সপ্তম অধ্যায়ঃ পারিবারিক আচরণ
ইসলামে পরিবার সমাজের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত ও গৌরবমণ্ডিত। পারিবারিক সম্পর্ক ও সুস্থ ও সামঞ্জস্যশীল রাখার প্রতি এজন্য গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
এ সম্পর্ক নিরুপণকারী আচরণবিধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্ত্রীর প্রতি আচরণ
১. ইসলামের দৃষ্টিতে যে ব্যক্তির স্ত্রীর কাছে উত্তম ও সহানুভূতিশীল- সে-ই উত্তম মানুষ। স্ত্রীর প্রতি সদাচরণ হচ্ছে ইসলামি নীতির বহিঃপ্রকাশ।
২. মানুষের জীবন কখনই এমন একতরফাভাবে পরিচালনা করা উচিত নয়, যাতে তার বৈবাহিক জীবন ঝুজির মুখে পড়ে। পারিবারিক গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহে যেরকম সময় ব্যয় করা হোকনা কেন, স্বামীর সময়ের প্রতিও তার হক রয়েছে। স্ত্রীর সাথে হাস্যকৌতুক, সঙ্গদান, খেলাধুলা করা এবং ইসলাম অনুমোদিত বিধানের আওতায় সময় ব্যয় করা যেতে পারে।
৩. ইসলাম বিরোধী না হলে স্ত্রীর সকল প্রয়োজন পূরণ করা স্বামীর অন্যতম কর্তব্য। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবারের ভরণপোষণ করাই অর্থব্যয়ের উত্তম পথ।
৪. মহিলাদের জন্য নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে মসজিদের চাইতে বাসগৃহ উত্তম হলেও তারা মসজিদে যেতে চাইলে তাদের বাধা দেওয়া যাবেনা।
একা্ত বিষয় বিশেষ করে যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে অন্যদের সাথে কথা বলা পুরোপুরি অন্যায়।
৬. স্ত্রীর ব্যাপারে স্বামী ঈর্ষাপরায়ণ হতে পারে। ভিত্তিহীন সন্দেহ অথবা যুক্তিসঙ্গত কারণে ঈর্ষা করার কিছু থাকলে তা করা যায়।
৭. স্ত্রীর এক ধরনের আচরণ স্বামী অপছন্দ করলেও অন্য ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারে- এজন্য স্বামী স্ত্রীকে ঘৃণা করবেনা। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয় অথচ স্বামী পছন্দ করেনা, স্ত্রীর এমন চরিত্র বৈষিষ্ট্য পরিবর্তন করে দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। স্ত্রীর রয়েছে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, যা তার স্বামী থেকে পৃথক এবং স্ত্রীর এই ব্যক্তি- স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করে দেয়া বা স্বামীর মত সামঞ্জ্যশীল করে তোলার অধিকার নেই। স্বামীকে স্মরণ রাখতে হবে স্ত্রীর চরিত্রের কতিপয় দিক অপ্রিয় মনে হলেও তার নিজের চরিত্রের কতিপয় দিকও স্ত্রীর কাছে অপ্রিয় হতে পারে।
৮. স্বামী কখনও তার স্ত্রী অথবা তার আত্মীয় স্বজনকে গালিগালাজ করবে না।
৯. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে বিশেষ প্রকৃতির। লজ্জা ও সামাজিক বিধিনিষেদের কারণে সৃষ্ট কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা দূর করার চেষ্টা না করলে এই সম্পর্ক গাঢ় হবেনা।
১০. পরিবার পরিচালনার ব্যাপারে স্বামীকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তার অবপ্যবহার ও বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। সুতরাং স্ত্রীর কাছে এমন কিছু চাওয়া ঠিক নয় যা তার সামর্থ্যের বাইরে। তাকে খুব বেশি আদেশ করাও ঠিক নয়।
১১. স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক জোরদার হয়।
১২. স্ত্রীর বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অতিথিপরায়ণ হওয়া স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামান্তর।
১৩. দ্বাদশ অনুচ্ছেদ বর্ণিত কাবিননামার অধিকাংশ শর্ত পূরণ করতে হবে। সুতরাং বিয়ের পর এসব শর্ত বাস্তবায়নে তৎপর হতে হবে, অবহেলা বা ভুলে গেলে চলবে না। অবশ্য এ সব শর্ত ইসলামি বিধিবিধান অনুযায়ী হতে হবে।
১৪. কথায় কথায় স্ত্রীর ভুল ধরা, তার কাজকর্ম অপছন্দ করা, তার নিন্দা করা বিবাহকে সংকটাপন্ন করে তুলবে। স্বামীকে বহুক্ষেত্রে স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি উপেক্ষা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
১৫. স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী অথবা সন্তানদের প্রতি ইসলামি বিধান লংঘন করে, উপেক্ষার ভাব প্রদর্শন করে, তাহলে তা হবে এক চরম ভুল যা কোন মুসলমানের করা উচিত নয়।
১৬. অন্য লোকদের বিশেষ করে আত্মীয়, সন্তানদের সামনে স্ত্রীর নিন্দা বা তার কাজ অগ্রাহ্য কা নিঃসন্দেহে একরূঢ় আচরণ।
১৭. স্ত্রীকে অর্থ উপার্জনের কথা বলার জন্য স্বামীকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার ভরন পোষণের দায়িত্ব খোদ স্বামীর।
১৮. বাসায় ফেরার পর স্বামী বেল বাজিয়ে অথবা দরজায় কড়া নেড়ে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা না করে বাসায় ঢুকবেনা। আলহামদুলিল্লাহ বলে বাড়িতে ঢুকে দু’রাকাত নামাজ পড়বে। এরপর সকলের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করবে।
১৯. স্বামীকে তার মুখের গন্ধ সুঘ্রাণ রাখতে হবে যাতে তার স্ত্রী ব্যথিত না হয় অথবা রাগ না করে।
২০. স্বামীর সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক হবে কঠোরতা ব্যতীত দৃঢ়তা এবং দুর্বলতা ব্যতীত নমনীয়তার ভারসাম্যের মাধ্যমে।
মুসিলম স্ত্রীর সঠিক আচরণ
১. সৎ স্ত্রী এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উত্তম স্ত্রীকে বিশ্বের সর্বোত্তম উপহার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২. বিবাহে স্ত্রীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বস্তুত তাই-ই হচ্ছে চূড়ান্ত বিষয়।
৩. স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য স্ত্রীর আপ্রাণ চেষ্টা করা কর্তব্য।
৪. আদর্শ স্ত্রীর তিনগুণ রয়েছে: স্বামী তাকে যাতে খুশি হয় সেজন্য সেজেগুজে হাজির হয়, আদেশ করলে সে মান্য করে, সে স্বামীর সম্পত্তির ব্যাপারে তার ইচ্ছার বিরোধী কাজ করে না।
৫. স্বামী যখন তাকে বিছানায় ডাকে তখন সাড়া না দেয়া একটি অপরাধ যা স্ত্রীর অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
৬. নফল রোজা রাখতে চাইলে স্বামীর অনুমতি নিয়ে স্ত্রীর রোজা রাখতে হবে। স্বামীর অনুমতি না পেলে রোজা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এর কারণ হচ্ছে, স্বামী স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করতে চাইলে রোজা রাখা অবস্থায় সম্ভব নয়।
৭. স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামী যাকে চায়না স্বামীর অনুমতি ছাড়া তাকে বাসগৃহে ঢোকার সুযোগ না দেওয়া।
৮. স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার সম্পত্তি থেকে স্ত্রী কাউকে কিছু দিতে পারেনা।
৯. স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী অতিরিক্ত অর্থ চাইবেনা অথবা এমন জিনিস চাইবেনা যা তার সামনে নেই এবং সে দিতে পারেনা তাকে যা-ই দেওয়া হোকনা কেনো সেজন্য সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
১০. স্বামী বাড়িতে কোনপ্রকার সহযোগিতা করতে চাইলে স্ত্রীর কৃতজ্ঞতচিত্তে তা গ্রহণ করা উচিত।
১১. স্বামী কোন বিষয়ের শপথ করালে তার প্রতি অনুগত থাকা উত্তম স্ত্রীর কর্তব্য।
১২. স্বামী বাসগৃহে ফিরলে স্ত্রী তাকে সহাস্যে স্বাগত জানাবে এবং রুচিশীল অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে।
১৩. স্ত্রী কখনও তার স্বামীর প্রয়োজনের প্রতি অবহেলা বা তার চাহিদার প্রতি উপেক্ষার ভাব দেখাবেনা। স্ত্রী স্বামীর যতই পরিচর্যা করবে তার প্রতি স্বামীর ভালবাসা ততই বেড়ে যাবে। অধিকাংশ স্বামী তাদের প্রতি স্ত্রীর যত্ন নেয়াকে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
১৪. স্বামী বাড়িতে ফিরলে পারিবারিক সমস্যা অথবা ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন না করার ব্যাপারে স্ত্রীকে সতর্ক থাকতে হবে। এর পরিবর্তে দীর্ঘ ও পরিশ্রান্ত দিনের শেসে স্ত্রীর উচিত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা।
১৫. পারিবারিক সমস্যা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে উপযুক্ত সময়ে কথা বলতে হবে স্ত্রীকে।
১৬. স্বামীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সম্মান দেখানো এবং তাদের সঙ্গে সহৃদয় ব্যবহার করা মূলতঃ স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শামিল।
১৭. বেশি বেশি করে বাড়ির বাইরে যাওয়া নারীদের বদঅভ্যাস বটে। স্বামী আপত্তি করলে স্ত্রী বাড়ির বাইরে যাবে না।
১৮. স্বামীর আপত্তির মুখে আগন্তুকদের সাথে স্ত্রী কথা বলবেনা।
১৯. স্বামীর কথা স্ত্রীকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
২০. স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সম্পদ থেকে কাউকে ধার দেওয়ার অধিকার স্ত্রীর নেই। তবে সে নিজস্ব সম্পদ থেকে ধার দিত পারে।
২১. উপযুক্ত কারণ ছাড়া স্বামীর কাছে তালাক চাওয়া নিষেধ।
২২. স্বামীর বন্ধু তার ব্যাপারে খোঁ-খবর নিলে স্ত্রী তার জবাব দেবে, তবে দীর্ঘ কথোপকথনে যাবে না।
২৩. স্বামীর সাথে বাদানুবাদ করা, তার প্রতি গালমন্দ করা, বিতৃষ্ণায় রূপ নেয় এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।
২৮. বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ এবং গার্হস্থালি কার্য পরিচালনা করা হচ্ছে স্ত্রীর দায়িত্ব। সুতরাং বাড়িঘর, আসবাবপত্র সংরক্ষণ করেতার দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং তাকে মিতব্যয়ী হতে হবে।
২৫. স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার সম্পদ থেকে স্ত্রী কাউকে সাহায্য করবেনা বা ভিক্ষা দেয়াও অনুচিত।
২৬. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার যৌন সম্পর্কের কথা অন্যদের বলা ইসলামে মহাপাপ বলে বিবেচিত।
২৭. স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি ভালবাসা ও আকর্ষণ প্রকাশে ভীত হবেনা। এর ফরে সে সন্তুষ্ট হবে এবং পরিবারের প্রতি বেশি আকর্ষণ প্রকাশে ভীতু হবেনা। এর ফলে সে সন্তুষ্ট হবে এবং পরিবারের প্রতি বেশি করে টানবে। যদি স্বামী বাড়িতে আকর্ষণীয়া, প্রেমময়ী স্ত্রী দেখতে না পায়, তাহলে সে ঘরের বাইরে অন্যত্র ভালবাসার জন্যৗ ছুটবে।
২৮. পরিবারের নেতৃত্ব স্বামীর ওপর ন্যস্ত। স্ত্রী স্বামীর সমান পরিমান দাবি করলে, তা হবে পরিবারের দুই কর্তার জঙ্গি অবস্থান এবং ইসলামে এর স্থান নেই। তবে স্বামীর স্বৈরাচারী কায়দা ব্যবহার করা এবং তার অবস্থানের অপব্যবহার করা নীচতার পরিচায়ক। প্রেম প্রীতি ভালবাসা দেখাতে হবে স্ত্রীর প্রতি এবং জীবন সঙ্গী হিসেবে আচরণ করতে হবে।
সন্তানদের প্রতি পিতামাতার আচরণ
১. শিশুরা প্রত্যেক মানুষের জীবনের হাসি, আনন্দ ও গৌরবের উৎস। সুতরাং পিতামাতাকে অত্যধিক আস্থা, মিথ্যা গৌরব প্রচারে লিপ্ত হওয়া যাবেনা এবং তাদের প্রতি ভালবাসার কারণে শিশুরা যাতে অপকর্মে লিপ্ত হতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
২. শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠনে পিতামার প্রতি তাদের নির্ভরশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩. ইসলামে শিশুদের তিনটি অবিচ্ছেদ্য অধিকার হচ্ছে: বেঁচে থাকার অধিখার, সমপর্যায়ে বাঁচার অধিকার ও বৈধতার অধিকার, যার অর্থ হচ্ছে প্রত্যেক শিশুর বৈধ পিতা থাকবে, সঠিক লালন পালন এবং সাধারণ পরিচর্যার অধিকার থাকবে।
৪. শিশুদের কল্যাণের ব্যাপারে দায়িত্ব ও আগ্রহ হচ্ছে পিতামাতার সর্বপ্রধান কর্তব্য।
৫. ত্রয়োদ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে, শিশুর বয়স সাত দিন হলে (ক) শিশর একটি আকর্ষণীয় নাম রাখতে হবে। (খ) তার মাথা নেড়ে করে দিতে হবে। (গ) মেয়ের জন্য একটি ভেড়া বা ছাগল এবং ছেলের জন্য ২টি ভেড়া বা ছাগল জবাই করে তার গোশত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। **১ এই অনুষ্ঠানকে আকিকা বলে।
৬. পিতা তার সন্তানদেগর সুশিক্ষার চেয়ে উত্তম কিছু দিতে পারেন না। তিনি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে শিক্ষা দেবেন, তা হচ্ছে ইসলামি শিক্ষা বিশেষ করে কুরআন ও সুন্নাহার শিক্ষা।
৭. ইসলামের দৃষ্টিতে উত্তম মাতা হচ্ছেন তিনি,যিনি তার ছোট ছোট শিশুদের প্রতি স্নেহশীল।
৮. কন্যা সন্তানের ওপর ছেলেদের অথবা ছেলেদের ওপর মেয়েদের প্রাধান্য দেওয়া কখনই উচিত নয়। তবে ইসলাম মেয়েদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়ার, তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার এবং তাদের প্রতি সদয় ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
[ **১ সম্ভবত এর কারণ হচ্ছে উত্তরাধিকার আইনে মেয়েদের জন্য ১ভাগ ও ছেলেদের জন্যৗ ২ ভাগে বরাদ্দ রয়েছে।]
৯. ছেলেমেয়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাদের বিয়ে শাদির ব্যাপারে সম্ভব হলে সহায়তা করতে হবে।*
১০. পিতামাতা জীবিত অথবা মৃত, হাজির অথবা গরহাজির, পরিচিত অথবা অপরিচিত যাই হোক না কেন, শিশুদেরকে আত্মীয়-স্বজন এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পরিচর্যা করতে হবে।
১২. সকল সন্তানের প্রতি সকল ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত প্রয়োজন।
১৩. শিশুদের আলিঙ্গন করে অথবা চুমো খেয়ে আদর করা উত্তম আচরণ।
১৪. শিশুদের লালন পালনের ক্ষেত্রে পিতামাতাকে অবশ্যই অতি রক্ষণশীল বা অতি উদার হওয়া অনুচিত।
১৫. পিতামাতাকে শিশুদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার কথা বলতে হবে এবং তাদের বেশি বোঝা চাপানো চলবেনা। পিতামাতার কর্তৃত্বের অপব্যবহার করা অনুচিত।
১৬. ক্ষুদ্র হলেও ছেলেমেয়েদের উপর পিতামাতার গ্রহণ করা উচিত।
১৭. ইসলামি শিক্ষা মোতাবেক শিশুদের লালন পালন করা অত্যন্ত জরুরি। শৈশব থেকে ধর্মীয় জীবনে প্রশিক্ষণ দান প্রয়োজন। সাত বছর বয়স থেকে ছেলেমেয়েরা যাতে নামাজ পড়ে পিতামাতাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
১৮. ইসলামের বিভিন্ন দিক ও ইসলামি আদব সম্পর্কে শিক্ষাদান পিতামাতার অন্যতম কর্তব্য।
১৯. পিতামাতার প্রতি ছেলেমেয়েদের আনুগত্য অনেকখানি পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল। তাদের কাছে বেশি কিছু দাবি করা তাদেরকে বেয়াদবির দিকে ঠেলে দেওয়ার নামন্তর।
[* স্মরণ রাখতে হবে লেখক জর্দানি এবং স্বাভাবিকভাবেই সেদেশের সংস্কিৃতির দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের দেশের ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা পিতামাতাই করে থাকে এবং তা ইসলামি সাংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিকও নয়- অনুবাদক]
২০. দশ বছর বয়স থেকে ছেলেমেয়েদের পৃথক বিছানায় থাকতে হবে।
২১. মাতা, বোন বা কন্যার পক্ষে (ক) হাত ও মুখমণ্ডল (খ) ঘাড় ও কলার এলাকা (গ) বাহুর উধ্বাঙ্গ থেকে আঙ্গুলের প্রা্ত এবং (ঘ) পায়ের নিম্নাংশ ছাড়া সাবালক পুত্র, ভাই বা পিতার সামনে শরীর ঢেকে রাখতে হবে।
পিতামাতার প্রতি সন্তানের আচরণ
পিতামাতার সঙ্গে ছেলেমেয়ে বিশেষতঃ সাবালক ছেলেমেয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে নিম্নোক্ত নির্দেশাবলীর প্রতি খেয়াল রাখতে হবেঃ
১. পিতামাতা ও ছেলেমেয়েদের মধ্যকার বিশেষ সম্পর্কের দরুণ পিতামাতার প্রতি সন্তানদের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। পিতামাতার চাইতে সন্তানদের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। পিতামাতার চাইতে সন্তানদের সহৃদয়তা, ধৈর্য ও উত্তম আচরণের হকদার আর কেউ হতে পারেনা।
২. অন্য কারো চাইতে সন্তানদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বেয়াদবি বা অসৌজন্যমূলক কার্যক্রমের ব্যাপারে পিতামাতা অত্যন্ত বেশি স্পর্শকাতর হন। এজন্য পিতামাতার সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সন্তানদের খুবই সুবিবেচক হতে হবে।
৩. পিতামাত সাধারণত: মনে করেন যে, তারা অনেক অভিজ্ঞ, জ্ঞানী ও সছিক; হয়তো এটা ভুলও হতে পারে। শিশু বয়ঃপ্রাপ্ত হবার পরেও পিতামাতার এ ধারণা থাকে যে, তারা ছেলেমেয়ের অভিভাবক। অত্যন্ত সহমর্মিতা ও ছবরের সাথে এই দৃষ্টিভঙ্গির মোকাবেলা করতে হবে।
৪. যদিও পিতামাতা উভয়েই ছেলেমেয়েদের সহৃদয় ব্যবহারের হকদার, তথাপি েএক্ষেত্রে বেশি হকদার হচ্ছে তার মা, তারপর পিতা। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘বেহেশত মায়ের পদতলে’।*
৫. পিতার নাম ধরে ডাকা সন্তানদের জন্য অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক কাজ।
৬. পিতার বন্ধুদের প্রতি সদয় আচরণ এবং তার মৃত্যুর পরেও তার বন্ধুর প্রতি সৌজন্য দেখানো অত্যন্ত উত্তম কাজ।
৭. ছেলেমেয়েরা তাদের পিতামাতার ভরণপোষণের জন্য দায়ী। প্রয়োজন হলে পিতামাতার ভরণপোষণ এবং তাদের জীবন আরামদায়ক করা ধর্মীয় দায়িত্ব।
[**** আল হাদিস]
৮. পিতামাতাকে বিরক্ত করতে পারে এমন বিষয় এড়িয়ে যেতে হবে। পিতামাতার প্রতি ছেলেমেয়ের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে ধৈর্য ও সমবেদান। এমনকি পিতামাতা ছেলেমেয়েদের কাছে যদি এমন কিছু দাবি করে, যা তার আয়ত্তের বাইরে, তাহলে ইচ্ছা পূরণে অপারগতার জন্য বিনীতভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
৯. পিতামাতা ও স্ত্রীর সঙ্গে কোন ব্যক্তির সম্পর্ক কারো বিনিময়ে হতে পারেনা। অথবা একজনকে অপরজনের বিনিময়ে ত্যাগ করা যায়না। এক্ষেত্রে সমঝোতা ও সমন্বয়ের পরিবেশ রচনা করতে হবে।
১০. পিতামাতার সাথে কথা বলার সময় ছেলেকে বিনীত ও ভদ্রভাবে কথা বলতে হবে।
১১. পিতামাতার প্রতি আনুগত্যের দরুণ যদি কোন ব্যক্তিকে খোদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়, তাহলে খোদার পক্ষেই তাকে কাজ করতে হবে। এটা সত্য যে, পিতামাতা তাদের সন্তানের কাছ থেকে আনুগত্যের প্রত্যাশী হবেন; কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড যদি খোদার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে পার্থক্য রেখা টানতে হবে এবং তা বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিনীত ও ভদ্রভাবে তাদের আদেশ বাস্তবায়নে অসম্মতি জানানো অপরিহার্য।
১২. পিতামাতা মূর্তিপূজক এবং ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষক হলেও তাদের প্রতি ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, সমবেদনা, শদ্ধাপূর্ণ ও স্নেহশীল হওয়া প্রয়োজন।
১৩. পিতামাতাকে আন্তরিক পরামর্শদান করা প্রয়োজন।
১৪. পিতামাতা সন্তানকে কোন কিছু বলতে চাইলে তা আগ্রহের সাথে শুনতে হবে। কথা বলার সময় তাদের বাধা দেওয়া উচিত নয় এবং তাদের সাথে বাদানুাদ করা অনুচিত।
১৫. গৃহের বাইরে পিতামাতার সাথে বেড়াতে গেলে সন্তান তাদের আগে হাঁটবেনা এবং তাদের আগে কোন আসনে বসবেনা।
১৬. পিতামাতার ক্ষতির কারণ হওয়া উচিত নয়।
১৭. পিতার নিকট অর্থ নাই অথবা তিনি সহজে দিতে পারবেন না- এ ধরনের অতিরিক্ত অর্থ না চাওয়ারই অভ্যাস করতে হবে।
১৮. পিতামাতার ভরণপোষণ বাবদ অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে সন্তানদের উদারতা জাহির করা নিষিদ্ধ।
১৯. সন্তানের অবস্থান যাই হোক না কেন ঘরে এবং বাইরে পিতামাতার অনুগত হওয়া ও তারেদ সেবা করা সম্মানের কাজ।
২০. পিতামাতা বৃদ্ধ হয়ে পড়লে তাদেরকে নিজের বাড়িতে রেখে পরিচর্যা করা সন্তানের কর্তব্য। পিতামাতার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তাদেরকে বৃদ্ধ নিবাসে প্রেরণ শুধু অসৌজন্যই নয় বরং আপত্তিকর।
২১. অপরের সঙ্গে হাসিমুখে দেখা করা যদি সহৃয়তার কাজ হয়, তাহলে পিতামাতার সাথে এরূপ করা অপরিহার্য।
২২. পিতামাতার সঙ্গে সাক্ষাতে সন্তানকেই উদ্যোগী হয়ে সম্ভাষণ জানাতে হবে। পিতামাতা তাকে সম্ভাষণ জানাবেন সন্তানের এরূপ আশা করা উচিত নয়।
২৩. পিতামাতা সন্তানের সাথে দুর্ব্যবহার করলেও সন্তানের উচিত তাদেরকে শ্রদ্ধা ও সদ্ব্যবাহার করা।
২৪. পিতামাতাকে গালি-গালাজ করা মারাত্মক গুণাহ। কোন সন্তানের উচিত নয় অন্যের পিতামাতাকে গালিগালাজ করা; কারণ তাহলে তারাও তার বাপ-মাকে গালি দেবে।
২৫. পিতামাতার সঙ্গে পুত্রের যতই মতভেদ হোকনা কেন সে তাদেরকে বাঁকা কথা বলবেনা অথবা এমন ভাব দেখাবেনা যাতে তারা ব্যথিত হয়।
২৬. সৎ মাতাও পুত্রের অন্যতম আত্মীয়। সুতরাং তার প্রতি পুত্রের অবহেলা করা চলবেনা।
২৭. পিতামাতার মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি কর্তব্য শেষ হয়ে যায়না; তাদের জন্য দোয়া করা, রুহের মাগফেরাত কামন করা, তাদের ন্যায়সঙ্গত প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং তাদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও অন্যতম কর্তব্য।
২৮. বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতা শারীরিকভাবে দুর্বল ও মানসিকভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এর ফলে তাদের মধ্যে অধৈর্য, কর্মদক্ষমতায় শৈথিল্য, রুক্ষ মেজাজা এবং সম্ভবতঃ তারা বুল ধারণা বশবর্তী হয়ে পড়েন। সুতরাং পুত্র-সন্তানকে এসব বিষয়ের প্রতি নজর রাখতে হবে এবং বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি সহনশীল হতে হবে।
২৯. সন্তানদের কর্তব্য হচ্ছে কোন প্রকার আদেশ নিষেধ ছাড়াই পিতামাতার গৃহস্থালী কাজে সহায়তা করা।
৩০. পিতামাতার প্রতি অবহেলা, অবাধ্যতা, কঠোর আচরণ করা পাপ। সারা জীবনের সব রকম ভুলের ব্যাখ্যা অনুধাবন করা যেতে পারে; কিন্তু পিতামাতকা কর্তৃক কৃত ভুলের ব্যাখ্যা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।