খোদাহীন শিক্ষাব্যবস্থা
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা অনুসারে যে সব বিষয় শিক্ষাদান করা হয়, তাতে ইসলামের কোন চিহ্ন নেই। আর তা থাকতেও পারে না। ইউরোপে এসব বিষয় যতখানি বিকাশ লাভ করেছে, তাতে খোদাদ্রোহী ব্যক্তিগণ নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ইউরোপে তখন নামমাত্র যে ধর্মপন্থীরা ছিল, চিন্তা ও সাধনার ময়দান থেকে তাদেরকে বহুদিন পূর্বেই বেদখল করা হয়েছিল। এজন্যেই দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে এ ধরনের লোক নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল। তারা নাস্তিক না হলেও নিজেদের বাস্তব জীবনে খোদার আনুগত্য স্বীকারের কোন প্রয়োজন অনুভব করত না। ইংরেজরা যে সব শাস্ত্র ও পুস্তকাদি আমদানি করে এ দেশে চালু করেছিল, আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত তাই পড়ানো হচ্ছে। যারা এই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা অনুসারে লেখাপড়া করছে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মস্তিষ্ক অজ্ঞাতসারে দ্বীন-ইসলাম, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও রীতিনীতি থেকে ক্রমশ দূরে চলে গেছে। এ ব্যাপারে তাদের ইচ্ছা-আগ্রহ কিংবা চেষ্টা-চরিত্রের আদৌ কোন দখল নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি শিক্ষা-জীবনের প্রথম দিন থেকে শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত যত শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছে, দুনিয়ার যত বিদ্যাই সে অর্জন করেছে, তার আগাগোড়া কোথাও যদি ধর্মীয় বা খোদায়ী দৃষ্টিভঙ্গি না থাকে, তবে তার মনে খোদার প্রতি বিশ্বাস জন্মাবে কি করে? তার পাঠ্য পুস্তকের কোথাও যদি খোদার কোন উল্লেখ আদৌ না থাকে, সে ইতিহাস পড়বে অথচ তাতে মানব-জীবনের ভাগ্য নির্ধারক সেই নিজেই, অন্য কেউ নয়, যে দর্শন সে অধ্যয়ন করবে তাতে বিশ্বাসপ্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে বিশ্বজগতের যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁর কোনই প্রয়োজন নেই,র বিজ্ঞান অধ্যয়ন করবে, গোটা বিশ্বের কোথাও সুকৌশলী সৃষ্টিকর্তা এবং শ্রেষ্ঠতম পরিচালক ও ব্যবস্থাপকের কোন অস্তিত্বের উল্লেখ তাতে নেই। আইন-কানুন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান-অর্থনীতি প্রভৃতি যত শাস্ত্রই যে অধ্যয়ন করুক না কেন, কোথাও এ কতার উল্লেখ নেই যে, মানব জাতির সৃষ্টিকর্তা তাদের জীবন যাপনের জন্যে কোন পন্থা নির্দেশ করেছেন কি না। বরং সকল শাস্ত্রের মূলনীতিই এই যে, মানুষ নিজেই তার জীবন পদ্ধতি নির্ধারণের অধিকারী, অন্য কারো তেমন কোন অধিকার বা ক্ষমতা নেই।
এ ধরনের শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকের নিকট এ কথা বলার কোন আবশ্যক নেই যে, তুমি খোদাকে অস্বীকার কর। সে নিজের অজ্ঞাতসারেই যে খোদা সম্পর্ক সম্পূর্ণ বেপরোয়া এবং উদাসীন হবে তাতে আর বাধা কোথায়?
নীতিবর্জিত শিক্ষা
ধর্ম ও ইসলামের সাথে এ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কোন সম্পর্ক তো নেই-ই, বরং ভাগ্যের বিড়ম্বনা এই যে, এ আমাদের তরুণদের মধ্যে মৌলিক নীতিবোধটুকুও জাগ্রত করে না। অথচ এ কথা সকলেই জানেন যে, নীতিভ্রষ্ট চরিত্রহীন কোন জাতির পক্ষে উন্নতি লাভ করা তো দূরের কথা, এ দুনিয়ার বুকে জাতি হিসাবে টিকে থাকাই একবারে অসম্ভব। এ কারণেই আধুনিক পন্থায় শিক্ষালাভের পরে যারা কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন, তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য জাতিগুলোর দোষত্রটি বা বদ-অভ্যাস বলতে যা কিছু আছে তা সবই পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য জাতিসমূহের গুণাবলীর লেশমাত্রও দেখা যায় না। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, তিতিক্ষা, সাহস, সংযম এবং চরিত্রের দৃঢ়তা ও নিজের সত্তা ব্যতীত অন্য কারো আনুগত্য, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি কোন কিছুই নেই। এরা যেন পরগাছা, শূন্যলতা। এদের আচার-ব্যবহার দেখে মনে হয় না যে, জাতীয় চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য বলতে এদের নিকটে কিছু আছে। বিশেষ সম্মানজনক পদে সমাসীন হওয়ার পরেও এরা স্বচ্ছন্দে অত্যন্ত জঘন্য ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা এবং অপরাধ করতে পশ্চাদপদ হয় না। এদের মধ্যে ঘুষখোর, স্বজনপরায়ণ, অন্যায়-অনুরোধকারী, কালোবাজারী, চোরাকারবারী, বিচার ও ন্যায়-নীতির কণ্ঠরোধকারী, জনসাধারণের ন্যায্য অধিকার হরণকারী, সামান্য ব্যক্তিগত স্বার্থের বিনিময়ে গোটা জাতির ভাগ্য বিনাশকারী এবং কাজে ফাঁকি দেয়ার মতো লোক এক আধজন নয় বরং হাজার হাজার মিলবে, সমাজের সর্বত্র এরা অবাধে বিচরণ করছে। ইংরেজদের চলে যাওয়ার পরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব এদের উ্পরে ন্যস্ত রয়েছে। ফলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এ চরিত্রহীনদের পাল্লায় পড়ে দেশের যে দুর্গতি হয়েছে তা সকলেই অনুভব করছে। বর্তমানে আমাদের যে সব তরুণ তথাকথিত এ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসারে বিদ্যা অর্জন করছে, তাদের চরিত্র ও আচার-আচরণ প্রত্যক্ষ করতে হলে যে কোন সময়ে ছাত্রাবাস, প্রমোদকেন্দ্র ও জাতীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে হাট-বাজারে গেলেই দেখা যাবে।
পূর্বতন শিক্ষাব্যবস্থার সাথে দীনিয়াত সংযোজন
বর্তমানে যারা আমাদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যাদের মুঠোর মধ্যে রয়েছে, যারা মাঝে মধ্যে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের খোশখবর শুনিয়ে থাকেন, তারাও যেন ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে উদ্যত হয়েছেন বলে মনে হয়। ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থাই পূর্ববৎ চালু থাকবে এবং তাতে শুধু দীনিয়াতের মাত্রাটা একটু বাড়িয়ে দিলেই চলবে। প্রকৃতপক্ষে তাদের সামনে যে শিক্ষা পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে এর বেশী তেমন কিছু নেই। এ কারণেই কয়েক বছর পূর্বেই আমি যে কথা বলেছিলাম এখনও তাই বলছি। কারণ আমার বিবেচনায় পরস্পর বিরোধী ও বিপরীতমুখী দু’টি বস্তুর সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের ন্যায় মারাত্মক ভুল আর দ্বিতীয়টি নেই। তাও আবার পরস্পর সংঘর্ষশীল দু’টি ধারা, যার একটি অপরটিকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে সাব্যস্ত করে। এ ধরনের মিক্সচার ব্যবহারে মানসিক বিশৃঙ্খলা ছাড়া অন্য কিছু সৃষ্টি হতে পারে না।
মনে করুন, এ সংমিশ্রণের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ [অবশ্য বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীনিয়াত শতকরা পঞ্চাশ ভাগ তো দূরের কথা, কোথাও শূন্যের কোঠায় এবং কোথাও থাকলে ছিটেফোঁটা আছে। উপরন্তু রয়েছে সহশিক্ষা, ছাত্র-ছাত্রীর অবাধ মেলামেশা, নৃত্যগীত-গ্রন্থকার।] দ্বীনী শাস্ত্রই রাখলেন। আর বাকী অর্ধেক ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার বুনিয়াদের উপরেই রাখলেন। ফলে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর মানসিক পরিবেশ একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে বাধ্য।
গোটা পরিবেশ যদি পূববৎ ফিরিঙ্গীপনায় আচ্ছন্ন থাকে, যেমন ইংরেজ আমলে ছিল এবং আমাদের রাষ্ট্রও যদি সাবেক নীতি অনুসারে পরিচালিত হয়, যেমনটি ইংরেজ আমলে হয়েছিল, তাহলে এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে তিন শ্রেণীর লোক আমাদের দেশে পয়দা হবে।
এক শ্রেণীর লোক- যারা দীনিয়াত পাঠের পরেও খোদাদ্রোহী সাব্যস্ত হবে। কারণ তাদের পাঠ্য তালিকার মধ্যে দ্বীনের খেলাফ অনেক বিষয়বস্তুও যে শামিল রয়েছে। তার উপর আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোটা পরিবেশ এ খোদাদ্রোহিতার পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকবে। অধিকন্তু রাষ্ট্রীয় পরিবেশও তাদের অনুকূল সাব্যস্ত হবে।
দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক-যারা দীনিয়াতের প্রভাব অনুযায়ী ইসলামকে নিজেদের জীবন ব্যবস্থা হিসাবে মনে করবে।
তৃতীয় শ্রেণীর লোক -যারা কুফর এবং ইসলামের মাঝামাঝি এমন এক পন্থা অনুসরণ করবে, যা সম্পূর্ণ কুফরও নয়, আবার সম্পূর্ণ ইসলামও নয়।
এ হচ্ছে উপরিউক্ত মিক্সচার পরিবেশনের স্বাভাবিক পরিণতি। আপনারা যদি এর অনুশীলন করেন, তবে দেখতে পাবেন দেশে তিনটি পরস্পর বিরোধী শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে যারা কোন সভ্যতা, জীবনব্যবস্থার উন্নতি ও ক্রমবিকাশের দায়িত্ব পালনে একাগ্রতার সাথে পরস্পর সহযোগিতা করতে সক্ষম হবে না।
এ জিজ্ঞাসা এই যে, কোন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কি এ জন্যেই রচিত হয় যে, সেখানে একটি মানসিক ও নৈতিক আস্তাকুঁড় সৃষ্টি করা হোক।
শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ
অনেকের মতে মধু বিদ্যা অর্জন করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। তাঁরা বলেন যে, জনগণকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবেই শিক্ষা দেয়া উচিত, যেন তারা ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের সমস্যাসমূহ, লেনদেন এবং যাবতীয় রহস্যাবলীর “বিষয়মুখ পর্যবেক্ষণ” (Objective Study) দ্বারা নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবেই নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, এ ধরনের বিষয়মুখ পর্যবেক্ষণ শুধু ক্যামেরার পক্ষে সম্ভব, মানুষ তা পারে না। মানুষের চোখ দু’টির পেছনে একটি মস্তিষ্ক আছে। সকল অবস্থাতেই তার একটি স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সমস্যাবলী ও বিচার বিশ্লেষণ করার একটি নির্দিষ্ট ধারণাও আছে। মানুষ যা কিছু দেখে, শুনে, যেসব জ্ঞান সে অর্জন করে তা সে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারেই পড়ে তোলে। এ চিন্তাধারার ভিত্তিতেই তার জীবনব্যবস্থা কায়েম হয়। একেই আমরা কৃষ্টি বা কালচার নামে আখ্যা দেই। এখন আমাদের যদি নিজস্ব কোনও কৃষ্টি ও কালচার থাকে, আমরা যদি এমন জাতির লোক হয়ে থাকি, যার নিজস্ব মতবাদ, বিশ্বাস, জীবন-দর্শন, উদ্দেশ্য ও কর্মজীবনের ধারা বলতে কিছু আছে, তবে আমাদেরকে বাধ্য হয়ে এমন পন্থা অনুসরণ করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যত বংশধরগণের শিক্ষা-দীক্ষার জন্যে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যেন তারা আমাদের তাহযীব-তামাদ্দুনকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয়, মূলভিত্তির উপরে কায়েম রেখে তার উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি সাধনে যেন সক্ষম হয়। দুনিয়ার প্রত্যেকটি জাতি এ উদ্দেশ্য নিয়ে তার জন্যে একটি স্বাধীন শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করে। এমন একটি জাতির নামও আমি জানি না, যে শুধু ‘বিষয়ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের’ (Objective Study) ভিত্তিতে স্বীয় শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করেছে। আমি এমন কোন জাতির নামও জানি না, যে ভিন্ন জাতির শিক্ষাব্যবস্থা হুবহু গ্রহণ করেছে। কিংবা তাতে স্বকীয় ভাবধারার সংযোগ সাধন না করে বিজাতীয় আদর্শেই নিজের ভবিষ্যত বংশধরগণকে গড়ে তুলতে অগ্রসর হয়েছে। এ ধরনের নির্বুদ্ধিতা যদি আমরা দুর্বলতা এবং অসহায় অবস্থার জন্যে পূর্বে একবার করেও থাকি, তবে এখনও তা পূর্ববৎ বহাল রাখার কোনই অর্থ হয় না।
দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য বিলুপ্তিকরণ
আর একটি বিষয়কে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা উচিত এবং যে বুনিয়াদের উপরে আমাদের গোটা মিল্লাতের জন্যে একটি মাত্র শিক্ষাব্যবস্থা রচিত হওয়া আবশ্যক তা এই যে, দ্বীন ও দুনিয়ার বতমান পার্থক্য আমরা খতম করব। কারণ দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য সৃষ্টির কথা খ্রিষ্টান মতবাদই সমর্থন করে, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং যোগী সন্ন্যাসীরাই তা বলে। কিন্তু এ ব্যাপারে ইসলামের ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত। শিক্ষা, রাষ্ট্র এবং সভ্যতার ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাজনীতি, অন্য কথায় দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে পার্থক্য স্বীকারের ন্যায় মারাত্মক ভুল দ্বিতীয়টি হতে পারে না। আমরা একথা মোটেই স্বীকার করি না যে, আমাদের জন্যে দ্বীনী ও বৈষয়িক দু’টি আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে। বরং আমরা তো এই স্বীকার করব যে, আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা একই সঙ্গে যেমন দ্বীনী বলে গণ্য হবে, তেমনি আমাদের পার্থিব প্রয়োজন মিটাতেও সক্ষম হবে।
পার্থিব এ হিসাবে যে, আমরা দুনিয়াটাকে জানতে পারব এবং দুনিয়ার কাজ আমরা দক্ষতার সাথে চালাতে পারব। অপরদিকে দ্বীনী এ হিসাবে যে, দুনিয়াটাকে আমরা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতেই বুঝতে পারব এবং দ্বীনের নির্দের অনুসারেই এ ব্যাপারে যাবতীয় কর্তব্য সম্পাদন করতে পারব। ইসলাম তেমন কোন ধর্ম নয় যে, আপনাকে যাবতীয় কাজ নিজের ইচ্ছা অনুসারে করবার অনুমতি দেবে এবং এর সঙ্গে শুধু কয়েকটি মতবিশ্বাস বা আকীদা ও ইবাদতের পরিশিষ্ট জুড়ে দিলেই চলবে। ইসলাম কখনো মানব জীবনের পরিশিষ্ট হিসাবে ভূমিকা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না, কখনো ছিল না এবং এখনো এতে রাজী নয়। সে তো আপনাদের সমগ্র জীবনের নেতৃত্ব করতে চায়। সে গোটা জীবনের কর্মসূচি হিসাবেই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্যেই প্রস্তুত। দুনিয়ার সাথে সম্পর্কহীন শুধু ঊর্ধ্বলোকের কথাই সে বলে না। বরং দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ে পূর্ণরূপে ব্যাপকভাবেই সে আলোচনা করে। ইসলাম আপনাকে বলছে যে, এ দুনিয়ার প্রকৃত রহস্য কি, কোন উদ্দেশ্যে আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে এবং আপনার জীবনের উদ্দেশ্যই বা কি, এ বিশ্বজগতে আপনার আসল স্থান কোথায়, আপনার মর্যাদা কতখানি, দুনিয়ার বুকে পার্থিব জীবনে কিভাবে কোন নীতিতে কাজ করতে হবে, তাও সে বলছে। সে আরও বলছে যে, এ দুনিয়াটা আসলে পারলৌকিক জীবনের জন্যে ক্ষেতখামারের মতোই। পরকালে যা কিছু লাভ করবেন, তা সম্পূর্ণরূপে এর উপরেই নির্ভর করছে যে, আপনি কোন ধরনের বীজ এ ক্ষেতে বপন করলেন। এ ক্ষেত কিভাবে চাষ-আবাদ করতে হবে, তাও সে আপনাকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিচ্ছে। সে আপনাকে পরিষ্কারূপে বলে দিচ্ছে য, সমগ্র পার্থিব জীবনে আপনার কর্মপন্থা কি হওয়া উচিত-যার ফল আপনি আখেরাতে লাভ করতে সক্ষম হবেন। এ ধরনের একটি দ্বীন এ কথা কিভাবে স্বীকার করতে পারে যে, আপনাদের একটি শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে পার্থিব, অন্যটি হবে ধর্মীয়? অথবা একটি পার্থিব শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় পরিশিষ্ট সংযুক্ত করলেই চলবে? সে তো এই-ই চায় যে, আপনাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই যেন একমাত্র ‘দ্বীনের’ আদর্শেই রচিত হয়।
দেশরক্ষা সম্পর্কে মাওলানার মূল্যবান পরামর্শ
মাওলানা একজন সূক্ষ্মদর্শী রাজনীতিবিদ হিসাবে পাকিস্তানের দেশরক্ষা সম্পর্কে যে সুপরামর্শ দিয়েছেন, তা শুধু পাকিস্তান কেন, যে কোন মুসলিম দেশ ও রাষ্ট্রের জন্যে অতীব মূল্যবান। মাওলানা বলেনঃ
“আপনাদের জানা আছে যে, গোটা পাকিস্তানই সীমান্ত অর্থাৎ বৈদেশিক রাষ্ট্রের সীমান্ত পাকিস্তানের সীমান্তে এসে মিশেছে। এমন একটি বড় শহর নেই, যা সীমান্তে অবস্থিত নয়। এজন্যে প্রয়োজন প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব উপলব্ধি করা এবং প্রতিটি বিপদের মুকাবিলা করার জন্যে সদা প্রস্তুত থাকা। এমতাবস্থায় যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, জাতির নৈতিক মনোবল (Morale)। অর্থাৎ জাতির নৈতিক মনোবল না থাকলে যুদ্ধের উপকরণও অর্থহীন হয়ে পড়ে। অস্ত্রশস্ত্র যতই অধিক হোক না কেন, তা নৈতিক শক্তি বা মনোবলের অভাব পূরণ করতে পারে না। বরং নৈতিক শক্তির অভাবে সে সব অস্ত্রশস্ত্র শত্রুর হস্তগত হতে পারে। আমরা নৈতিক শক্তিকে উৎসাহ-উদ্দীপনা, সাহসিকতা ও দেশরক্ষার প্রেরণার মধ্যে সীমিত বলে মনে করি না। বরং এ নৈতিক শক্তি অর্জন করতে হবে সমগ্র জীবনে। কারণ আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য পেতে হলে গোটা জীবনকেই তাঁরই মরযীর অধীন করে দিতে হবে। কোন ব্যক্তি অথবা জাতি একদিকে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত থাকবে এবং অপরদিকে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করবে, এ এক অযৌক্তিক কথা। যে জাতি খোদাকে মোটেই স্বীকার করে না তারা তাঁর নাফরমানী করেও কিছুকাল টিকে থাকতে পারে। কারণ তার জন্যে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবসর প্রদানের আলাদা লাইন রয়েছে। কিন্তু যে জাতি খোদাপুরস্তির আহ্বায়ক, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ মহাগ্রন্থের ধারক ও বাহক এবং দ্বীনে হকের প্রতিনিধিত্বকারী বলে পরিচিত, তারা যদি খোদার নির্দেশাবলীর প্রতি বিদ্রূপাত্মক ভূমিকা পালন করে, তাহলে দুনিয়ার কোন শক্তি তাদেরকে খোদার শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে না। তাদের এহেন ভূমিকা খোদার রহমতের পরিবর্তে অভিশাপ ও শাস্তির আহ্বান জানায়।
নৈতিক মনোবল অক্ষুণ্ন রাখার জন্যে প্রেরণামূলক বক্তৃতা এবং বড় বড় বুলি ও ঘোষণা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এসব কথার দ্বারা সাময়িক মনোবল সৃষ্টি করা হলেও তা স্থায়ী হয় না। কথার পরিবর্তে বাস্তব কাজের মাধ্যমে আমাদের নৈতিক মনোবল বাড়াতে হবে।
“আমাদের আপামর জনসাধারণকে এ নির্দেশ দিতে হবে যে, শত্রুর হামলার সময় যে যেখানেই থাক, তাকে যেখানেই অবিচল থাকতে হবে। পরায়নের চেষ্টা কিছুতেই করা চলবে না। তাদেরকে একথা বুঝিয়ে দিতে হবে যে, মৃত্যু থেকে তারা পালিয়ে থাকতে পারবে না। মৃত্যুর নির্ধারিত সময় এসে গেলে সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান করেও মৃত্যু থেকে আত্মরক্ষা করা যাবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে বোমা বর্ষণের সময়েও যদি মৃত্যুর সময় নির্ধারিত হয়ে না থাকে, তাহলে মৃত্যু কিছুতেই আসবে না। আর মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাসই এই যে, মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। এতএব এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্যে পলায়ন করা এবং সন্তা-সন্ততিকে বাঁচানোর চেষ্টা করা সব দিক দিয়েই অবাঞ্ছনীয়। লোকদেরকে বলে দেয়া উচিত যে, আমাদের জন্যে এমন নিরাপদ স্থানই বা কোথায় আছে, যেখানে পালিয়ে গিয়ে আমরা বাঁচতে পারি। আসল ব্যাপার এই যে, এসব কাপুরুষ যে কোন জনপদেই যাক না কেন, তারা সেখানকার লোকদের নৈতিক মনোবলও ভেঙ্গে দিবে। শত্রুর তো আত্মরক্ষার যথেষ্ট স্থান আছে। তারা বহুদূর পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে পারে। কিন্তু আমাদের জন্যে কোথাও এতটুকু ঠাঁই নেই যেখানে পালিয়ে গিয়ে আমরা নিরাপদে থাকতে পারি। অতএব, আমাদের উচিত যেখানেই থাকি না কেন, অচল অটল থেকে যে কোন পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত থাকা।
“আর একটি বিষয় যা দেশরক্ষার ব্যাপারে বিশেষ প্রনিধানযোগ্য তাহলো এই যে, দেশের অভ্যন্তরে অত্যাচার, অবিচার ও অপরের অধিকার হরণ চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত। যদিও এসব সমাজে কোন অবস্থাতেই চলতে থাকা উচিত নয়, কিন্তু বিশেষ করে যুদ্ধের সময় যদি এ ধরণের আচরণ করা হয়, তাহলে আমাদের আত্মরক্ষার দুর্গে ফাটল সৃষ্টি হবে এবং তা শত্রুকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সাহায্য করবে।
“এ এক সাধারণ জ্ঞানের কথা যে, কারো মনে যদি দেশরক্ষার প্রেরণা জাগ্রত হয়, তাহলে এজন্যে হতে পারে যদি যে অনুভব করে যে, সে এমন এক দেশে বাস করে যেখানে তার সকল প্রকার অধিকার ও মনসম্ভ্রম সংরক্ষিত এবং তার আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা যদি এ হয় যে, এ দেশে না তার মানসম্ভ্রম সংরক্ষিত আর না তার ব্যক্তি-অধিকার, তাহলে এমন কোন কারণ থাকতে পারে না যার জন্যে এ দেশের নিরাপত্তার জন্যে তার মধ্যে কোন প্রেরণা সৃষ্টি হতে পারে। যেখানে জনসাধারণ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অর্থনৈতিক অবিচারে মানুষ অভূক্ত থাকতে বাধ্য হয়, ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ক্ষমতাহীনদের ইযযত-আবরু লুণ্ঠিত হয়, যেখানে বৈদেশিক হামলার সময় জনগণের মধ্যে দেশরক্ষার প্রেরণা সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ তাদের এমন জিনিস সংরক্ষিত নয় যা তাদের জীবনের চেয়ে অধিকতর প্রিয় এবং যা রক্ষা করা তারা সবচেয়ে প্রয়োজন মনে করে। ইতিহাসে বারবার এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে যে, এমন অবস্থায় জনসাধারণ বহিঃশত্রুর আক্রমণের সময় উদাসীনতা অবলম্বন করেছে এবং অনেক সময় উৎপীড়িত জনগণ প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে বৈদেশিক আক্রমণকে স্বাগত জানিয়েছে যাতে যারা তাদের যাবতীয় অধিকার হরণ করেছে স্বচক্ষে তাদের ধ্বংস দেখতে পায়। ইতিহাসের এসব দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। অতঃপর আমরা যেন একে অপারের অধিকার সংরক্ষণ করি। আমাদের দেশে যেন পরিপূর্ণ ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। অত্যাচার-অবিচার দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল করে দেয়। যে ব্যক্তি আপন ব্যক্তিস্বার্থের জন্যে জনগণের আত্মসম্মানে আঘাত করে, সে প্রকৃতপক্ষে শত্রুর আগমন পথ সুগম করে দেয়।
“আমরা মনে করি এ ভূখণ্ড আমাদের নয়, বরং ইসলামের ‘ঘর’। কয়েক শতাব্দীর পর আমাদের এ সুযোগ এসেছে ‘দ্বীন হক’কে তার প্রকৃতরূপে রূপায়িত করার এবং দুনিয়ার সামনে তার সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করার। এ আমাদের জন্যে এক বিরাট দান এবং যে কোন মূল্যে তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে আমরা প্রস্তুত। আমরা চাই প্রতিটি মুসলমানের মনে এ দানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করতে। প্রত্যেকের মন-মস্তিষ্কে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দিতে চাই যে, এ দানের সংরক্ষণের জন্যে কোন প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে সে পশ্চাৎপদ হবে না। মনে রাখবেন, আপন বাড়িঘর, ধনসম্পদ, মানসম্মান রক্ষার জন্যে জীবন বিসর্জন অপেক্ষা খোদা ও তার দ্বীনের জন্যে জীবন দান অনেকগুণে শ্রেয়। এই প্রেরণাসহ জীবন দান (শাহাদাত) অতি উচ্চমানের জীবন দান সন্দেহ নেই।”
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
অর্থনৈতিক প্রচেষ্টায় সমান অধিকার
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ যাবতীয় বস্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যেই সৃষ্টি করেছেন। অতএব এ যমীন থেকে আপন জীবিকা অর্জনের চেষ্টা মানুষের জন্মগত অধিকার। সকল মানুষই সমানভাবে এ অধিকারের অংশীদার। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যেতে পারে না। আর না এ ব্যাপারে কেউ অন্যের চেয়ে প্রাধান্য লাভ করতে পারে। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি, বংশ বা শ্রেণীর প্রতি এ বিধি বিশেধ আরোপিত হতে পারে না যে, জীবিকার উপাদানসমূহের মধ্যে কিছু ব্যবহার করার অধিকার তার থাকবে না অথবা কোন পেশা অবলম্বনের পথ তার জন্যে বন্ধ করে দেয়া হবে। অনুরূপভাবে শরীয়ত অনুযাযী এ ধরনের পার্থক্যকরণও করা যেতে পারে না, যার ভিত্তিতে জীবিকার উপায় অথবা ধন-দৌলতের দুয়ার বিশেষ শ্রেণী, বংশ অথবা পরিবারের জন্যে একচেটিয়া হয়ে যাবে। খোদার সৃষ্ট যমীনে তাঁরই সৃষ্ট উপায়-উপাদানে স্বীয় অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টায় প্রত্যেকের সমান অধিকার রয়েছে এবং এর পথ সকলের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত।
(ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি)
অর্থনৈতিক সমস্যা ও ইসলাম
ইসলাম প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন সঞ্চিত রাখাকে দূষণীয় মনে করেছে। তার দাবি এই যে, যা কিছু ধন তোমার আছে তা তোমার প্রয়োজন পূরণে ব্যয় কর অথবা অন্যকে দান কর যাতে সে তার প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারে। এভাবে সমগ্র ধন সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আবর্তিত হতে থাকবে। কিন্তু এমন করা না হলে এবং একত্রে সঞ্চিত করার জেদ করা হলে এ সঞ্চিত ধনের শতকরা আড়াই ভাগ তার থেকে বের করে তা এমন লোককে দিতে হবে যারা জীবিকা অর্জনে সক্ষম নয় অথবা জীবিকা অর্জনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। এই হলো ’যাকাত ব্যবস্থা’। যাকাত ব্যবস্থাপনার যে পরামর্শ ইসলাম দেয় তা হলো এই যে, তাকে জনসাধারণের ধনভাণ্ডারে (Public Exchequer) জমা দিতে হবে, যেখান থেকে সকল অভাবগ্রস্থের প্রয়োজন পূরণ করা হবে। এ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সমাজের জন্যে আর্থিক নিরাপত্তার (Social Insurance) সর্বোত্তম পন্থা এবং সামাজিক সাহায্য বিতরণের কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে যে অনাচার হয়ে থাকে, এ যাবত ব্যবস্থা তার মূলোৎপাটন করে।
কোরআন-হাদীসে এ সবের বিস্তারিত বিধি ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। মাওলানা তাঁর ‘যাকাতের হাকীকত’ গ্রন্থে এ সবের যুক্তিপূর্ণ ও মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন।
মাওলানা বলেনঃ
‘বায়তুল মাল’ সর্বদা আপনার সাহায্যদাতা হিসাবে বিদ্যমান থাকে, যার জন্যে আপনার চিন্তার কোন কারণ থাকতে পারে না। আপনি অভাবগ্রস্ত হলে বায়তুলমালের সাহায্যপ্রার্থী হোন এবং স্বীয় হক আদায় করুন। এর পরে ব্যাংক ড্রাফট ও ইনসিউরেন্স পলিসির কোন প্রয়োজন নেই। আপনি পুত্র পরিজন ছেড়ে নিশ্চিন্ত মনে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করুন। সমাজের ধনভাণ্ডার আপনার মৃত্যুর পর তাদের ভরণপোষণের জন্যে দায়ী। বার্ধক্য ও সকল প্রকার বিপদে আপদে বায়তুল মাল আপনার সকল সময়ের সাহায্যকারী যেখানে আপনি সাহায্য চাইতে পারেন। পুঁজিপতি আপনাকে বাধ্য করতে পারবে না যে, তারই শর্তাধিন আপনাকে কাজ করতে হবে। বায়তুলমাল বিদ্যমান থাকতে অভূক্ত ও বিবস্ত্র হয়ে অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করার কোন আশংকা থাকতে পারে না। [অর্থনৈতিক সমাস্যা ও তার সমাধান (উর্দু) পৃঃ ৪০,৪৩]
অর্থনীতির বিশদ বিশ্লেষণ করে মাওলানা ‘সুদ’ ও ‘ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ’ নামে দু’খানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। অর্থনীতির উপরে প্রামাণ্য মূল্যবান গ্রন্থ এ দু’খানি।
‘সুদ’ গ্রন্থে সুদভিত্তিক অর্থনীতি ও সুদহীন ইসলামী অর্থনীতির বিশদ আলোচনার পর ইসলামী অর্থনীতিকেই মানব জাতির জন্যে একমাত্র মঙ্গলকর অর্থব্যবস্থা হিসাবে প্রমাণ করেছেন।
দ্বিতীয় গ্রন্থে পুঁজিবাদ, কমিউনিজম ও ইসলামের তুলনামূলক আলোচনা করে প্রথম দুটি ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করেছেন। জায়গীরদারী সামস্তবাদী ব্যবস্থা, ইউরোপীয় রেনেসাঁ, মধ্যযুগের লিবারেলিজম, শিল্প বিপ্লব ও আধুনিক লিবারেলিজমের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরেছেন। অতঃপর আধুনিক অর্থ সমস্যার ইসলামী সমাধানও পেশ করেছেন।
অন্যান্যের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদূদী
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সম্পর্কে অনেক বিজ্ঞ ও মনীষীগণের মন্তব্য রয়েছে, রয়েছে তার ঘনিষ্ঠজনের অনুভূতি যা অনেক শিক্ষণীয় এবং অনুসরণীয়। তার কিছু নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
বেমম মওদূদী
মওদূদী সাহেব একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁকে কোরআন এবং নবী চরিত্রের যে মাহাত্ম্য দান করেছে, তাতে বিনা দ্বিধায় একথা বলা যায় যে, তাঁর প্রতিটি কার্যকলাপ কোরআন সম্মত।
“আমি ছিলাম গুমরাহ। মওদূদী সাহেব আমার সামনে উদিত হন সিরাতুল মুস্তাকীমের’ রাহবার হিসাবে। তিনি ছিলেন নির্বাক, কিন্তু তাঁর কার্যকলাপই প্রতিমূহূর্তে সত্য পথের দিকে অনুপ্রেরণা যোগাতো। যদি তিনি মুখ খুলতেন, আমার প্রত্যেক কাজে বাধা দিতেন এবং প্রতিটি বিষয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করতেন, তাহলে আমার সংশোধন তো দূরে কথা, তাঁর সাথে জীবন যাপন করাও আমার পক্ষে হয়তো সম্ভব হতো না। কিন্তু তা তিনি করেননি কোনদিন। এটাই ছিল তাঁর ইসলাম প্রচারের বিজ্ঞানসম্মত পন্থা, যা তিনি শিক্ষা করেছিলেন কোরআন পাক থেকে।
“তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, ধৈর্যশীল ও স্নেহশীল। আমার স্মরণ নেই যে, তিনি বিগত পনেরো বিশ বছর ‘অমর-বিল মারুফ’ ও ‘নাহী আনিল মুনফার’ সম্পর্কে আমার প্রতি কোন কঠোর আদেশ করেছেন কি না। তাঁর চরিত্রের মাধুর্যই এই যে, কিছুকাল তাঁর সংস্পর্শে থাকলেই তাঁর মনঃপূত হওয়া যায়।”
“মওদূদী সাহেব বাহ্যিক সংশোধন অপেক্ষা আধ্যাত্মিক সংশোধনের প্রতি অধিকতর দৃষ্টি রাখেন। একবার তিনি কোথা হতে এসে শ্রান্ত-ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়েন। এমন সময় আগন্তুক তাঁর সাথে দেখা করতে চাইলেন। আমি বললাম যে, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। একথা শুনে মওদূদী সাহেব শুধু এতটুকু বললেন, ‘তুমি মিথ্যা কথা বলে ফেললে’?”
“একবার আমরা সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছি। আমি বড় ছেলেকে বলছিলাম, ‘ব্যাটাৱ, নামায পড়ো। নতুবা লোকে বলবে মওদূদী সাহেবের ছেলে নামায পড়ে না’।”
“তিনি বললেন, দেখ ব্যাটা, যখন নামায পড়বে, তখন একমাত্র আল্লাহর জন্যেই পড়বে, পিতর জন্যে না।”
“সন্তানের প্রতি এত স্নেহশীল যে, এমনটি আর কাউকে দেখিনি। যখনই তিনি বাড়িতে আসেন, প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে ডাকতেন। দারুল ইসলামে আমাদের এক টাঙা ছিল। তিনি নিজেই আমাকে এবং ছেলেদের নিয়ে সন্ধ্যার আগে বেগাতে যেতেন। অন্য কারো সঙ্গে তাদের কখনো কোন সথানে পাঠাতেন না, পাছে কেউ হঠাৎ টাঙা থেকে পড়ে যায়। একবার কি কারণে কোচওয়ানের সঙ্গে ছেলেদের পাঠানকোট পাঠিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি নদীর ধারে বেড়াতে যান। মাগরিবের আগেই নদীর ধার থেকে ফিরে এসে জানতে পারলেন যে, ছেলেরা তখন্টো ফিরেনি। তখন তিনি বাড়ির ভিতরে না এসে বাইরেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রইলেন। ছেলেরা ফিরে এলে, তবে তাদের নিয়ে তিনি ভেতরে এলেন।”
“সতেরো বছরবয়সে মওদূদী হাসেব পিতৃহীন হন। আল্লাহর অনুগ্রহে মা এখনও বেঁচে আছেন।” [বেগম মওদূদীর উপরোক্ত উক্তির পর ১৯৫৭ সালে মাওলানা মওদূদীর মাতা জান্নাতবাসী হন।]
“তিনি মায়ের এতদূর খেদমত করেন যে, এমন পুত্র সত্যিই বিরল। মায়ের কোন কিছু তাঁর মনঃপূত না হলে নীরব থাকেন। কোনরূপ বিরক্তিও প্রকাশ করেননি। তাঁকে কোন মন্দ বললেও তিনি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন না। প্রতি মুহূর্তে তাঁর খেদমতের জন্যে প্রস্তুত থাকেন।
“আমার পূর্ব পুরুষ বাদশাহ শাহজাহানের আমালে বোখরা থেকে দিল্লী আসেন। তখন থেকে পুরুষানুক্রমে দিল্লীতে বসবাস করার ফলে আমরা শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। মাওলানা মওদূদী হায়দারাবাদ থেকে দারুল ইসলামে আসার পর আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়।”
“আমাদের পরিবারসহ মাত্র তিনটি পরিবার নিয়ে দারুল ইসলামের বসতি শুরু হয়। সাদাসিধে গ্রাম্য ঘরবাড়ি। না সেখানে বৈদ্যুতিক আলো আছে, না পানির কল এবং না জীবন যাপনের অন্যান্য সহজ উপায়-উপাদান। এটা ছিল আমার জীবনে ধৈর্য্যশীলতার প্রাথমিক স্তর।”
“একবার আমাদের ঘরে জ্বালানী কাঠ ছিল না। মাওলানা সকালে নাশতা করে অফিসে চলে যান। তখন আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম কি করি। এমন সময়ে মাওলানা অন্দরে এসে বললেন, ‘ব্যাপার কি, এমন চুপচাপ বসে রয়েছ যে?”
বললাম, ‘জ্বালানী কাঠ নেই, পাচিকা বসে আছে।’ তিনি বললেন, ব্যাস এতটুকুতেই অধীর হয়ে পড়েছ? এই বলে একটা কুঠার হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঘরের বাইরে কতকগুলি কাষ্ঠখণ্ড পড়েছিল। তা নিজ হাতেই ফাড়তে শুরু করলেন। কুঠারের দু’এক ঘা মারতেই চারদিক থেকে লোকজন ছুটে এলো এবং অল্পক্ষণের মধ্যে জ্বালানি কাঠের স্তূপ হয়ে গেল।”
“এমনি একদিন কি কারণে ভিস্তিওয়ালা পানি দেয়নি। সেদিন ছিল আবার ভয়ানক গরম। আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম। মাওলানা জানতে পেরে দু’টি বালতি হাতে কূপে চলে গেলেন এবং নিজ হাতেই পানি তুলে বালতি ভরতে লাগলেন। লোকজন তা দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পানিতে বাড়ি ঘর ভরে দিল।” [বেগম মওদূদী মাহমুদা খাতুন ২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন।]
মাহিরুল কাদিরী
পাক-ভারতের বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক এবং মাসিক পত্রিকা ‘ফারান’র সম্পাদক জনাব মাহিরুল কাদিনী বলেনঃ
“আমি মাওলানার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করি। আমার বিশ্বাস, লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি দ্বীনের যে খেদমত করছেন, বর্তমান যুগে তার তুলনা বিরল। এমন কি আরব দেশগুলিতেও তার তুলনা নেই।”
মাওলানা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেনঃ
“তিনি ইসলামী জগতের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। তিনি মুসলমানদের মধ্যে সত্যিকার ইসলামী গবেষণার সূত্রপাত করেছেন এবং মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনয়ন করেছেন- যিনি কোরআন ও সুন্নাহর ভাষ্যকার, সত্যের সহায়ক, সত্যবাদিতার মূর্ত প্রতীক- ইসলামী ঐতিহ্যের অস্পষ্ট চিত্রাবলীর রূপদানকারী, আল্লাহর দ্বীনের একনিষ্ঠ সেবক, যাঁর কথা ও কাজে পূর্ণ বিশ্বাস করা যায়, যাঁর সমগ্র যৌবনকাল দ্বীনের কাজে উৎসর্গীকৃত এবং তাঁরই চিন্তা গবেষণায়, শ্রম ও সাধনায় যিনি অকালবৃদ্ধ-যাঁর কথা ও লেখা শতাব্দীর এক-চতুর্থাংশ কাল যাবত সত্যের আহ্বান জানিয়ে আসছে, এত বড় বিজ্ঞ আলিম-যিনি একই সময়ে কোরআন-হাদীস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, শাসনতন্ত্র, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণামূলক আলোচনা করতে পারেন- যিনি যুক্তির সম্রাট এবং জ্ঞানের সাগর, শুধু প্রাচ্যেরই নন পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার সাথেও যিনি শুধু পরিচিতই নন বরং তাকে পরীক্ষা ও যাচাই করে দেখেছেন, যিনি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং রাসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য পালনের আহ্বায়ক মুলতান জেলের প্রাচীর চতুষ্টয় ও লাহোর দুর্গের অন্ধকার ফাঁসিকক্ষ যাঁর আন্দোলন স্তব্ধ করতে পারেনি, কুফরের ফতোয়াবাজি যাঁর কণ্ঠরোধ করতে পারেনি, যিনি কোরআন ও সুন্নাহর কষ্টিপাথরে প্রত্যেক কথা ও কাজকে যাচাই-পর্যালোচনাকারী এবং কষ্টিপাথরে যা কিছুই ধরা পড়ুক তা যত বড় বিদ্বান পণ্ডিতের বেলায় হোক না কেন, নির্ভয়ে প্রকাশকারী, দ্বীনের প্রতিষ্ঠা যাঁর ব্রত, সত্যের আহ্বান যাঁর কর্মসূচী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি যাঁর লক্ষ্য-সত্য প্রচারের জন্যের যিনি সমগ্র জগতের রোষানলে ভীত শঙ্কিত নন এবং স্বীয় সুনাম নষ্টের ভয়ও যার নেই অজ্ঞ-অর্বাচীনরা তাঁর প্রতি নানা প্রকারের অপবাদ করলেও যিনি সবকিছুই ধৈর্য সহকারে উপেক্ষা করেছেন, যাঁর লেখনী উর্দু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও পবিত্র করেছে এবং উর্দু ভাষার অমূল্য অবদান হয়ে রয়েছে- বক্তৃতায় এক অভিনব প্রকাশ ভঙ্গিমার যিনি উদ্ভাবক এবং বক্তৃতাকালে মনে হয় যেন থমথমে আকাশ থেকে ঝটিকাপ্রবাহ ও বিদ্যুতমালার স্ফূরণ -যাঁর নামে ‘কাদিয়ানীবাদ’ প্রকম্পিত ও হাদীস অবিশ্বাসকারীদের শ্বাসরোধ শুরু হয়, যিনি সুন্নাতের পরিপোষক ও শির্কবিদয়াতের মূলোৎপাটক, যিনি জ্ঞান গরিমা ও অসাধারণ খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও সাধারণ লোকের সঙ্গে বিনা-লৌকিকতায়, সরলতা ও মিষ্ট মধুর ভাষায় এমনভাবে মিশতে পারেন যেন অপরের সঙ্গে তাঁর কোন পার্থক্যই থাকে না, যিনি শুধু একজন আলিম, চিন্তাবিদ, বাগ্মী এবং গ্রন্থকারই নন, বরং এমন এক মর্দে মুজাহিদ মৃত্যুদণ্ডাদেশ শ্রবণেও তাঁর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না-যিনি ইতিহাস-সৃষ্ট নন, বরং ইতিহাস-স্রষ্টা।”
বশীরুল ইবরাহিমী
আলজিরিয়ার জননেতা এবং তথাকার জমিয়তে উলামায়ে মুসলিমীনের সভাপতি আল্লামা মুহাম্মদ আল-বশীরুল ইবরাহিমী বলেন-
“তাঁর মত (সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী) মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। বিশেষ করে তাঁর মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও গুণসম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি আলেম সমাজে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন- আমি অতি অল্পই দেখেছি। তাঁর গুণপনার মধ্যে বিশেষ গুণ এই যে, তিনি সত্যের উপর অচল-অটল, সত্যপথে ধৈর্যশীল এবং শাসকশ্রেণীর তোষামোদ করা তো দূরের কথা, তাঁদের সাহায্য লাভেরও বিরোধী।
“পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান আমি যাঁদেরকে দেখেছি এবং যাঁদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি, ইসলামী শরীয়ত ও ইসলামী ইতিহাসের তথ্যাদি সম্পর্কে তিনি সকলের চেয়ে অধিক জ্ঞান লাখেন। তাঁর অধ্যয়ন অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর। তিনি সূক্ষ্ম বোধশক্তি, উচ্চতম মস্তিষ্ক, স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী।
“আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সম্পর্কে মাওলানা মাওদূদী যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছে। সকলকে তিনি ন্যায়ের কষ্টিপাথরে যাচাই করেন।”
“বিগত মাসে পাকিস্তানে বিশেষ উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং কিছু খুন খারাবীও হয়। আরব দেশের সংবাদপত্রগুলো এ সম্পর্কে কোন বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশন করেনি বলে আমি এর কারণ ও গুঢ় রহস্য বুঝতে পারিনি। তবে আমার সুস্পষ্ট ধারণা এই যে, ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবিই এ সবের মূলীভূত কারণ। সম্ভবত গভর্ণমেন্ট দেশের মধ্যে মাওলানা মওদূদী এবং তাঁর সহকর্মীগণের ক্রমবর্ধমান প্রভাব লক্ষ্য করে অধিকাংশ সহকর্মীকে কারারুদ্ধ করেছেন। অতঃপর লাহোরে সামরিক আইন জারি করে সামরিক বাহিনীর উপরই সকল ভার ন্যস্ত করা হয়। সামরিক আদালত মাওলানাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। পরে জানতে পালাম মৃত্যুদণ্ড রহিত করে চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। পাকিস্তানের মুসলমানগণ এই জুলুমশাহীর সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও শোভাযাত্রার তুমুল ঝড় উত্থিত হয়। দেশময় বিক্ষোভের ফলেই যে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
ওদিকে মিসর, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত প্রভৃতি স্থানের সুসংগঠিত ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও আনজুমানগুলোর পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ উত্থিত হয় এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। আমি যখন কুয়েতে ছিলাম, তখনই এসব সংবাদের সত্যতা জানতে পারি। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে এবং জমিয়তে উলামা ও এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধের ভিত্তিতে আমিও বিক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়ে পড়েছি। কারণ মাওলানা মওদূদীর ব্যক্তিত্ব কোন এক বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাঁর ব্যক্তিত্ব মুসলিম জাহানের অনুসরণযোগ্য। আমাদের প্রতি তাঁর যে হক আছে, তার মধ্যে একটি এই যে, গভর্ণমেন্ট যখন তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন, তখন তাঁর মুক্তির জন্যে আন্দোলন করা আমাদের কর্তব্য।…”
“মাওলানা মওদূদী আল্লাহর পথে যে জিহাদের অভিযান শুরু করেছেন, তার জন্যে এ জগতে এতটুকু প্রতিদানই যথেষ্ট যে, দুনিয়ার মুসলমান তাঁর সাহায্যর-সহযোগিতার জন্যে একতাবদ্ধ হয়েছেন। এর চেয়ে বিরাট ও চিরস্থায়ী প্রতিদান তাঁর জন্যে আল্লাহর নিকট গচ্ছিত আছে।”
ডাঃ মুহম্মদ আতাউর রহমান নদভী
’এতো ইবনে তাইমিয়ারই রং।’
আজ থেকে পনেরো বছর আগে একখানি পবিত্র মুখ থেকে আমি উক্ত কয়েকটি কথা শুনতে পেয়েছিলাম। যে মর্মস্পর্শী ভঙ্গিমায় কথাগুলো শুনেছিলাম, সে দৃশ্য অবিকল সুরক্ষিত অবস্থায় আমার চোখের সামনে ভাসমান রয়েছে। মনে হয় যেন এখনও সেই মুখমণ্ডল আমি দেখতে পাচ্ছি এবং সেই মর্মস্পর্শী কথাগুলো আজো আমার কর্ণকুহরে ঝংকৃত হচ্ছে।
সব কথা খুলে বলাই শ্রেয় মনে করি।
আমি ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠ্যভ্যাস করছিলাম। ১৯৩৫ সালে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় (লাখনো) ভর্তি হই। এ সময়ে ‘তর্জুমানুল কোরআন দেখার আমার সুযোগ হয়েছিল। আমার মনের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তর্জুমানুল যে, তর্জুমানুল কোরআন’ পাঠ করা আমার এক স্বাভাবিক চাহিদা হয়ে পড়েছিল।
গ্রীষ্মের বন্ধে যখন আমি বাড়ি যাই (মৌজা-পাহাড়পুর বাজার, পোঃ বড় হরিয়া, সারন) তখন তর্জুমানুল কোরআন সঙ্গে করে নিয়ে যাই। অতঃপর অতি আগ্রহে আমি আমার মুহতারাম পিতার নিকটে উক্ত পত্রিকার বিষয় উত্থাপন করি। তিনি তা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
আমার পিতা জনাব মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ জামিল আনসারী (রহঃ) একজন সত্যনিষ্ঠ দ্বীনের আলেম ছিলেন। তিনি সমগ্র জীবন অধ্যাপনায় কাটিয়ে দেন। তিনি শুধু অধ্যাপকই ছিলেন না বরং একজন মুফতীও ছিলেন। তিনি ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক এবং এর দারুল ইফতার মুফতী ছিলেন।
“তর্জুমানুল কোরআনের” যতগুলি সংখ্যা আমার কাছে ছিল, তার সবই পিতার খেদমতে হাযির করলাম। এসব দেখে তিনি সর্বপ্রথম যে মন্তব্য করেন তা হচ্ছে এই-মিঞা, এসবই কোরআন এবং সুন্নায় আছে। এখন শুধু তার আমলের প্রয়োজন। সাধারণ ইংরেজী শিক্ষিত লোকে এসব বিষয়ে তাঁদের পত্র-পত্রিকায় লিখে থাকেন, কিন্তু নিজেরা তা মেনে চলেন না।”
‘উনিশ শ’ ছত্রিশ সালের ছুটিতে যখন বাড়ি আসি, তখন ‘তর্জুমানুল কোরআনের’ সদ্য প্রকাশিত সংখ্যা এনে পিতাকে দিলাম। তিনি তা বেশ মনোযোগ সহকারে পাঠ করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমার বিরাট ভুল ধারণা ছিল। এ ব্যক্তি (মওদূদী) শুধু ইংরেজী শিক্ষিতই নন, বরং আরবী ভাষায়ও মহাপণ্ডিত। আচ্ছা, তাঁর বয়স কত?’
আমি বললাম, ‘খুব সম্ভব ত্রিশ-বত্রিশ হবে।’
তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘এত অল্প বয়সে এতখানি পাণ্ডিত্য ও যোগ্যতা? তাঁর পত্রিকা পাঠ কররে অবাক হতে হয়।’
“আমি মাওলানা মওদূদী সাহেবকে সবকিছু জানিয়ে দিলাম। তিনি তখন পাঠানকোটে এসে পড়েছিলাম। মাওলানা প্রভ্যুত্তরের সঙ্গে ‘সিয়াসী কাশ্মকাশ্, ‘ দীনিমাত’ প্রভৃতি গ্রন্থাবলী পাঠিয়ে দিলেন। আমার বুযুর্গ পিতা মরহুম এসব গ্রন্থ বারবার পাঠ করেন এবং বলেন, ‘এ ব্যক্তি সম্পর্কে আমার ভ্রান্ত ধারণা ছিল। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। এত অবিকল আল্লামা ইবনে তাইমিয়ারই রঙ। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এমন এক কালে যখন প্রকৃত প্রতিভাবান ব্যক্তি বিরল এবং বিশেষ করে এই হিন্দুস্তানে, এই ব্যক্তির কেমন করে আবির্ভাব হলো? ইনি যখন এর আদর্শ কার্যকর করতে থাকবেন, তখন তার সাথে চরম বিরোধিতা শুরু হবে। কারণ পৃথিবীতে সত্যনিষ্ঠ ও সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তির সাথে এরূপ ব্যবহারই হয়ে থাকে। এমনও হতে পারে যে, তাঁকে শহীদ করা হবে।’
এ সময় হতে ‘তর্জুমানুল কোরআন’ পাহাড়পুর বাজার, আনসারী কুতুবখানার ঠিকানায় নিয়মিত আসতে লাগলো। পিতা ছুটিতে কলকাতা থেকে বাড়ি এলে তা অবসর সময় মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। অবশেষেএকটি আদর্শবাদী দল গঠনের আবশ্যকতা সম্পর্কে যখন ‘তর্জুমানুল কোরআনের’ সম্পাদকীয় প্রবন্ধে মাওলানা মওদূদী ইঙ্গিত করতে আরম্ভ করেন, তখন আমার বযুর্গ পিতা বলেন-
‘যদি এ দল গঠিত হয়, তাহলে এর প্রথম সদস্য আমি হবো।’
কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, উক্ত দল (জামায়াতে ইসলামী) কায়েম হবার মাত্র দশ দিন পূর্বে (১৬ই আগস্ট, ১৯৪১ সাল) আমার পিতা জান্নাতবাসী হন। আল্লাহ তাঁকে রহম করুন।
এ সময়ে আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভী (রহঃ) এক বিরাট জনসভায় মাওলানা মওদূদীর বিরাট ব্যক্তিত্বের কথা ঘোষণা করেন।
উনিশ শ’ চল্লিশ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে দারুল উলুমের প্রাক্ত ছাত্রদের “নদভী সম্মেলন” হয়। আমি ১৯৩৯ সালে নদওয়ার দারুল উলুম থেকে সনদপ্রাপ্ত হয়েছিলাম। অতএব “নদভী সম্মেলন” যোগদান করার জন্যে আমিও লাখনো গিয়েছিলাম। এ সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে যা আমাকে বিশেষ অনুপ্রেরণা দিয়েছিল তা এই যে, ঠিক ঐ সময়ে মাওলানা মওদূদীরও লাখনো আসার কথা ছিল। আমার মত নদওয়ার অন্যান্য প্রাক্তন ছাত্রদেরও মাওলানার সাথে আলাপ করার বিশেষ আগ্রহ ছিল। সম্মেলন শেষে মাওলানা মওদূদী নদওয়ার মেহমানখানায় তাশরীফ আনেন। সকল শিক্ষক এবং প্রাক্তন ছাত্র তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। নদওয়ার কর্তৃপক্ষ সুধীবৃন্দ এবং ছাত্রদের সম্মুখে বক্তৃতা করার জন্যে মাওলানা মওদূদীকে অনুরোধ করেন। লাখনোর আঞ্জুমানটি ছিল লাখনো বিশ্ববিদ্যালয় এবং নদওয়ার ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারা গঠিত। মাওলানা মওদূদী ’নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা’ সম্পর্কে তাঁর বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় বক্তৃতা করেন। মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী সভাপতিত্ব করেন এবং আল্লামা সাইয়িদ সোলায়মান নদভী মাওলানার পরিচয় করিয়ে দেন। যে কথাও যে ভাষায় জনাব সাইয়েদ সাহেব মাওলানার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তা আজো আমার কর্ণকুহরে ঝংকৃত হয়। তিনি বলেছিলেন–
আমি আপনাদের সামনে একটি যুবক অথচ এক জ্ঞান সমুদ্রের পরিচয় করিয়ে দিতে দাঁড়িয়েছি। আজ সমগ্র শিক্ষিক জগত মাওলানা মওদূদীর পরিচয় লাভ করেছে। তিনি বর্তমান যুগে ইসলামের একজন মুখপাত্র এবং দীনের একজন বিরাট আলেম। ইউরোপ থেকে ধর্মদ্রোহিতা এবং নাস্তিক্যবাদের যে প্রবল বন্যা ভারত পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা এই পবিত্র হস্তেই ন্যস্ত করেছেন। তিনি ইউরোপের প্রাচীন ও আধুনিক চিন্তাধারা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছেন। শুধু তাই নয়, কোরআন এবং সুন্নাহ সম্পর্কেও তিনি এমন গভীর জ্ঞানের অধিকারী যে, তারই পরিপেক্ষিতে বর্তমান যুগের সকল সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান তিনি পেশ করতে পারেন। এ জন্যেই বড় বড় নাস্তিক ও খোদাদ্রোহী তাঁর অকাট্য যুক্তি তর্কের সম্মুখে নতি স্বীকার করেছে। একথা দ্বিধাহীন চিত্তে স্পষ্ট ভাষায় বলা যেতে পারে যে, ভারত এবং ইসলামী জগতের সুমলমানগণ দ্বীনের ব্যাপারে মাওলানা মওদূদীর কাছে বিরাট কিছু আশা করতে পারে।
আগা সুরেশ কাশ্মীরী
মাওলানা মওদূদীই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পাকিস্তানের মানসিক প্রতিভাকে জ্ঞানের রাজপথ প্রদর্শন করেছেন।
যে সময়ে আমাদের ইসলামী ভাবধারা দু’শত বছরের পরাধীনতার নাগপাশে পরিত্যক্ত হয়েছিল, সে সময়ে তিনিই ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন হিসাবে পেশ করেছেন।
তাঁর আন্দোলন এমন একটি শক্তি, যা আধুনিক ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
তাঁর চিন্তাধারার মধ্যে ইসলামের এতখানি প্রাণশক্তি বিদ্যমান যে, বর্তমান যুগের নব্য যুবকদল তা মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে উদ্যোগী হতে পারে।
দেশের নিত্য পরিবর্তনশীল শাসনতন্ত্র আইনের বলে দেশের স্থূল দেহিক বিপ্লব কিছুকালের জন্যে দমন করতে পারে। কিন্তু মানসিক বিপ্লব দমন করার কোন শক্তি অথবা অস্ত্রশস্ত্রাদি তার নেই। আমাদের সমাজ জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে অথবা কতিপয় বিশেষ কারণে ইসলামের বিপক্ষে এক মানসিক বিপ্লব গড়ে তুলেছে। এর গতিরোধ করার যদি কারো সাধ্য থাকে, তা একমাত্র মাওলানা মওদূদী এবং তাঁর আদর্শভিত্তিক দলেরই আছে।
মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী
পাঠকদের কাছে তর্জুমানুল কোরআন সম্পাদকের পরিচয় দান নিষ্প্রয়োজন। তাঁর প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিরাট দ্বীনী খেদমতের কথা তর্জুমানুল কোরআনের পৃষ্ঠায় বারবার আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান যুগের অশান্তি-অনাসৃষ্টি প্রতিরোধের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বক্ষকে বিশেষভাবে প্রশস্ত ও উন্মক্ত করে দিয়েছেন্ তাঁর লেখা প্রতিটি ছত্র আধুনিক শিক্ষিতদের জন্যে অমৃতস্বরূপ। এ ব্যাপারে উলামা সমাজে মাওলানার স্থান অতি উচ্চে। তিনি প্রকৃতপক্ষে মিল্লাতের চিন্তাশীল পুরুষ।
মাওলানা মানাযের আহসান গিলানী
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সাহেবের সুস্থ প্রকৃতি, সুষ্ঠু চিন্তাশাক্তি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রতি আমার চিরদিনই আস্থা রয়েছে। তাঁর আচার-আচরণ খোদা প্রদত্ত। সমস্যাবলীর প্রতি তাঁর দৃষ্টি সূক্ষ্ম, গভীর ও সর্বন্যাপী। তাঁর সমালোচনা এত পুঙ্কানুপুঙ্খ যে, কোন বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তাঁর কার্যপদ্ধতি মনোমুগ্ধকর, ব্যাখ্য-বিশ্লেষণ হৃদয়গ্রাহী। এতদসহ তাঁর মহৎ প্রকৃতির সাক্ষ্য ত আমি বারংবার দিয়েছি। স্বয়ং এ অধম মাওলানা আবদুল বারীর সাহচর্যে উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কার্য গ্রহণের জন্য মাওলানাকে অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু তাঁর আর্থিক অবস্থা অতীব শোচনীয় থাকা সত্ত্বেও তিনি সন্তুষ্টচিত্তে আমাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। যাঁর আত্মা এত বিরাট ও ঐশ্বর্যশালী, মননশীল ও চিন্তাশীল, প্রবন্ধকার হিসাবে যিনি খোদাপ্রদত্ত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, তাঁকে বেশী কিছু বলার ধৃষ্টতা ত ছিল না। কিন্তু এতটুকু বলতে চাই যে, আল্লাহ তায়ালা মাওলানা মওদূদীর উপরে অসাধারণ কৃষা বর্ষণ করেছেন। ঈমানের জ্যোতিতে তাঁর অন্তর উদ্ভাসিত দেখতে পাই। নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সাঃ)-এর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও আস্থা দিয়ে তাঁর অন্তর সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এতদসহ নানাবিধ যোগ্যতায় তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে। এ সমুদয় সাহিত্য, মন ও ঈমানের শক্তি দিয়ে আল্লাহর পথে আহ্বানকে জীবনের লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে যদি তিনি দণ্ডায়মান হন এবং উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় যদি কিছুদিন এ কাজ করা যায়, তা হলে হয়ত হতে পারে যে, লোকে সহসা তা গ্রহণ করবে না, কিন্তু ইসলাম যে সব স্বাভাবিক জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়, অন্তত মনের মধ্যে যে সব জিজ্ঞাসার স্ফুলিঙ্গ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবে।
মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী
তাঁর লেখার পদ্ধতি, অকাট্য যুক্তি, মৌলিক ও বুনিয়াদি আলোচনা পদ্ধতি এবং সর্বোপরি তাঁর সুষ্ঠু চিন্তাধারা ছিল আমাদের প্রকৃত ও মানসিকতার অত্যন্ত উপযোগী। এমন মনে হচ্ছিল যে, তাঁর খোদাপ্রদত্ত লেখনীশক্তি আমাদের মূক প্রতিভা ও রুচিরই মুখপাত্র। যেদিন নদওয়ার দারুল ইলুমের মসজিদ সংলগ্ন মেহমানখানায় বসে আমরা কয়েক বন্ধুতে হিজরী ১৩৫৬ সালের মহররম মাসের তর্জুমানুল কোরআনের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়ছিলাম, যাতে একটি প্রলয়ের ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছিল-তা কখনো ভুলবার নয়। এ মাওলানার এমন এক উদ্দীপনাপূর্ণ প্রবন্ধ ছিল যার প্রতিধ্বনি শুনা যেতো বহুদিন ধরে। আমরা সকলে মাওলানার বিচক্ষণতা, অন্তর্দৃষ্টি, সংকটের প্রতি অংগুলি নির্দেশ এবং তাঁর অসাধারণ লেখনীশক্তির অন্তর দিয়ে প্রশংসা করেছি। এরপর মাওলানার যেসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তা আমরা আনন্দের সাথে পড়তাম।
মাওলানা মুহাম্মদ মনযুর নো‘মানী
মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামীর কাজের মধ্যে যা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, হাজার হাজার তরুণ যুবক যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও শিক্ষায়তনের নাস্তিকতাপূর্ণ পরিবেশের প্রভাবে ইসলামের প্রতি সন্দিহান হয়ে তা একেবারে পরিত্যাগ করেছিল অথবা করার উপক্রম করেছিল, মাওলানা মওদূদীর প্রবন্ধাদি এবং জামায়াতে ইসলামীর কর্মতৎপরতা তাদেরকে শুধু যে ইসলামের দিকে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছে তা নয়, বরং তাদের ব্যবহারিক জীবনে এমন এক ইসলামী বিপ্লব সাধিত হয়েছে যে, অনেক বংশানুক্রমিক দ্বীনদারদের জন্যে তা ছিল এক শিক্ষণীয় ব্যাপার।
অধ্যাপক আলফ্রেড স্মিথ
মাওলানা মওদূদী বর্তমান যুগের ইসলামী চিন্তাধারার উপরে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং তাঁর দল পাকিস্তানের প্রতীয়মান শক্তিগুলোর মধ্যে একটি। এই আন্দোলন যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছে তা অতি বিরাট ও ব্যাপক। এই সাহিত্য বেশীর ভাগ উর্দু ভাষায়। তথাপি এর আরবী ও ইংরেজী অনুবাদ দিন দিন বেড়ে চলেছে। মওদূদী সাহেবের সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি আপন ভাবধারা ধীরে ধীরে এবং অত্যন্ত ধারাবাহিকতার সাথে একটি সঠিক এবং আকর্ষণীয় জীবন ব্যবস্থা হিসাবে পেশ করেছেন। মওদূদী সাহেবকে আধুনিক যুগে ইসলাম সম্পর্কে সংগঠিত ও আদর্শভিত্তিক পদ্ধতিতে একজন চিন্তাশীল পুরুষ বলে মনে হয়। তিনি ইসলামকে একটা শাসন-শৃঙ্খলার ছাঁচে ঢালবার আধুনিক ঝোঁক-প্রবণতাকে সুষমামণ্ডিত করে তুলেছন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামী আইন কানুনকে আধুনিক যুগের একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকরী ব্যবস্থা হিসাবে পেশ করেছেন। তিনি ইসলামকে এমন এক জীবন ব্যবস্থা হিসাবে পেশ করেছেন যা বহু শতাব্দী পূর্বেই ভবিষ্যতের সকল যুগের সকল মানবিক সমস্যার সমাধান সংগৃহীত রেখেছে। তাঁর কাছে ইসলাম এমন কোন ধর্ম নয়, যে প্রতিদিন প্রত্যুষে মানুষকে তার সমস্যার সমাধানকল্পে নতুন খোদায়ী জ্ঞান দান করার এক নতুন ঝঞ্ছাট সৃষ্টি করবে। যে চিন্তা ব্যবস্থাকে তিনি ক্রমশ মজবুত করে তুলেছেন তার উৎস ইসলামের প্রাথমিক যুগ, যেখান থেকে এই ব্যবস্থা-প্রাসাদের মৌলিক ভিত্তি সংগৃহীত হয়। এতদসহ তিনি যথেষ্ট পরিমাণ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারারও সুযোগ গ্রহণ করেছেন।
সত্য কথা এই যে, পাকিস্তানের মানসিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সময়ে তিনি বুদ্ধিজীবীদের এবং জনসাধারণেও একটা বিরাট অংশকে প্রভাবিত করেছেন। নৈতিক অধঃপতনের প্রবল ঝঞ্ছায় তিনি আপন সংকল্পিত লক্ষ্যের জন্যে অনুপম ঐকান্তিকতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন।
মাওলানা মওদূদী সাহেবকে একজন বিরাট এবং মহান ব্যক্তি মনে করি। এমন লোক অল্পই জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু আজ তিনি এত বড় হয়েছেন যে, এমন বড় তাঁকে আগে মনে করিনি। আমি ভাবতেই পারিনি যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর জন্যে এমন এক সৌভাগ্য সৃষ্টি করে রেখেছেন যে, তিনি দ্বীনের পথে একদিন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আল্লাহ তাঁকে হাজারের মধ্যে বেছে নিয়ে এমেন উচ্চস্থান দান করেছেন।’
রাজা জগনফর আলী খান
ঊনিশ শ’ উনচল্লিশ থেকে নিয়াল্লিশ সাল পর্যন্ত আমি লাহোর ইসলামিয়া কলেজে পড়াশুনা করতাম। এ সময় মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী হাবিবিয়া হলে ইসলামিয়াতের উপর লেকচার দেয়ার জন্যে প্রতি রোববারে আসতেন। শুক্রবার ছিল কলেজের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কিন্তু রোববার দিনে খেলাধুলা ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানাদি হতো। মাওলানার লেকচারও ঐদিন হতো। কলেজের সকলেই তাঁর লেকচার ক্লাসে যোগদান করত।
এ এমন এক সমায়ের কথা যখন মাওলানার দুধ-আলতা রঙের মুখমণ্ডলের উপরে দাড়ি ছিল কালো বর্ণের। মাথায় কালো টুপি, পরণে ডার্ক-ব্রাউন শিরওয়ানী এবং সাদা পায়জামা, চোখে নীল চশমা। মাওলানার যৌবনকাল তখন। কিন্তু কখনো তাঁর স্বভাবের মধ্যে রুক্ষতা অথবা ভাবাবেগ দেখিনি। কথা বলার ধরন বড়ই শালীনতাপূর্ণ এবং যা বলতেন তা খুবই যুক্তিসঙ্গত।
তাঁর ক্লাসে যোগদানকারী ছেলেরা কাগজ-পেনসিল সাথে করে আনত। লেকচার শেষ হলে কাগজের টুকরোয় প্রশ্ন করা হতো। মাওলানা তার সুন্দর করে জওয়াব দিতেন।
এ সময়ে খাকসার আন্দোলনের দ্বারা ছাত্ররা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিল। চল্লিশের আগ পর্যন্ত আমি খাকসার আন্দোলনের বলতে গেলে একজন কর্মীই ছিলাম। এ আন্দোলন এবং তার নেতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মাওলানা যে জওয়াব দিতেন, তা আমার মনঃপূত হতো না বলে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারিনি। তাঁর সাহিত্যও পড়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। সে সময়ে খাকসার আন্দোলন এবং তার মুখপত্র ‘আল-ইসলাহ’ সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ আন্দোলন আমাদের মন-মস্তিষ্ক প্রভাবিত করে রেখেছিল।
চল্লিশের ২৩ শে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ অধিবেশনে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মরহুমের ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হই। তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা, চরিত্রের দৃঢ়তা, তাঁর সততা এবং কার্যকলাপে পরিপূর্ণ নিষ্ঠা আমাকে খাকসার আন্দোলন থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে টেনে আনে।
আমার জীবনের তৃতীয় পর্যায়ে আমি ‘প্রগতিশীল’ সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। এ সময়ে মার্কস, লেনিন ও স্টালিনের বই পত্র পড়াশুনা করি। তারপর এ মতবাদের লোকদের প্রতি আকৃষ্ট হই। এতদসত্ত্বেও একটি ধর্মীয় পরিবারের সাথেই আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সামাজিক পরিবেশ আমাকে কমিউনিজমের দিকে টেনে নিয়ে যায়। বাড়িতে আব্বা মরহুমের সাথে আমার প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হতো। এমন এক জাহিলিয়াতের বেড়াজালে আটকে পড়েছিলাম যে, আল্লাহ মাফ করুন, আব্বা মরহুম আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন।
পাকিস্তান হতে তখনও বাকী। এদিন আব্বা মরহুম আমাকে মাওলানা মওদূদীর ইংরেজী বই Towards Understanding Islam পড়তে দেন। বইখানা পড়লাম। তারপর আবার পড়লাম। আমার উপর বইখানির প্রভাব এই হলো যে, আমার মন-মস্তিষ্কের উপরে জমে ওঠা গোমরাহীর অন্ধকার দূর হয়ে গেল। মাওলানার অকাট্য যুক্তি ও বর্ণনাভঙ্গি ছিল বড়ই হৃদয়গ্রাহী, যার ফলে তাঁর অন্যান্য সাহিত্যও পড়াশুনা শুরু করলাম।
পাকিস্তান হওয়ার পর মাওলানা তাঁর ইছরার বাড়ির সামনে সবুজ-শ্যামল ঘাসে-ভরা ছোট্ট বাগানটিতে বিকেলবেলা বৈঠক করতেন। আমি যেখানে গিয়ে বসতাম। তখন অতটা ভিড় জমতো না। আমি মাওলানাকে অনেক আজেবাজে এবং অসঙ্গত প্রশ্ন করে বসতাম। মাওলানা তাতে কিছুই মনে করতেন না। প্রত্যেকটি কথার জওয়াব ধীর স্থির ও মিষ্টি ভাষায় দিতেন। বেখাপ্পা প্রশ্নেও কখনো তাঁর চেহারার উপরে বিরক্ত বা রাগের চিহ্ন দেখা যেত না। ‘তুলুয়ে ইসলাম’ পড়ে যেসব প্রশ্ন মনে জাগত, তা অকাতরে মাওলানাকে বলে ফেলতাম। মাওলানা যুক্তির শানিত অস্ত্র দিয়ে ভ্রান্ত প্রশ্নের খণ্ডন করতেন। তাঁর জওয়াবের ধরণটাই এমন ছিল যে, প্রশ্নকারী প্রভাবিত না হয়ে পারত না।
যদি আমার মত লোক শুধু যুক্তির ভিত্তিতে কমিউনিজম পরিত্যাগ করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, তাহলে এরূপ আরো অনেকেই নিশ্চয়ই হয়ে থাকবে, যারা নিশ্চিতরূপে মাওলানার সাহিত্যের প্রভাবে সৎ পথ গ্রহণ করেছে অথবা নিদেনপক্ষে জন্মগত মতবাদ থেকে সরে পড়েনি। মাওলানার এ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে অগাধ জ্ঞানের দিক দিয়ে মাওলানার মত আর কাউকে দেখিনি। এ জন্যে আমি তাঁকে আলবৎ এ যুগের মুজাদ্দিদই বলব।
আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, তোমার কাছে বিখ্যাত ব্যক্তি কে. তাহলে বলব, মাত্র তিনজন- আল্লামা ইকবাল, কায়েদে আযম, মাওলানা মওদূদী।
এ কে ব্রোহী
মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার চরিত্র ও ভূমিকা। যদি কোন মানুষের চরিত্র ও ভূমিকাকে পালটে দেয়া এবং তার মধ্যে কোন প্রকার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনে দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে যিনি এ কাজটি করেন তিনিই সে মানুষটির জীবনের স্থপিত বা নির্মাতা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমার মতে বর্তমানে পাকিস্তানে সবচেয়ে বিরাট ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন মাওলানা মওদূদী।
আমি এ কথার সত্যতা স্বীকার করছি যে, যদি এ প্রশ্ন করা হয়, সে ব্যক্তি কে যিনি পাকিস্তানবাসীর চরিত্র ও ভূমিকাকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছেন, তাহলে আমার উত্তর হবে মাওলানা মওদূদী। আমার দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে যে, আজ আমি যে কথা বলছি আগামীকালও তাই বলব। আর যদি আখেরাতে আল্লাহ তায়ালা আমার সাক্ষ্য গ্রহণ করতে চান, তাহলে সেদিনও এই সাক্ষ্যই দিব যা আজ দিচ্ছি।
শরীফুদ্দীন পীরযাদা
পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা যাঁরা ছিলেন মাওলানা মওদূদী ছিলেন তাঁদের প্রথম সারির লোক। তিনি এবং অন্যান্যগণ এ বিষয়ে যেসব পরিকল্পনা এবং প্রস্তাব পেশ করেন, পাকিস্তান সংগ্রামে তা দিগদর্শনের কাজ করেছে। মাওলানা মওদুদী একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের জন্যে যে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেন, তা ১৯৩৮ সালের অক্টোবর ও ডিসেম্বরের তর্জুমানুল কোরআনে প্রকাশিত হয়। আমার ভালোভাবে মনে আছে, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালনার সময় অন্যান্য সাহিত্যের সাথে তর্জুমানুল কোরআনের সংখ্যাগুলো নিয়মিতভাবে সঙ্গে রাখতেন এবং একজাতীয়তার ধ্বজাধারীদের যুক্তি খণ্ডনের জন্যে তর্জুমানুল কোরআনের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ে শুনাতেন।
মাওলানা আমের উসমানী, দেওবন্দ
মাওলানা মওদূদীই একমাত্র ব্যক্তি-যাঁর খোদা প্রদত্ত প্রদত্ত প্রতিভা, লেখনীশক্তি, দ্বীনের সুস্পষ্ট ধারণা, অতুলনীয় নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা শুধু পাকিস্তানেই নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এমন বিরাট সাহিত্য-ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছে যে, তার স্বীকৃতি দিতে গিয়ে বলতে হয়, এ সাহিত্য-ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছে যে, তার স্বীকৃতি দিতে গিয়ে বলতে হয়, এ সাহিত্য-ভাণ্ডারের তুলনায় সপ্তরাজ্য তুচ্ছ। আমার মনে হয়, তাঁর প্রণীত সাহিত্যের এক একটি পৃষ্ঠা এক একটি রত্নের সমতুল্য।
মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বিহারী
আমি আমার মুসলমান ভাইগণ, আলেম, সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও জাতির সুধীবৃন্দের নিকটে খোদা ও রাসূলের নামে আবেদন জানাচ্ছি যে, এমন অতুলনীয় ইসলামী চিন্তাশীল, অদ্বিতীয় সাহিত্যিক এবং জাতীয় সম্পদকে বাঁচানোর জন্যে যেন এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করেন এবং অবিলম্বে যথাসম্ভব নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রাম অক্ষুণ্ন রাখেন।
মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বিহারীর সাক্ষ্য
সংবাদপত্রের মাধ্যমে বারবার এ অভিযোগ করা হচ্ছে যে, আল্লামা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। আমি বেশ কিছুদিন যাবত অসুস্থ। তাছাড়া আমার উপায়-উপাদানও সীমিত। তথাপি আশা করেছিলাম যে, হকপন্থী আলেমগণ জনগণের কাছে সত্যকে তুলে ধরবেন। কিন্তু দেখছি যে কোন কারণে সত্যের আওয়াজও বন্ধ হয়ে আছে। এ জন্যে এ দায়িত্ব পালন করছি। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাক্তন মুসলিম লীগপন্থী হিসাবে আমি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও প্রত্যেক মুসলিম লীগপন্থীর অপরিহার্য দায়িত্ব মনে করছি এ বিষয়ে কথা বলার। এমন কি নিজেকে এ সত্যটি তুলে ধরার জন্যে খোদা ও রাসূল (সাঃ)-এর সামনে জওয়াবদিহির জন্যে দায়ী মনে করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি যে, আল্লামা মওদূদী কখনোই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেননি। বরং প্রকৃত ব্যাপার এই যে, যখন মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী মরহুম এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কংগ্রেসকে সমর্থন করতে গিয়ে ঘোষণা করেন যে, জন্মভূমির ভিত্তিতে জাতি গঠিত হয়, তখন আল্লামা মওদূদী বলেন, জাভি ধর্মের ভিত্তিতে হয়, দেশ বা জন্মভূমির ভিত্তিতে নয়। তিনি ইসলামী জাতীয়তা প্রমাণ করে শক্তিশালী সাহিত্য রচনা করেন। হযরত আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী কংগ্রেসী জমিয়তের জওয়াবে এবং তার মুকাবেলা করার জন্যে কোলকাতায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম কায়েম করেন। আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসলামী আল্লামা মওদূদীকে ইসলামের তরবারি বলে অভিহিত করেন এবং তাঁর প্রথম গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ জানান। বস্তুত আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী এবং জামায়াতে ইসলামী রেফারেন্ডামের সপক্ষে জনমত গঠন করেন, যার ফলে সীমান্ত প্রদেশ এবং সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখ্য যে, আল্লামা মওদূদী পাকিস্তান ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা কখনোই করেননি। তবে ভুল ধারণার সৃষ্টি এর থেকে হয়েছে যে, হযরত আল্লামা মওদূদী কতিপয় মুসলিম লীগ নেতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, তারা ইসলামী আইন বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করবেন। তার প্রমাণ এখনও পাওয়া যাচ্ছে যে, বিগত পঁচিত বছরেও ইসলামী আইন জারি হতে পারল না। নেতৃবৃন্দের প্রতি সন্দেহ পোষণের জন্যে এ অভিযোগ করা যেতে পারে না যে, তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন। তারপর রইল কায়েদে আযমের বিরোধিতার অভিযোগ। আল্লামা মওদূদী তা কোনদিনই করেননি। অবশ্য তিনি বারবার ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন। তিনি ইসলামের উপরে অমূর্য সাহিত্য ও বহু সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছেন। জাতি তার জন্যে কৃতজ্ঞ।
মাওলানা যাফর আহমদ আনসারী
অবিভক্ত ভারতের অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জায়েন্ট সেক্রেটারী মাওলানা যাফর আহমদ আনসারী বলেন-
মাওলানা মওদূদীর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় এলাহাবাদে ১৯৩৮ সালে। তখন জামায়াতে ইসলামী হয়নি। মাওলানা উঠেছিলেন ডাঃ নাযীর আলী যায়দীর বাড়িতে। এলাহাবাদ এলে তিনি এখানেই উঠতেন। দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হয় ১৯৪১ সালে সেও এলাহাবাদে হারদারায় হাকীম খালিদ সাহেবের বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে। এখানে তিনি ইসলামিয়া কলেজে বক্তৃতাও করেন। মাওলানার গভীর পাণ্ডিত্যের প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
কিছুকাল পর আমাকে দিল্লী চলে যেতে হয়। মাওলানা দিল্লী এলে অবশ্যই তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হতো। তিনি উঠতেন শ্বশুর বাড়িতে। একবার তিনি চৌধুরী মুহাম্মদ আলীর বাসায়ও উঠেছিলেন। তিনি আমার বাসায়ও আসতেন এবং ঘণ্টারপর ঘণ্টা ধরে আলাপ-আলোচনা হতো। পাকিস্তান হওয়ার আগেই তর্জুমানুল কোরআনের খণ্ডগুলো কায়েদে আযমের লাইব্রেরীর শোভাবর্ধন করছিলো।
পাকিস্তান হওয়ার পর মাওলানা আমার বাসায় কয়েকবার এসেছেন। মাওলানা অন্য কারো প্রস্তাব বা পরামর্শ মানতেন না এ কথা ঠিক নয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে নীতিগত কথা তিনি স্বীকার করে নিতেন। আমার একটা বদনাম আছে যে, আমার সাথে মাওলানার সাক্ষাতের পর তিনি কখনো কখনো জামায়াতের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতেন। মাওলানা প্রত্যেকটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। একটা যুক্ত পেশ করলে তা তাৎক্ষণাৎ মেনে নিতেন।
মাওলানার ব্যক্তিত্ব ছিল অতি বিরাট। অসীম ধৈর্যসহ এবং হাসিমুখে সমালোচনার সম্মুখীন হওয়া তার অন্যতম বিশিষ্ট গুণ ছিল। এ কথা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে, ইসলামের প্রসার ও সমুন্নতির জন্যে যে পথ তিনি সঠিক মনে করতেন তার প্রতি তিনি অটল ও অবিচল থাকতেন।
ডঃ ইবরাহীম আগাহ
তুরস্কের আংকারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ ইবরাহীম বলেন-
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বিরাট পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। এতো বড় স্কলার যে, সারা দুনিয়ায় তাঁর কথা হৃদয়ঙ্গম করা হয় এবং তাঁরঅভিমত মেনে নেয়া হয়। তুরস্কেও মাওলানা মওদূদী সর্বজন স্বীকৃত গ্রন্থকারগণের অন্যতম। তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
মাওলানা মওদূদীর সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। তবে তাঁর গ্রন্থের মধ্যেই তাঁর সাক্ষাৎ পাই। তিনি তাঁর গতিশীল ব্যক্তিত্বের দ্বারা যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন, তা বর্তমান যুগের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করছে এবং ভবিষ্যতে অধিকতর প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে।
ইয়াসিন উমর
সুদান জাতীয় পরিষদ সদস্য ইয়াসিন উমর বলেন-
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ইসলামী পুনর্জাগরণের আন্দোলন শুরু করেন। আধুনিক যুগে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি পাশ্চাত্য মতবাদ ও চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি যুক্তির কষ্টিপাথরে সুস্পষ্ট করে দেন যে, পাশ্চাত্য মতবাদ ও চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি যুক্তির কষ্টিপাথরে সুস্পষ্ট করে দেন যে, পাশ্চাত্য চিন্তাধারা মানবতার জন্যে ক্ষতিকর। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার মুকাবেলা করেছেন এবং অন্যকেও মুকাবেলার ক্ষেত্রে নিয়োজিত করেছেন। এ বিরাট কাজের সূচনা তিনি চিন্তার ক্ষেত্র থেকে করেন। তিনি এক নতুন বর্ণনাভঙ্গিতে ইসলামী মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির এমন এক চিত্র পরিস্ফুট করেন যে, যে সব মুসলমান পাশ্চাত্য চিন্তাধারার মুকাবেলা করতে না পারার কারণে ইসলাম থেকে সরে পড়েছিলো, তাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন হয় এবং যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলো তারাও ইসলামের দিকে ফিরে আসে। মাওলানা মওদূদীর সাহিত্য তাদের মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করেছে এবং মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের জন্যে এক বজ্র-কঠিন সংকল্প সৃষ্টি করে দিয়েছে। ….. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী শুধু পাকিস্তান ও এশিয়ায় নন বরং আফ্রিকা এবং সারা বিশ্বে মুসলমান যুব সমাজকে তাদের সঠিক পরিচয় সম্পর্কে অবহিত করেন। বিশ্ব যুব মুসলিমকে তিনি ইসলামকে কেন্দ্র করে একত্র করেছেন, ইসলামকে তাদের জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে দিয়েছেন।
ইতিহাসে সাইয়েদ মওদূদীর স্থান যে কত উচ্চে তা বলার আগে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই যে, তাঁর সাহিত্য অধ্যয়ন করার আগে আমি কমিউনিজমের প্রবক্তা ছিলাম। নিজেকে একজন কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্ট বলে পরিচয় দিতে আনন্দ পেতাম। একমাত্র সাইয়েদ মওদূদীর সাহিত্য আমাকে কমিউনিজমের অনুসারী হওয়া থেকে ইসলামের আলোকে টেনে এনেছে।
সাইয়েদ মওদূদীকে আমি বলব একজন মহান ব্যক্তি। কিন্তু আমি অনুভব করছি যে, এ শব্দটি তাঁর মহত্ত্ব বর্ণনা করতে অপারগ। সাইয়ে মওদূদী এমন এক ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছেন, তিনি আজ একজন ইতিহাস-স্রষ্টা। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী পাশ্চাত্য সভ্যতা, চিন্তাধারা ও সংস্কৃতিকে পরাভূত করেছে। বস্তুত আজ এমন এক বিপ্লব সাধিত হয়েছে যে, মুসলিম যুব সমাজ নিজেদেরকে ’প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ বলার পরিবর্তে ‘ইসলামী’ বলার আওয়াজ তুলেছে। এ এক বিরাট পরিবর্তন বলতে হবে এবং কালের গতির সাথে সাথে এর প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
ডঃ সিরাজুল হক (বাংলাদেশ)
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের স্থান বহু উচ্চে। এত উচ্চে যে, শুধু এ কথা বললেই তার সঠিক অনুমান করা যাবে না। তিনি যে জ্ঞান-গবেষণার কাজ করেছেন, তার প্রভাব কয়েক বংশধর পর্যন্ত এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বলবৎ থাকবে। …. মাওলানা মওদূদীই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কোন বিষয়বস্তুর উপরে কলম ধরলে তারপর আর বলার কিছুই থাকে না। তিনি ঢাকায় গেলে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হতো এবং আমি এখানে এলেও সাক্ষাৎ হয়। এই শহর রাওয়ালপিণ্ডিতে একবার এমন পরিবেশে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিলো যে, তা কোনদিন ভুলতে পারব না। পিণ্ডিস্থ I DO NOT AGREE CLUB-এ একবার তিনি আমন্ত্রিত হন। আমাকেও আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো। মাওলানা তাঁর ভাষণের মাধ্যমে সবাইকেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করে ফেলেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় এমন কিছু নতুন আলোকের সন্ধান ছিলো যে, তার সামনে আর কারো টিকে থাকা সম্ভব ছিলো না।
সাইয়েদ মওদূদী তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর যুগের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছেন। আগামীতে যা কিছু ঘটবে তার উপরেও তাঁর প্রভাব বিদ্যমান থাকবে। বরং কালের গতির সাথে সাথে তাঁর প্রভাব তীব্রতর হতে থাকবে। তারপরে তাঁর পদাংক অনুসরণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে এবং তিনি অধিকতর শ্রদ্ধার পাত্র হিসাবে পরিগণিত হবেন। তিনি সকলের ‘প্রিয়জন’ এবং ‘প্রিয়জন’ হতেই থাকবেন। [I DO NOT AGREE CLUB জাঁদরেল সিএসপি এবং উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারীদের একটি বিশেষ ক্লাব। – গ্রন্থকার।]