আধ্যাত্মিক সংস্কার-সংশোধন
মাওলানা মওদূদী আধ্যাত্মিক সংস্কার সম্পর্কে তর্জুমানুল কোরআনে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেনঃ
‘…. এ কথা ভালো করে বুঝে রাখুন যে, আধ্যাত্মিক সংস্কার-সংশোধনের উপরে বাহ্যিক সংশোধনের কিছুতেই প্রাধান্য দেয়া চলবে না। সর্বপ্রথম নিজেকে কোরআনের কষ্টিপাথরে প্রকৃত মুসলমান বানানোর চেষ্টা করুন। অতঃপর বাইরের পরিবর্তন টিক তত পরিমাণে করতে থাকুন, যত পরিমাণে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন হতে থাকবে। নতুবা আপনি যদি নিছক নিয়ম পদ্ধতি সম্মুখে রেখে বাহ্যিক দিকটাকে রূপ দান করেন যা হাদীস ও ফিকাহ গ্রন্থে একটি মুক্তাকী লোকের বাহ্যিক চিত্র হিসাবে পেশ করা হয়েছে, অথচ প্রকৃত তাকওয়া সৃষ্টি হয়নি, তাহলে আপনার দৃষ্টান্ত এমন একটি তাম্র মুদ্রার ন্যায় হবে যার উপরে স্বর্ণমুদ্রার ছাপ দেয়া হয়েছে। স্বর্ণমুদ্রার ছাপ দেওয়া কটিন কাজ নয়। যমন ইচ্ছা তেমন সস্তা খাতুর উপরে অতি সহজেই এ কাজ করতে পারেন। কিন্তু খাঁটি মুদ্রা সরবরাহ করা কঠিন কাজ। বহুদিন ধরে রাসায়নিকের কাজ করার ফলে এ বস্তু অর্জন করা যায়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এ দেশে কিছুকাল যাবত বাহ্যিক দিকের উপরে অসাধারণ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তার ফল এই যে, স্বর্ণমুদ্রার ছাপসহ তামা, লোহা, সীসা এবং সর্বপ্রকার নিকৃষ্ট ধাতুমুদ্রার প্রচলন হয়ে পড়েছে। ব্যবহারিক জগতের বাজার মহাজনী কারবারে এতোটা তৎপর যে, বেশী দিন এ জাল মুদ্রার প্রবঞ্চনা চলবে না। কিছুকাল ধরে জাল স্বর্ণ মুদ্রা চলেছে, কিন্তু এখন বাজারে তার কানাকড়িও দাম নেই। অতএব আমাদের মধ্যে যে ধরনের দ্বীনদারী সৃষ্টি করতে হবে, তার দাবি এই যে, স্বর্ণমুদ্রার ছাপ লাগানোর পরিবর্তে আমাদের খাঁটি স্বর্ণমুদ্রা হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
বহির্জগতে খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার পরিবর্তে সেই বিদ্রোহীকে বশ করুন যে আপনার ভিতরে বিরাজমান থেকে সর্বদা খোদার আইন ও তাঁর মর্জির বিরুদ্ধে চলবার জন্যে পীড়াপীড়ি করে। এ বিদ্রোহী আপনার মধ্যে প্রতিপালিত হয়ে যদি আপনার উপর এতখানি প্রভাবশীল হয় যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির বিরুদ্ধে তার দাবি মানাতে সক্ষম হয়, তাহলে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা অর্থহীন হয়ে পড়বে। এর দৃষ্টান্ত টিক এমন যে, ঘরের মধ্যে মদের বোতল পড়ে আছে, আর যুদ্ধ চলছে বাইরের মদ্যপায়ীদের সঙ্গে। এই বৈষম্য আমাদের আন্দোলনের জন্যে অতি মারাত্মক। প্রথমে নিজে খোদার সামনে মাথা নত করুন। অতঃপর অপরের নিকটে আনুগত্যের দাবি করুন।’
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক
মাওলানা মওদূদী তাঁর সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে যে উপদেশ বাণী দান করেন, তার মধ্যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন সম্পর্কে তিনি নিম্নরূপ উপদেশ দেন-
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের তাৎপর্য সম্পর্কে কালামে পাকের বর্ণনা অনুযায়ী দেখা যায় যে, মানুষের জীবন, মরণ, ইবাদত, বন্দেগী, কোরবানী ইত্যাদি সব কিছু একমাত্র আল্লাহর জন্যেই থাকবে সীমাবদ্ধ।
******************************************
“পূর্ণ একাগ্রতার সাথে নিজের জীবন ব্যবস্থা বা দ্বীনকে আল্লাহ তায়ালার জন্যেই নির্দিষ্ট করে একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করবে।” –(আনয়াম-১৬২)
******************************************
হযরত রসূল করীম (সাঃ) একাধিকবার এ বিষয়ে এমনভাবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন যে, এর অর্থ, তাৎপর্য ইত্যাদি কোনটাই অস্পষ্ট রয়ে যায়নি।
হুযুর আকরাম (সাঃ) একাধিকবার এ বিষয়ে এমনভাবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন যে, এর অর্থ, তাৎপর্য ইত্যাদি কোনটাই অস্পষ্ট রয়ে যায়নি।
হুযুর আকরাম (সাঃ)-এর বাণীসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের অর্থ ************************************* গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে সকল কাজেই আল্লাহকে ভয় করে চলা -(আল হাদীস)। এতদ্ব্যতীত নিজের সহায় সঙ্গতির তুলনায় আল্লাহর মহান শক্তির উপরেই অধিক ভরসা করা।
******************************************
এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যে লোকের বিরাগভাজন হওয়া
******************************************
(আল হাদীস)
এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা হচ্ছে লোকের সন্তুষ্টি লাভের জন্যে আল্লাহ তায়ালার অসন্তোষ অর্জন করা।
পরে যখন এ সংযোগ-সম্পর্ক ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে এমন অবস্থায় উপনীত হবে, যখন কারো সাথে বন্ধুত্ব, শত্রুতা, লেন-দেন ইত্যাদি সবকিছুই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই সম্পন্ন হবে, নিজের ইচ্ছা, প্রবণতা, আগ্রহ অথবা ঘৃণা ইত্যাদির প্রভাব বিন্দু পরিমাণও থাকবে না, তখনই বুঝতে হবে যে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক পরিপূর্ণ হয়েছে।
******************************************
যে ব্যক্তি কেবল আল্লাহরই জন্যে ভালবাসলো, আল্লাহরই জন্যে শত্রুতা করলো, আল্লাহরই জন্যে কাউকে কিছু দিল এবং আল্লাহরই জন্যে কাউকে কিছু দেয়া বন্ধ করলো, সে তার ঈমান পূর্ণ করলো। (আবু দাউদ)
আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক নিরূপণের উপায়
মাওলানা মওদূদী তাঁর উপদেশ বাণীতে একথাও সুস্পষ্টরূপে বলে দিয়েছেন কিভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক পরিমাপ করা যায়। তিনি বলেনঃ
আমাদের সাথে আল্লাহ তায়ালার সংযোগ-সম্পর্ক বাড়ছে না কমছে, তাই বা আমরা বুঝব কিভাবে? এর সমাধানস্বরূপ আমি আপনাদেরকে বলতে চাই যে, এ অনুভব করার জন্যে স্বপ্নযোগে ‘সুসংবাদ’ অথবা কাশফ-কারামতের প্রয়োজন নেই। অন্ধকার কক্ষে পড়ে থেকে ‘আলোকপ্রাপ্তির’ অপেক্ষা করার কোন আবশ্যকতা নেই। এ সংযোগ-সম্পর্ক পরিমাপ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা নিজেই প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির অন্তরে করে রেখেছেন। আপনি জাগ্রত অবস্থায় দিনের বেলায় যখন খুশী তা পরিমাপ ও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। নিজের জীবন, কর্মপ্রচেষ্টা এবং যাবতীয় চিন্তা, মতবাদ ও ভাবধারা সম্পর্কে পর্যালোচনা করে দেখুন। নিজের হিসাব-নিকাশ ঠিক করার পরে আপনি আল্লাহর সাথে যে চুক্তিতে আবদ্ধ আছেন, তার সাথে মিলিয়ে দেখুন, আপনি তা কতখানি পালন করেছেন। আল্লাহ তায়ালার আমানতসমূহে আপনার অধিকার মাত্র একজন আমানতদার হিসাবেই। সুতরাং আপনাকে অবশ্যই হিসাব করতে হবে যে, আপনি তার মধ্যে কোন প্রকার খিয়ানত করেননি তো? আপনার সময়, শ্রম, দক্ষতা, যোগ্যতা, ধন-সম্পদ ইত্যাদির কতটুকু আল্লাহ তায়ালার বিধান অনুসারে ব্যয়িত হচ্ছে? আবার কতটুকু অন্য পথে নিয়োজিত হয়েছে? আপনার স্বার্থ কিংবা মনোভাবের উপরে আঘাত লাগলে আপনি কতখানি বিরক্ত ও রাগান্বিত হন? এ অবস্থাটির প্রতি লক্ষ্য করে দেখুন-আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করা হয়, তখন আপনারও ক্রোধ, মর্মপীড়া, উদ্বেগ-অশান্তি কিরূপ ও কতখানি হয়? এছাড়া আপনি আরো অনেক প্রশ্ন নিজের মনের কাছে, বিবেকের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এসব প্রশ্নের যে উত্তর সংগৃহীত হবে, তার উপর ভিত্তি করে প্রত্যহ আপনি বুঝতে পারবেন যে, আল্লাহ তায়ালার সাথে আপনার সম্পর্ক ও যোগাযোগ আছে কি না। থাকলে তা কতখানি এবং তা বাড়ছে না ক্রমশ কমে যাচ্ছে? বাশারাত, কাশফ-কারামাত, আনওয়ার কিংবা তাজাল্লিয়াত প্রভৃতি অতিপ্রাকৃতিক উপায় অবলম্বনের চেষ্টা থেকে আপনি বিরত থাকুন। প্রকৃতপক্ষে এ জড় জগতের প্রবঞ্চনামূলক বৈচিত্রের মধ্যে অবস্থান করে তাওহীদের প্রকৃত তত্ত্ব-অনুধাবনের তুলনায় বড় কাশফ আর দ্বিতীয়টি নেই। শয়তান ও তার চেলা-চামুণ্ডাগণ যে প্রলোভন দিচ্ছে ও ভীতি প্রদর্শন করছে, তার মুকাবিলায় সরল সত্য পথে মযবুতভাবে কায়েম থাকা অপেক্ষা কারামত আর কিছু নেই। কুফরী, ফাসেকী ও গোমরাহীর ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় সত্যের আলো দেখতে পাওয়া এবং তা অসুরণের জন্যে কোন ‘নূর’ দেখা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বিশ্বাসী মুমিনদের জন্যে সর্বোৎকৃষ্ট সুসংবাদ লাভের উপায় আল্লাহ তায়ালাকে নিজের প্রভু ও পালনকর্তা হিসাবে গ্রহণ করে সুদৃঢ়ভাবে এই মতবাদের উপর অবিচল থাকা এবং তাঁর নির্দেশ পালন করা।
******************************************
নিশ্চয়ই যারা বলেছে আল্লাহ আমাদের রব, এরপর এ কথা উপর দৃঢ় থেকেছে, তাদের উপরই ফেরেশতা নাযিল হয় এবং তোমরা ভয় পেয়োনা, চিন্তিত হয়োনা, তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ শোন, যার ওয়াদা তোমাদেরকে করা হয়েছে। (হা-মীম আসসাজদা-৩০)
উপরে যা বলা হয়েছে তা যদি প্রকৃত তাসাওউফ না হয়, তো তাসাওউফ আর কাকে বলে? মাওলানা মওদূদী তাঁর সহকর্মীদেরকে এ সব উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তাঁর অমুল্য উপদেশবাণীর প্রতিটি তিনি তাঁর জীবনে প্রতিফলিত করেছেন।
আধ্যাত্মিক সংস্কার, সংশোধন সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর অমূল্য উপদেশ বাণী লিপিবদ্ধ আছে ‘হেদায়াত’ নামক গ্রন্থে।
মাওলানা মওদূদীর পয়গাম
মুসলমানদের কাছে আমার পয়গাম এই যে, মুসলমান হওয়ার কারণে তাঁদের উপর যে দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে, তা যেন তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করে পালন করে। ‘আমরা মুসলমান, খোদা ও তাঁর দ্বীনকে আমরা মেনে নিয়েছি’-শুধু এতটুকু বললেই আপনারা রেহাই পাবেন না। বরং যখন আপনারা খোদাকে নিজেদের খোদা এবং তাঁর দ্বীনকে নিজেদের দ্বীন বলে মেনে নিয়েছেন, তখন তার সাথে সাথে কিছু দায়িত্বও এসে পড়ে, যার অনুভূতি আপনাদের থাকা দরকার এবং তা পালন করার জন্যে চিন্তা ভাবনাও থাকা দরকার। তা যদি আপনারা পালন না করেন, তাহলে এর ভয়াবহ পরিণাম থেকে না এ দুনিয়াতে পরিত্রাণ পাবেন, না আখেরাতে। সে দায়িত্বগুলো কি? তা শুধু এ নয় যে, আপনারা খোদা, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, নবীগণ ও আখেরাতের উপর ঈমান এনে ফেলবেন। তা শুধু এটুকুও নয় যে, আপনারা নামায পড়বেন, রোযা রাখবেন, হজ্জ করবেন এবং যাকাত আদায় করবেন। তা এতটুকুও নয় যে, আপনারা বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার প্রভৃতি ব্যাপারে ইসলামের নির্ধারিত নিয়ম-নীতি মেনে চলবেন। বরং এসব ছাড়াও একটা বিরাট এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আপনাদের উপরে রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, আপনাদের সমগ্র দুনিয়ার সামনে সেই সত্যের সাক্ষ্য নিয়ে দাঁড়াতে হবে, যার উপরে আপনারা ঈমান এনেছেন। কোরআন পাকে মুসলমান নামে একটি স্থায়ী মিল্লাত সৃষ্টির যে একমাত্র উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, আপনারা মানব সন্তানের কাছে সত্যের সাক্ষ্য পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরবেন।
******************************************
‘এবং আমি তোমাদেরকে বানিয়েছি মধ্যবর্তী উম্মত হিসেবে, যাতে তোমরা লোকের কাছে আল্লাহর দ্বীনের সাক্ষ্য দিতে পার এবং রসূল (সঃ) তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীনের সাক্ষ্য দিতে পারেন।’ (বাকারা-১৪৩)
এটা হচ্ছে আপনাদের উম্মত হিসেবে স্থায়ী থাকার প্রকৃত উদ্দেশ্য। এ যদি পূরণ না করেন, তাহলে জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এই হচ্ছে আপনাদের উপরে খোদার নির্ধারিত ফরয। কারণ তাঁর আদেশ-
******************************************
হে ঈমানদারগণ, তোমরা হয়ে যাও খোদার জন্যে দণ্ডায়মানকারী এবং সত্যের সাক্ষ্যদাতা।’ (আন নিসা-১৩৫)
আল্লাহ তায়ালার এ একটা সাধারণ আদেশ মাত্র নয়, বরং এর জন্যে তাকিদ করা হয়েছে।
******************************************
“ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যার নিকটে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সাক্ষ্য আছে এবং সে তা গোপন করে?’ (বাকারা-১৪০)
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আপনাদেরকে এ কথাও বলে দিয়েছেন যে, এ কর্তব্য পালন না করার কি পরিণাম হতে পারে। আপনাদের পূর্বে এ সাক্ষীর কাঠগড়ায় ইহুদীদের দাঁড় করানো হয়েছিল। কিন্তু তারা কিছুটা সত্য গোপন করল এবং কিছুটা সত্যের বিপরীত সাক্ষ্য দিল। মোটকথা, সত্যের পরিবর্তে বাতিলের সাক্ষ্যদাতা হয়ে রইল। তার ফল এই হলো যে, আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অভিশপ্ত করলেন।
******************************************
‘তারা লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্যের দ্বারা নিষ্পেষিত হলো এবং আল্লাহর ক্রোধবহ্নির শিকার হয়ে পড়ল।’ (বাকারা-৬১)
যে সাক্ষ্যদানের দায়িত্ব আপনাদের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে, তার অর্থ এই যে, যে সত্য আপনাদের কাছে এসেছে এবং যা উদঘাটিত করা হয়েছে, মানবের মঙ্গল ও পরিত্রাণের যে পথ দেখানো হয়েছে, তার সত্যতা সম্পর্কে দুনিয়ার সামনে আপনাদেরকে সাক্ষ্য দিতে হবে। এমন সাক্ষ্য যে, তার সভ্যতা যেন পরিস্ফুট হয়ে যায় এবং দুনিয়ার লোকের সামনে দ্বীনের যথার্থতা পরিপূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়ে পড়ে। এই সাক্ষ্য মাত্র দুই প্রকারের হতে পারে। একটি মৌলিক এবং অন্যটি ব্যবহারিক। মৌলিক সাক্ষ্যের পন্থা এই যে, আমরা বক্তৃতা ও লেখনীর সাহায্যে সেই সত্যকে পরিস্ফুট করে তুলব, যা নবীদের (আঃ) মাধ্যমে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। লোককে বুঝানোর জন্যে এবং তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে দেয়ার জন্যে যত প্রকার পন্থা আছে তা অবলম্বন করব। তাবলীগ, দাওয়াত ও প্রচার কার্যে যত সম্ভাব্য উপায় আছে তা অবলম্বন করব। জ্ঞান-বিজ্ঞান যত প্রকার উপায়-উপাদান সংগৃহীত করে দিয়েছে, সে সবের সাহায্যে দুনিয়ার কাছে আল্লাহর নির্ধারিত দ্বীনের শিক্ষাকে সমুজ্জ্বল করে তুলব। চিন্তাধারা ও বিশ্বাসে, নৈতিকতা, তামাদ্দুন ও সমাজ ব্যবস্থায়, জীবিকার্জন ও লেনদেনে, আইন-কানুন ও বিচার ব্যবস্থায়, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-সম্বন্ধের বিভিন্ন দিকে এই ‘দ্বীন’ মানুষের পথ-নির্দেশের জন্যে যা কিছুই পেশ করেছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করব। যুক্তি-তর্ক ও সাক্ষ্য প্রমাণাদির দ্বারা তার সত্যতা প্রমাণ করব এবং যা কিছু তার বিপরীত তার যুক্তিযুক্ত সমালোচনা করে বলে দেব যে, তার মধ্যে অমঙ্গল কতটা রয়েছে। এই মৌখিক সাক্ষ্যদান কখনই সার্থক হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সমগ্র উম্মত সমষ্টিগতভাবে মানবতার পথ প্রদর্শনের জন্যে এমনভাবে চিন্তান্বিত হয়ে না পড়ে, যেমন নবীগণ ব্যক্তিগতভাবে চিন্তান্বিত হতেন। একে সার্থক করবার জন্যে প্রয়োজন যে, এ কাজকে আমাদের সামগ্রিক চেষ্টা-চরিত্র ও জাতীয় সংগ্রাম সাধনার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু করে ফেলতে হবে। আমাদের মন-মস্তিষ্কের সমগ্র শক্তি এবং যাবতীয় উপায়-উপাদান এ কাজে নিয়োজিত করতে হবে। আমাদের সকল কাজকর্ম এই উদ্দেশ্যে অবধারিত হবে এবং সত্যের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানকারী কোন কিছু আমাদের মধ্যে প্রকাশ পেলে, তা কিছুতেই বরদাশত করব না।
এখন রইল ব্যবহারিক সাক্ষ্য। তার অর্থ এই যে, যে সকল আদর্শ আমরা সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছি, তা বাস্তব জীবনে কার্যকর করতে হবে। দুনিয়া শুধু আমাদের মুখ থেকে এ সবের সত্যতার বড় বড় বুলি শুনবে, তা নয়। বরং সে স্বচক্ষে আমাদের বাস্তব জীবনে এ সবের সৌন্দর্য ও বরকত যেন দেখতে পায়। ঈমানের দ্বারা মানুষের চারিত্রিক ব্যবহারে যে মধুরতা সৃষ্টি হয়, আমাদের আচার-ব্যবহারে তার স্বাদ যেন সে গ্রহণ করতে পারে। সে যেন স্বয়ং দেখতে পায় যে, দ্বীনের পরিচালনায় কেমন সৎ লোক তৈরি হতে পারে, কত পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন তামাদ্দুন জন্মলাভ করতে পারে, কত সুষ্ঠুভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যকলার পরিস্ফুরণ হতে পারে, কত ন্যায়পরায়ণ সহানুভূতিসম্পন্ন ও সর্বসম্মত অর্থনৈতিক সহযোগিতা পরিস্ফুট হয়ে পড়ে এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের প্রতিটি দিক কিভাবে সংশোধিত, সুবিন্যস্ত ও মঙ্গলময় হয়। এই সাক্ষ্যদান শুধুমাত্র তখনই সার্থক হতে পারে, যখন আমরা ব্যক্তিগতভাবে এবং জাতীয় পর্যায়ে আমাদের দ্বীনের সত্যতার মূর্তিমান সাক্ষ্য হয়ে পড়ব। আমাদের প্রতিটি ব্যক্তির চরিত্র তার সাক্ষ্যের প্রমাণ দেবে, ্মাদের গৃহ তার সুরভিতে ভরপুর হবে, আমাদের দোকান-পাট, কল-কারখানা তার আলোকে আলোকিত হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠান ও আমাদের শিক্ষাগার তার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে। সাহিত্য ও সাংবাদিকতা তার সৌন্দর্যের সনদ বহন করবে। আমাদের জাতীয় পলিসি ও সামগ্রিক চেষ্টা-চরিত্র তার সত্যতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হবে। মোটকথা, আমরা যেখানেই এবং যেখাবেই কোন ব্যক্তি বা জাতির সংস্পর্শে আসি না কেন, আমাদের ব্যক্তিগত এবং জাতীয় চরিত্র যেন এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, যে সকল আদর্শকে আমরা সত্য বলে প্রচার করি, তা প্রকৃতপক্ষেই সত্য এবং তার দ্বারাই সত্যিকারভাবে মানবজীবন সর্বাঙ্গ সুন্দর, সর্বোৎকৃষ্ট ও উন্নততম হয়। অতঃপর আরো বলতে চাই যে, এই সাক্ষ্যদান পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে শুধুমাত্র তখনই যখন একটি রাষ্ট্র এই সাক্ষ্যদান পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে শুধুমাত্র তখনই যখন একটি রাষ্ট্র এই আদর্শের ভিত্তিতে স্থাপিত হবে। অতঃপর সে রাষ্ট্র পরিপূর্ণ দ্বীনকে কার্যকর করে ন্যায়বিচার দ্বারা স্বীয় সংস্কারমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করবে। স্বীয় সুষ্ঠু পরিচালনা দ্বারা, শান্তি ও নিরাপত্তা দ্বারা, জনগণের মঙ্গল ও উন্নতি দ্বারা, শাসকবৃন্দের পূত পরিত্রের দ্বারা, মহৎ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দ্বারা, ন্যায়নিষ্ঠ বৈদেশিক নীতি দ্বারা, মহত্ত্বপূণর্ যুদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য সন্ধিসূত্র দ্বারা দুনিয়ার সামনে এ কথার প্রমাণ দিবে যে, যে ’দ্বীন’ এ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে তা প্রকৃতই মানবীয় মঙ্গলের প্রতীক এবং তা প্রতিপালন করার মধ্যেই মানব জাতির মঙ্গল নিহিত রয়েছে। এই সাক্ষ্য যখন মৌলিক সাক্ষ্যের সাথে মিলে যাবে, মুসলিম জাতির উপরে ন্যস্ত দায়িত্ব পরিপূর্ণ হবে, তখনই মানব জাতির উপরে হয়ে যাবে যুক্তি-প্রমাণাদির পরিসমাপ্তি এবং সমগ্র মুসলিম জাতি এতটা যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে যে, আখেরাতের আদাল ত নবী করীম (সাঃ)-এর পরে দণ্ডায়মান হয়ে সাক্ষ্য দিতে পারবে যে, নবী (সাঃ) আমাদের কাছে যে বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন, তা আমরা অন্যদের নিকটেও পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এরপরেও যদি তারা সৎ পথে এসে না থাকে তো এর জন্যে তারাই দায়ী।
অতএব আমার পয়গাম ঠিক তাই, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী (সাঃ)-এর মুখ দিয়ে পাঠিয়েছিলেনঃ
******************************************
“এস, আমরা এমন একটি বস্তু গ্রহণ করি, যা তোমাদের ও আমাদের কাছে এক। তা হচ্ছে এই যে, আমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারও দাসত্ব আনুগত্য করব না, তার সাথে কোন কিছুর শরীক করব না এবং আমাদের মধ্যে কেউ কাউকেও, আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রভু হিসাবে মানব না। (আলে ইমরান-৬৪)
আমরা সকলে এক খোদার বান্দাহ, একই রাসূলের অনুসারী, একই কিতাবে বিশ্বাসী এবং একই কেবলা আমাদের কেন্দ্র ও প্রত্যাবর্তনের মূল। আসুন আমরা এ কথার উপরে একমত হই যে, আল্লাহ ব্যতীত এ দুনিয়ায় আমরা আর কারো দাসত্ব করব না, তাঁর আইন ব্যতীত অন্য কোন আইন মানব না এবং তাঁর নির্দেশর ব্যতীত অন্য কারো নির্দেশ এ দুনিয়ায় চলতে দেব না।
শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর চিন্তাধারা
আমাদের ইতিহাসে সময়ের দাবির প্রেক্ষিতে স্যার সাইয়েদ আহমদ একটি শিক্ষা পরিকল্পনাসহ আবির্ভুত হন। অতঃপর সে পরিকল্পনার যা কিছু সাময়িক উদ্দেশ্য ছিল, তার ভাল এবং মন্দ ফলাফলও প্রকাশ পায়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান একটি স্বাধীনরাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অতঃপর একটি স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্রের জন্যে সে পরিকল্পনার সকল প্রয়োজন শষ হয়ে গেছে। তা একটি স্বাধীন জাতির জন্যে এমন আর মোটেও উপযোগী নয়।
এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের কিছু পূর্বে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বপ্রথম একটি পরিপূর্ণ শিক্ষা বিপ্লবের বলিষ্ঠ আওয়াজ শ্রুতিগোচর হয়। এ ছিল মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর আওয়াজ। এ শুধু একটি আওয়াজই ছিল না, বরঞ্চ এর সাথে মাওলানা মওদূদী ক্রমাগত তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ ও ভাষণের মাধ্যমে একটি সার্বিক শিক্ষা পরিকল্পনা, তা কার্যকর করার বাস্তব কর্মসূচী, পাঠ্য তালিকা প্রভৃতি বিষয়সমূহের প্রচুর মাল-মসলা আমাদের জন্যে রেখে দিয়েছেন।
মাওলানা একটি সত্যিকার ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয়ে এত বেশী মসি চালনা করেছেন যে, সে সব আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে এখানে তার কেন্দ্রীয় দৃষ্টিকোণ সংক্ষেপে পেশ করা হচ্ছে। তিনি বলেনঃ
“এখন এটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যে, এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে যে দু’টি বিপরীতমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তার উভয়টিকেই রহিত করতে হবে। অর্থাৎ ইংরেজদের কর্তৃত্বাধীন যে প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষা এবং আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তার বিলোপ সাধন করতে হবে। এ উভয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে এমন এক নতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন, যা একদিকে যেন অতীতের সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত হয় এবং অপরদিকে ঐ সকল প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, যা একটি মুসলমান জাতি, একটি স্বাধীন জাতি এবং একটি উন্নয়নকামী জাতি হিসাবে এ সময়ে আমাদের জন্যে অপরিহার্য।”
শিক্ষা বিপ্লবের এ আহ্বান জানাতে গিয়ে মাওলানা তাঁর একাধিক প্রবন্ধে ঈন্সিত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো এবং তার বুনিয়াদী মূলনীতি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন। তবে ইসলামী শিক্ষানীতি সম্পর্কে আলোকপাত করার পূর্বে মাওলানা মানব, মানবের জীবন দর্শন, বিশ্বপ্রকৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে সঠিক ও সুস্পষ্ট ধারণা পেশ করেছেন, যে সুস্পষ্ট ও সঠিক ধারণার উপরেই ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হতে পারে। অতঃপর শিক্ষা দর্শনের বর্ণনা প্রসঙ্গে জ্ঞানের প্রকৃত সংজ্ঞা ও তার প্রকৃত উৎসের ব্যাখ্যা দান করেন।
শিক্ষার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি চরিত্র গঠনের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি। মানুষের চরিত্র মহৎ না হলে সমাজে সঠিক ভারসাম্য স্থাপিত হতে পারে না। মানুষ যেহেতু খোদার প্রতিনিধি, সে জন্যে এ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকার উৎকৃষ্ট পন্থা এই যে, সে তার চরিত্র ও আচার-আচরণে সে সব গুণাবলী সৃষ্টি করবে যার প্রকৃত অধিকারী স্বয়ং তার প্রভু ও স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তার চরিত্রের মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে স্নেহ-মমতা, দয়া দাক্ষিণ্য, ন্যায়-নীতি, সুবিচার প্রভৃতি গুণাবলী।
মাওলানা তাঁর ‘তালীমাত’ (শিক্ষা ব্যবস্থাঃ ইসলামী দৃষ্টিকোণ) গ্রন্থে বলেনঃ “আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিক প্রশিক্ষণ অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে নৈতিক প্রশিক্ষণের উপর।
লুপ্ত যোগ্যতা ও প্রতিভার বিকাশকেও তিনি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো খোদার প্রকৃত পরিচয় লাভ করা। অতৎপর তার যোগ্যতা ও প্রতিভার বিকাশ এমন হওয়া উচিত যাতে সে সমাজের একটি মঙ্গলকর সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
মাওলানা বলেন, শিক্ষা মাধ্যমে কোন একটি সভ্যতা-সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শিক্ষা উদ্দেশ্য শুধু সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখা নয়, বরং তাকে ভবিষ্যত বংশধর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য এই হওয়া উচিত যে, যে মতবাদ ও লক্ষ্যের অধীন জীবন পরিচালিত হচ্ছে, তার ভিত্তিতেই তার উন্নতি সাধন করতে হবে। জীবন্ত জাতিসমূহ এহেন উদ্দেশ্যেই তাদের নিজস্ব ভবিষ্যত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে থাকে।
নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ
মাওলানা বলেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য এমন ব্যক্তিবর্গ তৈরি করা, যারা আধুনিক যুগে দ্বীনে হকের মূলনীতি অনুযায়ী সঠিকভাবে দুনিয়ার নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। অর্থাৎ শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো উৎকৃষ্ট নাগরিক সৃষ্টি করা যাতে তারা দুনিয়ায় নেতৃত্ব দানের যোগ্য হতে পারে। দুনিয়ার নেতৃত্বদান করা যে জাতির উদ্দেশ্য, তারা তাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলে যার দ্বারা এ উদ্দেশ্য পূরণ হয়।
মাওলানা মওদূদীর শিক্ষানীতির উপরে বিভিন্ন মহল থেকে গবেষণা শুরু হয়েছে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের “শিক্ষা ও গবেষণা” সংস্থার অধ্যাপক মুহাম্মদ হুসাইন “মাওলানার শিক্ষা সম্পর্কিত চিন্তাধারা” শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন, যা লাহোর গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থা থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষামোদী সুধীগণের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে এ জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধটি।
পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে মাওলানা
পাকিস্তান একটি আদর্শভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে অস্তিত্ব লাভ করার কয়েক বছর পরও এর শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক তেমনি রইল যেমনটি ছিল ইংরেজদের আমলে গোলামীর যুগে। বৈদেশিক ও বিজাতীয় শাসকদের রচিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে পাকিস্তানের আদর্শভিত্তিক একটা শিক্ষাব্যবস্থার কোন চেষ্টা-চরিত্রই হলো না। যদিও গোটা জাতি হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিল যে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপায়নের জন্যে যত কিছুর আয়োজন করতে হবে, তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে নিজস্ব জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে। কিন্তু শাসকগণ চলে যাওয়া প্রভুর ফেলে যাওয়া স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রইলেন। শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো যেমন ছিল, হুবহু তেমনি রইল, বরং এর কিছুটা সংস্কার করতে গিয়ে আরও করা হলো জরাজীর্ণ, করা হলো জাতীয় আদর্শের একেবারে পরিপন্থী।
১৯৫২ সালের ২৫শে ডিসেম্বর লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান ইসলামী জমিয়তে তালাবার বার্ষিক সম্মেলনে মাওলানা মওদূদী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দোষ-ত্রুটি, এর ভয়াবহতা ও বিষময় পরিণাম সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করেন এবং পাকিস্তানের উপযোগী একটা শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো সংক্ষেপে পেশ করেন। তাঁর সে ঐতিহাসিক ভাষণ পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। তার থেকে কিছুটা নিম্নে উদ্ধৃতি করছি-