মওদূদীর পত্রাবলী
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বিংশ শতাব্দীর একজন বিপ্লবী ইসলামী নেতা। তাঁর গোটা জীবনে আন্দোলনের পথে তাঁকে অসংখ্য বাধা বিপত্তি, বিদ্রূপ-সমালোচনা, নির্যাতন-নিষ্পেষণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিস্থিতে তাঁকে বিভিন্ন লোকের নিকট পত্রাদির মাধ্যমে মনের কথা ব্যক্ত করতে হয়েছে। লেখকের ব্যক্তিত্ব, তাঁর সত্যকার চরিত্র, আদর্শ ও ভাবধারার পরিস্ফুরণ হয় তাঁর পত্রাদির মাধ্যমে। এখানে বিভিন্ন সময়ে লিখিত তাঁর কিছু পত্র সন্নিবেশিত করা হলো- যার ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর জীবন দর্শন, জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য, সত্যিকার ইসলামী চিন্তাধারা, ইসলামী আন্দোলনের গুণাবলী ও কর্মধারা এবং ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার দুশমনদের প্রতি সহনশীলতার মনোভাব। আশা করি পত্রগুলি পাঠকদের জীবনেও আলোকবর্তিকার কাজ করবে।
[১]
জনাব আবদুস সাত্তার সাহেবকে।
পাঠানকোট, পাঞ্জাব।
৭ই জুন, ১৯৪১
আমার শ্রদ্ধেয়-
আসসালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আমি শ্রীনগর গিয়েছিলাম। ফিরে এসে আপনার পত্র পেলাম। আমি হযরত কুতুবুদ্দীন মওদূদ চিশতী (রঃ)-এর বংশধর। এ জন্যে নিজকে মওদূদী লিখি। এ নিজেকে প্রখাত করার কোন প্রচার কার্য নয় এবং এর দ্বারা কোন সুবিধা ভোগ করাও উদ্দেশ্য নয়। পারস্পরিক পরিচয় লাভ ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে বিভিন্ন গোত্র-বংশে বিভক্ত করেছেন। অতএব যে বংশে আমি জন্মগ্রহণ করেছি তাই প্রকাশ করি।
‘মওদূদী’ কোন মতবাদ অথবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাম নয় সে, আমাকে দোষারোপ করা যেতে পারে।
আমার যে সব কথা পড়ে আপনার এরূপ ধারণা জন্মেছে যে, আমি বুযুর্গানে দ্বীনের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করি, আপনি তার উল্লেখ করেননি। বুযুর্গানে দ্বীনের প্রতি যে ধারণা পোষণ করা আবশ্যক, আপনি তারও ব্যাখ্যা করেননি। দয়া করে এ দু’টি বিষয়ের উপরে কিছু আলোকপাত করলে আমার বক্তব্য পেশ করতে পারি। আমাকে যে দোষে অপরাধী করা হয়েছে তা যে কি, তা আপনার পত্রের দ্বারা বুঝতে পারলাম না। আমার বরং সন্দেহ হয় যে, আমার প্রবন্ধটি ধীরস্থির চিত্তে আপনি মোটেই পড়েননি। এ এক সাধারণ নিয়ম হয়ে পড়েছে যে, কোন ব্যক্তি যদি কোন একটি প্রবন্ধে কিছু তার রুচির বিপরীত দেখতে পায়, তাহলে গোটা প্রবন্ধটাকেই সে ঘৃণা ও সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। অতঃপর শান্তমনে চিন্তা করার অবসরই তার হয় না যে প্রবন্ধকার কি বলছে।
সম্ভবত আপনার জানা নেই যে, আমি এমন এক বংশে জন্মগ্রহণ করেছি যার মধ্যে এক হাজার বছর যাবত বায়আত ও দীক্ষাদানের পরস্পরা জারি ছিল। তার সমস্ত ভালমন্দ দিক সরাসরি অধ্যয়ন করার সুযোগ আমার হয়েছিল। বাইরের কোন লোকের ন্যায় বিদ্বেষের মনোভাব নিয়ে আমি এসব লক্ষ্য করিনি বরং স্বাভাবিকভাবে এ সবের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। দারপর যদি আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, ইসলামের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত এ প্রতিষ্ঠানটি বিকৃত হয়ে পড়েছে এবং এর মধ্যে বেশ কিছু রদবদরের প্রয়োজন, তাহলে একে কোন বাইরের শত্রুর অভিমত বলা হবে না, বরং আপন গৃহের বন্ধুর অভিমতই মনে করা হবে, যা নিছক সত্যের খাতিরে প্রকাশ করা হয়েছে। সত্যের সেবা যদি আমার লক্ষ্য না হতো, তাহলে অতি সহজেই আমি আমার খান্দানী গদি দখল করে বসতাম এবং পীর-মুরীদীর আসর জমিয়ে হস্তপদ চুম্বনকারী, নযর-নিয়ায প্রদানকারী বহু মহাত্মাকে আমার চারপাশে ভীড় জমাতে দেখতাম।
খাকসার
আবুল আ’লা।
[২]
হাফেযাবাদের হাকিম মুহাম্মদ শরীফ সাহেবের নামে।
নতুন সেন্ট্রাল জেল
মুলতান।
১৭ই মার্চ, ১৯৪৯
আমার শ্রদ্ধেয়,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
…… আপনি আমার স্বাস্থ্যের জন্যে চিন্তা করবেন না। সত্য কথা এই যে, এখন আমার স্বাস্থ্য যেমন আছে, তেমনি বহু বছর যাবত আমার ভাগ্যে হয়নি। শরীরের ওজন বেড়ে গেছে, ক্ষুধা বেড়ে গেছে এবং এত সুন্দর ঘুম হয় যে গত পনেরো বছরে এত সুন্দর ঘুম হয়নি। শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম আগে থেকে অনেক বেশী করতে পারি এবং ক্লান্তি খুব কম বোধ করি। তার কারণ এই যে, আজ পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী ব্যক্তি আর কেউ নেই। ছেলে মেয়ে ও আত্মীয় স্বজনের জন্যে কোন চিন্তা আমার নেই। কারণ তাদেরকে খোদার উপরে সঁপে এসেছি। জাতির জন্যে আমার কোন চিন্তা নেই। কারণ, এ ব্যাপারে খোদার তরফ থেকে আমার উপরে যতটা দায়িত্ব ছিল, তা বর্তমান সরকার তাদের নিজেদের স্কন্ধে নিয়েছেন। জামায়াত এবং ইসলামী দাওয়াতের জন্যেও আমার চিন্তা নেই। কারণ গ্রেফতার হওয়ার সাথে সাথেই দায়িত্বমুক্ত হয়ে পড়েছি। এর সাথে সাথে এ এ আস্থাও আমার পুরোপুরি রয়েছে যে, আমার কারারুদ্ধ হওয়ার কারণে জামায়াতের কোন ক্ষতি না হয়ে বরং উপকারই হবে। এখন আপনি নিজেই চিন্তা করে দেখুন আমার চেয়ে অধিক সুখী আরকি হতে পারে।
খাকসার
আবুল আ’লা
[৩]
হাফেযাবাদের হাকিম মুহাম্মদ শরীফ সাহেবের নামে।
নতুন সেন্ট্রাল জেল সুলতান
২২শে এপ্রিল, ১৯৪৯
আমার শ্রদ্ধেয়,
আসসালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আমার কারা-জীবনের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়ার জন্যে আপনি যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তা আমার প্রতি আপনার আন্তরিক ভালবাসারই পরিচায়ক। কিন্তু নীতিগতভাবে একটি বিষয় মনে রাখবেন যে, যে ব্যক্তি খোদা এবং তার সৃষ্টির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখে এবং খোদার পথে তাঁর সৃষ্টির মঙ্গলের জন্যে কাজ করে খোদা তার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেন না। প্রকাশ্যত তার জন্যে যা অমঙ্গলকর মনে হয়, খোদার ফযলে আমি লাভ করেছি। এ নিছক একটা ভাল ধারাপ পোষণ নয়, বরং একটা মহাসত্য। আমি যে সংস্কার-সংশোধনের জন্যে কাজ করছি, তার পথে কোন প্রস্তরময়-পর্বত প্রতিবন্ধক নয়। বরং গগনচুম্বী মল-আবর্জনাই ছিল প্রতিবন্ধক। আমি খোদার সন্তুষ্টির জন্যেই মহল-আবর্জনা পরিস্কার কার কাজ শুরু করেছিলাম। এ কাজ করতে গিয়ে যে মল-আবর্জনার ছিটা আমার উপ পড়েছিল, তা ধৈর্যসহকারে সহ্য করতাম। কিন্তু আমার খোদা আমার কাছ থেকে মেথরের কাজ নেয়া পছন্দ করেননি। এ জন্যে আমাকে এক নির্জন শান্তির স্থানে এনে ফেলেছেন। এখন যাদের মল, তাদের উপরেই নিক্ষেপ করা হচ্ছে। … এ কাজ এখনো অসম্পূর্ণ আছে। যখন সম্পূর্ণ হবে, তখন আপনারা আমাকে আপনাদের মধ্যে পাবেন।
খাকসার
আবুল আ’লা
[৪]
সাইয়েদ আবুল খায়ের মওদূদী সাহেবের নামে।
নতুন সেন্ট্রাল জেল, মুলতান
২৩শে নভেম্বর, ১৯৪৯
ভাই সাহেব
আসসালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আমার সারা জীবনের পড়াশুনা থেকে আমি একথা বলতে পারি যে, যে সব শক্তি দুর্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় নেয়, তারা কোন দিন এ দুনিয়ায় জীবিত থাকতে পারে না। কারণ মুক্ত মাঠে প্রতিযোগিতা করা থেকে পালিয়ে গিয়ে দুর্গের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কাপুরুষতার পরিচায়ক এবং আল্লাহ তায়ালা কাপুরুষদের শাসনের জন্যে এ পৃথিবী সৃষ্টি করেননি। আমার অধ্যয়ন এ কথাও বলে যে, যাদের কাজকর্ম মিথ্যা, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার ভিত্তিতে চলে, সত্যের আলোকে আসা যারা বিপজ্জনক মনে করে এবং যাদের শাসন ক্ষমতার নিরাপত্তার জন্যে প্রয়োজন হয় নিরাপত্তা আইনের, এমন নৈতিক কাপুরুষদের কাঠের হাঁড়ি বেশীক্ষণ উন্নয়নের উপরে থাকতে পারে না। এ বিবেকের পরিপন্থী, প্রাকৃতিক বিধানের পরিপন্থী এবং এক হাজার বছরের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, এ সবের উপরে নির্ভরকারী ক্ষণকালের জন্যে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না।
খাকসার
আবুল আ’লা
[৫]
সাইয়েদ আবুল খায়ের মওদূদী সাহেবের নামে।
নতুন সেন্ট্রাল জেল, মুলতান
১৬ই মে, ১৯৪৯
ভাই সাহেব
আসসালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আগামীতে আপনি যখনই আসবেন সাথে করে বড় ছেলে দু’টিকে আনবেন। হাজী মিঞা [বড় ভাইয়ের ছেলের হাক নাম ‘হাজী মিঞা’] আসতে চাইলে তাকেও আনবেন। এখানকার পরিবেশের একটা মন্দ প্রক্রিয়া হতে পারে, এটা মনে করে প্রথমত তাদেরকে আনতে নিষেধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন চিন্তা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, তাদেরকে সব জায়গা দেখিয়ে দেয়া উচিত। এখনও হতে পারে যে, বর্তমান বংশধর থেকে ভবিষ্যতের বংশধর অধিকতর পথভ্রষ্ট হবে এবং তাদের মুকাবেলায় তখনকার লোকদের আমাদের চেয়ে কঠিন সংগ্রাম করতে হবে। আমি আমার ছেলেদেরকে বিলাসিতার জন্যে প্রতিপারন করতে চাই না। বরং ভালোর সেবা এবং মন্দের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে প্রতিপালন করতে চাই।
খাকসার
আবুল আ’লা
[৬]
আহমদ ফারুক মওদূদীর নামে।
নতুন সেন্ট্রাল জেল, মুলতান
২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯
প্রিয় পুত্র,
ওয়া ‘আলায়কুমুস সালাম।
জানি না আজ তোমাকে যে পত্রখানা লিখছি তা কবে তুমি পাবে। এর জন্যে অবশ্য আমিও চিন্তিত নই এবং তোমাদের চিন্তিত হওয়া উচিত নয়। চিঠি পাও, না পাও এবং কুশল জানতে পার আর না পার সকল অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকবে যে, আল্লাহ যাই করেন, মঙ্গলের জন্যে করেন। শয়তান তো এই চায় যে, আমরা যেন এ অবস্থায় অত্যন্ত ঘাবড়ে যাই এবং অধীর হয়ে পড়ি। কিন্তু খোদার উপর ভরসা করে শয়তানের এ চালবাজি আমাদের পরাস্ত করা উচিত।
তোমলা ভালভাবে চলছ, না মন্দভাবে চলছ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমাদের ভালো-মন্দ অবস্থার কিছু যদি আমি জানতেও পারি, তো কিছুই করতে পারব না। এ জন্যে আমি তোমাদেরকে খোদার উপরে সোপর্দ করে ধৈর্য ধারণ করেছি। আমি মনে করি আমার মৃত্যুর পর তোমাদের যেভাবে জীবন যাপন করতে হতো, ঠিক সেইভাবে এখনও করবে। খোদার এ এক শান যে, অন্যান্যকে তাদের অভিভাবকের মৃত্যুর পর যে অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, আমার জীবদ্দশায় তোমাদেরকে সে অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ অভিজ্ঞতার জন্যে ভেঙে পড়ো না, বরং এ সুযোগ গ্রহণ কর ইনশাআল্লাহ এ তোমাদের জন্যে মঙ্গলকর প্রমাণিত হবে।
– আবুল আ‘লা মওদূদী
[৭]
করাচীর চৌধুরী গোলাম মুহাম্মদ সাহেবের নামে।
নতুন সেন্ট্রাল জেল, মুলতান
৬ই এপ্রিল, ১৯৫০
আসসালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
বর্তমান কালের বিপ্লবী আন্দোলনের মেযায থেকে ইসলামের মেযায পৃথক। বর্তমানে বিপ্লবী আন্দোলনগুলো প্রথমত তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে। দ্বিতীয়ত তারা একটি সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্য একটি সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার জন্যে অতীব হীন পন্থা অবলম্বন করে। এই বিপ্লব-পরিবর্তনের ফলে লক্ষ্ লক্ষ মানব সন্তান যে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, তার কোন পরোয়া তারা করে না। পক্ষান্তরে ইসলাম যখন ক্ষমতা লাভ করতে সক্ষম হয়, তখন যে সাধারণত প্রতিশোধ লওয়ার পরিবর্তে ক্ষমার নীতি অবলম্বন করে। অতঃপর পূর্ববর্তী সমাজ ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন এবং তদস্থলে নিজের সংস্কার-সংশোধনী প্রোগ্রাম কার্যকর করার ব্যাপারে তার সাধারণ নীতি এই হয় যে, সংস্কার-সংশোধন ক্রমশ এবং যতদূর সম্ভব সহজ পদ্ধতিতে করা হবে এবং মানব জীবনকে ঝটিকা বিপ্লব থেকে যথাসম্ভব বাঁচানো হবে।
ইসলামের স্পিরিট সম্পর্কে অজ্ঞ লোক সংস্কার-সংশোধনের অতি আগ্রহ জগতে প্রচলিত বিপ্লবী পদ্ধতির অনুকরণ করে এবং এরূপ অনুকরণ করতে গিয়ে তাতে ইসলামের লেবেল লাগিয়ে দেয়। তাদের ভ্রান্ত কর্মপদ্ধতির বিশ্লেষণ করাই হচ্ছে ইসলামী নীতি বর্ণনার উদ্দেশ্য।
-আবুল আ‘লা মওদূদী
[৮
রাসায়েল ও মাসায়েলে প্রদত্ত চিঠির জবাব
বিরোধিতার তুফান
…. আমার বিরুদ্ধে যে প্রচারণা শুরু করেছে তা আমার অজানা নেই। এ আমার নতুন কোন অভিজ্ঞতা নয়। বারবার এ ধরনের মিথ্যা অপবাদ আমার বিরুদ্ধে ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং সব সময়ে আমি ধৈর্য ধারণ করেছি। এখন পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতা এই যে, আল্লাহ তায়ালা মিথ্যাকে প্রসার লাভ করতে দেন না।
সব সময়েই আমার এ নিয়ম ছিল যে, যাদেরকেই সততা, বিশ্বস্ততা এবং খোদার ভয় থেকে বেপরোয়া দেখেছি, তাদের কোন কথার জবাব দেইনি এবং ভবিষ্যতেও দিতে চাই না। আমার মনে হয় তাদের প্রতিশোধ নেয়া আমার সাধ্যের বাইরে। আল্লাহ তায়ালাই তাদের প্রতিশোধ নিতে পারেন। এও আমার ধারণা যে, তাদের মিথ্যার প্রতিবাদ করারও আমার প্রয়োজন নেই। ইনশাআল্লাহ দুনিয়াতেই তাদের গুমোর ফাঁস হয়ে যাবে।
উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি
জামায়াতে ইসলামী গঠনের উদ্দেশ্য ভাল করে বুঝে রাখুন। কোন দেশ অথবা জাতি সাময়িক সমস্যা সামনে রেখে সাময়িক পদ্ধতিতে তার সমাধান করার জন্যে এ জামায়াত গঠিত হয়নি। সমস্যাবলীর সমাধানকল্পে যখন যে নীতি চালু দেখা যাবে, তাই অবলম্বন করা হবে- এমন নীতির ভিত্তিতে এ জামায়াত গঠিত হয়নি। এ জামায়াতের সামনে তো একটি মাত্রই বিশ্বজনীন ও শাশ্বত সমস্যা রয়েছে, যা প্রত্যেক দেশ ও জাতির সমুদয় সমস্যাকে আঁকড়ে ধরে আছে। সে সমস্যাটি হলো এই যে, মানবের পার্থিব উন্নতি ও পারলৌকিক মুক্তি কিসে রয়েছে। অতঃপর এ সমস্যার একটি মাত্র সমাধান এ জামায়াতের নিকটে রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, সমগ্র মানব জাতি সত্যিকারভাবে আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন করুক। অতঃপর তাদের মূলনীতি অনুসরণ করে চলুক যা রয়েছে আল্লাহর কিতাবে এবং রসূলের সুন্নাতে। এ সমস্যা এবং এর সমাধান ব্যীত দুনিয়ার অন্য কোন কিছুর প্রতিই আমাদের কোন আকর্ষণ নেই।
দল গঠনের আবশ্যকতা
… হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে যে, জামায়াতে বা দল ব্যতীত সত্যিকার ইসলামী জীবন হয় না। জীবন প্রকৃতপক্ষে ইসলামী হতে হলে সবচেয়ে প্রয়োজন যে বস্তুর, তা হচ্ছে এই যে, ইসলামের লক্ষ্য অর্থাৎ ইকামাতে দ্বীনের সাথে হতে হবে সংশ্লিষ্ট। এর দাবি হচ্ছে এই যে, এ লক্ষ্যের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ শক্তি ব্যতীত এ প্রচেষ্টা সম্ভব নয়। অতএব জামায়াত ব্যতিরেকে কোন জীবনকে ইসলামী বলা মারাত্মক ভুল হবে। দ্বিতীয় কথা এই যে, কোন ব্যক্তি আমাদের জামায়াতে শামিল না হোক। কিন্তু সে এমন জামায়াতে শামিল হোক যার লক্ষ্য এই হবে এবং যার দলীয় সংগঠন ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর পদ্ধতি ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী হবে। এমতাবস্থায় তাকে আমরা সত্য পথগামী বলে স্বীকার করতে দ্বিধা করবো না। কিন্তু ব্যক্তিগত চরিত্র গঠনের যে সব পদ্ধতি শরীয়তে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি শুধু তারই অনুসরণ করুক এবং ইকামাতে দ্বীনের চেষ্টা-চরিত্রের জন্যে কোন জামায়াতে শামিল না হোক- এ আমাদের কাছে ঠিক নয়। এমন জীবনকে আমরা অর্ধ জাহিলিয়াতের জীবন মনে করি। আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি মতে ইসলামের সর্বনিম্ন দাবি এই যে, যদি কোন ব্যক্তি তার চারপাশে ইসলামী লক্ষ্য অর্জনের জন্যে ইসলামী পদ্ধতিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকারী কোন জামায়াত দেখতে না পায়, তাহলে তার উচিত হবে এরূপ কোন দল গঠনের চেষ্টা করা এবং তাকে এ জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে যে, যখনই এ ধরনের কোন জামায়ত পাওয়া যাবে, তখন তার সকল আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে জামায়াতের মনোভাব নিয়ে তাতে শামিল হতে হবে।
তাবলীগ ও বিপ্লব
আপনার পত্র থেকে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তার মর্ম হলো এই যে, বর্তমান সময়ে শুধু মৌখিক তাবলীগ, বক্তৃতা, প্রবন্ধ লিখন ও পত্র-পত্রিকার দ্বারা প্রচার চালানো হোক। এর উপরে নিজের কোন আমল করার দাওয়াত দেয়ার প্রয়োজন নেই। তারপর যখন সকল মুসলমানের মন-মস্তিষ্ক আমাদের ভাবধারায় প্রভাবিত হবে, তখন হঠাৎ একদিন বিপ্লব ঘটবে।
ধারণাটি বেশ চমৎকার। কিন্তু তাবলীগ এবং বিপ্লবের প্রকৃতি যে এক নয় তার কি করা যাবে? প্রভাবশালী এবং কার্যকরী তাবলীগ কেবল মাত্র তখনই হতে পারে যখন তাবলীগকারী দল তার নীতির উপরে আমল করবে এবং এর উপরে আমলকারীদেরকে সংগঠিত করবে। শুধু ওয়ায-নসীহত তো বহুদিন ধরে চলে আসছে। তার কি ফল হয়েছে?
(রাসায়েল ও মাসায়েল)