লীডারশীপ গায়ের ইসলামী
উপরের অভিযোগগুলো এমন ছিল যা আপনি জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এবং তার মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে উত্থাপন করেছেন। এই ষষ্ঠ অভিযোগে আপনি সরাসরি আমার উপর দোষারোপ করেছেন যে, “আমি আমার বিভিন্ন জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় জাতির লীডারশীপকে গায়ের ইসলামী ও শয়দানী বলে ঘোষণা করেছি”। এর জবাব হলো, ‘শয়তানী’ শব্দ সম্পর্কে আমি বলতে চাই যে, এ শব্দটি আমি কখনো ব্যবহার করিনি এবং কারো সঙ্গে বিরোধ প্রকাশ করে এই ধরনের শব্দ ব্যবহারে আমি অভ্যস্তও নই। অবশ্য পাকিস্তানের কর্তৃত্ব যাদের হাতে তাদের সম্পর্কে আমি প্রকাশ্যে একথা বলেছি এবং এখনো বলছি যে, তারা ইসলাম অনুযায়ী কাজ করছেন না, তাই তাদের নেতৃত্ব গায়েব ইসলামী। একটি বিরোধী দলের নেতা হিসাবে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগত নেতৃত্ব ও তাদের কার্যাবলীর সমালোচনা করা আমার আইনগত ও গণতান্ত্রিক অধিকার। আমার এ অধিকার ছাড়তে আমি মোটেই রাজী নই। আমাকে জানানো হোক, কোন আইনের মাধ্যমে এই মত প্রকাশকে অপরাধ বলা যেতে পারে?
তর্জুমানুল কোরআনের প্রবন্ধ
আপনার শেষ অভিযোগ হলো এই যে, আমার মাসিক তর্জুমানুল কোরআনের ১৯৬৩ সালের ১ লা অক্টোবর সংখ্যায় আমি ইরান ও তার শাহী পরিবারের বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ পেশ করি। আপনি আরো দাবি করেছেন যে, ঐ প্রবন্ধটি প্রকাশ করার পেছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান ও তার ঐতিহ্যানুগ বন্ধু ইরানের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মূলে কুঠারাঘাত করা। এ ব্যাপারে আমার আরয হলো এই যেঃ
১। আপনি যে প্রবন্ধটির বরাত দিয়েছেন সেটি ইরাক ও ইরানের নেতৃস্থানীয় উলামা কর্তৃক প্রকাশিত কতকগুলি প্রবন্ধের সংক্ষিপ্তসার। তন্মধ্যে একটি হলো সমকালীন ইরানী আলেমগণের বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে লিখিত একটি পত্র। এ পত্রটি লেখা হয় জনৈক নেতৃস্থানীয় শিয়া আলেম আস সাইয়েদ আবুল কাসেম আল খাই-এর নামে। এটি মুদ্রিত হয় নাজাফ-ই-আশরাফ-এর আন-নো’মান প্রেসে। এর শিরোনাম ছিলঃ “রিসালাতুম-মিন উল্লামা-ই-ইরান।”
দ্বিতীয় পুস্তিকাটির লেখক হলেন আস্-সাই য়দ আল-খোই নিজে। এতে তিনি ইরানে ইহুদীদের বর্ধিষ্ণু প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং এ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করার জন্যে ইরান সরকারকে হুঁশিয়ার করে দেন। এ পুস্তিকাটির নাম ছিলঃ “তাসরীহাতুন নাজীরাতুল লিল-উম্মিল খোই”।
তৃতীয় পুস্তিকাটি হলো উল্লিখিত প্রবন্ধটির আর একটি সূত্র। এটির নাম ছিলঃ “কিফাহুল উলামা-ইল-আ’লাম”। এটি কারবালার সিকাফাতে ইসলামিয়ায় প্রকাশিত হয়। এ পুস্তিকাটিতে ইরানে যেসব ঘটনা সংগঠিত হয়, প্রামাণ্য তারিখসহ তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে।
২। উল্লিখিত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমি ইরানী দূতাবাস থেকে এর একটি জবাব পাই এবং সেটিও আমার পত্রিকার ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশ করি। (এ সংখ্যার একটি কপি বোর্ডের বিবেচনার জন্যে পেশ করা হলো এবং ঐ প্রবন্ধটি সম্পর্কিত সম্পাদকীয় মন্তব্যের দিকে আমি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি) এখন একটি সাময়িকী বা সংবাদপত্র উভয় পক্ষের বিবৃতি প্রকাশ করছে, এক্ষেত্রে সাংবাদিকতার সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতির বিরুদ্ধে কি অভিযোগ উত্থাপন করা যেতে পারে?
৩। আমি পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রেস থেকে তুরস্ক, মিসর, জর্দান, সউদী আরব, ইরাক, কুয়েত প্রভৃতি দেশের বিরুদ্ধে প্রকাশিত এই রকম বা এর চাইতে অনেক বেশী সমালোচনামূলক অন্যূন ৫০টি প্রবন্দের উল্লেখ করতে পারি। এমন কি সেই সব প্রবন্ধে উল্লিখিত দেশগুলোর শাসকগণের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও মন্তব্য করা হয়। জেলের মধ্যে আমি সেই সব সাময়িকী ও সংবাদপত্রের পুরানো ফাইল সংগ্রহ করতে অক্ষম। কিন্তু সুযোগ দেয়া হলে আমি এগুলো সংগ্রহ করে আপনার বিবেচনার জন্যে পেশ করতে পারতাম। এখন প্রশ্ন হলোঃ ইরান একাই শুধু পাকিস্তানের বন্ধু? অথবা উপরোল্লিখিত দেশগুলোও আমাদের বন্ধুত্বের স্বীকৃতি লাভ করেছে? এবং যদি তারা পাকিস্তানের বন্ধু বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, তাহলে সেই সব সাময়িকী ও সংবাদপত্র, যারা তাদের সমালোচনা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না কেন? এবং তর্জুমানুল কোরআনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের পেছনে কি যুক্তি আছে?
আমি জেনেছি যে, তর্জুমানুল কোরআনের প্রকাশ বন্ধ করার পর লায়ালপুরের সাপ্তাহিক ‘আল মিম্বার’ পত্রিকাও বন্ধ করা হয়েছে। পত্রিকাটি সংযুক্ত আরব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লিখেছিল। এটা করা হয়েছে এ জিনিসটি দেখানোর জন্যে যে, ইতঃপূর্বে নিছক কোন পার্থক্যমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। কিন্তু ‘আল মিম্বার’ একাই শুধু এ ধরনের রচনা প্রকাশ করেনি। ইতঃপূর্বে বলেছি যে, এই ধরনের কমপক্ষে ৫০টি দৃষ্টান্ত পেশ করতে আমি প্রস্তুত আছি। কাজেই এভাবে শুধু আর একটি পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করলেই কি ভারসাম্য রক্ষিত হয়?
৪। উল্লেখিত প্রবন্ধটি প্রকাশ করার জন্যে ইতঃপূর্বে তর্জুমানুল কোরআনের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন সেই একই অপরাধে আমাকে গ্রেফতার করা ও আটক রাখাটা কি ইনসাফের দাবি পূরণ করার জন্যে অথবা প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে?
৫। উল্লেখিত প্রবন্ধটি তর্জুমানুল কোরআনে প্রকাশ করার জন্যে একমাত্র আমিই দায়ী। আমিই এ পত্রিকাটির মালিক এবং আমিই এর সম্পাদক। জামায়াত গঠনের ৯ বছর পূর্বে ১৯৩২ সাল থেকে আমি এটি জারি করেছি। এর মালিকানা, সম্পাদনা, পরিচালনা, লাভ ও ক্ষতি কোন ব্যাপারে জামায়াতের কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। আমার ব্যক্তিগত অবস্থা ও যোগ্যতা অনুসারে আমি এটি চালিয়েছি। এখন এহেন একটি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশের জন্যে সরকার জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন, তাকে বেসআইনী ঘোষণা করেছেন এবং তার অর্থ শতেরও বেশী নেতৃবৃন্দকে জেলে আটক করেছেন। এ থেকে কি প্রমাণ হয় না যে, সরকার ন্যায়নীতি ও লজ্জার যাবতীয় মূল্যমান দূরে নিক্ষেপ করেছেন? এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দ যে সব দোষ করেননি তা জবরদস্তি তাদের ঘাড়ে নিক্ষেপ করতে ব্রতী হয়েছেন?
৬। কেমন করে আপনি জানলেন যে, উল্লেখিত প্রবন্ধটি প্রকাশ করার পেছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল পাক-ইরান বন্ধুত্ব সম্পর্কের মূলে কুঠারাঘাত করা? সমগ্র বিশ্বে এটি একটি সর্ববাদী সম্মত নীতি যে, যখন কোন দেশের সরকার সেখানকার জনগণের ওপর নির্যাতনের নীতি অনুসরণ করে এবং জনগণ নিজেদেরকে অসহায় অবস্থায় পায়, তখন আন্তর্জাতিক জনমতের চাপে ঐ সরকার নিজের অনুসৃত নীতির পরিবর্তন ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে সক্ষম হয়। ইরানের অধিবাসীরা আমাদের মুসলমান ভাই এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা ও সহানুভূতি আছে। ইরান ও ইরাকের প্রখ্যাত আলেমগণের রচনাবলীর মাধ্যমে যখন আমি জানতে পারলাম যে, জনগণের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, তখন ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইরান সরকারের ওপর আমাদের নৈতিক শক্তি ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেই আমি সেই রচনাবলীর সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করলাম। এই একই উদ্দেশ্যে ইরানের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরাকের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ ঐ পু্স্তিকাগুলো প্রকাশ করেন- এটি আমি আগেই উল্লেখ করেছি। প্রকৃতপক্ষে আমার বিরুদ্ধে যে উদ্দেশ্যে অভিযোগ করা হয়েছে, তার ছিটে-ফোঁটাও কখনো আমার মনে স্থান পায়নি। এমন কি পাক-ইরান সম্পর্কের মূলে কুঠারাঘাত’ করার ধারণার সামান্য ছায়াও কোনদিন আমার চিন্তারাজ্যে প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু হাড়িকাঠে বলি দেয়ার জন্যে সরকার সর্বপ্রথম একটি সর্ববাদীসম্মত আন্তর্জাতিক নীতির চরম অপব্যাখ্যা করলেন এবং তারপর সমগ্র জামায়াতের বিরুদ্ধে লজ্জাকর অভিযোগ উদ্ধাপন করলেন (১৯৬৪ সালৈর ৬ই জানুয়ারীর প্রেসনোট থেকে যা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে)। জামায়াতকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলানোর আগে এভাবে তাকে একটা ‘অপবাদ দেয়া হলো। কিন্তু যে কোন ষড়যন্ত্র আমাদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া এবং যে কোন টুপি আমাদের মাথায় পরিয়ে দেয়ার জন্যে আগ্রহশীল হওয়ার ব্যাপারে সরকারের এই অদ্ভুত ব্যবহারই কি যথেষ্ট নয়?
আগের আলোচনায় আমার বিরুদ্ধে যে সাতটি অভিযোগ আপনি এনেছেন, তার সব ক’টিই আমি মিথ্যা প্রমাণ করেছি। আমি দুঃখিত যে, এই আলোচনায় আমাকে এমন অনেক তিক্ত কথা বলতে হয়েছে, যা সরকার অপছন্দ করেন। কিন্তু আমাকে এমন করতে বাধ্য করা হয়েছে। কেননা, মিথ্যা ও মনগড়া অভিযোগ আমি কেমন করে স্বীকার করতে পারি? এ জন্যেই আমি স্পষ্ট বলেছি যে, আমাকে গ্রেফতার করার ও আটক রাখার জন্যে যে সব কারণ দর্শানো হয়েছে, সেগুলো সত্যিকার কারণ নয়। সরকারের এই ব্যবস্থা গ্রহণের পেছনে অন্য কিছু কারণ আছে। সেগুলো বলতে সরকার লজ্জা পান। এজন্যেই সত্যিকার কারণগুলো ঢাকা দেয়ার জন্যে মনগড়া অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে।
ডিষ্ট্রিক্ট জেল লাহোর
২৪ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৪। |
আপনার বিশ্বস্ত
আবুল আ’লা মওদুদী ৭-৩-৬৪ স্বাক্ষরঃ জি.এ. আলী, সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ডিস্ট্রিক্ট জেল, লাহোর। |
তৃতীয় অভিযোগের অতিরিক্ত জবাব
জনাব বিচারপতি এস.এ মাহমুদ,
চেয়ারম্যান, রাজবন্দী পুনর্বিবেচনা বোর্ড, লাহোর
জনাব,
সরকারের ৩নং অভিযোগের জবাবে ইতঃপূর্বে ১৯৬৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি যে জবাব দিয়েছিলাম, তার সঙ্গে নিম্নোক্ত জবাবগুলোও সংযুক্ত করতে চাই।
যেহেতু আমি বন্দী আছি এবং আমার প্রাইভেট অফিস তালাবদ্ধ করা হয়েছে, যেহেতু আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ খণ্ডন করার জন্যে যে সব জিনিসের প্রয়োজন, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ লাভ করতে পারলাম না। তবু অনেক কষ্টে আমি একটি পুস্তিকা সংগ্রহ করতে পেরেছি। এটি নাম ‘পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর মসলিসে শূরার রোয়েদাদ’। ১৯৫১ সালের ১৫ই থেকে ১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত এই শূরা অনুষ্ঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন বিভাগ কর্তৃক ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে এটি প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকায় মজুরদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণণা করা হয়েছে (দেখুন ৫৩-৬০ পৃষ্ঠা)। জামায়াতে ইসলামীর পলিসি সম্পর্কিত এই বর্ণনা তার বিরুদ্ধে আনীত এই অভিযোগ পূর্ণরূপে বাতিল করে যে, সে শ্রমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তাদেরকে “হাঙ্গামা সৃষ্টির জন্যে উৎসাহিত করে”।
১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে মসলিসে শূরা প্রথমবার সিদ্ধান্ত করে যে, মজুরদের সমস্যার ব্যাপারে জামায়াতকে আগ্রহশীল হওয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে একটি কর্মপদ্ধতি নিরূপণ করার জন্যে জামায়াতের আমীর হিসাবে আমাকে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। আমাকে যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি নিম্নলিখিত নির্দেশ দেইঃ
“আমরা শ্রমিকদের সংগঠিত করব এবং নেতৃত্ব দান করব, এই ইচ্ছা যদি কোন শ্রমিক দল প্রকাশ করে থাকে, তাহলে তাকে প্রথমেই সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া উচিত যে, আমরা কেবল মাত্র এই শর্তে তাদেরকে সংগঠিত করতে এবং তাদের দাবি আদায়ের জন্যে আন্দোলনকে পরিচালিত করতে পারি যদি-
(ক) দাবিসমূহ আইনানুগ ও ন্যাসঙ্গতদ হয় এবং তাদের অভিযোগসময়হ সত্য ও ন্যায়সঙ্গত থাকে। তাদের অন্যায় ও বে-আইনী দাবি সমর্থন এবং অবৈধ অভিযোগসমূহ আমরা কখনো সমর্থন করতে পারি না।
(খ) তাদের দাবিসমূহ পূরণ করবার জন্য তাদের আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মপদ্ধতির বন্ধনে আবদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা কোন রকমের বিক্ষোভ, হাঙ্গামা ও গুণ্ডামি পছন্দ করি না।
(গ) নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির মধ্যে তারা নিজেদের কার্যাবলী সীমাবদ্ধ রাখতে পারবে না, বরং একই সঙ্গে তাদের নিজেদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা উন্নত করার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।”
ঐ একই নির্দেশে কর্মপদ্ধতি এবং এই ধরনের মজুর ইউনিট সংগঠন রীতি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আমি লিখেছিলামঃ সর্বপ্রথম কর্মীদের মধ্যে নৈতিক ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করা উচিত। অতঃপর নিম্নলিখিত ধারণাগুলো ধীরে ধীরে তাদের মনে প্রতিষ্ঠিত করা উচিতঃ
১। এই দেশের যাবতীয় উপায় উপকরণ ও ধন-সম্পদ, তা যে আকৃতিতেই হোক (জমি, শিল্প, সম্পত্তি, প্রভৃতি) এবং যারই কর্তৃত্বাধীন হোক না কেন, এগুলো আসলে একটি জাতীয় সম্পদ ও ট্রাস্ট এবং জাতির এই সম্পদের সংরক্ষণ, সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন দেশের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক ও জাতীয় কর্তব্য।
২। সেই সমস্ত লোক হলো শত্রু (শুধু নিজেদের শত্রু নয় বরং দেশ এবং জাতির শত্রু), যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধ্বংসাত্মক এবং অরাজকতার পথ ধরে জাতীয় সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করতে প্রস্তুত হয়।
৩। মুসলমান হিসাবে আমরা খোদার প্রজা, হযরত মুহম্মদের (সাঃ) অনুসারী এবং কোরআনের আইনের অনুগত। আমাদের প্রয়োজন যতই জরুরী এবং আমাদের দাবি যতই ন্যায়সঙ্গত হোক না কেন, যে কোন পরিস্থিতিতে খোদা ও তাঁর রাসূল (সাঃ) কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা মুসলিম হিসাবে আমাদের জন্যে সঙ্গত নয়। যতক্ষণ আমরা মুসলিম আছি, ততক্ষণ আমরা বলগাহারা অশ্বের মত ছুটে চলতে পারি না।
৪। মুসলমান হিসাবে আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দর্শন বা মতবাদ আমরা গ্রহণ করতে পারি না। এমন করার কোন প্রয়োজনও নেই। কেননা, সম্ভাব্য সর্বোত্তম পন্থায় আমাদের যাবতীয় সমস্যা সমাধান করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা ইসলামের আছে। (এই প্রসঙ্গে কর্মী ও শ্রমিকদের ইসলামের মৌলিক শিক্ষাসমূহ সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানলাভ এবং মজুর সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তাদের বিস্তারিত জ্ঞানলাভ করা উচিত। এভাবে তারা নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হতে পারবে এবং চাইবার আগেই ইসলাম তাদেরকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দান করে, সে সম্পর্কে নির্ভুল অনুমান করতে পারবে।)
৫। সমাজের বিভিন্ন অংশ এবং দল মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ন্যায়। যেমন মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যক্ষ পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে এবং যদি তারা পরস্পরের সঙ্গে বিবাদ এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে যেমন কোন মানুষ বাঁচতে পারে না, ঠিক তেমনি যে সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ পরস্পরের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ, শত্রুতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, শ্রেণী সংগ্রাম, দলীয় বিরোধ ও প্রতিরোধ গ্রহণ মনোবৃত্তির স্থান দখল করে। একমাত্র ভালোবাসা, সাহায্য-সহযোগিতা ও ন্যায়নীতির ভিত্তিত্তেই একটি সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
৬। কোন ব্যক্তি কেবলমাত্র নিজের অধিকারটি এবং অন্যের কর্তব্যটি বড় করে তুলবে কিন্তু নিজের কর্তব্য ও অন্যের অধিকার পুরোপুরি উপেক্ষা করে যাবে, এ ধরনের মানসিকতা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, অমানুষিক, নিষ্ঠুর প্রসূত ও অন্যায়। আসলে প্রত্যেককেই খোদার সামনে তার কর্তব্য এবং অন্যের অধিকার সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
আজ থেকে তের বছর আগে যখন জামায়াত মজুরদের মধ্যে কাজ শুরু করেছিল, তৎকালীন প্রকাশিত একটি পুস্তিকা থেকে মজুরদের মধ্যে জামায়াতের কার্যধারা সম্পর্কে উপরিউক্ত উদ্ধৃতিগুলো পেশ করা হলো। শুরুতেই আমরা পরিচ্ছন্ন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিলাম। সরকার বলতে পারেন না যে, তারা এই রিপোর্ট সম্পর্কে অজ্ঞ এবং জামায়াতের শ্রমিক নীতি অবগত নন। এটা কি দুঃখজনক নয় যে, জামায়াতের এই পরিষ্কার বিবৃতির পরও সরকার অন্ধভাবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিরোধ ও হিংসা চরিতার্থ করেছেন এবং আমাদের উপর একটি মিথ্যা, অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন ও অন্যান্য অভিযোগ চাপিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা মজুরদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে ক্ষমতা দখল করতে চাই!
ডিস্ট্রিক জেল, লাহোর
৩রা মার্চ ‘৬৪ |
আপনার বিশ্বস্ত
আবুল আ’লা মওদূদী স্বাক্ষরঃ জি.এ. মারী, ৭-৩-৬৪ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডিস্ট্রিক্ট জেল, লাহোর। |
মাওলানা মওদূদী পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র সচিব এবং রাজবন্দী পুনর্বিবেচনা বোর্ডের চেয়ারম্যান বিচারপতি এস.এ মাহমুদের কাছে উপরোল্লিখিত যে জবাব দান করেন, তা এতই যুক্তিপূর্ণ, আইনানুগ ও বিজ্ঞতাপূর্ণ যে, অভিযোগকারীর অভিযোগুলো শুধু ভিত্তিহীন ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রমাণিত হয়নি, বরঞ্চ প্রতিপক্ষের বিদ্বেষদুষ্ট মনের প্রকৃত ব্যাধিও পরিস্ফুট হয়ে পড়ে। স্বার্থান্বেষী মহল তথা ক্ষমতাসীন কনভেনশন লীগ পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এরূপ হাস্যকর অভিযোগ উত্থাপন করে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারকে জনগণ, সুধী সমাজ ও আইনবিদদের কাছে এবং বহির্জগতের কাছে হাস্যাস্পদ করেছে।
অভিযোগের উত্তরে কাশ্মীরী নেতৃবৃন্দ
আযাদ জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জনাব সরদার মুহম্মদ ইবরাহীম খান এক বিবৃতিতে বলেন-
“কাশ্মীরের জিহাদ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ করা হয়েছে তা একেবারে ভিত্তিহীন। ১৯৯৪ সালে মাওলানা মওদূদীকে যখন এই অভিযোগের ভিত্তিতে কারাগারে প্রেরণ করা হয়, তখন আমি এই রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমি এসব অভিযোগের তদন্ত করে জানতে পেরেছিলাম যে, তার মধ্যে কোন সত্যততার লেশ মাত্র ছিল না। মাওলানা মওদূদীর দেশপ্রেম, রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর আনুগত্য এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করা যেতে পারে না।” (এপিপি-দৈনিক কোহিস্তান, রাওয়ালপিণ্ডি-৮ই নভেম্বর, ১৯৬৩)। আযাদ জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জনাব সাইয়েদ আলী আহমদ শাহ্ বলেন-
“কাশ্মীরের জিহাদকে বিতর্কের বিষয়বস্তুতে পরিণত করা ঠিক নয় এবং পুনঃ পুনঃ এ কথাও ঘোষণা করা ঠিক নয় যে, মাওলানা মওদূদী কাশ্মীর জিহাদের বিরোধী। এতে কাশ্মীরের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। কাশ্মীর সম্পর্কে আজ পর্যন্ত দেশের সকল দলই একমত। মাওলানা মওদূদী বরাবর জম্মু ও কাশ্মীর রাষ্ট্রের জনগণের জন্যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও গণভোটের সমর্থন করে আসছেন এবং ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও সমর্থন করবেন। আমি এও নিশ্চিতরূপে জানি যে মাওলানা মওদূদী কাশ্মীর বিভাগের তীব্র বিরোধী। পৃথিবীর প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র কাশ্মীর সমস্যা সম্পর্কে এই অভিমতই পোষণ করে। ১৯৪৮ সারে যখন কাশ্মীরে জিহাদ চলছিল, সে সময়ে মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামী আমার অনুমতিক্রমে আযাদ কাশ্মীর সেনাবাহিনীর মধ্যে নগদ টাকা এবং রসদ বিতরণ করেন। মাওলানা মওদূদী কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও গণভোটবিরোধী কখনোই ছিলেন না এবং এখনও নন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, যদি এখন কিংবা ভবিষ্যতে জাতিসংঘ অথবা ভারত নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব লঙ্ঘন করে বা বাতিল করে, তাহলে মাওলানা মওদূদী অবশ্য অবশ্যই পাকিস্তান এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রকে জিহাদের পরামর্শ ও ফতোয়া দেবেন।” (আঞ্জাম, পেশোয়ার, ১লা ডিসেম্বর, ১৯৬৩)
কাশ্মীরী নেতা চৌধুরী গোলাম আব্বাসীর বিবৃতিঃ
“রাওয়ালপিণ্ডি, ২রা ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৪। অদ্য এখানে পাবলিক লাইব্রেরী হলে নিখিল জম্মু ও কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্সের সভাপতি জনাব রাজা মুহাম্মদ হায়দার খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনে আযাদ কাশ্মীর থেকে দু’শ কাউন্সিলর যোগদান করেন। কায়েদে মিল্লাত চৌধুরী গোলাম আব্বাস অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘মুসলিম কনফারেন্স এর কাউন্সিলরগণের পক্ষ থেকে আমরা এই মর্মে নোটিশ পেয়েছি যে, কাউন্সিলর অধিবেশনে জামায়াতে ইসলামীর উপরে বাধা নিষেধ এবং তার নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করা হোক। আমি এ ব্যাপারে জেনারেল কাউন্সিলের সকল সদস্যের সামনে এ কথা স্পষ্ট করে বলে দেয়া আবশ্যক মনে করি যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সাথে আমাদের কোন সংস্রব নেই। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে জড়িত ব্যাপার সম্পর্কে আমাদেরকে আমাদের অভিমত ব্যক্ত করতে হচ্ছে।”
“এ এক সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিই দেশপ্রেমিক। বরং সর্বাপেক্ষা দেশপ্রেমিক। সত্যিকারভাবে দেশের মধ্যে এই একটি দল ছিল, যে দল দেশে ইসলামী গণতন্ত্রের জন্যে আইনানুগ পন্থায় সংগঠিত চেষ্টা করছিল। কাশ্মীর সমস্যা সম্পর্কে এবং কাশ্মীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের ব্যাপারে মাওলানা মওদূদী একাকী যা করেছেন, আমরা সকলে মিলে-এমন কি, আমাদের সরকারের সকল প্রচেষ্টাসহ আমরা তা করতে পারিনি। মাওলানা মওদূদী ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর’ মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যাকে বিশ্বের জাতিসমূহের দরবারে পৌঁছিয়ে দিয়ে আমাদের সপক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণের সমর্থন আদায় করেছেন, যা পাকিস্তানের কাম্য। উপরন্তু মাওলানা মওদূদী কাশ্মীর কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। এদিক দিয়েও তিনি একা আমাদের থেকে বেশী কাজ করেছেন। তিনি তাঁর জামায়াতের পক্ষ থেকে সাহায্য সমর্থনের নিশ্চয়তা দিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন (১৯৬৪ সালের ১লা জানুয়ারী এ বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়), ‘কাশ্মীর সমস্যা সম্পর্কে সরকারের একটা বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।’ কিন্তু পাকিস্তান সরকার অপ্রত্যাশিতভাবে এমন এক বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন যে, মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামীর নেদৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে তাঁর সে আওয়াজ বন্ধ করে দিলেন, যার দ্বারা কাশ্মীরবাসীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।”
“উপরন্তু একথা কারো অবিদিত নেই যে, অধিকৃত কাশ্মীরে বর্তমানে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীই একটি সুদৃঢ় দল। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এর শাখা বিস্তার লাভ করে আছে। এই কারণে পাকিস্তানের মতো একটি ইসলামী ও গণতান্ত্রিক দেশে জামায়াতে ইসলামীর ন্যায় শান্তিপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক দলের উপরে বাধা-বিশেষ আরোপ করার ফলে কাশ্মীরী জনগণের মনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবশ্যই ঘৃণার সঞ্চার হবে।”
“বর্তমানে কাশ্মীরের শান্ত-শীতল পরিবেশ উত্তপ্ত বারুদখানায় পরিণত হয়েছে এবং পাকিস্তান প্রকৃতই কাশ্মীর লাভ করতে চাইলে এর চেয়ে অধিকতর উপযোগী সময় আর কোনদিন আসবে না। এই সময়ে উচিত ছিল গোটা পাকিস্তানী জাতির একনিষ্ঠ ও সমবেত সমর্থন-সহযোগিতা। পাকিস্তান সরকার তা অর্জনও করেছিলেন। কিন্তু আমাদের জন্য পরিতাপের বিষয় এই যে, ঠিক এই সময়ে মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামীর উপরের বাধ্য নিষেধ আরোপ করে সরকার নিজকে সাহায্য-সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, সরকার এ ব্যাপারে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই চান না।”
“যদি পাকিস্তান সরকার কাশ্মীর সমস্যা আন্তরিকতা পোষণ করে থাকেন, তাহলে আমাদের দাবি এই যে, মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে বিনা শর্তে মুক্তি দেয়া হোক এবং জামায়াতে ইসলামীর উপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হোক।”
গোটা পরিষদ কায়েদে মিল্লাতের উপরিউক্ত ভাষণের প্রতি এক বাক্যে সমর্থন জানায় এবং পাকিস্তান সরকার ও প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খানের নিকট দাবি জানানো হয় যে, মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়া হোক এবং জামায়াতে ইসলামীর উপর থেকে বাধানিষেধ প্রত্যাহার করা হোক। (সাপ্তাহিক পাক-কাশ্মীর, রাওয়ালপিন্ডি, ৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৪)।
মাওলানা ও জামায়াত নেতাদের মুক্তি
প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য যে,৬ই জানুয়ারি, ১৯৬৪ জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষনা করার সাথে সাথে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (আমীর, জামায়াতের ইসলামী পাকিস্তান) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩ জন জামায়াত নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ছয়-সাত মাসের মধ্যে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট রায়ের পরও মাওলানা মওদূদীসহ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে অন্যায় বেআনীভাবে কারাগারে আবদ্ধ রাখা হয়। অবশ্য এই অন্যায় আটক আদেশের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট “হেবিয়ার্স কর্পাস” দায়ের করা হয়।
৯ই অক্টোবার, ১৯৬৪ পশ্চিম পাকিস্তানের হাইকোর্ট তাদের রায়ে বলেন যে, ‘নেতৃবৃন্দের আটক সম্পূর্ণ অন্যায় ও বেআইনী হয়েছে’। মাহামান্য হাইকোর্ট অবিলম্বে নেতাদের মুক্তির জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন।
হাইকোর্টের নির্দেশে মাওলানা মওদূদীসহ অন্যান্য জামায়াত নেতৃবৃন্দের নয় মাসাধিকাল বিনা দোষে কারাদণ্ড ভোগ করার পর দুর্নয়ার মুক্ত আবহাওয়ায় ফিরে আসার সুযোগ হলো। লাহোরের জনসাধারণ মাওলানাকে জেল গেটে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে প্রতীক্ষা করতে থাকে। অবশেষে রাত তিনটার পর জেল ফটক উন্মুক্ত হয়, মাওলানা বাইরে পদার্পণ করেন এবং তাকে নিয়ে বিরাট শোভাযাত্রা হয়। সত্যের জয়ধ্বনি আবার নিনাদিত হলো, মিথ্যার ফানুস বিলীন হলো মহাশূন্যে।
বিগত পাক ভারত যুদ্ধে মাওলানা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা
ঊনিশ শ’ পঁয়ষট্টি সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সাম্রাজ্যবাদী ভারত যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই স্থল ও আকাশ পথে পাকিস্তান আক্রমণ করে। ট্যাংক, আর্মার্ডকার ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ লাহোরের পূর্বে ওয়াগাহ্ সীমান্ত অতিরিক্ত করে ভারতীয় সৈন্য লাহোরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। শেষ রাত থেকেই ভারতীয় কামান ও গোলাগুলীর বজ্রনিনাদ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু পরদিন বেলা ন’টার পূর্বে লাহোরবাসী প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেনি।
৫ই সেপ্টেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে কাশ্মীরী নেতা চৌধুরী গোলাম আব্বাস, মাওলানা মওদুদী, মুহাম্মাদ আলী, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান ও সরদার শওকত হায়াত খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মিলিত হন। পরদিন সকালে (৬ই সেপ্টেম্বর) যুদ্ধের সংবাদ পাওয়া মাত্র বেলা আটটায় মাওলানা মওদুদী লাহোর রওয়ানা হন।
দুপুরের কিছু আগে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ইনফরমেশন বিভাগের সেক্রেটারী জনাব সাইয়েদ মুনীর হুসাইন মাওলানার বাসভবনে টেলিফোন যোগে জানিয়ে দেন যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তাঁর রাওয়ালপিণ্ডিস্থ বাস ভবনে সন্ধ্যা সাতটায় বিরোধী দলীয় নেদৃবৃন্দকে মিলিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মাওলানা মওদূদী তখনও লাহোর পৌঁছতে পারেননি। ইনফরমেশন সেক্রেটারী অনুরোধ জানান যে, মাওলানা লাহোর পৌঁছামাত্র তাঁকে জানিয়ে দিলে তিনি পিন্ডি যাওয়ার জন্যে সরকারী যানবাহন পাঠিয়ে দেবেন।
যা হোক, মাওলানা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত করে জানিয়ে দেন যে, ঐ চরম জাতীয় সংকট মুহূর্তে তিনি এবং তার জামায়াত যে কোন খেদমত ও ত্যাগের জন্যে প্রতিমূহূর্তে প্রস্তুত আছেন।
বলা বাহুল্য সাম্রাজ্যবাদী ভারত কর্তৃক কাশ্মীরী মুসলমানদের উপর কৃত অত্যাচার নিষ্পেষণ চরমে পৌঁছলে মজলুম মুসলমান জনসাধারণ তাঁদের আত্মরক্ষার জন্যে আগস্ট মাসের শেষভাগে জিহাদ ঘোষণা করেন। মাওলানা মওদূদী ইতঃপূর্বেই কাশ্মীরী মুজাহিদদের সর্বপ্রকার সাহায্যের জন্যে পাকিস্তানের জনগণের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানান এবং জামায়াতে ইসলামীর সকল কর্মীকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্যে নির্দেশ দেন। অতঃপর “জিহাদে কাশ্মীর ফান্ড” নাম দিয়ে জামায়াত কর্মীগণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ সংগ্রহ অভিযান শুরু করেন। শুধু নগদ অর্থই নয়, বিভিন্ন প্রকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভারও সংগৃহীত হতে থাকে। জনগণও মুক্ত হস্তে দান করে অভূতপূর্ব ত্যাগ ও কুরবানীর পরিচয় দিতে লাগল।
মাওলানা মওদূদী এতটুকু করেই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি সমগ্র মুসলিম জগতের প্রায় একশত আলেম, চিন্তাশীল ব্যক্তি, নেতৃবৃন্দ ও সংবাদপত্র সম্পাদকের কাছে কাশ্মীর জিহাদের জন্যে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রার্থনা করে পত্র লিখেন। তার এ আবেদনপত্র মুসলিম জাহানের বহু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ লাভ করে। তার ফলে সর্বত্র এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় ও মাওলানার আবেদন অনুযায়ী দ্রুতগতিতে কাজ শুরু হয়।
৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ সরাসরি পাকিস্তান ভূ-খণ্ডের উপর ভারত হামলা শুরু করলে মাওলানা পাকিস্তানের জনগণের কাছে নিম্নোক্ত আবেদন জানানঃ
“আজ ভারতীয় সৈন্য ওয়াগাহ্ সীমান্ত অতিক্রম করে লাহোরের দিকে অগ্রসর হওয়ার যে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে, এর পরে যুদ্ধ শুধু জম্মু ও কাশ্মীরেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং উভয় দেশের মধ্যে দস্তুরমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর এ সূচনা করেছে ঘোষণা না করেই। এখন পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিকের ফরয হচ্ছে মাথায় ফাফন বেঁধে মারতে ও মরতে তৈরি হওয়া এবং নিজের জান-মাল দিয়ে এ পবিত্র ভূ-ভণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করা। অবশ্য এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, খোদার ফযলে আমাদের সেনাবাহিনীর লোকেরা অত্যন্ত বাহাদুর এবং তাদের বীরত্বের উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তথাপি দেশের কোন অংশের উপরে যখন হামলা হয়, তখন তার প্রতিরোধ করা শুধু সেনাবাহিনীর উপরেই ফরয হয়ে পড়ে না, বরং আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলমানের উপরেই তা ফরয হয়ে পড়ে। অতএব আমি পাকিস্তানের সকল মুসলমানের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি যে, তারা যেন পরিপূর্ণরূপে একতাবদ্ধ হয়ে এদেশের নিরাপত্তার জন্যে দাঁড়িয়ে যান এবং সর্বপ্রকার ত্যাগের জন্যে তৈরি হন। এর পরেও মাওলানা মওদূদী পাকিস্তান রেডিওর মাধ্যমে জাতিকে জিহাদী অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে পাঁচটি বক্তৃতা করেন। বক্তৃতাগুলো পুস্তিকাকারে ছাপিয়ে পাকিস্তান সরকার জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিতরণ করেন। একথা অতিরঞ্জিত হবে না যে, মাওলানার জিহাদী বক্তৃতাগুলো, সেনাবাহিনী, সীমান্তবাসী ও সাধারণভাবে সমগ্র জাতির মধ্যে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে এক অভূতপূর্ব অদম্য শক্তির সঞ্চার করে। যুদ্ধবিরতির পর ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমরা যুদ্ধফ্রন্টগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। ঐতিহাসিক যুদ্ধফ্রন্ট চাবিন্ডা সেক্টরে (যাকে বিদেশী বিশেষজ্ঞগণ Graveyard of Indian Tanks- ভারতীয় ট্যাংকের সমাধিক্ষেত্র বলে অভিহিত করেছেন) আমাদের ফৌজী ভাইদের ব্যারাকে তখনও মাওলানার জিহাদী বক্তৃতার পুস্তিকা দেখতে পাই।