মাওলানার মুক্তি
মাওলানার বিনাশর্তে মুক্তির জন্যে শুধু পাকিস্তান থেকে নয়, সারা মুসলিম বিশ্ব থেকে জোরদার দাবি উঠেছিল এবং তার বিবরণ পূর্বে দেয়া হয়েছে। সরকার অবশেষে চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হ্রাস করে সাড়ে তিন বছর করেন। অতঃপর পাকিস্তানে এক আইন বিভ্রাটের ফলে মাওলানা দু’বছর ন’মাস পরে মুক্তিলাভ করেন। আইন বিভ্রাট এই যে, ১৯৫৮ সালের শেষের দিকে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মুহাম্মদ আলী মরহুম ঘোষণা করেছিলেন যে, সেই বছরই ২৫শে ডিসেম্বর কায়েদে আযমের জন্মদিনে তিনি জাতিকে একটি ইসলামী শাসনতন্ত্র উপহার দেবেন।
গভর্ণর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ মাওলানা মওদূদী ফাঁসীর মঞ্চে ঝুলতে না দেখে বড়ই মর্মপীড়া ভোগ করছিলেন। এদিকে আবার প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ইসলামী শাসনতন্ত্রের ঘোষণা তার কাট ঘায়ে নূনের ছিটে দিল। তাই তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে পাকিস্তান গণপরিষদ ভেঙ্গে দিলেন।
এর ফলে দেশে এক শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার ফলে যাবতীয় আইন-কানুন বাতিল হয়ে যায়।
এদিকে মাওলানার মুক্তির জন্যে হাইকোর্টে বন্দিত্বের কারণ প্রদর্শন (Habious Corpus) আবেদন করা হয়। কিন্তু কোর্টে শুনানি শুরু হওয়ার পূর্বেই সরকার বিনাশর্তে মাওলানার মুক্তি ঘোষণা করেন।
মাওলানার পূর্ব পাকিস্তান সফর
ফাঁসীর মঞ্চ ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মাওলানার মুক্তির পর মুসলিম বিশ্ব খোদার দরগায় শুকরিয়া আদায় করে। পূর্ব পাকিস্তানের লোক মাওলানাকে কোনদিন দেখেনি বলে তারা তাঁর সাক্ষাৎ কামনা করতে লাগল। উপরন্তু মাওলানার পূর্ব পাকিস্তান সফর আশু প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।
এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে পুনর্বার এক নতুন শাসনতন্ত্র সংকট দেখা দেয়। গভর্ণর জেনারেল কর্তৃক গণপরিষদ ভেঙ্গে দেওয়ার পর সামরিক ও বেসামরিক লোক নিয়ে এক ট্যালেন্টেড (প্রতিভাবন) মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অতঃপর কনভেনশন করে অর্ডিন্যান্সের সাহায্যে একটা অনৈসলামী ও অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়। কিন্তু ফেডারেল কোর্টের রায়ে কনভেনশন গঠন নিয়মতন্ত্র বিরোধী ঘোষিত হওয়ার পর গভর্ণর জেনারেল ও ট্যালেন্টেড মন্ত্রসভা ১৯৫৫ সালের মে মাসে গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হন। এ নির্বাচনের পর চৌধুরী মুহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাঁর একান্ত আগ্রহ ছিল দেশে একটা ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার। কিন্তু গণপরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পথে চরম বাধা হয়ে দাঁড়ান। এ দেশে ইসলামী শাসনতন্ত্রের পথ বন্ধ করার জন্যে যে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবের অপসারণ ও শেষ পর্যন্ত গণপরিষদ বাতিল করা হয় তার জন্যে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রবল ওকালতি ছিল। অতঃপর ট্যালেন্টেড মন্ত্রসভার আইনমন্ত্রী থাকাকালীন কনভেনশনের মাধ্যমে একটা গণতন্ত্র বিরোধী ও ধর্মহীন শাসনতন্ত্র জাতির মাথায় চাপিয়ে দেওয়ার আশাও সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্মূল হয়েছিল। অতএব পুনর্নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক যাতে ইসলামী শাসনতন্ত্র তৈরি হতে না পারে তার জন্যে তিনি হিন্দু কংগ্রেসের সদস্যদের নয়ে এক শক্তিশালী ইসলাম বিরোধী ফ্রন্ট গঠন করেন। তাই তাদের এ অপকৌশল বানচাল করে ইসলামী শাসনতন্ত্রের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যে গণআন্দোলন জোরদার করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।
মাওলানা মওদূদী জেল থেকে মুক্তি লাভ করার পর ১৯৫৬ সালের ২৪ শে জানুয়ারী প্রথমবার পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি দেড় মাসকাল এখানে অবস্থান করে প্রায় প্রতিটি জেলা শহর ও উল্লেখযোগ্য মহকুমা শহরে গমন করেন। এ উপলক্ষে তিনি কয়েক লক্ষ জনতার সামনে বক্তৃতা করেন, ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন, ইসলামী শাসনতন্ত্রের আবশ্যকতা বুঝিয়ে দেন, শত শত প্রশ্নের জবাব দেন এবং শত শত লোককে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ দান করেন। এভাবে তিনি পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলেও ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবি জোরদার করে তোলেন। উপরন্তু তিনি এ প্রদেশের অভ্যন্তরীণ সকল সমস্যা ও অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
সফরের শেষ ভাগে ৪ঠা মার্চ ঢাকা জিলা বোর্ড হলে জামায়াতে ইসলামীর এক কর্মী সম্মেলনে মাওলানা মওদূদী বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের যাবতীয় সমস্যা ও অভাব-অভিযোগ এবং তার সমাধানের সুষ্ঠু পথ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেন। “পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা ও তার সমাধান” নামে উক্ত বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়।
মাওলানা মওদূদী পূর্ব পাকিস্তানীদের কয়েকটি জটিল সমস্যার বিস্তারিত আলোচনা করে তার সমাধানও পেশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানীদের গুরুতর অভিযোগগুলোর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে তার উপর আলোকপাত করেন।
পূর্ব পাকিস্তানে মুহাজিরগণ যে ভুল পথে চলছিল সে সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন-
“যাঁরা এখানে সরকারী কর্মচারী হিসাবে এসেছেন, তাঁদের একটা বিরাট অংশ বিশেষ কোন প্রশংসনীয় ভূমিকা অর্জন করেননি। ইংরেজদের চেয়ারে বসে তাঁরা নিজেদেরকে ইংরেজ মনে করে নিয়েছেন। অপর জাতির উপর শাসন চালাতে ইংরেজরা যে নীতি অনুসরণ করত, তাঁরাও সেই নীতি অবলম্বন করেছেন। তাঁরা একথা চিন্তা করেননি যে, নিজ দেশের নিজ জাতির শাসন তথা খেদমতের ভারই তারা গ্রহণ করেছেন। ইংরেজদের অনুকরণ করাই যদি তাঁদের লক্ষ্য ছিল, তবে ইংল্যান্ডে প্রচলিত নীতি অনুসরণ করাই তাঁদের কর্তব্য ছিল। বস্তুত যে সব কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধরণ এ ধারণা পোষণ করতে আরম্ভ করেছে যে, তাদেরকে একটি কলোনীতে পরিণত করা হয়েছে, এই হচ্ছে তার প্রধান কারণ।”
(পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা ও সমাধান-পৃঃ ৫)
বহিরাগতদের প্রতি মাওলানার হুঁশিয়ারী
বহিরাগত ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তিনি নিম্নোক্ত মন্তব্য করেনঃ
“বহিরাগত ব্যবসায়ী ও কারখানা মালিকগণ এরসে এখানকার শিল্প ও বাণিজ্য সামলে নিয়েছেন সেজন্যে আমরা তাঁদের নিকট কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাঁদের উচিত ছিল এ দেশকে নিজেদের দেশ এবং এ জাতিকে নিজেদের জাতি মনে করে অনুন্নত ভাইদের সাহায্য করে উন্নত করবার চেষ্টা করা, শিল্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার জন্যে তাদের সাহায্য করা, তাদের দুরবস্থা দুর করার নিমিত্ত এখানের উপার্জিত অর্থ এখানেই ব্যয় করা, তাদের মঙ্গল ও উন্নতির জন্যে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান কায়েম করা এবং তাদের বিপদ-আপদের সময় যথোপযুক্ত সাহায্য করা। বড়ই দুঃখের বিষয়, তাদের মধ্যে অনেকেই এ কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না।” (উক্ত পুস্তিকা-পৃঃ ৭-৮ দ্রঃ)
ভাষা সমস্যা
পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ভাষা সমস্যা সম্পর্কে মাওলানা যে স্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেন। তা নিম্নে দেয়া হলোঃ
“ভাষা সমস্যাই হলো সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে কখনো কোন বিদ্বেষ ভাব ছিল না। বরঞ্চ এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এখানকার শিক্ষিত লোকদের মধ্যে একটা বিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত হতো। এখানকার সাধারণ লোক উর্দুভাষীদেরকে অত্যন্ত সম্মান করত। অদ্যাবধি আরবী ভাষার পরে উর্দু ভাষার এক প্রকার ধর্মীয় মর্যাদাও রয়েছে। কিন্তু একেই একমাত্র জাতীয় ও রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করলে এখানকার লোকদের পক্ষে তা বিশেষ অসুবিধার কারণ হয়ে পড়ত। কেননা এখানকার শিক্ষিত লোকেরাও উর্দু ভাষা জানেন না। ফলে তারা প্রতিক্ষেত্রেই উর্দুভাষী শিক্ষিতদের পশ্চাতে পড়ে থাকবার আশঙ্কা করেছিলেন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাভাষীগণ উর্দুর সাথে বাংলাকেও সরকারী ভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। পরিস্থিতির তীব্রতা সম্যক উপলব্ধি করে প্রথম দিনেই এ দাবি মেনে নিলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া হতো। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করা হয়েছে। একদিকে একে দমননীতির সাহায্যে নিষ্পেষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, আর অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বার বার এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হয়েছে। এ কারণে বাংলার দাবি একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা না থেকে একটি মতাদর্শ ও ভাসপ্রবণতার রূপ গ্রহণ করেছে এবং এ তারই স্বাভাবিক পরিণতি। কেননা, একটি দাবির উত্তরে যদি ‘দেয়া হবে না’ বলা হয়, তবে প্রতি উত্তরে ‘আদায় করে ছাড়ব’ এ আওয়াজ অবশ্যই তোলা হবে। উক্ত ব্যাপারেও ঠিক এ-ই ঘটেছে।”
সরকারী চাকরি সমস্যা
মাওলানা মওদূদী ঢাকা ডিবি হলে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে সরকারী চাকরির ব্যাপারেও পূর্ব পাকিস্তানের অন্তরের ভাষাই ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন-
“দ্বিতীয় সমস্যা হলো সরকারী চাকরি সম্পর্কিত সমস্যা। এতে সন্দেহ নেই যে, ইংরেজ আমলে মুসলমানগণ চাকরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ছিল। উচ্চ পদগুলোতে তাদের আনুপাতিক স্থান শূন্যের কোঠায় ছিল। অবশ্য ইংরেজ ও হিন্দুদের দু’শত বছর যাবত কৃত এ ত্রুটির সহসা সংশোধন করা সহজসাধ্যও ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, পূর্বাঞ্চলের মুসলমানগণ ন্যায়তই এ আশা পোষণ করে আসছিল যে, তাদেরকে উন্নতি লাভের সুযোগ দেয়া হবে। দুঃখের বিষয়, তাদের এ আশা পূর্ণ করা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের যুবকদের মধ্যে এ সম্বন্ধে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে তা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। চাকরিজীবী লোকদের এ মনোবৃত্তি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, যেখানেই তাদের প্রভাব আছে সেখানেই তারা নিজের আত্মীয়-স্বজনকে চাকরিতে ভর্তি করবার জন্যে চেষ্টা করে থাকে। অন্ততপক্ষে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন প্রভাবশালী লোকদের এ অবিচার থেকে মুক্ত থাকার প্রয়োজন ছিল। তাদের কর্তব্য ছিল বাংলাদেশের অবহেলিত ও অনুন্নত মুসলমান ভ্রাতাগণকে উন্নত করার চেষ্টা করা, যাতে তারা দেশের সেবায় সমান অংশগ্রহণ করার সুযোগও লাভ করতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ ব্যাপারে অত্যন্ত অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। এমন কি এ অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে একটি সাধারণ অভিযোগের সৃষ্টি হয়েছে।” (উক্ত পুস্তিকা-১৪-১৫ পৃঃ দ্রঃ)
দেশ রক্ষা সমস্যা
পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক সমস্যা নিরাপত্তা সমস্যা। এ সম্পর্কে মাওলানা বলেন-
“এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো সৈন্য বিভাগের চাকরি। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি বাস্তবিকই আপত্তিজনক। আজ পর্যন্ত এখানে ইংরেজ আমলের এ ধারণাই প্রচলিত রয়েছে যে, সৈন্য বিভাগের জন্যে কেবল ‘সামরিক জাতিই’ উপযুক্ত। এর পরিণাম এই হয়েছে যে, সৈনিকবৃত্তি একটা বিশেষ এলাকার লোকদের জন্যে একচেটিয়া হয়ে রয়েছে। সামরিক বাজেটের কেবল আর্থিক সাহায্যই নয়, সামরিক শিক্ষার অন্যান্য জরুরী বিষয়সমূহেও কোন উল্লেখযোগ্য অংশই পূর্ব পাকিস্তানীদের দেয়া হচ্ছে না।
জানি না আমাদের ক্ষমতাসীন লোকদের নিকট সিংহল, বার্মা, সিরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশগুলির বাসিন্দাগণ সামরিক জাতি বলে গণ্য হয় কিনা। যদি না হয়ে থাকে, তবে হয় তাদের দেশরক্ষার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত, নতুবা অন্যস্থান থেকে সামরিক লোক আহ্বান করে সৈন্যবাহিনী গঠন করা উচিত। আর যদি এ দেশগুলি নিজেদের দেশ নিজেরাই রক্ষা করতে সক্ষম হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা তাদের চেয়ে কোন অংশে নিকৃষ্ট যে, তাদেরকে সৈন্য বাহিনীর চাকরির অযোগ্য বলা হবে? এ ব্যাপারটির গুরুত্ব এখানেই শেষ নয়। বরঞ্চ এ পাকিস্তানের জীবন-মরণ সমস্যা। এ দেশের অধেরএকরও বেশী লোকসংখ্যা এমন একটি ক্ষুদ্র এলাকায় বাস করে যার তিনটি দিকই হিন্দুস্তানের আওতার মধ্যে রয়েছে। তার প্রায় চৌদ্দশত মাইলের সীমান্ত রক্ষা করতে হয়। যুদ্ধের সময় একে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোন সাহায্য করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এখানকার বাসিন্দারা যদি নিজেদের দেশ নিজেরা রক্ষা করতে সক্ষম না হয় এবং এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে সর্ববিষয়ে যোগ্য করে তৈরি করা না হয়, তবে কখনও তাদের মনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আসবে না। তাদেরকে আপনারা এ বিশ্বাস দিয়ে কখনও নিশ্চিত করতে পারবেন না যে, যুদ্ধে সময় পূর্বাঞ্চলকে পশ্চিমাঞ্চল রক্ষা করবে। কারণ এ অর্থ এই দাঁড়ায় যে, প্রথমত একবার পূর্বাঞ্চল শত্রু কর্তৃক লাঞ্ছিত হবে, তারপর পশ্চিমাঞ্চল থেকে আপনারা শত্রুকে বিতাড়িত করার জন্যে চাপ দিবেন। এ একটি ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কিছুই নয়। এবং এটাই পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের মনক্ষুন্ন হোয়ার প্রধান কারণ।”
(উক্ত পুস্তিকা-১৫-১৬ পৃঃ দ্রঃ)
সামরিক শাসন শেষ হওয়ার পর রাজনৈতিক দল আইনসঙ্গতভাবে কাজ শুরু করার পর রংপুর শহরে জামায়াতে ইসলামীর তিনদিনব্যাপী এক সম্মেলন হয়। ১৯৬২ সালের ১৮ই নভেম্বর এ সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় মাওলানা বলেন-
“আমি সামরিক শাসনের পূর্বে বহুবার বলেছি এবং আজ আবার বলছি যে, পূর্ব পাকিস্তানকে দেশরক্ষার ব্যাপারে সর্বতোভাবে প্রস্তুত করতে হবে।”
মাওলানার উপরিউক্ত ভাষণে একথাই সুষ্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, তিনি পাকিস্তানের প্রতিটি ইঞ্চি ভূখণ্ড ও তার অধিবাসীকে নিজের বলে মনে করেন। প্রাদেশিকতা অথবা ভাষাভিত্তিক সংকীর্ণতা তার অন্তরকে স্পর্শ করতে পারেনি কোনদিন। পরিপূর্ণ ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ ছাড়াও একটা উদার মানবতাবোধ ছিল মাওলানার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। পাকিস্তানের বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যার প্রতি তাঁর ছিল সমান দরদ। এজন্যে এর কোনটাকেই তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি কোনদিন।
মাওলানার সেদিনের ঢাকা ডিবি হলের বক্তৃতায় এর সুন্দর অভিব্যক্তি তিনি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন-
“পাকিস্তান আমার দেহ ও প্রাণের তুল্য। আমার দুই হাতের মধ্যে যেমন আমি পার্থক্য করতে পারি না, তদ্রূপ পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যেও কোন পার্থক্য করতে পারি না। আমার দুই হাতের মধ্যে যেটিই অসুস্থ হোক তা আমার পুরো শরীরেরই একটা রোগ। এর কারণ অনুসন্ধান করা ও সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা আমার কর্তব্য। আর তা না করার মানে হচ্ছে নিজের সাথে শত্রুতা করা।”
ইসলামী শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়ার পর
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ আলীর আন্তরিক চেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণীত ও গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ ইসলামী শাসনতন্ত্র পাস করে। ২রা মার্চ গভর্ণর জেনারেল স্বাক্ষর করেন এবং ২৩শে মার্চ থেকে তা কার্যকর করা হয়। বলা বাহুল্য, এ শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়ার সময় মরহুম সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁর আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য ও কংগ্রেসী সদস্যসহ গণপরিষদ বর্জন করেন। ইসলামী শাসনতন্ত্র গৃহীত হলেও দেশের ইসলাম বিরোধী মহল থেকে নিম্নের কয়েকটি বিষয়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
(১) রাষ্ট্রের ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামকরণ,
(২) রাষ্ট্রপ্রধানের মুসলমান হওয়া
(৩) কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী আইন প্রণয়ন না করা,
(৪) মদ, জুয়া, ব্যভিচার ইত্যাদি বন্ধ করা।
পাকিস্তানের জন্য ইসলামী শাসনতন্ত্র (যদিও ইসলাম ও গণতন্ত্রের দৃষ্টিতে তা একেবারে ত্রুটিহীন ছিল না) গৃহীত হলো বলে কিছু লোকের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো মাওলানা মওদূদীর উপর। তারপর শুরু হয় মাওলানার বিরুদ্ধে অভিযোগ ও সমালোচনা। তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভিত্তিহীন ও পরিতাপজনক অভিযোগ এই ছিল যে, তিনি বিনা নির্বাচনে শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামীর আমীরের পদ অধিকার করে আছেন।
মাওলানা যে কোনদিনই নেতৃত্বের অভিলাষী ছিলেন না, একথা প্রমাণ করার জন্যে তিনি সন্তুষ্টচিত্তে আমীরের পদ থেকে ইস্তিফা দান করেন। উপরন্তু তিনি ঘোষণা করেন যে, দীর্ঘদিন কারাবাস যাপনের ফলে তাঁর ইস্তিফা দানের পর চৌধুরী গোলাম মুহাম্মদ সাহেবকে সাময়িকভাবে আমীর নির্বাচিত করে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমীর নির্বাচনের প্রস্তুতি চলতে থাকে।
এ উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাহওয়ালপুর দেশীয় রাজ্যের অন্তর্গত মাছিগোট নামক স্থানে সপ্তাহব্যাপী জামায়াতে ইসলামীর এক সদস্য সম্মেলন হয়। অধম গ্রন্থকারেরও এ সম্মেলনে যোগদান করার সৌভাগ্য হয়েছিল। পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আট শতাধিক জামায়াত সদস্য এ সম্মেলনে যোগদান করেন। এটা পরিপূর্ণ শান্ত-শিষ্ঠ ও অনুপম পবিত্র পরিবেশে এ সম্মেলনের কাজ সমাপ্ত হয়। এ সম্মেলনেই নতুন করে জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। দেখা গেল যে, আট শতাধিক নির্বাচকের মধ্যে মাত্র চারজন ব্যতীত সকলেই মাওলানা মওদূদীকে আমীর পদের জন্যে গোপন ব্যালটে ভোট দান করেছেন। অতএব সকলের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্পিত দায়িত্ব মাওলানা এড়াতে পারলেন না। তিনি পুনর্বার আমীর পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যত কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে মাওলানা দীর্ঘ ছয় ঘণ্টাব্যাপী এক অতি যুক্তিপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দান করেন। এ বক্তৃতা জামায়াতে ইসলামীর এক অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। বক্তৃতাটি “ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসূচি” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে বেশ ঘনঘটা দেখা দিল। গোলাম মুহাম্মদের স্থলে ইস্কান্দার মিরযা গভর্ণর জেনারেল এবং পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। শাসনতন্ত্রে সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন ত্বরান্বিত করার উপর জোর দেয়া হয়েছে কিন্তু নির্বাচনের পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়নি। আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের চরম বিরোধিতার মুখে কোন প্রকার ইসলামী শাসনতন্ত্র পাস করানোই বড় কঠিন ব্যাপার ছিল। অতএব যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি হবে, না পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি- এ নিয়ে আলোচনা করার কোনই সুযোগ ছিল না। এখন ইসলামী শাসনতন্ত্রকে বানচাল করার জন্যে ইসলাম বিরোধী মহল এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে বসলো। তাদে নিশ্চিত ধারণা যে, মুসলমান অমুসলমানের যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে পারলে নির্বাচনে ইসলামপন্থী লোক জয়লাভ করার অতি অল্প সুযোগই পাবে। ফলে ইসলামী শাসনতন্ত্রকে অথবা শাসনতন্ত্রের ইসলামী ধারাগুলোকে সহজেই পরিবর্তন করা যাবে।
নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে এতটুকু সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, দুই প্রাদেশিক পরিষদের সুপারিশক্রমে জাতীয় পরিষদ এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। পশ্চিম পাকিস্তান পরিষদ পৃথক নির্বাচনের পক্ষে সুপারিশ করে। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক ঘোষণা করা হয়। এই বৈঠকেই নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে বলেও ঘোষণা করা হয়।
মাওলানা দ্বিতীয়বার পূর্ব পাকিস্তানে
এ কথা অনস্বীকার্য যে, যে দেশে মুসলিম ও অমুসলিম একত্রে বাস করে, সে দেশের ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা ও ইসলামী মূল্যবোধ নির্ভর করে পৃথক নির্বাচনের উপর। মুসলমারা পৃথকভাবে তাদের জাতীয় নেতা নির্বাচন করবে এবং অনুরূপভাবে অমুসলিমরা নির্বাচন করবে তাদের জাতীয় নেতা। যেহেতু মুসলমানরা শুধু মুসলমানদেরকে নিয়েই একটা স্বতন্ত্র জাতি, এ জাতিতত্ত্বের ভিত্তিই পাকিস্তানকে জন্ম দান করে। মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সকল জাতির যুক্ত নির্বাচন যেমন পাকিস্তানের আদর্শকে চানচাল করে দেয়, তেমনি মুসলমানদের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষাও এতে নির্মূল হয়ে যায়।
পূর্ব পাকিস্তানে আোয়ামী লীগ দলীয় মন্ত্রীসভা কায়েম ছিল। ইসলামের প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব কারো অজানা ছিল না। অতএব পূর্ব পাকিস্তানে পৃথক নির্বাচনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্যে জামায়াতে ইসলামী, নেযামে ইসলাম পার্টি ও মুসলিম লীগ সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ উদ্দেশ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু সরকার কর্তৃক নিয়োজিত সশস্ত্র গুণ্ডাদল সভাস্থলে আক্রমণ করে এবং বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে নির্মম আঘাতে ধরাশায়ী করে। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী প্রাদেশিক সরকার গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী এহেন দুষ্কর্মের জন্যে বিজয় গর্বে উল্লসিত হয়ে উঠে।
এ সময় মাওলানা মওদুদী ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয়বার পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। প্রতিটি জেলা শহরে ও বিশিষ্ট মহকুমা শহরে মাওলানার সফরসূচি তৈরি হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারী হাজার হাজার লোক রংপুর স্টেশনে মাওলানাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে উদগ্রীব হয়ে মাওলানার আগমন প্রতীক্ষা করতে থাকে। কিন্তু গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক চরম ও পরম বিস্ময় ঘটে গেল। মাওলানার রংপুরগামী ট্রেনের মধ্যেই প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে নিদের্শনামা হাতে দেয়া হলো। তাতে ঘোষণা করা হয় যে, শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় মাওলানা রংপুর শহরে ট্রেন থেকে নামতে পারবেন না। জনসভাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সরকার।
রংপুর স্টেশনের জনসমুদ্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল যেন এক মহাপ্রলয় ঘটে যাবে। ট্রেন স্টেশন থামলে মাওলানা ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে জনগণের সশ্রদ্ধ অভ্যর্থনা গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত শান্ত ও মিষ্ট ভাষায় বলেন, “আমি চিরদিনই আইন মেনে চলার পক্ষপাতী। দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্যে আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করছি। আল্লাহর মরুযি হলে এরপর কোনদিন আপনাদের শহরে আপনাদের খেদমতে হাজির হবো।” [১৯৬২ সালের ১৮ই নভেম্বর মাওলানা মওদূদী রংপুর শহরের এক জনসমুদ্রে তাঁর মূল্যবান ভাষণ দান করে রংপুরবাসীর বহুদিনের আশা পূর্ণ করেন।]
রংপুর স্টেশনে প্লাটফরমের সেদিনের দৃশ্য আজও গ্রন্থকারের চোখের সামনে ভাসছে। মাওলানার এ অতি সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর সরকারের প্রতি ক্রুদ্ধ জনতার সকল ক্রোধ ও উত্তেজনা যেন বুদবুদের মতো বিলীন হয়ে গেল। একটা প্রবল কান্নার বেগ কণ্ঠাগত হয়ে দু’টি চোখ অশ্রুসজল করে মৃদু শুষ্ক হাসির আকারে বিদায় নিল। মনে হলো কোথা হতে যেন এক খুন-খারাবীর নকশা অৎাকা হয়েছিল। এবং তা ভেঙ্গে গেল বলে অদৃশ্য লোকে শয়তানের বুকে ছুরিকাঘাত করলো। মাওলানাকে নিয়ে ট্রেন সামনের দিকে অগ্রসর হলো। জনতা ভগ্ন হৃদয়ে শহরের দিকে ফিরে চলল।
অতঃপর মাওলানা সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা শহরগুলোতে জনসভায় বক্তৃতা করেন।
এমনিভাবে দেশের প্রতিটি জেলা শহরে ও অনেক মহকুমা শহরে জনসভায় বক্তৃতা করে মাওলানা ঢাকায় ফিরে যান। কিন্তু জনগণের ঐক্যবদ্ধ দাবি পৃথক নির্বাচন প্রথাকে উপেক্ষা করে জাতীয় পরিষদ শেষরাতের সুপ্ত পরিবেশে যুক্ত নির্বাচন প্রথা জাতির মাথায় চাপিয়ে দেয়।
মার্চ মাসের শেষভাগে ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীর তিনদিনব্যাপী এক সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনে মাওলানা মওদূদী অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের শেষের দিনে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ও জনগণের এক মাইলব্যাপী এক মিশ্র মিছিল শহরে বিভিন্ন রাজপথ দিয়ে পল্টন ময়দানে সমবেত হয়। মুসলিম জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। অতঃপর মাওলানা পল্টনের জনসভায় বক্তৃতা করেন। সুখের বিষয় সভায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোন দুঃসাহস দুষ্কৃতকারীদের হয়নি।
মাওলানার বিদেশ ভ্রমণ
দামেশকে অনুষ্ঠিত মুতামেরে আলমে ইসলামরি দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগদানের জন্যে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ঈসায়ী ১৯৫৬ সালের জুন মাসে মধ্যপ্রাচ্যে রওয়ানা হন। এর প্রথম অধিবেশনটিতে মাওলানা যোগদান করতে পারেননি। কারণ তিনি সে সময় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন। মুতামেরের অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে মুসলিম জগত থেকে আগত প্রতিনিধিবৃন্দ মাওলানার ইসলামী খেদমতের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেন। মাওলানা মুতামেরের একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি সর্বসম্মতিক্রমে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ‘তাবলীগ ও দাওয়াতে ইসলামী’ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
মুতামেরে আলমে ইসলামীর অধিবেশন শেষ করে মাওলানা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি এবার হজ্জব্রত সম্পাদন করেন এবং মুসলিম বিশ্বের বহু জ্ঞানী ও চিন্তাশীল মনীষীর সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে।
মাওলানা দামেশকের পথে বৈরুত পৌঁছলে লেবাননে ইসলামী আন্দোলনের সংস্থা ‘ইবাদুর রহমানের’ কর্মী ও নেতৃবৃন্দ এবং শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ মাওলানাকে বিমানবন্দরে বিপুল অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ইবাদুর রহমানের স্কাউটগণ মাওলানাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এদের কাছ থেকে জানা যায় যে, তাদের মধ্যে মাওলানার সাহিত্যের বহুল প্রচার রয়েছে এবং প্রত্যেকে মাওলানা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকেফহাল।
সিরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করার সময়ে মাওলানা এবং তার সঙ্গীদের মালপত্র বিনা তল্লাশীতে ছেড়ে দেয়া হয়। চেকপোষ্টের জনৈক কর্মচারী বলেন যে, সিরিয়া সরকার ও জাতির পক্ষ থেকে মাওলানাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে সিরিয়া সরকার তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। দামেশকের দশ বারো মাইল দূরে মাওলানাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে বিরাট মোটর গাড়ীর মিছিলসহ শহরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ বহুপূর্ব থেকে মাওলানার আগমণ প্রতীক্ষায় ছিলেন। বিরাট মিছিল ষহকারে রাজকীয় সম্বর্ধনার মাধ্যমে মাওলানা দামেশক শহরে প্রবেশ করেন। পরে বৈকালিক নাগরিক সম্বর্ধনায় শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়াও সিরিয়া সরকারের বিচার সচিব, পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট এবং স্বরাষ্ট্র সচিব যোগদান করেন।
এ সুযোগে জানতে পারা যায় যে, সুদানে মাওলানার সাহিত্য বহুল পরিমাণে পৌঁছেছে এবং আরব জগতের অন্যান্য স্থানেও পৌঁছাচ্ছে। মরস্কোর ইসলামী দলের নেতা জনাব মক্কীউন নাসেরী দামেশক ব্যতীতও তুঞ্জা থেকে মাওলানার সাহিত্য প্রকাশের অনুমতি লাভ করেন। তিনি বলেন যে, মাওলানার সাহিত্যগুলো আরবী ভাষঅয় প্রকাশ করে মরক্কো, তিউনিসিয়া এবং আলজিরিয়ায় ব্যাপক প্রচারের পরিকল্পনা তিনি করেছেন।
পাকিস্তান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন
এবারের ভ্রমণে মাওলানা মওদূদী দেশের এক বিরাট খেদমত করার সুযোগ পান। এ যাবত পাকিস্তান সম্পর্কে আরব দেশগুলোর একটা বিরূপ ধারণা ছিল। তারা ভারতীয় প্রচার-প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়েছিল। মাওলানা তাঁর ভ্রমণের মাধ্যমে তাদের এ ভুল ধারণা ভুল ধারণা দূর করেন। তিনি আরব জাতীয়তাবাদেরও সমালোচনা করেন এবং এর ভ্রান্তি প্রমাণ করে দেন। তিনি তাদেরকে বলেন যে, পাকিস্তান ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিই হচ্ছে একমাত্র ইসলাম। তিনি আরও বলেন যে, ইসরাঈল যেমন আরবদের দুশমন, তার চেয়ে পাকিস্তানের বড় দুশমন ভারত। কারণ ভারত অন্যায়ভাবে কাশ্মীরের বিরাট অংশ দখল করে আছে। মাওলানা বলেন যে, ভারত ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিয়েছে। পাকিস্তান স্বীকার করেনি। তিনি প্রশ্ন করেন যে, এমতাবস্থায় পাকিস্তানের পরিবর্তে আরব দেশগুলো যদি ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে তাহলে তারা পাকিস্তানের কাছ থেকে কি আশা করতে পারে? মাওলানা তার মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণকালে সর্বত্র আরবদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় পাকিস্তান সম্পর্কে উক্তরূপ প্রচারকার্য চালান। আরবগণ দুঃখ করে বলেন যে, আরব দেশগুলোতে পাকিস্তানের সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব হয়নি।
দামেশক থেকে প্রত্যাবর্তনের সময়ও সিরিয়া সরকার মাওলানাকে পরম সম্মান সহকারে বিদায় দেন। যানবাহন সচিব ষ্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে মাওলানাকে শেষ বিদায় সম্ভাষণ জানান। সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত মাওলানার জন্যে সরকারী যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়।
জর্ডানের বাদশাহ শাহ হুসাইন মাওলানাকে আমন্ত্রণ জানান এবং এখানে মাওলানাকে এক জনসভায় বক্তৃতা করতে হয়। এ সভায় ইসলামী জীবন ব্যবস্থা, জামায়াতে ইসলামী, তার সাহিত্য, আরবী ভাষায় এ সবের অনুবাদ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর মাওলানাকে দিতে হয়। মাওলানা পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি এবং শোতৃমণ্ডলী তার জবাবে সন্তোষ প্রকাশ করেন। মাওলানা বলেন যে, আরব দেশগুলো ইসরাঈল থেকে বিশগুণ বড় হওয়া সত্ত্বেও তার আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্যে রাশিয়ার নিকট সাহায্যপ্রার্থী হওয়াকে দুষণীয় মনে করে না। পাকিস্তান তার চেয়ে চারগুণ শক্তিশালী ভারতের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্যে যদি আমেরিকার সাহায্যপ্রার্থী হয়, তবে তা দুষণীয় হবে কেন? অথচ পাকিস্তান সব সময়ে আরবদের সমর্থকই রয়েছে।
হলব থেকে একটা বিশেষ প্রতিনিধি দল মাওলানাকে নিভে আসে। অতঃপর তিনি মরস্কোর নেতা মককীউন নাসেরী এবং আলজিরিয়ার নেতা মুহাম্মদ আল গায়বীর সঙ্গে হলব যাত্রা করেন। এ পথেও মাওলানাকে সর্বত্র আন্তরিক সম্বর্ধনা জানানো হয়। প্রতিটি শহরে-বন্দরে পৌঁছবার পূর্বে শহর থেকে দশ বারো মাইল দূরে নাগরিকগণ মোটরগাড়ী মিছিলসহ মাওলানাকে স্বাগত জানান।
হামস এবং হামাতে ইখওয়ান যুবদল প্রাচীন আরবপ্রথা অনুযায়ী কবিতা পাঠ এবং হাততালি সহকারে মাওলানাকে অভ্যর্থনা জানান। তাদের স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দ ও আন্তরিকতায় মাওলানা অতীব প্রীত ও মুগ্ধ হন।
সিরিয়ার সৈন্য বিভাগের বহু যুবক মাওলানার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তারা জানান যে, মাওলানার অনেক বই-পুস্তক তারা পড়েছেন এবং মাওলানার বই পুস্তক পড়তে সরকার পক্ষ থেকে কোন বাধা-নিষেধ নেই। মাওলানা এসব জেনে মনে মনে খুবই দুঃখিত হলেন যে, তার নিজের দেশে তার সাহিত্য সৈন্য বিভাগের জন্যে নিষিদ্ধ ফলস্বরূপ। তাদের নিকট মাওলানার কোন বই পুস্তক রাখাকে বিরাট অপরাধ বলে গন্য করা হয়।
সউদী আরবে যারাই মাওলানার বই-পুস্তক পড়েছেন, তারা এসে মাওলানার সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে ভাবের আদান প্রদান হয়।
রুশীয় তুর্কীস্তানের মুহাজিরগণ মাওলানার সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের প্রতি রুশ সরকারের চরম নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেন। তাদের মধ্যে জনৈক আলেম মাওলানার কয়েকটি গ্রন্থ তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করেন।
অধিকৃত কাশ্মীরের বহু মুসলমান মাওলানার নিকট তাদের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনা করে হেরেম শরীফে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন।
তুরস্কের বহু মুসলমান বহু অনুসন্ধানের পর মাওলানার সাক্ষাৎ লাভ করেন। তাঁরা জানতে পারেন যে, মাওলানা মওদূদী এ বছর হজ্জ করতে আসবেন। তারা মক্কায় অনুসন্ধান করে মাওলানাকে না পেয়ে অবশেষে মদীনায় তাঁর সাক্ষাত লাভ করেন। তাঁরা তুর্কী ভাষায় মাওলানার সাহিত্য অনুবাদ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে মাওলানা সন্তুষ্টচিত্তে তার অনুমতি দেন।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন
পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়েছে, কার্যকর করা হয়েছে এবং নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সারা দেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের জন্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ইসলামী শাসনতন্ত্রের জ্বালায় রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে প্রাদেশিক পর্যায় পর্যন্ত ইসলাম বিমুখ মহলের চোখে ঘুম ছিল না। ইসলামী শাসনতন্ত্র বানচাল করার জন্যে রাষ্ট্রপ্রধান ইস্কান্দার মিরযা কেন্দ্রে মন্ত্রীসভা ভাঙ্গা-গড়ার খেলা শুরু করেন। ক্ষমতাহীন দল আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্যে নানাবিধ কলা কৌশল অবলম্বন করতে লাগল। নির্বাচনে শান্তিভঙ্গ রোধ করার নাম করে ক্ষমতাসীন দল দলীয় লোকদের মধ্য থেকে হাজার হাজার স্পেশাল পুলিশ নিয়োগ করতে লাগল। অতীতের ন্যায় এবারেও নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়ার জন্যে সরকারী কর্মচারীদেরকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা শুরু হলো। আগামী নির্বাচনের নামে সারা দেশে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়ে গেল।
মাওলানা মওদূদী এ পরিস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করার জন্যে ৬ই অক্টোবর লাহোরের মুচিদরজায় এক জনসভার আয়োজন করা হয়। মাওলানা তাঁর বক্তৃতায় দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে জাতিকে সাবধান করে দিয়ে বলেন যে, পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা-পিপাসা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে এখানকার বুরোক্র্যাসী বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দল এবং জনসাধারণ এখনো যদি তাদের ভুলের সংশোধন না করে, তাহলে এ দেশে গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হবে এবং তার উপরে গড়ে উঠবে বুরোক্র্যাসির প্রাসাদ।
বলাবাহুল্য, মাওলানার উক্তি ছিল অক্ষরে অক্ষরে সত্য। পাকিস্তানের বুরোক্র্যাসী একটা সুযোগ সন্ধান করছিল। কেন্দ্র ও প্রদেশের মন্ত্রিসভা যেন রাষ্ট্রপ্রধানের নাচের পুতুলে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের গুণ্ডামি পরিষদ কক্ষে গিয়ে পৌঁছালো। ক্ষমতাশিকারী বুরোক্র্যাসির এই ছিল সুবর্ণ সুযোগ।
যে রাতে মাওলানা মওদূদী মুচিদরজার জনসভায় জাতির জন্যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করছিলেন, সেই রাতেরই শেষ প্রহরে দেশে জারি হলো সামরিক শাসন। ইস্কান্দার মিরযা তার এতদিনের খেলায় বাজিমাত করলেন এই রাতের অন্ধকারে। তিনি চির আকাঙ্ক্ষিত ও বহু কষ্টসাধ্য শাসনতন্ত্র ভেঙ্গে চুরমার করলেন, দেশের উপর চাপিয়ে দিলেন সামরিক শাসন তথা বুলোক্র্যাসির এক জগদ্দল পাথর। দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল ও তাদের কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
মাওলানা মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয়বার
মাওলানার সউদী আরব ও মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের পর কয়েক বছর কেটে গেছে। এ ভ্রমণের ফলে সে সব দেশের ইসলামী জনতা ও নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে। তাঁদের ইচ্ছা, প্রতি বছরই যেন তাঁরা মাওলানাকে তাঁদের মধ্যে দেখতে পান।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলছে। সকল রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামীরও কোন তৎপরতা নেই। এ সময়টাই ছিল মাওলানার নিদেশ ভ্রমণের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী।
ঈসায়ী ঊনিশ শ’ ঊনষাট সালের অক্টোবর মাসে মাওলানা দ্বিতীয়বার মধ্যপ্রাচ্য সফরে যান। তাঁর এবারের সফর ছিল নিছক জ্ঞান সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে, ঐতিহাসিক স্থানসমূহের যিয়ারতের জন্যে এবং বিশেষ করে “আরদুল কোরআন” অর্থাৎ কোরআনে বর্ণিত স্থানগুলি সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে। মাওলানার বিশ্ববিশ্রুত তাফসীর ‘তাফহীমুল কোরআনের’ জন্যে আরদুল কোরআন’ স্বচক্ষে দর্শন করা মাওলানা প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন।
এবারের ভ্রমণেও মাওলানার সঙ্গে সর্বত্র বিশেষ ভ্রাতৃসুলভ ব্যবহার করা হয়। আরব সরকারগুলি আগ্রহণ সহকারে মাওলানার ভ্রমণের বিশেষ সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছিলেন। সঊদী আরব এবং জর্দান মাওলানার প্রতি যে আন্তরিক আতিথেয়তা প্রদর্শন করেছে, তা কোনদিন ভুলবার নয়। ভ্রমণকালে মাওলানা সুযোগমত আরব জাতীয়তাবাদের তীব্র নিন্দা করে তাদের এ ভ্রান্ত মতবাদ সংশোধনের চেষ্টা করেন। মাওলানা তাঁর আলাপ-আলোচনায় আরবদের কাছে পাকিস্তানের সত্যিকার পজিশন ও বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। মাওলানা তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন-
“তোমাদের ও আমাদের সম্পর্ক শুধুমাত্র ইসলামের জন্যে। তোমরা যদি ইসলামকে নিয়ে দাঁড়াও, তাহলে পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান তোমাদের পেছনে এসে দাঁড়াবে। আর যদি ইসলামের পরিবর্তে তোমরা কুফর ও জাহিলিয়াত অবলম্বন কর, তাহলে দুনিয়ার অন্যান্য মুসলমান কেন, আরব মুসলমানও তোমাদের ত্যাগ করবে।”
মাওলানা আরও বলেন,
“আমার ধারণা যে, আরব দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদ, নাস্তিকতা ও পাপাচারের যে স্রোত চলেছে, তার উৎসস্থল একটি। এ তিনের একটা অন্যটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যারা আরব জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী, তারাই নাস্তিকতা ও খোদাদ্রোহিতারও পতাকাবাহী।”
মাওলানার দ্বিতীয়বারের মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ অনেকটা আশাপ্রদ হয়েছে। প্রথমবার থেকে এবারে মাওলানার বই পুস্তক আরব দেশগুলিতে অধিকতর পরিচিত ও আদৃত হয়েছে। দেশের সরকারগুলোও মাওলানার সঙ্গে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর আন্তরিকতা, আতিথেয়তাপূর্ণ ও ভ্রাতৃসুলভ ব্যবহার করেছেন। স্থানে স্থানে জনসমাবেশে, কলেজ ও সুধী সমাবেশে মাওলানা বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর বাণী ও মিশন স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিয়েছেন। এতে সুধীসমাজে মাওলানার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। মাওলানার বলিষ্ঠ সাহিত্য আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কিছু মন-মস্তিষ্ক প্রভাবিত করছে বলে জানতে পারা যায়। মোটকথা, মাওলানার দ্বিতীয়বারের মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ পরিপূর্ণরূপে সার্থক হয়।
ভবিষ্যত বংশধরদের জন্যে লিখিত কোরআনের বিপ্লবী তাফসীর তাফহীমুল কোরআনকে প্রামাণ্য নির্ভরযোগ্য ও আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে মাওলানা তিন মাসের অধিক সময় তাঁর এ ভ্রমণে অতিবাহিত করেন। তিনি যে সব ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেন, তার মধ্যে নিম্নলিখিত স্থানগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
দরইয়া-যা ছিল মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব নজদীর আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। আকরাবাহ- যেখানে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার মুসায়লামাহ খালেদ বিন ওয়ালীদের নিকট পরাজয় বরণ করে। হযরত আইয়ুব আনসারীর বাসগৃহ, সাকীফায়ে বনি সায়েদাহ, মুতা, ইয়ারমুক, হুদায়বিয়া সন্ধির স্থান শুমাইসী, নবী পাক (সাঃ)-এর জন্মস্থান, দারুল আরকাম, গুয়াবে আবি তালেব, জাবালে নূর, গারে, কুহে সত্তর, তায়েফের ভগ্নাবশেষ, মসজিদুল খায়েফ, উহুদের জাবালুর রহমাত, যেখানে নবী পাক (সাঃ) পঞ্চাশজন তীরন্দাজকে পাহারায় নিযুক্ত করেন, খয়বর, মাদায়েনে সালেহের নিদর্শনাবলী, তাবুক, ওকবা-যেখানে আসহাবুস সাবত মাছ ধরত, মুসা (আঃ)-এর উপত্যকা, জাবালে মুসা (আঃ), হযরত হারুণের কর্মস্থল প্রভৃতি। মাওলানার গবেষণা ও শিক্ষা বিষয়ক এ ভ্রমণের ফল এই যে, তাফহীমুল কোরআনে এসব স্থানের এবং ভগ্নাবশেষগুলোর মনোজ্ঞ আলোকচিত্র সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আর কোরআন পাকের মূলবচনে বর্ণিত বিষয়সমূহেগর আধুনিকতম তথ্যাদি সংগৃহীত হয়েছে।