৬
পাশ্চাত্য সভ্যতার আর্তনাদ
(লর্ড লোথিয়ানের ভাষণ)
[প্রবন্ধটি ১৯৩৯ সালের মার্চে তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।]
১৯৩৮ সালের জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে আলীগড় ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন (উপাধি বিতরণের সভা) উপলক্ষে লর্ড লোথিয়ান একটি ভাষণ দান করেন। তাঁর এই ভাষণটি (অবিভক্ত) ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের আধুনিক ও প্রাচীন পন্থীদের পক্ষে বিশেষভাগে প্রণিধানযোগ্য। এতে তাদের জন্যে প্রচুর শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। এই ভাষণে এমন এক ব্যক্তি আমাদের সামনে তাঁর দিল দিমাগের পর্দা উন্মোচন করেছেন, যিনি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও তার সৃষ্ট সভ্যতাকে দূর থেকে দেখেননি; বরং নিজে সেই সভ্যতার কোলে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন এবং জীবনের সুদীর্ঘ ৫৬টি বছর সেই সমুদ্র মন্থনে অতিবাহিত করেছেন। তিনি পয়দায়েশী ও খান্দানি সূত্রে ইউরোপিডয়ান এবং অক্সফোর্ডে উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত। তিনি বিখ্যাত রাউন্ড টেবিল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং প্রায় একুশ বছর যাবত বৃটিশ সরকারের বড় বড় দায়িত্বশীল পদে কাজ করেছেন। তিনি কোনো বৈদেশিক পর্যবেক্ষক নন, তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতারই স্বগৃহের লোক। এ হিসেবেই তিনি আমাদেরকে সেই ঘরের আসল বিকৃতি, তার কার্যকরণ এবং ঘরের লোকেরা বর্তমানে কিসের জন্যে পিপাসার্ত, তা বিবৃত করেছেন।
একদিক থেকে এই ভাষণটি আমাদের আধুনিক শিক্ষিত লোকদের জন্যে অধিকতর শিক্ষাপ্রদ। কারণ, এ থেকে তাঁরা জানতে পারবেন, পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান এবং তার সৃষ্টি সভ্যতার সবটুকু কেবল সঞ্জীবনীই নয়; বরং এতে অনেক বিষেরও সংমিশ্রণ রয়েছে। যারা এ ওষুধটি তৈরি করেছে এবং কয়েকশ বছর একে ব্যবহার করে দেখেছে, তারা নিজেরা্ই আজ একে পুরোপুরি সেবন না করার জন্যে আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছে। তারা বলছেঃ ‘এ বস্তুটি আমাদের ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে পৌছে দিয়েছে এবং তোমাদেরও ধ্বংস করে ছাড়বে। আমরা নিজেরাই এক খাঁটি সঞ্জীবনীর প্রত্যাশা করছি। আমরা নিশ্চিতরূপে না জানলেও অনুমান করি যে, সে সঞ্জীবনী তোমাদের কাছেই বর্তমান রয়েছে। কাজেই তোমরা যেনো নিজেদের সঞ্জীবনীকে ধূলিসাৎ করে আমাদের বিষদুষ্ট ওষুধটির স্বাদ গ্রহনে লেগে না যাও।‘
অন্যদিকে আমাদের আলিম ও ধার্মিক সম্প্রদায়ের জন্যেও এ ভাষণটিতে রয়েছে প্রচুর চিন্তার খোরাক। তাঁরা বর্তমানে যে দুনিয়ায় বসবাস করছেন, তার সামনে ইসলামী শিক্ষার কোন দিকগুলোকে উজ্জল করে তুলে ধরা দরকার, তা এ থেকে তাঁরা অনুমান করতে পারবেন। এই দুনিয়া কয়েক শতাব্দী ধরে বস্তুবাদী সভ্যতার পরিক্ষা-নিরিক্ষা চালিয়ে আজ এররূপ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কয়েক শতক আগে সন্ধানী ভাবধারা ও মুক্ত চিন্তার যে সঞ্জীবনী আমরা ইউরোবাসীকে সরবরাহ করেছিলাম, তারা তাকে নিছক অজ্ঞতাবশত ধর্মহীনতা ও বস্তুতান্ত্রিকতার বিষমিশ্রিত করে এক নতুন সভ্যতা সঞ্জীবনীর জন্ম দিয়েছে। সে সঞ্জীবনী নিজের শক্তিবলে তাদেরকে উন্নতির শীর্ষদেশে উন্নিতি করেছে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে তার বিষক্রিয়াও বরাবর ক্রিয়াশীল রয়েছে। এমনকি সে সঞ্জীবনী আজ পুরোপুরি বিষদুষ্ট হয়ে পড়েছে। তার তিক্ত পরিণাম ফল উত্তমরূপে ভোগ করার পর আজ আবার তারা নতুন সঞ্জীবনীর সন্ধানে চারদিকে দৃষ্টিক্ষেপ করছে। তাদের সঞ্জীবনীর ভেতর কী কী বিষাক্ত জিনিস রয়েছে এবং সেগুলো তাদের জীবনে কী গুরুতর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে, তা তারা বুঝতে পেরেছে। আর ঐ প্রতিক্রিয়াগুলোকে দূর করার জন্যে কী ধরনের সঞ্জীবনী তাদের প্রয়োজন, তাও তারা আজ অনুভব করতে পারছে। কিন্তু যে সঞ্জীবনীর তারা সন্ধান করে ফিরছে, তা যে ইসলাম ছাড়া দুনিয়ার আর কারো কাছে বর্তমান নেই এবং যে দাওয়াখানা থেকে তারা প্রথম বটিকাটি নিয়েছিল এই শেষ বটিকাটিও যে সেখানেই পাওয়া যাবে এই কথাটুকু তাদের জানা নেই। এই পর্যন্ত পৌছার পরও যদি তারা ঈস্পিত সীবনীর জন্যে ছুটাছুটি করতে থাকে এবং তা না পেয়ে হলাহল দ্বারা সারা দুনিয়াকে বিষাক্ত করতে থাকে, তাহলে সে মহাপাপে তাদের সঙ্গে আমাদের আলিম সমাজকেও সমানভাবে শরীক হতে হবে। আজকে খোদাতত্ত্ব, অতিপ্রকৃতিবাদ এবং খুঁটিনাটি শাস্ত্রীয় বিষয় নিয়ে বিতর্ক বাহাসে লিপ্ত থাকবার সময় আলিম সমাজের নেই। রসূল সা. এর গায়েবী ইলম ছিলো কিনা? আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন কিনা? রসূলের কোনো তুলনা সম্ভব কিনা? ইসালে সওয়াব ও কবর যিয়ারতের শরয়ী মর্যাদা কী? শব্দ করে আমীন বলা ও ‘রাফে ইয়াদাইন’ করা হবে কিনা? মসজিদের মিনার ও মিম্বরের মধ্যে কতোটুকু পার্থক্য রাখা হবে ইত্যাকার খুঁটিনাটি সমস্যার সমাধান করার জন্যে আজ আমাদের ধর্মীয় নায়কগণ নিজেদের সমগ্র শক্তি ক্ষমতার অপচয় করছেন। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় এই সমস্যাগুলোর কোনই গুরুত্ব নেই এবং এগুলোর মীমাংসার ফলে সত্য মিথ্যা ও হেদায়াত গুমরাহীর এই বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ের অবসান হতে পারেনা; বরং কয়েক শতক ধরে খোদাবিমুখতা ও ধর্মহীনতার ভিত্তিতে জ্ঞান বিজ্ঞান ও সমাজ তমুদ্দুনের ক্রমবিকাশের ফলে যে জটিল সমস্যাবলীর উদ্ভব হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ উপলব্ধি করাই হচ্ছে আজকের সবচাইতে বড় প্রয়োজন এবং সেগুলো পুরোপুরি বিশ্লেষণ করে ইসলামী নীতির আলোকে তার গ্রহনযোগ্য সমাধান পেশ করাই হচ্ছে আজকের আসল কাজ। আমাদের আলিম সমাজ যদি এ কাজের জন্যে নিজেদেরকে যোগ্য করে না তোলেন এবং সুষ্ঠুভাবে এটি সম্পন্ন করার প্রয়াস না পান, তাহলে ইউরোপ আমেরিকার যা পরিণাম হবার তা তো হবেই, খোদ মুসলিম জাহানও একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ পাশ্চাত্য দেশগুলো যেসব সমস্যায় জর্জরিত, গোটা মুসলিম জাহান ও ভারতবর্ষে তা-ই আজ অতি তীব্রতার সঙ্গে পয়দা হচ্ছে। আর এগুলোর কোনো সঠিক সমাধান পেশ না করার ফলে মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই আজ ঐ ব্যাধিগ্রস্থদের ‘নোসখা’-ই ব্যবহার করে চলেছে। কাজেই বিষয়টি আজকে আর শুধু ইউরোপ আমেরিকার নয়; বরং এটি আমাদের নিজস্ব ঘর এবং আমাদের ভাবী বংশধরদেরই সমস্যা।
এসকল কারণেই আমাদের আধুনিক শিক্ষিত সমাজ ও আলিম সম্প্রদায়ের পক্ষে লর্ড লোথিয়ানের ভাষণটি প্রণিধান করা কর্তব্য। আমরা তাঁর বক্তব্যের মর্মোপলব্ধি করার জন্যে মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ ভাষণটি এখানে উদ্ধৃত করছি।
লর্ড লোথিয়ান তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেনঃ
আর একটি বিচার্য বিষয়ের প্রতি আজ আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষার যে মারাত্বক কুফল আজ ইউরোপ ও আমেরিকা ভোগ করছে, ভারতবর্ষ কী তা থেকে বেঁচে থাকতে পারে? আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে পাশ্চাত্যে দু’টি বিরাট পরিণাম ফল উদ্ভূত হয়েছে। একদিকে সে প্রকৃতি এবং তার শক্তিগুলোর ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে অনেক প্রশস্ত করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণ সমাজে এবং সাধারণভাবে গোটা দুনিয়ায় উত্তরাধিকার সূত্রে ধর্মীয় অনুশাসনকে দুর্বল করে দিয়েছে। আধুনিক পৃথিবীর অন্তত অর্ধেক বিকৃতি এই দু’টি কারণ উদ্ভূত হয়েছে। আজকের সুসভ্য মানুষ বিজ্ঞানের আবিস্কৃত শক্তির নেশায় আত্মহারা বটে, কিন্তু সে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমাজ তমদ্দুনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক ক্ষেত্রে সুষম উন্নতি সাধন করতে পারেনি। অথচ এ জিনিসটি বৈজ্ঞানিক শক্তিগুলোকে মানুষের ধ্বংসের পরিবর্তে তার কল্যাণের কাজে নিয়োজিত করার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারতো।’
এই ভূমিকায় লর্ড লোথিয়ান প্রকৃতপক্ষে মানবীয় তাহযীব ও তমদ্দুনের বুনিয়াদী সমস্যার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। বিজ্ঞান নিছক বিজ্ঞান হিসেসে চিন্তা-গবেষণা ও অন্বেষণ অনুশীলনের ঔৎসুক্য বৈ-কিছু নয়। এরই বদৌলতে মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোর অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং সেগুলোকে কাজে লাগানোর জন্যে উপায় উপকরণ সংগ্রহ করে। এই জ্ঞান সম্পদের উন্নতির ফলে মানুষ যে নতুন শক্তিগুলো অর্জন করে, সেগুলোকে প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করতে শুরু করলে তাকে বলা হয় সভ্যতার উৎকর্ষ। কিন্তু এই জিনিস দু’টি আপনা থেকে মানুষের কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেনা। এগুলো যেমন কল্যাণের হেতু হতে পারে, তেমনি হতে পারে ধ্বংসের কারণও। হাত দ্বারা কাজ করার পরিবর্তে মানুষ যন্ত্রের সাহায্যে কাজ করতে শুরু করেছে। জানোয়ারে চড়ে সফর করার পরিবর্তে রেল, মোটর, জাহাজ ও বিমানে চড়ে যাতায়াত আরম্ভ করেছে। ডাক হরকরার পরিবর্তে বিজলী তার ও ওয়ার্লেসের মাধ্যমে সংবাদ আদান প্রদান করা হচ্ছে। এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ আগের চাইতে বেশী সুখী ও স্বচ্ছল হয়েছে। এই জিনিসগুলো দ্বারা তার যে পরিমাণ স্বাচ্ছন্দ্য বাড়তে পারে, সেই পরিমাণে তার বিপদ ও ধ্বংসের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ যে স্তরে মানুষের কাছে শুধু তীর ধনুক ও তরবারি জাতীয় অস্ত্র ছিলো, তার তুলনায় যে সভ্যতা তার হাতে মেশিনগান, বিষাক্ত গ্যাস, উড়োজাহাজ ও ডুবোজাহাজ তুলে দিয়েছে, তা অনেক বেশি মারাত্বক হতে পারে। জ্ঞান বিজ্ঞানের ও তমদ্দুনের উন্নতির পক্ষে কল্যাণের হেতু বা ধ্বংসের কারণ হওয়াটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে সেই সভ্যতার ওপর, যার প্রবাবধীনে জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও কৃষ্টি তমদ্দুন বিকাশ লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে ক্রমবিখাশের ধারা মানবীয় চেষ্টা সাধনার লক্ষ্য এবং অর্জিত শক্তিগুলোর প্রয়োজ ক্ষেত্র নির্ণয় করার দায়িত্ব হচ্ছে সভ্যতার। এটিই মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের স্বরূপ নির্ধারন করে, তার সামাজিক জীবনের নিয়মনীতি এবং ব্যক্তিগত,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির জন্যে নৈতিক বিধি বিধান তৈরি করে দেয়। ফলকথা জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে যে শক্তিগুলো মানুষ অর্জন করেছে, সেগুলোকে তার সভ্যতার মধ্যে কিভাবে প্রয়োগ করবে, কী উদ্দেশ্যে এবং কী প্রকারে ব্যবহার করবে, বিভিন্নরূপ ব্যবহার বিধির মধ্যে কোন কোনটি বর্জন আর কোন কোনটি গ্রহন করবে, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত করার জন্যে এই জিনিসটিই মানুষের মনকে যোগ্য করে তোলে।
বস্তুত জড়জগতে পর্যবেক্ষণ এবং প্রাকৃতিক নিয়ম কানুন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাটাই কোনো উচ্চতর সভ্যতার ভিত্তি হতে পারেনা। কারণ এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মর্যাদা একটি বুদ্ধিমান জীবের বেশি কিছু নয়। এগুলোর সাহায্যে শুধু বস্তুতান্ত্রিক জীবনাদর্শই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অর্থাৎ মানুষের জন্যে এই দুনিয়ার জীবনটাই হচ্ছে একমাত্র জীবন। এ জীবন নিজের জৈবিক কামনা-বাসনাকে যতোদূর সম্ভব পূর্ণ করাই হচ্ছে তার চরম ও পরম লক্ষ্য।বিশ্ব প্রকৃতিতে বাঁচার সংগ্রাম,প্রাকৃতিক নির্বাচন ও যোগ্যতমের উর্ধ্বতন সম্পর্কে যে বিধান কার্যকরী রয়েছে, তাকেই চরম সত্য বলে গ্রহণ করে এবং আশ পাশের তামাম সৃষ্টবস্তুকে নিষ্পিষ্ট করে সবার ওপরে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে শক্তির আসল প্রয়োগ ক্ষেত্র। এই জীবন দর্শনই হচ্ছে ইউরোপের অনুসৃত কৃষ্টি সভ্যতার মূল ভিত্তি। এরই ফলে জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতার উতকর্ষ মানুষের হাতে যতো শক্তিই তুলে দিয়েছে, তা মানবতার কল্যাণের পরিবর্তনের তার ধ্বংসেরে পথেই নিয়োজিত হতে শুরু করেছে। আজ ইউরোপবাসী নিজেরাই অনুভব করতে পারছে যে, তাদের জৈবিক সভ্যতা থেকে উচ্চতর একটি মানবিক সভ্যতার প্রয়োজন। আর সেই সভ্যতার ভিত্তি ধর্ম ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।
সামনে এগিয়ে লর্ড লোথিয়ান বলেনঃ
সায়েন্টিফিক স্পিরিট(সন্ধানী মনোভাব) ক্রমশ লোকদের ভেতর থেকে পুরন কুসংস্কারগুলো দূর করে দিয়েছে,জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে এবং এভাবে প্রাচীনকালের বহু বন্ধন থেকে নর-নারীকে মুক্তিদান করেছে সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই সঙ্গে সে মানুষকে আধ্যাতিক ও ধর্মীয় সত্যেরও প্রচন্ড মুখাপেক্ষী করে তুলেছে। অথচ সত্য অবধি পৌছাবার কোনো পথের সন্ধান সে দিতে পারেনি। আজকের অধিকাংশ পাশ্চাত্যবাসী শিশুসুলভ ক্ষিপ্রতা, বৈচিত্র বিলাস ও ইন্দ্রিয় সুখের নেশায় বিভোর। অনাড়াম্বর জীবন যাপনের সামর্থ তাদের থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ধর্মের পেশকৃত আদিম, অসীম ও অনন্ত সত্যের সঙ্গে তাদের কোনোই সংযোগ নেই।
ধর্ম মানুষের জন্যে অপরিহার্য পথিকৃত। মানব জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় নৈতিক লক্ষ্য, মর্যাদা ও তাতপর্য লাভ করার এটিই একমাত্র মাধ্যম। এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সংকুচিত হবার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বংশগত ও শ্রেণীগত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক অপকৌশলের প্রতি পাশ্চাত্য দুনিয়া আসক্ত হয়ে পড়েছে এবং যে বিজ্ঞান বস্তুগত উন্নতিকেই চরম লক্ষ্য বলে আখ্যা দেয় এবং জীবনকে দিন দিন জটিল ও দুর্বিষহ করে তোলে, তারপ্রতি ঈমান এনে বসেছে। পরন্তু বর্তমান যুগের সবচাইতে বড় আপদ জাতীয়তাবাদের কবল থেকে মুক্তিলাভের জন্যে আত্মা ও জীবনের মধ্যে যে ঐক্যের প্রয়োজন, সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাও আজকের ইউরোপের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ-ও হচ্ছে ধর্মীয় কর্তৃত্ব হ্রাস পাবার একটি উল্লেখযোগ্য ফল।
অতঃপর লর্ড লোথিয়ান ভারতের আধুনিক শিক্ষিত লোকদের সামনে এই প্রশ্ন উত্থাপন করেনঃ
ভারতের দু’টি বৃহৎ ধর্ম হিন্দুমত ও ইসলাম কি পাশ্চাত্যের ধর্মীয় বিদ্বেষের চাইতে বেশি সাফল্যের সঙ্গে আধুনিক যুগের সমালোচনা ও সন্ধানী ভাবধারার মোকাবিলা করতে পারবে? এটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি ভারতকে পাশ্চাত্যের ওপর আপতিত বিপদাপদ থেকে রক্ষা করতে হয়, তবে এই প্রশ্নটির প্রতি এদেশের চিন্তাবিদ ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিৎ। এটা নিঃসন্দেহে যে, সন্ধানী ভাবধারা ক্রমে ক্রমে ভারতের জনগণের মধ্য থেকে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার উৎপাদনগুলোকে বিলীন করে দেবে এবং এটা খুবই ভালো কাজ হবে। কিন্তু এই জিনিসটি কি ভারতের রাজনৈতিক,তামাদ্দুনিক ও শৈল্পিক জীবনের ভাবী নেতৃবৃন্দের মন মগজ থেকে উভয় ধর্মের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূলনীতিকেও বের করে দেবে? আমি হিন্দুমত ও ইসলামের অভ্যন্তরীন জীবন সম্পর্কে বেশী পরিচিতির দাবীদার নই। তবু আমি মনে করি, এই দু’টি ধর্মের মধ্যে এমনসব উপাদান রয়েছে, যা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত পুরুষ ও মেয়েদেরকে আয়ত্তাধীন রাখার ব্যাপারে এর যে কোন একটিতে যোগ্য করে তুলতে পারবে। খ্রীষ্টধর্ম তো এ ব্যাপারে এমন কতকগুলো ভ্রান্ত বিশ্বাসজাত বন্ধনের ফলে ব্যার্থকাম হয়েছে, যা এই ধর্মের মহান প্রবর্তকের পেশকৃত সত্যতাকেই গোপন করে ফেলেছে।
এখানে লর্ড লোথিয়ান নিজেই স্বীকার করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে হিন্দুত্ববাদ ও ইসলাম সম্পর্কে তার বেশি কিছু জানাশোনা নেই। তিনি শুধু দূর থেকে হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে কতিপয় উল্লেখযোগ্য জিনিস দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মতে এই জিনিসগুলো আধুনিক সমালোচনা ও সন্ধানী ভাবধারার মুকাবিলায় শিক্ষিত লোকদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে সফলকাম হতে পারে। কিন্তু যারা এই উভয় ধর্ম তথা ভারতের সমস্ত ধর্মের অভ্যন্তরীন অবস্থা সম্পর্কে অবহিত তাদের কাছে এটা মোটেই গোপন নয় যে, সমালোচনা ও সন্ধানী ভাবধারার মুকাবিলায় টিকে থাকতে চাইলে একমাত্র ইসলামই টিকে থাকতে পারে; বরং স্পষ্টতম ভাষায় বলতে গেলে,এমনি ভাবধারাসহ কোনো ধর্মের পক্ষে তাঁর অনুবর্তীদের নিয়ে সামনে এগোবার এবং প্রগতি ও আলোকের যুগে গোটা মানব জাতির ধর্মরূপে স্বীকৃতি পাবার যোগ্যতা একমাত্র ইসলাম ছাড়া আর কারো নেই। খ্রীষ্টধর্ম কেনো ব্যর্থকাম হয়েছে? কেবল এই জন্যে যে, তা কোনো সামাজিক মতাদর্শ নয়; বরং তা সমাজবদ্ধতারই ঘোর বিরোধী। সে শুধু ব্যক্তির নাজাত সম্পর্কেই আলোকপাতকরে আর সে নাজাতের জন্যেও সে দুনিয়ার প্রতি বিমুখ হয়ে আসমানী বাদশাহীর মুখাপেক্ষী হওয়াকে একমাত্র পন্থা বলে নির্দেশ করে। এ কারনেই ইউরোপের জাতিগুলো উন্নতি ও তরক্কির পথে পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে খ্রীষ্টধর্ম তাদের সহায়ক হবার পরিবর্তে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। ফলে তাঁর বন্ধনকে ছিন্ন করেই তাদের এগিয়ে চলতে হয়। হিন্দুধর্মের অবস্থাটাও এরই সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তার কাছেও কোনো প্রগতিশীল জীবন দর্শন, কোনো যুক্তিসম্মত নৈতিক বিধান ও কোনো প্রসারমান সমাজপদ্ধতি বর্তমান নেই। আজ পর্যন্ত হিন্দুদেরকে একটি সমাজ পদ্ধতিতে বেধে রাখার এবং অন্যান্য সভ্যতার প্রভাব গ্রহণ থেকে তাদেরকে বিরত রাখার ব্যাপারে সবচাইতে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে তাদের বর্ণাশ্রম প্রথা। কিন্তু হতে বাধ্য এবং এ ছিন্ন হবেই। এরপর আর কোনো জিনিস হিন্দু সমাজকে ভাঙ্গনের হাত থেকে বাচাতে পারবেনা। ফলে তাঁর রুদ্ধ দরজা বহিপ্রভাবের জন্যে উন্মুক্ত হয়ে যাবে।পরন্তু এটাও লক্ষ্যণীয় যে, হিন্দুদের প্রাচীন সভ্যতা ও সমাজ বিধান, পুরনো মুর্তিপূজামূলক কুসংস্কার এবং তাদের অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক দার্শনিক মতগুলো আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক উন্নতি ও সমাজ সচেতনতার সামনে টিকে থাকতে পারেনা। তাই এখন হিন্দুরা দিন দিন এমনি এক চরম সন্ধিক্ষনের নিকটবর্তী হচ্ছে যেখানে তাদের এবং বহুলাংশে ভারতের ভাগ্য নির্নীত হবে। হয়তো তারা তারা ইউরোপের রেনেসা আমলের খ্রীষ্টানদের ন্যায় ইসলামের প্রতি বিমূখ ও বিদ্বেষান্ধ হয়ে বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার পথ অবলম্বন করবে, নতুবা দলে দলে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকবে।
এই ফয়সালা বহুলাংশে মুসলমানদের,বিশেষত প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষিত লোকদের কর্মধারার ওপর নির্ভর করছে। কারণ ইসলাম শুধু তাঁর নামের জোরেই কোনো মু’জিযা দেখাতে পারেনা। তাঁর নীতি ও আদর্শ শুধু কিতাবের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ থাকলে তাঁর পক্ষেও কোনো মু’জিযা দেখানো সম্ভবপর নয়। যে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে বর্তমানে মুসলমানরা লিপ্ত রয়েছে, যে জড়তা ও স্থবিরতা তাদের আলিম সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং যেরূপ নারীসুলভ ভীরুতা ও লাজুকতা তাদের নব্যশিক্ষিত বংশধরদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে ভারতের আত্নাকে জয় করা তো দূরের কথা, ইসলামের দাবিদারগণ নিজেদের জায়গায়ই টিকে থাকরে পারবে বলে আশা করা যায়না। বিপ্লবের খরস্রোতের মুখে কোনো জাতির স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। হয় তাকে স্রোতের মুখে ভেসে যেতে হবে, নতুবা পূর্ন বিক্রমের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে স্রোতের গতিমুখ ঘুরিয়ে দিতে হবে।এই দ্বিতীয় অবস্থাটি কেবল এভাবেই সৃষ্টি হতে পারে যে, প্রথমত সাধারন মুসলমানদের নৈতিক অবস্থার সংশোধন করতে হবে এবং তাদের মধ্যে ইসলামী জিন্দেগীর মূল ভাবধারা উজ্জীবিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত আলেম সমাজ ও নব্য শিক্ষিত মুসলমানদের মিলিতভাবে ইসলামী নীতির আলোকে জীবিনের আধুনিক সমস্যাবলী অনুধাবন করতে হবে এবং আদর্শ ও বাস্তব উভয় দিক থেকেই সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধান পেশকরতে হবে – যাতে করে অন্ধ বিদ্বেষী ছাড়া প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষই স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, একটি প্রগতিশীল সমাজের পক্ষে ইসলামী কৃষ্টি ও সভ্যতা ছাড়া আর কোনো ভিত্তিই নির্ভুল ও নির্দোষ হতে পারেনা।
ভারতে[উল্লেখ্য করা যেতে পারে যে,এই প্রবন্ধ লেখা হয়েছে ১৯৩৮ সালে।অবিভক্ত ভারতের তখনকার অবস্থায় পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রবন্ধে যেসব সমস্যার উল্লেখ করা হয়েছিলো,খন্ডিত তারতের দেশে দেশে আজো তা বর্তমান রয়েছে।–অনুবাদক] ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে আজকে যে ধরনের বিরোধ চলছে,আজ থেকে ৫০/৬০ বছর পূর্বে ইউরোপে তেমনি বিরোধই বর্তমান ছিলো। কিন্তু ইউরোপের উচ্ছিষ্টভোজী ভারতেও খুব শিগগীরই পট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। কাজেই সেদিন বেশি দূরে নয়,যেদিন ধর্মের বিরুদ্ধে অন্তত যুক্তি ও জ্ঞানের দিক থেকে এই বিদ্বেষের অস্তিত্ব থাকবে না। অবশ্য সে জন্য শর্ত এই যে, সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্যে আগে থেকেই আমাদের তৈরী থাকতে হবে। লর্ড লোথিয়ান সংক্ষেপে এই নিগূঢ় সত্যের দিকেও ইংগিত করেছেনঃ৬০ বছর পূর্বে বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে যে লড়াই চলছিল, তার অবসানের কোনোই প্রত্যাশা ছিলোনা; বরং জীবনের আধ্যাত্ম্রিক ও যান্ত্রিক ধারণার মধ্যকার এই যুদ্ধ সম্পর্কে এমনি সংশয় দেখা দিয়েছিলো যে, এ দুয়ের মধ্যকার কোনো একটির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এর অবসান হবেনা। কিন্তু আজকে উভয় বিবাদমান পক্ষই রণে ভংগ দিয়েছে। বিজ্ঞানী কি ধার্মিক, এ দুয়ের কেউই আজ দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করছেন না যে, বিশ্ব প্রকৃতির তামাম রহস্য তিনি উদঘাটন করে ফেলেছেন – সমস্ত জটিলতার তিনি মীমাংসা করতে পেরেছেন; বরং প্রকৃতপক্ষে এ রহস্য সম্পর্কে তিনি আদৌ কিছু জানেন কিনা উভয়ের মনে এমনি একটা সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই আজকে এমন একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যা জ্ঞান বিজ্ঞানের নিত্য নতুন অগ্রগতির মাঝে অসম্ভব মনে হয়েছিলো।
লর্ড লোথিয়ান অবশ্য ধর্ম সম্পর্কে খ্রীস্টীয় ধারনার প্রভাবমুক্ত নন। তাছাড়া তিনি ধর্ম সম্পর্কে ইসলামের যুক্তিসম্মত ধারনাও সন্ধান পাননি। এ কারনে তিনি বড়জোর এটুকুই ভাবতে পারেন যে, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে আজকে কোনো সমন্বয় হতে পারে। কিন্তু আমরা ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয়কে সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে করি। আজকে বিজ্ঞানের প্রাণবস্তু হবার পথে ইসলামের কোনো বাধা থেকে থাকলে তা তাঁর অন্তর্নিহিত ত্রুটি নয়; বরং তা হচ্ছে তাঁর অনুবর্তীদের সীমাহীন অলসতা এবং বিজ্ঞানের ধ্বজাবাহীদের অজ্ঞতা ও জাহিলীসুলভ বিদ্বেষ।এ দুটি বাধা অপসারিত হলে বিজ্ঞানের খাচার মধ্যে ইসলাম অবশ্যই প্রাণবস্তু হয়ে থাকবে।
সামনে অগ্রসর হয়ে প্রাজ্ঞ বক্তা আর একটি বিষরের প্রতি আলোকপাত করেছেন। তা হলো এই যে, বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক জাগরণ ও বুদ্ধিভিত্তিক সমালোচনার মোকাবিলায় কোনো ধরনের ধর্ম কি টিকে থাকতে পারে? বর্তমান আলোকজ্জ্বল যুগে মানুষ যে ধর্মের অনিসন্ধিতসু,তার কি কি বৈশিষ্ট থাকা উচিৎ? এবং বর্তমান মানুষ কোন কোন মৌল প্রয়োজনে ধর্মের পথ নির্দেশ খুজে বেড়াচ্ছে?
এটিই হচ্ছে আলোচ্য ভাষোণের সবচাইতে বেশি লক্ষণীয় বিষয়।তিনি বলেছেনঃ
পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার ধারণা যদি ভ্রান্ত না হয়, তবে এ সত্য অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বর্তমান সময়ের ধর্ম এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। এ পরীক্ষায় সে কেবল তখনি সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে পারবে, যখন নব্য বংশধরগণ তাঁর অন্তর্নিহিত বিধি ব্যবস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারবে যে, জীবনের সমস্ত বাস্তব সমস্যা জিজ্ঞাসা ও জটিলতার সুষ্ঠু সমাধান এই ধর্মের মধ্যেই নিহিত। ব্যাক্তিগত ধর্মের দিন আজ আর নেই। সেদিন আগেই বিদায় নিয়েছে। নিছক ভাবপ্রবন ধর্মের আজ কারো প্রয়োজন নেই। যে ধর্ম কেবল মানুষের নৈতিক আচার ব্যবহার সম্পর্কেই কিছুটা বিধি ব্যবস্থা দেয়ার মতো সাহায্য করতে পারে এবং বড়জোড় পরকালীন মুক্তিরই প্রতিশ্রুতি দিতে সক্ষম, তার যুগও আজ শেষ হরে গিয়েছে। বর্তমান যুগের যুক্তিবাদী মানুষ তো প্রতিটি জিনিসকে এমন কি সত্যকেও প্রত্যক্ষ ফলাফলের মানদন্ডে যাচাই করে দেখতে চায়। তার যদি ধর্মের আনুগত্য করতে হয়, তা হলে পূর্বাহ্নে তাঁর এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে যে, ধর্মের কাছে তাঁর বাস্তব সমস্যাবলীর কি সমাধান রয়েছে। বহু জন্ম-জন্মান্তর পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাণ লাভের প্রত্যাশা কিংবা মৃত্যুর পর্যায় অতিক্রম করে আসমানী রাজত্বে উপনীত হবার প্রতীক্ষা এমন কোনো জিনিস নয় যে, কেবল এর ওপর ভরসা করেই সে ধর্ম গ্রহণ করবে। তার দার্শনিক অনুসন্ধিতার কারণে ধর্মকে সর্বপ্রথম এমন চাবিকাঠি সংগ্রহ করে দিতে হবে, যা দ্বারা সে বিশ্ব প্রকৃতির গোপন রহস্যের কোনো সন্তোষজনক সমাধান বের করতে পারে। উপরন্ত তাকে যথাযথ বৈজ্ঞানিক পন্থায় কার্য ও কারণ-তথা নিমিত্ত ও ফলাফলের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রমাণ করে দেখাতে হবে যে, বর্তমান যেসব উদ্ধত ও দূর্বীনিত শক্তি মানব জাতির কল্যাণের পরিবর্তে ধ্বংসের হুমকি প্রদর্শন করছে, সেগুলোকে সে কিভাবে নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে পারে, অনুরূপভাবে সে বেকার সমস্যা, অযৌক্তিক বৈষম্য, জুলুম নীপিড়ন, অর্থনৈতিক শোষোণ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং অন্যান্য সামাজিক বিকৃতি কিভাবে নির্মূল করবে, লোকদের পারস্পরিক হানাহানি এবং পারিবারিক ব্যবস্থার বিপর্যয়কে কিভাবে রোধ করবে, ইত্যাকার বিষয়ও ধর্মে নির্দেশ করতে হবে। কারণ এই সমস্যাগুলোই মানুষের সমস্ত আনন্দকে ছিনিয়ে নিয়েছে। ধর্মের প্রতি আজ মানুষের এতোটা মুখাপেক্ষী হবার একমাত্র কারণ এই যে, বিজ্ঞান তাঁর সমস্যাবলীর সমাধানের পরিবর্তে একে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারনেই সে ধর্মের কাছ থেকে নিজের সন্দেহ ও সমস্যাবলীর মীমাংসা করানোর ব্যাপারে আজকের মতো এতোটা ব্যাকুল আর কখনো হয়নি। কাজেই ধর্ম তাঁর চৌহিদ্দির নিরাপত্তা এবং তাঁর লুপ্ত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে চাইলে উল্লেখিত প্রশ্নাবলীর আধাত্নিক অথচ বিজ্ঞানসম্মত জবাব দান করতে হবে – যাতে করে এই দুনিয়ায় বসেই তারে যথার্থতাকে ফলাফলের মানদন্ডে যাচাই, পরখ করা যেতে পারে।অর্থাৎ সে জবাবকে মৃত্যুরপরবর্তী দুনিয়ার জন্য শিকায় তুলে রাখা যাবেনা। আমরা পাশ্চাত্যবাসীরা জানি যে, এটিই হচ্ছে আমাদের এ যুগের সবচাইতে বড় সমস্যা। আপনারা ভারতবাসীরা এর কি জবাব দিতে পারেন?
লর্ড লোথিয়ানের ভাষণের এ অংশটি পড়ার পর মনে হয় সত্যই, একজন পিপাসার্ত ব্যক্তি যেনো যাতনায় ছটফট করছে। তার পানি সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই; কিন্তু পিপাসার লক্ষণগুলোকে সে যথাযথ অনুভব করছে এবং তার কলিজার আগুন কোন্ কোন্ গুণবিশিষ্ট জিনিস কামনা করছে, তাও সে স্পষ্টত বলে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় তার সামনে পানি এনে হাযির করা হলে তার প্রকৃতি এমনি বলে উঠবে, এই জিনিসটির জন্যেই তো পিপাসায় অস্থির। এমনকি পানির পাত্রটি নিয়ে চুমুক লাগাতেও সে কিছুমাত্র দ্বিরুক্তি করবেনা। এই অবস্থা শুধু লর্ড লোথিয়ানেরই নয়; বরং ইউরোপ, আমেরিকা তথা পৃথিবীর যেখানেই মানুষ পাশ্চাত্য সভ্যতার আগুনে দগ্ধ হয়েছে এবং দর্শন ও বিজ্ঞানরূপ মরুভূমির তীরবর্তী সবুজ বর্ণালী অতিক্রম করে মধ্যবর্তী পানি তৃণ লতাহীন প্রান্তরে এসে উপনীত হয়েছে, তারা সবাই আজ একই রূপে তৃষ্ণার্ত এবং লর্ড লোথিয়ানের ন্যায় সবাই একই গুণবিশিষ্ট জিনিস কামনা করছে। এর কেউই পানির নাম জানেনা, তা কোথায় পাওয়া যায় সে কথাও কেউ জানেনা; কিন্তু থেকে থেকে শুধু চীৎকার করছে ‘যে জিনসটির দ্বারা কলিজার আগুন নেভানো যাবে, তা শীঘ্রই নিয়ে এসো!’
পানির নাম অবশ্য শুনেছে; কিন্তু তার আসল চেহারা তারা প্রত্যক্ষ করেনি; বরং অজ্ঞ ও বিদ্বেষান্ধ পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে তারা একথাও শুনে আসছে যে, ‘সাবধান! পানির কাছেও যেওনা, এ একটি বিষাক্ত ভয়ংঙ্কর জিনিস।’ এ কারণেই তারা এ নামটিকে ভয় করে আসছে। কিন্তু আজকে পরিস্থিতি এমনি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, নামটি গোপন করে আসল জিনিসটি যদি তাদের সামনে পেশ করা হয়, তবে সত্যই তারা বলে উঠবেঃ ‘হ্যাঁ, এ জিনিসটির জন্যেই আমরা তৃষ্ণার্ত ছিলাম।’ তারপর যদি তাদের বলা হয়, ‘জনাব! যে নামটিকে আপনারা ভয় করছেন, এ হচ্ছে সেই পানি, তা হলে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলবেঃ ‘এতোদিন আমরা কী ধোকার মধ্যেই না ছিলাম!’
বর্তমান যুগের যুক্তিবাদী মানুষ খ্রীষ্টধর্মকে খুব ভালোমতো যাচাই পরখ করে দেখেছে। এ ধর্মটি যে তার ব্যাধির কোন প্রতিকার নয়, একথা দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের হেয়ালী দর্শন এবং তাদের ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখে কখনো কখনো সে মুগ্ধ হয় বটে কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমালোচনা ও বিশ্লেষণের প্রথম আঘাতেই তাদের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে পড়ে। বৌদ্ধ ধর্ম তো অনেকটা খ্রীষ্টধর্মেরই ভারতীয় সংস্করণ। আর হিন্দু ধর্ম নিজেই এমনসব সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি করে চলেছে, যেগুলো থেকে নিস্তার লাভের আশায়ই বর্তমান যুগের যুক্তিবাদী মানুষ ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করছে। এর চৌহদ্দির ভেতরেই মানুষে মানুষে অযৌক্তিক বৈষম্য সবচাইতে বেশি লক্ষ্য করা যায়। আর্থিক শোষণের সবচাইতে নিকৃষ্ট রূপ – অর্থাৎ মহাজনী ও সুদখোরী এর বিধি-ব্যবস্থার অচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল কারণ অর্থাৎ মানুষের গোত্রীয় বিভাগ ও বিদ্বেষ- তার ভিত্তিমূলে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছে। তার প্রতিষ্ঠিত সমাজ পদ্ধতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেনা; বরং তাকে বেশুমার শ্রেণী ও গোত্রে বিভক্ত করে দেয়। তার সমাজ বিধান এতোই প্রাচীন ও জরাজীর্ণ যে, বর্তমান বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবধর্মী চেতনার যুগে হাজার হাজার বছরের খান্দানী হিন্দুরা পর্যন্ত সেগুলোকে লঙ্ঘন করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ এগুলোর ভিত্তি জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তিবাদের ওপর নয়; বরং বিদ্বেষ ও কুসংস্কারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই সকল পার্থিব বিষয় ছাড়াও ন্যায় শাস্ত্র ও আধ্যাত্মবাদের ক্ষেত্রে তাকে আরো বেশি অকেজো বলে মনে হয়। বিশ্ব প্রকৃতির গোপন রহস্যাবলীর সন্তোষজনকভাবে মীমাংসা করার মতো কোন চাবিকাঠি তার কাছে নেই। তার প্রত্যয়গুলো নিছক কাল্পনিক বিষয় মাত্র, তার কোন একটি বিষয়ের পক্ষেও কোন বৈজ্ঞানিক বা বুদ্ধিভিত্তিক প্রমাণ পেশ করা যেতে পারে না। নীতি শাস্ত্রের ব্যাপারে চিত্তহারী কল্পনার একটি ইন্দ্রজাল সে অবশ্যি সৃষ্টি করে- যেমন একটি ইন্দ্রজাল মহাত্মা গান্ধীও সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু যুক্তি প্রমাণ ও বাস্তব বিচার বুদ্ধি (Practical wisdom) থেকে তা একেবারেই শূণ্য। কাজেই বর্তমান বৈজ্ঞানিক চেতনার যুগে তার ব্যর্থতা যে খুব শীঘ্রই প্রকটিত হয়ে উঠবে, এটা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়।
এরপর বাকি থাকে শুধু ইসলাম। বস্তুত আজকের যুক্তিবাদী মানুষ তর ঈস্পিত ধর্মের জন্য যেসব মাপকাঠি পেশ করেছে বা করতে পারে তার প্রতিটি মাপকাঠিতে ইসলাম পুরোপুরি উত্তীর্ণ।
ধর্ম নিছক একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং শুধু ব্যক্তিগত নীতিবোধের সঙ্গেই এর সম্পর্ক রয়েছে, একথা আজকে বাসি হয়ে গেছে। আসলে এ হচ্ছে ঊনিশ শতকেরই এক বিশেষ খামখেয়ালি মাত্র। অথচ বিশ শতকের এই চতুর্থ দশকে বসেও আমাদের দেশের একশ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল লোক এই মতবাদটি প্রচার করে চলছে। এই শ্রেণীর লোকেরা ‘প্রগতি’ ‘প্রগতি’ বলে চিৎকার করা সত্ত্বেও হামেশা চলমান বিশ্বের চাইতে পঞ্চাশ বছর পেছনে চলতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আজকে একথা প্রায় সর্বজন স্বীকৃত বলা চলে যে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তির কোন চিন্তাই করা যেতে পারেনা। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিই অপরাপর ব্যক্তির সংঙ্গে বেশুমার ছোট বড় সম্পর্কে জড়িত। সমাজ হচ্ছে মোটামুটিভাবে একটি দেহ সদৃশ্য। এখানে ব্যক্তির মর্যাদা হচ্ছে জীবন্ত দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো। ধর্মের প্রয়োজন যদি থেকেই থাকে, তবে তা শুধু ব্যক্তির নিজস্ব মনোতুষ্টি বা পরকালীন মুক্তির জন্য নয়; বরং গোটা সমাজের সংগঠন এবংপার্থিব জীবের তাবৎ কাজ কারবার পরিচালনার জন্যেই প্রয়োজন। আর তার প্রয়োজন না থাকলে ব্যক্তি বা সমাজ কারুর জন্যেই নেই। সমাজের বিধি-ব্যবস্থা হবে একরূপ আর ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মচারণ হবে তার থেকে ভিন্নরূপ, এটা নিছক বালকসূলভ বক্তব্য বৈ কিছু নয়। সমাজ জীবনের সাথে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মচারণের যদি সম্পর্ক না থাকে, তবে তো তেমন বিশ্বাস ও আচরণ একেবারেই নিরর্থক। শুধু নিরর্থক নয়, বরং যে সমাজ ব্যবস্থার অন্যান্য অংশের সাথে তা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত নয়, সেখানে তার বিলুপ্তি অনিবার্য। কাজেই দু’টি পন্থার মধ্যে কেবল একটি পন্থাই গৃহীত হতে পারেঃ হয় গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে একেবারে ধর্মহীন করতে হবে এবং কমিউনিস্ট মতবাদ অনুসারে মানব জীবন থেকে ধর্মকে চূড়ান্তরূপে নির্বাসিত করতে হবে; নতুবা সমাজ জীবনকে পুরোপুরি ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে এবং ইসলামের দাবি অনুসারে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃষ্টি তমুদ্দুন উভয় ক্ষেত্রেই ধর্মকে একমাত্র দিশারী বলে মানতে হবে। প্রথম পন্থাটি মানুষ বহুকাল ধরে পরীক্ষা করে দেখছে। তার যে বিষতিক্ত ফলের কথা লর্ড লোথিয়ান উল্লেখ করেছেন, তা-ই তা থেকে উৎপন্ন হতে পারে এবং তা-ই উৎপন্ন হয়েছে। আর ভবিষ্যতেও এ নিয়মের কোন ব্যতিক্রম ঘটবেনা। এমতাবস্তায় দুনিয়ার মুক্তি কেবল দ্বিতীয় পন্থাটির মধ্যেই নিহিত এবং এই পন্থাটি বাস্তবায়িত হবার সম্ভাবনা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে।
কিন্তু পূর্বে যেমন বলেছি, এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা কিংবা একে চিরতরে হারিয়ে ফেলা সম্পূর্ণত মুসলমানদের ইচ্ছাধীন। বাস্তব ঘটনা দুনিয়া ও দুনিয়ার একটি অংশ হিসেবে আমাদের এই দেশকে এমন এক স্থানে নিয়ে এসেছে, যেখান থেকে চলার গতি ইসলামের দিকেও ঘুরে যেতে পারে, আবার বস্তুতন্ত্র ও নৈতিক অরাজকতার অতল গহ্বরে গিয়েও পৌঁছা সম্ভব। সম্ভবতই তার গতি আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় পথের দিকেই রয়েছে; কারণ এক সুদীর্ঘকাল থেকে দুনিয়া এ পথেই এগিয়ে চলছে। অবশ্য এ পথের নানা বিপদাপদ ও বিভীষিকা দেখে সে ভীত ও শঙ্কিত হয়ে উঠেছে এবং এছাড়া কোনো বঁচার পথ আছে কিনা, চারদিকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে তাও নিরীক্ষণ করছে। কিন্তু বাঁচার কোনো পথই তার দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছেনা। প্রকৃতপক্ষে তাদের দৃষ্টিশক্তিকে আবরণমুক্ত করা এবং ইসলামের সহজ সরল পথকে একমাত্র মুক্তির পথ বলে প্রমাণ করার মতো শক্তিশালী নেতৃবৃন্দের জন্য তারা প্রতীক্ষমান। এমন মোজাহিদ ও মোজতাহিদের কোনো দল যদি মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় তো তারাই গোটা পৃথিবী দিশারী হতে সক্ষম। এমতাবস্থায় পূর্বে যে মর্যাদার আসনে তারা অভিষিক্ত ছিলো এবং সেখানে পাশ্চাত্য জাতিগুলোকে অধীষ্ঠিত দেখে আজকে তারা লালয়িত হচ্ছে, সে আসন আবার তারা লাভ করতে পারে। কিন্তু এ জাতির সংখ্যাগুরু অংশ যদি আজকের মতোই হতাশা ও নিরুৎসাহের সঙ্গে বসে থাকে, তার যুব সম্প্রদায় যদি পরের উচ্ছিষ্ট ভোজনকেই চরম স্বার্থকতা মনে করে, তার আলিম সমাজ যদি প্রাচীন ফিকাহ ও কালামের অন্তসারশূন্য বিতর্কে লিপ্ত থাকে, তার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকৃষ্ট মানসিকতা যদি ভিন জাতির পদাঙ্ক অনুসরণকেই ‘জিহাদী মনোবৃত্তির’ উচ্চতম আদর্শ বলে গণ্য করেন এবং আপন জাতিকে বিশ শতকের সবচাইতে বড় পতারণার ফাঁদে নিক্ষেপ করাকেই বিরাট কৃতিত্ব ও বুদ্ধিমত্তা বলে ভাবেন- ফলকথা এই বিশাল জাতির আপাদমস্তক সবটাই যদি নিষ্ক্রিয়তা ও অকর্মন্যতায়ই লিপ্ত থাকে এবং এই কোটি কোটি মানুষের মধ্যে থেকে কয়েকজন মর্দে মু’মিনও আল্লাহর পথে জিহাদ ইজতিহাদ ও সংগ্রাম সাধনার জন্যে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে দুনিয়া যে অতল গহ্বরের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সে গহ্বরে এ জাতিও একদিন নিক্ষিপ্ত হবে। তারপর আল্লাহর গযব আর একবার গর্জন করে উঠবেঃ
(আরবী)
(অর্থঃ ধ্বংস হোক আলিম সম্প্রদায়।)