মাওলানা মওদূদী (র) বংশ পরিচয়
বিগত তের-চৌদ্দ শত বছর যাবত দুনিয়ার ইসলামী তাবলীগ, দ্বীনী শিক্ষা-দীক্ষা এবং পীরী-মুরশিদির কাজ জারী রেখেছে এমন এক অতি সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে হযরত আলী-ফাতেমীয় বংশের একটি শাখা আফগানিস্তানের হিরাট শহরের সন্নিকটে যে স্থানটিতে বসতি স্থাপন করেন, সে স্থানটি পরবর্তীকালে ‘চিশত’ নামে জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই বংশেরই খ্যাতনামা ওলীয়ে বুযুর্গ হযরত শাহ সুফী আবদাল চিশতী (র) হযরত ইমাম হাসানের (রাঃ) বংশধর ছিলেন। হযরত আবদান চিশতী থেকেই প্রচলিত হয় প্রখ্যাত তরীকায়ে চিশতীয়া। ইনি ইন্তেকাল করেন ৩৫৫ হিজরীতে। তাঁর দৌহিত্র এবং স্থলাভিষিক্ত (গদ্দীনশীন) হযরত নাসিরুদ্দিন আবু ইউসুফ চিশতী (র) হযরত আলী-ফাতেমীর বংশের দ্বিতীয় শাখা সম্ভুত ছিলেন। তাঁর উর্ধ্বমুখী বংশ পরম্পরা (নসবনামা) হযরত ইমাম আলী নকীর (র) মাধ্যমে হযরত ইমাম হুসাইন শহীদ (রাঃ) জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন মওদূদ চিশতী (র) ভারতীয় চিশতীয়া তরীকার পীরগণের আদি পীর ছিলেন। মওদূদী খান্দানের উদ্ভব তাঁরই নামানুসারে হয়েছে। খাজা কুতুবুদ্দীন ৫৭২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
পাক-ভারতের বিখ্যাত সুফী ও দরবেশ হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (র) সাথে মওদূদী খান্দানের সম্পর্ক নিম্নরূপঃ
নিম্নমুখী পীর পরম্পরা
১) হযরত কুতুবুদ্দীন চিশতী (র)
২) হযরত জামী শরীফ যিন্দানী (র)
৩) হযরত উসমান হারুনী (র)
৪) হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী সিঞ্জরী (র)
অর্থাৎ হযরত কুতুবুদ্দীন মওদূদ চিশতী (র) ছিলেন খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (র) পর-দাদা পীর।
মওদূদী খান্দানের পূর্ব-পুরুষদের মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম ভারতে পদার্পন করেন, তাঁর নাম ছিল হযরত আবুল আ’লা চিশতী (র)। ইনি হিজরী নবম শতাব্দীর শেষ ভাগে দিল্লীর বাদশাহ সেকেন্দার লোদীর আমলে ভারত আসেন এবং কর্ণাটের উপকণ্ঠে বরাস নামক একটি ক্ষুদ্র শহরে বসবাস করতে থাকেন। ইনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ ওলীরে বুযুর্গ। ৯৩৫ হিজরীতে ইনি জান্নাতবাসী হন।
বাদশাহ শাহ আলমের সময়ে উক্ত পরিবার দিল্লীতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তখন থেকে উক্ত বংশের পঞ্চম পুরুষ পর্যন্ত সকলেই দিল্লীতে বাস করতে থাকেন। বর্তমান কালের মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র) উক্ত বংশের ষষ্ঠ পুরুষ।
মাতৃকূলের মাধ্যমে মাওলানা মওদূদীর (র) মধ্যে প্রবাহিত রয়েছে তুর্কী বীরের শোণিতধারা। তাঁর প্রমাতামহ মিরযা কোরবান আলী বেগ খান সালেক একজন তুর্কী কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। কিন্তু সৈনিক বৃত্তিই তাঁর পূর্ব-পুরুষগণের পেশা ছিল। মিরযা তোলক বে নামক তাদের জনৈক পূর্ব পুরুষ বাদশাহ আওরংযেব আলমগীরের আমলে ভারতে আগমন করে সেনা বিভাগে যোগদান করেন। বাদশাহ শাহ আলমের রাজত্বকাল পর্যন্ত উক্ত পরিবারের লোক কোন না কোন শাহী মসনদ অধিকার করেছিলেন। মোঘল সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবার পর তারাও বিভিন্ন দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। মরহুম কোরবান আলী বেগ খান সালেকের পিতা মরহুম নওয়াব আলম বেগ খান এবং চাচা মরহুম নওয়াব নিয়াজ বাহাদুর খান হায়দারাবাদের তৎকালীন নিযাম নওয়াব মীর নিযাম আলী খানের আমলের শেষভাগে হায়দারাবাদে আগমন করেন। নওয়াব নিয়াজ বাহাদুর বিয়ে করেন নওয়াব মুস্তাকিল জঙ ইযযতুদ্দৌলা আশুর বেগ খানে কন্যাকে। আশুর বেগ খান নিয়াজ বাহাদুর খানের চাচা ছিলেন। মোগল সম্রাটগণ তাঁদেরকে যে সব উপাধিতে ভূষিত করেন, হায়দারাবাদের নিযামগণও তাদেরকে অনুরূপ উপাধিতে ভূষিত করেন। মুক্তাকিল জঙের পর নওয়াব নিয়াজ বাহাদুর খান জমাদার জায়গীরদার হিসাবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
নওয়াব আলম বেগ খান গোলকুন্ডার কেল্লাদার আব্দুর রহীম খানের পরিবারে বিয়ে করেন। তাঁরই ঔরসে কোরবান আলী বেগ খান সালেক জন্মগ্রহণ করেন। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে নওয়াব নিয়াজ বাহাদুর খান দাক্ষিণাত্যের চঞ্চল গড়ের হাঙ্গামায় শহীদ হন। এই ঘটনার পর নওয়াব আলম বেগ শিশুপুত্রসহ দিল্লী চলে যান। এর প্রায় চল্লিশ বছর পর মিরযা কোরবান আলী বেগ হায়দারাবাদ গমন করেন এবং সালারে জঙ আযম তাঁকে প্রধান শিক্ষা উপদেষ্টা নিযুক্ত করেন। তথায় তিনি নওয়াব ইমাদ-উল-মূরক বিলগেরামীর সহায়তায় “মাখযানুল ফাওয়ায়েদ” নামে একখানি অমূল্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। গ্রন্থখানি হায়দারাবাদের সর্বপ্রথম না হলেও অন্যতম প্রসিদ্ধ প্রাচীন গ্রন্থ সন্দেহ নেই। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মিরযা কোরবান আলী বেগ খান সালেক পরলোক গমন করেন।
মাওলানা মওদূদীর (র) বংশ পরম্পরা
নিম্নমুখী
ইমামুল মুত্তাকীন সাইয়েদুনা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা)
হযরত ইমাম হুসাইন শহীদ (রা)
হযরত ইমাম জয়নুল আবেদনী (রা)
হযরত ইমাম মুহাম্মদ আলবাফ (রা)
হযরত ইমাম মুহাম্মদ জা’ফর সাদেক (রা)
হযরত ইমাম মূসা আ’ল কাযেমী (রা)
হযরত ইমাম মুহাম্মদ তকী (রা)
হযরত ইমাম মুহাম্মদ নকী (রা)
সাইয়েদুস সা’দাত আব্দুল্লাহ-আলী-আকবর (র)
সাইয়েদুস সা’দাত হুসাইন (র)
সাইয়েদুস সা’দাত মুহাম্মদ (র)
মুহাম্মদ শাময়ান চিশতী (র)
খাজা নাসিরুদ্দীন কুতুবুদ্দীন ইউসুফ চিশতী (র) ৱ
খাজায়ে খাজগান কুতুবুদ্দীন মওদূদ চিশতী (র)
খাজা আবু আহমদ ম্ওদূদী চিশতী (র)
খাজা রুকনুদ্দীন মওদূদী চিশতী (র)
খাজা নিযামুদ্দীন মওদূদী চিশতী (র)
খাজা কুতুবুদ্দীন মুহাম্মদ মওদূদী চিশতী (র)
খাজা আলী আবু আহমদ সানী মওদূদী চিশতী (র)
খাজা আহমদ আবু ইউসুফ সানী মওদূদী চিশতী (র)
খাজা মুহাম্মদ যাহেদ মওদূদী চিশতী (র)
খাজা কুতুবুদ্দীন মওদূদ সানী চিশতী (র)
খাজা নিযামুদ্দীন আলী মওদূদী চিশতী (র)
খাজা মুহাম্মদ মুহীউদ্দীন শাহ খাজগী মওদূদী চিশতী (র)
শাহ আবুল আ’লা মওদূদী চিশতী (র)
শাহ আবদুল আলী মওদূদী (র)
শাহ আবদুলগণি মওদূদী (র)
খাজা আবদুস সামাদ মওদূদী (র)
খাজা আবদুস শাকুর (ওরফে খোশহাল মুহাম্মদ) মওদূদী (র)
খাজা আবদুল্লাহ (ওরফে গুল মুহম্মাদ) মওদূদী (র)
খাজা আব্দুল বারী (ওরফে মীর ভিখারী) মওদূদী (র)
খাজা আবদুল ওয়ালী (ওরফে মীর ফযল ইলাহী) মওদূদী (র)
শাহ আবদুল আযীয (ওরফে মীর করম ইলা) মওদূদী (র)
শাহ ওয়রেস আলী মওদূদী (র)
সাইয়েদ হাসান মওদূদী (র)
সাইয়েদ আহমদ হাসান মওদূদী (র)
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র)
সাইয়েদ আহমদ হাসান মওদূদী
মাওলানা মওদূদীর (র) পিতা সাইয়েদ আহমদ হাসান মওদূদী (র) বিগত ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের দুই বছর পূর্বে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লী নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আলীগড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক যুগের ছাত্র। একথা সকলের জানা আছে যে, আলীগড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠা তৎকালীন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমর্থন-সহানুভূতি লাভ করতে পারেনি। কারণ তাঁরা ইংরেজী শিক্ষা তথা পাশ্চাত্য তাহযীব তামাদ্দুনের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও বিরক্তি পোষণ করতেন। পক্ষান্তরে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সাইয়েদ আহমদ ছিলেন এর প্রতি পরম আগ্রহশীল। তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের ভেতর থেকে প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও মেধাবী বালক সংগ্রহ করে আলীগড়ে ভর্তি করতে থাকেন। সাইয়েদ আহমদ হাসান মওদূদীকে তিনি এক প্রকার বল পূর্বক আলীগড়ে ভর্তি করে দেন।
মওদূদী পরিবার যে ইংরেজী ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত নারাজ ও বীতশ্রদ্ধ ছিলেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ তাঁরা শুধু ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার দিক দিয়েই শীর্ষস্থানীয় ছিলেন না, বরং পীরানে তরিকতের বা আধ্যাত্মিক দীক্ষাগুরুর শীর্ষস্থানও অধিকার করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সাইয়েদ আহমদ আত্মীয়তার দাবিতে পীরযাদা আহমদ হাসানকে আলীগড়ে নিয়ে গেলেন বলে পীর সাইয়েদ হাসান মওদূদী (র) অতীব বিষন্ন মনে নীরব রইলেন।
একবার পীর সাইয়েদ হাসান মওদূদীর (র) জনৈক বন্ধু কোন কার্যোপলক্ষে আলীগড় যান। তিনি সেখানে দেখতে পান যে বালক আহমদ হাসান ইংরেজী পোশাক পরে অন্যান্য ছাত্রদের সাথে ক্রিকেট খেলছেন। একজন প্রসিদ্ধ পীরানে-পীরে তরীকতের পুত্রের এহেন আচরণে তিনি মর্মাহত হলেন এবং দিল্লী ফিরে গিয়ে বললেন, “আহমদ হাসানকে অবিলম্বে আলীগড় থেকে বাড়ী নিয়ে আসুন নতুবা তার সংস্রব ত্যাগ করুন। সে গোল্লায় গেছে।”
আহমদ হাসানের আলীগড়ের ছাত্রজীবন শেষ হলো। কারণ পিতা সাইয়েদ হাসান অবিলম্বে পুত্রকে আলীগড় কলেজ থেকে বদলী সার্টিফিকেট নিয়ে বাড়ী ফিরিয়ে আনেন। তৎকালীন প্রিন্সিপাল নিম্নরুপ প্রশংসাপত্র দেনঃ
This is to certify that Ahmad Hasan was Reading in the third school class of this college during a part of last year and that he was then holding a scholarship of Rs 5/- a month.
His conduct was satisfactory and the moulvi with whom he read his second language states that he was fairly up in both Arabic & Persian.
Sd/-S.D.T.Siddons
Date: 17th Feb, 1877
Principal
Muhanmedan Anglo-Oriental College Aligarh
পরবর্তীকালে অবশ্য আহমদ হাসান মওদূদী এলাহাবাদ থেকে ওকালতি পাস করেন। ওকালতি পাস করার পর দেওগড় দেশীয় রাজ্যের রাজপরিবারে গৃহ শিক্ষকের কাজের জন্যে তাঁকে আহবান করা হয়। তিনি দেওগড় পৌঁছে জানতে পারলেন যে, তাঁর জনৈক শিক্ষককেও উক্ত চাররির জন্যে আহবান করা হয়েছে। তিনি রাজা সাহবেকে সবিনয়ে জানিয়ে দিলেন যে, আপন ওস্তাদের সাথে চাকরির জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তিনি অনিচ্ছুক। অতএব তাঁর পরিবর্তে তাঁর শিক্ষককে নিযুক্ত করলেই তিনি খুশী হবেন। এদিকে রাজা সাহেব আহমদ হাসান মওদূদীর শিক্ষক অন্য প্রার্থীকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তিনি বললেন, “সেতো আমারই ছাত্র এবং আমার কাছে বালক মাত্র। শিক্ষকতার যোগ্যতা তার কতটুকুই বা আছে?”
প্রার্থীদ্বয়ের চরিত্রের এই বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে রাজা সাহেব মন্তব্য করলেন, “শিক্ষক অপেক্ষা ছাত্রের মধ্যেই আমি অধিকতর যোগ্যতা দেখতে পাচ্ছি।” অবশেষে আহমদ হাসান মওদূদীই গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত হলেন।
উকিল আহমদ হাসান মওদূদী
দেওগড়ে কিছুকাল গৃহ-শিক্ষকের কাজ করার পর সাইয়েদ আহমদ হাসান মওদূদী মীরাট, গাযিয়াবাদ, বুলন্দ শহর প্রভৃতি স্থানে ওকালতি করেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে একটি মামলার ওকালতির জন্যে তিনি হায়দারাবাদের আওরংগাবাদ শহরে গমন করেন। জনাব মহীউদ্দিন খান ছিলেন সেখানকার মীর বা প্রধান বিচারপতি। তিনি ছিলেন দূর সম্পর্কে আহমদ হাসান মওদূদীর চাচা। মামলা পরিচালনায় আহমদ হাসান যথেষ্ট পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেন। প্রাদেশিক মীরের পরামর্শে তিনি আওরঙ্গাবাদেই স্থায়ীভাবে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই আইনঞ্জ হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
এ যাবত কিন্তু পাশ্চাত্য ভাবধারা ও চালচলনের বিশেষ প্রভাব ছিল উকিল মওদূদীর মধ্যে। অন্তরে যে বংশানুক্রমিক ধর্মীয় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিদ্যমান ছিল, তা ছিল তমসাচ্ছাদিত। কিন্তু মহীউদ্দিন খান সাহেবের সাহচর্য ও সংস্পর্শ লাভ করার ফলে তাঁর মধ্যকার পাশ্চাত্য ভাবধারাগুলো ক্রমশ পূর্ণ ইসলাম ভাবধারায় রূপান্তরিত হতে লাগলো। মহীউদ্দীন খান শুধুমাত্র একজন প্রধান বিচারপতিই ছিলেন না, বরঞ্চ ছিলেন একজন উচ্চাঙ্গের ওলীয়ে বুযুর্গ। আহমদ হাসান ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের তাঁর হাতে বাইয়াত করে যিকির-আযকার, মুরাকাবা-মুশাহাদা ও ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল হলেন। এভাবে কেটে গেল পূর্ণ চারটি বছর।
খ্রিষ্ট্রীয় ১৯০৪ সালে, যে সময় সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) এক বছরের শিশু, উকিল মওদূদী ভাবলেন যে, তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চায় ওকালতি পেশা এক বিরাট অন্তরায় হয়ে পড়েছে। অতএব তিনি ওকালতি পরিত্যাগ করে নির্লিপ্তভাবে খোদা-প্রেমে ধ্যানমগ্ন হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করলেন। আইন ব্যবসালব্ধ সমূদয় অর্থ, পোশাক-পরিচ্ছদ, গৃহের আসবাবপত্র ও সাজ-সরঞ্জাম অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে নিঃসম্বল অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি দিল্লী গমন করেন এবং হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আওলিয়া মাহবুবে এলাহীর (র) মাযার শরীফের সন্নিকট ‘আরব সরাই’ নামক এক অতি প্রাচীন বস্তিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। স্ত্রী-পুত্র পরিজনের সংস্রব এক প্রকার ত্যাগ করে দিবারাত্র হুজরানশীন হয়ে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল হলেন তিনি। এভাবে তিন-তিনটি বছর কেটে গেল।
এদিকে আওরঙ্গাবাদের প্রধান বিচারপতি জনাব মহীউদ্দীন খান উকিল মওদূদীর এহেন দুরবস্থায় কথা জানতে পেরে তাঁকে আওরঙ্গাবাদে নিজের কাছে ডেকে পাঠান। আহমদ হাসান মওদূদী পিতৃব্য পীর-মুর্শিদের আহবানে আওরঙ্গাবাদে পুনরাগমন করেন। মহীউদ্দিন খান তাঁকে এই বলে উপদেশ দেন যে, খোদা প্রাপ্তির পথে দুনিয়ার সংস্রব ত্যাগ করা অপরিহার্য নয়। বরঞ্চ বৈরাগ্য ইসলাম বিগর্হিত। জীবন যাপন ও সংসার পালনের জন্যে অর্থ উপার্জন একান্ত আবশ্যক। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রতিটি কপর্দক হালাল উপায়ে অর্জিত হয়। পীর-মুরশিদের নির্দেশে সাইয়েদ আহমদ হাসান মওদূদী পুনরায় সপরিবারে আওরংগাবাদ গিয়ে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু এখন থেকে তাঁর ওকালতি পেশার এক নতুন অধ্যায় সূচিত হলো।
এখন থেকে কোন মামলা মোকদ্দমা গ্রহণ করতে হ’লে তার পূর্বে তার সত্যতা সম্পর্কে বহু জিজ্ঞাসাবাদ করে নিতে হবে। এর ফলে তাঁকে দারিদ্র্য বরণ করতে হলো। কিন্তু একদিকে যেমন তাঁর ইসলামী ভাবধারা ও গভীর খোদাপ্রেম বাড়তে লাগল, অপরদিকে তেমনি বাড়তে লাগলো পার্থিব ভোগ লালসার প্রতি তাঁর বিরাগ বিতৃঞ্চা। তাঁর চিন্তাধারা, জীবন-যাপন প্রণালী এবং প্রতিটি কার্যকলাপ এমন এক রূপান্তর গ্রহণ করলো যে, পাশ্চাত্য ভাবধারার পূলক প্রবাহ তাঁর অন্তর প্রদেশে একদা প্রবাহিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করাই সুকঠিন ছিল।
যা হোক, তিনি ১৯১৫ সাল পর্যন্ত আওরঙ্গাবাদে ওকালতি করেন। তারপর তিনি হায়দারাবাদ যান। কিন্তু স্বাস্থ্যভঙ্গ হওয়ার কারণে তাঁকে ভূপাল যেতে হয়। দুঃখের বিষয় সেখান অর্ধাঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়ে চার বছর পর ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জান্নাতবাসী হন।
প্রকাশ থাকে যে, আহমদ হাসান মওদূদী মাদরাসা ইসলামিয়া আওরংগাবাদ -এর শিক্ষক মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান সাহেবের নিকট সহীহ মুসলিম কামেল এবং নাসায়ী কামেল এর পূর্ণ শিক্ষা লাভ করে সনদ লাভ করেন এবং হাদীস শিক্ষাদানের অনুমতি লাভ করেন।
মাওলানা মওদূদীর জন্ম ও শিক্ষালাভ
হিজরী সন ১৩২১ সালের ৩রা রজব (ইং ১৯০৩ সালে) আওরংগাবাদ শহরের প্রসিদ্ধ আইন ব্যবসায়ী সাইয়েদ আহমদ হাসান মওদূদীর গৃহে এক অপরূপ শিশু জন্মগ্রহণ করে। পিতা আকুল আগ্রহে শিশু পুত্রের নাম সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রেখে আল্লাহ তায়ালার অশেষ শুকরিয়া আদায় করলেন। শিশু জন্মগ্রহণের তিন বছর পূর্বে এক ওলীয়ে বুযুর্গ তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, “দেখ, আল্লাহর ফযলে তোমার একটি পুত্র সন্তান হবে। তার নাম রাখবে আবুল আ’লা মওদূদী। কারন এই নামে একজন প্রসিদ্ধ কামেল পীর তোমাদের পূর্ব পরুষ হিসাবে সর্বপ্রথম ভারতে আগমন করেছিলেন।”
এই উপদেশবাণী পিতৃ-হৃদয়ে জাগরূক ছিল। সত্য সত্যই খোদার মহিমায় তিন বছর পর তাঁর একটি পুত্র সন্তান লাভ হলো এবং অপার আনন্দ ও খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর হৃদয় মন বিগলিত হলো।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সাইয়েদ আবুল আ”লা মওদূদীর জন্মের পূর্ব থেকেই পিতার মধ্যে এক বিপ্লবী পরিবর্তন এসেছিল এবং পুত্রের জন্মের মাত্র এক বছর পরে খোদা প্রেমে পাগল হয়ে তিনি সংসার ত্যাগী হয়েছিলেন। পুনরায় যদিও তিনি সংসারী সেজেছিলেন, কিন্তু পূর্ব পরিত্যাক্ত সংসারের প্রতি পুনঃপ্রবৃত্ত না হয়ে এক পরিপূর্ণ ইসলামী ও নৈতিক পরিবেশপূর্ণ সংসার রচনা করেছিলেন। তার সুফল হলে, এই যে, শিশু মওদূদীর যখন জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হলো– যখন তিনি দুনিয়ার আলো-বাতাস উপভোগ করতে শিখলেন, তখন তিনি নিজের চারদিকে এক স্বর্গীয় মধুর ইসলামী নৈতিকতাপূর্ণ পরিবেশের মৃদু গুঞ্জরণই শুনতে পেলেন। পিতা ও মাতা উভয়ের জীবন যাপন প্রণালী পূর্ণ ইসলামী রঙে রঞ্জিত ছিল। অতএব, শিশুকাল থেকেই মওদূদীর কচি হৃদয়ে ইসলামী ভাবধারার পূর্ণ চিত্র অঙ্কিত হলো।
মওদূদীর বাল্য শিক্ষা
পিতার একান্ত বাসনা পুত্রকে একজন আলেমে দ্বীন বানাবেন। সে ভাবেই তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা হলো। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গেই আরবী, ফারসী ও উর্দূর মাধ্যমে কোরআন, হাদীস, ফেকাহ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁকে শিক্ষা দেয়া হলো। ইংরেজী শিক্ষা ও পাশ্চাত্য চিন্ধাধারার স্পর্শ থেকে তাকে সতর্কতার সাথে দূরে রাখা হলো। তাঁকে শৈশবে কোন বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেয়া হয়নি। সুদক্ষ ও চরিত্রবান গৃহ-শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তাঁর বাল্য শিক্ষা চলতে থাকে। অবসর সময়ে পিতা তাকে সঙ্গে করে সুধী-সমাজে গমন করতেন। জ্ঞানগর্ভ দার্শনিক আলোচনা বিন্দু-বিসর্গও বালক মওদূদীর মস্তিস্কে প্রবেশ করতো না। কিন্তু তবু তাঁর মনের উপর এর একটা নৈতিক প্রভাব ছাপ ফেলতো। রাত্রিকালে পিতা আম্বিয়ায়ে কেরাম (আঃ), সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ও বুযুর্গানে-দ্বীনের জীবনী এবং ইসলামী ইতিহাস গল্পচ্ছলে পুত্রকে শুনাতেন। চিত্তাকর্ষক বোদগম্য ভাষালংকারের মধ্য দিয়ে ইসলামী আকীদাহ-বিশ্বাস, মতবাদ ও ভাবধারা শিশু-পুত্রের হৃদয়ে অঙ্কিত করে দিতেন।
অন্য লোকের সঙ্গে সাধারন মেলামেশা ও গল্প-গুজবে নৈতিকতা ও ভদ্রতা রক্ষা করে চলবার ব্যাপারে পিতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। মাতৃভাষা উর্দূর প্রতিও তার ছিল বিশেষ লক্ষ্য। সুদীর্ঘ বিশ বছর দাক্ষিণাত্যে কাটিয়ে দেওয়ার পরও তিনি ভাষার শ্লীলতা ও লালিত্য অক্ষুন্ন রেখেছেন। তাঁর কথাবার্তায় কোনদিনই প্রবেশ করতে পারেনি অন্য কোন প্রতিশব্দ অথবা বাক-পদ্ধতি। হর হামেশা বিশুদ্ধ প্রাঞ্জল উর্দূ ভাষা তিনি বলতেন। পুত্রের ভাষারও বিশুদ্ধাতা ঠিক রাখবার জন্য তাকে বাইরের কোন সংস্রবে যেতে দেননি কোন সময়ের জন্যে। কোন কারণে পুত্রের কথায় অন্য ভাষার কোন প্রতিশব্দ শুনতে পেলে তিনি তা তৎক্ষণাৎ সংশোধন করে দিতেন।
শৈশব কাল থেকে পিতা তাঁর উন্নত চরিত্র গঠনের জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলেন। যাতে দুষ্ট ও অসৎ সংসর্গে মিশে তাঁর চরিত্র কুলষিত না হয়, তার প্রতি তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন।
একবার বালক মওদূদী বাড়ীর চাকরানীর ছোট ছেলেকে মেরেছিলেন। পিতা একথা শোনামাত্রই চাকরানীর পুত্রকে ডেকে এনে আপন পুত্র মওদূদীকে ঠিক সেইরূপ মার দিতে আদেশ করলেন। এ শিক্ষা বালক মওদূদীর কচি হৃদয়ে এমন ভাবে জাগরূক হয়ে রইলো যে, পরবর্তী জীবনে তিনি কোন দিন তার অধীন ব্যক্তির উপরে অপরাধ করা সত্ত্বেও উত্তোলন করেননি অথবা কোন কটুকথা বলেননি।
ন’বছর বয়স পর্যন্ত বাড়ীতেই বালক মওদূদীর বিদ্যাচর্চা চলতে থাকে। এ সময়ের মধ্যে তিনি আরবী ব্যাকরণ, সাহিত্য এং ফেকাহ শাস্ত্রের বিভিন্ন প্রাথমিক পুস্তকাদি শেষ করেন। তাপর তাঁর ওস্তাদ মরহুম মৌলভী নাদীমুল্লাহ হুসাইনীর পরামর্শে তাঁকে আওরংগাবাদের ফওকানিয়া (উচ্চ) মাদরাসায় রুশদিয়া মানের শেষ বর্ষ শ্রেণীতে (৮ম শ্রেণী) ভর্তি করে দেয়া হয়। ভর্তি হওয়ার ছ’মাস পরেই তিনি রুশদিয়া পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। অবশ্য একমাত্র অংক ব্যতীত অন্যান্য সকল বিষয়েই তিনি ভালভাবে পাস করেন। অংকে পাস না করার কারণ এই যে, মাত্র ছ’মাস পূর্বে সর্বপ্রথম তাঁর অংকে হাতে খড়ি দেয়া হয়। মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মোল্লা দাউদ সাহেব তাঁকে উপরের মৌলভী শ্রেণীতে ভর্তি করে নেন।
এবার তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নবনব জ্ঞানলাবের সুযোগ পান। শিক্ষার মাধ্যমে উর্দু হলেও রসায়ন শাস্ত্র, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, অংক, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর লাভের গভীর অনুরাগ জন্মে। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষকের সাহচর্য ও সংস্পর্শ লাভ করার ফলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা প্রসারিত হয়। এযাবত বহির্জগত ও বাইরের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে তাঁর মধ্যে যে বেরসিকতা ও উদীসীনতার সঞ্চার হয়েছিল, সহাধ্যায়ী বন্ধুদের সাহচর্য তা দূর করে দিল।
উল্লেখ যে, সে সময়ে আল্লামা শিবলী নো’মানী, নওয়াব নিযামুল মূলক বিলগেরামী ও মাওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহীর পরিকল্পনা অনুযায়ী হায়দারাবাদ ও আওরংগাবাদে এক নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করা হয়। শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দূ। ইতিহাস, কোরআন-হাদীস, ফেকাহ, মানতেক (তর্কশাস্ত্র) প্রভৃতি পড়ানো হতো। এ মানের মেট্রিকুলেশনকে মৌলভী, ইনটারমিডিয়েটকে মৌলভী আলেম এবং ডিগ্রী কলেজকে দারুল উলুম বলা হতো।
ঊনিশ শ’ চৌদ্দ খ্রিষ্টাব্দে বালক মওদূদী মৌলভী পরীক্ষা দেন এবং অংকে কাঁচা থাকার কারণে উত্তীর্ণ ছাত্রদের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান লাভ করেন। এই সময় পিতার স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আওরংগাবাদ থেকে হায়দারাবাদ গমন করেন এবং সেখানে দারুল উলুমে উচ্চ শিক্ষার জন্যে পুত্র মওদূদীকে ভর্তি করে দেন। তখন দারুল উলুমের অধ্যক্ষ ছিলেন মরহুম মাওলানা হামীদুদ্দীন। পুত্রকে হায়দারাবাদ রেখে অসুস্থ পিতার চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্যে ভূপাল চলে যান।
বালক মওদূদী হায়দারাবাদ দারুল উলুমে পাঠাভ্যাস করতে থাকেন। কিন্তু ছ’মাস অথীত না হতেই ভূপাল থেকে দুঃসংবাদ এলো যে, পিতা মৃত্যু শয্যায় শায়িত। সংবাদ পাওয়া মাত্র বালক মওদূদী মাতাকে নিয়ে ভূপাল চলে যান এবং মুমুর্ষূ পিতার শুশ্রুষায় আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় থেকেই বালক মওদূদীকে জীবিকা অন্বেষণের উপায় অবলম্বন করতে হয়। কারণ এত অল্প বয়সেই তাঁর এতটুকু তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয়েছিল যে, দুনিয়ায় আত্মসম্মান নিয়ে বসবাস করতে হলে স্বাবলম্বী হতে হবে এবং সদুপায়ে জীবিকা অর্জনের জন্যে সংগ্রাম করতে হবে। এদিকে পিতা দারিদ্র্য ও পীড়ার সঙ্গে ক্রমাগত কয়েক বছর সংগ্রাম করে ১৯২০ সালে দুনিয়ার কর্মক্ষেত্র থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।
সুদৃঢ় নৈতিক চরিত্র ও অটুট মনোবল
পিতার ঘনিষ্ঠ সাহচর্য ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে বালক মওদূদী ভাল-মন্দের তারতম্য নির্ণয় করতে শিখেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা ও তরবিয়তের দ্বারা তাঁর মধ্যে এমন এক নৈতিক চরিত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, ভিন্ন পরিবেশ তাঁকে কোনভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। এর সুফল এই হয়েছিল যে, যখন তিনি মাত্র পনেরো বছরের বালক, তখনই তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। তখন তাঁর সুদৃঢ় নৈতিক চরিত্রের গুণাবলীই তাঁকে সত্যপথে অবিচল রেখেছিল। যেরূপ অবস্থায় নব যৌবনের উদ্যম-উচ্ছ্বাস মানুষকে পথভ্রষ্ট করে, সে অবস্থায়ই জীবনের যৌবন জোয়ার জল-তরঙ্গ মওদূদীর পদতলে আছাড় খেয়েছে, ফেটে চুরমার হয়েছে। কিন্তু তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি, মাঝ দরিয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।
মওদূদের কর্মময় জীবনের সূত্রপাত
দয়াময় আল্লাহ তায়ালা কিশোর মওদূদীকে অসারধারণ প্রতিভা দান করেছিলেন। তাই তিনি অল্প বয়সেই সাহিত্য সাধনায় সিদ্ধহস্ত হয়েছিলেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে এক অভি সংকট মুহুর্তে তাঁকে জীবিকা অর্জনের দুর্গম পথ বেছে নিতে হয়। কোন অফিসে কেরানীগিরি করা অথবা কারো অধীনে চাকরি করা ছিল তার প্রকৃতি বিরুদ্ধ। অতএব তাঁর লেখনি শক্তিকেই তিনি একমাত্র অবলম্বন মনে করলেন।
ঊনিশ শ’ আঠারো সালে মওদূদীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সাইয়েদ আবুল খায়ের মওদূদী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। বিজনৌর থেকে প্রকাশিত ‘মদীনা’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার তিনি নিজ হস্তে গ্রহণ করেন। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীও বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিলে ‘মদীনা’ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু দু’মাস পর কনিষ্ঠ মওদূদী সেখান থেকে দিল্লী চলে যান। সে সময় ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবল ঝড় উঠেছিল। মন ও চিন্তার স্বাধীনতা, বংশীয় ঐতিহ্য এবং শৈশবকালীন পরিবেশের প্রভাব আবুল আ’লা মওদূদীকে ব্রিটিশ শাসন ও সভ্যতার প্রতি স্বভাবতই বীতশ্রদ্ধ করে তুলছিল। ফলে স্বাধীনতার যে কোন আন্দোলনই তিনি সমর্থন করতেন। উপরন্তু তাঁর মধ্যে ছিল ইসলামের বিরাট সংগ্রামী প্রেরণা। অতএব এসব কারণে তিনি তৎকালীন “আনজুমানে এয়ানাতে নযরবন্দানে ইসলাম” এর কর্মী হিসাবে কাজ করতে থাকেন। ১৯১৯ সালে যখন খেলাফত ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়, তখন তিনি তাতেও অংশগ্রহণ করেন।
খেলাফত আন্দোলন ও মাওলানা মওদূদী
খেলাফত আন্দোলন মাওলানা মওদূদীর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ই নয়, বরঞ্চ মুসলমানদের জাতীয় ইতিহাসের দিগদর্শী। সংক্ষেপে হলেও এ সম্পর্কে কিছু আলোচনার প্রয়োজন, যাতে করে তার পটভূমিকায় মাওলানার জীবন চরিত সম্যক উপলব্ধি করা যেতে পারে।
বিগত প্রথম মহাযুদ্ধে ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি তুরস্ক (The sick man of Europe) ইংরেজদের বিরুদ্ধে জার্মানীর পক্ষে যুদ্ধ করে। সে সময় পর্যন্ত তুরস্কে উসমানিয়া সাম্রাজ্য খেলাফতের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসাবে গণ্য হতো। ইংরেজ প্রতিপক্ষকে চরম আঘাত এবং মুসলিম ঐক্য ভেঙে চুরমার করার উদ্দেশ্যে লরেন্স অব অ্যারাবিয়াকে আরব জাতীয়তাবাদের প্রচারক হিসাবে আরব দেশে প্রেরণ করেন। মক্কার তদানীন্তন শরীফ হুসাইন হাশমী এ প্রচারণায় এতোটা প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে, ১৯১৫ সালে মাঝামাজি আরবদের জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধারন করে তুরস্কের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করেন। প্রথম মহাযুদ্ধে ইংরেজ তথা সম্মিলিত বাহিনী (Allied Forces) বিজয় লাভ করে। তারা যুদ্ধের প্রারম্ভেই একটি গোপন চুক্তি মাধ্যমে উসমানিয়া সাম্রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে রেখেছিল। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষে তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হলো। ইউরোপীয় অংশ তার হাতছাড়া হলো। আরব জাতীয়তাবাদের বিষক্রিয়ার ফলে আরবদেশগুলি তুরস্ক সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল বটে, কিন্তু সেগুলিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও গ্রীসের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হলো। উসমানিয়া সাম্রাজ্য প্রাচীন আনাতোলিয়াতে (ইস্তাম্বুল) সীমিত হয়ে থাকল। ১৯১৯ সালের মে মাসে উসমানিয়া রাজধানীতে শুধুমাত্র নাম সর্বস্ব সুলতানের অস্তিত্ব বাকী রইল। এখানেও তার স্বাধীনতা ছিল বিপন্ন। বৃটিশ ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের মনে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিলেন যে, খলীফাতুল মুসলিমীন এবং খেলাফত ব্যবস্থা তাদের প্রকৃত ঈমানের অঙ্গ-অংশ। অতঃপর উসমানিয়া সাম্রাজ্যের পতন এবং তার ছিন্নভিন্ন অবস্থা দৃষ্টে ভারতীয় মুসলমানদের মনে এ সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, ইংরেজ হয়তো খেলাফতের কেন্দ্রকেই ধ্বংস করে দেবে-যেটাকে মুসলমানগুণ তাদের দ্বীনী এবং রূহানী কেন্দ্র মনে করতো।
অতঃপর মুসলমান নেতৃবৃন্দ ভারতেই বড়লাটের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদ্ভী প্রমুখ নেতাদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল লন্ডনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। প্রত্যুত্তরে তাঁদেরকে বলা হয় যে, মূল তুরস্কের ভূখন্ড ব্যতীত অন্যান্য এলাকা তাদেরকে দেয়া যাবে না।
ব্রিটিশের আচরণে ভারতের মুসলমান অতিশয় ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েন এবং খেলাফতের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যে ভারতে প্রচণ্ড খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। খেলাফত কমিটি গঠিত হয় এবং ভারতীয় কংগ্রেস, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দু এবং খেলাফত কমিটি সম্মিলিতভাবে এ আন্দোলন পরিচালনা করে। ১০ই আগস্ট সারা দেশে খেলাফত দিবস পালন করা হয় এবং এ সময় থেকে বিভিন্ন স্থানে হরতালও পালিত হতে থাকে। মোটকথা, সমগ্র ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ শুরু হয়। এক মাসের মধ্যেই প্রায় ত্রিশ হাজার মুসলমান কারাবরণের জন্যে নিজেদেরকে পেশ করেন। শহরে-বন্দরে, হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে খেলাফত আন্দোলন এক প্রচণ্ড রূপ ধারনা করে। কিন্তু এতো বড়ো আন্দোলন ও ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ-বিস্ফোরণ সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তার কারণ এই যে, কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের মুসলমানদের জেহাদী প্রেরণার সুযোগ গ্রহণ করে অসাধারণ বীরত্ব ও বিচক্ষণতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে বহু এলাকা ইংরেজদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধার করেন। তুরস্কবাসীদের একতাবদ্ধ করেন এবং তাদের হৃত মর্যাদা ও গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এভাবে ক্ষমতা হস্তগত করার পর কামাল আতাতুর্ক ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে উসমানিয়া খেলাফতের সুলতান মুহাম্মদ হাশেমকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কাষ্টপুত্তলিসম সর্বশেষ সুলতান আবদুল মজীদকে দেশ থেকে বহিস্কার করে খেলাফতের উচ্ছেদ সাধন করেন।
ডক্টর মঈনুদ্দিন তাঁর History and freedom movement VIII part 1-এ মন্তব্য করেনঃ
কামাল আতাতুর্কের এ পদক্ষেপ খেলাফত আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় মুসলমানদের মনে চরম আঘাত করে। সর্বাপেক্ষা আঘাত পান মাওলানা মুহাম্মদ আলী- যিনি ছিলেন খেলাফত আন্দোলনের প্রাণস্বরূপ। যে শরীফ হুসাইন ইঙরেজের হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করেন এবং যার বিশ্বাসঘাতকতায় তুরস্ক সাম্রাজ্য লন্ডভন্ড হয়ে যায়, তিনি খেলাফতের দাবিদার হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করেন। কিন্তু একেতো তিনি মুসলিম জগতের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে পড়েছিলেন এবং ইংরেজ সরকারও তারএ দাবী প্রত্যাখান করেন। অপরদিকে বিপ্লবী ওহাবী নেতা ইবনে সউদের আক্রমণও তিনি প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন। বছরের শেষের দিকে ইবনে সউদ মক্কা এবং তায়েফ অধিকার করেন এবং হেজাযের অধিকাংশ এলাকা তাঁর হস্তগত হয়।
যাঁরা খেলাফত আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, তাঁদের সহানুভূতি ছিল ইবনে সউদের প্রতি। কিন্তু তিনি যখন কবর পূজার মূল্যেৎপাটনের জন্যে কবরের উপর তৈরী সকল প্রকার স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে চুরমার করেন, তখন বাদাউনী, বেরেলভী প্রভৃতি মতাবলম্বীগণ খেলাফত কমিটি থেকে বেরিয়ে আসেন। তথাপি ভারতীয় খেলাফত কমিটি ৪ঠা জানুয়ারী ইবনে সউদকে খলীফাতুল মুসলেমীন হিসাবে মুবারকবাদ জানিয়ে তারবার্তা প্রেরণ করেন। কিন্তু মাত্র চারদিন পর তিনি জবাবে বলেন যে, তিনি হেজাযের বাদশাহ, খলীফা নন।
– (History of freedom movement- Dr. Moyeenuddin)
ওদিকে কামাল আতাতৃর্ক উসমানিয়া খেলাফতের ধ্বংসস্তুপের উপরে এক নতুন দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
বাবায়ে উর্দু মৌলভী আব্দুল হক বলেনঃ
কামাল পাশা এতদূর অগ্রসর হন যে, পাশ্চাত্যের অনুকরণে পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ, চালচলন, নাচগান, মদ্যপান ও অন্যান্য বহুবিধ ইসলাম বিরোধী সংস্কৃতি তুরস্কের জাতীয় প্রতীক বলে ঘোষণা করেন। এমন কি ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ধর্মীয় শিক্ষা উচ্ছেদ করেন। তুরস্কের নিজস্ব ভাষার প্রাচীন বর্ণমালা পরিবর্তন করে রোমান বর্ণমালা প্রবর্তন করেন। তুরস্কের একটি প্রতিনিধি দল দিল্লী আগমন করেন। তারা বারবার নিজেদেরকে ইউরোপীয় জাতি বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। দিল্লীর মুসলমানগণ তাদেরকে দিল্লী জামে মসজিদে জুমার নামায আদায়ের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সে আমন্ত্রণ তারা প্রত্যাখ্যান করেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করা হয়। অথচ পূর্ব থেকে কোন কর্মসূচী না থাকলেও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁরা আনন্দের সাথে পরিদর্শন করেন।
স্যার-সৈয়দ আহমদ-মৌলভী আব্দুল হক (পৃ: ৩৪)
খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও তা ভারতের ইতিহাসে বিরাট প্রভাব রেখে যায় এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যে একটা অদম্য প্রেরণার সঞ্চার করে। মাওলানা মওদূদীর উপর এর প্রভাব এই যে, এ আন্দোলন তাঁর মধ্যে জনসভায় বক্তৃতা করার প্রেরণা, সাহস ও শক্তি দান করে এবং লেখনীর মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতের আশা-আকাঙ্খা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রকাশেরও সুযোগ দান করে। খেলাফত আন্দোলনের সময় মাওলানা জব্বলপুর থেকে ‘তাজ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করছিলেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র সতেরো বছর। তিনি তাঁর আত্মকথায় বলেনঃ
“সে সময় এখানে মুসলমানদের পক্ষ থেকে জনসভায় কিছু বলার কোন লোক ছিল না। বাধ্য হয়ে আমাকেই এ কাজ করতে হয়। এতে আমার দু’টি বড়ো উপকার হয়েছিল। প্রথমটি এই যে, আমার মধ্যে বিরাট আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল যা পূর্বে ছিল না। পূর্বে কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজ করতে সাহস করতাম না। কিন্তু জব্বলপুরে যখন অপরের সাহায্য ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ একাকী এবং সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে সাংবাদিকতা ও জনসেবার কাজ শুরু করলাম, তখন অনুভব করলাম যে, আমার মধ্যে এমন কিছু শক্তি লুক্কায়িত আছে, যা প্রয়োজনের সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর থেকে কোন দায়িত্ব গ্রহণের কখনো দ্বিধাবোধ করিনি।
দ্বিতীয় উপকার এই যে, আমি আমার জীবনে একেবারে আত্মনির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। ইতঃপূর্বে আমি কোন না কোন আত্মীয় বন্ধুর সাথে একত্রে বাস করতাম এবং অপরের উপর নির্ভর করার দুর্বলতা কিয়ৎ পরিমান হলেও আমার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু জব্বলপুরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে কাজ করতে পেরেছি।”
জব্বলপুরে সে সময়ের ‘তাজ’ পত্রিকায় লিখিত মাওলানার সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়লে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, অত অল্প বয়সে তিনি এতখানি তত্ত্বজ্ঞানী হয়ে পড়েছিলেন যে, জনগণের মধ্যে উদ্দীপনা ও অদম্য প্রেরণা সৃস্টি করার ভাষাজ্ঞানও তাঁর ছিল। তাঁর প্রতিটি কথা ছিল অতীব যুক্তিপূর্ণ, সুধী সমাজের গ্রহণযোগ্য এবং অতীব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর পূর্বাপর কথার মধ্যে ছিল পরিপূর্ণ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য। সে সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃক তুরস্কের প্রতি যে চরম অবিচার করা হয়েছিল, তিনি সেজন্যে ব্রিটিশের তীব্র সমালোচনা করে দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন। যার ফলে ‘তাজের’ প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়।