জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামী কিভাবে এবং কোন পরিবেশের মধ্যদিয়ে গঠিন হলো তার বিবরণ পাঠকদের সামনে পেশ করতে চাই।
মাওলানা মওদূদী তাঁর “মুলসামন আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ” গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ইসলামী আন্দোলনের ব্যাখ্যা করে তার জন্যে একটি দল গঠনের আবশ্যকতা বর্ণনা করেন এবং সে দলের গঠন পদ্ধতির একটা খসড়াও পেশ করেন। অতঃপর হিজরী ১৩৬০ সালের সফল মাসের তর্জুমানুল কোরআনে মাওলানা মওদূদী মুসলমান জনসাধারণের নিকট এক আবেদন জানান যে, যারা উক্ত মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে তদনুযায়ী কাজ করতে চান, তাঁরা যেন তর্জুমান অফিসের সাথে যোগাযোগ করেন। অল্প দিনের মধ্যেই সংবাদ আসতে লাগল যে, বেশ কিছু সংখ্যক লোক একটা ইসলামী দল গঠন করে কাজ করতে আগ্রহী। অতএব হিজরী ১৩৬০ সালের ১লা শাবান, ইং ১৯৪১ সালের ২৫শে আগস্ট লাহোরে সমবেত হওয়ার জন্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানানো হলো।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ৭৫ জন অধিবেশনে যোগদান করেন। প্রথম দিনে বিভিন্ন লোক মাওলানাকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন। মাওলানা সে সবের সন্তোষজনক জবাব দেন।
দ্বিতীয় দিন সকাল আটটায় অধিবেশন শুরু হয়। সর্বপ্রথম মাওলানা তাঁর বক্তৃতায় তৎকালীন ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের উপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন। তিনি ’দ্বীন’কে একটা আন্দোলন হিসাবে পেশ করে বলেন, “আমাদের জীবনে যেন দ্বীনদারী নিছক একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসাবে নিষ্ক্রিয় ও স্থবির হয়ে না থাকে। বরঞ্চ আমরা যেন আমাদের সামগ্রিক জীবনে দ্বীনকে কায়েম করতে এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর মূলোৎপাটন করার জন্য সংগ্রাম করতে পারি। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘দারুল ইসলামের’ প্রতিষ্ঠাই ছিল এর প্রথম পদক্ষেপ। সে সময়ে মাত্র চারজন ছিল আমার সহকর্মী। এ ক্ষুদ্র সূচনা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। কিন্তু এতেও আমরা নিরাশ হইনি। বরঞ্চ ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত এবং এই আন্দোলনের জন্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মন মস্তিষ্ক তৈরি করার কাজ খোদার ফজলে অব্যাহত রইলো। আল্লাহর অনুগ্রহে দু’একজন করে সহকর্মী বাড়তে লাগলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে এই ধরণের লোকের ছোট ছোট শাখা প্রতিষ্ঠান কায়েম হতে লাগলো। তার সাথে সাথে ইসলামী সাহিত্য প্রকাশ ও মৌলিক দাওয়াত-তাবলীগের কাজো চলতে থাকলো। অবশেষে আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া যাচাই-পর্যালোচনা কার পর বুঝতে পারা গেল যে, এখন জামায়াতে ইসলামী গঠন করে সংগঠিতভাবে ইসলামী আন্দোলন চালানোর উপযোগী ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তার ফলেই এই অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছে।”
এ পটভূমিকা বিশ্লেষণের পর মাওলানা বলেন, “মুসলমানদের মধ্যে সাধারণত যে সকল আন্দোলন অতীতে চলেছে এবং বর্তমানে চলছে, সে সব থেকে ইসলামী আন্দোলনের মৌলিক পার্থক্য কি, তা-ই সর্বপ্রথম আমাদের ভাল করে জেনে রাখা দরকার।”
“প্রথমত, হয়তো ইসলামের কোন অংশ বিশেষকে অথবা পার্থিব কোন উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করেএ সব আন্দোলন পরিচালিত হয়। কিন্তু আমাদের এ আন্দোলন চলবে পরিপূর্ণ ইসলামকে নিয়ে।”
“দ্বিতীয়ত, এদের দলীয় সংগঠন দুনিয়ার অন্যান্য দলগুলোর পদ্ধতিতে করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ঠিক সেই দলীয় সংগঠন ব্যবস্থা অবলম্বন করছি, যা প্রথমে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রতিষ্ঠিত দলের মধ্যে ছিল।”
”তৃতীয়ত, এসব দলে যখন কোন লোক ভর্তি করা হয়, তখন এ ধারণার বশবর্তী হয়ে করা হয় যে, যেহেতুসে মুসলমান জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, অতএব সে নিশ্চিয়ই প্রকৃত মুসলমানই হবে। এর ফল এই হয়েছে যে, দলের সভ্য ও কর্মী থেকে আরম্ভ করে নেতা পর্যন্ত এমন অনেক লোক এ দলে অনুপ্রবেশ করেছে যে, চরিত্রের দিক দিয়ে তারা মোটেই নির্ভরযোগ্য নয় এবং কোন মহান দায়িত্ব পালনের যোগ্যও নয়। কিন্তু আমরা আমাদের দলে কাউকে এ ধারণায় গ্রহণ করি না যে, ‘সে মুসলমানই হবে’। বরঞ্চ যখন সে কালেমায়ে তাইয়েবার অর্থ, মর্ম ও তার দাবি জেনে বুঝে তার উপর ঈমান আনার অঙ্গীকার করে, তখনই তাকে দলে গ্রহণ করি। যোগদান করার পর দলের সদস্য হয়ে থাকবার জন্যে অবশ্য পালনীয় শর্ত হচ্ছে এই যে, ঈমান যে সব বিষয়ে সর্বনিম্ন দাবি করে তা তাকে পূরণ করতে হবে। এভাবে ইনশাআল্লাহ মুসলমান জাতির মধ্য থেকে শুধুমাত্র সৎ ব্যক্তিই বাছাই হয়ে এ দলে যোগদান করবে।”
এমনি করে একটা ইসলামী দল গঠনের কারণ, তার সংগঠন পদ্ধতি এবং অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে তার তুলনামূলক পার্থক্য বিশ্লেষণ করার পর মাওলানা মওদূদী জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের খসড়া পাঠ করেন। অবশ্য এর ছাপানো কপি একদিন পূর্বে সকলকে বিতরণ করা হয়েছিল। পূর্ণ আলোচনার পর যৎসামান্য সংশোধনীসহ গঠনতন্ত্র সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
অতঃপর মাওলানা মওদূদী দাঁড়িয়ে কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করেন এবং সমবেত সকলকে সম্বোধন করে ঘোষণা করেন, “আপনারা সকলে সাক্ষী থাকুন যে, আমি নতুন করে ঈমান আনছি এবং জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করছি।”
এরপর একে একে সকলেই কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে জামায়াতে শরীক হওয়ার ঘোষণা করেন। কালেমা পাঠকালে প্রত্যেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। একদিকে আল্লাহর ভয় এবং অপরদিকে একটি বিরাট দায়িত্ব পালনের আবেগ-অনুভূতি তাঁদের অন্তরাম্তা কাঁপিয়ে তুলছিল।
সর্বপ্রথম পঁচাত্তর জন লোক জামায়াতে ইসলামীতে শামিল হন এবং তাদেরকে নিয়েই জামায়াতে ইসলামীর পত্তন হয়। মাওলানা মওদূদী সর্বসম্মতিক্রমে জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন।
(ক) আমীর নির্বাচনের পর মাওলানা মনযুর নো’মানী সাহেব দোয়ার জন্যে হাত উঠান। নো’মানী সাহেব দোয়া করেনঃ হে খোদা! তোমার কিছু নগণ্য বান্দাহ তোমার পয়গাম সারা দুনিয়ায় পৌঁছিয়ে দেয়ার সংকল্প করেছে। সমাজকে পরিবর্তন ও ইসলামকে বাতিলের সংস্পর্শ থেকে পবিত্র করার ইচ্ছা পোষণ করেছে। আমরা তোমার নগণ্য, অপদার্থ ও দুর্বল বান্দাহ। আমরা তোমারই সন্তুষ্টি লাভের আশায় এতোবড়ো মহান উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়িয়েছি। তুমি আমাদেরকে তৌফিক দাও যেন আমরা আমাদের সমগ্র জীবনে এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিতে পারি। যেন ইসলামকে তার প্রকৃতরূপে পুনরায় রূপান্তরিত করতে পারি।
মাওলানা নো’মানীর অশ্রু গদগদ কণ্ঠের দোয়া সকলের চোখে অশ্রু-জোয়ার এনে দিল। হৃদয়ে সঞ্চার করলো নব উদ্যম-উৎসাহ ও খোদার পথে চলার দুর্বার সংকল্প।
অংশগ্রহণকারী হাকীম মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেনঃ ‘এ দোয়া এবং দোয়ায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সৃষ্ট অভূতপূর্ব ভাবাবেগ আমাকে এতই মুগ্ধ করলো যে, তা জীবনে কখনো ভুলে যাবার জিনিস নয়। এর চেয়েও মুগ্ধকর ঘটনা, যা আমার হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, তাহলো এই যে, মেহমানদের খানাপিনার শেষে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী দস্তরখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হাড়-হাড্ডি প্রভৃতি উচ্ছিষ্ট বস্তুসমূহ নিজ হাতে সরিয়ে খানার জায়গা পরিষ্কার করে দেন।’
আমীর নির্বাচিত হওয়ার পর মাওলান মওদূদী যে ভাষণ দান করেন তা এইঃ
“আমি আপনাদের মধ্যে না সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী, আর না সর্বাপেক্ষা মুত্তাকী। অন্য কোন দিক দিয়েও আপনাদের উপর আমার কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কিন্তু যখন আমার উপর আস্থা স্থাপন করে আপনারা এ বিরাট কাজের দায়িত্ব আমার উপরে ব্যস্ত করেছেন, তখন আমি আল্লাহর কাছে এ দোয়াই করি এবং আপনারাও করুন, যেন এ দায়িত্ব পালনের শক্তি তিনি আমাকে দান করেন এবং আমার প্রতি আপনাদের আস্থাও অক্ষুন্ন রাখেন। আমি আমার সাধ্যমতো পরিপূর্ণ খোদাভীতি ও দায়িত্বানুভূতি সহকারে এ কাজ করার আগ্রাণ চেষ্টা করবো। আমি স্বেচ্ছায় আমার দায়িত্ব পালনে কোন প্রকার অবহেলা করব না। আমি ইলম ও জ্ঞান অনুযায়ী আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের পদাংক অনুরণ করে চলতে কোন ত্রুটি করব না। তথাপি আমার কোন ত্রুটি বিচ্যুতি হলে এবং যদি আপনারা কেউ অনুভব করেন যে, আমি সঠিক পথ থেকে সরে পড়েছি, তাহলে এমন ধারণা যেন পোষণ না করেন যে, এসব আমার স্চ্ছোকৃত। বরঞ্চ আমার প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করে আমাতে সংশোধন করার চেষ্টা করবেন। যতক্ষণ আমি সঠিক পথে থাকবো আপনারা আমার সহযোগিতা করবেন, আমার কথা মেনে চলবেন, সৎ পরামর্শ দেবেন, সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করবেন এবং জামায়াতের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী কর্মপদ্ধতি থেকে দূরে থাকবেন। এ আন্দোলনের মহত্ত্ব এবং আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আমার পূর্ণ অনুভূতি আছে। আমি জানি যে,এ এমন এক আন্দোলন যার নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন আল্লাহর মহান নবী-রাসূলগণ এবং নবুয়তের যুগ শেষ হওয়ার পর এমন সব অসাধারণ মানুষ এ আন্দোলন পরিচালনা করেছেন যারা ছিলেন মানব সমাজের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যক্তি। আমার নিজের সম্পর্কে এক মুহূর্তের জন্যেও আমার এ ভুল ধারণা নেই যে, এ মহান আন্দোলনের নেতৃত্বে যোগ্য আমি। বরং এটাকে আমি দুর্ভাগ্যজনক মনে করি যে, এ বিরাট কাজের জন্যে আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি আপনাদের চোখে পড়লো না। …. আমি কখনও আমার নিজেকে খোদার পথের প্রতিবন্ধক হতে দেব না। কাউকে একথা বলারও আমার নিজেকে খোদার পথের প্রতিবন্ধক হতে দেব না। কাউকে একথা বলারও অবকাশ দেব না যে, একজন অনুপর্যুক্ত লোক আনুন। তারপর যে পদ আপনারা আমাকে দিয়েছেন তা সর্বদা তার জন্যে শূন্য থাকবে। অবশ্য আমি এজন্যে প্রস্তুত নই যে, যদি অন্য কেউ এ কাজ চালানোর জন্যে অগ্রসর না হয়, তাহলে আমিও অগ্রসর হবো না।
এ আন্দোলন আমার জীবনের লক্ষ্য। আমার জীবন-মরণ এরই জন্যে। আর কেউ এ পথে চলুক বা না চলুক, আমাকে চলতেই হবে। এ পথে আমার সঙ্গে কেউ না চললে, একাকীই চলব। সারা দুনিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরোধিতা করলে আমাকে তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে এবং তার থেকে পশ্চাৎপদ হবো না।”
মসলিসে শূরা
জামায়াতে ইসলামীর ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জামায়াতের আমীর তাঁর মজলিসে শূরার সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। পরদিন শূরার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং নিম্নোক্ত কর্মসূচী ঘোষণা করেন আমীরে জামায়াত মাওলানা মওদুদীঃ
যারা এ জামায়াত শামিল হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের নিজেদের আত্মশুদ্ধি করবেন এবং জীবন যাপন প্রণালী ইসলাম অনুযায়ী পরিশুদ্ধ করে দেবেন। অপরদিকে এ জামায়াতের বাইরে যারা আছেন, তাঁরা অমুসলিম হোন অথবা এমন মুসলমান যাঁরা দ্বীনী দায়িত্ব এবং দ্বীনী লক্ষ্য থেকে দূরে সরে আছেন, তাঁদের উভয়ের কাছেই সাধারণত আল্লাহ ব্যতীত অপরের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করার এবং রাব্বুল আলামীনের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়ার দাওয়াত পেশ করতে হবে। অতঃপর পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য একথা মনে রাখতে হবে যে, খোদা ব্যতীত অন্যের আনুগত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি সমাজ ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে খোদার আনুগত্যের ভিত্তিতে একটি জীবন ব্যবস্থা কায়েম করা কোনক্রমেই সহজ কাজ নয়। এতে জান-মাল এবং প্রতিটি বস্তুর ক্ষতি অনিবার্য। এজন্যে একাজে শুধুমাত্র তারাই সামনে অগ্রসর হবেন যাঁরা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা, সম্ভোগ ও ভোগ-বিলাসের কুরবানী ও সকল প্রকার ক্ষতি হাসিমুখে মেনে নিতে প্রস্তুত।
জামায়াতে ইসলামীর ঘোষণাপত্রে নিম্নরূপ ঘোষণা করা হয়ঃ
“সাধারণত যে দলগুলোকে সংকীর্ণ অর্থে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সংস্কারমূলক দল বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী এমন কোন দল নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ একটা আদর্শভিত্তিক দল। মানব জীবনের জন্যে একটা ব্যাপক ও বিশ্বজনীন জীবনদর্শনে এ দল বিশ্বাসী। মানবীয় চিন্তাধারা ও বিশ্বাসে, চরিত্র ও আচরণে, শিক্ষা-দীক্ষায়, সাহিত্য ও শিল্পকলায়, তাহযীব ও জামাদ্দুনে, ধর্ম ও সামাজিকতায়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এ জীবন দর্শনকে সে কার্যকরীরূপে বাস্তবায়িত করতে চায়। এ জামায়াতের মতে মানুষ যখন খোদার আনুগত্য পরিত্যাগ করে পরকালে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার কথা বিস্কৃত হয় এবং আম্বিয়ায়ে কেরামের (আঃ) নির্দেশিত পথে চলতে অস্বীকার করে, তখনই তা পৃথিবীর যাবতীয় অশান্তি অনাচারের একমাত্র কারণ হয়ে পড়ে।”
সংক্ষেপে তিনটি বিষয়েই মূলত জামায়াতে ইসলামী সমগ্র মানব জাতিকে আহ্বান জানায়। আর তা হচ্ছেঃ
জামায়াতে ইসলামী’র দাওয়াত
মানব সমাজের নিকট সাধারণভাবে এবং মুসলমানদের নিকট বিশেষভাবে-
জীবনের সকল ক্ষেত্রে খোদার দাসত্ব ও নবীদের আনুগত্য স্বীকার কর।
বর্ণচোরা মনোভাব ও মুনাফেকী ত্যাগ কর এবং খোদার সাথে কাউকেও শরীক করো না।
খোদাবিমুখ লোকগুলোকে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থেকে সরিয়ে দাও এবং প্রকৃত ঈমানদের ও সৎকর্মীশীলদের হাতে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত কর, যেন জীবন ঠিক খোদার পথেই চালিত হয়।
এ আহ্বানকে সত্য বলে বিশ্বাস করলে আমাদের সাথে শামিল হোন। খোদার নিকট এর পুরস্কার নিজেই পাবেন। যে ব্যক্তি এ কাজে বাধা দেবে, সে যেন খোদার নিকট জবাবদিহির জন্যে প্রস্তুত হয়।
মোটকথা, আল্লাহর নবীগণ যে মিশন নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিলেন এবং যার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ হয়েছিল শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফার (সঃ) দ্বারা, জামায়াতে ইসলামীও সে মিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মানব জীবনের প্রতিটি বিভাগে, শিক্ষা-দীক্ষায়, শিল্প-বিজ্ঞানে, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ও যুদ্ধক্ষেত্রে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অফিস আদালতে, আন্তর্জাতিক সন্ধিসূত্র ও সম্পর্ক স্থাপনে একমাত্র খোদারই আনুগত্য করতে হবে- এই হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য। একেই বলা হয়েছে “ইকামাতে দ্বীন” বা আল্লাহর দ্বীন ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা।
ঊনিশ শ’ তেতাল্লিশ খ্রিষ্টাব্দে লাহোর থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় দফতর পূর্ব পাঞ্জানের পাঠাকোটের ‘দারুল ইসলামে’ স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৫ সালে নিখিল ভারত জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সম্মেলন এখানেই অনুষ্ঠিত হয়।
নিখিল ভারত জামায়াতে ইসলামী সম্মেলন
ঊনিশ শ’ বিয়াল্লিশের অক্টোবরে লাহোর থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় তফতর পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোটের ‘দারুল ইসলামে’ স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৫ সালে নিখিল ভারত জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সম্মেলন এখানেই অনুষ্ঠিত হয়।
এ সম্মেলনে মাওলানা মওদূদী কর্মীদের সামনে যে ভাষণ দেন, তার কিঞ্চিত এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
প্রকাশ থাকে যে, জামায়াত গঠন হওয়ার পর থেকে কায়েমী স্বার্থবাদী (Vested interests) কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াত ও মাওলানার বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। এর কারণ আছে এবং তা অতি স্বাভাবিকও।
জামায়াতে ইসলামী একটি আদর্শবাদী আন্দোলন, নিছক ইসলামী তাবলীগের কোন সংস্থা নয়। প্রকৃতপক্ষে আন্দোলন (তাহরীক) ও তাবলীগের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিরাজমান।
তাবলীগ অর্থ কিছু ভাল কথা ও কাজ মানুষকে শুনিয়ে দেয়া, ভালো কাজের উপদেশ দেয়া এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্যে সাধারণভাবে আবেদন জানানো। কোন ব্যক্তিকে ভাল কাজের উপদেশ দিলে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নসিহত করলে তার রাগান্বিত অথবা অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। বরঞ্চ এ ধরণের হিতোপদেশ যারা দান করেন, তাদের উপদেশ অমান্য করা হলেও তাদেরকে সাধারণত সম্মান দেখানো হয়। কিন্তু আন্দোলনের অর্থ হচ্ছে সমাজের বুক থেকে মন্দ কাজ, অনাচার, অশ্লীলতা প্রভৃতির মুলোৎপাটন করে সৎ কাজের প্রতিষ্ঠা করা। যদি দশ বিশ হাজার লোকের সমাবেশে উদাত্ত কণ্ঠে বলা হয়, আপনারা সৎ কাজ করুন এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকুন, তাহলে হয়তো এর কিছুটা সফল হতেও পারে। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়াশলী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে না। তবে যদি বলা হয়, “আসুন আমরা একতাবদ্ধ হই এবং সমাজে যা কিছু ভাল তার প্রতিষ্ঠা করি এবং যা কিছু মন্দ তার মূলোৎপাটন করি-” তাহলে একেই বলা হবে আন্দোলন এবং তখন অবশ্যই দেখা যাবে যে, একটি প্রতিক্রিয়াশলী শক্তি আপনার এ আন্দোলনকে রুখে দাঁড়ানোর জন্যে বদ্ধপরিকর হয়েছে। এ আন্দোলনই ছিল নবীদের কাজ এবং কোরআন পাকে ‘আমর বিল-মারুফ ও নেহী আনিল কুনকার’ এর যে আদেশ আল্লাহ তায়ালা করেছেন, একটি আন্দোলনের মাধ্যমেই হতে পারে তার সার্থক রূপায়ণ।
যেহেতু জামায়াতে ইসলামী ছিল একটি আন্দোলন, সেজন্যে শুরু থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তার প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ে। মাওলানা প্রথম নিখিল ভারত জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলনে প্রতিক্রিয়াশীলদের সমালোচনা বিরোধিতর আলোকে কর্মীদের সামনে যে ভাষণ দেন, তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভাষণ একদিকে জামায়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সুষ্পষ্ট করে তুলে ধরে এবং অপরদিকে আন্দোলনের পথে স্বাভাবিকভাবেই যেসব বাধাবিঘ্ন, বিপদ-মুসীবত, দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন-নিষ্পেষণ আসবে তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে কর্মীদের সজাগ ও সাবধান করে দেয়। তিনি একদিকে এ মহান আন্দোলনের জন্যে কর্মীদের মধ্যে অদম্য প্রেরণা সৃষ্টি করেন এবং অপরদিকে বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি সহনশীলতারও নির্দেশ দেন।
জামায়াতের লক্ষ্য হুকুমতে ইলাহিয়ার প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ
মাওলানা তাঁর ভাষণে বলেনঃ “দ্বীন প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলনের পরিণাম সম্পর্কে আমরা কিছুই বলতে পারি না। পরিণাম তো আল্লাহর হাতে। আমাদের এ প্রচেষ্টার ফল যদি এ হয় যে, আমরা একটি সৎ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে পেরেছি, তাহলে সেটা হবে আল্লাহর একটা বড় দান। অনেকে বিদ্রূপ করে বলেন যে, আমাদের সকল প্রচেষ্টা নাকি ক্ষমতা লাভ করা, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ আমাদের লক্ষ্য নয়। তাদের এ ধারণা একেবারে ভ্রান্ত। আমাদের সকল প্রচেষ্টা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি সৎ এবং খোদা প্রদত্ত জীবন বিধান প্রচেষ্টা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে এ প্রচেষ্টায় কোন দোষ নেই। আর এতে লজ্জারও কিছু নেই। আমরা যখন হুকুমতে ইলাহিয়ার কথা বলি, তখন তার দ্বারা আমরা এ ধরণের একটি ব্যবস্থাকেই বুঝাই। আমি বুঝতে পারি না যে, এ ধরনের একটা ব্যবস্থা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত ঈপ্সিত বস্তু হলে এতে বিতর্কের কি আছে। এটা কি তবে খোদার সন্তুষ্টি কামনা থেকে ভিন্ন কিছু? আল্লাহর যমীনের উপর আল্লাহরই রাজত্ব চলুক-এর থেকে অধিক খোদার সন্তুষ্টি আর কিসে হতে পারে? ঐসব লোক থেকে অধিকতর খোদার সন্তোষ প্রয়াসী আর কে হতে পারে, যারা কোন কিছুর পরোয়া না করে জীবনকে এজন্যে উৎসর্গীকৃত করে যে, খোদার যমীনের উপর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও কর্তৃত্ব যেন চলতে না পারে। এ ধরণের প্রচেষ্টা যদি দুনিয়াদারী হয়, তাহলে দ্বীনদারী কি এই যে, সারারাত জেগে ‘আল্লাহু আল্লাহু’ যিকির করা হবে এবং দিনের বেলায় খোদার যমীনের উপরে শয়তানের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হবে? যারা এ ধরনের কথা বলে, তাদের মন মস্তিষ্কে দ্বীন সম্পর্কে অতি নিকৃষ্ট ধারণা রয়েছে।
ভাষণের এক পর্যায়ে মাওলানা বলেনঃ
“আপনারা জানেন যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের কাছে এ দাবি করবেন না যে, আমাদেরকে হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমরের (রাঃ) রাষ্ট্রের মতো একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। এমনটি করার সাধ্যও কারও নেই এবং এর আদেশও আল্লাহ করেননি। অবশ্য আমাদের কাছে এ দাবি করা হয়েছে যাতে আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে সকল প্রকার চেষ্টা-চরিত্র করি এবং এ চেষ্টায় জীবনের সমস্ত সম্পদ নিয়োগ করতে পারি অর্থাৎ নিজের জীবনও এবং ধনসম্পদও। তার সাথে সকল প্রিয় বস্তুও। দ্বীন বলতে আমরা তার কোন বিশেষ অংশকে বুঝাই নাতা সে যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন। দ্বীন বলতে আমরা সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ দ্বীনকেই বুঝাই। তার মৌল ও খুঁটিনাটি বিষয়গুলো, তার আকীদাহ বিশ্বাস ও আমল-দ্বীন বলতে এসব কিছুকেই আমরা বুঝাই। দ্বীনের জন্যে আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব ঐকান্তিকতা ও উৎসাহ উদ্যমের সাথে। খোদার কাছে একটাই হচ্ছে আমাদের ঈমান ও নিফাকের (মুনাফেকী) কষ্টিপাথর। যে হৃদয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা নেই, সেখানে ঈমানের কোন স্থান নেই। দ্বীনের দরদ যে অন্তরে নেই, সে অন্তর কখনও খোদার ঘর হতে পারে না। যতই তসবীহ জপ করা হোক না কেন, যতই ওজীফা ও যিকির আযকার করা হকো ন কেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার যে প্রেম, তার সমতুল্য এসব হতে পারে না। সমস্ত দ্বীনদারীর প্রাণই হচ্ছে এটা এবং খোদা আমাদের অন্তরে এটাই প্রথম তালাশ করবেন। তারপর এই যে দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, তা অবশ্যই হতে হবে সংঘবদ্ধভাবে, ব্যক্তিগতভাবে নয়। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে যে প্রেম ও ভালবাসা, অন্তরে তার অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করার চেষ্টা করতে হবে। এ প্রশ্ন অবান্তর যে, পরিণাম কি হবে। এমনও হতে পারে যে, আমাদেরকে করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করা হবে।”
আন্দোলনের বিরোধিতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মাওলানা বলেনঃ
“এ পথের দাবি এই যে, আমাদের মধ্যে যেন বিরোধিতাকে স্বাগত জানাবার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। সত্য পথ হোক অথবা বাতিল পথ হোক, এ ব্যাপারে আল্লাহর নীতি এই যে, যে ব্যক্তি যে পথই অবলম্বন করুক, তাকে সে পথে অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। আর সত্য পথের বৈশিষ্ট্যই তো এই যে, শুরু থেকে আখের তক সে পথ অগ্নিপরীক্ষায় পরিপূর্ণ। অংকের একটি মেধাবী ছাত্র একটি কঠিন অংক পেলে যেমন খুশী হয় যে, এতে করে তার প্রতিভার যাচাই হবে, তেমনি এক দৃঢ়সংকল্প মুমেন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে আনন্দ পায়। কারণ এর দ্বারা সে তার আনুগত্য প্রমাণ করার সুযোগ পায়। মিটমিটে প্রদীপ সামান্য বাতাসের আঘাতেই নিভে যায়। কিন্তু একটি প্রজ্জ্বলিত চুলা বাতাসে অধিকতর প্রজ্জ্বলিত হয়। আপনারা নিজেদের মধ্যে এ যোগ্যতা সৃষ্টি করুন যে, একটি প্রজ্জ্বলিত চুলা সিক্ত জ্বালানী দ্বারা নির্বাপিত না হয়ে যেন তাকে তার ইন্ধন বানিয়ে নেয়, তেমনি আপনারাও যেন বিরোধিতার দ্বারা দমিত না হয়ে আহার ও শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন। যতোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে এ যোগ্যতার সৃষ্টি না হয়েছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত আশা করা যায় না যে, আমরা খোদার দ্বীনের কোন ভালো খেদমত করতে পারবো।”
অতঃপর ভাষণের এক পর্যায়ে মাওলানা কর্মীগণকে জামায়াতের সাহিত্য, কোরআন পাক ও সীরাতুন্নবী গভীরভাবে অধ্যয়ন করার তাগিদ করেন, আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠনের উপদেশ দেন। অনর্থক ও বেহুদা কাজকর্ম, বাহাস-মুনাযিরা (বিতর্কসভা) প্রভৃতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন।
অতঃপর তিনি বলেনঃ “আমার ব্যক্তিগত চরিত্র ও আচারণ-আচারণের কেউ তীব্র সমালোচনা করলে আপনারা তার প্রতিরোধ করতে যাবেন না। কারণ আমি নিজেও তা করব না। এসব করতে গিয়ে আপনারা সময় ও শক্তির অপচয় করবেন না। … পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করতে গিয়ে যদি প্রতিপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করেন, তাহলে আলোচনা বন্ধ করবেন। কারণ উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনার বহু অনিষ্টকর কুফল হয়ে থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “ইসামী আন্দোলনের একটা বিশিষ্ট মেজাজ প্রকৃতি আছে। এর একটি বিশেষ কর্মপদ্ধতি আছে, যার সাথে অন্য কোন আন্দোলনের কর্মপদ্ধতির কোনই মিল নেই। আজ পর্যন্ত যারা বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের সাথে জড়িত এবং যারা সে সব পদ্ধতিতে অভ্যস্ত, তারা এ জামায়াতে যোগদান করলে তাদের অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হবে। সভা সমিতি, ফেস্টুন, ঝাণ্ডা-পতাকা, শ্লোগান, ইউনিফরম, বিক্ষোভ প্রদর্শন, প্রস্তাবাদি গ্রহণ, বল্গাহীন বক্তৃতা, উত্তেজনা সৃষ্টিকারী রচনা এবং এ ধরনের যাবতীয় জিনিস ঔসব আন্দোলনের প্রাণস্বরূপ আর জামায়াতের আন্দোলনের জন্যে হলাহল। এখানের কর্মপদ্ধতি কোরআন পাক এবং সীরাতে মুহাম্মদী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন চরিত থেকে লিখে নিয়ে তার অভ্যাস করতে হবে।”
সর্বশেষে মাওলানা বলেন, “এ আন্দোলনের প্রাণ হলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে দৃঢ় সম্পর্ক। তাঁর সাথে আপনাদের সম্পর্ক যদি দুর্বল হয়, তাহলে হুকুমতে ইলাহিয়া কায়েম করার এবং তা সাফল্যের সাথে পরিচালনা করার যোগ্য হতে পারবেন না। সেজন্যে ফরয ইবাদতের সাথে নফল ইবাদতেরও নিয়মিত অভ্যাস করবেন। নফল নামায, নফল রোযা, সদকা প্রভৃতি এমন জিনিস যা মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা সৃষ্টি করে। আর এ সব যত বেশী সম্ভব গোপনীয়তার সাথে করবেন যাতে ‘রিয়া’ (লোক দেখানো) না হয়। নামায বুঝে পড়বেন। এমনভাবে নয় যে, একটা মুখস্থ জিনিসের আবৃত্তি করছেন। বরঞ্চ এভাবে যে, সজ্ঞানে আপনি খোদার দরবারে কিছু আরজি পেশ করছেন।…
…… যে সকল যেকের-আযকার, রিয়াযাত (সাধনা), মুরাকাবা-মুশাহাদা, তাসবীহ তপজপ সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত নয়, সে সব থেকে বিরত থাকবেন।”
একটি সাক্ষাৎকার
জামায়াতে ইসলামী কিভাবে কায়েম হলো এবং কোন অবস্থার মধ্যে তার সুচনা হলো, এ সম্পর্কে মাওলানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রশ্ন করলে তার উত্তরে মাওলানা যা বলেন, তা নিম্নে প্রদত্ত হলো। কারণ শিল্পীর নিজের মুখে তাঁর তৈরি শিল্পের আদিকথা শুনতে পাঠকগণ নিশ্চয়ই আনন্দ পাবেন।
জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের পূর্বে ইসলামী আন্দোলনের জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ধারণা তাঁর মধ্যে কখন এলো তা তাঁর নিজের মুখে শুনুনঃ
“আমি তো এর সঠিক রূপ সম্পর্কে চিন্তা করেছি ঊনিশ শ’ আটত্রিশ অথবা ঊনচল্লিশ সালে। অবশ্য এর আগে একটা রিসার্চ একাডেমী এবং একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (তরবিয়তগাহ) স্থাপনের বাসনা আমার ছিল, যাতে করে কিছু লোক তৈরি করা যায়। কারণ এটা এমনই একটা কাজ যে, নিজে লোক তৈরি করে না নিলে কাজই চলতে পারে না। একটা আন্দোলনের মধ্যে কিছু লোক সামিল করে সংগঠিত উপায়ে সামগ্রিকভাবে চেষ্টা-চরিত্র করার বিষয় বেশ কিছুকাল পরে আমার মনে জেগেছে।
কিন্তু এ ধারণা কেনই বা আমার মনের মধ্যে জাগলো এবং তখন এমন কি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল যার জন্যে আমার মধ্যে এ অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিল?
ঊনিশ শ’ চব্বিশ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রায় ঊনিশ শ’ সাঁইত্রিশ খিষ্টাব্দ পর্যন্ত অবস্থা অত্যন্ত নিরাশাব্যঞ্জক ছিল। মুসলমানগণ বিরাট সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। একদিকে খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল এবং তারপর হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। মুসলমানগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল যে আস্থাভাজন কোন নেতা বা পরিচালক তাদের মোটেই ছিল না। তাদের সামনে জীবনের কোন লক্ষ্য ছিল না এবং পরস্পরে ছিল বিবদমান। অপরদিকে এরই সুযোগে হিন্দুদের সংকল্প ও উদ্দেশ্য ভালোভাবে ধরা পড়লো। তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন গান্ধীজী স্বয়ং। মুসলমানগণ তার প্রতি আস্থা রাখতো। অথচ তিনি তাদের কোনই কাজের ছিলেন না। উপকারের পরিবর্তে তিনি তাদের অপকারই করেছেন। তাঁর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যে, তাঁর বাইরের দিকটা একরূপ এবং ভিতরের দিকটা অন্যরূপ। কারণ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সকল দোষ তিনি মুসলমানদের ঘাড়েই চাপাতেন এবং হিন্দুরা বাড়াবাড়ি করলেও তাদের সমর্থন জানাতেন। ফলে তাঁর প্রতি মুসলমানদের যে আস্থাটুকু ছিল, তা তারা হারাতে লাগলো। এই সময়েই মাওলানা মুহম্মদ আলী জওহর নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন। হাকিম আজমল খানও নিরাশ হয়েছিলেন।
এ সময় দু’একটি বছর এমনভাবে কাটলো যে তা আমার জন্যে ছিল অত্যন্ত পীড়াদায়ক। সে সময়ে আমি ছিলাম একেবারে নওজোয়ান। আমি তখন চিন্তাও করতে পারলাম না যে, কোন আন্দোলন আমি পরিচালনা করতে পারব। কারণ পরিস্থিতি ছিল সুস্পষ্ট। যে সব নেতার প্রতি আমাদের আস্থা ছিল, তাঁদের সকলেই ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের কাছে এমন কোন পয়গামও ছিল না, যার দ্বারা তাঁরা জাতিকে শান্ত করতে পারতেন। ভেবেও স্থির করতে পারতাম না যে কি করা যাবে।
এ সময়ে বহু নতুন নতুন সভ্যতা ও চিন্তাধারার প্রসার শুরু হয়েছিল। খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর চার-পাঁচ বছর তো হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা চালানো। তারপরে মুসলমানদের মধ্যে নাস্তিকতা ও পাপাচার দানা বাঁধতে লাগলো। ইসলামকে বিকৃত করা শুরু হলো। দেখতে দেখতে এ একটা ঝঞ্ছার আকার ধারণ করলো। [ফতেহ নিয়াজপুরী কর্তৃক সম্পাদিত একটি পত্রিকা- যার মাধ্যমে হাদীস শাস্ত্রকে অবিশ্বাস্য প্রতিপন্ন করার আন্দোলন শুরু হয়।] ‘নিগার’ এ সময়েরই সৃষ্টি। এমন কি আমাদের দেশের দ্বীনী মাদরাসাগুলো থেকে এমন বহু লোক বেরিয়ে আসছিল, যারা ইসলাম সম্পর্কে নিরাশ হয়ে তা থেকে দূরে সরে পড়ছিল। অবশেষে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, নামায পড়তে লোকে লজ্জা বোধ করতো। বিশেষ করে রেলগাড়ীতে ভ্রমণের সময় অথবা বাগ-বাগিচায় কেউ নামায পড়লে সে যেন নিজেকে অভ্যস্ত হাস্যাস্পদ মনে করতো।
এসময় চিন্তা করতে করতে আমি, এ বিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, এ অবস্থার মুকাবিলা করার জন্যে কিছু করা দরকার। এ এমনই এক পরিস্থিতি ছিল যা লক্ষ্য করে প্রত্যক্ষ অনুভব করলাম যে, সংগঠিত প্রচেষ্টা ব্যতীত ইসলামের হেফাযত এবং সমুন্নতি সম্ভব নয়।”
প্রশ্ন- তাহলে সর্বপ্রথম আপনি চিন্তাধারা পরিশুদ্ধিকরণের পরিকল্পনা করেন কি?
উত্তর- জি হ্যাঁ, সে সময়ে আমার মনে এই ছিল যে, সর্বপ্রথম চিন্তার ক্ষেত্রে কিছু কাজ শুরু করা এবং এভাবে কিছু লোক এ কাজের জন্যে তৈরি করা যাক। অবশেষে সম্মিলিত চেষ্টা করা যাবে।
চিন্তার ক্ষেত্রে সংগ্রাম চালানোর পর আমি অনুভব করলাম যে, এখন আমার পক্ষে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কাজ করা ব্যতীত গত্যন্তর নেই। কিন্তু আবার একটু চিন্তাও ছিল যে, কি জানি আমার ডাকে যদি কেউ সাড়া না দেয়, এ আন্দোলন আমি চালাতে পারি কি না। কিন্তু তথাপি ভেনে-চিন্তে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সব প্রমাণিত হবে। যদি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কাজ করার আর কোন ব্যক্তি না থাকে, তবে আমাকেই তা করতে হবে।
প্রশ্ন- আপনি এ কাজে অপরের সাহায্য লাভের জন্যে কিভাবে আবেদন করলেন এবং তাদেরকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করলেন?
উত্তর- এ ব্যাপারে সব কিছু নির্ভর করতো তর্জুমানুল কোরআনের প্রবন্ধাদি ও দাওয়াতী ঘোষণার উপর। যাঁদেরই সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি। চিঠিপত্র খুব কম লিখেছি। বেশীর ভাগ কাজ করেছি তর্জুমানে প্রকাশিত প্রবন্ধাদির দ্বারা এবং দেখা-স্বাক্ষাতের মাধ্যমে। এ কাজের জন্যে তাড়াহুড়া করিনি। যথা, বিরাট সভা-সম্মেলন করে তাতে কিছু লোক জমায়েত করা যাক-এ পথ আামি অবলম্বন করিনি। আমি ক্ষুদ্র সূচনার পক্ষপাতী। সব সময় আমার প্রচেষ্টা এই ছিল যে, যে ক’জনই উপর্যুক্ত ও বিশ্বাসভাজন লোক পাওয়া যায়, তাদের নিয়ে কাজ শুরু করি।
প্রশ্ন-জামায়াত গঠনের সময় কত লোক পেয়েছিলেন?
উত্তর- প্রথমবার জামায়াত গঠনের সময় প্রায় ১৫০ জন লোক আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিল এবং ৭৫ জন প্রত্যক্ষ জামায়াতে শরীক হন। এটাই ছিল প্রাথমিক সংখ্যা। [প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তর্জুমানুল কোরআনে প্রকাশিত জামায়াত গঠনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৫০ জন তাঁদের নাম-ঠিকানা তর্জুমান অফিসে পাঠিয়ে দেন এবং তাঁদের সকলের কাছে পত্র দেয়া হয় যেন তাঁরা ২৫শে আগস্ট ১৯৪১, লাহোর তর্জুমানুল কোরআন অফিসে হাযির হন। এ দাওয়াতের পর ৭৫ জন হাযির হন এবং তাঁদের নিয়েই জামায়াত গঠিত হয়- গ্রন্থকার।
প্রশ্ন- জামায়াতের এ সুচনায় নিজের মধ্যে আপনি কি প্রতিক্রিয়া অনুভব করেছিলেন?
উত্তর-আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, এর চেয়ে উত্তম সূচনা কিছুতেই আশা করা যায় না। আমি এ কথা কখনও মনে করিনি যে, ডাক দিব আর হাজার হাজার লোক সাড়া দিয়ে হাযির হবে।
ঐতিহাসিক চৌদ্দই আগস্টে মাওলানা
ঊনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালের চৌদ্দই আগস্ট পাক-ভারতের মুসলমানদের এক স্মরণীয় দিন। এই দিন ব্রিটিশ ও হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের নিগড় থেকে মুসলমানদের আযাদীর সূর্যকিরণ উদিত হয়েছিল। পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা ছিল সম্পূর্ণরূপে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারত বিভাগের সর্বসম্মত মৌলিক নীতি অনুযায়ী গুরুদাসপুর জেলা পাকিস্তানেরই নায্যা প্রাপ্য। তাই এ জেলার মুসলমানদের জন্যে ছিল আজ ঈদের দিন। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, মুসলমানদের এ আনন্দ বিষাদে পরিণত হলো। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ গুরুদাসপুরের মতো কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত জেলা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে টেনে বের করে ভারতের সাথে জুড়ে দিয়ে চরম পক্ষপাতিত্ব, অবিচার ও নির্লজ্জ হিন্দুপ্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো।
এই দিন মাওলানা মওদূদী গুরুদাসপুর জেলার পাঠানকোটের নিকটবর্তী “দারুল ইসলামে” অবস্থান করছিলেন। পাঠানকোট শহরের অধিবাসী ছিল প্রায় শিখ ও হিন্দু। ‘দারুল ইসলাম’ বস্তিও ছিল হিন্দু-শিখ পরিবেষ্টিত। রেডিওর মাধ্যমে গুরুদাসপুর জোর ভারতভুক্তির কথা শোনা মাত্রই মাওলানা গভীর দুঃখের সাথে মন্তব্য করেন যে, কাশ্মীর মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে গেল। তিনি এ কথাও বলেন যে, যদি তাঁর সাথে একশত সশস্ত্র সিপাহী থাকত তাহলে পাকিস্তানের পরিবর্তে তিনি কাশ্মীর গিয়ে তাকে আযাদ করার সংগ্রামে লিপ্ত হতেন।
ভারত বিভাগের পর পাঞ্জাবের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দাবানল জ্বলে ওঠে। হিন্দু ও শিখ পরিবেষ্টিত দারুল ইসলামের নিরাপত্তার প্রশ্ন এ ক্ষুদ্র পল্লীর অধিবাসীদের তখন বড় হয়ে দেখা দিল। এ সময়ে মাওলানা মওদূদী একজন অতি বিচক্ষণ সেনাধ্যক্ষের ন্যায় কাজ করেন। তাঁর নির্দেশে একদিকে ‘দারুল ইসলামে’ কয়েকটি পরিখা খনন করা হলো এবং মাত্র দুটি বন্দুক ও লাঠিসোটাসহ সকলে প্রস্তুত থাকল, যাতে হিন্দু ও শিখদের দ্বারা আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা করা যেতে পারে। অপরদিকে, জামায়াতের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ দাঙ্গা থেকে বিরত থাকার জন্যে শিখ নেতাদের আবেদন জানাতে লাগলেন।
একবার গুজব রটল যে, কয়েকশত শিখ ও হিন্দু অস্ত্রশস্ত্রসহ দারুল ইসলাম আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাওলানা আল্লাহর উপর সোপদ করে জামায়াতের সেক্রেটারী মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদকে দু’জন সঙ্গীসহ শিখ নেতা জায়গীর সিং এ চুনিলাল সিং এর কাছে পাঠালেন। পরিপূর্ণ শিখ বস্তির সশস্ত্র লোকজনের ভেতর দিয়ে তিনজন নিরস্ত্র মুসলমান শিখ নেতাদের বাড়ী পৌঁছলেন। তাদেরকে দেখে তারা অতীব আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়লেন। জামায়াত নেতাগণ নির্ভীকচিত্তে বললেন, শুনলাম আপনারা নাকি ‘দারুল ইসলাম’ আক্রমণ করতে চান। যদি একথা সত্যি হয় তবে তার কারণ কি? মাওলানা ও দারুল ইসলামের বাসিন্দাদের নিষ্কলুষ চরিত্র পূর্ব থেকেই তাদের মনে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। এখন এদের নির্ভীকতায় তারা মুগ্ধ হলেন এবং আশ্বাস দিয়ে নিরাপদ স্থান পর্যন্ত তাঁদেরকে এগিয়ে দিলেন।
মাওলানার নির্দেশে দূর-দূরান্তের বিপন্ন মুসলমানদেরকে দারুল ইসলামে আশ্রয় দেয়া হয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তান থেকে আগত কনভয়ের সাহায্যে তাদেরকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হয়। সকল লোকজনকে নিরাপদে পাকিস্তানে পাঠানোর পর সর্বশেষে মাওলানা দারুল ইসলাম ত্যাগ করে লাহোর চলে আসেন।
লাহোরে স্থানান্তরিত হওয়ার পর মাওলানা ও তাঁর সহকর্মী লোকজনদের মাথা গুজবার প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়াল। তাঁদের জন্যে সরকার পক্ষ থেকে একটা বাড়ী এ্যালট করার পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই আবার তা ফেরত দেয়া হলো। মাওলানা তাঁর লোকজনকে এ্যালটমেন্টে বাড়ী নিতে নিষেধ করে দিলেন। অতঃপর তারা ইসলাম পার্কে তাঁবু করে মাথা গুঁজলেন। পরে ইছরায় ভাড়াটে বাড়ীতে তাঁরা চলে আসেন।
এসব ছিন্নমূল জামায়াতে নেতাদের দিয়ে মাওলানা দুটি অভিযান শুরু করেন- শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মুহাজিরদের সেবা। এ সময়ে শহরের বহু স্থানে যে দুর্গন্ধময় আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়েছিল, তা মহামারী রোগের বার্তা বহন করছিল। জামায়াত কর্মীগণ মুচিদরজা ও ভাটিদরজার আবর্জনা অপসারণের কাজে লেগে গেলেন।
মুহাজিরদের সেবার জন্যে একটি দল সীমান্তে নিয়োজিত হলো এবং অপর দু’টি দল ওয়াল্টন ও বাউলী ক্যাম্পে অবস্থানকারী মুহাজিরদের প্রয়োজন পূরণের আত্মনিয়োগ করলো।
মোটকথা, মাওলানা মওদূদী তাঁর বহু সঙ্গী-সাথীসহ লাহোরে হিজরত করে সরকার বা জনগণের শরণার্থী না হয়ে বরঞ্চ আগত অন্যান্য মুহাজিরের সেবার ভেতর দিয়েই পাকিস্তানে তাঁর কাজের সূচনা করেন।