মাওলানা মওদূদীর আযাদ কাশ্মীর সফর
মাওলানা মওদূদী মোযাফফরাবাদ থেকে আযাদ কাশ্মীর রেডিওর মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার উপরে অকাট্যর যুক্তি ও তথ্যপূর্ণ এক বক্তৃতা করেন। অতঃপর তিনি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় দফতরের কতিপয় দায়িত্বশীল ব্যক্তিসহ আযাদ কাশ্মীরের বিভিন্ন যুদ্ধাঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং খোদার সঙ্গে সম্পর্ক মযবুত করে মনোবল দৃঢ় রাখতে সকলকে আবেদন জানান। মাওলানার আযাদ কাশ্মীর ভ্রমণ জনসাধারণ, মুজাহিদীন ও আযাদ কাশ্মীর সরকারকে প্রভূত উৎসাহ-উদ্দীপনা দান করে।
অতঃপর আযাদ কাশ্মীর সরকারের অনুরোধে অধিকৃত কাশ্মীর ও ভারত থেকে আগত হাজার হাজার মুহাজির ও যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবার ও চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব জামায়াতে ইসলামী গ্রহণ করে। এর জন্য পুঞ্জ ও মীরপুর জেলায় আটটি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করে তার সমগ্র ব্যয়ভার জামায়াত বহন করে। এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মেডিকেল অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারী জামায়াতের পক্ষ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ সেবাকার্য ১৯৬৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৬৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চালু থাকে।
জামায়াতে ইসলামীর সেবাকার্যের জন্য আযাদ কাশ্মীর সরকার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে জামায়াতের রিলিফ বিভাগের পরিচালক জনাব সাইয়েদ সিদ্দীকুল হাসান গিলানী সাহেবের কাছে যে পত্র দেন তার নকল নিম্নে দেয়া হলঃ
পত্রের নকল
No. INF/519/66
PRESIDENT’S HOUSE
MUZAFFARABAD
DATED THE 5TH APRIL, 1966
SAYED SIDDIQUL HASAN GILANI, ESQ
ORGANISER, MEDICAL UNITS.
JAMA’AT-I-ISLAMI PAKISTAN
ICHHRA, LAHORE
Kindly refer to your letter No… dated 25.2.66 on the subject of winding up the Medical units established by the Jamaat-i-Islami in Azad Kashmir during the last November, 1965.
I am desired by Mr. President, Azad Govt. of the State of Jammu & Kashmir to convey gratitude on his behalf for the invaluable assistance and co-operation rendered by Jamaat-i-Islami in all the matters and particularly in medical field. Undoubtedly the support of Jamaat-i-islami has been a cause of great relief of the victims of the barbarism of the Indian forces and the jana Shanghies accross the Cease Fire Line.
I am also desired to request you kindly to communicate the feelings of thankfulness to the doctors and other members of the medical units who wored in Azad Kashmir in extremely difficult conditions and served the refugees at considerable personal sacrifice.
- M.., Hashmi
Secretary to Govt.
Azad Govt. of Jammu & Kashmir.
এ সেবা কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণও পাঠকবৃন্দের কাছে পেশ করছি।
উপরে বর্ণিত আটটি মেডিক্যাল ইউনিট থেকে গত আট মাসে মোট ২,০২,৮৩৬ (দুই লক্ষ দুই হাজার আটশত ছত্রিশ) জনের চিকিৎসা করা হয়। প্রকাশ থাকে যে, রিলিফ কাজের জন্যে জামায়াতে ইসলামী মোট ২,৯৫,১৬৮.৬৮ টাকা সংগ্রহ করে। তন্মধ্যে নগদ এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা আযাদ কাশ্মীরের প্রেসিডেন্টের হাতে দেয়া হয়। ৭৫,৫১১.০০ টাকা মেডিক্যাল ইউনিটের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ছাত্রদেরকে দেয়া হয় ৩,৬৩৭.৮৯ টাকা, যুদ্ধ, উদ্বাস্তুদের জন্য লাহোর প্রদত্ত ২,১০০.০০ টাকা, হাবিব ব্যাংকে রক্ষিত রিজার্ভ ১৯,০৪৪.৮৫ টাকা, কর্মচারীদের ভাতা বাবদ ৫,৯৮৫.০০ টাকা, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যথা-লেপ তোশক, তৈজসপত্র প্রভৃতি খরিদ বাবদ ২৮,৫৫১.২৩ টাকা, যানবাহন, যাতায়াত, প্যাকিং প্রভৃতি বাবদ ৮,৭৩৪.২৬ টাকা, স্বেচ্ছাসেবকদের ভাতা বাদ ১,৮১১.৪৮ টাকা, কাপড় ধোলাই ও জুতা মেরামত ও খরিদ বাবদ ২,৬৩৮.৮০ টাকা এবং অন্যান্য বহুবিধ খরচ বাদে তহবিল ১,১৮৮.৪৪ টাকা জামায়াতের রিলিপ ফান্ডে জমা থাকে।
চিকিৎসা কার্য ছাড়াও লক্ষাধিক মুহাজিরের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে সকল প্রকার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে আযাদ কাশ্মীরে পাঠানো হয়। মানুষের এমন কোন প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছিল না, যা দেয়া হয়নি। এমন কি মুহাজির বর-কন্যার জন্যে বিবাহের মূল্যবান উপহারাদিতে পরিপূর্ণ কয়েক শত গ্যালভেনাইজড টিনের বাক্সও দেয়া হয়েছে, যাতে বাস্তুহারাদের বিয়েতে কিছুটা আনন্দের হাসি ফুটে উঠতে পারে।
আযাদ কাশ্মীরের চাহিদা মেটানোর পর ১৬ ট্রাক বোঝাই মালপত্র রাওয়ালপিণ্ডিস্থ জামায়াত দফতরে ফেরত পাঠানো হয় এবং তা পরে শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। মুসলমান জনসাধারণের কাছে মাওলানা মওদূদীর উদাত্ত আহ্বানের পর জামায়াত কর্মীগণ যে সাহায্য দ্রব্য সংগ্রহ করেন, তার মূল্য ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকার কম নয়।
এতদ্ব্যতীত “জিহাদ কাশ্মীর ফাণ্ডে”, “পাকিস্তান ডিফেন্স ফান্ডে” এবং গৃহহীনদের সাহায্য বাবদ জামায়াত কর্মীগণ নগদ ৫,৫৮,৬৪৫.৩৮ টাকা (পৎাচ লক্ষ আটান্ন হাজার ছয়শত পঁয়তাল্লিশ টাকা আটত্রিশ পয়সা) সংগ্রহ করেন। বহু জামায়াত কর্মী যুদ্ধের ময়দানে তাদের খেদমত পেশ করেন। কোন কোন যুদ্ধফ্রন্টে তারা সৈনিকদের পানাহারের ব্যবস্থা করেন এবং রেল লাইন রক্ষার জন্যে রাতে পাহারা দেন। জামায়াতে ইসলামীর জনৈক জেলা আমীর জিহাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত সিদ্দীক আকবর (রাঃ) এর দৃষ্টান্তের পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি তার গৃহের যাবতীয় আসবাবপত্র ও শেষ কপর্দক পর্যন্ত জিহাদের জন্য অকাতরে দান করেন। [কিন্তু এ এক মহাসত্য যে, যারাই আল্লাহকে একমাত্র প্রভু মনে করে ও তাঁর পথে জ্ঞান-মাল কুরআন করে, ইসলাম বিরোধী সমাজ তাকে সহ্য করতে পারে না। এক্ষেত্রেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো। জেলা র্তৃপক্ষ একটির পর একটি করে এ মর্দে মুজাহিদকে রাজনৈতিক মামলায় জড়িত করে হাজতবাসের আদেশ শুরু করে দিলেন। উল্লেখ যে, ভুট্টো সরকারের আমালে তিনি ছিলেন বিরোধী দলের স্পষ্ট বক্তা। অতএব তিনি ভুট্টো সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন এবং আততায়ীর গুলীতে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি হলেন ডাঃ নাজির আহমদ, তিনি ‘৭০ সালে এম.এন.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন।]
যুদ্ধকালে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান
মাওলানা মওদূদী সর্বপ্রথম সমগ্র বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দকে একত্র করে সম্মিলিত যুদ্ধ কমিটি গঠন করেন এবং কমিটির যাবতীয় কাজ জামায়াতের কেন্দ্রীয় দফতরেই সম্পাদিত হতো। এ কমিটি যুদ্ধের ব্যাপারে সকলপ্রকার শর্তহীন সহযোগিতার কথা সরকারকে জানিয়ে দেন।
বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের খেদমত
ভারত কর্তৃক সরাসরি পাকিস্তান আক্রান্ত হওয়ার পর মাওলানা মওদূদী সারা বিশ্বের মুসলিম জাতিগুলোর উদ্দেশ্যে লিখিত একখানা খোলা চিঠি মুসলিম দেশগুলোর বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশনার জন্যে প্রেরণ করেন। তা প্রায় সকল পত্রিকায় যথাসময়ে প্রকাশ লাভ করে। পত্র খানার নকল নিম্নরূপঃ
“সাম্রাজ্যবাদী ভারত শান্তিপ্রিয়তা ও নিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে ফেলেছে এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বহুসংখ্যক সৈন্য দ্বারা চারদিক থেকে পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। এ বর্বর হামলার কারণ এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না যে, কাশ্মীরের মজলুম মুসলমানগণ ভারতের পাশবিক অত্যাচার থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্যে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন এবং পাকিস্তান শুধু ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধে অনুপ্রাণিত হয়ে কাশ্মীরীদেরকে সাহায্য করেছিল। কাশ্মীর ও পাকিস্তানী মুজাহিদগণ এক সপ্তাহের মধ্যে অধিকৃত কাশ্মীরের বহু স্থান দখল করে ফেলে। এ অবস্থা দেখে ভারত দিগবিদিক জ্ঞানহারা হয়ে হঠাৎ স্থল, জল ও বিমান পথে পাকিস্তান আক্রমণ করে এবং অপরদিকে ভারতীয় ও কাশ্মীরী মুসলমানদের উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। আমাদের সৈন্য বাহিনীর সাথে ‘ঈমান বিল্লাহ’ ও ‘তাওয়াক্কাল আলাল্লাহ’-এর অস্ত্র আছে। এজন্যেই আজ পর্যন্ত যতটা সংঘর্ষ হয়েছে, তাতে পাকিস্তানী সৈন্য অসাধারণ বীরত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভারতীয় হামলা প্রতিরোধ করার জন্যে পাকিস্তানের দশ কোটি মুসলমান ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নিকট আবেদন জানাচ্ছি, তাঁরা যেন ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁদের পাকিস্তানী ও কাশ্মীরী ভাইদের আর্থিক ও নৈতিক সাহায্যদানের জন্যে এগিয়ে আসেন।”
বলা বাহুল্য, এর ফলে সারা মুসলিম বিশ্বে যে অভূতপূর্ব সাড়া জেগেছিল, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মক্কার বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেস, ইত্থওয়ানুল মুসলিমুন, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলো এবং তথাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে প্রকার সাড়া দিয়েছে তা কারো অবিদিত নেই। ইরামের বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা আল্লামা মুহাম্মদ আসসাদিকুর রূহানী প্রত্যুত্তরে মাওলানা মওদূদীকে জানান যে, ভারত কর্তৃক পাকিস্তান আক্রান্ত হওয়ার ফলে ইরানের উলামা, মাশায়িখ এবং সাধারণ মুসলমান অস্থির ও চঞ্চল হয়ে পড়েছেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, জামায়াতে ইসলামী সরকার কর্তৃক বেআইনী ঘোষিত হওয়ার পূর্বেই মাওলানা মওদুদীর আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট কারণ না জানিয়েই বাজেয়াপ্ত করা হয়। মক্কার বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের (রাবিতায়ে আলমে ইসলামী) কেন্দ্রীয় দফতর স্থাপিত। মাওলানা মওদুদী তার কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য। মদীনায় স্থাপিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বডিরও আজীবন সদস্য। হজ্জের সময় এ উভয় প্রতিষ্ঠানের জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়, যাতে শাহ ফয়সলও যোগদান করে থাকে। মাওলানার পাসপোর্ট সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর কয়েক বছর তিনি মক্কায় যেতে পারেননি। পাক-ভারত যুদ্ধের পর মাওলানার পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয় এবং পরবর্তী হজ্জের সময় তিনি মক্কা গমন করেন। তিনি কাশ্মীর সমস্যা সম্পর্কে ইংরেজী ও আরবী ভাষায় মূল্যবান তথ্যবহুল একখানি পুস্তিকা প্রণয়ন করে তার প্রায় পঞ্চাশ হাজার কপি সঙ্গে নিয়ে যান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শিক্ষিত হাজীদের মধ্যে সেগুলো বিতরণ করা হয়। পুস্তিকাগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ঐতিহাসিক ঘটনায় পরিপূর্ণ যে, কাশ্মীর সমস্যার মূল কারণ, এর পঞ্চাৎ পটভুমি ও কাশ্মীরী মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দ্বীনী ও তামাদ্দুনিক ইতিহাস এত নিখুঁত ও মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখিত যে, সরকারী কোন বিভাগের পক্ষ থেকে এ ধরনের উচ্চাঙ্গের কোন পুস্তিকা, ইতিহাস অথবা বিবৃতি আজ পর্যন্ত জনসমক্ষে উপস্থাপিত করা সম্ভব হয়নি। এই পুস্তিকায় মাওলানা সুস্পষ্টরূপে এককথাই প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, কাশ্মীর সমস্যা শুধু পাকিস্তানের নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের। সাম্রাজ্য লোলুপ ভারতের পররাজ্য জয় অভিযানের সামনে যদি পাকিস্তানের প্রতিরোধ প্রাচীর ভেঙ্গে যায়, তাহলে তার যাত্রা মুসলিম জাহানের সুদূর পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের সাথে ভারতের সটিক সম্পর্কও বিশ্বের মুসলমানদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
উপরন্তু বিগত হজ্জ্বের সময় মাওলানা মওদূদী বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন দেশের নির্বাচিত সাত-আটশত নেতৃস্থানীয় সুধীবৃন্দের সভায় পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পাকিস্তানী জনসাধারণের, অটুট মনোবল, অপূর্ব ত্যাগ, ভারতীয় সেনা বাহিনীর বর্বর পাশবিক আচরণ, ভারতের দুরভিসন্ধি প্রভৃতি সম্পর্কে তিনি দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। মাওলানা স্পষ্ট ভাষায় বলিষ্ঠ যুক্তি দিয়ে শ্রোতাবৃন্দকে একথা বুঝিয়ে দেন যে, মুসলিম দেশগুলোর তেল সম্পদের প্রতি ভারতের লোলুপ দৃষ্টি সুস্পষ্ট। এর জন্যে সে আফ্রো-এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর উপরে হিন্দু ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করতে চায়। অতঃপর বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের বৈঠকে শেখ আবদুল্লাহর মুক্তির দাবিতে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
মোটকথা, যুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে শুরু করে, যুদ্ধবিরতি ও তাশখন্দ চুক্তির পরবর্তী সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের জন্য মাওলানার খদমত অতুলনীয়। কিন্তু জীবন জগতের সঞ্জীবনী শক্তি সূর্যকিরণ বাদুড় মোটেই বরদাশত করতে পারে না বলে সারাদিন অধোমুখী হয়ে সূর্যকে পদাঘাত করতে থাকে। তেমনি পাকিস্তানের একশ্রেণীর লোক মাওলানার প্রতি অহেতুক বিদ্বেষপরবশ হয়ে দেশ-বিদেশে তাঁর সম্পর্কে অমুলক কাহিনী প্রচারে তৎপর। যুদ্ধের পরেও কোন এক মহল থেকে মাওলানার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ ও বিষোধগার সম্বলিত কয়েক হাজার প্রচার পত্রিকা মক্কায় প্রেরিত হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ লক্ষ্য করে তা বিতরণের সাহস করা হয়নি।
পাক-ভারত যুদ্ধে একটি ফ্রন্টে ভারতীয় সৈন্য চরম মার খেয়ে যখন পশ্চাদপসরণ শুরু করেছিল, নিরাপত্তা পরিষদ ও তর অধীন বড় বড় শক্তিগুলো যুদ্ধবিরতির জন্যে পাকিস্তানকে চাপ দিতে লাগল। এমন সময়ে মাওলানা মওদূদী সুস্পষ্ট ভাষায় এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে, যে পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী যা ভারতও মেনে নিয়েছিল, কাশ্মীরে গণভোটের নিশ্চিত ব্যবস্থা না করা হয়েছে যে পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্পতি দেয়া পাকিস্তানের জন্যে আত্মহত্যারই শামিল হবে। এরপরও মাওলানা পাকিস্তান সরকারকে বরাবর তাঁর ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিপূর্ণ সৎ পরামর্শ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু সবকিছুই অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। তাশখন্দ চুক্তি সব কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে। পাকিস্তানের জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা চূর্ণ করা হয়েছে, মজলুম কাশ্মীরী মুসলমানদেরকে ক্ষুধার্ত ও হিংস্র নরখাদকের সামনে ঠেল দেয়া হয়েছে।
চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মাওলানার বিদেশগমন-এর আগে পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত
পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে পাঁচটি বছর মাওলানা মওদূদী পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রনায়কের ভূমিকা ভূমিকা পালন করেন। বিনা শর্তে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং অতঃপর জানুয়ারীতে তাশখন্দ চুক্তি পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে বলে মাওলানা তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন। তাশখন্দ চুক্তির প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে এক সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলন আহূত হয়, যেখানে মাওলানা মওদূদী এবং বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ সরকার ও তাশখন্দ চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু সরকার এ সম্মেলনের বক্তব্য ও প্রস্তাবাদির প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ দেশব্যাপী পাকিস্তান ডেমোক্রেটক মুভমেন্ট নামে এক গণআন্দোলন শুরু হয়।
মাওলানার গ্রেফতার
যেহেতু মাওলানা মওদূদী ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রাণস্বরূপ, তাই তিনি হয়ে পড়েছিলেন শাসকগোষ্ঠির চোখের বালি। তাঁকে গ্রেফতার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য তাঁকে আন্দোলনের ময়দান থেকে সরিয়ে দেয়ার নানা বাহানা সরকার তালাশ করছিলেন এবং অবশেষে যে বাহানাও তাঁরা পেয়ে গেলেন।
সাতষট্টির ১০ই জানুয়ারী সন্ধ্যার পর সরকারী রুয়েতে হিলাল কমিটির বরাত দিয়ে রেডিও-টিভির মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গিয়েছে এবং পরদিন ১১ই জানুয়ারী সারাদেশে ঈদুল ফিতর পালিত হবে। অথচ পিণ্ডি, লাহোর, করাচী, দিল্লী এবং পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি। অতএব উলামায়ে কিরাম, রুয়েতে হিলাল কমিটির সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, ১১ই জানুয়ারীর পরিবর্তে ১২ই জানুয়ারী ঈদ পালন করা হবে এবং একথা, সংবাদপত্রের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচারিত হয়। মুসলমান জনসাধারণও চাঁদ না দেখে ১১ই জানুয়ারী ঈদ করতে রাজি ছিলেন না। কারণ ১০ই জানুয়ারী সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার কোন খবর কোথাও থেকে পাওয়া যায়নি। ফলে সারাদেশে অতি অল্প সংখ্যক লোক শুধুমাত্র সরকারকে খুশী করার জন্যে ১১ই জানুয়ারী ঈদ করলেও সমগ্র জাতি ১২ই জানুয়ারী শুক্রবার পবিত্র ঈদুল ফিতর পালন করেন।
এতে আইয়ুব খানের মর্যাদায় আঘাত লাগে। অতঃপর সরকারী সিদ্ধান্তের সমর্থনে এবং আলেমগণের বিশেষ করে মাওলানা মওদূদীর প্রতি বিষোদগার করে মন্ত্রীবর্গ ও তোষামোকদকারীদের কাছ থেকে বিবৃতির পর বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকে। এতে সরকারের কুমতলব কারো বুঝতে বাকী থাকে না। অতএব, ১৯শে জানুয়ারী মাওলানা মওদূদীসহ লাহোরের প্রখ্যাত চারজন আলেমকে গ্রেপতার করে পৃথক পৃথক জেলে পাঠানো হয়। মাওলানা মওদূদীকে লাহোর থেকে কয়েকশ’ মাইল দূরে বান্নু জেলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং তাঁর গতিবিধি কয়েকদিন যাবত দেশবাসীর কাছে একেবারে গোপন রাখা হয়।
গ্রেফতারের এক মাস পর আইয়ুব খান গভর্ণরদের সম্মেলনে দম্ভোক্তি করেন যে, কতিপয় আলেমকে এজন্য গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁরা ধর্মকে তাঁদের হাতের পুতুল বানাতে চান।
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আইয়ুব খান নিজে ধর্ম-এর অধীনে না হয়ে ধর্মকে তথা ইসলামকে তাঁর অধীন করতে চেয়েছিলেন। পক্ষান্তরে মাওলানা মাওদূদী ও সত্যাশ্রয়ী আলেমগণ ইসলামের প্রতি কারো কণামাত্র হস্তক্ষেপ বরদাশত করতে কিছুতেই রাজী ছিলেন না।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে চৌধুরী রহমত ইলাহী এ অন্যায় আটকাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করলে ১৩ মার্চ শুনানানির দিন ধার্য করা হয়। শুনানি চলাকালে সরকার ১৬ই মার্চ মাওলানাকে মুক্তিদান করতে বাধ্য হন। অতঃপর তাঁকে বান্নু জেল থেকে সম্মানে লাহোরে তাঁর বাসভবনে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।
চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মাওলানার বিদেশ ভ্রমণ
মূত্রাশয় পাথর সঞ্চারিত হওয়ার ফলে মাওলানা দীর্ঘকাল যাবত এ পাথুরে রোগে ভুগছিলেন। এ কারণে অসসময়ে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছিলো। দ্বীনের কাজের জন্য তিনি তাঁর দেহ মনকেও পাথরের মতো বানিয়ে নিয়েছিলেন। তার ফলে কঠিন রোগের মধ্যেও তিনি দিন রাত কাজ করতেন। রোগের কষ্ট ও বেদনা মুখ দিয়ে প্রকাশ করেননি। আর না তাঁর মুখমণ্ডলে কোনদিন বেদনার ছায়া দেখা গেছে।
প্রথম তাঁর মূত্রাশয় অপারেশন করা হয়েছিলো ১৯৪৬ সালের ১৬ই অক্টোবর, যখন তিনি দারুল ইসলাম পাঠানকোটে অবস্থান করছিলেন। একাধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এবং রাতে সুখনিদ্রা পরিহার করে ঠায় বসে বসে লেখাপড়ার কাজের জন্য তাঁর এ রোগ হয়। ইউনানী ও এলোপ্যাথিক ঔষধ সেবনে প্রস্রাসের সাথে পাথর বেরিয়ে যেতো এবং আবার হতো। হাকীম মুহাম্মদ শরীফ অমৃতসারী বরাবর তাঁর চিকিৎসা করতে থাকেন, কিন্তু রোগ নিরাময় হয় না। অতএব সকলের অনুরোধে মাওলানা অপারেশনের জন্যে রাজী হলেন।
লাহোরের জাফর ইকবাল মাওলানার বন্ধু এবং তাঁর ভাই ডাঃ রিয়াজ কাদির নাম করা সার্জন ছিলেন। স্থিরীকৃত হয় অক্টোবরে অমৃতসর হাসপাতালে ডাঃ রিয়াজ কাদির মাওলানার অপারেশন করবেন। অপারেশনের প্রস্তুতির জন্যে তিনি কিছু ঔষধের ব্যবস্থা করে মাওলানাকে পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দেন। তদনুযায়ী ২৫শে সেপ্টেম্বর মাওলানা শিমলা গমন করেন এবং সুফী আবদুর রহীম সাহেবের গৃহে অবস্থান করতে থাকেন। অতঃপর ১৩ই অক্টোবর তিনি অমৃতসরে আসেন এবং ১৬ই অক্টোবর ডাঃ রিয়াজ কাদির তাঁর অপাশেন করেন। তাঁর মূত্রাশয়ে পাঁচটি পাথর পাওয়া যায়। অপারেশন সফল হয় এবং ১৩ই নভেম্বর মাওলানা হাসপাতাল ত্যাগ করে সন্ধ্যে নাগাদ দারুল ইসলাম পৌঁছেন। ছ’দিন পর ১৯শে নভেম্বর মাওলানা বিশ্রামের জন্যে শিয়ালকোট যান এবং ডিসেম্বরের শেষে দারুল ইসলাম প্রত্যাবর্তন করেন।
বাইশ বছর পর পুনরায় ডাক্তারদের পরামর্শক্রমে মূত্রাশয় অপারেশনের জন্যে তাঁকে লন্ডন যেতে হচ্ছে। অতি স্বাভাবিকভাবেই মাওলানার অগণিত ভক্ত অনুরক্তগণ উদ্বিগ্ন এবং মাওলানার বিরহ চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েছেন। তাঁদের বিরহ কাতর মনের আবেগ উচ্ছ্বাস ভাষায় ও আঁখিজলে ব্যক্ত হয়ে পড়ে ৫/এ যায়লদার পার্কে মাওলানার বাসভবনে এবং তাঁর বিদায় উপলক্ষে আয়োজিত লাহোরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে।
আটষট্টির আগস্ট থেকে ডিসেম্বর
বাইশে আগস্টের অপরাহ্নকাল।
লাহোর বিমান বন্দরে জমাট বেঁধে আছে হাজার হাজার মানুষের বেদনাপ্লুত মনের আবেগ-উচ্ছ্বাস। জনতার মধ্যে বিরাজ করছে পূর্ণ শৃঙ্খলা। নেই কোন কোলাহল, কোন হে হল্লা। শুধু নীরবে আঁখিজলে ভেসে বিদায় দেয়ার আকুল আকুতি। বিমান বন্দরের দিকে জনতার স্রোত সদা প্রবহমান। লন্ডন রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে মাওলানাকে এক নজর দেখার জন্যে এ জনসমাবেশ।
বিকেল বেলায় সূর্য বিমান বন্দরে অগ্নিবর্ষণ করছে। মাওলানাকে বিদায়দানকারী জনতা সারিবদ্ধ হয়ে পূর্ণ শৃঙ্খলার সাথে অপেক্ষমান। তাদের হাতে বিভিন্ন প্রকার ব্যানার, “পাকিস্তানের বুনিয়াদ কি-ইসলাম, পাকিস্তানকে টিকে রাখবে- ইসলাম, পাকিস্তানের উৎস কি-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”
সত্য সুন্দরের দিকে আহ্বানকারী যে পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে দেখার জন্যে এ জনসমূদ্র, তিনি এসে পড়েছেন বিমান বন্দরে। অগণিত মানুষের অপলক দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ তাঁর প্রতি। তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত প্রতিটি কথা অপেক্ষমান জনতা হৃদয়ে গেঁথে রাখছে এবং তাঁর বিদায়কালের এ মূল্যবান বাণী তাঁরা পৌঁছে দেবেন লক্ষ লক্ষ নরনারীর কাছে, যাদের সুযোগ-সৌভাগ্য হয়নি এ বিদায় অনুষ্ঠানে যোগদান করার। মাওলানা অশ্রু গদগদ কণ্ঠে জনতার উদ্দেশ্যে বলেনঃ “আপনাদের সকলের জন্যে আমার অসিয়ত এই যে, আপনারা পূর্ণ আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সাথে পাকিস্তানের যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করে যাবেন। আমি আপনাদের জন্যে দোয়া করতে থাকব এবং আপনারাও আমার জন্যে দোয়া করতে থাকবেন, যেন আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের সাচ্চা খাদেম বানিয়ে দেন। আমরা যা কিছু করতে পারি, তা অধিক দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে করার তওফিক যেন তিনি দান করেন।”
জনতা কাতর কণ্ঠে বলে উঠল-’আমীন’।
পচিঁশে আগস্ট।
আজ করাচী বিমান বন্দর দু’দিন আগের লাহোর বিমান বন্দরের রূপ ধারণ করেছে। মাওলানা বিমানের সিঁড়ি বেয়ে উপরে আরোহণ কররছেন। বেদনার ছায়ায় আচ্ছাদিত বিমান বন্দরের গোটা পরিবেশটা শান্ত, গুরু-গম্ভীর ও পবিত্র রূপ ধারণ করেছে। বিদায় দানের উদ্দেশ্যে আগত জনতার দোয়া গুঞ্জরিত হচ্ছে বিমান বন্দরের আকাশে বাতাসে। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মাওলানা হাত তুলে জনতার উদ্দেশ্যে ‘খোদা হাফেয’ বললেন।
পিআইএ’র বোয়িং বিমানটি নীল আকাশে তার দুটি পাখায় ভর করে কত দেশ, কত নদ-নদী, কত সাগর পার হয়ে উড়ে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। যাত্রীদের মধ্যে কেউ পানাসক্তির সাধ মেটাচ্ছেন, কেউ পাশের সহযাত্রীর সাথে আলাপচারিতায় রত, কেউ চিত্ত বিনোদনের জন্যে কোন রস সাহিত্যের রস পানে নিমগ্ন। কিন্তু মাওলানার এ সবের ফুরসৎ কোথায়? তিনি তাঁর সাহিত্যের ইংরেজী তরজমার প্রয়োজনীয় সংশোধনী কাজে লিপ্ত রয়েছেন। বিমান মাঝে মাঝে আকাশ থেকে নেমে আসছে যমীনের উপর তেহরানে, বৈরুতে, ইস্তাম্বুলে। প্রতিটি স্থানে মাওলানার দর্শন প্রার্থীদের “আল্লাহু আকবার” কণ্ঠে বিদীর্ণ হচ্ছে বিমান বন্দরের আকাশ-বাতাস। দর্শনপ্রার্থীদের মধ্যে রয়েছে শহরের সুধীবৃন্দ, উলামায়ে কিরাম, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকমণ্ডলী এবং ছাত্রবৃন্দ। মাওলানার ব্যক্তিত্ব কোন একটি দেশের মধ্যে সীমিত নয়, বরঞ্চ তা বিশ্বজনীন। তিনি শুধু পাকিস্তানের নন, সারা বিশ্বের। মুসলিম বিশ্বের শ্রদ্ধার পাত্র তিনি, ইসলামের পথে চলার সত্যিকার দিক নির্দেশনা চায় মুসলিম বিশ্ব তাঁর কাছে।
সমাগত জনতার কাছে মাওলানা ব্যক্তিগতভাবে অপরিচিত। কিন্তু মাওলানার প্রতি তাঁদের আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্বতঃস্ফুর্ত আবেগ-উচ্ছাস ব্যহত এ কথারই সাক্ষ্যদান করে যে উভয়ে উভয়ের কাছে সুপরিচিত বহুদিনের, যুগান্তরের, শতাব্দীর। সত্যের দিকে আহ্বানকারী এবং সত্যকে গ্রহণকারীদের মধ্যে সম্পর্ক এতো গভীর ও মজবুত কেন এবং এ ধরনের আরও যত প্রশ্ন আছে, তার জবাব দেয়ার ফুরসত কোথায় এবং প্রয়োজনই বা কি? দু’টি চোখ যে হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য অবলোকন করছে, হৃদয় যা অনুভব করছে এই তো তার জবাব।
ইউরোপের সর্ববৃহৎ বিমান বন্দর ‘আল্লাহু আকবর’ কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্চে। তার সাথে ধ্বনিত হচ্ছে পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ইসলামী নিজাম জিন্দাবাদ। ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড টাইম অনুযায়ী অপরাহ্ন সাড়ে পাঁচ ঘটিকা। মাওলানা বিমান থেকে অবতরণ করেছেন। নিউটন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার রোচস্টার, ব্রাডফোর্ড এবং অন্যান্য বিশ-বাইশটি শহর থেকে আগত জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছেন মাওলানাকে। তাদের মধ্যে আছেন আরবের লোক, তুরস্কের লোক, এশিয়া ও আফ্রিকার লোক। আছে বহুসংখ্যক পাকিস্তানী এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থানের নওমুসলিমগণ। ইংরেজী, আরবী, উর্দু, জাপানী, মালয়েশীয় এবং তুর্কী ভাষায় লিখিত বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুনগুলো দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। লন্ডন বিমান বন্দরের তেতলা এবং তার গ্যালারী থেকে হাজার হাজার ইউরোপীয় দর্শক অপলক নেত্রে উপভোগ করছেন এ অভূতপূর্ব দৃশ্য। যে কথা বলা হয়েছির লাহোরে, করাচীতে এবং পথে বিভিন্ন বিমান বন্দরে, তাই বলা হচ্ছে লন্ডন বিমান বন্দরে। এই যে অভূতপূর্ব ও নযীরবিহীন সম্বর্ধনা-এ কোন ব্যক্তিত্বের প্রতি নয়, একটি জীবন দর্শন ও জীবন বিধানের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের স্বীকারোক্তি। তার সাথে একটি মিল্লাত ও জাতির পক্ষ থেকে ইসলামের জন্যে সমগ্র জীবন উৎসর্গকারী এবং ‘শাহাদাতে হকের’ প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যদানকারী এক ব্যক্তিকে বক্ষে ধারণ করার এ এক অভিব্যক্তি। সত্যকে গ্রহণ করার এবং মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করার এ একটি বলিষ্ঠ ঘোষণা।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি তো তিনিই যিনি আজ থেকে আটচল্লিশ বছর আগে মাত্র সতেরো বছর বয়সে কলম হাতে নিয়েছিলেন। তখন দুনিয়া দেখতে পেয়েছিল যে, তাঁর কলমের বিষয়বস্তু ছিল ইসলাম, তাঁর সারা জীবনের ধ্যান-ধারণা ও চেষ্টা চরিত্র ছিল ইসলামের জন্য। তাঁর অতীতের প্রতিটি দিন ও রাত, ঘণ্টা ও মুহূর্ত এ সাক্ষ্যই বহন করেছে যে, যে কাজের জন্যে তিনি এ সময়কাল ব্যয় করেছেন তা হলো দ্বীনে হক, অর্থাৎ দ্বীনের হকের প্রতিষ্ঠা। এক সময়ে এই দ্বীনে হকের জন্যে মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে থাকে দেখা গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর জীবনের প্রতি মুহূর্তকে দেখেছে। তাদের কাছে এ কথা গোপন নেই যে, তিনি গোটা জাতির কাছে এ সত্য তুলে ধরেছেন যে, মুসলমানদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলো ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে বিজয়ী ও সমুন্নত করা। তিনি তাঁর জীবন দিয়ে এ কথার প্রমাণ দিয়েছেন যে, কাজ যদি ইসলামের করতে হয়, তাহলে চরিত্র ও আচার-আচরণ হতে হবে একজন সত্যিকার মুসলমানের। দাওয়াত যদি দেয়া হয় ইসলামের, তাহলে প্রতি মুহূর্তে অন্তরে থাকতে হবে খোদার ভয়। নাম কোরআন ও সুন্নাহর নিতে হলে, যাবতীয় শিক্ষা-দ্বীক্ষা হতে হবে কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই। সত্যের ঝান্ডা যদি বুলন্দ করতে হয়, তাহলে এমনভাবেই করতে হবে যেন সত্য মিথ্যার জন্যে এক বিরাট আশঙ্কা হড়ে পড়ে।
লন্ডনের দিনগুলো
মাওলানা লন্ডন এসেছেন চিকিৎসার জন্যে-তাঁর মূত্রাশয়ের অপারেশনের জন্যে।। একদিকে চলছে এ অপারেশনের সকল প্রকার প্রস্তুতি। অপরদিকে দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে আহত ও ইংল্যান্ডে বসবাসরত মুসলমান ও তাদের সংগঠনগুলো অনুভব করছেন যে, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মাওদূদী তাঁদেরই মধ্যে বিদ্যমান। দূর ও নিকটের ইউরোপীয়গণ এবং ইংরেজ নওমুসলিমগণ মাওলানার সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব লাভ করছেন। মুসলমান ছাত্রদের আন্তর্জাতিক সংস্থা FOSIS মাওলানার সম্মানে ডিনারের আয়োজন করে একত্রে বহু লোকের সাক্ষাতের সুযোগ করে দিচ্ছে। সাক্ষাতকারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে মাওলানা। বিবিসি এবং অন্যান্য সংবাদ সংস্থারও সাক্ষাৎকার চলছে মাওলানার সাথে।
ইউকে ইসলামিক মিশনের সম্মেলনে
লন্ডনে ইউকে ইসলামিক মিশরের তিনদিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ৩১শে আগস্ট শুরু হয়। এ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে মাওলানা যোগদান করেন। মুসলিম বিশ্বের সকল দেশের প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। মাওলানা তাঁর ভাষণে বলেনঃ
“আপনারা এদেশে ইসলামের রাষ্ট্রদূত। আপনারা চান বা না চান এখানকার অমুসলমানগণ আপনাদেরকে ইসলামের প্রতিনিধিই মনে করে। অতএব আপনাদের এবং এখানে বসবাসকারী সকল মুসলমানের উপর স্বাভাবিকভাবেই এ বিরাট দায়িত্ব এসে পড়ে যে, আপনারা এখানে যা কিছুই করবেন এবং নিজেদের আচার-আচরণের যে চিত্রই পরিস্ফুট করবেন, তা সবই তারা ইসলামের উপরই আরোপ করবেন। আপনাদের হাবভাব ও চরিত্র থেকে তারা যে অভিমত পোষণ করবে, তার জন্যে আপনারাই দায়ী হবেন। ভালোভাবে চিন্তা করে দেখুন-এ কত বড় দায়িত্ব, যার জন্য আমাদেরকে মিয়ামতের দিনে জবাবদিহি করতে হবে।”
পরিপূর্ণ জীরব ও নিস্তব্ধ পরিবেশে উক্ত ভাষণের এক একটি শব্দ শ্রোতাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে আঘাত করছে। এ আঘাত অনুভব করছে প্রতিটি হৃদয়। মাওলানার এ উদাত্ত আহ্বান প্রতিটি বিবেকের কাছে। আর এই হলো তার সমগ্র জীবনব্যাপী ইসলামী দাওয়াতের বুনিয়াদী আকর্ষণ। উক্ত সম্মেলনের তৃতীয় দিনে ভাষণ প্রসঙ্গে মাওলানা বলেনঃ
“আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে, পৃথিবীর যেখানেই মানুষ বাস করে, সেখানেই ইসলামের প্রসার লাভ সম্ভব। আপনারা যদি নিজেদের আচার-আচরণের মাধ্যমে ইসলামের সত্যতার প্রমাণ পেশ করেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ এখানকার অমুসলিম জনপদেও ইসলাম বিস্তার লাভ করবে। সত্যি কথা বলতে কি, আপনারা ভাগ্যবান যে আল্লাহ তায়ালা আপনাদেরকে ইংরেজ জাতিকে জয় করার সুযোগ দান করেছেন।”
ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে ৬ই সেপ্টেম্বর মাওলানা জুমার ভাষণ (খুতবা) দান করেন। পরদিন মাওলানার বাসস্থানে দর্শনপ্রার্থীর সংখ্যা খুব বেড়ে যায়। কারণ ৮ই সেপ্টেম্বর মাওলানাকে অপারেশনের জন্যে হাসপাতালে যেতে হবে। সাত তারিখের সাক্ষাৎকারীদের মধ্যে ছিলেন সুদানের ছাত্রগণ, নাইজেরিয়ার সুধীবৃন্দ এবং অন্যান্য দেমের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ। লন্ডন ক্লিনিকে ৯ই সেপ্টেম্বর অপারেশনের উদ্দেশ্যে আগের দিন সন্ধ্যায় মাওলানা ক্লিনিকে গমন করেন। মাওলানার সাথে যান অধ্যাপক খুরশিদ আহমদ এবং মাওলানার পুত্র ডাঃ আহমদ ফারুক মওদূদী।
পরদিন অর্থাৎ ৯ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড টাইম বেলা দু’টো বিশ মিনিটে অপারেশন শুরু হয় এবং ২৪ গ্রাম ওজনের পাথর মূত্রাশয় থেকে অপসারণ করা হয়। বেলা চারটায় অজ্ঞান অবস্থায় মাওলানাকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বাইরে আনা হয়। বেলা সাড়ে পাঁচটায় মাওলানা জ্ঞান ফিরে পান। রাত আরামে কাটে। পরদিন বেলা বারোটায় তিনি ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসেন এবং সাক্ষাতের জন্যে আগমনকারীদের সালামের জবাব দেন।
ডাঃ আলেকজান্ডার বেডনুকের ক্লিনিক থেকে ২৪শে সেপ্টেম্বর মাওলানা তার বাসস্থানে ফিরে আসেন। লন্ডনে তিনি জনাব রশিদ আহমদ সিদ্দিকীর মেহমান ছিলেন। সিদ্দিকী সাহেবের বাড়ীতে সে সময়ে সারা দুনিয়া থেকে মাওলানার অবস্থা জানার জন্যে অবিরাম টেলিগ্রাম, টেলিফোন ও চিঠিপত্র এসে স্তূপীকৃত হচ্ছিল। তা ছাড়া সর্বদা বিভিন্ন দেশের সুধীজনের গমনাগমন তো ছিলই।
একুশে অক্টোবর পুনরায় মাওলানাকে ক্লিনিকে যেতে হয়। এবার অপারেশন করে তার একটি মূত্রাশয় অপসারণ করতে হবে। এ অপারেশন ছিল বেশ কিছুটা বিপজ্জনক। পরদিন দু’ঘণ্টা ধরে অপারেশন করে অকেজো মূত্রাশয়টি অপসারণ করা হয়। পরদিন মাওলানা জ্ঞান ফিরে পান।
ডাঃ বেডনুক এবং মেডিক্যাল বোর্ডের অন্যান্য ডাক্তারগণ মাওলানার দ্রুত আরোগ্য লাভ দেখে একাধারে বিষ্ময় ও সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ ধরনের রোগীকে এত অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে তারা কখনো দেখেননি। এ আল্লাহ তায়ালারই বিশেষ রহমত বলতে হবে।
বারোই নভেম্বর পূর্ণ আরোগ্য লাভের পর মাওলানা ক্লিনিক ত্যাগ করেন। অতঃপর তিনি সত্বর পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ডাক্তারগণ এক্ষুণি দীর্ঘ সফরের ঝুৎকি না নিয়ে কিছুদিন লন্ডনে অবস্থানের পরামর্শ দেন। আঠারোই নভেম্বর মাওলানা সাদেকাবাদের (পাকিস্তান) হাকীম নূরুদ্দীনের কাছে লিখিত পত্রে জানানঃ
আল্লাহর ফযলে এখন আমার শরীর ক্রমশ ভালোর দিকে। সাতাশ বছর পর এই প্রথম সকালে ঘুম থেকে উঠে আরাম বোধ করছি। বছরের পর বছর ধরে আমার শরীরের অবস্থা এই ছিল যে, সকালে ঘুম থেকে উঠলে মনে হতো সমস্ত শরীর ক্লান্তিতে ভরে আছে। পনেরোই ডিসেম্বর লন্ডনের একটি সুউচ্চ ও সুরম্য হোটেল লন্ডন হিল্টনে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী মুসলমানদের পক্ষ থেকে মাওলানার সম্মানে এক সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়। মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতগণ, প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ, বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞগণ, অন্যান্য সুধীবৃন্দ এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণএ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।
কোরআন পাক থেকে তেলাওয়াতের পর মিসরের ডাঃ সালাহ শাহীন অভিনন্দন বাণী পাঠ করেন। দু’ডজনেরও বেশী টেলিভিশন ও মুভী ক্যামেরা তৎপর হয়ে পড়ে। সমস্ত হলঘরটি ফ্লাসসাইটের পুনঃপুনঃ আলোক বিক্ষেপণে ঝলসে উঠে। মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের সুধী জ্ঞানীগুণী, পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঐতিহাসিক সমাবেশে মাওলানা পাশ্চাত্যবাসীকে সকল প্রকার বিদ্বেশ ও কুধারণা থেকে মুক্ত হয়ে স্বচ্ছ ও সত্যানুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ”সত্যানুসন্ধান মানব জাতির সকলেরই সমান ও সাধারণ কামনা-বাসনা। আপনাদের সমাজের ইসলাম থেকে দিগদর্শন লাভ করতে প্রতিবন্ধকতার কোন কারণ থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে আপনারা যতটুকু সুযোগ পান, তার সদ্ব্যবহার করুন, ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করতে পারলে মঙ্গল আপনাদেরই হবে।”
পাশ্চাত্যের বিভিন্নস্থানে বসবাসকারী মুসলমানদের উদ্দেশ্যে মাওলানা বলেনঃ
“পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান ও টেকনোলজি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করুন এবং এর সুফল প্রাণভরে উপভোগ করুন। কিন্তু ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করুন। একমাত্র এভাবেই আপনারা পাশ্চাত্যবাসীর সামনে একটি ভারসাম্যমূলক মানব দরদী এবং সুবিচারপূর্ণ সমাজের দৃষ্টান্ত পেশ করতে পারবেন। সব সময় মনে রাখবেন, আপনাদের ভবিষ্যৎ ইসলামের উপরই নির্ভরশীল। ইসলামী জীবন পদ্ধতিই আপনাদের দুনিয়ায় টিকে থাকবার নিশ্চয়তা দান করতে পারে। অন্যথায় এতটুকু তো নিশ্চয়ই হবে যে, কয়েক বছর পর এখানকার ইংরেজ সমাজে কিছু নতুন ইংরেজের সংযোজন হবে। কিন্তু এতে না আপনাদের মান সম্মান বাড়বে আর না এতে ইসলামের সাথে আপনাদের আনুগত্যের কোন লেশ থাকবে।”
এখন দু’এক দিনের মধ্যে মাওলানাকে দেশে ফিরতে হচ্ছে।
ঊনিশ শ’ আটষট্টির ২৬শে ডিসেম্বর।
মাওলানাকে বিদায় দেয়ার জন্যে আজ আবার লন্ডন বিমান বন্দরে জনতার ভিড় জমেছে। বিভিন্ন শহর থেকে আগত আওলানার বন্ধু-বান্ধব, ভক্ত-অনুরক্ত, ইসলামী আন্দোলনের কর্মী, সুধী, মধ্যপ্রাচ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তি শীতবস্ত্রে আবৃত হয়ে বিমান বন্দরে জমায়েত হয়েছেন। অশ্রুকাতর কণ্ঠে তাঁরা মাওলানাকে বিদায় অভিবাদন জানান। বোয়িং ৭০৮ মাওলানাকে নিয়ে তার দু’খানি পাখা বিস্তার করে তুষারাচ্ছন্ন আকাশে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। সাথে সাথে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের যবনিকাপাত হলো।
মাওলানাকে বহনকারী বোয়িং ৭০৮ ইস্তাম্বুল বিমান বন্দরে অবতরণের জন্যে আকাশে চক্কর দিচ্ছে। আংকারা থেকে প্রকাশিত মাসিক ’হিলাল’ পত্রিকার সম্পাদক, দৈনিক ‘বোগান’ ও ’ইতিহাদের’র সম্পাদকদ্বয় এবং তুরস্কের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি মাওলানাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। বিমান অবতরণের পর ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে বিমান বন্দর প্রকম্পিত করে দর্শনপ্রার্থীগণ মাওলানার সাথে মিলিত হন।
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের শাসনামলে যিনি ছিলেন তুরস্কের শায়খুল ইসলাম, তাঁর পৌত্র এসেছেন মাওলানাকে অভ্যর্থনা জানাতে। অতি বার্ধ্যক্যও তাঁকে বিমান বন্দরে আসা থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারেনি। তিনি মাওলানাকে আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, মাওলানা! আপনি যদি আমাদের মধ্যে থাকতেন, তাহলে এ দেশের ইসলামী আন্দোলন পঞ্চাশ বছর এগিয়ে যেত। আমরা আপনার মত ব্যক্তিত্বের নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত রয়েছি। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, আপনার সাহিত্যের মাধ্যমে আপনার চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হতে পারছি।”
পাকিস্তানের পথে কুয়েত ও দাহরান বিমান বন্দরেও অনুরূপ দর্শনপ্রার্থীদের বিরাট সমাগম ঘটে! তাঁরাও মাওলানাকে তাঁড়ের প্রাণঢালা ভক্তি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। মাওলানা ২৭শে ডিসেম্বর করাচী এবং ২৯শে ডিসেম্বর লাহোর বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। উভয় বিমান বন্দরে হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম হয়। লাহোর থেকে মোটর গাড়ি ও স্কুটারের মিছিল সহকারে মাওলানাকে তাঁর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়।
মাওলানার বাসভবন ৫/এ যায়লদার পার্ক কয়েকমাস পর আবার জমজমাট হয়ে পড়ে। যেন বসন্তের নব আগমনে ফুল বাগিচার ফুলকুঁড়িগুলো তাদের ঘোমটা খুলে বেরিয়ে এসেছে তাদের প্রাণ মাতানো সৌরভ ছড়ানোর জন্যে। দেশ-বিদেশের জ্ঞান-পিপাসুগণ আবার এখানে জমায়েত হতে শুরু করেছেন।
এই হলো ঐতিহাসিক ৫/এ যায়লাদার পার্ক, ইছরা, লাহোর, যেখান থেকে ইসলামী আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের চারিদিকে। [৫/এ যায়লাদার পার্কে ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিদিন বৈকালে মাওলানাকে নিয়ে যে আসর বসত, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মাওলানার দর্শনার্থীগণ জমায়েত হতেন এবং বিভিন্ন প্রশ্ন করে জবাব পেতেন, সে সম্পর্কে জানতে হলে পড়ুন বিকালের আসর-গ্রন্থকার।]
গোল টেবিল বৈঠক
আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের ফলে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যখন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, যখন বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনার জন্যে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী এক গোল টেবিল বৈঠকের অনুষ্ঠান করেন। সেখানে মাওলানা মওদূদীসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানগণ সমবেত হন, দ্বিতীয় বৈঠক হয় ১০ই মার্চ। কিন্তু বহু আলাপ-আলোচনার পর আইয়ুব খান তাঁর অনমনীয় মনোভাব ব্যক্ত করেন বলে গোল টেবিল বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তারপর গণ-আন্দোলন এক তীব্র আকার ধারণ করে এবং আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটতে থাকে। গণ-আন্দোলন ও বিক্ষোভের মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। তিনি ২৩ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে সরে পড়েন।
ইয়াহিয়া খান দেশে সামরিক আইন জারি করেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও তৎপরতা সীমিত করেন। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, সত্তরের জানুয়ারি মাসে মাওলানা শেষবারের মত ঢাকা সফরে আসেন। তিনি অনুভব করেন যে পাকিস্তানের ঐক্য ও অখণ্ডতা (Solidarity Sand Integrity) বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
এই সময়ে রাজনীতির গতিধারা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। ফলে দুটি দল আওয়ামী লীগ এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে এবং পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয় লাভ করে।
নির্বাচনের পরপরই মাওলানা মওদূদী মন্তব্য করেন যে, এখন কোন অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ডই দেশকে অখণ্ড রাখতে পারে। অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এ এক অবধারিত সত্য। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী তাঁরই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। কিন্তু পিপিপি নেতা জুলফিতার আলী ভুট্টো ভীতি প্রদর্শন করে পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের পরিষদ অধিবেশনে যোগদান করা থেকে বিরত রাখনে। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস, অসন্তোষ ও দূরত্ব এতো বেড়ে যায় যে, তার পরিণতিতে অনেক রক্তক্ষয়ের পর একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে অস্তিত্ব লাভ করে।
মাওলানা মওদূদী একে তো বহুদিন যাবত রোগে ভুগছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন হওয়ার পর তিনি হৃদয়ে এতো বড়ো আঘাত পান যে, তাঁর দেহ এবং মন উভয়ই একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।
একদিকে পরম আনন্দ ও সৌভাগ্যের বিষয় যে, ১৯৭২ সালে মাওলানার জীবনের অক্লান্ত শ্রম ও সাধনার ফল তাফহীমুল কোরআন সমাপ্ত হয় এবং অপরদিকে তিনি তার তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্যে জামায়াতের আমীরের পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। মিয়া তোফায়েল মুহম্মদ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমীর নির্বাচিত হন।
আটাত্তর সালের এপ্রিল ও জুলাই মাসে আমি মাওলানার সাথে দু’বার সাক্ষাৎ করি। তখন তাঁকে এমন অবস্থায় দেখেছিলাম যে, অশ্রু সংবরণ করা বড় কঠিন হয়ে পড়েছিল। মনে হয়েছিল তাঁকে যেন পুঁটুলি বেঁধে চেয়ারের উপর রেখে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থাতেও তিনি লোকজনের সাথে কথা বলতেন, লেখাপড়ার কাজও করতেন, বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শও দিতেন।
এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা বলেন-
“আল্লাহর শোকর যে, তিনি আমাকে এমন কোন রোগ দেননি যাতে আমি তাঁর দ্বীনের কাজ করতে পারি না। আমার এমন রোগ যা আমার ব্যক্তি সত্তাকেই কষ্ট দেয় এবং আমি মনে করি এতে আমার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। যেমন ধরুন, এখন আমি বসে বসেই লেখাপড়ার কাজ করছি। তাতে আমার কোন কষ্ট বা ক্লান্তি হয় না। কিন্তু দাঁড়ালে অথবা হাঁটা শুরু করলে ধাপে ধাপে কষ্ট অনুভব করি। দেড় মিনিটের বেশী দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না।”
এমন অবস্থাতেও ১৯৭৫ সালে রেডিও পাকিস্তান দু’ঘণ্টার অধিক সময়ের মাওলানার এক সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে। সে সাক্ষাৎকার তাঁর মৃত্যুর এক বছর পর লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তর্জুমানুল কোরআনে প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি ‘একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার’ নামে পুস্তকাকারে বাংলায় প্রকাশিত হয়, অত্র গ্রন্থকার তা বাংলায় অনুবাদ করেন।
এ সাক্ষাৎকারে যেসব প্রশ্নের অবতারণা হয় তার মধ্যে ছিল পাকিস্তান আন্দোলন, তার পশ্চাৎ পটভূমি, বিভাগপূর্ব ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা, ভারতে পার্লামেন্টারী শাসন প্রবর্তন, মুসলমান ও অমুসলমান নির্বিশেষে একজাতীয়তার যাঁতাকলে থেকে একটি মাত্র ভৌগলিক জাতীয়তার এক অদ্ভুত মিক্সচার তৈরি করে তার উপরে এক আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো তৈরির ষড়যন্ত্র, মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিনামের আশঙ্কা, অতঃপর মুসলমানদের পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতীয়তার প্রেরণা, তাদের পৃথক আবাসভূমি, তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি, তাদের নিজস্ব জীবন দর্শন ও আকীদাহ-বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি ও তার যৌক্তিকতা প্রভৃতি বহু বিষয়। এসবের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব মাওলানা দেন। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে যে মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য তিনি পরিবেশন করেন তার ভিত্তিতে এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায় যে, কোন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক পাকিস্তাপন আন্দোলন ও তার পটভূমির সঠিক ইতিহাস রচনা করতে বসলে আল্লামা মাওদূদীর ব্যক্তিত্ব ও তাঁর অমুল্য অবদান কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারবে না।
উপরন্ত এ সাক্ষাৎকারে আল্লামা মওদূদী এমন বহু কিছু বলেছেন এবং এমন অনেক কিছু স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যা একমাত্র দ্বীনের আন্দোলনকারীদের বিরাট কাজে লাগবে। তাই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এবং বিশেষ করে আমাদের যুব সমাজের এ ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটি পাঠ করার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
মাওলানার ইতিকাল
মাওলানা সারা জীবন যে কঠোর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করেন, তার জন্যে তাঁর স্বাস্থ্য অকালেই ভেঙ্গে পড়েছিলো। তিনি দীর্ঘদিন যাবত মূত্রাশয়ের পীড়ায় ভোগেন। তার ফলে হাঁটু ও কোমরের বেদনা বলতে গেলে চিরস্থায়ী হয়ে পড়েছিলো। আটষট্টি সালে লন্ডনে মূত্রাশয় অপারেশন করা হয়। কিন্তু রোগ নিরাময় হয় না। তাই আজীবন তাঁকে রোগ যন্ত্রণায় ভুগতে হয়। এর ভেতরেই তিনি সব কাজ করতে থাকেন। আল্লাহর প্রিয় বান্দাহর চোখে মুখে কোনদিনই রোগ-যন্ত্রণার কোন বহিঃপ্রকাশ, কোন আলামত দেখা যায়নি।
বাহাত্তুর সালে তাঁর বিপ্লবী তাফসীর ‘তাফহীল কোরআন’ লেখা সমাপ্ত হয়। তার বহু আগে থেকে তিনি বলতেন, “আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, দোয়া করুন যেন তাফহীম খতম করে যেতে পারি।”
তাফহীম লেখা খতম হওয়ারপরও আল্লাহ তাঁকে জীবিত রাখলেন। তাঁর জীবনের বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ্ব নবীর জীবন-চরিত রচনা করার। তিনি কলম ধরলেন। সাত বছরে নবীর মক্কী জীবন লেখা শেষ করলেন। তা দু’খণ্ডে প্রকাশিত হলো। জীবন-চরিতের নাম রাখলেন ‘সীরাতে সারওয়ারে আরম’। মাদানী জীবনের উপরেও প্রয়োজনীয় নোট লেখা শেষ করলেন। কিন্তু তার উপরে কলম ধরার আগেই দীন -দুনিয়ার প্রভুত তাঁকে আপন সন্নিধানে ডেকে নিলেন।
বাইশে সেপ্টেম্বর আমেরিকার বাফেলো শহরের এক হাসপাতালে আধুনিক জগতের শ্রেষ্ঠ মনীষী সাইয়েদ মওদূদী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর জানাযা হলো বাফেলোতে, লন্ডনে, করাচীতে, লাহোরে। শরীক হলো মুসলিম বিশ্বের মনীষীগণ, লক্ষ লক্ষ ভক্তবৃন্দ, জনসাধারণ, যুব সমাজ। তাঁর জানাযা অনুষ্ঠানের বর্ণনা নিম্নে সংযোজিত হলো।
মাওলানার জানাযার অভিজ্ঞতার আলোকে
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৯৭৯ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো শহরের হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর লাহোরে জানাযার পর তাঁর দাফন কার্য সমাপন করা হয়। তাঁর জানাজায় শরীক হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। এ সম্পর্কে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কিছু পরিবেশন করতে চাই প্রিয় পাঠক সমাজের কাছে।
২৩শে সেপ্টেম্বর বিকেল বেলা মফস্বল থেকে ঢাকায় ফিরে দুঃসংবাদ পেলাম মাওলানা মওদূদী ইন্তিকাল করেছেন। স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মুখ থেকে ইন্না লিল্লাহ….. বেরিয়ে এলো বটে। কিন্তু মনে হোল মাথায় আকাশ ভেংঙ্গ পড়লো। জানাযার জন্যে আমাকেই যেতে হবে এবং যতো শিগগির পারি। পরদিন ভিসা বিমানের সীট এবং অন্যান্য সব ঝামেলা চুকিয়ে পঁচিশ তারিখে পিআইএ-র বিমানে করাচী পৌঁছলাম। আমার অবস্থাও ছিলো অনুরূপ। ঐদিনই বেলা সাড়ে দশটায় লন্ডন থেকে মাওলানা মরহুমের মাইয়েত (কফিন) করাচী পৌঁছে এবং জানাযার পর লাহোর রওয়ানা হয়ে যায়।
জনৈক বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটালাম। রাত সাড়ে ন’টায় মাওলানার জানাযাসহ তাঁর জীবনের উপরে কিছু ফিচার দেখানো হলো পাকিস্তান টেলিভিশনে। প্রবল অশ্রুধারা টিভি দেখতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিলো। বড় আশা ছিলো মাওলানার শেষ দীদার লাভের। কিন্তু তার অপূর্ণই রয়ে গেল। রাতে লাহোরগামী বিমানের কোন সীট পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে পরদিন সকালের। সকাল সাড়ে দশটায় লাহোরে জানাযা হবে। বিমান লেট হলে জানাযাও ভাগ্যে জুটবে না। এমন এক দুশ্চিন্তায় রাত কাটালাম।
পরদিন সকাল সাতটায় লাহোর রওয়ানা হলাম। হঠাৎ ঢাকা থেকে আমার এক সাথী ছুটে গিয়েছিল। আমি যখন ঢাকা বিমান বন্দরে বিমানে উঠতে যাচ্ছি, তখন পেছন থেকে শ্রান্ত-ক্লান্ত কণ্ঠে আওয়াজ এলো, খান সাব, আল্লাহর শোকরিয়া শেষ পর্যন্ত এসে পড়লাম। পেছন ফিরে দেখি ডাঃ আজিজুল হক চৌধুরী। শুকনো মুখ, উস্কো খুস্কো চেহারা যেন উদ্ভ্রান্ত প্রেমিক। প্রেমিকই বটে। বিমানে উঠার পর একটু জিরিয়ে নেয়ার পর আমার কাছে এসে বললেন, মাওলানাকে তাঁর জীবদ্দশার দেখার সৌভাগ্যে হয়নি। তাই বড় সাধ মরণের পর একবার দীদার লাভের।
বললাম বলুন, আল্লাহ আমাদের আশা পূরণ করুন।
করাচী থেকে লাহোরের পথেও কয়েকজন বন্ধু জুটে গেল। তাদের মধ্যে ছিলেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ইমপ্যাকট’ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আরিফুল হক। নটায় লাহোর বিমান বন্দরে নামলাম। জীবনে বহুবার এ বিমান বন্দরে উঠানামা করেছি। কিন্তু আজ তার এক ভিন্ন রূপ দেখলাম। যেখানে হর হামেশা মানুষ গিজগিজ করে, সে স্থানটি বলতে গেলে একবারে জনমানবহীন। বিমান বন্দরে বাইরে এক শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ-একটা মর্মন্তুদ বিচ্ছেদ বেদনার মূর্ত প্রকাশ। নিশ্চিত ছিলাম যে বিমান বন্দরে কেউ আসবে নিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখছি না। হয়তো করাচীর বন্ধুরা শোকের আতিশয্যে খবর দিতে ভুলে গেছেন অথবা অন্য কোন কারণ ঘটেছে।
জনাব ফারুকীর বন্ধু গাড়ি নিয়ে এসেছেন তাকে নেয়ার জন্যে। আমাদের সকলের গন্তব্যস্থল একই। তাই তারা আমাদের দু’জনকে তাদের গাড়িতেই উঠালেন। বললাম, তাই সোজা ইছড়া চলুন, যদি আখেরী দীদার হয়ে যায়।
নতুন ফিয়াট গাড়ি শাঁ শাঁ করে ছুটছে, লেজ আকাশে তুলে যেমন ধারা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে একলা মাঠে ফেলে আসা গো-শাবক তার মায়ের কাছে। মিনিট পনেরোর মধ্যে আমরা মুজাং চুঙ্গী হয়ে ফিরোজপুর রোডে এসে পড়েছি। একটু দূরে দক্ষিণে ইছড়া মোড় ঘুরে বামে ঢুকতে হবে যায়লদার পার্ক লেনে। ৫/এ যায়লদার পার্ক মাওলানার বাসভবন। আমাদের গাড়ি ইছড়া মোড়ে পৌঁছতেই জনৈক শোকাকুল পথচারী বলে দিলেন- ঐ দেখুন দক্ষিণ দিকে জানাযার মিছিল চলছে।
সামনে জনসমুদ্র নজরে পড়ল। প্রশস্ত ফিরোজপুর রোডে মানুষ থৈ থৈ করছে। তার মধ্যে প্রাইভেট কার, বাস, পিকআপ, রিজার্ভ করা ট্রাক-অটোরিকশা, স্কুটার, সাইকেল, শোকাকুল গণমিছিল। মুখে উচ্চৈঃস্বরে কালেমায়ে শাহাদাত এবং ‘আল্লাহু আকবার’।
সামনে অর্ধ মাইল দূরে ‘মাইয়েত’ বলে মনে হয়। ভিড়ের মধ্যে গাড়ি চলতে পারে কই? কখনো কখনো এগুচ্ছে ধীরে ধীরে কচ্ছপ গতিতে। অগত্যা খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ফিরোজপুর রোড থেকে বাম দিকে কেটে পড়ে অন্য পথে দ্রুত পৌঁছে গেলাম গাদাফী স্টেডিয়ামে। এখানেই জানাযা হবে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ, দ্বীনের আলেমকুলশিরোমণি, বিশ্বব্যাপী ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের কর্ণধার, বিশ্ববরণ্যে আল-উস্তাজ, আল-মুরশিদুল আম আল্লামা আবুল আ’লা মওদূদীর।
গাদাফী স্টেডিয়াম পাকিস্তানে সর্ববৃহৎ। মাইয়েত পৌঁছুবার আগেই বিরাট বিশাল স্টেডিয়ামের আধখানা ভরে গেছে। স্টেডিয়ামের আটটি ফটক দিয়ে ক্রন্দরত মানুষের প্রবলস্রোত ভেতরে ঢুকছে। সারাদেশ থেকে আগত ইসলামী আন্দোলনের জন্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার তাগড়া নওজোয়ান শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত। শৃঙ্খলার কঠিন বেড়াজাল ডিঙিয়ে সামনে এগুবার উপায় নেই। অসহায়ের মত চারিদিকে তাকাচ্ছি। চোখের পানিতে রুমালখানা ভিজে জবজবা হয়েছে। সাথীরা কোথায় হারিয়ে গেছেন।
সংবাদপত্রের জনৈক ফটোগ্রাফার আমাকে দূর থেকে নিচে ফেলেছেন। চিৎকার করে বললেন, আসুন মাওলানা! আপনাদের মত বিদেশী মেহমানদের জন্যে প্রথম কাতার। এবার স্বেচ্ছাসেবকদের কড়া বেষ্টনী ভেদ করে সামনের কাতারে গিয়ে স্থান নিলাম। ডাঃ চৌধুরীও এসে গেলেন। খানিক পরে ‘মাইয়েত’ মাঠে পৌছে গেল এবং আমাদের সামনে রাখা হলো। সঙ্গে মাওলানা মরহুমের ছেলেরা, মিয়া তুফাইল মুহাম্মদ, অধ্যাপক খুরশীদ, মাওলানা হামিদী, চৌধুরী জিলানী এবং আরও অনেকে। তাঁদের সাথে বুক মেলাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। বহু চেষ্টা করেও নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কলিজাখানা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।
সামনের কাতারে আরও অনেকেই ঢুকতে শুরু করলেন এবং কাতার দু’ধারে প্রসারিত হতে লাগল। প্রথম স্থান থেকে ডান দিকে খানিকটা সরে যেতে হলো।
সামনের কাতারে যসব বিদেশী মেহমান ছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সউদী রাষ্ট্রদূত রিয়াদ আল খতীব, জর্দান রাষ্ট্রদূত, আয়াতুল্লাহ খুমেনীর বিশেষ প্রতিনিধি ও ইরান সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ ইউসুফ আবদুল্লাহ আল-কারযাবী, বিশ্ব মুসলিম যুব সংসদের সহ-সেক্রেটারী জেনারেল ডঃ মুহাম্মদ তুতুঞ্জী, সিরিয়ার প্রখ্যাত পণ্ডিত ও মনীষী শেখ সাঈদ হাওয়া ও শেখ আদনান সাদুদ্দীন, কুয়েত আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ইসলাম সম্পর্কিত বিভাগের ডাইরেক্টর শেখ আবদুল্লাহ আল-আকীল, কুয়েতের প্রখ্যাত আইনবিদ এবং বহুল প্রচারিত ‘আল-মুজতামিয়া’ পত্রিকার সম্পাদক শেখ মুবারক আল-মুকাওয়া, মাওলানা মরহুমের বিশিষ্ট বন্ধু শেখ আবদুল আজী আল-আলী আল-মোতাওয়া, মিশরের বিশিষ্ট ইখওয়ান নেতা ডঃ কামাল, হাসানুল বান্না শহীদের পুত্র আইনজীবী শেখ সাইফুল ইসলাম প্রমুখ মনীষীবৃন্দ। সামনের কাতারে আরো ছিলেন জামায়াতে ইসলামী হিন্দের আমীর মাওলানা ইউসুফ, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক, পাঞ্জাবের গভর্ণর লেঃ জেনারেল সরওয়ার খান, দেবল শরীফের পীর সাহেব এবং সামরিক বাহিনীর কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মচারী।
পিপিপি ব্যতীত পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বহু উলামায়ে কেরাম, সুধী ও সরকারী বেসরকারী কর্মচারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে জানাযায় শরীক হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুফতী মাহমুদ, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, আযাদ কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সরদার আবদুল কাইয়ুম খান, সরদার শওকাত হায়াত খান, চৌধুরী জহুর এলাহী, খাজা খায়রুদ্দীন, আল্লামা ইহসান ইলাহী জহীর প্রমুখ। ভারত থেকে আগত প্রায় পৌনে দু’শ আলেম ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মী জানাযায় শরীক হন।
জানাযার ‘কফিন’ জড়ানো রয়েছে কালিমায়ে তাইয়িবাহ সম্বলিত জামায়াতে ইসলামীর পতাকা ও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক সামরিক ইউনিফরমের উপর হাতে কালো ব্যাজ পরেছেন। তিনি নির্দেশ দেন যে, কোন সরকারী কর্মচারী ইচ্ছা করলে মাওলানার জানাযায় শরীক হতে পারে। জানাযার পূর্ব মুহূর্তে স্টেডিয়ামের দৃশ্য হৃদয়বিদারক, বিস্ফোরণোন্মুখ। স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ এবং ভেতরে ঢুকতে না পেরে বাইরে হাজার হাজার মানুষ বুক চাপড়ে মাতম করছে। লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে কালেমায়ে শাহাদাত, শোকের মর্সিয়া-ইয়া সাইয়িদী, মুরশিদী, মওদূদী-মওদূদী। লক্ষ লক্ষ কণ্ঠের হাহাকার ও মর্সিয়া স্টেডিয়ামের চারধারে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ঊর্ধ্বাকাশ বিদীর্ণ করে ছুটে চলেছে আরশে পাকের দিকে। জনতা মাইয়েতকে এক নজর দেখার জন্যে, মাওলানার জাসাদে খাকীর (মাটির দেহ) শেষ দীদার লাভের জন্যে এবং হাত দিয়ে মাইয়েতের একটু পরশ লাভের জন্যে উন্মত্তের মতো সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। নওজোয়ান স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রাণপণ শৃঙ্খলা রক্ষা করার চেষ্টায় নিয়োজিত।
ইমামে কা’বা শেখ মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বিন সাবিইয়িল জানাযার ইমামতি করবেন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু মক্কা মুয়াযযামা থেকে রওয়ানা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে অনিবার্য কারণে তাঁর সফর বিলম্বিত করতে হয়েছে। অতঃপর ইমামতির ভার দেয়া হলো কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. ইউসুফ আবদুল্লাহ আল-কারযাবীর উপর। তিনি কায়রো জামিয়া আজহার থেকে ইসলামিয়াত ও দীনিয়াতে ডকটরেট লাভ করেছেন। প্রখ্যাত আলেমে দীন এবং মাওলানার প্রতি পরম শ্রদ্ধা পোষণ করেন। তিনি ইমামতির আগে জনতাকে লক্ষ্য করে বলেন, সাইয়েদ মওদূদী তাঁর বিশ্বজনীন দাওয়াত ও চিন্তাধারার জন্যে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। তিনি তাঁর শতাধিক অমূল্য সাহিত্য রেখে গেছেন। আর রেখে গেছেন লক্ষকোটি রুহানী আওলাদ। আমি হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আসিনি আপনাদেরকে কোন সান্ত্বনার বাণী শুনাতে। বরং এসেছি একথা বলতে যে, দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ তাঁর চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হয়ে কাজ শুরু করেছে। আমরা মাওলানার আন্দোলনকে নিয়ে জোর কদমে এগিয়ে চলব। পাকিস্তানের জন্যে একমাত্র এটাই মঙ্গলজনক যে, এখানে সত্যিকার ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা হোক। আপনারা যারা মাওলানার প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করেন, তারা এর জন্যে সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন।
ডঃ কারযাবীর ভাষণের পর লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনিত হলো- সাইয়েদী মুরশিদী-মওদূদী-মওদূদী। স্টেডিয়ামের বাইরে অপেক্ষমান হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো- সাইয়েদী মুরশিদী-মওদূদী-মওদূদী। সে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো আকাশে-বাতাসে, চারধারের বৃক্ষরাজিতে, দালান-কোঠায়, প্রতিটি আনাচে কানাচে।
জানাযার পর জনসমূদ্রের বাধ ভেঙ্গে গেল। সকলের লক্ষ্য মাইয়েত। শৃঙ্খলা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ল। বহু কষ্টে ভিড়ের চাপ থেকে বাঁচিয়ে মাইয়েত স্টেডিয়ামের বাইরে নিয়ে ট্রাকে উঠানো হলো। চারদিক থেকে মানুষের অসম্ভব চাপের মধ্যে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল। ডাঃ চৌধুরী ও আমি একে অপরকে চেপে ধরে বাইরে চলেছি। ডাঃ চৌধুরী তাগড়া পালোয়ানের মত। তাই কতকটা ভরসা ছিল নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারব। বাইরে রাস্তায় নামার পর হঠাৎ আমাদের সামনে দু’ তিনটি যুবক সংজ্ঞাহীন হয়ে ধরাশায়ী হলো। আমার পালোয়ান সাথীটি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন। আমিও পড়লাম। শুধু পড়েই গেলাম না। অর্ধ ডজন মানুষ আমার উপরে। কি করে বেঁচে গেলাম জানি না। তবে কালেমা পড়ছিলাম নিশ্চয়ই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দু’ তিন জন আমাকে ধরে তুলে বাইরে বের করে দিলেন। আমার সাথীটি কোথায় হারিয়ে গেলেন। আমার জামাকাপড় ধুলো মলিন। কয়েক স্থানে আঘাতও পেলাম।
তাগড়া যুবকদের সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ার ঘটনা এই একটি নয়-বহু। এমনটি হবেই না বা কেন? মাওলানার জানাযার সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের দূর-দূরান্ত ও প্রত্যন্ত এলাকা থেকে লোক লাহোরের দিকে ছুটেছে উন্মত্তের মত। ট্রেনে, বাসে, বিমানে, স্কুটারে, সাইকেলে- যে যেভাবে পেরেছে এসেছে। কেউ এসেছে পনেরো বিশ মাইল পায়ে হেঁটে। শোক-দুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও প্রখর রৌদ্র তাপ উপেক্ষা করে।
সবচেয়ে বড় কারণ হলো, মাওলানার সাহিত্য, তাঁর বিশ্বজনীন ইসলামী দাওয়াত এবং তাঁর আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব লক্ষ লক্ষ যুবককে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। জাহিলিয়াতের ঘন অন্ধকার থেকে তাদেরকে তাওহীদের উজ্জ্বল আলোকের দিকে টেনে এনেছে। তাদের চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, মন-মানসিকতার এনে দিয়েছে এক বিরাট বিপ্লব। মাওলানার প্রতি তাদের বিরাট আকর্ষণ, শ্রদ্ধা ও প্রগাঢ় ভালবাসার এই একটি মাত্র কারণ। মাওলানার মৃত্যু তাদেরকে পাগল ও দিশেহারা করেছে। এতোবড় এবং এ দরনের শোক তাদের জীবনে এই প্রথম। তারা সব মাওলানার রুহানী আওলাদ। তাই যুবকবৃন্দ নির্বিশেষে অনেকেই এ শোকের আঘাতে মুষড়ে পড়েছেন এবং সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন।
যাহোক, আধ মাইল দূরে রাখা হাশের ফারুকীর গাড়িখানা বহু কষ্টে খুঁজে বের করলাম। গাড়িতে কেউ নেই। শরীর কাঁপছে। দুটি চোখ দিয়ে পাহাড়ি ঝরণা ছুটছে। মিনিট দশেক পর ডাঃ চৌধুরী এলেন। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন সর্বনাশ হয়েছে।
বললাম, বেঁচে তো আছেন। এরপর সর্বনাশটা কিসের শুনি?
বললেন, আমি মরে গেলে দুঃখ ছিল না। আমার সাধের ক্যামেরাটি ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ। বড় সুন্দর সুন্দর বিশ-বাইশটা স্ল্যাপ নিয়েছিলাম। যা সম্বল করে ঘরে ফিরতাম-তাই আমার চলে গেল। [জনাব আজিজুল হক চৌধুরী ২০০৩ সালের ৭ই এপ্রিল ঢাকাস্থ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।]
একটু পরে হাশেম ফারুকী ও তাঁর বন্ধু এসে পড়লেন। মাইয়েতসহ ট্রাক আগেই রওয়ানা হয়েছে। তবে গতি অত্যন্ত মন্থর। ট্রাকে রয়েছেন মাওলানার পুত্রগণ-উমর ফারুক, আহমদ ফারুক, মুহাম্মদ ফারুক ও হুসাইন ফারুক। রয়েছেন মিয়া তুফাইল মুহাম্মদ ও অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ। বিদেশীদের মধ্যে ডঃ কারযারী, ডঃ তুতুঞ্জী এবং শেখ মুবারক আল-মুকাওয়া।
যায়লদার পার্কের সংকীর্ণ গলি দিয়ে মাওলানার বাভবনে মাইয়েতসহ ট্রাক যাবে যেখানে দাফন কার্য সমাপন করা হবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে যাবে কি করে? তাই শুধু বিশিষ্ট লোককে গলির মধ্যে ঢুকতে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদেশী মেহমান জামায়াত নেতৃবৃন্দ এবং জনাব আলতাফ হাসান কুরায়শীসহ চার-পাঁচ জন সাংবাদিক মাওলানার বাসভবন পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি পেয়েছেন।
মাওলানার খাস কামরার সামনে একটা উঁচু জায়গায় মাইয়েত রাখা হয়েছে। দু’পাশের বাড়ির বারান্দা ও ছাদের উপরে হাজার হাজার শোকার্ত মেয়ে-পুরুষ তাদের সজল দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে মাইয়েতের উপর। মাওলানার চিরন্তন বাসস্থান তৈরি হতে একটু বাকী। সংকীর্ণ পরিসর হলেও কয়েক হাজার লোক ভিড় করে আছে।
এমন সময় এক অপরূপ অথচ হৃদয়-বিদারক দৃশ্য দেখা গেল। বাড়ির ভেতর থেকে দু’টি কচি শিশু বেরিয়ে মাইয়েতের নিকটে এলো। একজন অপরজনকে বলছে- ওদিকে যেয়ো না দাদাজান ঘুমুচ্ছেন।
অন্যজন বলছে এত লোক এখানে কেন? দাদারজানের যে ঘুম ভেঙ্গে যাবে। এতোগুলো মানুষ রোজ এখানে এলে দাদাজান কাজ করবেন কি করে?
মাসুম বাচ্চাদের মিষ্টি মিষ্টি কথাগুো যাদের কানে পৌঁছল, তারা না কেঁদে পারল না। কচি বাচ্চাদের কত দরদ, কত চিন্তা তাদের প্রিয় দাদাজানের জন্যে। কিন্তু দাদাজান যে তাদেরকে ফেলে চলে গেছেন, দূরে-বহুদূরে-ধরা একটু পরেই সাইয়েদ ও মুরশিদ মওদূদীকে শয়ন করানো হলো তাঁর চিরন্তন শয্যায়। মানব ইতিহাসের একটা উজ্জ্বল অধ্যায়ের যবনিকাপাত হলো। হয়তো আমাদের শ্রুতির অগোচরে ধ্বনিত হলো-
*******************************************
হে প্রশান্ত আত্মা! ফিরে চলো তোমার রবের দিকে এমন অবস্থায় যে, তুমি তোমার পরিণামের জন্যে তুষ্ট এবং তুমি প্রিয়পাত্র তোমার রবের কাছে। অতএব আমার নেক বান্দাহদের মধ্যে শামিল হয়ে যাও এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে। (আল-ফজরঃ ২৭-৩০)
শেষের কথাগুলো কিন্তু পরদিন সত্যি সত্যিই নিজ কানে শুনতে পেয়েছিলাম। সকাল ন’টার দিকে গেস্ট হাউজ থেকে গেলাম ৫/এ যায়লদার পার্ক। এটা কোনদিনই ভাবিনি যে, এ স্থানটিতে আসব আর মাওলানাকে দেখতে পাব না- দেখব তাঁর চিরন্তন শয্যাঘর। বুকখানা অব্যক্ত বেদনায় মোচড় দিল। দেখলাম মাওলানার মাজার ঘিরে বিশ-পঁচিশ জন লোক। তাঁদের মাঝে রয়েছেন দেবল শরীফের পীর সায়েব। সকলের হাত উপরে উঠানো দোয়ার জন্যে। পীর সায়েবের মুখে প্রথমে একথাই শুনলাম-
****************************************
দোয়ার জন্যে হাত উঠানোই রয়েছে এবং তিনি বলেই চলেছেনঃ সাইয়েদ মওদূদী সারা জীবন হক কথা বলেছেন, হকের দাওয়াত দিয়েছেন, হকের উপর শেষ পর্যন্ত অটল ছিলেন। মানুষ টেপ রেকর্ডের মতো। আপনারা যে টেপ রেকর্ডার দেখেন তা মানুষের তৈরি। মানুষ টেপ রেকর্ডার আল্লাহর তৈরি। মানুষের তৈরি টেপ হাসে, কাঁদে, গান গায়, কথা বলে। কিন্তু সাইয়েদ মওদূদী আল্লাহর তৈরি এমন এক টেপ, যা দুনিয়াতেও হক কথা বলেছে, কবরেও চলছে এবং আখেরাতেও বলবে। —–
পীর সায়েব এমনি সব বলেই চলেছেন আর শ্রোতাদের চোখ দিয়ে টস টস করে অশ্রু ঝরছে।
পীর সায়েব দোয়া শেষ করে মুখ ফেরাতেই তাঁকে সালাম মুসাফাহ করলাম। বড্ডো ভাল লাগল তাঁর কথাগুলো। এ ছিল তাঁর আন্তরিক অনুভূতির অভিব্যক্তি।
আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ! আপাতত কিছুক্ষণের জন্যে একটু পেছনে ফিরে যাই। লাহোর থেকে চিকিৎসার জন্যে মাওলানার বিদেশ যাত্রা এবং সেখান থেকে পরপারে যাত্রার কিছু বিবরণ জেনে রাখা দরকার মনে করি।
চিকিৎসার জন্যে মাওলানার বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছার মোটেই ছিল না। হয়তো তিনি স্পষ্টই বুঝেছিলেন যে, চিকিৎসায় কোন লাভ হবে না। কারণ সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু এমন এক ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁর বিদেশ যাত্রা তরান্বিত করে। সউদী আরবের বাদশাহ খালিদ তাঁর বিশেষ চিকিৎসক ডাঃ মারুফ দাওয়ালিবিকে পাঠান মাওলানাকে দেখার জন্যে। তিনি মাওলানার সাথে দু’ঘন্টা পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা করেন। আলাপ চলাকালে মাওলানা কাউকে এটা অনুভব করতে দেননি যে, তাঁর স্নায়ুগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তারপর যেই মাত্র ডাঃ দাওয়ালিবি মাওলানার কক্ষ ত্যাগ করলেন মাওলানা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। এ ঘটনাটি সকলকে উদ্বিগ্ন ও ব্যাকুল করে তোলে। ডাঃ আহমদ ফারুক মাওলানাকে চিকিঃসার জন্যে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। কিন্তু বেগম মওদূদী এবং বাড়িসুদ্ধ সকলে মিলেও মাওলানাকে রাজী করানো গেল না। মাওলানা তাঁর পাসপোর্ট গোপনে রেখে দিয়েছেন। সকলেই অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অবশেষে মাওলানার হিসাবরক্ষক জনাব বশীর আহমদ বাট ফন্দিফিকির করে মাওলানার নিকট থেকে পাসপোর্ট হস্তগত করেন। তারপর ২৬ শে মে লাহোর থেকে ইসলামাবাদ এবং ইসলামাবাদ থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে মাওলানা লন্ডন রওয়ানা হন। লন্ডন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন এয়ার মার্শাল আসগর খান। বেগম মওদূদী ও মাওলানার সাথে যান এবং শেষ পর্যন্ত মাওলানার পাশেই ছিলেন।
নিউইয়র্ক থেকে সাড়ে চারশ মাইল দূরে বাফেলো শহরে মিলার ফিলমোর হাসপাতালে অপারেশনের জন্যে মাওলানাকে ভর্তি করানো হয়।
মাওলানার দ্বিতীয় পুত্র আহমদ ফারুক মওদূদী একজন প্রখ্যাত ডাক্তার (ব্রেইন স্পেশালিস্ট) এবং তিনিও এখানে থাকেন। হাসপাতালে ৪ঠা সেপ্টেম্বর মাওলানার অপারেশন হয়। নাড়ীতে ক্ষতের কারণে অপারেশন করতে হয়।
ডাক্তার বলেন, এরূপ অবস্থায় রোগী অসহ্য বেদনা অনুভব করে। কিন্তু মাওলানার তা হয়নি। আগের দিন মাওলানা কথাবার্তা বলতে পারেননি। অপারেশনের পর অবস্থা সন্তোষজনক ছিল। ঐদিন বেলা চারটায় মাওলানার জনৈক বন্ধু ডাঃ আমীরুল্লাহ হুসাইনী তাঁকে দেখতে যান। শরীর কেমন জিজ্ঞেস করলে মাওলানা বলেন যে, তিনি ভালো আছেন। ডাক্তার সাহেব দোয়া করতে বললে মাওলানা কোরআনের নিম্ন দোয়া করেনঃ
*********************************
তুমি আমাকে মুসলিম হিসাবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎ কর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর। -সূরা ইউসুফ (১০১)
পরদিন ৫ই সেপ্টেম্বর হৃদরোগের আক্রমণ হয়। আবার সাত তারিখ থেকে স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে থাকে। উনিশ তারিখ আবার হঠাৎ অবনতি ঘটে এবং হৃৎপিণ্ডের ব্যথা খুব বেড়ে যায়। একুশে দিনগত রাতে বেগম মওদূদী অনেক রাত পর্যন্ত স্বামীর শয্যাপাশে বসে সূরায়ে ইয়াসীন ইত্যাদি এবং দোয়া কালাম পড়ে তাঁকে আল্লাহ তায়ালার উপর সোপর্দ করে আসেন।
পরদিন অধিক সময় মাওলানা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কাটান। কিন্তু সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নামাযের সময় তার ডান হাতের শাহাদাত অঙ্গুলি উঠানামা করতো- যা সকলেই লক্ষ্য করেছেন। ২২শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৯ ইং) সকাল পৌঁনে ন’টায় ৭৬ বছর বয়সে মাওলানা তাঁর প্রকৃত মা’বুদের সাথে মিলিত হন- ইন্না লিল্লাহি ….।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টার আগে হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ অপসারিত করা যায় না। সর্বপ্রথম স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হয়। তারপর কফিন বাক্স তৈরি হবে। মৃতদেহ রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন হবে। তারপর মৃতদেহ অপসারণ করা যাবে। এতে অন্তত ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে। আবার কোন মৃতদেহ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিতে হলেও সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রহমত বলতে হবে যে, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আশ্চর্যজনকভাবে এসব কাজ সম্পন্ন করা হয়।
বিকেল চারটায় হাসপাতাল থেকে বাফেলো শহরের উপকণ্ঠে উইলিং রোডে অবস্থিত ডাঃ ফারুক মওদূদীর বাসস্থানে মাইয়েত স্থানান্তরিত করা হয়। তারপর কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান থেকে মাওলানার সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলিম, নওমুসলিম ও শোকার্ত জনতার ভিড় জমতে থাকে উইলিং রোডে। ২২শে সেপ্টেম্বর বাফেলো শহরে তিনবার নামাযে জানাযা আদায় করা হয়। প্রথমবার নামায পড়ান মাওলানা শরীফ বোখারী, দ্বিতীয়বার টরেন্টোর (কানাডা) কারী সাহেব এবং তৃতীয়বার লাহোর বাগে জিন্নাহ মসজিদের খতীব এবং আঞ্জুমানে খোদ্দামুল কোরআনের সভাপতি ডাঃ ইসরার আহমদ। তাঁরা শিকাগো থেকে বিমান যোগে পৌঁছেন। এই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত টরেন্টো, নিউইয়র্ক, শিকাগো, ডেট্রয়, মিশিগান, ইন্ডিয়ানা এবং অন্যান্য শহর থেকে অবিরাম লোক আসতে থাকে। ইরানের কাউন্সের জেনারেল সংবাদ পাওয়া মাত্র বাফেলোয় এ স প্রথম জানাযায় শরীক হন। মাইয়েতকে উইলিং রোডে যখন আনা হয়, তখন ডাঃ আহমদ ফারুক, বেগম মওদূদী, মাওলানার জামাই সাইয়েদ মাসউদ এবং বেগম মওদূদীর ভাই উপস্থিত ছিলেন। ডাঃ আহমদ ফারুক তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, “মাওলানা মওদূদী মরহুম যে মিশন নিয়ে সারাজীবন কাটালেন, সে মিশন নিয়ে আমাদের সকলকে সংগ্রাম করে যেতে হবে। আমাদের জন্যে আনন্দের বিষয় এই যে, মাওলানা তাঁর প্রকৃত সম্মানদানকারী আল্লাহ তায়ালার দরবারে হাযির হয়েছেন। আমরা তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে শুধু পাকিস্তানেই নয় বরং সারা বিশ্বে ইনশাআল্লাহ ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাব।”
ডাঃ আহমদ ইরানের কাউন্সেল জেনারেলকে বলেন, “মাওলানা বলেছিলেন তাঁর স্বাস্থ্য অনুমতি দিলে তিনি নিশ্চয়ই ইরানে যাত্রা বিরতি করে আসতেন। মাওলানা এ কথাও বলেছিলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব আমার হৃদয়ের স্পন্দন।”
বাফেলোতে একটি স্মরণীয় সাক্ষাৎকার
মাওলানা ২২ শে জুলাই উত্তর আমেরিকার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আগত পঁয়ত্রিশ জনের একটি প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎ দান করেন। এ সাক্ষাৎকার ডাঃ আহমদ ফারুকের বাসস্থানে হয়। মাওলানা তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের জওয়াব দেন ও অনেক সমস্যার সমাধান পেশ করেন। এ সময়ে তাঁর শরীরের অবস্থা বাহ্যত ভাল মনে হতো। মেজাযও বেশ হাসিখুশী ছিল। আলাপচারির মধ্যে স্বভাবসুলভ রসিকতাও করেন।
এ সময়ে নিউইয়র্ক থেকে একজন মাওলানার জন্যে পান নিয়ে আসেন। তারপর পান নিয়ে কথা উঠলো। জনৈক আনওয়ার বেগ বললেন, “মাওলানা, মনে হয় আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে পান অবশ্যই রেখে থাকবেন।”
তার উত্তরে মাওলানা রসিকতা করে বলেন, ভাই, আপনার হয়তো জানা নেই যে, পান আসলে জান্নাতেরই পাতা এবং সেখান থেকেই যমীনে এসেছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতাল থকে মৃতদেহ সরানো এবং তা আবার দেশান্তরে নিয়ে যাওয়া এক অতি দুষ্কর ব্যাপার আগে বলেছি। এ সব ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে সমাধা করার ব্যাপারে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে আগত মাওলানার ভক্ত অনুরক্তগণ যথেষ্ট সাহায্য করেন। নিউইয়র্কে জানাযার জন্যে সেখান থেকে বারবার টেলিফোনে অনুরোধ আসতে থাকে। ব্যবস্থাপনা কতদূর কি হলো এ সম্পর্কেও বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্বেগের সাথে টেলিফোনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। ডাঃ আহমদের বাড়িতে অবিরাম টেলিফোন ক্রিং ক্রিং করছিল।
ওদিকে মাওলানার মৃত্যু সংবাদ শুনামাত্র আল্লামা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খুমেনী বলেন, “মিল্লাতে ইসলামিয়া একেজন প্রখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ হারাল”। অতঃপর তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বাফেলোতে বেগম মওদূদীকে জানান যে, ইরানের বিমান মাওলানার মাইয়েত বহন করার মত মহান খিদমতের জন্যে প্রস্তুত। মৃত্যু সংবাদে বাদশাহ খালেদ মর্মাহত হয়ে বলেন, আল-উস্তাজ মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর ইন্তেকাল মুসলিম বিশ্বের জন্যে এক মর্মন্তুদ ঘটনা।” তিনিও জানিয়ে দেন যে, সউদী এয়ার লাইন্সের বিমান মাওলানার মাইয়েত বহনের সৌভাগ্য লাভের জন্যে প্রস্তুত। অনুরূপভাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক মাওলানার মৃত্যু সংবাদে শোকে অধীর হয়ে পড়েন এবং মাওলানার মাইয়েত বহনের জন্যে পিআইএ’র খিদমত পেশ করেন।
বেগম মওদূদী এসব সরকারের প্রতি এবং বিশেষ করে আল্লামা খুমেনী, বাদশাহ খালেদ এবং জেনারেল জিয়াউল হকের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “যে ব্যক্তি তাঁর সারা জীবনে কোনদিন একটি বারের জন্যেও কোন বিষয়ে কারও কাছে হাত পাতেননি, তাঁর মৃত্যুর পর এ ধরনের খিদমত গ্রহণে তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধাই দেখানো হবে। আমি সকলের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলছি, আমরা আমাদের আপন সাধ্যানুযায়ী এ কাজের আঞ্জাম দেব।”
একটা চার্টার্ড বিমানে বাফেলা থেকে ২৩শে সেপ্টেম্বর বৈকাল চারটায় মাইয়েত নিউইয়র্ক রওয়ানা করার এবং নিউইয়র্ক থেকে পানামের বিমানে রাতের বিমানে লন্ডন পাঠাবার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়।
এক শোকার্ত পরিবেশে অবিরাম অশ্রু বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধেয় মুরশিদে আ’ম-এর মাইয়েতকে শেষ বিদায় দেয়া হলো। তার আগে বেলা আড়াইটায় চতুর্থ বার বাফেলোতে নামাজে জানাযা পড়া হলো। অতঃপর চার্টার্ড বিমানখানি বাফেলোকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশে আকাশে তার পাখা মেলে উড়ে চলল। নিউইয়র্ক থেকে পানাম বিমান মাইয়েতসহ রাতের আঁধার চিরে লন্ডনের উদ্দেশ্যে আটলান্টিক মহাসাগরের আকাশপথে উড্ডীন হলো।
লন্ডন ও পাকিস্তানে সকলে এ ধারণা পোষণ করতেন যে, আটচল্লিশ ঘণ্টার আগে মাইয়েতের উপস্থিতি আশা করা যায় না। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে নিউইয়র্ক থেকে বিমান রওয়ানা হওয়ার পর এ সংবাদ লন্ডনে পৌঁছানো হয়।
জনৈক চৌধুরী মুহাম্মদ ইয়াসীন মাওলানা ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ট বন্ধু। মাওলানার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থাপনায় তিনিও শরীক ছিলেন। তিনি লন্ডনে ব্যবসা করেন। মাওলানাকে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর লন্ডন ফিরে আসেন এবং সব সময় ডাঃ আহমদ ফারুকের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। তিনি বলেন, “হঠাৎ ২৩ তারিখ রাতে আমরা লন্ডনে খবর পেলাম মাওলানার মাইয়েত নিউইয়র্ক থেকে রওয়ানা হয়েছে। তখন কোন পত্রিকায় সংবাদ দেয়ার সময় ছিল না। শুধু টেলিফোনের মাধ্যমে সকল স্থানে খবর পৌঁছানো হলো।”
নিউইয়র্ক থেকে বিমানটি পরদিন অর্থাৎ ২৪শে সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় লন্ডন বন্দরে অবতরণ করে। ‘আল্লাহু আকবর’ লন্ডন বিমান বন্দরের ইতিহাসে এত বড় গণজমায়েত অতীতে কখনো হয়নি। বিমান পৌঁছুবার পূর্বেই বিমান বন্দর লোকে লোকারণ্য হয়। বিমান বন্দরের দিকে অবিরাম অশ্রুকাতর মানুষের স্রোত দেখা যায়।
বিমান থেকে মাইয়েতের সাথে অবতরণ করেন বেগম মওদূদী, ডাঃ আহমদ ফারুক ও সাইয়েদ মাসউদ। বিমান বন্দরে ক্রন্দনরত হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠ থেকে কালেমায়ে শাহাদাত ও আল্লাহু আপকবর ধ্বনি গুঞ্জরিত হতে থাকে। বিমান থেকে মাইয়েতকে নামিয়ে পি.আই.এ’র শালিমার লাউঞ্জে রাখা হয় এবং ৪৭নং টার্মিনালে নামাযে জানাযার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমবার জনাব খুররম জাহ মুরাদ এবং দ্বিতীয়বার অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। তারপর বার্মিংহাম থেকে কয়েকটি বাসভর্তি লোক এসে হাজির হন। এবার নামাযে ইমামতি করেন ইউ.কে ইসলামিক মিশনের সহ-সভাপতি। তারপরও অবিরাম লোক আসতে থাকে। পিআইএ-র বিমান ছাড়তে বেশ বিলম্ব হয়। তার ফলে আরও দু’বার জানাযার নামায আদায় করা হয়। বিমান বন্দরে দেশ-বিদেশের বহু সাংবাদিক উপস্থিত হন। তাঁরা মন্তব্য করেন, শোকে মুহ্যমান এমন জনসমুদ্র তারা কোনদিন দেখেননি এবং কল্পনাও করেননি।
মাওলানার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জ ন্য বিমান বন্দরে উপস্থিত হন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ উপদেষ্টা জনাব মুয়াযযম আলী, ইসলামিক কাউন্সিল অব ইউরোপের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব সালিম আযম এবং বহু দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিগণ।
সন্ধ্যায় বিলম্বে পিআইএ’র বিমান মাইয়েতসহ রওয়ানা হয় এবং আমস্টার্ডাম, দামেশক ও দুবাই হয়ে পরদিন (৩৫/৯/৭৯) সকাল দশটায় করাচী বিমান বন্দরে অবতরণ করে।
পঁচিশ তারিখে করাচীর ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা।
সকাল ন’টা থেকে করাচী বিমান বন্দরে লোক জমা হতে শুরু হয়েছে। এ দিন ছিল করাচী মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নির্বাচনের দিন। অধিকাংশ যানবাহন নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত। তথাপি বহু কষ্টে লোক সমান বন্দরের দিকে ছুটছে।
সাড়ে ন’টায় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমীর মিঞা তুফাইল মুহাম্মদ করাচী জামায়াত নেতৃবৃন্দ এবং দশ-বারোজন সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারসহ ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশ করছেন। চেহারা মলিন ও শোকার্ত। পিয়াসীর স্বেচ্ছাসেবকগণ সারিবদ্ধ হয়ে শৃঙ্খলা রক্ষার কাচে দণ্ডায়মান। বাইরে বারান্দায় কয়েকজন বোরকা পরিহিতা মহিলা ক্রন্দনরত। হাজার হাজার লোক বিমানের অপেক্ষায়। ঘোষণা হলো বিমান পৌঁছুতে কিছু বিলম্ব হবে- দশটায় নয়, সাড়ে দশটায়। লাউড স্পীকারে ঘোষণা করা হলো, বিমান পৌঁছুবার পনেরো মিনিট পরে এক মাইল দূরে বিমান বন্দর স্টেডিয়ামে জানাযার নামায হবে। লোক সেদিকেই দৌঁড়াতে থাকে।
মিঞা সায়েব ভিআইপি লাউঞ্জে শোকার্ত জনতার মধ্যে নির্বাক বসে আছেন। খানিক পরে সরদার শেরবাজ মাজারী লাউঞ্জে প্রবেশ করে মিঞা সায়েব, জান মুহাম্মদ আব্বাসী এবং অন্যান্যের সাথে গলা মিলিয়ে শোক প্রকাশ করতে থাকেন।
এমন সময় জনৈক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী মিঞা সায়েবকে সালাম করে বলেন, “আমি আসছি রাশিয়া থেকে। সেখানে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করতে গিয়েছিলাম। যখনই সম্মেলনে মাওলানার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছল, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোকের হাত উপরে উঠল দোয়ার জন্যে।”
তিনি আরও বলেন, “মাওলানার মৃত্যুতে ক্ষতি শুধু তাঁর পরিবার ও জামায়াতে ইসলামীর নয়, বরং গোটা মুসলিম বিশ্বের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।”
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি কথাগুলো বলেন।
ঠিক দশটায় বিমান রানওয়েতে নেমে পড়ে ভিআইপি লাউঞ্জের সামনে দাঁড়াল। শত শত লোক কান্নায় ভেঙে পড়ল। কয়েকজন শোকে মুহ্যমান হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
বিমান থেকে প্রথমে নামলেন ডাঃ আহমদ ফারুক। অতঃপর বেগম মওদূদী। তাঁর পেছনে অধ্যাপক খুরশীদ, সাইয়েদ মাসউদ এবং ‘ডন ট্রাভেলস লন্ডন’-এর চৌধুরী মুহাম্মদ ইয়াসিন। এ পাঁচজন এলেন মাইয়েতের সাথে।
ভিড়ের মধ্যে বহু কষ্টে মাইয়েতকে ট্রাকে উঠানো হলো। ট্রাকের উপরে মিঞা সায়েব, ডাঃ আহমদ, অধ্যাপক খুরশীদ প্রমুখ নেতাগণ। জনসমুদ্রের মধ্য দিয়ে ট্রাকটি বিমান বন্দর স্টেডিয়ামের দিকে রওয়ানা হলো। এগারোটা পাঁচ মিনিটে জানাযার নামায পড়ালেন মিঞা তুফাইল মুহাম্মদ সায়েব।
নামাযের পর মাইয়েতকে আবার ট্রাকে উঠানো হলো। এবার ট্রাকে অন্যান্যের মধ্যে রয়েছেন সিন্ধুর গভর্ণর জেনারেল আব্বাসী। এতক্ষণ পর্যন্ত লোক অসীম ধৈর্যের সাথে নিজেদেরকে সংযত রেখেছিলেন। কিন্তু এবার তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। অসংখ্য মানুষ সারা শহর থেকে বিমান বন্দরে হাযির হয়েছে। এমন কে আছে যে শেষ বিদায়ের সময় তার প্রিয় নেতার মুখখানা শেষবারের মত দেখে নেবে না? সকলে উন্মাদের মত ট্রাকের পিছনে ছুটছে। সকলেরই বাসনা একবার মাইয়েত স্পর্শ করবে- একবার জ্যোতির্ময় চেহারাখানা প্রাণভরে দেখে দেবে। এ যে শেষ বিদায়ের মুহূর্ত। যিনি তাদের সুপ্ত আত্মাকে জাগিয়ে দিয়েছেন, বিবেকের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, তিনি আজ নিজেই সুপ্ত ও নীরব। তিনি তাঁর কাজ সমাধা করে আপন প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। বারবার ধ্বনিত হতে লাগল- ‘আল্লাহু আকবর’ এবং তার সাথে ’সাইয়েদী-মুরশেদী-বিদায়-বিদায়’।
মাইয়েতকে বিমানে উঠানোর দৃশ্য আরও হৃদয় বিদারক। কতজন একে অপরকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। কতজন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। বেলা একটায় মাইয়েত বিমানে উঠানোর পর বিমানের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। দেড়টায় বিমান লাহোরের পথে আকাশে তার দু’টি পাখা মেলে উপরে উঠে। বিমানের বিকট শব্দ শোক-সন্তপ্ত প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আঘাত করতে থাকে। যদি তাদেরও দু’খানা করে পাখা থাকত, তাহলে পাখির ঝাঁকের মত বিমানের সাথে উড়ে চলত। তাই হাতাশা, দীর্ঘশ্বাস, অশ্রু-এ তিনের সাথে তাদের মুখে ছিল প্রিয় মুরশিদের জন্যে প্রাণভরা দোয়া।