ভারত বিভাগের পর
ভারত বিভাগের পর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় দফতর লাহোরে স্থানান্তরিত হয়। জামায়াতে ইসলামী “পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী” ও “ভারতীয় জামায়াতে ইসলামী” নামে দু’টি স্বতন্ত্র জামায়াতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মাওলানা মওদূদী এবার পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন।
ঊনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালের অক্টোবর থেকে পরবর্তী বছরের জানুয়ারী পর্যন্ত পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী লাহোর মুহাজির ক্যাম্পে সেবা কার্যে আত্মনিয়োগ করে।
এটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যত রূপ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদী ছয় বছর পূর্বে আলীগড়ের স্ট্রাচী হলে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, রাষ্ট্রের জন্মলাভের পর থেকেই তা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হতে দেখা গেল। শিশু রাষ্ট্রের লালন-পালনের ভার যারা গ্রহণ করলেন, তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, আকীদা-বিশ্বাস ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের মোটেই অনুকূল ছিল না। যে মহান উদ্দেশ্যের জন্যে লক্ষ লক্ষ মুসলমান নর-নারী জান-মাল ও সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছিল, পাকিস্তান অর্জনের পর ব্রিটিশ শ্বেতপ্রভূদের আসন যারা অলংকৃত করলেন, তারাও পাকিস্তানবাসীর কালো প্রভু সেজে পাকিস্তান হওয়ার সে মহান উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালেন। একমাত্র আল্লাহর দ্বীন কায়েম করার জন্যে যে লক্ষ্ লক্ষ প্রাণ জিহাদী অনুপ্রেরণায় শাহাদাতের পূর্ণ পাত্র পান করেছিল, তাদের মহান আত্মত্যাগ বিস্কৃত হয়ে নব রাষ্ট্রের শাসকবৃন্দ ব্রিটিশ প্রভুরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চললেন। উপরন্তু এ শিশু রাষ্ট্রকে ইসলামী ছাঁচে ঢালবার কোন ক্ষুদ্রতম বাসনাও তাদের মনে আছে, আকার-ইঙ্গিতে তাও বুঝতে পারা গেল না। অতএব পাকিস্তান অর্জনের পাঁচ মাস পরে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে লাহোর আইন কলেজে মাওলানা মওদূদী তাঁর প্রথম বক্তৃতায় দাবি করেন যে, পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা ইসলামী হতে হবে। পুনরায় ফেব্রুয়ারী মাসে উক্ত কলেজেই “ইসলামী আইন” সম্পর্কে বক্তৃতা প্রসঙ্গে মাওলানা চার দফা দাবি পেশ করেন। মার্চ মাসে করাচীর জাহাঙ্গীর পার্কের ঐতিহাসিক জনসমাবেশে তিনি তাঁর চার দফা দাবি বিশ্লেষণ করে বক্তৃতা করেন। চার দফা দাবি এই-
(১) পাকিস্তান রাষ্ট্রের সার্বভৌম মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ারা এবং এ রাষ্ট্রে একমাত্র তাঁরই ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
(২) এ যাবত যত প্রকার ইসলাম-বিরোধী আইন বলবৎ আছে, তার সবই রহিত করতে হবে।
(৩) একমাত্র ইসলামী শরীয়তই হবে পাকিস্তানের যাবতীয় আইন-কানুনের উৎস।
(৪) শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যেই পাকিস্তান তার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে পারে।
উক্ত চার দফা দাবি পাকিস্তান রাষ্ট্র ও গণপরিষদ কর্তৃক মেনে নেওয়ার জন্যে জামায়াতে ইসলামীই সর্বপ্রথম এক গণ-আন্দোলন শুরু করে। তিন মাসের মধ্যে এ আন্দোলন এমন তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, শাসকগণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইসলামী জনতার এ চার দফা দাবিতে নতি স্বীকার না করলেও তা অস্বীকার করার সাহসও তাদের ছিল না। তার কারণ ছিল এই যে-
এ ছিল সম্পূর্ণ ইসলাম সম্মত দাবি এবং বিগত দশ বছর থেকে তারা জনসাধারণের স্কন্ধে সওয়ার হয়েছিলে এ ইসলামেরই নাম করে। তাই এখন ইসলামী দাবি অস্বীকার করার দুঃসাহস তাদের নেই।
দাবিগুলো ছিল সকল দিক দিয়েই ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত।
দাবিগুলোর পশ্চাতে ছিল একটা সুসংগঠিত ও সুদৃঢ় আন্দোলন।
জনসাধারণ এত দ্রুততার সাথে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে, এর বিরোধিতা হতো জনগণের বিরোধীতারই শামিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ইসলাম বিমুখ শাসকগণ অবশেষে পশ্চাদ্দার দিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। তারা ইসলামী আন্দোলন বানচাল করার জন্যে নিম্নের অপকৌশল অবলম্বন করলেন। তারা অপপ্রচার শুরু করলেন যে-
(১) মাওলানা মওদূদী কাশ্মীরের যুদ্ধকে জিহাদ বলে মানতে রাজী নন।
(২) জামায়াতে ইসলামী সৈন্য বিভাগে ভর্তি হতে নিষেধ করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল করেছে।
(৩) জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রের আনুহত্য স্বীকার করতে চায় না।
দেশের সকল প্রকার প্রচারযন্ত্র রাষ্ট্রের করায়ত্ত থাকে বলে সরকার সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য বলে ফলাও করতে পারে এবং এ সবের সমালোচনা ও প্রতিবাদ বন্ধ করে দিতে পারে। এ ব্যাপারেও তাই হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব স্যার জাফরুল্লাহ খান ১৯৪৮ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী জাতিপুঞ্জের বৈঠকে ঘোষণা করেন যে, তার সরকার কাশ্মীর যুদ্ধকে জিহাদ বলে মেনে নিতে নিষেধ করেছে। মাওলানা মওদূদীকে কাশ্মীর যুদ্ধকে জিহাদ বলে ঘোষণা করতে বলা হলে তিনি বলেন, “কোন একটি দেশের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার দায়ত্ব হয় একটা রাষ্ট্রের, এ কাজ কোন ব্যক্তির নয়।
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেখানে কাশ্মীর যুদ্ধকে জিহাদ বলে ঘোষণা করতে বিশেষ করা হচ্ছে, সেখানে সেই রাষ্ট্রের অধীন কোন ব্যক্তি বা দল কি করে একে জিহাদ বলে ঘোষণা করতে পারে? কিন্তু তথাপি ব্যক্তিগতভাবে মাওলানা মওদূদী এবং দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী কাশ্মীর যুদ্ধে সর্বপ্রকার সক্রিয় সহযোগিতা করেন।
মাওলানা ও জামায়াতের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগও ঠিক এমনি অমূলক ও দুরভিসন্ধিমূলক ছিল। এগুলোর কোন প্রমাণ কেউ আজ পর্যন্ত পেশ করতে পারেনি। একেই বলে সরকারী প্রচারযন্ত্রের পুকুর চুরি।
মাওলানা মওদূদীর প্রথম কারাবরণ
ইসলামী দাবিগুলো সরাসরি অস্বীকার না করে শাসকবৃন্দ মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে তা চানচাল করার অপপ্রয়াসে মেতে উঠলেন। সরকারী প্রচারযন্ত্রের সাহায্যে তারা উক্ত অমূলক কাহিনী ফলাও করে প্রচার করতে লাগলেন এবং মিথ্যা ও দূরভিসন্ধিমূলক অজুহাতে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর বাদ মাগরিব জামায়াতের বিশিষ্ট কয়েকজন নেতাসহ (মিয়া তোফাইল মুহাম্মদ ও মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী) মাওলানা মওদূদীকে কুখ্যাত সাম্রাজ্যবাদী নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে মূলতান জেলে রাখা হয়। এক মাস পর তার মিয়াদ আরও ছ’মাস বাড়িয়ে দেয়া হয়।
এগারই অক্টোবর মাওলানা আব্দুল জব্বার গাজী জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন এবং আন্দোলন পূর্ণ মাত্রায় অব্যাগত রাখেন। সকল প্রকার সরকারী দুষ্ট প্রচারণা ক্রমশ লোকচক্ষে ধরা পড়তে লাগল এবং ইসলামী আন্দোলনও জোরদার হতে লাগল। জনসাধারণও অধিকতর সহানুভূতি ও সহযোগীতার সাথে আন্দোলনে যোগদান করতে লাগল। মুসলিম লীগ সমর্থক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম জনসাধারণের সমর্থনে জামায়াতের কর্মীগণ এমন প্রচণ্ড বেগে এ আন্দোলন পরিচালনা করলেন যে, ১৯৪৯ সালের ১২ই মার্চ পাকিস্তান জণপরিষদ কর্তৃক ঐতিহাসিক “আদর্শ প্রস্তাব” গৃহীত হলো।
“আদর্শ প্রস্তাব” গৃহীত হওয়ার পর অনুমান করা হয়েছিল যে, জামায়াতে ইসলাম এবং সরকারের মধ্যে যে অসন্তোষের কারণ ছিল তা এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর দূরভূত হবে। বস্তুত জামায়াতের মজলিসে শূরা ১৩ই মার্চে এক বৈঠকে আদর্শ প্রস্তাবের জন্যে সরকারকে মুবারকবাদ জানায়। অনেকে এও আশা আশ্চার্যের বিষয় এই যে, ১৯৪৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল থেকে পুনরায় ছ’মাসের জন্য তাঁর কারাবাসের মিয়াদ বৃদ্ধি করা হলো। এতদসত্ত্বেও জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা ৬ই, ৭ই এবং ৮ই এপ্রিলের বৈঠকে সরকারের সাথে পূর্ণ সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করে, যাতে আদর্শ প্রস্তাবকে ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র রচনার কাজ অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু সরকারের ক্রোধবহ্নি তখনও নির্বাপিত হয়নি। জনতার চাপে অনিচ্ছাসত্ত্বেও “আদর্শ প্রস্তাব” মেনে নিতে হয়েছে বলে তার পূর্ণ প্রতিশোধ মাওলানা মওদূদীর উপর নিতে হবে বলে তারা পণ করে বসলেন। ১৯৪৯ সালে ৪ঠা অক্টোবর সরকার তৃতীয় বার মাওলানার বন্দী জীবন আরো ছ’মাসের জন্য বাড়িয়ে দেন। মাওলানাকে বিনা বিচার ও বিনা কারণে সুদীর্ঘকাল লৌহ যবনিকার অন্তরালে রাখার কারণই হলো এই যে, ইসলামী আন্দোলনের নেতাকে এভাবে জব্দ করতে হবে এবং তাঁর দল ও জামায়াতকে খতম করতে হবে।
আদর্শ প্রস্তাব গৃহী হওয়ার পর ইসলাম বিমুখ শাসকদের ভূমিকা
ঊনিশ শ’ ঊনপঞ্চাশ সালে অক্টোবর থেকে ১৯৫০ সালের মে মাস পর্যন্ত এই আট মাস কাল জামায়াতের কর্মীগণকে বড় দুর্দিনের সম্মুখীন হতে হয়। “আদর্শ প্রস্তাব” অনুযায়ী তাঁরা সমগ্র পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি করেছিল যে, হয়ত এখন সরকার মাওলান মওদূদীকে মুক্ত করে দেবেন। কিন্তু করে আন্দোলন শুরু করেন। মাওলানা মওদূদীর তৎকালীন দু’খানি গ্রন্থ, যথা- “ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন” ও “ইসলামী শাসনতন্ত্রের মূলনীতি” বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু শাসকগণ ইসলামী শাসনতন্ত্র ঠেকিয়ে রাখার জন্যে বাহানা খুঁজতে লাগলেন। তাঁরা নানাভাবে ঘোষণা করতে লাগলেন যে-
কাশ্মীর বিপন্ন- অতএব শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব নয়।
পাকিস্তান এখন বিপন্ন-অতএব এটা জিহাদের সময়, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় নয়।
“মোল্লাদের” শাসন হলেই তা ইসলামী শাসন হয় না। বরং মুসলমানদের যে কোন শাসনকেই ইসলামী শাসন বলে।
আদর্শ প্রস্তাব” পুরাতন জীর্ণ ইসলামের নীতি অনুযায়ী করা হয়নি বরং করা হয়েছে পাশ্চাত্যের আধুনিক ইসলাম অনুযায়ী।
আধুনিক যুগের কোন প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্যে ইসলামী আদর্শে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন যুক্তিসঙ্গত নয়।
ধর্মীয় গোঁড়ামীর নামে রাষ্ট্র গঠিত হলে আধুনিক দুনিয়া উপহাস করবে।
জামায়াতে ইসলামীর কর্মীগণ সুসংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণাদির দ্বারা ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর উপরিউক্ত অপপ্রচারণার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে চললেন এবং সমগ্র পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে এক শক্তিশালী জনমত গড়ে উঠতে লাগল।
মাওলানার মুক্তি
ইসলামী আন্দোলনের অগ্রদূত এবং বর্তমান যুগের বিপ্লবী ইসলামী নেতাকে বিনা অজুহাতে কারা প্রাচীরের অভ্যন্তরে আটকিয়ে রাখা শাসকদের পক্ষে আর সম্ভব হলো না। ১৯৫০ সালের ২৮শে মে আইন ঘটিত বাধ্যবাধকতার জন্যে সরকার মাওলানাকে মুক্তি দিলেন। উনিশ মাস পঁচিশ দিন পর লৌহ যবনিকার অন্তরাল থেকে মাওলানা সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী জগতের মুক্ত আবহাওয়ায় ফিরে এলেন। মুক্তির পর পুনরায় জামায়াতে ইসলামী তাঁকে আমীর পদে বরিত করল।
মাওলানার মুক্তির পর জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাস যাবত সরকারপক্ষ “আদর্শ প্রস্তাবের” নানাভাবে বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা করে ইসলামী শাসনতন্ত্রের পথ রুদ্দ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মাওলানার নেতৃত্বে জামায়াতের কর্মীবৃন্দ তাঁদের অকাট্য যুক্তি-প্রমাণাদির দ্বারা তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন এবং “আদর্শ প্রস্তাবের” মূল লক্ষ্য জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেন। সরকার বাধ্য হয়ে সেপ্টেম্বর মাসে শাসনতন্ত্র মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট গণপরিষদে পেশ করেন। এই রিপোর্টের ভেতর দিয়ে পাশ্চাত্য ঘেষা শাসক শ্রেণীর মনের স্বরূপ প্রস্ফুটিত হয়ে পড়ে। কারণ যা কিছু ইসলামের বিপরীত ছিল তাই এত সন্নিবেশিত করা হয়েছিল এবং আদর্শ প্রস্তাবের সাথে এর কোন সামঞ্জস্যই ছিল না। অতএব ১৪ই অক্টোবর লাহোরের মুচিদরজায় অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় মাওলানা মওদূদী উক্ত রিপোর্টের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ গড়ে উঠল এবং সরকার বাধ্য হয়ে শাসনতন্ত্র মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট ও সুপারিশসমূহ প্রত্যাহার করেন। অতঃপর সরকার হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। অবশ্য সরকারের কিছু পাশ্চাত্যমনা তাবেদার উলামা সম্প্রদায়ের প্রতি কটাক্ষ করে ইসলামী শাসনতন্ত্রের খসড়া পেশ করার চ্যালেঞ্জ দেন।
আলেমদের ঐক্যবদ্ধ দাবি
অতঃএব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানের একুশ জন প্রসিদ্ধ আলেক উক্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ১৯৫১ সালের ২১ শে জানুয়ারী করাচী মহানগরীতে সমবেত হন। তাঁদের সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে ২২ দফা মূলনীতি প্রণয়ন করে সরকারের নিকট পেশ করা হয়। এবং তা জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা হয়। এটা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্রের এক শক্তিশালী “চর্চার” হিসাবে পরিগণিত হয়। উলামা কর্তৃক উপস্থাপিত এই ২২ দফা মূলনীতি জামায়াতে ইসলামী বিপুল সংখ্যায় প্রকাশ করে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। এতে সরকারের ইসলাম বিরোধী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এরপর থেকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন পূর্ণ উদ্যমে শুরু হলো। কিন্তু এতে করেও যখন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ বিলম্বিত হতে থাকে, তখন জামায়াতে ইসলামী ৯ দফা দাবি সম্বলিত ছাপানো কাগজে জনগণের স্বাক্ষর অভিযান শুরু করে দেয়। উক্ত ৯ দফা দাবি ছিল-
ইসলামী শরীয়তই হবে দেশের শাসনতন্ত্রের প্রকৃত উৎস।
শরীয়তের খেলাপ কোন আইন প্রণয়ন করা চলবে না।
সকল শরীয়ত বিরোধী আইন-কানুন বাতিল করতে হবে।
সরকারের কর্তব্য হবে ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ করা।
আদালতে বিচার ব্যতিরেকে নাগরিক অধিকার হরণ করা চলবে না।
শাসন বিভাগ এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দেশের আদালতে বিচার প্রার্থনা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
বিচার বিভাগে শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ চলবে না।
মানবের মৌলিক প্রয়োজন, যথা-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসা- এ পাঁচটি বিষয়ের পূর্ণ দায়িত্ব সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
কাদিনী সম্প্রদায়কে অমুসলমান সংখ্যালঘু ঘোষণা করতে হবে।
কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অমুসলমান সংখ্যালঘু ঘোষণা করতে হবে।
উক্ত নয় দফা দাবিতে স্বাক্ষর অভিযান ব্যতীতও ব্যক্তিগতভাবে এবং সভা-সমিতির পক্ষ থেকে পত্র ও তারযোগে বিলম্বে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জ্ঞাপনের জন্যেও সমগ্র দেশব্যাপী এক অভিযান পরিচালিত হয়। ১৯৫২ সালের শেষ পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত থাকে।
এ বছর পাকিস্তানের এক অতি মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর রাওয়ালপিণ্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। পাকিস্তানের রাজনীতির আকাশে যে এক অশুভ উপগ্রহের উদয় হয়েছিল, তার পরিণামস্বরূপ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানের ইতিহাসকে মসিলিপ্ত করে দিল। যা হোক মরহুম লিয়াকত আলী খানের পর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।
এ বছরই ২১ শে নভেম্বর করাচীতে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে উপরের ৯ দফা দাবিতে এক ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, যদি এবারের শাসনতন্ত্রের খসড়াটি পূর্বের মতোই অনৈসলামিক হয়, তাহলে ইসলামী জনতা সে খসড়াটি তার প্রণেতাদের মুখের উপরই ছুঁড়ে মারবে। অতঃপর সেদিন বিভিন্ন প্লাকার্ডসহ ইসলাম শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবিতে যে সুদীর্ঘ শোভাযাত্রা বের হয় তা দেখে শাসকবৃন্দ হতবাক হয়ে যান। করাচী শহরে এর ফলে এমন এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় যে, সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং বছরের শেষে ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয়বার শাসনতন্ত্রের খসড়া পেশ করেন।
এবারে শাসনতান্ত্রিক সুপারিশগুলো বিবেচনা করে দেখার জন্যে ১৯৫৩ সালের জানুয়ারী মাসে করাচীতে ৩১ জন বিশিষ্ট আলেমের এক সম্মেলন হয়। ১৮ই জানুয়ারী আলেমগণ উক্ত শাসনতন্ত্রের খসড়া সম্পর্কে তাদের অতীব যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাবাদি পেশ করেন।
এ মাসেই কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু ঘোষণা করার জন্যে করাচীতেই এক সর্বদলীয় কনভেনশন আহূত হয়। মাওলানা মওদূদীও উক্ত কনভেনশনে যোগদান করেন। তিনি কনভেনশন একথার উপর জোর দিয়ে বলেন যে, কাদিয়ানী সমস্যাকে পৃথকভাবে বিবেচনা না করে, একে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যেই শামিল করা হোক।
সর্বদলীয় কনভেনশন কর্তৃক ডাইরেক্ট একশান
সাতাশে ফেব্রুয়ারী (১৯৫৩) করাচীতে সর্বদলীয় কনভেনশনের কার্যকরী সংসদের এক অধিবেশন হয়। এতে কাদিয়ানী সমস্যা সম্পর্কে সরকারকে বাধ্য করার জন্যে “ডাইরেক্ট একশান” বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ অধিবেশনে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি Direct Action বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং কনভেনশন থেকে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কচ্যুতি ঘোষণা করেন। পরের দিনই “ডাইরেক্ট একশানের” নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয় এবং করাচীর শহরে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু পাঞ্জাবে এ এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
পাঞ্জাবে যে গোলযোগ হয়েছিল সরকারী ভাষায় যাকে Punjab Disturbances বলা হয়, এর পেছনে পশ্চিম পাঞ্জাব সরকারের উস্কানি ছিল বলে মনে করা হয়। গোলযোগের মূল কারণ এই ছিল যে, জনসাধারণের কিছু ন্যায্য দাবি নস্যাৎ করা হয়েছিল। সর্বদলীয় কনভেনশনে পাকিস্তানের সমস্ত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলিই শামিল ছিল, যথা- মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, মজলিশে আহরার, জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান, জমিয়তে আহলে হাদীস, আঞ্জুমানে তাহাফফুযে হুকুকে শিয়া প্রভৃতি। এসব দলের সম্মিলিত দাবি ছিল যে, কাদিয়ানীদেরকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে ঘোষণা করা হোক। এ ধরনের ছোট খাটো আরও দু’একটি দাবি এ ছিল পাকিস্তানের জনগণের দাবি। কারণ উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের সকল শ্রেণীর মুসলমানেরই প্রতিনিধিত্ব করছিল। সরকার এ দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করায় Direct action বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উপরে বলা হয়েছে, পাঞ্জাব ব্যতীত অন্য কোথাও এ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কার্যকর হয়নি। পাঞ্জাবেও সম্ভবত হতো না। কিন্তু পাঞ্জাব সরকার এখানে মারাত্মক ভুল করেছেন বলে মনে করা হয়। পাঞ্জাবে দৌলতানা মন্ত্রিসভা কায়েম ছিল। মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম এ যেন দৌলততানা মন্ত্রিসভার মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট করলো। অতএব কালো ছায়া দেখেই ভূতের ভয়ে আঁতকে ওঠা শুরু করলো। ৪ঠা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত এ গোলযোগ চলছিল। প্রথম দিন থেকেই জনসাধারণের উপরে পুলিশ নির্মমভাবে লাঠিচার্জ ও গুলী বর্ষণ শুরু করে। ৪ঠা মার্চ অপরাহ্নে জনৈক ছদ্মবেশী পুলিশ এক জনসভায় হাজির হয়ে জানালো যে, পুলিশ অমুক স্থানে জনতার উপর লাঠিচালনা করেছে এবং জনৈক ব্যক্তির গলায় বাঁধা কোরআন শরীফ লাথি মেরে ছিন্নছিন্ন করে ছড়িয়ে দিয়েছে। অতঃপর সে কোরআনের কিছু ছিন্ন পাতা জনতাকে দেখিয়ে দিল। এর ফলে জনতা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। সাধারণ মানুষ, শ্রমিক-মজুর, ছাত্র-শিক্ষক এমনকি সরকারী দফতরের কর্মচারীবৃন্দও সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ প্রকাশ করলো। এভাবে সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে প্রবলভাবে উত্তেজিত করে তোলা হচ্ছিল।
অপর একটি ঘটনা এ জ্বলন্ত আগুনে জ্বালানী কাঠ সংযোগ করল। ঐ একই দিনে একখানা জীপ গাড়ী থেকে জনসাধারণের উপরে অবিরল গুলি বর্ষণ করা হচ্ছিল। অনুসন্ধানে জানতে পারা গেল, জীপ গাড়ীতে কয়েকজন কাদিয়ানী আরোহণ করেছিল।
এভাবে সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড দাবানল প্রজ্জ্বলিত হয়। কিন্তু বেশীদিন এ গোলযোগ চলতে পারেনি। ৬ই মার্চ লাহোরে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গোলযোগ সম্পূর্ণ থেকে যায়।
৪ঠা এবং ৫ই মার্চ মাওলানা মওদূদীর সভাপতিত্বে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অধিবেশনে “প্রত্যক্ষ সংগ্রামের” তীব্র নিন্দা করা হয় এবং এর ভয়াবহ পরিণাম বিশ্লেষণ করে জনসাধারণকে এ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানানো হয়। এ সময়ে মাওলানা মওদূদীর ‘কাদিয়ানী সমস্যা’ নামক একখানা পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এ বইখানিতে তিনি মুসলমানদের ও কাদিয়ানীদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিশ্লেষণ করে সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু সমাধান পেশ করেন।
মাওলানা মওদূদীর প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশ
আটাশে মার্চ হঠাৎ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের কোন কারণ বলা হলো না।
“কাদিয়ানী সমস্যা” পুস্তিকার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে বিদ্বেষ প্রচার এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অভিযোগে মাওলানা মওদুদীর এবং তাঁর সহকর্মী মালিক নসরুল্লাহ খান আজিজ ও জনাব নকী আলীকে সামরিক আদালতে অভিযুক্ত করা হয়। উক্ত অভিযোগেই মাওলানা মওদূদীর প্রতি ৮ই মে সামরিক আদালত কর্তৃক ফাঁসীর আদেশ দেওয়া হয়।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, যে পুস্তিকা প্রণয়নের জন্যে গ্রন্থকারের প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হলো, সে গ্রন্থখানি বাজেয়াফত করার সাহস কর্তৃপক্ষের হলো না। সামরিক আদালতে বিচার চলাকালে লাহোর শহরেই উক্ত পুস্তিকা শত শত সংখ্যায় বিক্রি হচ্ছিল। পুস্তিকাটির কোথাও এমন কোন বিষয় ছিল না যা আইনের চোখে দূষণীয় হতে পারে। বরঞ্চ “কাদিয়ানী সমস্যা” গ্রন্থখানিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার গোলামগণ এবং ইসলাম ও ইসলামী আইনের দুশমনগণ ছলে-বলে কৌশলে ইসলামী আন্দোলনের মৃত্যুঞ্জয়ী বীর সেনানীকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে অপসারণের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন। মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তান এবং বহির্জগত থেকে সরকারের এহেন হঠকারিতা ও অপরিণামদর্শিতার তীব্র নিন্দা করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রত্যাহারের দাবি উত্থিত হয়। পৃথিবীর সমুদয় মুসলিম দেশে এমন বিক্ষোভের সৃষ্টি হয় যে, সামরিক আইনের প্রধান কর্মকর্তা মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে মাওলানাকে চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
ফাঁসীর আদেশে মাওলানা মওদূদীর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সমগ্র মুসলিম জগতে তাঁর জনপ্রিয়তা এবং আল্লাহরই জন্যে জ্ঞান কোরবানের যে মহান মহিয়ায়ম নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা ইসলামের ইতিহাসে অক্ষয় কীর্তি হয়ে থাকবে। তাঁর প্রতি ফাঁসীর আদেশ, অতঃপর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে জামায়াতে ইসলামীকে ভগ্নোৎসাহ না করে বরঞ্চ তার কর্মীবৃন্দকে শত গুণে জিহাদী অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি বহুগুণে বর্ধিত করেছ্ ইতিহাসের এ শিক্ষা যে, আবহমান কাল থেকে সকল কালে, সকল যুগেই ইসলামী আন্দোলন বিরোধী শক্তির ধাক্কা খেয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়েছে। তার দুর্বার অনমনীয় শক্তির সম্মুখে যারাই প্রতিরোধ গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছে, তারাই ভেসে গেছে এর প্রবল স্রোতে, মুছে গেছে ধরাপৃষ্ঠ থেকে তাদের নাম ও নিশানা।
এ প্রসঙ্গে এ কথা উল্লেখ না করে পারা যায় না যে, এক শ্রেণীর ইসলাম ও ইসলামী শাসনতন্ত্র বিরোধী লোক মাওলানা মওদূদীর প্রতি এ মিথ্যা অভিযোগ করে থাকেন যে, পাঞ্জাবের কাদিনয়ানী দাঙ্গার জন্যে তিনি প্রধানত দায়ী এবং তাঁরই উস্কানিতে তথায় হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে। উপরে যে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিক কার্যক্রম আলোচনা করা হয়েছে, তার মধ্যে কোথাও কণামাত্র অসত্য অথবা অতিরঞ্জনের লেশ নেই। এ আমরা গর্ব করে বলতে পারি। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় না যে, মাওলানা মওদূদী পাঞ্জাবের দাঙ্গার জন্যে দায়ী ছিলেন। স্বার্থবাদী লোকেরা একে “কাদিয়ানী দাঙ্গা” আখ্যা দিয়েছে এবং প্রথম কথা এই যে, এটা মোটেই “কাদিয়ানী দাঙ্গা” ছিল না এবং এতে হাজার হাজার লোকও নিহত হয়নি। কাদিয়ানীদের অমুসলিম সংখ্যালঘু হিসাবে ঘোষণা করার জন্যে সর্বদলীয় কনভেনশন সরকারের নিকট দাবি জানান। সরকার এ দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করলে উক্ত কনভেনশন সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম (Direct Action) অবলম্বন করে। এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে সরকার এবং জনসাধারণের মধ্যে সংগ্রাম। একে দমন করার জন্যে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং সামরিক বাহিনীর গুলিতে ১১ জন নিহত ও ৪৯ জন আহত হয়। (মুনির রিপোর্ট-পৃঃ ১ দ্রষ্টব্য)।
মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলাম এ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা তো দূরের কথা বরঞ্চ সর্বদলীয় কনভেনশনের “প্রত্যক্ষ সংগ্রামের” ও বিরোধিতা করেছে এবং জনসাধারণকেও তা থেকে বিরত থাকার জন্যে আবেদন জানিয়েছে। তাঁর প্রতি উক্ত অভিযোগ যে সম্পূর্ণ বিদ্বেষপ্রসূত, অমূলক ও ভিত্তিহীন, তা যে কোন বিবেকসম্পন্ন নিরপেক্ষ ব্যক্তি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করবেন।
মুনির রিপোর্টের কোথাও এ গোলযোগের জন্যে মাওলানাকে দায়ী করা হয়নি। এর জন্যে প্রধান দায়ী অধুনালুপ্ত আহরার দলের নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য দলকেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয়েছে। মজার ব্যাপার এই যে, দেশের এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী আদর্শহীন রাজনৈতিক দল আহরার দল প্রধানদেরকে নিয়ে নিজেদের দল গঠন করে আপন অপকর্ম ঢাকবার জন্যে মাওলানা মওদুদীকে পাঞ্জাব হাঙ্গামার জন্যে দায়ী করে।
আরও মজার ব্যাপার এই যে, সরকারী ভাষায় পাঞ্জাবের গোলযোগ (Punjab Disturbance) সংগঠিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। এটা ছিল সরকার ও জনগণের মধ্যে সংগ্রাম। এ গোলযোগের সাথে জামায়াতে ইসলামী তথা মাওলানা মওদূদীর দূরতম সম্পর্কও ছিল না।
অপরদিকে যে “কাদিয়ানী সমস্যা” বই লেখার অপরাধে মাওলানার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়, পাঞ্জাব গোলযোগের সাথে সে বইয়েরও কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামের হঠকারী ও অন্ধ দুশমনেরা এভাবেই মারাত্মক ভুল করেছে। যে বইয়ের জন্যে প্রাণদণ্ডাদেশ হলো, সে বই বাজেয়াফত হলো না, কোনদিন হয়নি, এখনো সে বই বাজারে পাওয়া যায়। সে বইয়ের মধ্যে এমন একটি ছত্রও নেই যার জন্যে লেখকের কোন ন্যূনতম শাস্তিও হতে পারে। কিন্তু বিনা দোষে হলেও ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তাকে রাতারাতি শেষ করতে হবে। অতএব একটা কারণ তো দেখাতেই হবে। কাদিয়ানী সমস্যা নামটিতেই ইসলামের দুশমনরা মনে করেছিল এটা একটা মারাত্মক গ্রন্থ। বইখানা পাঠ না করেই তাদের সম্ভবত এ ধারণা জন্মেছিল যে, বইখানিতে কাদিয়ানী নিধনের উস্কানি দেওয়া হয়েছে। বইখানা পড়ে দেখারও তাদের সময় ছিল না। এমনকি যে বইয়ের জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে, তা বাজেয়াফত করারও চিন্তা মনের মধ্যে আসেনি।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন কতিপয় ব্যক্তি তাদের মনের ব্যাধি গোপন করে ইসলামী আন্দোলনের মূল্যেৎপাটন করতে চেয়েছিল। তা পারেনি, তাদের গোপন মানসিকতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। ইসলামী আন্দোলন মরেনি, মাওলানা মওদূদীও মরেনি। কিন্তু প্রতিপক্ষের অপমৃত্যু ঘটেছে। তাদের অপমৃত্যু আমাদের কাছে আনন্দের নয়। তবে এটাই ইতিহাসের নির্মম বিচার।
পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, পাঞ্জাব দাঙ্গার পঁচিশ বছর পরও কিছু লোক মাওলানাকে শত শত কাদিয়ানীর হন্তা বলে গালি দিয়ে থাকে। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের চেয়ে এরা অধিকতর মারাত্মক মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে, তাতে সন্দেহ নেই। এদের জন্যে করুণা হয়। তাই তাদের এ মানসিক ব্যাধি নিরাময়ের জন্যে দোয়া করি।
সুবিচার এবং ন্যায়-নীতির এ এক নির্মম পরিহাস যে, যিনি বা যারা পাঞ্জাব হাঙ্গামার জন্যে প্রত্যক্ষ দায়ী, তাদের কারো প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়নি। মাওলানা মওদূদীর একমাত্র দোষ এই যে, তিনি পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বলা বাহুল্য, তাকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে রাতারাতি অপসারিত করে ইসলামী আন্দোলন বানচাল করাই ছিল স্বার্থবাদীদের মনের একান্ত বাসনা। কিন্তু আল্লাহ তায়ারা তাঁর প্রিয়জন ও দলকে যেএভাবেই বিজয়মণ্ডিত করেন, তা সম্ভবত ইসলাম বিরোধীদের জানা ছিল না।
************************************************
“আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে এবং তারা (বিপদে-আপদে, অত্যাচার ও উৎপীড়ন) আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট আছেন। তারাই আল্লাহর দলভুক্ত। অতএব সাবধান, মনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহর দল জয়যুক্ত হবে। মুজাদালা (২২)
ফাঁসী কক্ষে মাওলানা মওদূদী
মর্দে মুমিন যখন দীন-দুনিয়ার বাদশাহ আল্লাহর দরবারে নতশির, ইবাদতে মশগুল, তখন তাঁকে জানানো হলো মৃত্যুর পরওয়ানা। মৃত্যুদণ্ডাদেশে আল্লাহর পিয়ারা বান্দার চোখে -মুখে নেই কোন ভীতির চিহ্ন, নেই কোন উদ্বেগ। অম্লান বদনে হাসিমুখে ফাঁসীর আদেশ মেনে নিলেন ধন্যবাদের সাথে।
জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই। “কাদিয়ানী সমস্যা” পুস্তকখানার প্রকাশক ও মুদ্রাকর জনাব সাইয়েদ নকী আলী বলেন-
”আটই মে দেওয়ানী ঘরের প্রাচীন টেনিসকোর্টে আমরা মাগরিবের নামায পড়ছিলাম। মাওলানা ছিলেন ইমাম। মুক্তাদীদের মধ্যে জেলের নম্বরদার এবং বাবুর্চি ব্যতিরেকে আমরা ছিলাম পাঁচজন-মিঞা তোফাইল মুহাম্মদ, মাওলানা আমীন আহ্সান ইসলাহী, মালিক নসরুল্লাহ খান আজিজ, চৌধুরী মুহাম্মদ আকবর এবং আমি। আমরা যখন দ্বিতীয় রাকআতে, তখন হঠাৎ দরজা খুলে গেল এবং তারপর শোনা গেল কয়েকজনের পদধ্বনি। কিছু ফিসফাস এবং প্রত্যাবর্তনের শব্দ।
সুন্নাতের সালাম ফিরাত না ফিরাতে আবার শোনা গেল খটাখট। কয়েকজন সৈনিক এবং জেলখানার কর্মচারীকে ভিতরে আসতে দেখা গেল। একজন বললেন, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী কে?
মাওলানা শান্তকণ্ঠে বললেন- এই যে আমি, বলুন।
সরকারী কর্মচারী- তাসনীম সংবাদপত্রে দু’টি বিবৃতি প্রকাশের জন্যে আপনার সাত বছর সশ্রম কারাবাস এবং মালিক নসরুল্লাহ খান আজিজের তিন বছর। উভয়ে প্রত্যুত্তরে, “আচ্ছা ঠিক আছে” বলে নীরব রইলেন।
কর্মচারী পুনরায় বললেন- “কাদিয়ানী সমস্যা” পুস্তক প্রণয়নের জন্যে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর মৃত্যুদণ্ড এবং তার মুদ্রাকার সাইয়েদ নকী আলীর নয় বছর সশ্রম কারাদণ্ড।
আমরা উভয়ে ”আচ্ছা ধন্যবাদ” বলে চুপ করে রইলাম।
মাওলানার মৃত্যুদণ্ড ছিল একবারে অপ্রত্যাশিত। তবু কারও মুখে ছিল না কোন উদ্বেগ। তবে মন চিন্তা-ভাবনায় ভরে গেল। আমরা সকলে তাকালাম মাওলানার দিকে। দেখলাম তাঁর ধীর ওরশান্ত মূর্তি। দৃষ্টিতে বিরাট গভীরতা যেন গহীন সমুদ্রের অসীম গভীরতা।
কর্মচারী মাওলানার হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বললেন-
মাওলানা, আপনি ইচ্ছা করলে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন।
মাওলানা নীরবে মৃদু হাস্য সহকারে কাগজটুকু হাতে নিলেন। কর্মচারী বিদায়ের সময় বলে গেলেন-
– মাওলানা প্রস্তুত হোক আপনাকে একটু পরেই যেতে হবে।
– কোথায়?
– ফাঁসীর কুঠুরিতে।
– আমি তৈরি আছি।
অতঃপর আমরা নীরবে দেওয়ানী ঘরের কামরার দিকে চললাম। যেতে যেতে কর্মচারীকে বলতে শোনা গেল-
মালিক নসরুল্লাহ খান আজিজ এবং সাইয়েদ নকী আলী আপনাদেরও যেতে হবে। কিন্তু, আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনাদেরকাল সকালে নিয়ে যাব।
আমি এবং মালিক সাহেব যেন শুনেও শুনলাম না। কারণ মাওলানার মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ আমাদের এত শোকাভিভূত করেছিল যে, অন্য কোন দিকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল না।
দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চে সত্যপথের পথিকদের কতই না লাঞ্ছনা, কতই না নির্যাতন নিপীড়ন। আমরা সকলে দ্বীনে হকের নগণ্য খাদেম, সত্যপথের সংগ্রামী পুরুষদের সমপাংক্তেয় হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। অপরাধ? কাদিয়ানী সমস্যা বই প্রকাশের অপরাধ? এ তো শুধু দুনিয়াকে প্রতারণা করার জন্যে বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের অপরাধ হচ্ছে এই যে, আমরা পাকিস্তানে জাতি ও সরকারের যুক্ত শক্তিকে ইসলামের জন্য ব্যবহার করতে চাই। আল্লাহর দ্বীন কায়েম করাই আমরা আমাদের জীবনের লক্ষ্য করে নিয়েছি। শুধুমাত্র এই ছিল আমাদের অপরাধ।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। মাওলানাকে সত্যি সত্যিই ফাঁসীকক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এমন মনীষী যিনি শুধু পাক ভারতেই নন, সমগ্র আরব জগতেও বিরাট শ্রদ্ধার পাত্র আজ ফাঁসীকক্ষে? আমি ভাবছিলাম, একি সত্যি?
ইসলামী আন্দোলনের বীর মুজাহিদকে আজ ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলান হবে? জাতির মুঢ় পরিচালকগণ, যারা তাদের নির্বুদ্ধিতার কারণে পাকিস্তানে ইসলামের জয়জয়কার দেখতে চায় না- আজ এই পদক্ষেপ করতে চলেছে?
সত্যিই কি ইসলামী আন্দোলন তার শৈশবেই এই মহান ব্যক্তিত্ব থেকে বঞ্চিত হবে?
মাওলানার ধীর গম্ভীর স্পষ্ট উক্তি আমার কর্ণকুহরে ঝংকৃত হতে লাগল- আপনারা মনে রাখবেন যে, আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি তাদের কাছে কিছুতেই প্রাণ ভিক্ষা চাইব না। এমন কি আমার পক্ষ থেকে অন্য কেউ যেন প্রাণ ভিক্ষা না চায়- না আমার মা, না আমার ভাই, না আমার স্ত্রী-পুত্র পরিজন। জামায়াতের লোকদের কাছেও আমার এই নিবেদন।
মিঞা তোফাইল মুহাম্মদ সাহেব মাওলানার হোল্ড অল খুলে বিছয়ে দিলেন। আমরা সকলে মিলে তার মধ্যে জিনিসপত্র ভরতে লাগলাম। চামড়ার সুইকেটা মাওলানা এবং আমি সাজিয়ে ফেললাম। কারণ এ সবই মাওলানার বাড়ীতে ফেরত পাঠাতে হবে।
এদিকে একটা ছোট্ট বিছানা মাওলানার সঙ্গে ফাঁসীকক্ষে পাঠাবার জন্যে তৈরি করা হলো। একটা কাপড়ে বাঁধা খানা, কোরআন মজীদ এবং লোটা-গ্লাসও এসবের সঙ্গে দেয়া হলো।
আমার মুখে কথা ছিল না। হৃদয় কাঁপছিল। হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে আসছিল। মাওলানার মৃত্যুদণ্ডের ধারণা যেন ইলেকট্রিসিটির মতো শরীরের অণু-পরমাণুতে পরিব্যপ্ত হয়ে পড়ছিল। তোফাইল সাহেবের অবস্থাও ছিল ঠিক এমনি। মালিক নসরুল্লাহ খান আজিজ তাঁর ভাব-গম্ভীর মূর্তি নিয়ে পায়চারী করছিলেন এবং তাঁর মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে দোয়াও বেরুচ্ছিল। আমাদের সবার বয়োজ্যেষ্ঠ চৌধুরী মুহাম্মদ আকবর সাহেবের অবস্থা ছিল আজিব। তিনি শুধু দাঁড়িয়েছিলেন নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে। ইসলামী সাহেব কখনও পায়চারী করছেন, কখনও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। তাঁর দমিত আবেগ-উচ্ছ্বাস রক্তবর্ণ ধারণ করে মুখমণ্ডলে পরিস্ফুট হয়ে পড়ছিল।
বিছানাপত্র বাঁধতে বাঁধতে মনকে শক্ত করে একবার বলে ফেললাম-
– মাওলানা, প্রাণভিক্ষা না করার সিদ্ধান্ত তো আপনার নিজস্ব। এ সিদ্ধান্ত জামায়াতকে মেনে নিতে হবে তার কোন মানেই নেই। জামায়াতের লোক বাইরের অবস্থা বিবেচনা করে যা সিদ্ধান্ত করবে তা আপনাকে মানতেই হবে।
মাওলানা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বললেন-
আমি জামায়াতের দৃষ্টিতেও আমার এ সিদ্ধান্ত সঠিক মনে করি। আমার এ সিদ্ধান্ত জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দেয়া আপনাদের কর্তব্য।
এর মধ্যে জেল কর্মচারী এসে পড়ল। আমাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শান্ত, যেমন ঝড়ের প্রাক্কালে সমুদ্র থাকে শান্ত-শিষ্ঠ।
কিন্তু মাওলানা? ইসলামী আন্দোলন ও সত্য পথের বীর সেনানী, যাঁকে শাহাদতের মর্যাদা দানের ঘোষণা করা হয়েছে, সেই মাওলানা একেবারে শান্ত, ধীর-স্থির, অবিচল।
মাওলানা আমাদের সকলের সাথে বুক ভরে কোলাকুলি করলেন। তা ছিল এমন আন্তরিক যে, চিরদিন মনে থাকবে।
জিনিসপত্র কিছুটা আমরা নিলাম এবং কিছুটা জেলের নম্বরদার। কামরা থেকে বেরিয়ে দেওয়ানী ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে মাওলানাকে বিদায় দিলাম। এবার বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা তুফান আত্মপ্রকাশ করল। মিঞা তোফাইল সাহেব এবং আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম এবং আমি ফিরে এসে জায়নামাযে সিজদায় পড়ে গেলাম।
ইসলাহী সাহেব, মালিক সাহেব এবং চৌধুরী সাহেব আগে থেকেই সিজদায় পড়েছিলেন।
আমরা সকলে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে লাগলাম। কান্নার বেগ অপ্রতিহত, অশ্রু জোয়ার উদ্দাম, অফুরন্ত।
এভাবে কতক্ষণ কাটালাম জানি না। হঠাৎ নম্বরদারের কঠোর পদধ্বনি তার দিকে আমাদের সৃষ্টি আকৃষ্ট করল। দেখি, মাওলানার কাপড়, খাবার, বাসন, জুতা প্রভৃতি ফেরত এনেছে। কোরআন শরীফখানাও ফেরত এনেছে। কারণ ফাঁসীর কুঠুরিতে কোরআন শরীফ রাখার কোন স্থান নেই।
মাওলানা ইসলাহী সাহেব মাওলানার কাপড় আমার হাত থেকে নিয়ে বার বার চুমো দিতে লাগলেন, চোখে ও বুকে তার মধুর স্পর্শ উপভোগ করতে লাগলেন। কারণ এ কাপড় ছিল আল্লাহর পথে মুজাহিদের, যনি ছিলেন ফাঁসকিক্ষে আবদ্ধ, শাহাদাতের অমৃতপানের প্রতীক্ষায়।
মিয়া তোফাইল সাহেব মাওলানা ইসলাহীর হাত থেকে সে কাপড় নিয়ে মুখে-চোখে-বুকে লাগাতে থাকলেন। আমাদের সকলেরই অশ্রুজলে সে কাপড় সিক্ত হয়ে পড়ল।
তাঁর জন্যে আমাদের এই যে প্রাণঢালা ভালবাসা তা কিসের জন্যে?
– তিনি কি আমাদের কোন আত্মীয় ছিলেন?
– তাঁর সাথে আমাদের কি কোন বংশীয় সম্পর্ক ছিল?
– এ প্রেম ভালোবাসা কি এক বর্ণ-গোত্র হওয়ার কারণে?
– এ কি ছিল একই দেশের অধিবাসী হওয়ার জন্যে?
– না, না, শুধু এই কারণে যে, তিনি আল্লাহর পথে প্রাণ বিসর্জন দিতে চলেছেন। শুধু ইসলামের সম্পর্কই আমাদের ভালবাসাকে করেছিল এতখানি ঐতিহাসিক ও নিঃস্বার্থ।
মাওলানার সীমাহীন খোদাপ্রেম এবং খোদার পথে প্রাণ উৎসর্গ করার আকুল আগ্রহ জগতকে করল স্তম্ভিত। জেলখানার কর্মচারীদেরকেও করল বিস্ময়-বিমুগ্ধ এবং রেখে গেল ইসলামের ইতিহাসে এক পরম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ফাঁসীকক্ষে মাওলানাকে পরতে দেয়া হলো ইজারবন্দবিহীন পায়জামা। মাওলানা নম্বরদারকে জিজ্ঞেস করলেন-
“ভাই, ইজারবন্দ দিতে ভুলে গেছ।”
নম্বরদার বললে-
“মাওলানা, ফাঁসীর আসামীকে ইজারবন্দ দেয়া হয় না। কারণ যদি সে তাই দিয়ে আত্মহত্যা করে বসে?”
মাওলানা মৃদু হাস্য সহকারে বলেন-
“আরে যে প্রাণভরে শাহাদাতের জাম পান করতে যাচ্ছে, সে কি এমনই নির্বোধ যে, আত্মহত্যা করে জাহান্নামে যাবে?”
ফাঁসীকক্ষে মাওলানার কোন উদ্বেগ নেই। প্রাণনাশের জন্যে কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। মুখে- চোখে কালিমার কোন চিহ্ন নেই। কোরআন শরীফের পবিরর্তে সাইয়েদ আহমদ শহীদের (রঃ) জীবনী পড়তে পড়তে অতি স্বাভাবিক পরম সুখে নিদ্রা গেলেন। স্বাভাবিক অবস্থায় তাঁর আপন গৃহের নিদ্রা আর ফাঁসীকক্ষের নিদ্রায় কোন পার্থক্য সূচিত হলো না।
মাওলানার এ সময়ের আর একটি অমূল্য বাণী এই যে, তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অগণিত ভক্ত-অনুরক্ত ফাঁসীর আদেশে অধীর হয়ে পড়লে তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন-
“জীবন-মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, যমীনে হয় না।”
কি দৃঢ় প্রত্যয়! কি অটুট মনোবল?
ফাঁসীকক্ষে মাওলানার অবস্থা মাওলানার মুখে শুনুন। মাওলানাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন-
দেওয়ানী ঘরের পরিবেষ্টনীর মধ্যে যখন আমাকে ফাঁসীর আদেশ শুনান হলো এবং সাথে সাথে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রাণভিক্ষার অধিকারও দেয়া হলো, তখন আমার মনের মধ্যে তিন প্রকার ধারণার উদয় হলো।
প্রথমটি এই যে, জালিমের কাছে করুণাপ্রার্থী হওয়া আমার আত্মমর্যাদার পরিপন্থী।
দ্বিতীয় এই যে, কিসের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী হবো? এজন্যে কি যে, আমাকে কেন জান্নাতে পাঠান হচ্ছে? এটা সত্য কথা যে, সারা জীবন দ্বীনের খেদমত করে অন্যভাবে মৃত্যুবরণ করাতে বেহেশত লাভের ততটা নিশ্চয়তা নেই, যতটা আছে শাহাদত বরণ করে। অতএব আমি কি একথা বলব যে, আমাকে জান্নাত থেকে মুক্তি দাও?
তৃতীয় কথা এই যে, আমার মতো লোক যদি আজ প্রাণভিক্ষা করে, তাহলে এদেশের সাধারণ লোকের মন থেকে মর্যাদাবোধ মুছে যাবে।
অতএব, আমি আমার বন্ধু-বান্ধবদের একথা কঠোর চাপ দিয়ে বলে দিলাম আমার বাড়ীর কোন লোক, অথবা জামায়াতের কোন লোক আমার পক্ষ থেকে যেন ক্ষমাপ্রার্থী না হয়। নতুবা আমি কোনদিন তাদের ক্ষমা করব না।
যখন আমাকে ফাঁসীর কুঠরিতে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমাকে আবশ্যকীয় সকল দ্রব্যাদি থেকে বঞ্চিত করা হলো। আমার সবকিছু কেড়ে নেয়া হলো। এমনকি আমার পরিধেয় বস্ত্রও কেড়ে নিয়ে জেলের বস্ত্র দেয়া হলো। ইজারবন্দবিহীন পায়জামা দেয়া হলো। তা দেখে প্রথমত মনে করলাম যে, হয়ত ভুলে ইজারবন্দ দেয়নি। কিন্তু জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে, ইজারবন্দ মোটেই দেয়া হয় না। কারণ কয়েদী নৈরাশ্যে যদি তা দিয়ে আত্মহত্যা করে বসে। বাধ্য হয়ে পায়জামার সামনের দুই মাথা একত্রে করে পরতে হলো। কিন্তু তা সতর ঢাকার উপযোগী হলো না এবং নামায পড়তে বড়ই অসুবিধা হতে লাগল। কোরআন শরীফ প্রথমত সঙ্গে রাখতে চাইলাম, কিন্তু যখন দেখলাম যে, শোবার মেঝে ছাড়া তা রাখবার কোন স্থান নেই, তখন ফেরত দিলাম। যা হৃদয়ে গাঁথা ছিল তাই সংগে রয়ে গেল।
যা হোক, সবাই চলে যাওয়ার পর এক নম্বরদার (Warder) এলো এবং সরকার ও মন্ত্রীদের প্রাণভরে গালাগালি করলো। এরপরে এলো দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ। প্রত্যেকেই সরকারকে অভিসম্পাত করে গেল।
রাতের বেলায় ফাঁসীর কুঠরিতে এত চিৎকার আর্তনাদ শুরু হলো যে রাত দু’টোর আগে ঘুম এলো না। কেউ কোন পীর বুযুর্গের নাম ধরে ডাকছে। কেউ বা কবিতা আওড়াচ্ছে এবং কেউ বিড়বিড় করে বকেই চলেছে- ‘মাওলা বাঁচাও, মাওলা বাঁচাও’।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্পর্কে মাওলানার কি ধারণা ছিল তা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন-
আমার এই ধারণা ছিল যে, যদি জনসাধারণের পক্ষ থেকে বিরাট বিক্ষোভ করা না হয়, তাহলে সরকারের যা মনোভাব, তাতে তারা ফাঁসী দিয়েই ফেলবে। যদি তারা এ পদক্ষেপ করার সুযোগ পায়, তাহলে তা হবে অত্যন্ত মারাত্মক। এরপর এদেশে দ্বীনের কাজ বহুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু জনসাধারণ যদি সচেতন হয়ে কাজ করে এবং সরকারকে যদি একবার পিছপা হতে হয়, তাহলে ইনশাআল্লাহ তাদেরকে পিছনে হঠতেই হবে এবং ইসলামী আন্দোলনের পথকে রুদ্ধ করা সম্ভব হবে না। এ সময়টা হচ্ছে সারাদেশের জন্য এক বিরাট অগ্নি পরীক্ষার সময়।
দ্বিতীয় দিন শেখ সুলতান আহমদ এবং সফদর সাহেব ছেলেদের নিয়ে দেখা করতে এলেন। তারা আবার আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষার কথা বললেন। আমি তাদের শাসিয়ে বললাম, যেন তারা কিছুতেই ক্ষমাপ্রার্থী না হন।
অতঃপর মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী এলেন। তিনিও ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে তার নিজের খেদমত পেশ করতে চাইলেন। তাঁকে আমি বললাম যে, একথা কিছুতই আমার মাথায় ঢুকছে না।
মাওলানাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ফাঁসীর কুঠরিতে বিশেষ ধরনের কষ্ট ছিল না। তার উত্তরে মাওলানা বলেন-
একে তো সেই পরিধেয় বস্ত্র ছিল অসঙ্গত ও অপর্যাপ্ত এবং চিৎকার হট্টগোল। দ্বিতীয়-অসুবিধা এই যে, ফাঁসীকক্ষের গঠনটাই সকল মৌসুমে কয়েদীদের জন্য কষ্টদায়ক ছিল। আলো-বাতাসহীন সংকীর্ণ কক্ষ। রোদ, বৃষ্টি, শীত, গ্রীষ্ম থেকে আত্মরক্ষার উপায় নেই। তদুপরি ফাঁসীর কুঠরিতে আহার দেয়া হয় সি-ক্লাসের- যা একবারে অখাদ্য।
তৃতীয় দিনে প্রায় বেলা দু’টার সময় একজন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে বললেন, “মাওলানা আপনাকে মুবারকবাদ জানাই, আপনার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ হয়েছে।” তারপর এ সংবাদ দিতে দলে দলে লোক আসতে লাগলো। এর কিছু পরে মাওলানা নিয়াজী এবং আমাকে সেখান থেকে বের করে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া হলো।
ফাঁসীর আদেশে দেশ-বিদেশে প্রতিক্রিয়া
উপরে বলা হয়েছে যে, লাহোরের সামরিক আদালত মাওলানা সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড এবং পরে তা প্রত্যাহার করে চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এ দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে শুধু পাকিস্তানেই নয়, সমগ্র মুসলিম জগতে যে তুমুল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তার দৃষ্টান্ত অতীত ইতিহাসের পৃষ্ঠায় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর প্রতি এহেন আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে হরতাল, শোভাযাত্রা, সভা-সমিতি প্রভৃতি শুধু বড় বড় শহর ও রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ রইল না, বরঞ্চ দেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শহর ও গ্রামাঞ্চলেও বিক্ষভের অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। নিভৃত পল্লী থেকে বড় বড় শহর পর্যন্ত সকল স্থান থেকে অগণিত টেলিগ্রাম, পত্র ও প্রস্তাবাদির মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দাধ্বনি মুখলিত হতে লাগলো। এই যে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ, এ কোন সাময়িক উত্তেজনা কিংবা ভাবপ্রবণতার বশে প্রদর্শন করা হয়নি। এ ছিল প্রকৃতপক্ষে মাওলানার প্রতি মুসলিম জগতের স্থায়ী শ্রদ্ধার স্বতস্ফুর্ত অভিব্যক্তি। এটি জল বুদবুদের ন্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে হঠাৎ বিলনি হয়ে যায়নি। এ বিক্ষোভ প্রতিবাদ চলেছে অবিরাম পাঁচ মাস ধরে। যারা অতীতে খেলাফত ও কংগ্রেস আন্দোলনের যুগে নানা প্রকার বিক্ষোভ-প্রতিবাদ লক্ষ্য করেছেন, তারাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন যে, এ ধরনের বিক্ষোভ, আন্তরিক সমবেদনা, শোক ও কাতর ফরিয়াদ ইতঃপূর্বে কখনও দেখা যায়নি।
লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, সাধারণ লৌকিকতা অথবা লোক দেখানোর জন্যে এ বিক্ষোভ করা হয়নি। নীরব রাত্র ও কর্মব্যস্ত দিসের প্রতিটি মুহূর্ত সাক্ষ্য দেয় যে, শুধু পুরুষই নয়, পর্দানশীল মহিলাগণও মর্মাহত, শোকার্ত ও বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। নিশীথ রাতে তাদের তাহাজ্জুদের মুসাল্লা চোখের পানিতে সিক্ত হতো। ইসলামী আন্দোলনের এ মৃত্যুঞ্জয়ী বীরসেনানীর মৃত্যুদণ্ড এবং তারপর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে বিশ্ব মুসলিম এক বিরাট ট্রাডেজী মনে করেছিল। সে জন্যে আরব, মিসর, ইরাক, সিরিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের নেতৃবৃন্দ এর তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। সে সব দেশে সংবাদপত্রগুলির সম্পাদকীয় প্রবন্ধে পাকিস্তান সরকারের আচরণের নিন্দা করে মাওলানার আশু মুক্তি দাবি করা হয়।
পকিস্তানে নিম্নলিখিত সংবাদপত্রের সম্পাদকগণও এক স্মারকলিপির মাধ্যমে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেনঃ
করাচীঃ দৈনিক জং, দৈনিক আনজাম, দৈনিক মিল্লাত, টাইমস অব করাচী, দৈনিক ইমরোজ, দৈনিক আল মুন্তাজের, দৈনিক ইকবাল, দৈনিক আসরে জাদীদ, দৈনিক মুসলমান, দৈনিক নয়া রুশনী, দৈনিক শবনম, দৈনিক ওয়াতন, দৈনিক নয়ী সিন্ধ, আল অহীদ, মাকাসেদ, সাপ্তাহিক জাহানে নও, পাক্ষিক নিমকদান, মাসিক ফারান, মাসিক রিয়াজ, মাসিক মুশীর, মাসিক চেরাগে রাহ, পাক্ষিক স্টুডেন্টস ভয়েস, মাসিক কালীম প্রভৃতি।
ঢাকাঃ দৈনিক পাসবান, আজাদ, আংগারা, সিতারা, মর্নিং নিউজ, সাপ্তাজিক আল কায়েদ (ইংরেজী), দি মেইল, সাপ্তাহিক দৈনিক ও নিজামে ইসলাম।
লাহোরঃ দৈনিক পাকিস্তান টাইমস, দৈনিক ইমরোজ, দৈনিক আফাক, দৈনিক নওয়ায়ে ওয়াক্ত, দৈনিক ইহসান, সপ্তাহিক কেন্দিল, দৈনিক হেলালে পাকিস্তান, দৈনিক সাফিনা, সিভিল এন্ড মিলিটারী গেজেট, দৈনিক আসার, মাসিক খাদেদুল হারামাইন, মাসিক আরেফ, মাসিক আল জামেয়া, মাসিক ইসলামিক লাইফ, মাসিক মুসলিম, মাসিক আদাবী দুনিয়া, সাপ্তাহিক ইকদাম, সাপ্তাহিক কারওয়াঁ,
বাহওয়ালপুরঃ ইনসাফ, কায়েনাত, ইলহাম, আল ইমাম, আজম, রাহবার, পরওয়াজ, দেফা, রফীক, নয়া দাওর, কারওয়াঁ, তাবলীগ, নওয়ায়ে বাহওয়ালপুর।
কোরেটাঃ মীযান, পাসবান, নারায়ে হক, মাকাসেদ, হেলাল, খুরশীদ, তর্জুমান রাহবারে নেসওয়ান, বাচ্চুকা শাহীন, টাইমস, মুয়াল্লিম, দুশমন, পুকার, নওয়ায়ে বেলুচিস্তান, নিসওয়ায়ে দুনিয়া, নওয়ায়ে ওয়াতন, পয়গামে জাদীদ, সাদাকাত, কারওয়াঁ তামীরে বেলুচিস্তান।
এতদ্ব্যতীত বিদেশী পত্রিকাগুলোও তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে-
আসসিজল-বাগদাদ, ইখওয়াতে ইসলামীয়া বাগদাদ, আদ্দাওয়াত-কায়রো, মেম্বরশ শর্ক-কায়রো।
ইংল্যান্ডে শিক্ষারত মুসলিম দেশগুলোর ছাত্রবৃন্দ এবং ইংল্যান্ডে প্রবাসী মুসলমানগণ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব মুহাম্মদ আলীর (বগুড়া) নিকটে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে মাওলানার প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশের জন্য পাকিস্তান সরকারকে সাবধান করে দেন এবং মাওলানার আশু মুক্তি দাবি করেন।
ফিলিস্তীনের মুফতীয়ে আযম আলহাজ্জ মুহাম্মদ আমীনুল হুসাইনী, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মুরশিদ শেখ হাসানুল হাযেমী, জামে আযহারের উকিল মুহাম্মদ আবদুল লতিফ দারায এবং জমিয়তে শাববানুল মুসলিমীনের সভাপতি মুহাম্মদ সালেহ হেরেব, পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট নিম্নোক্ত মর্মে এক যুক্ত ভারবার্তায় বলেন-
“পাকিস্তানের প্রতি ভালবাসা ও সদিচ্ছা পোষণকারী সকল মুসলমান মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর ফাঁসীর আদেশে মর্মাহত হয়েছেন। আশা করি পাকিস্তান সরকার বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করবেন এবং আমাদের বরেণ্য মওদূদী সাহেবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করবেন।”
ইরানের শিয়া সম্প্রদায়ের মুজতাহেদে আযম হযরতুল ইমাম মুহাম্মদ আল খালেসী এবং ইরাকের আহলে সুন্নাতুল জামায়াতের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা আল্লামা আমযাদ আযযাহাবী নিম্নোক্ত রাষ্ট্রনায়কগণের নিটক এক যুক্ত তার প্রেরণ করে মাওলানা মওদূদীর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিতে অনুরোধ করেনঃ
দ্বিতীয় আমীর ফয়সাল-বাগদাদ, সুলতান ইবনে সউদ- সউদী আরব, আল্লামা আয়াতুল্লাহ কাশানী- ইরান, ডাঃ মুসাদ্দেক, ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী- ইরান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী, মিসরের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল নজীব, শায়কুল আযহার হাসানুল হাযিমী এবং ফিলিস্তীনের মুফতীয়ে আযম। পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীর নিকটেও তারা অনুরূপ তার প্রেরণ করেন।
ইন্দোনেশিয়ার মুযাহিদে আযম আল্লামা ঈসা আনসারী ইন্দোনেশিয়ার ষাটটি ইসলামী দলের পক্ষ থেকে বলেনঃ
“মাওলানা মাওদূদী জগতের আমানতস্বরূপ। পাকিস্তানে তাঁর প্রয়োজন না থাকলে ইসলামী জগতে তাঁর প্রয়োজন আছে। আমরা ইন্দোনেশিয়ার মুসলমান তাঁকে পূর্ণ সমর্থন করি এবং মনে করি যে, আজ মুসলিম জগতে তাঁর চিন্তাধারণার প্রয়োজন আছে।”
এতদ্ব্যতীত পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে মাওলানার মুক্তি দাবি করেন, তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী খাজা নাযিমুদ্দীন, মিঃ এম. গাযদার, মিঃ হুসাইন ইমাম, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী, পীর গোলাম মুহাদ্দিদ সিরহিন্দী, মাওলানা আকরাম খাঁ, মাওলানা দীন মুহাম্মদ খান, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং মাওলানা রাগেব আহসানের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মোটকথা, যে ইসলাম বিরোধী শক্তি মাওলানাকে রাতারাতি খতম করে ইসলামী আন্দোলন বানচাল করতে চেয়েছিল, বিক্ষুব্ধ মুসলিম বিশ্বের রক্তচক্ষুর সামনে তা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো বটে, কিন্তু মাওলানার প্রতি বহুদিনের পুঞ্জীভূতদ বিদ্বেষকে দমন করতে না পেরে তাঁকে চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে সান্ত্বনা লাভের চেষ্টা করলো।