মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাওলানার অবদান
দ্বিতীয়বার মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ শেষ করার অল্পদিন পরে আবার ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে মাওলানাকে সঊদী আরব যেতে হয়। এবার তিনি গিয়েছিলেন শাহ সউদের আমন্ত্রণে। শাহ সউদ বহুদিন থেকে এ অভিলাষ পোষণ করতেন যে, তিনি মদীনা শরীফে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবেন। এ প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নের জন্যে তিনি কতিপয় বিশেষজ্ঞের একটা বৈঠক আহ্বান করেন। এ বৈঠকে মাওলানা মওদূদী ‘শাহী মেহমান’ হিসাবে যোগদান করেন।
মাওলানা মওদূদী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আগে থেকেই তৈরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বৈঠকে যোগদানকারী প্রত্যক সভ্যের নিকটে একটি করে উক্ত খসড়ার সকল পেশ করেন। বিস্তারিত আলোচনা শেষে যৎসামান্য রদবদলের পর মাওলানার পরিকল্পনা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং একে ভিত্তি করেই স্থাপিত হয় মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। মদীনা গমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ও দালান-কোঠা দেখে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবার জন্যে শাহ সউদ মাওলানাকে অনুরোধ করেন। অতঃপর মাওলানা মদীনা শরীফে গমন করেন।
শাহ সউদ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মাওলানাকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্ণিং বডির স্থায়ী সদস্য নিযুক্ত করেন। পাকিস্তানী ছাত্রদের জন্যে নানান সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতিও শাহ সউদ দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই পাকিস্তানের বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন।
এবারের ভ্রমণে বহু লোকের সাথে মাওলানার পরিচয় ঘটে। রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্রবৃন্দ মাওলানার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাওলানা বক্তৃতা করেন।
এবার এখানে আফ্রিকার ইসলামী তাবলীগের কর্মসূচী তৈরী করা হয়। নাইরোবীর আঞ্জুমানে হিমায়াতে ইসলামের পক্ষে থেকে মাওলানাকে দাওয়াত করে ব্যপক কর্মসূচী তৈরি হয়। কেনিয়ার মুসলমানগণও অতি আগ্রহে মাওলানার আগমন প্রতীক্ষা করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাওলানার আফ্রিকা ভ্রমণ নানা কারণে সম্ভব হয়নি।
সামরিক শাসনের পর
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৫৮ সালের ৮ই অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ঐ সময়ে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। ফলে দেশের সকল রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। বলাবাহুল্য অন্যান্য দলের ন্যায় এই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতাও বন্ধ থাকে। এর ফলে মাওলানা মওদূদী যে অপ্রত্যাশিত অবসর লাভ করেন, তার পূর্ণ সদ্ব্যব্যবহার তিনি করতে পেরেছিলেন। সুদীর্ঘ কয়েক মাসব্যাপী তাঁর মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনে বর্ণিত ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ভ্রমণের অভিলাষ তিনি বহুদিন যাবত হৃদয়ে পোষণ করতেন। তাঁর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা এবার পূর্ণ হয়। এতদ্ব্যতীত শাহ সউদের ইচ্ছায় মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট খসড়া পরিকল্পনা রচনা করার অবসরও তিনি পেয়েছিলেন। ‘আরদুল কোরআন’ স্বচক্ষে পরিদর্শন করে, তৎসংক্রান্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে তিনি তাফসীর সাহিত্যের এক বিরাট অভাব মোচন করেছেন এবং তাঁর পরিকল্পনার ভিত্তিতে স্থাপিত মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী জগতের এক কীর্তি হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই।
যা হোক, ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের সমাপ্তি ঘটে এবং ঐ বছরই জুলাই মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে রাজনৈতিক দল আইন পাস হয়। এই আইনের বলে পুনরায় রাজনৈতিক দলের কর্মতৎপরতা শুরু হয়। পূর্বতন রাজনৈতিক দলগুলো পুনর্জীবিত হতে থাকে। জামায়াতে ইসলামীর দলীয় সাংগঠনিক কাজ সকলের আগে আগের মতই পুর্ণোদ্যমে চলতে থাকে।
নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী সম্মেলন
ঈসায়ী ঊনিশ শ’ তেষট্টি সালের অক্টোবর মাসে নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর একটি সম্মেলন লাহোরে অনুষ্ঠিত হবে বলে জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শূরা (Central Council) ঘোষণা করে। মাওলানা মওদূদীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর সুদৃঢ় সংগঠন ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে ক্ষমতাসীন দল বিব্রত হয়ে পড়ে। যাতে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে না পারে তাদের জন্যে প্রথমত কোন স্থানের অনুমতি দিতে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার অস্বীকার করে। পরে অবশ্য একটা নিকৃষ্ট স্থানের অনুমতি যদিও বা দেয়া হলো কিন্তু মাইকের অনুমতি দেয়া হলো না। এর বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানে মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। এরপরেও যখন বিনা মাইকে দশ-বারো হাজার লোকের সম্মেলন শুরু হলো, তখন ভাড়াটিয়া গুণ্ডাদল কর্তৃক গোলযোগ সৃষ্টি করা হয় এবং একজন নিরাপরাধ জামায়াত কর্মীকে দিবালোকে পুলিশের চোখের সামনে গুলী করে হত্যা করা হয়। কিন্তু এতসব কাণ্ডকারখানার পরেও পরম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সহকারে সম্মেলনের কাজ শেষ হয়।
এ সম্মেলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাঠকবর্গের গোচরীভূত করতে চাই, যাতে তারা প্রকৃত ব্যাপার সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন। সরকার এ সম্মেলনটি চানচাল করার কোন অপকৌশলই বাকী রাখেননি। প্রায় দশ বছর পর সারা পাকিস্তান ভিত্তিক এ সম্মেলনটি হতে চলেছে বলে এতে দশ-বারো হাজার কর্মীর যোগদানের আশা করা যাচ্ছিল। এর জন্যে যে প্রশস্ত ময়দানের দরকার ছিল তা কিছুতেই না দিয়ে ভাটি দরজা ও টেকসালী দরকার মধ্যবর্তী এক সংকীর্ণ স্থানের অনুমতি সরকার দিলেন। দূরদূরান্ত থেকে যোগদানেচ্ছু কর্মীদের রিজার্ভ করা রেলওয়ে বগিগুলো রওয়ানা হওয়ার অতি অল্প সময় পূর্বে বাতিল করা হলো। এরপর মাইকের অনুমতি দিতে অস্বীকার করা হলো। হাজার হাজার রোকের সম্মেলনের শৃঙ্খলা রক্ষা করা বিনা মাইকে এক অসম্ভব ব্যাপার। মাইক ব্যবহারের গণতান্ত্রিক অধিকারও ত্যাগ করা যায় না। অতএব এই নিয়ে হাইকোর্টে এক রিট দায়ের করা হলো। হাইকোর্টের রায় জামায়াতের অনুকূল হবে মনে করে সে রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সারা পশ্চিম পাকিস্তানে মাইক ব্যবহার হারাম করে দেয়া হলো। অবশ্য বিশেষ অবস্থায় জেলা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন। এ সুযোগ লাহোরের জেলা কর্তৃপক্ষের নিকটে মাইক ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করা হলো। জেলা কর্তৃপক্ষ এই বলে অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন যে, শহরের যে মহল্লায় জামায়াতের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সে মহল্লাবাসী এ ধরনের সম্মেলন পছন্দ করেন না। তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যেন মাইক ব্যবহারের অনুমতি দেয়া না হয়। নতুবা শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা রয়েছে।
জামায়াতের পক্ষ থেকে এ কথা মহল্লাবাসীদের বলা হলে তাঁরা হতবাক হন এবং এটা একটা অবাস্তব অভিযোগ বলে মন্তব্য করেন। উপরন্তু মহল্লাবাসী তীব্র প্রতিবাদ করে জানালেন যে, তাদের পক্ষ থেকে মাইক ব্যবহারের বিরুদ্ধে কোন আপত্তি করা হয়নি। এই প্রতিবাদ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী মহল্লাবাসীদের মধ্যে দশজন এ্যাডভোকেট ও একজন অধ্যাপক ছিলেন।
এ সবের পরেও মাইকের অনুমতি পাওয়া গেল না। ২৫শে অক্টোবর থেকে সম্মেলনের কাজ শুরু হওয়ার কথা। ছয়শত শামিয়ানার বিভিন্ন প্যান্ডেল, একশত গোসলখানা, তিনশত পায়খানা, টেলিফোন, বিজলীবাতি প্রভৃতির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। দু’দিন আগে তেকে লোকজনের আসা শুরু হয়েছে। ২৫শে অক্টোবর কেন্দ্রীয় মসলিসে শূরার (Central Council) এক জরুরী বৈঠকে সিদ্ধান্ত করা হলো যে, বিনা মাইকেই সম্মেলনের কাজ চলবে।
আমরা সন্ধ্যায় ক্যাম্পে গেলাম। দেখলাম এককালের দুর্গন্ধময় আবর্জনায় পরিপূর্ণ স্থানটি আজ অপরূপ স্বর্গীয় সুষমায় ঝলমল করছে। দূরদূরান্ত থেকে আহত বন্ধুদের পারস্পরিক সাক্ষাতে, কোলাকুলি-আলাপ-পরিচয় ইত্যাদিতে অনেক রাত হয়ে গেল।
পরদিন বেলা ৯টায় সম্মেলনে উদ্বোধনী বক্তৃতা করবেন মাওলানা মওদূদী। পনেরো-বিশ হাজার লোকের সমাবেশ। মাওলানা তাঁর বক্তৃতা ছাপিয়ে এনেছিলেন। তাঁর নির্দেশ হলো, তিনি যখন মঞ্চ থেকে তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতা শুরু করবেন, ঠিক সে সময়ে কিছু কর্মী শ্রোতাদের মধ্যে পনেরো-বিশ হাত পরপর একটি টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ছাপনো বক্তৃতা উচ্চস্বরে পড়তে থাকবেন। তাহলে বিনা মাইকে একই সময়ে সকলকে বক্তৃতা শুনানো সম্ভব হবে। ঘড়ির কাঁটার মত সেভাবেই কাজ শুরু হলো।
কাজ শুরু হওয়ার মিনিট দশ পর সভামণ্ডপে হঠাৎ কিছু গুণ্ডার অনুপ্রবেশ দেখা গেল। মদের নেশায় তারা ছিল উন্মত্তপ্রায়। তারা সভার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা শুরু করলো, হঠাৎ শামিয়ানায় আগুন জ্বলে উঠলো, শামিয়ানার বাইরে কিছু হৈ হল্লা ও পিস্তলের শুলীর শব্দ শুনা গেল। মাওলানাকে লক্ষ্য করেও কয়েকবার গুলী বর্ষিত হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি গুলীই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এ সময়ে চারিদিক থেকে এ কথা বলতে শুনা যায়- “মাওলানা বসে পড়ুন, মাওলানা বসে পড়ুন।”
কিন্তু মাওলানা পূর্ববৎ দাঁড়িয়ে থেকেই শান্ত কণ্ঠে বলেন, “আমি যদি বসে পড়ি, তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?”
ইসলামী আন্দোলনের পরিচালকের যথার্থ জবাবই বটে। বিপদের চরম মুহূর্তে নেতৃত্বদানকারী যদি বসে পড়েন, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন, ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়েন, তাহলে সে আন্দোলনের যে অকালমৃত্যু ঘটবে তাতে আর সন্দেহ কি। তাই বিপদের এ মুহূর্তে তিনি ইসলামী আন্দোলনের সুযোগ্য নেতার ভূমিকাই পালন করলেন, নির্ভীকচিত্তে অটল অচল হয়ে দৎাড়িয়ে রইলেন। আদর্শের প্রতি কতখানি নিষ্ঠা তাঁর, খোদার সন্তুষ্টির জন্যে জীবন বিসর্জন করার কি মহান প্রস্তুতি! আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি কতখানি আত্মসমর্পণ!
জামায়াত কর্মীগণ অসীম ধৈর্য এ হিকমতের সঙ্গে দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে গোটা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্বে আনতে ও পূর্ণ পৃঙ্খলা কায়েম করতে সক্ষম হলেন। পুলিশ কিন্তু দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল। যা হোক, মাওলানা পুনরায় তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতা শুরু করলেন এবং শেষ করলেন। আর কোনরূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়নি।
কিন্তু পনেরো বিশ মিনিটের মধ্যে সভামণ্ডপের বাইরে যে এক মহাপ্রলয় সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে গেছে তা আমরা বুঝতে পারিনি। সুশিক্ষিত, সুদক্ষ ও ধৈর্যশীল জামায়াত কর্মীগণ, যাঁরা শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁরা আমাদেরকে কিছু জানতে দেননি।
উদ্বোধনী বক্তৃতার পর আমরা সভামণ্ডপ ও ক্যাম্পের বাইরে গেলাম। মনে হলো একশ-দেড়শ মাইল বেড়ে ঝড় বয়ে গেছে। সম্মেলনের উদ্দেশ্যে স্থাপিত বহু দোকান পাট, খাবারের ও চায়ের স্টল, প্রহরায় নিযুক্ত লাহোর জামায়ত কর্মীদের ক্যাম্প প্রভৃতি একেবারে তছনছ, ছিন্নভিন্ন ধুলায় লুণ্ঠিত। ঘণ্টাখানেক পর জানতে পারলাম জামায়াত কর্মী আল্লাহ বখশ গুণ্ডা কর্তৃক পিস্তলের গুলীতে শহীদ হয়েছেন। শহীদের স্ত্রী ও কন্যাগণ মহিলাক্যাম্পে ছিলেন। মহিলাক্যাম্পের উপরেও গুণ্ডাদেশ আক্রমণ চলেছে। কিন্তু বিস্ময়ে বিমূঢ় হলাম যে, এত কাণ্ড ঘটে গেল, কিন্তু নেই কোন হৈ চৈ, দৌঁড়াদৌড়ি, কান্নার রোল অথবা কোন উদ্বেগ-উত্তেজনা। এমন ধৈর্যস্নাত অনুপম পরিবেশ কোনদিন কল্পনা করতে পারিনি। যেখানে খুন আছে- আর্তনাদ নেই, অগ্নিকাণ্ড আছে- বিলাপ নেই।
মাওলানার উদ্বোধনী বক্তৃতায় পাঠকগণের জ্ঞাতার্থে পেশ করা আবশ্যক বোধ করছি।