৭
তুরস্কের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংঘাত
[প্রবন্ধটি ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাসিক তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।– সম্পাদক]
খালেদা এদিব খানমের ভাষণ
[নামটির তুর্কী উচ্চারণ ‘হালিদা এদিব হানুম’।]
খ্যাতনামা তুর্কী বিদুষী ও সংগ্রামী মহিলা খালেদা এদিব খানম ১৯৩৫ সালের মধ্যভাগে ‘জামেয়া ইসলামিয়া’র আমন্ত্রণক্রমে ভারতে এসেছিলেন। তিনি দিল্লিতে যে য়টি ভাষণ প্রদান করেন, জামেয়ার অধ্যাপক ডক্টর সাইয়্যেদ আবিদ হোসাইন ‘তুরস্কে প্রাচ্যও পাশ্চাত্যের সংঘাত’ নামে তার উর্দু তরজমা প্রকাশ করেছেন। আলোচ্য নিবন্ধে উক্ত ভাষণগুলোর প্রতি আমরা কিছুটা আলোকপাত করবো।
মুসলিম জাহানে বর্তমানে দু’টি রাষ্ট্র দু’টি ভিন্ন দিক দিয়ে থেকে বিশ্ব মুসলিমের নেতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত। মানসিক দিক থেকে মিসর আর রাজনৈতিক দিক থেকে তুরস্ক। মিসরের সাথে মুসলিম জাতির সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে বেশি গভীর। কারণ তার ভাষা হচ্ছে আমাদেরই নিজস্ব আন্তর্জাতিক ভাষা -আরবি। তার বই পুস্তকাদি তামাম দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে প্রচারিত হয়। তার মানসিক প্রভাব চীন থেকে মরক্কো অবধি বিস্তৃত। এক কথায়, মিসরই হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যকার মেলামেশা, বোঝাপড়া ও জানাজানির একমাত্র সূত্র। পক্ষান্তরে তুর্কী জাতির সংগ্রামী জীবন, পাশ্চাত্য অভিযানের বিরুদ্ধে তাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা এবং জাতীয় মর্যাদার জন্যে তাদের বিপুল ত্যাগ ও কুরবানী নিসন্দেহে তামাম মুসলিম জাহানকে প্রভাবান্বিত করেছে। এ কারণেই তারা মুসলিম জাহানে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে উপবিষ্ট। কিন্তু ভাষাগত অপরিচিত এবং পারস্পরিক মেলামেশা ও বোঝাপার অভাব তুরস্ক ও অধিকাংশ মুসলিম দেশের মধ্যে একটি গভীর অন্তরালের সৃষ্টি করেছে। এর ফলে তুর্কী জাতির মানসিক ক্রমবিকাশ, তাদের বুদ্ধিভিত্তিক গড়ন, তার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা খুবই সীমাবদ্ধ। বিশেষত সাম্প্রতিক দশ বারো বছরে তুরস্কে যে বিরাট বিপ্লব ঘটে গেছে, তার অন্তর্নিহিত কারণ ও মূল ভাবধারাটি জানবার ও বুঝবার সুযোগ আমরা খুব কমই পেয়েছি। বহু লোক তুর্কিদের প্রতি যারপর নাই অসন্তুষ্ট। কেউ কেউ আবার তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে। এমনকি কতক লোক তাদেরপাশ্চাত্য প্রীতিকে নিজেদের পাশ্চাত্য পূজার জন্যে চূড়ান্ত দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্য এদের কারো কাছে নেই। কারো কারো কাছে সামান্য তথ্য বর্তমান থাকলেও আধুনিক তুরস্কের প্রাণসত্তাকে উপলব্ধি করার জনে তা মোটেই যথেষ্ঠ নয়।
এ পরিস্থিতিতে আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আধুনিক তুরস্কের একজন বিশিষ্ট নির্মাতা এখানে এসে নিজ জাতির অভ্যন্তরীণ অবস্থা ব্যক্ত করেছেন। তিনি শুধু সাম্প্রতিক বিপ্লবের মঞ্চাভিনেত্রীই ছিলেননা; বরং তিনি ছিলেন সে বিপ্লবের এক বিশিষ্ট ক্রিয়াশীল শক্তি। সেই সঙ্গে তিনি আল্লাহর ফযলে পন্ডিতোচিত দূরদৃষ্টি, দার্শনিকসূলভ উপলব্ধি ও মনীষীতুল্য ধী-শক্তির অধিকারিণী। এর ফলে তিনি বাহ্য ঘটনা প্রবাহের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ যেমন বুঝতে পারেন, তেমনি তা বোঝাতেও পারেন। এমনি প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এই প্রথমবার আমরা তুরস্ককে সঠিকভাবে জানবার ও বুঝবার সুযোগ পেয়েছি। আধুনিক তুরস্কের প্রাণসত্ত্বাকে তিনি আমাদের সামনে উন্মোচিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। যে জাতি আজ মুসলিম দুনিয়ার শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বই প্রদান করছেনা, তার মানসিক নেতৃত্ব অর্জনেও প্রয়াসী। প্রকৃতপক্ষে তার অভ্যন্তরীণ অবস্থাটা কি, কি কি উপাদান দ্বারা তা সংগঠিত হয়েছে, কোন্ কোন্ শক্তি তার ভেতর কাজ করছে, কোন্ কোন্ কার্যকারণ তাকে বর্তমান জায়গায় টেনে নিয়ে এসেছে এবং আজকে কোন্ দিকেই বা এগিয়ে চলছে – এসব কথা পরিপূর্ণ সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে তিনি আমাদের বলেছেন। এ প্রামাণ্য তথ্যাগারটি বিভিন্ন দিক থেকেই আমাদের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। এর শুধু এই একটি ফায়দাই নয় যে, তুর্কী জাতির প্রকৃত অবস্থা আমাদের সামনে প্রকট হয়ে পড়েছে; বরং এর একটি বড় ফায়দা এই যে, তুরস্ক থেকে আমাদের নব্য বংশধরগণ আজকে যে পথনির্দেশ পাচ্ছে, তার মূল ভাবধারাকে আমরা অধিকতর উত্তমরূপে বুঝতে পারছি। মোটকথা, বর্তমানে মুসলিম জাহানে যে বিপ্লব সংগঠিত হতে চলছে, তার অভ্যন্তরীণ কার্যকরণকে বুঝবার আর একটি সুযোগ আমরা লাভ করেছি।
অবশ্য খালেদা খানমের মারফতে আধুনিক তুরস্ককে বুঝবার আগে খোদ তাঁকেই উত্তমরূপে বুঝে নেয়া দরকার। এটা নিসন্দেহ যে, খালেদা খানমের অন্তর পুরোপুরি মুসলমান এবং তা ঈমানী চেতনায় পরিপূর্ণ। আর সে ঈমানও যেনো তেনো রকম নয়, ঈর্ষা করার মতো। কারণ তা হচ্ছে এক মুজাহিদ নারীর ঈমান। [দুঃখের বিষয়, পরবর্তী অধ্যয়নের ফলে এই মতের ওপর অবিচল থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি (১৯৪৩)]
তাঁর চিন্তাধারায় নাস্তিকতা ও অধার্মিকতার চিহ্ন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়না। ইসলামের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ রয়েছে; সে অনুরাগ একজন খাঁটি মুসলিম নারীর মতোই।
কিন্তু তাঁর অন্তর যেমন মুসলমান, তাঁর মস্তিষ্ক ঠিক তেমন নয়। তিনি সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষালাভ করেছেন, পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানই শুধু অধ্যয়ন করেছেন। পাশ্চাত্য চশমা দ্বারাই দুনিয়া, ইসলাম এবং নিজ জাতিকে দেখেছেন এবং তাঁর সমস্ত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিই পাশ্চাত্য ছাঁচে গড়ে উঠেছে। অবশ্য তাঁর অন্তরের প্রচ্ছন্ন ইসলাম ও প্রাচ্যপ্রীতি পাশ্চাত্যপনার ঐ মানসিক বুদ্ধিভিত্তিক প্রতিপত্তিকে বহুলাংশে প্রতিরোধ করছে। সেই প্রতিরোধের ফলেই তুর্কী জাতির অন্যান্য বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের তুলনায় তাঁর চিন্তাধারায় অনেকখানি ভারসাম্য লক্ষ্যকরা যায়। কিন্তু সে প্রতিরোধ তাঁকে পাশ্চাত্যপ্রীতির আধিপত্য থেকে একেবারে রক্ষা করতে পারেনি।
ইসলাম সম্বর্কে তাঁর জানাশোনা খুবই সীমিত বলে মনে হয়। পাশ্চাত্য দর্শন, ইতিহাস ও সমাজতত্বের অধ্যয়নে যতোটা সময় তিনি ব্যয় করেছেন, কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়নে সম্ভবত তার এক দশমাংশ সময়ও ব্যয় করেননি। এই কারণেই তাঁর ভাষণে ইসলাম সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারার যেটুকু ঝলক আমাদের লক্ষ্যগোচর হয়েছে, তাতে সদুদ্দেশ্য আছে বটে, কিন্তু গভীর বোধশক্তি ও দুরদৃষ্টি খুবই কম।
তিনি শেষ ভাষণটিতে বলেছেন, ‘গান্ধীজীর ব্যক্তিত্ব আধুনিক ইসলামের এক পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টান্ত।’ একথা কেবল এমন ব্যক্তিই বলতে পারে, যার আদৌ জানা নেই যে, ইসলাম কি জিনিস, প্রাচীন ও আধুনিকের তুলনার চাইতেও তা কতোবড় মহান ও উন্নত এবং তার পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টান্ত কিরূপ হয়ে থাকে? ইসলামী চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের প্রতি যার কিছুমাত্র লক্ষ্য আছে এবং যিনি সে চরিত্রের একটি ঝলক মাত্রও দেখতে পেয়েছেন, তাঁর দৃষ্টিতে গান্ধীজীর আর কি গুরুত্ব, বিশ্ব ইতিহাসের বড় বড় নায়করা পর্যন্ত মূল্যহীন। এটা কোনো জাতীয় বিদ্বেষপ্রসূত কথা নয়; বরং এ এক অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য। আবুবকর সিদ্দীক রা., উমর ফারুক রা., আলী মুরতাযা রা., হাসান ইবনে আলী রা., আবু হানিফা র. আহমদ বিন হাম্বল র. আবদুল কাদের জিলানী র., প্রমুখের চরিত্র সামনে রাখুন। তারপর ইনসাফের সঙ্গে বলুন, নবীগণকে বাদ দিলে বিশ্ব ইতিহাসের কোন ব্যক্তিত্বটিকে এই চরিত্রগুলোর সামনে দাঁড় করানো যেতে পারে?
উসমানীয় জাতির রাজনৈতিক সমাজ গঠনে তুর্কী জাতির প্রাচীন বংশগত বৈশিষ্ট থেকে শুরু করে গ্রীস, বাইজান্টাইন, রোম, এমনকি প্লেটোর গণতন্ত্র পর্যন্ত সবকিছুরই প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু লক্ষ্যগোচর হয়না শুধু কুরআন এবং মুহাম্মদ সা.-এর শিক্ষার প্রভাব। অথচ এই বস্তুটিই মধ্য এশিয়ার বেদুঈন তুর্কীদের হাতে তাহযীব তমদ্দুনের আলোকবর্তিকা দিয়েছে, তাদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি এবং জগতজোড়া খ্যাতি লাভের মতো যোগ্যতার সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরকে মানব জাতির পক্ষে ধ্বংসাত্নক শক্তির পরিবর্তে এক সুসংগঠিত শক্তিতে পরিণত করেছে। খালেদা খানম উসমানীয়দের মধ্যে বড়জোর ইসলামের সাম্য ও সুবিচারের কিছুটা প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। তারও অবস্থা হচ্ছে এই যে, সুলতান সলীম তাঁর প্রজাদের মধ্যে তরবারির জোরে ইসলাম প্রচার করতে চাইলে শায়খুল ইসলাম জামাল আফেন্দি তাঁকে একাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন এবং সলীমের মতো স্বৈরাচারী শাসকও সে নির্দেশের সামনে মাথা নতো করে দেন। কিন্তু এই বিরাট ঘটনার মধ্যে ইসলামী সুবিচারের পরিবর্তে ‘উসমানী জাতিত্বে’র অনুভূতি এবং ‘উসমানী রাজ্যশাসন নীতির’ সংরক্ষণের প্রেরণাই খালেদা খানমের লক্ষ্যগোচর হয়। তাঁর বোধগম্য নয় যে, জামাল আফেন্দীর ফতোয়ার মধ্যে ছিলো ‘লা ইকরাহা ফীদ্দ্বীনি’ এর ভাবধারা নিহিত।
ইসলামী সত্যানুরাগের শক্তিই তাঁকে সলীমের সামনে ফতোয়া জারীর সাহস যুগিয়েছিল। আর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বই সলীমকে তাঁর ফতোয়ার সামনে মাথা নতো করতে বাধ্য করেছিল।
তুরস্কের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর প্রান্তিকধর্মিকতা, যুলুম-পীড়ন, জবরদস্তিমূলক সমাজ-সংগঠন, সীমাহীন পাশ্চাত্য প্রীতি,বস্তুতান্ত্রিক মনোবৃত্তি এবং ধর্ম সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি খালেদা খানমকে অসন্তুষ্ট বলে মনে হয়। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রীতিনীতির মধ্যে একটা সুষম সমন্বয় কামনা করেন। ‘বস্তুবাদ’ ও ‘আধ্যাত্নবাদের’ মধ্যে তিনি একটি সঙ্গতি বিধানের পক্ষপাতি। তিনি এ সত্যও স্বীকার করেন যে, জীবনের এ দু’টি মতবাদের মধ্যে ইসলাম যে সমন্বয় সাধন করেছে তাই সর্বোত্তম। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে তিনি নিজে পূর্ণ দূরদৃষ্টির অধিকারী নন। এই কারনেই ইসলামী নীতি অনুসারে সমন্বয়ের সঠিক উপায় কি এবং দুই চরম প্রান্তের মধ্যে ভারসাম্যের সরল রেখা কোনটি এটা তাঁর জানা নেই। তবু তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত বাদ দিলে তাঁর ভাষণে আমরা আধুনিক তুরস্কের মানসিকতা, তার ভাবধারা এবং সাম্প্রতিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক কার্যকারণের একটি স্পষ্ট ও নির্ভুল বর্ণনা পেতে পারি; আর এটাই হচ্ছে আমাদের কাম্য।
তুর্কী জাতি যখন ইসলামে প্রবেশ করে, মুসলমানদের নৈতিক মানসিক অধপতন তখন শুরু হয়েছিল। [তুর্কী জাতি বলতে এখানে উসমানীয় তুরস্ককে বুঝানো হচ্ছে।] তাদের মধ্যে জিহাদী ভাবধারা বেঁচেছিল বটে, কিন্তু ইজতিহাদী ভাবধারা মরে গিয়েছিল। ইসলাম সম্পর্কে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তানায়ক ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ফকীহগণ (আইনবেত্তা) তখন তিরোহিত হয়েছিলেন। ইসলামী কৃষ্টি সভ্যতা অর্ধমৃত এবং ইসলামী চিন্তাধারা প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল। ‘শরয়ী’ বিধানের ক্ষেত্রে অন্ধ তাকলীদের প্রতিপত্তি ছিলো। সমাজ ও সভ্যতায় অনারব ও রোমদের রীতিনীতি অনুপ্রবেশ করেছিল। তাসাউফের ওপর প্রাচ্যবাদ এবং দর্শনের ওপর নিউ প্ল্যাটোবাদের প্রভাব বদ্ধমূল হয়েছিল। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি জ্ঞানার্জন করার মতো উপযুক্ত লোকের অভাব দেখা দিয়েছিল। আলিম সমাজের বেশির ভাগই শব্দের মারপ্যাঁচে জড়িত কালামের জটিল তর্কে লিপ্ত হচ্ছিলেন এবং পূর্বসুরীদেরই অনুসৃত পথে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দিচ্ছিলেন। শাসকদের অধিকাংশই কাইজার ও কিসরার অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত ছিলেন। সূফী সম্প্রদায় ও আধ্যাত্নিক নেতৃবৃন্দ ইসলামের সোনালী যুগের সত্যিকার সূফীবাদ পরিহার করে সন্নাসী ও যোগীদের অনুসরণ করে চলছিলেন। জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় মুসলমানদের উন্নতির ধারা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। চিন্তা গবেষণা ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি প্রায় নিশেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলকথা, উথানের পর অধঃপতনের স্পষ্ট লক্ষণাদি তখন গোটা মুসলিম জাহানেই দেখা দিয়েছিল।
এভাবে ইসলামের ইতিহাসে তুর্কীদের আবির্ভাবই ছিলো মৌলিক দুর্বলতা নিয়ে। আর ইউরোপে যে যুগে মানসিক ক্রমবিকাশ ও বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রার সূচনা হচ্ছিল, প্রায় সেই সময়েই উসমানীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়।
অবশ্য প্রথম দিকের দু’আড়াই শতকে ইউরোপকে উপর্যুপরি পরাভূত করে উসমানীয়গণ ইসলামের বিজয়কেতন উড্ডীন করেছিল। কিন্তু সে যুগে সাধারণ মুসলিম জাতিগুলোর সঙ্গে তুর্কীরাও ধীরে ধীরে অধপতনের দিকে নেমে যাচ্ছিল এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পাশ্চাত্য জাতিগুলো দ্রুততার সাথে বৈষয়িক ও মানসিক উন্নতির দিকে এগিয়ে চলছিল। ঈসায়ী সতের শতকে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্নরূপ ধারণ করলো। ফিরিঙ্গীদের সামরিক সংগঠন এবং বৈষয়িক ও মানবিক শক্তি এতোখানি বেড়ে গেলো যে, সেন্ট গোথার্ডের যুদ্ধে প্রথমবার তারা পতনশীল তুর্কীদেরকে শোচনীয়রুপে পরাজিত করলো। কিন্তু তাতেও তুর্কীদের চক্ষু উম্মীলিত হলোনা। তারা ক্রমাগত অধপতনের দিকেই যেতে লাগলো এবং ফিরিঙ্গীরা সেই অনুপাতে উন্নতির শীর্ষদেশে আরোহণ করতে লাগলো। এমনকি আঠারো শতকে তুর্কীদের নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও তামাদ্দুনিক অবস্থা চরম অধপতনে গিয়ে পোঁছলো। এবং ফিরিঙ্গীদের আধিপাত্য পুরোপুরি উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
ঊনিশ শতকের প্রারম্ভে সুলতান সলীম তুর্কী জাতির এই সার্বিক দুর্বলতা অনুভব করলেন। তিনি শাসন ব্যবস্থার সংস্কার, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার, নব্য পদ্ধতিতে সামরিক সংগঠন এবং আধুনিক পাশ্চাত্য যুদ্ধাস্ত্রের প্রচলন শুরু করলেন। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা ও তার ভাবধারা সম্পর্কে অজ্ঞ ও মূর্খ সূফী সম্প্রদায় এবং সংকীর্ণমনা আলিম সমাজ ধর্মের নামে এই সংস্কার কার্যের বিরোধিতা করলেন। ইউরোপীয় পন্থায় সামরিক সংগঠনকে তারা ধর্মদ্রোহীতা বলে আখ্যা দিলেন। আধুনিক ফৌজী পোশাককে তারা নাসারাদের অনুকরণ বলে অভিহিত করলেন। সঙ্গীণ ব্যবহার করা তাদের মতে গুনাহর কাজ। পরন্তু সলীমের বিরুদ্ধে এই বলে বিদ্ধেষ ছড়ানো হলো যে, কাফিরদের নীতি প্রবর্তন করে সে ইসলামকে বিকৃত করে ফেলেছে।
শায়খুল ইসলাম আতাউল্লাহ আফেন্দী ফতোয়া দিলেন, যে বাদশাহ কুরআনের বিরুদ্ধে কাজ করে, সে বাদশাহীর উপযুক্ত নয়। অবশেষে ঈসায়ী ১৭০৭ সালে সলীমকে পদচ্যুত করা হলো। এই প্রথমবার ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের অজ্ঞতা ও অন্ধত্বের দ্বারা ইসলামকে প্রগতির অন্তরায় বলে ধারণার সৃষ্টি করলেন।
যুগের পরিস্থিতি দ্রুততার সাথে পরিবর্তিত হচ্ছিলো অন্যান্য মুসলমানদের তুলনায় তুর্কীদের ওপর এই পরিবর্তনের প্রভাব অত্যন্ত তীব্রভাবে পড়ছিল। তারা ছিলো ইউরোপের একেবারে মুখোমুখী দাঁড়িয়ে এবং সেই সঙ্গে ছিলো পরস্পর যুদ্ধমান। পাশ্চাত্য জাতিগুলোর সঙ্গেই ছিলো তাদের গভীর রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এমনকি, তাদের অধীনস্থ ইউরোপীয় জাতিগুলো পর্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাশ্চাত্য প্রভাব গ্রহণ করছিলো। কিন্তু ইসলামী জ্ঞানে বুৎপত্তি ও ইজতিহাদী শক্তি থেকে মুক্ত এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ তুর্কী ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ঐ পরিবর্তন সম্পর্কে ছিলেন একেবারেই উদাসীন। ফলে তুর্কী জাতিকে তাঁরা সাত’শ বছরের পূর্বেকার পরিস্থিতি থেকে এক পা-ও সামনে না এগুতে বাধ্য করলেন।
সলীমের পর সুলতান মাহমুদ সংস্কার কার্যের চেষ্টা করলেন। আলিম সম্প্রদায় ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ আবার তাঁর বিরোধিতা করলেন। অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রমের পর ১৮২৬ সালে মাহমুদ আধুনিক সামরিক সংগঠনের নীতি চালু করতে সক্ষম হলেন। কিন্তু আলিম সমাজ ও সূফী সম্প্রদায় অবিরাম এই প্রচার চালাতে লাগলেন যে, এই ধরনের সংস্কার কার্য বিদয়াতের শামিল, এর দ্বারা ইসলামকে বিকৃত করা হচ্ছে; সুলতান বে-দ্বীন হয়ে গিয়েছেন এবং আধুনিক কায়দার সেনাবাহিনীতে ভর্তি হলে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট হতে বাধ্য।
এ যুগেই তুরস্কের চিন্তাশীল লোকদের মধ্যে নিজেদের জাতীয় অধপতন সম্পর্কে সাধারণ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তারা পাশ্চাত্য জাতিগুলোর উন্নতির কারণ সম্পর্কে চিন্তা করলো, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান আচার-পদ্ধতি অধ্যয়ন করলো, তাদের প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিক্ষেপ করলো; সেই সঙ্গে আপন রাজ্যের আইন কানুন, প্রশাসনিক বিষয়াদি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামরিক ব্যবস্থায় এমন সংস্কার নীতি পরিবর্তনের চেষ্টা করলো, যাতে করে তারা পাশ্চাত্য জাতিগুলোর সঙ্গে সমান তালে উন্নতি করতে পারে। খালেদা খানমের ভাষায়, এই লোকগুলোর শিরা উপশিরায় ছিলো ইসলামী ভাবধারার প্রাণ-প্রবাহ। তাদের মন ও মগজ দুই-ই ছিলো মুসলমান। তাঁদের মধ্যে আপন দুর্বলতার অনুভূতি অবশ্য ছিলো; কিন্তু পাশ্চাত্যের মোকাবিলায় মোটেই হীনমন্যতাবোধ ছিলোনা। তাঁরা পাশ্চাত্যের প্রতি সম্মোহিত ছিলোনা। নির্বিচারে তার প্রত্যেকটি জিনিসই গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলোনা; বরং পাশ্চাত্যের ভালো জিনিসগুলো দ্বারা আপন রাজ্য এবং জাতির দুর্বলতার নিরসন করা এবং জীবনের সর্বত্র ইউরোপীয়দের সাথে সমান তালে প্রতিযোগীতা করাই ছিলো তাদের একমাত্র লক্ষ্য। তারা সুলতান আবদুল মজীদ খানের আমলে শাসন ব্যবস্থার সংস্কার ও সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন করলো। আপন জাতির কৃষ্টি ও সভ্যতায় প্রাণের স্পন্দন ফুঁকে দিলো। নতুন নতুন স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করলো। এভাবে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তারা এমন একটি নয়া জাতি গড়ে তুললো, যার ভেতর ইসলামী সভ্যতার তামাম মণিমুক্তা সমেত চিন্তা গবেষণা করার মতো উন্নত প্রতিভাও বর্তমান ছিলো। সুলতান আবদুল আজীজের পদচ্যুতি (১৮৭৬) পর্যন্ত এই দলটি ভেতর ও বাইরের অসংখ্য বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জাতীয় পুনর্গঠনের কাজ উত্তমরূপে সম্পাদন করলো। এর ফলেই উমর পাশার ন্যায় জেনারেল, মুদহাত পাশার ন্যায় সংগঠক এবং নামিক কামাল ও আবদুল হক হামিদের মতো সাচ্চা মুসলিম চিন্তানায়ক ও সাহিত্যিকের আবির্ভাব হলো।
কিন্তু সুলতান আবদুল হামীদ এসে হঠাৎ গোটা গতিপথই বদলে দিলেন। ১৮৭৬ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩ বছর ছিলো তাঁর শাসনকাল। এই সময়ের মধ্যে অন্য একটি প্রাচ্য জাতি (জাপান) উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে কোথা থেকে কোথায় গিয়ে পৌছলো। আর এই স্বার্থপর সুলতান শুধু নিজের ব্যক্তিগত ক্ষমতার মোহে তুর্কী জাতির মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, তামাদ্দুনিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উন্নতির পথ রোধ করা এবং তার প্রাণচেতনাকে নিস্তেজ করার কাজেই সময় ব্যয় করলেন। এই ব্যক্তির কীর্তিকলাপ সম্পর্কে কোনো বিস্তৃত সমালোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে তার সংক্ষিপ্ত সার এই যে, গঠনমূলক কার্যের সর্বোত্তম সময়টিকে- যার প্রতিটি ঘন্টাই ছিলো অতি মূল্যবান- তিনি ধ্বংসাত্নক কাজে ব্যয় করেন। তুর্কী জাতির শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাগুলোকে তিনি বরবাদ করে দেন। এমনকি জামালউদ্দীন আফগানীর মতো অতুলনীয় ব্যক্তিত্বকেও তিনি নষ্ট করে ফেলেন। কিন্তু তার বদৌলতে শুধু তুর্কী জাতির নয়; বরং গোটা মুসলিম জাহানের যে সবচাইতে বড় ক্ষতিটি হয়েছে, তাহলো এই যে, খিলাফতের ধর্মীয় শক্তি এবং প্রতিক্রিয়াশীল আলিম ও ধর্মনেতাদের প্রভাবকে তিনি সংগঠন যুগের তুর্কী সংস্কারকদের গড়া ভিত্তিগুলোর এবং তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারগুলোর মুলোচ্ছেদের জন্যে ব্যবহার করেন। তার এই স্বার্থপরতামূলক ও অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজের ফলে তুর্কী নওজোয়ানদের মধ্যে এক বিপ্লবাত্নক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। এর ফলে তারা সোজা ধর্মকেই প্রগতির অন্তরায় বলে ভাবতে লাগলো। তাদের মন মগজ ইসলামী শিক্ষার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। প্রতিক্রিয়াশীল আলিম ও ধর্মনেতাদের প্রতি স্বাভাবিকভাবে তাদের মনে যে ঘৃণা ও বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছিলো, বিপ্লববাদের আতিশয্যে তার গতিধারা ধর্মের দিকে ঘুরে গেলো। তারা ভাবলো এবং মূর্খ আলিম ও ধর্মনেতারা তাদের ভাবতে বাধ্য করলো যে, ইসলাম একটি অচল ও গতিহীন ধর্ম। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার কোনো ক্ষমতা তার নেই। তার আইন কানুন, অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারেনা। মাত্র কতিপয় আকীদা বিশ্বাস ছাড়া তার ভেতরে আর কোনো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী জিনিস নেই। এই ৩৩ বছরে জুলুমপীড়ন – দুর্ভাগ্যবশত যা ধর্মীয় রং ধারণ করেছিলো – তুর্কীদের নব্য বংশধরগণের মধ্যে নাস্তিকতা, বস্তুতান্ত্রিকতা, পাশ্চাত্যের প্রতি সম্মোহন, পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার অন্ধ তাকলিদ, নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি বিদ্বেষ, প্রতিটি পুরনো জিনিসের প্রতি বিদ্রোহ এবং খিলাফত ও ইসলামী ঐক্যের প্রতি সুলতান আবদুল হামিদ যাকে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানিয়েছিলেন – তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি করে দিলো। সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে এ ধারণাও দৃঢ়মূল করে দেয়া হলো যে, দুনিয়ার উন্নতি ও সম্মৃদ্ধিলাভ করতে হলে অতীতের সকল ভিত্তিকে ধ্বসিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য কায়দায় তুর্কবাদের প্রাসাদ গড়ে তোলা আবশ্যক।
১৯০৮ সালের বিপ্লব সুলতান আবদুল হামিদকে সিংহাসনচ্যুত করলো। এর ফলে বিদ্রোহী মানসিকতাসম্পন্ন অত্যুৎসাহী ও উত্তেজনাপ্রবণ নওজোয়ানদের হাতে রাজ্যের একচ্ছত্র ক্ষমতা চলে গেলো। খালেদা খানমের ভাষায়, সংগঠন যুগের সংস্কারপন্থীদের চাইতে এ লোকগুলো ছিলো ভিন্ন ধরণের। এদের মধ্যকার একটি লোকও শিক্ষাগত যোগ্যতা, চিন্তা গবেষণা ও মার্জিত বুদ্ধিতে সংগঠন যুগের চিন্তানায়কদের সমকক্ষ ছিলোনা। এদের সামনে না সেই মহান লক্ষ্য বর্তমানছিলো, আর না ছিলো তাদের চরিত্রে তেমনি দৃঢ়তা। ভদ্রতা, সৌজন্য ও শিক্ষা দীক্ষায় তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো তুলনাই ছিলোনা। এদের মধ্যে না সেই প্রখর জাতীয়তাবোধ ছিলো, না ছিলো প্রাচীন ও আধুনিকের সঠিক পার্থক্য বুঝার মতো বিচার ক্ষমতা। এই মুষ্টিমেয় যুব সম্প্রদায়টি ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানে অজ্ঞ এবং ইসলামী শিক্ষা দীক্ষায় অপরিপক্ক ছিলো।অবশ্য পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানেও এদের প্রগাঢ় দৃষ্টি ছিলোনা। আপন ধর্ম, সভ্যতা, জ্ঞান বিজ্ঞান, রীতি নীতি এবং প্রাচীন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর্ বিরুদ্ধে তাদের মন মগজে তীব্র ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিলো। পাশ্চাত্যের উন্নতি ও অগ্রগতির ফলে তাদের মধ্যে পুরোমাত্রায় সম্মোহনের সৃষ্টি হয়েছিলো। নিজেদের প্রতিটি জিনিসকেই বদলে ফেলার জন্যে এরা অস্থিরচিত্ত হয়ে পড়েছিলো। তাদের হাতে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা এসে পড়লো, তখন দীর্ঘ ৩৩ বছরের বদ্ধ ও দূষিত পানি যেন বন্যার বেগে ফেটে বেরুল। এই যুগেই তুর্কীদের উপর স্বাদেশিকতা ও তুরাণী [তুরানি কথাটি এসেছে ‘তুরা’ বা ‘তুরান’ নামক যায়গা থেকে। এটি মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত তুর্কিদের আদি বাসভুমি। সম্ভবত মঙ্গল অভিজানকালে এখানকার ‘তুর্ক’ উপজাতিদের একটি শাখা বর্তমান তুরস্কে গিয়ে বসবাস শুরু করে এবং সেখান থেকেই ‘উসমানীয় তুর্কি’ বা আধুনিক তুরস্কের অভ্যুদয় ঘটে] জাত্যাভিমানের দৈত্য সওয়ার হয়ে বসলো। ইসলামী ঐক্যের প্রতি নিস্পৃহতা প্রদর্শন শুরু হলো। ধর্মের সমালোচনার কাজ পুরোদস্তুর শুরু হয়ে গেলো। ইসলামপূর্ব প্রাচীন সভ্যতাকে পুরোপুরি গ্রহণ করার জন্যে বিপুল শক্তি নিয়োজিত হতে লাগলো। অতীতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে পাশ্চাত্যের সাথে নৈকট্য স্থাপনের জন্যে লাতিন বর্ণমালা গ্রহণের প্রস্তাব উল্থাপিত হলো। আধুনিক মতাদর্শের ছাঁচে ইসলামকে ঢালাই করার জন্যে সরকারী আলিমদের একটি দল এগিয়ে এলো। যিয়াকোক আল্প ছিলেন এই দলটির পুরোধা। এই লোকটি ইসলামী ঐক্যের মোকাবিলায় তুরাণী ঐক্যের জন্যে তীব্র প্রচার চালালেন। ইসলামী যুগের ইতিহাস ও তার প্রখ্যাত বীর সন্তানদের সম্পর্কে তুর্কীদের মনে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা জাগিয়ে প্রাচীন অসভ্য তাতারীদের গর্ববোধ করতে শেখালেন। (যার মধ্যে চেঙ্গিজ ও হালাকুর ব্যক্তিত্ব সবচাইতে বেশি উল্লেখযোগ্য)। তুর্কী ভাষাকে ইসলামী সাহিত্যের প্রভাব মুক্ত করার চেষ্টা করলেন। তুর্কীদের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং বাস্তব জীবনের সমস্ত আচরণে পাশ্চাত্যের পুরোপুরি অনুকরণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করলেন। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তি আধুনিক বিপ্লবী দলের অগ্রনায়ক হয়ে এলেন। তিনি তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে মিলে ইসলামী শিক্ষার এমনি ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলেন, যাতে করে মুষ্টিমেয় কয়েকটি বিশ্বাস ও নৈতিক বিধান ছাড়া ইসলামের প্রতিটি জিনিসকেই পরিবর্তন করে পাশ্চাত্যের ছাঁচে ঢালাই করা যেতে পারে।
একদিকে তুর্কী জাতির মধ্যে এতোবড় বিপ্লবের সূচনা হচ্ছিল অন্যদিকে তুর্কী আলিম সমাজ ও ধর্ম নেতাগণ তখনো সপ্ত সতকের পরিবেশ থেকে বাইরে বেরুতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁদের অথর্বতা, কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চরম অসম্মতি সুলতান সলীমের আমলের মতোই অব্যাহত ছিলো। তাঁরা তখনো বলছিলেন যে, হিজরী চার শতকের পর ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।অথচ তাঁদের সামনেই ধর্মদ্রোহিতার দরজা উন্মুক্ত হচ্ছিলো। তাঁরা তখনও দর্শন ও কালাম শাস্ত্রের এমনসব কিতাবাদি পাঠন পাঠনে লিপ্ত ছিলেন, যেগুলোকে দূরে নিক্ষেপ করে যুগের গতি পাঁচশো বছর এগিয়ে গিয়েছিলো। তারা তখনো নিজেদের ওয়ায নসিহতে কুরআনের সেই পুরনো ধরনের তাফসীর এবং সেইসব দুর্বল হাদীস শোনাচ্ছিলেন, যা শুনে একশো বছরের আগেরকার লোকেরা হায় আফসোস করতো বটে, কিন্তু সমকালীন মস্তিস্কবান লোকেরা তা শুনে কেবল ঐ মুফাসসির ও মুহাদ্দিসদের প্রতিই নয়, বরং খোদ কুরআন ও হাদিসের প্রতিও বিতৃষ্ণ হয়ে উঠতো। তারা তখনো তুর্কী জাতির মধ্যে ‘শামী’ ও ‘কানজুদ-দাকায়েক’-এ লিখিত বিধিব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্যেই জিদ্ করছিলে- সে জিদের ফলে তুর্কীরা কুরআন ও সুন্নাহর নির্ধারিত বিধানের আনুগত্য বর্জন করলেও তাঁরা তাঁদের মত পরিবর্তনে প্রস্তুত ছিলনা।
ফলকথা, আলিম সমাজ ও ধর্মনেতাগণ এমন ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করছিলেন, যা তুর্কী জাতিকে মাত্র এক’শ বছরের মধ্যে সাংগঠনিকতার পর্যায় থেকে বিচ্যুত করে বিপ্লববাদের এই স্তরে নিয়ে এসেছিলো।অন্যদিকে তুর্কী জাতির বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ মনে-প্রাণে মুসলমান হলেও চিন্তা, বুদ্ধি ও কর্মের বাস্তব জগতে ইসলাম থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন। ঠিক এই সময়েই প্রথম মহাযু্দ্ধের দামামা বেজে উঠলো। এতে আরব ও ভারতের হতভাগ্য মুসলমানেরা ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে মিলে তুর্কীদের গলা কাটলো। অতপর মহাযুদ্ধের মহযুদ্ধের অবসানের পর তুর্কীরা যখন আপন জাতীয় জীবনকে চূড়ান্ত ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে সংগ্রামে লিপ্ত হলো, তখন তাদের সবচাইতে বেশি বিরোধিতা করলেন তৎকালীন খলীফা ও শাইখুল ইসলাম। বিপ্লবী ও তুর্কীদের অর্ধমৃত ইসলামী চেতনার পক্ষে এই সর্বশেষ আঘাতগুলো ছিলো ধ্বংসাত্মক। এরই অনিবার্য ফল আমরা নব্য তুরস্কের মাত্রাহীন আধুনিকতার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। ১৯০৮ সালে যে বিপ্লবী চিন্তাধারা অপরিপক্ক ছিলো এবং ত্রিপোলির যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ ও গ্রীক হামলার ব্যস্ততা যাকে পরিপক্ক হতে বাধা দিয়েছিলো, লোজান [এটি সুইজারল্যান্ডের একটি শহর। ১৯২৩ সালে এখানে ইংরেজ ও তুর্কিদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সন্মেলনের পরই তুরস্ক পুরপুরি ধরমনিরপেক্ষতাবাদের কবলে নিক্ষিপ্ত হয়] সম্মেলনের পর হঠাৎ তা পরিপক্কতা লাভ করলো এবং একেবারে বাস্তব রূপ ধারণ করতে লাগলো। এভাবে সমাজ ও সভ্যতায় পুরোপুরি পাশ্চাত্য নীতির রূপায়ণ; ভাষা সাহিত্য ও রাজনীতিতে পূর্ণমাত্রায় জাতীয়তাবাদের প্রতিফলন; খিলাফতের পতনের পর ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি খালেদা খানমের ভাষায় রাষ্ট্রকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত করে ধর্মকেই রাষ্ট্রের অনুগত করে দিলো। ইসলামী আইনের পরিবর্তে সুইজারল্যান্ডের আইন প্রবর্তন করা; মীরাস, বিবাহ, তালাক ইত্যাদি প্রশ্নে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশাবলী পর্য়ন্ত বদলে ফেলা; মহিলাদেরকে ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত এবং মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে ইউরোপীয় মহিলাদের অনুরূপ বল্গাহীন স্বাধীনতার পথে ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি সবকিছূই হচ্ছে মূর্খ আলিমদের অথর্বতা, আত্ম পূজারী সূফীদের ভ্রান্তি, খিলাফতের পদমর্যাদা থেকে অবৈধ সুযোগ গ্রহণকারী সুলতানদের স্বার্থপরতা এবং কুরআন ও সুন্নাহের জ্ঞান সম্পর্কে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের নিদারুণ অজ্ঞতারই স্বাভাবিক পরিণতি। পরিতাপের বিষয় যে, এই শতকের মধ্যে তুর্কী জাতি কুরআন ও হাদীসের গভীর ব্যুৎপত্তির অধিকারী এবং ইসলামী শিক্ষার মৌল ভাবধারা উপলব্ধি করতে সক্ষম, এমন একটি প্রতিভাও জন্ম দিতে পারেনি- যিনি যুগের পরিবর্তনশীল অবস্থা তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে ইজতিহাদী শক্তি ব্যবহার করতে এবং সে অবস্থার ওপর ইসলামী নীতি প্রয়োগ করে, কুরআন ও সুন্নাহর ওপর ভিত্তিশীল এবং যুগের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী একটি সুসামঞ্জস্য জীবনধারা গড়ে তুলতে পারতেন।
তুর্কী ইতিহাসের এই গতিধারা সম্পর্কে যারা অবহিত নয়, তারা এক আজব ধরনের ভ্রান্তিতে লিপ্ত হচ্ছে। পুরনো ধর্মীয় দৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা নব্য তুর্কীদের সম্পর্কে কুফরী ও ফাসিকীর ফতোয়া প্রচার করে চলেছেন। কিন্তু ঐ নব্য তুর্কীদের চাইতে তুর্কী আলেম ও ধর্মনেতারাই যে বেশি গুনাহগার. এ খবরটি তাদের জানা নেই। যে মুজাহিদ কওমটি দীর্ঘ পাঁচ’শ বছর ধরে ইসলামের জন্যে এককভাবে লড়াই করছিলো, এইসব আলিম ও ধর্মনেতাদের অথর্বতাই তাদেরকে ইসলাম থেকে ফিরিঙ্গীপনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই ধরনের অথর্বতা অন্যান্য মুসলমান কওমকেও একদিন ঐদিকে ঠেলে দিলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবেনা।
অন্যদিকে প্রগতিবাদীরা আঙ্কারা থেকে অবতীর্ণ প্রত্যেকটি ‘ওহী’-কেই মুসলমানদের সামনে এমনিভাবে পেশ করছে, যেনো কুরআন রহিত হয়ে গিয়েছে, মুহাম্মদ সা.-এর রিসালাত খতম হয়ে গিয়েছে। এখন হেদায়েত থাকলে আছে শুধু আতাতুর্কের জীবনাদর্শে, জ্ঞানের রশ্মি থাকলে আছে আঙ্কারার আসমান থেকে অবতীর্ণ ‘ওহী’র মধ্যে। অথচ বেচারা আতাতুর্ক এবং তাঁর অনুগামীদের অবস্থা হচ্ছে এই যেঃ
(আরবী)
(অথচ এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা তো কেবল অনুমানের পিছেই ছুটে চলেছে।–সুরা যুখরুফ: ২০)