জামায়াতে ইসলামীর লাহোর সম্মেলনে মাওলানা মওদূদীর উদ্বোধনী ভাষণ
(এই ভাষণ চলাকালেই ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জামায়াত কর্মী আল্লাহ বখশ শহীদ হন)
বন্ধুগণ!
ঊনিশ শ সাতান্ন সালের পর আজ প্রথমবার একটি নিখল পাকিস্তান সম্মেলনে একত্র হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আজ থেকে বাইশ বছর আগে মাত্র ৭৫ জন সদস্য নিয়ে এই শহরের বুকে জামায়াতে ইসলামীর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। আজ আর একবার আমরা এ শহরের বুকে সমবেত হচ্ছি। আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানী যে, আমাদের সমস্ত ভুলত্রুটি সত্ত্বেও যে আন্তরিকতার সাথে আমরা দ্বীনের এ নগণ্য খেদমতের সূচনা করেছিলাম তাকে তিনি কবুল করে নিয়েছেন। এ কাজে তিনি এমন বরকত দান করেছেন যার ফলে আজ পাকিস্তানের প্রতি এলাকায় জামায়াতের হাজার হাজার সদস্য, সমর্থক, জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং জামায়াত প্রভাবিত ব্যক্তির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং দেশের বাইরে দুনিয়ার বিভিন্ন অংশেও এর প্রভাব পড়েছে। নিজেদের প্রচেষ্টায় এ ফল লাভ করার মতো ক্ষমতা আমাদের ছিল না। এ সবকিছুই খোদার দান এবং তাঁর পাক সত্তার পক্ষ থেকে সাহায্য-সহায়তার বিস্ময়কর ফল। এজন্যে আমরা পূণর্ আন্তরিকতার সাথে তাঁর শুকরিয়া আদায় করছি।
বন্ধুগণ!
পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাসে এমন একটি দিনও পাওয়া যাবে না, যে দিনটি এ দেশের শাসকদের কোপানলে পতিত হয়নি এবং তাদের চোখে কাঁটার মতো বিধেনি। গত ষোল বছর এখানে যারাই ক্ষমতাসীন হয়েছেন, তারাই এ জামায়াতের অস্তিত্বকে বিরক্তিকর ও অসহনীয় মনে করেছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছেন। আমাদের বিরুদ্ধে নিত্য নতুন অপবাদ রটানো হয়েছে। আমাদের পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের অর্থ সম্পদ বাজেয়াফত করা হয়েছে। আমাদের কাজে নানান বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদেরকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। অতঃপর সামরিক শাসনামলে আমাদের সংগঠন খতম করে দিয়ে আমাদের সে সব গঠনমূলক কাজ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে, যা বছরের পর বছর মেহনত করে আমাদের কর্মী ও সমর্থকদের অক্লান্ত পরিশ্রমলব্ধ অর্থ দিয়ে গড়ে তুলেছিলাম। অথচ আমরা কোনদিনই ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম না। আমরা কখনও অন্যের পরিবর্তে নিজেদের হাতে ক্ষমতা লাভের প্রত্যাশা করিনি। আমাদের দাবি সব সময় এই ছিল এবং আজও আছে যে, এ দেশ যেহেতু ইসলামের নামে অর্জিত হয়েছে, সেহেতু এখানে পুরোপুরি ইসলামী জীবন ব্যবস্থাই জারি হওয়া উচিত। আমরা বারবার পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে এ কথাই যে, সততার সাথে যেই এ কাজ সম্পন্ন করবে আমরা মনে প্রাণে তাকে সমর্থন করব এবং তার সঙ্গে ক্ষমতায় শরীক হওয়া দূরের কথা, তার কাছ থেকে কোনরকম প্রতিদানও চাইব না। কিন্তু এখানে যারাই ক্ষমতাসীন হয়েছেন, তারাই একদিকে ইসলামের শ্লোগান দিয়ে এ দেশকে ইসলাম থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং অন্যদিকে আমাদেরকে তাদের কর্তৃত্বের পথে প্রতিবন্ধক মনে করে দাবিয়ে দেয়ার এবং নিশ্চিহ্ন করার জন্যে যাবতীয় নিকৃষ্টতম অস্ত্রও প্রয়োগ করেছেন।
কোন অভিযোগ হিসাবে আমি এ ইতিহাসের পুনরুল্লেখ করছি না। আমাদের উপর ক্ষমতাসীনদের যে সুনজর পড়েছে এটা কোন নতুন মেহেরবানী নয়। শুধু এ অনুভূতিটুকু আমাদের মধ্যে জাগিয়ে দেয়াই আমার উদ্দেশ্য। ষোল বছর থেকে অনুরূপ এবং এর চাইতেও কঠিন মেহেরবানীর শিকার আমরা হয়েছি এবং এ সবের মুখোমুখি হয়ে কাজ করেও খোদার মেহেরবানীতে আমাদের আন্দোলন এতটা অগ্রসর হয়েছে। কাজেই মাইক থেকে বঞ্চিত করে আমাদের এ সম্মেলন বানচাল করার চেষ্টা করা হয়েছে- শুধু এতটুকু কথায় আপনারা মনমরা হবেন না। ইতঃপূর্বে এর চাইতেও কোন কঠিন পদক্ষেপ আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। বরঞ্চ আমাদের জন্যে লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই এ সামান্য হীন প্রচেষ্টাটি আমাদের কি ক্ষতি করতে পারে? ক্ষতি হলে আমাদের অজ্ঞতার দরুন হবে, অন্যের কোন আক্রমণ থেকে নয়। অবশ্য আল্লাহ যদি চান তা পৃথক কথা।
বন্ধুগণ!
খোদার দ্বীনের জন্যে যাকে কাজ করতে হয়, তার মধ্যে অবশ্য অবশ্যই দু’টো গুণ থাকতে হবে। একটি সবর ও দ্বিতীয়াট হিকমত বা সুস্থ বিচার-বুদ্ধি। সবরের দাবি হলো আপনার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে তাতে উত্তেজিত হয়ে আপনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবেন না। বরঞ্চ প্রতিটি প্রতিবন্ধকতার মুখে আপনার সংকল্প অটুট রাখতে হবে এবং উত্তেজনার উত্তাপ থেকে নিজের মন-মস্তিষ্ককে রক্ষা করে সুস্থ বিচার বুদ্ধিসম্মত পথ গ্রহণ করতে হবে।
সুস্থ বিচার-বুদ্ধি হলো আপনি চোখ বুঁজে শুধু একটি নির্দিষ্ট পথে চলতে অভ্যস্ত হবেন না। বরঞ্চ একটি পথ বন্ধ হতেই অন্য দশটি পথ বের করার যোগ্যতা আপনার থাকতে হবে। যে ব্যক্তির মধ্যে এ হিকমত নেই, সে একটি পথ বন্ধ দেখেই বসে পড়ে। এবং এর সঙ্গে যদি সে বেসরও হয়, তাহলে ঐ প্রতিবন্ধকের সঙ্গে সংঘর্ষে নিজের মাথা ফাটিয়ে দেয় অথবা সে পথ ত্যাগ করে। কিন্তু আল্লাহ যাকে হিকমত ও সবর দুটোই দান করেছেন, তিনি হন গতিশীল স্রোতস্বিনীর মতো। তার গন্তব্যকে কোন জিনিসই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। বিপুলায়তন প্রস্তরখণ্ড হতবাক হয়ে যায় এবং নদী অন্যদিক দিয়ে তার মন্তব্যের পথে ধাবিত হয়।
সভা-সম্মেলনে বক্তৃতা করে হাজার হাজার লোক শুনানোই আমাদের পয়গাম পৌঁছানোর ও দাওয়াত সম্প্রসারণের একমাত্র পথ নয়। নিঃসন্দেহে এটিও এ কাজের একটি পদ্ধতি। কিন্তু যদি এটি আমাদের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে কোন পরোয়া নেই। আপনারা তিন তিন বা চার চার জনের দল গঠন করে সারা লাহোর শহর ছড়িয়ে পড়ুন। ঘরে ঘরে, দোকানে দোকানে, মসজিদে মসজিদে যান। পৃথক পৃথকভাবে প্রত্যেকটি লোকের সঙ্গে সাক্ষাত করুন। প্রত্যেককে জানিয়ে দিন, জামায়াতে ইসলামী কি, তার ব্যবস্থা ও সংগঠন কি, তার উদ্দেশ্য কি, তার কর্মপদ্ধতি কি, সে কোন জিনিসগুলোর সংশোধন চায়, আর কোন সুকৃতিগুলো কায়েম করতে চায়। যারা আরও কিছু বুঝতে চায় তাদেরকে জামায়াতের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। এতে পড়াশুনা করে পরে তারা নিজেদের রায় কায়েম করতে পারবে। যারা আগ্রহশীল নয়, তাদের পেছনে সময় নষ্ট করবেন না। বরঞ্চ আগ্রহশীলদের পেছনেই সময় ব্যয় করুন। আর যারা বিতর্কে নামতে চায়, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ না বাঁধিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলুন। আপনাদের পদ্ধতি-
********************************************
হিকমত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তোমরা প্রভুর পথে আহ্বান জানাও। (সূরা আন-নহল ১২৫ আয়াত)
আপসার দাওয়াত এই খোদায়ী নির্দেশ অনুযায়ীই হওয়া উচিত। আপনার ভাষা হবে মিষ্টি। চরিত্র হবে নিষ্কলুষ। ব্যবহার হবে ভদ্রোচিত। মন্দের জবাব দেবেন ভালোর মাধ্যমে। সত্যি সত্যিই যে আপনি মন্দের স্থলে ভালো প্রতিষ্ঠিত করতে চান, একথা শুধু মুখে নয়, নিজের কাজ ও প্রকাশভঙ্গির দ্বারা তা আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। এরপর বিশ্বাস করুন আল্লাহর রহমত আপনার সহযোগী হবে এবং যতটা কাজ আপনি করবেন, তার চাইতে অনেক বেশী কাজ খোদার ফেরেশতাগণ আপনার সহযোগী হয়ে সম্পন্ন করবেন।
সম্মেলনের এ দিনগুলোতে অনেক চক্ষু বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনাদের নিরীক্ষণ করবে। আপনারা নিজেদের জামায়াতের নির্যাস এনে কেন এখানে প্রদর্শনীতে রেখে দিয়েছেন। অসংখ্য কষ্টিপাথরে আপনাদের যাচাই করা হবে। এখন আপনারা যদি নিজেদেরকে খাঁটি অথবা ভেজাল প্রমাণ করতে চান, তাহলে তা নির্ভর করবে আপনাদের কার্যকলাপের উপর। যামানা বড় নির্দয় যাচাইকারী। আপনারা কোন কৃত্রিম কৌশলে এবং কোন বাহ্যিক আড়ম্বরের মাধ্যমে তার কষ্টিপাথরে নির্ভেজাল প্রমাণিত হতে পারবেন না। প্রকৃতপক্ষ আপনারা যদি নির্ভেজাল হয়ে থাকেন তাহলেও অনেক বিবেচনা ও ইতস্তত করার পরই সে আপনাদের খাঁটি বলে স্বীকার করবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যদি নিজেদের কাজের দ্বারা আপনারা নির্ভেজাল প্রমাণিত হন, তাহলে বিরোধী শক্তি আপনাদের ভেজাল প্রমাণ করার জন্যে যতই বিরাট এবং আপনাদের পরিবর্তে নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে। মিথ্যা আক্রমণ প্রত্যক্ষ করে আপনারা একটুও ঘাবড়াবেন না। তার আগমণ তুফানের মতো, কিন্তু মিলিয়ে যায় বুদবুদের মতো নিমেষে। আর একবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর তার ভেতরের প্রচ্ছন্ন আবর্জনা এমনভাবে মানুষের দৃষ্টিসমক্ষে ভেসে উঠে যে, সমগ্র দুনিয়া তারই উপর ছি ছি করে উঠে। কাজেই মিথ্যাই মুকাবিলা করার চিন্তা আপনাদের করা উচিত নয়। আপনাদের চিন্তা করা উচিত নিজেদের সত্যতার। আপনারা যদি সত্য হয়ে থাকেন, তাহলে মিথ্যার মুকাবিলা আপনাদেরকে করতে হবে না। খোদা তার মুকাবিলা করবেন এবং আজকের মিথ্যাকে তিনি ঠিক তেমন শিক্ষণীয় করে রাখবেন যেমন এর আগে প্রতি যুগের মিথ্যাকে শিক্ষণীয় করে রেখেছেন।
শেষ কথা এই বলতে চাই যে, এ জামায়াত এবং এ আন্দোলনকে যে ব্যক্তিই নিজের জন্যে ভয়াবহ বিপদ মনে করে, সেই তার সমগ্র শক্তি আমার বিরুদ্ধে নিয়োগ করে। আমাকে যাঁরা ভালবাসেন, এ জিনিসটা স্বভাবতই তাদের নিকট বিরক্তিকর ঠেকে। আপনারা বারবার এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। আমার ভয় হচ্ছে আপনারা নিজেদের দাওয়াত সম্প্রসারণের পরিবর্তে আমার প্রতিরক্ষায় নিজেদের সময় ও শক্তি ব্যয় না করে ফেলেন। আমার সকল অন্তরঙ্গ ভাইকে আমি নিশ্চিত হতে বলছি যে, খোদার মেহেরবানীতে আমার কোন প্রতিরক্ষার প্রয়োজন নেই। আমি কোন মহাশূন্য থেকে হঠাৎ এখানে আসিনি। এ দেশের মাটিতেই কাজ করে আসছি বছরের পর বছর ধরে। লক্ষ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষভাবে আমার কাজ সম্পর্কে অবগত। আমার লেখা শুধু এ দেশেই নয়, দুনিয়ার বিরাট এলাকায় ছড়িয়ে আছে এবং আমার উপর আমার প্রতিপালকের মেহেরবানী এই যে, তিনি আমাকে কলুষমুক্ত রেখেছেন। আমার মুখ কালো করে দেয়া সহজ কাজ নয়। যে কেউ উঠে দশ-বিশটা মিথ্যা দোষারোপ করে আমার মুখে এক পোঁচ কালি লেপে দেবে, এতটা সহজ নয়। বিশেষ করে ঐসব লোক, যাদের না কোন অতীত আছে, না ভবিষ্যত, ঘটনাপরম্পরা যাদেরকে মাত্র কয়েকদিনের জন্যে উপরে এনছে। এ খেলা খেলে ইনশাআলাহ তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কাজেই আমি নিজে নিশ্চিন্ত আছি এবং আপনারাও নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার প্রতিরক্ষায় ব্যাপৃত না হয়ে আল্লাহর পথের দিকে আল্লাহর বান্দাদেরকে আহ্বান করতে থাকুন। আমি আমার প্রতিপালকের উপর ভরসা রাখি। যদি আমি স্বচ্ছ নিয়তে তাঁর দ্বীনের খেদমত করে থাকি, তাহলে তিনি নিজেই আমার প্রতিরক্ষা করবেন।
আল্লাহ তায়ালার অসীম করুণা ও অপার মহিমা যে, সর্বপ্রকার অপকৌশল অবলম্বন করেও সম্মেলন বানচাল করা গেল না, মাওলানা অথবা জামায়াতের কোন ক্ষতি করা সম্ভব হলো না। উপরন্তু সারা দেশের লোকের সহানুভূতিশীল দৃষ্টিই আকর্ষণ করলো জামায়াতে ইসলামী। মাওলানার নির্দেশে তিন-চার জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো শহরে ছড়িয়ে পড়ার ফলে জনগণের মহানুভূতিই শুধু পাওয়া গেল না, দশ হাজারের মতো লোক জামায়াতের সমর্থনপত্রে স্বাক্ষর করে জামায়াতে ভর্তি হলেন।
প্রথমদিনের এতো লঙ্কাকাণ্ডের পর অবশিষ্ট দু’দিন ভালোভাবে কেটে গেল। আমরা সবাই সম্মেলনের প্যান্ডেল পরিত্যাগ করলাম। অতঃপর ৫-এ যায়লদার পার্কে অবস্থিত মাওলানার বাসভবনে আমরা কেন্দ্রীয় শূরা সদস্যগণ একত্র হয়ে সম্মেলনের বিভিন্ন বিষয় যাচাই পর্যালোচনা শুরু করি। আলোচনার এক পর্যায়ে আমরা সকলে প্রস্তাব করি যে, যেহেতু আইয়ুব সরকার মাওলানার জীবন নাশ ও জামায়াতের মূলোৎপাটনর জন্যে বন্ধপরিকর, সেহেতু নিরাপত্তার জন্যে মাওলানার বাসস্থানে দু’জন সশস্ত্র প্রহরী নিযুক্ত করা হোক।
মৃদু হাস্য করে মাওলানা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘দেখুন, আমি একটি ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছি, যে আন্দোলনের প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুকিঁ অনিবার্য। একদিকে আমি আপনাদের জীবনের ঝুকিঁ নেয়ার পরামর্শ দেব, অপরদিকে নিজের নিরাপত্তার জন্যে প্রহরী নিযুক্ত করব, এর চেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে? এ আমার মর্যাদারও খেলাফ।’
একটু নীরব থাকার পর পুনরায় বলেন, কারো মৃত্যু যদি আল্লাহর মনঃপুত না হয়, তাহলে সারা দুনিয়া চেষ্টা করেও তাকে মারতে পারবে না। আর তাঁর ইচ্ছা হলে পুত্রের গুলীতেও পিতা প্রাণত্যাগ করতে পারে।
মাওলানা আপন মনে কয়েকটি কথা বলে ফেললেন। সম্মেলনে গুলী চলাকালীন মাওলানাকে আসন গ্রহণ করার অনুরোধ জানালে বলেছিলেন, “বিপদ দেখে আমি যদি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?” মাওলানার সে নির্ভীক উক্তি কর্মীদেরকে শতগুণে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল। আদর্শ নেতার উক্তিই বটে। এবারের উক্তি ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁর এ উক্তি কোন ভবিষ্যদ্বানী ছিল না। কারণ ভবিষ্যদ্বাণী করার কোন ক্ষমতা ও অধিকার মানুষের নেই। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার ধারা ও গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে তার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কেই ছিল মাওলানার এ উক্তি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিন-চার মাসের মধ্যেই তার এ উক্তি সত্যে পরিণত হয়। আইয়ুব খানের নির্দেশে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্ণর কালাবাগ থেকে ভাড়াটিয়া গুণ্ডা এনে জামায়াত সম্মেলনকে একটি রক্তাক্ত প্রাঙ্গণে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তার তিন-চার মাস পর তিনি আপন গৃহে স্বীয় পুত্রের পিস্তলের গুলিতে প্রাণত্যাগ করেন।
জামায়াতে ইসলাম বেআইনী ঘোষিত
পূর্বে বলা হয়েছে, সম্মেলনের পূর্ব থেকেই কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিগণ জামায়াতে ইসলামী ও মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক বিবৃতির পর বিবৃতি দিয়ে আবহাওয়া উত্তপ্ত করে তুলছিরেন। অতঃপর সম্মেলনের বিজয় সাফল্য দেখে তারা মরিয়া হয়ে উঠলেন যে, এ জামায়াতকে খতম করতেই হবে। তদনুযায়ী ১৯৬৪ সালের ৬ই জানুয়ারী সমগ্র দেশে জামায়াতে ইসলামী সংগঠন বেআইনী ঘোষণা করে মাওলানা মাওদূদীসহ জামায়াত নেতৃবৃন্দের ষাটজনকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়।
পাকিস্তানের সবচেয়ে মজবুত নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় দলটিকে রাজনীতির ময়দান থেকে উচ্ছেদ করা হলো নেতৃবৃন্দকে জেলের অন্ধকার কক্ষে নির্বাসিত করা হলো। দেশের সকল রাজতিক দলের (শুধুমাত্র সরকারী দল ব্যতীত) নেতৃবৃন্দ তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। প্রায় সকল মুসলিম দেশ থেকে প্রতিবাদ ও নিন্দাধ্বনি উত্থিত হলো। কিন্তু সরকার জামায়াতে ইসলামীকে খতম করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নীরব রইলেন।
একথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মাওলানা মাওদুদী কর্তৃক ১৯৩২ সালে প্রকাশিত বিপ্লব সৃষ্টিকারী মাসিক পত্রিকা তর্জুমানুল কোরআন এ যাবত নিয়মিত চলে আসছিল। বিগত একত্রিশ বছরের মধ্যে বিভাগ পূর্ব ভারত সরকার এবং বিভাগোত্তর কালের পাকিস্তান সরকারের কেউ এ পত্রিকাখানি বন্ধ করে দেয়ার মতো সাহস করেনি। কিন্তু সামরিক শাসনের পরবর্তী তথাকথিত জনপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তান সরকার একটা তুচ্ছ কারণে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাস থেকে ছ’মাসের জন্যে এর প্রকাশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, মাওলানা প্রণীত কোরআনের তাফসীর ‘তাফহীমুল কোরআন’ তাফসীর সাহিত্যের এক অমূল্য অবদান। মাওলানার সারা জীবনের সাধনা ‘তাফহীমুল কোরআন’। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী বেআইনী ঘোষণা করার পর যখন তাকে জেলে পাঠানো হয়, তখন জেলখানায় বসে কোরআন পাকের তাফসীর লেখার অনুমতিও তাঁকে দেয়া হয়নি। অবশ্য ইসলামপ্রিয় জনগণের পক্ষ থেকে প্রবল বিক্ষোভ প্রদর্শিত হওয়ার পর অবশেষে সরকার অনুমতি দান করেন।
জামায়াতের মামলা
কিছুকাল পরে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে জামায়াতে ইসলামী বেআইনী ঘোষণাকারী সরকারী নির্দেশের বিরুদ্ধে রিট আবেদন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট সরকার পক্ষে এবং পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতের পক্ষে রায় দেন। পুনরায় মাওলানা মওদূদীর পক্ষ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল দায়ের করা হয়। সত্যের জয় সুনিশ্চিত ও অবধারিত বলে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট পঁচিশে সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে সুস্পষ্ট রায় দান করে সুষ্ঠু সুবিচারের ঐতিহাসিক নযীর স্থাপন করেন।
যে সকল অভিযোগের ভিত্তিতে সরকার জামায়াতেই ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে তার নেতৃবৃন্দকে কারাগারে আবদ্ধ করে, মাওলানা মওদূদী পশ্চিম পাকিস্তান ট্রাইবুন্যাল ও হাইকোর্টের সামনে সে সবের যে সুস্পষ্ট ও নির্ভীক জবাব দান করেন, তা সকলের অবগতির জন্য নিম্নে সন্নিবেশিত করা হয়।
অভিযোগগুলোর একটি বিশেষ অভিযোগ এই যে, মাওলানা মওদূদী কাশ্মীরের জিহাদকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছেন। এই অভিযোগটি পুনঃ পুনঃ প্রচার করা হতে থাকে। কাশ্মীর সমস্যাটি পাকিস্তানের জন্য এক জীবন-মরণ সমস্যা। মাওলানা মওদূদী কাশ্মীর সমাধান বিরোধী-একথা প্রকাশ করে জনগণকে তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলাই অভিযোগকারীদের মনের ইচ্ছা। এ সম্পর্কে কাশ্মীরী জননেতাদের মন্তব্যও সর্বশেষে সন্নিবেশিত হলো যাতে অভিযোগকারীদের মানসিক ব্যাধি পাঠক ও জনসাধারণের কাছে পরিস্ফুট হতে পারে।
মাওলানা মওদূদীর জবাব
পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের হোম সেক্রেটারী সমীপে-
মাননীয়,
আপনার ১৩-১-৬৪ তারিখের পত্রে আপনি আমার গ্রেফতার ও আটকের যে সব কারণ দর্শিয়েছেন, সেগুলো সম্পর্কে সর্বপ্রথম আমি সংক্ষেপে নিজের আইনসঙ্গত আপত্তিসমূহ বিবৃত করব। অতঃপর এগুলোর ওপর একটা মোটামুটি মন্তব্য করব এবং সবশেষে প্রত্যেকটি কারণ পৃথকভাবে বর্ণনা করব।
আটকের ব্যাপারে আইনসঙ্গত আপত্তি
গ্রেফতার ও আটকের কারণসমূহের ব্যাপারে আমার আইনসঙ্গত আপত্তিগুলো নিম্নরূপঃ
১। ১৯৬৪ সালের ৬ই জানুয়ারী আমাকে গ্রেফতার করা হয় এবং গ্রেফতার ও আটকের কারণসমূহ ১৩ই জানুয়ারী সন্ধ্যায় আমাকে জানানো হয়। কিন্তু এই কারণসমূহের মধ্যে একটি কারণও এমন নয়, যা প্রেসনোটে উল্লিখিত হয়নি। এ প্রেসনোট ৬ই জানুয়ারী সরকারের পক্ষ থেকে জারী করা হয় এবং ৭ই জানুয়ারী দেশের সমস্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর অর্থ দাঁড়ায় যে আটকের কারণসমূহ ৬ই জানুয়ারী তৈরি করা হয়। কিন্তু ৮ দিন বিলম্ব করে তা আমার কাছে পাঠানো হয়। এটা স্পষ্টত সেই আইনবিরোধী যার সাহায্যে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে-এর ৩ ধারার (৬) উপধারায় বলা হয়েছে যে, আটক ব্যক্তিকে যতদূর সম্ভব শীঘ্রই তার গ্রেফতার ও আটকের কারণসমূহ জানিয়ে দিতে হবে। এ কাজের কি কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শানো যেতে পারে যে, ৬ই জানুয়ারী প্রকাশিত প্রেসনোটের সংক্ষিপ্তসার ৮ দিনের কম সময়ে বের করা যেতে পারতো না?
২। আপনার অত্র পাওয়ার পর দ্বিতীয় দিনই আমি আপনার নিকট আবেদন জানাই যে, আটকের কারণসমূহের জবাব দেয়ার জন্যে আমাকে বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় বইপত্র আনবার অনুমতি দেয়া হোক। কিন্তু এ অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে আপনি আরও দেরী করেন এবং প্রয়োজনীয় বইপত্র ৪ঠা ফেব্রুয়ারীর আগে আমি হাসিল করতে পারিনি। এভাবে পূর্ণ একটি মাস আপনি এমনভাবে কাটিয়ে দেন যে, জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে কোন আটক ব্যক্তি নামকাওয়াস্তে তার বক্তব্য পেশ করার যে সুযোগ লাভ করে তা থেকেও আমি কোনরূপ উপকৃত হতে পারিনি। এ দেরীর জন্যে আপনার দফতরের কার্যধারার দীর্ঘসূত্রিতার কোন যুক্তিসম্মত কারণ নেই। এ দীর্ঘসূত্রিতার দণ্ড সেই ব্যক্তি ভোগ করবে কেন যার আযাদী আপনারা ছিনিয়ে নিয়েছেন?
৩। আমি ১৪ই জানুয়ারীর আবেদনে আপনার নিকট এও আরয করেছিলাম যে, আটকের কারণসমূহের জবাব দানের জন্যে আমাকে আমার উকিলগণের সঙ্গে পরামর্শ করার অনুমতি দেয়া হোক। ১লা ফেব্রুয়ারি আমি পুনর্বার এ আবেদন জানালাম। এর বেশ কয়েকদিন পর জেলা সুপারিন্টেন্ডেন্টের মাধ্যমে আমি আপনার পক্ষ থেকে এ জবাব পেলাম যে, আমি উকিলদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারি। কিন্তু এ সাক্ষাতের সময় সি.আই,ডি-এর এক ব্যক্তি উপস্থিত থাকবেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি অন্যায় শর্ত ছিল। এই শর্তসহ আইন সম্পর্কিত থাকবেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি অন্যায় শর্তছিল। এই শর্তসহ আইন সম্পর্কিত পরামর্শ করা আমার জন্যে একেবারেই অনর্থক ছিল। কোন ব্যক্তির অভিযোগ যে পক্ষের বিরুদ্ধে এবং ঐ অভিযোগ খণ্ডনের জন্যে নিজের উকিলদের সঙ্গে যে আইন সম্পর্কিত পরামর্শ করতে চায়, তার নিজের উকিলের সঙ্গে যে আইন সম্পর্কিত পরামর্শ করতে চায়, তার নিজের উকিলের সঙ্গে আলোচনার সময় অন্য পক্ষ যার বিরুদ্ধে তার অভিযোগ তার এজেন্ট মধ্যস্থলে থাকবেন, এটা সাধারণ বুদ্ধিবিবেক ও জ্ঞানের সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যশীল নয়।
মনে করুন আটক ব্যক্তি ও তার উকিল এ সিদ্ধান্ত করে যে, এই আটকের বিরুদ্ধে বন্দিত্বের কারণ প্রদর্শন (Habious Corpus) করার অবকাশ আছে। এ আলোচনায় সি.আই.ডি-এর লোকের উপস্থিতির অর্থ এই এ দাঁড়ায় যে, হেবিয়াস করপাসের আবেদন আদালতে পৌঁছবার আগেই আপনি এর বিষয়াবলী অবগত হবেন এবং তা ব্যর্থ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। এটা কি পরিষ্কার ইনসাফ-হত্যা নয়? [আমি এজন্যে কৃতজ্ঞ যে, তারা ২৬শে ফেব্রুয়ারী আমার এ অভিযোগ দূর করেছেন।]
৪। আপনি এ পত্রে গ্রেফতারী ও আটকের যত কারণ বর্ণনা করেছেন, তন্মধ্যে সপ্তম কারণ ছাড়া বাকি সবগুলোই অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ এবং নিছক অভিযোগ। এথেকে জানা যায় যে, এ অভিযোগগুলোর ভিত্তি কি। এভাবে আটকের কারণ বর্ণনা করা বা না করা একই কথা।
৫। আপনার বিবৃত আটকের কারণসমূহের মধ্যে পঞ্চম কারণে বলা হয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামী ১৯০৮ সালের সংশোধিত ফৌজদারী আইন অনুযায়ী বেআইনী গণ্য হওয়ার পূর্বে অমুক অমুক কাজে লিপ্ত ছিল এবং তুমি এর আমীর হিসাবে সে সব কাজে শরীক ছিলে। এজন্যে তোমাকে আটক করা হয়েছে।
এ আটকের ব্যাপারে ঠিক সেই দিন এবং সেই সময় অনুষ্ঠিত হয়, যেদিন এবং যে সময় ১৯০৮ সালের সংশোধিত ফৌজদারী আইনের সাহায্যে জামায়াতে ইসলামী বেআইনী ঘোষিত হয়। এর পরিস্কার অর্থ এই যে, এ আটক আমার অতীতের কার্যাবলীর (তর্কের খাতিরে কিছুক্ষণের জন্যে যদি তা মেনে নেয়া হয়) শাস্তি। অথচ যে আইনের সাহায্যে আমাকে গ্রেফতার ও আটক করা হয়েছে, তা আপনাকে Preventive Detention-এর ক্ষমতা দেয়, Punitive Detention-এর নয়। এভাবে আপনি আসলে আইনের সীমা লঙ্ঘন করেছেন। সরকারের যদি এ আশঙ্কা থাকে যে, জামায়াতে ইসলামী বেআইনী ঘোষণা করার পরও আমি সেই কাজ করব, যার কারণে জামায়াত বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে, তাহলে সেজন্যে ১৯০৮ সালের সংশোধিত ফৌজদারী আইনের ১৭ ধারার ১, ২ ও ৩ উপধারা ছিল। সেখানে জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ব্যবহার করার প্রয়োজন কি ছিল? এ থেকে কি প্রমাণ হয় না যে, সরকার আমাকে গ্রেফতার করার জন্যে বড়ই অস্থির ছিলেন? এজন্যে জামায়াত নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরও আমি সে কাজ করি বা না করি তা দেখার জন্যে সরকার সামান্য অপেক্ষা করতেও পারেননি, বরং জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আমাকে আমার অতীত কাজের শাস্তি দিয়ে দিলেন।
৬। আটকের কারণসমূহের মধ্যে ৫ম ও ৭ম কারণদ্বয়ের যে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আপনি আমাকে গ্রেফতার ও আটক করেছেন তা কর্মসীমা বহির্ভুত। তাতে আপনি আমার বিরুদ্ধে যে সব কাজের অভিযোগ করেছেন, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় যে, তা আমি করেছি, তাহলেও সেজন্যে আপনি জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স মারফত পদক্ষেপ গ্রহণ করার অধিকার রাখেন না।
৭। ৭ম কারণটি প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের সীমায় এসে যায়। আর এর মাধ্যমে আপনি আমার পত্রিকা তর্জুমানুল কোরআনকে ইতঃপূর্বেই ৬ মাসের জন্যে বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এবং আইনের সীমা লঙ্ঘন করে জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আমাকেও এ প্রবন্ধটি প্রকাশ করার শাস্তি দেয়া হয়েছে।
আটক করার কারণসমূহ সম্পর্কে কতিপয় সাধারণ আলোচনা
এই আইনসঙ্গত আপত্তিগুলো অবতারণা করার পর আমি সেই কারণসমূহ পর্যালোচনা করতে চাই, যেগুলোকে একটার পর একটা পর্যালোচনা করার আগে আমি পূর্ণ দায়িত্ববোধের সঙ্গে সুস্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে চাই যে, আপনার পত্রে আমার গ্রেফতার ও আটকের যেসব কারণ দেখানো হয়েছে, সেগুলো আসল কারণ নয়। বরঞ্চ আসল কারণ অন্য কিছু এবং সেগুলো এমন কারণ যা প্রকাশ করতে সরকার নিজেও পেরেশানী অনুভব করেন।
প্রথম কারণ হলো এই যে, ১৯৬৩ সালের রাওয়ালপিণ্ডির এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে আমি দাবি করেছিলাম যে, কালাত, খারান, মাকরান, বাহওয়ালপুর এবং অন্যান্য সীমান্ত রাষ্ট্রগুলোকে যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, ঠিক একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ সোয়াত ও দীর রাজ্য প্রভৃতিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করা উচিত। এবং পাকিস্তানের অন্যান্য নাগরিক যে সব সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ভোগ করছে, এসব এলাকার অধিবাসীদেরও যে সব সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার দান করা উচিত। আমাদের দাবি পূর্ণ আইনানুগ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, যখন প্রাক্তন ব্রিটিশ ভারতের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতের সাথে যুক্ত হলো, তখন গোলামী যুগের এই শেষ চিহ্নটিকেও বা কেন অপসারণ করা হবে না? এমনি পরিস্কারভাবে একটি নির্ভুল কারণ ব্যক্ত করার দরুণ সরকারের কতিপয় ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি অস্বস্তি অনুভব করেন এবং ক্রোধে ফেটে পড়েন।
দ্বিতীয়ত, জামায়াতে ইসলামীর প্রচেষ্টায় ক্ষমতাসীন দল রাওয়ালপিণ্ডি ও হায়দারাবাদে দু’টি উপনির্বাচনে পরাজয় বরণ করে। এটি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ক্রোধবহ্নিকে উসকিয়ে দেয়। এ নির্বাচন দু’টি অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে।
তৃতীয়ত, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ জামায়াতে ইসলামীর সুসংগঠিত আন্দোলনকে নিজেদের কনভেনশন মুসলিম লীগের পথে বিরাট বাধাস্বরূপ মনে করতেন এবং আগামী নির্বাচনের আগে বিরোধী দলেরই সবচাইতে সুসংবদ্ধ দলকে খতম কজরে দেয়া এবং তার নেতৃবর্গকে ময়দান থেকে সরিয়ে দেয়া জরুরী মনে করতেন। কেননা উপনির্বাচনের ফলাফল প্রত্যক্ষ করে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী সরকারী দলের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রমাণিত হবে।
এসব কারণে আমার ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে পরপর যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, সেগুলো আমি তারিখ মতে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করছি।
‘৬৩ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের জনৈক দায়িত্বশীল অফিসার টেলিফোনে আমাকে হুমকি দেন যে, কনভেনশন লীগের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে আপনি যা বলেছেন, সে সম্পর্কে সংবাদপত্রে নিজের ভুল স্বীকার করুন, নয়তো সরকার আপনার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন (দেখুন ‘নওয়া-ই-ওয়াক্ত’ ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৩)। হুমকি প্রদানের এ ব্যাপারটিকে আমি সঙ্গে সঙ্গেই দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্যে পাঠাই এবং তা প্রকাশ হয়। কেননা এ থেকে অনুমান করা গিয়েছিল যে, আমার ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গৃহীত হবে।
১৬ই অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর নিখিল পাকিস্তান সম্মেলনে ব্যবহারের জন্যে লাউড স্পীকারের অনুমতি দানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়। অথচ ১৪ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ই অক্টোবর পর্যন্ত লাহোরে পর পর সাত-আটটি এমন জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেগুলোর প্রত্যেকটিতে ১৪৪ ধারার উপস্থিতিতেও লাউড স্পীকারের অনুমতি দেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে এমন একটি সম্মেলনের জন্যে যেখানে পাকিস্তানের সকল এলাকা থেকে প্রায় সাত হাজার ডেলিগেট আসছিল এবং লাহোর শহরেও হাজার হাজার লোক শরীক হতে যাচ্ছিল, সেখানে লাউড স্পীকারের অনুমতি না দেয়া এ কথারই সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের মনে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একটি বিশেষ প্রতিরোধ স্পৃহা সক্রিয় আছে।
১৭ই অক্টোবর লাহোরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের উপরোল্লিখিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্যে পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টে দরখাস্ত পেশ করা হয়। ২২শে অক্টোবর এর ফয়সালা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাইকোর্ট তার ফয়সালা শুনাবার পূর্বেই পশ্চিম পাকিস্তান গভর্ণর একটি বিশেষ অর্ডিন্যান্স মারফত সমগ্র প্রদেশে লাউড স্পীকার ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এ থেকে একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা গভর্ণরের আছে, তাকে বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলন ব্যর্থ করার জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে।
২৫শে অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলন শুরু হচ্ছিল। এর ঠিক একদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র উজির আমার ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একটি ভীষণ কঠোর ও উত্তেজনাপূর্ণ বিবৃতি প্রকাশ করেন এবং সম্মেলনের দিন প্রভাতী সংবাদপত্রসমূহে প্রাদেশিক সরকারের কতিপয় উজিরের বিবৃতিও প্রকাশিত হয়। ঠিক এই সময় হঠাৎ এই ধরনের ক্রোধের তুফান প্রবাহিত হওয়ার কারণ কি? এর কারণ কি এ ছাড়া অন্য কিছু ছিল যে, সরকার লাহোরের মত একটি কেন্দ্রীয় স্থানে জামায়াতে ইসলামীর শক্তি ও সংগঠনের প্রকাশকে বরদাশত করতে পারছিলেন না।
২৫শে অক্টোবর পূর্বাহ্নে জামায়াতে ইসলামীর সভায় গুণ্ডামী করানো হয়। তাতে পুলিশ যে নীতি অবলম্বন করে লাহোরের প্রায় তিরিশ-চল্লিশ হাজার লোক তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে। সংবাদপত্রসমূহের মাধ্যমে সমগ্র দেশ সে সম্পর্কে অবগত হয়। পাকিস্তানের বাইরে বিভিন্ন দেশেও এই লজ্জাকর ঘটনার বিবরণ পৌঁছে যায়। প্রকাশ দিবালোকে মানুষের চোখের সামনে গুণ্ডা আনা হয়। তারা ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করে। শামিয়ানার দড়ি কেটে দেয়। বইয়ের স্টলগুলো লুট করে। মহিলাদের ক্যাম্পেও ইট ও সোডাওয়াটারের বোতল নিক্ষেপ করে। একটি বইয়ের স্টল থেকে কোরআন মজীদগুলো তুলে নিয়ে ইট পাথরের মতো সভার উপর নিক্ষেপ করে। এমনকি অবশেষে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে পিস্তলের গুলীতে নিহত করে।
এ সমস্তই পুলিশের উপস্থিতিতে সংগঠিত হচ্ছিল এবং পুলিশ দাঁড়িয়ে হাসছিল। এর মধ্যে প্রত্যেকটি কাজ এমন ছিল যার উপর পুলিশের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল। কিন্তু একজন গুণ্ডাকেও গ্রেফতার করা হয়নি। হত্যাকারীকেও পুলিশ নিজে পাকড়াও করেনি। বরং জামায়াতের কর্মীগণ তাকে ধরে জোরপূর্বক পুলিশের নিকট সোপর্দ করে এবং তাদের বারবার চাপ দেয়ার ফলে পুলিশ হত্যাকারীকে আটক করে। শাসন কর্তৃপক্ষের মুখ থেকে স্বীকৃতি বের হোক বা না হোক, তাদের বিবেক খুব ভাল করেই জানে যে, এসব কে করিয়েছে এবং কি উদ্দেশ্যে করিয়েছে? তাছাড়া লাহোরে ল’এন্ড অর্ডার কায়েম রাখার দায়িত্ব যে সব শাসকের ওপর ছিল, তাদের একজনও এ গোপন রহস্য সম্পর্কে অনবহিত নন যে, আইনের সংরক্ষকদের দ্বারা আইনকে অপদস্থ করলো কারা?
যে উদ্দেশ্যে এ জঘন্য ষড়যন্ত্র করা হয়, তা আসলে এই ছিল যে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মীগণ কোন না কোন প্রকারে গুণ্ডাদের সঙ্গে সংষর্ষে লিপ্ত হবে এবং তাদের ওপর গুলী চালিয়ে সমগ্র জামায়াতকে দাঙ্গাকারী গণ্য করে বেআইনী ঘোষণা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু জামায়াত কর্মীগণের ধৈর্য ও সংযম এ ষড়যন্ত্রটি বানচাল করে দেয়।
এরপর মাত্র এক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়। জামায়াতকে কোনক্রমে ফাঁসানোর জন্যে আবার তার বিরুদ্ধে অন্য একটি ষড়যন্ত্র তৈরি করা হয়। ‘৬৩ সালের ৬ই নভেম্বর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল। এর মাত্র দু’দিন আগে ইউনিয়নের সভাপতি পদপ্রার্থী বারাকাল্লাহ খানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ পদক্ষেপের অবশ্যম্ভাবী ফল এই ছিল এবং কার্যত এটিই প্রকাশিত হয় যে, ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এজন্যে ইউনিয়নের সমস্ত পদের সকল প্রার্থী যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫, একই সঙ্গে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে। তারা সঙ্গে সঙ্গে একটি এ্যাকশন কমিটি গঠন করে। ৪ঠা নভেম্বর ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি শোভাযাত্রা বের করে। তাদের সঙ্গে লাউড স্বীকার ছিল। (এই শোভাযাত্রা ও শৃঙ্খলা স্পীকার ব্যবহার যদি বেআইনী হয়ে থাকে, তাহলে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়েই তাদেরকে বাধা দেয়নি কেন? বিপরীতপক্ষে তারা শোভাযাত্রাকে এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে দেয় যার ফলে ভীড় অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং অন্যান্য মতলববাজও ভীড়ের মধ্যে শামিল হয়ে যায়।) তারপর হঠাৎ চ্যারিং ক্রসের কাছে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে তাদেরকে বিক্ষিপ্ত করা হয় এবং তাদের বহু নেতাকেও গ্রেফতার করা হয়। এ কার্যাবলীর পরিস্কার উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে অধিকতর উত্তেজিত করে ল’ এন্ড অর্ডারের শক্তির সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়া। অতঃপর এর সমস্ত দোষ জামায়াতে ইসলামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া। প্রথম দিন থেকে এ ঘটনাবলী সম্পর্কে যেভাবে অনুসন্ধান চালানো হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা যেভাবে জারি থাকে, তাতে একথা পূর্ণরূপে পরিস্ফুট হয় যে, আসল উদ্দেশ্য হলো জামায়াতে ইসলামীকে ফাঁসানো। সে সময় সংবাদপত্র ও রেডিওতে দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে নিয়ে উজির সাহেবান পর্যন্ত যে সব বিবৃতি প্রকাশ করছিলেন, তাতেও এই একই উদ্দেশ্যের প্রতিচ্ছায়া পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এ থেকে প্রকাশ্যে একথা প্রমাণ হচ্ছিল যে, শাসন কর্তৃপক্ষ জামায়াতে ইসলামীকে ছাত্রদের এই হাঙ্গামায় জড়িয়ে ফেলার জন্যে কত বেশী অস্থির। কিন্তু সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো এবং এই হাঙ্গামার ব্যাপারে জামায়াতকে দায়ী করার জন্যে কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না।
জামায়াতে ইসলামী কোন অপরাধ করবে এবং তারপর তাকে পাকড়াও করা হবে, সরকার আর কতদিনই বা এর অপেক্ষায় থাকতে পারেন? আবার এও বা কেমন করে হতে পারে যে, যে জামায়াত কনভেনশন লীগের উন্নতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে দিন কোন অপরাধ না করে তবু কি তাকে পাকড়াও করা যাবে না?
সংশোধিত ফৌজদারী আইন এবং পিটিশন অব পাবলিক অর্ডারকে তো এ জন্যেই আইনের বারুদখানায় রাখা হয়েছে যে, যারা অপরাধ করে না, তাদেরকে পাকড়াও করার প্রয়োজন যখন দেখা দেবে, তখন এগুলো কাজে লাগবে। কাজেই ৬ই জানুয়ারী এ দু’টি অস্ত্রের সাহায্যে আমাকে ও আমার জামায়াতকে শিকার করা হয় এবং আমার বিরুদ্ধে সেই সব অভিযোগ আনীত হয়, যা ৬ই জানুযায়ী সরকারী প্রেসনোট এবং আপনার প্রেরিত গ্রেফতার ও আটকের কারণসমূহের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে।
যে কারণে আমি এ দাবি করছি যে, এসব অভিযোগ সরকারের ঐ পদক্ষেপের আসল কারণ নয়, তা হলো এই যে, আমার ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সরকার এ অভিযান ১৯৬৩ সালের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করেছেন এবং এ ব্যাপারে সেই সব অভিযোগ আনীত হয়েছে, যার মধ্যে দু’টি (অর্থাৎ লাহোরে ছাত্রদের হাঙ্গামা এবং তর্জুমানুল কোরআনের প্রবন্ধ) এ অভিযান শুরু হওয়ার পরবর্তীকালের ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত। আর বাদ বাকী অভিযোগগুলো কয়েক বছরের পুরাতন ব্যাপার ও ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত।
এবার আমি আমার গ্রেফতার ও আটকের ব্যাপারে আপনি যে সব কারণ দেখিয়েছেন, তার এক একটির ওপর পৃথকভাবে আলোচনা করে তাদের স্বরূপ উদঘাটন করব।
বল প্রয়োগে ক্ষমতা দখল
আপনার প্রথম অভিযোগ এই যে, জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ছিল বলপ্রয়োগে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দখল করা, কিন্তু জামায়াতের এ উদ্দেশ্যটা আপনি কি উপায়ে জানতে পারলেন, তা আপনি বলেননি। কোন জামায়াতের উদ্দেশ্যকে জানার দু’টোই উপায় হতে পারে। এক. তার কাজ। দুই. তার গঠনতন্ত্র, সিদ্ধান্তসমূহ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিবৃতি। জামায়াতের কাজ সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র উজির জনাব হাবিবুল্লাহ খান তাঁর ‘৬৩ সালের ২৩ শে অক্টোবরের সাংবাদিক সম্মেলনে সমগ্র দুনিয়ার সামনে এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, “জামায়াত কাজ পর্যন্ত আইন ভঙ্গ করেনি”। এ সাংবাদিক সম্মেলনের রিপোর্ট ‘৬৩ সালের ২৪শে অক্টোবরের ‘পাকিস্তান টাইমস’ ও ‘ডন’-এ দেখুন। এখন দ্বিতীয় উপায়টির বিস্তারিত বর্ণনা নীচে পেশ করা হলোঃ
১। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শূরা একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে তার নিম্নোক্ত নীতি ঘোষণা করেছিল।-
“এর (অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর) চেষ্টা হলো দেশের (অর্থাৎ পাকিস্তানের) জীবন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ইসলামের ছাঁচে ঢালাই করা। নিজের এ উদ্দেশ্য সফলের জন্যে এ জামায়াতটি এমন পদ্ধতি ও উপায়-উপকরণ ব্যবহার বৈধ মনে করে না, যা সত্য ও সততা বিরোধী অথবা যা থেকে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির সৃষ্টি হয়। সে সংশোধন ও বিপ্লবের জন্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর বিশ্বাস রাখে। অর্থাৎ প্রচার-প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে মন-মগজ, চরিত্র সংশোধন এবং যে সব পরিবর্তন সাধন আমাদের লক্ষ্য তার জন্যে জনমত গঠন। জামায়াতের কোন কাজ গোপনে অনুষ্ঠিত হয় না। বরঞ্চ সবকিছুই হয় প্রকাশ্যে। যেসব আইনের ওপর দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত, সেগুলোকে সে ভংগ করতে চায় না, বরঞ্চ ইসলামী রীতি অনুযাযী সেগুলো পরিবর্তন করতে চায়। যে সব লোক দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করছেন, তাদেরকে সরিয়ে দেয়া বা নিজেরা তাদের স্থান দখল করা তাদের লক্ষ্য নয়। বরঞ্চ সে তাদেরকে সংশোধন করতে চায় এবং যদি তারা সংশোধন গ্রহণ না করে, তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদেরকে পরিবর্তন করে তাদের স্থালে এমন লোক বসাতে চায়, যারা সংশোধিত জনমতের দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবেন।” (তর্জুমানুল কোরআন, সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ সাল, পৃঃ ৩২৯-৩৩০)
২। জামায়ত ১৯৫৩ সালে যে গঠনতন্ত্র প্রকাশ করে, তার ১০ম ধারায় এবং আবার ১৯৫৩ সালে যে সংশোধিত গঠনতন্ত্র প্রকাশ করে, তার ৫ম ধারায় এ কথা পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা হয় যে-
“উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্যে জামায়াত কখনও এমন উপায় ও পদ্ধতি ব্যবহার করবে না, যা সত্য ও সততা বিরোধী বিরোধী অথবা যার ফলে দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। জামায়াত তার উদ্দেশ্যে বিবৃত সংস্কার ও বিপ্লব সাধনের জন্যে গণতান্ত্রিক ও আইনানুগ পদ্ধতিতে কাজ করবে। অর্থাৎ প্রচার, প্রোপাগান্ডা ও চিন্তার প্রসারের মাধ্যমে মন, মগজ ও চরিত্র সংশোধন করতে হবে এবং যে সব পরিবর্তন সাধন জামায়াতের লক্ষ্য সেগুলোর জন্যে জনমত গঠন করতে হবে। জামায়াত তার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে গোপন পদ্ধতিগুলোর অনুকরণে প্রচেষ্টা চালাবে না, বরঞ্চ প্রকাশ্যে জনসমক্ষে প্রচেষ্টা চালাবে। (এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যেকটি সদস্য জামায়াতে প্রবেশ করার সময় এ গঠনতন্ত্র মেনে চলার জন্যে দস্তুরমত শপথ গ্রহণ করে।)
৩। ১৯৫১ সালের ১০ই নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নিখিল পাকিস্তান সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে মরহুম জনাব লিয়াকত আলী খানের শাহাদাতের ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম-
“কোন দেশে ফয়সালা করার শেষ ক্ষমতা বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তি জনমতের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বিচারপতির তলোয়ারের হাতে সোপর্দ করে দেয়ার চাইতে বড় কোন দুর্ভাগ্য আর হতে পারে না। যে জাতি নিজে নিজের দুশমন নয় এবং যার বিবেক দেউলিয়া হয়ে যায়নি, সে এমন নির্বোধ হতে পারে না যে, তার বিভিন্ন বিষয়ের ফয়সালার ভার বিবেক ও যুক্তির পরিবর্তে তলোয়ারের অন্ধ ও ঘুষখোর বিচারপতির উপর ন্যস্ত করবে। যদি আমরা নিজেদের ভবিষ্যত অন্ধকার বলতে না চাই, তাহলে আমাদেরকে পূর্ণ শক্তিতে নিজেদের দেশের অবস্থার এহেন ভয়াবহ দিকে গতি পরিবর্তিত হতে না দেয়া উচিত। আমাদের এবং বিশেষ করে আমাদের দায়িত্বশীল লোকদের এখানে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা এবং কায়েম রাখার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত, যাতে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে এমন সব রকমের রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধন সম্ভবপর হয়, যার স্বপক্ষে জনমত গড়ে উঠেছে।” (আমাদের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা, ১৪ পৃষ্ঠা, প্রকাশক মাকতাবা জামায়াতে ইসলামী)
৪। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর নিখল পাকিস্তান সম্মেলনে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। তাতে পরিস্কার বলা হয়ঃ
“যেহেতু জামায়াতে ইসলামী তার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংস্কার ও বিপ্লব সাধনের পরিকল্পনার জন্যে আইনানুগ পদ্ধতিতে কাজ করতে বাধ্য এবং পাকিস্তানে কার্যত এই সংস্কার ও বিপ্লব সৃষ্টির একটি মাত্র পথ আছে, আর তা হলো নির্বাচনের পথ, যেহেতু জামায়াতে ইসলামী অবশ্য দেশের নির্বাচনসমূহ থেকেও অসম্পর্কিত থাকতে পারে না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অথবা প্রয়োজনবোধে উভয় পদ্ধতিতেই সে এতে অংশগ্রহণ করতে পারে।” (ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসূচী, ১৪ পৃষ্ঠা)
৫। ১৯৫৮ সালে জামায়াতে ইসলামী তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। তাতে তার এ উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়ঃ
“এমন একটি সত্যিকার গণতন্ত্র কায়েম করা, যাতে নিজেদের পছন্দমত লোককে ক্ষমতাসীন করতে সক্ষম হবে এবং যাদেরকে তারা পছন্দ করে না তাদেরকে কর্তৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে দিতে পারবে।” (নির্বাচনী ইশতেহার, পৃষ্ঠাঃ ১৪)
৬। গত বছর হজ্জের সময় আমি মক্কা মুয়াযযমায় আরব দেশসমূহ থেকে আগত নওজোয়ানদেরকে সম্বোধন করার সুযোগ লাভ করেছিলাম। এ বক্তৃতায় আমি তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, তাদের নিজেদের দেশে সশস্ত্র বিপ্লব সাধনের প্রচেষ্টা পরিহার করা উচিত এবং শান্তিপূর্ণ, আইনানুগ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংস্কার সাধনের চিন্তা করা উচিত। আমার এ বক্তৃতা সমস্ত আরব দেশে প্রকাশিত হয়েছে। তর্জুমানুল কোরআন পত্রিকায় এর উর্দু তর্জমাও প্রকাশিত হয়েছে। তার শেষাংশ হলো এই-
“আমার শেষ নসিহত হলো এই যে, তাদের গোপন আন্দোলন পরিচালনা করে এবং অস্ত্রের মাধ্যমেই বিপ্লব সাধনের জন্যে প্রচেষ্টা চালানো উচিত নয়। ….. একটি নির্ভুল ও সত্যিকার বিপ্লব হামেশা গণ-আন্দোলনের মাধ্যমেই সাধিত হয়। প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে দাওয়াতের কাজ করুন, বিরাটভাবে মন, মগজ ও চিন্তাশুদ্ধির কাজ করুন। মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তন করুন। নৈতিকতার অস্ত্র দিয়ে মনের ওপর বিজয় লাভ করুন। এমন প্রচেষ্টায় যে সব বিপদ ও পতিবন্ধকতা দেখা দেবে, সৎ সাহসের সঙ্গে তার মোকাবিলা করুন। এভাবে পর্যায়ক্রমে যে বিপ্লব সাধিত হবে, তা এমন স্থায়ী ও শক্তিশালী হবে যে, বিরোধী শক্তিসমূহের কাল্পনিক তুফান তাকে বিলুপ্ত করতে পারবে না। তাড়াতাড়ি কৃত্রিম পদ্ধতিতে কোন বিপ্লব সাধিত হলেও যে পথে সে আসবে, সেই পথেই তাকে বিলুপ্ত করে দেয়া যেতেও পারবে।” (তর্জুমানুল কোরআন, জুন, ১৯৬৩)
৭। ১৯৬৩ সালের ১০ই নভেম্বর আমি পাকিস্তানে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতেও নিজের এ চিন্তার পুনরাবৃত্তি করি। এ বিবৃতি নাওয়া-ই-ওয়াক্ত, মাশরিক এবং অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর আসল শব্দগুলো এই-
“আমি নীতিগতভাবে আইন ভঙ্গ, বেআইনী পদ্ধতি ও গোপনে কাজ করার ভীষণ বিরোধী। আমার মত হলো এই যে, কারো ভয়ে বা কোন সাময়িক প্রয়োজনে নয়, সুসভ্য সমাজের অস্তিত্বের জন্যে আইনের প্রতি সম্মানবোধ অপরিহার্য। কোন আন্দোলন এ সম্মানবোধকে যদি একবার নষ্ট করে, তাহলে তারপর মানুষকে আবার আইনের অনুগত করা তার নিজের পক্ষেও বড় কঠিন বরং অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে গোপন সংগঠনের মধ্যেও এমন দোষ আছে যার ফ এ পদ্ধতিতে কার্যরত ব্যক্তিরা নিজেরাই অবশেষে সমাজের জন্যে সেইসব লোকের চাইতেও বড় আপদে পরিণত হয়, যাদেরকে সরিয়ে দেয়ার জন্যে তারা এ পদ্ধতি গ্রহণ করে। এসব কারণে আমার আকীদা হলো এই যে, আইন এবং গোপন সংগঠন চরম ত্রুটিপূর্ণ। আমি যা কিছু করেছি সব সময় প্রকাশ্যে করেছি এবং আইন কানুনের সীমার মধ্যে থেকেই করেছি। এমনকি যে সব আইনের ঘোর বিরোধী সেগুলোকেও আমি গণতান্ত্রিক ও আইনানুগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কখনও সেগুলো ভঙ্গ করিনি।
এগুলো ১৯৪৮ সাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত আমার ও জামায়াতে ইসলামীর প্রামাণ্য বিবৃতি। এখন জানানো উচিত যে, সরকারের কাছে কি প্রমাণ আছে, যার সাহায্যে তারা আমার ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যে, আমরা বল প্রয়োগে ক্ষমতা দখলের পক্ষপাতী? তাদের কাছে কি আমার বা জামায়াতে ইসলামীর কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তির এমন কোন লেখা অথবা বক্তৃতা আছে, যা থেকেএ অর্থ প্রকাশ হয়? অথবা তারা এমন কোন দৃষ্টান্ত পেশ করতে পারবেন যে, গত ১৭ বছর জামায়াতে ইসলামী আইন বিরোধী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? যদি এমন কোন প্রমাণ তাদের কাছে থেকে থাকে, তাহলে তা জনসমক্ষে পেশ করছেন না কেন?
সরকার তার ৬ই জানুয়ারীর প্রেসনোটে এই অভিযোগের সমগ্র বুনিয়াদটিই কেবল মুনীর রিপোর্টের একটি উদ্ধৃতির ওপর রেখেছেন। তাতে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু স্মরণ করা উচিত যে, মুনীর রিপোর্ট কোন আদালতের ফয়সালা নয়। বরং একটি অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট মাত্র। এ রিপোর্ট Terms of Reference এর সীমা লঙ্ঘন করে বিশৃঙ্খলভাবে অসম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের ওপর নেহাত অযথা হামলা করা হয়েছে এবং এমন অদ্ভুত বিদ্রূপাত্মক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যা কখনও কোন নিরপেক্ষ অনুসন্ধানকারী আদালতের যোগ্য হতে পারে না। এ আদালতের (বা অনুসন্ধান কমিটির) সামনে কখনো এ প্রশ্ন নিখুঁত পর্যালোচনা সাপেক্ষ হিসাবে স্থান পায়নি যে, জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ কি, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি এবং তা হাসিল করার জন্যে সে কি কি উপায় অবলম্বন করতে চায়। এসব ব্যাপারে আমাকে বা জামায়াতে ইসলামীর কোন প্রতিনিধিকে কোন প্রশ্ন করা হয়নি। অথবা আমাদের সামনে এ অভিযোগ উত্থাপন করে আমাদের কাছ থেকে এর পক্ষে সাফাই চাওয়া হয়নি। এবং রিপোর্টের মধ্যে যেখানে এ অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সেখানেও এর কোন প্রমাণ পেশ করা হয়নি, যা থেকে কমিটি কিসের ভিত্তিতে আমাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তা জানা যেতে পারে।
প্রশ্ন হলো এই যে, কোন রিপোর্টে, তা আদালতের অনুসন্ধান রিপোর্টেই হোক না কেন, এভাবে বিনা সাক্ষ্য প্রমাণে কোন জামায়াতের বিরুদ্ধে এই ধরনের একটা রায় দিয়ে দেয়াই কি সেই জামায়াত থেকে তার অস্তিত্বের অধিকার এবং তার নেতৃবৃন্দের আযাদীর অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে? আবার আজ দশ বছর অতীত হওয়ার পর এভাবে মুনীর রিপোর্টের সেই বাক্যটির সুযোগ গ্রহণের বৈধতাই বা কোথায়? মুনীর রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে আর তার ঐ মন্তব্যের ভিত্তিতে আমরা নিজেদের আযাদী ও জামায়াতের অস্তিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি ১৯৬৪ সালে। এতে যৌক্তিকতার নামগন্ধও আছে কি?
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা
গ্রেফতার ও আটকের কারণ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে যে, ‘জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান ও এর সরকারের বিরুদ্ধে অনবরত প্রকাশ্যে শত্রুতামূলক মনোভাব প্রকাশ করেছে।’
এ অভিযোগের দু’টি অংশ। প্রথম অংশ হলো, জামায়াত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল এবং দ্বিতীয় অংশ হলো যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনবরত পাকিস্তান ও এর সরকারের প্রতি শত্রুতামূলক মনোভাব প্রকাশ করেছে। সম্ভবত দ্বিতীয় অংশটি এজন্যে বাড়ানো হয়েছে যে, প্রথম অংশটি অভিযোগকারীদের নিজেদের নিকটও এত বেশী বাজে মনে হয়েছে যে, নিছক এরই ভিত্তিতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে তারা অতীব সাহ্যকর মনে করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ষোল বছর পর এমন একটি জামায়াত, যে এই পূর্ণ ষোল বছর (সামরিক শাসনকাল ছাড়া) এখানে কাজ করেছে, তাকে ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল’ এই অভিযোগ উত্থাপন করে বে-আইনী ঘোষণা করা এবং তার নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা, বলা বাহুল্য প্রথম দৃষ্টিতেই প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে হাস্যকর মনে হবে। এ জন্যে একে যুক্তিসঙ্গত করার জন্যে এটুকু বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও এ জামায়াতটি ষোল বছর ধরে শুধু সরকারের নয় বরং পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও প্রকাশ্যে শত্রুতা প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু এটুকু বাড়ানোর পরও কথাটি ঠিক ততটুকু হাস্যকরই থেকে যায় যতটুকু প্রথম অবস্থায় ছিল।
প্রশ্ন হলো, ১৯৪৭ সাল থেকে যখন জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানে কাজ শুরু করেছে, তখন থেকে ১৯৬২ সালের ৫ই জানুয়ারী পর্যন্ত যে অনবরত শত্রুতা জারি রইল এবং তা গোপনেও ছি না বরং প্রকাশ্য জারি ছিল, তা হঠাৎ ১৯৬৪ সালের ৬ই জানুয়ারী কেমন করে দৃষ্টিগোচর হলো? এ দীর্ঘ সময়ে এই প্রকাশ্য শত্রুতা উপেক্ষিত হয়েছিল কেন? বরং এখন এমন কি বিশেষ কারণ সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে সঙ্গে সঙ্গেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের এবং এমন কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রয়োজন অনুভূত হলো? স্পষ্ট করে কেন বলা হলো না যে, কনভেনশন লীগকে সম্প্রসারিত করার জন্যে বিরোধী গ্রুপের একটি সুসংগঠিত পার্টিকে ময়দান থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে? বিশেষ করে নির্বাচনের পূর্বে তো এ প্রয়োজন আরো অনেক বেড়ে গেছে।
অতঃপর এ অভিযোগের এক একটি অংশের ওপর আমি পৃথকভাবে আলোচনা করব। অভিযোগের প্রথম অংশ সম্পর্কে আমার জবাব হলো-
১। কিছুক্ষণের জন্যে যদি একথা মেনেও নেয়া হয় যে, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল, তাহলে আমি জিজ্ঞেস করি যে, সে কি কংগ্রেসের চাইতেও বেশী বিরোধী ছিল? সবাই জানে যে, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানের আসল লড়াই জারি ছিল কংগ্রেসের সঙ্গেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই কংগ্রেসের যে দলটি এদেশে ছিল, সেটি সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করে। তার প্রতিনিধি আমাদের প্রথম ও দ্বিতীয় আইন পরিষদে ছিল। ‘৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সে একটি মুসলিম বিরোধী দলরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এবং কখনও এ প্রশ্ন ওঠানো হয়নি যে, তোমরা যেহেতু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলে, তাই এখন তোমরা পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করতে পার না। সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর পাকিস্তান কংগ্রেস পুনরুজ্জীবিত না হওয়ার পেছনে কোন আইন সঙ্গত কারণ নেই, বরং এটি এমন একটি ব্যাপার যেমন আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং অন্যান্য দল নিজেদেরকে পুনরুজ্জীবিত করেনি। পাকিস্তান কংগ্রেস যদি আজ নিজেকে পুনর্বহার করতে চায়, তাহলে তার পথে আইনগত কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।
২। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ সত্যবিরোধী যে, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল। জামায়াতে ইসলামী ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন থেকে ১৯৪৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত পূর্ণ ছ’বছর সময়ে কি কোন ব্যক্তি দেখাতে পারেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করার জন্যে জামায়াতে ইসলামী কোন সভা করেছিল? কোন প্রস্তাব পাস করেছিল? কোন শোভাযাত্রা বের করেছিল? নির্বাচনে মুসলিম লীগের মোকাবিলায় কোন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল? অথবা মুসলিম লীগের কোন বিরোধী প্রার্থীকে সমর্থন করেছিল? অথবা জনগণকে বলেছিল যে, মুসলিম লীগের প্রার্থীদেরকে ভোট দিও না? অথবা অন্য কোনরূপে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গতিরোধ করার জন্যে কোন কাজ করেছিল অথবা কোন রকমের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল? যদি এমন কোন প্রমাণ কারও কাছে থাকে তাহলে তা অবশ্য পেশ করা উচিত। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর রেকর্ডে যদি এমন কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে মেহেরবানী করে জানানো হোক যে, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কি বিরোধিতা করেছিল? কবে করেছিল? কিভাবে করেছিল? বড়জোর এতটুকু বলা যায় যে, জামায়াত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুসলিম লীগের সঙ্গে মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করেনি। নিছক অংশগ্রহণ না করাকে কি বিরোধিতা বলা যেতে পারে?
৩। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ না করার কারণ এ ছিল না যে, জামায়াত মুলমানদের জন্যে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করতে চায় না। বরং এর তিনটি কারণ ছিল। এ কারণ তিনটি একাধিকবার জামায়াতে ইসলামীর বইপত্রে পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম কারণ এই যে, মুসলমানদের মধ্যে এমন একটি জামায়াত থাকা জরুরী ছিল যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে খোদা না খাস্তা যদি মুসলিম লীগ ব্যর্থ হয়ে যেত, তাহলে যেন জাতিকে সাহায্য করতে সক্ষম হতো এবং এ কারণে এই সংরক্ষিত শক্তিকে (Reserve Fprce) সংগ্রাম থেকে পৃথক রাখার প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয় কারণ এই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও অবশ্য কয়েক কোটি মুসলমানকে ব্রিটিশ ভারতের সেই অংশে থাকতে হতো, যা পাকিস্তান পরিকল্পনার মাধ্যমে হিন্দুদের কর্তৃত্বাধীনে চলে যাচ্ছিল। দেশ বিভাগের পর ঐসব মুসলমানকে সাহায্য করার জন্যে অবশ্য মুসলিম লীগ কিছুই করতে পারত না। এ উদ্দেশ্যে অন্য একটি সুসংগঠিত দলকে প্রথম থেকে প্রস্তুত রাখার প্রয়োজন ছিল এবং এ দলকে পাকিস্তান সংগ্রাম থেকে পৃথক রাখারও প্রয়োজন ছিল, যাতে হিন্দু-ভারতে সে কাজ করতে সক্ষম হয়। তৃতীয় কারণ এই যে, পাকিস্তানের জন্যে যে দলটি (মুসলিম লীগ) কাজ করছিল তার সমস্ত দৃষ্টি একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের উপরই নিবদ্ধ ছিল। নৈতিক ও দ্বীনী দিক থেকে দল ও তাকিকে শক্তিশালী ও দৃঢ় রাখার জন্যে তার পক্ষে কোন প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছিল না। এ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছিল যে, এভাবে একটি দল সংগ্রাম করে যদি দেশ হাসিল করে তাহলে তাকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা তো দূরের কথা, তাকে জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে শক্তিশালী ভিত্তিতে দাঁড় করাতেও সক্ষম হবে না। এবং সেখানে ভীষণ নৈতিক ও আদর্শিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতিতে এ প্রচেষ্টা চাকালে মুসলমানদের মধ্যে এমন একটি সুসংগঠিত দল গঠনের প্রয়োজন ছিল যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ রাষ্ট্রকে নৈতিক ধ্বংস হতে রক্ষার এবং একে ইসলামের পথে পরিচালিত করার জন্যে কাজ করতে পারে। প্রশ্ন এই যে, এই দূরদর্শিতাপূর্ণ পরিকল্পনাকে কার্যকর করা কি গোনাহ ছিল? এর শাস্তি আজ সেই সব লোক জামায়াতে ইসলামীকে দিতে চায়, যাদের নিজেদেরও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় কোন উল্লেখযোগ্য অংশ নেই। এর শাস্তি মরহুম কায়েদে আযম দিলেন না, মরহুম লিয়াকত আলী খান দিলেন না, খাজা নাজিমউদ্দীন দিলেন না। তাঁদের সবার শাসনামলে জামায়াতে ইসলামী দস্তুরমত কাজ করে এসেছে।
৪। আমার যে সব রচনাকে আজ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হচ্ছে, তা ১৯৩৯ ও ‘৪০ সালে লিখিত। প্রথম, এগুলোকে জামায়াতে ইসলামীর মাথায় নিক্ষেপ করা ভুল, কেননা জামায়াতে ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে কায়েম হয়। দ্বিতীয়ত, ওগুলো সেই যুগের লেখা যখন মুসলমানদের মধ্যে সবেমাত্র এই আলোচনা চলছিল যে, ব্রিটিশ ভারতে তাদের জটিল সমস্যাবলীর সমাধান কি? তৃতীয়ত, ঐ লেখাগুলোর সত্যিকার উদ্দেশ্য ঐ উদ্ধৃতি থেকে বুঝা যায় যে, যারা সমগ্র রচনা থেকে পৃথক করে কাদিয়ানী এবং হাদীস অস্বীকারকারীগণ (মুনকেরীনে হাদীস) পেশ করেছেন এবং তাদের বিপরীত অর্থ করেছেন। বরং ওগুলোর আসল অর্থ সমস্ত সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধকে পুরোপুরি পড়ার পরই বুঝা যেতে পারে। এসব প্রবন্ধ আমি মুসলমানদেরকে একথা বুঝানোর জন্যে লিখেছিলাম যে, একটি জাতীয় রাষ্ট্র কায়েম করা নয়, বরং একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার জন্যে এমন কোন দলীয় সংগঠন উপযোগী হতে পারে না, যা নৈতিক ও দ্বীনী প্রাণবস্তুশূন্য। এ উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করার জন্যে আমি আমার প্রবন্ধে যে আলোচনা করেছি, তা এ দেশের হাজার হাজার শিক্ষিত লোক পড়েছেন। তারা তা থেকে ঐ অর্থ গ্রহণ করেননি, যা আমার লেখা থেকে কয়েকটি বাক্যকে পুর্বাপর সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বের করা হচ্ছে।
৫। কোন লেখকের রচনা থেকে এমন অর্থ বের করা, যা ঐ লেখকের নিজেরই সুস্পষ্ট বক্তব্যর বিপরীত, আসলে তা স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা। আমার সম্পর্কে কোন ব্যক্তি কেমন করে বলতে পারে যে, আমি দেশ বিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলাম, যেখানে আমি নিজেই দ্বি-জাতিত্ববাদের সমর্থনে তিনটি বই লিখেছি (দেখুন আমার বই- ‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ, ১ম খণ্ড ও ৩য় খণ্ড এবং মাসয়ালায়ে কওমিয়াত), যেখানে আমি নিজেই ১৯৩৮ সালে দেশ বিভাগের পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম (দেখুন আমার বই-মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ ২য় খণ্ডম পৃষ্ঠা ২০৮-২১৪), যেখানে ১৯৪৪ সালে পাকিস্তান দাবিকে আমি প্রকাশ্যে ন্যায্য দাবি বলে ঘোষণা করি (দেখুন, আমার বই- রাসায়েল ও মাসায়েল, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৫৯-৩৬২), যেখানে সীমান্ত প্রদেশের রেফারেন্ডামে আমি পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়াকে সমর্থন করেছি (দেখুন আমার বই-রাসায়েল ও মাসায়েল, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬২-৩৬৩)।
এখন অভিযোগের দ্বিতীয় অংশে আসুন অর্থাৎ “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী অনবরত পাকিস্তান ও তার সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে শত্রুতা প্রকাশ করে আসছে। অভিযোগের এ অংশটি যিনি তৈরি করেছেন তার চিন্তা এত বেশী বিক্ষিপ্ত যে, তিনি পাকিস্তান ও তার সরকারের মধ্যে পার্থক্য অনুভব করতে পারেননি এবং তিনি এও জানেন না যে, পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এখানে একটি সরকার নয় বরং পর পর কয়েকটি সরকার পরিবর্তিত হয়েছে।
পাকিস্তানের সরকারগুলো সম্পর্কে এতটুকু বলা যায় যে, জামায়াতে ইসলামী অবশ্য তাদের সযে মতবিরোধ প্রকাশ করে এসেছে এবং একটি বিরোধী দল হিসাবে এটি তার আইন সঙ্গত অধিকার। জামায়াতে ইসলামী এ নীতির ওপর অটল ছিল যে, যতক্ষণ না আমরা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হই এবং আমরা নিজেরাই সরকার গঠন ও নিজেদের নীতি অনুযায়ী পরিচালিত করার মত ক্ষমতা অর্জন করব, ততক্ষণ আমাদের সরকার যন্ত্রে অংশ গ্রহণ করা উচিত নয়। এ নীতির ভিত্তিতে গত সাড়ে ষোল বছর থেকে জামায়াতে ইসলামী একটি বিরোধী দল হিসাবে কাজ করে আসছিল। প্রশ্ন হলো, একটি যুক্তিযুক্ত ও সর্বস্বীকৃত গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে কোন দল যদি বিরোধী দলে থাকে এবং দেশের পরিবর্তিত সরকার সমূহের সঙ্গে মতবিরোধ প্রকাশ করতে থাকে তাহলে তা কবে এবং কিভাবে অপরাধ হয়ে গেল যে, তাকে বে আইনী ঘোষণা এবং তার নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার বৈধতা লাভ করা হলো?
আর পাকিস্তানের বিরোধিতার অভিযোগটি এমন একটি জঘন্য ও ঘৃণার্হ অভিযোগ যে, কোন সরকারের তার নিজের দেশবাসীর ওপর ততক্ষণ পর্যন্ত এ অভিযোগটি আরোপ করা উচিত নয়, যতক্ষণ তার নিকট এ অভিযোগের সপক্ষে শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকে। সরকারের নিকট এই কঠোর অভিযোগের সপক্ষে কি প্রমাণ আছে, তা আমাকে জানানো হোক। কোন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তারা এ দোষারোপ করেছেন? এবং এই চরম কঠোর অভিযোগের সপক্ষে যদি তাদের কাছে কোন প্রমাণ থাকে, তাহলে তারা প্রকাশ্যে আদালতে জামায়াতের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চালানোর পরিবর্তে সেই সব আইনের সাহায্য গ্রহণ করেছেন কেন, যেগুলোর মাধ্যমে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই ইচ্ছামত যে কাউকে দোষারোপ করা ও তাকে ইচ্ছামত শাস্তিও দেয়া যেতে পারে?
যদিও কোন ব্যক্তি বা দলকে অপরাধী ঠাওরানোর জন্যে প্রমাণ পেশ করা অভিযোগকারীরই কাজ, যে ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, নিজের নিরপরাধ হওয়ার জন্যে প্রমাণ পেশ করার দায়িত্ব তার উপর বর্তায় না, তবু আমি এ কথা প্রমাণ করতে চাই যে, সরকার নেহায়েত ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করে আমাদের উড়িয়ে ফেলতে চান। এ জন্যে আমি জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব ফয়সালার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি কি তা জানাব। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শূরা নিজের পলিসি সম্পর্কে যে প্রস্তাব পাস করে, তাতে বলা হয়-
“যেহেতু কায়েদে আযমের ইন্তেকালে দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি বিরাট আঘাত পেয়েছে এবং বাইরেও বিপদের আনাগোনা শুরু হয়েছে, তাই মজলিসে শূরা এ কথা সুষ্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দিতে চায় যে, জামায়াতে ইসলামী সংস্কারমূলক উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে পাকিস্তানের ঐক্য ও তার আযাদী সংরক্ষণের পুরোপুরি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং এ ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল উপায়ে দেশের অন্যান্য দল ও সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।”
“জামায়াতে ইসলামীর মতে, পাকিস্তানের মঙ্গল ও উন্নতি এবং তার স্থিতিশীলতার জন্যে পূর্বেই যথাশীঘ্র আইনগত পদ্ধতিতে এর ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কথা ঘোষণা করে দেয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন যখন কায়েদে আযমের ব্যক্তিত্বের সাহায্য রইল না, তখন এ প্রয়োজন আরও বেশী করে দেখা দিয়েছে। এই ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত পরিবর্তন পর্যায়ক্রমে সময় মাফিক হতে থাকবে। কিন্তু এ ঘোষণার পর নীতিগতভাবে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা একটি ইসলামী ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়ে যাবে। দেশের আসল শক্তি মুসলিম জনগণের দিল ও বিবেক যখন তাকে নিশ্চিন্ততা অনুভব করবে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও তার অগ্রগতির পথ নির্ধারিত হয়ে যাবে। এবং পাকিস্তানের নৈতিক স্থায়িত্ব, তার বিশৃঙ্খলামুখী অংশসমূহের ঐক্য, গুরুত্বপূর্ণ তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং তার দেশরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্যে একান্ত প্রয়োজনীয় আইনসমূহ এ পথে কাজ করার জন্যে একত্রিত হতে পারবে। উপরন্তু এর ফলে সেই আদর্শিক বিরোধও খতম হয়ে যাবে, যা দেশের ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা সম্পর্কে জন্ম নিচ্ছে এবং মানসিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।”
এই অধিবেশনে মজলিসে শূরার পক্ষ থেকে তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল খাজা নাযিমুদ্দীন সাহেবের কাছে নিম্নলিখিত পয়গাম পাঠানো হয়, “কায়েদে আযমের ইন্তেকালের পর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালা আপনার ওপর একটি বিরাট দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। আমরা দোয়া করছি, যিনি আপনার ওপর এ বোঝা চাপিয়েছেন তিনিই আপনাকে এটি বহন করার এবং এ হক আদায় করার শক্তি দান করুন। গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর আপনি যে ভাষণ দিয়েছেন তার মধ্যে একটি দ্বীনী প্রাণবস্তুর সন্ধান পাওয়া যায় এবং নেক ইরাদার নিশানা পরিদৃষ্ট হয়। আমরা অন্তর থেকে এর সম্মান করি। আমরা আশা করি, আপনি পাকিস্তানকে দিল ও দেহ উভয় দিক দিয়ে সত্যিকার ইসলামী রাষ্ট্রে পণিত করার চেষ্টা করবেন। আপনি বিশ্বাস করুন, এউদ্দেশ্যে আপনি যে কোন সঠিক প্রচেষ্টা চালাবেন, তাতে জামায়াতে ইসলামী আপনার সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।”
(তর্জুমানুল কোরআন, সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ সাল, পৃষ্ঠা ৩২৬ ও ৩২৭)।
একই অধিবেশনে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের জন্যে যে নির্দেশাবলী তৈরি করা হয়েছিল, তার প্রথম নির্দেশ ছিল-
“দেশের হেফাযতের জন্যে নিজেরা পূর্ণরূপে প্রস্তুত হোন এবং অন্যান্য মুসলমানদেরকেও প্রস্তুতির প্রয়োজন বুঝান। আমরা এ দেশটিকে ইসলামের জন্যে রক্ষা করতে চাই। কাজেই এই প্রেরণা নিয়ে সমস্ত কাজ থেকে এদিকে সবচেয়ে বেশী দৃষ্টি দেয়া আমাদের দ্বীনী কর্তব্য।” (তর্জুমানুল কোরআন, সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ সাল, পৃষ্ঠা ৩৩৬)
১৯৪৯ সালের ১২ই মার্চ পাকিস্তানের আইন পরিষদ আদর্শ প্রস্তাব পাস করেন এবং তার পরদিনই জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শূরা নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রকাশ করে-
“মসলিসে শূরার মতে আইন পরিষদ এই প্রস্তাবটি পাস করে সেই সর্বনিম্ন আইনগত শর্তাবলী পূর্ণ করেছেন, যা একটি দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যে প্রয়োজন।”
আবার ১৯৪৯ সালের ১৮ই এপ্রিল মসলিসে শূরা আদর্শ প্রস্তাবের প্রভাব ও ফল সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে পাকিস্তান সম্পর্কে তার এ নীতি প্রকাশ করে-
“এখন মন ও মগজের সমস্ত যোগ্যতা এবং যাবতীয় উপায়-উপকরণ এ রাষ্ট্রটিকে রক্ষা ও শক্তিশালী করার, একে তরককি দেয়ার এবং দেহ ও দিলের দিক দিয়ে একে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজে ব্যয় করা প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির ওপর ফরয হয়ে গেছে। যেভাবে এবং যেরূপে এর কোন খেদমত করা যেতে পারে, মনে প্রাণে তা করা উচিত। এখন রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ইতিবাচক (Positive) বিশ্বস্ততা। অসহযোগিতার ভাব শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা শুধু বাইরে থেকেই নয়। বরং ভেতর থেকেও (অর্থাৎ পার্লামেন্ট ও শাসন ব্যবস্থায়) প্রবেশ করে সংস্কার ও উন্নয়নের পূর্ণ প্রচেষ্টা চালাব।”
(জামায়াতে ইসলামী কি পজিশন উসকে আপনে ফায়সালে কি রোশনি মে, পৃষ্ঠাঃ ৬-৭)
সম্প্রতি লাহোরে জামায়াতে ইসলামীর যে নিখিল পাকিস্তান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, তাতে ‘৬৪ সালের ২৬ শে অক্টোবর একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। তার শব্দগুলো নিম্নরূপ-
“এই সংকট মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী ভারত ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শক্তিবর্গ, যাদের পাকিস্তান সম্পর্কে ভুল ধারণা রয়েছে, তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে যে, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে যত মতপার্থক্যই থাক না কেন, দশ কোটি পাকিস্তানী স্বদেশের নিরাপত্তা ও তাদের স্বাধীনতা রক্ষায় যে কোন ব্যাপারেই এক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে এবং এরূপ কোন অবস্থার সৃষ্টি হলে ইনশাআল্লাহ একজন পাকিস্তানীও পেছনে পড়ে থাকবে না।”
“কেবল দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসা রয়েছে এ কারণেই নয় বরং আমাদের বিশ্বাশ ও ধর্মীয় দাবির পরিপ্রেক্ষিতেও জামায়াত পাকিস্তানের দেশ রক্ষার প্রশ্নটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামের নামে এ দেশ অর্জিত হয়েছিল, তাই সমগ্র পাকিস্তান আমাদের কাছে একটি মসজিদ সমতুল্য এবং এর প্রতি ইঞ্চি জায়গা আমাদের কাছে এক মহান আমানতস্বরূপ। সকল মতপার্থক্য সত্ত্বেও আমরা সরকারকে সম্পূর্ণভাবে এই নিশ্চয়তা দান করছি যে, আমাদের দেশ রক্ষার ব্যাপারে সরকার যে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করুক না কেন, আমরা সর্বান্তকরণে তার সহযোগিতা করব। দেশপ্রেম কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের একচেটিয়া জিনিস নয়। প্রত্যেক পাকিস্তানীই সমানভাবে তার দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। কারণ তাদের জীবন, সম্পদ, সম্মান ও প্রিয় মূল্যবোধ এ সকল কিছুই সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তাদের এ দেশের নিরাপত্তা ও সংগতির ওপর। সুতরাং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রতিটি পাকিস্তানীই যদি সে বিকৃত মস্তিষ্ক অথবা নিজেই নিজের শত্রু না হয়, তাহলে স্বদেশ রক্ষার্থে এগিয়ে আসবে।” (রোয়েদাদ, কুল পাকিস্তান ইজতিমা জামায়াতে ইসলামী, পৃষ্ঠাঃ ৫৬)
এসব জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক রীতিমতো গৃহীত ও প্রকাশিত প্রস্তাবাবলী। সরকার এ কথা বলতে পারেন না যে, তারা এ সম্পর্কে অবগত নন। এ সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করে এ দোষারোপ করা হয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামী অনবরত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। এ দোষারোপের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে সরকারের ৬ই জানুয়ারীর প্রেসনোটে “মাযী কারীব কা জায়েযাহ” নামক একটি পুস্তিকার উপর। এ পুস্তিকা সম্পর্কে বক্তব্য হলো এই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন আমি তর্জুমানুল কোরআন পত্রিকা পুনরায় লাহোর থেকে বের করলাম তখন তার প্রথম তিন সংখ্যায় ‘৪৮ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে পরপর তিনটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখি। তাতে দেশ বিভাগের সময় দেশে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তার উপর বিস্তারিত মন্তব্য করা হয়। ব্রিটিশ সরকার, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তিন দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যাবলীর ওপর একজন ঐতিহাসিকের ন্যায় নিরপেক্ষ মন্তব্য করে বলা হয়, দেশ বিভাগের ব্যাপারটি মীমাংসা করার এবং একে কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের প্রত্যেকের কি কি ভুল হয় এবং তার ফল কিভাবে আত্মপ্রকাশ করে। অতঃপর তৃতীয় প্রবন্ধে বলা হয়, দেশ বিভাগের পর মুসলিম জাতি কি কি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং মুসলিম লীগ কি এসব সমস্যা সমাধানে সফল হতে পারে? এর মধ্যে প্রথম প্রবন্ধ দু’টিকে সম্ভবত ‘৪৯ সালে আমার অজ্ঞাতে করাচী জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা “মাযী কারীব কা জায়েযাহ” নামে একটি পুস্তিকাকারে করাচী থেকে প্রকাশ করে। যা হোক এ প্রবন্ধগুলো মরহুম কায়েদে আযমের জীবদ্দশায় যখন তিনি গভর্ণর জেনারেল ছিলেন, তখন প্রকাশ হয়। মরহুম লিয়াকত আলী খান তখন পাকিস্তানের উজিরে আযম ছিলেন। তখন কেউ একে এ দৃষ্টিতে দেখেনি যে, এগুলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লিখিত হয়েছে। বরং এতে মুসলিম লীগের কাজের যে সমালোচনা করা হয়, তাকে একটি বিরোধী দলের নেতার ন্যায়সঙ্গত অধিকার মনে করা হয়। এ কারণেই তার বিরুদ্ধে সে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়নি, যা ষোল বছর পর বর্তমান সরকার করেছেন। আমি বলি, আজ কোন নিরপেক্ষ বিচারপতি যদি ঐ প্রবন্ধগুলো পড়েন- পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দু’একটি বাক্য নয়- তাহলে কখনো তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন না যে, ঐ প্রবন্ধগুলো এমন এক ব্যক্তি লিখেছেন, যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হোক এ কামনা করত না এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর তাকে বিলুপ্ত করে দিতে চায়। ঐ প্রবন্ধগুলোর এ অর্থ শুধু এমন ব্যক্তি করতে পারে, যে পণ করে বসেছে মওদুদী ও তার জামায়াতকে যে কোন ক্রমেই জালে জড়িয়ে ফেলতে এবং এ উদ্দেশ্যে সব রকমের ফন্দিফিকির বের করতে বন্ধপরিকর হয়েছে।
সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি
আপনার প্রেরিত গ্রেফতার ও আটকের কারণসমূহের মধ্যে যে তৃতীয় অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তা হলো এই যে, “জামায়াতে ইসলামী সরকারী কর্মচারীদের বিশ্বস্ততার ভিত্তি নড়িয়ে দিয়ে এবং গোলযোগ সৃষ্টি করে কর্তৃত্ব দখল করার নিয়তে সরকারী বিভাগ সমূহ ও মজুর প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল।”
এ অভিযোগেরও দু’টি অংশ। একটি অংশ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং অন্যটির সম্পর্ক মজুর প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। আমি পৃথক পৃথকভাবে এ দু’টি অভিযোগের জবাব দেব।
সরকারী কর্মচারীদের সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, তাতে একটি সোজা ব্যাপারকে জেনে-বুঝে একটি ভয়াবহ রূপ দেয়া চেষ্টা করা হয়েছে। আসল ব্যাপার হলো এ যে, জামায়াতে ইসলামী এদেশের বছরের পর বছর ধরে ব্যাপকভাবে কাজ করে আসছিল। তার বই পত্র হাজার হাজার, লাখো লাখো সংখ্যায় ছাপা হতো। বিভিন্ন স্থানে এগুলো প্রকাশ্যে বিক্রি হতো। শত শত স্থানে তার পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রত্যেক ব্যক্তির সেখানে এসে বইপত্র পড়ার ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নিয়ে যাওয়ার অবাধ সাধীনতা ছিল। দেশের সকল স্থানে তার সভা অনুষ্ঠিত হতো। এতে সব রকমের লোক আসতো ও বক্তৃতা শুনতো। শত শত স্থানে দরসে কোরআন ও হাদীস দেয়া হতো। এতেও সব রকমের লোক শামিল হতো। এ আন্দোলনটি এভাবে সমগ্র দেশে প্রকাশ্যে জারি ছিল। তাহলে এক্ষেত্রে সরকারী কর্মচারী, যারা এদেশেরই বাসিন্দা এবং ঐসব লোকালয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একত্রে বসবাস করে তারা কেমন করে এ থেকে অজ্ঞ এবং দূরে থাকতে পারে। জামায়াত নিজে কোন পরিকল্পনা করে কোন বিশেষ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেনি। সরকারী কর্মচারীরা নিজেরাই তার বইপত্র পড়েছে, নিজেরাই তার সভায় এসেছে এবং দরসে শামিল হয়েছে। তাদের মধ্যে যাদের মন-মগজে জামায়াতের তাবলীগের আবেদন কার্যকর হয়েছে, সে নিজেই জামায়াতের প্রভাব গ্রহণ করেছে। তার নিকট বই পত্র পৌঁছে যাওয়ার পথ আমরা বন্ধ করতে পারতাম না। তারা যাতে বই পত্র পড়তে না পারে সেজন্যে তাদের চোখে কাপড় বাঁধার কোন ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তাদেরকে আমাদের সভা এবং দরসে কোরআন ও হাদীসের মাহফিলে শরীক হওয়া থেকে মানা করতে পারতাম না। এ কাজ যদি সরকার এখন করতে চান, তাহলে করুন। বরঞ্চ যদি সম্ভব হয়, তাহলে সরকারী কর্মচারীদেরকে ঐসব শহর ও লোকালয় থেকে বের করে পৃথক কোন কেল্লার মধ্যে বন্ধ করে রাখতে পারেন, যাতে এদেশে যেসব আন্দোলন চলছে তার কোন হাওয়া তাদের গায়ে না লাগে।
উপরে যা কিছু আমি বলেছি, তা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, জামায়াতে ইসলামী সরকারী দফতর ও কর্মচারীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেনি। বরঞ্চ তার চিন্তাধারা সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্তভাবে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে প্রবেশ করেছে এবং সরকার নিজেই বারবার সরকারী দফতরসমূহে সার্কুলার লাঠিয়ে এবং প্রত্যেকটি সরকারী কর্মচারীর কাছ থেকে শপথনামা গ্রহণ করে নিজের কর্মচারীদেরকে তার দিকে আকৃষ্ট করেছেন। এখন এই প্রবেশের কারণে ঐ কর্মচারীদের বিশ্বস্ততার ভিত্তি নড়ে উঠেছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, সে সম্পর্কে সরকারের জানানো উচিত যে, জামায়াতে ইসলামীর বইপত্র এবং তার তাবলীগের মধ্যে এমন কি জিনিস আছে, যা সরকারী কর্মচারীদের বিশ্বস্ততাকে স্থানচ্যুত করে? সত্যি বলতে কি একথা কেউ স্বীকার করুক বা নাই কারুক, জামায়াতে ইসলামীর তাবলীগের প্রভাব সেখানেই সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে পৌঁছেছে, সেখানেই তারা বেশী দায়িত্বশীল, বেশী কর্তব্যনিষ্ঠ, বেশী খোদাভীরু এবং বেশী বিশ্বস্ত হয়েছে। সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী যদি কোন শ্রেণী দুর্নীতি, উৎকোচ গ্রহণ ও কর্তব্যে অবহেলা থেকে বেঁচে থাকে, তাহলে তাহলো সেই শ্রেণীটি, যেদি জামায়াতে ইসলামীর বইপত্র ও তার প্রভাব গ্রহণ করেছে। কিন্তু সরকারের নিকট এ বিষয়টির কোন মর্যাদা নেই। তাদের চিন্তা শুধু এই হলো যে, কর্মচারী ও অফিসাররা কনভেনশন লীগের জন্যে অবশ্য ভলান্টিয়ারের মত কাজ করবে কিন্তু অন্য কোন বিরোধী দলের এবং বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর স্পর্শও যেন তারা না পায়। সরকারী কর্মচারীদের সম্পর্কে আমার নীতি আমি ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসের তর্জুমানুল কোরআনের ৩৬৬-৩৬৮ পৃষ্ঠায় এবং ‘৫৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ৪২০-৪২২ পৃষ্ঠায় সুষ্পষ্টভাবে বিবৃতি করেছি। এ দু’টো পত্রিকাই বোর্ডের সামনে পেশ করছি।
অভিযোগের দ্বিতীয় অংশ, যাতে মজুর সংগঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে ব্যাপারে আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি যে, তারা যেন এমন একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেন, যাতে প্রমাণ হয় যে, জামায়াতে ইসলামী মজুরদের সাহায্যে কোন সময় গোলযোগ সৃষ্টি করেছে অথবা কোন ধর্মঘট করেছে অথবা কারখানায় কোন ধরনের বিবাদ সৃষ্টি করেছে। অনেকগুলো দৃষ্টান্ত নয়, মাত্র একটি দৃষ্টান্ত পেশ করার দাবি জানাচ্ছি। মেহেরবানী করে তার বরাত দেয়া হোক। আসল ব্যাপার হলো এই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন জামায়াতে ইসলামী দেখল যে, কমিউনিস্ট কর্মী এবং তাদের ‘সহযাত্রী’ লাল সাহেবরা মজুরদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করছে এবং তারা কমিউনিস্ট বিপ্লব সাধনের উদ্দেশ্যে জমি পরিস্কার করার জন্যে মালিক-মজুরের শ্রেণী সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছে, তখন সে সর্বপ্রথম মেহনতী মানুষের জন্যে একটি পলিসি নির্ধারণ করল এবং তারপর সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিল।
এ ব্যাপারে যে পলিসি নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা ছিল এইঃ
১। মজুর-কারখানা মালিক অথবা অন্য কথায় বলা যায়, শ্রমদানকারী ও শ্রমলাভকারীদেরকে দুটি পৃথক সংঘর্ষশীল ও বিবাদী শ্রেণী হিসাবে মনে করার ধারণার বিলোপ সাধন করতে হবে। এই চিন্তাকে শক্তিশালী করতে হবে যে, এ দু’টি শ্রেণী একই সমাজের অংশ এবং তাদের মধ্য সংঘর্ষের পরিবর্তে ইসলামী ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে সহযোগিতা কায়েম হওয়া উচিত, যাতে এ সমাজের অংশ হিসাবে তারা এর উন্নতির সহায়ক হতে পারে।
২। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে যে সব বিবাদ সৃস্টি হবে, সেগুলোকে হরতাল, লক-আপ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার দিকে অগ্রসর হতে দেয়া হবে না এবং ঐসব বিবাদ দূর করার জন্যে দেশে যেসব আইন প্রচলিত আছে সেই মোতাবিক আদালতের মাধ্যমে বিবাদসমূহের মীমাংসা করানো হবে।
৩। শিল্প ব্যাপারে ইনসাফ কায়েম করার জন্যে আইনে যেসব অতিরিক্ত সংশোধনের প্রয়োজন, দেশের আইন পরিষদের মাধ্যমে তা করতে হবে।
এ পলিসি বিস্তারিতভাবে আমার বই রাসায়েল ও মাসায়েল প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় সংস্করণের ৪২৫-৪২৬ পাতায় এবং ‘জামায়াতে ইসলামী কি মানশূর’-এর ৩৭-৩৮ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করা হয়েছে। এ পলিসি অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী যে লেবার ওয়েলফেয়ার কমিটি গঠন করে, তা ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে অসংখ্য শিল্প-বিবাদের মীমাংসা করায় এবং বহু স্থানে হরতাল ও লকআপ প্রত্যাহার করিয়ে শিল্প বিবাদ সমূহের আইনগত পথের দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এ প্রচেষ্টার ফলে ৯০ লক্ষ টাকার ব্যাপারে আদালতের মাধ্যমে মীমাংসিত হয় এবং সামরিক শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর যখন জামায়াতের নিজের কাজ বন্ধ করতে হয়, তখন ৭ কোটি টাকার মামলা চালু ছিল। আমি আগেই বলেছি যে, এই সমগ্র সময়ের মধ্যে এমন একটি ঘটনাও সৃষ্টি হয়নি যার ফলে জামায়াতে ইসলামী কোথাও হরতাল, বিবাদ বা দাঙ্গা করিয়েছে। সরকার যদি এমন কোন ঘটনা পেশ করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই তা পেশ করতে হবে। আর যদি তারা তা পেশ করতে না পারেন তাহলে আমি আরয করব যে, রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের জন্যে দেশের শান্তিপ্রিয় ও আইন মান্যকারী নাগরিকদের ফাঁদে ফেলে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা থেকে সরকারের বিরত থাকা উচিত।
ইসলামী জমিয়তে তালাবা
আপনার বিবৃতি চতুর্থ অভিযোগ এই যে, “জামায়াতে ইসলামীর আমীর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতাসহ জমিয়তে তালাবার সাহায্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে বেআইনী হরতাল করার এবং পাবলিক স্থানসমূহে অশান্তি ও হাঙ্গামা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিল।” এ অভিযোগে জমিয়তে তালাবাকে ছাত্রদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর দোসর (Counter Part) বলেও গণ্য করা হয়েছে।
এ অভিযোগটি আমার ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তখনই উত্থাপিত হতে পারবে, যখন দুটি কথা প্রমাণ করে দেয়া হবে। এক-জমিয়তে তালাবা কখনো কোন প্রতিষ্ঠানে কোন বেআইনী হরতাল করিয়েছে অথবা কোন শিক্ষায়তনের মধ্যে অশান্তি বা হাঙ্গামা সৃষ্টি করিয়েছে। দুই-এ কাজে আমার বা জামায়াতে ইসলামীর কোন ইঙ্গিত ছিল। আমি জোরের সঙ্গে দাবি জানাচ্ছি যে, সরকার এ দু’টির একটিও প্রমাণ করতে পারবেন না। তাই তাঁরা জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ও ১৯০৮ সালের সংশোধিত ফৌজদারী আইনের সাহায্য নিয়েছেন, যাতে কোন আদালতের সামনে কোন সাক্ষী প্রমাণ পেশ করার ঝামেলা না পোহাতে হয় এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে হাটে হাড়ি না ভেঙে যায়।
যদিও এ অভিযোগের জবাবে ঐটুকু কথাই যথেষ্ট যা আমি উপরে বিবৃত করেছি, কিন্তু গত ৬ই জানুয়ারী জামায়াতকে বেআইনী ঘোষণা ও তার নেতৃবৃন্দকে আটক করে যে সরকারী প্রেসনোট জারি করা হয়, তা আমার সামনে আছে। এ প্রেসনোটে জমিয়তে তালাবার বড়ই ভয়াবহ চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে এবং অত্যন্ত পরিশ্রম করে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আসলে জামায়াতে ইসলামী জমিয়তে তালাবার মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে হাঙ্গামা সৃষ্টি করছে। এজন্যে আমি উল্লিখিত অভিযোগটির সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে ক্ষান্ত থাকতে পারছি না। বরঞ্চ প্রেসনোটে উল্লিখিত অভিযোগের বিস্তারিত জবাব দিয়ে আসল ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে চাই।
জমিয়তে তালাবা ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে কায়েম হয়। এটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ছাত্রদের একটি দল, যারা আমাদের দেশের শিক্ষায়তনগুলোর বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং অন্যান্য আধুনিক বিদ্যা শিক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী মনোবৃত্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, নৈতিক মূল্যমানের অনুগত এবং নিজের নিজের শিক্ষায়তনে নাস্তিক্য, বেদ্বীনী ও নৈতিক অরাজকতা প্রতিরোধ করার এবং ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী ভাব জাগ্রত করার চেষ্টাও করে। এই যুবকদের মধ্যে এমন অসংখ্য ছাত্র দেখতে পাবেন, যারা উচ্চ পর্যায়ের আধুনিক পাশ্চাত্য বিদ্যা শিক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে ‘তাহাজ্জুদণ্ডযারও’। তারা গত ষোল বছর যুব সমাজের ঈমান ও নৈতিক বিকৃতি প্রতিরোধ এবং তাদের নাস্তিক্যবাদী চিন্তা ও ফাসেকী কর্মের সয়লাব থেকে রক্ষা করার জন্যে বিরাট কাজ করেছে। যতদূর জানি পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে আমি বলছি যে, তারা আজ পর্যন্ত আইন বিরোধী কোন কাজ করেনি। বরং তারা নিজেদের তৎপরতাকে আইন-কানুনের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নীতিকে কঠোরভাবে মেনে চলেছে। ঐ ছাত্রদের এই গুণাবলীর কারণে আমি তাদের ব্যাপারে আগ্রহী। কেননা, আমি এদেশে এমন সব যুবক দেখতে চাই যারা উচ্চ থেকে উচ্চতর শিক্ষালাভ করার সঙ্গে সঙ্গে পাক্কা মুসলমানও থাকে। এবং ঐ ছাত্ররাও আমার সম্পর্কে এজন্যেই আগ্রহী যে, তারা আমার কাছ থেকে এটা আশা করে যে, আমি তাদেরকে ইসলামের আলোকে আধুনিক জীবন সমস্যার সমাধান দিতে পারব। আমার ও তাদের এ সম্পর্ক কারুর দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন নেই এবং একে প্রচ্ছন্ন রাখার কোন কারণও নেই।
জামায়াতে ইসলামী ও জমিয়তে তালাবার সম্পর্ককে অধিকতর গভীর এবং নিকটতর প্রমাণ করার জন্যে সরকারী প্রেসনোটে যে জোড় লাগানো হয়েছে, যদিও তা চরম অতিশয়োক্তি এবং এর বিরাট অংশ সত্য-বিরোধী, তবু আমি জিজ্ঞেস করি যে, এ সব কিছু যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলেও বা অপরাধ কি? আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষারত যুবকগণ নাবালেগ নয়। এই শহর ও লোকালয় থেকে দূরে কোন জঙ্গলে তারা বসবাস করে না। সব রকমের বইপত্র তারা পড়ে। খবরের কাগজ পড়ে, সভা-সম্মেলনে যায়। বক্তৃতা শোনে। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত ও বালেগ যুবক তারা। তাহলে কিভাবে কোন বুদ্ধিমান এটা আশা করতে পারেন যে, দেশে যেসব আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে এবং যেসব চিন্তা ও মতাদর্শ সম্প্রসারিত হচ্ছে, তা থেকে এই যুবকরা একেবারেই অসম্পর্কিত থাকবে এবং এর কোন প্রভাব তাদের ওপর পড়বে না? আসলে শিক্ষায়তনের বাইরে যত বিভিন্ন মত ও পথের লোক আছে ছাত্রদের মধ্যেও ঠিক তত বিভিন্ন মতবাদ ও পথানুসারী দল আছে। ছাত্রদের মধ্যে শুধু জামায়াতে ইসলামীরই একটি দোসর নেই, বরং আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, গোপনে কার্যরত (Under ground) কমিউনিস্ট পার্টি- সবার দোসর তাদের মধ্যে পাওয়া যায়। আর এখন কনভেনশন লীগের দোসরও জন্ম নিচ্ছে, বরঞ্চ নিয়েছে। যদি এসব দোসর বৈধ হয়ে থাকে, তাহলে জামায়াতে ইসলামীর দোসরের অস্তিত্ব কেমন করে গোনাহর পর্যায়ে প্রবেশ করতে পারে?
জামায়াতে ইসলামী ও জমিয়তে তালাবার মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক থাক না কেন, তাকে হারাম বা কোন প্রকার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের ভিত্তি হিসাবে ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করা যেতে পারে না, যতক্ষণ না পূর্ব বর্তিত কথা দু’টি প্রমাণ করা যায় অর্থাৎ প্রথমত জমিয়তে তালাবা এমন কোন কাজ করেছে যা আইনত অপরাধ এবং দ্বিতীয়ত এ কাজ জামায়াতে ইসলামীর ইঙ্গিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সরকারী প্রেসনোটে বড় কসরত করে এর দু’টি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। এক, ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর বক্তৃতার সময়ে জমিয়তে তালাবা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঙ্গামা করেছিল এবং জামায়াতে ইসলামী এ হাঙ্গামা করার নির্দেশ জারি করেছিল। কিন্তু এ প্রেসনোট প্রণয়নকারী এবং এর প্রকাশকারীদের স্মরণ নেই যে, ‘৬২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দেশে সামরিক শাসন জারি ছিল। জমিয়তে তালাবা ও জামায়াতে ইসলামী উভয়েই বেআইনী ছিল। এবং একটি দলের হাঙ্গামা করার এবং অন্য একটি দল কর্তৃক তার নির্দেশ দেয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। এ সত্ত্বেও যদি ধরে নেয় যায় যে, হ্যাঁ এটা সত্যি, তাহলে সামরিক আইনের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? দু’টি নিষিদ্ধ দল প্রকাশ্যে কাজ করে। তাদের মধ্যে একটি হাঙ্গামা করে এবং অন্যটি এই হাঙ্গামা করার জন্যে নির্দেশ জারি করে। এ সত্ত্বেও মার্শাল ল’ নীরব রইল? সরকার কি এর সাহায্যে মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতা প্রমাণ করতে চান? সত্যি বলতে কি, দু’বছর পর আজ এ ঘটনাটিকে আমার ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করা থেকে এর কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সরকার আমার ও জামায়াতে ইসলামীর ওপর হাত উঠানোর জন্যে সকল সম্ভাব্য বাহানা তালাশ করে বের করেছেন। তবু সরকার যদি দাবি করেন যে, এটি কোন মনগড়া বাহানা নয় বরং পূর্ণর সত্য, তাহলে তাকে প্রকাশ্য আদালতে সাক্ষ্য পেশ করে একথা প্রমাণ করা উচিত যে, জনাব ভুট্টোর সভায় হাঙ্গামা প্রথমত জমিয়তে তালাবা করেছিল এবং দ্বিতীয়ত জামায়াতে ইসলামী নির্দেশ জারি করেছিল। গোয়েন্দা বিভাগের এটি সন্দেহযুক্ত ও অপূর্ণ রিপোর্ট- যা অনেক সময় কাউকে ফাঁদে ফেলার জন্যে জেনে বুঝে তৈরি করা হয়- সাক্ষ্য ও প্রমাণ হিসাবে কখনো গ্রহণ করা যেতে পারে না।
সরকার যে দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি পেশ করেছেন, তা হলো এই যে, সম্প্রতি লাহোর ও অন্যান্য স্থানে ছাত্ররা যে হাঙ্গামা করেছিল তা সরাসরি জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীদের উস্কানিদানের ফল ছিল। সরকারের দাবি হলো এই যে, তার নিকট এ ব্যাপারে শক্তিশালী সাক্ষ্য প্রমাণ আছে। আমি বলি, সরকারের কাছে যদি সত্যি এমন কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে থাকে, তাহলে তা লুকিয়ে রাখা হয়েছে কেন? কেন তা আদালতে পেশ করে আমাদের অপরাধ প্রমাণ করা হচ্ছে না? আসলে এ ঘটনাবলীর জন্যে সরকারই সম্পূর্ণ দায়ী। সরকার নিজেই জেনে বুঝে উত্তেজনা সৃষ্টি করে ছাত্রদের উস্কানি দিয়েছেন। নিজেই অস্বাভাবিক জুলুম নির্যাতন চালিয়ে ব্যাপারটিকে ভয়াবহ রূপ দান করেছেন। অতঃপর সরকার নিজেই জোরপূর্বক এর এসব দোষ জামায়াতে ইসলামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অথচ এ হাঙ্গামার সঙ্গে জামায়াতের দূরতম কোন সম্পর্কও ছিল না, একথা আমি শুরুতেই বলেছি। এ ব্যাপারটি এভাবে শুরু হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের জনৈক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বারাকাল্লাহ খান, যার প্রার্থীপদ সংক্রান্ত কাগজপত্র রীতিমত গৃহীত হয়েছিল, হঠাৎ তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়, যাতে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সে আপনা আপনি বের হয়ে যায়। (এখানে জেনে রাখা দরকার যে, বারাকাল্লাহ খানের জামায়াতে ইসলামী ও জমিয়তে তালাবার সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল না। কোন এক সময় সে অবশ্য জমিয়তের সদস্য ছিল, কিন্তু জমিয়ত তাকে সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করেছিল।) এটি এমন একটি অন্যায় নির্যাতন ছিল যে, এর ফলে স্বভাবতই ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং নির্বাচনের সকল পদপ্রার্থী-যাদের সংখ্যা ছিল ৬৫ জনের কাছাকাছি এবং যাতে বারাকাল্লাহ খানের বিরোধী প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল- নির্বাচন বর্জন করে। অতঃপর ঐ প্রার্থীরা নিজেরাই একটি এ্যাকশান কমিটি গঠন করে। এ কমিটিতে এমন একজনও ছিল না, যার জমিয়তে তালাবা বা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দূরতম কোন সম্পর্ক ছিল। এই এ্যাকশন কমিটিই বারাকাল্লাহ খানের বহিস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত করে। এ কমিটিই প্রতিবাদ জানানোর জন্যে কার্যকরী প্রোগ্রাম তৈরি করে এবং ‘৬৩ সালের ৪ঠা নভেম্বর শোভাযাত্রা তাদেরই সিদ্ধান্তক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়। এ শোভাযাত্রাকে পুলিশ নিজেই তাদের লাউড স্পীকারসহ চ্যারিং ক্রস পর্যন্ত যেতে দেয়। অতঃপর হঠাৎ কোন সতর্কবাণী বা নোটিশ না দিয়েই তাদের ওপর লাঠিচার্জ এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে ছাত্ররা আরো বেশী উত্তেজিত হয়। তারা ফিরে এসে ভাইস চ্যান্সেলরের নিকট এই জুলুমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্যে দরখাস্ত করে। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব সম্ভবত নিজেকে অসহায় দেখছিলেন। তাই তিনি ছাত্রদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে ঠাণ্ডা করা তো দূরের কথা, বাইরে বেরিয়ে এসে তাদের মুখোমুখি হতেও অস্বীকৃতি জানালেন। এ ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রদের জন্যে আরো বেশী উত্তেজনার কারণ হয় এবং তাদের একটি গ্রুপ ভাইস চ্যান্সেলরের দফতরে প্রবেশ করে সেখানে হাঙ্গামা শুরু কর। ছাত্রদের এ দলটি যারা সেখানে হাঙ্গামা শুরু করে এতে মূলত সাধারণ ছাত্ররাই ছিল। এতে জমিয়তে তালাবার সঙ্গে সম্পর্কিত কোন ছাত্রের উপস্থিতির সপক্ষে সরকারের নিকট অবশ্যই কোন সাক্ষ্য নেই। ৫ই নভেম্বর এই এ্যাকশন কমিটির প্রোগ্রাম অনুযায়ী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের ফুটপাতে ধরণা দিয়ে বসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত করে। তাদেরকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার জন্যে শুধু দু’মিনিট সময় দেয়া হয়। অথচ কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ধারণাই করতে পারে না যে, এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র দু’মিনিটে বিক্ষিপ্ত হয়-বা কেমন করে। দু’মিনিট শেষ হওয়ার পরই ছাত্রদের ওপর বেগম লাঠিচার্জ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায় প্রবেশ করে পুলিশ চরম নির্যাতন শুরু করে।
মাননীয়! এই হলো আসল ঘটনা, যা থেকে জানা যায় যে, শাসন কর্তৃপক্ষই প্রথমে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন এবং তারপর ব্যাপারটি আরো বেশী অগ্রসর করার জন্যেও তারা দায়ী। এ সমগ্র ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীকে টেনে আনা তো দূরের কথা জমিয়তে তালাবাও যে কোনক্রমে দায়ী তাও প্রমাণ করা যাবে না। সরকার যদি তার দাবির সত্যতায় বিশ্বাসী হন এবং জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের প্রকাশ্যে উস্কানিদানের সপক্ষে তার কাছে কোন শক্তিশালী প্রমাণ থাকে, তাহলে তার সাহস করে সামনে আসা উচিত। জামায়াতের কোন কোন লোক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং এই হাঙ্গামায় কথা ও কর্মের ক্ষেত্রে তাদের কতটুকু ভূমিকা এবং কি আছে তা জানানো উচিত।
সেবাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃস্টি
আপনার পঞ্চম অভিযোগ এই যে, “জামায়াত তার নেতৃবৃন্দের আপত্তিকর বক্তৃতার মাধ্যমে সশস্ত্র সেবাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। (একথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, গ্রেফতা ও আটকের কারণের মধ্যে The Jamaat Attemption শব্দ আছে) এটি একটি একেবারেই অপস্পষ্ট অভিযোগ। এ থেকে জানা যায় যে, সে নতাই-বা কে- যে এই আপত্তিকর বক্তৃতা করল এবং তাতে সে কি বলল। তবু তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেয়া যায় যে, কতিপয় নেতা এমন বক্তৃতা করেছিলেন, তাহলে তাদের ওপর মোকদ্দমা চালানো হলো না কেন? তাদের বক্তৃতার দায়ে সমগ্র জামায়াতকে বেঁধে ফেলার বৈধতা কোথায়? জামায়াত কখনো এমন ফয়সালা করেনি যে, সশস্ত্র সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে হবে। আমীরে জামায়াত হিসাবে আমি নিজেও এমন কোন নির্দেশ দেইনি। কতিপয় নেতা যদি কোন কথা বক্তৃতার মধ্যে বলে থাকেন, তাহলে তারা নিজেরাই তাদের বক্তৃতার জন্যে দায়ী ছিলেন।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সরকারের ৬ই জানুয়ারী প্রেসনোটে কেবল মিঞা তোফায়েল মুহাম্মদ সাহেবের উপর এ দোষারোপ করা হয়েছে যে, তিনি ৭ই সেপ্টেম্বর মিয়ানওয়ালীতে এ ধরনেরকোন বক্তৃতা করেছিলেন এবং আপনি গ্রেফতার ও আটকের কারণে দোষারোপ করেছেন যে, জামায়াতের নেতৃবৃন্দ এমন বক্তৃতা করেছিলেন। দু’টি সরকারী বিবৃতির এই সুস্পষ্ট বৈপরত্যের কি ব্যাখ্যা আপনি করবেন? এ থেকে কি একথা স্পষ্ট হয় না যে, এ সমস্ত অভিযোগ বিনা অনুসন্ধানে আনীত হচ্ছে? এবং একটি অভিযোগ উত্থাপন করার সময় স্মরণ ছিল না যে, মাত্র কয়েকদিন আগে এ থেকে ভিন্ন ধরনের কথা স্বয়ং সরকার বাহাদুরের জবান মুবারক থেকে এরশাদ হয়েছিল।