মাওলানার বিবাহ
‘দারুল ইসলামে’ হিজরত করার এক বছর পূর্বে ইংরেজী ১৯৩৭ সালের ৫ই মার্চ মাওলানা মওদূদী এক প্রসিদ্ধ সাইয়েদ বংশে বিয়ে করেন।
ভারত সম্রাট শাহজাহান একমাত্র সাইয়েদ বংশীয় ইমামের পেছনেই নামায পড়তে ভালবাসতেন। তাই তিনি দিল্লী জামে মসজিদের জন্যে বুখারা থেকে একজন সাইয়েদ বংশীয় উচ্চ শিক্ষিত আলেমকে ইমাম নিযুক্ত করেন। এ বংশেরই একটি শাখা সম্ভুত আলেম এখনো দিল্লী জামে মসজিদের ইমামতির পদে অধিষ্ঠিত আছেন। এই বংশেই বিয়ে হয় মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর।
পাকিস্তান আন্দোলনে মাওলানার অমর অবদান
হিন্দু কংগ্রেসের সর্ব ভারতীয় জাতীয়তা আন্দোলন তথা অখণ্ড ভারতে রামরাজ্যে স্থাপনের আন্দোলনে মুসলমান জাতি যখন বিভ্রান্ত ও পথহারা হয়েছিল, তখন মাওলানা মওদূদী উক্ত জাতির সম্মুখে সত্যের মশাল প্রজ্জ্বলিত করে পথের সন্ধান দিয়েছিরেন এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তিনি “আল জিহাদু ফিল ইসলাম” গ্রন্থে ইসলামকে একটা সত্যিকার আদর্শবাদী বিপ্লবী আন্দোলন হিসেবে পেশ করেছেন এবং মুসলমান জাতির কর্তব্য, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণনা করেছেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের অন্ধ কংগ্রেসপ্রীতির জন্যে তিনি “আল জমিয়ত” পত্রিকার সংস্রব বর্জন করেছিলেন। পরবর্তীকালে মিঃ মুহম্মদ আলী জিন্নাহর (তখনও তিনি কায়েদে আযম হননি) ঐতিহাসিক চৌদ্দ দফা ইংল্যান্ডের গোল টেবিল বৈঠকে গৃহীত হওয়ার পর হিন্দু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসের বিপক্ষে মুসলিম লীগ এক আত্মরক্ষামূলক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এটাও প্রকৃতপক্ষে কোনও সুষ্ঠু আদর্শবাদী আন্দোলন ছিল না।
বলাবাহুল্য, কংগ্রেসের বহুদিনের সাধনা ছিল সকল জাতির সমন্বয়ে একটা ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক জাতি গঠন। এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করে মুসলমানগুণ তা থেকে আত্মরক্ষার জন্যে অপর এক ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করছিল। আর তা ছিল হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রভাবিত একজাতীয়তার পরিবর্তে মুসলিম জাতীয়তা। প্রকৃতপক্ষে উভয় প্রকারের জাতীয়তাই মারাত্মক। তাই মাওলানা মওদূদী তাঁর “সিয়াসী কাশমকাশ” গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে প্রথমত ইসলামের মূল লক্ষ্য, আদর্শ এবং রাজনৈতিক ভূমিকার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করেন। অতঃপর উক্ত গ্রন্থেরই দ্বিতীয় খণ্ডে কংগ্রেসের কাম্য জাতীয়তাবাদের দোষত্রুটি ও ভয়াবহ পরিণামের ফল বিশ্লেষণ করেন। তারপর ভারতীয় মুসলমানগণ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যে মুসলিম জাতীয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল, তারও ভয়াবহ পরিণাম বিশ্লেষণ করেন। বস্তুত ইসলাম কোন জাতীয়তাবাদ দৃষ্টি করতে অথবা কোন National State (জাতীয় রাষ্ট্র) কায়েম করতে আসেনি। বরং দুনিয়ার বুকে একটা সুষ্ঠু আদর্শ, জীবন দর্শন, সমাজ দর্শন উপস্থাপিত করে একটা Ideogical বা আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। এ গ্রন্থে (সিয়াসী কাশমাকাশ ২য় খন্ডে) মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে একটা ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের কথাই বলা হয়েছে।
১৯৩৫ সালের পর থেকে ভারতীয় মুসলমান যে রাজনৈতিক ঘূণিপাকের আবর্তে পড়ে দিকভ্রান্ত হয়েছিল মাওলানা তৎপ্রণীত ‘তানকিহাত’, ‘সিয়াসী কাশমাকাশ্’, ‘পর্দা’, ‘তাজ্বদীদ ওয়া ইহ্ইয়ানে দ্বীন’ প্রভৃতি গ্রন্থে সে সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চরণ করে সমাধান পেশ করেন।
কংগ্রেসের সর্বনাশা আন্দোলন মাওলানা কোনদিনই সমর্থন করতে পারেননি। বরং কংগ্রেস থেকে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র আদর্শবাদী দল বা জাতি হিসেবেই বসবাস করতে হবে- এ ছিল তাঁর বক্তব্য। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ নৈতিকতা বিস্মৃত হয়ে মুসলমানগণ ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। তিনি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন এবং ‘তানকিহাত’ গ্রন্থের মাধ্যমে ইউরোপীয় সভ্যতার বিষবৃক্ষের বিষময় পরিনাম ফল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তাঁর যাবতীয় লেখনী ও চেষ্টা-চরিত্রের মূল লক্ষ্যই এই ছিল যে, মুসলমানদের একটা আদর্শ জাতি হিসেবে দুনিয়ায় মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে এবং মানবের সমগ্র জীবনে একমাত্র আল্লাহ তায়ালরই অনুশাসন পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে পরবর্তীকালে এটাই পাকিস্তান আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
মাওলানা মাদানীর একজাতীয়তাবাদ
কংগ্রেস কিন্তু বরাবরই তার আপন লক্ষ্যে অবিচল ছিল। অর্থাৎ সমগ্র ভারতে একজাতীয়তা সৃষ্টি এবং তারই ভিত্তিতে দেশের স্বাধীনতা লাভ। ভৌগলিক ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ প্রমাণ করে ভারতীয় মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে হিন্দু-কংগ্রেস একজন শ্রেষ্ঠ আলেমকে কাজে লাগালো। ভারতের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দেওবন্দের হাদীস শাস্ত্রের অধ্যক্ষ মরহুম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী একদা লাহোর জামে মসজিদে কোরআন হাদীস উদ্ধৃত করে ভারতের হিন্দু-মুদলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-জৈন নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে এক ভৌগলিক জাতি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। তাঁর বক্তৃতা পুস্তিকাকারেও প্রকাশিত হলো। এ সময়ে মুসলিম লীগ আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে উঠছিল এবং মুসলমানদেরকে একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পেশ করেই এ আন্দোলন এতদুর অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রের হাদীস শাস্ত্রের অধ্যক্ষের মুখে মুসলিম-অমুসলিমের সমন্বয়ে একজাতীয়তার যুক্তি-প্রমাণ শুনে মুসলিম লীগমহল এবং সাধারণভাবে মুসলিম ভারত স্তম্ভিত, বিস্ময়বিমূঢ় ও নিরাশা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়লো। এ সময়ে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিক কবি ইকবাল রোগ শয্যায় শায়িত ছিলেন। তিনি রোগশয্যায় মাদানী সাহেবের উক্তির বিষয় জানতে পেরে অত্যন্ত ব্যথিত ও চঞ্চল হয়ে পড়েন। তিনি ধীরে ধীরে কম্পিত কলেবরে শয্যার উপর উঠে বসেন এবং স্বভাব-কবি রোগ যন্ত্রণার মধ্যেই কবিতার সুরে মাওলানা মাদানী সাহেবের উক্তির তীব্র সমালোচনা করেন-
আজম হনুয ন দানিস্ত্ রমুযে দীঅরনা,
যে দেওবন্দ্ হুসাইন আহমদ ইঁচে বুল্ আজবীস্ত্।
সরুদে বরসরে মেম্বর কে মিল্লাত আয ওতনস্ত্।
চে বেখবরয আয্ মকামে মুহাম্মদে আরবীস্ত।
বমুস্তফা বরেসাঁ খেশরা কে দী হমা উস্ত্
আগর বাউ না রসীদী তামামে বু লহবীস্ত।
অর্থাৎ-
বোঝেনি ঐ আজমবাসী
দ্বীনের মর্ম বিহ্বলতা,
দেওবন্দে তাইতো হুসেন
আহমদ কন আজব কথা।
“ওয়াতন থেকে মিল্লাত হয়”
এই কথা ফের গান যে তিনি,
বোঝেননি হায় নবীর মকাম
আল আরবীর মান যে তিনি।
নবীর কাছে পৌঁছিয়ে দাও
নিজেকে- এই দ্বীনের দাবি।
পৌঁছাতে না পারো যদি
সবই হবে ‘বু-লাহাবী’।
বলা বাহুল্য, ডাঃ ইকবালের কয়েক ছত্র কবিতা যদিও মরহুম মাদানী সাহেবের মতবাদকে কশাঘাত করলো, তথাপি তা একজাতীয়তা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে ভারতীয় মুসলমান এবং মুসলিম লীগ তাদের আন্দোলনকে কুয়াশাচ্ছন্ন দেখে দিশাহারা হয়ে পড়লো। ঠিক এই সংকট মুহুর্তে মাওলনা মওদূদী তাঁর বলিষ্ঠ মসি চালনা শুরু করেন এবং “মাসয়ালায়ে কওমিয়ত” নামে একখানা বিপ্লবাত্মক অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন।
এখানে মরহুম মাওলানা মাদানী সাহেবের উক্তির কিঞ্চিৎ উল্লেখ প্রয়োজন বোধ করছি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় এটাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, বর্তমানকালে জাতি ভৌগলিক আঞ্চলিকতার ভিত্তিতেই গঠিত হয়। তিনি তাঁর উক্তি প্রমাণ করার জন্য প্রথমেই বলেন-
“একজাতিতত্বের বিরোধিতা এবং উহাকে ন্যায়নীতির বিপরীত প্রমাণ করার প্রসঙ্গে যাহা কিছু প্রকাশিত হইয়াছে এবং হইতেছে তাহার ভুলত্রুটি দেখাইয়া দেওয়া এখন জরুরী মনে করিতেছি। কংগ্রেস ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ হইতে ভারতবাসীর নিকট স্বদেশিকতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের দাবি করিয়া যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা ও সাধনা করিতেছে। উহার বিরোধী শক্তিসমূহ ইহার অস্বীকার যোগ্য হওয়া বরং নাজায়েয ও হারাম হওয়ার কথা প্রমাণ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে। বস্তুতঃ ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের পক্ষে ইহা অপেক্ষা মারাত্মক আর কিছুই নাই। ইহা আজ নয়, ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে কিংবা তাহার পূর্ব হইতে এইসব কথা প্রকাশ করা হইয়াছে।”
তিনি আরও বলেন-
“একজাতীয়তা যদি এমনই অভিশপ্ত ও নিকৃষ্ট বস্তু হইয়াও থাকে, তবুও ইউরোপীয়গণ যেহেতু এই অস্ত্র প্রয়োগ করিয়াই ইসলামী বাদশাহী ও ওসমানী খেলাফতের মূলোচ্ছেদ করিয়াছিল, তাই এই হাতিয়ারকেই ব্রিটিশের মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা আজ মুসলমানদের কর্তব্য।” (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ- পৃষ্ঠা ৪৩)।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মরহুম সাহেবের উক্তির প্রত্যুত্তরে যে বিপ্লবী গ্রন্থ (“ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” মাওলানা মওদূদী প্রণীত উর্দূ গ্রন্থ “মাসয়ালায়ে কওমিয়তের” বাংলা অনুবাদ।) রচনা করেন তার প্রারম্ভে তিনি বলেন-
“দারুল উলুম দেওবন্দের প্রিন্সিপাল জনাব মাওলানা হুসাইন আহমেদ মাদানী ‘একজাতিতত্ত্ব ও ইসলাম’ নামে একখানি পুস্তিকা লিখিয়াছেন। একজন সুপ্রসিদ্ধ আলেম এবং পাক-ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত এই পুস্তিকায় ‘জটিল জাতিতত্ত্বের’ সরল বিশ্লেষণ এবং প্রকৃত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণ অভিব্যক্তি হইবে বলিয়া স্বভাবতই আশা করা গিয়াছিল। কিন্তু ইহা পাঠ করিয়া আমাদিগকে নির্মমভাবে নিরাশ হইতে হইয়াছে এবং এই বইখানিকে গ্রন্থকারের পদমর্যাদার পক্ষ্যে হানিকর বলিয়া মনে হইয়াছে। বর্তমান যুগে অসংখ্য ইসলাম বিরোধী মতবাদ ইসলামের মূলতত্ত্বের উপর প্রবল আক্রমণ চালাইতে উদ্যত, ইসলাম আজ ইহার নিজের ঘরেই অসহায়। স্বয়ং মুসলমানগণ দুনিয়ার ঘটনাবলী ও সমস্যাবলী খালেছ ইসলামের দৃষ্টিতে যাচাই করে না। বলা বাহুল্য, নিছক অজ্ঞানতার দরুনই তাহারা উহা করিতে পারিতেছে না। উপরন্তু ‘জাতীয়তার’ ব্যাপারটি এতই জটিল যে, উহাকে সুস্পষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করার উপরই এক একটি জাতির জীবন-মরণ নির্ভর করে। কোন জাতি যদি নিজ জাতীয়তার ভিত্তিসমূহের সহিত সম্পূর্ণ ভিন্ন মূলনীতির সংমিশ্রণ করে, তবে সে ‘জাতি’ হিসাবে দুনিয়ার বুকে বাঁচিতে পারে না। এই জটিল বিষয়ে লেখনী ধারণ করিতে গিয়া মাওলানা হুসাইন আহমেদ সাহেবের ন্যায় ব্যক্তির নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। কারণ তাঁহার নিকট নবীর আমানত গচ্ছিত রহিয়াছে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল তত্ত্বের উপর যদি কখনওজঞ্জাল-আবর্জনা পুঞ্জীভুত হয়, তবে ইহাদের ন্যায় লোকদেরই তাহা দূরভূত করা কর্তব্য।
বর্তমান অন্ধকার যুগে তাঁহাদের দায়িত্ব যে সাধারণ মুসলমানদের অপেক্ষা অনেক বেশি এবং কঠোর, সে কথা তাহাদের পুরাপুরিই অনুধাবন করা উচিৎ ছিল। সাধারণ মুসলমান যদি ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত থাকে, তবে সে জন্যও সর্বপ্রথম এই শ্রেণীর লোক দিগকেই দায়ী করা হইবে। সেই জন্য আমাকে আবার বলিতে হইতেছে যে, মাওলানা মাদানীর এই পুস্তিকায় তাঁহার দায়িত্বজ্ঞান ও দায়িত্বানুভূতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।” (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ – পৃষ্ঠা ৪১)।
সমগ্র ভারতবাসীর ”একজাতিতত্ত্বকে” সঙ্গত বলে প্রমাণ করার জন্যে মাওলানা মাদানী সাহেব আর একটি দলীল পেশ করেছেনঃ
“আমরা প্রতিদিন সম্মিলিত স্বার্থের জন্য জনসংঘ বা সমিতি গঠন করিয়া থাকি এবং তাহাতে শুধু অংশগ্রহণই করি না, উহার সদস্যপদ লাভ করিবার জন্যুদ প্রাণপণ চেষ্টাও করিয়া থাকি। …. শহর এলাকা, ঘোষিত এলাকা, মিউনিসিপ্যাল বোর্ড, জেলা বোর্ড, ব্যবস্থা পরিষদ, শিক্ষা সমিতি এবং এই ধরনের শত শত সমিতি রহিয়াছে যাহা বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসারে গঠিত হইয়াছে। এই সব সমিতিতে অংশগ্রহণ করা এবং সেজন্য সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে চেষ্টা করাকে কেহই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ই ধরনের কোন সমিতি যদি দেশের স্বাধীনতা এবং বৃটিশ প্রভুত্বের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তাহাতে অংশগ্রহণ করা হারাম, ন্যায়পরায়ণতার বিপরীত, ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী এবং জ্ঞানবুদ্ধি ইত্যাদির বিপরীত হইয়া যায়।” (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ – ৫২ পৃষ্ঠা)।
তদুত্তরে মাওলানা মওদূদী বলেন-
“বস্তুত ইহাকেই বলে ভুলের ভিত্তিতে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ। মাওলানা মাদানী একটি পাপের কাজকে ফরয গণ্য করতঃ উহারই অন্ধ প্রেমে পড়িয়া অনুরূপ আর একটি পাপকে সঙ্গত প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিতেছেন। অথচ উভয় ক্ষেত্রেই হারাম হওয়ার একই মূল কারণ বিদ্যমান। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলিতে চাই, উলামায়ে হিন্দের নিকট কিউন্সিল ও এসেম্বলীতে যোগ দেওয়াকে একদিন হারাম এবং অন্যদিন হালাল বলিয়া ঘোষণা করা একেবারে পুতুল খেলার শামিল হইয়াছে। কারণ প্রকৃত ব্যাপার লক্ষ্য করিয়া কোন জিনিসকে হারাম ঘোষণা করার নীতি তাহাদের নয়। গান্ধীজীর একটি শব্দেই তাহাদের ফতোয়াদান ক্ষমতা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি ইসলাম শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে বলিতেছি, আল্লাহ ও তাহার রাসূল (সাঃ) যে সব বিষয়ে সুস্পষ্ট ফয়সালা করিয়াছেন, সে সম্পর্কে নতুত ভাবে ফয়সালা করিবার নিরঙ্কুশ অধিকার মানুষকে দেয় যেসব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠান- মুসলমানদের পক্ষে তাহা সমর্থন করা এক চিরন্তন অপরাধ সন্দেহ নাই। কিন্তু এইরূপ নিরঙ্কুশ অধিকার ও কর্তৃত্বসম্পন্ন সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অমুসলিমদের সংখ্যা অধিক হইয়া পড়ে এবং তাহাতে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তখন ইহা দ্বিগুণ অপরাধরূপে পরিগণিত হয়। অতএব এইসব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানের কর্মসীমা খোদার শরীয়তের নির্দিষ্ট সীমা হইতে স্বতন্ত্র করিয়া দেওয়াই মুসলমানদের প্রথম কর্তব্য এবং তাহাদের পক্ষে প্রকৃত আযাদী যুদ্ধ ইহাই। কর্তৃত্ব প্রয়োগের উল্লিখিত সীমা উভয়ের যদি সতন্ত্র হয়, তবে মুসলিম অমুসলিম উভয় জাতির কোন মিলিত স্বার্থের জন্য গঠিত দলের সহযোগিতা করা মুসলমানদের পক্ষে সঙ্গত হইবে। তাহা কোন শত্রুর আক্রমনের প্রতিরোধের জন্য হউক, কি কোন অর্থনৈতিক বা শৈল্পিক কাজকর্ম আঞ্জাম দেওয়ার জন্য হউক, তাহাতে কোনরূপ পার্থক্য নাই। কিন্তু উভয় জাতির কর্ম ও ক্ষমতার সীমা যতদিন পরস্পর যুক্ত থাকিবে, মিলন ও সহযোগিতা তো দূরের কথা এইরূপ যুক্ত শাসনতন্ত্রের অধীন জীবনযাপন করাও মুসলমানদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসঙ্গত। এই ব্যাপারে নির্বিশেষে সকল মুসলমানই অপরাধী বলিয়া বিবেচিত হইবে, যতদিন না তাহারা সকলে মিলিয়া মিলিত শক্তির সাহায্যে উক্ত শাসনতন্ত্রকে চূর্ণ করিয়া দিবে। আর যাহারা সাগ্রহে এই শাসনতন্ত্র গ্রহণ করিবে এবং উহাকে চালু করার জন্য চেষ্টা করিবে তাহারা তদপেক্ষা বেশী অপরাধী হইবে। কিন্তু যে ব্যক্তি, সে যে-ই হউক না কেন, সেই শসনতন্ত্র চালু করার অনুকূলে কোরআন-হাদীস হইতে যুক্তি পেশ করিবে, তাহার অপরাধ হইবে সর্বাপেক্ষা বেশী।”
(ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ- পৃষ্ঠা ৫৩)
কংগ্রেসের একজাতীয়তার বিষময় ফল লক্ষ্য করে মওলানা মওদূদী বলেন-
“এই উদ্দেশ্যেই ওয়ার্ধা স্কীম রচনা করা হইয়াছে। বিদ্যামন্দির স্কীমেরও ইহাই উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্য এই উভয় স্কীমেই স্পষ্ট ভাষায় লিখিয়া দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু মাওলানা মাদানী এই সব স্কীম এবং উহাদের পাঠ্য তালিকা মোটেই দেখেন নাই। পণ্ডিত নেহেরু কয়েক বছর পর্যন্ত এই জাতীয়তারই শিক্ষা ফুঁকিতেছেন। কিন্তু তাঁহার কোন বক্তৃতা বা রচনাও মাওলানা মাদানীর গোচরীভূত হয় নাই। কংগ্রেসের দায়িত্বসম্পন্ন প্রত্যেকটি ব্যক্তি এই কথাই ঘোষণা করিতছেন, লিখিতেছেন এবং নতুন শাসনতন্ত্রলব্ধ রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে তাহা প্রবলভাবে প্রচারও করিয়া বেড়াইতেছেন। কিন্তু মাওলানা মাদানী ইহার কিছুই শুনিতে, দেখিতে ও অনুভব করিতে পারিতেছেন না। অথচ তিনি যে সব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করিয়াছেন, তাহাদের প্রত্যেকটির দ্বারাই এইসব কাজ সম্পন্ন করা হইতেছে।” (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ- পৃষ্ঠা ৫৯-৬০)।
মাওলানা মওদূদী আরও বলেন-
“সুতরাং মাওলানা মাদানী যদি তাঁহার মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য ‘পারস্পারিক বন্ধুতা’ ইত্যাদি কোন শব্দ ব্যবহার করিতেন এবং ইহাকে কংগ্রেসের নীতি ও কর্ম হিসাবে পেশ না করিয়া নিজের তরফ হইতে একটি প্রস্তাবও সুপারিশ হিসাবে পেশ করিতেন, তবেই ভাল হইত। অন্তত এখনও যদি তিনি এই জাতির প্রতি এতটুকু অনুগ্রহ করেন, তবে তাহা বড়ই মেহেরবানী হইবে। অন্যথায় তাঁহার লেখনীতে মহা বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রহিয়াছে। জালেম রাজা বাদশাহ ও ফাসেক রাষ্ট্রনেতা যাহা কিছু করিয়াছেন, আলেমগণ তাহাকেই কোরআন হাদীসের দলীল দিয়া সত্য প্রমাণ করত ধর্মকে অত্যাচার ও শোষণের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করিাছেন।
মাওলানা মাদানীর উল্লিখিত পুস্তিকা প্রকাশিত হওয়ার পর খালেছ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ‘জাতীয়তার’ বিশ্লেষন করা এবং এই ব্যাপারে ইসলামী ও অনৈসলামিক মতবাদের পারস্পরিক মূলগত পার্থক্য উজ্জ্বল করিয়া ধরা অত্যান্ত জরুরী হইয়া পড়িয়াছে। তাহা করা হইলে এ সম্পর্কীয় যাবতীয় ভুল ধারণা লোকের মন হইতে দূর হইবে এবং উভয় পথের কোন একটি পথ বুঝিয়া-শুনিয়া গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হইবে। ইহা আলেমদেরই কত্যর্ব ছিল, কিন্তু আলেম সমাজের প্রধান ব্যক্তিই যখন একজাতীয়তার পতাকা উত্তোলন করিয়াছেন এবং কোন আলেমই যখন প্রকৃত কর্তব্য পালনে প্রস্তুত হইতেছেন না, তখন আমাদের ন্যায় সাধারণ লোকেরাই তজ্জন্য তৎপর হইতে হইবে।” (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ – পৃষ্ঠা ৬১)।
এ গ্রন্থে তিনি ইসলামী জাতীয়তার ভিত্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ
“যেসব গন্ডীবদ্ধ, জড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও কুসংস্কারপূর্ণ ভিত্তির উপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তার প্রাসাদ গড়ে উঠেছ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেন। বর্ণ, গোত্র, জন্মভূমি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অবৈজ্ঞানিক বিরোধ ও বৈষম্যের ভিত্তিতে মানুষ নিজেদের মূর্খতা ও চরম অজ্ঞতার দরুন মানবতাকে চূর্ণ করে দেয় এবং মানবতার দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষকে সমশ্রেণীর সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমানাধিকার প্রদান করেছে।”
“ইসলামী জাতীয়তার মানুষে মানুষে পার্থক্য করা হয় বটে, কিন্তু জড়, বৈষয়িক ও বাহ্যিক কোন কারণে নয়। করা হয় আধ্যাতিক, নৈতিক ও মানবিকতার দিক দিয়ে। মানুষের সামনে এক স্বাভাবিক সত্য বিধান পেশ করা হয়, যার নাম ইসলাম। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, হৃদয়মনের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা, কর্মের অনাবিলতা, সততা ও ধর্মানুসরণের দিকে গোটা মানব জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, যারা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে, তারা এক জাতি হিসাবে গণ্য হবে। আর যারা তা অগ্রাহ্য করবে, তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ মানুষের একটি হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের জাতি এবং তার সমস্ত ব্যক্তিসমষ্টি মিলে একটি উম্মাহ। অন্যটি হচ্ছে কুফর ও ভ্রষ্টতার জাতি। তার অনুসারীগণ নিজেদের পারস্পরিক মতবিরোধ ও বৈষম্য সত্ত্বেও একই দল ও একই দলের মধ্যে গণ্য।”
“এ দুটি জাতির মধ্যে বংশ ও গোত্রের দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য বিশ্বাস ও কর্মের। কাজেই একই পিতামাতার দু’টি সন্তানও ইসলাম ও কুফরের উল্লিখিত ব্যবধানের দরুন স্বতন্ত্র দুই জাতির মধ্যে গণ্য হতে পারে এবং দুই নিঃসম্পর্ক ও অপরিচিত ব্যক্তি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কারণে এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।”
“জন্মভূমির পার্থক্যও এ উভয় জাতির মধ্যে ব্যবধানের কারণ হতে পারে না। এখানে পার্থক্য করা হয় হক ও বাতিলের ভিত্তিতে। আর হক ও বাতিলের ‘স্বদেশ’ বা ‘জন্মভূমি’ বলতে কিছু নেই। একই শহর, একই মহল্লা এ একই ঘরের দুই ব্যক্তির জাতীয়তা ইসলাম ও কুফরের পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন হতে পারে। একজন নিগ্রো ইসলামের সূত্রে একজন মরক্কোবাসীর ভাই হতে পারে।”
“বর্ণের পার্থক্যও এখানে জাতীয় পার্থক্যের কারণে নয়। বাহ্যিক চেহারার রং ইসলামে নগন্য। এখানে একমাত্র আল্লাহর রঙেরই গুরুত্ব রয়েছে। তা-ই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম রং।”
“ভাষার বৈষম্যও ইসলাম ও কুফরের পার্থক্যের কারণ নয়। ইসলামে মুখের ভাষার কোনই মূল্য নেই। মূল্য হচ্ছে মনের, হৃদয়ের-ভাষাহীন কথার।
ইসলামী জাতীয়তার এ বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে কালেমা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। বন্ধুতা আর শত্রুত এ কালেমার ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এ স্বীকৃতি মানুষকে একীভূত করে, অস্বীকৃতি মানুষের মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটায়। এ কালেমা যাকে বিচ্ছিন্ন করে, তাকে রক্ত, মাটি, ভাষা, বর্ণ, অন্ন, শসন ব্যবস্থা প্রভৃতি কোন সূত্র এবং কোন আত্নীয়তাই যুক্ত করতে পারে না। অনুরূপভাবে এ কালেমা যাদেরকে যুক্ত করে তাদেরকে কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
মাওলানা আরও বলেনঃ
“উল্লেখ্য যে, অমুসলিম জাতিসমূহের সাথে মুসলিম জাতির সম্পর্কের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমটি এই যে, মানুষ হওয়ার দিক দিয়ে মুসলিম অমুসলিম সকলেই সমান। আর দ্বিতীয়টি এই যে, ইসলাম ও কুফরের পার্থক্য হেতু আমাদেরকে তাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম সম্পর্কের দিক দিয়ে মুসলমানেরা তাদের সাথে সহানুভূতি, দয়া, ঔদার্য ও সৌজন্যের ব্যবহার করবে। কারণ মানবতার দিক দিয়ে এরূপ ব্যবহারই তারা পেতে পারে। এমনকি তারা যদি ইসলামের দুশমন না হয়, তাহলে তাদের সাথে বন্ধুত্ব, সন্ধি এবং মিলিত উদ্দেশ্যের (Common Cause) সহযোগিতাও করা যেতে পারে। কিন্তু কোন প্রকার বস্তুগত ও বৈষয়িক সম্পর্ক তাদেরকে ও আমাদেরকে মিলিত করে ‘এক জাতি’ বানিয়ে দিতে পারে না।”
যা হোক, মাওলানা মওদূদীর উপরিউক্ত গ্রন্থখানি তৎকালীন সমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মাওলানা মাদানীর বক্তৃতা ও পুস্তিকা যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা ও কর্মীগণ একে একটি শাণিত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। বস্তুত এই গ্রন্থখানি দ্বিজাতি তত্বের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি স্থাপন করে এবং ইহাই পাকিস্তান সৃষ্টির মূল কারণ হয়ে পড়ে। গ্রন্থখানি কংগ্রেসের রামরাজ্য স্থাপনের মারাত্মক পরিকল্পনা এবং মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী সমর্থিত আঞ্চলিক জাতীয়তার যুক্তি তর্ক নস্যাৎ করে তাকে অবৈজ্ঞানিক, অযৈক্তিক, অনৈসলামী এবং অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ করে দেয়। শুধু তাই নয়, মাওলানা মওদূদী এই গ্রন্থখানি দ্বারা মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র স্থাপন দাবির যৌক্তিকতা উজ্জ্বল ও পরিস্ফুট করে তুলেছিলেন।
মাওলানা মওদূদীর প্রতি মাওলানা মাদানীর অন্ধ আক্রোশের এটাই মূল কারণ। এই আক্রোশকে ভিত্তি করেই মাওলানা মাদানী পরবর্তীকালে মাওলানা মওদূদীর উপরে আমরণ ফতোয়াবাজীর মেশিনগান থেকে অমূলক, ভিত্তিহীন ও বিদ্বেষমূলক অভিযোগ টেনে রোষানল প্রজ্জ্বলিত ফতোয়ার গোলাবর্ষণ করেছেন। ততোধিক পরিতাপের বিষয় এই যে, মরহুম মাদানী সাহেবের অনেক শিষ্য-সাগরিদ, যাঁরা ‘উলামায়ে দ্বীন হিসাবে পরিচিত, ওস্তাদের অনুসরণ করে তাঁরাও মাওলানা মওদূদীর অন্ধ বিরোধিতায় মেতে ওঠেন। একথা অনস্বীকার্য যে, মাওলানা মাদানীসহ তাঁর শিষ্য-সাগরিদগণ পাকিস্তান সৃষ্টিতে চরম বাধা দান করেন। এমনকি পাকিস্তান ঘোষিত হওয়ার পরও ‘সিলেট রেফারেন্ডামের’ সময় এসব উলামায়ে কেরাম পাকিস্তানের বিপক্ষে ভোট সংগ্রহ করার জন্য সিলেটের মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে ধরণা দেন। পাকিস্তান হওয়ার পর এ সব উলামায়ে কেরাম হঠাৎ পাকিস্তানের পরম ও চরম কল্যাণকামী সেজে মাওলানা মওদূদীকে পাকিস্তান আন্দোলন বিরোধী বলে অভিযুক্ত করেন। ‘ইসলাম’ ও ‘উলামায়ে দ্বীনের’ ইতিহাসে এর চেয়ে বড় কলঙ্ক, এর চেয়ে বড় সত্যের অপলাপ আর কি হতে পারে?
পাকিস্তান সৃষ্টির পশ্চাতে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর যে বিরাট অবদান ছিল, তা কোন বিবেকসম্পন্ন, জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ন ও সুস্থ মস্তিষ্ক ব্যক্তির অস্বীকার করার উপায় নেই। এ কথা ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আমদের দেশের স্বার্থান্ধ ও সুবিধাবাদী কিছু রাজনৈতিক দল এবং তাদেরই অন্ধ সমর্থক কিছু লোক, এমনকি কিছু সংখ্যক আলেম পর্যন্ত মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকেন যে তিনি এক সময়ে কংগ্রেস ও জমিয়াতে উলামায়ে হিন্দুদের অনুসারী হিসাবে পাকিস্তানের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁদের এসব প্রচারণা যে ইসলাম বিদ্বেষ প্রসূত এবং ইসলামের পুর্ণজাগরণকে রোধ করার অশুভ চক্রান্ত, তা জ্ঞানী লোকের বুঝতে মোটেউ কষ্ট হবার কথা নয়। আমরা নিরপেক্ষ পাঠক-পাঠিকা ও দেশের সুধীজনকে অনুরোধ করি, তাঁরা যেন মাওলানা মওদূদীর সমগ্র অতীত কার্যাবলী জানবার ও বুঝবার চেষ্টা করেন। মাওলানা মওদূদী একজন মানুষ ব্যতীত কিছুই নন। তাঁর মধ্যে মানবসূলভ দোষত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে যে ব্যক্তি তাঁর সমগ্র জীবনের সময়, অর্থ ও শ্রম আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছেন এবং দ্বীন ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে অক্লান্ত সাধনা করে চলেছেন, তাঁর প্রতি বিদ্বেষমূলক মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা কোন ভাল মানুষের কাজ নয়। তাঁর প্রতি এর চেয়ে বড় জুলুম ও অবিচার আর কি হতে পারে? তবে এ ধরনের লোকের মনে রাখা উচিৎ যে, সত্য একদিন তার স্বর্গীয় আলোক আভায় উদ্ভাসিত হয়ে পড়বেই এবং সেদিন শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে যত মিথ্যার ফানুস।
মাওলানা মওদূদী ও মুসলিম লীগ
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকলেও মাওলানা মওদূদী মুসলীম লীগে যোগদান করেননি। কেন করেননি তা নিচের আলোচনায় জানা যাবে। তথাপি একথা অনস্বীকার্যযে, পাকিস্তান আন্দোলন যেসব মনীষীর চিন্তাধারার ফল, মাওলানা মওদূদী তাঁদের অন্যতম। শুধু তাই নয়, এ আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। শুধু আমাদের কথা নয়, অন্য মহল থেকে এবং বিশেষ করে মুসলিম লীগ মহল থেকেও এর স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। প্রমাণস্বরূপ নিচে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো-
মাওলানা যফর আহমদ আনসারী এম.এ, এল.এ.বি, বিভাগ পূর্বকালে মরহুম কায়েদে আযম ও মরহুম লিয়াকত আলেী খানের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যুগ্ন সম্পাদক এবং এর কার্যকরী সংসদ (Committee of action) ও কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারী বোর্ডের সম্পাদক ছিলেন। তিনি বলেন-
“এ বিষয়বস্তুর উপরে মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী সাহেব ‘জাতীয়তার সমস্যা’ (মাসয়ালায়ে কওমিয়াত) শীর্ষক এক ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। অকট্য যুক্তি-প্রমাণদি ও শক্তিশালী প্রকাশভঙ্গির দরুন প্রবন্ধটি মুসলমানদের কাছে অত্যান্ত সমাদৃত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুততার সাথে মুসলমানদের মধ্যে এ এক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে পড়ে। এ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ফলে একজাতীয়তার ধারণা বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় এবং স্বতন্ত্র জাতিতত্ত্বের অনুভূতি মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যুত বেগে সঞ্চারিত হয়। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এ একটা নিছক আদর্শিক বিতর্ক-আলোচনা ছিল না, বরং এ কংগ্রেস ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের স্বপ্ন প্রাসাদ ভেঙ্গে দিয়েছিল। মুসলমানদের অন্তর থেকে স্বতন্ত্র জাতিতত্ত্বের অনুভূতি কোন প্রকারে বিদূরিত করে তাদের জাতীয় অস্তিত্বের মূলকে অন্তঃসারশূন্য করে দেয়াই ছিল হিন্দুদের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক কৌশল। স্বয়ং মুসলিম লীগ এ বিতর্ক আলোচনায় ধর্মীয় দিকটা বেশী করে পরিস্ফুট করে তুলবার চেষ্টা করছিল, যাতে জনসাধারণ কংগ্রেসের খেলা ধরে ফেলতে পারে এবং তাদের দ্বীন ও ঈমানের দবি পূরণের জন্য প্রবৃত্ত হতে পারে।”
(‘পাকিস্তান আন্দোলন ও উলাম’ মাসিক চেরাগে রাহ, পাকিসতানের আদর্শ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২৩২)।
মাওলানা আনসারী সাহেব আরও বলেন-
“প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পূর্ব থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে ‘হুকুমতে ইলাহিয়া’, ‘মুসলিম হিন্দুস্থান’, ‘খেলাফতে রব্বানী’ প্রভৃতির দাবি উঠছিল। আল্লামা ইকবাল একটা মুসলিম হিন্দুস্থানের ধারণা দিয়েছিলেন। মওদূদী সাহেবের সাহিত্য ‘হুকুমতে ইলাহিয়ার’ আওয়াজ তুলেছিল। মাওলানা আযাদ সোবহানী ‘খেলাফতে রব্বানীর’ ধারণা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থান থেকে এ ধরনের দাবি উত্থিত হওয়াতে এ কথাই প্রমাণিত হচ্ছিল যে, মুসলমানগণ তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার ভিত্তিতে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করছিল এবং পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তাদের সুপ্ত সংকল্প পূর্ণজাগরিত হচ্ছিল।
(‘পাকিস্তান আন্দোলন ও উলাম’ মাসিক চেরাগে রাহ, পাকিসতানের আদর্শ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২৩৩)।
আল্লামা ইকবাল মাওলানা মওদূদীর প্রবন্ধাদির দ্বারা অত্যান্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন। লাহোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ইকদাম’ পত্রিকার সম্পাদক মিয়া মোহাম্মদ শফি সাহেব বলেন যে, আল্লামা ইকবাল ‘তর্জুমানুল কোরআনের’ ঐসব প্রবন্ধ অন্যের সাহায্যে পাঠ করিয়ে শুনতেন। এ সবের দ্বারা তিনি এতটা মুগ্ধ ও প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, মাওলানাকে তিনি দাক্ষিণাত্যের হায়দারাবাদ ত্যাগ করে পাঞ্জাব চলে আসতে অনুরোধ জানান। তাঁর এ আহ্বানেই মাওলানা মওদূদী ১৯৩৮ সালে পাঞ্জাবে চলে আসেন।
মিয়া মুহাম্মদ শফি সাহেব ১৯৬৩ সালের ৯ই জুনে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইকদমে ‘লাহোরের ডাইরী’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেন-
“মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তো প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের দুশমন ছিলেন। আমি পূর্ণ দায়িত্বের সাথে একথা বলছি যে, আমি আল্লামা ইকবালকে একথা বলতে শুনতাম, “মওদূদী এসব কংগ্রেসী মুসলমানদের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে।” আল্লামা ইকবাল আষাদ (মাওলানা আবুল কালাম আযাদ) ও মাদানির (মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী) সুস্পষ্ট ভাষায় সমালোচনা করতেন। কিন্তু তিনি মাওলানা মওদূদীর তর্জুমানুল কোরআনের বিশেষ বিশেষ অংশ অন্যের দ্বারা পড়িয়ে শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন। তারপর এ ব্যাপারে তো আমি ষোলআনা দায়িত্ব সহকারে বলছি যে, আল্লামা ইকবাল একখানা পত্রের দ্বারা দাক্ষিণাত্যের হায়দারাবাদের পরিবর্তে পাঞ্জাবকে কর্মস্থল বানানোর জন্য মাওলানা মওদূদীকে অনুরোধ জানান এবং এ পত্রখানা তিনি আমারই দ্বারা লিখিয়েছিলেন।”
পাকিস্তানের সামরিক শাসন আমলে গঠিত গঠনতন্ত্র কমিশনের পরামর্শদাতা ও কোম্পানী ল’ কমিশনের সভাপতি সাইয়েদ শরীফউদ্দীন পীরজাদা তাঁর Evolution of Pakistan গ্রন্থে বলেন-
“মাওলানা মওদূদী ১৯৩৮-৩৯ সালে ‘তর্জুমানুল কোরআনে’ প্রকাশিত এক ধারাবাহিক প্রবন্ধের দ্বারা কংগ্রেসের অবগুণ্ঠণ উন্মেচন করে মুসলমানদেরকে সাবধান করে দেন। উপরন্তু তিনি এই উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন। কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে ফেলেন এবং একথা প্রমাণ করে দেন যে, ভারতের বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর জন্যে গণতন্ত্র অনুপযোগী। কারণ এখানে মুসলমানদের একটি ভোট এবং হিন্দুদের চারটি ভোট রয়েছে। তিনি হিন্দুদের জাতীয় সম্রাজ্যবাদের নিন্দা করেন এবং এই মতামত ব্যক্ত করেন যে, যুক্ত নির্বাচন অথবা পরিষদসমূহে কিছু বেশী সংখ্যক আসন লাভ এবং চাকরিতে একটা সংখ্যার হার নির্ধারণ মুসলমান জাতির রাজনৈতিক সমস্যার কোন সমাধান নয়। তিনি এ ব্যাপারে তিনটি বিকল্প প্রস্তাবও পেশ করেন।” (Evolultion of Pakistan, Page- 191)
এ তিনটি প্রস্তাবের মধ্যে তৃতীয়টিই ছিল ভারত বিভাগের প্রস্তাব। পীরযাদা সাহেব তাঁর গ্রন্থে সর্বশেষ মন্তব্য করেনঃ
“ঐ সব প্রস্তাব ও পরামর্শ যা স্যার আব্দুল্লা হারুন, ডাঃ লতিফ, স্যার সেকান্দার হায়াত খান, জনৈক পাঞ্জাবী, ডাঃ কাদেরী, মাওলানা মওদূদী, চৌধূরী খালিকুজ্জামান প্রমুখ ব্যক্তিগণ উপস্থাপিত করেন তা সবই এক অর্থে পাকিস্তান সৃষ্টির পথ নির্দেশক ছিল।” উক্ত গ্রন্থ।
আমাদের কথা প্রমাণ করার জন্য উপরের উদ্ধৃতিগুলোর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু শুধু তাদেরই জন্যে প্রয়োজন বোধ করছি যারা সে সময়ের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন না। এসব থেকে প্রমাণিত হয় যে, পাক-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও বিশেষ করে পাকিস্তান অর্জনের পথে মাওলানা মওদূদী প্রণীত ‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাকাশ’ এবং ‘মাসয়ালায়ে কাওমিয়াত’ গ্রন্থদ্বয় কতখানি জাতীয় খেদমত করেছে।
শরীফ উদ্দীন পীরজাদা তাঁর গ্রন্থে মাওলানার যে তিনটি প্রস্তাবের উল্লেখ করেন, তা এমন তিনটি বিকল্প শাসনতন্ত্রের প্রস্তাব যা ১৯৩৮ সালের তর্জুমানুল কোরআনের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
সংক্ষেপে তা নিম্নে প্রদত্ত হলঃ
প্রথম প্রস্তাব
(ক) রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে আন্তর্জাতিক ফেডারেশনের (International Federation) মূলনীতির ভিত্তিতে। অন্য কথায় এটা একটিমাত্র কোন জাতির রাষ্ট্র হবে না বরং সন্ধিবদ্ধ জাতি সমূহের একটি রাষ্ট্র (A state of federated nations)।
(খ) এ ফেডারেশনে শরীক প্রত্যেক জাতি সাংস্কৃতিক স্বায়ত্বশাসনের (Cultural autonomy) অধিকারী হবে।
(গ) সাধারণ দেশীয় ও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারসমূহে কর্মপদ্ধতি তৈরি হবে সমঅংশীদারিত্বের (Equal partnership) ভিত্তিতে।
অতঃপর মাওলানা সাংস্কৃতিক স্বায়ত্বশাসনের মৌলিক নীতিও বিশ্লেষণ করেন।
দ্বিতীয় প্রস্তাব
আন্তর্জাতিক ফেডারেশনের প্রস্তাব যদি গৃহীত না হয়, তাহলে দ্বিতীয় বিকল্প প্রস্তাব এই যে, বিভিন্ন জাতির পৃথক পৃথক ভূখন্ড চিহ্নিত করা হবে যেখানে তারা তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে পারবে। অধিবাসী বিনিময়ের জন্যে পঁচিশ অথবা কমবেশী দশ বছরের মুদ্দৎ নির্ধারিত করে দেওয়া হবে। প্রত্যেক রাষ্ট্রকে অধিক পরিমাণ স্বায়ত্বশাসনের অধিকার এবং কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের অতি অল্প ইখতিয়ারই থাকবে।
তৃতীয় প্রস্তাব
উপরিউক্ত প্রস্তাবও যদি গৃহীত না হয়, তাহলে তৃতীয় বিকল্প প্রস্তাব এই যে, আমাদের জাতীয় রাষ্ট্রগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে কায়েম করা এবং তাদের পৃথক পৃথক ফেডারেশন হোক।
তৃতীয় এবং শেষ প্রস্তাবটি প্রকারান্তরে মাওলানার ভারত বিভাগেরই প্রস্তাব যা মুসলিম লীগ পনেরো মাস পরে ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ গ্রহণ করে, যা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব তথা পাকিস্তান প্রস্তাব নামে আখ্যায়িত হয়।
এখন প্রশ্ন এতসব করার পরও মাওলানা মওদূদী মুসলিম লীগের সাথে মিলে আন্দোলন করেননি কেন? তার একমাত্র কারণ ছিল মুসলিম লীগের কর্মপন্থা। মাওলানা একাধিকবার এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন-
যদি আমাদের লক্ষ্য একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন হয়, তাহলে সে লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্যে আমাদের জাতিকে নৈতিক দিক দিয়েও তৈরি করে নিতে হবে। এর জন্যে শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তাধারা, নৈতিকতা, তাহযীব-তামাদ্দুন, রাজনীতি প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই আমাদেরকে কাজ করতে হবে। তা ছাড়া এ উদ্দেশ্য সফল হওয়া বড়ই কঠিন।
এ আন্দোলনে সার্বিকভাবে ও সকল বিভাগে নেতৃত্ব নির্বাচনে অতি সাবধানতার সাথে কাজ করতে হবে। সামাজতন্ত্রী, নাস্তিক, ধর্মহীন, জায়গীদার, জমিদার প্রভৃতি সকলকে একস্থানে একত্র করলে যে ভীড় জমে ওঠে, তা কোনদিনই জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে না। এরা তো একে অপরের ধ্বংস সাধনে ও নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থের জন্যই জাতিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। ফলে গন্তব্য লক্ষ্যচ্যূত হবে। (বলা বাহুল্য মাওলানার তৎকালীন আশংকা প্রতিফলিত হয়েছে। পাকিস্তানের বিগত তিন যুগের ইতিহাস বারবার একথারই প্রমাণ দিয়েছে – গ্রন্থকার।)
মুসলমানদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা একটি আদর্শবাদী ও সত্যের দিকে আহবানকারী দল। কোন মূল্যেই যেন এ বৈশিষ্ট্য প্রভাবিত হতে না পারে।
দুঃখের বিষয় মুসলিম লীগ কর্তৃপক্ষ এসব কথায় কোন গুরুত্ব দেয়া প্রযোজন বোধ করেনি।
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কার্যকরী সংসদের (Commitee of Action) পক্ষ থেকে লিখিত এক পত্রের জবাবে মাওলানা বলেন-
“আপনারা কখনও একথা মনে করবেন না যে, কোন প্রকার মতানৈক্যর কারণে আমি এ কাজে অংশগ্রহণ করছি না। প্রকৃতপক্ষে আমার অক্ষমতা এই যে, আমি বুঝতে পারছি না যে, যদি অংশগ্রহণ করি তা কিভাবে করব। অর্ধ বা অসম্পূর্ণ উপায়-পদ্ধতি আমার মনে ধরে না। নিজের জন্য এটাই সঙ্গত মনে করি যে, আমি এ ব্যাপারে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার পরিবর্তে একজন ছাত্রের মতো দেখতে থাকি যে, পরিকল্পনাকারীগণ এ আংশিক সংস্কার ও গঠনমূলক কাজের কি উপায় নির্ধারণ করেন এবং কার্য সম্পাদনকারীগণ তা কার্যে পরিণত করে কি সুফল প্রদান করেন।”(তর্জুমানুল কোরআন, জুলাই-অক্টোবর-১৯৪৪)
এ ছিল মুসলিম লীগের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে মাওলানার মতানৈক্য। তাঁর এ অভিমত সম্পর্কে দ্বিমত হতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতের ইতিহাস লেখক বোধহয় এ সত্যকে উপেক্ষা করতে পারবেন না যে, ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে ও দিচ্ছে, স্বাধীনতা লাভের সাঁইত্রিশ বছর পরও পাকিস্তান যে বাস্তব ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত না হয়ে শুধু কাগজে কলমেই রয়ে গেছে, উপরন্তু তাকে সত্যিকার ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা-চরিত্র যারা করছেন, তাদেরকে যেভাবে জেল, ফাঁসি ও নানাবিধ অত্যাচার-নির্যাতনে নিষ্পেষিত হতে হচ্ছে, এসবের ভবিষ্যদ্বাণী বিভাগপূর্বকালেই মাওলানার প্রবন্ধাদিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
তথাপি এ কথা ভুললে চলবে না যে, মাওলানা পাকিস্তান আন্দেলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করলেও লেখনীর মাধ্যমে ইসলামী জীবন বিধানের সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ করে পাকিস্তান আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতাই করে এসেছেন। পাকিস্তান আন্দোলন চলাকালে মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক এরূপ মন্তব্য করতে লাহলো যে, ভারতকে খন্ড-বিখন্ড করা কি সহ্য করা যায়। মাওলানা তার জবাবে বলেন-
“মুসলমান হিসাবে আমার কাছে এ প্রশ্নের কোনই গুরুত্ব নেই যে ভারত অখন্ড থাকবে না দশ খন্ডে বিভক্ত হবে। সমগ্র পৃথিবী এক দেশ। মানুষ তাকে সহস্র খন্ডে বিভক্ত করেছে। আজ পর্যন্ত পৃথিবী যত খন্ডে বিভক্ত হয়েছে তা যদি ন্যায়সঙ্গত হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও কিছু খন্ডে বিভক্ত হলেই বা ক্ষতিটা কি? এই দেব-প্রতিমা খন্ড-বিখন্ড হলে মনঃকষ্ট হয় তাদের, যারা একে দেবতা মনে করে। আমি যদি এখানে এক বর্গমাইলও এমন জায়গা পাই, খোনে মানুষের উপর খোদা ব্যতীত অন্য কারো প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব থাকবে না, তাহলে এ সামান্য ভূমি খন্ডকে আমি সমগ্র ভারত থেকে অধিকতর মূল্যবান বলে মনে করব।”
(সিয়াসী কাশমাকাশ, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৭৬-৭৭)।
যে সময়ে পাকিস্তান দাবিকে ইসরাঈলীদের দাবির সাথে তুলনা করা হলো, তখন তার তীব্র প্রতিবাদ করে মাওলানা জানালেন-
“আমার মতে পাকিস্তান দাবির সাথে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমির দাবির কোন তুলনাই হতে পারে না। ফিলিস্তিন প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদের আবাসভূমি নয়। ইহুদীদের এ অবস্থা ছিল না যে, জাতীয় আবাসভূমি স্বরূপ তাদের একটা দেশ আছে, যার সংস্কৃতির জন্য তারা চেষ্টা করছে। বরং তাদের সত্যিকার পজিশন এই যে, একটা দেশ তাদের জাতীয় আবাসভূমি মোটেই নয়, অথচ তাদের দাবি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে তাদেরকে সেখানে একত্র করে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হোক এবং বল পূর্বক সে দেশকে তাদের জাতীয় আবাসভূমি বানিয়ে দেওয়া হোক। পক্ষান্তরে পাকিস্তান দাবির ভিত্তি এই যে, যে সব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলো তো তাদের জাতীয় আবাসভূমি। মুসলমানদের বক্তব্য এই যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে এক হয়ে থাকার ফলে তাদের জাতীয় আবাসভূমির রাজনৈতিক সত্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে তা থেকে তাদেরকে রক্ষা করা হোক এবং অখন্ড ভারতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে ‘হিন্দু ভারত’ ও ‘মুসলিম ভারত’ নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হোক। অন্য কথায় মুসলমানদের এ দাবি নয় যে, তাদের জন্য একটা জাতীয় আবাসভূমি সৃষ্টি করা হোক। বরং তাদের বক্তব্য এই যে, তাদের যে জাতীয় আবাসভূমি বর্তমান রয়েছে স্বতন্ত্রভাবে সেখানে এক স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করার অধিকার তাদের দেয়া হোক।”
(তর্জুমানুল কোরআন, জুলাই-অক্টোবর-১৯৪৪)।
পাকিস্তান একটা পূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র হবে একথা মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে জোরে-শোরে প্রচার করা হচ্ছিল। লীগ মহল থেকে কেউ কেউ অনুভব করছিলেন যে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার জন্য মৌলিক নীতি সম্বলিত একটা খসড়া তৈরী করা প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে ইউপি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে একটি উলামা কমিটি গঠন করা হয়। এতে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী, মাওলানা আযাদ সুবহানী, নবাব মুহম্মদ ইসমাঈল (ছাতারীর নবাব), নবাব শামসুল হাসান এবং চৌধূরী খালিকুজ্জামানের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
উক্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ছাতরীর নওয়াব মুহাম্মদ ইসমাঈল খান। একচল্লিশের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে লাখনৌর ‘নাদ্ওয়াতুল উলামা’ কমিটির বৈঠকে যোগদানের জন্যে ছতরীর নওয়াব মাওলানাকে অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেন। বৈঠকে যোগদানের আগে মাওলানা ‘নাদওয়ার’ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর কাছে যে পত্র দেন তা ‘আমার প্রিয় গ্রন্থ’ শীর্ষক বণর্না গ্রন্থের শেষে সন্নিবেশিত হয়েছে।
সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক রিসার্সের রীডার জনাব কামরুদ্দীন খান সাহেব বলেন যে, তিনি একবার মাওলানা মওদূদীর উঙ্গিতে ১৯৪১ সালে কায়েদে আযমের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি এ বিষয়ে নিম্নরূপ বিবরণ দেনঃ
“মাহমুদাবাদের রাজার মাধ্যমে দিল্লীর গুলরানা ভবনে আমাদের স্বাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। কায়েদে আযম পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর্যন্ত অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে আমার কথা শুনতে থাকেন। তারপর বলেন যে, মাওলানা মওদূদী যে খেদমত করেছেন, তা তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। কিন্তু এই উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ তাঁর পবিত্র জীবন ও কর্মধারা অপেক্ষা আশু প্রয়োজনীয়। জামায়াত একটা মহান উদ্দেশ্যের জন্যে কাজ করছে এবং লীগ সেই সমস্যার আশু সমাধানে প্রবৃত্ত রয়েছে। কারণ এর সমাধান না হলে জামায়াতের কাজ পূর্ণ হতে পারবে না।
– সাপ্তাহিক Thinker (১৯৬৩ সালের ২৭ শে ডিসেম্বরের একটি প্রবন্ধ)।
উপরের আলোচনা দ্বারা একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, মাওলানা মওদূদী শুধু যে পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন তা নয়, বরং এ আন্দোলনকে সার্বিক সাহায্য করেছেন, এর গতিবেগ বর্ধিত করেছেন, আন্দোলন বিরোধী উক্তি ও সমালোচনার অকট্য যুক্তিপূর্ণ জবাব দিয়েছেন। তবে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন নি, করতে পারেন নি। বিভিন্ন চরিত্র ও মতাদর্শের এমনকি ইসলামের বিপরীত মতাদর্শের লোকের ভীড় জমিয়ে যে দল গঠিত হয়, তা কোনদিনই কোন মহৎ আদর্শের দিকে চলতে পারে না। এ তত্ত্বজ্ঞান মাওলানার ছিল। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে, এ বিষয়ে তিনি ভারত বিভাগের বহু পূর্বে যে সব ভবিষ্যবানী করেছেন, তা পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে এবং আজও যাচ্ছে। আশা করি এতে করে মাওলানা সম্পর্কে বিরূপ মত পোষণকারীদের ভ্রান্তি দূর হবে।
মাওলানা মওদূদী – ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের পর
মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলমান অবশেষে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত লীগের এক ঐতিহাসিক অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্থাব গ্রহণ করে। মুসলমানদেরকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দান এবং তাদের জন্যে ভারত উপমহাদেশেই একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি দান করতে হবে, যেখানে তারা তাদের দ্বীন, তাহযীব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্য অনুযায়ী একটি পূর্ণ রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে। এই ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের মূল কথা। ইসলামের নামে এই পাকিস্তান আন্দোলন চলতে থাকলেও তা যে ইসলাম কায়েমের জন্যে মোটেই অনুকূল ও উপযোগী ছিল না, তা মাওলানা মওদূদী স্পষ্ট বুঝেছিলেন। কারণ মুসলিম লীগ তার বিঘোষিত গন্তব্যের দিকে যাত্রা না করে ভিন্ন পথে ভিন্ন দিকেই যাত্রা শুরু করেছিল। এর দু’প্রকার কারণ হতে পারে। প্রথমত, হয়তো তার উদ্দেশ্যের মধ্যে পূর্ণ আন্তরিকতার অভাব ছিল কিংবা দ্বিতীয়ত, লক্ষ্যস্থলে উপনীত হওয়ার সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি তার জানা ছিল না।
পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ছ’মাস পরে ১১ই সেপ্টেম্বর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ষ্ট্রাচী হলে ‘আনজুমানে ইসলামী তারীখ ও তামাদ্দুনের’ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় মাওলানা মওদীদী এক দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ‘ইসলামী রাষ্ট্র কিরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়?’ (ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হুতি হ্যায়?) তাঁর এ বক্তৃতা উর্দু, ইংরেজী, বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। ‘ইসলামী বিপ্লবের পথ’ গ্রন্থখানি এরই বাংলা অনুবাদ।
বক্তৃতায় মওলানা বলেন-
“ইসলামী রাষ্ট্র নিছক একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র। সংকীর্ণ জাতীয়তা ও উহার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব হইতে উহা সম্পূর্ণ মুক্ত। বস্তুতঃ ইসলামী হুকুমাতের ইহা প্রথম বৈশিষ্ট্যই উহাকে দুনিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র হইতে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দান করিয়াছে। ইংরেজি ভাষায় এই ধরনের রাষ্ট্রকে বলা হয় IDEOLOGICAL STATE । এহেন আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রের সহিত পৃথিবীর একাধিকবার পরিচিত হইতে পারে নাই। মুসলিম সমাজে জন্মগ্রহণ করিয়াও যাহারা সামাজিক ধারণা ও মতবাদ ইউরোপীয় ইতিহাস, ইউরোপীয় রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞান হইতে গ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের মন ও মস্তিষ্কে এই আদর্শবাদের স্থান হইতে পারে না।” (ইসলামী বিপ্লবের পথ – পৃষ্ঠাঃ ৪৮)।
মাওলানা আরও বলেন-
“ইসলামী রাষ্ট্রের গোটা ইমারতের কাঠামো আল্লাহ তায়ালার প্রভুত্বের বুনিয়াদের উপর স্থাপিত। বস্তুত ইহা ইসলামী হুকুমাতের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। নিখিল বিশ্বজগত একমাত্র আল্লাহ তায়ালার রাজ্য, তিনিই ইহার প্রভু, শাসক ও বিধানকর্তা। ইহাই ইসলামী রাষ্ট্রনীতির মৌলিক ধারণা। কোন ব্যক্তি, পরিবার, শ্রেণী কিংবা জাতি তথা সমগ্র মানুষেরও কোনরূপ প্রভুত্বের অধিকার নাই। রাষ্ট্রীয় বিধান রচনার এবং হুকুম-নির্দেশ দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তায়ালার- অন্য কাহারও নয়। মানুষ এই দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার খলীফা বা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করিবে। পৃথিবীর রাষ্ট্র পরিচালনার ইহাই একমাত্র বিশুদ্ধ ও সুষ্ঠু পন্থা।” (ইসলামী বিপ্লবের পথ)।
ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিশেষ গুণাবলী সম্পর্কে মাওলানা বলেন-
“ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে এক বিশেষ মনোবৃত্তি, বিশেষ প্রকৃতি এবং বিশেষ ধরনের কার্যক্রম নির্ধারণ আবশ্যক। অন্য কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সহিত উহার কোন তুলনাই হইতে পারে না। উহার সৈন্যবাহিনী, উহার পুলিশ, আদালত, উহার অর্থনীতি, আইন-কানুন ও রাজনীতি, উহার সন্ধি ও যুদ্ধনীতি এবং তৎসংক্রান্ত কার্যালাপ প্রভৃতি সবকিছুই ধর্মহীন রাষ্ট্র হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধর্মহীন বৈষয়িক রাষ্ট্রের আদালতের জজ ও প্রধান বিচারপতি ইসলামী হুকুমাতের কেরানী বা চাপরাশী হওয়ারও যোগ্য নয়। ওখানকার পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল ইসলামী হুকুমাতে একজন সাধারণ কনস্টেবলের পদেও নিয়োগ পাইতে পারে না। ওখানকার ফিল্ড মার্শাল এখানে সাধারণ সৈন্যবাহিনীতেও প্রবেশ করিতে পারে না। ওখানকার পররাষ্ট্র সচিব ইসলামী রাষ্ট্রে কোন পদ লাভ করা তো দূরের কথা, মিথ্যা প্রচারণা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধের দরুন নির্বাসন দন্ড লাভের যোগ্য।”(ইসলামী বিপ্লবের পথ-পৃষ্ঠাঃ ১১)।
মাওলানা তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্ট ভাষায় এ কথা বলেন যে, ইসলামী রাষ্ট্র যেহেতু একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা করতে হলে সর্বপ্রথম ইসলামী আদর্শে পূর্ণ চরিত্রবান ও ইসলামী গুণে গুণান্বিত কিছুসংখ্যক লোক ও অনরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নতুবা এ ধরনের কোন আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র সম্ভব নয়। তিনি দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলেন-
“রুশো, ভলটেয়ার এবং মনটেস্কিভ প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ দীর্ঘকাল ধরিয়া ফ্রান্সে যে বিশেষ আদর্শের নৈতিক ও মানসিক ক্ষেত্র তৈয়ার করিয়াছিলেন, তাহার ফলেই সেখানে তাহাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী বিপ্লব সৃষ্টি সম্ভব হইয়াছিল। রুশ বিপ্লব কেবল মার্কসের চিন্তাধারা, লেলিন ও ট্রটস্কির নেতৃত্ব, আর কমিউনিজমের মতাদর্শে সুদীক্ষিত হাজার হাজার কমিউনিস্ট কর্মীর বিপ্লবী কার্যকালাপের দ্বারাই সৃষ্টি হইতে পারিয়াছিল, অন্য কোন উপায়ে নয়। জার্মানীর জাতীয় সমাজতন্ত্রবাদ সেই বিশেষ ধরনের নৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই শিকড় গাড়িয়া দাঁড়াইতে পারিয়াছিল, যাহা হেগেল, ফিস্টে, গ্যেটে, নিটশে এবং তাহাদেরই মত আরও অসংখ্য চিন্তানায়কের গবেষণা, চিন্তাধারা, মতবাদ এবং হিটলারের দুর্ধর্ষ নেতৃত্ব দ্বারা সৃষ্টি হইয়াছিল। ঠিক তদ্রুপ ইসলামী বিপ্লবও তখনই সৃষ্টি হইবে এবং ইসলামী রাষ্ট্রও তখনই প্রতিষ্ঠিত হইবে, যখন কোরআনের আদর্শ ও মতবাদ এবং নবী মুস্তফার (সাঃ) চরিত্র ও কার্যকলাপের বুনিয়াদে কোন গণ-আন্দোলন জাগিয়া উঠিবে। আর সমাজ জীবনের সমগ্র মানসিক, নৈতিক, মনসতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক বুনিয়াদকে একটি প্রবলতর সংগ্রামের সাহায্যে একেবারে আমূল পরিবর্তন করিয়া ফেলা সম্ভব হইবে। জাতীয়তাবাদ আন্দোলন দ্বারা কোন ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি হইতে পারে না। কারণ তাহার পশ্চাতে রহিয়াছে ভুল শিক্ষা পদ্ধতি এবং উহার ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছে সুবিধাবাদী মনোবৃত্তি ও কালের গড্ডালিকা প্রবাহে অনির্দেশের পথে ভাসিয়া বেড়াইবার উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তির উপর। বস্তুতঃ রাষ্ট্র ও সমাজ দর্শনের ক্ষেত্রে প্রক্তন ফরাসী মন্ত্রী মঁসিয়ে রেনোর ন্যায় আমি এই ধরনের কোন অস্বভাবিক ঘটনায় মোটেই বিশ্বাসী নই। ইহাই আমার আন্তরিক বিশ্বাস। কাজ যেরূপ হইবে, ফল তাহার অনুরূপ হইবেই- ইহার ব্যতিক্রম সম্ভব নয়।” (ইসলামী বিপ্লবের পথ, পৃষ্ঠাঃ ১৮-১৯।)
পাকিস্তান তথা ইসলামী হুকুমাতের জন্যে যে ধরনের আন্দোলন ও কর্মপদ্ধতি চলছিল, তার কঠোর সমালোচনা করে মাওলানা বলেন-
“এক শ্রেণীর মুসলমান মনে করেন যে, মুসলিম জাতিকে কোনরূপে সঙ্গঠিত করিতে পারিলেই সকল দুঃখের অবসান হইবে। মুসলিম নামধারী একটি জাতিকে নির্দিষ্ট কোন প্লাটফরমে সমবেত এবং একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে সংগঠিত ও পরিচালিত করিতে পারিলেই আপনা আপনিই আসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা অবাস্তব কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কিছুই নহে। উপরন্তু ইহা অন্ধ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও জাতীয়তাবাদী কর্মপন্থা মাত্র, তাহাতে সন্দেহ নাই। যে জাতিই দুনিয়াতে নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম করিতে চাহিবে, তাহাকে এই পন্থা অবলম্বন করিতে হইবে, সে যে ধর্মের বা যে দেশের অন্তর্ভুক্তই হউক না কেন। জাতির প্রেমে আত্মহারা নেতার সর্বাপেক্ষা বড় পরিচয় এই যে, তিনি সময় ও সুযোগ বুঝিয়া কথা বলিতে পারেন, বিভিন্ন প্রকার চাল চালিতে পারেন এবং নির্দেশ দান ও দল পরিচালনার দক্ষতা তাঁহার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় থাকে। এহেন নেতার নেতৃত্বে জাতির যথেষ্ট উন্নতি লাভ হইতে পারে, তাহা অনস্বীকার্য। অনুরূপভাবে মুসলমানও যদি কেবলমাত্র একটি বংশানুক্রমিক কিংবা ঐতিহাসিক ঐতিহ্যসম্পন্ন জাতির সমষ্টির নাম হইত। কিন্তু এই ধরনের নেতৃত্ব ও কর্মপ্রণালীর দ্বারা আদৌ কোন ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি হইতে পারে না এবং উহার দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না, তাহা আর নতুন করিয়া বলিবার আবশ্যক হয় না।” (ইসলামী বিপ্লবের পথ- পৃষ্ঠাঃ ২০-২১।)
অবিভক্ত ভারতে পাকিস্তান আন্দোলন পূর্ণ উদ্দমে চলছিলো বটে, কিন্তু পথভ্রষ্ট ও চরিত্রহীন সমাজের সংস্কার সাধনের কোনই চেষ্টা করা হয়নি এবং সে সম্পর্কে কোন কর্মসূচীও গ্রহণ করা হয়নি। সমাজের মধ্যে ইসলামী চেতনাবোধ ও নৈতিক অবস্থঅ অতীব নৈরাজ্যজনক ছিল। জাহেলী যুগের আবর্জনা ও চরিত্রদোষসহ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছিল। মাওলানা এসবের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন-
“যে জাতির নৈতিক অবস্থা এত হীন ও অধঃপতিত, তাহার সেই নানা মতের ও নানা প্রকৃতির জনতার ভিড় জমাইয়া একটি বাহিনী গঠন করিয়া দিলে কিংবা রাজনৈতিক শিক্ষাদীক্ষার সাহায্যে তাহাদিগকে শৃগালের ন্যায় চতুর করিয়া তুলিলে অথবা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী করিয়া তাহাদের মধ্যে ব্যাঘ্রের হিংস্রতা জাগাইয়াতুলিলে অরণ্য জগতের প্রভুত্বলাভ করা হয়ত বা সহজ হইতে পারে, কিন্তু তাহার সাহায্যে মহান আল্লাহ্ তায়ালার দ্বীন ইসলামের কোন প্রচার হওয়া বা ইসলামী হুকুমাত কায়েম হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। কারণ এমতাবস্থায় দুনিয়ার কেহই তাহাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিবে না, কাহারও মনে ইসলামের আবেগময়ী ভাবধারা ও অনুপ্রেরণা জাগ্রত হইবে না এবং এই সব কারণেই ইসলামের সীমার মধ্যে দুনিয়ার মানুষের দলে দলে অনুপ্রবেশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন করার ভাগ্য কখনই হইবে না।” (ইসলামী বিপ্লবের পথ- পৃষ্ঠাঃ ২২)।
মুসলিম লীগ যে ভুল পথে তার আন্দোলন পরিচালনা করছিল, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে তার ভুল ধরে দিয়ে মাওলানা মওদূদী বলেন-
“আমি বুঝতে পারি না, একবার একটি ধর্মহীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়া গেলে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে তাহার পরিবর্তন করিয়া উহাকে ইসলামী আদর্শে ঢালিয়া গঠনকরা কিরূপে সম্ভব হইতে পারে। গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুসারে দেশের ভোটদাতাদের মধ্যে যদি ইসলামী মতবাদ, ইসলামী স্বভাব-চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামী মূল্যবোধ জাগ্রত না হয়, তাহারা যদি ইসলামী জীবন যাপন করিতে পূর্ব হইতেই অভ্যস্ত না হয়, তাহা হইলে তাহাদের ভোটে কখনই ‘প্রকৃত মুসলিম’ ব্যক্তি নির্বাচিত হইয়া পার্লামেন্টে বা ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য হইতে পারিবে না। ফলে রাষ্ট্রশক্তি এমন সব লোকের কুক্ষিগত হইয়া পড়িবে যাহারা আদম শুমারী রেজিষ্ট্রি বহিতে ‘মুসলমান’ বলিয়া গণ্য হইলেও মতবাদ ও চিন্তাধারা, আদর্শ ও কর্মপন্থার দিক দিয়া ইসলামের নামগন্ধও তাহাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। এই ধরনের লোকদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ার ফলে পূর্ণ আযাদী ও আযাদ রাষ্ট্র লাভ করিয়াও আমরা ঠিক সেই অবস্থায়ই জীবন যাপন করিতে বাধ্য হইবো, যে অবস্থায় ছিলাম স্বাধীনতা লাভের পূর্বে একটি অমুসলিম রাষ্ট্রের অধীনে। বরং তদপেক্ষা নিকৃষ্ট ও মারাত্মক পরিস্থির উদ্ভব হইতে পারে। কারণ যে জাতীয় রাষ্ট্রের উপর ‘ইসলামী হুকুমাতের’ লেবেল লাগানো থাকিবে, তাহা ইসলামী বিপ্লবের পথ রোধ করিবার ব্যাপারে অমুসলিম রাষ্ট্র অপেক্ষাও অধিকতর সাহসী ও নির্ভিক হইবে। এমনকি একটি অমুসলিম রাষ্ট্র যে সব অপরাধের জন্য কারাদন্ড দিবে ‘মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্র’ সেই সব ক্ষেত্রেই প্রানদণ্ড ও নির্বাসনদণ্ড দান করিবে। আর ইহা সত্ত্বেও মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্রের কর্ণধরগণ তাহাদের জীবদ্দশায় ‘গাযী’ ও ‘বীর মুজাহিদ’ এবং মৃত্যুর পর ‘মহিমান্বিত’ বলিয়া অভিহিত হইবে। অতএব মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাহায্যকারী হইতে পারে বলিয়া মনে করা একেবারেই ভুল।” (ইসলামী বিপ্লবের পথ- পৃষ্ঠাঃ ২৮।)
বলা বাহুল্য, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মাওলানার উপরিউক্ত কথাকলি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলাভের পর কয়েক বছরের মধ্যে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে।
মাওলানা উক্ত গ্রন্থে আরও মন্তব্য করেন-
“কিন্তু এখন প্রশ্ন এই যে, আমরা যদি সত্যিকারভাবে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিতে চাই, তাহা হইলে আমাদের কোন্ পন্থা অবলম্বন করিতে হইবে? আমাদের সমাজের অনেক লোক আবার নেতৃবৃন্দের উপর সবকিছু নির্ভর করিয়া হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া আছে। তাহাদের ভরসা এই যে, নেতৃবৃন্দই ইসলামী হুকুমাত কায়েম করিয়া দিবেন। সেজন্যে তাহাদের কিছুই করিবার আবশ্যকতা নাই। কিন্তু এই ধারণাও ঠিক ততখানি ভ্রান্ত, যতখানি ভ্রান্ত মুসলমানদের জাতীয় সংগঠন ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের গোড়ার দিকের কর্মপন্থা।”(ইসলামী বিপ্লবের পথ- পৃষ্ঠাঃ ২৮-২৯)
পরম পরিতাপের বিষয়, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাচী হলের বক্তৃতায় ইসলামী রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ চিত্র, তা কায়েম করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, ধারা ও বৈশিষ্ট্য এবং ভুল পন্থার ভয়াবহ পরিণাম বিশ্লেষণ করার পরও মুসলিম লীগ বেপরোয়াভাবে তার গতানুগতিক পদ্ধতিতেই কাজ করে চললো। মাওলানা তাঁর দূরদর্শিতার ফলে একথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে, গণ-আন্দোলনের ফলে একটা নব রাষ্ট্রের জন্মলাভ হয়তো বা নিশচয় হবে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র না হয়ে তা এমন ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে যে তার ভয়াবহ পরিণাম ফল হতে তাকে রক্ষা করতে হলে পূর্বাহ্নেই তার ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতের চিত্র মাওলানার মানসপটে তখনই পরিস্ফুট হয়েছিল। তিনি অবশ্য ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাসের অতীত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর উপরিউক্ত বক্তৃতায় বলেছিলেন-
“একটি গাছ মৃত্তিকা গর্ভ ভেদ করিয়া উর্দ্ভত হওয়ার সময় হইতে পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে পরিণত হওয়া পর্যন্ত যদি কমলা গাছ থাকে, তাহা হইলে হঠাৎ ফল ধারনের সময় তাহা আম ফলাইতে পারে না।”
পাকিস্তান আন্দোলনের ভবিষ্যত সম্পর্কে তাই তিনি স্পষ্ট উক্তিও করতে পেরেছিলেন।
ইসলামী আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে চিত্র মনের মধ্যে এঁকেছেন তাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্যে যে পরিবেশ ও পটভূমি তৈরির প্রয়োজন ছিল, তা জন্যে তাঁকে নিরলসভাবে বছরের পর বছর ধরে চিন্তা ও প্রেরণার জাল বিস্তার করতে হয়। তার জন্যে অসীম ধৈর্যের সাথে নৈরাশ্যের আঁধার ভেদ করে তাকেঁ যে তদ পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়েছিল তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্যে তর্জুমানুল কোরআনের ধারাবাহিক আলোচনার মূল বিষয়বস্তু পাঠকবর্গের সামনে পেশ করছি। এর থেকে এ সত্যো তারা উপলব্ধি করতে পারবেন যে, আকীদাহ বিশ্বাস, চিন্তা ও কর্মের দিক দিয়ে একটি বিকৃত ও অধঃপতিত মুসলমান জাতির মধ্যে সত্যিকার ইসলামী আন্দোলনের সূচনা করা কত বড় দুঃসাধ্য কাজ ছিল, যা মাওলানা মাওদূদী করেছিলেন। যে কেউ ইচ্ছা করলেই এবং যে কোন সময়ে ইসলামী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন না। তার জন্যে প্রয়োজন হয় ইসলাম তথা কোরআন ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য, তা সহজ-সরল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় প্রকাশ করার অনুপম লেখনীশক্তি, পথভ্রষ্ট মানব সমাজকে সত্যের পথে, আলোকের পথে আনবার হিকমত ও দক্ষতা। তদুপরি প্রয়োজন সংবেদনশীল মন-মানসিকতা, অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা, কালজয়ী সাত্যি রচনার যোগ্যতা ও অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা। এ সবকিছুই পরিপূর্ণরূপে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দান করেছিলেন।
জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা
‘দ্বীন হক’ প্রতিষ্ঠার জন্যে মাওলানা আবুল আ’লা মাওদূদী তাঁর মাসিক পত্রিকা ‘তর্জুমানুল কোরআনের’ মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করেন। যে কোন আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে এবং তাকে বাস্তব রূপ দিতে প্রয়োজন হয় একটি জামায়াত বা দলের। ঐক্যবদ্দ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম ব্যতীত কোন আন্দোলন পরিচালনা মোটেও সম্ভব নয়। এ উদ্দেশ্যে মাওলানা ১৯৪১ সালে ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামে একটি দল কায়েম করেন। পাকিস্তান আন্দোলন চলাকালে ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামে আর এতটি দল কায়েম করার কি প্রয়োজন ছিল এবং তৎকালীন ভারতীয় মুসলমান রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল তার বিশদ আলোচনার প্রয়োজন। মুসলিম লীগ মুসলমানদের সকল প্রকার প্রয়োজন পূরণ করতে পারতো কিনা এবং না পারলে তার বিকল্প ব্যবস্থা কি হতে পারতো, তাও আমাদের পরিষ্কার জানা দরকার।
ব্রিটিশ সরকার ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে একথা উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশ শাসনে ভারতবাসীকে অংশ গ্রহণের অধিকার দিতে হবে এবং তা হবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সে গণতন্ত্র আবার ইংল্যান্ডে প্রচলিত গণতন্ত্রের অনুরূপই হবে। ব্রিটিশ সরকার মনে করেছিলেন ইংল্যান্ডের ন্যায় ভারতবাসীও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এক জাতি। তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল শাসনকার্য পরিচালনা করবে এবং সংখ্যালঘু দল বিরোধী দলে থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের চেষ্টা করবে। এ সবের পশ্চাতে আবার ছিল তাদের তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক দর্শন। তা হলো এই যে, ধর্ম শুধু মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন সূচিত হবে তার দ্বারা উপকৃত একমাত্র তারাই হতে পারে যারা ছিল ভারত সংখ্যাগুরু। এ জন্যে ব্রিটিশ সরকার এ ব্যবস্থা শুধু মেনে নিতেই রাজি হয়নি, বরঞ্চ তার জন্যে জোর ওকালতিও শুরু করে দেয়। এদিকে ভারতীয় কংগ্রেসের সমগ্র আন্দোলন প্রথম থেকেই এই চলছিল যাতে করে সে উক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটা দায়িত্বশীল সরকার গঠনের চেষ্টা-চরিত্র করতে পারে। কিন্তু মুসলমানদের জন্যে উক্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণা হলাহল সমতুল্য ছিল বলে তারা এ বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।
প্রথমে তারা ভাবলো যে, দেশবাসীর হাতে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার না আসাই ভাল। বরঞ্চ তা ব্রিটিশ শাসকদের হাতেই থাকুক। কিন্তু পরে তারা একজাতীয়তার ভিত্তিতে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলনীতিই মেনে নিল। তবে তার সঙ্গেতাদের চেষ্টা এই ছিল যে, তাদের জন্যে আইননুগ রক্ষাকবচ থাকতে হবে, যাতে করে তারা স্বীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে। অতঃপর হঠাৎ খেলাফত আন্দোলনের সময়ে তারা হিন্দু মুসলিম ঐক্যের শ্লোগান শুরু করে দেয় এবং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উপর আস্থা স্থাপন করে আত্মসমর্পণে রাজী হয়। এরপর আবার আইনানুগ রক্ষাকবচের দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু এই প্রশ্নে ক্রমশ তাদের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়। একদলের অভিমত এই ছিল যে, প্রথমে সংখ্যাগুরুর সংগে মিলিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা হোক। তারপর রক্ষাকবচের দাবি উত্থাপন করা হবে। দ্বিতীয় দল বলেন যে, প্রথমে সংখ্যালঘু হিসাবে তাদের রক্ষাকবচের ব্যবস্থা হোক। তারপর সম্মিলিত স্বাধীনতা আন্দোলন করা যাবে। কিন্তু উভয় দলের মধ্যে কেউ একথা বুঝল না যে, একজাতীয়তার মূলনীতিতে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়, তার মধ্যে কোন জাতীয় স্বাতন্ত্র্য অক্ষুন্ন থাকতে পারে না এবং একটি ধর্মহীন রাষ্ট্রে কোন ধর্মীয় তাহযীব-তামাদ্দুনের বিকাশও সম্ভব হতে পারে না।
এই অবস্থার মধ্য দিয়ে ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন পাস হয় এবং ভারতের প্রদেশগুলিতে পূর্ণ্য স্বায়ত্ব শাসনের ভিত্তিতে নতুন সরকার কায়েম হয়। এতে করে পরীক্ষায় বুঝতে পারা গেল যে, একজাতীয়তায় গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ধর্মহীনতার মূলনীতির উপর এ দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় শাসনকার্য চালাতে থাকবে।
দূরদর্শী মাওলানা মওদূদী চিন্তা করলেন যে, এরূপ ব্যবস্থার ফলে মুসলমানদেরকে ভবিষ্যতে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা পরিষ্কার করে তাদের সামনে তুলে ধরা দরকার। কারণ তাঁর কাছে এ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট ছিল যে, ঐরূপ ব্যবস্থার অধীনে কোন প্রকার আইনানুগ রক্ষাকবচ মুসলমান ও তাদের তামাদ্দুনকে সংখ্যাগুরুর তাহযীব-তামাদ্দুনে বিলনি হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে না। এই বিপদ লক্ষ্য করে মাওলানা মওদূদী ১৯৩৭ সাল থেকে আরম্ভ করে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত তিন বছর যাবত তর্জুমানুল কোরআনের মাধ্যমে “মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ” এবং “মাসয়ালায়ে কওমিয়ত” শীর্ষক প্রবন্ধ লিখেন যা পরে গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়। এ সকল প্রবন্ধের দ্বারা তিনি মুসলমানদেরকে একথা বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, যদি তারা একজাতীয়তার মূলনীতিতে একটা গণতান্ত্রিক ধর্মহীন রাষ্ট্র গঠন মেনে নেয়, তাহলে এটা তাদের আত্মহত্যারই শামিল হবে।
এরপর মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা শুভবুদ্ধির উদয় হয়। তারা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারলো যে, একজাতীয়তার ভিত্তিতে যে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হবে, তার অধীনে কোন আইনানুগ রক্ষাব্যবস্থা তাদের কোনই কাজে লাগবে না। কিন্তুএখন তাহলে উপায় কি হবে? এক দল বলল যে, ভারত বিভাগের দাবি করা হোক এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলি ভারত থেকে পৃথক করা হোক। অনেকেই এ প্রস্তাব মানতে প্রথমে রাজী হলো না। মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও প্রথমে এতে রাজী ছিলেন না। কারণ তাঁদের ধারণা ছিল, এর দ্বারা একটা জাতির এক অংশের সমস্যার সমাধান হয়। পক্ষান্তরে অপর বৃহত্তর অংশ যা ভারতের বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্তভাবে দুর্বল সংখ্যালঘু হিসাবে ছড়িয়ে আছে, তাদেরকে হিন্দু ভারতের অনুগ্রহের উপরই ছেড়ে দেয়া হবে।
ঠিক এ সময়ে মাওলানা মওদূদী “সিয়াসী কাশমকাশ” তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে মাওলানা মওদূদী বলেন যে, ভারতীয় মুসলমান যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার একমাত্র কারণ এই যে, নিজেদেরকে একটা জাতি হিসাবে তারা একথা চিন্তা করে যে গণতন্ত্রে তাদের শক্তি নির্ভর করে সংখ্যার উপর। এই জন্যে তারা দ্বিগুণ সমস্যায় পড়েছে। যদি ভারত অখণ্ড থাকে, তাহলে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি বিভক্তি হয় তাহলে জাতির অর্ধাংশকে ভারতীয় হিন্দুর কৃপার উপর ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু মাওলানা বলেন যে, ভারতীয় মুসলমান প্রকৃতপক্ষে শুধু একটি জাতি নয় বরং একটা আদর্শবাদী দল বা মিল্লাত। জার্মানী, ফরাসী, ইংরেজদের মতো তারা বংশানুক্রমিক কোন জাতি নয়। তাদের একটা স্বতন্ত্র জীবন দর্শন আছে, একটা আদর্শ আছে এবং জীবনের এক মহান লক্ষ্য আছে। এ আদর্শেরই বলে তারা অতীতে দেশের পর দেশ জয় করেছে। ভারতের বর্তমান কোটি কোটি মুসলমানও সে আদর্শের দ্বারাই বশ হয়েছে। অতএব মুসলমান যদি জাতীয় অধকার ও জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে নিজের আদর্শ ও জীবন দর্শনের জন্যে সংগ্রাম করে, তাহলে এই হবে যে, ভারতে তাদেরকে কেউ ধ্বংস তো করতে পারবেই না, উপরন্তু একদিন সারা ভারতের উপর ইসলামী পতাকা উড্ডীন হওয়ার আশও করা যায়। কারণ ভারতের জন্য কোন জাতি বা দলের নিকট এমন কোন জীবন্ত আদর্শ নেই, যা ইসলামী মুসলমানদেরকে দিয়েছে।
মাওলানা তাঁর উপরিউক্ত মতবাদ ভারতীয় মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ করলো না। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং জাতীয় লক্ষ্য হিসাবে এর জন্যে জোরদার আন্দোলন চলতে থাকে।
এরপর স্বভাবতই দু’টি প্রশ্ন চিন্তাশীলদের উদ্বেগ্ন করে তুললো। প্রথমটি এই যে, পাকিস্তান আন্দোলনের পর যদি, খোদা না করুন, মুসলমানদেরকে নিরাশ হতে হয়, তাহলে এই জাতীয় পরাজয়ের পরিণাম ফল থেকে ইসলাম, ইসলামী তাহযীব ও মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য কিভাবে রক্ষা করা যাবে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান হয়ে গেলে ভারতের কোটি কোটি মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের আলো প্রজ্জ্বলিত রাখার উপায় কি হবে? এবং যে সকল লোকের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন চলছে তাতে পাকিস্তানকে দ্বিতীয় তুরষ্ক হওয়া থেকে কিভাবে রক্ষা করা যেতে পারে?
এ দু’টি প্রশ্ন মাওলানাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তাই বহু চিন্তা গবেষণার পর তিনি ১৯৪১ সালে ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামে একটি দল গঠন করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এ দলটির দ্বারা এই পাক-ভারত উপমহাদেশে এমন কিছু ইসলামের সাচ্চা সৈনিক তৈরি হবে, যারা এ দেশে ইসলামের বাণী সমুন্নত রাখার সংগ্রাম করে যাবে। পাকিস্তান আন্দোলন ব্যর্থ হলে জাতীয় পরাজয়ের ভয়াবহ পরিণাম থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করবে- এবং পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার পর তাকে সঠিক পথে চালাতে সাহায্য করবে।
জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন
“এখন মানবতার ভবিষ্যত ইসলামের উপর নির্ভরশীল। মানুষের তৈরি সকল মতবাদ ব্যর্থ হয়েছে। তাদের কোন একটিরও সাফল্য লাভের আর কোনই সম্ভাবনা নেই। মানুষের মধ্যে আর তেমন সাহসও নেই যে, নতুন কোন মতবাদ তৈরি করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নেবে। এমতাবস্তায় ইসলামই একমাত্র মতবাদ ও পথ যার থেকে মানুষ মঙ্গল ও উন্নতির আশা করতে পারে, যেটা হবে মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং যার অনুসরণ করে মানুষ ধ্বংস থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।
বিগত একচল্লিশের এপ্রিল সংখ্যার তর্জুমানুল কোরআনে মাওলানা মওদূদী ‘একটি সৎ জামায়াতের প্রয়োজনীয়তা’ -শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখন। এতে শিরক, বৈরাগ্যবাদ ও পাশ্চাত্যের আধুনিক জড়বাদী জীবন ব্যবস্থার ব্যর্থতার বিশদ বিবরণ দিয়ে উপরিউক্ত মন্তব্য করেন এবং বলেন যে এখন মানব জাতির মুক্তি একমাত্র ইসলামের মধ্যেই নিহিত আছে। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, ইসলামের প্রচারকার্য চালাতে থাকুন, এতেই সারা দুনিয়া জয় করে ফেলবেন। আসল কথা, প্রতিটি সভ্যতার মূল্যেৎপাটনের জন্যে প্রয়োজন হয় একটা শক্তির, একটা দলের। আবার নতুন সভ্যতার জন্যেও প্রয়োজন হয় নতুন চিন্তাধারার এবং নতুন দলের। অতএব দুনিয়াকে ভবিষ্যত অন্ধকার যুগের বিপদ থেকে মুক্ত করার জন্যে এবং ইসলামের অবদান থেকে উপকৃত হওয়ার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট নয় যে, তার একটা সঠিক মতবাদ তো বিদ্যমান আছেই। বরঞ্চ সঠিক মতবাদের সাথে একটা সৎ জামায়াত বা দলেরও প্রয়োজন আছে।
অতঃপর এ জামায়াত বা দলটির প্রতিটি সদস্যকে ঈমান এবং আমলের দিক দিয়ে অতি উচ্চস্তরের হতে হবে- একথা বলার পর তিনি বলেন, বর্তমান তাহযীব-তামাদ্দুন ও তার অনুসারীদের থেকে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এ সভ্যতা ও সমাজ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা, সুখ-সম্ভোগ, ও উন্নতি-অগ্রগতির আশা-আকাঙ্খা পরিত্যাগ করতে হবে। অতঃপর একটা ভ্রান্ত সমাজ ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে তার জায়গায় একটি সঠিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্যে যে সকল বৈষয়িক ক্ষতি, দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ মুসীবত অপরিহার্য, তা বরদাশত করে যেতে হবে। এ বিপ্লবের জন্যে প্রয়োজন সর্বাত্মক প্রচেষ্টার এবং উৎসর্গ করতে হবে জান-মাল ও মূল্যবান সময়। স্বীকার করতে হবে মানসিক ও দৈহিক সকল প্রকার শ্রম। প্রস্তুত থাকতে হবে জেল, ফাঁসি, নির্যাতন, দণ্ড প্রভৃতির জন্যে। বিষয়-সম্পত্তি হতে পারে বাজেয়াপ্ত এবং স্ত্রী-পুত্র-পরিজন হতে পারে ধ্বংসের সম্মুখীন। এসব কিছুই বরণ করতে হবে হাসিমুখে। প্রয়োজন হলে নিজের জীবনও বিসর্জন দিতে হবে এই পথে। এমন দুর্গম পথ অতিক্রম করা ব্যতীত দুনিয়ায় না অতীতে কোন বিপ্লব এসেছে, আর না এখন আসতে পারে।
অগ্নিপরীক্ষার মন্ত্রে দীক্ষিত উন্নতমানের চরিত্রবান লোকদের প্রসঙ্গে মাওলানা বলেনঃ
“আমাদেরকে বলা হয় যে, এ ধরণের লোক এ যুগে আর কোথায় পাওয়া যাবে। একটি পবিত্র ও মহান যুগে তো এমন লোকের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু স্রষ্টা তো তেমন ধরণের লোক তৈরি চিরদিনের জন্যে বন্ধ করে দিয়েছেন।”
আসলে এ একটা ভ্রান্ত ধারণা, একটা কুসংস্কার। স্বয়ং যারা নৈরাশ্যের স্বীকার হয়েছে, এ কুসংস্কার তাদেরই মনে পয়দা হয়েছে। দুনিয়ায় সকল প্রকার যোগ্যতার লোক সব যুগেই পাওয়া যায়। হিটলার, মার্কস এবং গান্ধীর প্রতি ঈমান এনে লোকে যদি এত কিছু করতে পারে, তাহলে খোদার উপর ঈমান এনে কি কিছুই করা যায় না? জন্মভূমির জন্যে যদি এতটা আকর্ষণ থাকে যে, মানুষ তার জন্যে জান-মাল উৎসর্গ করতে পারে, তাহলে খোদার সন্তুষ্টি এবং নৈকট্যের জন্যে কি এতটুকুও আকর্ষণ নেই?
‘জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন’- শীর্ষক প্রবন্ধে তর্জুমানুল কোরআনে মাওলানা জামায়াত গঠনের কারণ বর্ণনা করে বলেনঃ
“আমি এবং আমার সঙ্গে একমত এমন অনেকে গত তিন বছর ধরে এ চেষ্টা করে আসছিলাম যে, বর্তমানে মুসলমানদের যে বড় বড় দল আছে, তাদের সলে অথবা তাদের যেকোন একটি তাদের গঠন পদ্ধতি ও কর্মসূচীতে এমন কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসুক যাতে করে ইসলামের এই প্রয়োজন পূরণ হয় এবং একটি নতুন দল গঠনের প্রয়োজন না থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। এরপর যারা বর্তমান দলগুলির কার্যকলাপে সন্তুষ্ট নয় এবং সত্যিকার ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে কাজ করতে আগ্রহী, তাদেরকে একত্র করা ব্যতীত আমাদের গত্যন্তর রইল না। অতএব একচল্লিশের আগস্টে তাদের দিয়ে একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয় এবং পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামী কায়েম হয়।”