শাসনতান্ত্রিক আইন
শাসনতান্ত্রিক আইনের দৃষ্টিতে ইসলাম দুনিয়াকে দু ভাগে বিভক্ত করে। একটি দারুল ইসলাম, অন্যটি দারুল কুফর। দারুল ইসলাম ঐ অঞ্চলকে বলে যেখানে মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত এবং যেখানে কার্যত ইসলামী আইন প্রবর্তিত। অথবা শাসকদের মধ্যে এতটা শক্তি-সামর্থ থাকবে যাতে করে তারা এ আইন বাস্তবায়িত করতে পারে।১.[দারুল ইসলামের এ সংজ্ঞার কিছুটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। প্রকৃতপক্ষে সত্যিকার অর্থে দারুল ইসলাম সেই অঞ্চলকে বলে, যেখানে ইসলাম একটি জীবন বিধান হিসেবে শাসন পরিচালনা করবে এবং যেখানে ইসলামী আইন দেশের আইন হিসেবে চালু থাকবে। কিন্তু যদি কখনো এমন অবস্থা হয় যে, কোনো দেশে শাসন ক্ষমতা থাকে মুসলমানদেরই হাতে, কিন্তু তারা ইসলামের পরিবর্তে অন্য কোনো জীবন বিধান কায়েম করে এবং ইসলামী আইনের পরিবর্তে অন্য কোনো আইন প্রবর্তন করতে থাকে, তাহলে ইসলামী শাস্ত্রবিদগণ (ফকীহ) নৈরাশ্য পোষণ করে হঠাত করে সে দেশকে দারুল কুফর হবার ঘোষণা করা সংগত মনে করেন না। যতোক্ষণ পর্যন্ত না মুসলমানগন ইসলাম থেকে তাদের নাম মাত্র সম্পর্কও ছিন্ন করে, ততোক্ষণ সে দেশকে ক্ষমতাসীন দারুল ইসলাম বলেই তারা অভিহিত করতে থাকেন। ফকীহগণের এ সতর্কতাপূর্ণ কর্মপদ্ধতি এজন্য যে, মুসলমানদের কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের আদর্শ ও আইন-কানুনের দিক দিয়ে অমুসলমান হওয়া অনিবার্যরূপে দুটো কারনের মধ্যে কোনো একটি কারনেই হতে পারে। এক হচ্ছে এই যে, দেশের মুসলমান অধিবাসীগণ রীতিমত ইসলামের অনুসারী এবং তারই আনুগত্যে জীবনযাপন করার ইচ্ছা রাখে। কিন্তু কোনো না কোনো কারণে, একটি পথভ্রষ্ট দল ক্ষমতাসীন হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় কারণ এই যে, দেশের জনগণের মধ্যে সাধারণভাবে অজ্ঞতা ও গোমরাহী প্রসার লাভ করেছে এবং তাদের মর্যী অনুযারী সে পথভ্রষ্ট দলটি ক্ষমতা লাভ করেছে যারা অনৈসলামী পন্থায় জাতীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছে। প্রথম অবস্থার ব্যাপারেতো আশা করা যায় যে, মুসলিম জনগণের ইসলামী অনুভূতি শেষ পর্যন্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং ঐ দলটিকে ক্ষমতাচ্যুত করবে যারা ইসলামের গৃহে কুফরের কাজ চালাচ্ছে। এজন্য এমন কোনো কারন নেই যার জন্যে এ গৃহকে নিজেরাই কুফরের গৃহ বলে বসবো। অবশ্যি দ্বিতীয় অবস্থাটি নৈরাশ্যজনক বটে। কিন্তু যে জাতি অজ্ঞতা ও গোমরাহী সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ইসলামের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেনি এবং যারা এতটা বিগড়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ইসলামকেই নিজেদের ধর্ম মনে করে, তাদের সম্পর্কেও আমরা এতটা নিরাশ হতে পারি না যে, সত্যিকার ইসলামের দিকে তাদের প্রত্যাবর্তন করার সকল আশা নির্মূল হয়ে গেছে। অতএব তাদের গৃহকেও আমরা দারুল কুফর বলবো না। বরঞ্চ দারুল ইসলামই বলতে থাকবো। কিন্তু একথা ভালো করে উপলব্ধি করা উচিত যে, বাস্তব ক্ষেত্রে ইসলামী আইনের সম্পর্ক শুধুমাত্র সেই দারুল ইসলামের সাথে যা কার্যত দারুল ইসলাম। এখন কথা রইলো তথাকথিত দারুল ইসলাম সম্পর্কে যে স্বয়ং ইসলাম থেকে তার আইনগত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ইসলাম তার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সেরূপ শাসন্তান্ত্রিক অধিকার দিতে প্রস্তুত নয়, যা শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে নির্দিষ্ট।] পক্ষান্তরে যেখানে মুসলমানদের শাসন নেই এবং ইসলামী আইনও চালু নেই, তাহলো দারুল কুফর। এ হলো ঠিক সেরূপ যেমন ঐসব দেশ যেখানে ইংরেজ শাসন চলছে সেগুলোকে বৃটিশ অঞ্চল বলা হবে এবং যেসব এলাকা এর সীমারেখার বাইরে তাকে বলা হবে অন্য অঞ্চল। ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামী বিধানসমূহ শুধু তাদের উপর প্রয়োগ করতে পারে যারা তার আপন সীমার (JURISDICTION) মধ্যে বাস করে। এভাবে সে রাষ্ট্র শুধু সেসব সম্পদ, মান-সম্মান ও জীবন রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে যা তার ক্ষমতার অথবা অধিকৃত অঞ্চলের (TERRITORY) গন্ডির মধ্যে হবে। এ সীমারেখার বাইরে কোনো কিছুর রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব তার নয়।এ আইন অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণাধীন প্রতিটি জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষিত। তা সে মুসলমান হোক অথবা অমুসলমানের। পক্ষান্তরে দারুল কুফরে অবস্থানকারী প্রতিটি জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম অরক্ষিত যার রক্ষণাবেক্ষোণকারী ইসলামী রাষ্ট্র নয়, তা সে জীবন, সম্পদ ইত্যাদি মুসলমানের হোক অথবা অমুসলমানের। অরক্ষিত শুধু এতটুকু অর্থে যে, যদি তার জীবন, ধন-সম্পদ ও মান-সম্ভ্রম কোনো প্রকার আক্রান্ত হয়, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। কারণ এ কাজ তার কর্মসীমার বাইরে সংঘটিত হয়েছে। এ কাজ আল্লাহর কাছে গোনাহ বলে বিবেচিত হবে কিনা এবং তার জন্যে জবাবদিহি করতে হবে কিনা, সে হলো অন্য কথা। অতএব কোনো কিছুর অরক্ষিত হবার অর্থ এই নয় যে, তা হালাল হবে, আর না তার অরক্ষিত হবার অর্থ এভাবে গ্রহন করা হবে যে, তার কোনো ক্ষতিসাধন করা অথবা তা অধিকার করে নেয়া আল্লাহর কাছে জায়েয ও হালাল। এভাবে শাসনতান্ত্রিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি এরূপ কোনো কাজকে জায়েয মনে করা হয় যা দারুল কুফরে সংঘটিত হয়েছে, তাহলে তার অর্থ শুধু এতটুকু হবে যে, ইসলামী রাষ্ট্র তাতে বাধা দেবে না, এর জন্য কোনো শাস্তিও দেবে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এ হারাম কাজের জন্যে আল্লাহর কাছেও জবাবদিহি করতে হবে না।
এখানে বিশ্বাসমূলক আইন ও শাসনতান্ত্রিক আইন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাসমূলক আইন যে মুসলমানকে ভাই বলে এবং যার জান ও মালকে হারাম বলে গন্য করে, সে শাসনতান্ত্রিক আইনের দৃষ্টিতে অরক্ষিত। কারণ সে ইসলামী রাষ্ট্রের আওতায় বাইরে থাকে। আবার যে কাফেরকে বিশ্বাসমূলক আইন দুশমন মনে করে, শাসনতান্ত্রিক আইন তাকে রক্ষিত বলে গন্য করে এজন্য যে, সে ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষনে এসে গেছে। বিশ্বাসমূলক আইন যে কাজকে কঠিন গোনাহ ও অপরাধ বলে গন্য করে, শাসনতান্ত্রিক আইন তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করে না। কারণ তা তাঁর শাসন আওতার বাইরে। উভয়ের মধ্যে প্রকাশ্য পার্থক্য এই যে, বিশ্বাসমূলক আইনের সম্পর্ক আখেরাতের সাথে এবং শাসনতান্ত্রিক আইনের সম্পর্ক দুনিয়া এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়াদির সাথে। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ব্যতীত অন্যান্য সকল ইমামগণ কম-বেশী এ উভয় আইনকে মিশ্রিত করে ফেলেছেন এবং তারা এর সীমারেখাগুলোর পুরোপুরি পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেননি। কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে এ জটিল বিষয়টির ব্যাখ্যা করছিঃ
একঃ মনে করুন একজন মুসলিম ব্যবসায়ী নিরাপত্তা নিয়ে দারুল হরবে গেল এবং সেখান থেকে কিছু মাল চুরি করে আনলো। এ কাজ বিশ্বাসমূলক আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে হারাম। কারণ সে ব্যক্তি চুক্তি ভংগ করেছে। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক আইন সে ব্যক্তিকে উক্ত চোরাই মালের বৈধ মালিক মনে করে এবং তাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাস করে না।-(হেদায়া)
দুইঃ মনে করুন, দারুল ইসলামের কোনো নাগরিক দারুল হরবে বন্দী ছিল। সে কারাগার থেকে পলায়ন করলো অথবা তাকে ছেড়ে দেয়া হলো। এখন সে ওখানে চুরি করুক, মদ্য পান করুক অথবা ব্যভিচার করুক; শাসনতান্ত্রিক আইন অনুযায়ী সে অভিযুক্ত হবার যোগ্য নয়। -(বাহরুর রায়েক)
অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র না তাঁর হাত কেটে দেবে, না মদ্যপান ও ব্যভিচারের জন্যে কোনো শাস্তি দেবে, আর না হত্যার জন্যে কিসাস জারী করবে।১.[.প্রকাশ থাকে যে, দারুল ইসলামের যেসব নাগরিক বিদেশে গিয়ে কোনো অপরাধ এবং চরিত্রহীনতার কাজ করে, দারুল ইসলাম সরকার অবশ্যই তাদেরকে অভিযুক্ত করতে পারে যে, তারা তাদের অপকর্মের দ্বারা ইসলাম ও মুসলমানদের উপর কলংক লেপন করেছে। এজন্যেও অভিযুক্ত করতে পারে যে, তারা তাদের অপকর্মের দ্বারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আপন রাষ্ট্রের জন্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু দারুল ইসলামের আওতার বাইরে যেসব অপরাধ, যথা চুরি, হত্যা ইত্যাদি, সে করেছে তাঁর জন্যে কোনো মামলা দায়ের করা হবে না।] কিন্তু বিশ্বাসমূলক আইনে সে আল্লাহর কাছে গোনাহগার হবে।
তিনঃ মনে করুন, এক ব্যক্তি দারুল হরবে মুসলমান হলো। অতঃপর সেখান থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে এলো না। বিশ্বাসমূলক আইনে সে মুসলমান ভাই হয়ে গেছে। তাঁর খুন ও মাল হারাম হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু সে ইসলামী রাষ্ট্রের আওতার বাইরে, সে জন্যে শাসনতান্ত্রিক আইনে তাঁর কোনো কিছুই রক্ষিত নয়। একটি দুশমন রাজ্যের নাগরিকের মতোই তাঁর অবস্থা হবে। যদি কোনো মুসলমান দারুল ইসলামের বাইরে তাকে হত্যা করে, তাহলে ইসলামী আদালত তার উপর কিসাস গ্রহণ করবেনা। সে ব্যাক্তি স্বেচ্ছায় অবশ্যি কাফফারা দিয়ে দিতে পারে। এরূপ যদি কোনো মুসলমান তার নিকটে সুদ নেয় অথবা কোনো অবৈধ উপায়ে তার মাল হস্তগত করে, তাহলে শাসনতান্ত্রিক আইনে সে অভিযুক্ত হবার যোগ্য হবে না। কারণ তার মাল অরক্ষিত। এ ব্যাপারে ফকীহগণের ব্যাখ্যা তাৎপর্যপূর্ণঃ
(আরবী*******)
“যদি দারুল হরবের কোনো লোক মুসলমান হয় এবং হিজরত করে দারুল ইসলামে আসার আগে যদি কোনো মুসলমান অনিচ্ছাবশত কতল করে, তাহলে তাকে কাফফারা দিতে হবে — বিনিময়ে রক্ত দিতে হবে না। ইমলাতে এ বিষয়ে আবু হানিফা (রঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাকে কাফফারাও দিতে হবে না। কারণ কাফফারা ওয়াজিব হয় খুনের মূল্য হিসেবে, হত্যা হারাম হওয়া হিসেবে নয়। আর খুনের মূল্য তখনই মাত্র নির্ধারিত হয়, যখন তা দারুল ইসলামের রক্ষণাধীন হয়।”
(আরবী*********)
“ এবং আমাদের পূর্ববর্তী বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি মুসলমান হয়ে হিজরত না করে দারুল হরবের অধিবাসী হয়ে গেল, তার খুনের কোনো মূল্য নেই। ১.[এর অর্থ এই যে, যে মুসলমান কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষনে নেই, বরঞ্চ তার আওতার বাইরে থাকে, তার খুনের যতই মূল্য হোক না কেন, ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে তার আইনানুগ মূল্য কিছুই নেই। সে বিপন্ন হলে ইসলামী রাষ্ট্র তার কোনো প্রতিকার করতে পারে না। কাকে কেউ হত্যা করলে তাহলে তার কিসাস অথবা রক্তের বিনিময়ে আদায় করে দেয়ার কোনো দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের নেই। তার মাল ও ইজ্জত-আবরুর উপর কেউ অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করলে, সে অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকারের দায়িত্বও ইসলামী রাষ্ট্রের নয়। কিন্তু এতসব কিছু আইনের দিক দিয়ে,নতুবা আকীদাহ-বিশ্বাসের দিক দিয়ে তো মুসলমানের জান-মাল, ইজ্জত –আবরু দুনিয়ার সবকিছু থেকে অধিক মূল্যবান এবং দারুল ইসলামের মুসলমানদের দীনি মর্যাদার দাবী এই যে, তারা দারুল কুফরের মুসলমানদের যতটা সাহায্য করতে পারে, তা করবে।] ……………… এরই ভিত্তিতে আমাদের আলেমগণ (হানাফী) এ ধরনের মুসলমানকে হরবীর মতোই মনে করেছে। অর্থাৎ তার সম্পদ হস্তগতকারীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই — এ দিক দিয়ে তার মাল হরবীর মালের ন্যায় এবং এরই ভিত্তিতে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তার সাথে সেভাবে ক্রয়-বিক্রয় বৈধ বলেছেন যেভাবে হরবীদের সাথে বৈধ। অর্থাৎ দারুল হরবে এক দিরহামকে দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করা। “
(আরবী*******)
“হাসান ইবনে সালেহ বলেন, দারুল হরবের কোনো বাসিন্দা ইসলাম গ্রহন করার পর সেখানেই রয়ে গেল, অথচ তার হিজরতের সামর্থ ছিল, তাহলে তার মর্যাদা একজন মুসলমানের মত নয়।১.[বর্তমান যুগে ‘হিজরত সামর্থ’ — এ বিধানের সাথে আর একটি শর্ত লাগাতে হবে। তা হচ্ছে এই যে, দারুল ইসলামে মুহাজিরদের আগমনের দ্বার উন্মুক্ত থাকতে হবে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা থাকতে হবে যে, সাধারণ দারুল হরব ও দারুল কুফর থেকে এবং বিশিষ্ট কোনো দারুল হরব ও দারুল কুফর থেকে মুসলমানগণ ইসলামী রাষ্ট্রে চলে আসুক। এ অবস্থায় সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যারা হিজরত করবে না, তাদের সাথে দারুল ইসলামের মুসলমান সকল দিক দিয়ে সেই আচরণই করবে যা সি দারুল হরব বা দারুল কুফরের বাসিন্দার সাথে করবে। আর যারা হিজরত করতে অপারগ, শাসনতান্ত্রিক দিক দিয়ে তাদের কোনো অধিকার না থাকলেও তাদের সাথে একেবারে অমুসলিমের মতো আচরণ করা যাবে না। বরঞ্চ সেনাবাহিনীর লোকদেরকে এবং অন্যান্য মুসলমানদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হবে যে, যুদ্ধের সময় যতটা সম্ভব তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। সন্ধির অবস্থায়ও তাদের সাথে অধিকতর সহানুভুতিপূর্ণ আচরন করতে থাকবে। কিন্তু যদি দারুল ইসলামের সরকারের পক্ষ থেকে যদি বাইরের মুসলমানদের হিজরত করার আহ্ববান জানানো না হয়, আর হিজরতের জন্যে দ্বার উন্মুক্ত না হয়, তাহলে এ অবস্থায় বাইরের মুসলমানদের উপর হাসান ইবনে সালেহের একথা প্রযোজ্য হবে না যে, হিজরতের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যারা হিজরত করবে না তাদের মর্যাদা মুসলমানদের মতো নয়। অবশ্যি শাসনতান্ত্রিক আইনের এ নীতি সর্বত্র অটল থাকবে যে, যেসব মুসলমান দারুল ইসলামের নাগরিক নয় এবং তার আওতার বাইরে তাদের জান-মাল ইজ্জত-আবরুর দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের নয়।] তার জান-মাল সম্পর্কে সেই বিধান, যা একজন দারুল হরবের অধিবাসীর জন্যে রয়েছে।”-(আহকামুল কুরআন)
(আরবী********)
“কোনো হরবী যদি দারুল হরবে মুসলমান হয় এবং কোনো মুসলমান তাকে স্বেচ্ছায় অথবা ভুল বশত হত্যা করে এবং তার ওয়ারিশগণ দারুল হরবে বর্তমান থাকলেও হত্যাকারীকে কিছুই দিতে হবে না। ভুলবশত হত্যা করে থাকলে শুধু কাফফারা দিবে।”- (হেদায়া)
(আরবী********)
“যে ব্যক্তি দারুল হরবে মুসলমান হয়ে হিজরত করবে না, আবু হানিফা (র)-এর মতে তার মর্যাদা হরবীর ন্যায়। কারণ তাঁর মতে তার মাল অরক্ষিত।”-(বাহরুর রায়েক)
চার: মনে করুন একজন মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে গেল। তারপর সেখানে সে কোনো হরবীর নিকট হতে কর্জ গ্রহণ করলো, অথবা তার মাল আত্মসাত করলো। অতপর সে দারুল ইসলামে প্রত্যাবর্তন করলো এবং উক্ত হরবীও নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে এলো। এখানে ঐ নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হরবী সে কর্জ অথবা আত্মসাত করা মালের জন্যে দারুল ইসলামের আদালতে দাবী করতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রে তাকে এক পয়সাও ফেরত দিতে বলবে না। এরূপ যদি দারুল হরবী মুসলমান থেকে গৃহীত কর্জ মেরে দেয় অথবা তার মাল আত্মসাত করে এবং অতপর সে হরবী নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে আসে, তথাপি ইসলামী আদালত সে হরবীর উক্ত মুসলমানের কোনো প্রতিকার করতে পারবে না। – (জামেউস সাগীর ইমাম মুহাম্মদ)
পাঁচ: পিতা যদি থাকে দারুল ইসলামে এবং তার নাবালেগ সন্তানগণ থাকে দারুল হরবে, তাহলে সেই সন্তানগণের উপর থেকে পিতার অভিভাবকত্ব বিলুপ্ত হবে। এরূপ যদি সম্পদের মালিক থাকে দারুল ইসলামে এবং তার সম্পদ থাকে দারুল হরবে, তাহলে মালিকের জীবন রক্ষিত হবে, কিন্তু সম্পদ রক্ষিত হবে না।-(ফতহুল কাদীর ৪ : ২৫৫)
ছয়: দারুল ইসলামের নাগরিকদের দুজন মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে গিয়ে একজন অপরজনকে হত্যা করলো। অতপর হত্যাকারী দারুল ইসলামে প্রত্যাবর্তন করলে তার থেকে কিসাস নেয়া হবে না। হেদায়ার গ্রন্থকার এর যে কারণ বর্ণনা করেছে তা প্রণিধানযোগ্য:
(আরবী********)
“তার উপর কিসাস এজন্য ওয়াজিব নয় যে, রক্ষনাবেক্ষণ ব্যতিরেকে কিসাস ওয়াজিব হয় না এবং ইমাম ও মুসলিম জামায়াত ব্যতিরেকে রক্ষনাবেক্ষণ হয় না। আর এ ব্যবস্থা দারুল হরবে নেই।”
সাত: দারুল ইসলামের নাগরিকদের দুজন মুসলমান দারুল হরবে বন্দী ছিল। তাদের একজন অপরজনকে হত্যা করলো। অথবা কোনো মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে গিয়ে সেখানে কোনো বন্দী মুসলমানকে হত্যা করলো। উভয় অবস্থাতেই হত্যাকারীর জন্যে কিসাসও নেই, খুনের বিনিময়ও নেই। আল্লামা ইবনে হামাম যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আরো অর্থপূর্ণ।
(আরবী********)
“ইমাম আবু হানিফা (র) – এর মতে হত্যাকারীর জন্যে পার্থিব কোনো বিধান নেই। তবে ভুলবশত হত্যা করলে কাফফারা দিবে। স্বেচ্ছায় হত্যা করলেও কাফফারা দিতে হবে না, তবে আখিরাতে শাস্তির যোগ্য হবে। —- কিসাস ও রক্তের বিনিময় প্রযোজ্য না হবার কারণ এই যে, বন্দী হবার জন্যে সে আইনে হরবের অধীন হয়েছে। ————- তার অবস্থা সেই মুসলমানের মতই হয়েছে যে আমাদের রাষ্ট্রে হিজরত করেনি। এ কারনে তার পার্থিব রক্ষণ-ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে।” – (ফতহুল কাদীর ৪র্থ খ: পৃ: ৪৫১)
এ দৃষ্টান্তগুলোর দ্বারা বিশ্বাসমূলক আইন এবং শাসনতান্ত্রিক আইনের পার্থক্য কতখানি সুস্পষ্ট হয়েছে তা লক্ষ্য করুন। বিশ্বাসমূলক আইন মুসলমানদেরকে এক জাতি এবং কাফেরদেরকে অন্য জাতি গণ্য করে। তার দাবী এই যে, মুসলমানদের জান-মাল ইজ্জত কাফেরদের জান-মাল ইজ্জতের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক আইন এ বিশ্বজনীন বিভাগের পরিবর্তে নিজের শাসনের গন্ডিকে (JURISDICTION) ভৌগলিক গন্ডিতে (TERRITORIAL LIMITS) সীমিত করে। ইসলামী রাষ্ট্রের গন্ডির মধ্যে অবস্থিত জান-মাল ইত্যাদি ‘রক্ষিত’ তা মুসলমানের হোক অথবা অমুসলমানের। কারণ রাষ্ট্রীয় আইন তার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ সীমারেখার বাইরে যা কিছু আছে তা ‘অরক্ষিত’, তা মুসলমানের হোক বা অমুসলমানের। ইসলামী রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে কেউ চুরি করলে তার হাত কেটে দেয়া হবে, হত্যা করলে কিসাস অথবা রক্তপণ আদায় করা হবে। অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করলে তা ফেরত দেওয়ানো হবে। আর এ সীমারেখার বাইরে কোনো মুসলমান অথবা জিম্মি এসব কাজ করলে তা আমাদের আইনে অপরাধ বিবেচিত হলেও অপর অঞ্চলে আমরা তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি না, এমন কি আমাদের অঞ্চলে ফিরে এলেও। কারন অপরাধ এমন এক অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে যেখানকার নিরাপত্তা ও রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব আমাদের নয়। কিন্তু এ যা কিছু তাহলো পার্থিব দিক দিয়ে। ইসলামী সীমারেখার বাইরে যে গোনাহ করা হবে তা, পার্থিব শাসন সীমার বাইরে হবার কারনে পার্থিব শাস্তিযোগ্য হবে না; কিন্তু আল্লাহর নিকট শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না। কারণ আল্লাহর শাসন সীমারেখা ভৌগলিক সীমারেখার ঊর্ধে (ULTRA TERRITORIAL)। তিনি যা কিছু হারাম করেছেন তা সর্বত্রই হারাম।
এ ইমাম আবু হানিফা (র) -এর স্বকপোলকম্পিত আইন নয়। বরঞ্চ তা কুরআন-হাদীস থেকেই গৃহীত। কুরআন একদিকে যেমন বলে:
(আরবী********)
“যদি তারা নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই হয়ে যায়” এবং
(আরবী********)
“এবং যে স্বেচ্ছায় কোনো মুমেনকে হত্যা করে তার শাস্তি হচ্ছে চিরন্তনের জাহান্নাম,” অপর দিকে সেই কুরআনই ইসলামী সীমারেখার মধ্যে অবস্থানকারী মুসলমান এবং অপর অঞ্চলে অবস্থানকারী মুসলমানের মধ্যে পার্থক্যও বলে দেয়। উল্লিখিত প্রথম ধরনের স্বেচ্ছায় হত্যাকারীদের জন্যে কাফফারাও আছে, রক্তপণও আছে। আর দ্বিতীয় ধরনের হত্যাকারীদের জন্যে শুধু কাফফারা।১ [১. ********* আরবী ******** -এর অর্থ এই যে, অমুসলিম এলাকায় অবস্থানকারী মুসলমান যদি এমন এক দলভুক্ত হয়, যাদের সাথে রক্তপণ সম্পর্কে মুসলমানদের চুক্তি হয়েছে, তাহলে যেভাবে সে দলের একজন অমুসলিমের রক্তপণ দেয়া হবে। সেভাবে তার একজন মুসলমানেরও দেয়া হবে। অতএব এ রক্তপণ চুক্তির ভিত্তিতে, ইসলামী রক্ষণ-ব্যবস্থার ভিত্তিতে নয়।-(সুরা অন নিসা: ১৩ রুকু দ্রষ্টব্য)]
নবী করীম (স) উসমা ইবনে জায়েদকে একটি অভিযানের অধিনায়ক করে ‘হারাকাত’ অভিমুখে পাঠান। সেখানে একজন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করে আত্মরক্ষা করতে চাইলো কিন্তু মুসলমানগণ তাকে হত্যা করলো। একথা নবী করীম (স) জানতে পেরে উসামাকে বার বার বলেন: আরবী *********** (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর মুকাবেলায় কিয়ামতে তোমাকে কোন জিনিস রক্ষা করবে?) কিন্তু এ নিহত ব্যক্তির রক্তপণ আদায় করার হুকুম দেননি।২ [২. আবু দাউদ অধ্যায়: আরবী *************] এমনিভাবে অপর এক ঘটনায় ইসলামী গন্ডির বাইরে অবস্থানকারী কিছু মুসলমানকে হত্যা করা হলে নবী করীম (স) বলেন:
(আরবী********)
যেসব মুসলমান মুশরেকদের মধ্যে বাস করে তাদের কোনো দায়িত্ব আমার উপর নেই।১ [১. আবু দাউদ কিতাবুল জিহাদ উক্ত অধ্যায়।
এ দ্বিতীয় ঘটনায় নবী করীম (স) হত্যাকারীদের অর্ধেক রক্তপণ দেওয়ান। সম্ভবত তাঁর এ সিদ্ধান্ত ওই আয়াত নাজিলের পূর্বেকার যাতে নিহত ব্যক্তির রক্তপণ বাতিল করা হয়েছিল।] কুরআনও এ ধরনের মুসলমানদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবার ঘোষণা করেছে:
(আরবী********)
“এবং যারা ঈমান এনেছে বটে, কিন্তু হিজরত করে দারুল ইসলামে আসেনি তাদের উপর তোমাদের অভিভাবকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই যতক্ষণ না তারা হিজরত করে এসে যায়।” ২ – (সুরা আনফাল:৭২) [২. এ আয়াতটি ইসলামের শাসনতান্ত্রিক আইনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এতে এ মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘অভিভাবকত্বের’ সম্পর্ক শুধু সেসব মুসলমানদের সাথে হবে যারা দারুল ইসলামের অধিবাসী অথবা বাইরে থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে এসেছে। এখন রইলো ঐসব মুসলমান যারা দারুল ইসলামের বাইরে বাস করে অথবা দারুল ইসলামে এলেও হিজরত করে নয়–দারুল কুফরের নাগরিক হিসেবে — তাদের এবং দারুল ইসলামবাসীর মধ্যে অভিভাবকত্বের কোনই সম্পর্ক নেই। ***** আরবী ******* শব্দটি আরবি ভাষায় সমর্থন-সহানুভুতি, সাহায্য, পৃষ্ঠপোষকতা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা অভিভাবকত্ব এবং অনুরূপ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ আয়াতের পূর্বাপর প্রসঙ্গে সুস্পষ্টরূপে সে সম্পর্কই বুঝানো হয়েছে, যা কোনো রাষ্ট্রের স্বীয় নাগরিকদের সাথে, নাগরিকদের তাদের রাষ্ট্রের সাথে এবং নাগরিকদের পরস্পরের সাথে হয়ে থাকে। অতএব এ আয়াত দারুল ইসলাম বহির্ভূত মুসলমানদেরকে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সত্বেও সে রাজনৈতিক ও তামাদ্দুনিক সম্পর্ক থেকে ছিন্ন করে দিছে। এর থেকে ব্যাপক আইনগত সূত্র বা সিদ্ধান্ত আবিষ্কৃত হয়। ফিকাহর বিস্তারিত গ্রন্থসমূহে তা পাওয়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, এ অভিভাবকত্বহীনতার কারণেই দারুল ইসলাম এবং দারুল কুফরের মুসলমান পরস্পর বিয়ে-শাদী করতে পারে না। একে অপরের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। একে অপরের আইনগত অলী (GURDIAN) হতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্র কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে এমন কোনো মুসলমানকে নিয়োগ করতে পারে না, যে দারুল কুফরের সাথে তার নাগরিকত্ব ছিন্ন করেনি।]
এভাবে স্বয়ং কুরআন ও হাদীস পার্থিব রক্ষণ-ব্যবস্থাকে পারলৌকিক রক্ষণ-ব্যবস্থা থেকে পৃথক করে দিয়েছে এবং উভয়ের সীমারেখা বলে দিয়েছে। সকল ইসলামী শাস্ত্রবিদগণের মধ্যে শুধুমাত্র ইমাম আবু হানিফা (র)-ই এ নাজুক এবং জটিল আইন সম্পর্কিত বিষয়টিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ খ্যাতনামা মুজতাহিদগণও এ দু ধরনের রক্ষণ-
ব্যবস্থার মধ্যে পুরোপুরি পার্থক্য করতে পারেননি। ধরুন, যদি দারুল কুফরে মুসলিম নাগরিকদের একজন অন্য একজনকে খুন করে, তাহলে এসব ইমামগণের মতে খুনীর নিকট থেকে কিসাস গ্রহণ করা হবে। কারণ সে এমন এক ব্যক্তিকে খুন করেছে যে ছিল ইসলামে রক্ষিত।১ [১. জামেউস সগীর ও ফতোয়া–কাযী খান দ্রষ্টব্য।] অতএব এত বড় বড় ইমামগণ যখন এ মাসলায় বিভ্রান্ত হয়েছে, তখন অসম্ভব নয় যে, হানাফী ফেকাহর পরবর্তীকালের ব্যাখ্যাকারীগণও ইমাম আবু হানিফা (র) এর কথা বুঝতে ভুল করে থাকবেন।
দারুল হরব ও দারুল কুফরের পারিভাষিক পার্থক্য
ইমাম আযম সম্পর্কে প্রামাণ্য সূত্রে জানতে পেরেছি যে, উপরে যতগুলো বিষয় বর্ণিত হয়েছে তাতে এবং এ ধরনের অন্যান্য বিষয়ে তিনি দারুল হরবের পরিবর্তে দারুল কুফরের পরিভাষাই ব্যবহার করেছেন। কারণ শাসনতান্ত্রিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে দারুল ইসলামের প্রতিপক্ষ, অমুসলিম এলাকা বা বৈদেশিক এলাকা (FOREIGN TERRITORY) অর্থে দারুল কুফরই হতে পারে। হরব ও গায়ের হরবের এখানে কোনো কথাই নেই। যেসব দেশ ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সন্ধিসুত্রে আবদ্ধ তারাও দারুল কুফর। উপরে যেসব বিধান বর্ণিত হয়েছে তা এসব দেশের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু যেহেতু ইসলামের প্রাথমিক শতাব্দীগুলোতে ইসলামী রাষ্ট্রের সন্নিহিত সকল দারুল কুফর সাধারণত দারুল হরবই থাকত, সে জন্যে পরবর্তী ফকীহগণ দারুল কুফরকে একেবারে দারুল হরবের সমার্থবোধক মনে করেন এবং এ দুটো পরিভাষার সুক্ষ্ম আইনগত পার্থক্য উপেক্ষা করে বসেন। এভাবে ইমাম আবু হানিফা (র)-এর কথায় কোথাও আমরা এমন কোনো শব্দ পাইনি যার থেকে প্রমান হয় যে, তিনি ‘অরক্ষিতকে’ বৈধ অর্থে গ্রহণ করেছেন। তিনি ইসলামী সীমারেখার বহির্ভূত বস্তুগুলোকে অরক্ষিত বলাই যথেষ্ট মনে করতেন। এসব বস্তুসমূহের উপর হস্তক্ষেপকারীদের জন্যে শুধু এতটুকু বলতেন ***** আরবী ****** অথবা ******* আরবী ****** ইত্যাদি। অর্থাৎ তাকে অভিযুক্ত করা হবে না অথবা তার বিরুদ্ধে আদালতে কোনো বিচার করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালের ফকীহগণ অধিকাংশ স্থলে ‘অরক্ষিত হওয়া’ এবং বৈধতাকে একত্রে মিশ্রিত করে ফেলেছেন। তার ফলে এ ভুল ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ইসলামী সীমারেখার বাইরে যতই নিষিদ্ধ ও অবৈধ কাজ করা হোক, সরকার যেমন তার জন্যে অভিযুক্ত করবে না, আল্লাহতায়ালাও ধরবেন না। অথচ এ দুটো জিনিস কিন্তু একেবারে আলাদা। আপনি ভারতে কারো মাল চুরি করুন, তারপর এটা ঠিক যে আফগানিস্তানের আদালতে আপনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে না। দারুল ইসলামের আইনে আপনি দায়িত্বমুক্ত। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে, আল্লাহর আদালতেও আপনি বেঁচে যাবেন?
এখন আপনি বুঝতে পারেন যে, ফেকাহর বইগুলোতে দারুল হরবে সুদ, জুয়া এবং অন্যান্য অবৈধ চুক্তি এজন্য বৈধ করা হয়েছে যে, হরবীর জন্য রক্ষণ ব্যবস্থা (PROTECTION) নেই। এর দুটো দিক আছেঃ
একটি এই যে, ‘দারুল হরব’ অর্থে শুধু অমুসলিম এলাকা বুঝাবে। এ দিক দিয়ে এ বিষয়টি শাসনতান্ত্রিক আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট। তার ধরন এই যে, হরবীর (অমুসলিম এলাকার নাগরিক এ অর্থে) ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যেহেতু আমরা গ্রহণ করিনি, সে জন্য আমাদের কর্মসীমার বাইরে আমাদের রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যদি সে হরবীর কাছ থেকে সুদ গ্রহণ করে অথবা জুয়া খেলে কিংবা অন্য কোনো অবৈধ পন্থায় সম্পদ লাভ করে আমাদের এলাকায় এসে যায়, তাহলে আমরা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করবো না, দ্বীন ও আকীদাহ- বিশ্বাসের দিক দিয়ে সে অপরাধী হোক বা না হোক।
দ্বিতীয়টি এই যে, দারুল হরব বলতে এমন এক দেশ বুঝাবে যার সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ চলছে অর্থাৎ শত্রু দেশ(ENEMY COUNTRY)। এ দিক দিয়ে এ বিষয়টি বৈদেশিক সম্পর্কের আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট যার বিবরণ সামনে দেওয়া হচ্ছে।
বৈদেশিক সম্পর্কের আইন
ইসলামী আইনের এ শাখা এমন সব লোকের জান-মালের আইনগত আলোচনা করে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমারেখার বাইরে অবস্থান করে। এর বিশদ আলোচনার পূর্বে কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
ফেকাহের পরিভাষায় *** শব্দটি প্রায় ইংরেজী (TERRITORY) শব্দের অর্থে ব্যবহার করা হয়। যে ভূখন্ডে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে বলে দারুল ইসলাম। যেসব এলাকা এর সীমারেখার বাইরে হয়, তাকে বলা হয় দারুল কুফর অথবা দারুল হরব। বৈদেশিক সম্পর্কের আইন পুরোপুরি সেসব সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে, যা ভৌগলিক পার্থক্য অথবা উভয়বিধ রাষ্ট্রের বিভিন্নতার কারণে মানুষের জান-মাল সম্পর্কে উদ্ভূত হয়।
আমি পূর্বেই বলেছি যে, বিশ্বাসের দিক দিয়ে তো সকল মুসলমান ইসলামী জাতীয়তার নাগরিক। কিন্তু আইনের এ শাখার উদ্দেশ্যে তাদেরকে তিন শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এক, যারা দারুল ইসলামের নাগরিক। দুই, যারা দারুল কুফর অথবা দারুল হরবের নাগরিক। তিন, নাগরিক তো দারুল ইসলামের। কিন্তু নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হিসেবে সাময়িকভাবে দারুল কুফর অথবা দারুল হরবে গিয়ে তথাকার বাসিন্দা হয়। এদের অধিকার ও দায়িত্ব পৃথক পৃথক নির্ধারণ করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে কাফের যদিও সকলেই বিশ্বাসের দিক দিয়ে ইসলামী জাতীয়তা বহির্ভূত, তথাপি আইনের দিক দিয়ে তাদেরকেও অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়েছে।
একঃ যারা জন্মগতভাবে জিম্মী-(NATURAL BORN SUBJECTS) অথবা জিজিয়া ধার্য করার পরে জিম্মি করা হয়েছে (NATVRAL LISED SUBJECTS)।
দুইঃ যারা দারুল ইসলামের নাগরিক নয়। নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে এসে বসবাস করে-(DOMICILED ALICEN)।
তিনঃ যারা দারুল কুফর অথবা দারুল হরবের নাগরিক। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যতিরেকেই দারুল ইসলামে প্রবেশ করে।
চারঃ যারা আপন আপন রাষ্ট্রেই বসবাস করে। এ চতুর্থ শ্রেনীর অমুসলমানগণেরও আবার কয়েক শ্রেণী আছে।
(ক) যাদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তিও নেই, শত্রুতাও নেই।
(খ) যাদের সাথে মুসলমানদের শত্রুতা আছে।
এভাবে ভূখন্ডের (TERRITORY) সীমারেখার দিক দিয়ে মানুষ এবং সম্পদের মর্যাদায় যে পার্থক্য, তদনুযায়ী তাদের মধ্যে বিধানেরও পার্থক্য অনিবার্য। তাকে সামনে রেখেই ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা অত্যন্ত প্রয়োজন। এসব পার্থক্যের প্রতি লক্ষ্য না রেখে যদি শুধুমাত্র আইনের ভাষাগত শব্দের অনুসরণ করা হয়, তাহলে শুধু সুদের বিষয়েই নয় অধিকাংশ ফেকাহর মাসলায় এমন সব ভুল হয়ে পড়বে যার ফলে আইন বিকৃত হয়ে পড়বে এবং আপন উদ্দেশ্যের বিপরীত তা ব্যবহৃত হতে থাকবে।
এ প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যার পর, আমরা ঐসব প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দিতে চাই যে, দারুল ইসলাম প্রকৃতপক্ষে কোন এলাকাকে বলা হবে, তাঁর শ্রেণী বিন্যাস কিরূপ এবং প্রত্যেক শ্রেণীর জন্যে কিরূপ বিধান হবে। হরবীদের শ্রেণী কত এবং শ্রেণী হিসেবে জীবন ও ধন-সম্পদের ধরনটাও কিভাবে বদলে যায়।