[দ্বিতীয় ভাগ]
মাওলানার মধ্যে লেখনী শক্তির প্রেরণা
মাওলানা যে এক অতি উচ্চাঙ্গের প্রবন্ধকার, সাহিত্যিক ও চিন্তাশীল, তা সাহিত্য জগতের অজানা নেই। একথাও অনস্বীকার্য যে, তিনি উর্দু ভাষাকে এক নতুন রূপ ও জীবনীশক্তি দান করেছেন। তাঁর লেখনীর ধরন, বাক্য গঠনপদ্ধতি ও প্রকাশভঙ্গি একান্তই তাঁর নিজস্ব। অসাধারণ লেখার প্রেরণা যেন তাঁর জন্মগত এবং এ প্রেরণা প্রকাশ লাভ করে অতি বাল্যকালেই।
এ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব উক্তি পাঠকবর্গের অবগতির জন্য নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
“যখন আমার বয়স ছিল ন’বছর, তখন থেকেই প্রবন্ধ লেখার এক স্বাভাবিক প্রেরণা সঞ্চার হয় আমার মধ্যে। সে সময়ে জনাব আশফাক আহমদ জাহিদী নামে আমার এক বন্ধু আওরংগাবাদ আসেন এবং আমাদের বাড়ীতে কিছুদিন অবস্থান করেন। প্রবন্ধ লেখা ও বই পড়ার ভারী ঝোঁক ছিল তাঁর। তিনি আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রবন্ধ লেখার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেন এবং পাঠ্য বই ছাড়াও সাধারণ পত্র-পত্রিকা ও সংবাদপত্র পড়ার দিকে তিনি আমাদেরকে আকৃষ্ট করেন। একবার আমাদের যোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্যে তিনি বলেন, ‘মনে কর, তোমরা একটি বালিকার প্রেমে পড়েছ। এখন তোমাদের সে কল্পিত প্রেমিকার কাছে এমন একটি প্রেমপত্র লেখ, যার মধ্যে ফুটে উঠবে প্রেমের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও বিরহ-বেদনা।”
এ ব্যাপারে তো আমরা ছিলাম একেবারে অনভিজ্ঞ। বিশেষ করে আমার বয়স এমন ছিল যে, প্রেম, প্রেমিকা, বিরহ ইত্যাদি কোন বস্তু, তার কোন ধারণাই আমার মনে জন্ম লাভ করেনি। কিন্তু সে সময়ে গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ আমার পড়া ছিল। তার থেকে আমার একটুকু জ্ঞান হয়েছিল যে, ‘প্রেম এমন এক বিশেষ রোগ যা সৃষ্টি হয় কোন সুশ্রী সুন্দর মুখ দেখে, তারপর এস রোগের ফলে মনের মধ্যে জ্বলতে শুরু হয় আগুন। যা নিভে যায় একমাত্র সে মুখখানা দেখলেই। যতক্ষণ তা দেখা যায় না, ততক্ষণ সে আগুন জ্বলতেই থাকে মনের মধ্যে। আর মনের এ অবস্থারই নাম হচ্ছে ‘বিরহ’। যা হোক, আমাদের সাধ্যানুযায়ী এ জ্ঞানকে খুব কাজে লাগালাম এবং সে অবস্থার চিত্র অঙ্কন করে লিখলাম দীর্ঘপত্র। আমরা দুই ভাই এবং আশফাক ভাইয়ের মধ্যে কারও একথা মনে নেই যে, আমরা তখন কি লিখেছিলাম। কিন্তু এতটুকু অবশ্যই মনে আছে যে, আশফাক ভাই পত্র দু’খানা পড়ে স্তম্ভিত হয়েছিলেন এবং বিশেষ করে আমরটাই তিনি পছন্দ করেছিলেন বেশি। যদিও বড় ভাইয়ের পত্রখানা ছিল আকারে অধিকতর বড়।
মৌলভী পরীক্ষা পাশ করার পর এক অবসর সময়ে বড় ভাইয়ের কথায় আমি কাসিম আমীন বে’র একখানা আরবী বই ‘আল মিরআতুল জাদীদ-এর উর্দু তরজমা করেছিলাম। জানি না সে অনুবাদ লিপিগুলো এখন কোথায় আছে। তবে আমার বেশ মনে আছে, এ তরজমার সাবলীলতা, ভাষার সরলতা ও শ্রুতিমধুর বাক্যগঠন পদ্ধতিতে আব্বা মরহুম অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন এবং বড় ভাইও প্রশংসা করেছিলেন বিস্তর।
এ ছিল আমার প্রাথমিক প্রচেষ্টা। তারপর ১৯১৭ সালে ভূপালে চলে যাওয়ার পরে সাধারণ পড়াশুনার সাথে প্রবন্ধ লেখার ঝোঁক এত বদ্ধমূল হলো যে, মনে হলো মৃত্যুর আগে এর সমাপ্তি ঘট ব না। প্রাথমিক তিন-চার বছর ছিল নকল নবীশীর অবস্থা। যার লিখার ধরণ পছন্দ হতো তারই নকল করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু পড়াশুনা যতোই বাড়তে লাগলো, ততোই অনুভব করলাম যে, প্রবন্ধের সৌন্দর্য অন্যের পদ্ধতি অনুকরণে বিকশিত হয় না, বরঞ্চ হয় নিজস্ব প্রকাশভঙ্গিতে। ১৯২১ সাল থেকে নিজস্ব এক স্থায়ী ধরন পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, যার মধ্যে কারো অনুসরণ করি না।
আমি এ ধারণা পোষণ করি যে, প্রত্যেক চিন্তা-ধারণার সাথে কিছু ভাষাও উদগত হয়। আর প্রতিটি চিন্তা-ধারণা প্রকাশের জন্যে সবচেয়ে সঠিক ও সঙ্গত ভাষা তাই, যা চিন্তা-ধারণার সাথে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে। অতএব শুধু প্রবন্ধ সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। এখন রইল ভাষার কাথা। তা নির্বাচনের জন্যে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই। তা প্রবন্ধের সাথে আপনা আপনিই চলে আসবে।
এই হচ্ছে কারণ যার জন্যে আমাকে যখন কিছু লিখতে হয়, তখন আমার সকল চেষ্টা-চরিত্র শুধু চিন্তাধারা গুছিয়ে নিতে এবং মাল-মসলা ও যুক্তি-প্রমাণাদি সংগ্রহ করতেই ব্যয়িত হয়। তারপর একবার মনের মধ্যে বিষয়বস্তু সংকলিত হয়ে গেলে তাকে কাগ জ রূপান্তরিত করতে আমার বেশী সময় লাগে না। লেখার জন্যে শব্দ চয়ণের ব্যাপারে এতটা নিশ্চিন্ত থাকি যে, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া প্রায় সব ব্যাপারে একবার লেখার পর দ্বিতীয়বার দেখার দরকার হয় না।”
মাওলানার বিপ্লবী সাহিত্য
গত অর্ধ শতাব্দীকাল যাবত মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর বলিষ্ঠ ও বিপ্লবী সাহিত্য লক্ষ কোটি মানব সন্তানের মন-মস্তিষ্কে বিপ্লব এনে দিয়েছে। অসংখ্য নর-নারীর মনে খোদা-রাসূলের প্রতি নিবিড় ভালোবাসারা সঞ্চার করে তাদের জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছে। তাঁর সাহিত্য ও চিন্তাধারা কোটি কোটি মানুষের মধ্য থেকে কত জনকে ছাঁটাই-বাছাই করে বাতিলের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রামে নিয়োজিত করেছে। মুসলমানদের চিন্তার জগতে শতাব্দীর যে স্থবিরতা দানা বেঁধেছিল, মাওলানার সাহিত্য তা দূর করে এক ব্যাপক সূদূর প্রসারী স্বচ্ছ নির্মল চিন্তাধারার সঞ্চার করেছে। তাঁর সাহিত্যের প্রভাব কত জনকে পার্থিব লোভ-লালসা ও ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত করে অনাবিল মজবুত চরিত্রের অধিকারী করে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
তাঁর সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য
মাওলানা মওদূদীর সাহিত্যের প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি ইসলামকে একটা স্থবির ও প্রাচীন গতানুগতিক বা বংশ পারম্পরিক ধর্মের পরিবর্তে একটা বিপ্লবী জীবন দর্শন ও আন্দোলন হিসাবে পেশ করছেন। এর সবচেয়ে বলিষ্ঠ যুক্তি তিনি ইসলামী চিন্তাধারার অভ্যন্তর থেকে অভ্যন্তরীণ প্রমাণাদি হিসাবে উপস্থাপিত করেছেন। দ্বীনের এই বিপ্লবী মতবাদের সাক্ষ্য বহন করে কোরআন পাকের উৎসাহ-উদ্দীপনাব্যঞ্জক আয়াতসমূহ, নবী পাকের তেইশ বছরের সংগ্রামী জীবন, সাহাবায়ে কেরামের চিরন্তন সংগ্রাম সাধনা এবং খিলাফতে রাশেদার গৌরবোজ্জ্বল যুগ। মাওলানা তাঁর প্রকাশভঙ্গির শক্তি দিয়ে কথার জাল বুনে কোন কিছু প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি, বরঞ্চ যে সব তত্ত্ব ও তথ্য শতাব্দীর অনুশীলনহীন স্থবির চিন্তাধারার কারণে মানুষের গোচর থেকে লুক্কায়িত ছিল, তিনি তা ঝেড়ে-মুছে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন করে মিল্লাতে ইসলামিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন।
তাঁর সাহিত্য ও চিন্তাধারার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি ইসলামের প্রতিটি দিক ও বিভাগকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরে প্রত্যেকটি ক বর্তমান যুগের উপযোগী করে বর্ণনা করেছেন। ধর্মের প্রতি আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের যত প্রকারের অভিযোগ তা তিনি যুক্তি-প্রমাণাদির দ্বারা খন্ডন করেছেন। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ অট্টালিকার একটা চিত্র তিনি অঙ্কিত করেছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আইন ও শিক্ষা বিষয়ক, কৃষি ও শিল্প বিষয়ক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক- মোটকথা জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে ইসলামের নীতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যুক্তি-প্রমাণাদির দ্বারা বর্ণনা করেছেন। ইসলামের আধুনিক দাবি কি এবং আধুনিক জগৎ ইসলামের কাছে কি দাবি করে, তা তিনি বলে দিয়েছেন। কমিউনিজমকে তিনি ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন। পুঁজিবাদকেও তিনি একটা ধ্বংসকারী মতবাদ হিসাবে প্রমাণ করেছেন। ফ্যাসিজম, সোশ্যালিজম, লিবারালিজম প্রভৃতি যাবতীয় ইজমকে তিনি মানব জাতির জন্যে মারাত্মক মতবাদ মনে করেন।
এগুলোকে তিনি কোন ‘কাটমোল্লার’ ন্যায় ‘অমন্দ’ মনে করেন না। বরঞ্চ এ সবের ত্রুটি-বিচ্যুতি বিশ্লেষণ করে তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, মাওলানা মওদূদী একথা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, ইসলাম নিছক কোন পূজা-পার্বনের ধর্ম নয় যে এটি রাজনীতির সাথে কোন ‘সম্পর্ক রাখে না’ বরঞ্চ জীবনের এমন কোন বিভাগ নেই যা ইসলাম থেকে স্বাধীন হয়ে থাকতে পারে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এবং রাজনীতি এ জীবনের একটি বিভাগ। যতক্ষণ পর্যন্ত জীবনের এই রাজনৈতিক বিভাগটিকে ইসলামের অধীন করে দেয়া না হয়েছে, ততক্ষণ এর দাবি পূরণ হয় না।
মাওলানার কয়েকটি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
তাফহীমুল কোরআন
“কোরআন মজীদের অনুবাদ ও তাফসীর বিষয়ে আমাদের ভাষায় এতো বেশী গ্রন্থ রচনার কাজ হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির নিছক বরকত ও আশীর্বাদের জন্যে আর একটা অনুবাদ অথবা তাফসীর লিখে প্রকাশ করলে সময় ও শ্রমের সদ্ব্যবহার হবে বলে মনে হয় না। … আমি বহু দিন থেকে অনুভব করছিলাম যে, কোরআনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং তার সত্যিকার উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে আমাদের সুধী মহলে যে ক্রমবর্ধমান পিপাসা পরিলক্ষিত হচ্ছে, অনুবাদক ও তফসীরকারগণের প্রশংসনীয় উদ্যোগ সত্ত্বেও তা নিবারণ করা মোটেও সম্ভব হয়নি। আমি মনে করলাম যে, এ পিপাসা মেটানোর জন্যে আমিও কোন না কোন চেষ্টা করে দেখিনা কেন।”
উপরিউক্ত কথাগুলো মাওলানা তাঁর প্রণীত তাফহীমুল কোরআনের ভূমিকায় ব্যক্ত করেছেন। কোরআনের অনুবাদ করতে গিয়ে তাই তিনি শাব্দিক অনুবাদের চিরাচরিত প্রথা পরিহার করে আরবী পরিভাষাগুলোকে সহজ, সাবলীল ও প্রাঞ্জল উর্দু ভাষায় রূপান্তরিত করেছেন। এ তাঁর এক অনন্যসাধারণ ও সুনিপূণ রচনা শিল্প। তিনি বলেনঃ
প্রথম কথা এই যে, শাব্দিক অনুবাদ পড়লে মনে হয় যে মূলবচনের ধারাবাহিকতা, ভাষার মাধুর্য ও ভাষণের প্রভাব মোটেই অনুভূত হয় না। কোরআনের অনুবাদের ছত্রে ছত্রে এক নিষ্প্রাণ বক্তব্য দেখা যায় যা পড়ার পর পাঠকের মনে কোন প্রেরণার সঞ্চার করে না, শরীর রোমাঞ্চিত হয় না, চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে না এবং তার মনে কোন বিপ্লবাত্মক ভাবধারার সৃষ্টি হয় না। সে এতটুকুও অনুভব করতে পারে না যে, কোন কিছু তার জ্ঞান বুদ্ধি-বিবেককে প্রভাবিত করে মনের গভীরে প্রবেশ করছে। অথচ কোরআনের পবিত্র শিক্ষা ও উচ্চাঙ্গের বিষয়বস্তুর যতখানি প্রভাব আছে, তার সাহিত্যের প্রভাব তার চেয়ে কিছু কম নয়। আর এই কারণেই কোরআনের পবিত্র রাণী শ্রবণ করার পর প্রস্তর-কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হয়েছে, সে বাণীর বজ্রনির্ঘোষে সমগ্র আরব প্রকম্পিত হয়েছে। তার প্রভাবশক্তি বিরোধীরাও স্বীকার করত এবং তারা ভয় করত যে, এ বাণীতে এমন এক ঐন্দ্রজালিক শক্তি আছে যে, তা শুনলেই মানুষ ভার বশীভূত হয়ে পড়বে। এতটুকু শক্তি যদি কোরআনের ভাষায় না থাকত এবং তার অনুবাদে যে ভাষা আমরা দেখতে পাই সেই ধরণের ভাষায়ই যদি কোরআন নাযিল হতো, তাহলে সে কোরআন সমগ্র আরব জাতির মধ্যে অদম্য প্রাণ চাঞ্চল্যর সৃষ্টি করতে এবং তাদের হৃদয় মন জয় করতে কিছুতেই পারতো না। (তাফহীমুল কোরআন-ভূমিকা)।
অতঃপর কোরআন পাঠ করতে গিয়ে পাঠকের মনে বার বার এ খটকা ও প্রশ্ন জাগে যে, কোরআন আমাদের সাধারণ গ্রন্থাবলী থেকে এত স্বতন্ত্র কেন, এর আলোচ্য বিষয়বস্তুই বা কি, এতে ক্রমবিন্যাস ও ধারাবাহিকতাই বা নেই কেন, এ অবতীর্ণ হওয়ার পর কিরূপে সংকলিত ও সঞ্চয়িত হলো-এ ধরনের যাবতীয় সংশয় সন্দেহ মাওলানা তাফহীমুল কোরআনের ভূমিকায় খণ্ডন করেছেন। এ ধরনের যাবতীয় প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব তিনি প্রারম্ভেই পেশ করেছেন। তাঁর এ ভূমিকাকে প্রকৃতপক্ষে কোরআন পাক হৃদয়ঙ্গম করার বুনিয়াদী মূলনীতি বলা যেতে পারে, যা পৃথকভাবে পুস্তিকাকারেও প্রকাশিত হয়েছে।
মাওলানা তাঁর মাসিক পত্রিকা তর্জুমানুল কোরআনের মাধ্যমে ১৯৪৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে তাফহীমুল কোরআন-লেখার সূচনা করেন এবং ত্রিশ বছরে তা শেষ করেন। বলতে গেলে তিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ কাল অভিবাহিত করেন এই অমূল্য গ্রন্থ রচনায়। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে এ হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান।
তিনি একদা তাঁর বৈকালের আসরে (আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বৈঠক) মন্তব্য করেনঃ
“আমি আমার দিন রাতের সময় তিনি অংশে ভাগ করে রেখেছি। এক অংশ দেশ ও সংগঠনের দৈনন্দিন কাজকর্মে, এক অংশ বর্তমান বংশধরদের জন্যে এবং এক অংশ ভবিষ্যত বংশধরদের জন্যে। আর তাফহীমুল কোরআন লেখার কাজ আমার উপরে ভবিষ্যত বংশধরদের হক বলে মনে করি। এ হক আমি বর্তমান বংশধরদের খাতিরে নষ্ট করতে পারি না।”
ভবিষ্যত বংশধরদের জন্যে গ্রন্থখানি অধিকতর উপযোগী, প্রামাণ্য ও তথ্যবহুল করার জন্যে তিনি তার সমগ্র শক্তি ব্যয় করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য ‘আরদুল কোরআন. (কোরআনে বর্ণিত ঐতিহাসিক স্থানগুলি) স্বচক্ষে ঘুরে ফিরে দেখেছেন এবং সে সব ঐতিহাসিক স্থানের আলোকচিত্র তাঁর গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন।
মাওলানা তাফহীমুল কোরআনে কালামে ইলাহীর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কোন মনগড়া কথার অবতারণা করেননি। অতীতের মুসলিম মনীষী বা সালফে সালেহীনের অভিমত, সহীহ হাদীস ও সীরাত পাক অনুসরণ করেছেন। তাফসীর লেখার সময় বিশেষভাবে যেসব তাফসীরের সাহায্য নিয়েছেন তাদের মধ্যে আল্লামা জারুল্লাহ যমখশরীর ‘কাশশাফ আন হাকায়িকি তানযীল, আল্লামা ইবনে কাছিরের ‘তাফসীরুল কোরআনিল আলিম’, আবু বকর জাসসাসের ‘আহকামুল কোরআন’ এবং ইবনুল আরাবী মালিকীর ‘আহকামুল কোরআন’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কোরআনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফিকাহ সম্পর্কিত প্রশ্নের সম্মুখীন হলে মাওলানা ফিকাহ শাস্ত্রের ইমাম চতুষ্টয়-হানাফী, মালিকী, শাফিকী, শাফিয়ী ও হাম্বলীর মূল গ্রন্থাবলী আলোচনা করতেন। কারণ মাওলানার চিরাচরিত অভ্যাস হলো কোন বিষয়ে সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্যে সর্বদা মূল উৎস গ্রন্থ অধ্যয়ন করা। তাঁর টেবিলের উপরে বিভিন্ন তাফসীর, হাদীস, ফিকাহর মূল গ্রন্থাদি, সীরাত ও ইসলামের ইতিহাস প্রভৃতি পুস্তক ছড়িয়ে থাকতো। তাফহীমুল কোরআনের কিছু লিপিবদ্ধ করার আগে তিনি এসব গ্রন্থ থেকে তাঁর প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পৃথক কাগজে টুকে রাখতেন। বিশেষ বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসন্ধান কার্যে কখনো কখনো তাঁর দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যেত।
তাফহীমুল কোরআনের বৈশিষ্ট্য এই যে, আধুনিক মন মানসিকতাকে সামনে রেখে মাওলানা এর টিকায় বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা দান করেছেন। আরবী অভিধান, ব্যাকরণ ও তর্কশাস্ত্রের জটিল তত্ত্বের কোন প্রকার অবতারণা না করে সহজ সরল ভাষায় আধুনিক যুগের সমস্যাগুলোর সমাধান পেশ করেছেন। কোরআন পাঠকালে পাঠকের মনে যে সন্দেহ শংশয় ও প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে, সে সবের উপর মনোজ্ঞ আলোকপাত করেছেন।
তাফহীমুল কোরআনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রত্যেকটি সূরার প্রারম্ভে তার একটি পরিচিতি, উপক্রমণিকা বা মুখবন্ধ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। সুরাটির কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়বস্তু, তার পশ্চাৎ পটভূমিকা, শানে নুযূল, যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাঙস্কৃতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সুরাটির অবতারণা, তার পূর্ণ বিবরণ প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে সূরাটির অন্তর্নিহিত মর্মসহ তার আলোচ্য বিষয়বস্তু পাঠকের মনে পূর্বাহ্নেই পরিস্ফুট হয়ে যায়। কোরআন অনুধাবন করার এ এক অভিনব পন্থা, যা মাওলানা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
তাফহীমুল কোরআনের আর একটি উল্লেখ্য দিক এই যে, এর মাধ্যমে মাওলানা নবী মুস্তাফা (সাঃ) এর সীরাত পাকের উপরে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। কোরআন পাকের ধারক ও বাহক নবী মুস্তাফা (সাঃ)-এর সত্যিকার পরিচয় দান করে তাঁর প্রতি পাঠকের অগাধ প্রেম ও ভালোবাসার সঞ্চার করেছেন। নবী পাকের মক্কী ও মাদানী জীবনকে পৃথক পৃথক স্তরে বিভক্ত করে সীরাতুন্নবীর বিভিন্ন দিক সুস্পষ্ট করেছেন। পদে পদে নবুয়তের অকাট্য প্রমাণাদি পেশ করে রিসালাতের প্রতি পাঠকের দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর পাঠক স্পষ্টত অনুভব করতে পারে যে, ওহী, নবী রাসুল, কিতাব ও সুন্নাত পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাফহীমুল কোরআনের টীকায় সীরাতের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সত্ত্বেও এ সম্পর্কে পৃথক গ্রন্থ রচনার বাসনা মাওলানার ছিল। আল্লাহ তায়ালার অসীম অনুগ্রহে এ বিরাট কাজও তিনি সম্পন্ন করেছেন। এ গ্রন্থ (সীরাত সারওয়ারে আলম) কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
মাওলানার বিপ্লবী সাহিত্যগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে তাঁর তাফহীমুল কোরআন এবং তাঁর সাহিত্য সাধনার ভিত্তিপ্রস্তর আল জিহাদু ফিল ইসলাম’। ভবিষ্যত মানব জাতির জন্যে এ যে তাঁর সাহিত্য সাধনার ভিত্তিপ্রস্তর ’আল জিহাদু ফিল ইসলাম’। ভবিষ্যত মানব জাতির জন্যে এ যে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান, সে কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে।
তাফহীমুল কোরআন এবং মাওলানার জন্য গ্রন্থাবলীর উপরে দেশ-বিদেশে বিক্ষিপ্তভাবে গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে। তবে তাফহীম থেকে ভবিষ্যত বংশধরদের জন্যে স্থায়ী সুফল লাভ করতে হলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি রিসার্চ একাডেমী বা উচ্চ পর্যায়ের গবেষণাগার স্থাপিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। এ কাজের পথও আল্লাহ সুগম করে দেবেন বলে আশা রাখি।
কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা
কোরআনকে সঠিকবাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে এ গ্রন্থখানি পাঠকের মনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। এজন্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ গ্রন্থে মাওলানা যে চারটি পরিভাষার উপরে সম্যক আলোকপাত করেছেন তা হলো, ইলাহ, রব, ইবাদত ও দ্বীন। এ চারটি বিয়য় সম্পর্কে পাঠকের ধারণা সুস্পষ্ট না হলে কোরআন অনুধাবন করা মোটেই সম্ভব হবে না। পাঠকের মনে যদি এ ধারণা হয় যে, ইলাহ অর্থ কোন উপাস্য দেবতা, দ্বীন অর্থ কোন ধর্ম, রব অর্থ প্রতিপালক এবং ইবাদত অর্থ স্তব-স্তুতি ও পূজা-পার্বন বুঝায়, তাহলে কোরআনের মর্মকথা উপলব্ধি করার তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এ কারণেই এ পরিভাষা চতুষ্টয়ের সঠিক ব্যাখ্যা দান মাওলানা অপরিহার্য মনে করে এ গ্রন্থখানি রচনা করেছেন।
অবশ্য তাফহীমুল কোরআনে প্রসঙ্গক্রমে এ চারটি পরিভাষার ব্যাখ্যা দান করা হয়নি, তা নয়। তবে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর উপরে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে।
ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা
ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে এক মানসিক বিভ্রান্তি ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে। মুসলমান যা কিছুই করে অথবা বংশানুক্রমে করে আসছে তাকেই ইসলামী বা মুসলিম সংস্কৃতি বলে অ্যাখ্যায়িত করা হচ্ছে। মুসলমান যা করবে তাই ইসলামী এবং তার প্রতি ইসলামের সমর্থন থাকা উচিত। চিত্তবিনোদনের নামে ললিতকলা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানকে ইসলামী সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবেরই ফলশ্রুতি। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলাম দুনিয়ার সামনে কোন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ উপস্থাপন করে কিনা এবং সংস্কৃতির অঙ্গনে ইসলামের কোন মৌলিক নীতিমালা আছে কিনা না, সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায় এবং ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি কোন বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস কোন সাঙস্কৃতিক ধ্যান ধারণা স্বীকার করে কি না ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের বিশদ আলোচনা ও তার সঠিক সমাধান ও নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে উপরিউক্ত গ্রন্থে। রুচিবান সংস্কৃতিকসেবী লোকের জন্যে এ গ্রন্থখানি দিগদর্শনের কাজ করবে সন্দেহ নেই।
আল-জিহাদু ফিল-ইসলাম
এ সম্পর্কে গ্রন্থের প্রারম্ভেই আলোচনা করা হয়েছে।
ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
ইসলাম একটি প্রাণবন্ত জীবন দর্শন, যা বিশ্বস্রষ্টা মানব জাতির জন্যে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে, মানুষ এ জীবন দর্শন অনুযায়ী তার গোটা জীবন পরিচালিত করবে। এ জীবন দর্শনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেছিল শেষ নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সাঃ) এর জীবদ্দশায়। খিলাফতে রাশেদার যুগেও তা ছিল অক্ষুণ্ন, অমলিন ও নির্ভেজাল। কিন্তু পরবর্তীকালে খিলাফত রাজতন্ত্রে পরিবর্তিত হওয়ার ফলে ইসলামের মধ্যে ধীরে ধীরে জাহিলিয়াতের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। অতঃপর সাধারণ মানুষের কাছে এ এক কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়- এ সবের মধ্যে কোনটি ইসলাম ও কোনটি জাহিলিয়াত। ইসলামকে জাহিলিয়াতের আবর্জনামুক্ত করে তাকে নির্ভেজাল ও প্রকৃত রূপে পেতে হলে প্রয়োজন কোন সংস্কারকের, যাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘মুজাদ্দিদ’। মুসলিম জাতি যখনই ইসলামকে ক্লেদমুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে, তখনই ইসলামের ইতিহাসে আবির্ভাব হয়েছে একজন মুজাদ্দিদের।
মাওলানা তাঁর এ গ্রন্থে ইসলাম ও জাহিলিয়াতের আদর্শিক দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে জীবন সম্পর্কে চারটি মতবাদের বিশ্লেষণ করে একমাত্র ইসলামকেই মানব জাতির গ্রহণযোগ্য মতবাদ বলে প্রমাণিত করেছেন। তারপর মুজাদ্দিদের সংজ্ঞা, মুজাদ্দিদ ও নবীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য, ইমাম মাহদী প্রভৃতির বর্ণনা দান করেছেন। তারপর মুসলিম জাতির কতিপয় বড় বড় মুজাদ্দিদ ও তাঁদের কার্যাবলীর আলোচনা করেছেন।
ইসলাম ও পাশ্চত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব
ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পর মুসলমানরা শুধু শাসন ক্ষমতাচ্যুতই হয়নি, বরঞ্চ আধুনিক সভ্যতা তাদের আত্মবিশ্বাস, মানসিক নিশ্চিন্ততা, ঈমান ও আকীদাহ-বিশ্বাস পর্যন্ত নষ্ট করে দেয়। অতঃপর পাশ্চাত্য সভ্যতা মুসলমানদের যে যে জিনিসের প্রতি ঘৃণায় ভ্রূকুঞ্চিত করল, মুসলমানরা সে সবের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে তা পরিহার করা শুরু করল। তা সে সব তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ হোক, চালচলন হোক, ভাষা হোক অথবা তাদের ঈমান আকীদাহ হোক। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে প্রতিটি অবাঞ্ছিত বস্তু তারা এক একটি করে পরিহার করা শুরু করল। অবশেষে মুসলমানদের মধ্য থেকে একশ্রেণী এতদূর অগ্রসর হলো যে, ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত প্রতিটি বিষয়কে তারা অহীর ন্যায় বিশ্বাস্য মনে করে বসল এবং সত্যিকার ‘ওহী’ তাদের কাছে হয়ে পড়ল সন্দেহযুক্ত। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারে তারা মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হয়ে তার নানা মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে লাগল। এ ধরনের মানসিক দাসত্ব যে জাতিকে পেয়ে বসে, তারা অতঃপর স্বহস্তেই নিজেদের সমাধি রচনা করে। মাওলানা এই জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেও এ মানসিক দাসত্বের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে এ আত্মহত্যার পথ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
মাওলানা তাঁর উপরিউক্ত গ্রন্থে মানসিক দাসত্ব ও তার কারণ, ইসলামী সভ্যতার বিপর্যয় আধুনিক সভ্যতার ব্যাধি, প্রগতিবাদীদের ফাঁকা বুলি প্রভৃতির উপরে আলোকপাত করে আধুনিক সভ্যতার ব্যাধির প্রতিকার সম্পর্কে মনোজ্ঞ আলোচনা করেন। এ গ্রন্থের দ্বারা তিনি আত্মবিস্মৃত জাতির মধ্যে আত্মচেতনার সঞ্চার করেন।
ইসলাম পরিচিতি
ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানলাভের জন্যেএ বইখানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ। এর দ্বারা পাঠক ইসলামের প্রকৃত অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করতে পারে। মাওলানা তার সহজ, সরল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় এই বইখানিতে ইসলাম, ঈমান, নবুয়ত, দীন ও শরীয়ত এবং শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেন।
ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা
(খুতবাত বা হাকিকত সিরিজ)
এই বইখানিতে ঈমান, ইসলাম, নামায-রোযা, যাকাত, হজ্জ ও জিহাদের মর্মকথা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। ভাষা যেমন সরল, তেমনি সাধারণের বোধগম্য। তিনি জুমার খুতবায় এসব বিষয়ের উপর যে ধারাবাহিক ভাষণ দেন, বইখানি সে সব ভাষণেরই সংকলন।
ইসলামী জীবন পদ্ধতি
এই বইখানিতে ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিধি-পদ্ধতির উপরে আলোকপাত করা হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মাওলানা উক্ত বিষয়গুলির উপর যে পরপর বেতার ভাষণ দেন, সেগুলোকে একত্রে সঙ্কলিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়েছে। ইসলাম যে মানব জাতির জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান, গ্রন্থখানি তারই সাক্ষ্য বহন করে।
পর্দা ও ইসলাম
গ্রন্থখানি মাওলানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অবদান। গ্রন্থখানিতে আধুনিক কালের একটি বিতর্কিত বিষয়ের উপর শক্ত করে কলম ধরেছেন বিশ্বের অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। গ্রন্থের প্রারম্ভেই তিনি মানব সমাজের মৌলিক সমস্যা আলোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ
“মানবীয় তামাদ্দুনের প্রধানতম ও জটিলতম সমস্যা দুটি। এ দু’টি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের উপর নির্ভরশীল মানবজাতির উন্নতি ও সার্বিক কল্যাণ। তাই এর সমাধানের জন্যে জগতের চিন্তাশীল সুধী সমাজ বিব্রত ও চিন্তান্বিত রয়েছেন।
প্রথম সমস্যাটি এই যে, সামাজিক জীবনে নারী-পুরুষের সম্পর্ক কিভাবে স্থাপিত হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে তামাদ্দুনের ভিত্তিপ্রস্তর এবং এতে যদি বক্রতার কোন অবকাশ থাকে, তাহলে তাকে অবলম্বন করে যে তামাদ্দুনিক প্রাসাদ গড়ে উঠবে, তা অবশ্যই বক্র হবে।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে, মানবজাতির ব্যাষ্টি ও সমষ্টিগত সম্পর্ক। এ দু’য়ের সামঞ্জস্য বিধানে যদি সামান্যতম অসঙ্গতিও রয়ে যায় তাহলে এর তিক্ততা মানব জাতিকে ভোগ করতে হবে দীর্ঘকাল ধরে।” অতঃপর মাওলানা প্রাচীন গ্রীস, রোম, খ্রিষ্টীয় ইউরোপ দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থার এক অতি বেদনাদায়ক চিত্র অঙ্কন করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর স্বাধীনতার ধারণা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ যৌন অনাচার, (Sexual Anarchy) সংক্রামক যৌনব্যাধি, লাম্পট্য ও অশ্লীলতার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। সমাজে নারী-পুরুষের সঠিক স্থান নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়ে পাশ্চাত্য সমাজ কিভাবে জাতীয় আত্মহত্যার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে তা প্রমাণ করা হয়েছে। সমাজে নারী পুরুষের সম্পর্কে দার্শনিক, প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দেয়ার পর তার সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধানের জন্যে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার বিশদ বিবরণ দান করা হয়েছে। গ্রন্থখানি চিন্তার জগতে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
উপরিউক্ত গ্রন্থসমূহ ছাড়াও তাঁর লিখিতর ‘ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলমান’, ‘ইসলামী রাষ্ট্র’, ‘Ismamic Law and Constitution’, ‘ইসলাম ও জন্মনিয়ন্ত্রণ’, খিলাফত ও রাজতন্ত্র’, প্রভৃতিগ্রন্থও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মাওলানার অন্যান্য অর্ধ শতাধিক বই-পুস্তক সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে এবং এ যাবত অধিকাঙশ গ্রন্থই দুনিয়ার প্রায় চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
মাওলানা ও তাঁর সাহিত্যের প্রভাব অন্যান্য দেশে
ভারত
পাকিস্তানের বাইরে যে সব দেশে মাওলানা মওদূদীর বাণী ও মিশন প্রভাব বিস্তার করেছে, তার মধ্যে ভারত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাওলানা তাঁর কাজ অবিভক্ত ভারতেই শুরু করেন এবং বিভাগের পর মাওলানার চিন্তাধারা ও কর্মসূচির দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিগণ ভারতীয় জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তাঁরা নিম্নোক্ত চার দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে কাজ করছেনঃ
* সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের বিলোপ সাধন।
* ইসলামী নীতিতে মুসলিম সমাজের সংস্কার ও তাদের মধ্যে দ্বীনী ইলমের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার।
* শিক্ষিত মেধাবী শ্রেণীকে প্রভাবিত করে তাঁদের প্রতিভা বিকাশ ও গঠনমূলক কাজে নিয়োগ। বিশেষ করে নাস্তিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, সোশ্যালিজম ও কমিউনিজমের প্রবল স্রোত বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণের দ্বারা রোধ করা।
* হিন্দী এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় প্রবন্ধ লিখন ও বক্তৃতার যোগ্যতা লাভ করা, যাতে এসেব ভাষায় ইসলামের মহান বাণী প্রচার করা যায়।
তাঁদের কাজ ব্যাপক আকার চলছে এবং অত্যন্ত আশাপ্রদ।
সিংহল
সিংহলের শিক্ষিত মুসলমান বিশেষ করে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীগণ মাওলানা মওদূদীর সাহিত্য ও ইসলামী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে MUSLIM BROTHERHOOD MOVEMENT সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছেন। তাঁরা সাপ্তাহিক বৈঠক ও দু’টি পত্রিকার দ্বারা আদর্শের প্রচার করছেন। এখানকার ব্যবসায়ী শ্রেণীও এ ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহশীল। মাওলানার বেশ কয়েকটি গ্রন্থ তাঁরা সিংহলী ভাষায় অনুবাদ করেন। এই সংস্থাটি বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সিংহল’ নামে কাজ করছে।
আমেরিকা
সম্প্রতি কয়েক বছর যাবত আমেরিকায় মাওলানার সাহিত্য সমাদরে পঠিত হচ্ছে। ফিলাডেলফিয়ার মুসলমানদের ’মুসলিম লীগ’ নামে সংগঠনটি দস্তুরমত মাওলানার সাহিত্য চেয়ে পাঠাচ্ছেন। অন্যান্য স্থান থেকেও মাওলানার সাহিত্যের জন্যে অর্ডার পাঠানো হয়।
বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, মাওলানা মওদূদীর চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর দস্তুরমত রিসার্চ চলছে কানাডার ম্যাকগীল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ কাজ করছেন ড. অধ্যাপক চার্লস জে এডমস। রকফেলার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ কাজের জন্য তাঁকে ছ’হাজার ডলার ভাতা দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধীনে এ কাজ চলছে। এ প্রতিষ্ঠানটির অধীনে মাওলানা মওদূদীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন ও কর্মসূচীর উপর রিসার্চ হচ্ছে।
অধ্যাপক এডমস পাকিস্তানে দু’বছর অবস্থান করে মাওলানা এবং তাঁর সহকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি রীতিমত উর্দু ভাষাও শিক্ষা করেন।
তাঁর গবেষণার জন্যে মাওলানার যাবতীয় গ্রন্থমালা ও তর্জুমানুল কোরআনের সমস্ত ফাইল সংগ্রহ করা হয়েছে।
কিছুকাল পূর্বে ডঃ এডমস করাচীর “ভয়েস অব ইসলাম” পত্রিকায় নিম্নোক্ত পত্রটি প্রেরণ করেন।
“গত বছর আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমাকেএকটি প্রবন্ধ লিখতে বলা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক-সম্বন্ধ স্থাপনে আগ্রহশীল। যা হোক, আমি আমার প্রবন্ধে মাওলানা মওদূদী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি। যে সমাবেশে আমি আমার প্রবন্ধ পাঠ করি, সেখানে রকফেলার ফাউন্ডেশনের জনৈক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। প্রবন্ধ পাঠের পর তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং মাওলানা মওদূদীর রাজনৈতিক চিন্তাধারার উপর গবেষণা করতে অনুরোধ করেন। এখরন আমিএক বছর ধরে মাওলানা মওদূদী সম্পর্কে একখানা পুস্তক লিখব। এতে তাঁর ইসলামী রাষ্ট্রগঠন সম্পর্কে চিন্তাধারার বিশেষ আলোচনা করব।”
ম্যাকগীল বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনিক পত্রিকা ‘ম্যাকগীল ডেইলী’ নিম্নোক্ত মন্তব্য করেনঃ
“আধুনিক বিশ্বের যে তিন-চারজন চিন্তাশীল ব্যক্তি একটি আধুনিক রাষ্ট্রকে ইসলামের প্রচলিত দৃষ্টিকোণের আলোকে স্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন, মাওলানা মওদূদী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এদিক দিয়ে মাওলানার জীবন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
মাওলানার সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জনৈক উচ্চশিক্ষিত নওমুসলিম যুবক পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর অনুসরণে The Islamic party of Narth America নামে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে একটি ইসলামী দল গঠন করেন। দলটির কাজ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। দলটির দু’টি সংসদ আছে। প্রথম Central Cuidance Council (কেন্দ্রীয় মসলিশে শূরা) এবং দ্বিতীয় General Council (সাধারণ সংসদ)। দলের পক্ষ থেকে ইসলামের মুখপত্র হিসাবে মাসিক আল ইসলাম (ইংরেজী) এবং পাক্ষিক New trend নামে দুটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি ইউসুফ মুজাফফরুদ্দীন হামিদ বলেনঃ “ইসলামী বিপ্লবের প্রাণশক্তি উপলব্ধি করতে হলে ওস্তাদ মাওলানা মওদূদীর ‘তাফহীমুল কোরআন’ এবং সাইয়েদ কুতুব শহীদের’ফী যিলালিল কোরআন’ এক সাথে অধ্যয়ন করা একান্ত প্রয়োজন।
বলা বাহুল্য, মাওলানার সাহিত্যাবলী ইউসুফ মুজাফফরুদ্দীনকে ইসলামী আন্দোলনের এক অতি দুর্গম পথে টেনে এনেছে। তিনি বলেনঃ
“আমরা আমাদের জামায়াতকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগঠিত করেছি। দলের বিভিন্ন বিভাগ আছে, যথা- শিক্ষা, রাজনীতি, বৈদেশিক বিভাগ, সাহিত্য প্রকাশনা ইত্যাদি। প্রত্যেক বিভাগে শিক্ষিত দায়িত্বশীল এবং উৎসর্গীকৃতপ্রাণ কর্মীগণ নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালনের নিয়োজিত। কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের শিক্ষার প্রতিও আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্যে একটি বিশেষ সংস্থা কায়েম করা হয়েছে। প্রচলিত পাঠ তালিকার সাথে যাতে দ্বীন ইসলামেরসঠিক জ্ঞান লাভ করা যায়, তার ব্যবস্থাও আমরা করেছি। আমরা আমেরিকার বাইশটি রাষ্ট্রে কাজ করি।”
উল্লেখযোগ্য যে, গত ১৯৬৯ সালে ইউসুফ মুজাফফরুদ্দিন পাকিস্তানে আগমন করে মাওলানার মেহমান হিসাবেএক সপ্তাহ তাঁর সান্নিধ্যে অতিবাহিত করেন। মাওলানার সঙ্গে ক’দিন ধরে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয় এবং মাওলানা তাঁর বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেন। মাওলানার গ্রন্থাবলী, জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র, কর্মপদ্ধতি ও সংগঠন তাঁকে এতোটা মুগ্ধ করে যে, তিনি জামায়াতের সদস্য হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেন। কিন্তু বিদেশী নাগরিকের জন্যে সদস্য পদ নিষিদ্ধ বলে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করে ১৯৭১ সালে উক্ত ইসলামী পার্টি গঠন করেন।
ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ডের কয়েকটি স্থান থেকে মাওলানার সাহিত্যের জন্যে অর্ডার পাওয়া যায়। মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে এর খুবই চাহিদা। তারা মাওলানার কাছে বিভিন্ন প্রকার দ্বীনী জটিল প্রশ্ন করে থাকেন। লন্ডনে থাকাকালীন তাদেরকে যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, মাওলানার নিকট সে সবের সমাধান তারা চেয়ে পাঠান।
মাওলানার বই পুস্তক পাঠ করার পর ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে লন্ডনে অবস্থানকারী কিছু সংখ্যক মুসলমান সে দেশে ইসলামী তাবলীগের উদ্দেশ্যে ‘ইউকে ইসলামিক মিশন’ নামে এক ইসলাম প্রচার সংস্থা সম্প্রতি কায়েম করেছেন। লন্ডনে প্রবাসী মুসলমানদের ঐকান্তিক বাসনা, তাঁরা একবার মাওলানাকে তাঁদের মধ্যে দেখতে চান। এ উদ্দেশ্যে মাওলানাকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানিয়েও তাদের আশা পূর্ণ হয়নি। নানাবিধ অসুবিধার কারণে মাওলানার এ সফরের জন্যে সময় দেয়া সম্ভব হয়নি।
সত্তরের দশকে মাওলানার চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে লন্ডনের বাংলাভাষী মুসলমানগণ ‘দাওয়াতুল ইসলাম’ নামে একটি সংস্থা কায়েম করে ইসলামী দাওয়াত প্রসারের কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন শহরে দাওয়াতুল ইসলামের শাখাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন শহরে প্রাথমিক স্কুল কায়েমের মাধ্যমে বাংলাভাষীদের সন্তানগণকে ইসলামী শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ও সংস্থাটির একটি প্রশংসনীয় কাজ।
লিস্টার শহরে মাওলানার সাহিত্য ও চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ইসলামী গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ইসলামী চিন্তাবিদ ও রিসার্চ স্কলার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পূর্ণোদ্যমে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জার্মানী
জার্মানীতেও মাওলানা মওদূদীর বাণী ও মিশনের প্রভাব ভালোভাবে অনুভূত হচ্ছে। হেমবার্গের ইসলামী কমিউনিটির সহ-সভাপতি জনাব এরিক আবদুর রহমান রুসলার মাওলানার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তাঁর বই পুস্তক চেয়ে পাঠান।
তিনি মাওলানাকে জানান যে, সেখানকার লোকেরা বর্তমান চার প্রকারের ব্যাধিতে ভুগছে, যথা-মানসিক অশান্তি, পূর্ণ নৈরাশ্য, ত্রাস এবং চিন্তা রাজ্যে চরম ফরাজকতা।
মাওলানা তাঁর কাছে ইংরেজী ভাষায় অনুদিত তাঁর সবগুলি বই পাঠিয়ে দেন। জনাব আবদুর রহমানের প্রচেষ্টায় জার্মানীতে এখন বেশ ইসলামী দাওয়াতের কাজ চলছে।
জেনেভায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক সেন্টার থেকেও ইসলামী তাবলীগের কাজ চলছে এবং সেখানেও মাওলানার বই অনুবাদ করা হয়েছে। কতিপয় নওমুসলিম জার্মান মনীষীও মাওলানার গ্রনথ অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছেন।
মারিশাস
মাওলানার জনৈক সহকর্মী মারিশাসে অবস্থান করে দাওয়াতের কাজ চালাচ্ছেন। তিনি সেখানে একটি স্কুলে মাস্টার্সের পদে কাজ করেন, একটি মসজিদে খতিবেরও কাজ করেন, কোরআন-হাদীসের দারস দেন এবং একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর কাজের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক।
সিভিল কোরিয়া
এখানকার নওজোয়ান দল আগ্রহ সহকারে মাওলানার সাহিত্য অধ্যয়ন করছেন।
উপরন্তু বার্মা, লাওস, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ব্রিটিশ গিনি, দক্ষিণ আমেরিকা, প্রিটোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানু, নাইজেরিয়া, মরক্কো, জোহান্সবার্গ প্রভৃতি স্থানে উর্দু, আরবী ও ইংরেজী ভাষায় মাওলানার সাহিত্য বেশ চলছে।
প্রিটোরিয়ার ইসলামিক সোসাইটি মাওলানার সাহিত্য ইংরেজীতে অনুবাদ করার অনুমতি লাভ করে।
মারিমাস সরকার তাঁদের অধীনে স্কুলগুলোতে মাওলানার কিছু বই পাঠ্য হিসাবে মনোনীত করেছে।
আরব দেশগুলোতে মাওলানার সাহিত্য অতি সমাদর লাভ করেছে তা আগেই বলা হয়েছে। তাঁরা মাওলানার সাহিত্য আরবী, ইংরেজী ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করার পরিকল্পনা করেছেন।
জাপান
এশিয়ার অমুসলিম জাতিসমূহের মধ্যে জাপান জাতি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণের জন্যে আকুল আগ্রহ প্রকাশ করছে। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদকে তারা ঘৃণার চোখে দেখে। ক্রিষ্টধর্মের প্রতি তাদের কণামাত্র আকর্ষণ নেই। শিন্টু ধর্মের মোহ তাদের কেটে গেছে। বৈষয়িক দিক দিয়ে তারা খুবই স্বচ্ছল। কিন্তু আধ্যাত্মিক দিক তাদেরকে অধীর ও অতিষ্ঠ করে তুলছে। আজ পর্যন্ত পঁচিশ হাজার জাপানী ইসলাম গ্রহণ করেছে।
বলা বাহুল্য, এ সব মাওলানার সাহিত্যেরই প্রভাব। বিগত ষাটের দশকে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর জনৈক প্রতিভাসম্পন্ন কর্মী ইসলামী দাওয়াত সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে জাপান গমন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় টোকিওতে একটি ইসলামী সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। দাওয়াতী কাজ এবং মাওলানার সাহিত্যের জাপানী ভাষায় অনুবাদ কার্য শুরু হয়। আজকাল জাপান জাতির মধ্যে যে ইসলামী প্রাণ-চাঞ্চল্যর দেখা যাচ্ছে, তা মাওলানার হৃদয়স্পর্শী সাহিত্য ও ইসলামী সেন্টারের প্রচেষ্টারই ফল। জাপানী ভাষায় মাওলানার তাফহীমুল কোরআনের অনুবাদও চলছে। হুসাইন খান নামক জনৈক পাকিস্তানী এ সেন্টারের পরিচালক।
সুদান
সুদানে বিগত তিন দশক থেকে ইসলাম ও কুফর, হক ও বাতিলের একটানা সংগ্রাম চলে আসছে। সেখানকার ইসলামী আন্দোলন বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত এবং উত্থান ও পতনের ভেতর দিয়ে এখনও একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসাবে টিকে আছে।
ঊনিশ শ’ পঞ্চাশ সালে সুদানের খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অধিকাংশ শিক্ষক ও তাতে যোগদান করেন। কিন্তু ‘ইখওয়ানুল মুসলিমুন’ ও মাওলানার সাহিত্যাবলী ছাত্রদের মধ্যে এক নতুন চেতনার সৃষ্টি করে এবং কমিউনিজমের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৫৬ সালে সুদান স্বাধীনতা লাভ করে এবং সারাদেশে ইসলামী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবিতে মুখর হয়ে উঠে। ১৯৬৭ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র পাস হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বৈদেশিক চক্রান্তে দেশে সামরিক বিপ্লব হয় এবং সর্বত্র রাশিয়ার প্রভাব বিস্তার লাভ করতে থাকে। ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের উপর নির্যাতন নিষ্পেষণ শুরু হয়।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব জনগণের মন-মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। আন্দোলনের অন্যতম নেতা ডাঃ হাসান তোরাবী দীর্ঘদিন কারাভোগ করার পর মুক্তিলাভ করেছেন এবং ইসলামী আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। [সুদানে এখন ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা সেখানে ক্রমশ শরীয়তের আইন জারির কাজ শুরু করেছেন। যুব সমাজ ইসলামের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত।-গ্রন্থকার]
মাওলানা মওদূদী একটি আন্তর্জাতিক মিশনের আহ্বায়ক। তাঁর কর্মসূচী একটি ব্যক্তির সংস্কার সংশোধন থেকে একটি রাষ্ট্র পর্যন্ত এবং রাষ্ট্র থেকে গোটা মানবজাতির সংস্কার, মুক্তি ও মঙ্গলের জন্যে। তাই তাঁর উদাত্ত বাণী আন্তজাতিক-বিশ্বব্যাপী।
আধুনিক জগতে যে সব ব্যবস্থা মানব সমাজে চালু আছে, সে সবের তুলনায় মাওলানা মওদূদী ইসলামকে একটা সার্বিক জীবন ব্যবস্থা হিসাবে প্রতীয়মান করেছেন। অন্যান্য যে কোন ব্যবস্থা থেকে ইসলামকে শ্রেষ্ঠতর করেও প্রমাণ করেছেন। তাঁর চিন্তাধারা বিশ্বের বহু অমুসলিম দেশেও বেশ প্রভাব বিস্তার করছে। সে জন্যে তাঁর গ্রন্থাদির সে সব দেশে অনুবাদ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ গভীর গবেষণাও শুরু করেছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ইসলামের নীতিভিত্তিক করে গড়ে তোলার জন্যে ইসলামী শাসনতন্ত্রের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কিত করেছেন। তাঁর অমুল্য গ্রন্থ ‘Ismamic Law and Constitution’ দেশ-বিদেশের সুধী সমাজের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। একটা পূর্ণ ইসলামী শাসনতন্ত্রের জন্যে পাকিস্তানে তিনি আট বছরকাল গণআন্দোলন চালিয়েছেন এবং বহু জটিল ও খুঁটিনাটি বিষয়ের উপরে আলোকপাত করেছেন। বহু অভিযোগ ও অমূলক সন্দেহ-ভয়-ভীতির সন্তোষজনক জবাব দিয়েছেন। ফলে গণমনে ইসলামী শাসনতন্ত্র বললেই তার অর্থ দাঁড়াবে এমন এক ব্যবস্থা যা হবে কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই অন্যান্য মুসলিম দেশেও, যেখানে চেষ্টা চলছে এটি কায়েম করার জন্যে। বর্তমান জগতে যে সকল মুসলিম মনীষীকে ইসলামী আইন-কানুন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বলা হয়, তাঁদের মধ্যে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর স্থান সকলের উচ্চে।
তাঁর ব্যক্তিত্ব আজ আন্তর্জাতিক। বিশেষ করে ইসলামী জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল তিনি। উপরে তাঁর মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের যে সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেয়া হয়েছে, তার দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী জগতের আশার আলোক বহন করছেন তিনি এবং তাঁর আধুনিক চিন্তাধারা মুসলিম জগতের এক বিরাট সম্পদ।
মাওলানা মওদূদী ও তাসাওউফ
আমাদের দেশে এখনও বেশ কিছু লোক আছেন যাঁরা মাওলানা মওদূদীকে এই বলে সমালোচনা ও বিরোধিতা করেন যে, তিনি তাসাওউফ বিরোধী।
এঁদের মধ্যে কিছু লোক মাওলানার প্রতি অহেতুক বিদ্বেষ পোষণ করে উক্ত সমালোচনার অস্ত্রে তাঁকে ঘায়েল করতে চান, আর কিছু লোক নেহায়েত অজ্ঞতার কারণে এ সব বলে থাকেন।
মাওলানা মওদূদী তাঁর সারা জীবন ইকামতে দ্বীনের সংগ্রামের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। এ পথে তাঁকে কত নির্যাতন-নিষ্পেষণ যে ভোগ করতে হয়েছে, তার কোন শেষ নেই। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি মুহূর্তের জন্যেও বাতিলের সামনে নতি স্বীকার করেননি। তাসাওউফ বিরোধী বলে মাওলানার যাঁরা বিরোধিতা করেন, তাঁদের মধ্যে ইকামাতে দ্বীনের সংগ্রামী মনোভাব কোন দিনই দেখতে পাওয়া যায়নি। বরঞ্চ পীর-মুরীদীর ঠাট জমিয়ে বাতিল শক্তির সাথেই তাঁরা হাত মিলিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই আবার একদিকে যেমন ‘তাসাওউফ, মা’রিফাত’ বা ‘ইলমে বাতিনের’ দীক্ষাগুরু হিসাবে নিজেদেরকে জাহির করেন, অপরদিকে এমন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও কর্মী হিসাবে কাজ করেন, যার সকল চেষ্টা-চরিত্রই ইসলামের বিপক্ষে ব্যয়িত হয়। এটাকে তাঁরা দূষণীয় মনে করেন না এ জন্যে যে, তাঁদের মতে রাজনীতি ও ইসলাম দু’টি পৃথক জিনিস। এ থেকে বুঝা যায়, ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁদের ভ্রান্ত। একজন মুসলমান তো তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে সকল সময় একমাত্র আল্লাহ্রই নির্দেশ মেনে চলবে। তার পক্ষে এ ধারণা করাও সম্ভব নয় যে, মসজিদের চার দেয়ালের মধ্যে সে এক খোদার নির্দেশ মানবে এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্পকলায় নির্দেশ মেনে চলবে অন্য খোদার।
পীরানে পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) বলেছেনঃ তাসাওউফ মুসাফাত ******************* শব্দ থেকে উদ্ভূত। তার অর্থ হলো মন-মস্তিষ্ককে যাবতীয় ইসলাম বিরোধী মতবাদ, ভাবধারা, চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করা। আল্লাহ্ ব্যতীত সকল কিছুর প্রেম-ভালবাসা, ভয়-ভীতি, দাসত্ব, আনুগত্য থেকে নিজকে পবিত্র করা। প্রবৃত্তির পূজা, হিংসা-বিদ্বেষ, পার্থিব লোভ-লালসা, পরনিন্দা, পরচর্চা, গর্ব-অহষ্কার প্রভৃতি থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রাখাও তাসাওউফের উদ্দেশ্য। সমালোচক মহাত্মাগণ এ সব থেকে নিজেদেরকে কতখানি ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছেন, সে সম্পর্কে তাঁদের চিন্তা করে দেখা উচিত।
তাসাওউফ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদী স্পষ্ট ভাষায় নিম্নোক্ত উক্তি করেছেনঃ তাসাওউফ কোন একটি মাত্র বস্তুর নাম নয়। বরঞ্চ বিভিন্ন বস্তু বা বিষয় এই নামে অভিহিত হয়েছে। আমরা যে তাসাওউফকে মানি তা এক বস্তু, আর যে তাসাওউফকে মানি না, তা দ্বিতীয় এক বস্তু। যে তাসাওউফের আমরা সংস্কার সংশোধন চাই, তা আবার তৃতীয় আর এক বস্তু।
এক প্রকার তাসাওউফ হচ্ছে, যা ইসলামের প্রাথমিক যুগের সূফী। যথা- ফুযাইল বিন ইয়ায, ইবরাহীম বিন আদহাম, মারুফ করখী (রহঃ) প্রভৃতির মধ্যে ছিল। এর কোন পৃথক দর্শন ছিল না এবং এর কোন পৃথক কর্মপদ্ধতিও ছিল না। তাঁদের চিন্তাধারা ও কাজকর্ম এমন ছিল, যার উৎস ছিল কোরআন ও সুন্নাহ এবং এ সবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল তাই, যা ছিল ইসলামের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আল্লাহর জন্যে ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা।
******************************************
তাদেরকে একমাত্র এ জন্যে আদেশ করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর দাসত্ব করবে এবং অন্য সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দ্বীনের প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে থাকবে। -(বাইয়্যেনাহ-৫)
এ তাসাওউফের সত্যতা আমরা স্বীকার করি। শুধু তাই নয়, একে আমরা পুনরুজ্জীবিত ও প্রচারিত করতে চাই।
দ্বিতীয় প্রকার তাসাওউফ এই যে, এর মধ্যে গ্রীসীয় আধ্যাত্মবাদ, প্লেটোর কাম-গন্ধহীন মতবাদ, যরদস্তী ও বেদান্ত দর্শনের সংমিশ্রণ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে খ্রিষ্টিয় পুরোহিত এবং হিন্দু সন্ন্যাসীদের পদ্ধতি শামিল করা হয়েছে। এর মধ্যে মুশরিকী ধারণা ও কার্যকলাপ অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। শরীয়ত, তরীকত, মা’রিফত পৃথক পৃথক হয়ে পড়েছে। দুনিয়াতে আল্লাহ্র খলীফা হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্যে মানুষকে তৈরি করার পরিবর্তে তাকে সম্পূর্ণ অন্য কাজের জন্যে তৈরি করা হয়। এ তাসাওউফের আমরা খণ্ডন করতে চাই। আমাদের মতে খোদার দ্বীন কায়েম করার জন্যে এ তাসাওউফের মূলোৎপাটন ততখানি আবশ্যক, যতখানি আধুনিক জাহিলিয়াতের মূলোৎপাটন আবশ্যক।
এ দু’প্রকারের তাসাওউফ ব্যতীতও আর এক প্রকার তাসাওউফ আছে যার মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকারের বৈশিষ্ট্গুলো মিশ্রিত হয়ে আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ তাসাওউফের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেছেন এমন বিভিন্ন বুযুর্গানে দ্বীন, যাঁরা বিজ্ঞ ছিলেন এবং যাঁদের নিয়তও ছিল সৎ। কিন্তু তাঁরা নিজেদের সময়ের বৈশিষ্ট্য ও অতীত যুগের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না। ইসলামের সঠিক তাসাওউফ বুঝতে এবং তার ক্রিয়া পদ্ধতিকে জাহিলী তাসাওউফের কলুষ থেকে পবিত্র করার পূর্ণ চেষ্টা তাঁরা করেছেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু না কিছু জাহিলী তাসাওউফ দর্শনের প্রভাব এবং তাদের কার্য পদ্ধতিতে কিছু না কিছু বাইরের কার্য পদ্ধতির প্রভাব ছিল। এসব সম্পর্কে তাঁদের এই ধারণা ছিল যে, এগুলো কোরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার পরিপন্থী নয়। অথবা নিতান্ত পক্ষে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দ্বারা সেগুলোকে পরিপন্থী মনে করা যেতো। এতদ্বাতীত এ তাসাওউফের উদ্দেশ্য ও পরিণাম ইসলামের উদ্দেশ্য ও বাঞ্ছিত পরিণাম থেকে কমবেশী পৃথক। সুস্পষ্টরূপে প্রতিটি মানুষকে নৈতিক দায়িত্ব পারনের জন্যে তৈরি করা এর উদ্দেশ্য নয় এবং কোরআন ****************
অর্থঃ যেন তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষী হও।-বাকারা-১৪৩) শব্দগুলোর দ্বারা যা নির্দেশ করেছে তা শিক্ষা দেয়াও এর উদ্দেশ্য নয়। এমন কি এ তাসাওউফের পরিণামও এমন হতে পারেনি, যার দ্বারা এমন লোক তৈরি হতে পারতো যারা দ্বীনের পরিপূর্ণ ধারণা হৃদয়ঙ্গম করতে পারত, ইকামাতে দ্বীনের চিন্তায় অধীর হতো এবং এ কাজের যোগ্য হতে পারত। এই তৃতীয় প্রকারের তাসাওউফকে আমরা সম্পূর্ণরূপে মানি না এবং সম্পূর্ণরূপে এক খণ্ডনও করতে চাই না। বরং এর অনুসারী ও সমর্থকবৃন্দের কাছে আমাদের আবেদন এই যে, তাঁরা যেন অনুগ্রহ করে বড় বড় ব্যক্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস-শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ন রেখে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে এই তাসাওউফের প্রতি সমালোচনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন। উপরন্তু যদি কোন ব্যক্তি এ তাসাওউফের কোন বিষয় কোরআন ও সুন্নাহর বিপরীত দেখে তার সমালোচনা করে, তা হলে তার অভিমত মেনে নেয়া হোক বা না হোক, অন্তত তার সমালোচনার অধিকার অস্বীকার করে তাকে অযথা যেন তিরষ্কার করা না হয়।
মাওলানা কি তাসাওউফ বিরোধী ছিলেন?
এ সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাংবাদিক আবেদ নিযামী। তিনি বলেনঃ
বিগত পঞ্চাশ সালের কথা। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী লাহোর হোটেলের পেছনে (ফতেহ মুহাম্মদ রোড) একটি মসজিদে তখন প্রতি রোববার বেলা ন’টা থেকে দারসে কোরআন পেশ করতেন। সেখানে বহু লোক সমাগম হতো। আমার বয়স তখন পনেরো-ষোল। আমার পারিবারিক পরিবেশ ছিল একেবারে তাসাওউফ প্রভাবিত। শুনতাম মাওলানা মওদূদী তাসওউফ ও সূফীদের বিরোধী ছিলেন। এমন লোকের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ-অনুরাগ মোটেইর থাকার কথা নয়।
একদিন কি মনে করে তাঁর দারসে হাযির হলাম। এক টুকরা কাগজে বাড়ি থেকে এ প্রশ্ন লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম- দয়া করে বলুন, আপনি তাসাওউফের বিরোধিতা করেন কেন?
কাগজের টুকরোটি কয়েক জনের হাত বদল হয়ে মাওলানার হাতে গিয়ে পৌঁছল। মাওলানা জওয়াবে বরেন, আসলে এ আমার উপরে একটা বিরাট অপবাদ যে, আমি তাসাওউফ বিরোধী। আমি আমার বিভিন্ন প্রবন্ধে বারবার এ কথা বলেছি যে, আমার তাসাওউফের অর্থ হলো আত্মশুদ্ধি এবং এ হলো দ্বীনের রূহ বা প্রাণ শক্তি। কোরআন পাকে একেই বলা হয়েছে ‘তাযকিয়া’ এবং ’হিকমত’। হাদীসে এর নাম দেয়া হয়েছে ‘ইহসান’। এখন যে জিনিস কোরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণিত, তার বিরোধিতা একজন মুসলমান কিভাবে করতে পারে? অবশ্য এমন তাসাওউফ আমি কিছুতেই সমর্থন করি না, ইসলামী শরীয়তের সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামের সুফীগণও এ ধরনের তাসাওউফের বিরোধিতা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে খাঁটি নিয়ত এবং পরিপূর্ণ মহব্বতের সাথে রাসূলের ‘উসওয়ায়ে হাসানা’র অনুসরণ করার নামই হলো ‘তাসাওউফ’।
মাওলানার এ সুস্পষ্ট জওয়াবে আমি অনুভব করলাম যে, সহজ ও সরল তাস্বায় তাঁর তাসাওউফের ব্যাখ্যা আমার মনের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করল।
তারপর থেকে তার দারসে হাযির হতে থাকলাম। ৫/এ যায়লদার পার্কে তাঁর বাড়ি সংলগ্ন উঠোনটিতে আসরের পর যে বৈঠক হতো তাতেও হাযির হতাম। একদিন মাওলানাকে বললাম, মাওলানা স্বপ্নে দেখেছি যে, আপনি আমাকে ‘যবতে বেলাদাত’ (জন্ম নিয়ন্ত্রণ) বাইখানি দিয়ে পড়তে বলছেন।
মাওলানা বললেন-বইখানি পড়েছেন?
বললাম-জি হ্যাঁ।
মাওলানা বললেন- তাহলে বিয়ের পর তার উপরে আমল করতে থাকবেন।
সাতষট্টিতে বদলী হয়ে রাওয়ালপিন্ডি গেলাম। একদিন সন্ধ্যায় ছ’সাত মাসের রুগ্ন শিশুকে নিয়ে মারী রোডে অবস্থিত হামদার্দ দাওয়াখানায় গেলাম। সড়ক পার হয়ে দাওয়াখানায় যাওয়ার আগেই দেখলাম চাঁদনীচকে মাগরিব পড়ার পর মাওলানা বেরিয়ে আসছেন। এগিয়ে গিয়ে সালাম করলাম। বললেন, কি ব্যাপার, এখানে যে? বললাম, মাওলানা, বদলী হয়ে এখানে এসেছি। বাচ্চাটির ভয়ানক অসুখ, তাই দাওয়া নিতে এসেছি।
মাওলানা বাচ্চাকে আদর করলেন। তারপর বড্ডো স্নেহের সাথে কিছু পড়ে বাচ্চার উপর ফুক দিলেন।
একটু রসিকতা করে বললাম, মাওলানা, ঝাড় ফুঁকের কাজও করেন নাকি?
মাওলানা বললেন, জি হ্যাঁ, করি বই কি। আপনার মতো সূফী সায়েবরা তো খামোখাই আমাকে ’ওহাবী’ বলে প্রচার করেন।
যা হোক ওখান থেকে সোজা ঘরে ফিরে এলাম। বিবি বললেন, দাওয়াই কোথায়? তাঁকে সব ঘটনা বলে শুনিয়ে দিলাম, এখন ইনশাআল্লাহ দাওয়াই ছাড়াই সে সেরে উঠবে এবং সহ্যি হলোও তাই।
তারপর থেকে, মাওলানার সাথে আমার সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।
সত্তরের একটি ঘটনা ৫/এ যায়লদার পার্কে বিকেলের আসর চলছে। মাওলানা এক ব্যক্তির প্রশ্নের জওয়াব দিচ্ছেন। এমন সময় একটি যুবক একটা ধারালো ছোরা হাতে দাঁড়ালো এবং মাওলানার সামনে টেবিলের উপর তা রেখে দিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে মাওলানার কাছে মাফ চাইতে লাগল। জানা গেল, যুবকটি লায়ালপুরে (বর্তমান ফয়সালাবাদ) এক মৌলভীর মুখে মাওলানার বিরুদ্ধে ভয়ানক উস্কানিমূলক বক্তৃতা শুনে মাওলানাকে হত্যা করতে এসেছিল। মাওলানার নূরানী চেহারা দেখে এবং তাঁর মনোমুগ্ধকর আলাপ-আলোচনা শুনে সে এতোটা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে যে, উল্টো সেই মৌলভীকেই গালাগালি করতে লাগলো।
আসরের সকলেই হতবাক, বিস্ময়-বিস্ফারিত। মাওলানা তাকে খুশী মনে মাফ করে দেন। যুবকটি অনুতপ্ত ও পরিবর্তিত মন নিয়ে আসর ত্যাগ করে।
একবার একজন জিজ্ঞেস করল, মাওলানা, রোজ হোশরে যখন আপনি মালিকের দরবারে দাঁড়াবেন, তখন আপনার কোন কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা সেখানে পেশ করবেন?
মাওলানা কম্পিত কণ্ঠে বললেন, কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা? না-না, আমি তো সে দিন তাঁর খাস রহমতের আশায় বুক বেধে থাকব। তিনি তাঁর অশেষ রহমতে আমার কোন আমল যদি কবুল করে নেন, তাহলে সেটা হবে তাঁর বিশেষ মেহেরবানী।
এই বিকালের আসরে একদিন একটি যুবক খুব উত্তেজিত হয়ে বলে, মাওলানা! কিছু লোক আপনার বিরুদ্ধে এমন সব অপবাদ রটায় যে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। এমন কি কিছু মৌলভী মসজিদের মেম্বর-মেহরাব থেকে আপনার পরিবারের লোকদেরও অপবাদ করে। এসব লোকের বিরুদ্ধে আপনি আদালতে মানহানির মামলা করেন না কেন?
মাওলানা জওয়াবে বলেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি এমন এক উচ্চ আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে রেখেছি যে, তারা কিছুতেই বাঁচতে পারবে না। সে দিন খুব বেশী দূরে নয়, যে দিন তাদের নামায-রোযা আমার ভাগেই এসে পড়বে।