ঊনবিংশ অধ্যায়ঃ সফর
সফর বা ভ্রমণ সহজ কাজ নয়; বরং তা কষ্টসহিষ্ণু ও প্রায়শ জটিল। এজন্য সফরকে যতদূর সম্ভব হালকা ও উপভোগ্য করে তোলার জন্য ইসলাম কতিপয় বিধি প্রণয়ন করেছে:
১. সফরের আগে মুসলিমকে দু’রাকাত (ইস্তিখারার) নামাজ পড়া উচিত এবং খোদার কাছে সুষ্ঠু নির্দেশনা চাওয়া আবশ্যক।
২. কোন কোন বক্তি তার কোন আত্মীয় সফরে গেলে এমন সব কুসংস্কার ও বিশ্বাস পালন করে (যেমন ঐ ব্যক্তির গৃহত্যাগের পর পরই ক্ষতি হতে পারে ভেবে, বাড়িঘর পরিস্কার না করা) যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ ইসলাম সব রকম কুসংস্কারের বিরোধী।
৩. কোন মুসলমান সফরের আগে তার প্রতিকূল কোন চিহ্ন বা প্রতীক দেখেছে বলে মনে করে সফর থেকে বিরত থাকবে না।
৪. সফরকালে সাথি নেয়া প্রয়োজন এবং একা সফর পরিহার দরকার।
৫. দিনের শুরুতে সফর শুরু করা শ্রেয় এবং সম্ভব হলে বৃহস্পতিবার যাত্রা শুরু করা।
৬. যে কোন দিন ও সময়ে সফর শুরু করা যেতে পারে। শুক্রবার সফর না করা সংক্রান্ত ধারণা ইসলামের বিধানসম্মত নয়।
৭. চার ব্যক্তির সমন্বয়ে আদর্শ সফরকারী দল হয়ে থাকে।
৮. সফরে বের হলে অথবা যানবাহনে আরোহণের আগে মুসলমানদের এই দোয়া পড়া উত্তম: “সুবহানাল্লাজী সাখখারলানা হাজা ওয়া মা কুন্না লাহু মাকরিনীন ওয়া ইন্না ইলা রাব্বীনা লা মুনকালিবীন” (তিনিই সকল গৌরবের মালিক যিনি এই বাহনকে আমাদের অনুগত করে দিয়েছেন, আমাদের পক্ষে একে বাগে আনা সম্ভব ছিলনা এবং নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রভৃর দিকেই প্রত্যাবর্তন করব)।
৯. সফরকারীর সাথে বিদায় বেলায় করমর্দনকালে মুসলমানদের বলা উচিত: “আসতাজাল্লাহ দিনাকা ওয়া আমানাতাকা ওয়া খাওয়াতিমা আমালিকা” (খোদা তোমার ঈমান, ধর্মীয় দায়িত্ব এবং শেষ পর্যন্ত তোমার কর্তব্য সম্পাদনের সুযোগ দাও)।
১০. কোন গ্রুপে তিনের অধিক ব্যক্তি সফর করলে এই সফর আয়োজনের জন্য একজনকে নেতা নির্বাচন করতে হবে।
১১.সফরে অংশগ্রহণকারী সকলকে নেতার কথা শুনতে ও মানতে হবে। তার প্রতি অবাধ্যতা ও মতানৈক্যের ফলে তর্কবিতর্কসহ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
১২. কোন মুসলমানের একাধিক স্ত্রী থাকলে, সফরে কোন্ স্ত্রী যাবেন, তা নির্ধারণের একমাত্র পথ হলো লটারি করা।
১৩. হজ্ব বা উমরাহ পালনকালেও ১২ নম্বরে বর্ণিত নিয়ম পালন করতে হবে।
১৪. কোন মুসলমান যদি এমন দেশ সফরে বের হয়, যেখানে পবিত্র কুরআনের অসম্মান হতে পারে, সেক্ষেত্রে কুরআন বা তার অংশবিশেষ সঙ্গে নেয়া বাঞ্ছনীয় হবেনা।
১৫. মহরম পুরুষ বা স্বামী ছাড়া দীর্ঘপথ সফরে মহিলাদের বের হওয়া অনুচিত।
১৬. সফরসঙ্গীর প্রতি সদয়, সহায়ক, ভদ্র ও সহযোগিতার মনোভাব রাখতে হবে। অন্যের সেবা করা এবং সকল কাজ ভাগ করে অংশ নেওয়া উচিত।
১৭. সফরসঙ্গীদের কেউ পীড়িত হয়ে পড়লে সঙ্গীদের উচিত আর পরিচর্যা করা।
১৮. যারা বিভিন্ন দেশ সফর করে তারা ফিরে এসে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের উপহার দেবেন- এই প্রত্যাশা ভ্রমণকে আরো জটিল ও ব্যয়বহুল করে তোলে।
১৯. সফর দূর পাল্লার হলে সফরকারীর প্রতি পরামর্শ হলো কষ্টকর অতিরিক্ত সফর না করা; বরং যখনই সুযোগ আসবে বিশ্রাম নিতে হবে।
২০. কোন কারণে থেমে গেলে সফরকারীর কর্তব্য হচ্ছে: সড়কে তার যানবাহন পার্ক না করা অথবা সড়কের অংশবিশেষ দখল না করা; কারণ এর ফলে যান চলাচল ব্যাহত হতে পারে এবং অন্যদের জীবন ও মাল বিপন্ন হতে পারে।
২১. বাইরে থেমে গেলে অথবা ঘুমাতে গেলে, সফরকারীকে বিশেষ করে রাতের বেলায় যেখানে ক্ষতিকর প্রাণী থাকে, এমন স্থান এড়িয়ে যেতে হবে।
২২. সফরকারীরা কোন কারণে থামলে বা বিশ্রাম নিতে চাইলে তারেদ উচিত বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত না হওয়া অথবা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া বরং এক গ্রুপে চলাফেরা করা।
২৩. সফরকালে এমন লোকদের সাক্ষাৎ পেলে, যাদেরকে সাহায্য করা উচিত, এবং সেক্ষেত্রে মুসলিম পর্যটকের কর্তব্য হচ্ছে: জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাহায্যকামী যেই হোক না কেন, তাদেরকে পানি বা জ্বালানী দান করে, যানবাহন মেরামত করে, বা লিফট দিয়ে অথবা সম্ভাব্য অন্য যেকোন প্রকারে সহায়তা করা।
২৪. রমজান মাসে সফরে গেলে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। কোন মুসলমনা সফরকালে রোজা রাখতে সক্ষম হলে রোজা রাখতে পারে- না হলে সে রোজা ছাড়তেও পারে।
২৫. পর্যটকের সুবিধার জন্য জোহর ও আছর নামাজ একত্রে এবং মাগরিব এবং এশার নামাজ একত্রে পড়তে পারে।
২৬. সফরকালে যেদিকেই সফর করা হোকনা কেন, মুসলমান তার যানবাহনস বা জন্তুর উপরে থেকেও নামাজ পড়তে পারে।
২৭. সফরকালে চার রাকাত নামাজের দু’রাকাত (কসরের নামাজ) পড়তে হয়।
২৮. সফরকারীর উচিত সফরের জন্য রাতের বেলায় সদ্ব্যবহার করা।
২৯. সফরের উদ্দেশ্য সম্পাদিত হওয়ার পর বিশেষতঃ হজ্বের পর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুসলমানদের গৃহে ফিরে আসা উচিত।
৩০. ভ্রমণ শেষে রাতে বাড়ি ফেরা পরিহার করা উচিত।
৩১. নিজ শহরে ফেরার পর মুসলমানের কাজ হলো স্থানীয় মসজিদে গিয়ে দু’রাকাত নামাজ পড়া।
৩২. সফরকারী ফিরে আসার পর তাকে কোলাকুলি করে স্বাগত জানানো উচিত। পুরুষ পুরুষকে এবং মহিলা মহিলার সাথে কোলামুলি করবে।
৩৩. গ্রাম, শহর বা আবাসিক এলাকায় প্রত্যাবর্তনের মুখে পর্যটককে এই বলে দোয়া করতে হবে: ‘আউজোবি কালিমতিআল্লাতি তাম্মাতি মিন শাররী মা খালাক” (আল্লাহর সৃষ্ট ক্ষতিকর জিনিস হতে আমি পানাহ চাই)।
৩৪. সফরকালে দোয়াদ পড়া যায়। কার্যতঃ সফরকারীর দোয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে এবাদত অর্থে কেবল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথা বলা হচ্ছে না বরং খোদাকে স্বতঃস্ফূর্ত স্মরণ, তার কাছে পরিপূর্ণতা, নির্দেশনা ও সাহায্যের জন্য মোনাজাত করা।
৩৫. যানবাহনে আরোহণকালে আল্লাহু আকবর (আল্লাহ মহান) এবং অবতরণকালে সুবহানাল্লাহু বলা উচিত।
৩৬. সফকারীর অন্যতম সদাচরণ হচ্ছে: তার সঙ্গীর ভুলত্রুটি উপেক্ষা করা ও ভুলে যাওয়া, খোশালাপ করা, তাদের সাথে পানাহর করা এবং বিতর্ক এড়িয়ে চলা।
৩৭. কোন জন্তুর পিঠে চড়ে ভ্রমণকালে যদি এমন কোন এলাকার মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয় যেখানে ঘাস ও পানি রয়েছে, সফরকারীকে তখন ধীরে অগ্রসর হতে হবে, অনুর্বর বা মরুভূমির মধ্র দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।
৩৮. মুসলমানদের মুসলিম বিদ্বেষী দেশে যাওয়া এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করা যথার্থ নয়। কোন মুসলমান যদি কোন অমুসলিম দেশে সফর করতে চায়, তাহলে তার উপযুক্ত কারণ বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।