কতকগুলো মূল্যবান কথা
[১]
আমি অতীত ও বর্তমানের কারো কাছ থেকে দ্বীনকে বুঝবার চেষ্টা না করে সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। এতএব খোদার দীন আমার ও প্রত্যেক মুমিনের কাছ থেকে কি দাবি করে- এ কথা জানার জন্যে দেখার চেষ্টা করি না যে, অমুক বুযুর্গ কি বলেন ও কি করেন। বরঞ্চ শুধু দেখার চেষ্টা করি যে, কোরআন কি বলে এবং তার রাসূল (সাঃ) কি করেছেন।
-আবুল আ‘লা মওদূদী
[২]
আমরা প্রকৃত পক্ষে এমন একটা দল তৈরি করতে চাই, যারা একদিকে দ্বীনদারী পরযেহগারীতে পারিভাষিক দ্বীনদার মুত্তাকী থেকে হবে অধিকতর অগ্রসর এবং অপরদিকে দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা চালানোর জন্যে সাধারণ দুনিয়াদার থেকে হবে অধিকতর যোগ্যতা ও ক্ষমতাসম্পন্ন। সৎ লোকের এমন একটা দল গঠিত হওয়া উচিত, যার লোকগুলো হবে খোদাভীরু, নিষ্ঠাবান ও বিশ্বস্ত। আর তারা ভূষিত হবে খোদা মনঃপূত চরিত্র ও গুণাবলীতে। তার সাথে তারা দুনিয়ার কাজ-কারবার বুঝতে পারবে দুনিয়াদারদের থেকে অধিকতর ভালোভাবে।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[৩]
আমার ও আমার সহকর্মী বন্ধুদের কাছে যখনই এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, আমরা চুল বরাবর কোরআন ও সুন্নাহ থেকে সরে পড়েছি, তখন ইনশাআল্লাহ দেখবেন যে, আমরা হকের দিকে ফিরে যেতে এক মুহূর্তও ইতস্তত করব না। কিন্তু আপনারা যদি হক ও বাতিলের কষ্টিপাথর খোদার কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের পরিবর্তে কোন ব্যক্তিকে করেন, তাহলে আপনারা নিজেদেরকে ও নিজেদের ভবিষ্যতকে ব্যক্তির উপরেই সোপর্দ করুন। এর পূর্ণ অধিকার আপনাদের আছে। অতঃপর খোদার কাছে এরূপ জবাব দিবেন, ‘হে খোদা, আমরা আমাদের দ্বীনকে তোমার কিতাব ও তোমার রাসূলের সুন্নাতের পরিবর্তে অমুক ও অমুক লোকের উপরে ছেড়ে দিয়েছিলাম’। আপনাদের এ জবাব যদি আপনাদেরকে খোদার কাছ থেকে বাঁচাতে পারে, তাহলে তা সন্তুষ্ট চিত্তে করতে থাকুন।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[৪]
এ কাজ যদি আমরা দোকানদারীর মনোভাব নিয়ে করে থাকি, তাহলে আমাদের উপরে এবং আমাদের এ কারবারের উপরে হাজার হাজার লা’নত। আর যদি এটা ঐকান্তিকতার সাথে খোদার দ্বীনের খেদমত হয়, তাহলে আমাদের উপরে প্রত্যেকের খুশী থাকা উচিত যে, এ কাজ সে শুধু একাই করছে না বরং অন্যান্যরাও এতে লিপ্ত আছেন। আমাদের কাজ হচ্ছে এই যে, আমরা তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করব না। বারবার আমরা তার কাছে যাব, যাতে আল্লাহ তার মনকে ফিরিয়ে দেন।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[৫]
ইকামতে দীন একটি অটল ও অপরিহার্য কর্তব্য
প্রত্যেক সত্যানুসন্ধী ব্যক্তির অপরিহার্য কর্তব্য এই যে, সে যেন তার মধ্যে ইকামতে দ্বীনের তীব্র অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। অতঃপর সে চেষ্টা করবে যাতে তার মনের মধ্যে এ আগুন জ্বলে উঠে। এ চেষ্টা-চরিত্রের পরিণাম কি হবে, তা আলোচনা বহির্ভুত। এমনও হতে পারে যে, আমাদেরকে করাত দিয়ে চিরা হবে, মাটির উপর দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে নেয়া হবে, জ্বলন্ত কয়লার উপরে নিক্ষিপ্ত করা হবে এবং আমাদের মৃতদেহ কাক-চিলের খাদ্য হবে। এতসব করেও হয়ত আমাদের এ সৌভাগ্য হবে না যে, বর্তমান বাতিল ব্যবস্থাকে আমরা একটা সত্য সুন্দর ব্যবস্থায় পরিবর্তিত করতে পারব। কিন্তু এ ব্যর্থতা কোন ব্যর্থতা নয়। ব্যর্থতার কোন আশঙ্কা অথবা অনিশ্চয়তা আমাদেরকে ঐ দাবি থেকে মুক্তি দান করবে না, যে দাবি ইকামতে দ্বীনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা করেছেন। এ একটা অটল অপরিহার্য কর্তব্য, যা আমাদেরকে যে কোন মূল্যে যে কোন অবস্থায় পালন করতে হবে। যদি সকল খানকাহ আপনাদেরকে এ আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করে যে, অমুক অমুক ওযীফা-তপজপ এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে পারে, তাহলে আমি আপনাদেরকে নিশ্চিয়তার সঙ্গে বলব যে, এ শয়তানী প্রবঞ্চনা মাত্র। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের ঘাড়ে মাথা রয়েছে আর আল্লাহর পৃথিবীর সূচ্যগ্র-ভূমি আল্লাহ ব্যতীত অপরের দাসত্বে নত হয়ে আছে, ততক্ষণ আপনাদের জন্যে শান্তির নিদ্রা হারাম।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
(জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী-৩য় খণ্ড)
[৬]
হুকুমতে ইলাহিয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি
ইকামতে দ্বীনের এ প্রচেষ্টা সম্পর্কে কিছু বলতে পারি না যে, এর ফলাফল কি হবে। পরিণাম তো আল্লাহ তায়ালাই জানেন। এ প্রচেষ্টার ফল যদি এ হয় যে, আমরা একটা সৎ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছি, তাহলে তা হবে আল্লাহর দান। কিছু সংখ্যক লোক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে এ কথা বলে যে আমাদের সকল প্রচেষ্টা ক্ষমতা লাভের জন্যে এবং দ্বীনের আসল উদ্দেশ্য যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ, তা আমাদের মধ্যে নেই। তাদের এই ধারণা একেবারে ভ্রান্ত। আমাদের সকল প্রচেষ্টা একটা সৎ এবং খেদায়ী ব্যবস্থার জন্যে। এ প্রচেষ্টায় কোন অপরাধ নেই এবং এতে লজ্জারও কিছু নেই। আমরা যখন হুকুমাতে ইলাহিয়ার নাম করি তখন আমরা উপরিউক্ত ব্যবস্থাকেই বুঝাই। আমি বুঝতে পারি না যে, এটা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত হলে এত বিতর্কের কি আছে? এবং এটা খোদার সন্তুষ্টির কামনার পরিপন্থীই বা কি করে হবে? খোদার পৃথিবীতে একমাত্র কোদারই বিধান চলবে- এর চেয়ে অধিক খোদার সন্তুষ্টি লাভ আর কি প্রকারে হতে পারে? তাদের চেয়ে অধিক খোদার সন্তুষ্টি কামনাকারী আর কে হতে পারে, যারা এ কাজের জন্যে জানমাল উৎসর্গ করে এবং ফলাফল যাই হোক না কেন, খোদার পৃথিবীতে খোদা ছাড়া আর কারো প্রভুত্ব কিছুতেই চলতে দিতে চায় না। এ ধরণের সংগ্রাম প্রচেষ্টা যদি দুনিয়াদারী হয়, তাহলে দ্বীনদারী কি একে বলে যে, রাত্রি জেগে জেগে ‘আল্লাহ’ যিকির করা হবে, আর দিনের বেলায় শয়তানের সিংহাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হবে? যারা এ ধরনের কথা বলে, তাদের মন-মস্তিষ্কে দ্বীন সম্পর্কে অতি নিকৃষ্ট ধারণা রয়েছে।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
(জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী-৩য় খণ্ড)
[৭]
সত্য পথের দাবি
এ পথের প্রকৃত দাবি এই যে, আমাদের মধ্যে যেন বিরোধিতাকে স্বাগত জানানোর অনুরাগ সৃষ্টি হয়। সত্য পথেই হোক আর ভ্রান্ত পথেই হোক, আল্লাহ তায়ালার নীতি এই, যে ব্যক্তি যে পথই অবলম্বন করে সে পথেই তার অগ্নিপরীক্ষা হয়। হক পথের তো বৈশিষ্ট্যই এই যে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এ অগ্নি পরীক্ষায় পরিপূর্ণ। যেমন অংক শাস্ত্রে কোন মেধাবী ছাত্র কঠিন প্রশ্নে সন্তুষ্ট হয় এ জন্যে যে, তার মেধাশক্তি পরীক্ষার সুযোগ সে লাভ করেছে। ঠিক এইরূপ কোন দৃঢ়-সংকল্প মুমিন কোন নতুন পরক্ষিার সম্মুখীন হতে আনন্দ পায় এ জন্যে যে, তার আনুহত্য প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে। ক্ষীণ প্রদীপ বাতাসের ঝাপটায় নিভে যায়, কিন্তু প্রজ্জ্বলিত উনুনকে বাতাসের ঝাপটা আরো অধিকতর প্রজ্জ্বলিত করে দেয়। আপনারা নিজেদের ভিতর এমন যো্যতা সৃষ্টি করুন যে, যেভাবে একট প্রজ্জ্বলিত উনুন সিক্ত জ্বালানির দ্বারা নিভে না গিয়ে বরং তাকে তার খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তেমনি আপনারা বিরোধিতার কাছে নত না হয়ে বরং তা থেকে খাদ্য এবং শক্তি সংগ্রহ করুন। যতদিন না এ যোগ্যতা আমাদের মধ্যে পয়দা হয়েছে, ততদিন এ আশা করা যেতে পারে না যে, আমাদের দ্বারা দ্বীনের কোন ভালো খেদমত হতে পারে।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
(জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী-৩য় খণ্ড)
[৮]
দ্বীনকে যেভাবে বিকৃত করা হচ্ছে, তা যদি আমি মেনে নেই এবং কিছু লোক আমাকে যেভাবে দেখতে চায়, আমি যদি তা হয়ে যাই, তাহলে এমন অপরাদে অপরাধী হবো যে, আল্লাহর কাছে আমাকে কঠিন জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। সেদিন আমাকে কেউ সাহায্য করতে আসবে না। অতএব, আমি তাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র হওয়াকে শ্রেয় মনে করি আখেরাতে নিজেকে বিপন্ন করা থেকে।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[৯]
খোদা সাক্ষী আছেন, কোন ব্যক্তি অথবা দলের প্রতি আমার কোন শত্রুতা নেই। আমি শুধু সত্যের বন্ধু এবং মিথ্যার দুশমন। যা আমি সত্য মনে করছি, তার সত্যতার যুক্তিও পেশ করেছি। যা মিথ্যা মনে করেছি, তারও যুক্তি উপস্থাপিত করেছি। যিনি আমার সাথে একমত নন, তিনি যুক্তি দিয়ে আমার ভুল ধরে দিলে, আমি আমার মত পরিবর্তন করতে পারি। এখনো কিছু লোক এরমন আছেন, যাঁরা শুধু এ জন্যে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েন যে, তাদের অথবা তাদের প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়েছে। অথচ তাদের বিবেচ্য এটা নয় যে, যাঁ বলা হয়েছে তা সত্য না মিথ্যা। এ রূপ লোকের ক্রোধবহ্নিকে আমি কোন পরোয়া করি না। আমি তাদের গালির জবাব দেবো না এবং আমার পথ থেকে বিচ্যুত হবো না।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[১০]
আমার স্পষ্টবাদিতা নিশ্চয়ই ঐ সব মহাত্মার কাছে কটু লাগবে, যারা মানুষকে সত্যের দ্বারা যাচাই করার পরিবর্তে সত্যকে মানুষের দ্বারা যাচাই করতে অভ্যস্ত। এর জবাবে আরো কিছু গালি খাবার জন্যে আমি নিজকে প্রস্তুত রেখেছি।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[১১]
আমার বড় দুঃখ হয়, মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতন বর্তমানে এমন চরমে পৌঁছেছে যে, খোদার আইন-ভঙ্গকারীরা সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপরদিকে যারা রাব্বুল আলামীনের আইন মেনে চলে ও অপরকে চলতে বলে, আজ তারাই হচ্ছে লাঞ্ছিত ও অপমানিত।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[১২]
খোদার ফযলে আমি ভাবাবেগে কোন কাজ করিনি। আমার বক্তৃতায় যা কিছু বলেছি, তার প্রতিটি শব্দ পরিমাপ করে বলেছি এ কথা চিন্তা করে যে, এর হিসাব খোদার কাছে দিতে হবে, কোন বান্দার কাছে নয়। আমি নিশ্চিত যে, সত্যের বিপরীত একটি শব্দও আমি বলিনি। যা কিছু বলেছি, তা দ্বীনের খেদমতের জন্যে ছিল একান্ত অপরিহার্য। আমার আশংকা হয়েছিলো যে, এ কথা বলা জন্যে নয়, বরং না বলার জন্যে আমাকে খোদার কাছে দায়ী হতে হবে।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[১৩]
আমি তাদের মধ্যে নই, যারা মিথ্যা প্রচারণা, ব্যক্তিগত কোন্দল এবং গালাগালি করাকে নিজেদের পেশা বানিয়ে নিয়েছে। বুযুর্গানে কওমের পাগড়ি বহনকারী এবং রাজনৈতিক মতভেদকে ব্যক্তিগত শত্রুতায় পরিবর্তনকারীদের আচরণ আমি সর্বদাই ঘৃণার চোখে দেখে এসেছি। আমাকে যাঁরা জানেন, তাঁরা এ সত্যিটিও জানেন।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[১৪]
সিনেমা
প্রশ্নঃকখনো কখনো চিত্ত বিনোদনের জন্যে সিনেমায় যাই। যৌন-অনুরাগে প্রভাবিত হয়ে যাই না। এ বিষয়ে আপনি কি বলেন?
জবাবঃসিনেমার দৃশ্যাবলী বরদাশত করতে পারে শুধুমাত্র ঐসব চোখ, যা এখনো পূর্ণ মুসলমান হয়নি। আপনি চোখ দুটোকে মুসলমান বানানোর চেষ্টা করুন। তারপর দেখবেন যে, সিনেমায় আপনার চিত্তবিনোদন হবে না। এমন কষ্ট হবে যে, মনে হবে, কে যেন চোখে সূঁচ ফুটিয়ে দিচ্ছে।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
একটি সাক্ষাতকার
প্রশ্নঃআপনি আপনার জীবনের অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কিছু বলবেন কি?
উত্তরঃআমার ডাইরী লেখার অভ্যাস নেই এবং এ সব বিষয়ে কোন দিন বসে চিন্তাও করিনি। সুযোগ বুঝে কোন কথা হয়ে যায়। আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গে কোন ঘটনার উল্লেখ করে ফেলি। কিন্তু কোন দিন এ সবের কোন তালিকা প্রস্তুত করিনি এবং এ সব নিয়ে কোন চিন্তাও করিনি। কখনও বা হঠাৎ কোন অসাধারণ কথা এসে পড়ে। নতুবা সাধারণত আমি কোন বিষয়ে অধিক আনন্দও করি না এবং বিমষর্ হয়েও পড়ি না।
প্রশ্নঃএমন অবস্থা কি আপনার কখনো হয়েছে যাতে খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট হয়েছে?
উত্তরঃজি না, এমন তো হয়নি। এর জন্যে খোদার খোকর। তবে একবার মাত্র এমন হয়েছিলো যে, আজ বুঝি অনাহারে থাকতে হয়। কিন্তু উপোস থাকবার আগেই আল্লাহ তায়ারা কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। খোদার শোকর যে, আজ পর্যন্ত যে অবস্থা হয়নি। তার কারণ এই যে, বহুকাল একাকী বাস করেছি এবং অনেক সময়ে নিজ হাতে রান্নাও করেছি। আবার অনেক সময় কাজে এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে, রান্না করার অবসর পাইনি। খাবার সময় হলে কলা এনে খেয়ে নিয়েছি।
প্রশ্নঃআপনি কখন বেশিক্ষণ ধরে বসে কাজ করতেন এবং কত ঘণ্টা?
উত্তরঃআমি সব সময় কাজ করতে পারি। কিন্তু যখন দেখি যে, দিনের বেলায় অবসর নেই, তখন রাতেই কাজ করি। এমন এক সময় ছিলো, যখন ইশার নামাযের পর থেকে ফযরের নামায পর্যন্ত কাজ করেছি। এ সময়ের মধ্যেও লোকজন দেখা করতে আসতো, কথাবার্তাও চলতো।
প্রশ্নঃএ আন্দোলনের কাজে এবং এই অবস্থায় আপনি স্বাথ্যের প্রতি কিরূপ ল্কষ্য রাখতেন?
উত্তরঃস্বাস্থ্য সম্পর্কেও কিছুকাল পর্যন্ত আমি বেপরোয়া ছিলাম। বরং এক সময়ে তো আমি এই চিন্তা করে কাজ করতাম যে, আমাকে আমার সকল শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, ফলাফল যাই হোক না কেন। যে সময়ে আমি মরিয়া হয়ে কাজ করতাম। কোনই পরোয়া করতাম না যে শরীর ও স্বাস্থ্যের উপর কি চাপ পড়বে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এভাবেই কাজ করে গিয়েছি। একা কাজ করেছি। সাহায্য করার কেউ ছিলো না। আমি অনুভব করছিলাম যে এ কাজ চলুক না চলুক যতটুকু করতে পারি করে ফেলি। অবশ্য ভরসা তো ছিলো না যে কোন সহকর্মী পাওয়া যাবে এবং যে কাজ করছি তা সফল হবে।
প্রশ্নঃসহকর্মী পাওয়াতে এবং আন্দোলনের কাজ বেড়ে চলাতে আপনার আনন্দ হয়েছিলো?
উত্তরঃ জি হ্যাঁ, এ তো অতি স্বাভাবিক কথা।
প্রশ্নঃপ্রথমবার যখন জেলে পাঠানো হয়, তখন আপনার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিলো?
উত্তরঃআমি প্রথম থেকেই মনে করে রেখেছিলাম যে, এ পরিস্থিতি অবশ্য অবশ্যই আসবে এবং এ আমার ধারণার অতীত ছিল না। বরং আমি এই ধারণাই করেছিলাম। এতে আমার কোন দুঃখও ছিল না।
প্রশ্নঃপ্রথমবার যখন আপনি জেলে গেলেন এবং বিশ মাস জেলে থাকার পর যখন বেরিয়ে এলেন, তখন আপনার মনের অবস্থা কি ছিল?
উত্তরঃসে সময়ে কোন বিশেষ সুখ অথবা দুঃখ অনুভব করিনি। পরম আরামে জেলে বসে কাজ করতাম। প্রতি ছ’মাস পর গভর্নমেন্ট আমার বন্দী জীবনের মিয়াদ বর্ধিত করত। এমন কখনো হয়নি যে, আমি দিন গুণছিলাম এবং অবশেষে মুক্তির দিন এসে গেছে। আমি স্থির নিশ্চিত ছিলাম যে, তারা আমাকে কিছুতেই মুক্তি দেবে না। আমি প্রথম থেকেই তৈরি থাকতাম যে, ছ’মাস পর আবার মিয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হবে। সে সময়ে যাদের হাতে ক্ষমতা ছিল, আমার জানা ছিল তারা কোন ধরনের লোক। এ জন্যে আমি আশাই করতে পারতাম না যে, ছ’মাস পর মিয়াদ বাড়ানো হবে না। প্রতিবার মিয়াদ যে বাড়িয়ে দেয়া হতো, তা আমি ধারণাই করতাম এবং তারপর আবার নিশ্চিন্তে কাজ করতে শুরু করতাম। মুক্তির জন্যে কোন উদ্বেগ হতো না।
প্রশ্নঃআপনি কি মনে করেছিলেন যে, আপনার মৃত্যুদণ্ড হবে? যখন মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ পেলেন, যখন মনের অবস্থা কেমন হয়েছিলো?
উত্তরঃআসল কথা, এ ঢাক-ঢোল পিটে বলার বিষয় নয়। এ প্রশ্নের জবাবে আজ যা কিছু বলবো, কাল হয়ত তার উল্টো অর্থ করা হবে। মোটকথা, বহুদিন থেকে আমি এ বিষয়ে প্রত্যাশী ছিলাম যে, মৃত্যু যদি আসে তো তার পরের অধ্যায়টাও একবার দেখে নেব। এ জন্যে আমার বেশ আনন্দ হচ্ছিল যে, একে তো মৃত্যুদ্বার অতিক্রম করে পরপারের দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার হবে। দ্বিতীয়ত আখেরাতের নাজাত সুনিশ্চিত করার জন্যে যে আমাকে শহীদ করে দেবে আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। বরং আমি এক ধরনের আনন্দ অনুভব করতাম। অবশ্য আমি এ কথাও ভাবতাম যে, হয়ত এরা আমাকে ফাঁসী দেয়ার সাহসই বা কোথায়? এরা তো আমা থেকে মুক্তি পেতে চায়। কারণ আমার অস্তিত্ব এদের কাছে অসহনীয় হয়ে পড়েছে। এ জন্যে হতে পারে যে, এবারের সুযোগ তারা গ্রহণ করবে। আমারও ইচ্ছা ছিল যে তাই হোক। সে জন্যে আমি নিশ্চিত এবং আনিন্দত ছিলাম।
প্রশ্নঃআপনার জীবনে এমন কোন বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল কি যা আপনার জীবনের মোড় এদিকে ফিরিয়ে দিয়েছে?
উত্তরঃআমি এরূপ লোকই নই যে, কোন বিশেষ ঘটনা আমার জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেবে। আমি ধীর-স্থির চিত্তে গবেষণা করে ক্রমশ একদিকে অগ্রসর হই। একটি মাত্র বিশেষ ঘটনা আমাকে অত্যন্ত বিচলিত করেছিল।
হায়দারাবাদে নয় বছর অতিবাহিত করার পর যখন ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে আমি দিল্লী পৌঁছি, তখন আমি অনুভব করি যে, এ সময়ের মধ্যে মুসলমানগণ ইসলাম থেকে অতি দ্রুত সরে পড়ছে। দিল্লীতে যা অনুভব করলাম হায়দারাবা দ সে অবস্থা ছিল না। মুসলমান সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা প্রকাশ্যে বাজারে চলাফেরা শুরু করেছিল, যাদের সম্পর্কে আমি এতটা চিন্তাও করতে পারিনি। এটা আমাকে খুবই বিচলিত করে। দিল্লীর অবস্থা দেখে আমার রাতে ঘুম আসত না যে একি হলো। নয় বছরে এত পরিবর্তন? এ এমন সময়ের অবস্থা যখন কংগ্রেস সরকার স্থাপিত হয়েছিল, যার ফলে চারিদিকে শুধু হিন্দুদের প্রাধান্যই চোখে পড়ত। এ পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ১৯৩৭ সারে আমি দিল্লী থেকে যখন টেনে হায়দারাবাদ রওয়ানা হই, তখন একজন হিন্দু নেতা আমার সহযাত্রী ছিলেন। কিছু মুসলমান তার সঙ্গে আলাপ করতে লাগল। তাদের আলাপ-আলোচনায় মনে হলো যেন কংগ্রেস নেতারাই এ দেশের কর্তা এবং মুসলমানরাই তাদের প্রজা। যেন এরা ভিখারী এবং তারা দাতা। তাদের আলাপ-আলোচনা নীরবে শুনতে লাগলাম। মুসলমানদের ভবিষ্যত অবস্থা কি হবে তার একটা পূর্ণ চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এই ঘটনার পর আমি ‘সিয়াসী কাশমকাশ-১ম খণ্ড’ রচনা করি। হায়দারাবাদে বসে সংবাদপত্রের মাধ্যমে যে অবস্থার সঠিক ধারণা আমি করতে পারিনি এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে এবং চারদিকে ঘুরে ফিরে তা সঠিকভাবে অনুভব করতে পারলাম। এটাই আমাকে সংগঠিত উপায়ে সংগ্রাম-প্রচেষ্টার অনুপ্রেরণা জোগায়।
(চেরাগে রাহ-ইসলামী আন্দোলন সংখ্যা)
কিছু ঐতিহাসিক উক্তি
* এ হচ্ছে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মতের দেশ-মার্কস এবং মাওসেতুং-এর উম্মতের দেশ নয়। যদি আল্লাহর দ্বীনের জন্যে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়, তাহলে দশটি ফ্রন্টে সংগ্রাম করতেও কুণ্ঠিত হবো না। আমরা একই সাথে সংগ্রাম করবো এক-নায়কত্বের বিরুদ্ধে এবং সংগ্রাম করবো ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে। যতদিন আমরা জীবিত থাকব এবং যতদিন আমাদের ঘাড়ে মাথা আছে, ততদিন কারো সাহস হবে না এখানে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা কায়েম করার।
* ভাই, আমার মনোভাব তো আপনাদের জানাই আছে। আমার যে অপরাধ কি এটা তাদের ভাল করে জানা আছে। তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার চেয়ে ফাঁসীতে জীবন দেয়াই ভালো।
* আমি যদি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?
* যামানা বড় নির্মম যাচাইকারী। আপনি কোন কৃত্রিম উপায়ে এবং বানোয়াট পদ্ধতিতে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খাঁটি বলে বিবেচিত হবেন না। কিন্তু নিশ্চিত থাকুন যে, যদি আপনি আপনার কার্যকলাপের দ্বারা নিজেকে খাঁটি প্রমাণিত করতে পারেন, তাহলে বিপক্ষ শক্তি আপনাকে জাল প্রমাণ করার জন্যে যতই চেষ্টা করুক না কেন, আল্লাহ চাহেন তো তারা ব্যর্থ হবেই। আপনি মিথ্যার প্রাবল্য দেকে ঘাবড়ে যাবেন না। সেতো কখনো ঝড়ের বেড়ে আসে, আবার কখনো বুদবুদের মতো শূন্যে বিলীন হয়ে যায়। মিথ্যার মুকাবেলা করার কোন চিন্তা আপনার করা ঠিক নয়, বরং চিন্তা আপনার নিজের সততার জন্যে হওয়া উচিত।
* ইসলাম এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা এখন দুটি নৌকার মতো, যা ঠিক দু’টি বিপরীত দিকে চলে। যদি কেউ এ দু’টির একটিতে আরোহণ করে, তাহলে তাকে অবশ্যই দ্বিতীয়টি পরিত্যাগ করতে হবে। আর যদি কেউ একই সাথে দু’টিতে আরোহণ করে, তাহলে সে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে।
* এখন সময়ে এসেছে আমাদের মুসলমান থাকা না থাকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করার। মুসলমান হয়ে থাকতে হলে আমাদেরকে আপন পরিবেশ এবং সারা দুনিয়াকে ’দারুল ইসলাম’ বানানোর সংকল্প নিতে হবে। যদি এতটুকু সাহস ও হিম্মত আমাদের না থাকে, তাহলে ইসলামের দাবিদার হওয়ার কথাটা ছেড়ে দিতে হবে। ‘ইসলামী বিপ্লব’ সম্ভব কি না এ প্রশ্নতো পরের। প্রথম প্রশ্ন এই যে, আপনাদের মধ্যে মুসলমান হয়ে থাকার সংকল্প ও বাসনা আছে কি না। ধরে নিন, ইসলামী বিপ্লব অসম্ভব। ধরে নিন, এ সময়ে কুফর শক্তির ফ্যাসিবাদী তৎপরতা ও সার্বিক প্রাধান্য দেখার পর যে ব্যক্তি ‘দারুল ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে দাঁড়ায়, তাকে আলবৎ পাগল বলা হবে এবং বলা হবে সে আগুন নিয়ে খেলা করতে চায়। এটাও বিশ্বাস করুন যে, এ সময়ে বলতে গেলে আমরা ময়দান প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। এ অবস্থার মুকাবেলার জন্যে দাঁড়ানো পাগলের কাজ বলেই মনে হবে। এ কথাও ভাল করে জেনে রাখুন, এর পরিণাম হবে তাই, যা আমাদের দুর্বল ইমানদার নেতাগণ মনে করেন। অর্থাৎ আসমান-যমীনের প্রতিটি অণু-পরমাণু আপনাদের দুশমন হয়ে পড়বে। তারপর এ কথাও আগে থেকে জেনে রাখুন, ইসলামের-দুশমন শিবিরগুলো এক জোট হয়ে আপনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। অপরপক্ষে মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। বরং আপনাদের এ ‘পাগলামির’ জন্যে বিদ্রূপ করবে। এসব জেনে শুনে ভালো করে আপন মনকে জিজ্ঞেস করুন যে, তার মধ্যে মুসলমান হয়ে থাকার আবেগ-অনুভূতি সেই ‘পাগলামির’ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে কি না। যাদের মধ্যে এ ‘পাগলামি’ বিদ্যমান আমাদের প্রয়োজন শুধুমাত্র তাদেরই এবং ‘দারুল ইসলামের’ আন্দোলন চালাতে পারে একমাত্র তারাই।
* হক বা সত্য সম্পর্কে এ কথা ভালো করে জেনে রাখা দরকার যে, সে স্বয়ং সত্য। সে এমন এক শাশ্বত মূল্যবোধের নাম, যা একেবারে সঠিক ও অভ্রান্ত। সমগ্র দুনিয়া যদি তাকে পরিত্যাগ করে তথাপি সে সত্য। কারণ তার সত্য হওয়াটা এ শর্তের অধীন নয় যে, দুনিয়া তাকে মেনে নেবে। দুনিয়ার মানা না মানা সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের কষ্টিপাথর নয়। দুনিয়া যদি সত্যকে মেনে না নেয়, তাতে সত্য ব্যর্থ হয়ে যায় না। বরং ব্যর্থ হয় সে দুনিয়া, যে তাকে মেনে না নিয়ে মিথ্যাকে মেনে নেয়। বিপদ-আপদ সত্যের উপরে আসে না, আসে সত্যপন্থীর উপর। কিন্তু যারা ভেবে-চিন্তে মনের নিশ্চয়তার সাতে এ সিদ্ধান্ত করে যে, তাদেরকে যে কোন অবস্থাতেই সত্যের উপর অবিচল থাকতে হবে, তার বাণী সমুন্নত করার জন্যে জীবন ও ধন-সম্পদ উৎসর্গ করতে হবে, তাদের উপর বিপদ আসে সত্য, কিন্তু বিফলকাম তারা কখনো হয় না। হাদীসে আছে, এমন কিছু নবী এসেছেন, যাঁরা সত্যের দাওয়াত দিতে দিতে সারা জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু একজনও তাঁদের উপর ঈমান আনেনি। তবে কি আমরা তাদেরকে বিফল মনোরথ বলবো? না, বিফল মনোরথ সে জাতিই হয়েছে, যারা হক বা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে বাতিলপন্থীদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে।
এতে সন্দেহ নেই যে, দুনিয়াতে তাই চলে যা সাধারণ লোকে মেনে নেয়। আর যা তারা মানে না তা চলতে পারে না। কিন্তু লোকের মানা ও নামানা সত্য-মিথ্যার মাপকাঠি হতে পারে না। অধিকাংশ লোক যদি আঁধারে হাতড়াতে ও হোঁচট খেতে চায়, তাহলে তারা স্বচ্ছন্দে হাতড়াতে ও হোঁচট খেতে থাক। আমাদের কাজ হচ্ছে আঁধারে প্রদীপ জ্বালানো এবং এ কাজ আমরা আজীবন করতে থাকব। পথভ্রষ্ট বা পথভ্রষ্টকারী হওয়া থেকে খোদার কাছে আশ্রয় চাই। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ যে, তিনি আমাদেরকে আঁধারে প্রদীপ জ্বালাবার তাওফীক দিয়েছেন। এ অনুগ্রহের শোকরিয়া আমরা এভাবে আদায় করব যে, প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতেই মৃত্যুবরণ করব।
* মসজিদই শুধু খোদার ঘর নয়। বরং এ ঘরের বাইরে দ্বিতীয় একটি মসজিদও আছে যা অনেক অনেক বড় এবং যার নাম দুনিয়া। ঐ ছোট মসজিদটিতে যেভাবে মানুষ তার প্রতিটি কাজ ও পদক্ষেপ আল্লাহ তায়ারার নির্দেশেই সম্পন্ন করে, তেমনি ঐ মসজিদের বাইরেও যাবতীয় কাজকর্ম আল্লাহরই নির্দেশে করলে সেটাই হবে ইবাদত এবং তারই নাম ‘দ্বীন’।
* আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে যে, দুনিয়ায় সে সব শক্তি কিছুতেই টিকে থাকতে পারেনি, যা দুর্গের অভ্রন্তরে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেছে। কারণ ময়দানের মুকাবিলায় ভীত হয়ে দুর্গের মধ্যে আত্মগোপন করা কাপুরুষতার সুস্পষ্ট নিদর্শন। আল্লাহ তায়ারা এ যমীনকে কাপুরুষদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে তৈরি করেননি।
আমার প্রিয় গ্রন্থ
‘আমি জাহিলিয়াতের যুগের অনেক বই-পুস্তক পড়াশুনা করেছি। প্রাচীন ও আধুনিক দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে বহু সংখ্যক বই-পুস্তকের আলমারী উজাগ করে পড়াশুনা করেছি। কিন্তু যখন চোখ খুলে কোরআন পাক পড়লাম, তখন সত্যিই মনে হলো যে, এ যাবত যা কিছু পড়াশুনা করেছি তা সবই অতি নগন্য। জ্ঞানের মূল এখন আমার হস্তগত হয়েছে। কান্ট, হেগেল, নিটশে, মার্কস এবং দুনিয়ার অন্যান্য শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীলগণ আমার কাছে একেবারে শিশু মনে হয়েছে। তাদের প্রতি করুণা হয় যে, তারা যে সব সমস্যা সমাধানের জন্যে সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এবং যে সবের উপরে বিরাট গ্রন্থ রচনা করেছেন, সে সবের সমাধান পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পক্ষান্তরে এ মহাগ্রন্থে (আল কোরআন) এ সব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান দু’এক কথায় পেশ করা হয়েছে। এ সব বেচারা যদি এ মহাগ্রন্থ সম্পর্কে অজ্ঞ না থাকতেন, তাহলে তারা তাদের জীবন এভাবে ব্যর্থতায় কাটিয়ে দিতেন না। আমার সত্যিকার প্রিয় গ্রন্থ এই একটি। এ আমাকে একেবারে বদলে দিয়েছে। পশু থেকে মানুষ বানিয়েছে। অন্ধকার থেকে টেনে বের করে আলোকে এনেছে। এমন এক প্রদীপ এ আমার হাতে দিয়েছে যে জীবনের যেদিকেই তাকাই না কেন, সত্য আমার কাছে এমন ভাবে প্রতিভাত হয়ে পড়ে যে, তার মধ্যে কোন অস্পষ্টতা থাকে না। যে চাবি দিয়ে সব রকমের তালা খোলা যায় ইংরেজীতে তাকে বলে Master Key। কোরআন আমার কাছে Master Key। জীবন সমস্যার যে তালাতেই তা আমি লাগাই তা চট করে খুলে যায়। যে খোদা এ মহাগ্রন্থ দান করেছেন, তাঁর শোকরিয়া আদায়ের ভাষা আামার নেই।’
‘আন-নাদওয়া’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর একটি পত্রের জওয়াবে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মাওদূদী ৩১শে মার্চ, ১৯৪০, যে পত্র লিখেন, তার মধ্যে উপরের মূল্যবান কথাগুলো ছিল।
ইউপি মুসলিম লীগ ইসলামী শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্যে একটি কমিটি তৈরি করেছিলো, যার মধ্যে মাওলানা মওদূদীকেও শামিল করা হয়েছিলো। ‘নাদওয়াতুল উলামায়’ অনুষ্ঠিতব্য এই কমিটির বৈঠকে যোগদানের জন্যে ছাতারীর নওয়াব সাহেবের পক্ষ থেকে মাওলানাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বৈঠকে যোগদানের পূর্বে তিনি সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর নিকটে যে পত্রখানি লিখেন, তাও পাঠকগণের সাম ন পেশ করছি।
মুবারক পার্ক, পুঞ্জ রোড, লাহোর
২৪শে ডিসেম্বর, ১৯৪০
মুহতারম ও মুকাররম জনাব
আসসালামু আলায়কুম।
আপনার পত্র পেয়েছি। আজ ছাতারীর নওয়াব সাহেবের পত্র পেলাম। পত্রে তিনি ইসলামী শাসনতন্ত্রের খসড়া কমিটির বৈঠকে যোগদান করার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বৈঠক আপনাদের লক্ষ্মৌতেই হচ্চে। নওয়াব সাহেবদের এবং তাঁদের কমিটির জন্যে আমার অবশ্য তেমন আগ্রহ-উৎসাহ নেই। নিছক তাদের কমিটির বৈঠকে যোগদান করার ব্যাপারে যদি হতো, তাহলে এড়াবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এ বৈঠকে যোগদান করার মাধ্যমে ‘নাদওয়া’ এবং আপনাদের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্কে স্থাপনের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্যে লক্ষ্মৌ যাওয়ার মনস্থ করেছি। ইনশাআল্লাহ ৩রা জানুয়ারী লক্ষ্মৌ পৌঁছব। আমার আহার বাসস্থানের ব্যবস্থাপনা আপনার দায়িত্বে রইলো। এমন স্থানে থাকতে চাই, যেখানে সব ধরণের লোক আসতে পারে এবং স্বাধীনভাবে খোলাখুলি আলাপ-আলোচনা করতে পারে। আলীগড়ে গিয়ে ‘ওল্ড বয়েজ লজে’ থাকাটাই পছন্দ করেছিলাম। তার ফায়দাটা এই হয়েছিলো যে, সকল দল ও মতের লোক বিনা-দ্বিধায় আমার সাথে দেখা সাক্ষাত করে। লক্ষ্মৌতে এ ধরনের কোন একটি জায়গা আমি চাই। কট্টর কমিউনিস্ট এবং নাস্তিক আমার সাথে মিশে, যেমন মিশে মুমেনীন সালেহীন। তাদের সাথে কথা বলতে হলে এমন জায়গা ভালো, যখানে এমন সব লোক থাকবেন না, যাদের সামনে যেতে তারা ইতস্তত করে।
খাকসার
আবুল আ‘লা
মাওলানা মওদূদীর অবদান
আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর (রঃ) জীবনী তাঁর আদর্শ ও চিন্তাধারা, তাঁর মতবাদ ও কর্মপদ্ধতি, তাঁর আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্র ছিল পরিপূর্ণ ইসলামী এবং তা ছিল আয়নার মত স্বচ্ছ, নির্মল ও নিষ্কলুষ। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ মন নিয়ে যারা তাঁকে দূর ও নিকট থেকে দেখেছেন, তারাই মুগ্ধ হয়েছেন তাঁর গগনচুম্বী মানবতায় ও মহত্ত্বে, তাঁর সরলতা ও হৃদ্যতাপূর্ণ অমায়িক ব্যবহারে।
সাহিত্যিক, কবি, রাজনীতিবিদ, আইনবিদ, বিজ্ঞানী অথবা দার্শনিক তাঁর সাথে যে কোন বিষয়ে অনর্গল আলোচনা করে তাঁর পাণ্ডিত্যের কাছে নতি স্বীকার করেছেন। দূর থেকে যারা তাঁকে মনে করেছেন ‘সংকীর্ণমনা কাটমোল্লা’, আলাপ-আলোচনায় তাঁকে মনে হয়েচে বিশাল উদার সমুদ্রের মত, দেখেছেন তাঁর মধ্যে দূরে নিক্ষেপ করার নয়, কাছে টেনে নেয়ার আকুল আগ্রহ। এতো বড় জ্ঞানী-গুণীর বিনয়-নম্র ও নিরহস্কার ব্যবহার অনেকের কাছে এক বিরাট বিস্ময়।
মাওলানা কোন দারুল উলুম অথবা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত না হলেও এক জ্ঞানসমুদ্র। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না থাকলেও দক্ষতা ও প্রশংসার সাথে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন প্রখ্যাত মহাবিদ্যালয়ে। তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থাবলী পাঠ করে এবং তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করে নিঃসন্দেহে একথা বলা যায় যে, কোরআন, হাদীস, ফিকাহ-শাস্ত্র থেকে আরম্ভ করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন কিছুই তাঁর অজানা ছিল না। দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি ইতিহাস, তাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক উত্থান-পতনের ইতিবৃত্ত ছিল তাঁর নখদর্পণে। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারক, বাহক ও পূজারীদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে ইংরেজী, জার্মান প্রভৃতি বিজাতীয় ভাষায় নাটক উপন্যাস তাঁর পাঠ্য তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। তাই তিনিই নিঃসন্দেহে ছিলেন জ্ঞানের ইনসাইক্লোপেডিয়া।
আল্লাহ তায়ালা বিংশ শতাব্দীর যুগস্রষ্টা মনীসী আলেমে দীন ও মুজতাহিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর উপর তাঁর অসংখ্য রহমত বর্ষণ করুন, যিনি তাঁর গোটা জীবনে জীবনের প্রতি মুহূর্তকে দ্বীনে হক সমুন্নত করার লক্ষ্যে ওয়াকফ করে দিয়েছেন, তাঁর দেহ ও মনের সকল শক্তি শরীর, স্বাস্থ্য উপেক্ষা করে এ মহান কাজে নিয়োজিত করেছেন। আল্লাহ পাক তাঁকে এ মর্যাদায়ও ভূষিত করেছেন যে, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় দেখতে পেয়েছেন যে, তাঁর হৃদয়ের স্পন্দন গোটা ইসলামী দুনিয়ার হৃদয়ের স্পন্দনে পরিণত হয়েছে।
তাঁর গোটা জীবচন ছিল তিনটি অধ্যায়ে সমন্বিত-হিজরত, জিহাদ ও শাহাদাত। তিনি নিজেকে খোদার রাহে এমন নিবিষ্ট চিত্তে উৎসর্গিত করেন যে, বাতিল পক্ষের সকল জুলুম-নির্যাতন, কারাদণ্ড এমন কি ফাঁসীর মঞ্চও হাসিমুখে বরণ করেন। তাই তিনি ছিলেন যিন্দাহ শহীদ-মর্দে মুজাহিদ।
তিনি মুসলিম বিশ্বের জন্যে এমন কিছু অতুলনীয় অবদান রেখে হেছেন-যা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর কয়েকটির উল্লেখ দৃষ্টান্তস্বরূপ করতে চাই।
এক.মুসলমানদের পতন যুগে এত সব ফেতনা মাখা চাড়া দিয়ে উঠেছিলো যার ফলে মুসলমান সত্যিকার ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়েছিলো। তার একটি দ্বীন ও দুনিয়ার পৃথককরণ। তার ফলে একজন মুসলমান, এমনকি একজন আলেমের মুখেও এ বিদ্রূপবাণী শুনা যেত-শাসন ক্ষমতা? পার্লামেন্ট? এতো সব দুনিয়াদারী ব্যাপার। নামায পড়, রোযা রাখ, পারলে হজ্জ কর, যাকাত দাও, কালামে পাক তেলাওয়াত কর, তাসবীহ-তাহলীল কর- এইতো ইসলাম। এ পতন যুগে সর্বপ্রথম মাওলানা মওদূদীর মুখে এ শ্লোগান ধ্বনিত হয়- ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ভুলে যাওয়া সবক তিনি শিখিয়ে দেন এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে আজ এ শ্লোগান ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ইসলামের মৌল শিক্ষাই এই যে, জীবনের এমন কোন দিক ও বিভাগ নেই, যা ইসলামের আওতার বাইরে।
দুই.ইসলামের বিপক্ষে যতো ফেতনা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার একটি তালিকা তৈরি করলে দেখা যাবে যে, এমন কোন ফেতনা নেই, যার সফল মুকাবেলা তিনি করেননি। জড়বাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা-সৱংস্কৃতির মনভুলানো জৌলুস ঔজ্জ্বল্যে মুসলিম যুব সমাজ খোদাদ্রোহিতার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল।
মাওলানা তাঁর প্রথম কাজ এটাই করেন যে, কিভাবে মুসলিম যুব সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পাশ্চাত্য সভ্যতার যাদু থেকে রক্ষা করা যায়। তিনি তাঁর ‘তানকীহাত’ গ্রন্থে পাশ্চাত্য সভ্যতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তার অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করেন। তাঁর ‘তানকীহাত’ ও ‘তাফহীমাত’ গ্রন্থ দু’টি লেখার ধারন যে কত শামীল ও যাদুমন্ত্রের ন্যায় প্রভাবশালী তা দেখার বস্তু। যে সব মারত্মক রোগে ইউরোপের বস্তুবাদী সভ্যতা আক্রান্ত ছিল মাওলানার লেখনীর অস্ত্র তার অস্ত্রোপচার করে। তিনি গবেষণালব্ধ ও বিজ্ঞানসূলভ ভাবনার দ্বারা ওসব মতবাদের উপরে মরণ-আঘাত হানেন, যা বস্তুবাদ, নাস্তিকতা ও সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদ ছিল। এ আঘাতে ইউরোপবাসী বিব্রত হয়ে পড়ে এবং মুসলিম যুব সমাজের মধ্যে চরম উৎসাহ-উদ্যম ও প্রেরণা সৃষ্টি করে। মাওলানার সাহিত্য যুব সমাজের তৃষ্ণা নিবারণ করে। তারা পাগলের মতো নৈতিকতা ও ইসলামের দিকে ছুটে চলে। ইউরোপ থেকে ধর্মহীনতা ও নাস্তিক্যের যে প্লাবন এ উপমহাদেশে এসেছিলো, আল্লাহ তাআলা তার সামনে বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা মাওলানার পবিত্র হস্তেই করেন। এ কাজ আর কারো দ্বারা হয়নি।
তিন.মাওলানা মওদূদীর সবচেয়ে বড় অবদান এই যে, তিনি মুসলমানদের মধ্যে কুরআন উপলব্ধি করার প্রেরণা সৃষ্টি করেছেন। যে কুরআন আল্লাহ তায়ালার হেদায়েতের সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও সংরক্ষিত উৎস আমরা তা ভুলে বসেছিলাম। কতিপয় আলেম কুরআন থেকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পথ-নির্দেশনা লাভ করার পরিবর্তে তাবিজ-তুমার ও ঝাঁড়-ফুঁক পর্যন্ত সীমিত করে রাখেন। অপরদিকে প্রাচ্যবিদগণ কুরআনের প্রতি এন এমন মারাত্মক আক্রমণ চালায় যে, আধুনিক শিক্ষিক সমাজ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং কেউ কেউ কুরআনের কোন কোন স্থানের অর্থ একেবারে পরিবর্তন করে ফেলে। এমনও দেখা গেছে যে, কোন কোন তাফসীরকার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন সব বিতর্কের অবতারণা করেন যে, তার সাথে না জীবনের আর না কুরআনের কোন সম্পর্ক আছে।
অনেক অনুবাদ এমন জটিলতাপূর্ণ এবং পূর্বাপর বক্তব্য থেকে এমন বিচ্ছিন্ন যে, আল্লাহ তায়ালার মূল বক্তব্য বুঝতে পারা যায় না।
মাওলানা মওদূদী এ ক্ষেত্রে এমন চমৎকার কাজ করছেন যে, পাঠকের অন্তর থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে তাঁর জন্যে দোয়া বেরিয়ে আসে। যুব সমাজের প্রতি কুরআন পাকের আগ্রহ বেড়ে চলেছে এবং আল্লাহর কালাম অধ্যয়নে এক স্বর্গীয় স্বাদ অনুভব করতে শুরু করেছে। তাঁর তরজমার ভাষা জনসাধারণের জন্যে এতোটা বোধগম্য যে, এর চেয়ে সহজতর বর্ণনাভঙ্গি সম্ভব নয়।
ভাষার শক্তি ও প্রভাব ছাড়াও তাঁর তাফসীর তাফহীমুল কুরআনে এ বিষয়ের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা যেন সুসামঞ্জস্যভাবে পাঠকের সামনে থাকে। কুরআন অধ্যয়নে যদি সে জীবন ব্যবস্থার কাঠামো পাওয়া না যায়, যার জন্যে এ কিতাব নাযিল হয়েছে এবং খোদার নবী পাঠানো হয়েছে, তাহলে সে উদ্দেশ্যই পূর্ণ হয় না। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহঃ) সে ব্যবস্থার পূর্ণ চিত্র এবং পরিপূর্ণ প্রাসাদ সংগ্রহ করে দিয়েছেন এবং মানবতার সে পৃষ্ঠপোষকের (হুযুর সাঃ) গোটা জীবনও পরিস্ফুট হয়েছে, যিনি তেইশ বছরে ডিজাইন মুতাবেক প্রাসাদ নির্মাণ সম্পন্ন করেন।
চার.আর এটি মূল্যবান অবদান ‘সীরাতে সরওয়ারে আলম’ (নবী চরিত)। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন কুরআনেরই বাস্তব চিত্র এবং চারিত্রিক মহত্ত্ব ও গুণাবলীর শীর্ষস্থানীয়। তেইশ বছরে ধারাবাহিকভাবে নাযিলকৃত কুরআনের সাথে হুবহু মিল রেখে এখন নিখুঁত নবী চরিত প্রণয়ন বিরল। নবী চরিতকে উপেক্ষা করে যেমন কুরআন উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, তেমনি কুরআনের সাহায্য ব্যতীত নবীর সঠিক পরিচয় জানাও সম্ভব নয়। সীরাতে সরওয়ারে আলম গ্রন্থে এ উভয় বিষয়ের উপর সুন্দর আলোকপাত করা হয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যে নিঃসন্দেহে বিশ্বনবী এবং তিনি যে সর্বকালের ও সর্বযুগের মানবজাতির একমাত্র পথ প্রদর্শক ও কল্যাণকামী নেতা এ সীরাত গ্রন্থে তার হৃদয়গ্রাহী যুক্তি-প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রন্থকার স্বয়ং নবীপ্রেমেও ছিলেন পাগল এবং গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে নবীপ্রেমের ঝলক দেখা যায়। এ নবীপ্রেম তাঁকে নবীর অনুকরণেই আপন জীবন গড়ার প্রেরণা যোগায়। মাওলানা মওদূদীর অবদান এতো বেশি যে, তার উপরে একটি গ্রন্থ প্রণীত হতে পারে। সে দিকে না গিয়ে এখন তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্যাবলীর কিছু উল্লেখ করতে চাই।
পাঁচ.অনেকে মাওলানার প্রতি এ অভিযোগ করেন যে, তিনি তাসাওউক বিরোধী এবং পীর মাখায়েখদের নিন্দা করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাসাওউফ কোরআন, হাদীস, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনের ব্যবহৃত কোন পরিভাষা নয়। কিন্তু তাসাওউফ বলতে যদি কুরআনের তাযকিয়া ও হাদীসের ইহসান বুঝানো হয়ে থাকে, তাহলে আলবৎ মাওলানা মওদূদী শুধু যে তাসাওউফের সমর্থকই ছিলেন না, বরঞ্চ অতি উচ্চমানের কামেল সূফী ছিলেন। তাঁর গোটা জীবন তার প্রকৃত প্রমাণ। যার দিলে ভয়, ভীতি, ভালবাসা শুধু আল্লাহর জন্যে, তাওয়াক্কাল একমাত্র আল্লাহর উপরে, তায়াল্লক একমাত্র আল্লাহর সাথে, যার দিল আল্লাহর ইয়াদে পরিপূর্ণ এবং যেখানে গায়রুল্লাহর কোন স্থান নেই, তার চেয়ে বড় সূফী আর কে হতে পারে? এ সবের মূর্ত প্রতীকই মাওলানা মওদূদী। তাঁর অভিযোগকারীগণ নন।
ছয়.মাওলানা হরতামেশা নিজেকে আল্লাহর ভয়ে নতশির এক নগণ্য বান্দাহ মনে করতেন। কেউ তাঁর প্রশংসা করুক এটা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। সিকিউলার দলের নেতৃবৃন্দ চান যে, তাদের অনুসারীগণ তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হোক, যিন্দাবাদ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করুক, গলায় ফুলের মালা দিয়ে অথবা বিভিন্ন উপঢৌকনাদি দিয়ে সংবর্ধনা জানাক। এতে তারা বড় আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। কিন্তু মাওলানার স্বভাব প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ এর বিপরীত। মাওলানার মৃত্যুদণ্ড সশ্রম কারাদণ্ডে পরিবর্তিত করা হয়। কিন্তু ২৫ মাস পর তিনি যুক্তি লাভ করেন। তারপর তর্জুমানুল কোরআনের সম্পাদনা ভার পুনরায় গ্রহণ করেন। তাঁর সম্পাদকীয় প্রবন্ধে তিনি সে সব গুণগ্রাহীর শুকরিয়া আদায় করেন, যারা তাঁর অপ্রত্যাশিত মুক্তিতে আনন্দ প্রকাশ করেন। এ প্রবন্ধের এক স্থানে তিনি বলেন, সেই সাথে আমি এ আবেদন না করে পারছি না যে, বন্ধুদের আনন্দ প্রকাশ এবং মহব্বতের আবেগ ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে এমন রীতি-পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, যাতে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়নি। তাদের নিষেধ করাও আমার জন্যে মুশকিল। কারণ আধ্যাত্মিকতা ও বিনয়-নম্রতার প্রদর্শনী আমি পছন্দ করি না এবং তা মেনে নেয়াও কটিন। কারণ আমি মনে করি এসব বিষয় ফেতনা সৃষ্টি করতে পারে। কতোই না ভাল হতো যদি আমার বন্ধুগণ আমার জন্যে তাদের আবেগ প্রকাশের ব্যাপারে ভারসাম্যের সীমা থেকে কম করাই যথেষ্ট মনে করতেন। (তর্জুমানুল কুরআন, খণ্ড ৪, সংখ্যা ৪)
আমার এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে রাখি। ১৯৫৮ সালে মাওলানা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ভ্রমণে আসেন। এর এক পর্যায়ে তিনি দিনাজপুর থেকে বগুড়া আসবেন। আমি সাথে ছিলাম। দিনাজপুর থেকে বগুড়া আসার রেলপথ পার্বতিপুর-জয়পুরহাট-শান্তাহার হয়ে। বললাম, মাওলানা আমার বাড়ি জয়পুরহাটের উপর দিয়েই তো বগুড়া যাব। জয়পুরহাট এবং শান্তাহারের বহু লোক আপনাকে সংবর্ধনা জানাতে আসবে।
আমার কথায় মাওলানার চেহারায় কিছুটা মলিনতার ছাপ দেখতে পেলাম। তিনি স্পষ্ট করে বললেন, ভাই, আমি তো এটা একেবারে পছন্দ করি না যে, লোক আমাকে দেখে যিন্দাবাদ শ্লোগান দিক, আমার গলায় ফুলের মালা দিক, আমি এ আপদ থেকে বাঁচতে চাই। আমি শান্তাহার হয়ে বহুড়া কিছুতেই যাব না। অন্য পথে চলুন।
মাওলানা কিছুতেই এ পথে যেতে রাজি হলেন না। অগত্যা রংপুর, কাউনিয়া, গাইবান্ধা হয়ে বগুড়া যেতে হলো।
জয়পুরহাট ও শান্তাহারে বহু লোক এসে মাওলানাকে না পেয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে যায়। বহুড়া স্টেশনেও লোক মাওলানাকে নিতে এসে না পেয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সকলের অজ্ঞাতে আমরা বগুড়া নেমে পড়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাই।
সাত.মাওলানা ছিলেন ‘যিন্দাহ শহীদ’। তাই মৃত্যুকেও তাঁর খোড়াই পরোয়া। তার জ্বলন্ত প্রমাণ বহুবার পাওয়া গেছে। তেষট্টি সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী সম্মেলনে মাওলানার ভাষণ দানকালে জনৈক ভাড়াটিয়া গুণ্ডা দশ-বারো হাত দূর থেকে পরপর তিনবার মাওলানাকে লক্ষ্য করে পিস্তলের গুলি করে। মাওলানা মৃত্যুকে ভয় করেন না। মৃত্যু যেন ভয় করে মাওলানার কাছেও এলো না। আল্লাহর অসীম কুদরতের খেলা, তাঁর প্রিয় বান্দার রক্ষার জন্যে তিন তিন বার পিস্তলের গুলিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিল। চারদিক থেকে লোকের চিৎকার, মাওলানা, বসে পড়ুন, বসে পড়ুন।
মাওলানা নির্ভীক ও শান্ত কণ্ঠে জবাব দেন, আমি বসে পড়লে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?
মৃত্যুর ভয় না করে সিরাতে মুস্তাকিমের উপর দাঁড়িয়ে থাকার ইঙ্গিতই করলেন মাওলানা।
এটাকে মাওলানার কেরামত বলি না, বরঞ্চ আল্লাহ তায়ালার মো’জেযা, যা বিস্ময় সৃষ্টি করলো সকলের মনে এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত গ্রন্থকারের মনেও।
কোরআন-হাদীসের জটিল তত্ত্ব ও তথ্য যখন তিনি সহজ, সরল ও খোদা প্রদত্ত এক হৃদয়গ্রাহ প্রকাশ ভঙ্গিমায় বর্ণনা করতেন, তখন তাঁকে মনে হতো আধুনিক মুসলিম বিশ্বের আলেমকুল শিরোমণি, ইসলামের নির্ভরযোগ্য মুখপাত্র এবং ইসলামী জ্ঞান-গবেষণার স্বাক্ষর বহন করে। তাই মুসলিম বিশ্ব তাঁকে ডাকল আল-উস্তাদ আল-মুরশিদ বলে, রাবিতায়ে আলমে ইসলামী তাঁর খেতাব দিল আল-ইমাম মওদূদী বলে।
বর্তমানকালে মুসলিম জাতি ইতিহাসে এক অতীব সংকট সংকট সংকুল অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে। যতো আকীদাহ, বিশ্বাস ও ক্রিয়াকর্ম, যতো মতবাদ ও ইজম ইসলামের বিপরীত, তাই মুসলিম সমাজ জীবনে চালু করার এক ব্যাপক প্রচেষ্টা চলছে প্রায় সর্বত্র, যার পেছনে রয়েছে কতিপয় রাষ্ট্রীয় শক্তি। সোশ্যালিজম-কমিউনিজম, পুঁজিবাদ, কাদিয়ানী ও পরতেজী আন্দোলন, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ, প্রভৃতি ইজম ও মতবাদগুলো ইসলামের মূল প্রাণশক্তিকে গ্রাস করে ফেলছিল। মাওলানা তাঁর শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে এ সব মতবাদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছেন। আরব জাতীয়তাবাদেরও সর্বনাশা পরিণামের কথা মাওলানা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে এর বিরুদ্ধেও অসন্তোষ-বিক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
কখনো কোন বার লাইব্রেরীতে আইনবিদ সমাবেশে ভাষণ দানকালে তাঁকে মনে হয়েছে একজন সবজান্তা আইনবিদ। এ.কে.ব্রোহীর মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির মনে হয়েছে তাঁর কাছে আইনের ছাত্র। একটি পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা, তার আইন-কানুন তিনি নিখুঁতভাবে রচনা করেছেন। এ বিষয়ে প্রতিনিট আধুনিক জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন দক্ষতার সাথে এবং নিরসন করেছেন সকল সন্দেহ-সংশয়।
রাজনৈতিক প্রতিভা ও দূরদর্শিতা তাঁর অসাধারণ। তাই তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা থেকে সুদূর ভবিষ্যতের যে চিত্র এঁকে দিতেন, তা বাস্তবে পরিণত হতে দেখা গেছে।
মুসলিম মিল্লাতের প্রতি তাঁর বিরাট অবদান এই যে, মুসলমানদের পতন যুগে পাশ্চাত্যের খোদাহীন মতবাদ ও চিন্তাধারা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ যেভাবে মুসলমানদের মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে তাদেরকে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক প্রভুদের মানসিক গোলামে পরিণত করেছিল, মাওলানা তাঁর শক্তিশালী লেখনীর সাহায্যে পাশ্চাত্য মতবাদ ও চিন্তাধারার অন্তঃসারশূন্যতা ও ধ্বংসকারিতা প্রমাণ করে তার প্রবল প্লাবন থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করেন। শুধু তাই নয়, ইসলামকে একমাত্র গতিশীল, প্রাণবন্ত ও মানব জাতির জন্যে মঙ্গলকর পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে সুস্পষ্ট করে জগতের সামনে তুলে ধরেন। জগতের কোটি কোটি শিক্ষিত যুবক ও সুধী ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে উপলব্ধি করে তার আলোকে নিজেদের মন-মস্তিষ্ক ও চরিত্র গড়ে তুলছে। আজ সমগ্র বিশ্বে ইসলামের যে গুঞ্জরণ শোনা যাচ্ছে, তা মাওলানার সাহিত্য ও বিশ্বজনীন ইসলামী দাওয়াতেরই ফসল।
মাওলানা একজন বাস্তবধর্মী মনীষী। মানব জাতির সার্বিক কল্যাণ, উন্নতি ও প্রগতির জন্যে তাঁর আহ্বান ছিল বিশ্বজনীন। এ বিষয়ে তাঁর কর্মসূচী ছিল অতি সুস্পষ্ট, স্বাভাবিক ও মানবতাসুলভ। নারী-পুরুষের মধ্যে সুষ্ঠু-সুন্দর, সুসামঞ্জস্য ও সুখকর সম্পর্ক কি হতে পারে, কি তার পদ্ধতির-জীব বিজ্ঞান, যৌন বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও সমাজ বিজ্ঞান প্রভৃতির বিশ্লেষণ দ্বারা তা তিনি চিন্তাশীলদের গোচরীভূত করেছেন। মোটকথা, মাওলানা মওদূদী ছিলেন এক অসাধারণ মনীষী, মুসলিম বিশ্বের তথা মানব সভ্যতার জন্যে একে বিশেষ অবদান।
তিনি ছিলেন এক অনুপম চরিত্রের অধিকারী। তাঁকে কোনদিন কারো প্রতি রাগ করতে অথবা কোন প্রকার কটূভাষা প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি। পরিবারস্থ লোকজন, ছেলে-মেয়ে, চাকর-বাকর, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব কারো প্রতি কোন মন্দ ব্যবহারে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েননি, মনে কষ্টদায়ক টু শব্দটিও করেননি। এ ছিল তাঁর স্নেহশীল পিতার শৈশবকালীন কঠোর শিক্ষা, যা তিনি সারা জীবন পালন করে চলেছেন। তবে ত্রুটি সংশোধনের জন্যে রসিকতার (Humour) ভেতর দিয়ে সমালোচনা করেছেন।
চরম বিপদে মুহূর্তেও তাঁর মুখমণ্ডলে কোন প্রতিক্রিয়ার ছাপ দেখা যায়নি। স্বভাবিক দুঃখ দৈন্যে, পুলিশের আবেষ্টনীতে, জেলখানার সস্কীর্ণ প্রকোষ্ঠে অথবা মৃত্যুদণ্ড শ্রবণে তাঁর স্বভাবসুলভ মিষ্টিমধুর মৃদুহাসি বিলীন হয়ে যায়নি। তাঁর যেন ‘থোড়াই পরোয়া’ এ সবের জন্যে।
যেসব রাজনৈতিক দল ও তথাকথিত বুযুর্গানে কওমের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি অবিরল গালি বর্ষণ হয়েছে, অমুলক অপবাদ ও ফতোয়াবাজি হয়েছে, তাদের প্রতি তিনি কোন মন্দ ভাষা প্রয়োগ করেননি। বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন তাদেরকে চিরদিনের জন্যে। মন তাঁর ছিল স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন উদার ও সকল প্রকার কলুষ-কালিমার ঊর্ধ্বে। তথাপি তাদের অপবাদ-গালাগালি বন্ধ হয়নি। এ বিষয়ে বারবার তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেছেনঃ
“আমি বুঝতে পারছি তারা আমার নেকীর পাল্লা ভারী করার কাজে লেগে আছে। তার জন্যে তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।”
পরিচ্ছন্ন মনের মত তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদও পরিচ্ছন্ন, আধুনিক রুচিসম্মত ও ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির বাহক। ঘরদোর তকতকে ঝকঝকে নোংরামির লেশহীন এবং একটা অনাবিল শালীনতাপূর্ণ পরিবেশের অধীন। তাঁর বই-পুস্তক, কাগজপত্র, লেখার সাজ-সরঞ্জাম যথাস্থানে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে রক্ষিত যেন নিপূণ শিল্পীর হাতে সাজানো। তাঁর খানাপিনা সহজ-সরল অথচ দিল্পীর অভিজাত সম্প্রদায়ের রুচিমাফিক।
সদাহাস্য নূরানী চেহারা বিশিষ্ট সদালাপী কারো উঠতে ইচ্ছা হতো না। এটা তাঁর ব্যক্তিত্বের এক বিরাট আকর্ষণ, চরিত্রের এক মধুর বৈশিষ্ট্য।
এক স্বর্গীয় মধুর আনন্দ লাভ করা যেতো তাঁর পেছনে নামায পড়ে। চাপা মধুর স্বরে ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে যখন তিনি নামাযের ক্বিরাত পড়তেন, তখন একদিকে যেমন কানে মধু বর্ষণ হতে থাকতো, অপরদিকে নামাযের প্রতি পরিপূর্ণ একাগ্রতা মনের মধ্যে সঞ্চার করে দিত আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যের এক অভুতপূর্ব অনুভূতি।
মাওলানার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁর আদর্শ ও চিন্তাধারার বাস্তব প্রতিফলন তাঁর সারাজীবন। শুধু নিজেকেই তিনি এ আদর্শের ছাঁচে তৈরী করেননি, বরং সারাবিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী অসংখ্য পথহারা মানব সন্তানের জীবনের কায়ার পরিবর্তন হয়েছে।
মাওলানা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক। তাঁর খানাপিনা, পড়াশুনা, লোকের সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং নিদ্রার সময় নির্দিষ্ট করা থাকত। তার ব্যতিক্রম সহজে হতে দিতেন না। অবশ্য একমাত্র সফরে বেরুলে কোথাও কোথাও এর ব্যতিক্রম হয়ে পড়তো।
মাওলানা বলেন, অতীতে তিনি তাঁর শরীরের উপর ভয়ানক জুলুম করেছেন। আহার-নিদ্রার অবসর থাকত না। বহু বছর ধরে তিনি এশার নামাযের পর থেকে ফযর পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তার ফলেই তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। তিনি বলেন, পরবর্তীকালে তাঁকে বাধ্য হয়ে আহার-নিদ্রা নিয়ন্ত্রিত ও নিয়মানুবর্তী করতে হয়।
একবার পূর্ব-পাকিস্তানের একস্থানে বৈকালিক চায়ের সাথে বহু কিছু খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। মাওলানা বলেন, সকালে চায়ের সাথে তিনি টোস্ট, আন্ডা ফ্রাই এবং কিছু ফলমূল খান। বিকেলে শুধু এক পেয়ালা চা।
মাওলানার অভ্যাস ছিল এই যে, আসরের নামাযের পরে বাড়ির বাইরে ছোট্ট বাগানটিতে তিনি গিয়ে বসতে। দেশ-বিদেশের সাক্ষাৎকারীগণ সেখানে জমায়েত হতো, বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করতো, মাওলানা তার জবাব দিতেন। বিকেল বেলার এ আসরে আসত আরব দেশের লোক, জাপান ও নরওয়ের লোক, মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার লোক, তুরস্ক এবং ইউরোপ-আমেরিকার লোক। এ ছিল যেন একটা আন্তর্জাতিক মধুচক্র। জ্ঞানপিপাসু লোকেরা ছুটে আসত জ্ঞানের সন্ধানে। মাওলানা সবার প্রশ্নের জবাব দিতেন। এভাবে তিনি সবার জ্ঞান পিপাসা মেটাতেন।
মাওলানা আলাপ-আলোচনায় বড় রসিকতা করতেন। তিনি একবার রংপুর জেলার সৈয়দপুর শহরে আসেন। বিকেল বেলা শহরের ব্যবসায়ী ও গন্যমান্য লোক মাওলানার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। আলাপ প্রসঙ্গে জনৈক ভদ্রলোককে মাওলানার জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কি করেন।
ভদ্রলোক- আমি চামড়ার ব্যবসা করে।
মাওলানা- কিসের চামড়া, মুরগীর না কি?
ভদ্রলোক একটুখানি অপ্রস্তুত হয়ে তড়িঘড়ি বলে ফেললেন- জি না হুজুর, গরু-ছাগলের চামড়া।
মাওলানা- ও তাই নাকি? ঢাকা থেকে শুরু করে যেখানেই গিয়েছি সব জায়গায় খেয়েছি মুরগী আর মুরগী। কোথাও খাসীর গোশতের সাথে দেখা হয়নি। তাই মনে করেছিলাম এ দেশে বুঝি মুরগীর চাড়মারও ব্যবসা চলে।
বুদ্ধিমান মেজবানের আর বুঝতে বাকী রইল না যে, মাওলানাকে খাসীর গোশত খাওয়াতে হবে।
ঊনিশ শ’ তেষট্টির মাঝামাঝি একবার মাওলানা রাওয়ালপিন্ডি যান। আমরা চাকলালা বিমান বন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যাই।
বিপুল সম্বর্ধনার পর গাড়িতে উঠবার আগে ডিব্বা থেকে পান বের করে মাওলানা মুখে পুরলেন। আমি একজন পানখোর, এটা মাওলানার জানা ছিল। তাই তিনি আমাকেও একটা দিলেন। আমি জর্দার জন্যে হাত বাড়ালে তিনি রসিকতা করে বললেন
-ওহো আপতো পানকো হালাল কর ছোড়া হ্যায়।
বললাম- মাওলানা! পান তো হর ওয়াক্ত হালাল হ্যায়।
মাওলানা- বেগায়র জর্দা পান কব হালাল হোতা?
মাওলানা বিদায় নিয়েছেন দুনিয়া থেকে। তিনি পরিপূর্ণ করে গেছেন তাঁর কাজ, পূর্ণ হয়েছে তাঁর জীবনের সাধনা। তাঁর সাধনা, তাঁর বিশ্বজনীন দাওয়াত, রেখে যাওয়া তাঁর জ্ঞানের ফসল তাঁকে অমর করে রাখবে চিরদিনের জন্যে। তিনি বলে গেছেন রেখে গেছেন তাঁর অমূল্য সাহিত্য ভাণ্ডার এবং অগণিত রূহানী আওলাদ-যারা ছড়িয়ে আছেন সারা বিশ্বব্যাপী। তাঁর ফেলে যাওয়া কাজ চলতে থাকবে যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে।