চতুর্থ অধ্যায়ঃ খানাপিনার আদব
উত্তম খানা তৈরির জন্য খাবারের পরিমাণ এবং কত প্রকারে খানা হবে, সে ব্যাপারে পরিষ্কারা ধারণা, পারিপাট্য এবং পরিমিতিবোধের প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
১. বৈধ বস্তু থেকে খাবার প্রস্তুত করতে হবে। শূকরের মাংস, মদ, শূকর ছানা থেকে তৈরি জেলী, মদের সাহায্যে মিষ্টিপণ্য, রক্ত, সাপ ও ব্যাঙ ইসলামে নিষিদ্ধ। অনৈসলামি পন্থায় জবাই করা জন্তুর মাংস ভক্ষণও সিদ্ধ নয়।
২. অমুসলমানদের হাঁড়ি-পাতিল ব্যবহারের আগে সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। কারণ পরিচ্ছন্নতা ও খাদ্যের ব্যাপারে মুসলমানদের জন্য বিশেষ নির্দেশ রয়েছে, যা অন্যেরা অনুসরণ করবে বলে আশা করা যায় না।
৩. কিছু অতিরিক্ত সালুন রান্না করা দরকার, যাতে আরো বেশি পরিমাণ লোকদের আপ্যায়ন করা যায়। এছাড়া স্কোয়াশের ন্যায় সব্জি তৈরি করা যেতে পারে; এটা খাবারে পদ বৃদ্ধির একটি মিতব্যয়ী নীতি এং অধিক সংখ্যক লোককে এভাবে আপ্যায়ন করা যায়।
৪. পিঁয়াজ বা রসুন খেতে হলে রান্না করে খেতে হবে। কাঁচা পিঁয়াজ রসুন খেলে মুখ থেকে সৃষ্ট গন্ধ অন্যের জন্য কষ্টদায়ক হয়। স্বর্ণ বা রৌপ্যের বাসন কোসন বা ছুড়ি কাঁটা ব্যবাহর নিষিদ্ধ।
৬. দুধ ও মধু হচ্ছে সর্বোত্তম খাদ্য। পশুর সিনার গোশত সর্বোত্তম।
৭. মেঝেতে বসে খাবার খাওয়া অগ্রাধিকার দেয়া যথাযথ। এটা বিনয়ের প্রতীক।
৮. গরুর গোশতসহ অন্যান্য হালল গোশত খাওয়াকে নিষিদ্ধ মনে করা অন্যায়।
৯. ইসলামের খাবারের পরিবেশ অন্যান্য সংস্কৃতির চাইতে ভিন্ন। এক্ষেত্রে পরিবেশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছেঃ পরিচ্ছন্নতা, অনাড়ম্বরতা ও মিতব্যয়ীতা; অহেতুক সময় ও প্রচেষ্টার অপচয় করা যাবে না, পাশ্চাত্য রীতিতে যেমনটি হয়ে থাকে,সৌন্দর্যবিধানও এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়। খাবার গ্রহণকে পুষ্টি বর্ধন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
খেতে বসা
১. খোদার রহমত কামনা করে মুসলমানদের খেতে বসতে হবে। খেতে বসার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন না থাকলেও এর মধ্যে বিনম্রতা সবচেয়ে গুরুত্বপূল্ণ।
২. চিৎ হয়ে বা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় খাওয়া যথার্থ নয় এবং দাঁড়িয়ে বা হাঁটার সময় খাবার পরিহার করা উচিত।
৩. খাবার সময় মুসলমানদের যথায্যথভাবে বসতে হবে এবং কোন কুষন বা হাতের ওপর ঠেস দিয়ে খাওয়া যথোচিত নয়।
৪. খেতে বসার ব্যবস্থা এমন থাকা চাই, যাতে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ ও সময় ক্ষেপণ না হয়।
৫. খাবার গ্রহণকালে বাম হাতে খাওয়া, গালিগালাজ করা, বৃহৎপাত্রে অপরের অংশ হতে খাবার খাওয়া পভৃতি অসদাচরণকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা উচিত।
খাওয়ার সুষ্ঠু রীতি
১. একা খাবার খাওয়ার কোন আপত্তি নেই। তবে পরিবারের সকলে একসাথে মিলে খাবার গ্রহণ উত্তম। কারণ পরিবারের সবাই একটি বৃহৎ পাত্র থেকে খাওয়ার স্বাদই আলাদা।
২. ধনী-গরিব, যুবক-কিশোর-বৃদ্দ সকলের সাথে আহার করতে ঘৃণা বোধ না করা মনের উদারতার পরিচায়ক।
৩. রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা না থাকলে ভীতিকার প্রকৃতির রোগ না হলে শারীরিকভাবে পঙ্গু লোকদের সুস্থ সবল লোকদের সাথে খাওয়ার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
৪. খাবার গ্রহণের আগে ও পরে হাত ধুতে হবে।
৫. উত্তপ্ত থাকা অবস্থায় খাবার গ্রহণের জন্য হুমড়ি খাওয়া উচিত নয়। খাবার ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল। খাবার ঠাণ্ডা করর জন্য ফুঁ দেওয়া স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
৬. খাওয়ার শুরুত মুসলমানদের বলতে হবে “বিসমিল্লাহির রামানির রাহিম” (আল্লাহর নামে যিনি দয়াময়, করুণাময়) এছাড়া আরো দোয়া পড়া যায়ঃ “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফিমা রাজাকতানা ওয়াকিনা আজাবান্নার” (হে খোদা এই খাবারে বরকত দান কর এবং আমাদের দোযখের আগুন থেকে রক্ষা কর)।
৭. খাবার গ্রহণকালে যদি কেউ খোদার নাম নিতে ভুলে যায়, তাহরে সে বলবে, “বিসমিল্লাহ ওয়া আউয়ালাহু ওয়া আখিরুহু” (খাবারের শুরুতে খোদার নাম এবং সমাপ্তিও তার নামে)।
৮. খাবার গ্রহণ কালে কেউ কেউ বিসমিল্লাহ বলল, আবার কেউ কেউ বললনা, তা নয়। উপস্থিত সকলকেই তা বলতে হবে।
৯. বৃহৎ পাত্রের সকল দিক থেকে খাবার গ্রহণ করা ঠিক নয়, বরং নিকটবর্তী স্থান থেকেই তা নেয়া দরকার। অবশ্য পাত্রে ফলমূল বা খেজুর থাকলে কোন দিক থেকে তা নেয়া যায়।
১০. কোন মুসলমানকে খাবার দেওয়া হলে এবং নামাজের সময় উপস্থিত হলে, প্রথমে তাকে খাবার কেতে হবে এবং খাবার শেষ না করা পর্যন্ত নামাজের তাড়াহুড়া করবেনা; অবশ্য যদি এই আশংকা না থাকেযে, খাবর শেষ হওয়ার আগেই নামাজের সময় শেষ হয়ে যাবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ সালাতে তার মনোনিবেশে সহায়তা করা আর খাবার চিন্তা থাকলে এটা সম্ভব নয়।
১১. ডান হাতে চামচ অথবা চাম না থাকলে ডান হাতে আঙ্গুলের সাহায্যে খাবার খেতে হবে।
১২. গোগ্রাসে নয়, ধীরে ধীরে খাবার খেতে হবে।
১৩. যদি খাবার পছন্দের না হয়, তাহলে সেজন্য অসন্তোষ প্রকশ বা সমালোচনা করা যাবেনা। একান্তই সে বলতে পপারে, ‘আমি খেতে চাইনা’ অথবা ‘আমি এ ধরনের খাবার বেশি পছন্দ করিনা।ৎ’
১৪. একই সাথে গরম ও ঠান্ডা খাবা গ্রহণ যথার্থ নয়; কারণ এর ফলে দাঁদ ও পাকস্থলীর ক্ষতি হতে পারে।
১৫. হালকা আলোচনা হতে পারে, তবে তা বিতর্কিত বিষয় অথবা উসকানীমূলক হবেনা এবং যে কোন মূল্যে অশোভন বর্ণনা এড়িযে যেতে হবে; কেননা, এর ফলে অন্যান্যরা বেজার হতে পারে।
১৬. খাবার ভর্তি মুখে কথা বলা অশোভন।
১৭. খাবারকালে মুখ থেকে কিছু খাদ্য পড়ে গেলে, তা সরিয়ে নিতে অথবা সম্ভব হলে খেয়ে ফেলতে হবে। অপচয় করা যাবে না। হাড়ের সাথে অনেক গোশত রেখে দেওয়ার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।
১৮. খাবার গ্রহণরত লোকদের সম্ভাষণ জানানো যেতে পারে, তবে তাদের সঙ্গে মোসাহাফা করা যাবে না।
১৯. মুসলমানদের বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়। উদর পূর্তির আগেই খাওয়া বন্ধ করা উচিত। গোগ্রাসে খাওয়াটা অনৈসলামি আচরণ।
২০. খাবর পর পরেই ঘুমাতে যাওয়া অস্বাস্থ্যকর।
২১. খাবার প্লেটে খাদ্য অবশিষ্ট রাখা অনুচিত।
২২. মুসলমানদের খানা শেষ করে বলতে হবে, “আলহামদুলিল্লাহ হিল্লজিী আত’আমানা, ওয়াসাকানা ওয়াজায়ালনা মিনাল মুসলিমীন।” (সেই খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতা, যিনি আমার আহার যুগিয়েন এবং মুসলমান বানিয়েছেন)। এছাড়া খোদার আরো প্রশংসা করা যেতে পারে একথা বলেঃ “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফিহে ওয়া আতিমনা খায়রানা মিনহু” (হে খোদা আমাদের বরকত দাও, আমাদের আহার যোগাও এবং উত্তম আহার প্রদান কর)।
২৩. খাবার গ্রহণের পর হাত মুখ ধুতে হবে।[এ ব্যাপারে তৃতীয় পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে।] চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের পর তাহ মুখ ধোয়া জরুরি। খাবার পর দাঁতের সুরক্ষার জন্য খিলাল ব্যবহার করতে হবে।
২৪. শিষ্টাচারের নিয়ম হচ্ছেঃ পিতামাতার আগে ছেলে মেয়েরা খাবার শুরু করবে না এবং অতিথিদের আগে পরিবারের সদস্যরা খাবার খাবে না। বায়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা ইসলামের অন্যতম নীতি।
২৫. খাবার অথবা পানিতে কোন মাছি পড়লে, সেটা না ডুবে যাওয়া পর্যন্ত ঠেসে ধরতে হবে এবং পরে তা বের করে ফেলে দিতে হবে। একটি সহিহ্ হাদিসে এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রত্যেক মাছি তার এক পাখায় রোগ এবং অন্য পাখায় প্রতিষেধক বহন করে।
২৬. প্রত্যেক মুসলমানকে নিশ্চিত হতে হবে যে, সে তার বাড়ির বাইরে যা কাচ্ছে তা হালাল।
২৭. খাবার গ্রহণকালে সংবাদপত্রে বা চিঠিপত্র পড় অনুচিত, এতে খাবার সময় দীর্ঘায়িত হতে পারে।
পানীয়
১. সব রকম উত্তেজক পানীয় নিষিদ্ধ।
২. স্বর্ণ বা রৌপ্যের পাত্রে পানি নিষিদ্ধ। অন্য যে কোন প্রকার পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. পানীয় দ্রব্য বিশেষ করে পানি পরিষ্কার রাখতেহবে এবং বিশেষ করে রাতে পানির পাত্র ঢেকে রাখতে হবে।
৪. পানি পানের আগে দেখতে হবে পানিভারা পাত্রটিতে কোন কিছু পড়ে আছে কি-না।
৫. পানি পানকালে ডান হাত ব্যবাহার করতে হবে। হোয়েত প্রয়োজন ছাড়া বাম হাত ব্যবহার করবে না।
৬. ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে পানি পান করতে হবে।
৭. কোন বোতল, জগ বা চামড়ার পাত্রের মুখ থেকে সরাসরি পানি না করা উচিত নয়।
৮. ভাঙ্গা কিনারা বিশিষ্ট কোন পাত্র পানি পান করার জন্য ব্যবহার করা উপযুক্ত নয়।
৯. পানি পানকালে পাত্রে নিশ্বাস ফেলা উচিত নয়। এক চুমুকে তৃষ্ণা মেটানো যায় না। মুখ থেকে কাপ সরিয়ে নিয়ে বিশ্বাস ফেলার পর পুনরায় পানি খাওয়া উচিত।
১০. ঝর্ণা, নদী বা জলাশয় থেকে পানি পান করতে হলে পেটের ওপর ভর করে থাকা অবস্থায় মুখ লাগিয়ে পানি পান করা উচিত নয়। রবং হাত ধুয়ে হাতের সাহায্যে পানি পান করা উচিত।
১১. কাপ অথবা গ্লাস থেকে এক ঢোকে না খেয়ে, ধীরে ধীরে পানি পান করা উচিত। পানি পানকালে মুখ থেকে পাত্র সরিয়ে নিঃশ্বাস নিতে হবে।পানি পানের সময় তিনভাগে বিভক্ত করে তিনবার এরপুনরাবৃত্তি করতে হবে। এটা অধিকতর তৃষ্ণা নিবারক, স্বাস্থ্যপ্রদ ও উত্তম কাজ।
১২. দাঁড়িয়ে, হেলাল দিয়ে অথবা শুয়ে থাকা অবস্থায় পানি পান করা উচিত নয়। বসে থাকা অবস্থায় পান করা উচিত; অবশ্য ঝর্ণা থেকে পানি পান করার সময় বসার প্রশ্ন আসে না।
১৩. পানি পান করার পর মুসলমানদেরকে খোদার প্রশংসা ও শুকরিয়া প্রকাশ করতে হবে। দুধপানের বিশেষ উপকারিতার জন্য আল্লাহর বিশেষ শুকরিয়া প্রকাশ করে বলতে হবে এই বলে: “আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফিহে ওয়াজিদনা মিনহু” (হে খোদা, আমাদেরকে দুধ পানের তওফিক দাও এবং তা থেকে সমৃদ্ধি দাও।)।
১৪. একদল লোক যখন পান করে, তখ ডানে অবস্থিত ছেলে-বুড়ো যেই থাকুক, সেই প্রথম পান করবে। প্রথমে পানির পাত্রের চালান ডান দিক থেকে শুরু করতে হবে। ডানে বসা লোকটিকে অনুরোধ করতে হবে যাতে পানীয়টি ডানদিকে আরেক ব্যক্তিকে চালান দেয়।
১৫. যখন কোন ব্যক্তি একদল লোকের মধ্যে কিছু পানীয় বিতরণ করতে চায়, সে তখন যেন তার ডানে যে কেউ থাকুকনা কেন, তাকেই দেয়। অতঃপর সে ডানদিকেই অগ্রসর হবে যদিও তার বামে কোন বৃদ্ধ লোকও থাকে। ডান দিকে যারা থাকবে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ডান হাতে পানীয় চালান দিতে হবে।
১৬. যদি কোন মুসলমানকে কেউ পানীয় পান করতে দেয়, তাহলে তাকে ধন্যবাদ দিতে ভুল করা উচিত নয় এবং তার বরকতের জন্য খোদার কাছে দোয়া করতে হবে।
১৭. যদি কেউ এমন কিছু খায় যাতে চর্বি বা Sugar Acid আছে, যেমন দুধ: তাহলে মুখ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পরে কুলি করতে হবে।
১৮. যদি কুকুর কোন পাত্র থেকে পানি পান করে, তাহলে মাটি অথবা সাবান দিয়ে ৭বার পাত্রটি ধুতে হবে। কুকুরের মুখের লালার জন্য এরূপ করতে হবে। (অন্য প্রাণীর জন্য এটা প্রযোজ্য নয়।)।