পরিশিষ্ট: এক
বাণিজ্যিক ঋণ বৈধ কিনা?
(পাকিস্তান সরকারের ভূতপূর্ব অডিটর জেনারেল জনাব সাইয়েদ ইয়াকুব শাহ এবং গ্রন্থাকারের মধ্যে এ সম্পর্কে পত্র বিনিময়ের বিবরণ।)
প্রথম পত্র
প্রশ্ন: আমি আপনার সুদ গ্রন্থখানি মনোযোগ সহকারে পড়েছি। পড়ার পর আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে এবং বহু চেষ্টা করেও তার কোনো সন্তোষজনক জবাব খুঁজে পাইনি, তাই আপনাকে বিরক্ত করছি। আশাকরি দয়া করে আপনি আমার প্রশ্নগুলো সমাধান করে দেবেন।
এক: আপনি আপনার গ্রন্থের প্রথম খন্ডে (উর্দূ ৩য় সংস্করণ পৃঃ ৩৫) প্রাক ইসলামী যুগের সুদের যে দৃষ্টান্তগুলো দিয়েছেন, তা থেকে সে যুগে ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণ করা হতো কিনা, একথা সুস্পষ্ট হয় না। আমি যতটা জানতে পেরেছি অন্তত ইউরোপে ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণের রীতি অনেক পরে শুরু হয়েছে। এর পূর্বে ব্যবসা করা হতো ব্যক্তিগত পুঁজি দিয়ে অথবা কার্যকরী অংশীদার (WORKING PARTNER) হিসেবে। আপনি কি এমন কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থের নাম উল্লেখ করতে পারেন, যার থেকে আরবে তৎকালে ব্যবসা সংক্রান্ত সুদ প্রচলিত ছিল কিনা তা জানা যেতে পারে?
দুই: এ খন্ডেরই উর্দূ ১৬৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, ****** -এর হাদীসগুলো সুদ নিষিদ্ধকারী কুরআনের আয়াত (সূরা আল বাকারা ) নাযিল হওয়ার পূর্বে বর্ণিত। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত করা কি সঙ্গত হবে যে, ****** কুরআনে বর্ণিত হারাম ও শাস্তির লক্ষ্য নয়? অথবা স্যার সাইয়েদ আহমদের ভাষায় এই যে, প্রকৃতপক্ষে অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপার এবং এটা ঐ সুদের ব্যাখ্যার মধ্যে শামিল নয়, যার উল্লেখ উপরোক্ত আয়াতে রয়েছে?
আশাকরি এ সবের জবাব দানে কৃতার্থ করবেন।
জবাব
অবশ্য একথা কোনো গ্রন্থে বিশদভাবে তো বলা হয়নি যে, আরবের প্রাগ ইসলামী যুগে ব্যবসায়ে সুদ প্রচলিত ছিল। কিন্তু একথা উল্লেখিত অবশ্যিই আছে যে, মদীনার কৃষিজীবী লোক ইয়াহুদী পুঁজিপতিদের নিকট থেকে সুদী ঋণ গ্রহণ করতো। ইয়াহুদীদের মধ্যেও পারস্পরিক সুদী লেনদেন প্রচলিত ছিল। উপরন্তু কুরাইশগণ – যাদের পেশা ছিল প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্য সুদী লেনদেন করতো শুধুমাত্র অভাবী লোকদেরই প্রয়োজন পূরণের জন্যে অনিবার্যরূপে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজন হতো না, বরঞ্চ কৃষিজীবী লোকদেরকেও তাদের কৃষি কাজের জন্যে এবং ব্যবসায়ীগণের ব্যবসার জন্যে এর প্রয়োজন হতো। আর এটা কোনো নতুন পদ্ধতি নয়, বরঞ্চ আবহমানকাল থেকে এ চলে আসছে। এ প্রথাটি ক্রমোন্নতির ভেতর দিয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। প্রাচীন প্রথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত লেনদেনের মধ্যে সীমিত। আধুনিক প্রথার পার্থক্য এই হয়েছে যে, ঋণ দ্বারা বৃহৎ আকারে মূলধন জমা করে তা ব্যবসায় বিনিয়োগ করার প্রথা প্রবর্তিত হয়েছে।
****** সংক্রান্ত হাদীসসমূহ সূরা আল বাকারায় সুদ নিষিদ্ধকারী আয়াত নাযিল হবার পূর্বেকার তা বটেই। কিন্তু তা সূরা আলে ইমরানের আয়াতের পরবর্তীকালের। সূরা আলে ইমরানের আয়াতে কুরআনের এ উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করে দেয় যে, সুদ একটি অন্যায়-অনাচার যার উচ্ছেদ বাঞ্ছনীয়। নবী করীম (স) এজন্য পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক ব্যাপারে এমন সব সংস্কার সাধন করেছিলেন, যার নামকরণ করা হয় ****। এসব হাদীসে সুস্পষ্টরূপে ’রিবা’ (সুদ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং নিষিদ্ধকরণের শব্দাবলী স্বয়ং হারাম ঘোষণা করার কথাই বুঝায়। অবশ্যি এটা ঠিক যে, কুরআনে যে সুদ হারাম করার কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে ঋণ সংক্রান্ত সুদ, হাতে হাতে লেনদেনের সুদ নয়। ফকীহগণ এ ব্যাখ্যাও করেছেন যে, **** ঠিকই সুদ নয় যা কুরআনে হারাম করা হয়েছে। বরঞ্চ প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে সুদের মূলোচ্ছেদ করার জন্যে পূর্ব প্রস্তুতি মাত্র।
দ্বিতীয় পত্র
প্রশ্ন: আপনি যেমন বিশদভাবে আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, তাতে পুনর্বার আপনাকে বিরক্ত করার সাহস পাচ্ছি।
কুরআন মজীদে সুদ সম্পর্কে যেমন কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে, এমনটি সম্ভবত অন্য কোনো পাপ কাজের জন্যে বলা হয়নি। এজন্য আমার ক্ষুদ্র ধারণামতে আলেমদের উচিত এ ব্যাপারে কিয়াস করে কোনো সিদ্ধান্ত না করা এবং সুদের কোনো প্রকার সম্পর্কে যতক্ষণ না তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, নবীর যমানায় তা প্রচলিত ছিল, ততক্ষণ তাকে রিবার মধ্যে শামিল না করা। আপনার পত্রে একথা জানতে পারা যায় যে, আপনি ব্যবসায় ক্ষেত্রে সুদের বিদ্যমান থাকার কিয়াস নিম্নের কারণগুলোর ভিত্তিতে করেছেন :
এক: মদীনায় কৃষিজীবী লোকেরা ইয়াহুদী পুঁজিপতিদের নিকট থেকে সুদে ঋণ গ্রহণ করতো। আমার বিনীত নিবেদন এই যে, এ ধরনের ঋণকে বাণিজ্যিক ঋণ বলা ঠিক হবে না। এ ধরনের ঋণ অভাবগ্রস্ত লোকেরাই গ্রহণ করতো। কৃষির জন্যে বাণিজ্যিক ঋণ আধুনিক যুগের উদ্ভাবন। যখন থেকে বৃহৎ আকারে কৃষি এবং তার জন্যে যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়, তখন থেকে বড় বড় জমির মালিকগণ বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। প্রাচীনযুগে কৃষিজীবী লোকদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণ গ্রহণ করতে হতো এবং তা গ্রহণ করতো প্রয়োজন পূরণের জন্যে।
দুই: স্বয়ং ইয়াহুদীদের মধ্যেও পারস্পরিক সুদী লেনদেন হতো, তা থেকে একথা বলা যায় না যে, তাদের এ ঋণ ব্যবসার জন্যে নেয়া হতো। আরবের ইয়াহুদীরা ছিল অধিকাংশ কৃষিজীবী অথবা সুদী মহাজন। যেমন, ইউরোপেও বহুকাল যাবৎ তাই ছিল। সম্ভবত আরবের ইয়াহুদী সুদী মহাজনেরা গরীব-ধনী নির্বিশেষে উভয় শ্রেণীর লোকেরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কারণে টাকা ঋণ দিয়ে তাদের সুদী ব্যবসা চালাতো।
তিন: কুরাইশগণ অধিকাংশ ব্যবসাজীবী ছিল এবং তারাও পরস্পর সুদী লেনদেন করতো। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য এই যে, কুরাইশদের মধ্যে সুদী লেনদেনের যে দৃষ্টান্ত আমার নজরে পড়েছে, তার থেকে একথা সুস্পষ্ট করে বলা যায় না যে, আলোচ্য ঋণ তারা ব্যবসার জন্যে গ্রহণ করতো। এমন কোনো দৃষ্টান্ত যদি আপনার জানা থাকে, তাহলে দয়া করে আমাকে অবহিত করবেন। তৎকালে ব্যবসা ব্যক্তিগত পুঁজিতে অথবা কার্যকরী অংশীদার হিসেবে করা হতো। কুরাইশরা যে ব্যবসায়ী কাফেলা বাইরে পাঠাতো তাতে সব রকম লোক অংশ গ্রহণ করতে পারতো। বলা হয় যে, এক দীনার, অর্ধ দীনার দিয়েও শামিল হওয়া যেতো, বলাবাহুল্য এ ধরনের ব্যবসার জন্যে ঋণ করার কোনো দরকারই হবার কথা নয়। যেমন আমি বলেছি যে, ব্যবসা সংক্রান্ত ঋণ ইউরোপে বহু পরে প্রচলিত হয় এবং পঞ্চম ও দশম শতাব্দীর মধ্যে এর প্রচলন সেখানে ছিল না। অবশ্যি এ অবস্থা যে আরবেও ছিল তা এর থেকে বলা যায় না। কিন্তু আমি প্রয়োজন বোধ করছি যে, আরবে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সুদ বিদ্যমান ছিল – একথা মেনে নেয়ার পূর্বে এ বিষয়ে ভালো করেই যাঁচাই করা দরকার। আরব এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ নবীর যমানার অবস্থার বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। ব্যবসা সংক্রান্ত সুদ সম্পর্কে তাদের নীরবতার দ্বারা এটা কি অনুমান করা যায় না যে, সে সময়ে এ ধরনের সুদের মোটেই প্রচলন ছিল না? বিশেষ করে ব্যবসা পদ্ধতি যখন এরূপ ছিল যে, তাতে সর্ব শ্রেণীর আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন লোক শামিল হতে পারতো।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সূরা আল বাকারা ১৭৬-১৭৭ আয়াতের ব্যাখ্যা হয়তো আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তিনি ’রিবা’ অর্থে সেই সুদ বুঝিয়েছেন যা কোনো অভাবগ্রস্ত লোকের নিকট থেকে নেয়া হয়। আলেমগণ এবং মুফাসসিরগণের আর কেউ কি এ অর্থ গ্রহণ করেছেন? যদি এ অর্থের সাথে অন্যান্য বুজর্গানে দ্বীন একমত হন তাহলে একটি বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধানই হয়ে যায়।
জবাব
আমি আপনার এ ধারণার সাথে একমত যে, কুরআনে যে বিষয়ের হারাম হওয়া সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা করা হয়নি, তাকে ঠিক ঐ বিষয়ের পর্যায়ভুক্ত করা উচিত হবে না, যার হারাম হওয়া সম্পর্কে কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে। কিন্তু সুদের ব্যাপারে আপনি এ নীতির প্রয়োগ যেভাবে করেছেন, তা আমার মতে সঠিক নয়। আপনার প্রমাণের বুনিয়াদ দুটো জিনিসের উপর। প্রথম হচ্ছে এই যে, ঋণ সম্পর্কিত সুদের অর্থ তাই গ্রহণ করতে হবে যা নবীর যমানায় প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয়, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সুদ যেহেতু তখন প্রচলিত ছিল না এবং দরিদ্র অভাবগ্রস্ত লোকেই সুদে ঋণ গ্রহণ করতো, সে জন্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর সুদই কুরআনে বর্ণিত হারাম সুদের পর্যায়ে পড়ে এবং প্রথমটি হারাম বহির্ভূত। আপনার এ দুটো সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। প্রথমটি ভুল হবার কারণ এই যে, কুরআন শুধুমাত্র ঐসব বিষয়েরই নির্দেশ দিতে আসেনি, যা কুরআন নাযিলের সময় আরবে তথা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে প্রচলিত ছিল। বরঞ্চ কুরআন এসেছিল এমন সব মূলনীতি বর্ণনা করার জন্যে, যা কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভাব্য সকল ব্যাপারে বৈধ-অবৈধ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করতে পার। যদি একথা স্বীকার করা না হয়, তাহলে কুরআনের শাশ্বত ও বিশ্বজনীন পথ প্রদর্শক হবার কোনো অর্থই হয় না। অধিকন্তু ব্যাপার শুধু সুদ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না। এক ব্যক্তি এহেন অবস্থায় বলতে পারে, কুরআন যে পানীয় হারাম ঘোষণা করে, তার থেকে পানীয় বস্তুর শুধু সেই প্রকারই বুঝতে হবে, যা সে সময়ে আরবে তৈরী হতো। কুরআন যে চুরি হারাম ঘোষণা করে তাহলো ঠিক ঐ পন্থায় চুরি করা যা তখন আরবে ব্যবহৃত হতো। প্রকৃতপক্ষে যা হারাম করা হয়েছে তাহলো পানীয় (শরাব) এবং চুরি কার্যের মূল বিষয়টি তৎকালে প্রচলিত, তার প্রকার ও পদ্ধতি নয়। এভাবে মূলবস্তু সুদ হারাম করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে এই যে, ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার নিকট হতে আসলের উপরে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করার শর্ত আরোপ করে। এ অতিরিক্ত গ্রহণের শর্তটি যে কোনো প্রকার ঋণের সাথে থাকুক না কেনো, তার উপরে কুরআনের নিষিদ্ধকরণ নির্দেশ প্রযোজ্য হবে। কুরআন মূল সুদ বস্তুটিকে হারাম করেছে এবং কোথাও একথা বলা হয়নি যে, কোনো ব্যক্তি দারিদ্র ও অভাবের জন্যে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করলে তার নিকট সুদ গ্রহণ করা হারাম।
আপনার দ্বিতীয় যুক্তিটি এজন্য ঠিক নয় যে, প্রথমত, বানিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের শুধু এ ধরনটাই আধুনিক যে, ব্যবসার জন্যে প্রাথমিক পুঁজি ঋণের মাধ্যমে জমা করা হয়। নতুবা ব্যবসা চলাকালীন ব্যবসায়ীদের পারষ্পারিক ঋণের লেনদেন অথবা সুদী মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করে কোনো ব্যবসা সংক্রান্ত প্রয়োজন পূরণ করার প্রচলন তো অবহমান কাল থেকে সারা দুনিয়ায় ছিল এবং তা যে আধুনিক উদ্ভাবন বলে কোনো নজীর খুঁজে পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্যে অব্যবসায়সূলভ ঋণ গ্রহণের এ একটি মাত্র পন্থাই ছিল যে, কেউ চিকিৎসার জন্যে ঔষধ-পত্রের প্রয়োজনবোধ করলো অথবা ক্ষুধানিবৃত্তির জন্যে তার চাল-ডালের দরকার হলো এবং এর জন্যে কোনো অবস্হাপন্ন লোকের নিকট থেকে কিছু টাকা ঋণ করলো, এছাড়া আরও অনেক পরিস্থিতি এমন দেখা যায় যে, অভাব না থাকা সত্ত্বেও মানুষ ঋণ করে নিজের প্রয়োজন মেটায়। যেমন ধরুন ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদীতে খরচ করবে অথবা বাড়ীঘর তৈরী করবে। এ ধরনের ঋণ গ্রহণ সব দেশে সব যুগেই হয়ে থাকে। ঋণ গ্রহণের এরুপ বিভিন্ন পন্থার মধ্যে আপনি কোন্ কোন্টিকে সুদ হারাম করার আওতাবহির্ভূত রাখবেন এবং কোন্ কোন্টিকে হারামের মধ্যে শামিল করবেন? এর জন্যে কোন্ মূলনীতিইবা অবলম্বন করবেন? আর কুরআনের কোন্ শব্দাবলীর দ্বারা এ মূলনীতি নির্ধারণ করবেন?
জাহেলিয়াতের যুগ অথবা ইসলামের প্রাথমিক যুগের ব্যবসা সংক্রান্ত রীতি-পদ্ধতিতে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদ এবং বানিজ্যের বাইরের সুদের বিশদ বর্ণনা পাওয়া না যাবার কারন হচ্ছে এই যে, ঐ সময়ে এ পার্থক্য করণের কোনো ধারণাই বিদ্যমান ছিল না এবং এ ধরনের কোনো পরিভাষাও সৃষ্টি হয়নি। সে সময়ের লোকের দৃষ্টিতে ঋণ বলতে সব ধরনের ঋণই বুঝাতো। তা সে ঋণ অভাবগ্রস্থ গ্রহণ করুক অথবা ধনী, ব্যক্তিগত প্রয়োজন অথবা ব্যবসার জন্যে। এজন্য তারা শুধুমাত্র ঋণের ব্যাপারটি এবং তার জন্যে সুদের লেনদেনের কথাই বলতো। তার বিশদ ব্যাখ্যায় তারা যেতো না।
মাওলানা আজাদের আসল উদ্দেশ্য তা ছিল না, যা আপনি বুঝে নিয়েছেন। তিনি তাঁর ব্যাখ্যায় একথাই সুষ্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন যে, নৈতিক দিক দিয়ে সুদ কতখানি মারাত্মক। কিন্তু তাঁর কথার অভিপ্রায়ের ধারা একথা প্রকাশ পায় না যে, সুদ বলতে শুধুমাত্র সেই সুদ যা আদায় করা হয় কোনো অভাবী ব্যক্তিকে তার অভাব পূরণের জন্যে টাকা ঋণ দিয়ে।
মাওলানা আজাদের ব্যাখ্যার যে মর্ম আপনি গ্রহণ করছেন, তা কুরআনের বক্তব্যেও অতিরিক্ত এবং সুদ নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত কুরআনের এ নির্দেশ অভাবগ্রস্থের জন্যে প্রযোজ্য। একথা মুফাসসির ও ফকীহগণের মধ্যে কেউ বলেননি।
এ ব্যাপারে ভালো হতো, যদি আপনি আমার তাফসীর ‘তাফহীমুল কুরআন’ (সূরা আল বাকারা টীকা ৩১৫-৩২৪) পড়ে দেখতেন।–(তর্জুমানুল কুরআন জমাদিউল উখ্রা : ১৩৭৬ হি:, মার্চ ১৯৫৭)
তৃতীয় পত্র
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন যে, আমার প্রমাণের ভিত্তি দুটো। প্রথম এই যে, ‘রিবা’ বলতে ঋণের সেই পন্থা বুঝতে হবে, যা ছিল নবীন যামানায় প্রচলিত। দ্বিতীয় হচ্ছে এই যে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের প্রচলন যেহেতু সে সময়ে ছিল না সে জন্যে এ ধরনের ‘রিবা’ (সুদ) কুরআনের নিষিদ্ধকরণের (হারাম) আওতায় পড়ে না। আপনি আমার দুটি যুক্তি সঠিক মনে করেন না। কিন্তু একথা আসে আপনার সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং (উর্দূ) গ্রন্থের ৩৪-৩৫ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আলোচনা থেকে। আপনি বলেছেন, “কুরআন যে বাড়তি প্রাপ্য হারাম বলে, তা এক বিশেষ ধরনের বাড়তি। এজন্য কুরআন তাকে ‘রিবা’ বলে অভিহিত করেছে। আরববাসীদের ভাষায় ইসলামের পূর্বেও লেনদেনের একটা বিশেষ ধরনকেও এ পারিভাষিক নামে স্মরণ করা হতো। ——-এবং যেহেতু ‘রিবা’ একটা বিশেষ ধরনের বাড়তির (অতিরিক্ত প্রাপ্য) নাম ছিল এবং তা ছিল সর্বজন পরিচিত, সে জন্যে কুরআন মজীদে তার কোনো বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।————-”
তারপর কিছু ঐতিহ্যের উল্লেখ করে জাহেলিয়াতের যুগের সুদের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তারপর লিখেছেন, “ব্যবসা-বানিজ্যের এসব পদ্ধতি আরবে প্রচলিত ছিল। এসবকে আরববাসী তাদের ভাষায় বলতো ‘রিবা’ এ হলো সেই বস্তু যা কুরআনে হারাম করা হয়েছে।
আমি আগেই বলেছি যে, আপনার গ্রন্থে এবং অন্যান্য গ্রন্থে ‘রিবার’ যে দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে, তার থেকে একথা প্রমাণিত হয় না যে, আরববাসী ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণ করতো এবং আরবে যদি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের প্রচলন না থেকে থাকে, তাহলে আপনার নিজের যুক্তি অনুযায়ী তা ‘রিবার’ পর্যায়ে পড়ে না। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমার যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে মেহেরবানী করে আমাকে অবহিত করবেন। ওলামায়ে কেরামও স্বীকার করেছেন যে, ‘রিবা’ সেই বাড়তি প্রাপ্যকে বলা হতো, যা তখনকার দিনে আরবে প্রচলিত ছিল এবং ‘রিবা’ নামে অভিহিত করা হতো।
এখন কথা হলো এই যে, আরব জাহেলিয়াতের যুগে সত্যিকারভাবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদ মোটেই প্রচলন ছিল কিনা। এ বিষয়ে আপনি বলেছেন যে, একথা বিশদভাবে কোনো বই-কেতাবে লিখা নেই। তাই আমি আরজ করেছিলাম এমন এক সাংঘাতিক বিষয়ে, যার জন্যে আল্লাহ তায়ালা কঠোর শাস্তির বিধান করে রেখেছেন, কোনো কিয়াস অনুমানের ভিত্তিতে কাজ করা ঠিক হবে না। বরঞ্চ যথাসম্ভব প্রকৃত ব্যাপার জানতে হবে। আমি আরও আরজ করেছিলাম এ এক ঐতিহাসিক সত্য যে, পঞ্চম এবং দশম শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের প্রচলন ছিল না। এ বিষয়ে আমি বিভিন্ন গ্রন্থের উল্লেখ করতে পারি। উপরন্তু যেসব বই-পুস্তক আমার দেখা সম্ভব হয়েছে, তার থেকে জানতে পেরেছি যে, ঐ সময়ে আরবে ব্যক্তিগত মূলধনে অথবা কার্যকরী অংশীদার হিসেবে ব্যবসা করা হতো। ব্যবসা সম্পর্কে যতই আলোচনা আমার নজরে পড়েছে, তাতে কোথাও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের উল্লেখ নেই। আমি আশা করেছিলাম যে, আপনি আপনার গভীর জ্ঞান ও ব্যাপক অধ্যয়নের দ্বারা আমাকে এমন কোনো গ্রন্থের সন্ধান দেবেন, যার থেকে এ বিষয়ে আমি পূর্বে বলেছি, গ্রন্থকারগণ নবীর যমানার অবস্থা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কোথাও একথার উল্লেখ নেই যে, লোকেরা ঋণ করে ব্যবসা করতো। কুরাইশগণ ছিল ব্যবসায়ী। হযরত আব্বাস (রা.) সুদের উপর টাকা ঋণ দেবেন। কিন্তু কাকে? খেজুর উৎপন্নকারীদেরকে। ব্যবসায়ীদের কোনো শ্রেণী সুদের উপর কাউকে ঋণ দিয়ে থাকলে, তা দিয়েছেন কৃষিজীবীকে। এর থেকে কি এ ধারণা করা যায় না যে, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সুদ তখন বিদ্যমান ছিল না।
আপনি প্রশ্ন করেছেন যে, ঋণের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে কোন্ কোনটিকে সুদ নিষিদ্ধকরনের হুকুম থেকে বাদ দেয়া যাবে এবং কোন্ কোনটিকে শামিল করা যাবে। যে যে ধরনের সুদ জাহেলিয়াতের যুগে প্রচলিত ছিল, তা সবই হারাম হবে। যতদুর আমি বুঝতে পেরেছি, সে সময় মানুষ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এবং নিরুপায় হয়ে ঋণ করতো। মহাজনগণ এরুপ ঋণ গ্রহণকারীদেরকে সর্বস্বান্ত করতো এবং তাদেরকে রক্ষা করা প্রয়োজন ছিল বলে ‘রিবা’ হারাম করা হয়েছে। এ ধরনের সুদের যতই কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হোক, তা হবে ন্যায়সংগত এবং সুদখোরদের কঠোর শাস্তি দেয়া হলে তাও হবে যথার্থ। পক্ষান্তরে যেসব ঋণগ্রহণকারী তাদের গৃহীত ঋণ লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করে তাদের ঋণের উপর সুদ জায়েয হওয়া উচিত। এ ধরনের সুদদাতা ও গ্রহীতা উভয়েই লাভবান হয়। আপনি দেখতে পাবেন যে, অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী অংশীদার হিসেবে ব্যবসা করার চেয়ে, ঋণ করে ব্যবসা করা লোকে পসন্দ করে। আমি বুঝতে পারি না যে, ওলামায়ে কেরাম এ ধরনের সুদকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো কঠোর শাস্তিমূলক অপরাধ বলেন কেন? ইসলামী ফিকাহ অনুযায়ি অপরাধ এবং তার শাস্তির মধ্যে কি সামঞ্জস্য থাকা উচিত নয়? এ ধরনের সুদের বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হয়, তাহলো এই যে, এর দ্বারা এমন এক শ্রেণীর লোক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যারা উপার্জন করে বিনা পরিশ্রমে। একথা তো তাদের বিরুদ্ধেও বলা যেতে পারে যারা বড় বড় জমিদারী ও গাড়ী-বাড়ীর মালিক। তারা বিনা পরিশ্রমে শুধু জীবীকা নির্বাহই করে না, বরঞ্চ বিলাসিতাপূর্ণ জীবন যাপন করে। ইসলাম যদি এ ধরনের অমিতচারী ভোগবিলাসীদেরকে প্রশ্রয় দেয়, তাহলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদগ্রহনকারী কেনই বা শাস্তির যোগ্য হবে?
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের বিরুদ্ধে আরও বলা হয় যে, সুদে ঋণগ্রহীতা তার কারবারে যতই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন, ঋণদাতা লাভবানই হবে, একথা বহুলাংশে সত্য। কিন্তু একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ব্যবসার জন্যে সুদে টাকা এজন্য নেয়া হয় যে, ঋণগ্রহীতা এ সুদের হার থেকে কয়েকগুণ বেশী মুনাফার আশা করে এবং অধিকাংশ সময়ে তা পূর্ণ হয়। নতুবা বানিজ্যিক ঋনের এতোটা প্রসার হতো না। এ ধরনের ঋণদাতা বছরে অল্প পরিমান কিছু পেয়ে থাকে এবং তার বিনিময়ে ঋণগ্রহীতা তার চেয়ে কয়েকগুন বেশী মুনাফা করে। অবশ্যি কখনো কখনো তার লোকসানও হয়। এ ধরনের ঝুঁকি (RISK) নিয়ে কাজ করাতো ব্যবসা-বাণিজ্যের সাধারণ নীতি। এ এমন কিছু নয় এবং এমন কোনো অমংগলও আনয়ন করে না যার জন্যে ‘রিবার’ মতো অপরাধের শাস্তি আরোপিত হতে পারে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানমতে সুদের লাভজনক ও অলাভজনক বিষয়ের মধ্যে তারতম্য হওয়া উচিত এবং প্রথমটি জায়েয ও দ্বিতীয়টি নাজায়েয হওয়া উচিত।
আপনি একথাও বলেছেন, “সে যুগের লোকের দৃষ্টিতে ঋণ বলতে প্রত্যেক প্রকারের ঋণই ছিল। তা সে ঋণ অভাবগ্রস্থ করুক অথবা অবস্থাপন্ন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নেয়া হোক অথবা ব্যবসার জন্যে।” এর জন্যে কি কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থের নাম উল্লেখ করতে পারেন? বিগত কয়েক শতাব্দী থেকে বাণিজ্যিক সুদের প্রচলন দুনিয়ায় হয়েছে এবং লোক এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই তাদের জন্যে মুশকিল হয়ে পড়েছে। এ ধারণা পোষণ করার যে এমন এক সময় ছিল যখন বাণিজ্যিক সুদ ছিল না। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ব্যবসা সংক্রান্ত সুদের লেনদেন অন্তত পাশ্চাত্য দেশগুলোতে নবীর আগমনের সময় প্রচলিত ছিল না। -(এর জবাব পরিশিষ্ট : দুই দ্র:)
আমি আপনাকে আরও একটু বিরক্ত করতে চাই। তার তিনটি কারণ। এক হচ্ছে এই যে, লাখো লাখো মুসলমান বানিজ্যিক সুদের লেনদেন করছে। কারণ এ প্রতিযোগিতার যুগে ব্যবসা ক্ষেত্রে যদি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রাখতে হয়, তাহলে তাদের জন্যে এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমি জানি যে, আপনি একথা স্বীকার করেন না। আপনি এর বিকল্প পন্থার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু আমি সবিনয়ে নিবেদন করব যে, আমাদের বর্তমানকালের মানসিক ও নৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তা কার্যকর করা যাবে না। যে নৈতিক মান আমরা আমাদের স্বধর্মীদের কাছে আশা করি তার জন্যে প্রয়োজন একজন নবীর। কিন্তু ইসলামে আর কোনো নবী আগমনের সম্ভাবনা নেই। তাই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান মতে আলেম সমাজের উচিত ধর্মের তামাদ্দুনিক ও সামাজিক ব্যাপারে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কঠোরতা না করা এবং আল্লাহ তায়ালার একথা……………আরবী লেখা………… স্মরণ করা। উপরন্তু এ এক সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি যে, যে জিনিস আইনত নিষিদ্ধ তার অমংগল মংগল থেকে অধিক। যেমন আল্লাহ তায়ালা শরাব ও জুয়ার ব্যাপারে এরশাদ করেছেন ………….আরবী লেখা……………. বাণিজ্যিক সুদ কতিপয় লোকের জন্যে কোনো কোনো সময়ে ক্ষতিকারক হয়। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, অধিকাংশ সময় তা লাভজনক হয় এবং তার লাভ ক্ষতি থেকে অনেক বেশী হয়। তাই এটা নিষিদ্ধ না হওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত, আজকাল সামরিক প্রয়োজনে এত পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় যে, যুদ্ধের সময় ঋণ করা ব্যতীত উপায় থাকে না। এ সত্য অস্বীকার করা যায় না।
তৃতীয় কারণটি আমার ব্যক্তিগত। আমি সরকারী চাকুরী করা কালে জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ডে স্বেচ্ছায় আমার বেতন থেকে টাকা কেটে রাখতাম। তার থেকে একটা মোটা অংকের সুদ আমার নামে জমা হয়েছে যা আমি আলাদা করে রেখেছি। আমি জানতে চাই এ সুদ জায়েয, না জায়েয। এ বিষয়ে আপনি আমাকে দয়া করে জানাবেন। যদি নাজায়েয হয় তাহলে এ টাকা কোন্ কাজে ব্যয় করবো? অভাবগ্রস্থদের অভাব মোচনে তা ব্যয় করা যাবে কি? আমার এ টাকাটা হালাল কি হারাম তা জানার জন্যে অশেষ চেষ্টার ফলে বহু বই-পুস্তকও পড়েছি। কিন্তু কয়েকটি বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। সমাধানের জন্যে তা আপনার কাছে পেশ করার সাহস করছি। এ ব্যাপারে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে মাফ চাইছি। মনের দিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই। কিন্তু এ পত্রের জবাবের পর আপনাকে আর বিরক্ত করব না।
জবাব
আমি আগেও বলেছি এবং এখনো বলছি যে ঋণ দেবার পর আসলের উপরে যে বাড়তি বা অতিরিক্ত গ্রহণকে আরবে ‘রিবা’ বলা হতো, কুরআন তাকেই হারাম করেছে। কিন্তু একে আপনি যে অর্থে নিচ্ছেন তা হচ্ছে এই যে, ঋন দেয়ার যে প্রকার পদ্ধতি সে সময়ে আরবে প্রচলিত ছিল, কুরআন শুধুমাত্র তার মধ্যেই আসল থেকে অতিরিক্ত নেয়া হারাম করেছে। অথচ সকল ফকীহগণের সাথে একমত হয়ে আমি ঋণদানের প্রকার পদ্ধতির নয়, বরঞ্চ অতিরিক্ত গ্রহনের প্রকার পদ্ধতি থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছি।
এটাকে একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে সুস্পস্ট করতে চাই। কুরআন নাযিলের সময় আরবে পরিভাষা হিসেবে ‘খমর’ (***) শব্দটি আঙুর থেকে নিঃসৃত শরাবের জন্যে ব্যবহৃত হতো। সে সময় অন্য পন্থায় যেসব শরাব তৈরি হতো তাকেও পরোক্ষভাবে এ শব্দ দ্বারা বুঝানো হতো। যা হোক, যখন কুরআনে তার হারাম হবার নির্দেশ এলো, তখন কেউ তার এ অর্থ গ্রহণ করেনি যে, এ হারামের নির্দেশ শুধুমাত্র ঐ ধরনের শরাবের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, যা তখন আরবে প্রচলিত ছিল। বরঞ্চ এ অর্থই গ্রহন করা হতো যে, এসব বস্তুর মধ্যে যে গুণটি ছিল সকলের মধ্যে সাধারণ (COMMON) অর্থাৎ মাদকতার গুণ, হারাম করার নির্দেশটি ছিল তারই উপর প্রযোজ্য। আর এ গুণটি (মাদকতা) যে ধরনের পানীয় অথবা খাদ্যের মধ্যে পাওয়া যাবে, তা হারামের আওতায় পড়বে।
অনুরূপভাবে আরবে ঋণেরও কয়েকটি প্রকার পদ্ধতি ছিল। এ সবের মধ্যে যে বিষয়টি ছিল সাধারণ (COMMON) তাহলো এই যে, লেনদেনের শর্তে একথার উল্লেখ থাকা যে, আসলের উপর অতিরিক্ত কিছু আদায় যোগ্য হবে। আরববাসী একেই বলত ‘রিবা’। কুরআনে যখন ‘রিবা’ হারাম হবার হুকুম এলো, তখন কেউ তার এ অর্থ গ্রহণ করেনি যে, এ হুকুম শুধুমাত্র ঐ ধরনের ঋণ সম্পর্কে, যা তখন আরবে প্রচলিত ছিল। বরঞ্চ প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সকল ফকীহগণ এ অর্থই গ্রহণ করেছেন যে, আসলে অতিরিক্ত যা দাবী করা হবে তাই হারাম—ঋণের ধরন বা প্রকার পদ্ধতি যাই হোক না কেন। এ দিকেই কুরআন ইংগিত করেছে:
(************************)
“যদি তোমরা তওবা কর, তাহলে তোমাদের আসল মাল ফিরে পাবার হকদার হবে।” – (সূরা আল বাকারাঃ ২৭৯)
এর থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, আসলের উপরে অতিরিক্ত নেয়াটাই ‘রিবা’। আর এটাকে কুরআন হারাম করেছে। যদি ঋণের কোনো প্রকার
পদ্ধতিতে অতিরিক্ত গ্রহণকে হারাম করার উদ্দেশ্য থাকতো, তাহলে কোনো না কোনো প্রকারে সে উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেয়া হতো। যেমন, একথা বলা হতো, অভাবগ্রস্তদেরকে ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত নিও না।
আপনি অভাবগস্তের উল্লেখ কুরআনে কোথাও পাচ্ছেন না, তা আমদানী করছেন বাহির থেকে এবং এ শর্ত বাড়াবার জন্যে যে যুক্তি পেশ করেছেন তাতে সাংঘাতিক নীতিগত ত্রুটি এই হচ্ছে যে, শুধু সুদই নয়, কুরআনের যাবতীয় নির্দেশাবলী ঐসব অবস্থা ও লেনদেনের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা তখন আরবে প্রচলিত ছিল। উপরন্তু এ যুক্তির দ্বারা আপনি একটা বিরাট ঝুঁকিও (RISK) টেনে আনছেন। আপনি এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পেশ করতে পারছেন না যে, ঐ সময়ে লোকে ঋণ করে ব্যবসা করতো না। আর একথারও কোনো প্রমাণ নেই যে, ব্যবসা করা কালীন কোনো ব্যবসায়ী অন্য কোনো ব্যবসায়ী অথবা সুদী মহাজনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতো না। এ দুটো ধারণা আপনার সৃষ্টি হয়েছে মধ্যযুগীয় ইউরোপ সম্পর্কে সাধারণ ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে। তা হচ্ছে এই যে, সে সময়ে ব্যবসা চলতো ব্যক্তিগত পুঁজি দিয়ে অথবা কার্যকরী অংশীদার হিসেবে। বানিজ্যিক সুদের প্রচলন অনেক পরে হয়েছে। এ ধরনের ঐতিহাসিক বর্ণনা যার দ্বারা একটা সাধারণ অবস্থার চিত্র পেশ করা হয়েছে—একথা প্রমাণ করা যায়না যে, ঐ সময়ে আর কোনো পন্থার প্রচলন মোটেও ছিল না।
আমি পূর্বে বলেছি যে, লোক প্রত্যেক ধরনের ঋণকে ঋণই বলতো, তা সে ঋণ অভাবগ্রস্ত নিক অথবা অবস্থাপন্ন, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অথবা ব্যবসার জন্যে। এ হচ্ছে আমার ধারণা এবং এর বুনিয়াদ হচ্ছে এই যে, আমার দৃষ্টিতে অতীতের কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনায় ঋণের প্রকারভেদ বর্ণনা করা হয়নি, ঋণগ্রহণকারীর অবস্থা ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, মানুষ সকল যুগেই বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ঋণগ্রহণ করে থাকতো। আর ঋণগ্রহণ শুধু অভাবীদের মধ্যেই সীমিত থাকতো না।
এখানে এ আলোচনা নিস্প্রয়োজন যে, মুনাফা এবং স্বার্থের জন্যে ঋণে সুদ গ্রহণ কেন হারাম হওয়া উচিত। এ বিষয় পূর্বে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে।
আমার মতে প্রভিডেণ্ট ফাণ্ডের উপরে সুদের যে অংক আপনার জমা হয়েছে, তা আপনি নিজের জন্য ব্যয় করবেন না। এর হারাম হওয়া সম্পর্কে যদি নিশ্চিত নাও হন, তবুও এ-তো সন্দেহযুক্ত বটেই। যার পবিত্র হবার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আপনার মতো একজন ভাল মানুষের তার থেকে লাভবান হওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে আপনি যখন এ টাকার মুখাপেক্ষী নন। বরঞ্চ উত্তম কাজ এই হবে যে, এর দ্বারা আপনি একটি তহবিল গঠন করে
বিনা সুদে অভাবগ্রস্তদেরকে ঋণ দেবেন। আমার মনে হয়, অন্যান্য লোকের মধ্যে যাদের এ ধরনের সুদী অংক জমা হয়েছে, ভবিষ্যতে হবে, তারাও সন্তুষ্টচিত্তে আপনার এ তহবিলে তাদের উপরোক্ত টাকা জমা দেবে। এভাবে উপরোক্ত উদ্দেশ্যে একটা মোটা রকমের পুঁজি জমা হবে।–(তর্জুমানুল কুরআন, শাবান-রমজান : ১৩৭৬ হিঃ জুনঃ ১৮৫৭)
চতুর্থ পত্র
প্রশ্ন: জুন সংখ্যার তর্জু্মানুল কুরআনে বাণিজ্যিক সুদ সম্পর্কে আমার এবং আপনার উত্তরের নকল ছাপিয়েছে। আপনাকে আর বিরক্ত করবো না বলে ওয়াদা করা সত্ত্বেও আর একটু বিশদ ব্যাখ্যার জন্যে অনুরোধ করছি।
এক: আপনি লিখেছেন এভাবে আরবে ঋণের লেনদেনের বিভিন্ন পন্থা প্রচলিত ছিল। এসবের মধ্যে এ ছিল একটি সাধারণ বস্তু যে, লেনদেনের বিবরণীতে আসলের উপরে অতিরিক্ত দেয় একটি অংক শামিল থাকতো। আর এটাকেই আরববাসী ‘রিবা’ নামে অভিহিত করতো। এর থেকে একথা প্রকাশ পায় যে, আপনি প্রচলিত প্রকার ঋণ থেকে অতিরিক্ত গ্রহণেয় প্রকার নির্ধারিত করেছেন এবং আমার চেষ্টাও তাই ছিল। এর জন্যে প্রয়োজন আরব জাহেলিয়াতের যুগে প্রচলিত ঋণের সকল প্রকার একত্র করা এবং দেখা যে, এদের সকলের মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ বস্তু কোনটি। আপনার নিকটে সে বস্তুটি লেনদেনের বিবরণীতে আসলের উপরে অতিরিক্ত কিছু আদায়ের শর্ত শামিল থাকা। আমার নিবেদন এই যে, আর একটি বস্তু ছিল সাধারণ (COMMON) এবং তা হচ্ছে ঋণগ্রহীতার অভাব-অনটনের জন্যে তার উপর নাজায়েয শর্ত আরোপ করা অথবা অন্য কথায় তার উপর অন্যায়-অত্যাচারের সম্ভাবনা, ঋণের যত প্রকার দৃষ্টান্ত আপনি আপনার ‘সুদ’ গ্রন্থে পেশ করেছেন তার সবগুলোর মধ্যে এ সম্ভাবনা বিদ্যমান। অতএব সবের মধ্যে বিদ্যমান এই সাধারণ বিষয়টি (অন্যায়-অত্যাচার) ‘রিবার’ সংজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। নতুবা ‘রিবা’ শব্দের সংজ্ঞা পূর্ণ হয়না। এ জবরদস্তিমূলক অত্যাচারের সম্ভাবনা সকল অলাভজনক (NON-PRODUCTIVE) ও ভোগ্য (CONSUMPTION) ঋণের বৈশিষ্ট্য এবং সম্ভবত সুদ হারাম হবার এটাই কারণ। কিন্তু যদি একথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সেই যুগে আরববাসী লাভজনক কাজেও সুদে টাকা ঋণ করতো তাহলে আমার ধারণা হবে ভুল। যেহেতু আরব জাহেলিয়াতের যুগে এ ধরনের ঋণ প্রথার অনুসন্ধান করে ও ব্যর্থ হয়েছি। সে জন্য আমি আপনাকে বিরক্ত করছি এবং আশা করি আপনাদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আমাকে জানাবেন, সে যুগে লাভজনক ঋণগ্রহনের প্রথা প্রচলিত ছিল কিনা। আপনি যত প্রকার ঋণ গ্রহনের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন তার মধ্যে একটি মাত্র এমন যা ব্যবসার সাথে কিছুটা সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ কাতাদার সেই বর্ণনা যাতে বলা হয়েছেঃ “কোনো ব্যক্তি কারো কাছে কোনো জিনিস বিক্রি করলো এবং মূল্য পরিশোধ করার জন্যে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে অবকাশ দিল। সময় উত্তীর্ণ হলো কিন্তু ক্রেতা মুল্য পরিশোধ করলো না। তখন বিক্রেতা পুনরায় কিছু সময় পর্যন্ত অবকাশ দিল এবং মুল্য বাড়িয়ে দিল।”
চিন্তা করে দেখুন এ অতিরিক্ত মুল্য কখন চাপানো হতো। যখন সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে অক্ষম হতো এবং ঋণদাতা ইচ্ছামতো শর্ত ঋণগ্রহীতার দ্বারা স্বীকার করিয়ে নিতে পারতো। অর্থাৎ এতে জবরদস্তি ও যুলুম অত্যাচারের সম্ভাবনা থাকতো।১ [১. একথা নিঃসন্দেহে ভুল। পাইকারী ব্যবসায় এ কোনো অসাধারণ ব্যপার নয় যে, একজন পাইকারী বিক্রেতা কোন খুচরা বিক্রেতা পুরাতন গ্রাহককে কিছু মাল বাকি দিল এবং মুল্য পরিশোধের জন্যে বিনা সুদে দু এক মাসের অবকাশ দিল। এ সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করতে অপারগ হলে সুদের উপর আরও কিছু কালের অবকাশ দেয়। এ অবস্থায় সময়মতো মূল্য পরিশোধ না করলে খুচরা বিক্রেতা অনিবার্যরূপে অনাহারে থাকে না যে, তার উপর সুদ আরোপ করলে বিশেষ ধরনের যুলুম হয়, যা শাহ সাহেব মনে করেন।]
দুইঃ আপনি শরাবের (***) দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন যে, তার নিষিদ্ধকরণ আদেশের কেউ এর অর্থ গ্রহণ করেনি যে, সে সময়ে আরবে যে ধরনের শরাব প্রচলিত ছিল শুধু তাই হারাম করা হয়েছে। বরঞ্চ সকলে এটাই বুঝতো যে, এ সবের মধ্যে যে বস্তু বা গুণটি সাধারণ অর্থাৎ মাদকতার গুণ, তাই আসলে হারাম। আমার কথা এই যে, এরূপ রিবার ক্ষতিকারক হবার গুণটি সকলের মধ্যে সাধারণ মনে করতে হবে এবং তাই হবে হারাম। এখন সুদের যেসব প্রকার ক্ষতিকারক নয়, তা রিবার মধ্যে শামিল্ করা ঠিক হবে না।
তিনঃ সূরা আল বাকারার আয়াতঃ (**************) থেকে আপনি যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, আসলের উপর অতিরিক্ত গ্রহণ করছি ‘রিবা’। কারণ ঋণের কিছু শ্রেণী বিশেষে যদি এ অতিরিক্ত গ্রহণ হারাম করা উদ্দেশ্য হতো, তাহলে আকার-ইংগিতে তা বলে দেয়া হতো। যেমন বলা হতো, ‘অভাবগ্রস্তকে ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত কিছু নিওনা।’ এ আয়াতকে যদি তার পূর্ব থেকে পড়েন তাহলে গোটা নির্দেশ হচ্ছেঃ
(***************)
“যারা ঈমান এনেছো তারা জেনে রেখে দাওঃ তোমরা ভয় কর আল্লাহকে এবং সুদের যা কিছু অবশিষ্ট আছে (আদায় করার) তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা সত্যি-সত্যি ঈমান এনে থাক। যদি তোমরা তা না কর, অর্থাৎ সুদের বকেয়া ছেড়ে না দাও, তাহলে তৈরী থাক, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। এখনো যদি তওবা কর (এবং সুদ ছেড়ে দাও) তাহলে আসল ফেরত পাবার হকদার হবে। যুলুম তোমরা করো না, তাহলে তোমাদের উপর ও যুলুম করা হবেনা।” -(সূরা আল বাকারাঃ ২৭৮-২৭৯)
এ নির্দেশাবলী ঐ অতিরিক্তটুকু ছেড়ে দেয়ার জন্যে, যা সে সময়ে ঋণ-দাতাগণ খাতকের কাছে পাওনা ছিল। এ জন্য তার সম্পর্ক অনিবার্যভাবে সেই ধরনের ঋণের সাথেই ছিল।
চারঃ আপনি ঠিকই বলেছেন যে, আপনার নিকটে এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই যে, সে সময়ে এমন কোনো ব্যক্তি ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতো। অথবা ব্যবসাকালীন কোনো ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায়ীর কাছে কিংবা কোনো সুদী মহাজনের কাছে ঋণ যে করতো না তারও কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু আমি আমার পূর্বের পত্রগুলোতে যেসব সুত্রের উল্লেখ করেছি তার থেকে স্পষ্টই এ ধারণা জন্মে যে, যে সময়ে এ ধরনের ঋণের প্রচলন ছিল না। আমার দৃষ্টিভংগী এই যে, সুদগ্রহণকারীর জন্যে যেরূপ কঠোর শাস্তি নির্ধারিত করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত গ্রহণের কোনো প্রকারকে ‘রিবার’ মধ্যে শামিল করা উচিত হবে না, যতক্ষণ না এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, নবী করীম (স)-এর যমানায় তা ‘রিবার’ মধ্যে শামিল ছিল। পক্ষান্তরে আপনার দৃষ্টিভংগী মনে হয় এই যে, ধারণার ভিত্তিতে একে ‘রিবার’ মধ্যে গণ্য মনে করা উচিত। আর যতক্ষন পর্যন্ত না একথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এ ধরনের অতিরিক্ত গ্রহণের প্রচলন তখন ছিল না, ততক্ষণ তাকে ‘রিবার’ বহির্ভূত মনে করা চলবে না। সতর্কতা ও ধর্মভীরুতার জন্যে আপনি এ দৃষ্টিভংগী পোষণ করেন। কিন্তু আমার ভয় হয়, আপনার এ সতর্কতা পার্থিব ক্ষতির পরেও পারলৌকিক ক্ষতির কারণ না হয়। বর্তমান দুনিয়ায় বানিজ্যিক সুদ ব্যতীত চলবার উপায় নেই। যে জাতি এর থেকে দূরে সরে থাকবে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সে জাতি অন্যান্য জাতির তুলনায় হীন দুর্বল হয়ে পড়বে। আর এ ধরনের হীনতার প্রভাব যে তার আজাদীর উপরও পড়তে পারে তা আপনার অজানা থাকার কথা নয়। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয় এটা চান না যে, মুসলমান পদানত হয়ে থাক। সূরা আল মায়েদার (**************) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আপনি আপনার তাফহীমুল কুরআনে বলেছেনঃ ”এ আয়াতে দুটো বিষয়ে এরশাদ করা হয়েছে। এক ইচ্ছে এই যে, তোমরা স্বয়ং হালাল-হারাম নির্ধারণের মালিক-মোক্তার হয়ে যেয়ো না। হালাল ঐ বস্তু যা আল্লাহ হালাল করেছেন এবং হারাম উহাই যা তিনি হারারম করেছেন।” উপরন্তু আপনি ১০৪নং টীকায় বলেছেন যে, রসূলে করীম (স) প্রত্যেক মুসলমানকে তার নিজের উপরে কঠোরতা আরোপ করতে নিষেধ করেছেন। এজন্য এটা কি সংগত হবে না যে, যতক্ষন না প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বাণিজ্যিক সুদও (PRODUCTIVE INTEREST) ’রিবার’ মধ্যে শামিল, তা শুধু ধারণার বশীভূত হয়ে হারাম বলে গণ্য করা চলবে না?
পাঁচঃ প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে যে সুদের টাকা আমি পেয়েছিলাম, অল্পদিন পরেই তা আমার এক বন্ধু ঋণ হিসেবে নিয়েছেন এবং এখনো ফেরত দেননি। ফেরত পাবার পর তা ইনশাআল্লাহ আপনার পরামর্শ অনুযায়ী নিজের জন্যে ব্যয় করবো না।
ছয়ঃ একটি অপ্রাসংগিক কথা আপনাকে বলতে চাই। আল্লাহ তায়ালা মদ ও জুয়া সম্পর্কে এরশাদ করেছেনঃ ( আরবী টেক্স্ট)-এর অর্থ আপনি করেছেন ”তার ক্ষতি লাভ থেকে অনেক বেশী।” অভিধান গ্রন্থগুলোতে (*************) শব্দের অর্থ ’ক্ষতি’ কোথাও দেখতে পাইনি। আমার অনুরোধ আপনার এ অর্থের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ গ্রন্থের উল্লেখ করলে কৃতার্থ হবো।
জবাব
আপনি যে বিষয়গুলোর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সে সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে আমি বলতে চাই যে, আপনি আর একবার নতুন করে আসল প্রশ্নটি বুঝবার চেষ্টা করুন। আসল প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, কুরআন যে ’রিবা’ হারাম করেছে, তার তাৎপর্য কি অথবা অন্য কথায় বলতে গেলে তার হারাম হবার কারণ কি। তা কি এই যে, একজন তার আসলের উপরে অতিরিক্ত করে অথবা তা কি এই যে, সে অপরের অভাব-অনটনের সুযোগে অবৈধভাবে লাভবান হয়? আমি প্রথমটিকে ’রিবার’ তাৎপর্য ও হারাম হবার কারণ মনে করি। তার প্রমাণ সংক্ষেপে এইঃ
একঃ কুরআন যে বস্তুকে হারাম ঘোষণা করেছে, তার জন্য যে পরিপূর্ণ শব্দ ’ আর রিবা’ (************) ব্যবহার করছে। আরবী অভিধান অনুযায়ী তার অর্থ শুধু আধিক্য। অভাবগ্রস্তের নিকট থেকে অধিক নেয়া এ শব্দের অর্থের অন্তুর্ভুক্ত নয়। অভাবহীন সচ্ছল ব্যক্তিকে ঋণ দিয়ে অথবা কোনো লাভজনক উদ্দেশ্যে ঋণ দিয়ে অধিক ফেরত নিলেও আভিধানিক দিক দিয়ে এ আধিক্যের উপর ’আর রিবা’ (*******) শব্দটি প্রযোজ্য হবে।
দুইঃ কুরআন স্বয়ং ’রিবার’ শব্দকে এমন কোনো বাগধারা সংজ্ঞার দ্বারা সীমিত করে না। যার থেকে বুঝা যায় যে, সে ঐ ’রিবাকে’ হারাম করতে চায়, যা কোনো অভাকগ্রস্তকে ঋণ দিয়ে আদায় করা হয় এবং ঐ ’রিবাকে’ হারামের আওতার বাইরে রাখতে চায়, যা অভাবহীন লোককে অথবা লাভজনক কাজে ঋণ দিয়ে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে আদায় করা হয়।
তিনঃ আরববাসী ঋণের উপর মুনাফা এবং ব্যবসার মুনাফাকে সমান মনে করতো। তারা বলতো (*******) ’ব্যবসাতো সুদের মতোই’। কুরআন উভয় প্রকার মুনাফার পার্থক্য নির্ণয় করে পরিস্কার করে দিয়েছে যে, ব্যবসার মুনাফা হালাল এবং ঋণের মুনাফা হারাম। এর থেকে একথা পরিস্কার হয়ে গেল যে, মুনাফা লাভের জন্যে ব্যবসা ও ব্যবসার অংশীদার হওয়ার পথ উন্মুক্ত আছে। কিন্তু ঋণের আকারে টাকা খাটিয়ে মুনাফা করার পথ বন্ধ।
চারঃ কুরআন (**********) (তোমাদেও আসলটুকু ফেরত পাবার অধিকার আছে) বলে, একথাও পরিস্কার করে দিয়েছে যে, ঋণদাতা শুধু অতটুকু পাবার হকদার, যতটুকু সে দিয়েছে। তার অতিরিক্ত নেয়ার হকদার সে নয়। এখানে এ ব্যাপারেও কোন ইংগিত নেই যে, যাকে কোনো লাভজনক কাজে মাল বা টাকা দেয়া হবে, তার কাছ থেকে আসলের উপরে কিছু অতিরিক্ত নেয়ার অধিকার দাতার থাকবে।
পাঁচঃ অভিধান এবং কুরআনের পর প্রমাণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো সুন্নাহ, যার থেকে আল্লাহ তায়ালার হুকুমের অভিপ্রায় জানা যায়। এখানেও আমরা দেখছি যে, শুধু আধিক্যকে নিষিদ্ধকরণ আদেশের কারণ বলা হয়েছে। সে আধিক্য নয় যা আদায় করা হয় কোনো অভাবগ্রস্তকে ঋণ দিয়ে। হাদীসে পরিস্কার বলা হয়েছে (***********)
”যে সকল ঋণ মুনাফা আকর্ষণ তা সুদের কারণগুলোর মধ্যে একটি (বায়হাকি) এবং ************”প্রত্যেক ঋণ দ্বারা যে মুনাফা লাভ করা হয় তা রিবা বা সুদ (মুসনাদে হারিস বিন উসামা)।” ১ [১. কেউ কেউ এ হাদীসটির সত্যতার প্রতি সন্দেহ পোষণ করেন। তাদের যুক্তি এই যে, তার সনদ (রাবী পরস্পরা) দুর্বল। কিন্তু যে মূলনীতি এ হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, সকল ফকীহগণ সর্বসম্মতিক্রমে তা মেনে নিয়েছেন। বর্ণনার দিক দিয়ে তার সনদ দুর্বল হলেও এ সর্বস্বীকৃিত হাদীসের বিষয়বস্তুকে জোরদার করে দেয়।]
ছয়ঃ ঋণের উপরে গৃহীত সুদ হারাম করেই নবী (স) ক্ষান্ত হননি। বরঞ্চ নগদ আদান-প্রদান ব্যাপারেও একই প্রকার বস্তুও বিনিময়ে অতিরিক্ত গ্রহণ হারাম করেছেন। আর এ সত্য কথা যে, এতে অভাবগ্রস্ততার কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। এর থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে, নবী (স) আল্লাহ তায়ালার আদেশের যে অভিপ্রায় উপলব্ধি করেছিলেন তা নিশ্চিতরূপে এই ছিল যে, ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত গ্রহণকে তিনি হারাম করতে চান। উক্ত প্রবণতা বন্ধ করার জন্যে নবী (স) নগদ লেনদেনের মধ্যেও অতিরিক্ত গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছেন।
সাতঃ মুসলিম জাতির ফকীহগণ সর্বসম্মতিক্রমে এ আদেশের অভিপ্রায় এই বুঝেছিলেন যে, ঋণের ব্যাপাওে আসলের উপরে অতিরিক্ত যা কিছুই নেয়া হোক না কেন, তা হারাম। ঋণগ্রহণকারী তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের জন্যে সে ঋণগ্রহণ করুক অথবা কোনো লাভজনক কাজে তা বিনিয়োগ করুক তাতে কিছু আসে যায় না।
(***********)
”শরীয়তের পরিভাষায় ’রিবার (সুদ) অর্থ হচ্ছে উভয় পক্ষের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় ব্যতীত আসলের উপর অতিরিক্ত গ্রহণ।”-(নেহায়া, ইবনে কাছির)
এ সংজ্ঞা অনুযায়ী সকল ফকীহগন ঐ ধরনের মুনাফা গ্রহণকে হারাম বলে অভিহিত করেন, যা ঋণদাতা গ্রহীতার নিকট থেকে গ্রহণ করে।
এ কারণগুলোকে উপেক্ষা করে আপনি বলেছেন যে, শুধুমাত্র ঐসব ঋণের উপরে সুদ হারাম হবে যা কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি তার অভাব পূরণের জন্যে নিয়ে থাকে এবং লাভজনক কাজে খাটাবার জন্যে যে ঋণ নেয়া হয় তার উপর সুদ হারাম হবে না। যার উপর ভিত্তি করে আপনি এসব কথা বলছেন, তাহলো এই যে, আপনার মতে কুরআন নাযিল হবার সময় আরবে শুধু প্রথম প্রকারের ঋণেরই প্রচলন ছিল এবং দ্বিতীয় প্রকারের ঋণের প্রচলন দুনিয়ার অনেক পরে হয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি নি¤œলিখিত প্রশ্নগুলোর বিশদ ও সন্তোষজনক জবাব দিয়েছেন, ততক্ষন আপনার এ অভিমত মেনে নেয়া যেতে পারে না।
একঃ আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল ঋণসমূহের মধ্যে লাভজনক ও অলাভজনক ঋণের পার্থক্য নির্ণয় কওে সুস্পষ্টভাবে অথবা আকরে-ইংগিতেও কি সুদের অবৈধতা প্রথম প্রকারের মধ্যে সীমিত করেছেন এবং দ্বিতীয় প্রকারকে অবৈধতা বা হারামের বহির্ভূত করে রেখেছেন? যদি তা করে থাকেন, তাহলে তার প্রমাণ থাকতে হবে। কারণ হারামের নির্দেশ যিনি দিয়েছেন, হারাম বহির্ভুত করার অধিকারও তাঁর। তাঁর কোনোরূপ ইংগিত ব্যতিরেকে হালাল-হারামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কোনো অধিকার আমাদের অথবা আপনার নেই। এ ব্যাপারে আপনি সম্ভবত এ যুক্তিই দেখাবেন যে, যেহেতু সে সময়ে শুধুমাত্র অলাভজনক ঋণের উপরে সুদ গ্রহণ করার প্রচলন ছিল সে জন্যে আল্লাহ তায়ালার হারাম করার নির্দেশ তা সাথেই সম্পর্কিত বুঝতে হবে। কিন্তু যতক্ষন পর্যন্ত না একথা ধরে নেয়া যায় যে, মানবীয় ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জ্ঞান শুধু কুরআন নাযিলের সময়ে প্রচলিত ব্যাপার পর্যন্তই সীমিত ছিল এবং ভবিষ্যতে কি কি ঘটবে সে সম্পর্কে তাঁদের কোনো জ্ঞান ছিল না, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার এ যুক্তি চলতে পারে না। উপরন্তু বলতে হয় যে, ইসলাম শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়-কাল পর্যন্তই পথপ্রদর্শন করতে পারে। শাশ্বত পথপ্রদর্শক নয়। আপনার যুক্তির মূলে যদি এরূপ ধারণা করা না হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, লেনদেন ও কায়কারবারের সে সব প্রকার পদ্ধতিও আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত ছিল যা পরবর্তীকালে সংঘটিত হবে। আপনি যখন একথা মেনে নেবেন, তখন তার সাথে একথাও স্বীকার করে নিতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা যদি এই হতো যে, তিনি সুদের অবৈধতা শুধুমাত্র অলাজনক ঋণের উপরেই সীমাবদ্ধ রাখবেন। তাহলে তিনি কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয়ই তাঁর সে ইচ্ছা প্রকাশ করতেন এবং তাঁর রসূলও এ ইচ্ছাকে এতটা সুস্পষ্ট করে বলে দিতেন যে, সুদের অবৈধতার নির্দেশ সকল প্রকার ঋণের উপর প্রযোজ্য হতে পারতো না।
দুইঃ দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, আরবে শুধু যে অভাবগ্রস্ত লোকই ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করতো এবং কেউ ব্যবসার জন্যে অথবা কোনো লাভজনক কাজে খাটাবার জন্যে ঋণ নিত না এর কোনো প্রমাণ কি আপনার কাছে আছে? পৃথিবীতে লাভজনক কাজের জন্যে ঋণ করে পুঁজি সংগ্রহ করার রীতি অনেক পরে প্রচলিত হয়েছে–শুধু একথা এমন সিদ্ধান্ত করার জন্যে যথেষ্ট প্রমাণ নয় যে, প্রথমে কোনো ব্যক্তি ব্যবসা করার পূর্বে অথবা ব্যবসা চলাকালীন অবস্থায় কখনো ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করতো না। আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মীমাংসা করতে বসেছেন। আল্লাহ তায়ালার একটি নির্দেশ থেকে কোনো কিছুকে বহির্ভূত করে রাখা সহজ কাজ নয়। এর জন্যে আপনি যে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন তার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী যুক্তির প্রয়োজন। একথা প্রমাণ করার দায়িত্ব আমাদের নয় যে, আরবের লোক সে সময়ে ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণ করতো। বরঞ্চ একথা প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনার যে, সে সময়ে ব্যবসার জন্যে কেউ ঋণ গ্রহণ করতো না। এটা এজন্য যে, ব্যতিক্রমের দাবী আপনি করছেন। তার জন্যে আপনি আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের কোনো ইংগিত অথবা ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করছেন না। বরঞ্চ আপনার যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে এই যে, আরবে সে সময়ে ’রিবা’ বা সুদ শুধু অলাভজনক কাজের উদ্দেশ্যে গৃহীত ঋণের উপরেই প্রযোজ্য হতো।
এখন আমি আপনার উত্থাপিত বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছি। ’রিবা’র মর্ম নির্ধারণ করতে এবং তা হারাম করার কারণ অবগত হবার জন্যে আমরা শুধু সেসব কায়কারবারের প্রকার পদ্ধতির উপরেই নির্ভর করছি না যা তখন আরবে প্রচলিত ছিল। বরঞ্চ ভাষাতত্ত্ব, কুরআনের বর্ণনা, হাদীস, মুসলিম ফকীহগণের ব্যাখ্যা হচ্ছে তার প্রকৃত উৎস। উপরন্তু আর একটি জিনিস এ ব্যাপারে সাহায্য করে এবং তা হচ্ছে এই যে, সে সময় যেসব ব্যাপারে ’রিবা’ প্রযোজ্য হতো, তার মধ্যে সর্ব সাধারণের কল্যানে জন্যে কিছু আছে কিনা তা অবগত হওয়া যাক।
আপনি বলেছেন যে, তাদের মধ্যে সাধারণ বস্তু শুধু আসলের উপরে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করাই ছিল না, বরঞ্চ এই সাধারণ বস্তুটি ছিল এই যে, এ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হতো অভাবগ্রস্তদেরকে তাদের প্রয়োজনে ঋণদান করে। কিন্তু প্রথমত খোদার নির্দেশের কারণ নির্ধারণ করার জন্যে এটাকে নির্ভরযোগ্য বলে গ্রহণ করা যেতে পারে না যে, না কুরআন এর দিকে কোনো ইংগিত করেছে আর না সুন্নাতে এমন কোনো বস্তু পাওয়া যায়, যার উপর নির্ভর করে এরূপ ধরে নেয়া যেতে পারে যে, শুধু অভাবগ্রস্তদের নিকট থেকে অতিরিক্ত নেয়াটাই হারাম হবার কারণ। দ্বিতীয়ত আমরা স্বীকার করি না যে, সে সময়ে ঋণ গ্রহণের ব্যাপার শুধু ঐ ধরনেই সীমাবদ্ধ ছিল। আরবদের ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পর্কে আমাদের বিশদভাবে জানা নেই যে, ঋণের পুঁজিতে তখন ব্যবসা চলতো, না ব্যবসায়ে মোটেই ঋণের কোনো লেশমাত্র ছিল না। এজন্য কোনো বিবরণের উপর আমরা এবং আপনি আমাদের আলোচনার ভিত্তিস্থাপন করতে পারি না। কিন্তু এ এক সাধারণ জ্ঞানের কথা এবং দুনিয়ার সাধারণ ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তিই একথা অস্বীকার করতে পারে না যে, ব্যবসায় ঋণের পুঁজিকে ভিত্তিরূপে ব্যবহার করার প্রথা পরবর্তীকালে শুরু হলেও ব্যবসায়ীদের কারবার চলাকালে একে অপরের নিকট থেকে এবং মহাজনের নিকট থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন পূর্বেও হতো। তাছাড়া খুচড়া ব্যবসায়ী পাইকারী ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে বাকীতে মাল পূর্বেও নিতো। আরববাসীদের সম্পর্কে এধরনের কোনো লিখিত বিবরণ বিদ্যমান না থাকলেও, দুনিয়ার অন্যান্য দেশ সম্পর্কে এ ধরনের বিবরণ কুরআন নাযিলের শত শত, হাজার বছর পুর্বেরও পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এ দাবী করা যেতে পারে না যে, পুর্বের যুগে ব্যবসা সংক্রান্ত কারবার ঋণের উপাদান থেকে একেবারে মুক্ত থাকতো। ১[বিশদ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট দুই দ্রষ্টব্য]
আপনার ধারণা এই যে, সুদের ব্যাপারে ক্ষতিকর সাধারণ গুন শুধু অভাবগ্রস্থ লোককে তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের জন্য ঋণ দিয়ে তাদের কাছ থেকে উৎপীড়নমূলক হারে সুদ নির্ধারণ করা। কিন্তু আমাদের কাছে এই একটি মাত্র ক্ষতিকারক সাধারণ গুন এতে নেই। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শুধু টাকা ঋণ দিয়ে নিজেদের জন্য একটি নির্দিষ্ট লাভের নিশ্চয়তা লাভ করবে-এটাও একটি ক্ষতিকারক গুন। আর যে সকল লোক এ টাকার সাহায্য নিজের শ্রম, যোগ্যতা মস্তিষ্ক খাটিয়ে মুনাফা লাভের চেষ্টা করবে, তাদের জন্যে নির্দিষ্ট মুনাফা তো দূরের কথা, কোন মুনাফা লাভেরই নিশ্চয়তা থাকবে না। কুরআন মজীদ যে নিয়ম বলে দেয় তা হচ্ছে এই যে, ঋণ হিসেবে যদি তুমি কাউকে কিছু মাল দাও, তাহলে আসলের উপর অতিরক্ত কিছু নেয়ার অধিকার তোমার নেই, আর যদি ব্যবসায় মুনাফা লাভ করতে চাও, তাহলে সোজাসোজিভাবে স্বয়ং সরাসরি ব্যবসা কর, অথবা ব্যবসায় অংশীদার হয়ে যাও। কুরআনের এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ইসলামে অংশীদারিত্ব জায়েজ এবং সুদ নাজায়েজ করা হয়েছে।
(আরবী*******) (সুদের যার কিছু বাকি আছে তা ছেড়ে দাও) এর দ্বারা আপনি যে যুক্তি দিয়েছেন, তা ঠিক নয়। এ শুধু সে সময়ের জন্যে একটি সাময়িক নির্দেশ ছিল না। বরঞ্চ কুরআনের অন্যান্য নির্দেশাবলীর ন্যায় এ ছিল এক চিরন্তন বিধান। যখন এবং যেখানেই কোনো ব্যক্তি ঈমান আনবে, তার উপর এ বিধান প্রযোজ্য হবে। কারো কাছে তার প্রদত্ত ঋণের যদি সুদ পাওনা থাকে, তাহলে তার দাবি ছেড়ে দিতে হবে এবং নিজের দেয়া মূলধন ফেরত পাবার উপরই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। উপরন্তু এ আয়াতের দ্বারা আপনার যুক্তি প্রদর্শন আপনার এ দাবীর উপর প্রতিষ্ঠিত যে, সে সময়ের সকল প্রকারের ঋণ ব্যবসায় সংক্রান্ত সুদ থেকে মুক্ত ছিল। এ দাবী স্বয়ং প্রমাণ সাপেক্ষ। একে কি করে প্রমাণ রূপে উপস্থাপিত করা যেতে পারে? যে ধরণের ঋণের কথা আপনি বার বার উল্লেখ করেছেন, তা শুধু ব্যক্তিগত ধরণের ঋণই হতে পারতো। তার মধ্যে এ সম্ভাবনাও আছে যে, একজন ছোট ব্যবসায়ী কোনো বড় ব্যবসায়ীর নিকট থেকে ধারে মাল নিয়ে যেতো এবং বড় ব্যবসায়ী তার মালের আসল মুল্যের উপরে সুদও নির্ধারিত করে দিত। তারপর সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করতে না পারলে, সে (বড় ব্যবসায়ী) মাল গ্রহীতাকে অধিক অবকাশ দিয়ে সুদের মাত্রাও বাড়িয়ে দিতো। এ ধরনের সুদের বকেয়া (আরবী.*******) এর হুকুমের আওতায় পড়ে। আপনার কাছে এমন কি প্রমাণ আছে যে, ঐ বকেয়াগুলোর মধ্যে এ ধরণের বকেয়া শামিল ছিল না?
আমার মতে বাণিজ্যিক সুদের হুকুম ‘রিবা’র অধীনে আনা না আনার ভিত্তি যদি শুধু ধারণার উপরেই হয় (যদিও প্রকৃত তা নয়) তথাপি ধারণার উপরে ভিত্তি করে একটি সম্ভাব্য হারামকে হালাল করে দেয়া, তাকে হারাম বলে স্বীকার করে নিয়ে তার থেকে দূরে সরে থাকার চেয়ে অধিকতর বিপজ্জনক। হাদীসের নির্দেশ অতি সুস্পষ্ট যে, (আরবী*******)
-সুদ ছেড়ে দাও এবং সে বস্তুও ছেড়ে দাও, যার মধ্যে সুদ আছে বলে সন্দেহ হয়। এ কথা আমি শুধু আপনার ঐ কথার উত্তরে বলছি যে, বাণিজ্যিক সুদ হারাম করার ভিত্তি শুধু ধারণা মাত্র। নতুবা এই যে, অকাট্য হারাম এবং এর হারাম হবার ভিত্তি শুধুমাত্র যে ধারণা নয়, বরঞ্চ কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
আমি এ কথা জানতে পেরে আনন্দিত হয়েছি যে, আপনি নিজে আপনার প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদের ব্যাপারে আমার পরামর্শ মেনে নিয়েছেন। আশা করা যায় যে, অন্ততপক্ষে আপনি সন্দেহজনক মাল দ্বারা উপকৃত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন। খোদা করুন, আপনি অপরের জন্যে একে হালাল করার চিন্তা পরিত্যাগ করবেন এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে আপনার যে অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা লাভ হয়েছে, তাকে একটি সুদহীন অর্থনীতি গঠন করার জন্যে ব্যবহার করবেন।
আপনার শেষ প্রশ্নের জবাব এই যে, আমি (আরবী****) শব্দের অর্থ (আরবী******) (লাভ) শব্দের মুকাবিলায় গোনাহের পরিবর্তে ক্ষতি অর্থ করেছি। ভাষার দিক দিয়ে এটা ভুলও নয়। কারণ (আরবী****) শব্দের প্রকৃত অর্থ বাঞ্ছিত মঙ্গল লাভে অক্ষম হওয়া। এ অর্থের দিক দিয়ে আরববাসীগণ বলে থাকে (আরবী*******)-ঊটনি মন্থর গতি হয়েছে। যে দ্রুতগতি তাঁর থেকে আশা করা হয়েছিল তাতে সে অক্ষমতা দেখিয়েছে।-( তর্জুমানুল কুরআন-মহররম-সফর, ১৩৭৭ হিঃ অক্টোবর- নভেম্বর, ১৯৫৭ খৃঃ)
———–