَأَثَارُوا الْأَرْضَ وَعَمَرُوهَا أَكْثَرَ مِمَّا عَمَرُوهَا وَجَاءَتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ ۖ فَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَٰكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
অর্থঃ তারা ছিলো এদের চাইতেও প্রবল শক্তিমান। তারা যমীনকে ভালোভাবে কর্ষণ করেছিলো এবং এতোটা আবাদ করেছিলো যতোটা এরা করে নাই।’ (সূরা রূম : আয়াত ৯)
কিন্তু তবু তাদের পরিণতি কি হয়েছে? তারা আপাত সৌভাগ্যের নেশায় হলো প্রতারিত। ঐশ্বর্য আর ভোগাড়ম্বর তাদের নিক্ষিপ্ত করলো অহমিকার গর্ভে। স্বাচ্ছন্দ্য তাদের জন্য হয়ে দাঁড়ালো আপদ(ফিতনা)। প্রতিপত্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার গরবে তারা পরিণত হলো অনাচারের প্রতিমূর্তিতে। এভাবে নিজস্ব দুষ্কৃতির দ্বারা নিজেদের ওপরই তারা শুরু করে দিলো জুলুম চালাতে :
فَلَوْلَا كَانَ مِنَ الْقُرُونِ مِن قَبْلِكُمْ أُولُو بَقِيَّةٍ يَنْهَوْنَ عَنِ الْفَسَادِ فِي الْأَرْضِ إِلَّا قَلِيلًا مِّمَّنْ أَنجَيْنَا مِنْهُمْ ۗ وَاتَّبَعَ الَّذِينَ ظَلَمُوا مَا أُتْرِفُوا فِيهِ وَكَانُوا مُجْرِمِينَ
অর্থঃ আর যালেমরা তো সেই সব সামগ্রীর স্বাদ আস্বাদনে লিপ্ত ছিলো যা তাদেরকে বিপুল পরিমাণে দেয়া হয়েছিলো। আর তারা ছিলো মহা অপরাধী।’ (সূরা হুদ : আয়াত ১১৬)
তাদের এই বিদ্রোহ আর অবাধ্যতা সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের অবকাশ দিলেন :
وَكَأَيِّن مِّن قَرْيَةٍ أَمْلَيْتُ لَهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ ثُمَّ أَخَذْتُهَا وَإِلَيَّ الْمَصِيرُ
অর্থঃ কতো জনপদ এমন ছিলো যারা ছিলো যালেম। আমি প্রথমে তাদের অবকাশ দিয়েছি, তারপর পাকড়াও করেছি।’ (সূরা আল হজ্জ : আয়াত ৪৮)
আর এ অবকাশও কোনো মা’মুলি অবকাশ ছিলোনা; বরং বিভিন্ন জাতিকে শতাব্দীর পর শতাব্দী অবকাশ দেয়া হলো। কিন্তু প্রতিটি অবকাশই তাদের জন্য এক নতুন আপদ হয়ে দাঁড়ালো :
وَيَسْتَعْجِلُونَكَ بِالْعَذَابِ وَلَن يُخْلِفَ اللَّهُ وَعْدَهُ ۚ وَإِنَّ يَوْمًا عِندَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّونَ
অর্থঃ কিন্তু আল্লাহর নিকট একদিন তোমাদের গণনার হাজার বছর।’ (সূরা হজ্জ : আয়াত ৪৭)
তারা মনে করলো যে, তাদের চাতুর্যের সামনে আল্লাহ অসহায়। কাজেই দুনিয়ার ওপর এখন আল্লাহর নয়, তাদেরই রাজত্ব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোদার গযব উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। তাদের উপর থেকে সুদৃষ্টি ঘুরে গেলো। সুদিনের পরিবর্তে দুর্দিন ঘনিয়ে এলো। তাদের চালবাজির মোকাবিলায় আল্লাহও এক কঠিন চাল প্রয়োগ করলেন। কিন্তু তারা আল্লাহর সে চাল উপলব্ধি করতেই পারলনা,প্রতিরোধ করবে তারা কোথেকে?
(আরবী)
অর্থঃ তারা একটা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো, অথচ আমরাও একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম,যা তারা টেরই পায়নি।(সুরা আন নামলঃআয়াত ৫০)
আল্লাহর পরিকল্পনা কখনো প্রত্যক্ষভাবে আসেনা বরং তার বিষক্রিয়া শুরু হয় খোদ মানুষের ভিতর থেকে-তার দিল দিমাগে অনুপ্রবেশ করার পর থেকে। তা আক্রমন চালায় মানুষের বিবেক বুদ্ধি,অনুভুতি, বিচারবোধ,চিন্তাশক্তি ও বোধশক্তির উপর। তা অন্ধ করে দেয় তার অন্তরদৃষ্টিকে। তা তার চর্মচক্ষুকে অন্ধ করেনা বটে, কিন্তু তার জ্ঞানচক্ষুকে অন্ধ করে দেয়ঃ
(আরবী)
অর্থঃ “আসল ব্যাপার হল চক্ষু অন্ধ হয়না, বরং অন্ধ হয় অন্তর যা বুকের মধ্যে থাকে”।(সুরা আল হাজ্জঃআয়াত ৪৬)
অন্ধ!আর হৃদয় চক্ষুই যখন অন্ধ হয়ে যায়, তখন নিজের কল্যানের জন্য যে ফন্দি ফিকিরই সে খাটায়,তাই তার পক্ষে হানিকর হয়ে দাঁড়ায়। সাফ্যলের আশা দিয়ে যে পদক্ষেপ সে করে, তাই তাকে নিয়ে যায় ধ্বংসের দিকে। তার সমস্ত শক্তিই ঘোষনা করে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তার নিজের হাত নিজের গলাটিপে ধরে আপনা থেকেঃ
(আরবী)
অর্থঃএকবার দৃষ্টই নিক্ষেপ করে দেখো তাদের ষড়যন্ত্রের পরিনতি কি ভয়াবহ হয়েছে,আমার তাদের এবং তাদের কওমকে পুরোপুরি নাস্তানাবুদ করে দিয়েছি।(সুরা আন নামলঃ৫১)
এই সুদিন আর দুর্দিনেরই একটি পুর্ণাঙ্গ চিত্র আমরা দেখতে পাই খান্দানে ফিরাউন ও বণী ইসরাইলের কাহিনীতে। মিশরবাসী যখন উন্নতি ও প্রগতির চরম শিখরে আরোহণ করল, তখন তারা কোমড় বেঁধে লাগল জোর জুলুম ও বিদ্রেহাত্নক কার্যকলাপে। তাদের বাদশাহ ফিরাউন দাবি করল খোদায়ী মর্যাদার। তার কিছুকাল আগে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের আমলে বণী ইসরাইলগন সেখানে গিয়ে করেছিল বসতি স্থাপন। ফিরাউন এই দুর্বল কওমটিকে পরিনত করলো জুলুম ও পীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে। শেষ পর্যন্ত তার মিসরবাসীর অবাধ্যতা গেলো সীমা অতিক্রম করে। তাই আল্লাহ সিদ্ধান্ত করলেন তাদের অপদস্থ করে, তাদের কাছে ঘৃন্য, সেই কওমটিকে সমুন্নত করবার।অবশেষে আল্লাহর সিদ্ধান্তই কার্যকর হলো। সেই দুর্বল জাতির মধ্যে পয়দা করা হল হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে। তাঁর প্রতিপালন করানো হলো ফিরাউনের ঘরে এবং খোদ তারই স্বহস্তে। অতঃপর তাকে নিযুক্ত করা হলো মিসরীয়দের গোলামী থেকে নিজ কওমকে মুক্ত করানোর খেদমতে। তিনি ফিরাউনকে নম্রভাবে বোঝালেন কিন্তু সে বিরত হলোনা। আল্লাহর পক্ষ থেকে ফিরাউন ও তার কওমকে বারংবার সতর্ক করা হলো, উপুর্যপরি দুর্ভিক্ষ ও বন্যার প্রকোপ দেখা দিল, আসমান থেকে শোণিতধারা বর্ষিত হল। পঙ্গপালের আক্রমনে তাদের ফসলের ক্ষেত বিরাণ হয়ে গেল।
উকুন ও ব্যাঙের উপদ্রবে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। কিন্তু তবু তাদের অহমিকা কিছু মাত্র হ্রাস পেল নাঃ
(আরবী)
অর্থঃ তারা অহংকারে মেতে উঠেছিলো আর তার ছিলো অহংকারী জাতি।(সুরা আরাফঃআয়াত ১৩৩)
একে একে সমস্ত যুক্তি প্রমান যখন চুড়ান্ত হলো। তখন খোদায়ী আযাবের সীদ্ধান্ত কার্যকরী হল। আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা আলাইহিস হালাম আপন কওমকে সঙ্গে নিয়ে মিসর ত্যাগ করলেন। ফিরাউনকে তার দলবলসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়া হল। ফলে মিসরের রাষ্ট্রশক্তি এমন বিপর্যস্ত হলো যে, কয়েক শতক পর্যন্ত তা আর মাথা তুলে দাড়াতে পারলো নাঃ
(আরবী)
অর্থঃ আর আমরা তাকে ও তার বাহিনীকে পাকড়াও করলাম তারপর তাদের ডুবিয়ে দিলাম সমুদ্রে। চেয়ে দেখো কি ভয়াবহ পরিনতি হয়েছে এই যালেমদের।(সুরা আল কাসাসঃআয়াত ৪০)
অতঃপর এলো ইসরাঈলের পালা। মিসরীয় জাতিকে বিপর্যস্ত করার পর বিশ্ব জাহানের মালিক সেই লাঞ্ছিত ও অপমানিত কওমতিকেই দুনিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রদান করলেনঃ
(আরবী)
অর্থঃআর তাদের স্থানে আমরা নির্যাতিত লোকদেরকে সেই অঞ্চলের পুর্ব পশ্চিমের অধিকারী বানিয়ে দিলাম, যাকে আমরা কানায় কানায় প্রাচূর্যে ভরে দিয়েছিলাম। আর এভাবেই সবর অবলম্বন করার কারনে বনী ঈসরাইলের ভাগ্যে তোমার প্রভুর কল্যানময় ওয়াদা পুরন হয়ে গেলো।(সুরা আরাফঃআয়াত ১৩৭)
এবং তাকে দান করলেন দুনিয়ার সমস্ত জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্বঃ
(আরবী)
অর্থঃ আর আমি তোমাদেরকে বিশ্ব জাতি সমূহের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম।(সুরা বাকারাঃআয়াত ৪৭)
কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্ব ও রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিলো স্ৎকর্ম ও সদাচরণের শর্ত সাপেক্ষ। হযরত মুসা আলাইহিস সালামের জবানিতে আগেই বলে দেয়া হয়েছিলো যে, তোমাদের কে দুনিয়ার খিলাফত দেয়া হবে অবশ্যই; কিন্তু তোমরা কিরুপ কাজ করো(*****), তার প্রতিও লক্ষ্য রাখা হবে। বস্তুত এ শর্ত শুধু বণী ঈসরাইলের বেলাই নয়,বরং দুনিয়ায় যে জাতিকেই রাষ্ট্র শক্তি দান করা হয়, তার প্রতিই এই শর্ত আরোপিত হয়ঃ
(আরবী)
অর্থঃঅতঃপর আমরা তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করলাম তোমরা কি রকম কাজ করো তা দেখার জন্য।(সুরা ইউনুসঃ আয়াত ১৪)
তাই বণী ঈসরাইল যখন আপন প্রভুর সাথে অবাধ্য আচরন করল, তাঁর বাণী ও কালামকে বিকৃতদুষ্ট করল, সত্যকে মিথ্যার দ্বারা বদলে ফেললো, হারামখোরী, মিথ্যাচার, বেঈমানী ও ওয়াদা ভঙ্গের নীতি গ্রহন করলো, অর্থগৃদ্ম, লোভী, কাপুরুষ ও আরাম প্রিয় হয়ে উঠলো, খোদার নবিগনকে হত্যা করতে শুরু করলো, সত্যের পথে আহবানকারীদের সাথে দুশমনি শুরু করলো, সৎ নেতৃত্বের প্রতি অপ্রসন্ন হলো এবং অসৎ নেতৃত্বের আনুগত্য স্বীকার করলো, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুদৃষ্টিও তাদের উপর থেকে উঠে গেল। তাদের কাছ থেকে পৃথিবীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়া হলো। ইরাক, গ্রীস, রোমের দূর্ধর্ষ সম্রাটদের দ্বারা তাদের পর্যদুস্ত করানো হল। তাদেরকে ঘর ছাড়া করা হলো।ভবঘুরের ন্যায় লাঞ্চনা ও গঞ্জনার সাথে দেশে দেশে ঘুরান হলো। তাদের হাত থেকে রাষ্ট্রশক্তি ছিনিয়ে নেয়া হল। দু’হাজার বছর যাবত তারা লা’নতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়লো যে,দুনিয়ার কোথাও তারা এতোটুকু মর্যাদাকর ঠাঁই খুঁজে পেলনা।
([এই প্রবন্ধ প্রকাশের কয়েক বছর পর ফিলিস্তিনে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে লোকেদের মনে এই সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে যে, এটা কুরআনের ভবিষ্যতের পরিপন্থি। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এই রাষ্ট্রটি নিজের শক্তিতে নয়; বরং আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্য দুনিয়ার চারদিক থেকে ইহুদিরা এসে এই ক্ষুদ্র ভুখন্ডে জমায়েত হচ্ছে। কিন্তু যে দিন এই পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ কোন বড় যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ইসরাইল কে সমর্থন দিতে অপারগ হয় পড়বে, সে দিন তার জন্যে মৃত্যুর পয়গাম নেমে আসবে এবং প্বার্শবর্তী আরব রাষ্ট্রগুলো এই ময়লার মোড়কটিকে তুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। বস্তুত ইহুদীরা পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের সহায়তায় আরব ভুমিতে জোরপুর্বক তাদের নিজ্স্ব আবাস ভুমি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে,দৃশ্যত একে তাদের কামিয়াবি বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ তাদের বিরাট শাস্তিরই নামান্তর])
(আরবী)
অর্থঃফলশ্রুতিতে তাদেরকে গ্রাস করল লাঞ্চনা,অধপতন ও দুরাবস্থা,আর তারা পরিবেষ্টিত হলো আল্লাহর গযবে।(সুরা বাকারাঃআয়াত ৬১)
আজকে আবার আমরা খোদায়ী নিয়মের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। পুর্বেকার জাতিগুলো যে কর্মফলের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলো, তা-ই আজ পাশ্চাত্য জাতিকে জড়িয়ে ফেলেছে। তাদেরকে যতোটা সতর্কীকরণ সম্ভব ছিলো, প্রায় সবই করা হয়েছে। মহাযুদ্ধে প্রলয়কান্ড, আর্থিক দুর্গতি, বেকারীর আধিক্য, কুৎসিত ব্যাধির প্রকোপ, পারিবারিক ব্যবস্থার বিপর্যয়, এসব হচ্ছে তার উজ্জ্বল নিদর্শন। তাদের যদি চোখ থাকতো তো এগুলো দেখেই বুঝতে পারতো যে, জুলুম, অবাধ্যতা, আত্নপুজা ও সত্য বিকৃতির কী পরিনাম হয়ে থাকে। কিন্তু তারা ঐ নিদর্শনগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহন করছেনা; বরং সত্যের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনে তাদের ক্রমাগত একগুয়েমিই পরিলক্ষিত হয়েছে। তাদের দৃষ্টি ব্যাধির মুল কারন অবধি পৌছুচ্ছেনা। তারা শুধু রোগ লক্ষনই দেখতে পাচ্ছে এবং তারই প্রতিকার করার ব্যাপারে নিজেদের সমস্ত চেষ্টা যত্ন ব্যয় করছে। এ কারনে ওষুধ যতই প্রয়োগ করা হচ্ছে, ব্যাধি ততোই বেড়ে চলছে। এখন অবস্থা দেখে প্রতীয়মান হচ্ছে যে,সতর্কবাণী ও যুক্তিপ্রমানের পর্যায় শেষ হচ্ছে এবং চুড়ান্ত ফয়সালার সময় অত্যাসন্ন।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাশ্চাত্য জাতিগুলোর উপর দু’টি প্রচন্ড শয়তান চাপিয়ে দিয়েছেন। তারা তাদেরকে ধ্বংস ও বিণাশের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার একটি হচ্ছে বংশ নিধনের শয়তান আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে জাতীয়তাবাদের শয়তান। প্রথম শয়তানটি চেপে বসেছে তাদের ব্যক্তিদের ওপর, আর দ্বিতীয়টি বসেছে তাদের জাতি ও রাজ্যসমূহের ওপর। প্রথমটি তাদের পুরুষ ও নারীদের বিবেক বুদ্ধিকে বিকৃত করে দিয়েছে। তাদের নিজস্ব হাত দ্বারাই তাদের বংশধরদের নিধণ করাচ্ছে।তাদেরকে গর্ভনিরোধের কলা কৌশল শিক্ষা দান করছে। গর্ভপাতের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। বন্ধ্যাত্বকরণের মাহাত্য বোঝাচ্ছে। এর ফলে তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় শক্তি তারা নিজেরাই বিনষ্ট করে ফেলছে। এটি তাদের এমনি হৃদয়হীন করে দিয়েছে যে, তারা নিজেদের সন্তানকে নিজেরাই হত্যা করছে। ফলকথা,এই শয়তান ক্রমশ তাদের আত্নহত্যায় প্রবৃত্ত করাচ্ছে।
দ্বিতীয় শয়তানটা তাদের বড় বড় রাষ্ট্রনায়ক ও সেনাধ্যক্ষদের থেকে নির্ভুল চিন্তা ও সঠিক কর্মপন্থা গ্রহনের শক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে। সে তাদের মধ্যে আত্নসর্বস্বতা, প্রতিদ্বন্দিতা, প্রতিহিংসা, ঘৃনা বিদ্বেষ ও লোভ লালসার কুৎসিত মনোবৃত্তি পয়দা করেছে। তাদেরকে পরস্পর বিবাদমান ও বৈরী ভাবাপন্ন বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত করে দিচ্ছেঃ
(আরবী)
অর্থঃঅথবা তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত করে দিবেন এবং এক দলের দ্বারা আরেক দলের শক্তির স্বাদ গ্রহন করাবেন।(সুরা আ’নাম;আয়াত ৬৫)
তাদেরকে পরস্পরের শক্তি ও ক্ষমতার স্বাদ গ্রহনে উদ্বুদ্ধ করেছে। আর এ-ও হচ্ছে এক ধরনের খোদায়ী আযাব। মোটকথা সে তাদেরকে এক প্রচন্ড আত্নহত্যার জন্য তৈরী করেছে। এটি পর্যায়ক্রমে নয়;বরং আচানক অনুষ্ঠিত হবে। সে তামাম দুনিয়ায় গোলা বারুদ জমা করেছে এবং বিভিন্ন জায়গায় বিপদকেন্দ্র বানিয়ে রেখেছে। এখন সে কেবল একটি বিশেষ মুহূর্তের জন্য প্রতীক্ষমান। সে মুহূর্তটি আসামাত্রই সে কোন একটি বারুদাগারকে অগ্নিশলাকা দেখিয়ে দেবে। তারপর দেখতে না দেখতেই এমন ধ্বংসলীলা বিস্ফোরিত হবে,যার ফলে পুর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসলীলাও ম্লান হয়ে যাবে।
এ পর্যন্ত আমি যা কিছু বলেছি, তাতে কোনো অত্যুক্তির অবকাশ নেই। বরং ইউরোপ, আমেরিকা,জাপানে আসন্ন মহাযুদ্ধের বিপুল প্রস্তুতি([এখানে স্মর্তব্য যে,প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কয়েক বছর আগে]) দেখে খোদ তাদেরই দুরদর্শী নেতৃবৃন্দ শিউরে উঠেছেন এবং এই ভয়াবহ যুদ্ধের পরিনাম চিন্তা করে তারা অত্যন্ত দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি মার্কিন মিলিটারী স্টাফের প্রাক্তন সদস্য সার্জেল নিউম্যান(sergel neuman)আসন্ন যুদ্ধ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন,আসন্ন যুদ্ধ শুধু সৈন্যদের লড়াই হবেনা, বরং তাকে ব্যাপক গনহত্যা বলাই হবে সমীচিন। এই হত্যাযজ্ঞে নারী ও শিশুদের পর্যন্ত রেহাই দেয়া হবে না। বিজ্ঞানীদের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের দায়িত্বটা সৈন্যবাহিনীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য ও নিষ্প্রান যন্ত্রের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছে। এই মরণাস্ত্রগুলো সামরিক ও অসামরিক লোকের মধ্যে পার্থক্য করতে সম্পূর্ন অক্ষম। পরুন্ত এখন যুদ্ধমান শক্তিগুলোর লড়াই ময়দান বা দুর্গের মধ্যে নয়,বরং শহর,বন্দর ও লোকালয়ের মধ্যে হবে। কারণ আধুনিক যুদ্ধনীতি অনুযায়ী শত্রুপক্ষের আসল শক্তি সেনাবাহিনীর মধ্যে নয়, বরং তার জনপদ, বাণিজ্যকেন্দ্র ও শিল্পকারখানার মধ্যে নিহিত। তাই এখন যুদ্ধ বিমান থেকে নানারকম বোমা বর্ষন করা হবে। সেসব থেকে অগ্নিদগীরক পদার্থ, বিষাক্ত গ্যাস ও রোগ জ়ীবানু নির্গত হয়ে যুগপৎ লক্ষ লক্ষ মানুশকে নাস্তানাবুদ করে দেবে। তার মধ্যে এমন এক প্রকার স্বয়ংক্রিয় বোমা রয়েছে,যার একটি মাত্র গোলা লন্ডনের বৃহত্তম ইমারতটি চূর্নবিচূর্ন করে দিতে পারে([পরবর্তীকালে আনবিক বোমা ও উদযান বোমা নামে এর চাইতেও ভয়ংকর মারণাস্ত আবিস্কৃত হয়েছে এবং নাগাসাকি ও হিরোশিমাতে তার ধ্বংসলীলার একটি ক্ষুদ্র নমুনাও পেশ করা হয়েছে])। গ্রীন ক্রস গ্যাস(green cross gas) নামে এক প্রকার বিষাক্ত গ্যাস হিসেবে পরিচিত। এর প্রকৃতি এই যে,এটি যার নাকে প্রবেশ করবে,তার মনে হবে যেনো সে পানিতে ডুবে গিয়েছে। আর এক প্রকার বিষাক্ত গ্যাসের নাম হচ্ছে ইয়েলো ক্রস গ্যাস(yellow cross gas)। এর প্রকৃতি হচ্ছে সাপের বিষতূল্য। এটি নাকে প্রবেশ করলে ঠিক সর্প দংশন করার মত বিষক্রিয়া দেখা দেয়। এমন ধরনের আরো নানা প্রকার গ্যাস রয়েছে। এই গ্যাসগুলো প্রায় অদৃশ্য। প্রথম দিকে এগুলোর প্রতিক্রিয়া মোটেই অনুভুত হয়না। পরে যখন অনূভুত হয়,তখন প্রতিক্রিয়া বা চিকিৎসার কোন সম্ভাবনাই থাকে না।এ র মধ্যে এক বিশেষ ধরনের গ্যাস বহু উর্ধ্বে উঠে ছড়িয়ে যায়। এর প্রভাবিত এলাকা দিয়ে কোন বিমান অতিক্রম করলে তার চালক সহসাই অন্ধ হয়ে যায়। অনুমান করা হয়েছে যে, কোন কোন বিষাক্ত গ্যাসের এক টন পরিমান যদি প্যারীস নগরের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়,তবে তার এক ঘন্টার মধ্যেই গোটা শহর টিকে সম্পুর্ন ধ্বংস করে ফেলা যেতে পারে।আর এই কাজটি সম্পাদন করার জন্য মাত্র একশ বিমানই যথেষ্ট।
সম্প্রতি এক বৈদ্যুতিক অগ্নুৎপাদক গোলা আবিস্কার করা হয়েছে। এর ওজন মাত্র এক কিলোগ্রাম। কিন্তু এইটুকু গোলার ভেতরে এতোখানি শক্তি রয়েছে যে,কোনো জিনিসের সঙ্গে এর সংঘাত লাগলে হঠাৎ তিন হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপ উৎপন্ন হয় এবং তা থেকে এমনি প্রচন্ড অগ্নুৎপাত হয় যে, তা কিছুতেই নেভানো সম্ভব নয়। তাতে পানি নিক্ষেপ করলে পেট্রোলের ন্যায় কাজ করে। তাকে নেভানোর জন্য বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত কোনো পন্থা উদ্ভাবন করতে পারেনি। অনুমান করা হচ্ছে যে, একে শহরে বন্দরের বড় বড় বাজারে নিক্ষেপ করা হবে, যাতে করে তার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবধি আগুন লেগে যায়। অতপর লোকেরা ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পালাতে শুরু করলে বিমান থেকে বিষাক্ত গ্যাসের বোমা বর্ষণ করে ধ্বংসযজ্ঞকে পূর্ণতর করা হবে।
এসব মারণাস্ত্রের আবিস্কার দেখে রণ বিশেষজ্ঞগণ অনুমান করেছেন যে, মাত্র কয়েকটি বোমারু বিমানের সাহায্যে দুনিয়ার বৃহত্তম ও সুরক্ষিত রাজধানীকেও দু’ঘন্টার মধ্যে ধুলিসাৎ করে দেয়া যেতে পারে। লক্ষ লক্ষ লোকের বাসস্থানকে এমনিভাবে বিষাক্ত করা যেতে পারে যে, রাতে তারা ভালোয় ভালোয় শোবে বটে, কিন্তু সকালে একজনও জীবিত উঠবেনা। এভাবে বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা একটি গোটা দেশের প্রাণী সম্পদকে বিষাক্ত, গবাদী পশু ধ্বংস এবং ক্ষেত খামার ও বাগ বাগিচাকে নিশ্চিহ্ন করা যেতে পারে। এই সর্বধ্বংসী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার কোনো কার্যকরী পন্থা আজও আবিস্কৃত হয়নি। এতে কেবল উভয় যুদ্ধমান পক্ষ পরস্পরের প্রতি হামলা করে ধ্বংস হয়েই যেতে পারে, ধ্বংসের হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারে না।
এই হচ্ছে আসন্ন মহাযুদ্ধের প্রস্তুতির একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণণা। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হয়ে আপনারা What would be The Character of a New War নামক পুস্তকটি দেখুন। এই পুস্তকটি জেনেভার আন্তপার্লামেন্টারী ইউনিয়ন’ নামক সংস্থা যথারীতি গবেষনা ও তথ্যানুসন্ধানের পর প্রকাশ করেছে।
এটি পড়লে সহজে অনুমান করতে পারবেন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতা কিভাবে নিজের ধ্বংসের উপকরণ নিজ হাতেই সংগ্রহ করেছে। এখন তার আয়ুস্কাল রয়েছে শুধু তার যুদ্ধ ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত।১ ([দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে- ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত – কি সব কান্ড ঘটেছে তার একটি নমুনা নাগাসাকির ধ্বংসলীলার মধ্যে দেখা যেতে পারে। এর চাইতে বিস্তৃত নমুনা দেখতে হলে লর্ড রাসেলের Seourge of Swastika নামক পুস্তকটি পড়ুন এবং একটি খোদাহীন সভ্যতা কিভাবে একটি গোটা জাতিকে হিংস্র পশুর চাইতেও নিকৃষ্টতর জীবে পরিণত করতে পারে তার নিদর্শন দেখুন।])
যেদিন দুনিয়ার দু’টি বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাবে, সেদিনই পাশ্চাত্য সভ্যতা ধ্বংসের জন্যে খোদায়ী ফায়সালা কার্যকর হয়েছে মনে করতে হবে, কারণ দু’টি বৃহঃ রাষ্ট্র ময়দানে অবততণ করার পর যুদ্ধ কিছুতেই বিশ্বব্যাপী রূপ ধারণ না করে পারেনা। আর যুদ্ধ বিশ্বব্যাপি হলে ধ্বংসও হবে বিশ্বব্যাপি, সন্দেহ নেই।
(আরবী)
অর্থঃ লোকেরা স্বহস্তে যা কিছু অর্জন করেছে তার ফলে জলে স্থলে সর্বত্র বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যাতে করে তারা কোনো কোনো কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহন করতে পারে। সম্ভবত তারা এখনও (সৎ পথে) প্রত্যাবর্তণ করতে পারে।” সূরা রুমঃ৪১)
যাই হোক, দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সম্পর্কে নতুন কোনো বন্দোবস্ত গ্রহন এবং যালিম ও অত্যাচারীদের পতন ঘটিয়ে অপর কোনো জাতিকে (সম্ভবত তা কোনো নিপীড়িত জাতি হবে) দুনিয়ার খিলাফতের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সময় এখন অত্যাসন্ন। এই মর্যাদার জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাকে মনোনীত করেন, তা-ই এখন লক্ষ্য করবার বিষয়।
এরপরে দুনিয়ার কোন কওমটিকে সমুন্নত করা হবে, আমাদের তা জানবার কোনো উপায় নেই। এ হচ্ছে সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাধীন ব্যাপার। তিনি যার কাছ থেকে ইচ্ছা, কর্তত্ব ছিনিয়ে নেন, আবার যাকে ইচ্ছা দান করেনঃ
(আরবী)
অর্থঃ বলো, হে আল্লাহ! সমস্ত রাজ্য ও সাম্রাজ্যের মালিক! তুমি যাকে চাও রাজ্য দান করো, আর যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নাও। (সূরা আল ইমরানঃ ২৬) কিন্তু এ ব্যাপারেও একটি নির্ধারিত কানুন রয়েছে। সেটি তিনি তাঁর প্রিয় কিতাবে বিবৃত করেছেন। তা হলো এই যে, তিনি এমন কোনো জাতিকে সমাসীন করেন, যারা সেই অভিশপ্ত কওমটির ন্যায় বদকার ও অবাধ্য হবে না।
(আরবী)
অর্থঃ যদি তোমরা অবাধ্য আচরণ করো তা হলে তোমাদের পরিবর্তে অপর কোনো জাতিকে সমুন্নত করা হবে। তারা তোমাদের মতো হবেনা। (সূরা মুহাম্মদঃ আয়াত ৩৮)
এ কারণেই বাহ্যিক লক্ষনাদি দেখে মনে হয়, আজকাল যেসব দুর্বল পরাধীন জাতি পাশ্চাত্য সভ্যাতার অনুকরণ করছে এবং ফিরিঙ্গি জাতিগুলোর সদগুনাবলী (যা কিছু সামান্য তাদের মধ্যে অবশিষ্ট রয়েছে) বর্জন করে তাদের দোষত্রুটিগুলো (যা তাদের অভিশপ্ত হবার হেতু) গ্রহন করেছে, আসন্ন বিপ্লবে তাদের সফলকাম হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই। (প্রথম প্রকাশঃ তরজমানুল কুরআন, অক্টোবর ১৯৩২ সাল)