ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম
মুহাম্মাদ কুতুব
বাংলা অনুবাদ
অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ আবদুর রাজ্জাক
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
মুহাম্মাদ কুতুব মধ্যপ্রচ্যের ইসলামী আন্দোলন ইখওয়ানুল মুসলেমুনের বিশিষ্ট নেতা সাইয়েদ কুতুব শহীদের ভাই। এক সময়ে তিনি মিসরে প্রধান বিচারপতি ছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি ইসলাম সম্পর্কে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হন এবং আধুনিক শিক্ষিত যুব মানসে যেসব জিজ্ঞাসা তিনি লক্ষ্য করেন, ‘ভ্রান্তির জেড়াজালে ইসলাম’ তারই জবাব। প্রাঞ্জল ভাষায়, যুক্তি ও তথ্য সহকারে তিনি ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে ইসলামের শ্রেষ্টত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেন। এক দিকে ইসলামী ও ইতিহাস সম্পর্কে শতাব্দীকালের অজ্ঞতা, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, অন্যদিকে সমকালীন পাশ্চাত্য সভ্যতার সর্বগ্রাসী সয়লাব ইসলাম সম্পর্কিত বিভ্রান্তির মূল কারণ।
বর্তমান বইটি আরবী ভাষায় ১৯৬৪ সালে কায়রো হতে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ সালে কুয়েত সরকার এর ইংরেজী সংস্করণ প্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সাল থেকে আমরা এই বইটির যে অনুবাদ প্রকাশ করে আসছিলাম তা ছিল কুয়েত সরকার কর্তৃক প্রকাশিথ ইংরেজী সংস্করণের অনুবাদ। এতে সম্পাদক মূল কপি হতে কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়েছেন।
বর্তমানে বইটির মূল আরবী কপি হতে সরাসরি অনুবাদ ও কোন রকম কাটছাট না করা উত্তম বিবেচিত হওয়ায় এবং অনেক বিজ্ঞ পাঠকের পরামর্শ পাওয়ায় আমরা বইটির মূল আরবী থেকে বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করলাম।
বিশিষ্ট ইসলামী শিক্ষাবিদ সুসাহিত্যিক এবং গবেষক অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক বর্তমান সংস্কারণের অনুবাদ করেছেন। আশা করি বইটি পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করবে।
মহান আল্লাহ পুস্তকুটির সাথে সম্পৃক্ত সকলের খেদমতকে কবুল করুন।
-প্রকাশক
ভূমিকা
আধুনিক শিক্ষিত লোকদের অধিকাংশই একটা কঠিন ধর্মীয সংকটে আবর্তিত হচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হলো: “ধর্ম কি মানব জীবনের জন্যে সত্যি অপরিহার্য? অতীতে হয়ত তা-ই ছিল। কিন্তু বর্তমানে যখন বিজ্ঞান মানব জীবনের সমগ্র ধারাকে পরিবর্তিত করে দিয়েছে এবং বাস্তব জীবনের বৈজ্ঞানিক সত্য ছাড়া অন্য কিছুর আদৌ কোন স্থান নেই তখন উক্ত দাবী সংগত হতে পারে কি? ধর্ম কি মানুষের জন্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন? –না এটা তাদের ব্যক্তিগত রুচি বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারে যে, কেউ এটা গ্রহণ করছে, আবার কেউ এটাকে প্রত্যাখ্যান করছে? এতে করে কি প্রমাণিত হয় না যে, ধর্মকে মানা অথবা না মানার কারণে মানুষের কার্যকলাপে তেমন কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না? আর আমরা মানুষের যে আচরণ ও কর্মতৎপরতাকে ‘কুফর (আল্লাহদ্রোহিতা)’ বা ‘ঈমান’ নামে অভিহিত করি বাস্তবতার নিরিখে তাতে কোন ত ফাৎ নেই?
তারা যখন ইসলাম সম্বন্ধে কথা বলেন তখন তাদের এই মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। যখন তাদেরকে বলা হয়: ইসলাম শুধু কিছু প্রত্যয় ও আকীদার নাম নয়। শুধু আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অথবা মানুষের কল্যাণমূলক শিষ্টাচার বা নিয়ম-শৃংখলার মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটা হচ্ছে এমন একটি সর্বাত্মক ও সুসম্বিত পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে একটি সুবিচার ভিত্তিক অর্থনৈতিক জীবনাদর্শ, ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, দেওয়ানী-ফৌজদারী ও আন্তর্জাতিক আইন-কানুন, একটি বিশেষ জীবনদর্শন এবং দৈহিক প্রশিক্ষণ ও প্রতিপালনের সুষ্ঠু বিধান। আর এর সবকিছুই উহার মৌল বিশ্বাস এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাবধারা থেকেই উৎসারিত তখন এরা খুব বিব্রত ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেননা তাদের একমাত্র বক্তব্যই হলো: ইসলাম বহু পূর্বেই উহার শৌর্য ও কল্যাণকার ভূমিকা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। এ কারণেই যখনই তাদেরকে বলা হয়: ইসলাম কেন মৃত ধর্মের নাম নয়। বরং উহা এক অপরাজেয় দুর্বার শক্তি, পাতায়-পল্ববে, ফুলে সুশোভিত এক জীবন পদ্ধতি যাতে কার্যকর রয়েছে এমন এমন শক্তিশালী উপাদান যার দৃষ্টান্ত না সমাজতন্ত্র পেশ করতে পেরেছে, না সাম্যবাদ উহার কল্পনা করতে সক্ষম হয়েছে, না অন্য কোন মতবাদ উহার বিকল্প তুলে ধরেতে পেরেছে তখন তারা অধৈর্য হয়ে পড়েন এবং আমাদেরকে প্রশ্ন করতে থাকেন : “আপনারা কি সেই ধর্ম সম্বন্ধে এই কথাগুলো বলছেন যা দাস প্রথা, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদকে সমর্থন করে? –যা নারীকে পুরুষের অর্ধেক বলে মনে করে এবং তাকে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে রেখে দেয়? – যা পাথর মেরে মেরে মানুষ হত্যা, হাত-পা কেটে ফেলা এবং কোরা লাগাবার ন্যায় পাশবিক শাস্তির বিধান দেয়?- যা উহার অনুসারীদেরকে দান-খয়রাতের পয়সা দিয়ে জীবনযাপন করতে শেখায়? –যা তাদেরকে নানা শ্রেণীর বিভক্ত করে দেয় যাতে করে কিছু লোক অন্যদের ধন-সম্পদ শোষণ করতে সক্ষম? –যা শ্রমিকদেরকে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের কোন নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে না? আর যে ইসলাম সম্পর্কে আপনারা এটা-ওটা বলছেন তা কি আপনারা নিজেরা পালন করে থাকেন? এর উন্নতি বিধান ও ভবিষ্যত সাফল্যের নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ তো দূরে থাক, আমাদের দৃষ্টিতে এর অস্তিত্বই এখন চারদিক থেকে বিপন্ন হয়ে পড়েছে –আজকের বিশ্বে যখন বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক মতবাদের আদর্শিক সংঘাত তুঙ্গে উঠেছে তখন ইসলামেরন্যায় একটি বস্তাপচা ধর্মের ক্ষীণকণ্ঠ ও সাফল্যের কথা কোন আলোচ্য বিষয় বলেও পরিগণিত হতে পারে না।”
আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে, আসুন এই সন্দেহবাদী আধুনিক শিক্ষিতদের প্রকৃত পরিচয় আমরা জেনে নেই। -পর্যালোনা করে দেখি, তাদেরকে এই সন্দেহ ও সংশয়ের মূল সূত্র ও উৎস কোথায়? তাদের এই চিন্তাধারা কি তাদের নিজস্ব ও স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণের ফল, না অন্যদের অন্ধ অনুসরণের ফসল?
প্রকৃত অবস্থা এই যে, এরা ইসলামের বিপক্ষে যে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করে থাকেন তা তাদের স্বাধীন চিন্তা ও নিরপেক্ষ বিচার বিবেচনার ফসল নয়। বরং এটা তা অন্যদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন। এর মূল উৎস জানতে হলে আধুনিক যুগের ইতিহাসের প্রকৃত দৃকপাত করতে হবে।
মধ্য যুগে ইউরোপ এবং ইসলামী বিশ্বের মধ্যে ক্রুসেড নামে কয়েকবারই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অতপর উভয় পক্ষের মধ্যে বাহ্যিকভাবে সন্ধি স্থাপিত হলেও আন্তরিকভাবে কোন মৈত্রী স্থাপিত হয়নি। ফলে পারস্পরিক বৈরিতারও কোন অবসান হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজরা যখন যেরুজালেম দখল করে নেয় লর্ড এলেন বি (Allen By) প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন : আজই ক্রুসেডের অবসান হল।”
এই সংগে আমাদের একথাও স্বরণ রাখতে হবে যে, বিগত দু’শ’ বছর ধরে ইউরোপ সাম্রাজ্য ও ইসলামী বিশ্বের মধ্যে একটি বিরতিহীন সংঘর্ষ চলছে। তওফীক পাশার ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ইংরেজরা মিসরে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে। মিসরে আরাবী পাশার নেতৃত্বে সংগটিত ১৮৮২ খৃস্টাব্দের গণবিপ্লবকে এই তওফীক পাশার সাহায্যে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। অতপর তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় যে কোন পন্থায়ই হোক না কেন নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী থাকা বিস্তার করে ইসলামের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণকে দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করে তুলতে হবে এবং সম্ভাব্য যাবতীয উপায়-উপাদান ব্যবহার করে, নিজেদের ক্ষমতাকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে ইসলামী আন্দোলন ও উহার দুর্বার চেতনাকে পর্যদস্তু করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্মরণীয় যে, ভিক্টোরিয়া যুগের বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ গ্লাডস্টোন একবার এক জিলদ কুরআন টাক হাতে নিয়ে বৃটিশ কমন্স্ সভায় (House of Commns) সদস্যগণকে বলেছিলেন: “মিসরীয়দের নিকট যতদিন এই গ্রন্থ বর্তমান থাকবে ততদিন মিসরের বুকে আমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে অবস্থান করতে পারবো না।
এ কারণেই ইংরেজরা মুসলমানদেরকে ইসলাম সম্পর্কে বিমুখ ও উদাসীন করে তোলার উদ্দেশ্যে ইসলামী আচার-অনুষ্ঠানকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে এবং ইসলামের এক জঘন্য ও কদর্য রূপ উপস্থাপিত করতে শুরু করে- যাতে করে মিসরের উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী বন্ধর দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হতে থাকে এবং তাদের পৈশাচিক উদ্দেশ্যসমূহ সফল হতে থাকে।
মিসরে তারা যে শিক্ষানীতি প্রবর্তন করে তাতে প্রকৃত অর্থে মুসলমান শিক্ষার্থীদেরকে তাদের দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভের কোন সুযোগই দেয়া হয়নি; এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তন থেকে সর্বোচ্চা ডিগ্রী হাসিল করার পরেও কেউ ইসলামের প্রকৃত মর্ম সম্পর্কে অবহিত হতে পারেনি। সে সকল শিক্ষায়তনে তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান দান করা হতো তার সারকথা ছিল এই যে, কুরআন পাক আল্লাহর কিতাব। কেবলমাত্র বরকত ও সওয়াব লাভের জন্যেই উহা পাঠ করা হয়। আর ইসলামের অন্যান্য ধর্মের ন্যায় মানুষকে ভালো মানুষ রূপে গড়ে তোলার জন্যে ণৈতিক চরিত্রকে উন্নত করার প্রেরণা দেয় এবং ঐ সকল ধর্মের ন্যায় ইহাও ইবাদাত-বন্দেগী, অযীফা-যিকর, কাশফ-কারামাত এবং দরবেশী ও তাসাউফের একটি সমষ্টি মাত্র। ইসলামের পরিধি এতটুকুই। এছাড়াও ইসলামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্তা, রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন-কানুন এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি মানুষের নিকট যে অন্যান্য সঞ্জীবনী শক্তির সন্ধান দেয় সে সম্পর্কে শিক্ষার্তীদেরকে শুধু যে অন্ধকারে ফেলে রাখা হয় তাই নয়, বরং তথাকথিত প্রাচ্যবীদদের প্রচারিত ভ্রান্ত চিন্তাধারা ফেলে রাখা হয় তাই নয়, বরং তথাকথিত প্রাচ্যবীদদের প্রচারিত ভ্রান্ত চিন্তাধারা এবং ধ্বংসাত্মক সংশয়ের অনুসারী করে তোলা হয়। আর একমাত্র লক্ষ্য থাকে মেধা ও চিন্তাধারাকে বিকৃত করে তাদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।
এই সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদেরকে শুধু শেখানো হয়েছে যে, সমগ্র বিশ্বে ইউরোপের জীবন ব্যবস্থাই সবচেয়ে উপযুক্ত ও সর্বশ্রেষ্ঠ; সর্বোৎকৃষ্ট অর্থনীতি ইউরোপীয় চিন্তাবীদদের সর্বাত্মক গবেষণার সুফল। আধুনিক যুগের সবচেয়ে উপযুক্ত ও নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতি ইউরোপীয় পণ্ডিতগণই শত শত বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচনা করেছেন। শিক্ষার্তীদেরকে আরো বুঝানো হয়েছে : মৌলিক অধিকার সর্বপ্রথম ফরাসী বিপ্লবই মানুষকে দিয়েছে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক জীবনধারার বিস্তার ও জনপ্রিয়তার সবটুকুই ইংল্যাণ্ডের গণতান্ত্রিক বিকাশের সুফল। আর সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রকৃত বুনিয়াদ রোমান সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের সর্বোৎকৃষ্ট উপহার। মোটকথা এই শিক্ষাব্যবস্থা ইউরোপ ও ইউরোপীয়দের এক আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর চিত্র তুলে ধরেছে। উহা দেখা মাত্রই এরূপ বিশ্বাস জন্মে যে, ইউরোপ একটি গর্বিত অথচ মহান শক্তি; বিশ্বের কোন শক্তিই উহার মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়; উহার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার পথে কোন শক্তিই কোন বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। আর এর বিপক্ষে শিক্ষার্থীদের সম্মুখে প্রাচ্যকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও অবমাননাকর বলে উপস্থাপিত করা হয়েছে, ইউরোপের সম্মুখে প্রাচ্যেল যেন কোন মূল্যই নেই, বরং প্রাচ্যের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব সম্পূর্ণরূপেই ইউরোপীয় লোকদের উপর নির্ভরশীল; সভ্যতা ও সংস্কৃতি বলতে প্রাচ্যের নিকট কিছুই নেই, যতটুকু যা আছে তা এতদূর নিম্ন মানের যে, উহা পাশ্চাত্যের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির মূল্যবোধের ছিটে-ফোটা নিয়েই কোন রূপে বেঁচে আছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র একদিনস ফল হলো। মিসরীয় মুসলমানদের নতুন প্রজন্ম জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ, স্বকীয় সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিত্ববোধ থেকে বঞ্চিত হলো। ইউরোপ ও উহার সভ্যতা তাদের মন-মানসিকতা ও ধীশক্তিকে একেবারেই আচ্ছন্ন করে ফেলল। না তারা নিজেদের চোখ দিয়ে দেখতে পারত, না তাদের প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি রহিত হয়ে গেল; ইউরোপীয় প্রভুদের সন্তুষ্টি বিধানই তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল।
এই ঐতিহাসিক পটভূমি বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদরে অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি বিরাট অবদান, তাদের গোপনীয় ষড়যন্ত্র সফল হওয়ার সবচাইতে বড় দলীল। মুসলিম সমাজে এই শিক্ষিত শ্রেণীর চিন্তাধারা ও কর্মমাণ্ড সাম্রাজ্য-বাদীদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সুস্পষ্ট দর্পণ।
ইসলাম সম্পর্কে এই বেচারাদের জ্ঞান খুবই সীমিত ও অসম্পূর্ণ এবং তাদের পাশ্চাত্যের শিক্ষকদের নিকট থেকে গৃহীত। অনুরূপভাবে সাধারণ ধর্ম সম্বন্ধে তাদের ধ্যান-ধারণাও ইউরোপীয়দের আপত্তি ও সন্দেহের প্রতিধ্বনি মাত্র। বরা বাহুল্য প্রভুদের দেখাদেখিই তারা ইসলাম সম্পর্কে নানারূপ ভিত্তিহীন প্রশ্নের অবতারণা করে। কখনো বলে: রাষ্ট্রীয় ও সরকারী কার্যকলাপে ইসলামের কোন স্থান থাকতে পারে না; আবার কখনো তারা এই বলে ঢাক-ঢোল পিটাতে থাকে যে, ইসলাম ও বিজ্ঞান পরস্পর বিরোধী, একটির সাথে আরেকটির মিল নেই।
কিন্তু মুর্খতা আর কাকে বলে? হয়ত তারা অবগত নয় যে, গোটা ইউরোপ যে ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল তার নাম ইসলাম ছিল না, বরং তা ছিল ইসলাম থেকে ভিন্নতর অন্য ধর্ম। একথাও তারা ভুলে যায় যে, যে অবস্থা এ ঘটনাবলী ইউরোপীয়দেরকে নিজেদের ধর্মর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তুলেছিল তা শুধু ইউরোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ্বের অন্য কোন এলাকায় এর কোন নযীর খুঁজে পাওয়া যায় না। নূন্যকল্পে ইসলামী ইতিহাসের এমন কোন অবস্থা ও ঘটনাবলীর কোন সন্ধান মিলে না। এমনকি ভবিষ্যতেও এরূপ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ইউরোপের এই অন্ধ অনুসারীরা কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের মতে ইসলামকে বর্জন করার একমাত্র কারণ হল এই যে, ইউরোপীয়রা ধর্মের প্রতি রুষ্ট এবং রুষ্ট বলেই উহাকে দেশ থেকে চিরতরে বিদায় দিয়েছে।
ইউরোপে ধর্ম ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সংঘর্ষের মূলে ছিল ধর্মযাজকদের নির্বুদ্ধিতা। তারা কোনরূপ বিচার-বিশ্লেষণ না করেই গ্রীসদের পরিত্যক্ত কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণাকে ধর্মের অংগীভূত করে উহাকে পবিত্রতার লেবাস পরিয়ে দেয়। ফলে উক্ত ধারণার অস্বীকৃতি ও নিরংকুশ সত্য বা ধর্মের অস্বীকৃতি বলে বিবেচিত হয়। অতপর সুষ্ঠু চিন্তা ও সঠিক গবেষণার মাধ্যমে যখন উক্ত ধারণার ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়া হয় তখনও তাদের চৈতন্য উদয় হল না। বরং জ্বলজ্যান্ত ভুলকেও নির্ভুল ও অকাট্য সত্যরূপে গ্রহণ করার বিধান চালু রাখা হয়। এই পরিবেশ গোটা ইউরোপে গীর্জা ও ধর্মযাজকদের মর্যাদাকে মারাত্মকভাবে ম্লান করে দেয়। ধর্ম ও বিজ্ঞানের এই দ্বন্দ্ব ক্রমেই এক ধ্বংসাত্মক রূপ গ্রহণ করে এবং জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় জুলুম ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া শুরু হয়্ এরপর যখন ধর্মযাজকগণ তাদের ‘খোদায়ী শক্তি’কে অভাবনীয় নিষ্ঠুর পন্থায় ব্যবহার করতে শুরু করে তখন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকল মানুষই ধর্মের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে। ধর্মযাজকগণ নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইউরোপবাসীদের সম্মুখে ধর্মের যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে তা ছিল অতিশয় জঘন্য ও বর্বরোচিত। তাদের ধর্ম হয়ে উঠলো এক শক্তিশালী দানব। এই দানবের ভয়ে দিবাভাগে যেমন মানুষ এক মুহূর্তেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারত না। তেমনি রাতের অন্ধকারেও তারা তার খপ্পর থেকে রেহাই পেত না। ধর্মযাজকরা ধর্মের নামে যে অর্থ জনসাধারণের কাছ থেকে আদায় করে তিন তার ফলে তারা কার্যতই তাদের দাসে পরিণত হল। ধর্মযাজকরা নিজেদেরকে এই জমিনের বুকে আল্লাহর প্রতিনিধি বলে মনে করত এবং তাদের দাবী ছিল: তাদের যে কোন কথা বা উদ্ভট বক্তব্যকে চিরন্তন সত্য বলে অবনত মস্তকে স্বীকার করতে হবে। এ কারণে যে সকল বৈজ্ঞানিক তাদের কোন রায়ের সাথে একমত হতে পারেননি তাদের জন্যে তারা নিষ্ঠুরতম দৈহিক শাস্তির ব্যবস্থা করেছে এবং নামমাত্র খুঁটিনাটি কথার জন্যেও তাদেরকে জীবন্ত অবস্থায় পড়িয়ে মেরেছে। যে বৈজ্ঞানিক পৃথিবীকে গোলাকার বলে রায় দিয়েছিলেন তার করুণ কাহিনীই এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
মোটকথা ধর্মযাজকদের এই নিষ্পেষণ ও অন্যান্য আচরণ ইউরোপের সকল বিবেকবান ও চিন্তাশীল মানুষকে অস্থির করে তুলল। তখন তারা এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, ধর্মনামধারী এই বিরাট দৈত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে; হয় তাকে চিরতরে নির্মূল করে দিতে হবে, নইলে অন্তত পক্ষে এতখানি দুর্বল করে দিতে হবে যাতে করে ভবিষ্যতে কাউকে কোনদিন নির্যাতন করতে না পারে এবং নিজের ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড দিয়ে একথা প্রমাণ করতে না পারে যে, মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার নামই হচ্ছে ধর্ম।
কিন্তু প্রশ্ন এই যে, ইউরোপবাসী ও ধর্মের মধ্যে যে সম্পর্ক মুসলমান ও ইসলামের মধ্যেও কি সেইরূপ সম্পর্ক বর্তমান? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে ইসলাম ও বিজ্ঞানের বৈরিতা সম্পর্কে এত হুড়-হাঙ্গামা কেন? বাস্তব সত্য তো এই যে, ইসলাম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। না আজ পর্যন্ত এমন কোন বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা বলা হয়েছে যা মেনে নিলে ইসলামের কোন সত্য ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। ইসলামের সুদীর্ঘ শাসনামলে এমন কোন সময় আসেনি যখন বৈজ্ঞানিকগণকে পাশবিক অত্যাচারের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। ইসলামের সমগ্র ইতিহাসই আজ আমাদের সামনে বর্তমান। এর বিভিন্ন অধ্যায়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্রের বড় বড় পণ্ডিত অতীত হয়েছেন, কিন্তু তাদের এমন একটি ঘটনার কথাও কেউ বলতে পারবে না যে, অমুককে তার বৈজ্ঞানিক রায় বা চিন্তাধারার জন্যে নিগৃহীত করা হয়েছে। এই মুসলিম বিজ্ঞানীদের কেউই ইসলাম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে কোন দূরত্ব বা বৈপরীত্য খুঁজে পাননি। এরূপে মুসলিম শাসকমণ্ডলীও তথাকথিত ধর্মযাজকদের ন্যায় বিজ্ঞানীদের কখনো শত্রু বলে মনে করেনিনি। এবং করেননি বলেই ইসলামের ইতিহাসে না কোন বিজ্ঞানীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, না কাউকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, না কাউকে অন্যরূপ শাস্তি দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এ সত্ত্বেও কিছু লোক ইসলাম ও বিজ্ঞানকে পরস্পর বিরোধী প্রমাণ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। এরা ইসলামের কোন জ্ঞান হাসিল না করেই ইসলামের দোষ-ত্রুটি আবিষ্কার করতে শুরু করেছে। বস্তুত সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শিরা-উপশিরায় যে তীব্র হলাহল ঢুকিয়ে দিয়েছে তারই অনিবার্য ফল স্বরূপ এরা এই সমস্ত প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকে। অথচ এরা কখনো এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে না।
এদের প্রতি লক্ষ্য করে আমি এই বই লিখিনি। কেননা আমার মতে তাদেরকে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি। তাদের সঠিক পথে ফিরে আসার জন্যে আমাদের সেই শুভ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যখন তাদের পশ্চিমা প্রবুরা নাস্তিক্যবাদী সভ্যতা সম্পর্কে হতাশ হয়ে এমন এক জীবন পদ্ধতির জন্যে পাগলপারা হয়ে উঠবে যাতে থাকবে জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সুষ্ঠু সমাধান- যাতে থাকবে দেহ ও মন এবং ঈমান ও আমল সংক্রান্ত যাবতীয় দিকনির্দেশনা। ঠিক তখনই আশা করা যায়, তাদের দেখা-দেখি এই শ্রেণীর শিক্ষিত লোকেরা সঠিক পথ অবলম্বন করবে।
এই বই আমি তাদের জন্যেই লিখেছি যারা আলোকপ্রাপ্ত বিবেকের অধিকারী এবং সত্যিকার নিষ্ঠাবান, যারা একান্ত ধীরস্থিরভাবেই প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধানী। অথচ নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে এবং মিথ্যা প্রচারণা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী চক্রান্তকারীদের কেউই একথা কামনা করে না যে, এরা ইসলামের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করুক- প্রকৃত স্বাধীনতা এবং সম্মান ও মর্যাদার অদ্বিতীয় পথ অবলম্বন করুক।
আমি এই শ্রেণীর যুবক বন্ধুদের হাতে এই বইখানি তুলে দিচ্ছি এবং দোয়া করছি এর সাহায্যে ইসলাম সম্বন্ধে তাদের যাবতীয় সন্দেহ ও সংশয় দূরীভূত হোক। আমীন।
-মুহাম্মাদ কুতুব