এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়বস্তু
এ বিরাট গ্রন্থখানার প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে ইসলামী জেহাদের মর্যাদা, আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ, ইসলাম প্রচার ও তরবারি এবং যুদ্ধ ও সন্ধি সম্পর্কে ইসলামী আইন কানুনের উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী ও খ্রিষ্টান ধর্মের যুদ্ধনীতি। সপ্তম অধ্যায়ে বর্তমান সভ্যতার অধীনে পরিচালিত যুদ্ধ-সন্ধিকে আলোচনার বিষয়বস্তু করা হয়েছে।
এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, বিষয়টির উপর এমন তথ্যবহুল যুক্তিপূর্ণ ও প্রামাণ্য গ্রন্থ দুনিয়ার কোন ভাষায় কোন গ্রন্থকারের দ্বারা লিখিত হয়নি। এ সন্মান ও খ্যাতি আল্লাহ তায়ালা দান করেন মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীকে।
তর্জুমানুল কোরআন
উপরে বলা হয়েছে ”আল জিহাদু ফিল ইসলাম” গ্রন্থের দ্বারা মাওলানা মওদুদী নিজে সবচেয়ে বেশী উপকৃত হয়েছেন। এ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে তিনি পাঁচ-ছয় বছর যাবত গভীর অধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জনের পর ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের হায়দারাবাদ থেকে মাসিক পত্রিকা ‘তর্জুমানুল কোরআন’ প্রকাশ করে বিরামহীন সংগ্রাম শুরু করেন। একাকী আর্থিক দৈন্যের ভেতর দিয়ে একটা সুপ্ত জাতিকে জাগ্রত করে সথ্যের পথে পরিচালিত করতে তিনি যে বিপ্লবী আহবান জানিয়েছিলেন, তর্জুমানুল কোরআনের পাতায় পাতায় তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
তর্জুমানুল কোরআনের প্রকাশনা
ইংরেজী ১৯৩১ সালের ৩১শে জুলাই মাওলানা মওদুদী দিল্লী থেকে হায়দারাবাদ প্রত্যাবর্তন করেন। হায়দারাবাদ শহরে জনৈক নেক্ দিল মুসলমান আবু মুহাম্মদ মুসলেহ সাহেব ‘তর্জুমানুল কোরআন’ নামে একখানা মাসিক পত্রিকা কিছুদিন যাবত বের করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল কোরআনের পবিত্র বাণী ঘরে ঘরে পৌছেঁ দেয়া। তিনি মওলানা মওদুদীর প্রজ্ঞা, প্রতিভা, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় দক্ষতা এবং সর্বোপরি তাঁর অসাধারণ ইসলামী জ্ঞানের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তর্জুমানুল কোরআনের সম্পাদনার ভার তাঁর উপর ন্যস্ত করেন। ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের কাজে পত্রিকাটিকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারবেন মনে করে মাওলানা এ দায়িত্ব-ভার গ্রহণ করেন। তখন থেকে পত্রিকাটির পশ্চাৎ পৃষ্ঠায় (Back Page) নিম্নের কথাগুলো প্রতি মাসে ছাপা হতে থাকেঃ
“সমগ্র ভারতে এ ধরনের পত্রিকা মাত্র একটি। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করা ও জিহাদ ফী-সাবীবিল্লাহর ডাক দেয়া। দুনিয়ায় যেসব চিন্তাধারা, মতবাদ ও সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলনীতি ছড়ানো হচ্ছে, কোরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে তার পর্যালোচনা-সমালোচনা করা, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিকতা- মোটকথা প্রতিটি বিষয়ের কোরআন ও সুন্নাহর উপস্থাপিত মূলনীতির আলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা এ পত্রিকাটির মূল লক্ষ্য ও আলোচ্য বিষয়। এ পত্রিকাটি উম্মতে মুসলেমাকে এক নব জীবনের দাওয়াত দিচ্ছে। তার দাওয়াতের সারমর্মঃ “নিজের মন-মস্তিষ্ককে মুসলমান বানাও। জাহেলিয়াতের রীতি-পদ্ধতি পরিহার করে ইসলামের সিরাতুল মুস্তাকীমের উপরে চলো। কোরআন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ো এবং দুনিয়ার বুকে বিজয়ীর বেশে অবস্থান কর।”
উল্লেখ্য যে, আবু মুহাম্মদ মুসলেহ সাহেবের মালিকানাধীন যে তর্জুমানুল কোরআনের সম্পাদনা মাওলানা করছিলেন, ১৯৩২ সালের প্রারম্ভেই তার মালিকানা তিনি খরিদ করে স্বাধীনভাবে দ্বীন ও মিল্লাতের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন।
তাঁর সম্পাদনায় ১৯৩২ সালে তর্জুমানুল কোরআনের প্রথম সংখ্যার তৃতীয় পৃষ্ঠায় তিনি বলেনঃ “ইসলামকে তার প্রকৃত আলোকে পেশ করতে হবে, যে আলোকে কোরআন হাকীম তাকে পেশ করেছে।”
পঞ্চম পৃষ্ঠায় বলেনঃ “মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সকলকেই কোরআন উপলব্ধি করতে সাহায্য করতে হবে — এবং ঐসব সন্দেহ সংশয় দূর করতে হবে — যা কোরআন অধ্যয়নকারীদের মনে সৃষ্টি হয়।
পত্রিকাটির ১৫০ পৃষ্ঠায় জীবন সম্পর্কে ইসলামী ধারণা সম্ভবতঃ তিনিই প্রথম এভাবে পেশ করেন-
“ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়া না তো এমন কোন পরিত্যাজ্য ঘৃণ্য ও বস্তু আর না এমন কোন বস্তু যার প্রতি মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে পড়বে। আর না তার আনন্দ সম্ভোগে নিজেকে বিলীন করে দেবে। না সে একেবারে প্রশান্তি, আর না একেবারে অমঙ্গল, অশান্তি। তার থেকে দূরে থাকাও ঠিক নয় এবং পুরোপুরি তার মধ্যে নিমজ্জিত থাকাও ঠিক নয়। না সে পুরোপুরি অপবিত্র ও আবিলতাপূর্ণ, আর না পুরোপুরি পবিত্র-পরিচ্ছন্ন। তারপর এ দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক তো এমন হওয়া উচিত নয়- যেমন রাজ্যের সাথে বাদশাহের হয়ে থাকে। এমনও হওয়া উচিত নয়- যেমন কোন কয়েদীর জেলখানার সাথে মাথা নত করবে। আর এতটা বিজয়ী ও পরাক্রমশালী নয় যে, প্রতিটি বস্তু তার সামনে মাথা নত করবে। সে এতটা অসহায় নয় যে, তার ইচ্ছা কোন বস্তুই নয় এবং সে এতটা শক্তিশালী নয় যে, তার ইচ্ছা ও মর্জিই সব। না সে সৃষ্টিজগতের নিরঙ্কুশ শাসক, আর না সে অসংখ্য অগণিত প্রভুর অসহায় গোলাম। প্রকৃত সত্য যা কিছু তা হলো এ দুই প্রান্তিকতার মাঝে এক মধ্যম অবস্থা।
তাঁর পত্রিকা দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করলে তিনি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে মন্তব্য করেন-
‘তর্জুমানুল কোরআন’ আমার সম্পাদনায় প্রথম বর্ষ অতিক্রম করে দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করছে। এই এক বছরের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁর দ্বীন এবং অমূল্য গ্রন্থ কোরআন পাকের খেদমত করার যে শক্তি আমাকে দিয়েছেন এবং কঠিন নৈরাশ্যজনক অবস্থার ভেতর দিয়েও যেভাবে আমাকে এ কাজের জন্যে অটল ও অবিচল রেখেছেন তার জন্যে তাঁর শুকরিয়া জ্ঞাপন করা আমার একান্ত কর্তব্য বলে মনে করি। অবশ্য তাঁর অনুগ্রহ ও দানের তুলনায় আমার এ কৃতজ্ঞতা অতি নগণ্য। যে অবস্থার ভেতর দিয়ে আমি এ পত্রিকার সম্পাদনা ভার গ্রহণ করি এবং পরবর্তী মসয়ে যে সকল বিপদের সম্মুখীন আমাকে হতে হয়, তাতে যদি আমি একমাত্র খোদার উপর ভরসা না করে পার্থিব উপায়-উপাদান এবং নিজের শক্তি সামর্থ্যের উপর নির্ভর করতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমি হতাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু খোদাকে ধব্যবাদ, পার্থিব কোন কিছুর উপরই আমার কণামাত্র ভরসা ছিল না এবং একমাত্র আল্লাহরই অনুগ্রহের উপর নির্ভর করেছিলাম। খোদার এ প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে সত্য যে, যে ব্যক্তি তাঁরই পথে ধৈর্য ও নিষ্ঠা সহকারে চেষ্টা-চরিত্র করে, তার সাফল্য সুনিশ্চিত এবং দুঃখ-কষ্টও তাকে স্পর্শ করতে পারে না।” (মর্জুমানুল কোরআন, মুহররম, ১৩৫৩ হিঃ)।
বিরাট বিপদ ও আর্থিক দৈন্যের সম্মুখীন হয়েও মাওলানা মাওদূদী মানুষের নিকট সাহায্য প্রার্থনা বা নতি স্বীকার করেননি। এটা প্রভুর সাথে তাঁর গভীর সম্পর্কেরই পরিচায়ক। হায়দারাবাদ নিযাম রাজ্যের ধর্মীয় বিভাগ প্রতি বছর কয়েক শত সংখ্যা তর্জুমানুল কোরআন ক্রয় করত। একবার তা বন্ধ করে দেয়া হয়। নওয়াব যুল কদর জঙ বাহাদুর উক্ত বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে, মাওলানা স্বয়ং তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে অনুরোধ ও তোষামোদ করলে তিনি তাঁর পত্রিকা অধিক সংখ্যায় পুনর্বার খরিদ করার ব্যবস্থা করবেন। হাওলানা এ সংবাদ শুনে বললেন, “আমি কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকলেও তাঁর কাছে যাব না। কারণ, এ আমার ব্যক্তিগত কাজ নয়, বরং দ্বীনের কাজ।”
এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই মাওলানাকে বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
পত্রিকাটি তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করলে মাওলানা নিম্নোক্ত সম্পাদকীয় লেখেন-
“এ মাস থেকে ‘তর্জুমানুল কোরআনের’ তৃতীয় বর্ষ শুরু হচ্ছে। প্রথম বছর দৈন্যের ভেতর দিয়ে কেটেছে। দ্বিতীয় বছর খোদার অনুগ্রহে কিছুটা স্বাচ্ছল্য দেখা যায়। তৃতীয় বছর পুনরায় বিপদ ও দৈন্যের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু যাই হোক, সুখে-দুঃখে একমাত্র আল্লাহ্ রই উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ তিনিই একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও ভরসা-স্থল। তিনি তো দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, নিশ্চয়ই দুঃখের পরে সুখ আসবে এবং তা অনিবার্য। অতএব, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, যদি আমরা বিপদেও দ্বীনের খেদমতে অটল থাকি এবং আল্লাহকেই একমাত্র সাহায্যকারী ও মনোবাঞ্ছা পূরণকারী মনে করে তাঁর উপর নির্ভর করে থাকি, তাহ হলে তাঁর অনুগ্রহ-কণা সুখের আকারে আমাদের সম্মুখে এসে দাঁড়াবে। আমরা জানি যে, যাবতীয় বিপদ, লাঞ্ছনা ও দুঃখ-দারিদ্র্য আমাদের পরীক্ষার জন্যেই হয়ে থাকে।”
উক্ত সম্পাদকীয় প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন,
“বর্তমান মুসলমান জাতির অবস্থা এক অনুর্বর ভূমিখন্ডের ন্যায়, সেখানে নিকৃষ্ট গাছপালা প্রভূত পরিমাণে উৎপন্ন হয়। কিন্তু উৎকৃষ্ট ধরনের বৃক্ষ সেখানে উৎপন্ন হতে পারে না। আমাদের চোখের সামনে বহু কল্যাণ ও মঙ্গলের বীজ মাটির তলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কোথাও আবার বীজ অংকুরিত হলেও তা মূল বিস্তার করতে না পেরে শেষ হয়ে গেল। …. কিন্তু আমার মতে কোন পুরুষ মুসলমানের কাজ এ হতে পারে না যে, ভূমির অনুর্বরতা, মওসুমের প্রতিকূল আবহাওয়া এবং পানির স্বল্পতা দেখে তাকে নিরুৎসাহে বসে থাকতে হবে। আদিকাল থেকে এটাই তো প্রকৃতির বিধান রয়েছে যে, অনুর্বর জমিতে হাল কর্ষণ করতে হবে, তার কাঠিন্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। আপন ঘর্ম এমন কি প্রয়োজন হলে রক্তবিন্দুর দ্বারাও সেই মাটিকে সিক্ত করতে হবে এবং ফলাফলের চিন্তা না করে বীজ বপন করতে হবে। যদি তার চেষ্টায় অনুর্বর জমি শস্য শ্যামল হয়ে পড়ে, তা হলে তো কোন কথাই নেই। কিন্তু যদি সেই অনুৎপন্ন জমিতে তার সারা জীবন ব্যর্থ পরিশ্রমে কাটিয়ে অবশেষে একদিন মৃত্যুবরণ করে, তবুও প্রকৃতপক্ষে এটা তার পরাজয় নয়। একি তার কম সাফল্যের কথা যে, যে কাজকে সে অবশ্য করণীয় (ফরয) মনে করতো, সে তার জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তার উপরেই অবিচল ছিল এবং কোন ব্যর্থতাই তাকে কর্তব্য-কর্ম থেকে বিমুখ করতে পারে নি? (তর্জুমানুল কোরআন, মুহররম, ১৩৫৪ হিঃ)।
খোদার প্রেম ও ভালবাসা, তাঁর সাথে গভীর নিবিড় সম্পর্ক, তাঁরই উপর নির্ভরশীলতা এবং তাতেই আত্মবিলীনতা–এসব কিছুই ঐ সব পথিকের পাথেয় যারা চলতে চায় আল্লাহর পথে। মাওলানা মওদূদীর পরিত্রেও আমরা এ সবেরই পরিচয় পাই। উপরিউক্ত সম্পাদকীয় প্রবন্ধ এবং তাঁর প্রত্যক্ষ কার্যকলাপ তাই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে ।
তর্জুমানুল কোরআন চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ করলে তিনি তার সম্পাদকীয় স্তম্ভে মন্তব্য করেন-
“এটা কি খোদার কম অনুগ্রহ যে, দ্বীনের বিরাট খেদমতের জন্যে তিনি আমার ন্যায় একজন নগণ্য ব্যক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন? যদি জ্ঞান, খোদাভীতি, ঐকান্তিকতা এবং জাহেরী ও বাতেনী পূর্ণ জ্ঞানের ভিত্তিতে কোন ব্যক্তিকে এ কাজে নিযুক্ত করা হতো তা হলে কশ্মিনকালেও আমি এ কাজের যোগ্য বিবেচিত হতাম না। উপরন্তু তাঁর অধিকতর অনুগ্রহ এই যে, আমার সমস্ত ত্রটি বিচ্যুতি উপেক্ষা করা হয়েছে। আমি জ্ঞানহীন ছিলাম তিনি আমাকে জ্ঞান দান করেছেন। পথভ্রষ্ট ছিলাম, তিনি সুপথ দেখিয়েছেন। অনন্যোপায় ও নিরুৎসাহ ছিলাম। তিনি আমাকে ধৈর্য, সাহস এবং আপন সংকল্পে দৃঢ়তা দান করেছেন। সহায় সম্বলহীন ছিলাম– তিনি অদৃশ্য ভাণ্ডার থেকে প্রতি পদে পদে সাহায্য দান করেছেন এবং প্রতিটি বিপদকে এমন সহজ করে দিয়েছেন যে, তা আমার কল্পনার অতীত। আমি জ্ঞান পিপাসু– তিনি ব্যতীত এ পিপাসা নিবারণ করার আর কেউ নেই। আমার জ্ঞান বুদ্ধিতে অগণিত ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। তা দূর করার যদি কেউ থাকেন তো একমাত্র তিনিই আছেন। আমার মন ব্যাকুল, আত্মা অধীর চঞ্চল, আমার মস্তিষ্ক অশান্ত। একমাত্র তিনিই আমার এ ব্যাধি নিরাময় করতে পারেন। আমি পাপ সমুদ্রে ডুবে আছি। আমার কাজে অসংখ্য দোষ-ত্রুটি আছে। স্বাভাবিক দুর্বলতা আমাকে পদে পদে খোদার সন্তুষ্টি বিধানের পথ থেকে বিচ্যুত রাখছে। খোদা ব্যতীত আর এমন কেউ নেই যিনি আমার এ দোষগুলি দূর করতে পারেন। আমি তাঁর নিকট সুষ্ঠু চিন্তাশক্তি ও পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রার্থনা করছি। একমাত্র আল্লাহরই জন্যে ভালবাসা ও হিংসা পোষণ করার শক্তি প্রার্থনা করছি।”
(মর্জুমানুল কোরআন, মুহররম, ১৩৫৫ হিঃ)
একজন খোদাপ্রেমিক ও একনিষ্ঠ সাধকের অন্তরাত্মার অভিব্যক্তিই উপরিউক্ত ভাষায় পরিষ্ফুট হয়েছে। আপন পাপ চিন্তায় নতশির। অযোগ্যতার জন্যে লজ্জিত, অবনত। সিরাতুল মুস্তাকীমের উপরে চলবার উগ্র বাসনা, জ্ঞান পিপাসায় কাতর, আপনাকে প্রভুর সামনে হেয়-বিনীত, ধুলায় লুণ্ঠিতকরণ, প্রভু-প্রেম লাভের জন্যে আকুল আগ্রহ-এত সবকিছুই পাগল প্রেমিক মর্দে মুমিনেরই পরিচায়ক।
উপরের বর্ণনা থেকে একথা পরিস্কার জানতে পারা যায় যে, তিনি কেমন প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে ধীর-স্থির চিত্তে মুসলমান জাতিকে সত্যের দিকে আহবান জানাচ্ছিলেন। ক্রমাগত ছ’-সাত বছর তিনি এভাবে পাক-ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে একটা চেতনা সঞ্চার করার চেষ্টা করেন। বন্ধুর পথে একাকী একটানা সংগ্রাম করে চলেছেন তিনি। বুকে অসীম সাহস, হাতে দুর্বার লেখনীশুক্ত, খোদার উপর পরিপূর্ণ ভরসা। তবু মানব সুলভ স্বাভাবিক দূর্বলতাহেতু কখনো গভীর দুঃখ ও বেদনা ফুটে উঠেছে। তিনি তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে মন্তব্য করেন-
–“এ পত্রিকাটির সর্বধিক উন্নতি সাধনই আমার অন্তরের একান্ত অভিলাষ। কিন্তু যে ধরণে এটি প্রকাশিত হচ্ছে তাতে আমি সন্তুষ্ট নাই। আমি চাই এ যেন একটা বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হয়। এ যেন মানবীয় চিন্তাধারাকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোক আভায় উদ্ভাসিত করে এবং খাটিঁ ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতেই উক্ত চিন্তাধারা পরিশুদ্ধ, আলোকিত ও বিকশিত হয়। যে ইসলামকে অতীতের নিছক স্মরণীয় একটা অনুৎপন্ন জড়পদার্থে পরিণত করে রাখা হয়েছে, এ পত্রিকাটি যেন তাকে গতিশীল এবং জীবন ব্যবস্থার জণ্যে সক্রিয় আন্দোলন ও বিপ্লব সৃষ্টিকারীরূপে জনসমাজের সামনে তুলে ধরতে পারে। উচ্চাঙ্গ সমালোচনা ও প্রতিবাদের দ্বারা পৃথিবী থেকে এক একটি করে ইসলাম বিরোধিতার মূলোৎপাটন করবে এবং গভীর তথ্যানুসন্ধানের দ্বারা জীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান ইসলামের মৌলিক নীতির ভিত্তিতেই করবে- এই আশা আমি করি। গত ছ’বছর যাবত এই আশা হৃদয়ে পোষণ করে আমার সর্বশক্তি প্রয়োগে উক্ত অভীষ্ট সিদ্ধির চেষ্টা করছি। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় এ পথে আমি সম্পূর্ণ একাকী, উপায়-উপাদান ও সহায়-সম্বলহীন। আমার শক্তি-সামর্থ্য সীমাবদ্ধ। সুতরাং যা আমি করতে অভিলাষী, তা আমি করতে পারছি না। চারদিকে সহযোগী-সহকর্মী অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছি। কোথাও তার সন্ধান মিলছে না। জনবহুল এ শহরে নিজেকে নিঃসঙ্গ, অপরিচিত ও আগন্তুক মনে করছি। যার প্রেমে আমি উদভ্রান্ত, সে প্রেমাস্পদের সন্ধান নেই। বছরের পর বছর ধরে যাদের নিকট আমার মনোভাব ব্যক্ত করছি, তাদের নিকটবর্তী হলে মনে হয়, তার আমা থেকে বহু দূরে। তাদের আকাঙ্ক্ষা আমার আকাঙ্ক্ষা থেকে পৃথক। তাদের জীবনের লক্ষ্য আমার লক্ষ্য থেকে স্বতন্ত্র। তাদের অন্তরের কাছে আমার অন্তর অপরিচিত। তাই আমার আকুল আহ্বান তাদের কর্ণগোচর হয় না। আমি যেন একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে বাস করছি।”
যা হোক আশা-নিরাশা ও আঘাত-প্রত্যাঘাতের ভেতর দিয়ে ‘তর্জুমানুল কোরআন’ সামনের দিকে এগয়েই চললো তার দু’ধারী তলোয়ার দিয়ে মুসলমানদের চিন্তারাজ্যের স্তূপীকৃত জঞ্জাল ও নৈরাশ্য পরিষ্কার করে, তার হেদায়াতের মশাল দিয়ে দিগ্ দিগন্ত আলোকিত করে।
দারুল ইসলামে মাওলানা মওদূদী
ঊনিশ শ’ আটত্রিশ সনের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী দাক্ষিণাত্যের হায়দারাবাদ থেকে পূর্ব পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার পাঠানকোট নামক স্থানে হিজরত করেন। আল্লামা ইকবাল মরহুমের পরামর্শে পাঠানকোট শহর থেকে প্রায় চার মাইল দূরে ‘দারুল ইসলাম’ নামে একটি ইসলামী গবেষণাগার স্থাপিত হয়। ১৯৩৮ সন থেকে ভারত বিভাগের সময় পর্যন্ত দারুল ইসলাম শুধুমাত্র ইসলামী গবেষণাকেন্দ্রই ছিল না, বরঞ্চ এখান থেকে বেশ কিছু সংখ্যক ইসলামের সাচ্চা সৈনিক ও মর্দে মুজাহিদও তৈরি হয়েছিলেন।
এ কথা উল্লেখযোগ্য যে, পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিক ইকবাল মাওলানা মওদূদীর প্রকাশিত তর্জুমানুল কোরআন নিয়মিত পাঠ করতেন। তিনি মাওলানার বিপ্লবী চিন্তাধারা ও প্রবন্ধাবলীর দ্বারা এতখানি প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাকেঁ মাঝে মাঝে এরূপ মন্তব্য করতে শোনা যেতো “একমাত্র এ মওদূদীই বিভ্রান্ত ভারতীয় মুসলমানদেরকে একটা সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে।” কারণ দার্শনিক ইকবাল মাওলানার মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন ভবিষ্যতের এক মহান মানুষের সুস্পষ্ট নিদর্শন। মাওলানার বিভিন্নমুখী প্রতিভা, কর্মদক্ষতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও নিষ্কলুষ চরিত্রের পরিচয় পেয়ে কবি ইকবাল তাকেঁ লাহোর ডেকে পাঠান। এটাই ছিল কবি ইকবালের সাথে মাওলানার প্রথম সাক্ষাত পরিচয়। আলাপ-আলোচনার মূল বিষয় এই ছিল যে, পাঞ্জাবকেই মাওলানার কর্মস্থল বানানোর জন্যে বিচক্ষণ কবি অনুরোধ করেন। সাক্ষাতের পর মাওলানা পুনরায় হায়দারাবাদ গমন করেন।
মিল্লাতে ইসলামিয়ার ভবিষ্যত সঠিক কর্মপন্থার জন্যে যাঁরা চিন্তা ও পরিকল্পনা করছিলেন, তাদেঁর মধ্যে চৌধুরী নিয়ায আলী খান সাহেবও একজন ছিলেন। তিনি তাঁর পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর চিত্র কবি ইকবালের নিকট পেশ করেন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে কবি এ বিষয়ে কিছু করতে তাঁর অক্ষমতা জ্ঞাপন করে বলেন, “যেমন করেই হোক মাওলানা মওদূদীকে ‘দারুল ইসলামে’ নিয়ে আসুন।”
এখানে একটি মজার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার পাঞ্জাবের পতোকী শহর ভ্রমণের আমার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলাম জনৈক বুযুর্গ হাকীম নে’মাত আলীর গৃহে। তিনি আমার কাছে যে ঘটনাটি বিবৃত করেন তা এই-
জনৈক খোদাপ্রেমিক চৌধুরী নিয়ায আলী খান তাঁর বিরাট সম্পদ দ্বীনের কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করার উদ্দেশ্যে বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শ চান। তাঁর জনৈক বন্ধু এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা করার জন্যে তাকে আল্লাম ইকবালের নিকট যেতে বলেন। অতঃপর চৌধুরী নিয়ায আলী খান আল্লামা ইকবালের সাথে সাক্ষাত করে তাঁর মনের বাসনা তাঁর কাছে ব্যক্ত করেন। আল্লামা ইকবাল তাঁর সকল কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করার পর উঠে বাড়ীর ভেতরে চলে যান। চৌধুরী সাহেব বহুক্ষণ আল্লামার প্রত্যাগমনের অপেক্ষায় বসে থাকার পর নিরাশ হয়ে উঠে আসেন। আল্লামা তাঁকে কোন একটি কথাও না বলায় তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হন।
অতঃপর তাঁর বন্ধুটি একথা শুনে বলেন, “আপনি পুনরায় আল্লামার নিকটে যান। তিনি অতি দার্শনিক ও চিন্তাশীল। হয়তো কোন চিন্তার সাগরে ডুবে গিয়ে আপনার কথা ভুলে গেছেন। এবার হয়তো আপনাকে সঠিক পরামর্শই দিবেন।” চোধুরী নিয়ায আলী পুনরায় আল্লাম ইকবালের নিকট তাঁর বাসনা ব্যক্ত করে বিনীত কন্ঠে বলেন-
“হুযুর সেদিন আমাকে কোন কথা না বলেই ভেতরে চলে গেলেন। তাতে করে আমার বিশ্বাস যে, আমার পরিকল্পনাটি আপনার মনঃপূত হয়নি।”
আল্লামা বলেন, “সেকি, কিছু বলিনি? বলেছি, আলবৎ বলেছি। তুমি বুঝতে পারনি।”
অতঃপর তিনি মাওলানা মওদূদী সম্পাদিত ‘তর্জুমানুল কোরআন দেখিয়ে বলেন-
“সেদিন তুমি লক্ষ্য করনি, এ পত্রিকাখানি তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভেতরে চলে গেলাম? তার অর্থ হলো এই যে, তোমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন এ পত্রিকার সম্পাদক আবুল আ’লা মওদূদীর। তাকে আনতে পারলে তোমার সব কাজ হবে।”
চৌধুরী নিয়ায বলেন, “হুযুর, তাঁর সাথে তো আমার পরিচয়ই নেই।”
আল্লামা বলেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে। সে অমুক দিন দিল্লী আসছে। আমরা একখানা চিঠি নিয়ে তার সাথে দেখা করো।”
যথা সময়ে চৌধুরী নিয়ায আলী খান দিল্লী গিয়ে আল্রামার পত্র মাওলানা মওদূদীর হাতে দেন।
মাওলানা মওদূদী আল্লামা ইকবালের পত্র পাঠে হতবাক হন। আল্লামা তাকে হায়দারাবাদ পরিত্যাগ করে পাঞ্জাবে চলে আসার আহ্বান জানান। মাওলানা মওদূদী অতঃপর কিছুদিন পরে আল্লামার সাথে সাক্ষাত করেন এবং বিষয়টির উপরে দীর্ঘ আলোচনা করেন।
অতঃপর মাওলানা হায়দারাবাদ পরিত্যাগ করে ‘দারুল ইসলাম’ এসে পৌঁছেন। কিন্তু কে জানতো যাঁর আহ্বান অনুরোধে মাওলানা তাঁর জন্মভূমি ও আত্মীয়-বন্ধু পরিত্যাগ করে বিদেশের এক পল্লীগ্রামে নিজের আবাস-স্থল বেছে নিলেন, তিনি ডাক দিয়েই পরপারে যাত্রা করবেন? মাওলানা ‘দারুল ইসলাম’ পৌছে তাঁর লট-বহর সাজ-সরঞ্জাম সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত রয়েছেন এমন সময় লাহোর থেকে সাইয়েদ নযীর নিয়াযী সাহেবের একখানা পত্র তাঁর হস্তগত হলো। পত্রের সারমর্ম নিম্নরুপঃ
“ডাক্তার সাহেবের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তিনি আপনাকে একবার দেখার জন্যে খুবই ব্যস্ত। সম্ভব হলে শীঘ্রই চলে আসুন।”
মাওলানা মওদূদী নিজে এ সম্পর্কে বলেন, “আমি পত্র পেয়ে হতবাক হলাম। সবেমাত্র নতুন জায়গায় এসে পড়েছি। মালপত্র স্তুপীকৃত হয়ে পড়ে আছে। মনে করলাম একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে দু’চারদিন পর যাব। কিন্তু কে জানতো যে, মরণের ফেরেশতা একেবারে ওৎ পেতে বসে রয়েছেন। লাহোরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ আল্লামার ইন্তেকালের সংবাদ এসে পৌঁছালো।”
অজানা-অচেনা বিদেশ বিভূঁয়ে পা দিতে না দিতেই তাঁর হিতাকাঙ্খী ও পৃষ্ঠপোষকের পরলোকগমনে হয়তো মাওলানার জীবনতরী বিরাট ধাক্কা খেলো, ক্ষনিকের জন্যে ঘুপাক খেলো; কিন্তু সুদক্ষ কর্ণধার নীরবে অবিচল চিত্তে সবলে হাল ধরে রইলেন।
দারুল ইসলামে কর্মসাধনা
কোলাহল বিবর্জিত দারুল ইসলামের নির্জন নির্ঝঞ্জাট পরিবশে ইসলামী চিন্তা-গবেষণার পরিস্ফুরণ ও পূর্ণ বিকাশ লাভের সহায়ক হয়। সুদীর্ঘ দশ বছর একটানা মসি চালনার ফলে একদিকে কেরাআন হাদীসের গবেষণা প্রসূত ইসলামী সাহিত্য ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে ও কিছু সংখ্যক আল্লাহর বান্দার মন-মস্তিস্ক, আচার-আচরণ, কাজ-কর্ম খোদার রঙে রঞ্জিত হয়েছে, অপরদিকে দারুল ইসলামের গবেষণাকেন্দ্রেই সৃষ্টিলাভ করেছে পাকিস্তান সৃষ্টির মৌলিক উপাদান, দ্বিজাতিরতত্ত্বের মতবাদ। এখান থেকে মাওলানার যে সব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে খুতবাত (ঈমান, ইসলাম, নামায, রোযা, হজ্জ্ব, যাকাত প্রভৃতির মর্মকথা), ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ, কোরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে, তাজদীদ ওয়া ইহইয়ায়ে দ্বীন, ইসলামী বিপ্লবের পথ প্রভৃতি অন্যতম। মাওলানার মর্মস্পর্শী ও বিপ্লবী কোরআনের তাফসীর ‘তাফহীমুল কোরআনের’ সূচনা এখান থেকেই হয়। উপরন্তু ইসলামী মননশীলতা ও জাতীয় অনুভূতির অনুপম গ্রন্থ ‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ ৩য় খণ্ড’ দারুল ইসলামের এক পবিত্র রমযান মাসেই সমাপ্ত করা হয়। মোটকথা, মুসলিম জাতি যখন তমসাচ্ছন্ন রাতের অন্ধকারে পথহারা হয়ে পড়েছিল দারুল ইসলামের উদ্দীপ্ত মশাল তাদের পথ আলোকিত করে দিয়েছিল।
একথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, ‘দারুল ইসলাম’ ছিল একটি ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী’, যেখান থেকে তৈরী হয়েছিল দুটি মজবুত ও শক্তিশালী যুদ্ধের আগ্নেয়াস্ত্র, যা দিয়ে পাক ভারত উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমান কংগ্রেস ও তার সকল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র জাল করেছিল ছিন্নভিন্ন। সে দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র হচ্ছে ‘মাসয়ালায়ে কওমিয়াত’ এবং ‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ’।
মাওলানার হিজরত
হিজরত শব্দের অর্থ ইসলামের স্বার্থে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আপন জন্মভূমি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ক্ষেত-খামার, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিত্যাগ করে অন্যত্র কোথাও আল্লাহর যমীন বসবাসের জন্যে বেছে নেয়া, যেখানে ইসলাম পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব হয়, অথবা যেখান থেকে দ্বীনের খেদমত করার অধিকতর সুযোগ পাওয়া যায়। এ কাজ যে অত্যন্ত কঠিন ও বেদনাদায়ক তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যেখানে মানুষ জন্মগ্রহণ করে, যেখানকার আলোবাতাসে সে প্রতিপালিত ও বর্ধিত হয়, যেখানকার গাছ-পালা, নদী-নালা, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, আপনজন, বন্ধু-বান্ধব ও বিভিন্ন সম্পদ ও ব্যবহার্য দ্রব্যসম্ভার এক মায়াজাল সৃষ্টি করে তাকে আঁকড়ে ধরে থাকে, তা ছিন্ন করে অন্যত্র চলে যাওয়া কম কথা নয়। এ ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে নবী পাকেরও (সাঃ) দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর জন্যে তাঁকে তা করতে হয়েছিল।
মাওলানা মওদূদীর জন্ম হায়দারাবাদেরই এক আধুনিক শহর আওরংগাবাদে। পরবর্তী সময়ে হায়দারাবাদ শহরকেই তিনি কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। কিন্তু এক মহান উদ্দেশ্যে আল্লামা ইকবালের আহ্বানে পাঞ্জাব প্রদেশে পাঠানকোট থানার অধীন জামালপুর নামক নিভৃত পল্লীতে হিজরত করেন। এখানে কোন বিদ্যুতের ব্যবস্থাও ছিল না। নিকটতম রেলষ্টেশন সার্নাও এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। রাতে কেরোসিন তেলের বাতি জ্বালিয়ে কাজকর্ম করতে হতো। আধুনিক বাড়ীঘর ও আধুনিক বাথরুম লেট্রিনের কোন ব্যবস্থা ছিল না। কূপ থেকে পানি উত্তোলন করে গোসলাদি ও পাক-শাকের ব্যবস্থা করতে হতো। কাঠ ফেড়ে ধূম্ররাশির মধ্যে নাকানি চুবানি খেয়ে বহু কষ্টে রান্না বান্না করতে হতো।
মাওলানা দিল্লী শহরের এক অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করেন। তাঁর বিবির জন্যে এমন নিভৃত পল্লীতে বসবাস করা যে কত কষ্টকর ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। এমন স্থানে বসবাস তাঁদের রুচি ও স্বাস্থ্যের জন্যে অনুপযোগী হলেও তাঁদেরকে মনের উপর পাথর চাপা দিয়ে তা মেনে নিতে হয়েছিল। এটা কি কোন সামান্য ত্যাগ ও কুরবানী ছিল? কিন্তু তা তিনি করেছিলেন নিছক দ্বীনি খেদমতের জন্যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। এ পথে যে কোন ত্যাগ ও কুরবানী করতে তিনি দ্বিধা বোধ করেননি। সে কুরবানীর স্বর্ণ ফসল আজ বিশ্বের অসংখ্য অগণিত মানুষ ভোগ করছে- জীবনের ভ্রান্ত পথ থেকে সঠিক পথে আসছে।